১.১ দর্পণে কার মুখ

এ স্ট্রেঞ্জার ইন দ্য মিরর – সিডনি সেলডন
ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন

দর্পণে কার মুখ?

সূচনা :

১৯৬৯-র আগস্টের শুরুতে নিউইয়র্ক বন্দর থেকে লা হাভর বন্দরগামী পঞ্চান্ন হাজার টন ওজনের লাক্সারী লাইনার এস, এস, ব্রিট্যানীর বুকে শনিবারের এক সকালে সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতির সময় অনেকগুলো অদ্ভুত ও অযৌক্তিক ঘটনা ঘটে গেল।

 খুঁটিনাটি সম্বন্ধে অতিসচেতন ও কর্মদক্ষ চীফ পারসার ক্ল্যদ দেসাদ জাহাজে পনেরো বছর ধরে চাকরী করছে। যে কোন পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে, গোপনীয়তা বজায় রেখে সামলাতে সে খবুই পটু। এস, এস, ব্রিট্যানী ফরাসী জাহাজ এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজটা খুবই কঠিন।

 কিন্তু গ্রীষ্মের এই সকালে হাজারটা শয়তান যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। সংবেদনশীল গল্-দেশীয় ব্যক্তিত্বের অন্তর্লীন অহমিকায় সেদিন যে আঘাত লেগেছিল, পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল-এর মার্কিন ও ফরাসী শাখা এবং স্টীমশিপ কোম্পানীর নিজস্ব সিকিউরিটি শাখা এই ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যুক্তিসঙ্গত কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছলেও ক্ল্যদ দেসাদ-এর আহত অহংবোধের সম্পূর্ণ নিরাময় হয়নি।

 যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছিল বিখ্যাত ব্যক্তিদের কেন্দ্র করে। কাহিনীটা পৃথিবীর অধিকাংশ সংবাদপত্রে বড় বড় হেডলাইনে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু রহস্য ভেদ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

ক্ল্যদ দেসার্দ ট্র্যান্স অ্যাটলান্টিক স্টীমাশিপ লাইন থেকে রিটায়ার করে নীএ একটা রেস্তোরাঁ খুলেছিল। আগস্ট মাসের সেই অদ্ভুত ও অবিস্মরণীয় দিনের গল্প সে সবাইকে শোনাতো।

…দেসার্দ বলতো, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পাঠানো উপহার ফুলগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনার শুরু।

সমুদ্রযাত্রার শুরু করার ঠিক এক ঘন্টা আগে হাডসন নদীর জেটির সামনে এলো সরকারী লাইসেন্স-প্লেট-লাগানো কালো লিমুজিন গাড়ী। কাঠকয়লার রঙের ধুসর সুট পরা এক ভদ্রলোক জুনিয়র ডেক অফিসার অ্যালা-সাফ-এর হাতে ছত্রিশটা স্টারলিং সিলভার গোলাপের তোড়া তুলে দিয়ে কয়েকটা কথা বললেন। পরে ফুলগুলো গেল জুনিয়র ডেক অফিসার জানির হাতে। সে ফুলগুলো যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে জাহাজের চীফ পারসার ক্ল্যদ দেসাদ-কে জানালোর প্রেসিডেন্ট ফুল পাঠিয়েছেন মাদাম টেমপলকে।

 মাদাম টেমপল। অর্থাৎ, মিসেস জিল টেমপল। গত এক বছরে সবকটা দৈনিক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের সামনের পাতায় এই মহিলার ফটো ছাপা হয়েছে। নিউইয়র্ক, ব্যাংকক, প্যারী ও লেনিনগ্রাদের সব পত্রপত্রিকায়। পৃথিবীর কোন মহিলা সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয়। এই শীর্ষক সাম্প্রতিক পোলে সবচেয়ে বেশী ভোট পেয়েছেন এই মহিলা। নবজাতিকাদের নাম রাখা হয় তার নামে। জিল টেমপল এখন অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এক জনপ্রিয় নায়িকা। তার সাহস, আশ্চর্য সংগ্রাম এবং নিয়তির নির্মম পরিহাসে তার পরাজয় : এসব পৃথিবীর মানুষের কল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর জীবনকাহিনী শুধু অসাধারণ এক প্রেমকাহিনী নয়। গ্রীক নাটক ও ট্র্যাজেডির সব উপাদানই আছে তার জীবনে।

ফরাসী নাগরিক ক্ল্যদ দেসার্চ অ্যামেরিকানদের খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু মাদাম টবি টেমপলের কথা আলাদা। মাদামের সমুদ্র যাত্রার অভিজ্ঞতা যেন আনন্দদায়ক ও মনে রাখার মত হয়, তা সে দেখবে।

প্যাসেঞ্জার-লিস্টে অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের নামের ওপর চোখ বোলাচ্ছে ক্লদ দেসার্দ। আমেরিকানরা যাদের ভি. আই. পি. বলে তাদের অনেকেরই নাম আছে লিস্টে। অবশ্য মানুষের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমেরিকানদের ধারণা খুবই অদ্ভুত।

এক ধনী শিল্পপতির বউ জাহাজে একা যাচ্ছেন দেখে লিস্ট খুঁজে নিগ্রো ফুটবল খেলোয়াড় (এবং মহিলার প্রেমিক) ম্যাট এলিসের নাম খুঁজে পেয়ে খুব খুশী হল ক্ল্যদ। দেসাদ। পাশাপাশি কেবিনে রয়েছেন নামজাদা এক মার্কিন সিনেটর এবং ক্যারোলিনা রককা নামের এক দক্ষিণ অ্যামেরিকান রূপসী, যে স্ট্রিপটিজ নাচে নগ্ন শরীরের ছলাকলা দেখায়। ওদের দুজনের যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক কেচ্ছা কাহিনী ছাপা হয়েছে খবরের কাগজে।

 লিস্টে আরও নাম। ডেভিড ক্যানিয়ন। সুদর্শন, অ্যাথলিটের মত চেহারা, স্বল্পবাক এবং ধনী। ওকে ক্যাপটেনের টেবিলে ঠাই দিতে হবে।

ক্লিফটন লরেন্স। শেষ মুহূর্তে এই জাহাজে কেবিন বুক করেছেন। হ্যাঁ, এখন প্রশ্ন হল, ক্যাপটেনের টেবিলে মঁসিয়ে ক্লিফটন লরেন্সকে ঠাই দেবে চীফ পারসার ক্ল্যদ দেসার্দ? না, দেবে না? এককালে হলিউডের বহু বিখ্যাত চিত্রাভিনেতা ও ব্রডওয়ের বহু নাট্যাভিনেতা অভিনেত্রীর এজেন্ট ছিলেন এই ক্লিফটন লরেন্স। কিন্তু আজ তার সুখের দিন ফুরিয়েছে। আগে হলে ক্লিফটন লরেন্স দামী কেবিন চাইতেন। এখন তিনি নিয়েছেন লোয়ার ডেকের একটা মাত্র ঘর। ওঁর ব্যাপারে কিছু করার আগে নামগুলো দেখা দরকার।

এই জাহাজে চলেছেন ছোটখাট দেশের এক রাজা, বিখ্যাত এক অপেরা-গায়িকা এবং এমন একজন রাশিয়ান ঔপন্যাসিক, যিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।

দরজায় করাঘাতের শব্দ হয়। আঁতোয়া নামের এক পোর্টার ভেতরে ঢোকে।

ইয়েস…কি হয়েছে, আঁতোয়া?

 আপনি কি থিয়েটার লক করার অর্ডার দিয়েছেন?

তার মানে?

দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে বোধহয় ফিলম দেখানো হচ্ছে?

 জাহাজ যখন বন্দরে থাকে, তখন ফিলম দেখানো হয় না। তাছাড়া ওই দরজা কখনও লক করা হয় না। আমি ব্যাপারটা দেখছি…

কিন্তু ছোটখাট সব ব্যাপারের দেখাশোনা করতে আরও আধঘন্টা গেল। ক্যাপটেন বিয়ে উপলক্ষ্যে যে উপহার-এর অর্ডার দিয়েছিলেন তা ভুলে অন্য জাহাজে গেছে। ক্যাপটেন চটে যাবেন। জাহাজের চারটে টারবাইনের স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শোনে দেসার্দ। জাহাজ জেটি ছেড়ে চ্যানেলের দিকে যাচ্ছে।

 আধঘন্টা পরে চীফ ডক স্টুয়ার্ড লিয় এসে বলে–একটু আগে মাদাম জিল টেমপলের কেবিনের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনলাম, উনি আর্তচীৎকার করে বলছেন–তুমি আমাকে খুন করলে–কাকে বলছেন, আমি জানি না…

আমি খোঁজ নিচ্ছি।

ক্যাপ পরে দরজার দিকে যাচ্ছিল ক্ল্যদ দেসা। হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। থার্ড মেট ফোনে বলে-ক্ল্যদ, থিয়েটারের মেঝেয় রক্ত, রক্ত, রক্ত

দেখছি..কেউ আহত হয়নি তো? রক্ত মুছতে পাঠাচ্ছি পোর্টারকে। ডাক্তারকেও ফোন করছি।

…অ্যামব্রোজ লাইটশিপের কাছাকাছি এসেছে এখন জাহাজ। এবার পাইলট-বোট বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কি আশ্চর্য….

লাগেজ সমেত এক প্যাসেঞ্জারও চলে যাচ্ছেন পাইলট-বোটে!

তাড়াতাড়ি জিল টেমপলের কেবিনের দিকে গেল ক্ল্যদ দেসাদ। কোন সাহায্য করতে পারি?

কোন উত্তর নেই।

দরজার হাতল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল।

কেবিনের এক প্রান্তে পোর্টহোলে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয়া মহিলা জিল টেমপল। অদ্ভুত একটা শব্দ, চাপা শব্দ বের হচ্ছে ওর মুখ দিয়ে। যেন একটা জন্তু দারুণ যন্ত্রণায় কাত্রাচ্ছে। ব্যক্তিগত যন্ত্রণার সেই মুহূর্তে অসহায় ক্ল্যদ দেসাদ সবাধানে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সাবধানে ও নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।

দুঃখ বড় আপন এবং দুঃখ বড় গোপন, ফরাসীরা জানে।

তারপর মেন ডেকের সামনে জাহাজের যে থিয়েটার, তার দিকে যায় ক্ল্যদ দেসাদ। মেঝেয় রক্ত মুছছে পোর্টার। এই আধুনিক অডিটোরিয়ামে দুশো লোক ফিলম দেখতে পারে। কিন্তু এখন অডিটোরিয়াম শূন্য। ভেতরে ৩৫ মিমি. প্রজেক্টর দুটোর একটা গরম। অর্থাৎ কেউ ফিলম দেখাচ্ছিল…কিন্তু প্রজেকসনিস্ট বলছে, সে কিছু জানে না।

এবং রান্নাঘরে… ।

 শ্যেf রেগে উঠে বললে–দ্যাখো, ক্ল্যদ, একটা উজবুক এ কি করেছে..

