মর্নিং নুন নাইট (তিন প্রহরের খেলা) — সিডনি সেলডন
সকাল
০১.
দিমিত্রি বলল–মিঃ স্ট্যানফোর্ড আপনি কি বুঝতে পারছেন আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে?
হ্যাঁ জানি। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরেই ব্যাপারটি তিনি লক্ষ্য করছেন। দুজন পুরুষ এবং একটি মহিলা। অতি সাধারণ পোশাক। ঘরোয়া ধরনের। পর্যটকদের ভীড়ে মিশে যাবার চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু সকালের হালকা আলগা ভীড়ে ব্যাপারটা কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এ জায়গাটা এমনিতেও তেমন কিছু পর্যটকসঙ্কুল নয়। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড ওদের সহজেই খেয়াল করতে বা ধরে ফেলতে পেরেছিলেন। কারণটা হয়ত ওদের অতি বেশি রকম ক্যাজুয়াল থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। সেটাই নজর কেড়ে নেয়। বড় বেশি রকম ছিল ওদের ওর দিকে না দেখার চেষ্টাটা। অথচ যতবারই তিনি মাথা ঘুরিয়েছেন বা আলতো তাকিয়েছেন, ওদের একজন না একজন কেউ ওঁর দিকেই তাকিয়েছিল। অনুসরণ করার পক্ষে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড সহজ শিকার। তার ছয়ফুট উচ্চতার দীর্ঘ চেহারা। মাথা ভরা শুভ্র চুলের ঢেউ। আভিজাত্যময়, এবং প্রায় উদ্ধত দাম্ভিক প্রভুত্ব ব্যাঞ্জক শরীরী ভাষা। সবার নজর কাড়বার পক্ষে যথেষ্ট। এবং এর পরও তার সঙ্গী হিসেবে রয়েছে বিদ্যুত চমকময় এক রক্তকেশী সুন্দরী যুবতী। একটি ব্যাঘ্র সদৃশ জার্মান শেফার্ড এবং দিমিত্রি কামিনস্কি। সাড়ে ছয়ফুট লম্বা, পেশীময়। নাহ, সত্যিই চেষ্টা করলেও হারিয়ে ফেলা সম্ভব নয় এই দলটাকে। স্ট্যানফোর্ড ভাবলেন।
উনি জানে কে ওদের পাঠিয়েছে এবং তিনি আগত প্রায় এক ভয়ঙ্কর বিপদের গন্ধ স্পষ্ট টের পাচ্ছেন। বহুদিন ধরেই, নিজের সপ্তম ইন্দ্রিয়, লোকে যাকে বলে ইনসটিঙ্কট, তার ওপর প্রবল আস্থা তার। এই আঁচ করবার বহু আগে থেকে গন্ধ পাবার বিশেষ ক্ষমতাটিই তাকে সর্বশেষ্ঠ ধনীদের একজন বানিয়েছে। ফোর্বস ম্যাগাজিন তার সম্পত্তির আনুমানিক হিসাব দিয়েছে সত্তর বিলিয়ন ডলার।
ফরচুন-এর মতে এটা নব্বই বিলিয়ন। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড জানেন দুটোর কোনটাই সঠিক নয়। তার সম্পত্তির আসল হিসাব অনেক অনেক বেশি। প্রকাশিত হিসাবগুলো হিমশৈলের চুড়োটুকুই শুধু। নিত্য দিনই দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ব্যারনস, দি ফিনানসিয়াল টাইমস কাগজপত্রপত্রিকা গুলোয় তাকে নিয়ে ও তার কর্মজীবন নিয়ে অবিশ্বাস্য উত্থান বিষয়ে লেখা এবং ছবি প্রকাশিত হয়। বাণিজ্য জগতে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড এক চূড়ান্ত বিস্ময়। তিনিই বাণিজ্য দৈত্য স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজ-এর একচ্ছত্র মালিক। বাণিজ্য জগতের কাছে নিজের কর্মদক্ষতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ত্বের কারণে তিনি এক বিস্ময়কর কিংবদন্তী। লার্জার দেন লাইফ হয়ে ওঠা চরিত্র।
হ্যারী স্ট্যানফোর্ড যেহেতু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সংবাদ মাধ্যম তাই তার সব কিছুই জানে এবং জনগণকে জানায়। আবার সেই পাবলিক ফীগার ব্যবসায়ী হ্যারী স্ট্যনফোর্ডের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে এক অন্যতর ঘরোয়া পারিবারিক হ্যারী স্ট্যানফোর্ড। সংবাদ মাধ্যম যাকে ছুঁতে পারে না। জনগণ সে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড এর জীবন যাপন সম্পর্কে কিছুই। জানতে পারে না, জানে না, সেই স্ট্যানফোর্ডই আসল। যার সবটুকুই আড়ালে গোপনে।
তোমরা কোথায় যাচ্ছ? সুন্দরী লালচুল যুবতীটি প্রশ্ন করে। হ্যারী উত্তর দেবার অবস্থায় ছিলেন না। তিনি তখন এক অন্য জগতে। রাস্তার অপর দিকের ফুটপাথে তখন অনুসরণকারী জুটিটির ওপর তার মনোনিবেশ। সারা শরীর জুড়ে থমকে রয়েছে এক রুদ্ধ বিরক্তি, বিপদের অনুভূতিটার সাথে সাথে তার মন জুড়ে এই যে ওরা তার পারিবারিক জীবনে নাক গলাচ্ছে। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, তার ব্যক্তিগত স্বর্গোদ্যান, সেখানেও ওরা পিছন ধরে এসে হাজির হয়েছে। এর বিরুদ্ধেই প্রচণ্ডতর এক রাগে সোচ্চার হয়ে উঠতে চাইছিলেন তিনি। কান আর নিসের মধ্যে আল্পস পর্বত চূড়ার পথে অবস্থিত সেন্ট পলস ডি ভেনস এর মন জুড়াননা প্রকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যবলী সত্যিই মননামুগ্ধকর। উচ্চতর অবস্থান থেকে চারপাশে যে দিকে তাকানো যায় রক্তবেরঙের ফুল আর বিভিন্নতর অর্কিড। পাইন সারির বন। সেন্ট পল-ডি ভেনস যেন কোন প্রাকৃতিক শিল্পীর স্টুডিও। নাকি ভোলা ক্যানভাস? যে রঙীনতর ক্যানভাসের উচ্ছল চুম্বক টানে সারা পৃথিবী থেকে ছুটে আসেন পর্যটকের দল।
এখন স্ট্যানফোর্ড এবং তার দলবল দাঁড়িয়ে আছেন রু গ্র্যান্ডে। স্ট্যানফোর্ড তার সঙ্গিনীর দিকে ফিরে তাকালেন। সোফিয়া তুমি কি মিউজিয়াম পছন্দ করো? হা নিশ্চয়ই। যুবতীটি হ্যারীর পছন্দে বা যে কোন কথায় সায় দিয়ে তাকে খুশি করতেই সদা উৎসুক। তার জীবনে সে আগে কখনো হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মত কোন পুরুষের সাথে মিলিত হয়নি, আলাপ করেনি। কথা বলার সুযোগ পায়নি। দীর্ঘযাত্রার সঙ্গিনী হওয়া তো অনেক দূরের কথা। আমি ভাবতাম যৌনতার ব্যাপারে সবকিছুই আমি জেনে ফেলেছি। আর কিছু বাকি নেই। হে ভগবান, হারীর সাথে বিছানায় না গেলে আমি কোনদিন জানতেই পারতাম না যে আমিও কতটা নবিশ, এখনো যৌনতার বিস্তৃত চরাচরে। আহ, ও যেন এক শিল্পী। যার সৃজনী শক্তি কোন নারীর পক্ষে কল্পনাতীত। নারীকে সমস্তটুকু নিংড়ে বের করে।
পাহাড়ের উচ্চতর অংশে ফাউন্ডেশন মায়েঘট আর্ট মিউজিয়ামে গিয়ে পৌঁছল। সারা মিউজিয়াম জুড়ে শিল্পের অনন্য সাধারণ সব সংগ্রহের মাঝে ঘুরে দেখে বেড়াতে লাগল। একসময় হ্যারী স্ট্যানফোর্ড যখন চোখ বোলালেন শিল্প সংগ্রহের গ্যালারীর শেষ প্রান্তে তখন তিনি অনুসরণকারীর একজনকে দেখতে পেলেন। খুব যেন মনোযোগ দিয়ে মিনোর একটা ছবিকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত। স্ট্যানফোর্ড সোফিয়ার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকালেন। ক্ষিধে পেয়েছে? হ্যাঁ যদি তোমারও পেয়ে থাকে। সে হাসে। ঠিক আছে চলো, লা–কলম্বো ডি ওর-তে আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাবো। লা-কলম্বো ডি ওর স্ট্যানফোর্ডের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। এটা আসলে একটি ষোড়শ শতাব্দীর প্রাচীন বাড়ী। যার প্রাচীনতর ঐতিহ্যকে ধরে রেখেই একটি আধুনিক খাদ্যশালা তৈরি করা হয়েছে। এখানকার খাবারও অত্যন্ত সুস্বাদু। উপাদেয় স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে তৈরি। গ্রামে ঢোকার মুখেই হোটেল তথা রেস্তোরাঁটা। ওরা সাঁতারের জলাশয়ের পাশে বাগানে ছাতাওয়ালা আসনে গিয়ে বসল। প্রিন্স নামের জার্মান শেফার্ডটি প্রভুর পায়ের কাছে এসে জড়িয়ে বসল। প্রিন্স তার প্রভুর সর্বক্ষণের সঙ্গী। বলা যায় হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের যেন ট্রেড মার্ক এই প্রিন্স। গুজব শোনা যায় অত্যন্ত রকম প্রভুভক্ত প্রিন্স নাকি একবার তার মনিবের নির্দেশে জনৈক ব্যক্তি টুটি কামড়ে ছিঁড়ে দিয়েছিল। যদিও এটা শুধুই গুজব কিনা তা পরীক্ষা করার সাহস কারোরই হয়নি। দিমিত্রি রেস্তোরাঁর ঠিক প্রবেশ পথের সামনে একটি আলাদা চেয়ারে বসে সদা সতর্ক চোখে চলমান প্রতিটি মানুষ এবং আশেপাশের সবকিছু লক্ষ্য করছিল। নজর রাখছিল।
.
সুস্বাদু, দামী, উপাদেয় খাবারের মহার্ঘ্য স্বাদ নিতে নিতে সোফিয়া মুখ তুলল, আমি আগে এখানে কখনো আসিনি। আসতে পারব ভাবিও নি। স্ট্যানফোর্ডের মনোযোগ এবার সোফিয়ার দিকে ফিরল। এই যুবতীটিকে দিমিত্রি দিন কয়েক আগে নিসের এক হোটেলে প্রথমবার দেখতে পায়। এবং সেখান থেকেই মনিবের জন্য তাকে সংগ্রহ করে দিমিত্রি। প্রথম আলাপেই দিমিত্রি যখন তাকে মনিবের হয়ে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানায়, যুবতীটি জানিয়ে দেয় সে কোন হেজি বেজি নয়। একজন অভিনেত্রী। এবং বাস্তবিকই পিউপি আভাতির শেষ ছবিতে, ভীড়ের দৃশ্য বলা যায় না, ঠিক এরকম একটি প্রায় না একস্ট্রা চরিত্রে অভিনয় করেছে। এবং গিউশিপ্লে টরনাতোরের ছবিতেও দুলাইনের সংলাপ সহ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছে সে। একজন অপরিচিতের সাথে কেন আমি রাতের খাওয়া খেতে যাবো? বিরক্তি মেশা, বাঁকা ভূ সহকারে প্রশ্ন করেছিল সে। দিমিত্রি একটা পাঁচশো ডলারের নোট মেয়েটির হাতে গুঁজে দেয়।
আমার মনিব অত্যন্ত দয়াপরাবশ, ভদ্র, বিনয়ী। সবচেয়ে বড় কথা বাড়াবাড়ি রকমের অতি ধনবান। তাঁর নিজের ইয়ট আছে। বিনোদন বাস আছে কয়েক ডজন-সমুদ্র পাড়ে শৈলশিখরে মিলিয়ে। কিন্তু তবু তিনি বড় নিঃসঙ্গ। পুরো কথা শেষ হবার আগে থেকেই, তার বক্তব্যের মাঝপর্ব থেকেই মেয়েটির মুখের তীক্ষ্ণ অভিব্যক্তি পরিবর্তিত নরম হতে লক্ষ্য করে দিমিত্রি। কথা শেষ হতে না হতেই বাঁকা ভুরু সোজা। সে হাসে–ছবির শুটিংয়ের ফাঁকে যদি আপনার বন্ধুর নিমন্ত্রণটা হয় তাহলে তা রাখা যেতে পারে। বিরক্তির পারদ তখন বদলে গেছে, কৌতূহল আর আগ্রহে।
মানতেই হবে, দিমিত্রির পছন্দ, রুচিজ্ঞান অতি চমঙ্কার। ইতালিয়ান মধ্য কুড়ির যুবতীটি আবেদনময়ী, পুর্ণস্তনী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী। এ মুহূর্তে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। সোফিয়া তুমি বেড়াতে ভালোবাসো? দারুণ, দারুণ ভাল লাগে আমার ঘুরে বেড়াতে। স্ট্যানফোর্ড হাসেন, চমৎকার। তাহলে একটা ছোট্ট অথচ দারুণ সফরের ব্যবস্থা করা যাক। এক মিনিট বসো। সোজা উঠে গিয়ে সাঁতারের জায়গাটার পাশে, জনগণের ফোনটায় গিয়ে ঢোকেন। একটা মুদ্রা ফেলে অক্ষর সংখ্যা ঘোরাতেই অপর প্রান্তে সাড়া পেলেন আমি কী কথা বলবো, স্ট্যানফোর্ড সাথে সাথে বললেন, আমি নীল আকাশ ইয়টে যোগাযোগ করতে চাই হুইস্কি ব্র্যাভো লিমা নয় আট শূন্যকথা শেষ হবার পর ফোন রেখে দিয়ে স্ট্যানফোর্ড আরো একটা ফোন করলেন। নিসে বিমানবন্দরে। মিনিট দুয়েক পরই আবার খাবার টেবিলে যোগ দিলেন তিনি। খাবার শেষ হলো, তখন তিনি সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো এবার একটু হেঁটে আসা যাক। তার প্রখর মস্তিষ্কে তখন ধীরে ধীরে আদল নিতে শুরু করেছে একটি সম্পূর্ণ পরিকল্পনা। যাকে এবার তিনি কাজে পরিণত করতে চলেছেন। আজকের দিনটা সত্যিই দারুণ। ঝকঝকে সুর্যের নরম রোদ ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তরেখা জুড়ে। উজ্জ্বলতর রুপোর রঙ চারপাশে। ওরা হেঁটে বেড়ালো রু গ্ল্যান্ডের পথ ধরে। বাড়ীর সামনে এসে পৌঁছে একটা দোকান থেকে তাজা সদ্য সেঁকা রুটি কিনলেন স্ট্যানফোর্ড কিছুটা। রুটির টুকরোর প্যাকেটটা সোফিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি বাড়ীর দিকে এগোও। আমি একটু পরে আসছি। সোফিয়া মাথা নেড়ে হেসে এগিয়ে যায়। ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে, বেশ কিছুটা দূরে চলে যাবার পর স্ট্যানফোর্ড দিমিত্রির দিকে ফিরলেন। হ্যাঁ বলো। কি খবর? দিমিত্রি চাপা গলায় বলে, মেয়েটা আর লোক দুজনের একজন থাকছে লা কললে রাস্তার ওপর লা হোমেউ হোস্টেলে। স্ট্যানফোর্ড মাথা নাড়লেন। তিনি জায়গাটাকে চেনেন। আর অন্যজন? সে থাকছে লা মাস ডি. আটিগনিতে। এটা একটা প্রাসাদোপম বাড়ী। বাড়ীটা কার জানতে পারিনি। কথা শেষ করে কয়েক মুহূর্ত মনিবের দিকে তাকিয়ে থেকে দিমিত্রি প্রশ্ন করে, এদের কি ব্যবস্থা করব? কিছু না। এদের আমি দেখছি।
স্ট্যানফোর্ড যখন ভিলায় ফিরলেন, সোফিয়া তার জন্যে শোবার ঘরে অপেক্ষা করছিল। বেঁচে থাকার জন্য, জীবন ধারনের চাহিদা মেটাতেই ফিল্মের কাজের পাশে পাশে সোফিয়াকে কলগার্ল হিসেবে পুরুষকে সঙ্গ দিতে হয়। তাদের খুশি করতে হয়, সোফিয়াকে চরম তৃপ্ত হবার অভিনয় করতে হয়। কিন্তু এই পুরুষটির সঙ্গে সে সবের কোন প্রয়োজনই হয় না। ও অপ্রতিবোধ্য। এবং প্রতিবারই চরম যৌনসুখের শীর্ষতৃপ্তিতে ভরে ওঠে সোফিয়া।
লা কাফে ডি লা পেলেসে রাতের খাওয়া সেরে ওরা যখন ফিরছে, স্ট্যানফোর্ড ইচ্ছাকৃত ভাবেই আয়েসী ধীর পায়ে হাঁটছিলেন। সঙ্গে পাশে সোফিয়া, পেছনে দিমিত্রি। তার মাথায় একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা কাজ করছে। এবং তিনি তার অনুসরণকারীদের সুযোগ করে দিতে চান। রাত একটায় তার ভিলার উল্টো দিকের ফুটপাথে পথবাতির নিচে দাঁড়িয়ে অনুসরণকারীদের একজন দেখল ভিলার ঘরগুলোর আলো একটা একটা করে ক্রমে নিভে যাচ্ছে। যতক্ষণ না সবগুলো ঘরের শেষ আলোটাও নিভে গিয়ে পুরো বাড়ীটা অন্ধকার আর নৈঃশব্দে ডুবে না গেল সে নড়ল না। রাত চারটে। স্ট্যানফোর্ড সোফিয়াকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। সোফিয়া, সোফিয়া, গাঢ় ঘুম ভাঙা ঘোর চোখে সোফিয়া তাকাতেই তিনি বললেন, ওঠো সোনা, বলেছিলাম না আমরা বেড়াতে যাবো? তৈরি হয়ে নাও। আমরা বের হবো। সোফিয়া অবাক গলায় বলে এখন? হ্যাঁ সোনা। তাড়াতাড়ি করো। হাতে সময় খুব কম! এর পনের মিনিট পর, হ্যারী স্ট্যানফোর্ড সোফিয়া দিমিত্রি এবং প্রিন্সকে নিয়ে বাদামী রেনল্ট গাড়ীটা রাস্তায় নামল। চালকের আসনে বসা দিমিত্রির দিকে তাকিয়ে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড বললেন, নিস বিমানবন্দর জলদি।
.
০২.
চল্লিশ মিনিট পর নিস বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা বোয়িং ৭২৭ বিমানটি প্রথমে রানওয়ে ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। তারপর আকাশে উড়ল। এটি হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের ব্যক্তিগত বিমান। এবং বিমানটি যখন আকাশে উড়ল হ্যারী জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। তিনি নিশ্চিত। তার এই ধোঁকাটি বেশিক্ষণ গোপন থাকবে না তার ধূর্ততর প্রতিপক্ষের কাছে। এবং তার অনুমান ভুল ছিল না। বোয়িংটি সবে আকাশে উড়তে না উড়তেই নিস বিমান বন্দরে কনট্রোল রুমের ফোন বাজল। হ্যালো নিস বিমানবন্দর কনট্রোল রুম? হ্যালো মঁসিয়ে স্ট্যানফোর্ডের বিমানটি কি আছে? না মঁসিয়ে ওরা এইমাত্র আকাশে উড়েছে। অন্য প্রান্তে সাময়িক স্তব্ধতার পর সাড়া পাওয়া গেল। ঐ বিমানের চালক কি তাদের রুট চার্ট জানিয়েছেন? নিশ্চয়ই, জন এফ কেনেডী বিমানবন্দর, আমেরিকা। ধন্যবাদ। টেলিসংযোগ ছিন্ন হলো।
হ্যারী স্ট্যানফোর্ড তার গাড়ীর তোলা কাঁচের জানালার মধ্যে দিয়ে বিমানটিকে আকাশে উড়তে দেখলেন। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ওরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব জেনেছে? যাক বিমানের পেছনে বুনোহাঁস তাড়া করুক। দিমিত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, নাও হে, কাজ শেষ এখানকার। এবার চলল। আধ ঘন্টা পর তার বাদামী রেনল্ট মন্টে কালো পার হয়ে ইতালির সীমান্তের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। আকাশে তখন সবে রাতের আঁধার কেটে ফিকে আভা। ভোরের আকাশ সদ্য জাগতে শুরু করেছে।
.
