পরবর্তী কয়েকটা সপ্তাহ কোথা দিয়ে কেটে গেল জেনিফার টের পেল না। সপিনা বিলি করার কাজে প্রচণ্ডভাবে ব্যস্ত সে–ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। সে খুব ভালোভাবেই জানে, কোনো বড়ো প্রতিষ্ঠান তাকে চাকরি দেবে না। নিজের ব্যবস্থা নিজে করা ছাড়া উপায় নেই।
তখন পিবডি অ্যান্ড পিবডি প্রতিষ্ঠানের গোছ গোছা শমন আর সপিনা এসে জমা হচ্ছে জেনিফারের ডেস্কের ওপর। অবশ্য এই কাজটাকে সে কখনোই আইনজীবীর পেশা হিসেবে গণ্য করে না। কিন্তু জীবন ধারণের জন্য মোটামুটি উপার্জন তো করতে পারছে। সাড়ে বারো ডলার তাকে দেওয়া হয় প্রতি সমন ও শপিনা পিছু। যাতায়াতের জন্য গাড়িভাড়াও তার পকেট থেকে যায় না।
অনেক সময় কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যায়, তখন সে কেনেথ বেইলি আর অটো ওয়েনজেলকে সঙ্গে নিয়ে ডিনার খেতে যায়।
কেনেথ বেইলিকে দেখে জেনিফার প্রথম প্রথম ভুল ধারণা করেছিল, রুক্ষ ও কঠোর প্রকৃতির জীবনের প্রতি কোনো টান নেই। তবে কয়েকদিন পরেই তার এ ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হল। সে তার সম্পর্কে আর একটা তথ্য আবিষ্কার করেছে–কেনেথ নিঃসঙ্গ। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেনেথ গ্রাজুয়েট হয়েছে, প্রচুর পড়াশুনা করেছে। অথচ এই লোকই ঘিঞ্জি নোংরা অফিস ঘরে বসে, কার হারিয়ে যাওয়া বউ বা স্বামী, অথবা ছেলেমেয়ের অনুসন্ধান করে খবর এনে দিচ্ছে। কেন যে সে জীবনটাকে এমনভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে, জেনিফার জানে না। সম্ভবত কোনো কারণে জীবনে এগিয়ে যাবার পথে প্রথমেই বিশ্রী এক প্রতিরোধের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। তাই আজ সাফল্যের কথা ভাবতে ভয় পায়।
কথা প্রসঙ্গে জেনিফার তাকে বিয়ের কথা বলেছিল। কেনেথ বেইলি ভীষণ চটে গেল। চিৎকার করে বলল–ওসব নিয়ে আপনাকে না ভাবলেও চলবে।
এরপর থেকে জেনিফার তার কাছে বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না।
আর অটো ওয়েনজেল? কেনেথ বেইলির সম্পূর্ণ উল্টো পিঠ, মোটা ও বেঁটে চেহারার লোকটা বিয়ে-থা করে সুখেই ঘরকান্না করছে। সে জেনিফারকে মেয়ের মতো স্নেহ করে, বাড়ি থেকে বউয়ের বানিয়ে দেওয়া কেক আর স্যুপ সে মাঝে মধ্যে জেনিফারকে খেতে দিয়েছে। জেনিফার খেতে চায় না। কিন্তু ভয়, যদি অটো ওয়েনজেল দুঃখ পায়, সে জন্য সে যা পেত, সব খেয়ে নিত, আপত্তি করত না।
সেদিন ছিল শুক্রবার। ডিনারে নিমন্ত্রণ করল অটো। জেনিফার তার বাড়িতে গেল। একটা বিশ্রী রান্না বেঁধেছিল তার বউ। চাল, বাঁধাকপি আর মুরগির মাংস দিয়ে বানানো একটা নতুন পদ। খেতে বসে জেনিফারের বমি পাচ্ছিল-বাঁধাকপি আর চাল আধসেদ্ধ, মাংসটা চামড়ার মতো শক্ত আর সিটানো। সে কোনোরকমে ডিনার সেরেছিল।
খাবারগুলো কেমন খেতে লাগছে? আগ্রহ ভরে অটোর বউ জানতে চাইল।
–ওহ দারুণ। জেনিফারের ঠোঁটে কৃত্রিম খুশীর আভাস, এই পদটা খেতে আমি ভীষণ ভালোবাসি।
এরপর থেকে প্রতি শুক্রবার তাকে অটো ওয়েনজেলের বাড়িতে যেতে হত ডিনার। খেতে। অটোর বউ জেনিফারের প্রিয় পদটি রান্না করে খেতে দিত।
.
সকাল হয়েছে। ফোন বেজে উঠল।
মিস পার্কার, আমি মিঃ পিবডি জুনিয়ারের সেক্রেটারী বলছি, মিঃ পিবডি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। আজই, সকাল এগারোটায়। দয়া করে ওই সময় আপনি একবার আসবেন।
-ঠিক আছে, ম্যাডাম।
পিবডি আর পিবডি একটি নামকরা বড়ো আইন প্রতিষ্ঠান। সপিনা আর শমন বিলি করার সুবাদে এখানকার ডজন ডজন সেক্রেটারী আর কেরানীদের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। অল্পবয়সী উকিলরা আইন পাশ করে এখানে চাকরিতে ঢুকতে পারলে বর্তে যায়। পিবডি অ্যান্ড পিবডি প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে জেনিফার বেরিয়ে পড়ল। তারও মনে কত স্বপ্নের আনাগোনা। পিবডি স্বয়ং তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হয়তো তার মধ্যে প্রচুর সম্ভবনা লক্ষ্য করেছেন। তাই নিজে থেকে ডেকে তাকে চাকরি দিতে আগ্রহী। জেনিফারের মধ্যে যে এলেম আছে, তা তিনি প্রমাণ করে দেখাবার সুযোগ দিতে চাইছেন। সত্যি, এমন সুযোগ যদি জেনিফার পায়, তাহলে সবাইকে একেবারে অবাক করে দেবে। এমনও তো হতে পারে, কোনো একদিন সে এই কোম্পানীর একজন অংশীদার হয়ে উঠেছে। তখন এই কোম্পানীর নাম পিবডি, পিবডি অ্যান্ড পার্কার।
এগারোটার অনেক আগেই জেনিফার নির্দিষ্ট অফিসে এসে ঢুকল। বাইরের করিডরে আধঘন্টা কাটিয়ে দিল। ঘড়ির দিকে তাকাল। পাক্কা এগারোটা। সে রিসেপশনে ঢুকল। তারপর দু-ঘন্টার প্রতীক্ষা। ডাক এল।
পাতলা ছিপছিপে চেহারা মি. পিবডি জুনিয়ারের। পরনে স্যুট ও পায়ে দামী জুতো। সবই লন্ডনের তৈরী।
উনি জেনিফারকে বসতে না বলে রুক্ষ কর্কশ গলায় বললেন মিস পটার–
পার্কার, জেনিফার ভুলটা ঠিক করে দিল।
এক টুকরো কাগজ তিনি এগিয়ে দিতে দিতে বললেন–এটা একটা শমন। আপনাকে এটা পোঁছে দিতে হবে।
জেনিফার বুঝতে পারল, তাকে চাকরি দেওয়ার জন্য ডাকা হয়নি।
–এই কাজটা করতে পারলে আপনাকে পাঁচশো ডলার দেওয়া হবে পারিশ্রমিক হিসেবে।
–আঁ, জেনিফার আঁতকে উঠল। পাঁচশো ডলার!
–হ্যাঁ, পাঁচশো ডলার, যদি কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারেন।
জেনিফারের বুঝতে আর দেরী হল না, কাজটা সহজ সোজা সাপটা নয়।
–শুনুন মিস পটার, জেনিফার এবার আর তার ভুল শুধরে দিল না। গত এক বছর ধরে আমরা লোকটার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। লোকটা হল উইলিয়াম কারলাইন। লং আইল্যান্ডে বাস করে লোকটা। নিজের ওই বাড়ির মধ্যেই সর্বদা থাকে, বাইরে বেরোয় না। একডজন লোক শমন বিলি করতে গিয়ে দরজা থেকেই ফিরে এসেছে। গেটে এক প্রহরী কাম বাটলার আছে। সে কাউকেই কারলাইনের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
কীভাবে যে কাজটা
–এটা প্রচুর টাকার ব্যাপার, মি. পিবডি জুনিয়ার একটু ঝুঁকে পড়ে বলতে থাকলেন, ওই লোকটাকে কিছুতেই আদালতে হাজির করাতে পারছি না। শমন বিলি না করা অব্দি কিছু করা যাবে না। আপনার পক্ষে কি কাজটা করা সম্ভব?
তখন জেনিফারের মাথায় ঘুরঘুর করছে পাঁচশো ডলারের ছবি। কীভাবে টাকাটা খরচ করবে তা ভাবছে। বলল–দেখি, উপায় তো একটা বের করতেই হবে।
.
সেদিন ঠিক মধ্যে দুপুরে জেনিফার এসে হাজির হল লং আইল্যান্ডে। উইলিয়াম কার লাইনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দশ একর জায়গার ঠিক মাঝখানে প্রাসাদোপম বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটির চারদিকে সুন্দর সুন্দর ফুল ও ফলের বাগান।
কী করে কাজটা হাসিল করবে, সেটাই ভাবতে লাগল জেনিফার। আগেই সে জেনেছে বাড়িতে ঢোকা অসম্ভব। তাহলে যে কোনো উপায়ে মিঃ কারলাইনকেই বাড়ির বাইরে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু
হঠাৎ সে দেখল, পথের ঠিক মাঝখানে বাগানের মালির ট্রাক দাঁড়িয়ে। সে পায়ে পায়ে ট্রাকটির সামনে এসে দাঁড়াল। তিনজন জাপানি কাজ করছে।
মালিদের প্রধান কে?
জেনিফারের প্রশ্ন শুনে একজন জাপানি এগিয়ে এল–আমি।
একটা ছোট্ট কাজ তোমাকে করে দিতে হবে।
দুঃখিত মিস, আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।
–পাঁচ মিনিট মাত্র লাগবে।
–তাহলেও হবে না।
–তোমরা প্রত্যেকে একশো ডলার করে পাবে। কী রাজী? মালিরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল বোকার মতো–পাঁচ মিনিটের কাজের জন্য একশো ডলার করে দেবেন?
-হ্যাঁ, দেব।
–আমরা রাজী, বলুন, কী কাজ?
পাঁচ মিনিট বাদে দেখা গেল মালির ট্রাকটা এসে ঢুকল উইলিয়াম কারলাইনের বাগানের ভেতর। তিনজন জাপানি আর জেনিফার সেই গাড়ি থেকে নামল। চারপাশে ভালো করে লক্ষ্য করল সে। তারপর একটা সুন্দর গাছের দিকে আঙুল তুলে বলল–তোমরা ওই গাছের গোড়াটা খুঁড়তে থাকো।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল কাজ। শাবলের আঘাত এসে পড়তে থাকল গাছের গোড়ায়। আধমিনিটের মধ্যেই বাড়ির দরজা সশব্দে খুলে গেল। ছুটে এল একটা বিশাল দেহের লোক, পরনে বাটলারের পোশাক।
থামো। থামো! লোকটা ছুটে এল, কী করছ?
লং আইল্যান্ড নার্সারি থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে। জেনিফারের কন্ঠে সামান্য ভয়ও নেই। ওই গাছগুলো তুলে নিয়ে যাব।
কী বলছেন আপনি?
বিশাল দেহী লাকটির চোখে অবিশ্বাস।
–বললাম, এখানকার সব গাছ তুলে নিয়ে যাব। ধরো সরকারী হুকুম। এই বলে জেনিফার এক টুকরো কাগজ লোকটির হাতে তুলে দিল। অসম্ভব। এই হুকুম দেখলে মি. কারলাইন অজ্ঞান হয়ে যাবেন। লোকটি এবার তিন জাপানির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা শাবল চালানো বন্ধ করো।
সাবধান। জেনিফার গর্জে উঠল, কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করো না।
-শুনুন, লোকটি বোঝানোর চেষ্টা করল, নিশ্চয়ই আপনার কোনো ভুল হচ্ছে। এরকম কোনো হুকুম মি. কারলাইন দেননি।
উনি দেন নি তো কী হয়েছে, আমার মালিক দিয়েছেন।
উনি এখন কোথায়?
উনি ব্রুকলিনে গেছেন, বিশেষ কাজে। অফিসে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। লোকটি বড়োবড়ো চোখে জেনিফারের দিকে তাকাল, পারলে যেন তাকে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। বলল–বেশ, একটু থামুন। আমি আসছি মিনিট খানেকের মধ্যেই, কোনো কিছুতে এখন আর হাত দেবেন না।
বাটলার লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
কয়েক মিনিটের নীরবতা।
বেঁটেখাটো মাঝবয়সী একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে বাটলার ফিরে এল।
–এসবরে অর্থ কী? বেঁটে লোকটা জেনিফারকে প্রশ্ন করল।
আপনার অতশত জেনে লাভ কী? জেনিফার পাল্টা প্রশ্ন করল।
লাভ তো আছেই। এটা আমার জমি। আমি হলাম উইলিয়াম কারলাইন।
–ও, আপনিই উইলিয়াম কারলাইন। জেনিফার দ্রুত পকেট থেকে শমনটা বের করে ওর হাতে খুঁজে দিল, এটা দিতেই আমি এখানে এসেছিলাম। তারপর মালিদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের কাজ শেষ।
উইলিয়াম কারলাইন কিছু বোঝার আগেই জেনিফার সেখান থেকে সরে পড়ল।
পরদিন খুব সকালে অ্যাডাম ওয়ার্নার ফোন করল।
-শোনো জেনিফার, গলাটা শুনেই জেনিফার বুঝতে পারল কে ফোন করছে, তুমি সত্যিই দুশ্চিন্তা মুক্ত হলে। তোমাকে বার থেকে বহিস্কৃত করার যে মামলা দায়ের করার কথা ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে।
জেনিফার দুটি চোখ বন্ধ করল। গাল বেয়ে জলধারা গড়িয়ে পড়ছে খুশীতে। পরম করুণাঘন ঈশ্বরকে তার কৃতজ্ঞতা জানাল। অ্যাডামের প্রতিও জানাল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা সত্যি, তোমাকে যে কীভাবে ধন্যবাদ জানাব, জানি না। জীবনে তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না।
জেনিফার, ধন্যবাদ আমার প্রাপ্য নয়। ধন্যবাদ দাও আইনকে, অ্যাডাম বলতে থাকে, আইনের চোখ বাঁধা বলে সে কিন্তু অন্ধ নয়।
অবশ্য এর জন্য মামাশ্বশুর স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম আর ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি ডি সিলভার কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে, জেনিফারকে ইচ্ছে করেই সেকথা বলল না।
–ওই হারামজাদীকে তুমি ছেড়ে দিচ্ছো অ্যাডাম। রাগে গজগজ করতে থাকে রবার্ট ডি সিলভা। মাফিয়াদের সঙ্গে ওর ওঠা-বসা আছে। আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। আর তুমি কিনা ওই নচ্ছার মেয়েটাকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করছে। সাবধান, ও তোমাকেও বিপদে ফেলবে।
রবার্ট, আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। অ্যাডাম শান্ত গলায় বলতে লাগল, আপনি জেনিফারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করেছিলেন, তা ছিল পারিপার্শ্বিক। কিন্তু আমি তদন্তে জেনেছি, ও মাফিয়াদের পাতা ফাঁদে নিজের অজান্তেই পা দিয়েছিল। মাফিয়াদের সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি
থামো, ডি সিলভা মন্তব্য করলেন, তার মানে তোমার জেনিফার পার্কার আগের মতোই উকিল থাকছে, তাই তো? বার থেকে কেউ ওকে তাড়াতে পারবে না। তবে তুমি জেনে রাখো, আমার হাত থেকে ও রেহাই পাবে না। কোনো একটা মামলায় ওকে পাই, দেখবে এমন কোণঠাসা করে ছাড়ব যে পালাবার পথ পাবে না। ওর ভবিষ্যৎ কালো করে ছাড়ব আমি।
অ্যাডাম জানে, ডি সিলভা অত্যন্ত প্রতিহিংসা পরায়ণ, জেনিফারের এক প্রবল শত্রু। জেনিফার এমনই এক নরম ও স্পর্শকাতর লক্ষ্যস্থল যেখানে তীর নিক্ষেপ করা ডি সিলভার পক্ষে কঠিন কাজ নয়।
জেনিফার অসাধারণ রূপবতী, মেধাবী, আদর্শবাদী আইনজীবী। অ্যাডাম বুঝতে পারল, জেনিফারের সঙ্গে আর দেখা না করাই ভালো।
.