প্যাস্ট্রীর টেবিলে আগামী বিবাহ উৎসব উপলক্ষে আনা সুন্দর ওয়েডিং কেকের ওপরে চিনির তৈরী বরবধুর মূর্তি। নববধূর মাথাটা কে যেন ভেঙে দিয়েছে।

… সেই মুহূর্তে…

–দেসার্দ তার রেস্তোরাঁয় সম্মোহিত শ্রোতাদের বলতে থাকে।

 সেই মুহূর্তে আমি বুঝেছিলাম যে ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে…

.

কাহিনী

০১.

১৯১৯–এ মিচিগানের ডেট্রয়েট শহর পৃথিবীর সবথেকে সফল শিল্পনগরী। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং এই মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষকে বিজয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডেট্রয়েটের। কারণ মিত্রপক্ষকে ট্যাংক, ট্রাক ও এরোপ্লেন সরবরাহ করছে এই ডেট্রয়েট শিল্পনগরী। এখন জার্মান হুনদের আক্রমণের ভয় কেটে যেতে দিনে চার হাজার মোটর গাড়ী তৈরী হচ্ছে এই শিল্পনগরীতে। ট্রেন্ড ও আনট্রেন্ড দুধরনের শিল্প শ্রমিক-ইতালিয়ান, আইরিশ, জার্মান–সবাই ভিড় জমাচ্ছে ডেট্রয়েটে।

 নতুন আগন্তুকদের মধ্যে দুজন পল টেমপলা এবং তার নববধু ফ্রিয়েদা। বিয়েতে পণ হিসাবে সে যা টাকা পেয়েছিল তাই দিয়ে ডেট্রয়েটে একটা কসাইখানা খুললো পল। কিন্তু লাভের বদলে ক্ষতি হতে লাগলো। কসাই হিসেবে পল কাজ বোঝে। কিন্তু সে ব্যবসায়ী হিসেবে একেবারেই অপদার্থ। সত্যিকথা বলতে কি, টাকা কামানোর চেয়ে তার কবিতা লেখাতেই বেশী আগ্রহ দেখা যায়। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সে কবিতার ছন্দ, কবিতার স্বপ্নলোকের কথা ভাবে। সে কবিতা লিখে ম্যাগাজিনে পাঠায়। সেই মাস্টারপিসগুলো কোনো ম্যাগাজিন ছাপায় না। টাকা পয়সার কোন গুরুত্ব নেই পলের কাছে। সে কাস্টমারদের ধারে মাংস দেয়। পকেটে পয়সা না থাকলে তরেই ওরা তার দোকানে আসে।

 পলের বউ ফ্রিয়েদা দেখতে ভালো নয়। পল তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার আগে কোন পুরুষই আসেনি ফ্রিয়েদার জীবনে। প্রস্তাবটা মেনে নেওয়ার জন্য বাবাকে অনুরোধ জানিয়েছিল ফ্রিয়েদা। কিন্তু প্রস্তাবটা না মেনে নেওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না বুড়ো বাপের। বাপের ভয় ছিল, এই নেহাৎ সাদামাটা চেহারার মেয়ের বুঝি কোনকালে বিয়েই হবে না। ফ্রিয়েদা ও তার স্বামী যাতে জার্মানী ছেড়ে আমেরিকা যেতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে যথেষ্ট টাকা দিয়েছিল বুড়ো।

প্রথম দর্শনেই স্বামীকে ভালেবেসে ফেললাম ফ্রিয়েদা। এর আগে কোন কবিকে কখনও চোখে দেখেনি ফ্রিয়েদা। পল রোগা, দেখতে বুদ্ধিজীবীর মত, চোখে ভালো দেখে না, মাথায় টাক পড়েছে। জেনসিয়ান রং গাঢ় নীল চোখ দুটো ছাড়া ফ্রিয়েদার চেহারায় সুন্দর কিছু নেই। থ্যাবড়া নাক, উঁচু কপাল, চৌকোনো চোয়াল, মোটা-সোটা শরীর ফ্রিয়েদার বাইরের এই রূপটার আড়ালে লুকিয়ে ছিল যুবতী মন-যে মন ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে। অথচ এই লোভেই ওকে বিয়ে করেছিল এই পল। টাকা থাকলে তাকে গরু-শুয়োরের মাংস নিয়ে বেশী ভাবতে হবে না। সে নিশ্চিন্তে কবিতা লিখতে পারবে।

 স্যালজবার্গে বনভূমি ও উদ্যানঘেরা এক সুন্দর ও প্রাচীন দুর্গে মধুচন্দ্রিমা উদযাপনে গেল নবদম্পতি। সামনে সুন্দর হ্রদ।

হানিমুনের দৃশ্যটা স্বপ্নে ভেবেছে অনেকবার ফ্রিয়েদা।

দরজা বন্ধ করে ভালোবাসার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে বলতে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করবে তার স্বামী। তারপর মিষ্টি ঠোঁট নেমে আসবে ঠোঁট থেকে স্তন, স্তন থেকে নাভিমূল, নাভিমূল থেকে গোপন গভীরে। পুরুষের নারী অঙ্গ লেহনের নানা কাহিনী পর্নোগ্রাফিতে পড়েছে বই কি ফ্রিয়েদা।

 পলের পুরুষাঙ্গটা জার্মান পতাকার পতাকাদণ্ডের মত শক্ত ও সোজা হয়ে উঠবে। উলঙ্গ ফ্রিয়েদাকে জড়িয়ে ধরে বিছানার দিকে নিয়ে যাবে পল। ফ্রিয়েদা বড় মোটা, সুতরাং কোলে তুলে নিয়ে না যাওয়াই ভালো।

উদোম উলঙ্গ ফ্রিয়েদাকে বিছানায় শুইয়ে পল বলবে–মাই গড, ফ্রিয়েদা, তোমার শরীর রোগা মেয়েদের মত নয়, সত্যিকার মেয়ে মানুষের মত..

কিন্তু রূঢ় বাস্তব সব স্বপ্ন ভেঙে দেয়।

দরজা বন্ধ করে শার্ট খুললো পল। রোগা বুক সম্পূর্ণ নির্লোম। দুপায়ের মাঝখানে ছোট্ট শিথিল পুরুষাঙ্গ-পর্নোগ্রাফির ছবির সঙ্গে কোন মিল নেই। প্যান্ট খুলে বিছানায় শুলো পল। অর্থাৎ ফ্রিয়েদা নিজেই পোশাক খুলবে।

বেশ, তাই হোক। সাইজই তো সব নয়। পল হয়তো যৌন মিলনে দারুন পারদর্শিতা দেখাবে।

খানিকক্ষণ পরে নববধূ ফ্রিয়েদা উদোম উলঙ্গ হয়ে শুলো তার স্বামী পলের পাশে। একটাও রোম্যানটিক কথা বললো না পল। স্রেফ তার শরীরের ওপর চাপলো, তার গোপন গভীরে পুরুষাঙ্গ কয়েকবার খোঁচা দিল। তারপর নেমে গেল। শুরু হতে না হতেই শেষ।

পলের যৌন অভিজ্ঞতা এ যাবৎ মিউনিখ শহরের বেশ্যাদের সঙ্গে। আর একটু হলে সে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে বউয়ের হাতে দিতে যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে তার হঠাৎ খেয়াল হল, যৌন মিলনের জন্যে বউকে পয়সা দিতে হয় না। নিখরচায় ফুর্তি।

পল ঘুমিয়ে পড়ার অনেক পরেও জেগেছিল বেচারা ফ্রিয়েদা। জেগে জেগে ভাবছিল–সেক্স সবকিছু নয়, স্বামী হিসেবে খুব ভালো হবে পল।

কিন্তু ও ব্যাপারেও তার আশা পূরণ হয়নি।

হনিমুনের কয়েকদিন পরেই স্বামী বাস্তব রূপ চিনতে পেরেছিল ফ্রিয়েদা। কিন্তু জার্মান বউদের ঐতিহ্য বজায় রেখে সে স্বামীর আদেশ মেনে চলতো। তবে সে বুঝতে যে কবিতা লেখা ছাড়া এই পলের কোন ব্যাপারে সামান্যতম আগ্রহ নেই। এবং কবিতাগুলোই একদম বাজে।

ডেট্রয়েটে আসার পর ফ্রিয়েদার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। সে একদিন দোকানে এসে ক্যাশ রেজিস্ট্রার নিয়ে বসলো এবং পলকে আতংকিত করে নোটিস টাঙালো : ধার দেওয়া হয় না। সে মাংসের দাম চড়ালো এবং দোকানের বিজ্ঞাপন বিলি করলো চারপাশের এলাকায়। রাতারাতি কসাইখানায় মাংসের বিক্ৰী বেড়ে গেল।

 সেই মুহূর্ত থেকে ব্যবসায় টাকা খাটানো, বাসস্থানের ব্যাপারে বা ছুটি কোথায় কাটানো হবে সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার নিল ফ্রিয়েদা।

এবং এক সন্ধ্যায় ফ্রিয়েদা পলকে জানালো, সে এবার সন্তানের মা হবে বলে ঠিক করেছে। পলের ধারণা, বেশী যৌনসঙ্গমে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে। কিন্তু ফ্রিয়েদা খুব শক্ত মেয়ে। সে ছাড়বার পাত্র নয়। ফ্রিয়েদা বলে–

ওটা আমার ভেতরে ঢোকাও।

কিভাবে ঢোকাব? ওটার ইচ্ছে নেই।

পলের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেটা শক্ত হয়ে উঠলে ফ্রিয়েদা ওটা নিজের গোপন গভীরে ঢুকিয়ে নেয়।

তিন মাস পরে ফ্রিয়েদা স্বামীকে জানালো, স্বামী এখন বিশ্রাম নিতে পারে। কেননা ফ্রিয়েদা গর্ভবতী হয়েছে। ফ্রিয়েদা চেয়েছিল ছেলে।

অতএব…ওদের ছেলেই হল।

ফ্রিয়েদার ইচ্ছে অনুযায়ী বাড়ীতে দাই-এর তত্ত্বাবধানে বিনা ঝামেলায় বাচ্চা হল।

কিন্তু নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে সবাই অবাক। ওর পুরুষাঙ্গটা শরীরের তুলনায় অনেক বড় ও অনেক মোটা। ওর বাবার মত নয়, গর্বের সঙ্গে ভাবলো ফ্রিয়েদা।