সন্ধ্যের একটু পরে রেনল্টটা সান রেমেতে পৌঁছল। অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার এই শহরটার সাথে। কিন্তু বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চরিত্র হারাচ্ছে শহরটা। এক সময় এটা সুন্দর সুন্দর হোটেল আর বেঁস্তোরাময় শহর ছিল। ছিল ক্যাসিনোগুলো। সেখানে এক সন্ধ্যাতে ভাগ্যর পাশা ওলোট পালোট ঘটাত মানুষের জীবন। আর এখন শহরটা কিছু হঠাৎ ধনী, হামলাবাজ, জুয়াড়ীর দখলে। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড তখন শহরটাকে পছন্দ করতে। পর্যটকরা জুয়া খেলত। এখন জুয়াড়ীরা আসে পর্যটক হয়ে। রেনল্টটা শহরের ভিতর দিয়ে দ্রুতগতিতে জাহাজ ঘাটার দিকে চলল। এই বন্দরটা ইতালি-ফ্রান্স সীমান্ত রেখার বারো মাইল দূরে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে জাহাজ ঘাটায় নোঙর করা নীল আকাশ ইয়টে পৌঁছে গেলেন হারী স্ট্যানফোর্ড তার দলবল সহ। ইয়টের ক্যাপটেন কারো ওদের অভ্যর্থনা জানালেন। শুভ সন্ধ্যা সিনর। আপনাদের মালপত্র তুলে আনতে বলি? স্ট্যানফোর্ড হাত নাড়লেন। আমাদের সাথে কোন মালপত্র নেই। তারপর সতর্ক চোখে কেবিন ক্রুদের দিকে লক্ষ্য করতে করতে কোণের দিকের অল্প বয়সী যুবকটির দিকে তাকিয়ে আঙুল তুললেন। ওটি নতুন মুখ, তাই না? কারো মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ সিনর। আমাদের একজন কেবিন বয় কাপ্রিতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার বদলে এ ঢুকেছে। ওকে বাদ দাও। মায়নাপত্র দিয়ে এখনি এই বন্দরেই নামিয়ে দাও। আমি কোন অচেনা মুখ এই সফরে চাই না। মনে রেখো। কারো অবাক। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ চোখে তাকালেন। মাথা নেড়ে সায় দিলেন মনিবের হুকুমে। আচ্ছা সিনর। স্ট্যানফোর্ড তার নৌ অধ্যক্ষের চোখের বিস্ময় পড়তে পারলেন। তিনি বাতাসে বিপদের গন্ধ টের পাচ্ছেন। এই সময়ে তার কাছাকাছি কোন অপরিচিত লোক থাকা, রাখার ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। ইয়টের ক্যাপটেন এবং অন্য নাবিকরা দীর্ঘদিন তার কাছে কাজ করছে। তিনি এবার তার নতুন সঙ্গিনীর দিকে ফিরলেন। কামিনস্কি ওকে যেহেতু বেছেছিল প্রায় লক্ষ্যহীন ভাবে, হঠাৎ খেয়াল খুশি মত, কোন পরিকল্পনা ছাড়াই, তাই এর দিক থেকেও কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। বাকি রইল কামিনস্কি। নাহ, ওর বিশ্বস্ততা নিয়ে কোন সন্দেহ তোলার অবকাশই নেই।
দিমিত্রি কামিনস্কি বাইরের ডেকে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরুর আয়োজন লক্ষ্য করছিল। জেনারেটরগুলো চলতে শুরু করেছে সগর্জনে। নোর ভোলা হয়েছে। সামান্য দুলতে শুরু করেছে নৌকো। কারো এসে স্ট্যানফোর্ডের কেবিনের দরজায় দাঁড়ালেন, সিনর স্ট্যানফোর্ড। বলুন ক্যাপটেন। আমরা যাত্রা শুরু করছি। আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য কী হবে? পোটো ফিলো, ক্যাপটেন।
.
০৩.
ইতালিয়ান রিভিয়েরার লিগুরিয়ান কোস্ট। একটা অর্ধ বৃত্তাকার নিয়ে জেনোয়া থেকে প্রায় ঝাড়ু মারার মত ঘুরে গিয়ে এগিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে লা স্পেজিয়া গালফ-এর দিকে। দীর্ঘ একটা ফিতের মত ছড়ানো এই বালুকা বেলার এক পাশে ছোট্ট বন্দর পোটোফিলল। একটু আগেই নীল আকাশ সে বন্দরে এসে থেমেছে, নোঙর ফেলেছে। নিজের কেবিনের জানালা দিয়ে সতর্ক চোখে বন্দরের দিকে দেখতে দেখতে স্ট্যানফোর্ড মনে মনে হাসলেন। নাহঃ, ওরা তার জন্য জন এফ কেনেডীতেই অপেক্ষা করবে। সোফিয়া এসে তার পাশে দাঁড়ায়, তুমি কি প্রায়ই এখানে আসো? মাঝে মাঝে। তোমার আসল বাড়ী কোথায়। বড় ব্যক্তিগত। স্ট্যানফোর্ড প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। বন্দরটা খুব সুন্দর। আশা করি তোমার ভাল লাগবে।
.
একটু পর ওরা তিনজন–স্ট্যানফোর্ড, সোফিয়া এবং দিমিত্রি বন্দরের সুন্দর সুন্দর দোকান বাজারের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এক সময় স্ট্যানফোর্ড সোফিয়ার দিকে তাকালেন। আমরা দুপুরের খাওয়া খেতে যাবো হোটেল সেপ্নভিডোতে। একেবারে পাহাড়ের চুড়োয় বেঁস্তোরাটা। খেতে খেতেই ছবির মত পুরো শহরটাকে দেখতে পাওয়া যায়। কথা শেষ করে তিনি হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি ডাকলেন। সোফিয়ার হাতে কিছু লিরা তুলে দিয়ে বললেন, তুমি চলে যাও। ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি একটা ছোট্ট কাজ সেরে আসছি। সোফিয়া মাথা নেড়ে সায় দেয়। ট্যাক্সিটা সোফিয়াকে নিয়ে চলে যেতে তিনি দিমিত্রির দিকে তাকালেন। একটা ফোন করতে হবে। এবং সেটা নৌকো থেকে করা যাবে না। দিমিত্রি ভাবে, ইয়টে উঠেই নৌকোর রেডিওটিকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন মনিব। কোনরকম রেডিও বার্তা পাঠান, নেওয়া বা কোনরকম রেডিও সংযোগই করতে দিচ্ছেন না। এমন কি, নৌকো থেকে কাউকেই সেলুলার ফোন ব্যবহার করে কথা বলারও অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। দিমিত্রি যখন এসব ভাবছে লম্বা পা ফেলে রাস্তার অন্য প্রান্তে জনগণের ফোন ঘরটাতে ঢুকে পড়লেন স্ট্যানফোর্ড।
.
বোয়িং ৭২৭ জন এফ কেনেডী বিমানবন্দরে নামল। লাউঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চার জোড়া চোখ অতি সতর্ক ভাবে চলমান যাত্রী স্রোতে নজর বুলোচ্ছিল। খুঁজে বেড়াচ্ছিল একজনকে।
দুপুর পার হওয়া সদ্য বিকেলে নীল আকাশ এসে পৌঁছল এলবা দ্বীপের বন্দরে। স্ট্যানফোর্ড সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানেই নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। সারা দ্বীপ জুড়ে যোড়শ শতাব্দীর অনন্য সাধারণ স্থাপত্যময় সুন্দর সুন্দর সব বাড়ী আছে। রাস্তাঘাটেও ছড়িয়ে আছে সুন্দর প্রাচীন ঐতিহ্য। তারপর দিমিত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি বরং ওকে নিয়ে যাও। ভিলা ডেল মুলিনি ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসো। দিমিত্রি মাথা নাড়ে, আচ্ছা স্যার। ওরা বেরিয়ে যায়। স্ট্যানফোর্ড তার ঘড়ির দিকে তাকালেন। সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে বিমান জে কে এফ-তে পৌঁছে গেছে। এবং ওরা ব্যাপারটি ধরতে পেরেছে। সাথে সাথে নতুন করে শুরু হবে সন্ধান। ওর সঠিক গতিপথ খুঁজে পেতে ওদের কিছুটা সময় লাগবে। যা করার তার মধ্যে তার আগেই করে ফেলতে হবে। সব কিছু গুছিয়ে ফেলতে হবে। তিনি একাই ইয়ট ছেড়ে বন্দরে নেমে এলেন। একটা ফোন বুথে ঢুকলেন। যন্ত্রে মুদ্রা ফেলে নম্বর ঘোরালেন, হ্যালো? বাকলেজ ব্যাঙ্ক? এক…সাত…এক…।
পনেরো মিনিট পর আবার তিনি বুথটায় গিয়ে ঢুকলেন। নম্বর ঘোরালেন…হ্যালো? সুমিটুমো ব্যাঙ্ক, টোকিও? আধঘণ্টা পরে তিনি যখন নৌকাতে ফিরে এলেন তাকে কিন্তু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। দিমিত্রি এবং সসাফিয়া ততক্ষণে ফিরে এসেছে। ক্যাপটেন এসে জানতে চাইলেন, সিনর, আজকের রাতটা আমরা কি এখানেই নোঙ্গর ফেলব? নাহ, রওনা দাও। সারদিনিয়া। এখনি। তার ভঙ্গীতে ক্ষিপ্ততাময় অস্থিরতা ধরা পড়ে।
সারদিনিয়ার পাশে অবস্থিত কোস্ট স্মেরালডা সম্ভবত এই অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। মেডিটেরিনিয়ান কোস্ট-এর পাশ ঘেঁষা এই সমুদ্র উপকূল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত করে দেবার মত। ছবির মত ছোট্ট শহরটা পোর্টো সিরভো ধনীদের বেড়ানোর আকর্ষণ। সারা বছরই পর্যটকে ভরা থাকে আলিই খান-এর হাতে তৈরি প্রাচীনতম শহরটি। স্ট্যানফোর্ড শহরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, সোফিয়াকে। প্রাচীন স্থাপত্য শৈলী, গথিক সৌন্দর্যে ভরা বিশাল বিশাল ভিলা, ইট বানো চওড়া রাস্তা, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মূর্তি। স্থাপত্যের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তারা। একসময় স্ট্যানফোর্ড রাস্তার পাশে একটা জনগণের ফোন দেখতে পেয়ে সোফিয়াকে বললেন, দাঁড়াও। আমায় একটা ফোন করতে হবে। সোফিয়া অবাক হয়। নৌকো থেকে কেন ফোন করে না ও; ব্যাপারটা কী? স্ট্যানফোর্ড ততক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছেন। যন্ত্রে মুদ্রা ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট নম্বর ঘোরালেন, হ্যালো, ব্যাঙ্ক ডিটালিয়া; রোম?… এরপর প্রায় আধঘণ্টা ধরে কথোপকথন চলে, ফোন ঘর থেকে যখন তিনি বের হয়ে আসেন, ওকে বিধ্বস্ত দেখায়। প্রায় কদাকার একটা ঝড় বয়ে গেছে যেন।
দুপুরের খাবার খেতে ওরা যায় লিসিয়া ডি ককাতে। ওদের খাওয়া যখন মাঝ পর্বে হঠাৎ যেন হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল স্ট্যানফোর্ডের। সোফিয়ার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে পেলেন, কোণের টেবিলে দুজন পুরুষ এদিকেই তাকিয়ে আছে। দুজনেরই পরনে গাঢ় রঙের সুট। তখন কি লোক দুটো পর্যটক সাজার ভানও করছে না। করার দরকারই মনে করছে না। ওরা কি তারই পেছনে; নাকি নিছক নিরীহ অচেনা? নাহ, ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সোফিয়া কথা বলে চলেছে। তুমি কিন্তু আমায় এখনো বলনি, তুমি কীসের ব্যবসা করোকী করো। স্ট্যানফোর্ড সোফিয়ার দিকে ফিরলেন, কেউ অচেনা, তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এ ব্যাপারটা কেন জানি তৃপ্তি দেয় ওঁকে। আমি রিটায়ার করেছি। এখন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছি। এবং তুমি খুব একা নিঃসঙ্গ। তাই না? এবার শব্দ করে হো হো হেসে ওঠার মত পরিস্থিতি, অথচ স্ট্যানফোর্ড তা করলেন না। বিষণ্ণ ভঙ্গী গলা করে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আর সেই চরম নিঃসঙ্গতার মাঝে তোমায় পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি সোফিয়া। ওঁর হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে সোফিয়া বলে আমিও; আমিও। স্ট্যানফোর্ড আবার তাকালেন চোখের কোণ দিয়ে। ওরা টেবিল ছেড়ে উঠে বের হয়ে গেল। দুপুরের খাওয়া শেষ হলো। ওরা আবার রাস্তায় বের হয়ে এলো। ছায়ার মত, একটু দূরত্বে দিমিত্রি। রাস্তায় নেমেই স্ট্যানফোর্ড উলটো দিকের ফোন ঘরে ঢুকলেন। হ্যালো লিয়ননেইস ক্রেডিস, প্যারিস?… সোফিয়া দিমিত্রির দিকে তাকায়, আপনার মনিব সত্যিই দারুন মানুষ। উনি সবার থেকে আলাদা। দারুণ মানুষ। আপনি সত্যি সৌভাগ্যবান। হ্যাঁ সত্যিই তাই। কবছর কাজ করছেন ওর কাছে? তিন বছর। ফোনঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওরা কথা বলছিল। দিমিত্রির কানে ভেসে আসতে থাকে স্ট্যানফোর্ড-এর ফোন সংলাপের টুকরো–রেনে? তুমি তো জানো কেন আমি ফোন করছি…হা…হা…তুমি করবে তো।…ঠিক আছে…হা..দারুণ..না, না। ওখানে …হা তাহলে করসিকা..সেটাই ঠিক রইল তাহলে? ফোন ঘর থেকে বের হয়ে আসার পর তাকে অনেকটা আশ্বস্ত নিরুদ্বেগ চিন্তামুক্ত মনে হচ্ছিল।
ফোন ঘর থেকে বের হয়ে এসে তিনি সোফিয়াকে বললেন–সোফিয়া আমাকে একটা দরকারী কাজ করতে হবে। তুমি বরং সোজা হোটেল পিত্রাজায় চলে গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করো। মাথা নেড়ে সায় দেবার ভঙ্গীতে প্রেমময়তার আবেদন ফুটিয়ে তুলে সোফিয়া চলে যায়। স্ট্যানফোর্ড আবার ফোন ঘরটায় গিয়ে ঢোকেন। একটা নম্বর ঘোরান। হ্যালো? হারী স্ট্যানফোর্ড বলছি। আমি শ্ৰী ফিৎজেরাভের সাথে কথা বলতে চাই। অন্য প্রান্ত থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে, আমি ওনার ব্যক্তিগত সহকারী বলছি। উনি তো অফিসে নেই। কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়ে বেড়াতে গেছেন। অন্য কাউকে… না, আমার ফিজেরাল্ডকেই দরকার। শুনুন ওকে খবর পাঠান। আমি দেশে ফিরছি, ও যেন সোমবারই সকাল দশটায় বস্টন এর রোজ হিলতে আমার উইল এবং একটা নোটারী নিয়ে হাজির থাকে। মেয়েটি উত্তর দেয়, আমি চেষ্টা করছি…। ওর কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ধারালো কাটা কাটা ভঙ্গীতে স্ট্যানফোর্ড বলেন, চেষ্টা নয়, চেষ্টা নয়। এটা করতেই হবে। অত্যন্ত জরুরী ব্যাপার। ঠিক আছে স্যার। আমি দেখছি। ফোন ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসার পর তাকে সমাহিত ধীর স্থির, নিশ্চিন্ত দেখায়। দিমিত্রির কাছে এসে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ইয়টে ফিরে চলো। আমরা রওনা হবো। দিমিত্রি অবাক গলায় বলে, কিন্তু…। স্ট্যানফোর্ড বাঁকা হাসেন। মেয়েটার কথা বলছ? ও যেভাবেই হোক ফিরে যেতে পারবে।
নীল আকাশে ফিরে তিনি সোজা ক্যাপটেন ভাকাবোর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ক্যাপটেন আমাদের এক্ষুনি করসিকার দিকে রওনা হতে হবে। নোঙর তুলুন। ভাকাররা ইতস্তত করেন, সিনর, একটু আগে একটা বার্তা এসেছে। সমুদ্রের অবস্থা ভাল নয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অসম্ভব। আমাদের এখনি রওনা হতে হবে। আমার হাতে সময় নেই। কিন্তু সিনর, এটা দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহ। সমুদ্র ভীষণ রকম অশান্ত হয়ে ওঠে। আমার ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। রওনা দিন। যা হবে দেখা যাবে। করসিকাতে তার সমস্যার সমাধান ঘটবে। তাকে যেতেই হবে। এবং কুড়ি মিনিট বাদে নীল আকাশ নোঙর তুলে রওনা হলো।
.
০৪.