জেনিফার একা এবং নিঃসঙ্গ। সারাদিন নানারকম কাজের মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। কিন্তু রাত হলেই সেই একাকীত্বের যন্ত্রণা গ্রাস করে তাকে। দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, কিন্তু ঘুম আসে না। রাশি রাশি দুঃস্বপ্ন তাকে যেন তাড়া করে বেড়ায়। যেদিন তার মা আঠারো বছরের একটা ছেলেকে সঙ্গে করে স্বামী কন্যা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল সেদিন থেকে জেনিফার দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। নিঘুম থেকে রাত কেটে যায় তার।
সে একজন সঙ্গীর অভাব বোধ করে। মন হাঁপিয়ে ওঠে। শরীর ছটফট করে। মাঝে মধ্যে সে সমবয়সী তরুণ উকিলদের সাথে ডেট করে। কিছুদিন মেলামেশার পর সে অনুভব করে, তার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বের কাছে ওরা অত্যন্ত সাদাসিধে। কেউ কেউ তাকে বিছানায় পেতে চায়। দৈহিক চাহিদা মেটাতে সেও ছুটে যায়। ব্যাস ওই পর্যন্ত। কিন্তু দেহের খিদে মিটলে তো হল না, মন বলেও একটা বস্তু আছে। সেই মন এমন কোনো পুরুষকে খুঁজে পায়নি, যে অ্যাডাম ওয়ার্নারের মতো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। সে এমন কাউকে মন দিতে চায়, যে তার জন্য ভাববে, আবার সে তার জন্য ভাববে।
বিবাহিত পুরুষরাও জেনিফারের দিকে হাত বাড়াত। ডেট করতে চাইত। কিন্তু জেনিফার এই সব পুরুষদের পছন্দ করত না। তাদের ডাকে সাড়া দিত না। মায়ের দুর্ব্যবহার আর বেলেল্লাপনা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না, যে মহিলা নিজের হাতে গড়া সংসার দুপায়ে। মাড়িয়ে থেতলে দিয়ে চলে গেছে, যে বাবার বাকি জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল, জেনিফার কোনোদিন তার মাকে ক্ষমা করতে পারবে না।
.
বড়োদিন এল, আর কয়েকটা দিন পরেই পুরোনোকে বিদায় দিয়ে নববর্ষের আগমন ঘটবে। এই সময় শহরে প্রচুর তুষারপাত হল। জেনিফার পথে বেরোল একা। হাঁটতে হাঁটতে দেখল কত সুখী দম্পতিকে, দেখল প্রেমিক-প্রেমিকাকে। পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে আহ্বান জানাতে খুশীতে মেতে উঠেছে। সবাই জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছে। অথচ সে? একা, নিঃসঙ্গ ভীষণভাবে সে এই একাকীত্বটাকে অনুভব করে, মনে পড়ে বাবার কথা। ভয়ানক খারাপ হয়ে যায় মন।
বড়োদিনের ছুটি শেষ। এল উনিশশো সত্তর সাল। জেনিফার ভাবল, এই বছর তার জন্যে নিশ্চয়ই শুভ সংবাদ বহন করে এনেছে।
কেনেথ বেইলির কথা মনে পড়ল। জেনিফারকে চাঙ্গা করার জন্য লোকটার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। মাঝে মধ্যে সে জেনিফারকে সিনেমা দেখতে নিয়ে গেছে। কখনও বা পার্কে বেড়াতো। জেনিফার টের পেয়েছে কেনেথ তার প্রতি আসক্ত। কিন্তু কাছে ঘেঁষতে চায় না, দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
মার্চ মাস। অটো ওয়েনজেল ঠিক করল, সস্ত্রীক ফ্লোরিডায় যাবে।
অটো বলল জেনিফারকে উদ্দেশ্য করে, নিউইয়র্কে ভীষণ ঠান্ডা। শীতে হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বয়স তো বাড়ছে। এত ধকল সহ্য হয়।
–আপনার অভাব আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করব।
কথাটার মধ্যে একটুও ভেজাল নেই। গত কয়েক মাসে ওয়েনজেল পরিবারের সে একজন ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।
–জেনি, অটো বলল, কেনেথের প্রতি খেয়াল রেখো।
কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে জেনিফার বোকার মতো তাকিয়ে রইল।
–ও তোমায় কিছু বলেনি? অটো জানতে চাইল।
–কী?
–ওর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিল। এ ব্যাপারে কেনেথ নিজেকে দায়ী করে।
-তাই নাকি? জেনিফার তাজ্জব বনে গেল। কী এমন হয়েছিল যে, সে আত্মহত্যা করল?
-কেনেথ, একটু ইতস্তত করে অটো বলল, ও একজন সমকামী ওর বউ দেখেছে, ও একটা সুন্দর ছেলের সঙ্গে একবিছানায় শুয়ে
হায় ভগবান।
–ওই দৃশ্য দেখে ওর বউয়ের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। কেনেথকে খুন করে নিজে মরতে চেয়েছিল। তাই কেনেথকে লক্ষ্য করে একটা গুলি চালিয়ে দিয়েছিল, অন্যটা নিজের মাথা তাক করে। কেনেথ বেঁচে গেল। কিন্তু ওর বউ
–এমন এক ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা কেনেথ আমাকে কখনও বলেনি। অথচ তাকে দেখে–
ওর বাইরেটা হাসিখুশী হলে কী হবে, অন্তরে দুঃখের অনল জ্বলছে।
ব্যাপারটা আমায় বলার জন্য ধন্যবাদ।
জেনিফার অফিসে ফিরে এল।
কেনেথ বলল–তা হলে সত্যি সত্যি অটো ওয়েনজেল আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
-হ্যাঁ।
–তাহলে এবার সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের দুজনকে লড়াই করতে হবে।
–ঠিক তাই।
ওই ঘটনা শোনার পর থেকে জেনিফারের মনে কেনেথের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। সে কেনেথের মধ্যে সমকামিতার কোনো লক্ষণ খুঁজে পায় না। তারা এক সঙ্গে লাঞ্চ খায়, ডিনার খায়। তবে জেনিফার জানে, কেনেথ সম্পর্কে অটো যা বলেছে সব সত্যি। লোকটা এখন আত্মগ্লানিতে ভুগছে।
ধীরে ধীরে জেনিফারের ব্যবসা জমতে শুরু করল। কয়েকজন মক্কেল আসছে। তবে তাদের বেশীর ভাগই বেশ্যা। কোনো সমব্যবসায়ী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, তাকে জামিন করাতে হবে। এরা সংখ্যায় কম। কিন্তু নিয়মিত মক্কেল। কিন্তু কার কাছ থেকে তারা জেনিফারের ঠিকানা পেয়েছে, তা বারবার জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেনি সে। কেনেথ বেইলকেও এব্যাপারে প্রশ্ন করেছে। সে নীরব থেকেছে। বোকার মতো তাকিয়ে থেকেছে, যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।
যখন মক্কেল আসত, তখন কেনেথ বেইলি ঘরের বাইরে চলে যেত। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হত, সে বুঝি এক গর্বিত পিতা, মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক, এটাই তার একমাত্র কামনা।
বিবাহ বিচ্ছেদের মামলাও এল। কিন্তু এসব কেস জেনিফার হাতে নেয় না। মনে পড়ে যায় সেই প্রফেসারের কথা। যিনি বলেছিলেন, ওকালতিতে পসার জমাতে গেলে ডিভোর্সের মামলা কখনওই গ্রহণ করা উচিত নয়। তাই ডিভোর্সের জন্য যেসব উকিল, লড়ে, তাদের কম বেশী বদনাম আছে। বিয়ে ভাঙার কারণেই এটা তাদের কপালে জুটে যায়। আসলে মোটা টাকার লোেভ তারা সামাল দিতে পারে না। তাদের কারণেই এক একটি সুন্দর সংসার ভেঙে যায়। স্বামী, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জীবনে নেমে আসে এক বিভীষিকা।
এবার আসতে শুরু করেছে অবস্থাপন্ন লোকেরা। সাধারণ ফৌজদারী মামলা নয়, তারা আসছে দেওয়ানি মামলার জন্য। লক্ষ লক্ষ ডলারের ব্যাপার। এসব মামলা সাধারণত বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়ে থাকে।
কিন্তু তার মতো এক অনামী উকিলের কাছে তারা আসবে কেন? কে পাঠাচ্ছে তাদের?
মক্কেলদের কাছে জেনিফার প্রশ্ন রাখত। কিন্তু কখনও স্পষ্ট জবাব পায়নি।
এক বন্ধুর মুখ থেকে শুনেছি।
কাগজে পড়েই আপনার কথা জানতে পেরেছি।
এক পার্টিতে গিয়ে একজন পরিচিত আপনার নাম বলেছিলেন। তাই চলে এলাম। লোকটা কে? কে তার হিতাকাঙ্খী? একদিন জেনিফার তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।
এক ধনী মক্কেল তার নিজের সমস্যা বলতে বলতে নামটা বলে ফেলল–অ্যাডাম ওয়ার্নার।
–ও, আপনাকে তাহলে উনিই পাঠিয়েছেন! জেনিফার স্পষ্ট ভাবে জানতে চাইল। ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেল। ঢোক গিলে বলল, আপনাকে আমি কথাটা বলে ফেললাম, মি. ওয়ার্নার যেন জানতে না পারেন।
অ্যাডাম ওয়ার্নারের প্রতি আরো একবার কৃতজ্ঞতাবোধ করল জেনিফার। এমনিতেই সে তার কাছে ঋণী। ফোন করে ওকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।
টেলিফোনে অ্যাডাম ওয়ার্নারকে পাওয়া গেল না। সেক্রেটারী জানাল, তিনি ইওরোপে গেছেন একটি বিশেষ কাজে। কয়েক সপ্তাহ পরে ফিরবেন।
অ্যাডাম ওয়ার্নারকে খুব বেশী করে মনে পড়ছে জেনিফারের। যেদিন সন্ধ্যায় অ্যাডাম প্রথম তার কাছে এসেছিল। ছিঃ ছিঃ, কী দুর্ব্যবহারই না সে করেছিল। কিন্তু অ্যাডাম ওসব গায়ে মাখেনি। জেনিফারকে সে বাঁচিয়েছে, তার দয়াতেই সে এখনও ওকালতি পেশা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিন সপ্তাহ পর জেনিফার আবার ফোন করল।
মি. ওয়ার্নার দক্ষিণ আমেরিকায় গেছেন। সেক্রেটারী জানাল, ওনাকে কোনো জরুরী খবর দেবার আছে কি?
না, বিশেষ কিছু নেই। জেনিফার ফোন নামিয়ে রাখল।
চেষ্টা করল অ্যাডামকে ভুলে যেতে। কিন্তু পারছে না। আচ্ছা, অ্যাডাম কি বিয়ে করেছে, নাকি এখনও অবিবাহিত? আমি যদি ওর বউ হতে পারতাম? ব্যাপারটা কল্পনা করে জেনিফার আপন মনে হেসে উঠল–যত সব অলীক ভাবনা।
দৈনিক খবরের কাগজ আর সাময়িক পত্রে মাঝে মাঝেই মাইকেল মোরেটির সম্বন্ধে ছাপা হয়। জেনিফারের নজরে পড়েছে। নিউইয়র্কের ম্যাগাজিনে অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি সমেত পূর্বাঞ্চলের বহু মাফিয়া পরিবার সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলির জামাই মাইকেল মোরেটি। শ্বশুরের স্বাস্থ্য দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে। তাই অপরাধমূলক কাজকর্ম আর খুনখারাপির বিরাট রাজ্যপাট জামাইয়ের ওপর ন্যস্ত হয়েছে।
মোরেটির বিচারের খবরটা লাইফ ম্যাগাজিন ছেপেছিল। ক্যামিলো স্টেলা, মোরেটির ডান হাত এখন লিভেনওয়ার্থ জেলে বন্দী। রবার্ট ডি সিলভা একেই রাজসাক্ষী করতে চেয়েছিলেন। অথচ নাটের গুরু মোরেটি বহাল তবিয়তে মুক্ত জীবন কাটাচ্ছে। আইন তার চুলও স্পর্শ করতে পারছে না। মাইকেল মোরেটির বিরুদ্ধে সাজানো মামলাটি কীভাবে জেনিফার পার্কারের জন্য বানচাল হয়ে গিয়েছিল, তাও বিস্তারিত ভাবে লাইফ ম্যাগাজিন লিখেছে। যদি মামলাটি ঠিক পথে চলত তাহলে এতদিনে মাইকেল মোরেটির ফাঁসি হয়ে যেত, নতুবা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করত।
প্রবন্ধটা পড়তে পড়তে জেনিফার কেমন অস্বস্তিবোধ করল। বৈদ্যুতিক চেয়ার? সম্ভব হলে সে নিজেই ওই বৈদ্যুতিক চেয়ারের সুইচ চালু করে দিত।
.
জেনিফারের মক্কেলের সংখ্যা কম নয়। তবে বেশীর ভাগই সাধারণ স্তরের অপরাধী। তাদের হয়ে মামলা লড়তে গিয়ে ফৌজদারী আইনের পুরোটাই জেনিফার রপ্ত করে ফেলল। ফৌজদারী আদালতে সব কটা এজলাস তার ঘোরা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দেহ বেচা, নিষিদ্ধ মাদক বিক্রি, ইত্যাদি অপরাধে অপরাধী, এমন মক্কেলদের হয়ে মামলা লড়তে হত জেনিফারকে। এখানে দাম দস্তুর করা একটা মামুলি ব্যাপার।
বিচারক রায় দিলেন–জামিন পাঁচশো ডলার।
ধর্মাবতার আমার মক্কেল গরীব, অত টাকা নেই। জেনিফার বলে উঠল, যদি দয়া করে টাকার পরিমাণ কমিয়ে দুশো ডলার করেন তা হলে বেচারী আবার কাজকর্ম শুরু করতে পারে। সংসারটাও রক্ষা পায়।
–ঠিক আছে। দুশো ডলার জামিন।
ধন্যবাদ মী লর্ড।
.