ওই এলাকার এক অলডারম্যানের নাম অনুযায়ী ফ্রিয়েদা নবজাত শিশুর নাম রাখলে টোবিয়াস। ছেলের বাবা পল ছেলের কাছে যাবার সুযোগ পেতো না বিশেষ। ছেলেকে মানুষ করলো ফ্রিয়েদা। শক্ত হাতে মানুষ করলো। টবি রোগা, পা দুটো সরু, চোখদুটো উজ্জ্বল নীল। সে মাকে ভালোবাসে, মায়ের আদর চায়। কিন্তু ছেলেকে খুব ভালোবাসলেও জীবিকা অর্জনে ব্যস্ত মায়ের ছেলেকে আদর করার সময় নেই। তাছাড়া ছেলে যেন বাপের মত অপদার্থ, দুর্বল, আহাম্মক না হয়, তাও তো দেখা দরকার। স্কুলের পড়া টবি না পারলে মা বলতো–কাম অন, সার্টের হাতা, গুটিয়ে কাজে কাজে নামো। এবং ফ্রিয়েদা ছেলেকে যতো বকাবকি করতো, ছেলে মাকে ততো ভালোবাসতো। মা অসন্তুষ্ট হবে ভাবলে ছেলে ভয়ে কাপে। কোন অন্যায় করলে মা সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেয়। ভালো কিছু করলে মা সহজে প্রশংসা করে না। মায়ের ধারণা, এসব ছেলের ভালোর জন্যেই। এই ছেলে বড় হলে তার দারুন নামডাক হবে। কিভাবে হবে, ফ্রিয়েদা জানে না। ঈশ্বর যেন তার কানে কানে বলে দিয়েছেন, এই ছেলে বড় হলে নামজাদা লোক হবে। এবং ছেলেকে সে বোঝায়, তুমি মস্ত বড় হবে, তোমার নামডাক হবে, এবং ছোট্ট টবির বিশ্বাস হল, বড় হলে সে মস্ত এক মানুষ হবে। কিভাবে হবে, সে জানে না। কিন্তু তার মা কখনও মিথ্যে বলতে পারে না।

ছোট্ট টবির জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্তগুলো কাটতো রান্নঘরে। পুরোনো ধরনের মস্ত বড় স্টোভে তার মা রাঁধতো সুগন্ধী কালো বীনস্যুপ। তাতে ভাসতো মস্ত সব ফ্র্যাংকঘুস্টার। আলুর প্যানকেকের ধারটা বাদামী লেসের মত। তুষারকণার মত হাল্কা ময়দা মাখছে মা। তাজা আপেলের টুকরো ভাজছে মাখনে। তখন ছোট্ট টবি মায়ের মোটাসোটা শরীরটা জড়িয়ে ধরতো। মায়ের কোমর অবধি হাত পৌঁছতো তার। এবং নারী শরীরের গন্ধ বালকের অন্তলীন সুপ্ত যৌনতাকে জাগিয়ে তুলতো। সেই মুহূর্তে টবি তার মায়ের জন্য মরতেও তৈরি ছিল। পরবর্তী জীবনে, মাখনের তাজা আপেল ভাজার গন্ধ পেলেই তার স্মৃতিতে ভেসে আসতো মায়ের ছবি।

টবির যখন বারো বছর বয়স মিসেস ডারকিন নামের প্রতিবেশিনী বাঁচাল, আড্ডাবাজ এক মহিলা এলেন ওদের বাড়ী বেড়াতে। উনি চলে যেতে ছোট্ট টবি মহিলার বাচনভঙ্গী নকল করে শোনালো মাকে। মা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরলো। তার পর থেকেই মাস্টার, সহপাঠী, কসাইখানার কাস্টমারদের কথনভঙ্গী নকল করে মাকে দারুন হাসাতো । ছোট্ট টবি।

 স্কুলে নো অ্যাকাউন্ট ডেভিড নামের হাসির নাটকে মুখ্য ভূমিকা পেল টবি। মা নাটক দেখে খুব হাসলো। ছেলে খ্যাতিমান হবে, ঈশ্বরের এই প্রতিশ্রুতি কিভাবে পূরণ হবে? মা বুঝতে পারলো।

১৯৩০-এ যখন অ্যামেরিকায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, সিনেমায় ভীড় নেই বলে সিনেমার আগে গানের, বাজনার, কমিকের সব কমপিটিসন হচ্ছে। এই সব। প্রতিযোগিতায় ছেলেকে নিয়ে যেতো মা। অল জনসন, জেমস ক্যাগণী, এডি ক্যান্টরের কথনভঙ্গী নকল করে লোক হাসিয়ে ছেলে প্রায়ই প্রথম পুরস্কার পায়। কি প্রতিভাবান ছেলে।  –মা বলে।

 এখন টবি লম্বা হয়েছে। তবে রোগা। সরল মুখে উজ্জ্বল দুটো চোখ। দেখলেই মনে হয় : নিষ্পাপ। লোকে টবিকে ভালোবাসে। সে স্টেজে উঠলেই সবাই হাততালি দেয়। এই প্রথম টবি বুঝলো প্রথমে মাকে এবং দ্বিতীয়তঃ ঈশ্বরকে খুশী করার জন্য তাকে মঞ্চ ও ফিলমের তারকা হতে হবে।

পনেরো বছর বয়সেই তার যৌনকামনা জেগে উঠেছিল। সে বাথরুমে হস্তমৈথুন করতো।

এক সন্ধ্যায় এক সহপাঠীর বিবাহিতা দিদি ক্লারা কনরস তাকে নিজের গাড়ীতে লিফট দেয়। ক্লারার মাথায় সোনালী চুল, তার স্তন দুটো বড় বড়। ক্লারার পাশে বসে টবির পুরুষাঙ্গ খাড়া হয়ে ওঠে। হঠাৎ ক্লারার কোলে হাত রাখে টবি। তারপর প্যান্ট খুলে নিজের পুরুষাঙ্গের সাইজ ক্লারাকে দেখালো টবি। মস্ত বড় ও খুব মোটা শক্ত খাড়া পুরুষাঙ্গ দেখে এত অভিভূত হল ক্লারা যে সে টবিকে নিজের বাড়ী নিয়ে গিয়ে যৌনসঙ্গমে দীক্ষা দিল। টবির কাছে সে এক আশ্চর্য সুন্দর অভিজ্ঞতা। সাবান মাখানো হাতের বদলে নারীশরীরে গোপন গভীরে তপ্ত, নরম, স্পন্দিত এক পাত্র যা পুরুষাঙ্গকে ধরে রাখে। ক্লারার মৃদু শীৎকারের শব্দে পুরুষাঙ্গটা বার বার শক্ত হয়ে ওঠে। বার বার যৌন পুলক পায় টবি। ব্যাপারটা গোপন রাখলো না ক্লারা। ফলে অচিরে প্রতিবেশিনী এক ডজন বিবাহিত মহিলার সঙ্গে যৌনসঙ্গমের সুযোগ পেল টবি।

পরবর্তী দুর্বছরে ক্লাসের সহপাঠিনী মেয়েদের প্রায় অর্ধেকের কৌমার্য হরনের সুযোগ পেল টবি। টবির অনেক সহপাঠী সুদর্শন, ফুটবল খেলোয়াড়, ধনী। কিন্তু টবির যা আছে, ওদের তা নেই। টবি মেয়েদের হাসাতে পারে। এই নিষ্পাপ মুখে স্বপ্নাতুর দুটো উজ্জ্বল নীল চোখের চাউনি মেয়েদের কাছে টানে।

হাইস্কুলের সিনিয়র ইয়ারে পড়ছে টবি। তাকে প্রিনসিপ্যালের ঘরে ডাকা হল, সেখানে তখন প্রিনসিপ্যাল, টবির মা, ষোল বছর বয়সী ক্যাথলিক মেয়ে আইলীন হেনেগান এবং তার বাবা ও ইউনিফর্মপরা পুলিশ সার্জেন্ট। টবি ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে বুঝলোঃ সে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে।

প্রিনসিপ্যাল বললেন–

টবি, আইলীন এখন গর্ভবতী, ওর সঙ্গে তোমার শারীরিক সম্পর্ক ছিল?

টবির মুখ শুকিয়ে যায়। আইলীনের ভালো লেগেছিল টবির সঙ্গে যৌনসঙ্গম।

আইলীনের পুলিশ সার্জেন্ট বাবা গর্জন করে–জবাব দাও, ইউ লিটল সন অফ এ বিচ, তুমি আমার মেয়েকে ছুঁয়েছো?

 মায়ের দিকে আড়চোখে তাকালো টবি। মাকে সে দুঃখ দিয়েছে। সে ডাক্তারের কাছে। গিয়ে বলবে, আমার অণ্ডকোষ দুটো কেটে আমায় খোঁজা করে দাও, যাতে আমি আর কোন মেয়ের সঙ্গে যৌনমিলনে না মাতি, যেন আমার মা আমার ব্যবহারে দুঃখ না পায়।

তার মা ঠান্ডা, শক্ত গলায় বলে–

টবি, তুমি এই মেয়ের সঙ্গে শুয়েছো?

ঢোঁক গিলে টবি বলে–হ্যাঁ, মা।

তাহলে তোমায় আইলীনকে বিয়ে করতে হবে। আইলীন, তুমি তাই চাও?

হ্যাঁ আমি টবিকে ভালোবাসি। টবি, তোমার নাম আমি বলতে চাইনি। ওরা জোর করে…

আইলীনের পুলিশ সার্জেন্ট বাবা বলে–

আমার মেয়ের বয়স ষোল বছর। আইন অনুযায়ী, তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বলাৎকারের সামিল। টবির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

তবে ও যদি বিয়ে করতে চায়…

টবি আবার ঢোঁক গিলে বলে–হ্যাঁ স্যার…আমি দুঃখিত।

মায়ের সঙ্গে বাড়ী ফেরার সময় টবি ভাবছিল, তার চিত্রতারকা হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেল, এখন তাকে আইলীন ও বাচ্চার খরচপত্র জোগাড় করতে মাংসের দোকানে খাটতে হবে।

অথচ ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে সুটকেসে তার কাপড় জামা ভরতে থাকে তার মা।

মা, তুমি কি করছে?

 টবি, ফালতু একটা মেয়ের জন্যে তোমার জীবন নষ্ট হতে আমি দেব না। তুমি ওর সঙ্গে শুয়েছে। ওর বাচ্চা হবে। তার মানে, তুমি পুরুষ, মেয়েটা বোকা। না, আমার ছেলেকে এই ভাবে ফাঁদে ফেলা যাবে না। তুমি বড় হবে, তোমার নামডাক হবে। এটাই ঈশ্বরের অভিপ্রায়। টবি, তুমি নিউইয়র্কে যাবে। যখন তুমি মস্ত বড় তারকা হবে, তখন আমায় ওখানে নিয়ে যাবে।

 মাকে জড়িয়ে ধরে টবি, তাকে তারকা হতে হবে, বিখ্যাত হতে হবে। কেননা মা বলেছে…

.

০২.