ওর আদর্শ হচ্ছেন ডন কোয়াইলে এবং ছদ্ম পরিচয় হিসেবে মাঝে মাঝেই এই নামটাকে ব্যবহার করে থাকে সে। কোয়াইলে সম্পর্কে সবাই কী বলে তাতে মোটেই আমল বা কান দেয় না সে। সব সময় সর্বদা কোয়াইলের পেছনে আছে। কারণ কোয়াইলে একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি নাকি পারিবারিক মূল্যবোধকে সম্মান ও গুরুত্ব দেন। এই যে যুবক যুবতীরা বিবাহ বহির্ভূত জীবন যাপন বা লিভ টুগেদার করছে, সন্তান ধারণ করছে, এরকম একটা ঘৃণ্য পদ্ধতিকে, শকিং ব্যাপারকে কী করে মেনে নিচ্ছে, মেনে নেয় সমাজ ব্যবস্থা? এই যে এত অপরাধ ঘটছে চারপাশে, কেন তার কোন প্রতিকার হচ্ছে না? ডন কোয়াইলে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তবে এসব কিছুই ঘটত না। দৃঢ় বিশ্বাস তার। ওর নিজের চার ছেলে মেয়ে। বড় ছেলের বিলির বয়স আট। পরের তিন মেয়ে অ্যামি, সুসান, ক্লারিসসার বয়স যথাক্রমে দশ, এগারো, চৌদ্দ। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো তার কাছে এক অত্যন্ত সুখকর আরামদায়ক অভিজ্ঞতা। সপ্তাহান্তের ছুটিটা ছেলে মেয়েদের সাথেই কাটায়। কাটাতে ভালবাসে। শুধু নিজের ছেলে মেয়েদেরই নয়, আশেপাশে পাড়া প্রতিবেশীর ছেলেমেয়েদেরও খুবই ভালবাসে। ওদের সাইকেল সারাই করে দেয়। খেলনা তৈরি করে দেয়। ছেলে মেয়েগুলোও তাকে খুবই ভালবাসে। শ্রদ্ধা করে। ওরাও তার নিজের সন্তানদের মতই। তাকে ডাকে পাপা বলে।
ঝকঝকে রোদে উজ্জ্বল ছবির মত সুন্দর দিনটা। বসে বসে বেসবল খেলা শেখাচ্ছিল সে। এমন সময় তার সেলুলার ফোন বেজে উঠল। আহ, তার ভঙ্গীতে বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ে। এই নম্বরটা শুধু একজনই জানে। আর সে জানে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটানো পরিবারের মধ্যে থাকার সময়ে বিরক্ত করাটা সে মোটেই পছন্দ করে না। মনে মনে রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা তোলে। কারণ তাকে অমান্য করার ক্ষমতা তার নেই। কয়েক মিনিট কথা বলে সে। বোতাম টিপে ফোনটা বন্ধ করে আগে সে বলে–ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি আমি দেখছি। ফোনটা নামিয়ে রাখতেই হাঁসের মাংসের কোর্মা রান্না করতে করতে ওর স্ত্রী জিজ্ঞেস করে। কী ব্যাপার গো? সব ঠিক আছে তো? সে হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ে, বোধহয় না, ওরা আমাকে ডেকেছে। কাজ পড়েছে। অথচ কৃর্তা জানেন সপ্তাহের শেষের ছুটিতে কাজ আমি পছন্দ করি না। ওকে বিরক্ত রাগত দেখায়। স্ত্রী ওর হাত আলতো চাপ দেয়। ভালবাসামাখা গলায় বলে, তোমার কাজটা সব থেকে জরুরী। নাহ, মোটেই না। তার পরিবারের থেকে বড় কিছুই নয়। হতে পারে না। সে ভাবে। ডন কোয়োইলি বুঝত। একমাত্র সে বুঝত। কিন্তু এবার তাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। ডাক যখন এসেছে। বস্টনের ফ্লাইট ধরার জন্যে তার হাতে খুব বেশি সময় নেই।
রবিবার সকাল সাতটা। সে বস্টন পার্ক প্লাজার বিশাল বাড়ীটায় ঢুকল। বস্টন ট্রাষ্ট বিল্ডিং এটা। আটতলার ওপরে উঠে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। মোম পালিশ করা দরজায় পিতলের নাম ফলক ঝকঝক করছে–ফিজেরাল্ড অ্যাটনী। নিস্তব্ধ জনমানব শূন্য করিডোরটার দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বন্ধ দরজাটার সামনে বসে পড়ল। নিজের ছোট্ট কালো চামড়ার যন্ত্রপাতির বাক্সটা খুলে কাজে নেমে পড়ল। মিনিট সতেরর মত সময় লাগল তার সদর দরজার স্বয়ংক্রিয় তালাচাবিকে অকেজো করে বিনা অনুমতিতে অনধিকার অনুপ্রবেশ করতে।
অফিসটায় এক চক্কর লাগালো সে তার প্রার্থিত গন্তব্য খুঁজে পেতে। রেকর্ডস রুম। ঘরটায় ঢুকে আর এস চিহ্নিত করা ক্যাবিনেটটা খোলার চেষ্টা করল। ওটা তালা বন্ধ ছিলো। পকেট থেকে এক গোছা সব খোলা চাবি বের করে সে। বেশ কয়েকবার কয়েকটি চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর তার মুখে হাসি ফুটল। ক্যাবিনেটটা খুলে গেল। আহ, এবার একটা লম্বা ছুটি। বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে একটা লমবা দুর্দান্ত মন মাতানো ছুটি। একটা ড্রয়ার টেনে সে তার প্রয়োজনীয় কাগজগুলো পেয়ে গেল। খালি টেবিলটায় সেগুলো বিছিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট অথচ ক্ষমতাশালী ক্যামেরা বের করে কাজে নেমে পড়ে।
গোটা কাজটা শেষ করে আবার সব যথাযথ ভাবে গুছিয়ে তালা বন্ধ করে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বাড়ীর বাইরে বের হয়ে আসতে তার ঠিক পাকা সতেরো মিনিট সময় লাগল। একটা দুর্দান্ত রকম নিখুঁত এবং সফল কাজের হিসেবে যথেষ্ট কম সময় মানতেই হবে।
.
০৫.
সমুদ্র। সেদিন সন্ধ্যেবেলা। ক্যাপ্টেন কারো দেওয়ালে ছড়ানো বৈদ্যুতিক ম্যাপটায় লম্বা একটা ছড়ি দিয়ে দেখাচ্ছিল। এই যে আমরা এখানে। আর ভয়ঙ্কর দক্ষিণ-পশ্চিমী বায়ুর ঝড় ঠিক এখানে, প্রচণ্ডতরভাবে বইছে। স্ট্যানফোর্ড তাকালেন। বোনিফিয়াশিওর কাছে এখন বইছে ঝড়টা। কয়েক কিলোমিটার মাত্র দূরে। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে তিনি বললেন, আপনি একজন দক্ষ নাবিক, নৌকাটাও উন্নত মানের। আপনি সামলে নিতে পারবেন। ক্যাপ্টেন কারো ডোক গেলেন। আমি চেষ্টা করব। সিনর! স্ট্যানফোর্ড তার কেবিনে ফিরে এলেন। করসিকাতে রেনের সাথে দেখা করবেন। সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে হেলিকপ্টার ঠিক করা আছে। কামিনস্কি ব্যবস্থা করে রেখেছে, নেপলস যাবেন। সেখান থেকে ভাড়া করা বিমানে সোজা বস্টন। ফিৎজেরাল্ড তার জন্য অপেক্ষা করবে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, মিটে যাবে। তিনি মিটিয়ে নিতে পারবেন। আটচল্লিশটা ঘণ্টা শুধু তার দরকার। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা শুধু।
.
নৌকোর ওঠা নামায় তার ঘুমটা ভেঙে গেল। ঠিক রাত দুটোতে। কেবিনে বসেই বাইরের প্রবল ঝড়ের তাণ্ডব টের পাচ্ছিলেন তিনি। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে মোচার খোলার মত দুলছে তার বিশাল প্রমোদ তরণী। বাতাসের তীব্র হুঙ্কারে কানে তালা লেগে যায়। জীবনে অনেক ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কিন্তু এটা ভয়ঙ্করভাবে নিকৃষ্টতম সাংঘাতিক। গা গুলিয়ে বমি আসছিল তার। বিছানা থেকে উঠে দেওয়াল ধরে ধরে টলতে টলতে কোনরকমে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। শক্ত হাতে একটা ডেক স্ট্যান্ড আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলেন। প্রবল হাওয়ায় সেটা অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। ডেক ফঁকা। কেউ নেই। প্রবল ভাবে মারাত্মক ভঙ্গীতে দুলছে নৌকোটা। মনে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে যেন ঢেউয়ের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে। ঠিক এক সময়ে প্রবল বেগে শরীর কাঁপিয়ে বমি এলো তার। দুহাতে পেট চেপে ডেকের ওপর উপুড় হয়ে বসে বমির বেগ সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। আর ঠিক তখনি, প্রবলতর বাতাস আছড়ে পড়ল নৌকোটাকে পাক দিয়ে। ঢেউয়ের দুরন্ততায় নৌকোটা কাগজের নৌকোর মত দুলে টালমাটাল হয়ে ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে উঠল। সাথে সাথে আরো এক প্রচণ্ড বেগবান বাতাসের আছড়ে পড়া চাবুক। অবলম্বনহীন দুহাতা হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের শরীরটা বাতাসে ছিটকে উঠল। কয়েক মুহূর্ত হাওয়ায় ভেসে থেকে ছিটকে পড়ল। অশান্ত সমুদ্র নিমেষে গিলে নিল তাকে।
ক্যাপ্টেনের কেবিনের জানালা থেকে কামিনস্কির তীব্র আর্তচিৎকারটা ঝড়ো বাতাসের হিংস্র গর্জনের তলায় ডুবে গেল।
.
০৬.
ক্যাপ্টেন ফ্রাঙ্কোয়েস ডুরের, চিফ অফ দ্য পুলিশ দম ফেলবার অবস্থা নেই তার। বছরের এই সময়টা প্রতি বছরেই পর্যটকের ভীড়ে ঠাসা হয়ে ওঠে ছোট্ট দ্বীপটা এবং সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট পুলিশ দফতরটাও পর্যটকে ঠাসা হয়ে ওঠে। নানা ধরনের অভিযোগের স্রোতে পাগল হয়ে ওঠার অবস্থা হয়। একজন আমার ব্যাগ ছিনতাই করেছে। আমার জাহাজ আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে। অথচ আমার স্ত্রী জাহাজে রয়েছে। আমি একজন ফুটপাতের বিক্রেতার থেকে এই ঘড়িটা কিনেছিলাম। অথচ ঘড়িটায় কোন যন্ত্রপাতিই নেই। আমার প্রয়োজনীয় অত্যন্ত দরকারী ওষুধটা এখানকার কোন দোকানে নেই। সমস্যা, সমস্যা আর সমস্যা। অন্তহীন অভিযোগের স্রোত। এমন সময় পুলিশ দফতরে ঢুকল ওরা দুজন। ক্যাপ্টেন কারো এবং দিমিত্রি কামিনস্কি। ওদের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে ক্যাপ্টেন ডুরের গম্ভীর মুখ আরো ভার হলো। ওফ, তার কপালেই কি যত গন্ডগোল ঝুট ঝামেলাগুলো লেখা আছে। ঘটনার পুরো বিবরণ শুনে তিনি বললেন, তাহলে মৃতদেহ আপনারা জল থেকে তুলতে পেরেছেন? দিমিত্রি মাথা নাড়ে, হ্যাঁ স্যার। ক্যাপ্টেন কারো সাথে সাথে নৌকা বন্ধ করে দেন। তারই আপ্রাণ চেষ্টায় আমরা ওনাকে খুঁজে বের করে জল থেকে তুলতে পারি। যদিও তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। উনি মারা গিয়েছিলেন। তাহলে এখন আপনাদের সমস্যাটা কী? দিমিত্রি বিষণ্ণ গলায় বলে, কপাল জোরে ওনার মৃতদেহটা যখন উদ্ধার করতে পারা গেছে। আমরা তা দেশে নিয়ে যেতে চাই। এ ব্যাপারে দরকারী অনুমতির জন্যেই আপনার কাছে আসা। ডুরের মাথা নাড়লেন, তার কোন অসুবিধা হবে না।
একটা হলদে কাগজ টেনে নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন। মৃতের নাম? হ্যারী স্ট্যানফোর্ড। তিনি হঠাৎ ঝলসে ওঠা চোখ নিয়ে দুই আগন্তুকের দিকে তাকালেন। কী নাম বললেন? বিখ্যাত শিল্পপতি, কোটিপতি, মিঃ স্ট্যানফোর্ড? দিমিত্রি মাথা নাড়ে। ক্যাপ্টেন ডুরের বুকে যেন গুনগুন সুর ওঠে। ভগবান তাহলে নিমর্ম একপেশে নন? মানুষের ভালও করেন। ভগবান প্রেরিত সেই আগামী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবিটা ক্যাপ্টেন ডুবের যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। মিঃ স্ট্যানফোর্ড আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর খবর সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলবে, আর তার মধ্যমণি হবেন তিনি। পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব তার হাতে। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত হয়ে উঠতে চলেছেন তিনি। দিমিত্রি প্রশ্ন করে। মৃতদেহটাকে কত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারবেন আপনি? ক্যাপ্টেন ডুবের পূর্ণ দৃষ্টিতে ওদের দুজনের দিকে তাকালেন। পরিস্থিতিকে এখন নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। ম্যানিপুলেট ইট ফর ইওর ম্যাক্সিমাম বেনিফিট। ভাল প্রশ্ন, এটাই আমিও ভাবছি। সাংবাদিকেরা, টিভি চ্যানেলগুলোর ক্যামেরা এসে পৌঁছাতে কত সময় নেবে? কতক্ষণ লাগবে? সাক্ষাৎকার। ক্যাপ্টেন ডুবের কি সাক্ষাৎকারে ইয়টের অধ্যক্ষকেও ডেকে নেবেন? না, না, মুখের মত ভাবনা। যশের আলোয়, প্রচারের উজ্জ্বলতর গৌরবে ভাগীদার আনবেন কেন?
ওদের দিকে তাকিয়ে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কাগজপত্র তৈরি করতে হবে। কিছু বিধি, কর্তব্য পালন করতে হবে। দেখা যাক কতো তাড়াতাড়ি করতে পারি। এসব ক্ষেত্রে তো তাড়াহুড়ো করা যায় না। তার এখন সময় চাই। যতটা সময় পারা যায় নষ্ট করতে হবে।
.
০৭.
সাইমন ফিৎজেরাল্ড। বয়স ছিয়াত্তর। ফিৎজেরাল্ড ল-অ্যাটনীর একমাত্র কর্তা। যার অধীনে ষাটজন আইনজীবী কাজ করেন। ফিৎজেরান্ডের নোগা পাতলা চেহারা, ধবধবে চুল, তরে মানতেই হবে বয়স এখনো সেভাবে দাঁত বসাতে পারেনি তার চেহারায়। এই মুহূর্তে তার মন প্রবল চিন্তায় দোদুল্যমান। দ্বিধায় আচ্ছন্ন। ব্যক্তিগত সচিবের দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, মিঃ স্ট্যানফোর্ড যখন ফোন করেছিলেন; আমায় কেন তার দরকার কিছু উল্লেখ করেননি? না, স্যার, উনি শুধু সোমবার সকাল নটায় ওনার বাড়ীতে আপনাকে হাজির থাকতে বলেছিলেন! ঠিক আছে। মিঃ সোলানেকে একটু পাঠিয়ে দিন। স্টিভ সোলানে। এই সংস্থার সবচেয়ে উজ্জ্বল কর্মক্ষম, উদ্যমী, আইনবিদ কর্মী। মধ্য চল্লিশের স্টিভ সোলানে এই ফার্মের বিপদভঞ্জন। যে কোন পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হোক না কেন, সে ঠিকই বের হয়ে আসবে। সংস্থার পক্ষে সর্বাপেক্ষা লাভজনক সওদা করে। স্টিভ ঘরে ঢোকে। আপনার তো এখন নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে মাছ ধরার কথা। তাই নয় কি? ফিৎজেরাল্ড-এ মুহূর্তে ঠিক রসিকতার মেজাজে নেই। বসো স্টিভ। আমরা একটা গভীর সমস্যায় পড়েছি। স্টিভ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ আর নতুন কথা কী? এটা হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের বিষয়। স্টিভ নড়েচড়ে বসে। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড তাদের সবচেয়ে সম্মানজনক, দামী, গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট। কয়েক ডজন আরো আইন সংস্থা স্ট্যানফোর্ডের অন্য নানা কোম্পানীর আইনী পরামর্শের কাজ করে বটে। কিন্তু তারা ফিজেরান্ড ওর ব্যক্তিগত আইনী বিষয়ে পরামর্শ দেয়, কাজকর্ম করে, যেটা চরম গৌরবজনক। অন্যদের ঈর্ষার বিষয়।
–হুম, তা ব্যাপারটা কী? স্ট্যানফোর্ড মারা গেছেন। কি-ঈ-ই-ই। সোলানের গলা দিয়ে চেরা আওয়াজ ছিটকে আসে। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে সাইমন ফিৎজেরান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু আগে করসিকার পুলিশ দফতর থেকে একটা ফ্যাক্স এসেছে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ স্টিভের দিকে তাকিয়ে ফিৎজেরাল্ড বলেন, তিরিশ বছর ধরে মানুষটাকে আমি চিনি। তুমি তো কখনো ওকে দেখনি, বুঝবে না। দ্বৈত স্বভাবের কী নিপুণ মিশ্রণ। অমায়িক ভদ্র, শান্ত বিনয়ী মানুষটাই প্রয়োজনে হঠাৎ কেউটে সাপের মত হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড ছিল একই সাথে সাপুড়ে আবার বিষাক্ত সাপও। আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে স্মৃতিচারণে আবার ডুব দিলেন সাইমন ফিৎজেরাল্ড। ব্যবসায়ে ওর প্রতিদ্বন্দ্বীদের খতম করে দেওয়াটা ওঁর একটা বিষাক্ত নেশা ছিল। ওঁর উন্নতির পথে যারা কাটা ছিল ছলে-বলে কৌশলে তাদের ধ্বংস করতই। ওর এই খেলায় দেউলিয়া হতে বাধ্য হয়েছে, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে যে কতজন। আবার দেখো, ওই শয়তানী মনোবৃত্তির মানুষটাই অসংখ্য অনাথ আশ্রম চালাচ্ছে। এমন দ্বৈত অবস্থান একই মানুষের চরিত্রে আমি খুব কমই দেখেছি। স্টিভ সোলানে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। ফিজেরান্ড বললেন, তুমি গ্রীক পুরাণের অদিয়েপাস এর কাহিনী জানো তো? হ্যাঁ, মা-কে পাবার জন্য বাবাকে খুন করেছিল তো? ফিৎজেরাল্ড অদ্ভুত ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকালেন, হারী স্ট্যানফোর্ড তার বাবাকে খুন করেছিল মায়ের ভোট পাবার জন্য। ভাবতে পারো?
সোলানের মুখে কথা ফুটছিল না। কোনরকমে সে শুধু বলল, কি বলছেন আপনি? হ্যারীর বাবার ছিল মুদীর দোকান। বেশ বড় সড় ডিপার্টমেন্টাল দোকান বলা যায়। কলেজ ছাড়ার পরই হ্যারী কাজ নেয় সেই দোকানে। উদ্যমী উচ্চাকাঙ্খী হ্যারী ডিপার্টমেন্টাল মুদী দোকান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারল না। সে চাইল, দোকানে বিক্রি হওয়া মাংস অন্য কসাইখানা থেকে না কিনে নিজের দোকানেই নিজস্ব কসাইখানা বানাতে। ফল শাক সবজী চাষীদের থেকে না কিনে নিজে জমি কিনে চাষ করতে। ওর বাবার এসবে মত ছিল না। প্রায়ই বিষয়টা নিয়ে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত তর্ক হতো। এর পরই স্ট্যানফোর্ডের মাথায় এলো সবচেয়ে আলোড়ন তোলা বৈপ্লবিক এক পরিকল্পনা। নিজেদের দোকানকে অতি আধুনিকতম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একটা চেইন বানাবার কথা ভাবতে শুরু করে। একটা শৃঙ্খলে বাঁধা। ওদের কোম্পানির দোকানগুলো। যেসব দোকানে জীবন যাপনের জন্যে যাবতীয় যা কিছু প্রয়োজনীয় সবই পাওয়া যাবে। আলপিন থেকে গাড়ী। রুটি থেকে বৈদ্যুতিক উনুন। হ্যারীর বাবা শোনামাত্র প্রস্তাবটাকে খারিজ করে দিলেন। কিন্তু হারীর মধ্যে তখন থেকেই যা করতে চাইবে তা পেতে হবেই গোঁ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বাবার বাধা, তার উন্নতির পদে পদে বাধা হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে চতুর এক পরিকল্পনা করে সে। কৌশলে বাবাকে ভুলিয়ে দুরে পাঠিয়ে দেয়। ছুটি কাটাবার ছুতোয়। এবং বাবার অনুপস্থিতির সুযোগটায়, কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের হাত করে নিজের দিকে নিয়ে আসার কাজে লাগায়। ডিরেক্টরদের মধ্যে দুজন ছিল ওর কাকা ও কাকিমা। খুব সহজে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে আসে। ওকে কোম্পানির মালিকানা প্রদানের আইনী কাগজে সই করিয়ে নেয়। বাকি ডিরেক্টরদের ঘন ঘন দুপুরে খাবার খাওয়াতে নিয়ে যেতে থাকে। গলফ খেলার আমন্ত্রণ জানায়। শিকারে নিয়ে যায়–এবং, এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাদের মগজ ধোলাই করতে থাকে।
এমন কী, উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য, স্বামীর ওপর প্রভাব ও পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে এরকম এক ডিরেক্টরের স্ত্রীর সাথে বিছানায়ও যায় পর্যন্ত। সেই ভদ্রমহিলাকে দিয়ে স্বামীকে নিজের কাজ হাসিল করার মতলবে। ফিৎজেরাল্ড থামেন, দম নেন। সোলানে ঢোক গেলে, অবিশ্বাস্য। ফিৎজেরাল্ড আবার বলতে শুরু করেন–হ্যারীর বাবা যখন ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলেন তিনি দেখলেন, তারই বন্ধু-আত্মীয়রা সবাই তার ছেলের পেছনে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানির মালিকানা কর্তৃত্ব থেকে হটিয়ে দিয়েছে তাকে। এমন কী নিজের স্ত্রীও। হ্যারীর মায়ের হাতেই ছিল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শেয়ার। সুতরাং কোম্পানির মালিকানা বিষয়ে শেষ কথা বলবার ক্ষমতা, অধিকার শুধু তারই ছিল। হ্যারী তাকেও নিজের দলে টানতে পেরেছিল। নিজেরই স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করাতে রাজী করতে পেরেছিল। তবে এখানেই শেষ নয়। এসব দেখে চূড়ান্ত হতাশ হ্যারীর বাবা যখন নিজের অফিসে ঢুকতে গেলেন, অফিসের ছাদ থেকে ছুঁড়ে দেওয়া ফেলা হলো তাকে। মনে রেখো হারীর বয়স তখন তিরিশও ছোঁয়নি। বাবার মৃত্যুর পর পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে পেয়ে সেই ছোট্ট ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটাকে একলার চেষ্টায় দেশের সর্ববৃহৎ ডিপার্টমেন্টাল চেইন বানিয়ে তুলেছে। নিজের একার ক্ষমতায় স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজ দেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানিরগুলোর একটাকে গড়ে তুলেছে সে। কীসের ব্যবসা নেই ওর?