ফাদার ফ্রান্সিস জোসেফ রায়ান। পঞ্চাশের ওপর বয়স। মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল কানের ওপর দিয়ে ঝুলছে। তাকে দেখেই জেনিফারের ভালো লেগে গিয়েছিল। কেনেথ বেইলি অবশ্য তার সঙ্গে জেনিফারের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। উনি কেনেথ বেইলিকে অনেক মর্কেল পাঠিয়ে ছিলেন। তাই কেনেথ তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
এক মাস পর একদিন সকালবেলা ফাদার রায়ান এসে হাজির হলেন জেনিফারের অফিসে।
–একটা বিশেষ দরকারে তোমার কাছে আসা, ফাদার বলে চললেন, আমার এক বন্ধু খুব ঝামেলায় পড়েছে। কিন্তু বেচারার কাছে
অর্থ নেই। জেনিফার তার কথাটা সম্পূর্ণ করে দিল।
–তোমার অনুমান যথার্থ। লোকটিকে সাহায্য করা আমার একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি। তাই তোমার দ্বারস্থ হয়েছি।
ব্যাপারটা কী? খুলে বলুন।
–ও হল আব্রাহাম, আব্রাহাম উইলসন। ওর বাবা আমার যজমান। মদের দোকানে ডাকাতি করতে গিয়ে আব্রাহাম মালিককে খুন করেছিল। তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম করাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ও এখন জেলে দিন কাটাচ্ছে।
-সাজা তো হয়েই গেছে, আমার কী আর করার আছে।
আগে সবকথা শোনো, ফাদার রায়ান বলতে থাকেন, কয়েক সপ্তাহ আগে আব্রাহাম জেলের মধ্যেই একটা খুন করেছে। এক কয়েদিকে। নাম রেমন্ড থর্প। দ্বিতীয় বার খুনের অভিযোগে পুলিশ ওকে আদালতে হাজির করবে। এবার নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে ওকে।
হ্যাঁ, কয়েক দিন আগে কাগজে খবরটা সে পড়েছিল, জেনিফারের মনে পড়ল।
আমি কী করতে পারি বলুন?
আব্রাহামের যাতে মৃত্যুদণ্ড না হয়, সেটা তোমায় দেখতে হবে।
–ফাদার, মামলাটা খুব জটিল। জেনিফার চেয়ারে পিঠ দিয়ে বসল। ওর বিরুদ্ধে তিনটে অপরাধ একই সঙ্গে কাজ করছে–প্রথমত ও কৃষ্ণাঙ্গ, দ্বিতীয়ত খুনের দায়ে তার জেল হয়েছে, তৃতীয়ত সে জেলের ভেতর বসে এক কয়েদিকে হত্যা করেছে। সে যে এই খুনটা করেছে, তা নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছে।
–তা তো দেখেছে। প্রায় একশো জন কয়েদি আর ওয়ার্ডারের সামনে খুন করেছে সে।
–তাহলে ওর বাঁচার আশা আপনি ছেড়ে দিন। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো দিকই ওর জন্য ভোলা নেই। যাকে ও খুন করেছে সে ওকে মারধোর করার ভয় দেখিয়েছিল, অথবা মারতে এসেছিল। সে ক্ষেত্রে আব্রাহাম জেলের ওয়ার্ডারদের ডেকে সাহায্য চাইতে পারত। তা না করে সে বোকামি করে বসল। আইন নিজের হাতে তুলে নিল। পৃথিবীতে এমন কোনো আদালত নেই, যেখানকার জুরীরা ওকে নির্দোষ বলবে।
জানি, তবুও ও একজন মানুষ। তুমি কি একবার ওর সঙ্গে কথা বলবে?
–বেশ, আপনার কথা আমি রাখব। ওর সঙ্গে দেখা করব। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেনিফার বলল, তবে এই মামলার ফলাফল কী হবে, সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না আমি।
-তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। খুব জানাজানি হোক এটা তুমি চাও না।
.
হাডসন নদীর পূর্ব পারে ম্যানহাটান শহর। সেখান থেকে তিরিশ মাইল ভেতরে সিং সিং জেলখানা। এখানেই আব্রাহাম উইলসন জেল খাটছে। জেলে কোনো কয়েদির সঙ্গে দেখা করতে গেলে আগে থেকে সহকারী ওয়ার্ডেনের কাছে আবেদন করতে হয়। জেনিফার তাই টেলিফোনে ওই জেলের সহকারী ওয়ার্ডেনের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
জেলের বাইরে মূল ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল জেনিফার। কলিংবেলে হাত রাখল। মস্ত বড়ো গেট খুলে প্রহরী বেরিয়ে এল। জেনিফার ভেতরে ঢুকল। দর্শন প্রার্থীদের তালিকায় জেনিফারের নাম আছে কিনা মিলিয়ে দেখা হল। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হল সহকারী ওয়ার্ডেন হাওয়ার্ড প্যাটারসনের কাছে। বিশাল চেহারা। সামরিক রীতি অনুযায়ী চুল ছোটো ছোটো করে ছাঁটা। মেচেতার দাগে মুখ ভরা।
–আপনাকে আমি টেলিফোনে কথা বলেছি। আমার পরিচয় আপনি জেনেছেন। জেনিফার বলল, আব্রাহাম উইলসন সম্পর্কে আপনি কী জানেন বলুন।
কিছু মনে করবেন না, ওর প্রতি আমার কোনো দরদ নেই। সামনে পড়ে আছে। আব্রাহাম উইলসনের কাগজপত্র। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্যাটারসন বলতে থাকল, জীবনের বেশীর ভাগ সময় সে জেলের মধ্যে কাটিয়েছে। ওর কীর্তিকলাপের ইয়ত্তা নেই। এগারো বছর বয়সে সে প্রথম অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিল। চুরি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। এর দু-বছর বাদে ছিনতাই করতে গিয়ে আবার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। পনেরো বছর বয়সে ধর্ষণের অভিযোগে ওর জেল হয়েছিল। আঠারো বছর বয়স থেকে বেশ্যাদের দালাল হয়ে কাজ করছিল। এক বেশ্যাকে এমন পিটিয়ে ছিল, যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই অভিযোগে ওর জেল হল। ওর কী গুণের শেষ আছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ এবং অবশেষে খুন
আমি একবার আব্রাহাম উইলসনের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি কি
–নিশ্চয়ই অনুমতি পাবেন। হাওয়ার্ড প্যাটারসন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তবে আপনি একটা কথা জেনে রাখুন, একশো কুড়িজন লোক ওর ওই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী, আপনি শুধু শুধু ওর জন্য সময় খরচ করছেন।
আব্রাহাম উইলসন–আলকাতরার মতো কালো গায়ের রং, ছুরির দাগ মুখটাকে ফালা ফালা করে দিয়েছে। নাকের হাড় ভাঙা। কুতকুতে ছোটো দুটি চোখ। ঘন ঘন চোখের পাতা পড়ে তার। অসীম শক্তির অধিকারী। ছ-ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। এমন বীভৎস চেহারার মানুষ জেনিফার আগে কখনও দেখেনি। যে কোনো সুস্থ মানুষের বুকে কাঁপন জাগাতে পারে।
একটা সেলে সে একাই ছিল। প্রহরী এসে তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে নিয়ে গেল। জেনিফার আর আব্রাহাম উইলসন মুখোমুখি বসল। অবশ্য তাদের মাঝখানে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে মোটা ইস্পাতের জাল। একজন প্রহরী দুরে দাঁড়িয়ে আছে, আব্রাহামকে পাহারা দিচ্ছে।
জেনিফার তার পরিচয় দিয়ে বলল, ফাদার রায়ানের কথাতেই আমি এখানে এসেছি।
ফাদার রায়ানের নাম শুনেই আব্রাহাম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ফাদারকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিতে লাগল। এমন কী জেনিফারও বাদ পড়ল না। রাগে ঘেন্নায় জেনিফারের গা গুলিয়ে উঠল। সহকারী ওয়ার্ডেন ঠিকই বলেছেন, ওর সঙ্গে দেখা করা মানে সময় অপচয় করা।
তবু জেনিফার ধৈর্য হারাল না। একসময় কাজ হল। আব্রাহাম উইলসন খিস্তি দেওয়া বন্ধ করে বলল হ্যাঁ, আমিই সেই খুনী, যে ওই খানকির বাচ্চাটাকে খুন করেছে।
সে তো শুনেছি। কিন্তু খুন করার কারণ কী? জেনিফার জানতে চাইল।
–কেন খুন করব না? মস্ত বড় একটা রামদা নিয়ে ও আমাকে মারতে এসেছিল। ওকে খুন করে নিজে বেঁচেছি।
বাজে কথা রেখে সত্যি কথা বলল। জেনিফার গর্জে উঠল, জেলের মধ্যে রামদা কোথায় পাবে?
দূর হও? দূর হও এখান থেকে। চেঁচিয়ে বলতে লাগল আব্রাহাম। আমি বাজে কথা বলছি। তোমাকে কে ডেকেছে শুনি? আমি তো আসতে বলিনি। নিজেই আগ বাড়িয়ে এসেছে। আমার উপকার করবে। হুম। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, শোনো একটা কথা বলে দিই, আর কখনও এখানে আসবে না। আমাকে বিরক্ত করবে না। তোমার উপদেশ শোনার মতো আমার সময় নেই। প্রহরী নিয়ে চলে গেল।
জেনিফার হতাশ হল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর কিছু করার নেই। কথা রেখেছে, এটুকু তো সে ফাদারকে বলতে পারবে।
আমরা এখানকার আপরাধীদের মানসিক দিক থেকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে থাকি সবরকমভাবে। সহকারী ওয়ার্ডেন হাওয়ার্ড প্যাটারসন বলতে থাকল, কিন্তু আব্রাহাম উইলসন এ সবের বাইরে চলে গেছে। ওর একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, বৈদ্যুতিক চেয়ার।
বাঃ, দারুণ প্রশংসনীয় যুক্তি। জেনিফার মনে মনে উচ্চারণ করল। সে জানতে চাইল, উইলসন বলল, ওকে নাকি রামদা নিয়ে তাড়া করেছিল বলে ও খুনটা করেছে। জেলের মধ্যে রামদা কোথা থেকে আসবে?
মিস পার্কার, অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই জেলের মধ্যে মোট বারোশো চল্লিশজন কয়েদি আছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এসব হাতিয়ার বানাতে জানে। আসুন, আমার সঙ্গে একটা জিনিস দেখুন।
করিডোর ধরে তারা দুজনে এগিয়ে গেল। একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তালা বন্ধ। দরজা খুলে হাওয়ার্ড ভেতরে ঢুকল জেনিফার তার পেছনে।
একটা বড়ো বাক্সের দিকে আঙুল তুলে হাওয়ার্ড বলল–এটার ভেতরে কয়েদিদের অনেক অস্ত্র থাকে।
বাক্সটা খুলে ফেলল হাওয়ার্ড। ডালা তুলে ধরল। জেনিফার তাকাল। আঁতকে উঠল। বলল–মি. প্যাটারসন, আমি আমার মক্কেল আব্রাহাম উইলসনের সঙ্গে আবার দেখা করতে আগ্রহী।
.
জেনিফার আবার এল সিং সিং জেলখানায়, ওয়ার্ডার আর কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলল। সে জানতে চাইল, রেমন্ড থর্পের খুন হতে কেউ স্বচক্ষে দেখেছে কিনা।
একশো কুড়ি জন কয়েদি নিজের চোখে দেখেছিল ওই হত্যাকাণ্ড। কিন্তু কেউ তা স্বীকার করল না। এই খুনের সঙ্গে কেউ নিজেকে জড়াতে চাইল না। প্রত্যেক একটাই জবাব দিল, না, রেমন্ড থর্পকে খুন হতে দেখিনি।
.
আব্রাহামের মামলা নিয়ে জেনিফার তখন খুবই ব্যস্ত। এমন কী দুপুরে লাঞ্চ করার সময় নেই তার হাতে। আদালতের কফি কাউন্টার থেকে স্যান্ডউইচ এনে কোনোরকমে খিদে মেটাল। এর ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওজন কমে গেল সাঙ্ঘাতিক ভাবে। যখন তখন মাথা ঘুরছে। চোখে সরষের ফুল।
জেনিফারের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে কেনেথ বেইল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। আদালতের কাছেই ফোরলিনি রেস্তোরাঁ। সে প্রায় জোর করে জেনিফারকে সেখানে নিয়ে গেল লাঞ্চ খাওয়াতে। একটা বড়ো লাঞ্চের অর্ডার দিল।
–আপনি কি তিলে তিলে মরতে চান? কেনেথ বেইলি জানতে চাইল।
কখনো নয়।
–আয়নায় নিজের মুখটা দেখেছেন?
না।
মরতে না চাইলে এই মামলাটা থেকে সরে আসুন।
কারণ?
কারণ এটা সামান্য মামলা নয়। খবরের কাগজগুলো ওৎ পেতে বসে আছে। কেনেথ বলতে থাকল, হাজার হাজার চোখ আপনার ওপর। এই মামলায় আসামীর হয়ে লড়তে গেলে আপনাকে নিয়ে নানারকম প্রচার শুরু হবে।
–কেনেথ, ভুলে যাবেন না, আমি একজন উকিল, আব্রাহাম উইলসন আমার মক্কেল। জেনিফার বলে চলল। মক্কেলের সুবিচার আমি আশা করি। আপনি আমাকে নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তা করবেন না। আর এ মামলা নিয়ে বেশী কথা বলবেন না।
তাই বুঝি? কেনেথ বলল, আপনি জানেন, এই মামলায় সরকারী উকিল কে?
না।
–রবার্ট ডি সিলভা।
.
পরপর তিনটি রাত বিনিদ্রার মধ্যে কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত জেনিফার একটা সিদ্ধান্তে এল। তার ওপর থেকে রবার্ট ডি সিলভার রাগ এখনও যায়নি, এটা সে ভালো মতোই জানে। আর এটাও সে জানে, এই মামলায় রবার্ট ডি সিলভা তার ওপর প্রতিশোধের পুরোনো জ্বালা মেটাতে চেষ্টার কোনো ফাঁক রাখবেন না। কিন্তু এর ফলে তার মক্কেল আব্রাহাম উইলসনের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে। একজন উকিল হয়ে মক্কেলের এই ক্ষতি সে কখনো করতে পারে না। একবছর নিজের বোকামির ফলে যে ভুল সে করেছিল, দ্বিতীয়বার সেটা সে ঘটতে দেবে না। সে ঠিক করল, আব্রাহাম উইলসনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হলে, তার সরে আসাই শ্রেয়। চোখের সামনে জেনিফারকে না দেখে রবার্ট ডি সিলভার রাগ তাহলে কিছুটা প্রশমিত হবে। আর উইলসনও কিছুটা সুবিচার পাবে। জেনিফার তাই স্থির করল, সে নিজে ডি সিলভার সঙ্গে দেখা করবে। তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবে, এবং উইলসনের প্রতি তিনি যেন একটু সদয় হন, সে প্রার্থনাও জানাবে।
টেলিফোন করল সে। রবার্ট ডি সিলভার সঙ্গে দেখা করার দিন ঠিক করল।
নির্দিষ্ট দিনে লিওনার্দো স্ট্রিটের ফৌজদারী আদালত ভবনে জেনিফার এসে দাঁড়াল। সাত তলায় ডি সিলভার অফিস, জেনিফার দেখল দরজার গায়ে রবার্ট ডি সিলভার নাম জ্বলজ্বল করছে।
জেনিফার ভেতরে ঢুকল। পুরোনো সেক্রেটারী তার ডেস্কে বসে আছে।
-আমি জেনিফার পার্কার। মি: ডি সিলভার সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল।
–উনি ভেতরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি যান। বিশাল ঘর। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি তখন চুরুট মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডেস্কের পেছনে। দুজন সহকারী ডেস্কের পেছনে। দুজন সহকারী বসে। সম্ভবত তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিলেন। জেনিফারকে দেখে তার মুখের চোয়াল শক্ত হল।
আমার ধারণা ছিল, তুমি এ জীবনে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে না। ভয়ানক নিষ্ঠুর। গলা ডি সিলভার।
–আমি আপনার কাছে এসেছি।
–ভেবেছিলাম, লেজ গুটিয়ে শহর ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি। বেহায়া কোথাকার। বলো কী জন্য এসেছো?