১৯৩৯-এর নিউইয়র্ক মহানগরী থিয়েটারের তীর্থস্থান। অর্থনৈতিক মন্দার দিন শেষ।, প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট বলছেন, ভয় ছাড়া আমাদের ভয় পাবার মত কিছুই নেই এবং আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ হবে। তাই হয়েছে, প্রত্যেকের পকেটেই খরচা করার মত টাকা আছে। ব্রডওয়েতে তিরিশটা নাটকের অভিনয় চলছে। প্রত্যেকটাই হিট হয়েছে।

মায়ের দেওয়া একশো ডলার পকেটে নিয়ে নিউইয়র্কে এল টবি। সে জানে যে সে বিখ্যাত হবে, ধনী হবে। তারপর সে মাকে নিউইয়র্কে আনবে, উর্দুতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে, রোজ রাতে থিয়েটারে ছেলের অভিনয় দেখবে মা। ইতিমধ্যে…একটা চাকরী চাই। ব্রডওয়ের সব থিয়েটারের দরজায় দরজায় ঘুরেছে টবি। অ্যামেচারদের কত প্রতিযোগিতায় সে জিতেছে, তার কতো প্রতিভা–সে সবাইকে বোঝায়। ওরা তাকে বের, করে দেয়। থিয়েটারে ও নাইটক্লাবে কমেডিয়ান অভিনেতাদের অভিনয় দেখে টবি। বেন ব্ল. জো. ই. লুই, ফ্র্যাংক ফে। টবি জানে, একদিন সে ওদের সবার থেকে বেশী জনপ্রিয় হবে।

টাকা ফুরিয়ে আসছে। রেস্তোরাঁয় ডিশ ধোয়ার চাকরী নিয়েছে টবি। রবিবার সকালে ফোনের রেট কম। তখন মাকে ট্রাংকল করে টবি। টবি পালিয়েছে বলে সবাই চটে গেছে।

 পুলিশ অফিসার রোজ রাতে পুলিশের গাড়ীতে আমাদের বাড়ী এসে চেঁচামেচি করে। ভাব দেখলে মনে হবে, আমরা সব চোর-ডাকাত। তুই কোথায়, ওরা জানতে চায়।

তুমি কি বললে মা?

সত্যি কথাই বললাম। তুই রাতে চোরের মত পালিয়েছিস। এখানে ফিরলে আমি নিজের হাতে তোর ঘাড় মুচড়ে দেবো। ছেলে হেসে ওঠে।

 সেই গ্রীষ্মে এক ম্যাজিসিয়ানের অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরী পেল টবি। তার প্রতিভার অভাব। সে নাম নিয়েছে–গ্রেট মার্লি। ক্যাটস্কিলের ফালতু হোটেলগুলোতে লোকটা ম্যাজিক দেখায়। সহকারী হিসেবে টবির কাজ হল মার্লিনের স্টেশনওয়াগন থেকে ম্যাজিক দেখানোর ভারী যন্ত্রপাতি বার করা এবং ছটা সাদা খরগোস, তিনটে ক্যানারী আর দুটো হ্যামস্টারকে পাহারা দেওয়া। অন্য কোন জন্তু যেন ওগুলোকে খেয়ে না নেয়, সেই ভয়ে ওদের সঙ্গেই রাত কাটায় টবি। সেই গ্রীষ্মের অভিজ্ঞতা জন্তুর শরীরের দুর্গন্ধে ভরা। ভারী ভারী ক্যাবিনেট, নীচের ও পাশের দরজা খোলার বড় বড় খিল–এইসব বইতে বইতে টবি ক্লান্ত। নিঃসঙ্গতা তাকে যন্ত্রণা দেয়। হতাশা তাকে পোড়ায়। বিশ্রী, ছোট্ট ঘরের ভেতরে। শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, এখানে সে কি করছে, কিভাবে সে তারকা হতে পারবে। আয়নার সামনে সে নানা মুখভঙ্গী নকল করে দেখানো প্র্যাকটিস করে। তার দর্শক ও শ্রোতা মারলিনের পোষা দুর্গন্ধযুক্ত জানোয়ারগুলো।

গ্রীষ্ম শেষ হয়ে আসছে। প্রতি সপ্তাহে বাড়ীতে ট্রাংকল করে টবি। এক রবিবার ফোন ধরলো তার বাবা।

আমি টবি, বাবা। তুমি কেমন আছো?

সব চুপচাপ।

হ্যালো, তুমি শুনছো?

হ্যাঁ, টবি।

মা কোথায়?

ওকে কাল হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

এতো জোরে রিসিভার চেপে ধরে টবি, আর একটু হলে ওটা ভেঙে যেতো।

কি হয়েছে মায়ের?

ডাক্তার বললো, হার্টের অসুখ।

না! আমার মা…

 মা ভালো হয়ে যাবে। তাই তো? বলো, বলো, মা ভালো আছে তো?

লক্ষ মাইল দূর থেকে ভেসে আসে বাবার কান্নার শব্দ।

ও…কয়েক ঘন্টা আগে ও মারা গেছে।

 যেন তপ্ত গলিত লাভার স্রোত টবিকে জ্বালিয়ে দেয়, পুড়িয়ে দেয়। বাবা মিথ্যে বলছে। মা মরে যেতে পারে না। কথা রাখার কথা ছিল। টবি বড় হবে, খ্যাতিমান হবে। মা তার পাশে থাকবে। সুন্দর ফ্ল্যাট, গাড়ী, ড্রাইভার, ফার-কোট, হীরে সব মায়ের জন্যে। দূর থেকে ভেসে আসে বাবার স্বর

টবি! টবি!

আমি বাড়ী যাবো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন কবে?

 কাল। তুমি এসো না টবি। ওরা তোমায় খুঁজছে। আইলীনের বাচ্চা হবে। ওর বাবা তোমায় খুন করতে চায়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তুমি আসবে ওরা আশা করে।

পৃথিবীতে একটা মাত্র মানুষকে ভালোবাসে টবি। মা, তার মা, তাকে বিদায় জানাতে যাওয়া হল না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে টবি। স্মৃতি ভেসে আসে। মায়ের স্মৃতি। জীবন্ত, উজ্জ্বল। রান্নাঘরে মা। মা বলছে, টবি তুই বড় হবি, বিখ্যাত হবি। থিয়েটারের সামনের রোয়ে বসে মা বলছে-ছেলেটার কি প্রতিভা।

–ছেলে অভিনয় করে, হাসায়। মা হাসে। মা সুটকেসে ছেলের জিনিসপত্র ভরে দিচ্ছে। বলছে–যখন তুই নামজাদা চিত্র ও মঞ্চ তারকা হবি, তখন আমায় ডেকে পাঠালেই আমি যাবো।

 টবি ভাবে–আজ, ১৯৩৯-এর ১৪ ই আগস্ট। এই দিনটা আমি ভুলবো না, কোনদিন ভুলবো না।

ওর জীবনে এই দিনটার গুরুত্ব অনেক।

 সে ঠিকই বুঝেছিল।

তার মায়ের মৃত্যুদিন বলে নয়…

ওই দিনে…

১৫০০ মাইল দূরে টেকসাসের অডেসায় আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেইজন্যে…

 নামহীন একটা চারতলা বাড়ীতে হাসপাতাল। ভেতরে খরগোসের বাসার মত ছোট ছোট কিউবিকল। কোথাও রোগ নির্ণয় হয়, কোথাও বা হয় রোগযন্ত্রণা কমানো, রোগ সারানো অথবা রোগীর মৃত্য। এই মেডিক্যাল সুপার মার্কেটে সবার জন্যেই কিছু না কিছু আছে।

এখন ভোর চারটে বাজছে। নিঃশব্দ মৃত্যুর সময়, কিম্বা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে ছটফট । করার সময়। হাসপাতালের ডাক্তার ও কর্মচারীদের পক্ষে পরের দিনের পরিশ্রমের আগে একটু বিশ্রাম নেবার সময়।

 প্রসূতি চিকিৎসাবিভাগের চার নম্বর অপারেশন থিয়েটারে এখন ঝামেলা বেঁধেছে। সাধারণ ডেলিভারী হিসেবে যা শুরু হয়েছিল, এখন তা এমার্জেন্সি রূপ নিয়েছে। মিসেস কার্ল জিনস্কির ডেলিভারী অস্বাভাবিক হওয়ার কোন কারণ ছিল না। মিসেস জিনস্কির বয়স কম, স্বাস্থ্য ভাল এবং পাছার দিকটা চওড়া

প্রসূতিবিশারদরা যা পছন্দ করেন। লেবার-পেই শুরু হয়েছে। সব ঠিকমতো চলছে।

 স্পেশ্যালিস্ট ডক্টর উইলসন ঘোষণা করলেন–ব্রীচ ডেলিভারী।

আতঙ্কের কোন কারণ ছিল না। ব্রীচ ডেলিভারীতে নবজাতকের মাথার বদলে শরীরে নীচের অংশ আগে বার হয়। শতকরা তিন ভাগ কেসে এরকম হয়। তবে ম্যানেজমেন্ট চিন্তিত নয়। তিন ধরনের ব্রীচ ডেলিভারী হতে পারে। স্বাভাবিক অর্থাৎ ডাক্তার নার্সের সাহায্য ছাড়াই। দ্বিতীয় ধরনের ব্রীচে সাহায্যের দরকার। তৃতীয় ধরনে বাচ্চা জরায়ুর ভেতরে আটকে যায়।

ডক্টর উইলসন দেখছিলেন, দেখে খুশী হয়েছিলেন যে এক্ষেত্রে সাহায্যের দরকার হবে না। নবজাতকের পা দুটো বেরিয়ে এসেছে। উরু অবধি।

ডাক্তার বললেন–

আর একবার…প্রায় হয়ে গেছে।

মিসেস জিনস্কি কথা শুনলেন। কিন্তু কিছুই হল না।

আর, একবার…জোরে।

কিছুই হল না।

নবজাতকের পাদুটো ধরে, আস্তে টান দিলেন ডক্টর উইলসন। কিছুই হল না। নবজাতকের শরীরের পাশ দিয়ে জরায়ুর ভেতরে হাত ঢোকলেন ডাক্তার। তার কপালে হঠাৎ দেখা দিল ঘামের ফোঁটা। মেটারনিটি–নার্স কাছে এসে ঘাম মুছে দিল।

সমস্যা দেখা দিয়েছে, নীচু গলায় বললেন ডাক্তার।

মিসেস জিনস্কি কথাটা শুনতে পেলেন।

ঝামেলাটা কি?

সব ঠিক আছে।

আস্তে আস্তে বাচ্চাটাকে নীচের দিকে নামবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন ডাক্তার। নাড়ীটা বাচ্চাটার শরীর ও মায়ের শরীরের মধ্যে চাপা পড়ায় বাচ্চাটা শ্বাস নিতে পারছে না।

ফীটোস্কোপ!

 মেটারনিটি নার্স যন্ত্রটা নিয়ে মায়ের পেটে লাগিয়ে বাচ্চার হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনলো।

 কমে গেছে। মিনিটে তিরিশ। অনিয়মিত

ডাক্তার উইলসনের আঙুল মায়ের জরায়ুর ভেতরে। মস্তিষ্কের দূরতম স্নায়ুতন্ত্রের মতই সন্ধানে ব্যস্ত।

বাচ্চার হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছে না।

মেটারনিটি নার্সের কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক

নেগেটিভ! অর্থাৎ..