হ্যারী স্ট্যানফোর্ড কি বিবাহিত ছিলেন? স্টিভের প্রশ্নটায় সাইমন ফিজেরাল্ড আবার স্মৃতির গহনে ডুব দেন। হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের স্ত্রী এমিলি টেম্পল। সম্ভবত আমার দেখা সব চেয়ে সুন্দরী নারী। অসাধারণ রূপসী ছিলেন। ওদের তিন সন্তান হয়েছিল। বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য একজন সুন্দরী যুবতী গভর্নেস রাখা হয়েছিল, রোজমেরী নেলসন। হ্যারী তার আকর্ষণে জড়িয়ে পড়ল। অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। এবং তা আরো দুর্নিবার হয়ে, উঠল। কারণ রোজমেরী হ্যারীকে পাত্তাই দিত না। হ্যারীর সাথে বিছানায় যেতে কোন আকর্ষণ বোধ করেনি। হ্যারী না শুনতে অভ্যস্ত ছিল না, কেউ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা কল্পনাই করতে পারে না। যে কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রোজমেরীর প্রতি তার আকর্ষণ আরো একশ গুণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। যেভাবেই হোক তাকে পাবার জন্যে মরীয়া হয়ে উঠল। নারী-মন জয়ে পটু প্লেবয় স্ট্যানফোর্ড এক সময় সত্যিই রোজমেরীর মন জিতে নিল। ওকে শয্যা সঙ্গিনীও বানালো। যার ফল হিসেবে গর্ভবতী হয়ে পড়ল সে। ওরা যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, দুর্ভাগ্য ক্রমে তার নাতি ছিল এক সাংবাদিক। পুরো ঘটনাটাকে যথেষ্ট কেচ্ছাসহ তার কাগজে ফাঁস করে দিল সে। সারা শহর, বলা ভাল গোটা দেশ জুড়ে প্রবল আলোড়ন উঠল। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড শিল্পপতি, কোটিপতি ধনী হিসেবে তখনই সারা দেশে যথেষ্ট বিখ্যাত ছিল। তার চারিত্রিক অধঃপতনের কেচ্ছা জেনে সারা দেশের মানুষ আলোকিত হয়ে উঠল। সে এক বিশী স্ক্যান্ডাল।
স্টিভ দম বন্ধ করে শুনছিল। যেন কোন আধুনিক রূপকথা। ফিৎজেরাল্ড থামতেই সে প্রশ্ন করে, তারপর? তারপর কী ঘটল? সাইমন একটা গভীর শ্বাস ফেলেন। এমিলিও জানতে পারে সব কিছুই। এদিকে, রোজমেরী কিছুতেই গর্ভপাতে রাজী হয় না। স্ট্যানফোর্ড বারবার বোঝনোর চেষ্টা করে ওকে। ওকেই সে ভালবেসে বিয়েও করবে কিন্তু তার আগে গর্ভপাত করিয়ে নিতে হবে। বলাই বাহুল্য এ ধরনের কথা বহু মেয়েকে বহুবার বলেছে সে। এতে কোন সত্যি ছিল না। রোজমেরীকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই তার ছিল না। শুধুই অবাঞ্চিত গর্ভ এবং পিতৃত্বের দায় থেকে মুক্ত হবার জন্যই রোজমেরীকে ওসব কথা বলে চলেছিল দিনের পর দিন ধরে। সম্ভবত রোজমেরীও আঁচ করতে পেরেছিল তার প্রেমিকের মন, স্বভাব চরিত্র। তাই নিজের গোঁ থেকে নড়ল না। এদিকে একদিন স্ট্যানফোর্ড যখন রোজমেরীকে বোঝাচ্ছে, ভালবাসা প্রেমের আশ্বাস দিচ্ছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিজ্ঞা করছে, হঠাৎ করেই আড়াল থেকে তা শুনতে পেয়ে যায় এমিলি টেম্পল। সে রাতেই সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার পরই ঐ বাড়ী ছেড়ে চলে যায় রোজমেরীও। পরে জানা গিয়েছিল, ত্যরীকে সে এক চিঠি পাঠিয়েছিল–মিলউকীর সেন্ট জোসেফ হাসপাতালে সোফিয়া নামের একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিল রোজমেরী।
অবশ্য তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না স্ট্যানফোর্ডের। রোজমেরীর মোহ কেটে ততদিনে অন্য নারীতে জড়িয়েছে সে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ঘটল এরপর। স্ট্যানফোর্ডের তিন সন্তানই তাদের মায়ের অকাল মৃত্যুর জন্য তাদের বাবাকে দায়ী করল। তাদের বয়স তখন দশ, বারো, চোদ্দো। বাবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই বা প্রতিবাদ করার পক্ষে বড়ই কম বয়স। কিন্তু অন্যায়টাকে ঠিকই চিহ্নিত করতে পেরেছিল তারা। বাবাকে তারা মনে প্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করে। এই সময় থেকেই সন্তানদের আচরণ দেখে হ্যারীর মনে একটা চরম আতঙ্ক তৈরি হয়। তার সন্তানেরাও তার সাথে ঠিক তাই করবে। যা হ্যারী করেছিল নিজের বাবার সাথে। সুতরাং তারপর থেকেই তার একমাত্র চেষ্টা ছিল সেই ঘটনাকে আটকানো তা যাতে না ঘটে তার জন্য। যত কিছু করা সম্ভব সবই করেছিল। সে। ছেলেদের এবং মেয়েকেও আলাদা আলাদা বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। তারা যেন কখনো এক সাথে একজোট না হতে পারে। সেই ব্যবস্থা করা ছিল পাকাভাবে। ওর কোন টাকা পয়সাও ওরা পেত না। এমিলির সঞ্চিত অর্থের ভাগ থেকেই প্রতিপালিত হয়েছে। ওরা তিন ভাই। সামান্য সেই অর্থে অত্যন্ত দীনভাবে বড় হওয়া তিন ভাইবোনের জন্য তাদের বিখ্যাত কোটিপতি বাবা ঐ টুকুন বরাদ্দ করেছিল। স্টিভ সোলানে প্রশ্ন করে, ত্যারী স্ট্যানফোর্ডের ছেলে-মেয়েরা এখন কে কী করেন? সাইমন পড়ে থাকা ঝরা পাতা স্মৃতি যেন হাতে তুলে নেন। ভঙ্গীতে এতটাই সূক্ষ্মতর প্রবণতা। একটু কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বলেন, টাইলার স্ট্যানফোর্ড একজন বিচারপতি। যতদূর শুনেছি, জানি, উডরাও কিছুই করে না। প্লেবয় গোছের। এক সস্তা রেস্তোরাঁয় মহিলা পরিচারিকার সাথে প্রেম করতে গিয়ে তাকে গর্ভবতী করে বসে। বছর কয়েক আগের ঘটনা এটা। এবং সবাইকে অবাক করে ঐ মহিলাকে বিয়ে করে। বেনডাল নামী ফ্যাশান ডিজাইনার। নিউইয়র্কে থাকে। এক ফরাসী পুরুষকে বিয়ে করেছে। স্টিভ মাথা নাড়ে, সব তো বুঝলাম। এবার আমায় কী করতে হবে। ফিৎজেরাল্ড মাথা নাড়েন, হ্যাঁ এবার সেই কথা। তুমি আজই করসিকা চলে যাও। স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহ এখন ওখানকার পুলিশের কজায়। গোটা ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল তুমি যাচাই করে দেখো। কোন ফাউল গেম আছে নাকি খতিয়ে দেখার দায়িত্বটাই তোমায় দিয়ে পাঠাচ্ছি।
.
স্টিভ সোলানে বিমানের জানালা থেকে দ্বীপ শহরটাকে দেখছিল। ছবির মত। ছবির থেকেও অনেক বেশি সুন্দর শহরটা। বিমান বন্দর থেকেই ট্যাক্সী ধরে সে পুলিশ সদর দফতরে হাজির হলো।বোনজুর রিসেপশন কর্মীটি তাকে স্বাগত জানালো। এখানে ইনচার্জ কে? ক্যাপ্টেন ডুবের। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। সার্জেন্টটি ক্রু কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গী করে, কী ব্যাপারে দেখা করতে চান? স্টিভ তার কার্ড বের করে সার্জেন্টের হাতে দেয়। আমি হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের উকিল। তার মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি আমি। সার্জেন্টটি ওকে বসতে বলে পিছনের একটি ঘরে অদৃশ্য হয়ে যায়। স্টিভ চারপাশে তাকায়। অফিস ঘরটা ভীড়াক্রান্ত। হ্যারীর মৃত্যুর খবর ইতিমধ্যে যে বেশ চাউর হয়ে গেছে তার প্রমাণ হিসেবে ঘর জুড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের খবরের কাগজ, বেতার, টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের ভীড়।
ক্যাপ্টেন ডুবের-এর বহুদিনের সযত্নে লালিত স্বপ্ন এবার সত্যি সফল হতে চলেছে। পৃথিবীর এক কোণে, এক প্রান্তের, বিন্দুসম ছোট্ট পুলিশ থানার বড় কর্তা। এখন আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত হবার মুখে। সার্জেন্ট তার সুখ স্বপ্নে বিঘ্ন ঘটাল। স্টিভ সোলানের কার্ড হাতে নিয়ে এবং তার আসবার কারণ জেনে ক্যাপ্টেনের কপালে বিরক্তির খাঁজ জমল। বলে দাও, আমি এখন ব্যস্ত আছি, দেখা করতে পারব না। কাল সকাল দশটার সময় আসতে বলল। ঠিক আছে স্যার। সার্জেন্ট ফিরে যায়। সার্জেন্টের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন ডুবেরের চিন্তিত কপালের ভাজ আরো গম্ভীর হয়, না, তার খ্যাতির মুহূর্ত কেড়ে নেবার সুযোগ তিনি কাউকেই দেবেন না। এই লোকটাকে আটকাতে হবে। হারী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহটিই হচ্ছে আপাতত তার একমাত্র অদ্বিতীয়ম মূল্যধন। এটাকে সহজে হাতছাড়া করা যাবে না। যতক্ষণ ঐ মৃতদেহ, বরফে জড়ানো কাঠ হয়ে যাওয়া জড় পদার্থটা তার কবজায় আছে, ততক্ষণ পর্যন্তই মধু লোভী মৌমাছির মত ঐসব সাংবাদিকগুলো তার চারপাশে ভন ভন করবে। তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি যশের স্থায়িত্বও, ততক্ষণ, যতক্ষণ মৃত স্ট্যানফোর্ড তার সাথে আছেন।
এদিকে বাইরের অফিসে স্টিভ সোলানে বিস্ময় বিমূঢ় অবিশ্বাসের বিস্ফারিত চোখে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাল সকালে? আমি অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না। বিকেলের উড়ানেই ফিরে যাবার কথা। সার্জেন্টটি শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। স্টো আপনার সমস্যা। সোলানে কাঁধ ঝাঁকায়। ভবী ভুলবার নয়। তবু একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে সার্জেন্টটির দিকে ঝুঁকে পড়ে। কোন উপায়ই কি নেই? কোন ভাবেই কি…। একই রকম হিমশীতল চোখে ফিরে তাকায় পুলিশটি। এবার তার চোখে বিরক্তিও। বললাম তো, কাল সকাল দশটা। সোলানে রাস্তায় বের হয়ে আসে। এখানে থাকার পরিকল্পনা করে সে আসেনি। সুতরাং এখন প্রথমেই তাকে একটা ভাল হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। বেশি খুঁজতে বাছতে হলো না। ৪, এভিনিউ ডি প্যারিস ঠিকানায়, রাস্তার ওপর, ছিমছাম, কোলামবা হোটেলটা তার পছন্দ হলো। হোটেলের ঘর থেকেই সোলানে অফিসে ফোন করল। সাইমন ফিজেরাল্ড উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় ছিল। তাকে বিস্তারিত জানালো পরিস্থিতি। আজকের রাতটা যে তাকে এখানেই কাটাতে হবে তাও জানিয়ে দিল। হোটেলের ঘরে নির্জন অবসরে এরপর হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সোলানে ভাবছিল। সাইমন ফিৎজেরাল্ড তাকে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড সম্পর্কে যে সব কথা বলেছিল, তথ্য দিয়েছিল, সেগুলোকে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল। রোজমেরী নেলসন নামের সেই মেয়েটা। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে ঠিক দশটায়, পুলিশ দফতরে হাজির হলো স্টিভ সোলানে। আজও সেই একই মুখ, সার্জেন্টটি স্টিভের সুপ্রভাত সম্ভাষণে মাথা ঝাঁকালে প্রত্যাভিবাদনে। ক্যাপ্টেন ডুবের-এর সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি। স্টিভ মনে করিয়ে দেয়। সার্জেন্ট মাথা নাড়ে। একটু বসুন। কালকের মতই পেছনের একটা ঘরে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। পেছনের ঘরে ক্যাপ্টেন তখন একটি বিদেশী টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে ব্যস্ত। শটের ফাঁকে তার হাতে স্টিভের কার্ডটা গুঁজে দিতে সক্ষম হয় সার্জেন্ট। ক্যাপ্টেন বিরক্ত চোখে তার এই বোকা অধস্তনের দিকে তাকালেন। খেঁকিয়ে ওঠেন, তুমি কী হে? দেখছ না আমি কি রকম ব্যস্ত? যাও ওকে কালকে আসতে বলল গিয়ে। সার্জেন্ট মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যায়। ক্যাপ্টেন আবার সাময়িক বন্ধ ক্যামেরার দিকে ফিরে তাকান। তিনি জানতে পেরেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আরো কয়েক ডজন খবরের কাগজ এবং টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকেরা আসছে তার কাছে। এমন কি সুদুর নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও। এই সময়ে হত্যারী স্ট্যানফোর্ডের উকিলের সঙ্গে কথা বলা বা সময় দেবার অর্থই তার মূলধন অর্থাৎ স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহটি হাত ছাড়া করার ঝুঁকি নেওয়া। যার কোন ইচ্ছেই তার নেই।
বাইরের অফিস ঘর। এখন উনি দেখা করতে পারবেন না? প্রায় স্বগতোক্তির মত শোনায় সোলানের গলা। রোজই তো ক্যাপ্টেনকে নানা রকম দায়িত্ব সামলাতে হয়। ব্যস্ততা চরম ওনার। তাহলে কখন দেখা হবে? আমার মনে হয় কাল দুপুরের আগে উনি সময় দিতে পারবেন না। কাল দুপু-র? সোলানের সামনে ক্যাপ্টেনের চরম ব্যস্ততার কারণ এবং ছবিটা তখন স্পষ্ট এবং পরিষ্কার হচ্ছে। সে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি শুনেছি, স্ট্যানফোর্ডের মৃত্যুর ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আছে। হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী কামিনস্কি। সে এখন কোথায়? অস্ট্রেলিয়ায়। এই হোটেলটা কোথায়? দুঃখিত স্যার। ওটা হোটেল নয়, এটা দেশ। সোলানে বিমূঢ় হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ওর মুখে কথা ফোটে না, তার…মা…মানে আপনি বলতে চান ঘটনাটির একমাত্র সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শীকে আপনারা ছেড়ে দিয়েছেন? চলে যেতে দিয়েছেন? কেউ তার সঙ্গে কথা বলা বা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন? তার মনে হয়েছে ঘটনাটার সঙ্গে লোকটির কোন সংস্রব বা যোগাযোগ নেই।
হোটেলে ফেরার পথে রাস্তার পাশে খবরের কাগজের স্টলে তার চোখ পড়ল ইন্টার ন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনের প্রথম পাতাতেই চার কলম জুড়ে শিরোনাম–স্ট্যানফোর্ড ব্যবসা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত কী এরপর? সঙ্গে বিস্তারিত খবর। সোলানে এগিয়ে গেল। কাগজটা তুলে নিয়ে দাম মেটাবার সময়েই তার নজর পড়ল, স্টলে ঝুলন্ত দেশী বিদেশী সব রকম সংবাদ পত্রের প্রথম পাতাতেই হারী স্ট্যানফোর্ডের খবরের জোরালো তীব্রতর উপস্থিতি। এবং প্রতিটি খবরের রিপোর্টের সঙ্গেই ক্যাপ্টেন ডুবের-এর এক ঝকঝকে উজ্জ্বল ছবিসহ সাক্ষাৎকার। সোলানে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ল। এটাই তাহলে ক্যাপ্টেনের–ব্যস্ততার কারণ? সোলানের দুচোখ জ্বলে ওঠে। ঠিক আছে…সেও দেখে নেবে। কাটা দিয়েই তাহলে কাটা তুলবে। হোটেলে ফিরেই ফিৎজেরাল্ডকে ফোন করল সে। এখানকার পরিস্থিতি বিস্তারিত ভাবে জানালো। নিজের পরবর্তী পরিকল্পনার কথাও সে জানালো।
পরের দিন সকাল পৌনে দশটা। পুলিশ দফতরে পৌঁছেই সোলানে দেখতে পেল যে, রিসেপশন ডেস্কে সার্জেন্টটি তার জায়গায় নেই। এরকম আচমকা পাওয়া একটা সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করল না। ক্যাপ্টেনের অফিসের অর্থাৎ পেছনের ঘরের খোলা দরজা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ফাঁকা অফিস ঘরে ক্যাপ্টেন তখন একা। ক্যাপ্টেন সম্ভ্রম চোখে তাকালেন। আমি আসছি দি নিউইয়র্ক টাইমস কাগজ থেকে–সোলানে বলে। নিমেষে ডুবেরের মুখচোখ উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে,–ওহ আসুন, আসুন। ভদ্রমহোদয়ের নামটা জানতে পারি কি? ডুবেরের গলায় বিনয় মেশা অ্যাপায়নের সুর। সোলানে নির্বিকার মুখে বেবাক মিথ্যে বলে, জোনস। জোহান জোনস। মহোদয় কী নিতে পছন্দ করবেন? কফি? নাকি কনিয়াক বলব? সোলানে হাত নাড়ে, কিছু না। কিছু না, আমি কয়েকটা অতি দরকারী গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে এসেছি আপনার কাছে। ডুবের মাথা দোলাল, জানি, নিশচয়ই মশিয়ে স্ট্যানফোর্ডের ব্যাপারে। সত্যি আমাদের এই ছোট্ট দ্বীপে এরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল, ভাবা যায় না। হাতে সময় খুবই কম। সোলানে সরাসরি দরকারী কথায়, তার প্রয়োজনীয় বিষয়ে ঢুকে পড়ে। মৃতদেহটি কবে আপনারা ছাড়বেন। ক্যাপ্টেন একটা গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। আপাতত বেশ কিছুদিনের মধ্যে সেটা সম্ভব । হবে না। বহু নিয়ম কানুন বহু কাগজ পত্র…সহজে সব হয় কী? বহু সময়ের ব্যাপার। বহুদিন লাগবে। যতদিন না সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ক্ষিধে পুরোপুরি মিটছে। আমার ছবি সাক্ষাৎকারের পুরো প্রয়োজন মিটছে। ততদিন… ক্যাপ্টেন ডুবের শেষ হয়ে যাওয়া কথার খেই ধরেই আবার প্রায় স্বগতোক্তির মত বলেন–হয়তো দশদিন। কিম্বা পনেরো দিনও হতে পারে।
সোলানে এবার পকেট থেকে নিজের কার্ডটা বের করে এগিয়ে দেয়। এই যে আমার কার্ড এটা, আসল কার্ড। সেটার দিকে তাকিয়েই ক্যাপ্টেন নড়ে চড়ে ওঠেন। প্রায় তড়িতা হতের মতই ছিটকে ওঠেন–আপনি রিপোর্টার নন? উকিল? হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের অ্যাটর্নী আমি। তার মৃতদেহ নিয়ে যেতে এসেছি। কাল সেটা আমি নিয়ে যাব। ক্যাপ্টেন সহানুভূতির ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বলেন, সত্যি যদি তা আমি পারতাম। কিন্তু আমার দুহাত বাধা। দুভার্গ্যজনক ভাবে আমি কোন উপায়ই দেখতে পারছি না। কাল, কালই নাহ, অসম্ভব। সোলানে সোজা চোখে তাকায়। ক্যাপ্টেনের চোখে চোখ রেখে কর্তৃত্বের গলায় বলে, আমার মনে হয়, আপনার এক্ষুনি প্যারিসে আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা ব্যবস্থা করা উচিত। এদেশে আমাদের সংস্থার বেশ কয়েকটি দফতর, কারখানা রয়েছে। এরকম একটা বিষয়ে যদি আমরা ক্ষোভের বশে সেসব কলকারখানা, দফতরগুলো বন্ধ করে দিই–এ দেশের সরকারের পক্ষে সেটা চরম লাভজনক ব্যাপার হবে কী? ক্যাপ্টেন অসহায় ভঙ্গী ফোঁটাবার চেষ্টা করেন, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমার নেই। সোলানে উঠে দাঁড়ায়, ঠিক আছে। আমি তাহলে সেটাই আমার মালিককে জানাচ্ছি। এবং আমার সংস্থা মারফৎ আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং এদেশের সরকার জানতে পারবে যে আপনার গাফিলতি, কর্তব্য অবহেলার কারণেই স্ট্যানফোর্ড সংস্থা এদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। নিতে বাধ্য হয়েছে এবং তাতে দেশের কোটি কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে…।
সোলানে দরজার দিকে এগোতে থাকে। মিশিয়ে দাঁড়ান। হয়তো কয়েকদিন সময়… ক্যাপ্টেনের গলায় বিপন্নতা। কাল, আমি দেখতে চাই কাল সকালে শ্রী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহকে খালাস করে দেওয়া হয়েছে। দরজা দিয়ে বের হয়ে যায় সে, ক্যাপ্টেন ডুবের এর অসহায়তা মাখা বিপন্ন মুখের দিকে দৃকপাত না করেই।
পরের দিন বিকেলে স্টিভ সোলানে স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের নিজস্ব বিমানে হারী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহ বহন করে নিয়ে এসে লোগন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামল। বস্টনের আকাশে তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ঘন সন্ধ্যা।
.