দুটো চেয়ার খালি। ডি সিলভা তাকে বসতে পর্যন্ত বললেন না।
–আমার মক্কেল আব্রাহাম উইলসন সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই আমি।
রবার্ট ডি সিলভা জেনিফারকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। তার মুখের ভাব দেখে মনে হল, তিনি যেন আব্রাহাম উইলসনের নাম জীবনে শোনেন নি।
খানিকবাদে বলে উঠলেন–ও ঘঁা, মনে পড়েছে। ওই কালো চামড়ার লোকটা, যে জেলের মধ্যেই এক কয়েদিকে খুন করেছে। তুমি ওর হয়ে সাওয়াল করছো তো? কোন অসুবিধা হবে না।
ডি সিলভার ইঙ্গিতে সহকারী দুজন ঘর ছেড়ে চলে গেল।
–এবার শুনি তোমার বক্তব্য।
–একটা আবেদন আছে আমার।
–তার মানে সন্ধি করতে চাইছো? তোমার চিন্তা কীসের? তুমি হলে প্রতিভাসম্পন্ন আইনজীবী। আব্রাহামকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তোমার কোনো বেগ পেতে হবে না।
মি: ডি সিলভা। জেনিফার নরম স্বরে বলল, এটা একটা সাধারণ মামলা। এর মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই।
–তুমি এসেছো, আমার সঙ্গে আপোস করতে। ডি সিলভা গর্জে উঠলেন, তুমি আমার জীবন, আমার উচ্চাশা, আমার ভবিষ্যৎ সবকিছু ধ্বংস করেছ। সাধ মেটেনি না? এখন এসেছে আপোস করতে নির্লজ্জ কোথাকার? বলিহারি তোমার সাহস, অভিনয় ক্ষমতাকেও প্রশংসা করতে হয়। তুমি আমাকে চেনো না। একটা কথা জেনে রাখো, তোমার ওই কালোমানিককে আমি বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়েই ছাড়ব।
–মি: ডি সিলভা, জেনিফার মিনতি করল, এমনিতেই ও যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। আপনাকে বলতে এসেছি যে, এই মামলায় আমি থাকছি না। দয়া করে ওর কেসটা একটু হালকা করে দিন।
অসম্ভব। হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ডি সিলভা। খুনের দায়ে উইলসন দোষী, তা প্রমাণিত হয়েছে। ওকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসতেই হবে।
জেনিফার এতক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিল। আর সে পারছে না। সে বলল–মি: ডি সিলভা, আপনি একজন সরকারী উকিল, জুরী নন। উইলসন দোষী কী নির্দোষ, তা বিচার করবেন আদালতে উপস্থিত জুরীরা।
বাঃ দারুণ। তুমি একজন আইন বিশেষজ্ঞ, আমাকে শিক্ষা দিচ্ছো। খুব আনন্দের কথা। হা-হা করে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠলেন ডি সিলভা।
আমরা কি আমাদের পুরোনো কথগুলো ভুলে যেতে পারি না?
–আজীবন তোমার ওপর আমার ঝাল থাকবে। ডি সিলভা বললেন, তোমার বন্ধু মাইকেল মোরেটিকে আমার শুভেচ্ছা জানিও।
মামলা শুরু হতে আর তিনদিন বাকি। জেনিফার জানতে পেরেছে, এই মামলার বিচারক লরেন্স ওয়াল্ডম্যান। মাইকেল মোরেটির মামলাটি ওনার এজলাসেই উঠেছিল। আর উনি রবার্ট ডি সিলভার গলায় গলা মিলিয়ে জেনিফারকে বার থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
.
১৯৭০ সাল, সেপ্টেম্বর মাসের এক সোমবার।
আব্রাহাম উইলসনের মামলা শুরু হল।
জেনিফার নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে আব্রাহামকে ভদ্র করে তোলার চেষ্টা করেছে। সে পরেছে সাদা রঙের শার্ট, নীল রঙের স্যুট আর নীল রঙের টাই। এত সুন্দর পোশাক তার চেহারার বীভৎসতার কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। জেনিফার খুব ভালো করেই জানে, ওই বীভৎস খুনী চেহারা কোনো বিচারক বা জুরীর সহানুভূতি লাভ করতে পারে না।
সরকারের পক্ষে সওয়াল শুরু হল। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি ডি সিলভা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তার বক্তব্য পেশ করলেন–
মাননীয় ধর্মাবতার। কয়েক বছর আগে একটি মামলায় আব্রাহাম উইলসনকে দোষী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেখানে ছিল বারোজন জুরি। তার অপরাধ কী ছিল, সেকথা আমি আর উত্থাপন করার প্রয়োজন মনে করছি না। তবে একটা কথা বলব, আমাদের দেশের আইন রক্ষকদের ধারণা ছিল, ওই দাগী অপরাধীকে জেলের চার দেওয়ালের মধ্যে। বন্দী রাখলে সে নিজেকে শুধরে নেবে। আর কোনো অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়াবে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে ওই ধারণা ভুল বলে আজ প্রমাণিত হয়েছে। জেলের ভেতরে বন্দী থেকেও আব্রাহাম উইলসন তার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটায় নি। তাই রেমন্ড থর্প নামে এক আপাত নির্দোষ কয়েদিকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে সে। আব্রাহাম উইলসন এক নরপিশাচ। তাকে নর হত্যার অপরাধ থেকে বিরত করা উচিত। এরজন্য একটি মাত্র উপায় আছে। তা হল প্রাণদণ্ড। আব্রাহাম উইলসনকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করলে মৃত রেমন্ড থর্প বেঁচে উঠবে না আমরা জানি। কিন্তু ভবিষ্যতে আর কোনো নিরাপরাধকে ওর হাতে মরতে হবে না। এটাই সমাজের লাভ।
রবার্ট ডি সিলভা এবার ধীর পায়ে জুরীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বলতে থাকলেন–এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিটি দোষী, না নির্দোষ তা বিচার করতে আশাকরি আপনাদের বেশী সময় লাগবে না। কথাটা বলার কারণ আছে। আব্রাহম উইলসন, যে লোকটা আসামীর টেবিলে বসে আছে, সে ঠান্ডা মাথায় একজনকে খুন করেছে, এমন কী, সে নিজের অপরাধের কথা স্বীকারও করেছে। তবে আব্রাহাম উইলসন যদি খুনের কথা স্বীকার না করত, তা হলেও বিচারের কোনো অসুবিধা হতো না। কেননা একশোর বেশী সাক্ষী আছে, যারা আব্রাহামকে খুন করতে দেখেছে নিজের চোখে।
ঠান্ডা মাথায় খুন কী, সেই ব্যাপারটা আপনাদেরকে বুঝিয়ে বলছি। এমন অনেক খুন করার কথা জানা যায়, যার পেছনে উপলব্ধিকর যুক্তি থাকে। আগে এই ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু বলি। মনে করুন, আপনার পরিবার কোনো দুর্বত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। সে প্রাণ নাশের হুমকি দিচ্ছে। তখন আপনি তাদের প্রাণরক্ষার তাগিদে নিজের হাতে বন্দুকের ট্রিগার টিপে দিলেন। অথবা ধরুন, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখলেন, একজন আততায়ী খুন করার জন্য আপনার ওপর চড়াও হয়েছে। আপনি তাকে খুন করলেন। এসব ক্ষেত্রে আপনাকে মারাত্মক অপরাধী বলা যাবে না। কারণ প্রাণরক্ষার তাগিদে হঠাৎ মাথাগরম করে কাজটা করে ফেলেছেন। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় খুন, ডি সিলভার কণ্ঠস্বর আরও কঠিন শোনাল, টাকার জন্য, বেআইনি মাদকের জন্য, অথবা নিছক খুন করার আনন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে যে খুন করা হয় তাকেই বল হয় ঠান্ডা মাথায় খুন। এক্ষেত্রে কোনো আবেগ বা অনুভূতির প্রয়োজন হয় না।
জেনিফার জুরীদের মুখের দিকে তাকাল। দেখল তারা মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে ডি সিলভার যুক্তিতে সায় দিচ্ছেন।
জেনিফার তার মক্কেল আব্রাহাম উইলসনকে বারবার সাবধান করে দিয়ে বলেছিল ভুলেও জুরীদের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
কিন্তু আব্রহাম সে সাবধানবাণী বেমালুম ভুলে গিয়ে কটমটে চোখে জুরীদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আব্রাহাম। জেনিফার চাপা গলায় ডাকল।
কিন্তু হায়! জেনিফারের ডাক তার কানে গেল না। সে একইভাবে জুরীদের দিকে তাকিয়ে রইল।
বাইবেলে উল্লেখ করা আছে, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ। ডি সিলভা বলতে লাগলেন, সেসব প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। রাষ্ট্র ও জনগণ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায় না, তারা চায় ন্যায্য বিচার। আব্রাহাম উইলসন ঠান্ডা মাথায় রেমন্ড থর্পকে খুন করেছে, জনগণ সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার প্রার্থনা করছে ধন্যবাদ।
এতক্ষণ ধরে জেনিফার সরকারী উকিল রবার্ট ডি সিলভার সওয়াল শুনছিল। মাঝে মাঝে তার শরীর কেঁপে উঠছিল। ডি সিলভা কোমর বেঁধেই এই লড়াইতে নেমেছেন। আব্রাহাম উইলসনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে উনি যে প্রকারান্তরে তার ওপর নিজের বহুদিনের পুরোনো ঘা শুকিয়ে নিতে চাইছেন সেটা বুঝতে দেরী হল না তার।
এবার জেনিফার সওয়াল করবে। উঠে দাঁড়াল সে মাননীয় ধর্মাবতার ও জুরীবৃন্দ আমরা সবাই জানি, আত্মরক্ষার অধিকার আমাদের প্রত্যেকের আছে। আব্রাহাম উইলসনকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদি সে খুনটা না করত, তাহলে আজ তাকে আর এই আদালতে আপনারা দেখতে পেতেন না। কারণ সে নিজেই খুন হয়ে যেত। প্রত্যেকটি মানুষের জীবন রক্ষা করার অধিকার আছে, ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির সাথে আমিও এক মত। আব্রাহাম উইলসন নিজেকে বাঁচাতে গিয়েছিল। ফলে রেমন্ড থর্পের মৃত্যু হয়। রেমন্ড থর্প আব্রাহাম উইলসনকে খুন করার জন্য তেড়ে এসেছিল। এটা আমি প্রমাণ করতে পারি। এবার আমি সিং সিং জেলের সহকারী ওয়ার্ডেন হাওয়ার্ড প্যাটারসনকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আহ্বান করছি।
হাওয়ার্ড প্যাটারসন সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল। জেনিফার জেরা শুরু করল।
মি: প্যাটারসন, আপনাকে প্রথমদিকে এই আদালতে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল কিন্তু আপনি আসেননি। শমন পেয়ে আপনি ছুটে এসেছেন। কেন এখানে আজ এসেছেন সেটা আদালতের সামনে বলুন।
–হ্যাঁ বলছি, প্যাটারসন বলল, আব্রাহাম উইলসনের মতো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা যাতে জেলের মধ্যে ঠান্ডা থাকে, সেটা দেখা আমার কাজ। অথচ উইলসন এক নৃশংস খুনে। ঝামেলা আর অশান্তি ছাড়া ও কিছু জানে না।
মি. প্যাটারসন, ওকে কিন্তু ঝামেলা ও অশান্তির জন্য আদালতে আনা হয়নি। আপনার খেয়াল রাখা উচিত, ও যাবজ্জীবন সশ্রম করাদণ্ডে দণ্ডিত এক কয়েদি। অন্যায়ভারে যদি কোনো মানুষের ওপর খুনে অভিযোগ চাপানো হয়, তাহলে আপনি কি বিবেকের দংশনে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন না?
যদি অন্যায়ভাবে কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সাহায্য করব। হাওয়ার্ড প্যাটারসন জবাব দিল।
–জেলের মধ্যে এর আগেও খুন খারাপি হয়েছে। আমি কি ঠিক বলছি মিঃ প্যাটারসন?
-হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই বলেছেন আপনি, তবে কয়েক হাজার নরপশুদের একসঙ্গে রাখলে তাদের মধ্যে খুন করার স্পৃহা তো জাগতেই পারে। তাই না, বলুন?
-হ্যাঁ। আপনার জেলের ভেতর এমন ঘটনাও ঘটেছে যে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোনো কয়েদি খুন করতে বাধ্য হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই আপনি অস্বীকার করবেন না, মিঃ প্যাটারসন।
-হ্যাঁ, তা অবশ্য মাঝে মধ্যে হয়ে থাকে এই জেলের ভেতর, মিস পার্কার।
–তাহলে এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, নিহত কয়েদী রেমন্ড থর্প আব্রাহাম উইলসনকে আক্রমণ করেছিল। আর তার হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্য উপায় না পেয়ে আব্রাহাম উইলসন ওই কয়েদিকে খুন করেছে। খুব সহজভাবে বলা যায় আত্মরক্ষার অধিকার সব মানুষেরই আছে, আর তার জন্য যে কোনো পন্থা অবলম্বন করা যায়। আব্রাহামও সেই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
প্যাটারসন জেদী ছোটো ছেলের মতো উত্তর দিলেন–এটা কি করে সম্ভব?
জেনিফার রেগে গিয়ে জজ ওয়াল্ডম্যানকে বলল ধর্মাবতার, সাক্ষী আমাকে সাহায্য করছে না। দয়া করে আপনি ওকে বলুন উনি যেন আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দেন।
জজ ওয়াল্ডম্যান অনুরোধের সুরে বললেন–উনি যেসব প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর দিন। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করবেন না।
-ঠিক আছে, ধর্মাবতার, আমি ওঁর সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এবার জেনিফার প্যাটারসনের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনার ওই বাক্সটা কোথায়? সেটা এনেছেন কি? যদি সঙ্গে থাকে তাহলে সেটা আদালতে পেশ করুন আপনি।
প্যাটারসন বললেন–এনেছি, তবে ওটা আমি এখুনিই পেশ করছি না, এই আদেশের আমি বিরুদ্ধাচরণ করছি।
জেনিফার স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল–সে ব্যাপারটাতো আপনি নিজেই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন প্রথমেই, তাহলে আবার ওটা দেখাতে আপত্তি করছেন কেন, মিঃ প্যাটারসন।
এবার বাধ্য হয়ে প্যাটারসন জেলের এক প্রহরীকে ইশারায় ডাকলেন। সে কাছে আসতে তাকে বাক্সটি আনতে বললেন। প্রহরীটি সঙ্গে সঙ্গে তার কর্তব্য পালন করল। সে জেনিফারকে একটি কাঠের বাক্স এনে দিল।
বাক্সটা হাতে নিয়ে জেনিফার বলল–ধর্মাবতার আমি এই বাক্সটিকে সাক্ষ্য প্রমাণ এক্সিবিট-এ হিসেবে পেশ করছি।
রবার্ট ডি সিলভা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–এটা আবার কি? এতে কি আছে?