জরায়ুর ভেতরে অক্সিজেনের অভাবে বাচ্চাটা মরে যাচ্ছে। এখনও বের করতে পারলে বাঁচানোর সামান্য একটা সম্ভাবনা আছে। চার মিনিটের মধ্যে বার করতে হবে। শ্বাসনালী ও ফুসফুস সাফ হলে ছোট্ট হৃদপিণ্ড কাজ করতে পারে। চার মিনিটের বেশী সময় লাগলে মস্তিষ্কের যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়।

ক্লক।

ডক্টর উইলসন অর্ডার দিলেন।

দেয়ালে ইলেকট্রিক ঘড়িতে বারোটা বাজছে। সেকেন্ডের লাল কাটা ঘুরতে শুরু করলো।

ডেলিভারী টিম কাজ শুরু করেছে। এমার্জেন্সি রেসপিরেটরী ট্যাংক কাজ শুরু করেছে। মায়ের জরায়ুর গহ্বর থেকে নবজাতককে বাইরে আনতে হবে। ডক্টর উইলসন চেষ্টা করছেন। ব্র্যাৎ–প্রবর্তিত পন্থায় নবজাতকের শরীর ঘোরাচ্ছেন ডক্টর। বাচ্চার কাধ যেন মায়ের যোনিগহ্বরের বাইরে আসে। বৃথা চেষ্টা।

জীবনের প্রথম ডেলিভারী দেখতে দেখতে অসুস্থ হয়ে পড়লো একজন স্টুডেন্ট নার্স! ও তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে গেল।

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মিঃ কার্ল জিনস্কি। নার্ভাস। স্নায়ুবিক উত্তেজনার বশে মাথার টুপি খুলে ও কড়া ওঠা হাতে ঘোরাচ্ছে। এই দিনটা তার জীবনের সবথেকে সুখের দিন। লোকটা পেশায় ছুতোরমিস্ত্রী, সরল সাদাসিধে মানুষ, অল্পবয়সে বিয়ে করেছে। অনেক সন্তান চায়। এই তাদের প্রথম সন্তান। কার্ল উত্তেজনা চাপতে পারছে না। সে বউকে ভালোবাসে। বউ নইলে সে বাঁচবে না। এখন সে বউয়ের কথাই ভাবছে। ডেলিভারী রুম থেকে ছুটে বের হয়ে এল অসুস্থ স্টুডেন্ট নার্স।

 ও কেমন আছে? কার্ল জানতে চাইল।

তরুণী স্টুডেন্ট নার্স বাচ্চাটার কথা ভাবছিল, সে চেঁচিয়ে উঠলো–ও মরে যাবে। সে বমি করতে ছুটলো।

মিস্টার কার্ল জিনস্কির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে নিজের বুক চেপে ধরে হাঁফালো। এমার্জেন্সী ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার আগেই লোকটা মরে গেল।

ডেলিভারী রুমে ঘড়ির কাটার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন ডাক্তার উইলসন। বাচ্চার নাড়ী ছোঁয়া। যাচ্ছে কিন্তু আলগা করা যাচ্ছে না। ডাক্তার হিসেবে তার অভিজ্ঞতা বলছে, ওভাবে বাচ্চা বের করলে ফলটা ভালো হবে না।

 কোৎ দিন, মিসেস জিনস্কি। জোরে!

 কোন লাভ নেই। ঘড়ির দিকে তাকালেন ডাক্তার। মূল্যবান দুটো মিনিট কেটে গেছে। বাচ্চাটার মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছয়নি। চার মিনিট পেরিয়ে গেলে কি হবে, সেটাই সমস্যা। বাচ্চাটাকে মরতে দেওয়া হবে, না, আজীবন জড়বুদ্ধি হয়ে বাঁচতে দেওয়া হবে? সমস্যার কথা মন থেকে দূরে সরিয়ে, চোখ বন্ধ করে, প্রসূতির শরীরের ভেতর যা ঘটছে তার দিকে মন দেন ডাক্তর।

মরি–স্মেইলী–ফেইৎ ম্যানুবর।

বাচ্চার শরীর মায়ের শরীর থেকে আলগা করার জটিল প্রক্রিয়া।

হঠাৎ বাচ্চার শরীর নড়ে ওঠে।

পাইপার ফরসেপস!

মেটারনিটি নার্স যন্ত্রটা বাড়িয়ে দেয়। বেবীর মাথার দুপাশে ফরসেপ লাগিয়ে টান দিলেন ডাক্তার। এক মিনিট পরে মাথা দেখা গেল।

ডেলিভারী শেষ।

এই মুহূর্তটা আনন্দের। নবজীবনের বিস্ময়। জরায়ুর অন্ধকার প্রশান্তি থেকে আলো ও হিমের মধ্যে টেনে নিয়ে আসার প্রতিবাদে নবজাতকের কান্নার মুহূর্ত।

 কিন্তু এই বাচ্চাটা কাঁদে না।

এই বাচ্চাটা নিথর, তার রং নীলচে-সাদা। মেয়ে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার। আর দেড় মিনিট। বছরের পর বছর অজ্ঞিতায় পরিশীলিত আঙুল গজ দিয়ে বাচ্চার গলার ভেতরটা সাফ করছে।

 বাচ্চাটাকে চিৎ করে শুইয়েছেন ডাক্তার। মেটারনিটি নার্স তার হাতে তুলে দেয় ছোট্ট বিদ্যুৎচালিত সাকশন যন্ত্র-সমেত ছোট্ট ল্যারিন-গোস্কোপ মেশিন, চালু হয়। আবার ঘড়ির দিকে তাকান ডাক্তার।

আর কুড়ি সেকেন্ড।

হৃৎস্পন্দন শোনা যায় না।

পনেরো সেকেন্ড।

চোদ্দ সেকেন্ড।

 বাচ্চার হৃৎত্যন্ত্র এখনও কাজ করছে না।

আর একটা পথ বেছে নিতে হবে। হয়তো এর মধ্যেই বাচ্চার মগজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। কে বলতে পারে?

হাসপাতাল–ওয়ার্ডে অনেক জড়বুদ্ধি রোগী দেখেছেন ডাক্তার। বয়স্কের শরীর, শিশুর মন।

 দশ সেকেন্ড। এখনও ধমনীতেও স্পন্দন নেই।

পাঁচ সেকেন্ড।

ডাক্তার মন স্থির করলেন।

যন্ত্রটা উনি বন্ধ করে দেবেন। প্লাগ থেকে খুলে দেবেন যন্ত্রটা। বলবেন, বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না। তাঁর বক্তব্যে কেউ কোন প্রশ্ন তুলবে না। বাচ্চার চামড়া ছুঁয়ে দেখলেন ডাক্তার। ঠান্ডা, ভিজে।

তিন সেকেন্ড।

বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের চোখে জল আসে। এই শিশু একদিন সুন্দরী রমণী হতো। কেমন হতে পারতো তার জীবন? বিয়ে করতো, সন্তানের জননী হত, শিল্পী হতো, কিম্বা শিক্ষিকা। ধনী হত কিম্বা গরীব। সুখী হতে কিম্বা অসুখী।

এক সেকেন্ড।

নব জাতিকার হৃৎপিন্ড কথা বলে না।

সুইচের দিকে হাত বাড়ালেন ডাক্তার।

ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করে লাভ নেই।

সেই মুহূর্তে… ।

বাচ্চাটার হৃৎপিন্ড কাজ শুরু করলো। প্রথমে অনিয়মিত তারপর নিয়মিত। ঘরের মধ্যে আনন্দ, অভিনন্দন জানাচ্ছে আর সবাই।

ডাক্তার শুনছেন না।

 ওঁর চোখ দেয়াল-ঘড়ির কাঁটার দিকে।

ওর মা ওর নাম রাখল জোসেফাইন। ওর দিদিমার নামে নাম।

ডাক্তার উইলসন বললেন, প্রত্যেক দুহপ্তা অন্তর বাচ্চাকে হাসপাতালে আনতে হবে। কারণটা উনি কিন্তু বললেন না।

প্রত্যেকবারের পরীক্ষার একই ফল।

 আপাতদৃষ্টিতে মেয়েটা স্বাভাবিক।

ভবিষ্যতে কি হবে, সময়ই তা বলতে পারে।

.

০৩.

লেবার ডে, ১৯৩৯, ক্যাটস্কিলে গ্রীষ্ম শেষ। গ্রেট মার্লিনের কাজ খতম। সঙ্গে সঙ্গে টবিরও। সে স্বাধীন। কিন্তু সে কোথায় যেতে পারে? ঘর নেই চাকরী নেই, পয়সা নেই। হোটেলের এক মহিলা বললেন, টবি যদি তাকে ও তার তিনটে বাচ্চাকে গাড়ীতে তুলে গাড়ী ড্রাইভ করে শিকাগো নিয়ে যায়, টবি পঁচিশ ডলার পাবে। গ্রেট মার্লিন ও তার। পোষা দুর্গন্ধযুক্ত জানোয়ারগুলোকে বিদায় জানানোর দরকার মনে হল টবির।

শিকাগো, ১৯৩৯। পয়সা সেখানে হাওয়ায় ওড়ে। পয়সা দিলে সব কেনা যায় সেখানে। মেয়েমানুষ, নেশার ওষুধ, পেশাদার রাজনীতিবিদ। নানাজনের রুচিমাফিক শত শত নাইটক্লাব। শেজ পারীর মস্ত ক্লাব। রাশ স্ট্রীটের ছোট্ট বার। সব জায়গায় গেছে টবি। সব জায়গায় একই জবাব পায় টবি। তার মত অচেনা কমেডিয়ানকে কেউ চায় না।

সময় দ্রুত সরে যাচ্ছে। টবির মায়ের স্বপ্ন ছিল, টবি তারকা হবে। সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সময় এসেছে। এখন তার বয়স উনিশ বছর।

নী-হাই ক্লাব, শিকাগো। ক্লান্ত অর্কেষ্ট্রায় তিনটে মোট বাজনা। মাঝবয়সী মাতাল কমেডিয়ান। মেরি ও জেরি ও দুই পেরী বোন পোষাক খুলে নগ্ননৃত্য দেখায়। বারে বসে ছিল টবি। তার পাশে এসে বসলো জেরি। টবি হেসে ভদ্রতা দেখিয়ে বললো–আপনার নাচ আমার ভালো লাগে।

জেরি ঘুরে তাকিয়ে দেখলো, বাচ্চা ছেলে, পোষাক দেখলে মনে হয়, মালদার নয়। ও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। টবি উঠে দাঁড়ালো। জেরি হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার টাইট : প্যান্টের দিকে। প্যান্টের ভেতরে জেরির বিশাল পুরুষাঙ্গের আদল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। টবির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালো জেরি। বললো

জেসাস্ ক্রাইস্ট। তোমার জিনিসটা সত্যিই অতো বড়?