০৮.
জজ টাইলার স্ট্যানফোর্ড। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে তার সারা শরীরে এক ঘন কাপুনি জাগল। ডবলিউ বি বি এম চ্যানেলে নিউজ বুলেটিনে দেখাচ্ছিল, ছবি…শব্দ…কথা…শ্রী স্ট্যানফোর্ডের নীল আকাশ ইয়টটি করসিকান দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রে এক বিধ্বংসী ঝড়ের মুখোমুখি হয়। দুভার্গ্যজনক ঘটনাটির সাক্ষী ছিলেন শ্রী স্ট্যানফোর্ডের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দিমিত্রি কামিনস্কি। তার চোখের সামনেই…।
পর্দায় দ্রুত নড়ছে চড়ছে, সরে যাচ্ছে প্রতিচ্ছবি, এসে পড়ছে নতুন প্রতিচ্ছবি। চলমান দ্রুত পরিবর্তনশীল সেই ছবির দিকে তাকিয়ে শুন্য প্রায় বোধহীন মগজে বসে থাকতে থাকতে জজ টাইলারের মস্তিস্কে ফিরে আসছিল স্মৃতি, সার সার স্মৃতি।
একটা ভরাট গলার চড়া চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেল। গভীর রাত, চোদ্দ বছর বয়স তখন তার। রাগী চড়া গলার স্বরটাকে কয়েক মিনিট ধরে শুনল সে। তারপর প্রায় নিঃশব্দে গুঁড়ি মেরে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। সিঁড়ির চাতালে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেলো, বাইরের ঘরে সিঁড়ির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে বাবা আর মা ঝগড়া করছে। তর্ক-বিতর্ক করছে। মা উন্মত্তের মত চিৎকার করছে। বাবা এলোপাথাড়ি চড় মারছে মায়ের মুখে গালে।
টেলিভিশনের ছবিতে, হ্যারী স্ট্যানফোর্ড, হোয়াইট হাউসকে পশ্চাৎপট হিসেবে রেখে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ-এর সঙ্গে করমর্দন করছেন। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড ছিলেন প্রেসিডেন্টের আর্থিক পরামর্শদাতাদের বিশেষ দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তার পরামর্শকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট…। ।
ওরা বাড়ির বাগানের চত্বরে ফুটবল খেলছিল। ছোট ভাই উডির মারা বলটা বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল। টাইলার বলটা আনতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। একতলায় বাবার পড়ার কাজকর্মের ঘরের জানালার ঠিক নিচে বলটা পড়েছিল। বলটা যখন সে কুড়িয়ে নিচ্ছে, খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসা বাবার গলার স্বর শুনতে পেল–আমি তোমায় ভালবাসি। তুমি জানো না আমি তোমায় কতটা ভালবাসি। টাইলার রোমাঞ্চিত হয়েছিল। বাবা-মায়ের ভাব হয়ে গেছে জেনে খুশি হয়েছিল। ঠিক তখনি তার কানে আসে, তুমি ভাল। এসব কিছুতেই সম্ভব নয়। তুমি বিবাহিত। সন্তানের বাবা। রোজমেরী, তাদের গভর্নের্সের গলা। আচমকাই তার সারা শরীর গুলিয়ে তীব্র বমিভাব জাগল। মাকে সে ভালবাসত। হ্যাঁ, ভালবাসে রোজমেরীকেও। বাবা অনেক দূরের মানুষ ছিল। এ মুহূর্তে তাকে আরোও আতঙ্কজনক অচেনা ঠেকেছিল।
টেলিভিশনের ছবিতে এখন ফাইল সট। বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে, নানা সময়ে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের নানা প্রতিক্রিয়া নানা অভিব্যক্তি নানা সময় নানা জায়গার ছবি। কে নেই সেই লম্বা তালিকায়? মিতের..গরবাচভ…থ্যাচার…প্রবাদ প্রতিম বাণিজ্য সম্রাট বিভিন্ন সময়ে নানা বিশ্বনেতার অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। ঘোষকের বিষাদ কণ্ঠ শোনা গেল।
এক মাঝরাতে তীব্র ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলেই মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা বাবার মুখ দেখতে পেলো। টাইলার ওঠো তাড়াতাড়ি। একটা খারাপ খবর আছে। তোমার মা মারা গেছেন। চোদ্দ বছরের বালকের শরীরটা প্রচণ্ড আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠেছিল। বাবা বলেছিল এটা দুর্ঘটনা। কিন্তু ও জানত তা মিথ্যে। বাবা খুন করেছিল মাকে। বাবাই দায়ী ছিল। বাবা আর রোজমেরীর সম্পর্কের জন্যেই মাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। সে এক চরম কেচ্ছা। সারা বস্টনে ছড়িয়ে পড়েছিল, সবাই জেনে গিয়েছিল ঘটনা। বেশ কয়েকদিন ধরে খবরের কাগজের পাতায় পাতায় শিরোনাম ছিল ঘটনাটা। এর ওপর ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো সত্যি মিথ্যের চাটনি বানিয়ে মুখরোচক রসালো কুৎসা কেলেঙ্কারী-কেচ্ছাময় করে ছাপছিল ব্যাপারটাকে। গর্ভবতী রক্ষিতা ছেলেমেয়ের গভর্নের্স, কোটিপতি শিল্পপতি স্ত্রীর আত্মহত্যা। স্কুলের বন্ধুরা এসব নিয়ে টিটকিরি ঠাট্টা, অসহ্য হয়ে উঠেছিল জীবন। মায়ের মৃত্যুর পরই রোজমেরীও বাড়ী ছেড়ে চলে গেল। একুশ ঘণ্টার মধ্যে দুই কিশোর এবং বালিকাটি হারালো তাদের ভালবাসার দু-দুজন প্রিয়তমাকে। বাবার জন্যই দুজনকেই হারাতে হলো।
আমি বাবাকে ঘেন্না করি। চাপা গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলল বেনডাল, আমিও, উডরোও বলে। সায় দেয় টাইলার, আমিও। বাস্তবিকই ওদের তিন জনের মধ্যে সেই বয়স থেকে অথবা সত্যি বললে তার বহু আগে থেকেই বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ প্রোথিত হয়েছিল। শিকড় ছড়িয়েছিল মনের গহনে। ওরা পালিয়ে যাবে বাড়ী থেকে ঠিক করে। কিন্তু তার পরই ওদের মনে হয়েছিল, কোথায় যাবে পালিয়ে, শেষ পর্যন্ত ওরা ঠিক করে বিদ্রোহ করবে। প্রতিবাদ করবে। একদিন খাবার টেবিলে সবচেয়ে ছোট বেনডাল, যার তখনো বুদ্ধি পরিণত হয়নি, বলে ফেলে, আমাদের তোমাকে ভালে লাগে না। আমরা অন্য বাবা চাই। হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের আঙুলে হাত কাটা ছুরি থেমে গিয়েছিল। শীতল চোখে তিন কিশোর বালিকা ছেলেমেয়ের মুখের দিকে পর্যায় ক্রমে কয়েকবার চোখ রাখলেন। তারপর কাটাকাটা বরফ ঠান্ডা গলায় বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। আমি ব্যবস্থা করছি সেরকম কিছুর। সম্ভবত সন্তানদের মনের তীব্র বিদ্বেষের আঁচ তিনিও অনুমান করতে পেরেছিলেন। এর তিন সপ্তাহ পরেই ওদের তিনজনকে আলাদা আলাদা তিনটি বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দিন-মাস-বছর কেটে যেতে লাগল, বাচ্চারা তাদের বাবার দেখা খুব কমই পেতো, খবরের কাগজে পত্র-পত্রিকায় ওরা বাবার সম্পর্কে পড়ত। টেলিভিশনে তাকে দেখত। তাদের কৈশোর পিতৃসঙ্গহীন, নির্বাসিত ছিল।
টাইলার সম্মোহিতের মত দেখছিল। টেলিভিশনের পর্দায় এখন স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজ এর ব্যবসা-সাম্রাজ্যের নানা জায়গীরের ছবি। কারখানা অফিস, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের ব্যবসা সাম্রাজ্যের মনতাজ। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড নিজেকে প্রবাদপ্রতিম বানিয়ে তোলার পথে যা যা, যেসব কিছুকে সৃষ্টি করেছিলেন, টাইলার মুগ্ধ বিস্ময়ে শিহরিত দৃষ্টিতে দেখছিল। ওয়াল স্ট্রীটের বিশেষজ্ঞদের মনে এখন বড় প্রশ্ন কৌতূহল হয়ে দেখা দিয়েছে। এর পর কী? পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা সংস্থার ভাগ্য এবার কোন পথে এগোবে? যখন, প্রতিষ্ঠাতা চলে গেছেন? হ্যারী স্ট্যানফোর্ড যদিও তিন সন্তান রেখে গেছেন। কিন্তু এখনো জানা যায়নি স্ট্যানফোর্ড যে হাজার কোটি ডলারের সম্পত্তি রেখে গেছেন তার উত্তরাধিকারী কে হবে? কে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পাবে স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের? ঐ তুমুল সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে কার জন্যে?
তার বয়স তখন ছয় বছর। বালকোচিত কৌতূহল উৎসাহেই সারাটা বাড়ি ঘুর ঘুর করে বেড়াত। একমাত্র বাবার কাজের ঘরটাতে ঢোকার অধিকার বাবা ছাড়া আর কারো ছিল না। বালক টাইলার দেখত, কালো ধূসর বাদামী নানারঙের কোট পরা সুসজ্জিত নানা ধরনের মানুষেরা আসত। ঐ ঘরে ঢুকতো, বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলত, কাজ সারতো, তার পর চলে যেত। যেহেতু ঐ ঘরে ঢোকার অধিকার ছিল না সে কারণেই ঘরটা তার মনে অপ্রতিরোধ্য এক আকর্ষণ তৈরি করেছিল। মাঝে মাঝে ভোলা দরজা দিয়ে বাবার চেয়ারটা নজরে পড়ত। ছড়ানো টেবিলটার পেছনে বিশাল চামড়া মোড়া চেয়ারটা, যা তাকে দুর্নিবার আকর্ষণে চুম্বকটান মারত। একদিন আমি বাবার মত গণমান্য মানুষ হয়ে উঠব। একদিন ঐ চেয়ার আমার হবে। আমি বসব ঐ চেয়ারে। শিশুমনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। একদিন বাবা বাড়ী ছিল না। দরজাটা খোলা পেয়ে সে ঘরটায় ঢুকে পড়ে। পুরোপুরিই অফিস ঘর একটা, প্রথামাফিক। পুরো ঘরটা ঘুরে দেখার পর একসময় বাবার চেয়ারটায় উঠে বসে। আহ, আমিও এখন একজন গুরুত্বপূর্ণ, গণ্যমান্য মানুষ। এক উজ্জ্বল গর্বে ফুলে ওঠে তার বুক। টেবিলের দেরাজগুলো টেনেটেনে খুলে দেখতে থাকে। শুধু মাত্র কাগজপত্রে সব দেরাজ তাকগুলো ভরা। কি হচ্ছেটা কি? এখানে তুমি কি করছ? টাইলার চমকে ফিরে তাকায়। ঘরের দরজায় বাবা দাঁড়িয়ে। কে তোমাকে বলেছে তুমি ঐ চেয়ারটায় বসতে পারো? বাবার মুখ রাগে টকটকে রক্তবর্ণ। টাইলার কথা খুঁজে পায় না। কাঁপতে থাকে।–আ…আমি… এমনি বসেছিলাম…কেমন লাগে… বাবা রাগে কাঁপতে কাঁপতে ওকে হিড়হিড় করে টেনে নামায় চেয়ারটা থেকে। তুমি, তোমরা কোনদিন জানতে পারবে ঐ চেয়ারে বসতে কেমন লাগে। বুঝেছ? এখন দূর হয়ে যাও। আর এ ঘর থেকে দূরে দূরে থেকো। না হলে…।
কান্নায় ভেঙে পড়ে টাইলার মায়ের কোলে গিয়ে আছড়ে পড়ে। মা ওকে সান্ত্বনা দেন। কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতে উঠতে টাইলার বলে, আমি কিছু করিনি, শুধু চেয়ারটাতে বসেছিলাম। মা বলেন, আসলে ওটা ওঁর চেয়ার, ওঁর একার, কেউ ওটায় বসুক, সেটা উনি সহ্য করতে পারেন না। তবুটাইলারের কান্না থামছিল না। তখন মা ওকে আরো কাছে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, টাইলার তোমার বাবা যখন আমায় বিয়ে করেন, তখন তিনি আমায় বলেছিলেন আমায় তার কোম্পানির অংশীদার করে নিতে চান। তিনি আমাকে একটি শেয়ার দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা রসিকতার মতই। সেই শেয়ারটি তোমায় দিয়ে দেব আমি। তাহলে তুমিও কোম্পানীর একজন হতে পারবে, কি খুশি তো? এবং, সত্যি তার নিজের শেয়ারটি ওকে দিয়ে দিয়েছিলেন। স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের অজস্র শেয়ারের একটির গর্বিত মালিক হয়ে উঠেছিল সে। পরে ব্যাপারটা জানতে পেরে বাবা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তুমি কী ভাবো? ঐ একটা শেয়ার নিয়ে কী করবে? কোম্পানি টেক ওভার?
স্মৃতি থেকে আবার বাস্তবে ফিরে আসে টাইলার। কী জানি এক স্বস্তিবোধ পরিপূর্ণতা ওকে এ মুহূর্তে তৃপ্ত করে। ঐতিহ্যগত ভাবে পুত্র সফল হয় বাবাকে খুশি করার, গর্বিত করার জন্যে। টাইলার প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে সফল বানিয়ে তুলেছে। তার নিজের বাবাকে ধ্বংস করার জন্য। শিশু বয়স থেকে তার মনে স্থায়ী হয়ে গেড়ে বসেছে এক তীব্রতর কল্পনা। তার মাকে খুনের অভিযোগে বাবার মৃত্যুদণ্ড জারী করবে সে। তারই আপোষহীন কলম। প্রতিশোধকাম জর্জর শব্দমালায় সে লিখবে বাবার, তারই জনকের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা–আমি আসামীকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিচ্ছি। আহ গোপন স্বপ্নটা প্রায় বাস্তব সত্যি হয়ে উঠেছিল।
মিলিটারি স্কুলের কঠোর শৃঙ্খলা নিয়মের বাধন, অসহ্যকর হয়ে উঠেছিল। চোদ্দ বছরের জীবনে সে কখনো নিয়ম বাধা শৃঙ্খলা পছন্দ করেনি। সে ভাবে চলেনি। কিন্তু স্কুলের কর্তৃপক্ষ তার ওপর অত্যন্ত কড়া নজর জারী রাখতেন। টাইলার নিশ্চিত, বাবার গোপন নির্দেশ ছিল এ ব্যাপারে। স্কুলের প্রথম বছরটিতে বার কয়েক আত্মহত্যা করার কথাও মনে হয়েছিল তার। কিন্তু নিজেকে দমন করত সে। না, এই সুখ আনন্দটা বাবাকে সে দেবে না। তাছাড়া মায়ের মৃত্যুর শোধ তাকেই নিতে হবে। স্কুল শেষ করে সে যখন আইন কলেজে ভর্তি হলো, বলাই বাহুল্য, ও তখন প্রাপ্তবয়স্ক। বাবার ইচ্ছের ধার ধারে না। সে খবর জেনে বাবার প্রতিক্রিয়া ছিলো–ওহ তুমি কী ভেবেছ? আইনবিদ হবার পর আমি তোমায় আমার কোম্পানিতে নেবো? আইনবিদের দায়িত্ব দেবো? ভুলে যাও। সেরকম কোন আশা ভুলেও মনে এমো না। আমার কোম্পানিগুলোর একশো মাইলের মধ্যে আমি তোমায় আসতে দেবো না।
জজ টাইলারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তার সহকর্মীরাও বিশেষ কিছু জানে না। কর্মক্ষেত্রে তাঁর অতি বেশি কড়া হিসেবে সুনাম ও কুখ্যাতি। তিনি মনে করেন, অপরাধ মাত্রই কঠোর শাস্তিযোগ্য। এক্ষেত্রেও তার অবচেতনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে বাবার প্রতি, বাবাকৃত সেই অপরাধের প্রতি বিদ্বেষ। প্রতিটি অপরাধের মধ্যেই যেন বাবার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান তিনি। সারা দিন ধরে অপরাধী পক্ষের আইনবিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের নানা যুক্তিজাল, কাকুতি, দয়াভিক্ষা শোনেন তিনি। তারপর রায় দেবার সময় সব উড়িয়ে দেন। অপরাধীর কঠোর কঠিন সাজা হয়। এ কারণে অপরাধী মহলে তার ডাক নাম কুখ্যাতি ছড়িয়েছে ফাঁসুড়ে জজ। ব্যক্তিগত জীবনে তার বিবাহটি তিক্ত অভিজ্ঞতা। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং তারপর থেকে তিনি একাই থাকেন। বাধা নিয়মে জীবন কাটান তিনি।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান উৎসব জমায়েতে সহকর্মীদের স্ত্রীরা তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়। ওরা জানে তিনি একক পুরুষ। কেউ কেউ পরস্ত্রী বন্ধুপত্নীরা নিজেরা টাইলারের সঙ্গে জড়াতে আগ্রহ দেখায়। কেউ কেউ অবিবাহিতা বান্ধবী বা আত্মীয়দের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে উৎসুক হয়। কিন্তু টাইলার এড়িয়ে যান। কেউ তাকে রাতের খাওয়া খেতে ডাকে। কেউ বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ জানায়। নানা ছুতোয় টাইলার সেসব এড়িয়ে যান। টাইলারের এক আইন ছাড়া অন্য আর কোন কিছুতে উৎসাহ নেই। এক আইনবিদ বন্ধু তার স্ত্রীকে কথাটা বলে। এবং এও বলে টাইলারের বিয়েটা মর্মান্তিক হয়েছিল। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হবার পর আর কোন নারীর সঙ্গে আবেগঘন সম্পর্কে জড়াবেন না নিজেকে। কিন্তু, হঠাৎ একদিন লি-এর সঙ্গে পরিচয় হলে তার। এবং প্রায় নিমেষে ঝড়ের মত সব কিছু বদলে গেল তার। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো লি-কে পাওয়া। সুন্দরী অনুভূতি প্রবণ এবং ভালবাসাময়। লি এমন এক নারী বাকি জীবনটা যার সঙ্গে কাটাতে তার ভালবাসা পেতে উতলা হয়ে উঠল টাইলার।
সমস্ত মন প্রাণ আবেগ দিয়ে লিকে ভালবাসেন টাইলার। কিন্তু লি কেন তাকে ভালবাসবে? একজন সফল মডেল লি-এর প্রচুর ভক্ত গুণমুগ্ধ আছে। এবং তারা প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত ধনী এবং লি দামী উপহার বিলাস পছন্দ করে বললে কমই বলা হবে। সুতরাং, টাইলার নিজের কোন আশাই দেখেননি। লি-এর ধনকুবের স্তাবক প্রেমিকদের সঙ্গে দৌলতের প্রতিযোগিতায় পাল্লাবাজি লাগিয়ে লিয়ের নজর প্রেম দৃষ্টি কাড়বার কোনরকম সুযোগ বা ক্ষমতাই তাঁর ছিল না। কিন্তু রাতারাতি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মৃত বহু বিলিয়নের মালিক বাবার পুত্র হিসেবে তার সামনে এখন তার কল্পনার ও দুঃসাধ্য দৌলতের মালিক উত্তরাধিকারী হবার সুযোগ, হাতছানি। * সেই বিকেলে, বস্টনগামী বিমানের উড়ানের যাত্রী জজ টাইলার স্ট্যানফোর্ডের বারবার মনে পড়ছিল। তার সঙ্গে বাবার শেষ কথোপকথন। তাকে বলা বাবার শেষ কথাটি। শব্দগুলো–জানি আমি তোমার নোংরা গোপনীয়তা।
.
