জজ, ট্রেসিকে এখানে রাখা বোধহয় উচিত নয়।
খবরের কাগজ পড়তে পড়তে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন ওয়ার্ডেন। জানতে চাইলেন–কেন? সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?
মুখ ভার করে সু বললেন–আমার মনে হচ্ছে ট্রেসি বোধহয় অ্যামিকে পছন্দ করতে পারছে না। মনে হয় ও কোনো বাচ্চা ছেলেমেয়েকে পছন্দ করে না।
–অ্যামির সঙ্গে নিশ্চয় ও খারাপ ব্যবহার করেনি। তেমন ভাবে মারধোর করেছে। কি? বকাঝকা?
–না।
–তাহলে?
–কাল অ্যামি দৌড়ে ট্রেসির গলা জড়িয়ে ধরেছিল। ট্রেসি ওকে দুহাত দিয়ে ধরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। অ্যামি সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল। অ্যামি বোকা মেয়ে, ইতিমধ্যেই ট্রেসিকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছে। হয়তো এই কারণেই আমার ঈর্ষা হচ্ছে।
ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান স্ত্রী-র স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ওঃ এই কথা–তবে জেনে রাখো ট্রেসি এই কাজে সব থেকে উপযুক্ত। যদি সত্যি সত্যি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে আমাকে বলল, আমি সমাধানের একটা পন্থা বাতলে দেব।
সু এলেন তখনকার মতো চুপ করে গেলেন, কিন্তু স্বামীর এই উত্তরে তিনি যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তা তার আচরণ দেখেই বোঝা গেল।
.
ট্রেসি উৎসুক চিত্তে জানতে চাইল–ধোবীখানার কাপড়গুলো যে ঝুড়িতে যায় সেগুলি কি ভালোভাবে দেখা হয়?
লিটলচ্যাপ উত্তর দিল–না, তবে যখন ঝুড়িতে নোংরা কাপড় জামা রাখা হয় তখন একজন পাহারাদার সবকিছুর ওপর নজর রাখে।
ট্রেসি চিন্তায় পড়ল, আমতা আমতা করে জানতে চাইল আচ্ছা আর্লি, যদি কেউ পাহারাদারের দৃষ্টি অন্যদিকে পাঁচ মিনিটের জন্য আকর্ষণ করে তাহলে কি হবে?
–তাতে কি হবে বলতে বলতে আর্লি লিটলচ্যাপ হেসে ফেলল–যদি কেউ পাহারাদারটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে, বা তাকে অন্য দিকে টেনে নিয়ে যায় তাই বলছো তো? হ্যাঁ এখানে সেরকম গায়ে পড়া অনেক বেহায়া মেয়ে আছে, বলো তো তাদের কাজে লাগিয়ে দেব, কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে তুমি কি গুটি গুটি মেরে ওই ঝুড়ির ওপর বসতে পারবে?
–তাহলে তুমি আমাকে সাহায্য করবে তো?
মুহূর্তের জন্য কি ভেবে আর্লি বলল–হ্যাঁ করবো, বিগবার্থার মুখে ঝামা ঘষে দেবার এমন সুযোগ আমি আর কখনও পাবো না।
জেলখানার বাতাসে একটা খবর তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে ট্রেসি হুইটনি জেল থেকে পালাতে যাচ্ছে। কোনো একটা মুখরোচক খবরের সন্ধানে সবাই উৎসুক চিত্তে অপেক্ষা করে। নিজেদের সাহস নেই, কিন্তু কেউ একজন সাহসী হয়ে উঠেছে, একথা ভেবে সকলে মনে মনে অসীম আনন্দ পায়।
আর্লি লিটলচ্যাপ-এর সাহায্যে পালাবার পরিকল্পনা তখন ক্রমশ আরও পেকে উঠেছে। আর্লি ট্রেসির পোশাকের মাপ নিল। লোলা আর পাউলিটা কোথা থেকে কাপড় যোগাড় করল, ট্রেসির নতুন পোশাক তৈরি হল। একজোড়া নতুন জুতো চুরি করে আনা হল। পোশাকের রঙের সঙ্গে জুতো জোড়ার রং একেবারে মিলে গেল। টুপি দস্তানা সব যেন ম্যাজিকের মতো এসে উপস্থিত হল।
এবার দরকার ক্রেডিট কার্ড আর ড্রাইভারের লাইসেন্স, মুখ গম্ভীর করে লিটলচ্যাপ বলল–সেসব কোথা থেকে পাবে?
–ভার যখন নিয়েছি তখন তো ব্যবস্থা করতেই হবে।
আর কয়েকদিন বাদে জেমস স্মিন্টের নামে বড় অংকের টাকায় ক্রেডিট কার্ড যোগাড় হয়ে গেল। শেষ অবধি ড্রাইভারের লাইসেন্স।
পরদিন রাতে লিলিয়ান নামের একটা কয়েদি চুপিচুপি ট্রেসিকে ডেকে নিয়ে গেল। প্রথম দিন তার আঙুলের ছাপ যে ঘরে নেওয়া হয়েছিল সেই ঘরে ট্রেসি হাজির হল। ওখানে আরেকজন অপেক্ষা করছিল। চট করে ফটো ভোলা হয়ে গেল। কাল সকালে ড্রাইভারের লাইসেন্স হাতে এসে যাবে।
লিলিয়ান বলল, শুনলাম তোমাকে অন্য সেলে ভর্তি করা হচ্ছে? লিলিয়ানের এই কথা শুনে ট্রেসি পাথর হয়ে গেল।
–তুমি জানো না? তোমাকে বিগবার্থার সেলে পাঠানো হবে।
নিজস্ব সেলে ফিরতেই আর্লি-লোলা-পাউলিটা এগিয়ে এল। জানতে চাইল সব ঠিক মতো হয়েছে তো?
ট্রেসির মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে লিলিয়ানের শেষ কথাগুলোতোমাকে বিগবার্থার সেলে পাঠানো হবে।
পাউলিটা জানালো–শনিবারের মধ্যে সবকিছু তৈরি হয়ে যাবে।
ট্রেসি মনে মনে ভাবলোশনিবারের মধ্যেই সব কাজ শেষ করতে হবে।
আর্লি ফিস ফিস করে বলল–সব ঠিক আছে, শনিবার দুটোর সময় ধোবীখানার গাড়ি আসবে। দেড়টার মধ্যে তুমি নোংরা জামাকাপড় রাখার পাশের ঘরে পৌঁছে যাবে, পাহারাদারদের জন্য চিন্তা করো না। লোলা ওকে ভুলিয়ে রাখবে ফষ্টি নষ্ঠি করে। পাউলিটা তোমার সব জিনিসপত্র নিয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করবে। ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে তোমার পরিচয় পত্র থাকবে, থাকবে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ক্রেডিট কার্ড। দুটো বেজে পনেরো মিনিটে গাড়ি বেরিয়ে যাবে গেট দিয়ে।
ট্রেসির দম বন্ধ হয়ে এল। বেরিয়ে তো যাবে, কিন্তু মৃতদেহ হয়ে আবার তাকে ফিরে আসতে হবে এই জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যে?
আর কয়েকদিনের মধ্যেই ট্রেসি মুক্তি পাবে, তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ আরও দ্রুত হয়ে উঠেছে।
এবার লিটলচ্যাপ আর বিগবার্থার মধ্যে রেষারেষি শেষপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিগবার্থার সেলের সকলের কাছে এই খবর পৌঁছে গেছে যে ট্রেসি পালিয়ে যাবে কিন্তু সাহস করে এই খবরটা কেউ বিগবার্থার কানে তুলতে পারছে না। খারাপ খবর শুনতে সে মোটেই অভ্যস্ত নয়। খারাপ খবর যে বয়ে আনে এক ঘুষিতে তার নাক ফাটিয়ে দেয়। শেষ। পর্যন্ত শনিবার সকালে বিগবার্থার কানে এই মারাত্মক খবরটা পৌঁছে গেল।
যে জেল বয়টি ট্রেসির ফটো তুলেছিল, সেই বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করল।
কথাটা শুনে বিগবার্থা গম্ভীর হয়ে গেল। তার বিশাল শরীরটা তখন নিথর হয়ে গেছে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলল–কখন পালাচ্ছে?
–আজ দুপুর দুটোর সময়, ধোবীখানার কাপড় জামা যে ঝুড়িতে রাখা হয় সেই ঝুড়ির মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে থাকবে।
অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর বিগবার্থা মেট্রনের কাছে হাজির হল। সে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে এখন দেখা করতে চায়।
শেষ রাতটা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি ট্রেসি, উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে তার রোগা শরীর। অতীতের সব ছবিগুলো একের পর এক চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছে। কতকাল এই নরকের অন্ধকারে পচে মরতে হয়েছে ট্রেসিকে। এবার সে সত্যি সত্যি মুক্তির সন্ধান পাবে।
ঘুম ভাঙার ঘণ্টা পড়ল। ট্রেসি ধরফর করে উঠে বসল। আর্লি লিটলচ্যাপ কাছে এসে বলল কি ভাবছো? তুমি ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি, তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ, কথাগুলো বলল বটে ট্রেসি, কিন্তু উত্তেজনায় তখনও তার বুক ধরফর করে কাঁপছে।
–আমরা দুজনে আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, তুমি দেড়টার মধ্যে ওয়ার্ডেন এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসো কেমন?
–অসুবিধা হবে না, আমি দুপুরে ঘুমায়। আমি অনায়াসে ফিরে আসতে পারবো।
পাউলিটা বলল–একটুও দেরি কোরো না কিন্তু, এখানে প্রত্যেকটা মিনিট অত্যন্ত মূল্যবান। সময়ের একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলে সব পরিকল্পনা একেবারে ভেস্তে যাবে।
ট্রেসি গলায় গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বলল–আমি ঠিক সময় ফিরে আসবো দেখো।
গদির তলা থেকে কিছু নোট বের করে লিটলচ্যাপ বলল–বেশি নেই, দুশো ডলার আছে, বাইরের পৃথিবীতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে টাকার দরকার।
–তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব…ট্রেসি কথা শেষ করতে পারল না।
আর্লি বলল–চুপ, নাও টাকাটা রাখো।
.
জলখাবারটা গিলছিলো, ট্রেসি, মাথার ভেতর একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, যে করেই হোক আজ তাকে পালাতে হবে।
রান্নাঘরে আরও অনেকে ছিল, বেশ থমথমে পরিবেশ সেখানে। সবাই তারই কথা চিন্তা করছে, আজকের এই নাটকে সেই মহানায়িকার চরিত্রে অবতীর্ণ হবে। শেষপর্যন্ত ঠিক মতো সংলাপ উচ্চারণ করতে পারবে তো? নাকি অর্ধেক কথা বলার পর শেষ হয়ে যাবে তার অভিনয়?
আধখাওয়া অবস্থাতেই উঠে পড়ল সে, ছুটল ওয়ার্ডেন-এর বাড়ি যাবার জন্য। বারান্দার শেষে লোহার গেট। পুলিশ দরজাটা খুলতেই উল্টো দিক থেকে বিগবার্থার চোখে পড়ল। দুজনে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ট্রেসি মনে মনে ভাবল–বিগবার্থা, একটু বাদে তুমি একটা চমৎকার খবর পাবে। তখন তোমাকে আফশোস করে মরতে হবে।
ট্রেসিকে দেখে বিগবার্থা ভাবল, ও আমার হাতের মুঠোয় আসবে। ওর এই সুন্দর শরীরটা নিয়ে আমি যা খুশি খেলা খেলতে পারবো।
সময় বুঝি আর কাটতে চাইছে না, ট্রেসি অ্যামিকে বই পড়ে শোনাচ্ছে, কি পড়ছে তা খেয়াল ছিল না, তবে এটা বুঝতে পারছিল যে জানলা দিয়ে অ্যামির মা তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন।
–ট্রেসি চল লুকোচুরি খেলি।
ট্রেসির তখন খেলার মতো অবস্থা নেই। যাতে সু-এর মনে কোনো সন্দেহ না আসে তাই সে খেলতে রাজী হল।
–নিশ্চয়, তুমি আগে লুকোও, আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।
বাংলোর সামনে একটা উঠোন, ওখান থেকে সেই ঘরটা দেখা যাচ্ছে যেখানে ট্রেসিকে দেড়টার সময় পৌঁছতে হবে। পনেরো মিনিটের মধ্যে তাকে বাইরে যাবার পোশাক পাল্টাতে হবে, ঢুকে পড়তে হবে ঝুড়ির মধ্যে, ওপর থেকে তার গায়ের ওপর নোংরা জামা কাপড় চাপিয়ে দেওয়া হবে। দুটোর সময় সান্ত্রী ফিরবে ট্রাকে মাল তুলবার জন্য। দুটো বেজে পনেরো মিনিটে গাড়ি বেরিয়ে যাবে। সামান্য দূরে শহরের মধ্যে ধোবীখানা। ড্রাইভারের জায়গা থেকে পেছনটা আর দেখা যাবে না, রাস্তায় লাল আলো দেখে ট্রাকটা দাঁড়ালেই ঝুপ করে পথে নেমে পড়বে।
একটা ম্যাগনোলিয়া গাছের পাশে দাঁড়িয়ে অ্যামি বলছে–আমাকে দেখতে পাচ্ছো?
এর সঙ্গে আর দেখা হবে না, এখান থেকে পালিয়ে গেলে দুজনের জন্য খুব মন খারাপ লাগবে আমার, একজন লিটলচ্যাপ আরেকজন এই অ্যামি।
নিজেই ভাবল ট্রেসি।
–আসছি তোমাকে খুঁজে বের করবো।
সু এলেন বাড়ির ভেতর থেকে বার বার ট্রেসিকে দেখছিলেন, আজ সকাল থেকেই ট্রেসি বেশ চঞ্চল। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে, কোনো কাজে যেন মন নেই। অ্যামিকে ঠিক মতো যত্ন করছে না। স্বামী এলেই অভিযোগ করতে হবে। ট্রেসির স্বভাব চরিত্র মোটেই ভালো লাগছে না সু এলেনের।
বেশ কিছুক্ষণ খেলার পর ট্রেসি দেখল সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। এবার অ্যানির খাবার সময় হয়েছে ভেতরে গিয়ে ট্রেসি সু এলেনকে বলল–আমি এবার যাই মিসেস ব্র্যানিগান?
–কেন? দুটি ভূ-ভঙ্গীতে বিরক্তি এনে মিসেস বললেন, তোমাকে কেউ কিছু বলেনি ট্রেসি? তুমি কি জান না আজ আমাদের এখানে কয়েকজন ভি আই পি আসবেন? ওই অতিথিরা আজ এখানেই খাবেন, আমি আজ ঘুমোবে না, তুমি ওকে চোখে চোখে রাখবে।
অতি কষ্টে নিজের উত্তেজনা দমন করে ট্রেসি বললনা না আজ আমি পারবো না।
–পারবে না মানে? সমস্ত শরীরের রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে শ্রীমতী ব্র্যানিগান-এর।
উনি যে রেগে গেছেন সেটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেসি মত বদলালো। কারণ এখনই যদি মিঃ ব্র্যানিগান-এর কাছে এই খবর পৌঁছে যায় তাহলে উনি ট্রেসিকে হয়তো সেলে পাঠিয়ে দেবেন।
ট্রেসি জোর করে হেসে বলল–মানে বলছিলাম কি অ্যামি এখনও খায়নি।
–তোমাদের দুজনের জন্য পিকনিকের মতো খাবারের প্যাকেট তৈরি রেখেছি। পেছন দিক দিয়ে মাঠে চলে যাও, ওখানে বসে আজ দুপুরের খাবারটা খেও কেমন?
–হ্যাঁ, আমরা কখন ফিরবো মিসেস ব্র্যানিগান?
–তিনটের আগে অতিথিরা চলে যাবেন, ওই সময় ফিরবে।
এই কথা শুনে ট্রেসির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
মিসেস ব্র্যানিগান জানতে চাইলেন-ট্রেসি সত্যি করে বলো তত তোমার কি শরীর। খারাপ?
–না না সেরকম কিছু নয়; তাড়াতাড়ি বলল ট্রেসি।
ভি আই পি-রা হঠাৎ জেলখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। গভর্নর উইলিয়াম হোভার নিজেই এসেছেন জেলখানা সংস্কার কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে। প্রতি বছর একবার তারা জেলখানার হাল-হকিকৎ দেখতে আসেন।
–সবই ঠিক আছে ব্র্যানিগান, মেয়ে বন্দীদের বলল আর একটু পরিষ্কার থাকতে, জেলখানাটাকেও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তাহলে এই বছরে এখানকার বরাদ্দের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবো। হাসতে হাসতে বললেন গভর্নর সাহেব।
সকাল দশটার সময় গভর্নর হোভার এবং তার কমিটির সদস্যদের আসার কথা ছিল। সেদিন সকালেই গেট পাহারাদার সমস্ত বন্দীর কাছে একটা গোপন খবর পাঠিয়ে দিয়েছে, তাহল, নেশার ওষুধ বা ছুরিছোরা কোনো কিছুই রাখা চলবে না।
বিগবার্থা ক্রমশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে, সকালে সে ওয়ার্ডেন-এর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বলা হয়েছে ওয়ার্ডেন আজ খুবই ব্যস্ত থাকবেন, বিগবার্থা যেন আগামীকাল আসে।
একটা কুৎসিত গালাগাল দিয়ে বিগবার্থা বলেছিল–আমাকে দেখা করতেই হবে, ভীষণ জরুরী এই দেখা করাটা।
বিগবার্থাকে সকলে সমঝে চলে, কিন্তু ওয়ার্ডেন-এর অফিস ঘরে কতক্ষণ বসে থাকবে সে? ঘড়ি দেখল, বারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট, হাতে এখনও অনেক সময় আছে।
দিনটা ভারী সুন্দর, আকাশের কোথাও কালো মেঘ নেই, ঝকঝকে রোদ্দুর চারপাশে হা হা করে হাসছে। বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ। পুকুরটার ধারে বড় টেবিল ক্লথ পেতে অ্যামিকে ট্রেসি খেতে দিয়েছে। ডিম আর স্যালাড দেওয়া স্যান্ডউইচ অ্যামি মনের সুখে চিবুচ্ছে।
ট্রেসি ঘড়ি দেখল, সর্বনাশ, একটা বাজে, সময় বুঝি হু হু করে কেটে যাচ্ছে। যেমন করেই হোক পালাবার এই সুযোগটা আমাকে গ্রহণ করতেই হবে। এ সুযোগটা ফসকে গেলে আমি আর কখনও পালাতে পারবো না।
একটা বেজে দশ মিনিট, ওয়ার্ডেন-এর সেক্রেটারী টেলিফোন নামিয়ে বললেন–দুঃখিত, ওয়ার্ডেন বলেছেন আজ কিছুতেই তাঁর সঙ্গে দেখা হতে পারে না। তেমন দরকার থাকলে আগামী কাল…
–দেখা করতেই হবে, আজই, কালকে খবরটা দেওয়ার কোনো দরকার হবে না। হঠাৎ নিজেকে সামলে নিল বিগবার্থা, আরেকটু হলেই মুখ ফসকে সেই ভয়ংকর খবরটা বেরিয়ে পড়তো। ট্রেসিকে সে কিছুতেই নাগালের বাইরে যেতে দেবে না। অনেক চিন্তা করে সে গেল জেলখানার লাইব্রেরীতে। একটুকরো কাগজে কি যেন লিখল, তারপর মেট্রনকে আসতে দেখে তার টেবিলে কাগজটা ফেলে দিয়ে চলে গেল।
মেট্রন এসে কাগজটা দেখলেন, তাতে লেখা রয়েছে ধোবীখানায় যাবার ট্রাকটা ভালোভাবে তল্লাশি করলে ভালো হয়।
মেট্রন লেখাটা দুবার পড়লেন। তলায় কারো সই নেই। কেউ কি তাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে নাকি? যাই হোক না কেন ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই? টেলিফোন তুলে মেট্রন বললেন–পাহারাদার সুপারকে দাও।
একটা বেজে পনেরো মিনিট।
–তুমি কিছু খাচ্ছো না, অ্যামি বলল, আমার থেকে স্যান্ডউইচ খাবে?