টবি হেসে বলে– সেটা জানার একটাই উপায় আছে।

…সেই রাতে তিনটে নাগাদ দেখা গেল, মেরি ও জেরি–দুই বোনের সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে আছে টবি।

 সব কিছু নিখুঁতভাবে প্ল্যান করা হয়েছিল। শো শুরু হবার ঠিক এক ঘন্টা আগে ক্লাবের কমেডিয়ানকে ডাইভারসী এভিনিউয়ের এক ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল জেরি। কমেডিয়ান লোকটির জুয়া খেলার নেশা আছে, ওই ফ্ল্যাটে পাশার জুয়াখেলা চলছে। লোকটা জিভে ঠোঁট চেপে বললো–এক মিনিট খেলা যাক।

আধঘন্টা পরে জেরি যখন সরে পড়লো, তখনো সেই জুয়াড়ী কমেডিয়ান জুয়াখেলায় মত্ত। কুত্তার বাচ্চা, আমার আট…, ও চেঁচাচ্ছে। ওর কল্পনার জগতে সাফল্য, তারকা হওয়া, বড়লোক হওয়া : সব কিছু নির্ভর করে পাশার একটা দানের ওপর।

ওদিকে নী-হাই ক্লাবের বারে সেজেগুজে অপেক্ষা করছে, টবি।

 শো-য়ের সময় হল। অথচ কমেডিয়ানের পাত্তা নেই। ক্লাবের মালিক চেঁচাচ্ছে, মুখখিস্তি করছে-বেজন্মা কমেডিয়ানকে আর ক্লাবে ঢুকতে দেব না।

মেরি বললো–তোমায় দোষ দেওয়া যায় না। তবে নিউইয়র্কের নতুন এক কমেডিয়ান, ওই তো বারে বসে আছে।

 কে? কোথায়? ও তো বাচ্চা ছেলে ওর আয়া কোথায়?

জেরি বললো–লোকটা দারুন।

বিছানায় দারুন সত্যি কথাই বলেছে জেরি।

মেরি বললো–ওকেই নাও না, তোমার ক্ষতি কিসের?

কাস্টমাররা পালাবে। শোনো হে, তুমি নাকি, কমেডিয়ান?

 টবি কিছুটা উদাসীনভাবে বলে–হ্যাঁ, আমি ক্যাটস্কিলের হোটেলে শো দেখানো শেষ করে এখানে এসেছি।

বয়স কত?

বাইশ।

ফালতু বাতেলা। শো ভালো না হলে তুমি বাইশ বছরে পা রাখবে না, বুঝেছো।

…এবং টবি টেম্পলের স্বপ্ন এতোদিনে সত্য হল। সে স্পটলাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে। তার জন্য ব্যান্ড বাজছে। শ্রোতার দল প্রতীক্ষা করছে। ওদর জন্যে তার বুকে ভালোবাসা জেগে ওঠে। শ্রোতারা আর সে নিজে যেন অবিচ্ছেদ্য এক সূত্রে বাঁধা। মা, তুমি যেখানেই থাকো, আমাকে দ্যাখো। ব্যান্ডের বাজনা থেমে যায়। টবি শো শুরু করে।

 গুড ইভনিং, তোমরা সৌভাগ্যবান। আমার নাম টবি টেম্পল। আশা করি তোমরা নিজেদের নাম জানো।

….শ্রোতারা নীরব।

শিকাগোর মাফিয়াদের নতুন সর্দার পাগল। এখন মৃত্যুর চুম্বন মানে নাচ অর ডিনার।

..শ্রোতারা এখনও নীরব। ওরা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। টবি ঘামছে।  শ্রোতাদের সঙ্গে কল্পনার যোগসূত্র ছিঁড়ে গেছে।

 মেইনের এক থিয়েটারে শো দেখিয়েছি। জঙ্গলে থিয়েটার, থিয়েটারের ম্যানেজার এক ভালুক।

…শ্রোতারা তবুও নীরব। ওরা টবিকে ঘেন্না করছে।

কেউ তো আমায় বলেনি যে, আমি যোবা কালাদের শো দেখাচ্ছি।

টাইটানিক জাহাজ জলে ডুবেছিল। তার সোস্যাল ডিরেক্টরের মত আমার অবস্থা। গ্যাংপ্ল্যাংকে, হাঁটছি, অথচ জাহাজ নেই।

…শ্রোতারা বিদ্রূপধ্বনি শুরু করে। ম্যানেজারের নির্দেশে ব্যান্ডে জোরে বাজনা বাজে। টবির চোখে জল। মুখে হাসি।

তার চীৎকার করতে ইচ্ছে হয়।

.

…বাচ্চার চীৎকারে ঘুম ভাঙে মায়ের। খুব জোরে অদ্ভুত আতঙ্ক জাগানো গলায় রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে চেঁচাচ্ছে মিসেস জিনস্কির ছোট্ট মেয়ে জোসেফাইন। নার্সারীতে ঢুকে মিসেস জিনস্কি দেখে, জোসেফাইনের খিচুনি হচ্ছে, সে এপাশ-ওপাশ গড়াচ্ছে বাচ্চার মুখ নীল হয়ে গেছে।

হাসপাতালে ইনটানী ছোট্ট মেয়ের শিরায় ঘুমের ওষুধ ইনজেকসন দিতে ও ঘুমিয়ে পড়ে। ডক্টর উইলসন খুব ভালোভাবে জোসেফাইনকে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু গলদ কিছু খুঁজে পেলেন না ডক্টর।

তবুও ওঁর দুশ্চিন্তা কাটলো না।

কেননা জোসেফাইনের জন্মের সময় অপারেশন থিয়েটারের দেওয়ালে যে বিদ্যুৎচালিত  ঘড়ি চালু করা হয়েছিল, সেটার কথা ভুলতে পারছিলেন না ডক্টর উইলসন।

.

০৪.

তরুণ কমেডিয়ান এবং বিদ্রূপমুখর শ্রোতা। কিন্তু কোন কোন কমেডিয়ান খ্যাতির শিখরে ওঠে। এডি ক্যানটর এবং ডবলিউ. সি. ফিলডস, জোনাসন এবং বেনী, অ্যাবট ও কসটেলো। জোসেল ও বারনস, মার্কস্ ব্রাদার্স। আরও অনেকে। বিখ্যাত যারা, তারা থিয়েটারে শো দেখায়, রেডিওর পোগাম করে। টবির মত উঠতি কমেডিয়ানদের জন্যে সস্তা নাইটক্লাবের টয়লেট সারকিট। নোংরা সালোয় বীয়ার গেলে নোংরা মানুষেরা, যে মেয়েগুলো স্ট্রিপনিজ দেখাচ্ছে তাদের খিস্তি করে, স্রেফ মজা পাবার জন্য কমেডিয়ানদের বিদ্রূপ করে বসিয়ে দেয়। নোংরা টয়লেটে ড্রেসিং রুম, যেখানে পচা খাবার, প্রস্রাব ও সস্তা সেন্টের গন্ধ। এবং ঘামের গন্ধ। ভয় পেলে যে ধরনের ঘাম হয়। ব্যর্থতার ভয়। শ্রোতার ধিক্কারের ভয়। বদলে কি পায় তরুণ উঠতি কমেডিয়ান? একবেলার খাবার, তাও অখাদ্য, কখনও বা পাঁচ, দশ বা পনেরো ডলার। শ্রোতার মন্তব্যের ওপর নির্ভর করে, কমেডিয়ান কত পাবে।

 টবি টেম্পল এইসব নাইটক্লাবে প্রোগ্রাম দেখায়। কথা বলে মানুষকে হাসায়। কেউ হাসে কেউ হাসে না। যারা হাসে না, যারা তাকে পছন্দ করে না তারা টবির কথার মধ্যে শিস দেয়, টবিকে বিদ্রূপ করে, টবির দিকে বীয়ারের বোতল ছোঁড়ে। টবি লড়তে এবং বাঁচতে শেখে। মাতাল ট্যুরিস্ট এবং গুন্ডা : দুয়ের তফাৎ শিখেছে টবি। যারা বিদ্রূপ করতে পারে, তাদের কাছে এক চুমুক মদ খেতে চাইলে বা কপালের ঘাম মোছর জন্য ন্যাপকিন চাইলে তারা আর বিদ্রূপ করবে না : টবি জেনেছে।

লেক কিয়ামেশা, শাওনগা, লজ, অ্যাভন, ওয়াইল্ডউড, নিউজারসী, ব্যানাই ব্ৰিথ, সন্স অফ ইটালী, মুস হল।

কমেডিয়ান টবি টেম্পলের স্কুল। কমেডিয়ানের পেশা শিখছে টবি টেম্পেল।

জনপ্রিয় গানের প্যারডী, ক্লার্ক গেবল, কারী গ্র্যান্ট, হামন্ত্রে বোগার্ট ও ক্যাগনীর মত নামজাদা ফিল্মস্টারের কণ্ঠস্বরের নিখুঁত ও অদ্ভুত অনুকরণ, নামজাদা কমেডিয়ানদের বিখ্যাত লেখকরা যে স্ক্রিপ্ট লিখে দেয়, তা হুবহু চুরি করে তোক হাসানো।

টবি সবরকম চেষ্টা করে। উদাসীন শ্রোতার মুখোমুখি হয়ে সে স্বপ্নিল নীল চোখে তাকায়, বলে-এসকিমো কিভাবে প্রস্রাব করে দেখেছো? সে প্যান্টের বোতামে হাত রাখে। অমনি বরফের টুকরো চারপাশে ছিটকে যায়।

সে মাথায় পাগড়ী বেঁধে আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে বলে–আমি, আবদুল, সাপ খেলাই। সে বাঁশী বাজায়। বাক্স থেকে মাথা তোলে…সাপ নয়, সাপের মত…, শরীরটা ডুশ-ব্যাগ, মাথাটা ডুশ-ব্যাগের নকল। শ্রোতাদের কেউ না কেউ হাসে।

 বাসে দেশ ঘোরে টবি, সব থেকে সস্তা হোটেলে থাকে। লন্ড্রির পয়সা বাঁচাতে শার্টের কলারে চক ঘসে, নতুন জুতো না কিনে পুরোনো জুতোর সোলে কার্ডবোর্ড ভরে দেয়। বিশ্রী শহর, বিশ্রী খাবার। টবি টেম্পল বেঁচে আছে না মরে গেছে, তাতে কারো কিছু এসে যায় না। তার স্বপ্নের অংশ নেবারও কেউ নেই।

নামজাদা কমেডিয়ানদের দামী গাড়ী, সুন্দরী সঙ্গিনীদের ঈর্ষার চোখে দেখে টবি।

সে ভাবে, একদিন আমারও দিন আসবে।

মাঝে মাঝে, তার শোর মাঝখানে লোকে ঝামেলা করে। শো বন্ধ হয়ে যায়। পাবলিককে খুন করতে ইচ্ছা হয় তার। ঈশ্বর আমার অভিনেতা হওয়ার এই ইচ্ছেটা তুমি কেড়ে নাও, আমাকে হতে দাও জুতোর দোকানের সেলসম্যান, মাংস কাটা কসাই অফিসের কেরানী, আমাকে সাধারণ মানুষের মত বাঁচতে দাও…

অথচ পরের দিনে সন্ধ্যাবেলা আবার তাকে স্টেজে দেখা দেয়।

‘এক যে ছিল আজব মানুষ।’

–সে হেসে বলে-

 ‘সে হাঁস পুষতত। হাঁসটাকে বড্ড ভালোবাসতো। ওটাকে নিয়েই সিনেমা গেল। ক্যাশিয়ার বললো, হাঁস নিয়ে সিনেমায়, ঢাকা চলবে না। লোকটা এককোণে গিয়ে ছোট্ট হাঁসটাকে প্যান্টের সামনের দিকে ভরে নিল, টিকিটও কাটলো, ভেতরে ঢুকে সীটে বসে অন্ধকারে প্যান্টের বোম খুলে বসলো, যেন হাঁসটা ঠোঁট বার করতে পারে। ওর পাশে বসেছিল এক মহিলা। মহিলার পাশে ছিল তার স্বামী।

খনিকক্ষণ করে মহিলা স্বামীকে বললো

‘র‍্যালফ, আমার পাশের লোকটা প্যান্ট খুলে ওই জিনিসটা বার করে বসে আছে।’

 ‘ও তোমায় বিরক্ত করেনি তো?’