০৯.
মধ্য জুলাইয়ের গ্রীষ্ম। দুপুর জুড়ে প্যারিসে তখন তুমুল বৃষ্টি। বিব্রত পথচারীরা দ্রুত মাথা বাঁচানোর আশ্রয় খুঁজতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ ট্যাক্সির খোঁজ করছে। যা নাকি তখন বিলুপ্ত কোন প্রাণীর মতই বিরল প্রায়। রু ফাবর্গ স্ত্রী অনরেতে বিশাল একটি ধূসর রঙা বাড়ীর একতলার প্রেক্ষাগৃহে তখন যাকে বলা যায় চরমতম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ডজন খানেক প্রায় নগ্ন মহিলা মডেল উদভ্রান্তের মত মঞ্চের পেছনের অংশটাতে দৌড়াদৌড়ি করছে। কর্মীরা কেউ কেউ চেয়ারগুলো প্রেক্ষাগৃহে পেতে সাজিয়ে দিতে ব্যস্ত। ছুতোরেরা কাঠের কাজের শেষ তৎপরতায় ব্যস্ত। প্রত্যেকেই ব্যস্ত ভঙ্গীতে চেঁচাচ্ছে। এদিক থেকে ওদিকে দৌড়াচ্ছে। নিজের কাজ শেষ করার মরীয়া চেষ্টা করছে। এবং চারপাশের প্রায় মুচ্ছগ্রস্ত উদ্ভ্রান্তের ব্যস্ততার মধ্যে একজনই সমস্ত কিছুতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মরীয়া চেষ্টা করে চলেছিলেন অনুত্তেজিত ভাবে। তিনিই এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। এক পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটাকে সংগঠিত করার চেষ্টা করতে করতে বেনডাল স্ট্যানফোর্ড রেনর ভাবছিলেন, ফ্যাশান শো শুরু হতে আর মাত্র চার ঘন্টা বাকি। অথচ প্রকৃতি থেকে শুরু করে প্রেক্ষাগৃহের শব্দ ব্যবস্থা সবই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা অসহযোগিতা করছে। হাতের সিগারেটটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলেন বেনডাল।
বেনডাল স্ট্যানফোর্ড রেনরকে অনায়াসে একজন মডেল বলে ভুল করতে পারে যে কেউ। অবশ্য একটা সময়ে বেনডাল নিজেও মডেল ছিলেন। প্যারিসের ফ্যাশান জগত মনে করত তার অনিন্দ্য দেহবল্লরীতে যে কোন পোশাকই অসাধারণ খাপ খেয়ে মানাত অনেক অনেক বেশি। শুধুমাত্র একজন মডেল হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। এই বিশ্বাস মনে প্রাণে ছিল তার। এই মুহূর্তে চরকির মত পাক খেতে খেতে, সহকারীদের নানা আদেশ দিতে দিতে, মডেলদের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে দিতে দিতে, মেকআপ ম্যানদের দ্রুত কাজ সারার মেয়েদের তৈরি করে দেবার জন্য আদেশ দিতে দিতে সেই চরম ব্যস্ততার ফাঁকেও বেনডাল মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন। সারা পারিপার্শ্বিক একবার নজর বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সারা পৃথিবীর ফ্যাশান জগতের বিশিষ্টরা আজ এখানে তার, বেনডাল স্ট্যানফোর্ড রেনর-এর সৃষ্টিকে তারিফ করার জন্য হাজির থাকবে। হ্যাঁ, তাঁর কাজ তার সৃষ্টি যে উচ্চ প্রশংসিত হবেই, সে আত্মবিশ্বাস তার চরম ভাবেই আছে। ধন্যবাদ বাবা। এই সাফল্য আমি তোমায় উৎসর্গ করছি। তোমার নির্দয় অবহেলা উপেক্ষা ছাড়া বোধ হয় আমি এত বড় হতে এতটা এগোতে পারতাম না। তুমি বলেছিলে, আমি কোন দিন সাফল্য অর্জন করতে পারব না। ধন্যবাদ বাবা, তোমার ঐ উপেক্ষা অনুপ্রেরণাহীনতাই আমার সাফল্যের পাথেয়। সফল হবার জেদ হয়ে উঠেছিল এবং আমি পেরেছি বাবা।
বেনডাল ছোটবেলা থেকেই জানত সে একজন ফ্যাশান ডিজাইনারই হয়ে উঠবে। খুবই অল্পবয়স থেকে ফ্যাশান সম্পর্কে আশ্চর্যরকম স্পষ্ট স্বচ্ছ ধারণা ছিল তার। নিচু শ্রেণীর ছাত্রী থাকার সময়েই বালিকা বয়সেই নিজের পুতুলগুলোর জন্য নানা ছাঁট কাটের যে, পোশাকগুলো সে বানাত, তা সবাইকে চমৎকৃত করত। মা সে সব দেখে দারুণ প্রশংসা করে বলতেন, তুমি একদিন পৃথিবী বিখ্যাত ফ্যাশান ডিজাইনার হবে এবং বেনডালের নিজেরও সে বিষয়ে কোনরকম দ্বিধা ছিল না। স্কুল পার হয়েই তাই সে ফ্যাশন ডিজাইনিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল। সেই সময়েই এক বিখ্যাত ফ্যাশান ডিজাইনারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তাকে একটা মূল্যবান পরামর্শ দেন। শুরু হিসেবে সবচেয়ে ভাল হচ্ছে নিজে মডেল হও। এভাবে তুমি বিখ্যাত ডিজাইনারদের সঙ্গে পরিচিত হতে, তাদের কাছাকাছি আসতে পারবে। খুব কাছ থেকে তাদের কাজগুলো দেখতে পারবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ মনে করে বেনডাল এ বিষয়ে যখন বাবার মত নিতে গিয়েছিল, তিনি সশব্দে, উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিলেন–তুমি, মডেল? মডেল? এটা বোধহয় বছরের সেরা ঠাট্টা রসিকতা বিবেচিত হতে পারবে।
ছুটিতে বোর্ডিং হোস্টেল থেকে বেনডাল যখন বাড়ী ফিরত, গিয়ে দেখত এক অসহ্যকর পরিস্থিতি। সমস্ত কিছুর মধ্যেই চরম বিশৃঙ্খলতার ছাপ। সে প্রাণপণে চেষ্টা করত সবকিছুকে স্বাভাবিকতা শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে, সুস্থ চেহারা দিতে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তার করা কোন কিছুই যেন বাবার পছন্দ হতো না। এই নতুন রাধুনীটা জঘন্য, কোথা থেকে জোগাড় করা হয়েছে একে? নতুন ডিশগুলো কে পছন্দ করে এনেছে? জঘন্য রুচি। আমার শোবার ঘর নতুন করে সাজাতে কে বলেছে। বিশ্রী। কুৎসিত হয়েছে। বেনডালের মনে হতো, শুধুমাত্র সে করেছে বলেই বাবাকে অপছন্দ করতে হচ্ছে। বাবার এই নিষ্ঠুরতা, নির্মম ব্যবহারই তাকে শেষ পর্যন্ত বাড়ী থেকে দুরে চলে যেতে বাধ্য করল। এক ভালবাসাহীন গৃহ। ছেলেমেয়েদের প্রতি বাবার কোন আদর যত্ন ভালবাসাই ছিল না। একদিন শেষ পর্যন্ত সত্যিই সে নিউইয়র্কের দিকে পাড়ি জমাল। চিরদিনের মত ঐ বাড়ীকে পরিত্যাগ করে, সম্পর্ক ছিন্ন করে। এবং শুরু হলো তার নতুন জীবন। প্রথম দিকে যা মোটেই সহজ ছিল না। রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে পায়ের তলায় একটু জমি খুঁজে পাবার জন্য। মডেলিং এজেন্সীগুলোর দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু কেউ তাকে সুযোগ দিতে চায়নি। অচেনা, অজানা, অনভিজ্ঞ একটা মেয়েকে মডেল হিসেবে কে নিতে চাইবে? প্রত্যাখানের পর প্রত্যাখান। তবুও ভেঙ্গে পড়েনি সে। জানত, তার আত্মবিশ্বাস ছিল যে, একদিন না একদিন সুযোগ সে পাবেই, আসবেই।
নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা মডেলিং এজেন্সী ছিল প্যারামাউন্ট মডেলস এজেন্সী। এই এজেন্সীতে তার কোন সুযোগই নেই বুঝেছিল বেনডাল। বিশেষ করে ছোট ছোট এজেন্সীগুলোই যখন তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবু কী মনে করে, হঠাৎ এক দুপুরে সে হাজির হলো প্যারামাউন্টের দফতরে। রিসেপশন বলে কিছু ছিল না, সে সোজা ঢুকে পড়ল কাঁচের দরজা ঠেলে উল্টোদিকের ঘরটায়। রোকসানে মানেরিক ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। ফোন রেখে এক ঝলক তার দিকে তাকালো। দুঃখিত আমরা আপনার চেহারার কাউকে খুঁজছি না। বেনডাল মরীয়া গলায় বলে, দেখুন আপনারা যে ধরনের মডেল চাইছেন, রোগা মোটা লম্বা বেঁটে আমি নিজেকে ঠিক সে ধরনের বানিয়ে তৈরি করে নেবো। আমি শুধু একটা সুযোগ চাই। একটা সুযোগ পেতে চাই। ওর দিকে স্থির চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। মেয়েটির চোখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। সংকল্প এবং আত্মবিশ্বাস। কী যেন ভেবে নেয় কয়েক মুহূর্ত। তারপর হাত বাড়ায়। দেখি তোমার পোর্ট ফোলিও। সেই শুরুর পর বেনডালকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে জানে না, প্যারামাউন্টের মত সংস্থার মালকিন রোকসানে মানেরিক তার মধ্যে কী দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু রোকসানের পরামর্শ ও প্রশ্রয় সে পেয়েছিল পুরোমাত্রায়। তার মত একজন নবীনকে হাত ধরে মডেলিং এবং সমস্ত কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ও শিখিয়ে ছিল রোকসানেই। বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশানের জগতে প্রতিষ্ঠিত মডেল হিসেবে শক্ত জমির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
মডেল হিসেবে কাজ করতে করতে, নানা ডিজাইনারের পোশাক পরতে পরতেই শিখে চলেছিল বেনডাল। নানা ডিজাইনারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ছিল। মডেল হিসেবে চরম ব্যস্ত দ্রুতগামী জীবনের মাঝেও এক মুহূর্তের জন্যও সে ভুলত না নিউইয়র্কে আসার মূল কারণটিকে, নিজের জীবনের আসল লক্ষ্যটিকে। এবং বাড়ীতে অবসরে সে নানাভাবে পোশাকের স্কেচ করত। অন্য ডিজাইনারদের পোশাকগুলো পড়ে সে এবং অন্য মডেলরা মঞ্চে উঠত সেগুলো যদি সে করত, কেমন হতে কী কী বদল করত? এভাবেই নানা চিন্তা ভাবনা মাথায় গিজ গিজ করত। যা তার স্কেচ খাতায় পাতার পর পাতায় ভরে উঠত। অবশ্য, পুরোটাই সাফল্যের গল্প নয়। ওর প্রথম প্রদর্শনীটি বিশ্রীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রায় এক বছর পর যখন সে ফ্যাশান ডিজাইনার হিসেবে তার দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি করল, ফলাফল অন্যরকম কিছু হলো না। ব্যর্থ পোশাক পরিকল্পক হয়ে প্রায় চিহ্নিত হয়ে গেল সে। রাতে বিছানায় জেগে সে ভাবত ব্যর্থতার কারণগুলো। তারপর হঠাৎ করে একরাতে সে বুঝতে পারল যে পোশাকগুলো সে বানাচ্ছে ডিজাইন করছে, সেগুলো মডেলদের পরবার মত নিখুঁত। কিন্তু সাধারণ মহিলাদের তা পছন্দ হবে কেন? তাকে এমন পোশাক পরিকল্পনা করতে হবে যা সাধারণ নারীদের কাছে আরামদায়ক। সহজ সপ্রতিভ এবং সস্তা হবে। একবছর পর তার তৃতীয় প্রদর্শনীটি সুপার হিট হলে পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সে।
সাফল্যের খুশিতে সে একদিন হাজির হলো রোজ হিলে তাদের বাড়ীতে। কিন্তু বাবা বদলায়নি। তার সাফল্য বাবাকে খুশি করা তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত করতে পারেনি। ওকে দেখে বাবা মুখ কুঁচকে কুৎসিত ভঙ্গী করে বললেন–এখনো কাউকে ফাসাতে পারোনি? ঐ চেহারা নিয়ে সারাজীবন বোধহয় তা পারবেও না কোনদিন।
এক চ্যারিটি ডিনারে তার আলাপ হয়েছিল মার্ক রেনর এর সঙ্গে। বেনডাল তার থেকে পাঁচ বছরের বয়সে ছোট। ঐ আকর্ষণীয় চেহারার ফরাসী যুবকটির প্রতি অতি দ্রুত আকর্ষিত হয়ে পড়েছিল। সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে রেনরের সঙ্গে আলাপ করে। এমন কি পরের রাতে তার সঙ্গে খাবার খেতে যাবার ইচ্ছেও প্রকাশ করে। সে রাতে, পরের রাতে, খাবার, খেয়ে তারা রেনরের ফ্ল্যাটে যায় এবং বেনডাল বিনা দ্বিধায় তার শয্যাসঙ্গিনী হয়। তারপর থেকে প্রতিরাতেই। মার্ক তখন নিউইয়র্কের এক শেয়ার দালাল সংস্থায় কাজ করত। একদিন মার্ক তাকে বলে, বেনডাল আমি তোমায় পাগলের মত ভালবাসি। মার্কের গলাটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বেনডাল প্রণয়সিক্ত গলায় বলে, আমি সারাজীবন তোমারই মত কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মার্ক বিমর্ষ গলায় বলে, কিন্তু আমাদের বিয়ের একটা বিরাট সমস্যা আছে। একে তো তুমি নিজেই একজন সফলতম নারী। তার ওপর একজন পৃথিবীখ্যাত শিল্পপতির মেয়ে তুমি। আমার মত একজন অতি সামান্য… বেনডাল কথা শেষ করতে না দিয়ে ওর ঠোঁটে নিজের আঙুলটাকে চেপে ধরে।
বড়দিনের ছুটিতে সে মার্ককে নিয়ে তাদের রোজ হিলের বাড়ীতে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বাবার সঙ্গে মার্কের আলাপ পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তুমি ঐ ছোকরাকে বিয়ে করতে চাও। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড যেন আগুনের গোলার মত ফেটে পড়লেন। ঐ ছোকরার আছে কী? অতি সামান্য তুচ্ছ একটা মানুষ। ও শুধু স্ট্যানফোর্ড পরিবারের বিশাল অর্থ সম্পত্তি পাবার লোভে তোমায় বিয়ে করতে চাইছে। তা কি তুমি বুঝতে পারছ না? বোকাটা ভেবেছে, তুমি আমার সম্পত্তির অংশ পাবে। বেনডাল স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। ফিরতি বিমানেই ওরা ফিরে এসেছিল। পরের সপ্তাহেই ওরা বিয়ে করেছিল। এবং তার বিয়ে সত্যিই সুখের হয়েছিল। স্বামী হিসেবে মার্ক সত্যিই আদর্শ। কোন অপূর্ণতা নেই ওদের দাম্পত্য জীবনে। বিয়ের রাতেই মার্ক ওকে বলেছিল–সারাজীবন ধরেই তোমার বাবা তার অর্থ বিত্তকে অস্ত্র হিসেবে, ক্ষমতাদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে এসেছেন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মাঝে, আমরা কোনদিন তোমার বাবার অর্থকে আসতে দেব না। মার্কের প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা আরো তীব্রতর হয়েছিল একথা শুনে।
ফ্যাশান শো শেষ হবার পর নিজের অফিসে বসেছিল বেনডাল। মুখটা ঝলমল করছিল শোটা বেশ সফল হয়েছে। উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে ওর কাজ। এমন সময় ওর ব্যক্তিগত সচিব ঘরে ঢুকল। কুরিয়ার মাধ্যমে একটা চিঠি এসেছে আপনার নামে। সে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাদামী খামটার দিকে তাকিয়ে বেনডালের সারা শরীরে হিম স্রোতের শিহরণ বয়ে গেল। চিঠিটা না খুলেই সে বুঝতে পারে ওতে কী লেখা আছে।
প্রিয় শ্রীমতি রেনর,
আপনাকে বিনীতভাবে জানাচ্ছি, আপনাদের পশু ক্লেশ নিবারণ সংস্থা আবার তহবিল ঘাটতিতে পড়েছে। খরচ সামাল দিতে অবিলম্বে দশ হাজার ডলার প্রয়োজন। টাকাটা দ্রুত পাঠাবার ব্যবস্থা করলে কৃতজ্ঞ থাকব। টাকা জুরিখের ক্রেডিট সুইস ব্যাঙ্ক এর এ ৮০৭০৪০২ নম্বরের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। চিঠির শেষে কোন সই প্রেরকের নাম নেই।
বেনডাল স্তব্ধ। বোবা হয়ে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা তার স্নায়ুর পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে ক্রমে। এই ব্ল্যাকমেইলিং বোধহয় কোনদিন বন্ধ হবে না। যতদিন সে বেঁচে থাকবে এটা বোধহয় চলতে থাকবে। ঠিক এই সময়ই হন্তদন্ত হয়ে তার একজন সহকারী ঘরে ঢোকে। উত্তেজনায় লাল মুখে সে হাঁপাচ্ছে। বেনডালের দিকে তাকিয়ে বিবর্ণ মুখে সে বলে, আমি…দুঃখিত…একটা ভয়ঙ্কর খারাপ খবর আছে ম্যাডাম। আরো খারাপ খবর? বেনডাল ভাবে তার স্নায়ু আর কত সহ্য করবে? কী? কি ব্যাপারটা কী? ম্লান মুখে সহকারীটি বলে। এই মাত্র রেডিওর খবরে বলল…আপনার বাবা হ্যারী স্ট্যানফোর্ড জলে ডুবে মারা গেছেন। ব্যাপারটাকে নিজের অনুভবে ডুবিয়ে নিতে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে বেনডালের কয়েক মুহূর্ত সময় বেশিই লাগল। তারপর ওর মাথায় প্রথম অনুভতিই যেটা প্রকট হলো–আমার বেশি খুশি হওয়া উচিত কোনটিতে? ফ্যাশান শোয়ের সাফল্যতে? নাকি আমি একজন খুনী, এই গূঢ় বাস্তবে?