–না আমাকে বিরক্ত কোরো না অ্যামি, আমার মন ভালো নেই।
এই কথা বলে ট্রেসির মনে হল এতটা কড়া না হলেই হয়তো ভালো হতো।
অ্যামি খাওয়া বন্ধ করে জানতে চাইল–তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো? আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
অ্যামিকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলল ট্রেসি। বলল, না না আমি তোমার ওপর কি রাগ করতে পারি?
–আর খাব না, চল বল খেলি। পকেট থেকে রবারের বলটা বের করল অ্যামি।
…একটা বেজে ষোল মিনিট, আগেই বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল ট্রেসির। ওই ঘরটায় যেতে এখনও পনেরো মিনিট সময় লাগবে। অ্যামিকে একলা ফেলে সে কি করে যাবে? হঠাৎ ট্রেসি দেখল তার মতো বিশ্বাসী কয়েকটি কয়েদি মাঠে কাজ করছে। সঙ্গে সঙ্গে সে মনস্থির করে ফেলল।
অ্যামি তখন অধৈৰ্য্য হয়ে চীৎকার করছে, আমার সঙ্গে বল খেলবে না ট্রেসি?
–হ্যাঁ খেলবো অ্যামি, আমি তোমাকে একটা নতুন খেলা শেখাবো।
ট্রেসির এই কথা শুনে অ্যামি চঞ্চল হয়ে উঠল। ছোট্ট শিশু সে, পৃথিবীর দুঃখ শোক সন্তাপ এখনও পর্যন্ত তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এখনও সে স্বপ্নরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে থেকে গেছে।
–কি নতুন খেলা?
অধীর আগ্রহে অ্যামি জানতে চাইল।
আজ দেখা যাক কে কত দূরে বল ছুঁড়তে পারে। আগে আমি বল ছুঁড়ি তারপর তুমি ছুঁড়বে, এই কথা বলতে বলতে ট্রেসি কয়েদীরা যেদিকে কাজ করছিল সেদিকে লক্ষ্য করে বলটা ছুঁড়ে দিল।
–কি মজা, তুমি কত দূরে ছুঁড়েছো?
–যাই আমি বলটা নিয়ে আসি, তুমি কিন্তু এখানেই থাকবে।
ট্রেসি ছুটতে লাগল, একটা বেজে আঠারো মিনিট, সময় অত্যন্ত দ্রুত পিছলে যাচ্ছে, মুক্তির ঘন্টা সে শুনতে পাচ্ছে, মাত্র আর কয়েকটা মিনিট, তারপর? তারপর আঃ, মুক্ত পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যাবে সে!
শুনতে পেল অ্যামি তার নাম ধরে ডাকছে, কিন্তু ওদিকে তাকালে মুক্তির পথ বন্ধ
হয়ে যাবে।
একজন ট্রাস্টি জানতে চাইল কি হয়েছে? এমনভাবে ছুটছো কেন?
–না না কিছু না, ওই যে ছোট্ট মেয়েটি, ওকে দেখতে পাচ্ছ কি? প্লীজ তোমাদের মধ্যে কেউ একজন ওর দিকে নজর রাখবে? খুব জরুরী একটা কাজ আছে আমার, আমি এখুনি আসছি।
আবার নিজের নামটা শুনে ট্রেসি ঘুরে দাঁড়াল। পুকুরের চারপাশে যে পাথরের দেওয়াল তারই একটার ওপরে উঠে দাঁড়িয়েছে অ্যামি। হাত তুলে ডাকছে ট্রেসিকে। ট্রেসি বুঝতে পারলো এখনই চোখের সামনে কি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাবে। সে বলল–অ্যামি, অ্যামি নেমে পড়।
ট্রেসির চোখের সামনে সেই বিপদটা ঘটে গেল। ব্যালেন্স হারিয়ে অ্যামি পুকুরের জলে, পড়ে গেল।
হায় ভগবান, ছুটতে ছুটতে ট্রেসি থমকে থেমে দাঁড়াতে বাধ্য হল। তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন আরও দ্রুততর হয়েছে তখন। সে ভাবল হায়, পালাতে গিয়ে আমি একটা খুন করলাম। মনের সঙ্গে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। বিবেক বলছে এখনই তাকে পুকুরের ধারে চলে যেতে। ছোট্ট মেয়েটা শুধু তাকে ভালোবেসে এইভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে? ট্রেসি আজ হৃদয়হীনা রমণীর মত সবকিছু দেখবে? যুক্তি বলছে না, পালাবার এমন সুযোগ আর কখনও পাবে না সে। অন্য কোনো, ট্রাস্টি না হয় মেয়েটাকে জল থেকে উদ্ধার করুক। আগে নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে, তারপর অ্যামির কথা ভাববো।
ট্রেসি ছুটতে শুরু করল, ট্রাস্টিরা ওকে ডাকছিল, কিন্তু কারোর শব্দ তখন ট্রেসির কানে পৌঁছেচ্ছে না। তখন তার পা থেকে জুতো খুলে গেছে সে জানে না, শেষ অবধি, শেষ অবধি সে দেওয়ালের কাছে পৌঁছে গেল, নিচে অনেকটা নিচে গভীর জলে হাত পা ছুঁড়ে ভেসে থাকার শেষ চেষ্টা করছে অ্যামি, এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা না করে ট্রেসি পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সহসা তার মনে হল, হে ভগবান, আমি তো সাঁতার জানি না।
.
১২.
নিউ অর্লিয়েন্স, শুক্রবার, ২৫শে আগস্ট, সকাল ১০টা।
নিউ অর্লিয়েন্সের ফার্স্ট মার্চেন্টস ব্যাঙ্কের ক্যাসিয়ার লেস্টার টেরেন্স-এর কথা বলা যাক। এই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা আত্ম-অহমিকা বোধকে মুঠো বন্দী করে বেঁচে থাকতে ভালোবাসেন, লেস্টার টোরেন্স সেই দলভুক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন নারীসঙ্গ লাভ এবং যৌনক্ষমতায় তিনি নাকি পৃথিবীতে এক অদ্বিতীয় আসনে আসীন। তার আরেকটি বিশ্বাস আছে, তাহল তিনি খুব সহজেই তার খদ্দেরকে চিনতে পারেন এবং খদ্দেরের মনোভাব বুঝতে পারেন।
চল্লিশ-এর কোঠা শেষ করতে আরও কয়েক বছর বাকি আছে তার। ছিপছিপে চেহারা, কোথাও অতিরিক্ত মেদ নেই, গাল দুটো বসে গেছে, দারুণ একজোড়া গোঁফ হল তার শরীরের সম্পদ। কানের জুলপী অস্বাভাবিক রকমের বড়ো।
দু-দুবার তাঁকে প্রমোশন দেওয়া হয়নি, তাই ব্যাঙ্কের ওপর রাগ আছে ক্যাসিয়ার লেস্টার টোরেন্স-এর। লেস্টার বদলা নেবার জন্য ব্যাঙ্কটাকে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগের অফিস করে তুলেছেন।
যে সমস্ত দেহপসারিণীরা রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, এক মাইল দূর থেকেও লেস্টার তাদের চিনতে পারেন। নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে লেস্টার বিনা পয়সায় কাজ সারেন। নিঃসঙ্গ বিধবারা হল তার সব থেকে ভালো শিকার। নানা চেহারার নানা বয়সের বিধবা মেয়েরা পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। দারিদ্রতার জ্বালায় তারা জর্জরিত। সংসারের সকলের কাছ থেকে তারা অপমান পেয়ে আসছে। লেস্টার শেষ পর্যন্ত তাদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হন। তারা লেস্টারের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ জমা টাকার থেকে বেশি টাকা তুলে ফেলে। চেক যাতে ফেরত না যায় সেজন্য লেস্টার আশ্বাসবাণী শুনিয়ে দেন। পরিবর্তে কি? পরিবর্তে ওই মহিলা হয়তো লেস্টারকে একদিন নৈশ ভোজের আসরে নিমন্ত্রণ করবেন। লেস্টারের বহু মহিলা মক্কেল নানা সাহায্য চায়, নিজেদের গোপন কথা হরহরিয়ে বলে ফেলে, কেউ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার চায় অথচ স্বামীর কাছে এই ব্যাপারটা বলা চলবে না, কেউ চেকের কোনো কোনো বিষয় গোপন রাখতে বলে, কেউ আবার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানের জন লেস্টারের শরণাপন্ন হয়। কেউ বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে চাইছে, লেস্টার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করে দিতে পারেন কিনা? লেস্টার সব ব্যাপারে সবাইকে খুশি করতে অত্যন্ত আগ্রহী, প্রত্যেকদিন অন্তত একজন অসহায় মহিলাকে সাহায্য না করলে রাতে লেস্টার দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না।
শুক্রবারে সকালে লেস্টারের হঠাৎ মনে হয় উনি একটা মস্ত বড় জ্যাকপট জিতে ফেলেছেন। ব্যাঙ্কের দরজা দিয়ে ঢোকার মুহূর্তে লেস্টার মেয়েটাকে দেখেছিলেন। মেয়েটার রূপ লাবণ্য লেস্টারকে বিমোহিত করেছিল। লেস্টার সুনিশ্চিত, মেয়েটাকে পায়ে পায়ে তার খাঁচার দিকে এগিয়ে আসতেই হবে। সুন্দর কালো চুলের গোছা কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে, স্কিন টাইট জীনস আর সোয়েটার পড়েছে, মনে হচ্ছে ফ্যাসান ডিজাইনের পাতা থেকে বুঝি এখুনি উঠে এসেছে। আঃ, ঈশ্বর যে কেন চোখের সামনে এমন মনোহরিণী মেয়েদের এনে উপস্থিত করেন।
ব্যাঙ্কে আরও চারজন ক্যাসিয়ার আছেন। অন্য তিনজন লেস্টারের ভাগ্যকে সবসময়ে। ঈর্ষা করেন। ক্যান্টিনে কফি খেতে খেতে তারা বলে-লেস্টার, তুই ভগবানের পোষ্যপুত্র নাকি? দ্যাখ, তোর খাঁচা সবার শেষে অথচ সুন্দরী মেয়েরা তোর দিকেই ছোটে, কেন বলতো?
ডিমের পোচ খেতে খেতে লেস্টার জবাব দেন–আমার শরীরে ভগবান একটা চুম্বক ফিট করে দিয়েছেন, তাই লোহার মতো মেয়েরা আমার দিকে ছুটে চলে।
এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। মেয়েটি এক এক করে তিনটি খাঁচা পার হয়ে শেষ পর্যন্ত লেস্টারের খাঁচায় সামনে এসে দাঁড়াল।
লেস্টার বললেন–সুপ্রভাত, আপনার জন্য কি করতে পারি? তারপর একদৃষ্টিতে মেয়েটির উর্ধাঙ্গের দিকে তাকালেন। কবে যে, এই সোয়েটারের বোঝাটা ওই মেয়েটিকে আর বহন করতে হবে না, লেস্টার মনে মনে ভাবলেন। আরও ভাবলেন তিনি, খুকুমণি, তোমার ঠোঁট থেকে খসে পড়া একটুকরো হাসির জন্য আমি জীবনটকে পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারি।
মেয়েটি মিষ্টি করে বলল–একটা সমস্যায় পড়ে গেছি, তার কথার মধ্যে দক্ষিণী টান স্পষ্ট।
গলায় দরদ ঢেলে লেস্টার বললে–আপনার সমস্যা সমাধান করবার জন্যই তো ব্যাঙ্ক আমাকে মাসে মাসে মোটা মাইনে দিচ্ছে। বলুন আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করবো?
–আমিও সে রকম আশা করছি, একটা দারুণ ঝঞ্ঝাট বাঁধিয়ে ফেলেছি।
মনে মনে লেস্টার ভাবলেন–স্বচ্ছন্দে তোমার সমস্যার কথা আমাকে তুমি গুছিয়ে। বলতে পারো। যদি এখানে বলতে অসুবিধা হয় তাহলে বিকেলে কোনো কাফেতে আসতে পারো।
লেস্টার মুখের ওপর একটা অমায়িক ভাব তুলে বললেন–আমি বিশ্বাস করি না তোমার মতো মেয়ে কোনো ঝঞ্ঝাট বাঁধতে পারে। ঈশ্বর যাকে এমন রূপ দিয়েছেন, নিশ্চয় তার মাথার খোলটাকে একেবারে ফাঁপা করে রাখেননি।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতার লেস্টার দেখেছেন, প্রশংসা করলে সব মেয়ে মোমবাতির মতো গলতে শুরু করে।
কিন্তু তখন মেয়েটির বাদামী চোখের তারায় আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছে–সে বলল, সত্যি সত্যি আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। আমি জোসেফ রোমানোর সেক্রেটারী, উনি আমাকে এক সপ্তাহ আগে তাঁর কারেন্ট অ্যাকউন্টের নতুন চেক বই নিয়ে রাখতে বলে ছিলেন। আমি একদম ভুলে গেছি। এখন আমাদের সব চেক প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, এই খবরটা যদি ওঁর কানে পৌঁছয় তাহলে আমার চাকরি আর থাকবে না।
জোসেফ রোমানোর নাম লেস্টার খুব ভালোভাবেই জানেন, উনি হলেন এই ব্যাঙ্কের একজন গণ্যমান্য কাস্টমার, অবশ্য এখন তিনি খুব অল্প টাকা ব্যাঙ্কে রাখেন। জনান্তিকে শোনা গেছে উনি নাকি অন্যত্র বেশি টাকা খাটান।
মনে মনে মেয়েটিকে তারিফ করলেন লেস্টার, আঃ, রোমানো দেখছি এই ব্যাপারে বাজী জিতে বসে আছেন, সেক্রেটারী রাখার ক্ষেত্রে তার কোনো ভুল হয়নি।
শেষ পর্যন্ত একটু হেসে উনি বললেন–দেখো, এটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয় শ্রীমতি।
আমি শ্রীমতি নই, আমি কুমারী লুরিন হার্টফোর্ড।
কুমারী, আহা, তাহলে সবকটা ছাড়পত্র পাওয়া গেল, লেস্টার মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে বললেন–আমি এখুনি নতুন চেকবই-এর জন্য বলে দিচ্ছি। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যেই পেয়ে যাবে।
লেস্টারের এই কথা শুনে মেয়েটি এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরে সে বলল–ওঃ না, তাহলে কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে যাবে। মিঃ রোমানো এমনিতেই আমার ওপর চটে আছেন, আমি নিজের কাজ ঠিক মতো করতে পারি না। এবার মেয়েটি খাঁচার ওপর তার সুন্দর তনুবাহার মেলে ধরল। এই প্রথম সোয়েটারের আড়াল থেকে স্তন বিভাজন দেখতে পেলেন লেস্টার, মনের আকাশে খুশির ফানুস উড়ে গেল। মেয়েটি বলছে দুচোখের পাতায় করুণ মিনতি নিয়েযদি একটু তাড়াতাড়ি করে চেক বইটা পাইয়ে দেন তাহলে যে আমার কি উপকার হয়। যদি এর জন্য কোনো বাড়তি চার্জ। দিতে হয়, আমি তাও দেব।
বাড়তি চার্জ, মেয়েটির শরীর জরিপ করতে করতে লেস্টার বললেন–না, দুঃখিত লুরিন, তা সম্ভব নয়।
এবার মেয়েটির চোখে জল এসেছে।
–সত্যি কথা বলতে কি, কর্তব্যের গাফিলতির জন্য আমার চাকরি চলে যেতে পারে। দয়া করে যা বলবেন আমি তাই করবো।
লেস্টার এই কথাগুলি শুনে খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, তার মানে? মেয়েটিকে কি এখুনিই ফাঁদে ফেলা উচিত?
লেস্টার বলতে শুরু করলেন–ঠিক আছে আমি চেষ্টা করছি, সোমবারে তুমি চেকবই পেয়ে যাবে। কি চলবে তো?
লেস্টারের এই কথা শুনে মেয়েটির গলা তখন কৃতজ্ঞতায় বুজে এসেছে। মেয়েটি বলল–আপনি অসাধারণ।
-অফিসে পাঠিয়ে দেব?
–না, না অফিসে পাঠাবেন না। তাহলে মিঃ রোমানো জেনে যাবেন। বলুন সোমবার কটার সময় আসতে হবে আমাকে?
–আমাকে সব সময় এখানেই পাবে।
একরাশ মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে অঙ্গ দুলিয়ে মেয়েটি চলে গেল। লেস্টার ফাইল ক্যাবিনেট থেকে জোসেফ রোমানোর এ্যাকাউন্ট নাম্বারটা বের করলেন, নতুন চেক বই। এখনই তৈরী করতে হবে, তা নাহলে মেয়েটির ওপর জাল বিস্তার করবেন কেমন করে?
.
নিউ অর্লিয়েন্সের কারমেন স্ট্রীটের এই হোটেলটার মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। পাঁচশ হোটেলের মতো এটি খুবই সাধারণ, তাই ট্রেসি এই সস্তা হোটেলটাকে বেছে নিয়েছিল।
সস্তা হলেও জেলখানার সেলের তুলনায় এটি একটা স্বর্গ একথা অনায়াসেই বলতে হবে।
ব্যাঙ্কে লেস্টারের সাথে দেখা করে ফেরার পথে ট্রেসি তার কালো চুলের পরচুল আর চোখের কনট্যাক্ট লেন্স অতি দ্রুত খুলে ফেললাম। চড়া মেক-আপ নিয়েছিল, সেটাও ক্লিনার দিয়ে তুলে ফেলল। তারপর আরাম করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসল। ভাবল, এবার ঠিক মতো কাজ শুরু হয়েছে, জোসেফ রোমানো কোন্ ব্যাঙ্কে টাকা রাখে সেটা ও মা র ফাইল থেকে জেনে ফেলেছে। জো রোমানো ওর মাকে একটি চেক দিয়েছিল। আর্নি লিটলচ্যাপের কথা মনে পড়ে গেল ট্রেসির, আর্নি বলেছিল জো রোমানো, ভুল করে ওর গায়ে হাত দিও না তুমি।
আর্নি ভুল করেছিল, জো রোমানোকে দিয়েই শুরু হয়েছে ট্রেসির প্রতিশোধের পালা। এর পর একে একে সে সবার সাথে লড়াই করবে। কিভাবে অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে ভাবতে ভাবতে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল।
ঠান্ডা জলের তলায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল ট্রেসি। কোনোরকমে সামলে দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে অ্যামিকে খুঁজে পেল। অ্যামিকে টানতে টানতে জলের ওপর ভেসে উঠল। অ্যামি তখন ভীষণ ভয় পেয়ে প্রাণপণ শক্তিতে ট্রেসিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। একটু পরে অ্যামির মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল। তখন সে আর ট্রেসিকে বিশ্বাস করতে পারছে না। হয়তো ছোট্ট অ্যামি বুঝতে পেরেছিল ট্রেসির জন্যই আর তার এই অবস্থা।
তখন সে পাগলের মতো ট্রেসির হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। দুজনেই আবার ডুবতে শুরু করল। ট্রেসি বুঝতে পারছিল সে আর কিছু করতে পারবে না, দম বন্ধ হয়ে আসছে, বুক ফেটে যাচ্ছে। সলিল সমাধি থেকে অ্যামিকে বাঁচাবার জন্য শেষবারের মতো চেষ্টা করল ট্রেসি। অ্যামিকে জলের ওপর টেনে তুলে ভাসিয়ে রাখতে গেল, ট্রেসি বুঝতে পারল ও আর পারবে না। একটু বাদে দুজনেই মরে যাবে।
তখনই মানুষের গলার স্বর শোনা গেল। কারা যেন অ্যামিকে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে কয়েকটা শক্ত হাত এসে ট্রেসির কোমর ধরে তাকেও টেনে তুলল। কে যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল–সব ঠিক আছে, আপনি ভয় পাবেন না।
মরিয়া হয়ে ট্রেসি মুখ তুলে তাকাল, একজনের কোলে অ্যামি। যাক বাবা, তাহলে অ্যামি শেষপর্যন্ত মরেনি!
ঘটনাটা সমান্য, কিন্তু রাতারাতি গণমাধ্যম ট্রেসিকে এক মহান দুঃসাহসী নায়িকা করে। তুলল। গভর্নর হোভার নিজেই চলে এলেন জেলখানার হাসপাতালে ট্রেসির সঙ্গে দেখা করার জন্য। সাঁতার জানে না এমন একজন মেয়ে কয়েদী নিজের জীবন বিপন্ন করে ওয়ার্ডেনের মেয়েকে বাঁচিয়েছে বর্তমান সমাজে ব্যবস্থায় এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে কি?
ওয়ার্ডেন বলেছিলেন–খুব সাহসের পরিচয় দিয়েছো তুমি, তুমি না থাকলে মেয়েটি কখনই বাঁচতো না। শ্রীমতী ব্র্যানিগান এবং আমি দুজনেই তোমাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইছি।
তখনও ট্রেসি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। সে ধীরে ধীরে বলল–অ্যামি কেমন আছে?
অ্যামি ভালো আছে, এই কথাটা শুনে শান্তিতে ট্রেসির দুচোখ বন্ধ হয়ে গেল। অ্যামির কিছু হলে সে কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো না। অ্যামিকে সে খুব একটা ভালো বাসতে চায়নি, কিন্তু আমি ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে, এর জন্য খুবই অপরাধবোধ জাগলো ট্রেসির মনের মধ্যে।
দুর্ঘটনাটার ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত হল।
আমি তার বাবাকে বলেছিল–দোষটা আমার, আমরা বল খেলছিলাম, ট্রেসি বলটা আনবার জন্য অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। যাবার আগে ট্রেসি পইপই করে বলেছিল আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে, কিন্তু ট্রেসিকে ভালো করে দেখার জন্য আমি পাঁচিলের ওপর উঠে যাই, তখনই জলে পড়ে যাই। ট্রেসি কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে বাঁচিয়েছে বাবা।
সে রাতটা ট্রেসিকে হাসপাতালে রাখা হল। পরদিন সকালে তাকে ওয়ার্ডেনের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে টিভির ক্যামেরা আগে থেকেই হাজির ছিল। হাজির ছিল সাংবাদিকদের দল। ট্রেসিকে নিয়ে একটা দারুণ সিরিয়াল তৈরী হতে পারে।
সন্ধ্যাবেলা টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ ট্রেসির এই অসাধারণ সাহসিকতার কথা শুনল। খবরের কাগজগুলোর পাতায় পাতায় প্রকাশিত হল ট্রেসির এই দুরন্ত অভিযানের কাহিনী। কয়েকদিনের মধ্যে হাজার হাজার চিঠি আর টেলিগ্রাম পৌঁছতে লাগল জেলখানাতে। সকলেই অনুরোধ করছে কর্তৃপক্ষ যেন ট্রেসিকে ক্ষমা করে দেয়।
শেষপর্যন্ত গভর্নর হোভার ব্যাপারটা নিয়ে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে আলোচনা করলেন।
ওয়ার্ডেন মনে করিয়ে দিলেন যে ট্রেসি হুইটনি একটা গুরুতর অপরাধের জন্য জেলে বন্দী অবস্থায় সময় কাটাচ্ছে।
গভর্নর বেশ চিন্তায় পড়লেন, তিনি বললেন–কিন্তু এর আগে সে তো কোনো অপরাধ করেনি তাই নয় কি?
–তা সত্যি স্যার।
–মনের কথাটা বলছি আপনাকে। ওপর থেকে আমার ওপর প্রচুর চাপ আসছে, মেয়েটির জন্য কিছু একটা করতেই হবে।
–আমার ওপরও স্যার।
–অবশ্য জনগণের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আমরা জেলের প্রশাসন চালাবো নাকি কী বলেন?
–নিশ্চয় না স্যার।
–কিন্তু, আবার গভর্নর বেশ ভেবেচিন্তে বললেন, ওই হুইটনি মেয়েটি অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছে। আমাদের দেশের সকলের চোখে ও এখন কল্পলোকের নায়িকা এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
হাত কচলাতে কচলাতে ওয়ার্ডেন বললেন–হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে এক মত।
শেষ পর্যন্ত গভর্নর সিগার ধরিয়ে প্রশ্ন করলেন–আপনার কি মত ওয়ার্ডেন?
খুব সাবধানে বেছে বেছে শব্দ নির্বাচন করে ওয়ার্ডেন তাঁর মন্তব্য ব্যক্ত করলেন–আপনি নিশ্চয় জানেন গভর্নর, এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে। ট্রেসি যদি নিজের জীবন বিপন্ন করে জলে ঝাঁপিয়ে না পড়তো তাহলে আমার মেয়ে বাঁচতো না স্যার। তবে আমি মনে করি না ট্রেসি হুইটনি জাত অপরাধী। ও ছাড়া পেলে সমাজ এবং সংসারের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি জোরালোভাবে ওর জন্য সুপারিশ করছি, ওকে যাতে ক্ষমা করা হয় সে বিষয়টা আপনি ভালো করে দেখবেন।
গভর্নর দ্বিতীয়বার গভর্নর নির্বাচিত হওয়ার পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই সুবিধাজনক বলে মনে হল। তিনি ওয়ার্ডেনকে বললেন–বিষয়টা এখন গোপন রাখবেন। রাজনীতিতে সব কিছু সময় বুঝে করতে হয়।
স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করার পর সু ট্রেসির কাছে এলেন। সু বললেন–ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান এবং আমি চাইছি তুমি আমাদের কোয়ার্টারে এসে থাক। পিছনদিকে একটা শোবার ঘর আছে সেখানে থাকলে তুমি সবসময়ে অ্যামির যত্ন নিতে পারবে।
তখন কৃতজ্ঞতায় ট্রেসির দুচোখে জল এসে গেছে। ট্রেসি বলল, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
অ্যামির সঙ্গে ট্রেসির সম্পর্ক তখন খুবই মধুর হয়ে উঠেছে। অ্যামির ভালোবাসার ডাকে ট্রেসি প্রাণ খুলে সাড়া দিল। এই প্রাণচঞ্চল সুন্দর মেয়েটির সান্নিধ্যে এসে ট্রেসির জীবন তখন আরও মধুময় হয়ে উঠেছে। খেলাধুলো আর পড়াশোনাতে সময় কেটে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তারা দুজন একসঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় ওয়াল্ট ডিজনির কার্টুন দেখেন। সে যেন এখন ব্রানিগান পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে।
যখনই কোনো কাজে তাকে জেলখানার ভেতর যেতে হতো তখন বিগবার্থার চাপা কণ্ঠস্বর তাকে বিরক্ত করতো। বিগবার্থা তাকে লক্ষ্য করে বাছা বাছা কিছু বিশেষণ ছুঁড়ে দিতো। মাঝেমধ্যে সে বলতো কুত্তী, তোর ভাগ্যটা দেখছি খুবই ভালো। তবে তোকে একদিন এখানে ফিরে আসতেই হবে। দেখি ওয়ার্ডেনের বাপ তোকে কি করে বাঁচায়।
অ্যামিকে জল থেকে উদ্ধার করার পর তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। একদিন ট্রেসি আর অ্যামি সামনের বাগানে বসে খেলছিল, হঠাৎ সু সেখানে এলেন, তিনি বললেন–ট্রেসি, ওয়ার্ডেন এখনই ফোন করেছেন, তোমাকে অফিসে দেখা করতে বলছেন।
এই কথা শুনে ভয়ে ট্রেসির বুক কাঁপতে থাকলো। তাহলে? নিজের অজান্তে সে কি : কোনো কুকাজ করে ফেলেছে নাকি? তাকে কি আবার জেলখানায় ফেরত পাঠানো হবে? তাহলে কি বিগবার্থারই জয় হল? মিসেস ব্র্যানিগান কি চাইছেন না যে তার সঙ্গে অ্যামির ঘনিষ্টতা বেড়ে উঠুক?
–যাচ্ছি মিসেস ব্র্যানিগান।
পুলিশ ট্রেসিকে ওয়ার্ডেন-এর অফিসে পৌঁছে দিল, ওয়ার্ডেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রেসিকে দেখে তিনি আন্তরিকতা পূর্ণ কণ্ঠস্বরে বললেন–বোসো, তোমার জন্যে একটা খবর আছে, একটু থামলেন তিনি, তার গলায় আবেগের একটা সূক্ষ্ম ছোঁয়া আছে, ট্রেসি সেটা বুঝতে পারলো না।
–লুইসিনিয়ার গভর্নরের কাছ থেকে একটা খবর এসেছে। তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে, এই মুহূর্ত থেকে তুমি স্বাধীন আর মুক্ত।
–হে ঈশ্বর, আপনি যা বলছেন তা কি ঠিক? মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হল না ট্রেসির!
–আমি তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি, আমার মেয়েকে বাঁচাবার জন্যই এটা করা হচ্ছে না। একজন সৎ এবং ভদ্র নাগরিক হিসাবে তুমি যা করছে, তার কোনো তুলনা নেই। আমি বিশ্বাস করি তোমার দ্বারা সমাজের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে আমার একটু কষ্ট হচ্ছে, দেখতে দেখতে তুমি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলে, কথা দাও পরে আবার আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে আসবে তো?
ট্রেসির মুখে কোনো ভাষা ফুটলো না। হায় ওয়ার্ডেন যদি সেদিনের পরিকল্পনার কথাটা জানতে পারতেন তাহলে নিশ্চয় একথা বলতেন না। এতদিন আমার মৃতদেহ আনার জন্যে তার লোকেরা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতো।
পরশুদিন তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ট্রেসি কোনো রকমে বলল–কি বলে যে আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো আমি বুঝতে পারছি না।
–তোমার কিছু বলার দরকার নেই ট্রেসি। এখানকার সকলেই তোমার কাজের জন্য গর্বিত। মিসেস এবং আমার একান্ত ইচ্ছো তুমি তোমার অভিজ্ঞতা বাইরের কাজে লাগাও। আশাকরি সৎ সুন্দর শোভন জীবন-যাপন করতে পারবে।
–শেষপর্যন্ত আমি স্বাধীন হতে পেরেছি, দুর্বল হয়ে গেছে ট্রেসির সমস্ত শরীর, কোনোরকমে চেয়ারের হাতল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল–অনেক কিছু করার আছে আমার ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান!
জেলখানার শেষরাত। ট্রেসির সেল–ওয়ার্ডের একজন মেয়ে কয়েদী বলল–তাহলে তুমি বেরিয়ে যাচ্ছ?
–হ্যাঁ।
এর নাম বেটি ফ্রান্সিসকসে। বয়স চল্লিশের কোটায়, কিন্তু এখনও যৌবনকে ধরে রেখেছে।
–বাইরে যদি কারো সঙ্গে দেখা করতে হয় তাহলে নিউইয়র্কের কোনরাড মরগানের সঙ্গে দেখা করো। অপরাধীদের সংশোধিত জীবন-যাপন করার জন্য মরগান আন্তরিকভাবে সাহায্য করে।
বেটির ঠিকানা লেখা একটা কাগজ তুলে দিলে ট্রেসির হাতে।
ট্রেসি বলল–ধন্যবাদ আমার তেমন কোনো দরকার হবে না।
–না, কাগজের টুকরোটা রেখে দাও, বিশাল পৃথিবীতে কখন কাকে দরকার পড়ে আমরা কি আগে থেকেই হিসেব নিকেশ করতে পারি?
দুঘন্টা বাদে ট্রেসি জেলখানার দরজা দিয়ে বের হল। টেলিভিশনের ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে দুপাশে। সাংবাদিকদের সাথে সে কথা বলবে না। কিন্তু আমি তার মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে এসে ট্রেসিকে জড়িয়ে ধরল। একসঙ্গে সব কটি ক্যামেরা তখন অন হয়ে গেছে। সেদিন সন্ধ্যার খবরে এই দৃশ্যটই বার বার দেখানো হচ্ছিল।
সে ভালো পোশাক পরতে পারবে, ভালো দোকানে খেতে পারবে, ভালো সাবান মাখতে পারবে, শুধু তাই নয়, একটা নম্বর থেকে সে আবার নামে ফিরে এসেছে। স্বাধীনতার পাশাপাশি বিগবার্থার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াটাও বটে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ছকে ফেলতে হবে, ফিলাডেলফিয়াতে চার্লস স্ট্যানহোপ তৃতীয় দেখলো, ট্রেসি জেলখানা থেকে ছুটি পাচ্ছে। মনে মনে সে চিন্তা করলো, ও এখনও তেমনই সুন্দর। চার্লস বিশ্বাস করে ট্রেসিকে কোনোভাবে ফাঁসানো হয়েছে। যে আপরাধের জন্য তাকে জেলখানায় থাকতে হল, সেই অপরাধ সে কোনোদিনই করেনি। চার্লস তার আদর্শ স্ত্রীর দিকে একবার তাকলো, স্ত্রী আপন মনে সেলাই করে চলেছে। চার্লস মনে মনে ভাবলো শেষপর্যন্ত জীবনের জুয়া খেলাতে আমি হেরে গেলাম নাকি?
ড্যামিয়েন কুপার নিউইয়র্কে নিজের ফ্ল্যাটে বসে টেলিভিশনে এই ছবিটা দেখতে পেল। ট্রেসি জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে। টেলিভিশনটা বন্ধ করে সে নিজের কাজে মন দিল। জো রোমানো এই দৃশ্যটা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো, হুইটনি মেয়েটার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, জেলখানা থেকে ও ভালোভবে শিক্ষা পেয়েছে। আশা করি আমার সঙ্গে আর টক্কর নিতে আসবে না।
রোমানো মনে মনে খুবই খুশী। রেনোয়ার ছবিটাকে ইতিমধ্যে দেশের বাইরে চালান করে দিয়েছে। জুরিখের একজন শৌখীন সমঝদার সেটা কিনে নিয়েছে, নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় সাজিয়ে রাখার জন্য। বীমা কোম্পানীর কাছ থেকে পাঁচ লাখ পাওয়া গেছে, জুরিখের ওই ভদ্রলোক দিয়েছে দু-লাখ। অ্যান্টনি ওরসেত্তির সঙ্গে টাকাটা ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে। কারণ ওরসেত্তিকে সব ব্যাপারে বিশ্বাস করে রোমানো। লেনদেনের ব্যাপারে সামান্য গোলযোগ দেখা দিলে ওরসেত্তি যে কিভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠে, এর আগে বেশ কয়েকবার দেখতে পেয়েছে রোমানো।
সোমবার দুপুরবেলা, ট্রেসি এখন লুরিন হার্টফোর্ড সেজেছে। হাজির হয়েছে ফাস্ট মার্চেন্টস ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কটা গমগম করছে। সবকটা কাউন্টারের সামনে খদ্দেরদের লম্বা লাইন। লেস্টার টোরেন্সের জানলার সামনে তখন কয়েকজন কাস্টমার অপেক্ষা করছেন। ট্রেসি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। এগুতে এগুতে খাঁচার সমানে এসে গেল। লেস্টার বোধহয় এতক্ষণ ট্রেসির কথাই ভাবছিলেন। আঃ, মেয়েটাকে দেখে তাঁর সমস্ত মন খুশীতে ভরপুর হয়ে উঠল। আগের থেকেও মেয়েটাকে আরও সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে। শরীরে একটা আলগা চটক আছে। হায়, কবে ওই মেয়েটাকে আমি নিজের মতো করে পাবো?
–দেখো, কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না, কিন্তু তুমি যখন অসুবিধার কথা বলছে, তখন আমি না করে থাকতে পারলাম না।
ট্রেসি বুঝতে পেরেছে এবার মাছ তার জালে পড়েছে, খেলিয়ে খেলিয়ে তাকে ওপরে তুলতে হবে। সে মুখে হাসি আনলো, উষ্ণ আমন্ত্রণের ইশারা জাগালো তার দুটি চোখের তারায়। সে বলল–সত্যি আপনার তুলনা হয় না।
–এই নাও, ড্রয়ার খুলে চেকবই-এর বাক্স বের করলেন লেস্টার, ট্রেসির হাতে চারশো নতুন চেক তুলে দিলেন। বললেন–হবে তো? এতে কাজ হবে তো?
–যথেষ্ট, এবার লেস্টারের চোখে চোখ রেখে ট্রেসি বলল–আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
এই কথা শুনে লেস্টারের সমস্ত শরীরে একটা মৃত্যু শিহরণ বয়ে গেল। তিনি বললেন, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করার কোনো কারণ আছে কি? কি বলো লুরিন?
–খুবই সত্যি কথা বলেছেন আপনি।
–আচ্ছা তুমি কেন এখানে কোনো অ্যাকাউন্ট খোলোনি? আমি সবদিক দিয়ে সাহায্য করবো।
–আমি জানি আপনি সাহায্য করবেন, ট্রেসি মুখে একটা সপ্রতিভ ভাব দেখালো।
–একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে ডিনার খেতে খেতে এনিয়ে আলোচনা করলে কেমন হয়?
–খুবই ভালো হয়।
ট্রেসি তো তাই চাইছিল, যে করেই হোক লোকটাকে ফাঁদে ফেলতে হবে। যে কোন বাজে উদ্দেশ্যে সিদ্ধ করতে হলে ক্যাশিয়ারকে হাতে রাখতেই হবে।
–কোথায় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো লুরিন?
–কেন আপনি কষ্ট করবেন? আপনি কত ব্যস্ত মানুষ, আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবো।
লাইন থেকে সরে দাঁড়ালো ট্রেসি।–এক মিনিট, লেস্টার এখনই এই ব্যাপারটা পাকা করতে চান, তার আগে অন্য খদ্দের এক থলি খুচরো তুলে দিল লেস্টারের হাতে।
ব্যাঙ্কের মাঝখানে চারটে টেবিল পাতা, সেখানে টাকা জমা দেবার এবং তোলবার শ্লিপগুলো থাকবন্দী রাখা থাকে। টেবিলে ভীষণ ভীড়, লেস্টার যাতে দেখতে না পায়, এমন একটা কোণে সরে গেল ট্রেসি। একজন খদ্দের সরে যেতে ট্রেসি চেয়ারে বসে পড়ল। আটটা প্যাকেট ভর্তি ফাঁকা চেকগুলো লেস্টার দিয়েছিলেন একটি কাগজের বাক্সে করে। কিন্তু চেকের ব্যাপারে ট্রেসির কোনো আগ্রহ নেই। প্যাকেটগুলোর পেছনে দেওয়া জমা দেওয়ার শ্লিপগুলো তার দরকার।
ট্রেসি সাবধানে জমা দেওয়ার শ্লিপগুলোকে আলাদা করলে। তিন মিনিটের মধ্যে ওর হাতে আশিটা জমা দেওয়ার শ্লিপ চলে এল। কেউ তাকে লক্ষ্য করছে কিনা সে ভালোভাবে দেখলো। কুড়িটা শ্লিপ ধাতুর পাত্রে ঢুকিয়ে দিল।
পাশের টেবিলে গিয়ে আরও কুড়িটা শ্লিপ ওইভাবে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আশিটা শ্লিপ চালান হয়ে গেল। জমা দেবার এই শ্লিপগুলো ফাঁকা ছিল, কিন্তু তার তলার দিকে চুম্বক লাগানো অংশে নম্বর দেওয়া থাকে, কম্পিউটার যন্ত্র সহজেই গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে টাকাটা জমা করে দেয়। টাকাটা কে জমা দিচ্ছে সেটা দেখা কম্পিউটারের কাজ নয়, ওই শ্লিপগুলোর মাধ্যমে জো রোমানোর নামে টাকা জমা হয়ে গেল। ব্যাঙ্কে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ট্রেসি জানে দুদিনের মধ্যে চুম্বক লাগানো জমা শ্লিপগুলো কাজে লেগে যাবে। সত্যিকারের টাকা জমা দিয়েও এইভাবে শ্লিপ জমা দেওয়ার ব্যাপারটা ধরতে ধরতে পাঁচদিন লেগে যাবে। ট্রেসির যা কিছু ষড়যন্ত্র তা ওই পাঁচদিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে।
হোটেলে ফিরে ফাঁকা চেকগুলো নষ্ট করে ফেলল, এবার ট্রেসি গেল নিউ অর্লিয়েন্স হলিডে ট্রাভেল এজেন্সীর দপ্তরে। ডেস্কের পেছনে বসে থাকা এক যুবতী বলল, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
নিজের পরিচয় দিয়ে ট্রেসি বলল–আমি জোসেফ রোমানোর সেক্রেটারী। মিঃ রোমানো, রিও ডি জেনেরিওর একটা টিকিট চেয়েছেন, আগামী শুক্রবার পেলে ভালো হয়।
–একটাই টিকিট চাই?
–হ্যাঁ, ফার্স্ট ক্লাসের কোণের দিকে, আর যাতে সিগারেট খেতে পারেন সেই ব্যবস্থাও করতে হবে।
যুবতী কম্পিউটার নিয়ে বসলো, কয়েক মিনিট পড়ে বলল–সব ঠিক আছে, প্যান আমেরিকান প্লেনে ফার্স্ট ক্লাস টিকিট পাবেন। ফ্লাইট নাম্বার ৭২৮, সন্ধ্যে সাড়ে ছটার সময় টেক অফ।
ট্রেসি যুবতীটিকে আশ্বাস দেবার জন্য বলল, মিঃ রোমানো একথা শুনে খুবই খুশি হবেন।
–টিকিটের দাম পড়বে ১৯২৯ ডলার। টাকা কি নগদে দেবেন, না আমরা চার্জ করে নেব?
মিস্টার রোমানো সবসময় নগদে দেন। ওঁর অফিসে বৃহস্পতিবার টিকিট পৌঁছাতে হবে। সেখানেই টাকাটা দিয়ে দেওয়া হবে।
–ম্যাডাম, আমরা কি কাল টিকিট পাঠিয়ে দেব?
–না-না, কালকে মিস্টার রোমানো থাকছেন না। বৃহস্পতিবার ঠিক সকাল এগারোটায়, মনে থাকবে তো?
–ঠিক আছে। ঠিকানাটা?
–মিস্টার জোসেফ রোমানো, ২৭ পয়ড্রাস স্ট্রিট, সুইট নম্বর ৪০৮।
যুবতীটি সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিয়ে বলল, বৃহস্পতিবার সকালে টিকিট পৌঁছে যাবে।
একটু দূরে লাগেজ স্টোরস। দোকানে ঢোকার আগে জানলায় সাজানো বাক্স প্যাটরাগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ট্রেসি।
একজন কেরানী এগিয়ে এসে বলল–সুপ্রভাত ম্যাডাম, বলুন আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
ট্রেসি বলল, আমি আমার স্বামীর জন্য লাগেজ কিনতে চাই।
–ঠিক জায়গাতে এসেছেন। এখন আমরা ভালো জিনিস কম দামে ছেড়ে দিচ্ছি।
–না-না, কম দামী জিনিস আমি চাই না। দেওয়ালের গায়ে কতগুলো দামী স্যুটকেস সাজানো ছিল। সেই দিকে আঙুল তুলে ট্রেসি বলল–ওই ধরনের জিনিস চাই।
–সুন্দর জিনিস। আপনার স্বামীর পছন্দ হবে, এই জাতীয় স্যুটকেস তিনটি সাইজের হয়। কোনটা দেব আপনাকে?
একটুখানি চিন্তা করে ট্রেসি বলল–তিনটে সাইজের একটা করে দেবেন।
–ভালো কথা, আমরা বিল পাঠিয়ে দেব, নাকি আপনি নগদে দেবেন?
–ডেলিভারী দিলেই হবে, নাম জোসেফ রোমানো, বৃহস্পতিবার সকালে পৌঁছে দিতে হবে।
–নিশ্চয়ই দেব মিসেস রোমানো।
–সকাল এগারোটার সময়।
–আমি নিজে যাব।
–তাহলে তো খুব ভালো হয়। একটু ভেবে ট্রেসি আবার বলল, স্যুটকেসের গায়ে J. R. অক্ষরদুটো লিখে দেওয়া যায় কি?
–নিশ্চয়ই যায়। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।
ট্রেসি একটু হেসে জোসেফ রোমানোর অফিসের ঠিকানাটা ওই ছেলেটির হাতে তুলে দিল। সেখান আর এক মুহূর্ত থাকল না।
তারপর কাছের একটা পোস্টাফিস থেকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাল। টেলিগ্রামটি রিও ডি-জেনেরিওর কোপাব্লাঙ্কা বিচের রিও ওখোল প্যালেস-এর বিখ্যাত হোটেলে।
ট্রেলিগ্রামে বলা হল, শুক্রবার থেকে দুমাসের জন্য আপনাদের হোটেলের সব থেকে ভালো সুইটটা আমার নামে বুক করতে হবে। টেলিগ্রামে টাকার অঙ্কটা জানিয়ে খবর দেবেন। জোসেফ রোমানো, ২৭ পয়ড্রাস স্ট্রিট, স্যুইট নম্বর ৪০৮, নিউ অর্লিয়েন্স লুইস্পিনিয়া, ইউ. এস. এ।
তিনদিন বাদে ট্রেসি ব্যাঙ্কে ফোন করল। লেস্টার টোরেন্সের সাথে যোগাযোগ করে মিষ্টি ভাষায় বলল, আমাকে হয়তো আপনার মনে নেই। আপনি যা ব্যস্ত মানুষ, আমি মিস্টার রোমানোর সেক্রেটারী লুরিন হার্টফোর্ড বলছি।
লেস্টার মনেপ্রাণে এমন একটি ফোনের জন্য অপেক্ষাতে ছিলেন। তিনি হৈ-হৈ করে বললেন, মনে নেই মানে? নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই মনে আছে তোমাকে। তোমাকে যে একবার দেখবে, তার মনের প্রেক্ষাপটে তোমার ছবি চিরদিনের জন্য ধরা থাকবে।
–মনে আছে? কী আশ্চর্য, আপনাকে রোজ তো কত কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
কিন্তু ম্যাডাম, অপরাধ নিও না। তোমার মতো আর কেউ নয়, তুমি কি ডিনার খাবার কথাটা ভুলে গেছো।
–না, আমি ছটফট করছি, আগামী মঙ্গলবার কি আপনার সময় হবে?
–হ্যাঁ, সময় হবে।
–তারিখ তা হলে পাকা রইল। আহা, আমি একটা বোকা গঙ্গারাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এত উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, আসল খরবটা নেওয়া হয়নি। মিস্টার রোমানো জানতে চাইলেন, তার অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে। আপনি কি বলতে পারবেন?
লেস্টার টেরেন্স এ ধরনের খবর কাউকে দিতে চান না। ব্যাঙ্কের নিয়মনীতিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। কিন্তু এখন তিনি অত্যন্ত উদার। তিনি বললেন, অনুগ্রহ করে ফোনটা একটু ধরবেন কি?
লেস্টার উঠে গিয়ে অ্যাকাউন্ট বইটা দেখে এলেন। এই একটা ব্যাপারে খুব আশ্চর্য লাগল তার, গত কয়েকদিন ধরে মিস্টার জোসেফ রোমানো প্রচুর টাকা জমা দিয়েছেন। এর আগে রোমানো তো এত টাকা কখনো রাখেননি। তাহলে কোনো একটা অঘটন কি ঘটতে যাচ্ছে? লুরিনের পেট থেকে সব কথা বের করতে হবে ডিনারের সময়।
ফিরে এসে ফোনটা তুলে ট্রেসিকে বললেন–তোমার সাহেব আমাদের খুব ব্যস্ত করে তুলেছেন। ওনার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে প্রায় তিন লক্ষ ডলার জমা আছে।
–ঠিক আছে, হিসাবের সাথে একদম মিলে যাচ্ছে।
–তাহলে মঙ্গলবার?
–আমি ফোন করে জায়গাটা ঠিক করে রাখব, ডার্লিং। মিষ্টি করে বলল ট্রেসি। কিন্তু এই সম্পর্কটা বোধহয় ওখানেই ছিন্ন হয়ে গেল।
এবার আমরা আর এক অপরাধী অ্যান্টনি ওরসেক্তির কাছে যাব। পয়ড্রাস স্ট্রিটের ওপর একটি অকাশ ছোঁয়া বাড়ির মালিক তিনি। একদিকে নদী, অন্য দিকে লুইসিনিয়ার বিখ্যাত সুপারড্রাম। প্যাসিফিক এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানীর অফিস এই বাড়ির পাঁচতলাটা দখলে রেখেছে। এরই একপ্রান্তে ওরসেত্তির অফিস। ঠিক বিপরীত দিকে জো রোমানোর অফিস। মাঝের বিশাল হলঘরে চারজন মহিলা রিসেপশনিস্টকে দেখা যায়। এরাই আবার সন্ধ্যেবেলা ওরসেত্তির বন্ধু বা খদ্দেরদের সঙ্গ দেয়। ওরসেত্তির ঘরে দুটো বিশাল দেহী মানুষ বসে থাকে। তারা হল ওরসেত্তির দেহরক্ষী, ড্রাইভার এবং মালিশওলা। মাঝে মধ্যে তারা ওরসেত্তির ফাঁই ফরমাস খাটে।
বৃহস্পতিবার সকালবেলা, ওরসেত্তির নিজের অফিসঘরে বসে আগের দিন কত টাকা জমা হয়েছে, তার হিসাব নিকাশের ওপর চোখ বোলাচ্ছিল। প্যাসিফিক এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানী যে কত রকমের ব্যবসা করে সে বোধহয় নিজেও তার খবর রাখে না।
ওরসেত্তির বয়স ষাটের কোটার শেষের দিকে। তার শরীরের গঠনটা অত্যন্ত বিচিত্র, ওপরের অংশটা বিশাল। পা দুটো সেই তুলনায় ছোটো এবং রোগা। সে যখন দাঁড়ায়, তখন মনে হয় একটা ব্যাঙ বোধহয় উঠে দাঁড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। মুখে অসংখ্য কাটাকুটির চিহ্ন। চট করে দেখলে একটা মাতাল মাকড়সার কথা মনে পড়ে যায়। প্রচুর মদ গিলে বেচারা মাকড়সা এলোমলো পায়ে হেঁটে গেছে তার মুখের ওপর দিয়ে। মুখের হাঁটা বড্ড বড়ড়া, ঠোঁটটা কালো। পনেরো বছর বয়েস থেকে তার মাথার চুল পাতলা হতে শুরু করেছে। তারপর থেকে সে কালো পরচুল পরে থাকে। এটা তাকে মোটেই মানায় না। কিন্তু মুখের ওপর সত্যি কথাটা বলবে কে?
তার চোখের দৃষ্টি পাকা জুয়াড়ির মতো। কখনো সেখানে কোনো আবেগের খেলা দেখা যায় না। মনে হয় সে যেন নিস্পন্দ চোখের তারা দিয়ে কাউকে ভালো ভাবে দেখার চেষ্টা করছে। যখন সে তার পাঁচ মেয়ের সঙ্গে থাকে তখন চোখের দৃষ্টিতে স্নেহ আর ভালোবাসা ঝরে পড়ে। ওরসেত্তির মনের কথা বুঝতে হলে তার কণ্ঠস্বর শুনতে হবে। এমনিতে তার গলা বেশ কর্কশ, একুশ বছরের জন্মদিনে তার গলায় তার জড়িয়ে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন থেকে সে খ্যাড়খেড়ে কণ্ঠস্বরের অধিকারী হয়েছে। যে দুজন ভুল করে ওই কাজটা করেছিল, দুদিনের মধ্যে তাদের মৃতদেহ মর্গে জমা পড়ে যায়। কিন্তু ওরসেত্তির এর পর থেকে আর জোরে কথা বলতে পার না।
নিউ অর্লিয়েন্স হল ওরসেত্তির রাজত্ব। ঘুষ, বন্দুক, আর ব্ল্যাকমেলকে সঙ্গী করে সে তার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। নানাজনের কাছ থেকে ভোলাবাবদ যা পায়, তা সংগ্রহ করে আজ শহরের এক মস্ত বড়ো ধনী। অন্য দলের কাঁপোনরা ওরসেত্তিকে মহাগুরু বলে সম্মান করে। বিপদে আপদে তার কাছে আসে শলা-পরামর্শ করার জন্য।
সেদিন সকালে মনটা বেশ খুশিখুশি ছিল ওরসেত্তির। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছে। লেকভিটা অঞ্চলের ফ্ল্যাটে তার রক্ষিতার কাছে গিয়ে। সপ্তাহে তিনদিন নিয়ম করে সে ওই ফ্ল্যাটে যায়। আজ সকালের মধুর স্মৃতিতে তার মন এখনো আচ্ছন্ন। ব্যবসাপত্র বেশ ভালোই চলছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। ওরসেত্তি জানে, সমস্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে তার সমাধান করতে হয়। আর একটা ব্যাপারে সে অসম্ভব চালাক। যদি লোকের মধ্যে বৈরীতার সামান্য চিহ্ন দেখা দেয়, তখনই সে লোকটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। এ ব্যাপারে সে কারো সাথে আপোস করে না।
ওরসেত্তির ডান হাত হল জো রোমানো। দুজনের স্বভাব চরিত্রে দারুণ মিল আছে। তাই একে অন্যকে অসম্ভব ভালোবাসে। জো রোমানো ছোটো থেকেই পকেটমারের কাজে যথেষ্ট নাম করেছিল। তখনই সে ওরসেত্তির নজরে পড়ে যায়। এবার ওরসেত্তি জো রোমানোকে শিখিয়ে পড়িয়ে বড়ো করে তুলেছে। ওরসেত্তির কাছে জো রোমানো প্রায় ছেলের মতোই। জো রোমানো ওরসেত্তিকে খুবই বিশ্বাস করে। ওরসেত্তির পৃষ্ঠপোষকতায় সে আজ এতদূর অগ্রসর হতে পেরেছে। গত দশ বছর ধরে সে ওরসেত্তির ডান হাত হিসাবে কাজ করছে।
দরজায় টোকা দিয়ে ওরসেত্তির প্রাইভেট সেক্রেটারী লুসি ঘরে ঢুকল। মেয়েটার বয়েস চব্বিশ বছর, গ্রাজুয়েট, দেখতে দারুণ, সুন্দরী, স্থানীয় কয়েকটা বিউটি কনটেস্টে প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পেয়েছে। সত্যিই তাক লাগানো রূপের বাহার তার, নিজেকে কেমন করে আরো আবেদনময়ী করে তুলতে হয়, মেয়েটি সেটা ভালোভাবেই জানে। আমরা আগেই বলেছি, ওরসেত্তি সবসময় সুন্দরী মহিলাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে দিন কাটাতে ভালোবাসে। অবশ্য এটা হল তার ব্যবসার একটা কৌশল। এভাবেই সে রূপসী মেয়েদের টোপ হিসাবে ব্যবহার করে।
ওরসেত্তি ঘড়ির দিকে তাকাল। দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। লুসিকে বলা আছে দুপুরের আগে যেন তাকে বিরক্ত না করা হয়। তাকে এই সময় আসতে দেখে ওরসেত্তি খুবই অবাক হয়ে গেল। চোখের তারায় অসংখ্য বিরক্তি এনে সে প্রশ্ন করল–কী হয়েছে?
–আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কে একজন মিস গিগি দুপ্রেস ফোন করেছে। মনে হয় মেয়েটার মাথা খারাপ। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ও বারবার ফোনে আপনাকেই চাইছে।
ওরসেত্তি তার মনের কমপিউটার চালু করল। গিগি দুপ্রেস? এই জীবনে অসংখ্য মেয়ের সঙ্গে সঙ্গত করেছে সে। একবার ভাবল, লাসভেগাসে মনে হয় ওই মেয়েটির সঙ্গেই রাত কাটিয়ে ছিল। নাঃ, নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, যাই হোক, কে বলছে, কি বলছে, একবার শোনা দরকার, ওরসেত্তি ফোনটা তুলল। চোখের ইঙ্গিতে লুসিকে চলে যেতে বলল।
–হ্যাঁ, কে বলছো?
–আপনি কি মিস্টার অ্যান্টনি ওরসেত্তি? মেয়েটির গলায় ফরাসী টান আছে। ফরাসী মেয়েরা আরো বেশী যৌন আবেদনময়ী হয়ে থাকে। ওরসেত্তির মন বিহ্বল, মুহূর্তের জন্য চিন্তা করল।
–যদি তাই হয়?
–ভগবানকে ধন্যবাদ, শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হল। ঠিকই বলেছে সেক্রেটারী, মেয়েটির মাথায় গোলমাল আছে। যাই হোক কী বলছে শুনতে হবে। ওরসেত্তি ঠান্ডা মাথায় ভাবল।
–ওকে যেমন করে পারেন, থামান।
–দেখুন ম্যাডাম, আপনাকে আমি চিনি না। কিন্তু আপনি কী বলছেন, তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
–আমি আমার জো-এর কথা বলছি। জো রোমানো। ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে বলেছিল, আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?
–জো রোমানোর সঙ্গে আপনার যা গোলমাল সেটা আপনারা দুজনে মিটিয়ে নিন। আপনাদের দুজনেরই বয়েস হয়েছে, এব্যাপারে আমাকে মিছিমিছি টেনে আনছেন কেন?