‘না।’

‘ও, কে, ওদিকে তাকিও না।’

 কিন্তু ওর ওই জিনিসটা যে আমার হাতের প্যাকেট থেকে ভুট্টাদানা খাচ্ছে।

সানফ্রান্সিসকোর থ্রি সিক্স ফাইভ, নিউইয়র্কের রুডিজ রেল, টলেডোর কিন ওয়ালো। জেম, অডিওন, এমপায়ার ও স্টার-এর মত ছোট ছোট থিয়েটারে দিনে চার পাঁচটা শো। এইভাবেই কেটে যেত তার জীবন। সে অচেনা, অনাবিষ্কৃতই থেকে যেত। কিন্তু একটা ঘা বদলে দিল।

১৯৪১-এর ডিসেম্বরের শুরুতে এক ঠান্ডা বিকেলে টবি টেম্পল নিউইয়র্কের পাঁচটা শো দেখাচ্ছে। প্রত্যেক শোয়ে আটটা দৃশ্য দেখানো হয়। টবির কাজ বিভিন্ন অভিনেতা অভিনেত্রীদের পরিচয় দেওয়া। দ্বিতীয় দৃশ্যে জাপানী অ্যাক্রোব্যাটদের ফ্লাইং ক্যানাজাওয়া নামের একটা দলকে জনতার সামনে টবি পেশ করতেই বিদ্রূপধ্বনি ভেসে এল।

টবি স্টেজের পেছনে ফিরে জানতে চাইলো– কি হয়েছে?

জেসাস, তুমি জানো না? কয়েক ঘন্টা আগে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করেছে।

 তাতে কি হল? এই জাপানীরা কি দোষ করলো? ওরা তো ভালোই খেলা দেখাচ্ছে।

পরের শোয়ে টবি স্টেজে দাঁড়িয়ে বললো– লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন, ম্যানিলা থেকে সদ্য আসা ফ্লাইং ফিলিপিনোদের খেলা দেখুন।

কিন্তু জাপানী অ্যাক্রোব্যাটরা স্টেজে দেখা দিতেই দর্শকেরা ঝামেলা শুরু করলো।

পরবর্তী শোগুলোতে ওদের সুখী হাওয়াইয়ান, পাগল মঙ্গোলিয়ান বা এসকিমো ফ্লায়ার বানিয়েও বাঁচাতে পারলো না টবি।

এবং সেই সন্ধ্যায় বাবাকে ফোন করে টবি জানালো, আর্মিতে নাম লেখানোর জন্য চিঠি এসেছে তার নামে।

সুতরাং আর্মিতে যোগ দিল কমেডিয়ান টবি টেম্পল। তখন তার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা…

 …ছোট জোসেফাইনের মাথায় অসহ্য ব্যথা হয়। মনে হয় কে যেন প্রকাণ্ড হাতে তার মাথা চেপে ধরেছে। মাকে বিরক্ত করার ভয়ে কাঁদে না জোসেফাইন।

তার মা মিসেস জিনস্কি আজকাল ধর্মকর্মে মন দিয়েছে। তার ধারণা, স্বামীর মৃত্যুর । জন্য সে ও তার মেয়ে কোনভাবে দায়ী।

এক বিকেলে রিভাইভ্যালিস্ট মীটিং-এ সে শুনল-ধর্ম প্রচারক পাদ্রী বক্তৃতা দিচ্ছে–

তোমরা পাপে ডুবে আছো। কুৎসিত পতঙ্গকে যেমন আগুনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, ঈশ্বর তেমনিভাবে তোমাদের নরক কূপের ওপর ধরে রেখেছেন। একটা সূক্ষ্ম সূত্র তোমাদের ধরে রেখেছে। ওটা ছিঁড়ে গেলে ঈশ্বরের ক্রোধের আগুন তোমাদের পোড়াবে। তোমরা এখনও অনুতাপ করো। নইলে জ্বলে মরবে।

মিসেস জিনস্কির মনে হল, সে যেন ঈশ্বরের বাণী শুনছে।

জোসেফাইনকে সে বলল–আমরা তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাই ঈশ্বর তোমায় শাস্তি দিচ্ছেন।

ছোট্ট জোসেফাইন সবকিছু বুঝলো না।

কিন্তু তার মনে হল…সে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করেছে, সেই জন্যেই সে শাস্তি পাচ্ছে। কোন খারাপ কাজ সে করেছে, জানলে ভালো হত।

তাহলে অন্তত মাকে বলা যেত..অমুক খারাপ কাজটা করেছি বলে আমি দুঃখিত।

.

০৫.

শুরুতে টবি টেম্পলের যুদ্ধ ছিল এক দুঃস্বপ্ন।

আর্মিতে তার কোন স্বতন্ত্র পরিচয় নেই। লক্ষ লক্ষ সৈনিকের মত সে একটা নম্বর, ইউনিফর্মপরা নামহীন, অপরিচিত অনেকের একজন।

 ভার্জিনিয়ায় বেসিক ট্রেনিং ক্যাম্প। তারপর সাসেক্সের ক্যাম্প। আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ড।

কম্যানডিং জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল টবি। তার বদলে দেখা হল ক্যাপ্টেন স্যাম উইনটার্স-এর সঙ্গে। শ্যামল রং, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, বয়স তিরিশের কোটার প্রথম দিকে।

তোমার সমস্যাটা কি?

আমি কমেডিয়ান, লোক হাসাই, প্যারডি, নকল করা–এইসব।

কোথায় অভিনয় করেছো?

বড় কোথাও নয়।

দেখি কি করতে পারি।

ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন।

মহাযুদ্ধ শুরু হবার আগে এই স্যাম উইনটার্স ছিল হলিউডের ফিল্ম প্রোডিউসার। প্যান প্যাসিফিক স্টুডিওতে টবির মত অনেক আশাবাদী যুবককে একটা সুযোগের আসায় আসতে দেখেছে স্যাম। ওদের সুযোগ দেওয়া উচিত, সে বিশ্বাস করে।

সে কর্নেল বীচকে বললো– ছোকরা হয়তো কমেডিয়ান হিসেবে ভালো হবে, সৈন্যদের আমোদ-প্রমোদেরও দরকার। টবির ব্যাপারে স্পেশ্যাল সারভিস যদি সুযোগ দেয়–

–ঠিক আছে, ক্যাপ্টেন, মেমো পাঠাও।

কর্নেল বীচ পেশাদার সৈনিক, পেশাদার সৈনিকের ছেলে। সিভিলিয়ানদের সে ঘেন্না করে। ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম পরলেই কেউ সৈনিক হয় না। ক্যাপ্টেন উইনটার্সও পেশাদার সৈনিক নয়। মেমোর ওপর কর্নেল লিখলোঅনুরোধ অগ্রাহ্য করা হল।

দর্শক নেই, শ্রোতা নেই। কখনও নিঃসঙ্গ রণক্ষেত্রে দুজন প্রহরারত সৈনিক। কখনও বাসভর্তি সৈনিক। কখনও বা ডিশধোয়ার কাজটা যে করে, সেই। ওদেরই হাসাতে চেষ্টা করে টবি। ওরা হাসে খুশী হয়।

 ক্যাপ্টেন উইনটার্স বলে–তোমাকে স্পেশ্যাল সারভিসে ট্রান্সফার করা গেল না বলে আমি দুঃখিত, টেম্পল। আমর মনে হয়, তোমার প্রতিভা আছে, যুদ্ধ শেষ হলে তুমি হলিউডে আমার সঙ্গে দেখা করো। অবশ্য যদি তখনও আমার চাকরীটা থাকে…

যুদ্ধের স্মৃতি। না, যুদ্ধ নয়, মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানোর স্মৃতি। সাঁ-লো-তে বিং ক্রসবীর নকল করে লোক হাসানো। আর্শে হাসপাতালে ঢুকে রোগীদের মুখে হাসি ফোঁটানো। একজন সৈনিক এতো জোরে হেসেছিল সে তার হাতের সেলাই ছিঁড়ে গিয়েছিল। মেৎসে কেউ হাসেনি, কেন না নাৎসী প্লেন আকাশে উড়ছিল।

…জার্মান কম্যান্ড পোস্ট দখল করার জন্যে বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছিল টবি। আসলে জন্ ওয়ে-এর নকল করতে করতে তার ভয় পাবার মত হুঁশ ছিল না।

 …শ্যেরবুর্গে এক বেশ্যাবাড়ীতে বাড়ীউলী ও তার দুই মেয়েকে এমনই হাসালো টবি, ওরা তার কাছে পয়সা নিলো না।

….এই হল টবির যুদ্ধ।

…১৯৪৫-এ যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হল, টবির বয়স পঁচিশ বছর। অথচ মুখে শিশুর সারল্য, আকর্ষণীয় দুটো নীল চোখ, যেন বয়স বাড়েনি।

এখন সবারই ঘরে ফেরার দিন।

 কারও জন্যে ক্যানসাস শহরে নববধূ অপেক্ষা করছে।

 কোন সৈনিকের জন্যে তার মা-বাবা অধীর প্রতীক্ষায় রয়েছে বেয়নের নগরীতে

কারো জন্যে সেন্ট লুইসের ব্যবসাটা অপেক্ষা করছে।

শুধু টবি টেম্পলের জন্যে কেউ প্রতীক্ষায় নেই। শুধু খ্যাতি ছাড়া।

টবি টেম্পল হলিউডে যাবে।

 ঈশ্বর, তোমার প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় এসেছে।

.