.
১০.
উডরোও উডি স্ট্যানফোর্ড-এর সঙ্গে পেগি মালকোভিচের বিয়ে হয়েছে দুবছর। কিন্তু হোব-এর বাসিন্দাদের কাছে আজও সে বেঁস্তোরা পরিচারিকা হিসেবেই বিবেচিত হয়। উডির সঙ্গে রেইন ফরেস্ট রেস্তোরাঁতেই প্রথম আলাপ হয়েছিল তার। সুদর্শন, সপ্রতিভ, আকর্ষণীয় চেহারার উডি তখন হোবের সব অবিবাহিত কুমারী মেয়েদেরই লক্ষ্যবিন্দু ছিল। শুধু হোব কেন? ফিলাডেলফিয়া, লঙ আইল্যান্ড পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা ছিল। তাই উড়ি যখন পেগির মত একজন স্কুল পার না হওয়া বিদ্যের রেস্তোরাঁ পরিচারিকাকে বিয়ে করল। সারা হোব শহরের মানুষ বিষম চমক পেয়ে আঁতকে উঠল বলা ভাল। আঁতকে ওঠার পরিমাপটা আরো চরম হলো, কারণ সারা হোব শহরই মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে উডির পেছনে যত মেয়েই ঘোরাঘুরি ছোঁক ছোঁক করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত উডি বিয়ে করবে কাঠ ব্যবসায়ী, ধনীর মেয়ে মিমি কারসনকেই। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মিমিও উডির প্রেমে পাগল ছিলো। ক্রমে জানা গেল পেগি মালকোভিচ বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। সে কারণেই উডি তাকে বিয়ে করে নেয়।
চব্বিশ বছর আগে, এরকমই একটি স্ক্যান্ডাল নাড়িয়ে দিয়েছিল হোবকে। সেটি, সেই ঘটনাটিতেও জড়িত ছিল স্ট্যানফোর্ড পরিবারের একজন পুরুষ। একটি ভদ্রঘরের মেয়ে এমিলি টেম্পল সেই ঘটনায় আত্মহত্যা করে। কারণ তার স্বামী বাচ্চাদের দেখাশোনাকারীনি যুবতী গভর্নের্সকে গর্ভবতী করেছিল। যেহেতু নিজের বাবার কুকাজ, পাপ, উডকেও কোনদিন অনুমোদন করেনি। প্রকাশ্যেই তার সমালোচনা করে এসেছে এতদিন। বাবাকে সোজাসুজি এবং প্রকাশ্যে ঘৃণা করে এসেছে। তাই পেগি মালকোভিচ গর্ভবতী হয়ে পড়ায় সে দ্বিতীয় ভাবনা চিন্তা বা কোন দ্বিধা না করেই তাকে বিয়ে করে নেয়। বোধ হয় নিজের বাবার থেকে সে অনেক উন্নততর মহৎ চরিত্রের পুরুষ। এটা সবাইকে বোঝাবার একটা দায় অথবা চেষ্টা, ইচ্ছাও তার মনের গভীরতর পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করেছিল।
সুতরাং ওদের বিয়েটা হয়ে গেল। সারা হোব শহর এবং উডির বন্ধুবান্ধবেরাই এ বিয়েতে বেশ হতাশ হয়েছিল। মেয়েটার মধ্যে উডরোও স্ট্যানফোর্ড এমন কি দেখতে পেলো? নিরন্তর এই চর্চা চলেছিলই। এবং সত্যি কথা বলতে কী এই সমালোচনা চর্চা অর্থহীন ছিল না মোটেই। পেগি, নির্বোধ ব্যক্তিত্বহীন এক মহিলা। দেখতেও সে মোটেই সুশ্রীও বলা যাবে না। সুন্দরী তো দূরের কথা। উডি প্রাণপণে তাদের বিয়েটাকে সার্থক সফল করে তোলবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। একজন আদর্শ স্বামী হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ বিয়ের পরে কাটতেই সে বুঝে গেল, বিরাট একটা ভুল করে ফেলেছে সে। বিয়েটা কিছুতেই সফল হয়ে উঠবে না। তাদের সমাজের স্তর থেকে অনেক দূরে পেগির অবস্থান। উডরোও এর পরিচিত বন্ধু আত্মীয়দের সঙ্গে কিছুতেই সহজ হয়ে মিশতে পারত না পেগি। নিমন্ত্রণ পার্টিতে নিয়ে গেলে আড়ষ্ট জড়োসড়ো হয়ে থাকত। ঐ রকম কোন পরিবেশে বলার মত কথা পেতো না। ঐসব নিমন্ত্রণে অথবা অনুষ্ঠানে, পার্টিতে পেগি মালকোভিচের কোন অবদান থাকত না। ফলে ঐ সব জায়গায় গিয়ে সে এক কোণে জড়োসডো নার্ভাস হয়ে থাকত। সহজ হতে পারত না। বিয়ের চার সপ্তাহ পরই হঠাৎ করে পেগির গর্ভপাত ঘটে। বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়।
ঐ ঘটনাটা ওদের দাম্পত্যে একটা প্রভাব ফেলে। তীব্রতর প্রভাব। পেগি নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয়। তীব্র নিঃসঙ্গতার এক শক্ত খোলসে মুড়ে এবং গুটিয়ে নেয় নিজেকে। বাইরে বের হওয়া, অনুষ্ঠান নিমন্ত্রণে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দেয়। উত্তরোত্তর বারবার অনুরোধেও কোন কাজ হত না। ফলে, বাধ্য হয়েই সব জায়গাতে উডরোওকে একাই যেতে হতো। অন্যদিনও বাড়ী ফিরতে গভীর রাত হতো তার। নিজের শোবার ঘরে বিনিদ্র রাত পার করতে করতে পেগি স্বামীর ফিরে আসা টের পেতো। এবং সে ঠিকই বুঝত যে এতক্ষণ অন্য নারীদের সঙ্গ লাভ করছিল উডি। এভাবেই দিন কাটছিল এবং ওদের দুজনের মধ্যেই ভাঙ্গনটা বিশালতর হয়ে উঠতে থাকছিল।
আচমকা সবকিছু বদলে গেল একটা দুর্ঘটনায়। সেটা ঘটল একটা পোলো ম্যাচে। পোলো খেলোয়াড় হিসেবে সারা দেশ জুড়ে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল উডরোও-এর। একটা পোলো ম্যাচে দ্রুততর গতিতে ধাবমান অবস্থায় মাটিতে ছিটকে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। ডাক্তারী পরীক্ষায় ধরা পড়ল তার পা ভেঙ্গেছে। পাজরের তিনটে হাড় ভেঙ্গেছে। ফুসফুঁসেও চোট লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরের দু সপ্তাহে তিনটে আলাদা আলাদা অস্ত্রোপচার করা হলো উডিকে। পাঁচ সপ্তাহ পরে হাসপাতাল থেকে যখন সে বাড়ীতে ফিরল, তার চরিত্রের, ব্যবহারে একটা অদ্ভুত অসাম্য দ্বিমুখীতা লক্ষ্য করা যেতে লাগল। হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে রেগে উঠতে লাগল। এক মুহূর্ত আগে হয়তো পেগির সঙ্গে চা খেতে খেতে ঠাট্টা ইয়ার্কি করছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মেজাজের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত। এক উদ্দাম উত্তেজনা, উন্মাদনায় ক্ষেপে উঠত সে। যা আসলে এক প্রচণ্ডতর তীব্র রকমের হতাশা বিষণ্ণতার ক্ষিপ্ত বহিঃপ্রকাশ। ক্ৰমে পেগিকে দৈহিক নিপীড়ন শুরু করল সে।
একদিন ডাক্তার টিকনার, যিনি উডির চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন, পেগিকে হাসপাতালে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। কোন ভূমিকা না করেই সরাসরি তিনি বললেন, মিসেস স্ট্যানফোর্ড, আপনি কি বুঝতে পারছেন না? জানেন না আপনার স্বামী নিয়মিত মাদক নিচ্ছে? পেগি যেন আকাশ থেকে পড়ে। ড্রাগ? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ডাঃ টিকনার-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথা নেড়ে হতাশার ভঙ্গী প্রকাশ করে ডাঃ টিকনার বলেন, জানি আপনার বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য। উনি রীতিমত মাদকে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছেন। কেউ ওকে নিয়মিত ভাবে হেরোইন কোকেন সরবরাহ করছে। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর একটাই পথ আছে। ওকে কোন রিহ্যাবিটেশন সংস্থায় ভর্তি করে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
ব্যাপারটা যদিও খুব সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত ডাঃ টিকনার এবং পেগির আপ্রাণ চেষ্টায় উডরোও রাজী হলো। হারবার গ্রুপ ক্লিনিকে তিন সপ্তাহ চিকিৎসা করিয়ে উডি যখন ফিরে এলো সবাই আবার পুরনো উডিকে খুঁজে পেলো। সপ্রতিভ হাসি খুশি। আবার পোলো মাঠে ফিরেও গেল সে। এরকমই একটা পোলো ম্যাচ চলছিল। উডি দুরন্ত খেলছিল। পঞ্চম চাকার চলার সময়ে উডি দ্রুতগতিতে একটা বল নিয়ে বিপক্ষ সীমানায় ঢুকে পড়ে। অনেকটা এগিয়ে গেল। বলটাকে কোন সঙ্গী খেলোয়াড়কে বাড়িয়ে দেবার জন্য তাকাতেই চোখের কোণ দিয়ে সে দেখতে পেলো বিপক্ষের সেরা খেলোয়াড় রিক হ্যাঁমিলটন তেড়ে আসছে। রিক বলটা কেড়ে নিয়ে বিপক্ষের গোলের দিকে দৌড় শুরু করল। উডি প্রাণপণে তাকে তাড়া করে বলের দখল নিতে চেষ্টা করতে থাকল। হ্যাঁমিলটন গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মরীয়া উডি তাকে প্রাণপণ শক্তি দিয়ে বাধা দিলো অবৈধভাবে। আম্পায়ারের বাঁশি তীব্র রাগত স্বরে বেজে উঠল। একটা হাত তুলে তিনি পেনাল্টির ইঙ্গিত করলেন, সেই চাকার একটা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে কাটল। পরের তিন মিনিটে উডি আরো দুটি অবৈধ ফাউল করল। বিপক্ষ দল আরো দুটো পেনাল্টি গোল লাভ করল। জেতা ম্যাচটা একা উডির জন্য হারতে হলো তার দলকে।
খেলার পরে সাজঘরে যেন কবরের স্তব্ধতা। উডি বিষণ্ণ, ম্লান মুখে বসেছিল। লজ্জায় দলের অন্যদের মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছিলো না। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন দলের কোচ। উডির কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে তিনি বললেন, উডি তোমার জন্য একটা ভয়ঙ্কর খারাপ খবর আছে। তোমার বাবা মারা গেছেন। উডি চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। তার দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল, আমি…আমি…এরজন্য দায়ী। আমার দোষেই…কোচ সহানুভূতির স্বরে বললেন, না উডি, এরকম তো সবারই জীবনে ঘটতে পারে। এর জন্যে নিজেকে কেন দায়ী করছ। এটা দুর্ঘটনা, এই শোকের ঘটনার জন্যে তোমার কোন দোষ তো নেই। উডি কেঁদে উঠে, কান্না ভেজা গাঢ় গলায় বলে, না, না, দোষ আমারই। আমার পেনাল্টিগুলো না হলে তো আমরাই খেলাটা জিততাম।
.
১১.
জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড কোনদিন নিজের বাবাকে স্বচক্ষে সামনা সামনি দেখেনি। শুধু খবরের কাগজে টেলিভিশনের ছবিতে দেখেছে শিল্পপতি বিজনেস টাইফুন হ্যারী স্ট্যানফোর্ডকে। আজ সে মানুষটা মৃত। এক বিখ্যাত ধনী শিল্পীপতি বিজনেস টাইফুন থেকে স্রেফ খবরের কাগজের মোটা কালো হরফের কয়েকটা লাইন। জুলিয়া খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছবিসহ হ্যারী স্ট্যানফোর্ড, বিখ্যাত প্রবাদ প্রতিম শিল্পপতি জলে ডুবে মৃত শিরোনামের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মধ্যে তীব্র বৈপরীত্যময় আবেগের উথাল পাথাল চলেছে। আমার মায়ের সঙ্গে যে ব্যবহার উনি করেছিলেন তার জন্যে আমি কি ওকে ঘৃণা করি? যতই হোক, আমার বাবা উনি, সেজন্য ওকে কি আমি ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি? নিজে কেন কোনদিন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি, করার চেষ্টা করিনি। এজন্যে আমার কি অপরাধ বোধ, আত্মশোনা হচ্ছে? উনি কোনদিন নিজের মেয়েকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেননি। এ কারণে ওকে কি ঘৃণা করা উচিত আমার? প্রশ্নগুলো ওর মনে ঝলসে উঠেছিল। আবার বুদবুদের মত মিলিয়েও যাচ্ছিল। অবশেষে উত্তরটা ও নিজেই খুঁজে পেলো। ঐসব প্রশ্নগুলো এবং তার উত্তর, এখন আর কোন যথার্থতা নেই, অর্থহীন, কারণ আসল মানুষটিই নেই, চলে গেছেন।
অবশ্য সেভাবে ভেবে দেখলে, তার বাবা চিরকালই ওর জন্ম থেকেই ওর কাছে মৃত। এই মৃত্যু শুধুই একটা ইঙ্গিতময় প্রতীকি মৃত্যুর বেশী কিছু নয়। তাই তার কাছে প্রথমটায়। স্বজন হারানোর ক্ষতিটা হৃদয় জুড়ে বেজে উঠেছিল খবরটা পাওয়া মাত্র। তারপরই মনের গহন গভীর থেকে ওর বাস্তববুদ্ধি বোধ ধমকে ওঠে। বোকা মেয়ে যাকে তুমি চেনোই না, তাকে হারানোর ক্ষতি তোমার মনে অনুভূত হয় কী ভাবে? জুলিয়া তার কোলের ওপর রাখা ছবির অ্যালবামটার পাতা ওলটাতে থাকে। পরম মমতায় ধূসর হলুদ বিবর্ণ হয়ে ওঠা ছবিগুলোতে হাত বুলোতে থাকে। ছবিগুলো ওর মায়ের। বেশির ভাগই স্ট্যানফোর্ড পরিবারের নানা জনের সঙ্গে গভর্নেসের পোশাকে। দীর্ঘক্ষণ সেই ভাবেই বসে থাকে জুলিয়া। অতীতে হারিয়ে যায়।
মিলাউঁকির সেন্ট জোসেফ হাসপাতালে ওর জন্ম হয়েছিল। ছোটবেলার স্মৃতি বলতে ওর শুধু মনে আছে ছোট্ট ছোট্ট ঘিঞ্জি অ্যাপার্টমেন্ট। কোন শহরেই বেশিদিন একনাগাড়ে থাকত না। চরকির মত এ শহর সে শহর ঘুরে বেড়াত। এমন সময় প্রায়ই আসত ওর মা। জীবনে মেয়ের হাতে আধ ডলারও থাকত না। দিন কাটত অনাহারে। ওর জন্মের পর থেকেই মা অসুস্থ রুগ্ন হয়ে পড়েছিল। অসুস্থতার কারণেই কোথাও টানা স্থায়ীভাবে চাকরী করতে পারত না। ছোটবেলা থেকেই রুক্ষ জেদী স্বভাবের ছিল। ছাত্রছাত্রী শিক্ষক সবার কাছেই সে ছিল এক উপদ্রব। হয়ত, স্কুলের সেরা ছাত্রী না হলে ওকে বোধহয় স্কুল থেকে তাড়িয়েই দেওয়া হতো। ছোটবেলা থেকেই ও জানত ওর বাবা মৃত। সে কথা বিশ্বাস করেই ও বড় হয়েছিল। তারপর একদিন ওর বয়স তখন বারো, পুরনো কাগজপত্রের ভেতর থেকে একটা বেশ পুরনো ছবি ওর হাতে এলো। একটা পারিবারিক গ্রুপ ছবি। ছবিটার দিকে অচেনা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে জুলিয়া প্রশ্ন করেছিল, এরা তোমার সঙ্গে ছবিতে কারা মা? ওর মা বোধহয় বুঝেছিল, সব কিছু মেয়েকে জানানোর সময় এসেছে। সব কিছু হা, সব কিছুই জেনেছিল জুলিয়া, চিনেছিল সত্য। সৎ দাদাদের, সৎ দিদিকে। উনি কি করে তোমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে পারলেন? বাবার প্রতি ঘৃণা বোধের বীজ সেই প্রথমবার প্রোথিত হয়েছিল তার মনে।
বাবার থেকে দূরে থাকলেও বিখ্যাত ধনকুবের পিতার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য তার নেশা হয়ে উঠল। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ দেখলেই, হ্যারী স্ট্যানফোর্ড সম্পর্কে কোন লেখা খবর তথ্য বের হতো, জেনে রাখত, জোগাড় করে নিতো। একসময় তার মায়ের এক নাগাড়ে বেশিদিন কোথাও না থাকা, এক শহর থেকে অন্য শহরে পালিয়ে বেড়ানোর সঠিক কারণ সে খুঁজে পেলো। সংবাদ মাধ্যম, কেচ্ছা সন্ধানী, গুজব, অনুসন্ধিৎসু সংবাদ মাধ্যম তাড়া করে বেড়াত রোজমেরী নেলসনকে। হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের প্রেমিকা ও তার অবৈধ সন্তান এখন কোথায়, কীভাবে আছে জানার জন্যে মুখরোচক কেচ্ছা বর্ণনাসহ কাগজের পাতায় তা তুলে ধরার জন্যে রোজমেরীর পিছু তাড়া করে বেড়াত কেচ্ছা লোভী কুকুরের দল। আর নিজেকে, নিজের ও মেয়ের সম্মান বাঁচাতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো রোজমেরীকে। আর জুলিয়া পিতৃ পরিচয় জানবার পর একটু বড় হতেই যখনি হ্যারী স্ট্যানফোর্ড-এর কোন ছবি দেখত অথবা কোন খবর পড়ত, টেলিভিশনে দেখতে পেতো, বাবাকে ফোন করার এক তীব্র অপ্রতিরোধ্য স্পৃহা বোধ করত। বাবা, আমি তোমার মেয়ে বলছি, তুমি কি আমায় দেখতে চাও–দুচোখ বুজলেই, স্বপ্নের মত অথচ স্বপ্ন নয়, জুলিয়া দেখতে পেতো-বাবা এসেছেন। মায়ের প্রতি অবাক ভালবাসায় পড়েছেন। মাকে বিয়ে করলেন। সব ঠিকঠাক, স্বাভাবিক হয়ে গেল। ওরা সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে লাগল। এই স্বপ্নের মত বাস্তব ইচ্ছে অথবা বাস্তবের ইচ্ছে যা স্বপ্নই, বাবা এবং মাকে আবার একসঙ্গে মিলিত করার সেই প্রখর কামনা, শেষ হয়ে গেল, শূন্যে মিলিয়ে গেল, যেদিন মায়ের মৃত্যু হলো।
এ খবরটা অন্তত আমার বাবার জানা উচিত। তাকে জানানো উচিত। এই বোধ থেকে মায়ের মৃত্যুর তৃতীয় দিনে বোস্টনে ফোন করে জুলিয়া, হালো স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইস? ফোন ধরে রেখে ইতস্তত করে জুলিয়া, হ্যালো, কে বলছেন? উত্তরহীন জুলিয়া ফোনটা নামিয়ে রাখে। মা নিজেও বোধ হয় চাইতেন না, যা সে করতে যাচ্ছিল।
সে একা হয়ে গেল। আজ থেকে তার কেউ নেই। জুলিয়া একজন অত্যন্ত সৌন্দর্যবতী যুবতী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর সবার আগে তার কাছে প্রশ্ন হয়ে উঠল জীবনধারণের জন্য সে কি করবে? অতুলনীয় রূপের জন্যেই কেউ কেউ তাকে ফিল্ম অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেবার পরামর্শ দিলো। প্রস্তাবটা এককথায় উড়িয়ে দেয় সে। কারণ সেক্ষেত্রে এতদিন ধরে তার মা সংবাদ মাধ্যমের থেকে সেটা লুকিয়ে রেখেছে সেই অতীত, গোপনতা হারাবে, প্রকাশিত হয়ে পড়বে। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য কিছু তো করতে হবে। কিন্তু কী তা? শেষ পর্যন্ত জুলিয়া একটা সেক্রেটারিয়াল কোর্স করে এবং একটি অংশীদারী মালিকানা কোম্পানীতে চাকরীও জোগাড় করে ফেলে। যদিও সে জানত এটা শুধুই শুরু। বহুদূর এগোতে হবে। এগোবে সে এই পথ ধরে।
.