–ও আমাকে মিথ্যে বলেছিল, আমি এইমাত্র খবর পেলাম, ও ব্রাজিল চলে যাচ্ছে। আর তিন লাখ ডলারের অর্ধেকটা আমার, কিন্তু আমাকে কিছু জানায়নি।
হঠাৎ ওরসেত্তির মনে হল, ব্যাপারটার মধ্যে রহস্যের গন্ধ আছে। সে জানতে চাইল,–আপনি কোন্ তিন লাখ ডলারের কথা বলছেন?
–যে টাকাটা জো তার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে রেখেছে। মানে যে টাকাটা…
ওরসেত্তির মুখ চোখ গম্ভীর হল। এবার সে রহস্যের চক্রব্যুহে প্রবেশ করতে চাইছে। সে বলল, দেখা যাক, আপনার জন্য কী করতে পারি ম্যাডাম।
জো রোমানোর অফিস ঘরটা খুবই আধুনিক। দেওয়ালে হালকা বিস্কুট রঙের প্রধান্য। কয়েকটা দামী পেন্টিং সুন্দরভাবে সাজানো–এ নিয়ে রোমানোর গর্ব আছে। শহরের বস্তি থেকে এতদূর পথ পার হয়েছে সে, অহংকার তো হবেই। মোটামুটি লেখাপড়াও শিখে নিয়েছে। ছবির কদর করে। সঙ্গীত শিল্পীদের সম্মান করে। মদ খায়, অন্যরা সেখানে গায়ের জোর খাঁটিয়ে কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করে জো রোমানো বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজ হাসিল করে। সত্যি যদি এই কথা মেনে নেওয়া হয়, যে নিউ অর্লিয়েন্সের আসল রাজা ওরসেত্তি তবে আর একটা সত্যি আমাদের স্বীকার করতে হবে–। তা হল, ওই রাজ্যে জো রোমানো হল প্রধানমন্ত্রী।
জো রোমানোর সেক্রেটারী ঘরে ঢুকে জানাল মিস্টার রোমানো, একজন লোক রিও-ডি-জেনেরিওর প্লেনের টিকিট নিয়ে এসেছে। টাকাটা ওকে দিয়ে দেব কি?
–রিও-ডি-জেনেরিও? রোমানো অবাক হয়ে তাকাল, বলে দাও–ওরা ভুল করেছে।
উর্দি পরা একজন লোক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, আমাকে এই টিকিটটা |||||||||| জো রোমানোর অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
–দেখো, কেউ হয়ত ভুল করেছে, নাকি বিমান কোম্পানী নতুন একটা কয়দা কানুন বের করল। এভাবে ওরা কাস্টমারদের বোকা বানচ্ছে নাকি?
–না, স্যার। আমি…
জো রোমানো হাত বাড়িয়ে টিকিটটা নিল। শুক্রবারের টিকিট। আমি হঠাৎ শুক্রবার রিও-ডি-জেনেরিওতে যাব কেন?
–কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে, টিকিটটা লোকটির হাতে তুলে দিতে দিতে জো রোমানোনা মন্তব্য করল-যাও, ফেরত নিয়ে যাও।
–না-না, এত তাড়াতাড়ি নয়, বলতে বলতে ওরসেত্তি ঘরে ঢুকে পড়ল। টিকিটটা হাতে তুলে নিল।
–এই যে এতে লেখা আছে, ফাস্ট ক্লাসের টিকিট, সিগারেট খাওয়া চলবে, রিও ডি-জেনেরিও শুক্রবার। শুধু যাবার টিকিট, রিটার্ন টিকিট কাটা হয়নি।
জো রোমানো হেসে বলল, ভুল করে পাঠানো হয়েছে।
তারপর সেক্রেটারীর দিকে ঘুরে বলল–ঐ ট্রাভেল এজেন্সিকে ডেকে বলে দাও তো। দেখো, কোন বেচারার টিকিট আমার ঘাড়ে পড়েছে, ব্যাপারটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো গোলমাল আছে।
ঠিক এই সময় সহকারী সেক্রেটারী জোলীন ঘরে এসে বলল, আমাকে মাপ করবেন স্যার, সুটকেসগুলো এসে গেছে। আমি কি সই করে নিয়ে নেব?
জো রোমানো হাঁ করে তাকিয়ে রইল।সুটকেস? স্যুটকেসের অর্ডার তো আমি দিইনি ।
সকাল থেকে কী হচ্ছে?
ওরসেত্তি হুকুম দিল স্যুটকেসগুলো এখানে নিয়ে এসো।
রোমানো বোকার মতো মন্তব্য করল–কী ব্যাপার বলো তো? সকলের একসঙ্গে মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
দোকানের কর্মচারী তিনটে স্যুটকেস নিয়ে ঘরে ঢুকল। ডেলভারী স্লিপটা পড়ে সে বলল–এতে লেখা আছে, মিস্টার জোসেফ রোমানো, ২৭, পয়ড্রাস স্ট্রিটে পৌঁছে দিতে হবে। সুইট নম্বর ৪০৮।
এবার জো রোমানো সত্যি সত্যি ক্ষেপে গেছে। কাহাতক এই রঙ্গ রসিকতা সহ্য করা যায়? সে বলল, তুমি আমার চোখের সামনে থেকে এখনই দূর হয়ে যাও। আমি কোনো কিছুর অর্ডার দিইনি।
ওরসেত্তি স্যুটকেসগুলো পরীক্ষা করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল–কিন্তু জো, এতে তোমার নাম লেখা আছে!
–কী বললেন? দাঁড়ান, মনে হচ্ছে, কেউ উপহার পাঠিয়েছে।
–আজ কি তোমার জন্মদিন?
–না, তবে মেয়েদের তো আপনি ভালো করেই চেনেন, কোনো গায়ে পড়া মেয়ে হয়তো আমার সঙ্গে আরও একটু বেশী আলাপ জমাতে চাইছে। তাই উপহার পাঠানোর এই সরল সহজ পথটাই সে গ্রহণ করেছে।
কথা শেষ হবার আগে ওরসেত্তি বলল–তুমি কাল ব্রাজিল যাচ্ছো কেন?
–ব্রাজিল? কেউ ঠাট্টা করেছে।
অদ্ভুত হেসে ওরসেত্তি দুজন সেক্রেটারী আর দুজন লোককে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলল। তারপর জানতে চাইল-ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে জো?
একটু সামলে নিয়ে জো রোমানো বলল–জানি না, হাজার দেড়েক, কী দুয়েক হবে।
–পরীক্ষা করার জন্যই বলছি, তুমি কি একবার ব্যাঙ্কে ফোন করে দেখবে?
–কী জন্য?
–দেখোই না একবার।
–বেশ। জো রোমানো তার সেক্রেটারীকে ফোন করে বলল, ফার্স্ট মার্চেন্টস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টট্যান্টকে ফোনে দাও তো।
এক মিনিট বাদে ব্যাঙ্কের ফোন বেজে উঠল–আমি জোসেফ রোমানো বলছি। আমার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, জানাবেন কি? আমার জন্ম তারিখ ১৪ই অক্টোবর।
শেষেরটা কোড নম্বর। ওরসেক্তির ফোনের এক্সটেনশান লাইনটা ধরল। একটু বাদে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জানাল, আপনার অ্যাকাউন্টে তিন লাখ ন হাজার পাঁচ ডলার সাঁইত্রিশ সেন্ট আছে মিস্টার রোমানো।
রোমানোর মনে হল, তার শরীরের সমস্ত রক্ত কে বুঝি শুষে নিচ্ছে। সে আরো একবার প্রশ্ন করল-কত বলছেন?
–তিন লাখ ন হাজার পাঁচ ডলার সাঁইত্রিশ সেন্ট।
–বুদ্ধ কোথাকার, কার অ্যাকাউন্ট কার ঘাড়ে চাপাচ্ছিস। আমি এখনই তোর চাকরির বারোটা বাজিয়ে দেব। তুই এখনই ম্যানেজারকে লাইনটা দে।
রেগে গেলে রোমানো এইভাবেই তুই তুকারি করতে শুরু করে। কিন্তু রোমানোকে। আর কোনো কথা বলতে দিল না ওরসেত্তি। সে বুঝতে পারল, কোথাও একটা গভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সে চট করে রিসিভারটা রোমানের হাত থেকে কেড়ে নিল।
–এই টাকাটা তুমি কোথা থেকে পেলে জো?
–বিশ্বাস করুন, ভগবানের নামে দিব্যি করে বলছি, এই টাকার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
–ঠিক করে বলো।
এবার কঠিন চোখে জো রোমানোকে জরিপ করতে থাকে ওরসেত্তি। ওরসেত্তি বুঝতে পেরেছে, এবার বিশ্বাসের পাথরে ফাটল ধরেছে, এর শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়তে হবে।
জো রোমানো তখন ঝরা পাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে আত্মপক্ষ সমর্থনের শেষ চেষ্টা করছে। সে বলছে, বিশ্বাস করুন আমাকে, আপনি তো বহুকাল ধরে আমাকে চেনেন। কেউ বোধহয় আমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে।
–ওই কেউ তোমাকে খুবই ভালাবাসে। সে নিশ্চয়ই তোমাকে তিন লক্ষ ডলার ধারে দিয়েছে।
ওরসেত্তি একটা বড়ো সোফায় গা এগিয়ে দিল। আবার জোকে নজর বন্দী করল। বলতে লাগল–সব কিছু ঠিকঠাক করা আছে।
তাই নাকি? সব ঠিকঠাক করা আছে। রিও-ডি-জেনেরিওতে যাবার টিকিট, স্যুটকেস, মনে হচ্ছে তুমি নতুন করে জীবনটা শুরু করতে চাইছো।
–না, রোমানো আর্তনাদ করে উঠল। আপনি তো জানেন, আমি কখনো আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিনি। আমার কাছে আপনি বাবার মতো।
জো রোমানো ঘামতে শুরু করেছে। এমন সময় দরজায় টোকা। সেক্রেটারী মাথা বাড়াল, হাতে একটা খাম, দুঃখিত, আপনার নামে একটা কেবল আছে। আপনাকেই সই করতে হবে।
জো রোমানো এবার বোধহয় সত্যি সত্যি ফাঁদে পড়েছে। মরিয়া হয়ে সে বলল–এখন না, আমি ব্যস্ত আছি।
ওরসেত্তি সই করে সেটা নিয়ে নিল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কেবলটাতে চোখ বোলাল।
মর্মভেদী দৃষ্টিতে জো রোমানোর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ওরসেত্তি বলল–আমি পড়ে শোনাচ্ছি জো, তুমি শুনতে পারবে তো? এই শুক্রবার, পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে দুমাসের জন্য আমাদের প্রিন্সেস সুইটটা আপনার জন্য রিজার্ভ করা হল। সই আছে এস মন্তালবান্দ, ম্যানেজার, রিও ওখোল, কোপাব্লাঙ্কা বিচ, রিও ডি জেনেরিও। কি জো, এবার তুমি বলবে সব কিছু মিথ্যে? তবে মনে রেখো, তুমি কিন্তু সাপের গর্তে পা দিয়েছ।
.
১৩.
আন্দ্রে গিলিয়ান রান্না ঘরে খাবার বানাতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ দুম করে শব্দ হল। এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্রটা থেমে গেল।
আন্দ্রে এই ঘটনাতে খুবই বিরক্ত। সে বলল–ধ্যুৎ, আজকে খেলার দিন, আজকে এমন ঘটনা ঘটলে চলবে কেমন করে?
সুইচগুলোতে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল সে। এটা-ওটা টিপে এয়ার কন্ডিশনারটা চালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু মেশিনটা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে।
তার মানে মিস্টার পোপ আজ দারুণ ক্ষেপে যাবে। আন্দ্রে জানে ওর মালিক শুক্রবারের রাতগুলোর জন্য সাদর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। প্রতি শুক্রবার এই বাড়িতে পোকার খেলা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে এই বাড়িতে খেলাটি চলে আসছে। শহরের বিশেষ মানুষেরা সেই খেলাতে যোগ দেন। এয়ার কন্ডিশনার কাজ না করলে গরমে খেলা অসহ্য হয়ে উঠবে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর মাসে নিউ অর্লিয়েন্সে যা গরম পড়ে।
আন্দ্রে ঘড়ি দেখল, চারটে বাজতে চলেছে, রাত সাতটা থেকে অতিথিরা আসতে শুরু করবেন। প্রথম সে ভাবল, মিস্টার পোপকে একটা ফোন করবে। তারপর মনে পড়ল উনি আজ সারাদিন কোর্টে ব্যস্ত থাকবেন। এত খাটাখাটনির পর একটু বিনোদনের আসর না বসালে বাঁচবেন কেমন করে?
টেলিফোনের বই দেখে একটা নাম্বারে ফোন করল আন্দ্রে। এক্সিনো এয়ার কন্ডিশনার সার্ভিস।
ফোন ধরেই মেয়ে রিসেপসনিস্ট মুখস্থ করার মতো গড়গড় করে বলে গেল–এই মুহূর্তে মেকানিক নেই, নাম-ঠিকানা দিয়ে রাখুন, এলেই পাঠিয়ে দেব।
রাগে গড়গড় করতে করতে আন্দ্রে পেরী পোপের নাম ঠিকানা জানাল। বলল, এখুনি যেন মেকানিককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আন্দ্রে গিলিয়ান তিন বছর ধরে রাঁধুনির চাকরি করছে। সে জানে, তার মনিবের ক্ষমতা অসীম। এত কম বয়েসে এত বুদ্ধি রাখতে আর কাডিকে দেখেনি সে। নামকরা লোকেরা পর্যন্ত তার মনিবের কথায় ওঠা-বসা করে। লোককে সম্মোহিত করে রাখার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর মনিব ইতিমধ্যেই করায়ত্ত করেছেন।
গরম ধীরে ধীরে বড়ছে। রান্নার কাজটা এগিয়ে রাখতে হবে। আন্দ্রে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আধ ঘন্টাবাদে ঘন্টার আওয়জ হল। আন্দ্রে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। কোম্পানীর পোশাক পরা দুজন লোক এসেছে। তাদের হাতে যন্ত্রপাতির বাক্স। একজন কালো চামড়ার,
অর্থাৎ নিগ্রো অন্য জন সাদা চামড়ার।
নিগ্রো লোকটি জিজ্ঞেসা করল–এয়ার কন্ডিশনার খারাপ হয়েছে?
–হ্যাঁ, ভাগ্য ভালো তোমরা এসে গেছে। একটু তাড়াতাড়ি করো। কিছুক্ষণ পর থেকেই নিমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করবেন।
আন্দ্রে দুজন মেকানিককে নিয়ে গেল সেই ঘরে, যেখানে এয়ার কন্ডিশনারটা আছে। নিগ্রো মিস্ত্রীটি যন্ত্রের তলার দিকটা খুলে কী সব দেখে নিয়ে মন্তব্য করল ঝঞ্ঝাটটা এখানে নেই, অন্য কোথাও আছে, যেখান দিয়ে হাওয়া ঢোকে সেই গর্তে।
আন্দ্রে জানাল, এই বাড়ির প্রত্যেকটা ঘরে এয়ার কন্ডিশনার আছে। তাই মোট ফোকরের সংখ্যা আট-নটার কম হবে না।
ওগুলো একে একে দেখার জন্য আন্দ্রে মেকানিক দুজনকে নিয়ে বসার ঘরে মধ্যে দিয়ে আর একটা ঘরে যাচ্ছিল। বসার ঘরটা বেশ বড়ো এবং সুন্দর সাজানো। বাঁদিকে খাবার ঘর, ডানদিকে আড্ডা মারার ঘর। সেখানে তাস খেলার টেবিল পাতা। ওই ঘরে ছাদের কাছে এয়ার কন্ডিশনারের গর্তটা দেখল তারা।
তাস খেলার টেবিলের ওপরের ছাদ দেখে মেকানিকরা বলল–এই ঘরের ওপর কী আছে?
–চিলেকোঠা।
–ওখানে একবার যেতে হবে। আন্দ্রে একটা ঘরে নিয়ে গেল। এতকোণে একটা ইলেট্রিক ফিটিংস-এর তারগুলো জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে।
পেয়েছি। আন্দ্রে তাড়াতাড়ি করে জানতে চাইল–ঠিক হয়ে যাবে তো সব?
–নিশ্চয়। তবে একটু সময় লাগবে। মনে হচ্ছে কনডেনসার খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের কাছে নতুন কনডেনসার আছে, এখুনি লাগিয়ে দেব।
–একটু তাড়াতাড়ি করো ভাই। মিস্টার পোপ এখুনি ফিরে আসবেন। তিনি যা রগচটা মানুষ, খেটেখুটে ফিরে এসে যদি এই অবস্থার সামনে তাকে পড়তে হয়, তাহলে অবস্থা খুবই খারাপ হবে।
–আমাদের হাতে ভার দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত মনে তোমার কাজ করো।
সাদা মেকানিক আশ্বাস দিল আন্দ্রেকে।
ওরা দুজন আবার নেমে গেল। ট্রাক থেকে দুটো বড়ো বড়ো ব্যাগ নিয়ে উঠে এল চিলেকোঠায়। আন্দ্রে রয়ে গেল রান্না ঘরে।
এবার আমরা দুজন মেকানিকের পরিচয় দেব। নিগ্রোটির নাম অ্যাল, সাদা চামড়ার নাম র্যালফ। ওরা চিলেকোঠায় এসে ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা একটি ক্যাম্প চেয়ার বের করল। বের করল একটা ড্রিল মেশিন। স্যান্ডউইচ খাবার ট্রে, দু টিন বিয়ার, একটি শক্তিশালী বাইনোকুলার, যা দিয়ে অল্প আলোতেও সব কিছু দেখা যায়। আর বের করল, দুটি জ্যান্ত ইঁদুর। যাদের ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
এবার ওরা দুজন একমনে কাজ করতে শুরু করল।
নিগ্রো অ্যাল কাজ করতে করতে মনের আনন্দে কথাটা বলল–এবার আর্নেস্টাইন আমাকে বাহবা দেবেই।
প্রথমে অ্যাল কিন্তু পুরো ব্যাপারটাতে আপত্তি জানিয়ে ছিল।
–তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কোথাকার কে পেরী পোপ, তাঁর জন্য আমি কেন ছুটতে যাব? আর যদি একবার ধরা পড়ি, তা হলে?
–ওকে ভয় পাবার কিছু নেই। ও কোনো দিনই কারোর পেছনে লাগবে না। আল আর আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপ কথা বলছিল লিটলচ্যাপের ফ্ল্যাটে বসে।
–এতে তোর কী লাভ হবে? অ্যাল জানতে চাইল।
–পেরী পোপ লোকটা খচ্চর। জন্মের ঠিক নেই। বেজন্মার বাচ্চা।
এই কথা শুনে অ্যাল হেসে উঠল হো-হো করে। বলেছিল–এই পৃথিবীর অদ্ধেক লোকই তাই। তাদের শাস্তি দেবার দায়িত্ব কেন আমি মাথার ওপর নেব।
–এই কাজটা আমি করতে চাইছি আমার বন্ধুর জন্য। লিটলচ্যাপ শেষ পর্যন্ত বলে–বসল।
–ট্রেসি?