-একে যন্ত্রেরর বাক্স বলা হয়। সিং সিং জেলের কয়েদীরা এই নামকরণ করেছে। এর ভেতর প্রচুর হাতে তৈরী অস্ত্র আছে। এসব অস্ত্র সিং সিং জেলের কয়েদীরা নিজের হাতে তৈরী করেছে।
তিড়িং করে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন রবার্ট ডি সিলভা। তিনি জোরালো স্বরে আপত্তি জানিয়ে বললেন–অবজেকশান। আমার মনে হয় আসামী পক্ষের উকিলের সাক্ষ্য গ্রহণের রীতিনীতি জানা নেই। এই যন্ত্রের বাক্সটি এমন কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নয় যার মাধ্যমে মামলার কাজ ত্বরান্বিত হতে পারে।
মিস জেনিফার পার্কার একগুঁয়ের মতো বলল–এই বাক্সটিই মামলা পরিচালনার কাজে সাহায্য করবে। এটি প্রমাণ করবে যে…
–রাগে ডি সিলভার চোখ দুটি থেকে আগুন ঝরতে লাগল। তিনি নিজেকে সংযত করে বললেন–এই এক্সিবিট এই মামলায় মূল্যহীন। এটা কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না যা থেকে আসামী নির্দোষ প্রমাণিত হবে।
বিচারক মিঃ ওয়াল্ডম্যান মিঃ ডি সিলভাকে সমর্থন জানিয়ে বললেন–আপনার আপত্তির প্রাসঙ্গিকতা আছে, তাই আপনার আপত্তি বহাল রইল।
জেনিফার বুঝতে পারল বিচারকও ডি সিলভার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এমনকি জুরীবৃন্দেরও মত নেই যে সে এই ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করুক। তাই তারা সবাই মিলে জোট বেঁধে জেনিফারকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করছেন। তবে একথাও সত্যি এই মামলার ক্ষেত্রে এই বাক্সটিই হবে অকাট্য প্রমাণ। এটিই তাকে এই মামলাতে জয়ী হতে সাহায্য করবে। এই বাক্সটি ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণ আপাতত তার হাতে নেই। সে হেরে গেলে তার আসামীকেও হার স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ তার আসামী মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাবে না।
জেনিফার পূর্ণোদ্যমে আবার বলতে শুরু করলধর্মাবতার, আমার স্থির বিশ্বাস এই মামলা পরিচালনার ব্যাপারে এই এক্সিবিট একটা মোক্ষম প্রমাণ। এর ভেতরের জিনিসগুলো দেখলে আমার কথার সত্যতা আপনি বুঝতে পারবেন।
বিচারক হাত তুলে মিস পার্কারকে থামিয়ে দিলেন। তিনি কণ্ঠস্বরে বিরক্তি এনে বললেন মিস পার্কার, আইন সম্পর্কে শিক্ষা বা জ্ঞান দেওয়ার মতো সময় বা ইচ্ছা এই আদালতের নেই। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির কথাও ফেলে দেবার নয়। আপনার উচিত আদালতে আসার আগে সাক্ষ্য গ্রহণের নিয়ম কানুন জেনে নেওয়া। যে লোকটিকে খুন করা হয়েছে সে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র ছিল তা এই আদালতে নথীভুক্ত করা হয়নি। কাজেই এসব অস্ত্র এখানে গৌণ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
জেনিফার রাগ সংবরণ করতে না পেরে বলল–আমি দুঃখিত ধর্মাবতার, কেন যে আপনি এই প্রসঙ্গটাকে চাপা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমি বলছি, এই এক্সিবিটটি এই মামলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
বিচারক জেদের সঙ্গে বললেন–ব্যস, আপনি এবার থামুন মিস পার্কার। আপনি ইচ্ছে করলে একস্পেশন ফাইল করতে পারেন।
জেনিফার বলল–এখানে একস্পেশন ফাইল করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার বক্তব্য এই যে আমার মক্কেলকে তার অধিকার প্রয়োগ করতে সহযোগিতা করুন।
মিস পার্কার, আপনি কিন্তু আদালত অবমাননা করছেন। এর দায় আপনার ওপর
–আমার বিরুদ্ধে আপনি যে কোনো চার্জ আনতে পারেন, আমার তাতে আপত্তি নেই। এই সাক্ষ্যটি পেশ করার মতো উপযুক্ত কারণ আছে, যা কি না ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি মিঃ ডি সিলভার বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট।
জেনিফারের এই অতর্কিত আক্রমণে রবার্ট ডি সিলভা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন–আপনি কি বলতে চাইছেন, মিস পার্কার?
–আমি বলতে চাইছি এই যে আপনি যে বক্তব্যটি এই আদালতে ব্যক্ত করেছেন তা আবার শুনলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এবার জেনিফার ঘুরে দাঁড়লেন যেদিকে স্টেনোগ্রাফার বসে আছে সেদিকে। সে স্টেনোগ্রাফারের উদ্দেশ্যে বলল–যেখানে ডি সিলভা বলেছেন, কেন আব্রাহাম উইলসন খুন করতে প্রভাবিত হয়েছিল, তা আমরা কেউ জানি না…, এই জায়গা একবার পড়ে শোনান তো?
রবার্ট ডি সিলভা বললেন–ধর্মাবতার, আপনি এসব অনুমোদন করবেন না।
বিচারক রবার্ট ডি সিলভাকে থামিয়ে দিলেন। এরপর তিনি জেনিফারের উদ্দেশ্যে বললেন মিস পার্কার, আইন সম্পর্কে আদালতের সম্যক জ্ঞান আছে। তার জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। এই মামলার নিষ্পত্তি হলে আপনাকে আদালত অবমাননার অভিযোগে, অভিযুক্ত করা হবে। তবে এটা একটা খুনের মামলা তাই আপনার বক্তব্য আমি শুনতে রাজী আছি। এইবার তিনি স্টেনোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির বিবৃতিটা পড়ে শোনাতে অনুমতি দিলেন।
স্টেনোগ্রাফার পড়তে শুরু করল–কেন আব্রাহাম উইলসন ওই নিরীহ নিরস্ত্র কয়েদি রেমন্ড থর্পকে খুন করতে প্রভাবিত হয়েছিল তা আমরা কেউ জানি না…।
ব্যস এতেই চলবে, এই পর্যন্তই ঠিক আছে, ধন্যবাদ, জেনিফার আর পড়তে নিষেধ করল ওই স্টেনোগ্রাফারকে।
এবার ডি সিলভার উদ্দেশ্যে বলল–এই ছিল আপনার মূল বক্তব্য, তাই না মিঃ ডি সিলভা। এরপর বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলল ধর্মাবতার, আমার লার্নেড ফ্রেন্ডের বয়ান অনুযায়ী ধরে নিতে হবে যে নিহত কয়েদি রেমন্ড থর্প নিরস্ত্র ছিল। ওঁর এই বিবৃতিই আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ওঁর কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল যে সে কোনোভাবেই নিরস্ত্র ছিল না। তার হাতে ভয়ংকর কোনো মারণাস্ত্র ছিল, যার সাহায্যে ও যে কোনো লোককে খুনের ভয় দেখাতে পারে।
বিচারক ওয়াল্ডম্যান জেনিফারের এই মোক্ষম যুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। তিনি ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির দিকে তাকিয়ে বললেন মিস পার্কারের যুক্তি অবান্তর নয়। আপনি স্বয়ং ওঁকে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি মুখ খোলার মতো আর সাহস দেখালেন না।
বিচারক জেনিফারকে বললেন–আদালত এক্সিবিট-এ পেশ করার অনুমতি আপনাকে দিচ্ছে। আপনি এক্সিবিট-এ পেশ করতে পারেন।
বিচারককে ধন্যবাদ জানিয়ে জেনিফার জুরীদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল–মাননীয় জুরীবৃন্দ, এতদিন ধরে আপনাদের ভুল বোঝানো হয়েছিল। আপনারা সকলেই জানেন আমার মক্কেল আব্রাহাম উইলসন। তাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আপনাদের বলা হয়েছে যে আব্রাহাম নৃশংসভাবে খুন করেছে সিং সিং জেলের আরেকজন কয়েদিকে, যার নাম রেমন্ড থর্প। ওই খুনের ছবিটি আপনাদের সামনে খুব সুস্পষ্ট ভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল। আর আপনারাও তা বিশ্বাস করেছেন। কোনো কারণ ছাড়াই আব্রাহাম ওই খুনটি করে পরিকল্পিতভাবে। আচ্ছা আপনারা ভালো করে ভেবে দেখুন তো কোনো মানুষ বিনা কারণে ও উদ্দেশ্যহীনভাবে কাউকে খুন করতে পারে? লোভ, ক্রোধ, কামনা মানুষকে খুন করার প্রবণতা যোগায়। এক্ষেত্রেও তেমন একটা উদ্দেশ্য বা কারণ নিশ্চয়ই ছিল। তাহল আত্মরক্ষা। একটু আগে সিং সিং জেলের সহকারী ওয়ার্ডেন সাক্ষ্য প্রদান কালে বলেছিলেন এর আগেও জেলের ভেতরে খুনোখুনির ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। এর থেকে কি নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না যে সিং সিং জেলের কয়েদিদের জিম্মায় মারাত্মক সব অস্ত্র আছে। এবং নিহত ওই কয়েদির হাতেও যে ওই রকম কোনো অস্ত্র থাকবে, এটা ভাবা আমাদের ভুল হবে না। ওই অস্ত্রের দ্বারাই সে এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত আসামী আব্রাহাম উইলসনকে আক্রমণ করেছে। এবং নিজেকে রক্ষা করার তাগিদ বোধেই আমার মক্কেল ওই কয়েদি রেমন্ড থর্পকে বাধ্য হয়েই খুন করেছে। যদি আপনারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন যে আব্রাহাম উইলসন বিনা প্ররোচনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে রেমন্ড থর্পকে খুন করেছে তাহলে আপনারা তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন। আমার হাতে এই যে বাক্সটি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এর মধ্যে কতকগুলো মারাত্মক জিনিস আছে। সেগুলো আমি আপনাদের দেখাবো, সেগুলি দেখে আপনারা যদি কোনো সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আসামীকে নির্দোষ বলে মনে করেন সেই সিদ্ধান্তও আপনারা নিতে পারেন। এতটা বলে জেনিফার জুরীগণের মুখের দিকে তাকালো, তারা সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তার ওপর নজর রেখেছে।
বাক্সটার ঢাকা বন্ধ ছিল। সেটা ভীষণ ভারী, এটা এত ভারী যে এটা বহন করতে জেনিফারের খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেসব তোয়াক্কা না করে এবং জুরি মহোদয়গণকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জেনিফার আবার বলতে শুরু করল।
–আপনারা একটা কথা ভুলবেন না, তাহল সিং সিং জেলের সহকারী ওয়ার্ডেন নিজে এই বাক্সটা এনেছেন। এর ভেতর যেসব অস্ত্র আছে তা ওই জেলের কয়েদিরা ব্যবহার করে থাকে। জেলের সুপার এইসব সংগ্রহ করেছেন তল্লাসী চালিয়ে।
বাক্সটা হাতে করে জেনিফার এগিয়ে এল জুরীদের দিকে। অতর্কিতে সে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। তার হাতের বাক্সটিও হাত থেকে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাক্সের ঢাকনা খুলে ভেতরের সব জিনিস বেরিয়ে এল। সেগুলি আদালত চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।
এই অনভিপ্রেত ঘটনায় আদালতে উপস্থিত সবাই হতচকিত হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবাই আত্মস্থ হয়ে যে যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। জুরীরা, দর্শকরা সবাই ছুটে এলেন এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্যটি দেখার জন্য। এমন কি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকরাও বাদ গেলেন না। তারাও তাদের চক্ষুকর্ণ উন্মুক্ত করে সাগ্রহে এগিয়ে গেলেন।
মেঝের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অস্ত্রসম্ভারের মধ্যে কি নেই! আছে জেলের ভেতর থাকা কয়েদিদের নিজেদের হাতে তৈরী মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র। সেই সব অস্ত্র বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন মাপের, সংখ্যাও কম নয়। সে এক বিরাট তালিকা, যেমন হাতে তৈরী রাম দা, ছুরি, কাঁচি, ছররা বন্দুক, কুঠার, কুড়ুল। সব কটায় আবার কাঠের হাতল লাগানো আর ধারালো। এসবের সাহায্যে যে কোনো সময়ে যে কোনো মানুষকে খুন করা সম্ভব।
এতসব ভয়ংকর ধারালো অস্ত্র দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, আবার আদালতের ভেতর গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। বিচারক ওয়াল্ডম্যান অধৈর্য হয়ে তার বেঞ্চে বার বার হাতুড়ি ঠুকতে লাগলেন। তিনি ভিড় সরানোর চেষ্টা করলেন।
–একজন পেয়াদা জেনিফারকে সাহায্য করার জন্য ছুটে এল। কিন্তু জেনিফারের কাছ থেকে বাধা পাওয়ায় সে চলে গেল। ততক্ষণে জেনিফার মেঝেতে উঠে বসেছে। সে একটি একটি করে অস্ত্রগুলো তুলে বিচারককে দেখাতে লাগল। তারপর তা মিলিতভাবে আবার বাক্সে রাখতে লাগল। সব কটি অস্ত্র তুলতে তুলতে মিনিট দশেক সময় লেগে গেল তার। এদিকে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি নিজের মনে রাগে গরজাতে লাগলেন।
এবার জেনিফার উঠে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি পড়ল সাক্ষীর কাঠগড়ার দিকে। সে দেখতে পেল এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন মিঃ প্যাটারসন, সে ডি সিলভাকে ইশারা করে বুঝিয়ে দিল ইচ্ছা করলে তিনিও মিঃ প্যাটারসনকে জেরা করতে পারেন।
ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা বহুদিন ধরে এই আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই বিষয়টি তিনি খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। তাই তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলেন যে এত কাণ্ডের পর আর জেরা করে কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া এই মামলার ফল কি নির্ধারিত হবে তা তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলেন। জেনিফার তার মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করে ডি সিলভাকে ঘায়েল করে ফেলেছে। তার এই অস্ত্রের মাধ্যমে সে মামলাটিরও দফারফা করে ফেলেছে। এখন শত চেষ্টা করলেও তিনি সেই ক্ষতি পূরণ করতে পারবেন না। তাই তিনি নিরুপায় হয়ে বিচারককে বললেন–আমার জেরা করার আর প্রয়োজন নেই।
জেনিফার স্মিত হেসে আসামী আব্রাহাম উইলসনকে জেরা করার জন্য বিচারকের কাছে অনুমতি চাইল। বিচারক সম্মতি জানালে জেনিফার আসামীকে কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে বলল।
.
আসামী আব্রাহাম উইলসন কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল। আবার সওয়াল-জবাব পর্ব শুরু হল।
–আপনার নাম?
আব্রাহাম উইলসন।
–মিঃ উইলসন, আপনি কি রেমন্ড থর্পকে খুন করেছেন?
হ্যাঁ, মাডাম।
–কেন করেছেন এবং তার উদ্দেশ্য কি কোন কথা গোপন না করে আদালতের সমক্ষে জানান।
–হুজুর ও আমাকে খুন করতে চেয়েছিল, তাই ওকে আমি খুন করেছি।
জেনিফার বাক্সটি আবার খুলল। তার ভেতর থেকে সে দুটি জিনিস বের করল। একটি ভারী চিমটে ও একটি ধারালো রামদা। উইলসনের সামনে রামদাটা তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করল সে–এটাই কি সেই রামদা যার সাহায্যে রেমন্ড থর্প আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল?
সরকারী উকিল মিঃ ডি সিলভা গর্জে উঠলেন–অবজেকশন মী লর্ড, কোন অস্ত্র নিহত কয়েদীর হাতে ছিল তা আসামী জানবে কি করে?
ডি সিলভার কথার সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে জেনিফার আবার বলতে লাগল–যে অস্ত্র দিয়ে আপনাকে রেমন্ড থর্প আক্রমণ করেছিল, সেটা কি এটা?
-হ্যাঁ ম্যাডাম।
–আর এই চিমটেটাকেও আপনি ওই নিহত কয়েদীর হাতে দেখতে পেয়েছিলেন?
–হ্যাঁ ম্যাডাম।
এর আগে কি আপনি রেমন্ড থর্পের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন?
–হ্যাঁ ম্যাডাম।
তাহলে কি ধরে নেবো, এই অস্ত্র দুটো হাতে নিয়ে আপনার দিকে ও ছুটে এসেছিল, আর তাই আপনি আত্মরক্ষার জন্য ওকে খুন করে বসলেন?