….এবং তখনই—

তুমি কি ঈশ্বরকে চেনো? তুমি কি যীশুর মুখ দেখেছো? ভাই-বোনেরা, আমি তাকে দেখেছি, তার কণ্ঠস্বর শুনেছি। যারা নতজানু হয়ে পাপ স্বীকার করে অনুতাপ জানায়, শুধুমাত্র তাদের সঙ্গেই তিনি কথা বলেন। যারা অনুতপ্ত নয়, ঈশ্বর তাদের ঘৃণা করেন। ঈশ্বরের ক্রোধের জ্বলন্ত তীর এই মুহূর্তে তোমার পাপী হৃদয়ের দিকে ছুটে যেতে পারে। তার প্রতিশোধের তীর তোমার হৃদয়কে দীৰ্ণবিদীর্ণ করতে পারে। এখনও সময় আছে, এখনও অনুতাপ করো…

… জোসেফাইন জিনস্কি তাঁবুর ছাদের দিকে তাকায়। হয়তো দেখবে, ঈশ্বরের ক্রোধ ও প্রতিশোধের জ্বলন্ত তীর তার দিকে ছুটে আসছে। সে ভয়ে মায়ের হাত ধরে। কিন্তু তার মায়ের সেদিকে খেয়াল নেই। ধর্ম-উন্মাদনায় তার মায়ের চোখদুটো জ্বল জ্বল করছে।

যীশুর প্রশংসা করো।

 সবাই চেঁচিয়ে ওঠে।

…অডেসা শহরের শহরতলী এলাকায় মস্ত বড় তাবুতে ধর্ম-উন্মাদনা জাগানোর জন্য মিটিং করে পাদ্রীরা। সেখানে ছোট্ট জোসেফাইনকে নিয়ে যায় তার মা। উঁচু কাঠের তৈরী মঞ্চে দাঁড়িয়ে যাজক বক্তৃতা দেয়। তার সামনে পাপীরা আসে অনুতাপ জানাতে। সারি সারি কাঠের বেঞ্চে বসে থাকে মুক্তিকামী অর্ধ-উন্মাদ মানুষ। নরক ও অভিশাপের ভয়ে তারা আতংকিত। দু বছরের মেয়ের পক্ষে এই পরিবেশ সুস্থ নয়। ফানডামেনট্যালিস্ট; হোলি, রোলার, পেনটেকসট্যালিস্ট, মেথডিস্ট, অ্যাডভেনটিস্ট পাদ্রীরা বক্তৃতা দেয়। সবাই নরক ও অভিশাপের ভয় দেখায়।

পাদ্রী বলে–

পাপীরা, শোনো! হাঁটু গেড়ে বসো! মহান জেহোভার ভয়ে কাঁপো! তোমাদের অশুভ মতিগতিতে ঈশ্বরপুত্র যীশুর হৃদয় ভেঙেছে। তাই যীশুর পিতা ঈশ্বর তোমাদের শাস্তি দেবেন। চারপাশে তাকাও। পাপে যাদের জন্ম, পাপে যাদের হৃদয় ভরা–সেই শিশুদের মুখ দেখো৷

…এবং ছোট্ট জোসেফাইন লজ্জা পায়। সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মাথার যন্ত্রণা হলে সে জানে ঈশ্বর তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। মাথার যন্ত্রণা সেরে গেলে সে জানবে, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেছেন। কি পাপ সে করেছে, তাই শুধু সে জানে না। পাদ্রী বলে

মদ খেও না। মদ হল শয়তানের রক্ত। সিগারেট খেও না। তামাক হল শয়তানের নিঃশ্বাস। যুবতী নারীর সঙ্গে সহবাস করো না। কেন না ওটাও শয়তানের আনন্দ। যারা শয়তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, তারা চির-অভিশপ্ত। তারা নরকের আগুন পুড়বে। শয়তান তোমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছে।

কাঠের বেঞ্চ শক্ত করে ধরে ভয়ে কাঁপছে, চারপাশে তাকাচ্ছে জোসেফাইন। শয়তান যেন তাকে ধরে নিয়ে না যায়।

এবং শ্রোতারা গান গাইছে–

আমরা যেতে চাই স্বর্গে,
আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার বিরামপুরীতে।

 জোসেফাইন ভুল শোনে, বলে–

আমরা যেতে চাই স্বর্গে।
আমার দীঘল-খাটো পোষাক সমেত।

বজ্রগর্জনের মত ধর্মোপদেশের পর অনেক অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখানো হয়। যাজক হাত দিয়ে ছুঁলেই হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গু মানুষ, লাঠি-নিয়ে-হাঁটা খোঁড়া মানুষ, খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে হিস্টিরিয়ার ঝোঁকে অদ্ভুত সব কথা বলে।

জোসেফাইনের মুখে আতঙ্কের ছাপ।

মিটিং-এর পর চাদা দেওয়ার পালা। চাঁদা কম হলে চলবে না।

যীশু সব দেখছেন। উনি কঞ্জুসদের ঘেন্না করেন।

তারপর সব শেষ।

কিন্তু জোসেফাইনের মুখে চোখে ভয় ভাঙে না।

১৯৪৬-এ টেক্সাসের অডেসায় গাঢ় বাদামী–কালোলা খনিজ, তেলের স্বাদ।

অডেসার মানুষ দুটো শ্রেণীর। একদল খনিজ তেলের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অন্য শ্রেণীর জন্য তাদের করুণা। ঈশ্বর চেয়েছিলেন, টেক্সাসে সবার প্রাইভেট প্লেন, ক্যাডিল্যাক মোটর গাড়ী, সুইমিংপুল, একশোটা মানুষকে শ্যাম্পেন খাওয়ানোর ক্ষমতা থাকবে। তাই উনি টেক্সাসের মাটির নীচে রেখেছিলেন খনিজ তেল।

 জোসেফাইন জিনস্কি সেই শ্রেণীর মানুষ, তেলের সঙ্গে যাদের ভাগ্য জড়ানো হয়।

 তবে সে সুন্দরী, মাথায় চকচকে কালো চুল, চোখের রং গাঢ় বাদামী, সুন্দর ডিমছাদ মুখ। তার মা সেলাই জানে। তেলের খনির মালিকদের বউদের জন্যে সে সুন্দর ইভনিং গাউন সেলাই করে। ওরা জোসেফাইনকে পছন্দ করে। কারণ মেয়েটা ভদ্র, ভালো ব্যবহার করে। তাই গণতন্ত্রের খাতিরে তারা নিজেদের মেয়েদের সঙ্গে জোসেফাইনকে মিশতে দেয়। জোসেফাইন বড় লোকেদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলে, তাদের বাইসাইকেল বা টাট্ট ঘোড়ায় চড়ে। অথচ তার বাড়ী ক্ল্যাপবোর্ডের কুঁড়েঘর, তোবড়ানো আসবাব, দরজার ছিটকিনি আলগা, জানলাগুলো ঝুলছে। অথচ বড়লোকের মেয়ে সিসি টপিং বা লিনডি ফারগুসনের বাড়ী রাত কাটালে মস্ত বড় এক বেডরুম তাকে একাই ছেড়ে দেওয়া হয়। ঝি ও খানসামা ব্রেকফাস্ট এনে দেয়। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বড়লোকের বাড়ী ঘুরে ঘুরে দেখে জোসেফাইন। সুন্দর আসবাব, সুন্দর পেন্টিং, রুপোর বাসনপত্রে মনোগ্রামের ছাপ, ইতিহাসের স্মৃতিজড়ানো পুরোনো জিনিসপত্র। ও দেখে হাত বোলায়, স্বপ্ন দেখে : ও-ও এমনি সুন্দর বাড়ীতে সুন্দর সব জিনিসের মাঝখানে একদিন রানীর মত থাকবে।

 জোসেফাইন দুই পৃথিবীর মানুষ। একটা বড়লোকের, একটা গরীবের। এই দুই পৃথিবীতেই সে কিন্তু নিঃসঙ্গ একা। তার মাথার যন্ত্রণা বা ঈশ্বর সম্বন্ধে তার ভয়ের কথা সে মাকে বলে না। কেননা তার মা এক-ধর্মীয় উন্মাদনায় পাগল, ঈশ্বরের দেওয়া শাস্তির কথা ভাবে, হয়তো বা শাস্তি পেতে চায়। ওসব কথা তেলের খনির মালিকদের মেয়েদের কাছেও বলা চলবে না। কেন না তারা তো চায়, জোসেফাইন তাদের মত সবসময় হাসিখুশী থাকে। নিজের ভয় নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখে জোসেফাইন।

 জোসেফাইনের যখন সাত বছর বয়স, ব্র্যবকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর অডেসার সবচেয়ে সুন্দরী ছোট্ট মেয়ে নির্বাচনের জন্যে ফটোগ্রাফের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলো। ফটো তুলতে হবে ওদের দোকানে, বিজয়িনীর নাম-লেখা সোনার কাপ পুরস্কার দেওয়া হবে। দোকানের জানলায় রাখা সোনার কাপটা বারবার দেখেও আশ মেটে না জোসেফাইনের। জীবনে কোন কিছু সে অমন করে চায়নি। তার মা প্রতিযোগিতায় তাকে যোগ দিতে দেবে না। রূপের গর্ব মানেই, শয়তানের আয়না-মা বলে। কিন্তু তেলের বনির এক মালিকের বউ জোসেফাইনকে ভালোবাসে। সে ওর ফটো তোলার টাকা দিল। সেই মুহূর্ত থেকে জোসেফাইন জানলো, সোনার কাপটা তার। সে স্বপ্ন দেখে, সোনার কাপটা তার ঘরে ড্রেসারের ওপর বসানো রয়েছে। যেদিন প্রতিযোগিতার ফাইনালে উঠলো জোসেফাইন, সেদিন সে পেট খারাপ করে বিছানায় শুয়ে রইলো। এতো সুখ তার সইছিল না। এই প্রথম সে সুন্দর কিছু পাবে।

পরের দিন জোসেফাইন শুনলো, প্রতিযোগিতায় জিতেছে তেলের খনির এক মালিকের মেয়ে টিনা হাডসন। টিনা জোসেফাইনের মত সুন্দরী নয়। কিন্তু টিনার বাবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বোর্ড অফ ডাইরেক্টরসের সদস্য।

খবরটা শোনা অবধি জোসেফাইনের মাথার প্রচণ্ড যন্ত্রণা। সোনার কাপটা তার কতো ভাল লেগেছিল, সে ঈশ্বরকে জানতে দিতে চায় না। কিন্তু ঈশ্বর নিশ্চয়ই জানে। কেননা মাথার যন্ত্রণা থামছে না। রাতে মাকে লুকিয়ে বালিসে মুখ গুঁজে কাঁদে জোসেফাইন।

কদিন পরে সপ্তাহ শেষের ছুটিতে টিনার বাড়ীতে নেমতন্ন করা হল জোসেফাইনকে। টিনার ঘরে সোনার কাপ। জোসেফাইন এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

যখন সে নিজের বাড়ী ফিরলো, সোনার কাপটা তার সুটকেসে লুকানো। পরে টিনার মা এসে ওটা নিয়ে গেল।

কাপ চুরি করার জন্যে মেয়েকে চাবকালো মা। মেয়ে কি মায়ের ওপর রাগ করলো না।

 কয়েকটা মুহূর্ত সে সোনার সুন্দর কাপটা ছুঁয়েছে। সেই সুখ সব দুঃখের চেয়ে বড়।