–হ্যাঁ।
ট্রেসিকে অ্যালের পছন্দ হয়েছিল। সেদিন ট্রেসি জেল থেকে ছাড়া পায়, সেদিন তিনজন একসঙ্গে ডিনার খেয়েছিল।
–ভদ্রবাড়ির মেয়ে কিন্তু তাই বলে, ওর জন্য আমি এতটা বিপদের ঝুঁকি নেব? অ্যাল আমতা আমতা করতে থাকে।
–এই জন্য যে ওকে আমরা সাহায্য করতে না পারলে ও অন্য কারো কাছে চলে যাবে। সে তোর মতো ভালো কাজ করতে পারবে না। আর যদি ও ধরা পড়ে যায়, তাহলে চরম সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এবার সত্যি অ্যাল অবাক হল। সে বলল–লিটলচ্যাপ, মেয়েটাকে তুমি সত্যি ভালোবাসো।
-হ্যাঁ।
লিটলচ্যাপ কতটা ভালোবাসে, সেটা অ্যালকে বোঝানো মুশকিল। তবে ভালোবাসার থেকে বড় কথা হল, ট্রেসি ধরা পড়লে আবার তাকে জেলে যেতে হবে এবং এবার সে নিশ্চিতভাবে বিগবার্থার, খপ্পরে পড়বে। ব্যাপারটা লিটলচ্যাপের কাছে মোটই ভালো লাগবে না। ট্রেসিকে লিটলচ্যাপ আশ্রয় দিয়েছে, বিগবার্থার হাত থেকে তাকে বাঁচাতেই হবে। বিপদের দিনে সত্যি সত্যি তার পাশে বান্ধবী হিসেবে দাঁড়াতে হবে। সে বলল অ্যাল, একাজটা তোমাকে করতেই হবে।
এটাই হল লিটলচ্যাপের একটা অদ্ভুত স্বভাব। আদরের আতিশয্যে মাঝে মধ্যে সে তার হবু স্বামীকে তুই-তুকারি করতে ভালোবাসে আবার কখনো তুমি বলে সম্মান দেয়।
অ্যাল বলল–এই কাজটা আমি একা করতে পারব না।
তার গলার স্বরে পরিবর্তন এসেছে। খুশী হয়েছে লিটলচ্যাপ। তার মানে অ্যাল গররাজী।
অ্যালকে একটু বেশী মাত্রায় আদর করতে শুরু করলো। সে বলল–আচ্ছা র্যালফ কয়েক দিনের জন্য ছাড়া পেয়েছে নাকি?
অতএব জুটি বেঁধে গেল। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার মধ্যে অল আর র্যালফ চিলেকোঠার কাজ সেরে রান্নাঘরে আন্দ্রের কাছে গিয়ে হাজির হল।
–কাজ হয়ে গেছে?
–দারুণ ঝাটের কাজ ছিল, এখানে একটি এসি-ডিসি কনডেনসার আছে।
অ্যালের কথা শেষ হবার আগে আন্দ্রে ব্যস্ত হয়ে বলল–ওসব কথা পরে শুনব আগে বলল কাজটা হয়েছে কিনা?
–পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করবে ওই এয়ার কন্ডিশনার।
–আঃ বাঁচালে, কী বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ দেব। আমি তো আমার মনিবের, কথা ভাবছিলাম, বিলটা রেখে যাও।
–বিল কোম্পানী পাঠাবে। অমায়িক ভাবে অ্যাল বলল।
–ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ। আন্দ্রে তাড়াতাড়ি রান্না সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেকানিক দুজন ব্যাগ দুটো নিয়ে ভ্যানে চড়েছে। গেটের বাইরে গাড়ি রেখে অ্যাল চুপটি করে বাগান পেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্রের একটি তার খুলে রেখেছিল। সেটা আবার লাগিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মেশিন চালু হয়ে গেল।
কনডেনসারের সঙ্গে লাগানো কাগজে যে সার্ভিস টেলিফোনের নম্বর লেখা, সেটা ছোট্ট একটা কাগজে টুকে নিল। একটু পরে একটা টেলিফোন বুথ থেকে সে এক্সিমমা এয়ার কন্ডিশনিং কোম্পানীকে ফোন করে বলল–পেরী পোপের বাড়ি থেকে বলছি, ৪২, চার্লস স্ট্রিট, আমাদের এয়ার কন্ডিশন মেশিন ঠিকই আছে। লোক পাঠাবার আর দরকার নেই।
প্রতি শুক্রবার রাতে অ্যাটর্নি পেরী পোপের বাড়িতে তাসের একটা জমজমাট আড্ডা বসে। তবে এটা হল তাসের জুয়া, তিন পাত্তির তাস বলতে যা বোঝায়, তাই আর কী! শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ওই দিনটির জন্য সাদরে অপেক্ষায় থাকেন। যাঁরা খেলতে আসেন তাদের মধ্যে সরকারের এক সেনেট সদস্যের কথা বলা উচিত। আসেন একজন আল্ডারম্যান, জজ হেনরি লরেন্সও এই খেলার এক সম্মানীয় অতিথি। এছাড়া অ্যান্টনি ওরসেত্তি ও জো রোমানোকে প্রায় প্রতি শুক্রবারই ওই আসরে দেখা যায়।
পেরী পোপের মনটা আজ ফুর্তিতে ভরপুর। বেডরুমে গিয়ে জামাকাপড় বদলাচ্ছে। সে। সাদা সিল্কের একটা প্যান্ট পড়ল। ম্যাচ করা সাদা জামা। এব্যাপার সে খুবই শৌখীন, কয়েকদিন ধরেই একের পরে এক মামলা জিতে চলেছে। অবশ্য জীবনযুদ্ধে তাকে আমরা এক জয়ী সম্রাট বলতে পারি।
নিউ অর্লিয়েন্সে যদি কেউ আইনের সাহায্য পেতে চায়, তা হলে তাকে অনিবার্যভাবে পেরী পোপের কাছে আসতে হবে। অবশ্য তার ক্ষমতার আড়ালে একটা গোপন শক্তির উৎস আছে। ওরসেত্তি পরিবারের সে খুব কাছের মানুষ। পেরী পোপকে সকলে জানে। এক করিতকর্মা মানুষ হিসাবে। খুন, চোরাচালান, নারী ধর্ষণ–যে কোনো অপরাধ হোক না কেন, পেরী সব কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারে।
এইভাবে ফুরফুরে শরৎ মেঘের মতো দিন কাটছে তার।
অ্যান্টনি ওরসেত্তি এল সঙ্গে এক গেস্টকে নিয়ে। সে বলল–জো রোমানো আসবে না। আপনারা নিশ্চয়ই সবাই ইন্সপেকটার নিউহাউসকে চেনেন?
নিউহাউস এসে সবার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করল।
পেরী পোপ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল–সাইড বোর্ডে মদ আছে, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা না হয় পরেই হবে। একহাত হয়ে যাক।
সকলের জন্য আলাদা চেয়ার নির্দিষ্ট করা আছে। এই ব্যাপারে পেরী পোপকে কেউ। দোষ দিতে পারবে না। সবাই বসে পড়ল। জো রোমানো যে চেয়ারটায়, বসত, সেখানে বসল ওই ইন্সপেকটার।
–এবার থেকে ইন্সপেকটার, তুমি ওই চেয়ারটিতে বসবে।
ভারী গলাতে হুকুম করল ওরসেত্তি। তার হুকুমকে মান্য করতে হবে–এই আসরে সবাই তা জানে।
নতুন তাসের প্যাকেট বের করে শাল করা শুরু হল। পেরী পোপ, পোকার খেলার চাকতি বের করে ইন্সপেকটারকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল। কালো চাকতির দাম পাঁচ ডলার,
লাল দশ ডলার, নীল কুড়ি আর সাদা একশো ডলার। খেলোয়াড়রা প্রত্যেকে পাঁচশো |||||||||| ডলারের চাকতি তুলে নিল।
পেরী আরো একবার বলল–বাজির টাকা টেবিলেই শোধ করতে হবে। তিনবার পর্যন্ত ডাক দেওয়া হবে। যে তাস দেবে, প্রথম তাস তারই হবে।
সব বুঝতে পেরেছে, এমন ভঙ্গি করে ইন্সপেকটার বলল ঠিক আছে, ভালোই বুঝতে পারছি।
ওরসেত্তির গলায় বিরক্তির ছাপ। সে চিৎকার করে বলল–এত দেরী হচ্ছে কেন? এখনই শুরু করতে হবে।
জো রোমানোর কী হয়েছে তা জানবার জন্য পেরী পোপের মনটা ছটফট করছে। ওরসেত্তি মনে মনে চিন্তা করছে, আমি জো রোমানোকে ছেলের মতো ভালোবাসতাম। শেষ পর্যন্ত কুত্তার বাচ্চাটা পেছন থেকে আমাকেই ছুরি মারল। ভাগ্যিস সেই ফরাসী ঘুড়িটা ফোন করেছিল। তা না হলে পুরো টাকা আমার হাত থেকে বেরিয়ে যেত। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। বড্ড বেশী চালাকি করতে গেছে। কার সঙ্গে লেগেছে সেটা ভুলে গেছে। এমনই হয় বোধহয়। বেশী ওপরে উঠলে মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করে।
–মিস্টার ওরসেত্তি, কী হচ্ছে? আপনার মন কোথাও উড়ে গেছে মনে হচ্ছে?
কথাটা কানে আসতেই ওরসেত্তি জো রোমানোর চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল, এই টেবিলে বহু টাকার লেনদেন হয়। কেউ হারে, কেউ জেতে। এটা নেহাতই একটা খেলার আসর। কিন্তু ওরসেত্তি হারতে ভালোবাসে না। জীবনের সব খেলায় ও যেমন জয়কে করায়ত্ত করতে চায়, তাসের আসরেও একই ব্যাপার। গত ছ সপ্তাহ ধরে পেরী পোপ খালি জিতেই চলেছে। আজ ভাগ্যের চাকাটা অন্য দিকে ঘোরাতেই হবে।
খেলা শুরু হল। ওরসেত্তি ক্রমশ হারছে। মোটা অঙ্কের বাজি ধরেও হারের ওই ধারাবাহিকতাকে রুখতে পারল না। মাঝ রাতে আন্দ্রে খাবার টেবিল সাজিয়ে যখন ডাকতে এল, ততক্ষণে ওরসেত্তি তিরিশ হাজার ডলার হেরে গেছে। বেশীর ভাগটা জিতেছে পেরী পোপ।
দারুণ রান্না। ভোজনরসিক হলেও ওরসেত্তির মন পড়ে আছে তাসের টেবিলে। সবার আগে কফির কাপটা হাতে নিয়ে ওরসেত্তি খেলার টেবিলে বসে পড়ল। দু-এক চুমুক দিয়েছে, হঠাৎ কাপে কী যেন পড়ল। চামচ দিয়ে তুলতে গিয়ে দেখল, ছাদের প্লাস্টারের টুকরো। ছাদের দিকে তাকাতেই কপালে আর এক টুকরো পড়ল। কান পেতে শুনতেই মনে হল, ওপরে কে বা কারা ফিসফিস করে কথা বলছে।
ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওরসেত্তি বলল–ওপরে কী হচ্ছে?
এতক্ষণ পেরী পোপ ইন্সপেকটার নিউহাউসকে একটা দারুণ মজার গল্প শোনাচ্ছিল। ওরসেত্তির কথাটা তার কানে গেল। সে বলল, কী বললেন ওরসেত্তি?
প্লাস্টার খসছে। আরো তাড়াতাড়ি।
সেনেটর বললেন, ইঁদুর মনে হচ্ছে।
পেরী পোপ রেগে গেল। বলল–ওসব বাড়িতে নেই।
ওরসেত্তি এবার গর্জন করে উঠল–ওপরে কিছু একটা আছে।
এবার একটা বড়ো টুকরো পড়ল টেবিলের ওপরে। আন্দ্রেকে বলছি দেখতে, পেরী পোপ বিরক্ত হয়ে জবাব দিল।
ওরসেত্তি হ্যাঁ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বলল–বেশ বড় একটা ফুটো দেখা যাচ্ছে।
পেরী পোপ খেলা শুরু করার কথা বলল। ওরসেত্তি রেগে গিয়ে বলল, তার আগে দেখে এসো সত্যি সত্যি ওপরে কী হচ্ছে।
বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সে। বাকিরাও এগোতে থাকল।
–হয়তো কাঠবেড়াল তার খাবার জমিয়ে রেখেছে। পেরী পোপ ব্যাপারটাকে লঘু । করার চেষ্টা করে।
চিলেকোঠায় পৌঁছে আলো জ্বালাল পেরী পোপ। দুটি সাদা ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। সেদিকে লক্ষ্য নেই ওরসেত্তির। ঘরের মাঝখানে একটা ক্যাম্পচেয়ার, স্যান্ডউইচ, বিয়ারের খোলা টিন, একটা বাইনোকুলার, ধুলো ভরা মেঝের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল ওরসেত্তি। ছাদের সিলিং-এ একটা ফুটো। তার দিয়ে বন্ধ করা। টানতেই সেটা উঠে এল। ফুটো দিয়ে তাকাল ওরসেত্তি। সেখান থেকে তাস খেলার টেবিলটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
তার মানে? দুই আর দুয়ে চার। তার মানে পেরী পোপ এইসব ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছে।
পেরী পোপ তখনো চিৎকার করছে–এসর জিনিস এখানে কে এনে রেখেছে? আন্দ্রেকে মজা দেখাতে হবে।
ওরসেত্তি উঠে দাঁড়াল। প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে পেরী পোপকে ফুটোটা দেখিয়ে বলল এসো, প্রিয় বন্ধু, তোমার কীর্তি নিজেই একবার দেখে যাও।
ওখানে গিয়ে তাকাতেই পেরী পোপের মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। সে পাগলের মতো সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল–আপনারা আমাকে কি বিশ্বাসঘাতক ভাবছেন? বিশ্বাস করুন, আমি আপনাদের ঠকাতে পারি না।
উত্তেজনায় নিজের আঙুল কামড়ে ফেলল সে।
ওরসেত্তি তার পিঠ চাপড়ে রক্ত হিম করা কণ্ঠস্বরে কলল ঠিক আছে, এসব নিয়ে
তুমি ভেব না। চলো, আবার তাসের টেবিলে যাওয়া যাক।
.
১৪.
–তা হলে? দুখানা পড়ল। তাই না ট্রেসি?
আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপ খুশীতে উচ্ছল হয়ে বলল–বাজারে জোর গুজব, তোমার। উকিলবন্ধু পেরী পোপ আর প্র্যাকটিস করবে না। তার নাকি একটা বাজে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
রয়্যাল স্ট্রিটের একটা ছোট্ট কাফেতে বসে ট্রেসি আর লিটলচ্যাপ তখন কথাবার্তায় মেতে উঠেছে। হাসতে হাসতে লিটলচ্যাপ বলল–তোর বুদ্ধি দারুন, আমার সাথে ব্যবসা করবি?
মুখে নিস্পৃহভাব এনে ট্রেসি বলে–না, তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমার অন্য কাজ আছে।
–এরপর কে? নিজের আগ্রহ চেপে রাখতে পারল না আর্নেস্টাইন।
চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে ট্রেসি উচ্চারণ করেলরেন্স, জজ হেনরি লরেন্স!
.
হেনরি লরেন্সের ওকালতি শুরু হয়েছিল লুইসিনিয়ার লিসভিল শইরে। আইন খুব একটা ভালো বুঝতেন না। কিন্তু দুটি অসাধারণ গুণ ছিল তাঁর। দেখতে দারুণ আকর্ষক। চরিত্রের মধ্যে ছিল একধরনের নমনীয়তা। উকিলদের যেটা মস্ত বড়ো গুণ। অতি সহজেই তিনি সাফল্যের সহজ সরণীর সন্ধান পেয়ে যান। এক বিশেষ শ্রেণীর মক্কেলদের জন্য আইনের জগতে নাম করে ফেলেন। যে কোনো মামলা হাতে নিতেন। কীভাবে জুরী ভাঙতে হয় সেই মন্ত্রটা শিখে নিলেন। সাক্ষীদের অপদস্ত করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মামলায় যারা সাহায্য না করে তাদের কীভাবে ঘুষ দিয়ে কিনতে হয়, তাও জানতেন।
অ্যান্টনি ওরসেত্তি যে ধরনের মানুষ চাইছিলেন লরেন্স ছিলেন ঠিক তার আদর্শ। দুজনের মধ্যে অতি দ্রুত একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল। লরেন্স ওরসেত্তি পরিবারের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন। একসময় ওরসেত্তি তাঁকে জজের আসনে বসিয়ে ছিলো।
–এই জজটাকে কী করে গাঁথবে, ভেবে পাচ্ছি না। লোকটার টাকা পয়সা অঢেল, ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে। ওর গায়ে হাত দেওয়া মুশকিল।
ট্রেসি বলল–ধনী আর ক্ষমতাবান, তার কোনো ক্ষতি করা যাবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না।
ট্রেসি প্ল্যান ছকে ফেলেছিল কিন্তু জজ লরেন্সের চেম্বারের ফোন করার পর সে বুঝতে পারল : প্ল্যানটা পাল্টাতে হবে।
–আমি, একটু জজ লরেন্সের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সেক্রেটারী শুকনো কণ্ঠে জবাব দিল-দুঃখিত, জজ সাহেব এখানে নেই।
ট্রেসি জানতে চাইল–কখন ফিরবেন?
–ঠিক বলতে পারব না। একই রকম নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর।
–জরুরী দরকার ছিল। কাল সকালে পাওয়া যাবে কি?
–না, উনি শহরে নেই।
–কোথায় গেছেন জানতে পারলে ভালো হত।
–সেটা বোধহয় বলা সম্ভব নয়। জজ সাহেব দেশের বাইরে গেছেন।
ট্রেসি এমন ভাব দেখাল, যেন সে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছে।
সে বলল–ও বুঝেছি, কিন্তু কোথায় গেছেন?
–জজ সাহেব ইউরোপে গেছেন। আন্তর্জাতিক আইন আলোচনা চক্রে যোগ দিতে।
–কী আশ্চর্য, এই খবরটা আমাদের জানা নেই।
–আপনি কে কথা বলছেন? সেক্রেটারী জানতে চাইল।
ট্রেসি দ্রুত চিন্তা করে বলল–আমি এলিজাবেথ রোয়ানে জাস্টিন, আমেরিকার মহিলা আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ বিভাগের সভানেত্রী বলছি। এই মাসের কুড়ি তারিখে নিউ অর্লিয়েন্সে বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভায় জজ হেনরি লরেন্সকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হবে।
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল সেক্রেটারীর কণ্ঠস্বর। সে বলল–খুবই খুশীর খবর। কিন্তু ওই সময় তো উনি ফিরছেন না।
–সত্যি দুঃখের কথা। আমরা সকলে ওনার অসাধারণ বক্তৃতা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। জজ সাহেবকে সকলে একমত হয়ে নির্বাচিত করেছি।
–এই খবর শুনলে উনিও খুব দুঃখিত হবেন।
–আচ্ছা, ওনার লেখা বক্তৃতা কিছু জোগাড় করে দেওয়া যায়?
–ঠিক বলতে পারছি না। জজ সাহেবের প্রোগ্রাম একেবারে ঠাসা।
–আঃ, কী যে করা যায়, সমস্ত দেশের টেলিভিশনে এই উৎসবটা দেখানো হবে।
সেক্রেটারী একটু ইতস্তত করল। ও জানে, জজ সাহেব আত্মপ্রচারের ব্যাপারটা খুব পছন্দ করেন। এই যে উনি বিদেশে গেছেন, এসবই প্রচারের একটি অঙ্গ মাত্র।
–হয়তো উনি দু-এক লাইনের বাণী লিখে দিতে পারেন। আমি তাকে বলে রাখব। বিষয়টা কী হবে?
ট্রেসি খুশীতে লাফিয়ে উঠে বলল–বাঁচালেন, বিষয়টা আমরাই ওনাকে বুঝিয়ে বলতে পারি।
সেক্রেটারী আবার দ্বিধার মধ্যে পড়ল। জজ সাহেবের ভ্রমণসূচী গোপন রাখতে হবে। ঠিকানাটা দেওয়া ঠিক হবে কি? আবার সম্মানটাও সে হাতছাড়া করতে চাইছে না। অবশেষে সে বলল, ঠিকানা দিতে আমাকে নিষেধ করে গেছেন। তবে এক্ষেত্রে না দিয়ে পারছি না। জজ সাহেব এখন মস্কোর ব্রেসিয়া হোটেলে আছেন। ওখানে পাঁচদিন থাকবেন। তারপর…
তারপর জজ সাহেব জাহান্মামে যাক, আমার দরকার নেই জানতে, ট্রেসি মনে মনে বলল। মুখে বলল–অশেষ ধন্যবাদ। আমরা এখনই যোগাযোগ করছি।
মস্কোর রোসিয়া হোটেলের ঠিকানায় জজ হেনরি লরেন্সের নামে তিনটি পরপর কেবল গেল।
প্রথমটাতে লেখা আছে–বিচার সংক্রান্ত পরিষদের পরবর্তী সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে এবার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন, আপনি আমাদের করতে বলেছেন, বরিস।
দ্বিতীয় কেবলটা পৌঁছল পরের দিন। ভ্রমণসূচীর সমস্যার ব্যাপারে কী করতে হবে তা জানান। আপনার বোনের প্লেন পৌঁছেছে, নিরাপদে অবতরণ করেছে। পাশপোর্ট, টাকাপয়সা হারিয়ে গেছে। তাকে এক প্রথম শ্রেণীর সুইস হোটেলে রাখা হয়েছে। পরে ব্যাঙ্ক মারফত হিসাব করতে হবে।
শেষ কেবলটা লেখা আছে–সাময়িক পাশাপোর্ট পাবার চেষ্টা আপনার বোন করে ফেলেছেন। নতুন ভিসার খবর এখনো পাওয়া যায়নি। সুইজারল্যান্ডের তৈরী নতুন জিনিসগুলোকে রাশিয়ান বলে মনে হচ্ছে। জাহাজে করে বোনকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি পাঠাচ্ছি, পৌঁছোলে আমাদের খবর দেবেন। বরিস।
সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বোচ্চ গুপ্তচর সংস্থা কেবলগুলো চেপে বসে রইল। আরো কেবল আসছে কিনা দেখতে হবে। আর যখন এলো না, তখন তারা জজ লরেন্সকে গ্রেপ্তার করল।
দশ দিন দশরাত ধরে জেরা করা হল।
–খবরটা আপনি কাকে পাঠিয়ে ছিলেন?
জজ লরেন্স আকাশ থেকে পড়লেন। কোন্ খবর? আপনাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না।
–আমরা নকসাটির কথা বলছি। কার কাছ থেকে আপনি নকসাটি পেয়েছেন?
–কোন নকসা?
–সোভিয়েত আনবিক শক্তি চালিত ডুবো জাহাজের নকসা।
–নিশ্চয়ই আপনাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে খবর আমি কী করে জানব?
–সেটাই তো আমরা খুঁজে বের করব। কার সঙ্গে আপনার গোপন মিটিং হবে?
–কীসের গোপন মিটিং। গোপন করার কী থাকতে পারে?
–তাহলে এই বরিস কে?
–বরিস? সে কে?
–যে আপনার নামে সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছে।
–সুইস ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট? কী যা-তা বলছেন।
ওরা এবার রক্তকঠিন কণ্ঠস্বরে জজ সাহেবকে জরিপ করতে করতে বলল–আপনি বোকামি করছেন। এমন শিক্ষা আপনাকে দেব যে, মার্কিন গুপ্তচররা বুঝবে, আমরা কত শক্তিশালী।
অতি কষ্টে মস্কোর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জজ লরেন্সের দেখা হল। একদিনে সাতকেজি ওজন কমে গেছে তাঁর। রাষ্ট্রদূত ওনার পরিচয় পেয়ে ছুটলেন পলিটব্যুরোর একজন সদস্যের কাছে। বললেন–জজ লরেন্স গুপ্তচর হতে পারেন না। আমি এ গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ করছি।
পলিটব্যুরোর সদস্য শান্ত গলায় বললেন–এবার এগুলো দেখুন দয়া করে। তিনটি কেবল মার্কিন রাষ্ট্রদূতের হাতে তুলে দেওয়া হল। তিনটি কেবল পড়ার পর রাষ্ট্রদূত বললেন–এর মধ্যে বেআইনী কিছু দেখতে পাচ্ছি না তো?
–তাই নাকি? ভালো করে পড়ুন। বুঝতে পারছেন না। প্রতিটি কেবলের চতুর্থ শব্দটি পড়তে হবে।
সত্যিই তো, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
আদালতে সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিক ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আসামী শেষ পর্যন্ত নিজের দোষ অস্বীকার করেছিলেন। তিনি গুপ্তচুর হিসাবে রাশিয়ায় এসেছেন, একথা মানতে চাইলেন না, সরকার পক্ষ বারবার লরেন্সকে বলছিলেন, দোষ স্বীকারের জন্য। এইধরনের একটা কনফেসন দিলে শাস্তির মেয়াদ কম হবে। লরেন্স বলতে পারেন নি।
বিচারের পরের দিন পত্রিকায় একটা ছোটো খবর বেরল। জজ হেনরি লরেন্স আমেরিকার গুপ্তচর। তাঁকে চোদ্দো বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।
এই খবর পেয়ে আমেরিকার গুপ্তচর বিভাগ মাথায় হাত দিয়ে বসল। সি. আই. এ বলল, ও নিশ্চয়ই ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের লোক।
ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বলল–জজ লরেন্স আমাদের লোক নয়। মনে হয় এফ. বি. আই আমাদের জড়াতে চাইছে।
মোট কথা সব দপ্তরের, বক্তব্য, জজ হেনরি লরেন্স অন্য দপ্তরের হয়ে কাজ করছিলেন।
শেষ পর্যন্ত সি. আই. এর প্রধান বললেন–ওনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। এত হেনস্তার মধ্যেও উনি কারো নাম ফাস করেন নি। বিচারপতি হয়েও উনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য আর ভালোবাসা দেখিয়েছেন। তার জন্য ওনাকে আমরা শ্রদ্ধা করব।
.
অ্যান্টনি ওরসেত্তির জীবনের চাকা এবার বোধ হয় ঘুরত শুরু করেছে। পরাজয়ের তেঁতো স্বাদ তাকে বারবার গ্রহণ করতে হচ্ছে। জো রোমানোর বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে যে নাটক শুরু হয়েছিল, তার শেষ অঙ্ক কবে আসবে?
পেরী পোপ আর জজ লরেন্সকে হারাতে হল। এরা সবাই ছিল ওরসেত্তির ভরসা।
জো রোমানোর জায়গায় উপযুক্ত তোক পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে জোর গুজব, অ্যান্টনি ওরসেত্তি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, নিজের লোকদের আর হাতের মুঠোয় রাখতে পারছে না। এবার বোধহয় পতনের প্রহর শুরু হল।
বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো নিউজার্সি থেকে একটা টেলিফোন এল।
–খবর পেলাম, আপনি নাকি একটু অসুবিধায় পড়েছেন? আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি। আপনি সাহায্য নেবেন কি?
–হ্যাঁ, অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু সব ঠিক হয়ে গেছে।
ওপাশে একটু চাপা হাসি–আমাদের কাছে খবর আছে স্যার, সবকটা সমস্যার সমাধান। হয়নি। আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা দেখে নিচ্ছি।
ওরসেত্তির পৌরুষে আঘাত লেগেছে–এটা আমার শহরে, যা করার আমিই করব।
–মিস্টার ওরসেত্তি, আপনার শহরে আমরা নাক গলাচ্ছি, তেমন কিছু ভাববেন না। আমরা সামান্য কয়েক জন লোক পাঠাচ্ছি। যারা সব সিধে করে দেবে। পুরোনো বন্ধুকে এভাবে আমরা সাহায্য করব।
এই কথা শুনে ওরসেত্তির শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সামান্য কয়েক জন লোক দেখতে দেখতে অসামান্য হয়ে উঠবে? ওরসেত্তি তা সহ্য করবে সেটা কী করে হবে?
.
লিটলচ্যাপ রান্না করছিল। ট্রেসিকে নেমতন্ন করেছে। অ্যাল কখন ফিরবে, তারই অপেক্ষাতে সে বসে আছে।
বাইরে প্রচণ্ড গরম, অ্যাল ফিরল।
–কোথায় গিয়েছিলে? রান্না শেষ হয়ে গেছে?
এই বকুনিটা অ্যাল গায়ে মাখল না। এক মুখ হেসে ট্রেসিকে লক্ষ্য করে বলল–তোমার প্ল্যান কাজ করেছে। নিউজার্সি থেকে লোক আসছে নিউ অর্লিয়েন্সের দখল নিতে। ওরসেত্তির অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। তুমি খুশী হয়েছে তো?
এই শব্দটা ট্রেসির কাছে এখন সম্পূর্ণ অপরিচিত। খুশী হবার মতো মানসিক অবস্থা সে অনেক বছর আগেই হারিয়ে ফেলেছে। মা এবং তার ওপর যে অন্যায় অত্যাচার করা হয়েছে, তার শেষ না দেখে ট্রেসি খুশী হতে পারবে না।
পরদিন সকালে একটা ফুলের দোকানে গিয়ে ট্রেসি বলল–সাদা রিয়ন জড়ানো একটা ফুলের রিফ তৈরী করে অ্যান্টনি ওরসেত্তিকে পাঠাতে হবে।
এই রিফগুলি পাঠানো হয় মৃত ব্যক্তির কফিনের জন্য। কার্ডে ট্রেসি লিখল শান্তিতে থাকুন–ডরিস হুইটনির মেয়ের কাছ থেকে।
.
১৫.
ফিলাডেলফিয়া,
মঙ্গলবার, ৭ই অক্টোবর, বিকেল ৪ টে।
একে একে চারজনকে খতম তালিকায় তোলা গেছে। পঞ্চম নামটি কার? অবশ্যই চার্লস স্ট্যানহোপ তৃতীয়র পালা। বাকিরা ছিল তার অপরিচিত। কিন্তু চার্লস তার প্রেমিক এবং চার্লসের সন্তানকে সে গর্ভে ধারণ করেছিল। কিন্তু চার্লস দরকারে সাহায্য করেনি।
আর্নেস্টাইন আর অ্যাল এসেছে নিউ অর্লিয়েন্স এয়ারপোর্টে। ট্রেসিকে বিদায় জানাতে হবে।
আর্নেস্টাইন বলল–এই শহরটাকে তুমি পাগলা করে ছেড়ে দিয়েছে। চাইলে এখানকার মেয়র পর্যন্ত হতে পারতে।
অ্যাল জিজ্ঞাসা করল–ফিলাডেলে তুমি কেন যাচ্ছো?
ট্রেসি কিন্তু সব কথা খুলে বলেনি-ব্যঙ্কের পুরোনো চাকরিটা ফিরে পাবার চেষ্টা করব।
–ওরা কি জানে তুমি ফিরছো?
–না, তবে ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাকে খুবই পছন্দ করেন। আমার মতো দক্ষ কমপিউটার অপারেটর সহজে পাওয়া যায় না।
–ভালো, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখো, আর নতুন করে কোনো ঝাটে নিজেকে জড়িয়ে ফেলো না।
আর্নেস্টাইন পরম মমতায় ট্রেসিকে আদর করল।
ফিলাডেলফিয়াতে পৌঁছে হিলটন হোটেলে উঠল ট্রেসি। পরের দিন সকাল এগারোটায় ব্যাঙ্কে গিয়ে ক্লারেন্স ডেসমন্ডের সেক্রেটারীর সঙ্গে দেখা করল। ট্রেসিকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
ট্রেসি বলল–মিস্টার ডেসমন্ডের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
মিস্টার ডেসমন্ড টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
–হ্যালো মিস্টার ডেসমন্ড, আমি ফিরে এসেছি।
–কিন্তু কেন? কী চাই?
সঙ্গত কারণেই তার কণ্ঠস্বর থেকে রুক্ষতা ঝরে পড়ছে।
ট্রেসি সামান্য হেসে বলল–চাকরিটা আবার ফিরে পেতে চাই।
–মিস হুইটনি, সেটা কী করে সম্ভব? আপনার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ ছিল। জেল খাটার পরেও আমাদের সম্ভ্রান্ত ব্যাঙ্কে আপনি চাকরি পাবেন কী করে?
ট্রেসি হতভম্ব হয়ে গেল। এই মানুষটি কিছুদিন আগে বলেছিল–তোমাকে আমরা হারাতে চাই না। বিয়ের পরেও তুমি এখানে চাকরি করবে।
–আর কিছু বলার আছে মিস হুইটনি? তার অর্থ এবার তুমি বিদায় হও।
লজ্জায় মাথা নীচু করে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল ট্রেসি। মনে মনে শপথ নিল এর উত্তর দিতে হবে।
সারাটা দিন হোটেলে, কাটাল সে। এখানে তার থাকা উচিত নয়। তার কাছে নিউইয়র্ক নিরাপদ জায়গা সেখানে কেউ তাকে চিনবে না।
সন্ধ্যেবেলা এল কাফে রয়্যালে। সেখানকার অসাধারণ পরিবেশ হয়তো তার মনটাকে ভালো করে দেবে। একটা কোণ বেছে নিয়ে বসল। ভদকা মদ কিনে দেবার জন্য বেয়ারাকে অর্ডার দিল।
একটা চুমুক দেবার পর মনটা বেশ প্রসন্ন হল তার। এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চমকে উঠল সে। নিজের চোখ দুটিকেই বুঝি বিশ্বাস করতে পারছে না। উল্টোদিকে বেশ খানিকটা দূরে ঘেরা জায়গায়তে চার্লস তার স্ত্রীকে নিয়ে খাচ্ছে। প্রথমেই তার মনে হল, এখান থেকে উঠে চলে যাবে। চার্লসের মুখোমুখি দাঁড়ানো এখন উচিত নয়। তাহলে পরিকল্পনাটা হয়তো ভেস্তে যাবে।
চার্লস তাকে দেখতে পায়নি। তাই খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ট্রেসি ওদের দেখতে লাগল। কিন্তু এই চার্লসের সঙ্গে আগের চার্লসের অনেক তফাত। মনে হচ্ছে চার্লসের জীবনের ওপর কী যেন ঝড় বয়ে গেছে। অকালে বুড়ো হয়ে যাওয়া চার্লস, সামনের দিকে চুলে টাক পড়তে শুরু করেছে। কোথায় গেল তার প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা সজীব চেহারা? এ বোধহয় চার্লসের মৃতদেহ। সমস্ত শরীরে ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার ছাপ।
এই মানুষটির সাথে নিজেকে জড়াতে চেয়েছিল ট্রেসি। এবার ট্রেসি চার্লসের স্ত্রীকে দেখতে লাগল। তার মুখেও কে যেন বিরক্তির ছাপ এঁকে দিয়েছে। দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা একে অন্যকে সহ্য করতে পারছে না। বসে বসে খাচ্ছে, কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। পাশাপাশি থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক ব্যবধান।
ট্রেসি বুঝতে পারল, দুজনকে সারা জীবন কাটাতে হবে এমন এক পরিবেশের মধ্যে যেখানে সুখ শান্তি আনন্দ কোনো কিছু নেই। এমন একটা জগতের বাসিন্দা হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী? হয়তো এটাই চার্লসের শাস্তি। এই কথাটা মনে হতে ট্রেসির বুক অনেকটা হালকা হয়ে গেল। চার্লসকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত যে পাষাণ ভারটা তার মাথার ওপর চেপে বসেছিল, সেটা নেমে গেল।
ট্রেসি বেয়ারাকে ডেকে খাবার দিতে বলল। অতীতের সব ঋণ সে শোধ করে ফেলেছে। এখন সে মুক্ত আর স্বাধীন।
রাতে হোটেলে ফিরে ট্রেসির হঠাৎ মনে হল, ব্যাঙ্ক কর্মীদের তহবিল থেকে তার কিছু পাওনা আছে। মোটামুটি হিসাব করে দেখল এক হাজার তিনশো পঁচাত্তর ডলার পাঁয়ষট্টি সেন্ট। ক্লারেন্স ডেসমন্ডকে চিঠি লিখল ওই টাকাটা তাকে অবিলম্বে দিতে হবে।
দু-দিন বাদে সেক্রেটারীর কাছ থেকে উত্তর এল—
প্রিয় মিস হুইটনি,
আপনার চিঠির উত্তরে মিস্টার ডেসমন্ড আপনাকে জানাতে বলেছিল যে, নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত থাকায় আপনার প্রাপ্য টাকা সাধারণ তহবিলে জমা পড়ে গেছে। ওটা আর আপনাকে দেওয়া যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে আপনার বিরুদ্ধে কোনো খারাপ চিন্তা করেন না মিস্টার ডেসমন্ড।
আপনার বিশ্বস্ত
মে ট্রেনটন
সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি
তাহলে? ট্রেসি এখন কী করবে? না, পুরো ব্যাপারটা নিজের হাতে নিতেই হবে।
পরের দিন ট্রেসিকে দেখা গেল ফিলাডেলফিয়া অ্যান্ড ফাইডেলিটি ব্যাঙ্কের অতি পরিচিত দরজায়। লম্বা কালো রঙের পরচুল পরেছে সে। চড়া মেক-আপ নিয়েছে। চিবুকে টাটকা কাটা দাগ। ছদ্মবেশ ধারণ করা সত্ত্বেও ট্রেসির মনে হচ্ছিল বোধহয় ব্যাঙ্কের লোকেরা তাকে চিনে ফেলবে। এই ব্যাঙ্কেই পাঁচ-পাঁচটা বছর চাকরি করেছে সে। সবাই তার পরিচিত। কিন্তু এমন ভান করতে হবে, যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে।
হাতব্যাগ খুলে একটি ছিপি জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকল সে। একটা কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল। কাউন্টারে জন ক্রেগটন বসেছিল। রক্ষণশীল মনের মানুষ।
–কী চাই?
–কিছু না সেনর, একটি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে চাই। ট্রেসি ইচ্ছে করেই মেক্সিকান ভাষায় কথা বলছিল।
–নাম কী?
–রিটা গঞ্জালেস।
–কত টাকা জমা রাখবেন?
–দশ ডলার।
হাতে চোট আছে, এই অজুহাত দেখিয়ে ট্রেসি ক্রেগটনকে দিয়ে ফর্মটা ভরাল। কাজ শেষ করে বেরিয়ে এল।
কমপিউটার যন্ত্রের নাগাল পাবার অনেক বেআইনি পন্থা আছে। ট্রেসি এ ব্যাপারে দারুণ এক্সপার্ট। ফিলাডেলফিয়া ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের কমপিউটার সংক্রান্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থাটি তার নিজের হাতে তৈরী করা। এবার সে প্রথম সুযোগ নেবে।
প্রথমেই সে ব্যাঙ্কের কাছাকাছি একটা কমপিউটার বিক্রির দোকানের খোঁজ করল। দোকানটা পেয়েও গেল। দোকানটা বেশ ফাঁকা ছিল।
ওকে দেখে এগিয়ে এল একজন কর্মচারী।
–বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
ট্রেসি মেক্সিকান ভাষা মিশিয়ে উত্তর দিল–না-না, আমি এমনি দেখতে এসেছি।
দোকানের অন্য কোণে কয়েকটা ছেলে কমপিউটার গেমস খেলছিল। কর্মচারী সেই দিকে চলে গেল।
ট্রেসি একটি কমপিউটার যন্ত্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার সঙ্গে একটা টেলিফোন লাগানো ছিল। সেখান থেকে ব্যাঙ্কের কমপিউটার যন্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, কিন্তু ব্যাঙ্কের কমপিউটারে একটা কোড নম্বর থাকে। সেটা প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যায়। সেই কোডনম্বরগুলো ট্রেসিই ঠিক করে দিয়েছিল কোড নম্বরগুলো ঠিক করা হত চারটি ঋতু, বছর আর সেই দিনের তারিখ দিয়ে।
মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেসি ব্যাঙ্কের নম্বরটা ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে উঠল–আপনার কোড নম্বরটি প্লীজ।
আজ ৫ তারিখ, ঋতুটি শরৎ, তাই ট্রেসি জানাল কমপিউটার মারফত–শরৎ-১০।
নম্বরটা মিলছে না কেন? কমপিউটারের পর্দা সাদা হয়ে গেল। তা হলে কি ব্যাঙ্ক
নম্বর পঞ্চমলছে না কেন? কমষ্টি ট্রেসি জানাল কমপি
একটা কর্মচারী আসছে দেখে ট্রেসি অন্যদিকে সরে গেল।
সেই কর্মচারীটি ট্রেসিকে আপাদমস্তক দেখল। সঙ্গে সঙ্গে দোকানে এক বয়স্ক অভিজাত মক্কেল ঢুকলেন। ট্রেসি নিশ্চিন্ত মনে যন্ত্রটার কাছে চলে এল। মিস্টার ডেসমন্ডের চিন্তাধারার সঙ্গে ট্রেসি পরিচিত, হয়তো উনি নম্বর পাল্টে ফেলেছেন। আবার চেষ্টা করা যাক–শীত-১০। পর্দা এবারও সাদা। শেষ চেষ্টা করল-বসন্ত-১০। পর্দা ডাকল, আগে বলুন। ট্রেসির মন আনন্দের নেচে উঠেছে। তাহলে মিলেছে।
ট্রেসি জানাল, টাকা জমা রাখতে চাই। কমিপিউটারের নির্দেশ অনুযায়ী, কত: টাকা, কোথা থেকে কার নামে জমা হবে সব জানিয়ে দিল ট্রেসি। টাকার অঙ্কটা বলার সময় তার বিবেক অন্যভাবে কাজ করল। সে চাইলে কয়েক হাজার ডলার জমা দিয়ে দিতে পারত, কিন্তু দিল না। যে টাকাটা তার পাওনা ছিল, সেটাই জানিয়ে দিল। রিটা গঞ্জালেসের খাতায় ১৩৭৫ ডলার ৬৫ সেন্ট জমা পড়ে গেল।
বাইরে বেরিয়ে এসে ট্রেসি ব্যাঙ্কে ফোন করে অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বলল–রিটা গঞ্জালেসের জমা টাকাটা ফার্স্ট হ্যাঁনোভার ব্যাঙ্ক, নিউ ইয়র্কে যেন ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়।
এক ঘন্টা পরে প্লেন ধরে ট্রেসি চলে এল নিউইয়র্কে, পরের দিন সকালে দশটায় ব্যাঙ্ক খুলতেই ট্রেসি রিটা গঞ্জালেসের নামে জমা পড়া টাকাটা নগদে তুলে নিল।
জেল থেকে ছাড়া পাবার সময়, দুশো ডলার পেয়েছিল। অ্যামিকে দেখাশোনা করার জন্য আরো কিছু পেয়েছিল। কিন্তু কিছু একটা তাকে তো করতেই হবে। চাকরি না করলে খাবে কী?
একটা কম দামী হোটেলে উঠল? তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে একটার পর একটা ব্যাঙ্কে দরখাস্ত করল। কিন্তু দেখা গেল, সব ব্যাঙ্কই তার অতীত ইতিহাস জানে। ফলে কোথাও চাকরি হল না।
আরো অনেক জায়গাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল ট্রেসি। শেষে বাধ্য হয়ে একটা বিজ্ঞাপন দেখে সেলসগার্লের চাকরির দরখাস্ত করল। চাকরিটা হয়ে গেল। এবার দোকানে ঢুকতে যাবে, হঠাৎ মালিক বলল–আরে, তোমাকে আমি টেলিভিশনে দেখেছি। জেলখানাতে একটা বাচ্চাকে বাঁচিয়েছিলে। কী তাই তো?
ট্রেসি কি আর সেখানে থাকতে পারে?
পরে অন্য একটা দোকানে চাকরি হল, কিন্তু দ্বিতীয় দিনে একজন খদ্দের তাকে চিনতে পেরে চিৎকার করতে শুরু করল–জেলখাটা আসামীর কাছ থেকে জিনিস কিনব না।
সঙ্গে সঙ্গে এই চাকরিটাও গেল ট্রেসির।
না, এভাবে কিছু করা যাবে না। যাদের বিরুদ্ধে সে প্রতিশোধ নিয়েছে, তারা মরেও তাকে রেহাই দেয়নি। কোন পথ সে নেবে ভেবে পাচ্ছে না। সেই রাতে টাকার ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খুঁজল, কত টাকা আছে দেখে নিতে হবে। হঠাৎ এক কোণ থেকে বেটি ফ্রান্সিসকাসের দেওয়া কাগজের টুকরোটা বেরোল–কোনরাড মরগান জুয়েলার, ৬৪ ফিফথ এভিনিউ, নিউইয়ক। বেটি বলেছিল, জেলখাটা কয়েদিদের সংশোধনে লোকটা সাহায্য করে।
কোনরাড মরগানের দোকানটা সুন্দর করে সাজানো। বাইরে বন্দুকধারী পাহারা। রিসেপসনিস্টকে বলে ট্রেসি দেখা করতে গিয়ে শুনল, কোনরাডের সঙ্গে সন্ধ্যে ছটায় দেখা হবে।
সন্ধ্যা ছটার সময় ফিরে এসে দেখল, দোকান বন্ধ এবং পাহারাদার চলে গেছে। কী ভেবে সে দরজায় টোকা দিল। টাক মাথা হাসি খুশী মুখের একটি মানুষ বলল–ভেতরে আসুন।
দারুণ সাজানো অফিস ঘরে ট্রেসি ঢুকে পড়ল। লোকটা বলল–কী খাবেন বলুন? হুইসকি কনিয়াক, নাকি শেরী?
ট্রেসি একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। কীভাবে কোনরাডকে সব কিছু বলবে?
শেষ পর্যন্ত সে বলল–বেটি ফ্রান্সিসকাস আমাকে বলেছিল, অসুবিধাতে পড়লে আপনার সঙ্গে দেখা করতে?
–বেচারী বেটি, ওর ভাগ্যটা ভালো ছিল না।
–ভাগ্য!
–হ্যাঁ, ধরা পড়ে গেল।
–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–ব্যাপারটা খুবই সামান্য মিস হুইটনি, বেটি আমার কাছে কাজ করত। নিউ অর্লিয়েন্সের এক ড্রাইভারের প্রেমে পড়ে নিজে থেকেই কাজ করতে শুরু করল এবং ধরা পড়ে গেল।
ট্রেসি তখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি–ও কি আপনার কাছে সেলসগার্লের কাজ করত?
কোনরাড মরগান হো-হহা করে হেসে উঠল–না-না, বেটি তোমায় কিছু বলেনি? আমার একটা সাইড বিজনেস আছে। যারা আমার সঙ্গে কাজ করে তাদের আমি ভালো অংশ দিই। তোমাদের মতো লোককে কাজ দিতে পারলে আমি খুব খুশী হব। কিছু মনে । করো না, তোমার অতীত ইতিহাস তো খুব একটা ভালো নয়। কোনো ভদ্র-সংস্থায় তমার চাকরি হবে না। তুমি জেলখাটা আসামী, এই ছাপটা তোমার গায়ে পড়ে গেছে।
ট্রেসি তখনো অবস্থাটা বুঝতে পারছে না।
–আমার বেশ কিছু ধনী মক্কেল আছে। তারা বন্ধুর মতো সব গোপন কথা আমাকে বলে। তারা মাঝে মধ্যে গয়না গাটি বাড়িতে রেখে বেড়াতে যায়। গয়না কোথায় রাখবে, কী ভাবে রাখবে, সব কিছু আমার নির্দেশেই হয়।
মরগানের কথার মধ্যে ট্রেসি উঠে দাঁড়াল-অশেষ ধন্যবাদ মিস্টার মরগান।
তার এই আচরণে মরগান অবাক হয়ে গেল–তুমি কি চলে যাচ্ছো?
হাঁ, আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পেরেছি। জেনে রাখুন আমি চোর-জোচ্চর নই? আমি এখানে চাকরি খুঁজতে এসেছিলাম।
এবার মিস্টার মরগানের ঠোঁটে অমায়িক হাসি ফুটে উঠেছে। তাইতো দিচ্ছি তোমাকে। কাজ মাত্র দুতিন ঘন্টার, টাকা দেব পঁচিশ হাজার ডলার। কোনো ট্যাক্স লাগবে না।
ট্রেসির রক্ত মাথায় চড়ে গেছে। ঠাস করে একটা চড় কষাতে ইচ্ছে হল। কোনোরকমে রাগ চেপে দরজার দিকে পা বাড়াল। মরগানের মুখের ভাব তখন পাল্টে গেছে কিন্তু শুনে রাখো মিস হুইটনি, আমার যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা হলে তোমাকে আমি ছেড়ে : দেব না।
–সেই কথাটা দিয়ে যাচ্ছি। আমার কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।
–আর একটা কথা, যদি কখনো দরকার হয়, আমার কাছে আসতে দ্বিধা করো না কিন্তু।
ট্রেসি হোটেলে ফিরে গেল। কিছু কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়ে ভাবতে বসল। জেলে ছিল বলেই কি ও আর পাঁচজন সাধারণ অপরাধীর মতো? কিন্তু কে ওকে চাকরি দেবে? ভাল একটা সস্তার হোটেলে চলে যাব। নতুন করে চাকরি খুঁজবো।
পরের দিন লোয়ার ইস্ট সাইডের চারতলার একটি ছোট্ট ঘরে উঠে এল ট্রেসি। কথাবার্তায় বুঝতে পারল, এখানে যারা থাকে, তাদের বেশীর ভাগই বেশ্যা অথবা ব্যাগ ছিনতাইকারী।
পথে বেরোতেই কজন সরাসরি তাকে চোখ ইশারা করল। না, এখানে থাকা চলবে না।
কাছেই একটা অফিস ছিল, যারা চাকরি জোগাড় করে দেয়। মিসেস মারফি নামে এক মহিলা এই অফিসটি চালান। ট্রেসির কাগজপত্র দেখে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, জেলখাটা আসামীকে কেউ কমপিউটারে চাকরি দেবে না।
-কিন্তু আমার যে একটা চাকরি চাই।
–ঠিক আছে, জ্যাকসন হোল নামে একটা ছোট্ট হোটেল আছে, সেখানে ওয়েট্রেসের পদ খালি আছে। আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
উপায় নেই, কম বয়সে শখ করে এমন অনেক কাজ করেছিল ট্রেসি। দেখাই যাক না কী হয়?
জ্যাকসন হোল ছোট্ট একটি হোটেল। খাবারটা ভালো, কিন্তু খদ্দেররা নীচু ক্লাসের। প্রথম দিন হাড় ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল ট্রেসি। আনন্দ একটাই যে, শেষ পর্যন্ত সে চাকরি করছে।
পরদিন ঘটে গেল দুর্ঘটনা। একটা মাতাল খদ্দের তার স্কার্ট ধরে টান মারল। ট্রেসির হাতের চিলি সসের বোতলটা উল্টে পড়ল ওই খদ্দেরের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে চাকরিটা গেল তার।
মিসেস মারফির চেষ্টায় অনেক কষ্টে একটা হোটেলে গেল ট্রেসি। এটা মোটামুটি ভালো। এখানে ভালো ভালো খদ্দেররা আসেন এবং রাতে থাকেন। ওর কাজ হল সহকারী হাউসকিপারের। হোটেলে খদ্দেরদের ঘরগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা। মাইনেটাও খুব একটা খারাপ নয়।
দেখতে দেখতে সাতটি দিন কেটে গেল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ট্রেসিকে ডেকে পাঠলেন তার ঘরে।
–৮২৭ নম্বর ঘরে কাজ করতে গিয়েছিলে? ওই ঘরে হলিউডের এক অভিনেত্রী থাকেন। তার নাম জেনিফার মার্লো। ট্রেসি জবাব দিল, হ্যাঁ।
–কখন?
–দুপুর দুটোর সময়।
–কেন কিছু হয়েছে?
–হ্যাঁ, তিনটের সময় মিস মালো ঘরে ফিরে দেখেন, তার একটা হীরের আংটি পাওয়া যাচ্ছে না।
এই কথা শুনে ট্রেসির সমস্ত শরীর কাঠের মতো শক্ত হয়ে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য ট্রেসির মনে হল, কে বুঝি তার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ করে দিয়েছে। জেলখানার অন্ধকার মুহূর্তগুলির কথা আবার তার মনে পড়ে গেল।
ম্যানেজার জানতে চাইলেন–তুমি কি ওনার শোবার ঘরে ঢুকেছিলে?
সত্যি কথা বলার বদভ্যাস আছে ট্রেসির।–হ্যাঁ, সব ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য ঢুকেছিলাম।
–শোবার ঘরে হীরের আংটিটা দেখেছিলে?
–মনে হচ্ছে না।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার চিৎকার করে বললেন–মনে হচ্ছে মানে? একটু দাঁড়াও পুলিশ আসছে।
একজন গার্ড ট্রেসিকে অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। ট্রেসি দ্রুত চিন্তা করতে থাকল, পুলিশ এলে আবার জেলে ঢুকতে হবে তাকে। শত্রুরা বারবার জিতে যাচ্ছে। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। ভাগ্যের হতে নিজেকে সমর্পণ করে দিল সে।
মিনিট কুড়ি বাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এলেন–এই যে খবর ভালো, মিস মার্লো তাঁর আংটিটা ঘরেই পেয়েছেন। সামান্য ভুল আর কী।
ট্রেসি হোটেল থেকে বেরিয়ে পা বাড়াল কোনরাড মরগানের জ্বলেয়ারী দোকানের দিকে।
কোনরাড তাকে দেখে এতটুকু অবাক হয়নি। বুদ্ধিমান মানুষ সে। এই সব জেলখাটা কয়েদিদের নিয়ে কাজ কারবার করে থাকে। সে জানে, এই লোকগুলোকে বারবার তার কাছেই ফিরে আসতে হবে।
অফিস ঘরে বসে সে বলল–আমার এক খদ্দের লুই বেলামি ইওরোপ বেড়াতে গেছেন। ওই মহিলা লং আইল্যান্ডে সী ক্লিকে থাকেন। শনি রবিবার বাড়ির চাকররা থাকে না। নিজস্ব একটা পাহারাদারী গাড়ি আছে। চার ঘন্টা অন্তর টহল দিয়ে যায়। বাড়ির ভেতর ঢুকতে আর বেরোতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে।
একটু থামল কোনরাড। ট্রেসির দিকে তাকাল। ট্রেসি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব কথা শুনছিল।
–অ্যালার্ম ঘন্টার ব্যাবস্থা আমার জানা আছে। লোহার সিন্দুকের তালা খোলার নম্বরটাও আমি জানি। তোমার কাজ বাড়ির মধ্যে ঢুকে গয়নাগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসা। বাকি ঝামেলা আমি সামলাব।
–কাজটা যদি এত সহজ হয়, তাহলে আপনি নিজে করছেন না কেন?
–এই ধরনের কোনো ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি ব্যবসার খাতিরে শহরের বাইরে থাকি। আশা করি এর আসল অর্থটা তুমি বুঝতে পারছে।
–বুঝেছি।
–মিসেস বেলামির গয়না চুরি করতে যদি বিবেকে বাঁধে, তা হলে তার সম্পর্কে কিছু গোপন খবর জেনে রাখো। মহিলা খুব একটা ভালো চরিত্রের নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে তার অনেকগুলি বাড়ি আছে। সমস্ত বাড়িতে এই ধরনের গয়না আছে। তাছাড়া গয়নাগুলো বীমা করা, এতে মহিলার কোনো লোকসান হয় না।
ট্রেসি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিল। সে ভাবতেই পারছে না, এখানে বসে বসে সে গয়না চুরি করার প্ল্যান আঁটছে।
–আমি আর জেলে যেতে চাই না মিস্টার মরগান।
–কোনো বিপদ নৈই এতে, আমার সঙ্গে কাজ করলে কোনো দিন কোনো ঝঞ্ঝাট হবে না। হয়নিও আগে? এ ব্যাপারে আমি তোমাকে একশো ভাগ নিরাপত্তা দিতে পারি। ট্রেসির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, আপনি পঁচিশ হাজার ডলারের কথা বলছিলেন না?
–মাল হাতে পেলেই নগদ পাবে।
এতগুলো টাকা হাতে পেলে ট্রেসিকে আর ওই নরকে থাকতে হবে না। চাকরির জন্য দোরে দোরে ভিক্ষা করতে হবে না। তবু শেষ পর্যন্ত সে বিবেকের দংশনে দংশিত হচ্ছিল। দোনামোনা করছিল।
–আমি বলছিলাম কী, এই শনিবারই কাজটা সেরে ফেল। চাকররা দুপুরবেলা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আমি তোমাকেই ছদ্মনামে গাড়ি চালাবার লাইসেন্স দেব। তুমি ম্যানহাটন থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে লং আইল্যান্ডে চলে যাবে। পৌঁছবে ঠিক এগারোটার সময়, গয়নাগুলো নিয়ে ফিরে আসবে। গাড়ি চালাতে জানো তো?
–জানি।
–চমৎকার। সেন্টলুই স্টেশন থেকে সকাল ৭-৪৫ মিনিটে একটি ট্রেন ছাড়ে। তোমার জন্য কামরা রিজার্ভ করা থাকবে। স্টেশনে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। তখনই তোমার হাতে ২৫ হাজার ডলার দিয়ে দেব।
ট্রেসি আর কথা বলার সুযোগ পেল না। তবু আমতা আমতা করে সে বলল আমার একটা সোনালী পরচুল চাই।
ট্রেসি চলে যাবার পর কোনরাড একটু দ্বিধায় পড়ল। মেয়েটা দারুণ সুন্দরী, চুরি আটকানোর জন্য ওই বাড়িতে অ্যালার্মের ব্যাপার আছে, এটা কিন্তু কোনরাড জানত না।