-হ্যাঁ ম্যাডাম, ঠিক তাই। জেনিফার বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলল–ধর্মাবতার আমার জেরা শেষ হয়ে গেছে। এখন ইচ্ছে করলে আমার লানেড ফ্রেন্ড মিঃ ডি সিলভা আসামীকে জেরা করতে পারেন।
বিচারক ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভাকে জেরা করার অনুমতি দিলেন। মিঃ ডি সিলভা এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলেন কাঠগড়ার দিকে। তিনি আব্রাহাম উইলসনকে জিজ্ঞাসা করলেন–আচ্ছা, এটাই কি আপনার প্রথম খুন নাকি এর আগেও খুন করেছন?
-আমি অন্যায় করেছি, এখন তা শুধরাতে চাইছি।
–হ্যাঁ বা না এক কথায় উত্তর দিন।
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা বলুন তো এ পর্যন্ত আপনি কতজনকে খুন করেছেন?
দুজনকে।
ব্যস, মাত্র দুজন? নিজেকে কি মনে করো? ভগবান নাকি? ইচ্ছে হলেই এক একজন মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলো! এত ক্ষমতা থাকাও তো আবার গর্বের বিষয়, তাই না?
আব্রাহাম উইলসন উত্তেজিত হয়ে উঠলো। নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। সে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ডি সিলভাকে নোংরা ভাষায় গালি দিল।
মি. ডি সিলভাও কম উত্তেজিত হয়ে পড়েন নি। তিনি দাঁতে দাঁত ঘষে চিৎকার করে বললেন–অনেক বীরত্ব দেখিয়েছে, এখন থামো। আচ্ছা রেমন্ড থর্পকে খুন করার সময় কি তুমি এতটাই উদ্ধত হয়ে উঠেছিলে?
–আপনি ভুল বলছেন, ও নিজেই আমাকে খুন করতে এসেছিল।
তখন ডি সিলভা সেই রামদা ও চিমটে নিয়ে কাঠগড়ার কাছাকাছি গিয়ে আব্রাহামের চোখের সামনে তুলে ধরলেন। তাকে সেটি দেখিয়ে বললেন–এগুলো নিয়ে তোমায় খুন করতে এসেছিল! তুমি যতটা ভয় পেয়েছিলে ততটা মারাত্মক কিন্তু এই অস্ত্রগুলো নয়। এগুলো দিয়ে মারলে হয়তো মাথা বা শরীরের কোনো অংশ ফুলে যেতো। আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি এসবের আঘাতে তোমার প্রাণ সংশয় ঘটতো না। আচ্ছা, তোমার কি ধারণা এই চিমটে দিয়ে মানুষের কতটা ক্ষতি করা যায়?
–এই চিমটের সাহায্যে মানুষের অণ্ডকোষ চেপে ধরে তাকে মেরে ফেলা সম্ভব, আব্রাহাম উইলসন ঝাঝালো স্বরে উত্তর দিলেন।
.
জেরা পর্ব শেষ। এবার জুরীরা সিদ্ধান্ত নেবেন। আসামী দোষী না নির্দোষ তা ঘোষণা করবেন তারা। তাই জুরীরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে গেছেন পরামর্শ নিতে। সেও প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেছে। রবার্ট ডি সিলভা ও তার সহযোগীরাও আদালত ছেড়ে বাইরে এখন। কেবল মাত্র জেনিফার পার্কার অনড় অটল হয়ে নিজের আসনটিতে একলা বসে আছে। সে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত। সে মনের জোর হারিয়ে ফেলেছে। তাই চেয়ার ছেড়ে উঠবার মতো ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনোটাই এখন আর অবশিষ্ট নেই।
এখন আদালত কক্ষ একেবারে শূন্য। এমন সময় কেন বেইলি জেনিফার পার্কারের কাছে এলেন। তিনি সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন–জেনিফার কিছু খাবে কি? কিছু না হলেও অন্তত এক কাপ কফি খাও।
জেনিফার শান্তস্বরে উত্তর দিলনা, এখন আর কিছু ভালো লাগছে না।
জেনিফার এই মামলাটা নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। সে ভাবছিল যা হবার তা তো হয়ে গেছে। একজন মানুষকে রক্ষা করার জন্য তার যা করা কর্তব্য করেছে। এবার ভগবানই একমাত্র ভরসা। তিনি বাঁচালে তবেই আসামী বাঁচবে। তার জয় হবে। সে দুচোখ বন্ধ করে ভগবানের প্রার্থনা করতে লাগল। ভয় ক্রমশ তার মনের ভেতর চেপে বসেছে। সে বেশ বুঝতে পারছে, জুরীদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার ওপর তার ও আব্রাহাম উইলসনের জীবন নির্ভর করছে। তারা আব্রাহামের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবেন। তাকেও দোষী সাব্যস্ত করবেন।
জুরীরা ফিরে এলেন। তাদের সবার মুখ কালো মেঘে ঢাকা। জেনিফার তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেগে বইতে লাগল। তার সারা শরীর যেন হিম শীতল হয়ে গেছে। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়েছে। সে তাদের মুখ দেখে বুঝতে পারছে যে তারা আসামীর অপরাধ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েছেন। তারই জন্য একজন নির্দোষ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হল। তার রাগে ক্ষোভে দুঃখে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সে ভাবছে এই মামলা নেওয়া উচিত হয়নি। রাবার্ট ডি সিলভার মতো একজন পাকা অভিজ্ঞ উকিলের সঙ্গে লড়াই করা তার বোকামি হয়েছে। তাছাড়া এই মামলায় যে তার জয় হবে এই ধারণা হল কিভাবে? তার ইচ্ছে করছিল আব্রাহাম উইলসনের পক্ষে অন্য উকিল দিয়ে এই মামলাটা আবার নতুন করে সাজানোর। কিন্তু অতশত করার মতো সময় আর নেই জেনিফারের হাতে।
হঠাৎ জেনিফারের দৃষ্টি পড়ল কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আব্রাহাম উইলসনের ওপর। সে এখনও নিশ্চল পাথর প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
এতক্ষণে জজ ওয়াল্ডম্যান মুখ খুললেন, তিনি জুরীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আপনারা কি সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন?
-হ্যাঁ, ধর্মাবতার।
জজ ইশারা করলেন তার পেশকারকে। সে ছুটে গেল জুরী চারজনের দিকে। জুরীরা তার হাতে একটি কাগজ দিলেন। পেশকার তা নিয়ে জজের হাতে দিল।
এদিকে জেনিফারের দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। তার মনে হচ্ছে এখুনিই বুঝি হৃৎপিন্ডটা স্তব্ধ হয়ে যাবে।
জজ ওয়াল্ডম্যান ওই কাগজটির ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর আদালত কক্ষে উপস্থিত সমস্ত মানুষদের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। সব শেষে তার নজর গিয়ে পড়ল আসামী আব্রাহাম উইলসনের ওপর, তাকে দেখে তার মনে হল সে যেন একটা প্রাণহীন দেহে পরিণত হয়েছে। ইতিপূর্বে কে তার শাস্তি নির্ধারণ করে ফেলেছে।
বিচারক ওয়াল্ডম্যান আসামীর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে ধীরে ধীরে বললেন–এতক্ষণ। ধরে জুরীগণ সমস্ত সাক্ষীদের বয়ান ও সাক্ষ্য প্রমাণগুলি বিচার বিশ্লেষণ করলেন। তারা সকলেই একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন। আমিও তাদের সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করছি। তাই। আমি ঘোষণা করছি যে আসামী আব্রাহাম উইলসন সম্পূর্ণ নিরপরাধী।
জেনিফার জুরীগণের রায় শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবছে, ঠিক শুনেছে তো? উইলসনের অবস্থাও তথৈবচ। কয়েক মুহূর্তের জন্য আদালতের ভেতর পিন পড়লেও শোনা যাব এমন স্তব্ধতা বিরাজ করছিল। তারপরেই দর্শকরা উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে উঠল। উইলসন জেনিফারের দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসিতে প্রাণ ফিরে পাওয়ার আনন্দের পরশ আছে। ছুটে গেল জেনিফার উইলসনের কাছে। বিরাট আকৃতির উইলসন তাকে দেখে নিচু হল এবং বিশাল দুটি হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল। জেনিফার আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। শ্রাবণের ধারার মতো তার দুচোখ থেকে আনন্দাশ্রু বেরিয়ে এল। সেই মুহূর্তে সাংবাদিকরাও সেখানে এসে হাজির। তারা এমন একটি দৃশ্যকে নিজেদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত করার আশায় উন্মুখ হয়ে উঠল। তারা জেনিফারকে একের পর এক প্রশ্ন করে করে উত্যক্ত করে তুলল।
জেনিফার ওইসব সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের উত্তর দিল না। এইসব সাংবাদিকরা এখানে এসেছিল কিভাবে একজন নিরপরাধ মানুষকে অযথা হয়রানি করা হয়, কিভাবে মিথ্যে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তা দেখতে। উইলসনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলে তাহলে পরিস্থিতি কি রকম হত তা জেনিফারের কল্পনার অতীত। অবশ্য এখন সে আর ওসব ভাবতে পারছে না। সে দ্রুত হাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় ফাইলপত্র একটা ব্রীফকেসে গুছিয়ে নিল।
এমন সময় একটা পেয়াদা এসে খবর দিল- মিস পার্কার, জজ ওয়াল্ডম্যান আপনাকে ডাকছেন, আপনি এখুনিই ওঁর কামরায় যান। সঙ্গে সঙ্গে জেনিফারের মনে পড়ে গেল যে জজ তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনবেন বলেছিলেন। খুশী ও আনন্দের আতিশয্যে এতক্ষণ সে ওসব কথা ভুলে গিয়েছিল। তবে এখন আর সে ওই অভিযোগকে পরোয়া করে না। তার কাছে এই মুহূর্তে একটা বিষয়ই বিশেষভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে, তাহল, সে যে শেষপর্যন্ত আব্রাহাম উইলসনকে রক্ষা করতে পেরেছে এটাই।
সে এক মুহূর্তের জন্য ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির টেবিলের দিকে তাকাল। দেখতে পেল রবার্ট ডি সিলভা উত্তেজিতভাবে দরকারী কাগজপত্রগুলো ব্রীফকেসে ভরছেন। দুজনের চোখাচোখি হল। কিন্তু কেউ কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলল না।
জেনিফার পার্কার ধীর পায়ে জজ ওয়াল্ডম্যান-এর খাস কামরায় এসে উপস্থিত হল।
জজ ওয়াল্ডম্যান তাকে দেখে ভাবলেশহীনভাবে বলতে শুরু করলেন–অপমান আর ঔদ্ধত্য এ দুটো একটাও আমি এজলাসের ভেতর বরদাস্ত করবে না। তবে একথা শুধু আপনার ক্ষেত্রেই নয়, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
জেনিফার কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
আজ দুপুরে আপনি জেরা করার সময় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। এমন কি নিজের এক্তিয়ারের বাইরে চলে গেছেন। আমি বুঝতে পারছি, একটি মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তেছে। আপনার বক্তব্যের ওপর আসামী দোষী না নির্দোষী তা নির্ভর করছে। তাই এবারের মতো আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আদালত অবমাননার অভিযোগে আমি আর আপনাকে অভিযুক্ত করবো না।
অনেক কষ্টে জেনিফারের মুখ থেকে বেরিয়ে এল শুধু একটি কথা-ধন্যবাদ ধর্মাবতার।
জজ ওয়াল্ডম্যান আবার বলতে লাগলেন–যে কোনো মামলার রায় দেবার পরে আমি বুঝতে পারি ন্যায়সঙ্গত বিচার করেছি কি না। কিন্তু আব্রাহাম উইলসনের ক্ষেত্রে আমি এখনও স্থির করতে পারিনি কিছু। আমি সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। জানি না এক্ষেত্রে আমি যে রায় দিয়েছি সেটা সত্যিই ন্যায়বিচার হয়েছে কিনা।
জেনিফার পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
ব্যস, এই কথাগুলো জানানোর জন্য আমি আপনাকে ডেকেছিলাম, এবার আপনি আসতে পারেন।
.
সেদিন সব কটি সান্ধ্য পত্রিকায় জেনিফার, রবার্ট ডি সিলভা ও আব্রাহাম উইলসনের ছবি ছাপা হল। টেলিভিশনের প্রত্যেকটি নিউজ চ্যানেলগুলো জেনিফারের জয়লাভের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই তার কৃতিত্বের তারিফ করছিল। তাকে সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল। আজ জেনিফারও নিজের জয়লাভে ভীষণ খুশী। বিজয়িনীর গর্বে গর্বিত আজ সে, নিজের জয়লাভের খবর সে উপভোগ করছিল।
লাচেট রেস্তোরাঁ। সেখানে কেন বেইলির আমন্ত্রণে জেনিফার এসেছে ডিনার খেতে। মিঃ বেইলির উদ্দেশ্য ছিল জেনিফারের এই জয়লাভকে চিরস্মরণীয় করে রাখার। সেখানের প্রতিটি স্টাফ ইতিমধ্যেই জেনিফারের জয়লাভের খবর দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন মারফত পেয়ে গেছে। তারা জেনিফারকে চিনতে পারল। তারা নানাভাবে জেনিফারকে অভিনন্দিত করতে লাগল। তাদের এই আন্তরিকতার কথা জীবনে জেনিফার ভুলতে পারবে না।
কে একজন এক বোতল দামী সুস্বাদু ওয়াইন উপহার পাঠালো জেনিফারকে। জেনিফার তৃষ্ণার্ত ছিল। তাই পর পর তিন গ্লাস ওয়াইন ঢক ঢক করে গিলে ফেলল এক নিঃশ্বাসে।
এবার জেনিফার বলতে শুরু করল–কেন, তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, আর ওই রাবট ডি সিলভা আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। ইচ্ছে করেই আক্রোশবশতঃ ডি সিলভার নামটা বিকৃতভাবে উচ্চারণ করল সে।
–কেন, এরকম মনে হওয়ার কারণ কি? কেন বলল।
উনি আমায় ঘেন্না করেন, ভীষণ ঘেন্না করেন। উনি আমাকে বার থেকে বের করে দেবেন বলেছিলেন। শেষ অব্দি কি হল? ওঁর আস্ফালন বিফলে গেল। উনি কিছুই করতে পারলেন না, কি বল কেন?
রাত তখন দুটো। জেনিফার সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছে, ভালোভাবে হাঁটার ক্ষমতা সেই সময় লোপ পেয়েছে। কেন বেইলি তাকে ধরে নিয়ে এল তার অ্যাপার্টমেন্টে। পরদিন ঘুম ভাঙলো টেলিফোনের কর্কশ আওয়াজে। কোনরকমে চোখ দুটো খুলল সে। ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজে।
–জেনিফার শুয়ে শুয়েই রিসিভারটা কানে তুলে নিল, ও প্রান্ত থেকে কেনের গলা ভেসে এল–শীগগির চলে এসো জেনিফার। এখানে যে সব কাণ্ড কারখানা শুরু হয়েছে, আমার একার দ্বারা সামলানো সম্ভব নয়।
–ঠিক আছে, আমি ঘটাখানেক বাদে যাচ্ছি। ততক্ষণ তুমি সামলাও, কেন।
এক ঘণ্টা বাদে জেনিফার অফিসে গিয়ে পৌঁছল। সে দেখল দুটো টেলিফোনই একসঙ্গে বেজে চলেছে। তাকে দেখে কেন ব্যস্ত হয়ে বলল–ওঃ তুমি এসে গেছো! একের পর এক ফোন আসছে। আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা হয়েছে, সবাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, রেডিও, টিভি ছাড়াও বড় বড় আইন প্রতিষ্ঠানগুলি জেনিফারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক। দেশের প্রত্যেকটি গণমাধ্যমগুলি ইন ডেপথ। স্টোরি করার জন্য তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইছে। রাতারাতি জেনিফার খ্যাতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে গেল। এছাড়া আরও কয়েকটি জায়গা থেকে টেলিফোন আসছিল, যারা এক সময় জেনিফারকে উপেক্ষা করেছিল, চাকরী দেয়নি, সেইসব ল সংস্থাগুলিও তার সাক্ষাৎ প্রার্থী। তারা জানতে চাইছে কবে কখন জেনিফারের সঙ্গে তারা দেখা করবে।
.
এদিকে রবার্ট ডি সিলভার অবস্থা তখন আহত বাঘের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে। রাগে। ও হতাশায় তার চোখমুখ থমথম করছে। তিনি একজন সহকারীকে ডেকে পাঠালেন। তাকে ঝাঝালো গলায় আদেশ করলেন-জেনিফার পার্কারের নামে একটা কনফিডেনসিয়াল ফাইল প্রস্তুত করো। ওর যেখানে যত মক্কেল আছে তাদের নাম, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি সম্পর্কে অনুসন্ধান কর। ও সব বিস্তারিতভাবে আমাকে জানাও।
সহকারীটি বিনম্র সুরে বলল হা স্যার।
.
বছর খানেক আগের ঘটনা। নিউইয়র্কের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম মাফিয়া ডন ছিলেন অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি। তার জামাই হলেন মাইকেল মোরেটি। তিনি শ্বশুরের সবকটি ব্যবসার কর্তৃত্ব অর্জন করলেন। তিনিই সেই সময় মাফিয়া পরিবারের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন। গ্র্যানেলির উকিল টমাস কোলফ্যাক্স মাইকেলকে একেবারেই পছন্দ করতেন
। তাই যখন মাইকেলকে র্যামোস ভ্রাতৃদ্বয়ের হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করা হল এবং গ্রেপ্তার করা হল, তখন টমাস কোলফ্যাক্স ভীষণ খুশী হয়েছিলেন। তার চোখেমুখে পরম তৃপ্তির হাসি দেখা দিয়েছিল। নিক মিটো, সালভাতের ফিওরে ও জোসেফ কেলেলা, এই তিনজন কুখ্যাত অপরাধীকে মাইকেল ওরফে মাইক নিজের দলভুক্ত করেছিলেন। এই ব্যাপারটিও টমাস কোলফ্যাক্স বরদাস্ত করতে পারেন নি। আসলে গ্র্যানেলি পরিবারে মাইকেলের আধিপত্য বিস্তারলাভ করুক এটা কখনই চাননি টমাস কোলফ্যাক্স। এদিকে মাইকেল মোরেটিও টমাস কোলফ্যাক্স-এর বিরুদ্ধাচরণ করতেই বেশী আগ্রহী ছিলেন। আবার । টমাসকে যতটা প্রাধান্য দেন ঠিক ততখানিই টমাস মাইকেলের কাছে গুরুত্বহীন।
র্যামোস ভাইদের খুন করার মামলা চলছিল। আর সেই মামলায় মাইকের প্রধান অনুচর ক্যামিলল স্টেলা রাজসাক্ষী হতে রাজী হয়েছিল, এ খবর শুনে টমাস কোলফ্যাক্স ভীষণ উৎফুন্ন হয়েছিলেন। তিনি জানতেন ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সলভার মতো উঁদে উকিলের হাত থেকে মাইকের নিস্তার নেই। ডি সিলভার কাছে মাইকের বিরুদ্ধে যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ আছে তা এক একটি মারণাস্ত্র হয়ে মাইককে বিধবে। তার সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। রবার্ট ডি সিলভা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন ওইসব মোক্ষম সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে। তাই প্রতিপক্ষ হয়েও টমাস কোলফ্যাক্স কায়মনঃবাক্যে প্রার্থনা করেছিলেন, যেন তিনি এই মামলায় হেরে যান এবং রবার্ট ডি সিলভা বিজয়ী হন।
মামলার গতি প্রকৃতি ক্রমশ আইকেলকে ভাবিয়ে তুলছে। তিনি নিশ্চিত এই মামলা থেকে তার নিষ্কৃতি নেই। তাকে হারতেই হবে এবং মৃত্যু তার শিরোধার্য। অনেক চিন্তা ভাবনা করে মাইক একটা উপায় বের করেছিলেন। রাত চারটে, তার বিশ্বস্ত সাগরেদ জোসেফ কেলেলাকে ফোন করেছিলেন তিনি।
কোনোরকম ভনিতা না করে মাইক সোজা সাপটা ভাষায় বললেন–আগামী সপ্তাহে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিসে কয়েকজন নবনিযুক্ত উকিল শপথ গ্রহণ করবেন। তারা সবাই রাবর্ট ডি সিলভার সহকারী হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন। তাদের সবার নামধাম আমার চাই। তুমি পাত্তা লাগাও।
একসপ্তাহ পরে মাইকেল মোরেটি এলেন আদালতে। তিনি সরকারী উকিলের সেইসব নতুন সহকারীদের মুখ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। অবশেষে চোখ গিয়ে পড়ল জেনিফার পার্কারের দিকে। তাকেই তাঁর কাজের উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল, লাঞ্চের সময় মাইকের এক বিশ্বস্ত অনুচর একটি মুখবন্ধ বড় খাম দিয়েছিল জেনিফারকে। তাকে এও বলা হয়েছিল ওই খামটা কোথায় কাকে দিতে হবে। ওই লোকটির নির্দেশে জেনিফার পার্কার রাজসাক্ষী ক্যামিলো স্টেলার হাতে ওই খামটি পৌঁছে দিয়েছিল। ফলে ঘটল বিপত্তি। মাইকেল মোরেটির মামলা তো খারিজ হয়ে গেল, উপরন্তু জেনিফার পড়ল সমস্যায়।
এসব বছর খানেক আগের ঘটনা। কেউ আর এসব কথা মনে রাখেনি। কিন্তু আজ এক বছর পর আবার মাইকেলের স্মৃতিপটে জেনিফার পার্কারের মুখটা ভেসে উঠল। জেনিফারের কীর্তির পরিচয় মাইকেল টিভির দৌলতে জেনে গেছেন। এছাড়া তার ছবি ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে প্রতিটি সংবাদপত্রে। তাও মাইকেল লক্ষ্য করেছেন। আব্রাহাম উইলসন মামলায় ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভাকে পরাস্ত করে সে বিজয়ীনী হয়েছে এসব খবর মাইকেল জানতে পেরেছেন। এর সঙ্গে মাইকেল মোরেটির সেই মামলার প্রসঙ্গটিও উল্লিখিত হয়েছে। টেলিভিশনে জেনিফারের সাক্ষাৎকার শুনে ও তার ছবি দেখে মাইকেল মোরেটির খুব ভালো লেগেছে।
মাইকেলের পাশে বসে তার শ্বশুর অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি টেলিভিশন দেখছিলেন। তিনি একসময় বলে উঠলেন–এই মেয়েটিকেই তুমি তোমার কাজে ব্যবহার করেছিলে, তাই না মাইক?
মাইকেল উত্তরে বললেন হ্যাঁ, এর বুদ্ধি ও সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে ও আমার কাজে আসতে পারে।
.
আব্রাহাম উইলসনের রায় বেরোনোর পরের দিন জেনিফার একটি ফোন কল পেল। সে ফোনের রিসিভার তুলতেই শুনতে পেল অ্যাডাম ওয়ার্নারের কণ্ঠস্বর।
-হ্যালো, জেনি, আমি অ্যাডাম ওয়ার্নার বলছি। তোমায় অজস্র অভিনন্দন জানাচ্ছি।
-ধন্যবাদ, অ্যাডাম।
–আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে ডিনার খাওয়ানোর, কবে আসতে পারবে বলো? তবে শুক্রবারের আগে তুমি ডেট ফেলল না। ওইদিন যদি তুমি আসতে পারো। আমি তোমার বাড়িতে যাব কি?
সঙ্গে সঙ্গে জেনিফারের চোখে ভেসে উঠল তার হত দরিদ্র ঘরটি। পুরোনো আমলের সেকেলে সব আসবাবপত্র। সবদিকে জরা জীর্ণতার ছাপ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। এইরকম • পরিবেশের মধ্যে অ্যাডামকে আসতে বলতে জেনিফারের একদম ইচ্ছে করল না।
অ্যাডামের প্রস্তাব শুনে সে বলল–না, অ্যাডাম আমার অ্যাপার্টমেন্টে তোমাকে আসতে হবে না। আমি অন্য কোথাও তোমার সঙ্গে দেখা করবো, ঠিক রাত আটটায়, বলেই জেনিফার রিসিভার নামিয়ে রাখলো।
এমন সময় কেন বেইলি এসে ঘরে ঢুকল। জেনিফারকে খুশী খুশী দেখে বলল–কি উকিলসাহেবা, বড়ো কোনো মক্কেল পাকড়াও করেছে নাকি?
উচ্ছ্বসিত হয়ে জেনিফার কেনকে বলল–আমি একজনের নাম বলবো, তুমি তার সম্পর্কিত কিছু তথ্য জোগাড় করতে পারবে, কেন?
কেনও ততোধিক মজা করে বলল–আমি কাগজ পেন নিয়ে প্রস্তুত আছি, নামটি বলে ফেলল।
জেনিফারের মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। সে কিছু একটা চিন্তা করল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর আমতা আমতা করে বলল–থাক কেন, তার আর দরকার হবে না।
কেন বেইলি পেন কাগজ সরিয়ে রেখে বলল–যো হুকুম, উকিল সাহেবা। কিন্তু তোমার কি হয়েছে জেনিফার? তুমি কি এত ভাবছো?
জেনিফার ইতস্তত করে বলল–আমি যার খোঁজখবর নিতে তোমায় বলছি তার নাম অ্যাডাম ওয়ার্নার।
কেন বলল–ওঁর সম্পর্কে কিছু জানতে হলে আমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই তোমার। কাগজ পড়লেই তুমি সব জানতে পারবে।
তবুও তোমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই আমি, কেন।
–ওই ভদ্রলোেকের নাম অ্যাডাম ওয়ার্নার, তা তো তুমি জানো। উনি হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে পাশ করেছেন। বছর পঁয়ত্রিশের যুবক। সম্ভ্রান্ত বিত্তশালী পিতার সন্তান। তিনি নিজেও পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। নিডহ্যাম, পিয়ার্স অ্যান্ড ওয়ার্নার, ফিঞ্চ-এর অন্যতম অংশীদার।
জেনিফার কৌতূহলী হয়ে উঠল। সে বড় বড় চোখ করে বলল তুমি এত খবর জানলে কিভাবে, কেন?
তুমি তো জানো আমার অনেক লোকের সঙ্গে পরিচয় আছে। তাদের মারফৎ জানতে পেরেছি এবার ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, সেনেটর হবার আশায়। তিনি বেশ উচ্চাকাঙ্খী। তার সম্পর্কে এও শুনেছি যে ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ অর্জন করার জন্য তিনিও এখন থেকেই প্রস্তুত হচ্ছেন।
জেনিফার অজান্তিকে বলল–সে ক্ষমতা ও যোগ্যতা অ্যাডামের আছে। প্রকাশ্যে বলল–ওঁর ব্যক্তিগত জীবন কি রকম, তা কি জানো?
মিঃ ওয়ার্নার বিবাহিত। নৌবাহিনীর প্রাক্তন সচিবের মেয়ে তার সহধর্মিণী। ওই ভদ্রমহিলার আরেকটি পরিচয় আছে, তিনি হলেন তার স্বামীর সিনিয়র পার্টনার স্টুয়ার্ট নিডহ্যামের ভাগ্নী। ।
অ্যাডাম বিবাহিত জেনে মনে মনে মুষড়ে পড়ল জেনিফার।
–তবে কৌতূহলবশতঃ একটা প্রশ্ন না করে করে আমি পারছি না জেনিফার। ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে জানার এত আগ্রহ কেন তোমার? কেন বলল।
না না তেমন কিছু নয়, নিছক কৌতূহল মাত্র।
.
কোন কথা না বলে কেন বেইলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই অবসুরে জেনিফার অ্যাডামের কথা ভাবতে বসলো। অ্যাডাম জেনিফার সারা মন জুড়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অ্যাডাম কি নেহাত খাওয়াবে নাকি অন্য কোনো কারণ আছে এর পেছনে। তাছাড়া অভিনন্দন জানাতে চাইলে তো সে আগেই টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছে। তার জন্য বাইরে দেখা করার দরকার তো ছিল না। উনি এত বোকা নন যে নিজের স্ত্রীর কথা বলার জন্য আমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছেন। সে যাক গে, শুক্রবার রাত তো আগে আসুক, তারপর ভাবা যাবে। আমার মনে হয় এরপর আর কোনেদিন উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না।
সেদিন দুপুরে একটা ফোন এল। ফোনটা ছিল পিবডি অ্যান্ড পিবডি আইন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়ার পার্টনারের।
তিনি বললেন–কদিন ধরেই আপনাকে ধরার জন্য চেষ্টা করছি। আপনাকেকাল দুপুরে লাঞ্চ খাওয়াবো, আপনার হাতে সময় আছে তো?
জেনিফার জানে আব্রাহাম উইলসনের মামলার খবর টিভি ও কাগজে বেরোতেই সবার মনে এইরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাকে সবাই খাতির যত্ন করতে চাইছে। তাই সকলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তাকে ডিনার লাঞ্চ খাওয়াবার কথা।
জেনিফারকে নীরব দেখে মিঃ পিবডি সিনিয়ার পার্টনার আবার বললেন–কাল দুপুরে আপনি রেডি থাকবেন। মাই ক্লাব রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাব আপনাকে।
পরদিন দুপুরবেলা। সিনিয়ার পার্টনার মিঃ পিবডির সঙ্গে জেনিফার এল লাঞ্চ খেতে। খেতে খেতে নানা কথাবার্তার মাঝখানে মিঃ পিবডি বললেন আমাদের কোম্পানিতে একজন এ্যাটর্নির প্রয়োজন যদি আপনি ওই পদটি গ্রহণ করেন মিস পার্কার? প্রথমে আমরা পারিশ্রমিক হিসেবে আপনাকে পনেরো হাজার ডলার দেব।
পনেরো হাজার ডলার শুনেই তো জেনিফার আকাশ থেকে পড়ল। একবছর আগের একটা কথা তার মনে পড়ল। একটি চাকরীর আশায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে এ অফিস ও অফিস। তখন কেউ তাকে সাহায্য করেনি। তার এখন অনেক কথাই মনে পড়ল।
সিনিয়ার পার্টনার মিঃ পিবডি আবার বলতে শুরু করলেন–আপনার যা প্রতিভা তাতে কয়েক বছরের মধ্যে আপনি আমাদের কোম্পানীর একজন পার্টনার হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে।
বার্ষিক আয় পনেরো হাজার ডলার আর ভবিষ্যৎ পার্টনারশিপ হওয়ার অঙ্গীকার, এ যেন জেনিফার ভাবতেই পারছে না, সে কোনো মন্তব্য করতে পারলো না।
তার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে মিঃ পিবডি বললেন–তাহলে আগামী সোমবার থেকেই আপনি আসুন, মিস পার্কার।
না, সংক্ষেপে জবাব দিল জেনিফার।
–তাহলে আপনার ইচ্ছে মতো কোনো একদিন।
আমাকে ক্ষমা করুন মিঃ পিবডি, আপনার অফারটা আমি নিতে পারলে সত্যিই ভীষণ খুশী হতাম।
মিঃ পিবডি একটু চিন্তা করে বললেন–ঠিক আছে, আপনাকে আর একটু বেশি বাড়িয়ে দেব। পনেরোর পরিবর্তে বছরে কুড়ি বা পঁচিশ হাজার ডলারই আপনাকে দেওয়া হবে, মিস পার্কার। তবে আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন।
না, মিঃ পিবডি, এতে আমার আর বোঝাবুঝির কিছু নেই। আমি নিজের স্বাধীন ব্যবসা নিয়ে খুব ভালোই আছি।
ক্রমে ক্রমে জেনিফারের মক্কেলের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তবে তারা কেউই উচ্চবিত্ত নয়। তবুও তো তারা তার মক্কেল। এই অফিসের ছোট্ট পরিধির মধ্যে আর কুলোচ্ছে না।
একদিন সকালে কেন বেইলি এই বিষয়টা উত্থাপন করল। সেদিন তিনজন মক্কেল এসেছিল জেনিফারের কাছে। একজন জেনিফারের অফিস ঘরে বসে কথা বলছিল। অন্য দুজন বাইরে দাঁড়িয়েছিল। পাশের টেবিলে বসেছিল কেন বেইলি। সে হঠাৎ বলে উঠল এখানে আর কাজ করা সম্ভব নয়। শহরের অন্য কোনোখানে তোমাকে একটা অফিস করতে হবে। আর সেটা আমরা খুব সুন্দর করে সাজাবো।
জেনিফার স্বাভাবিক গলায় বলল–আমিও কিছুদিন ধরে এই কথাটা ভাবছি, কেন।
তবে আমার একটা অসুবিধা দেখা দেবে। তোমার কথা মনে পড়বে, তুমি চলে গেলে আমি তোমাকে ভীষণভাবে মিস্ করবো। কেন মাথা নিচু করে কোনো রকমে কথাগুলো বলল। ।
জেনিফার অবাক হয়ে বলল–তুমি এসব কি বলছো কেন, আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না। আমি যেখানে যাব সেখানে তোমাকেও নিয়ে যাব।
জেনিফারের কথা শুনে কেন বেইলি হো হো করে হেসে উঠে বলল তুমি কি পাগল হয়েছ? তোমার সঙ্গে গেলে আমাকে এখানকার ব্যবসা তুলে দিতে হবে যে।
এক সপ্তাহ পরে কেন বেইলি ও জেনিফার একটা বাড়িতে ঘর ভাড়া নিল। জায়গাটা ফিফথ এ্যাভিনিউতে। আগের তুলনায় এই ঘরটি অনেক ভালো। তারা একসঙ্গে তিনটি ঘর নিল। দুটি নিজেদের বসার জন্য আর একটি সেক্রেটারীর জন্য। তার দুজনে পরামর্শ করে একজন মহিলা সেক্রেটারী নিযুক্ত করল। নাম তার সিনথিয়া এলম্যান, বয়সে জেনিফারের থেকে ছোট। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে।
জেনিফার তাকে বলল–এখন কাজ কম হবে, কিন্তু পরে বাড়তে পারে।
এতে আর আশ্চর্যের কি আছে? আমার কোনো অসুবিধা হবে না মিস পার্কার, বলল সিনথিয়া। তার গলার স্বর শুনেই জেনিফারের আর বুঝতে বাকি রইল না যে এই মেয়েটি তাকে একজন আইডিয়াল লেডি ভাবছে। অবশ্য এটা ভাবার পেছনে দুটি কারণ আছে, সেটা হল তার কৃতিত্ব ও অভাবনীয় সাফল্য।
এমন সময় কেন বেইলি সেখানে এসে হাজির হল, সে বলল–এতবড় অফিসে বসে একা একা কাজ করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। চলো একটা থিয়েটার দেখে মন ও শরীরটাকে চাঙ্গা করে আসি। তারপর বাইরে কোথাও ডিনারটা সেরে আসবো।
আমি এখন ব্যস্ত আছি কথাটা বলতে গিয়েও জেনিফার বলতে পরল না। এত কাজের চাপে পড়ে সেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া কেন তার খুব ভালো বন্ধু, তাকে কষ্ট দিতে জেনিফারের মন সায় দিল না। তাই সে তার কাজ ফেলে বলল ঠিক আছে, চলল।
নাটকটা জেনিফারের মনকে ভালো করে দিল। নাটকের নাম অ্যাপলজ, নায়ক লরেন বাকাল দারুণ অভিনয় করেছেন। শো দেখে তারা সারডি রেস্তোরাঁতে ডিনার খেল।
আসছে শুক্রবার ব্যালে নাচ দেখতে যাবে? দুটো টিকিট পেয়েছি, পথ চলতে চলতে কেন বলল।
–না, আমি ওইদিন যেতে পারবো না, আমার অন্য কাজ আছে, কিছু মনে কোরো না কেন–জেনিফার তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
-কেন নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে জবাব দিল–ঠিক আছে জেনিফার।
জেনিফার কিছুদিন ধরে কেনের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। তার চাহনির মধ্যে কিসের একটা প্রতিচ্ছবি সে দেখতে পায়। সে কেনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না, তবুও তার মনে হয় কেন নিজেকে একাকী বোধ করে। তাই সর্বদা সচেষ্ট থাকে কেনকে নানাভাবে সাহায্য করতে। আর এতে জেনিফারও নিজে খুব আনন্দ পায়।
শেষ পর্যন্ত সেই শুক্রবারের রাতটি এল। সে রাতে মুখোমুখি বসে আছে জেনিফার ও অ্যাডাম ওয়ার্নার। হোটেল ফুটিস-এর নিভৃত এক কোণে।
জেনিফার আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল–আমাকে অনেক মক্কেল পাইয়ে দিয়েছো তুমি অ্যাডাম। তার জন্য তোমার আমার কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওনা আছে। কিন্তু তুমিই আমাকে না।সেই সুযোগ দাওনি। আমি অনেকবার তোমাকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করেছিলাম।
আমি বুঝতে পারছি, আমি ইচ্ছে করে তোমার টেলিফোন ধরিনি। কারণ আমার মনে একটা সংশয় আছে।
জেনিফার বিস্মিত হয়ে বলল–সংশয়? আমার ফোন ধরলে বুঝি তুমি কোনো বিপদে পড়ার আশঙ্কা করছে অ্যাডাম?
অ্যাডাম বলল–আমি যে বিবাহিত তা তোমায় বলা হয়নি, জেনিফার।
জেনিফার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল–তাহলে আজ আবার এখানে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে এলে কেন?
কারণ তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগে তাই, শান্ত স্বাভাবিক স্বরে অ্যাডাম বলল। অ্যাডাম ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। শামুক যেমন ভয় পেলে নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়ে তেমনি অ্যাডামও নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে, অ্যাডামের ভেতরকার এই প্রতিক্রিয়া জেনিফারের নজর এড়াল না।
তবুও জেনিফার কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ঠিক আছে, তুমি বিয়ে করেছে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তোমার স্ত্রীর বিষয়ে কিছু বলো।
অ্যাডামের মুখে স্মিত হাসি। তিনি হাসতে হাসতে বললেন–আমার স্ত্রীর বিষয়ে কি জানতে চাও তুমি?
–এই ধরো তোমার স্ত্রীর নাম, তোমাদের কতদিন বিয়ে হয়েছে? কটি সন্তান এবং তোমাদের দাম্পত্য জীবন কি রকম ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার স্ত্রীর নাম মেরিবেথ। আমাদের পনেরো বছর আগে বিয়ে হয়েছে। তবে আজও আমরা কোনো সন্তানের বাবা-মা হতে পারিনি।
জেনিফার আঁতকে উঠে বলল–সে কি? তোমার স্ত্রীর কি কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে?
না, সে সব কিছু নয়। আসলে আমরা কেউই সন্তান চাইনি। আমরা অনেক ছোট বয়সে বিয়ে করেছি। বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমাদের দুজনের পরিচয় ছিল। আমরা দুজনে পাশাপাশি বাড়ীতে থাকতাম। মাত্র আঠারো বছর বয়সে মেরি ওর বাবা-মা-কে হারায়। তারা এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। তাদের শোকে মেরি মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগল। নিজেকে ও ভীষণ একা মনে করতো। ওর ওই দুঃসময়ে আমি ওর খুব কাছাকাছি থাকতাম। ওকে সব সময় আগলে রাখতাম। আর সেই থেকেই আমাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসা জন্মালো। তার শেষ পরিণতি হল পরিণয়ের মধ্যে দিয়ে।
জেনিফার মনে মনে ভাবল–অ্যাডাম একজন নিপাট ভদ্রলোক। নিছক আবেগের বশেই মেরিকে বিয়ে করেছে।
অ্যাডাম আবার বলতে শুরু করলেন–আমার স্ত্রী চমৎকার মনের মহিলা। তাছাড়া আমাদের দাম্পত্য জীবন খুবই সুখের। আজও এতবছর পরেও আমাদের সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি। সুন্দর সম্পর্ক বজায় আছে।
জেনিফার যতটা না প্রত্যাশা করেছিল তার বেশি অ্যাডাম তাকে বললেন। জেনিফারের বিবেক তাকে সাবধান করে দিয়ে বলল যথেষ্ট হয়েছে, আর বেশি দূর এগোনো উচিত হবে না। যত দ্রুত সম্ভব অ্যাডামের সঙ্গ বর্জন করে। অ্যাডামকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করো। জেনিফারও বুঝতে পারছে এই মানুষটির ভালোবাসা যতটা সহজ এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ঠিক ততটাই কঠিন। পুরোপুরি পাগল না হলে অ্যাডামের মতো কোনো ভদ্রলোকের প্রেমে পড়া বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই হবে না।
জেনিফার নিজেকে হুঁশিয়ার করে বলল–অ্যাডাম, তোমাকে আমার ভালো লাগে। তবে বিবাহিত পুরুষদের সঙ্গে আমি কখনও মিশি না।
অ্যাডামের মুখে হাসির ঝিলিক, তার চোখে সততা ও উষ্ণতার বিচ্ছুরণ প্রতিফলিত হচ্ছে। অ্যাডাম বললেন–তুমি চিন্তা কোরো না, বৌয়ের অসাক্ষাতে আমি তোমাকে প্রেম নিবেদন করবো না। তোমার প্রতি আমি একটা টান অনুভব করি। তোমার জন্য আমি গর্বিত। তাই মাঝেমধ্যে তোমার সঙ্গ পেতে আমার ভালো লাগে।
রূঢ় একটা কথা তার বলতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। অনেক কষ্টে মুখে হাসি এনে সে বলল–তাহলে তো খুব ভালই হবে।
.
অ্যাডাম ওয়ার্নারের সঙ্গে দেখা করার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। একদিন জেনিফার গেল কেন বেইলির সঙ্গে নাইট শোয়ে নাটক দেখতে। হলে ঢুকতে যাবার সময় তারা প্রচণ্ড ভীড়ের মুখোমুখি হল। এমন সময় একজন ভদ্রমহিলার চিৎকার শোনা গেল। তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলছেন–ওই যে ওখানে শয়তানটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
জেনিফারেরও চোখ পড়ল বাইরের দিকে। সেখানে একটা বড় লিমুজিন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়িটা থেকে মাইকেল মোরেটি ও একজন মহিলা নেমে এলেন। ততক্ষণে ভদ্রমহিলার দৃষ্টি অনুসরণ করে সমবেত মানুষজনও সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারাও এই দৃশ্যটা দেখলেন। জেনিফারের মনে হল এই মহিলাই বুঝি মাইকেল মোরেটির স্ত্রী। কাঁচের দরজা খুলে ভীড় ঠেলে মোরেটি হলের ভেতর ঢুকে পড়লেন। অতর্কিতে জেনিফারের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল তার। নাটকটি খুব ভালো ছিল। কিন্তু জেনিফার ঠিক মন বসাতে পারল না। সে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। তার মনে পড়ছিল মাইকেল মোরেটির দুর্ব্যবহারের কথা। কিভাবে তিনি তাকে বিপদে ফেলেছিলেন। সেই দুঃখদায়ক স্মৃতি তার। ভেতরটা তছনছ করে দিচ্ছিল। নাটকটির প্রথম অঙ্ক শেষ হল। সে কেনকে বলল কেন, আমার ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে। চলো আমরা উঠে যাই। তার কথায় সম্মতি জানিয়ে কেন তাকে নিয়ে হলের বাইরে বেরিয়ে এল।
পরদিন আবার অ্যাডামের ফোন এল। জেনিফার ভেবেছিল তিনি হয়তো তাকে আবার লাঞ্চ বা ডিনারে আমন্ত্রণ জানাবে। তাই সে রিসিভার তুলেই বলল–দুঃখিত অ্যাডাম, আমার হাতে এখন অনেক কাজ আছে।
টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে অ্যাডামের কণ্ঠস্বর জেনিফার শুনতে পেল-হ্যাঁ, আমি তা জানি। আমি কদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি সেটা জানাতেই আমি তোমাকে ফোন করেছি।
কথাটা শুনে জেনিফারের মন খারাপ হয়ে গেল। সে বেশ বুঝতে পারছে অ্যাডামের অভাব সে সহ্য করতে পারবে না।
জেনিফার জিজ্ঞাসা করলকদিনের জন্য তুমি বাইরে যাচ্ছ, অ্যাডাম?
বড়জোর পনেরো দিনের জন্য, ফিরে এসে তোমাকে ফোন করব, কেমন।
–তা তোমার গন্তব্যস্থল কোথায়?
–বেশিদূর নয়, এই সামনেই, আমাদের গ্রামে।
–ভাল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, কথাটা শেষ করে জেনিফার রিসিভার নামিয়ে দিল। জেনিফারের মন চিন্তাচ্ছন্ন। সে ভাবতেই পারছে না আগামী পনেরো দিন অ্যাডামের সঙ্গে তার দেখা হবে না। নানারকম সব উদ্ভট অবাস্তব চিন্তা তার মাথায় ভীড় করল। সে যেন প্রত্যক্ষ করছে অ্যাডাম রায়ো ডি জেনেরিওর সাগর বেলায় সুন্দরী যুবতীদের, সঙ্গে গল্পে মশগুল। তারা স্বল্পবাস পরিধেয়। পরমুহূর্তেই অন্য একটা ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অ্যাডাম এক নগ্নিকা সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছে সুইজারল্যান্ডের কোনোও এক বিলাসবহুল কামরায়।
পরক্ষণেই জেনিফার নিজেকে শাসন করল, আমি এসব কি ভাবছি, নিশ্চয়ই ব্যবসার কাজে অ্যাডামকে গ্রামে যেতে হচ্ছে। হয়তো বা সেখানে দিনরাত কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। আর আমি কিনা ওর সম্পর্কে এসব আজেবাজে চিন্তা করছি। এটা ভারী অন্যায় হচ্ছে। এতই যদি মন সন্দিহান হয় তাহলে কৌশলে তার কাছ থেকে জেনে নিতে দোষ তো ছিল না। উনি কোথায় যাচ্ছেন, কোথায় রাত কাটাবেন, সঙ্গে কে যাচ্ছে, এসব আর কি? তাহলে তো কৌতূহল মিটতো আবার সন্দেহটাকেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলা যেত।
সেই সময় কেন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। ঢুকেই তাকে অবাক হতে হল, এক মুহূর্ত জেনিফারের দিকে তাকিয়ে থেকে তার প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর বলল কি হল জেনিফার, একা একা পাগলের মতো বকছো কেন? তোমার শরীর কি খারাপ?
জেনিফার লজ্জা পেল। সে বলল না, তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না, ক্লান্তি এসে আমার সারা শরীর মনকে আচ্ছন্ন করেছে, তাই…।
কেন সহানুভূতির সুরে বলল–বেশি রাত জেগে কাজ করার ফল, আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে, বুঝেছো।
জেনিফার নিজের মনে প্রশ্ন করল–অ্যাডামও কি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে আজ? এর সদুত্তর তার জানা নেই।