১২.
এ-এক অদ্ভুত পারিবারিক মিলন। একই পরিবারের একদল অচেনা অপরিচিত মানুষ মুখোমুখি হলো। যাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ সংযোগ খুবই কম। বহু বছর হয়ে গেছে ওদের মধ্যে শেষ দেখা সাক্ষাৎ হবার পর। যাই হোক, হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের বংশধরদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, অন্তিম কাজ সম্পন্ন হবে কিংস চ্যাপেলে। যেহেতু হ্যারী। স্ট্যানফোর্ডের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে দেশ বিদেশের নানা বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছিলেন, তাই গির্জার ভেতর বাইরে নিরাপত্তা কড়াকড়ি ছিল। পুলিশ নিরাপত্তা কর্মীতে থিকথিক করছিল জায়গাটা। গির্জার ভেতর ওরা ভাই বোনেরা মিলিত হলো। অস্বস্তিজনক সেই মিলন। অপরিচিতদের মুখোমুখি হবার মতই বিব্রতকর। বেনডাল, মার্কের সঙ্গে অন্যদের আলাপ করিয়ে দিল। পেগির সঙ্গে ভাই বোনের পরিচয় করিয়ে দিল উডবরাও। ভদ্র বিনীত ভঙ্গীতে আন্তরিকতার আবেগ উচ্ছ্বাসহীন, যথার্থ অচেনাদের মত আলাপ পর্ব শেষ হলো।
এক সময় অন্ত্যেষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হলো।
টাইলারের কাছে বস্টনে ফিরে আসাটা মিশ্র অনুভূতিময়। জঘন্য, ভুলে যেতে চাওয়া স্মৃতির সঙ্গে ভাল সুন্দর কিছু স্মৃতিও আছে মায়ের, রোজমেরীর। যখন তার বয়স এগারো, সে একটা ছবি দেখেছিল। গইয়ার বিখ্যাত ছবি স্যাটার্ন ডেভভারিং হিজ সন এবং সর্বদাই সে নিজের পিতাকে ঐ ছবিতে খুঁজে পেয়েছে। শয়তান আজ মৃত। বাবার কফিনের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার কানের পাশে অপার্থিব অনুরণনটা আবার : টের পেলেন জাজ টাইলার স্ট্যানফোর্ড–আই নো ইয়োর ডার্টি লিটল সিক্রেট।
উডির কাছে পরিস্থিতিটা অসহ্যকর মনে হচ্ছিল। যার জন্য মনে সামান্যতম শ্রদ্ধা ভালবাসা নেই তারই জন্যে শোকের ভান করা, বসে থাকা। এসব নাটক তার অসহ্য বিরক্তিকর লাগে। উসখুশ করতে করতে সে তার ভাই বোনেদের দিকে তাকায়। টাইলার বেশ ওজন চড়িয়েছে শরীরে। ওকে বেশ ভারিক্কী লাগে। বিচারকের মানানসই। বেনডাল দারুণ সুন্দরী হয়েছে। তবে ওকে কিছুটা শান্ত মনে হচ্ছে। বাবার মৃত্যুর কারণেই কি? শোকে? না, বাবাকে অন্য ভাই বোনেদের মতই মনের থেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করত বেনডালও।
বেনডালের মন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিকে ছিল না, যান্ত্রিকভাবে ঘটে যাওয়া সব কিছুর ওপর সে আলতো চোখ রাখছিল। কিছু শুনছিল না। কিছু বোঝার চেষ্টাও করছিল না।
পেগি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। এরা সবাই তার থেকে অনেক উঁচু স্তরের মানুষ। এত সব গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিত্তের চোখ বাধানো প্রদর্শনীর মাঝে সে নিজেকে দলছুট মনে করে।
মার্ক রেনর একমনে ব্ল্যাকমেইলের চিঠিটার কথা ভেবে যাচ্ছিল। খুব সতর্কভাবে শব্দবাছাই করে দারুণ বুদ্ধির সঙ্গে চিঠিটা লেখা। পড়ে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই কে এর পেছনে। মার্ক স্ত্রীর দিকে তাকায়। শ্রান্ত দেখাচ্ছে। আর কত নেবে, নিতে পারে এই দুর্বিপাকের রাশি? স্ত্রীর প্রতি এক অসীম মমত্ব বোধ করে সে।
অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শেষ হবার পর হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মরদেহ সহ শবাধারটি তুলে দেওয়া হল শবদেহ বহনকারী যানে। পিছনে চলল আত্মীয় বন্ধু, গণ্যমান্যদের নিয়ে গাড়ীর বিরাট মিছিল। ঘন্টা খানেকের মধ্যে শবদেহসহ আধারটি মাটির নিচে কবরস্থ হলো। গাড়ীর মিছিল আবার ফিরে চলল। রোজ হিলের বাড়ীতে ফিরে আসার পর, বহুদিনের পুরনো চাকর ক্লার্ক, যার বয়স এখন সত্তরোর্ধ, ওদের অ্যাপায়ন করল। দুই পরিচারিকা ইভা ও মিলি সবাইকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে দিতে চলল। সে সময় ক্লার্ক টাইলারের দিকে তাকিয়ে বলল,–বিচারক টাইলার আপনার জন্যে একটা খবর আছে। সাইমন ফিৎজেরাল্ড আপনাদের সবার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। তার তরফে আপনাদের কিছু বলার আছে। উনি ফোন করে জানাতে বলেছেন আপনারা কখন ওকে সময় দিতে পারবেন। মার্ক প্রশ্ন করে, সাইমন ফিৎজেরাল্ড ভদ্রলোকটি কে? ক্লার্ক সবিনয়ে জানায়, উনি স্ট্যানফোর্ড পরিবারের এ্যাটনী। টাইলার বিচারক সুলভ গাম্ভীর্য ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তুলে বলে, তার মানে ফিৎজেরাল্ড হয়ত বাবার সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্যেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। তোমাদের কারো যদি আপত্তি না থাকে তাহলে কাল সকালে ওনাকে সময় দিই। এ ব্যাপারে কারোরই কোন আপত্তি দেখা গেল না। ক্লার্ককে বলে দেওয়া হলো, সে যেন ফিৎজেরাল্ডকে জানিয়ে দেয় পরদিন সকাল নটার সময় স্বর্গত ত্যারী স্ট্যানফোর্ডের বাড়ীর পড়বার ঘরে ওরা তার সঙ্গে মিলিত হবে।
পরদিন সকালে যথা সময়ে ফিৎজেরাল্ড এবং সোলানে এসে হাজির হলেন। ক্লার্ক তাদের হ্যারী স্ট্যানফোর্ড-এর পড়ার ঘরে নিয়ে আসে। তিন ভাইবোন তাদের স্বামী স্ত্রী অপেক্ষা করছিল। সোলানের মনে পড়ে পথে আসতে আসতে সাইমন বলেছিল, একটা উৎসাহ ব্যঞ্জক অন্য রকম সকাল হতে চলেছে। ব্যাপারটা শুনে ওদের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন কিরকম হবে ভেবে আমার যথেষ্ট উৎসুক্য জাগছে। কী বোঝাতে চেয়েছিল, সাইমন ঐ কথাটার মধ্যে দিয়ে? ফিৎজেরাল্ড ঘরের মানুষগুলোর দিকে পর্যবেক্ষণময় চোখে তাকায়। সবাই, সব কজন নিজেদের সহজ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ওদের সবার মুখেই আগ্রহ ঔৎসুক্যের রেখাচিত্র। শরীরগুলোয় টানটান উত্তেজনা। সাইমন ফিৎজেরাল্ড কথা শুরু করেন। আপনারা জানেন…প্রয়াত হ্যারী স্ট্যানফোর্ড… ফিৎজেরাল্ড বলেই চলেন। সারা ঘরে এক অদ্ভুত নীরবতা। অস্বস্তিকর উশখুশে ভাব। হঠাৎ উড়ি বাধা দেয়, ওসব তো ইতিহাস, পুরনো কথা হয়ে গেছে। আপনি বরং সরাসরি কাজের কথায় আসুন। বাবার উইল সে প্রসঙ্গে বলুন। টাইলার সমর্থন সূচক মাথা নাড়ে। সাইমন ওদের সবার মুখের দিকে আরেক ঝলক নজর বুলিয়ে নিয়ে বলেন, বেশ ভাল কথা। তবে সে প্রসঙ্গেই আসি। তিনি তার হাতের চামড়ার ব্রিফকেসটা খুলে কয়েক গোছা কাগজপত্র বের করলেন। উডি অধৈর্য ভঙ্গীতে হাতের তালুতে হাত ঘষতে ঘষতে প্রায় ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে বলে, আমি জানতে চাই, বুড়োটা আমাদের জন্য এক সেন্টও রেখে গেছে কিনা। টাইলার চাপা ধমকের সুরে বলে, উডি। উডি প্রায় ফেটে পড়ে। আমি জানি, হতচ্ছাড়া, নচ্ছার বুড়োটা আমাদের জন্য কানাকড়িও দিয়ে যায়নি।
সাইমন ফিৎজেরাল্ড শান্ত ধীর চোখে ধনকুবের প্রবাদসম শিল্পপতি হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের বংশধরদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কেটে কেটে শান্ত স্বরে তিনি বলেন, বাস্তব সত্যি কথাটা হলো, আপনাদের সবাইকে তিনি তার সম্পত্তির সমান অংশীদার করে গেছেন। কথাটা শেষ হওয়া মাত্র সারা ঘর জুড়ে যেন এক অপার্থিব নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল অকস্মাৎ। প্রথম কথা বলতে পারল উডিই বেশ কিছু সময় পর, কি বলছেন? তার কণ্ঠস্বর ভাঙ্গা আর্তনাদের মত শোনায়। আপনি সত্যি বলছেন তো? উত্তেজনায় সে দাঁড়িয়ে ওঠে। ফিজেরাল্ড এবং স্টিভ সোলানে ঘরের মধ্যে বয়ে যেতে থাকা আচমকা বিদ্বেষ, ঘৃণা, বিরক্তিপূর্ণ মনোভাবের আবহাওয়াটা খুশির উচ্ছ্বাসের মধুরতায় পরিবর্তিত হয়ে যেতে দেখল। ফিৎজেরাল্ড তার পেশাদারী নিরাসক্ত। গাম্ভীর্যের আড়াল থেকে ঘোষণা করলেন, মোটামুটি, আপনাদের প্রত্যেকের ভাগে একশো কোটি ডলার করে পড়বে। ঘরের সবাই বাক্যরহিত, যেন স্বপ্নহত। ফিৎজেরাল্ড গলা খাকারী দিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ করে ওদের বাস্তবের জগতে টেনে নামিয়ে আনলেন। ঠিক আছে। সম্পত্তি হস্তান্তরের আইনি প্রক্রিয়াগুলো সম্পূর্ণ হলে আমি তবে জানাব আপনাদের। যে যার অংশ বুঝে নেবেন। পুরো ব্যাপারটার ঘোর তখনো ওদের কাটেনি। কিছুক্ষণ আগেও ওরা ছিল নগণ্য অতি সাধারণ। আর মাঝখানে মাত্র দুতিন মিনিটের ব্যবধান। পৃথিবীর সেরা একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অংশীদার মালিক। একশো কোটিরও বেশির মালিক। পৃথিবীর অন্যতম ধনকুবের। ব্যাপারটার অভিঘাত তীব্রতা হজম করতে ওদের সময় তো লাগবেই।
একশো কোটি ডলার অথবা আরো বেশি, ওরা যে যার নিজস্ব উজ্জ্বল ভবিষ্যতের না পূরণ হওয়া স্বপ্নগুলো সার্থক হয়ে ওঠার সুখ স্বপ্ন দেখতে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। ফিজেরাল্ড তাকালেন, এদের স্বপ্নাতুরতা ভেঙ্গে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে বারবারই তাকে এই অস্ত্রটার প্রয়োগ ঘটাতে হচ্ছে। আপনারা হয়ত জানেন, সমস্ত কোম্পানীগুলো মিলে যে স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইস, তার ৯৯ শতাংশ শেয়ার ছিল আপনার বাবার দখলে। ঐ শেয়ারগুলো আপনাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, আপনারা তিনভাই বোন ছাড়াও, আপনার বাবার সম্পত্তির আরো একজন উত্তরাধিকারী আছেন। আরো একজন উত্তরাধিকারী? ওদের তিনজনের গলা থেকে ছিটকে বের হওয়া বিস্ময়সূচক প্রশ্নটাকে সমবেত আর্তনাদের মত শোনায়। হ্যাঁ, স্বাভাবিক। বিবাহসূত্রের তিন উত্তরাধিকারী ছাড়াও, আপনার বাবার বিবাহ বহির্ভূত একজন উত্তরাধিকারী আছেন। আইনত যিনি বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারীনি হবার অধিকারী। আইন অনুযায়ী এই সমর্থন বিবাহ সম্পর্ক বহির্ভূত সন্তানের পক্ষে থাকবে। এ ব্যাপারে আপনাদের বাবা সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই তিনি তাকে বঞ্চিত করেন নি। বা কোন অন্যায় উদ্দেশ্যও তার ছিল না। লম্বা বক্তৃতা শেষ করে ফিৎজেরাল্ড শ্বাস ছাড়লেন। দম নিলেন। সেই সামান্য ফুরসতেই বেনডাল ব্যগ্র অতি উৎসাহী এবং সামান্য উদ্বিগ্নতা মেশা গলায় প্রশ্ন করে, কে, কে সে? ওর প্রশ্নে অন্য দুভাইয়ের গলার আওয়াজও যেন প্রতিধ্বনিত হয়। ফিৎজেরাল্ড সামান্য ইতস্তত করেন। একজন কৃতি পিতার, সফল মানুষের অবৈধ সন্তানের কথা তার ছেলে মেয়েদের কাছে জানাতে এই দ্বিধাটুকু স্বাভাবিকই। বহু বছর আগে, এ বাড়ীতে তাঁর ছেলে মেয়েদের দেখা শোনার জন্যে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড একজন গভর্নের্স রেখেছিলেন। রোজমেরী নেলসন, টাইলার জানায়। হ্যাঁ, সেই রোজমেরী, আপনাদের মায়ের মৃত্যুর পর যখন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। বলা বাহুল্য…। কথা শেষ না করে, অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে ফিজেরাল্ড এ ঘরের মানুষদের মুখগুলো নিরীক্ষণ করতে লাগলেন সময় নিয়ে।
সারা ঘর জুড়ে পিন পতন কবর অভ্যন্তরের স্তব্ধতা। সেই মেয়েটির, হারীর ঔরসজাত রোজমেরীর যে মেয়ে হয়েছিল, তার নাম জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড। ফিৎজেরাল্ড তার কথা শেষ করলেন। বেনডাল ধীর নীচু গলায় প্রশ্ন করে, মেয়েটি এখন কোথায়? সাইমন ফিজেরাল্ড মাথা নাড়ে, না, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ওর কোন খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। উডি অসহিষ্ণু গলায় বলে, তাহলে এসব কথা উঠছে কেন? সাইমন তার পেশাদারীত্ব বজায় রেখে বললেন, ব্যাপারটা আমি আপনাদের একারণেই বলে আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম, কারণ ভবিষ্যতে কখনো কোনদিন যদি সে এসে হাজির হয় তবে কিন্তু আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে সেও আপনাদের বাবার সম্পত্তির সমান অংশ দাবী করতে পারবে। সমান অংশীদার হিসেবে তাকে মেনে নিতে আইনগত ভাবে আপনারা বাধ্য থাকবেন। উডরোও আত্মবিশ্বাসের গলায় বলে, ভুলে যাও। ওরকম দিন কখনো আসবেই না। মেয়েটি হয়ত জানেই না। কোনদিন জানতে পারবেও না, কে তার বাবা।
সাক্ষাৎকার পর্ব, কথাবার্তা শেষ করে স্ট্যানফোর্ডদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে এসে বসে সাইমন ফিৎজেরাল্ড আগ্রহ ভরা চোখে স্টিভ সোলানের দিকে তাকালেন। স্ট্যানফোর্ড পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে কথাবার্তা বলে, তোমার কি অনুভব হচ্ছে স্টিভ? সোলানে মাথা নাড়ে, শোকের পরিবেশ থেকে একটা পারিবারিক মিলন উৎসবের আবহাওয়া মনে হচ্ছিল। একটু থেমে স্টিভ সঙ্গে সঙ্গেই নিজের কথার খেই ধরে, আচ্ছা স্ট্যানফোর্ড নাকি তার ছেলে মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই ঘৃণা অপছন্দ করতেন। অথচ সেই ছেলেমেয়েদের জন্যই তিনি নিজের বিশাল সম্পত্তি দিয়ে গেলেন কেন? সাইমন একটা, গভীর শ্বাস ছাড়লেন। এ রহস্যের প্রশ্নের উত্তর জানবার আজ আর কোন উপায় নেই। তবে একটা কথা আমার মনে হচ্ছে, হয়ত তিনি সম্পত্তির পুরোটা বা কিছু অংশ অন্য কাউকে দেবার কথা, বর্তমান উইল-এর পরিবর্তন করার কথা ভেবেছিলেন। তাই আমাকে জরুরী তলব করেছিলেন।
সে রাতে ওদের কারোরই ভাল করে ঘুম হলো না। চুড়ান্ত উত্তেজনায় অস্থির মস্তিষ্কে হাতুড়ীর ঘা মেরে চলল একশো কোটিরও বেশি সম্পত্তির মালিকানা শব্দগুলো। যে যার নিজস্ব সুখ স্বপ্নের ভবিষ্যতের অবয়ব দেখতে পাচ্ছিল। টাইলার ভাবছিলো অবশেষে এটা সত্যিই ঘটল। এখন লিকে আমি তার যা ইচ্ছে হবে তাই এনে দিতে পারব। বেনডালের চিন্তা একটাই বেজন্মাগুলোকে আমি এবার একেবারেই কিনে নিতে পারব। সারাজীবন ধরে ওদের হাতে নিষ্পেষনের শিকার হওয়া থেকে মুক্তি এবার। উডির কল্পনাও আকাশ ছোঁয়া, আমি নিজের একটা পোলো দল তৈরি করব। পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে ওদের সবাইকেই খুশি খুশি, উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। প্রাতরাশ সারতে সারতে ওরা নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে কথা বলছিল। তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছ। কিভাবে টাকাটা খরচ করবে? উডি বলে। মার্ক কাঁধ ঝাঁকায়, একশো কোটিরও বেশি, কয়েক হাজার ডলার তো নয়। ঐ বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার পরিকল্পনা করা কি এত সহজ? এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়, মার্কের কথায় অন্যেরা সশব্দে সমবেত ভাবে হেসে ওঠে। এমন সময় ক্লার্ক ঘরে ঢোকে। সবাইকে বিনীতভাবে অভিবাদন জানিয়ে সে বলে, কুমারী জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড এসেছেন। তিনি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান।