তৃতীয় পর্ব । প্রথম অধ্যায়
প্লেন এসে থামল লন্ডন এয়ারপোর্টে। এখানকার নামকরা ডেভলপার ব্রায়ান ম্যাকিনটোস শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ এয়ারপোর্টে লারার জন্য ফুলের তোড়া পাঠিয়ে দিয়েছে। পল মার্টিনও ফুল পাঠিয়েছে। হাওয়ার্ড কেলারের ওপর সব দায়িত্ব দিয়ে লারা একাই লন্ডন শহরে এসেছে।
হোটেলের ঘরে বসে সে নিউইয়র্ক থেকে ফোন পেল বিল্ডিং তৈরির ব্যাপারে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর্কিটেক্ট নকশার কিছু পরিবর্তন করতে চাইছে, তাছাড়া আবহাওয়াও ভালো নয়।
লারা তাদের সতর্ক করে দিয়ে নিজের মতামত জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
পরের দিন ব্রায়ানকে সঙ্গে নিয়ে লারা লোকেসন দেখতে এল। নদীর ধারে বিশাল অঞ্চল। এখানে ব্যবসা কেন্দ্র খুললে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট অনেকটা ট্যাক্স রিলিফ করবে। কারণ এখানকার অনেক মানুষই তাতে উপকৃত হবে।
এরপর তারা এল লন্ডনের একটা বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহে। সেখানে একটা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের অনুষ্ঠান চলছিল।
লারার কিন্তু এসব ভালো লাগছিল না। তার মন পড়ে ছিল নিউইয়র্কে। চুক্তির ব্যাপারটা মিটে গেলেই সে ফিরে যাবে।
লন্ডন ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠান পুরোদমে চলছে, সকলে তা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে। কিন্তু লারার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে তখন ভাবছে, বিল্ডিং তৈরির কাজ ওখানে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। নতুন করে নকসা তৈরি করলে খরচ বেড়ে যাবে অনেক। প্রতি স্কোয়ার ফুটের খরচ কীভাবে কমানো যায় ইত্যাদি চিন্তা করছে।
হঠাৎ ব্রায়ান পাশ থেকে বলে উঠল–মিস ক্যামেরন, ওই দেখুন ফিলিপ অ্যাডলার আসছেন।
–কে উনি? লারা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
ততক্ষণে হলের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে।
–এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী।
–ও।
ফিলিপ অ্যাডলারের একক অনুষ্ঠান শুরু হল।
.
ব্রায়ানের বন্ধু ফিলিপ। লারার অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ ব্রায়ান তাকে নিয়ে এল গ্রিনরুমে, ফিলিপের সঙ্গে পরিচয় করাতে।
বাইরে তখন প্রচুর ভিড়। লারা জানতে চাইল, মিস্টার ম্যাকিনটোস এত ভিড় কেন এখানে?
–ফিলিপ অ্যাডলারকে একবার কাছ থেকে দেখতে চায় ওরা।
–তাই বুঝি। আমি কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না। লারা উপেক্ষার সুরে বলল।
.
ফিলিপ অ্যাডলারকে দেখে লারার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। এতত সেই তার স্বপ্নের রাজকুমার। মুহূর্তের মধ্যে ফিরে গেল তার মন অতীতে। দীর্ঘকাল ধরে সে তো এমন একজন পুরুষকে খুঁজে বেড়িয়েছে। সেই মুখ, সেই হাসি। দীর্ঘকায় চেহারা, সোনালী চুল। অপূর্ব চোখ। মুখের হাসিতে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। এই সেই মানুষ। গ্রেস বে-র সেই রান্না ঘরে, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফাঁকে যে পুরুষ এসে তাকে হেসে বলত আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হতে চলেছে। লারার শরীরটা কেমন করছিল। তার যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
ব্রায়ান জানতে চাইল মিস ক্যামেরন, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?
–না-না, আমি ঠিক আছি।
ততক্ষণে ফিলিপ এসে ব্রায়ানের সাথে করমর্দন করল।
ব্রায়ান বলল দারুণ ফাটাফাটি অনুষ্ঠান করেছে। সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছে। তারপর লারাকে লক্ষ্য করে বলল, ইনি হলেন বিখ্যাত ডেভলপার লারা ক্যামেরন। আমার আমন্ত্রণেই এখানে এসেছেন।
ফিলিপ হাসল, যে হাসির আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। বলল–আপনার মুখটা শুকনো কেন মিস…?
–না-না, আমি ঠিক আছি। লারা কোনোরকমে জবাব দিল।
–আসুন না, আজ রাতে আমার একটা প্রোগ্রাম আছে। লারা যেন সম্মোহিত, কণ্ঠস্বরে লোকটার যেন জাদু আছে। ওর স্বপ্নের রাজকুমার আজ ওর চোখের সামনে। কল্পনার শরীর নয়, একেবারে রক্ত মাংসের মানুষ। ছোটোবেলা থেকে একেই তো কামনা করে এসেছে লারা।
ব্রায়ান বলল মিস ক্যামেরন, আমরা এবার বিদায় নিই, ফিলিপ এখন বিশ্রাম নেবে।
লারার যেতে ইচ্ছে করছিল না। কল্পনা ও বাস্তব তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ছুঁতে ইচ্ছে করল তার। ফিলিপের দিকে তাকিয়ে কোনোরকমে বলল চলি।
কোনোরকমে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাস্তব আর কল্পনা আবার আলাদা হয়ে গেল তার চোখে।
.
নিউইয়র্কে ফিরে এল লারা। ভুলতে পারেনি ফিলিপ অ্যাডলারকে। ফিলিপের সঙ্গে যেভাবেই হোক আবার তাকে দেখা করতে হবে। বিছানায় শুয়ে সে ভাবছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। পল মার্টিন ফোন করেছে। তার সঙ্গে লারা যান্ত্রিকভাবে কিছু কথাবার্তা সেরে রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার তলিয়ে গেল ফিলিপ অ্যাডলার সাগরে। তার স্বপ্নের রাজকুমার। যে অল্পক্ষণের জন্য তার কাছে ধরা দিয়েছিল।
কনফারেন্স রুমে লারা গম্ভীর মুখে বসে আছে। হাওয়ার্ড জানাল লারা, আমরা কুইন্স ডিলটা হারালাম।
–কেন? চুক্তিতে একরকম ঠিকই ছিল।
–কিন্তু কমিউনিটি বোর্ড জোনিং-এর ব্যাপারটা কোনোভাবেই পাল্টাতে রাজি নয়।
সেখানে উপস্থিত আর্কিটেক্ট, লইয়ার, পাবলিসিটি অফিসার, কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার সকলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে লারা বলল–ওখানকার ভাড়াটিয়ারা বছরে গড়ে নয় হাজার ডলার আয় করে অথচ ভাড়া দেয় মাসে দুশো ডলার। আমরা ওদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রেখেছি। আরো ভালো ব্যবস্থা করার কথা ভেবেছি। কিন্তু তার জন্য বেশী ভাড়া দেওয়ার কথা কখনো বলা হয়নি। এছাড়া নতুন কিছু অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে ওদের প্রতিবেশীরাও ওখানে থাকতে পারে। কী এমন হল যে, ওরা বেঁকে দাঁড়াল?
–বোর্ডের চেয়ারম্যান এডিথ বেনসন আপত্তি তুলেছে। অবশ্য আপত্তির কারণ পরিষ্কার। নয়। হাওয়ার্ড জানাল।
–হাওয়ার্ড, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করো। সেদিনের মতো মিটিং শেষ হল।
এডিথের সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় লারা বিল হুইটম্যানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এডিথ নিজের ফ্ল্যাটে এনে ওদেরকে বসালো। বিল ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। এডিথকে লারা বললেন, সত্যি বলতে কি মিস বেনসন, বোর্ড যখন আমাদের ফিরিয়ে দিল তখন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, ওই জায়গাটার জন্য একশো মিলিয়ন ডলার খরচ করতে চেয়েছি। তাসত্ত্বেও…
এডিথ বেনসন এখনও বেশ রূপসী। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। সে বলল, মিস ক্যামেরন, আমরা যা কিছু করবো আমাদের সভাবেই তা করা উচিত।
–তা তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার কি অপরাধ? আমার এই প্রজেক্টটা হলে স্থানীয় মানুষের উপকার হবে।
এডিথ গম্ভীর হয়ে বলল, আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। এখন আরামে আর খোলামেলাভাবে বাস করছি। আপনার এই কাজটা শেষ হলে জায়গাটা ঘন বসতি এলাকায় পরিণত হবে।
লারা বলল, ভুল করছেন মিস বেনসন, আমরা ছোটো ছোটো ঘর বানাবো না। আপনারা এখন যেমন আছেন, তেমনই থাকবেন। আমাদের ডিজাইনিং প্ল্যান একেবারেই আলাদা।
দুঃখিত, আমি এবারেও আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাইছি। এডিথ কঁধ ঝাঁকিয়ে বলল। তখন লারার মনে একটা জেদ চেপে বসেছে। যে করেই হোক এই জায়গাটা করায়ত্ত করতে হবে।
শান্ত স্বরে লারা বলল, এক মিনিট মিস বেনসন, আমি শুনেছি বোর্ডের সকলেই আমাদের প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন, শুধু আপনি মত দিচ্ছেন না।
এডিথ বলল, আপনি ঠিকই শুনেছেন।
লারা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, একটু ব্যক্তিগত ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।
একটুখানি ইতস্তত করল সে। আবার বলল–আমি একটা গোপনীয় কথা আপনাকে জানাতে চাইছি, আমার দশ বছরের মেয়েকে আমি এখানে পাঠাবো থাকবার জন্য। ও ওর বাবার সঙ্গে থাকবে।
এডিথ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল–আপনার মেয়ে আছে তা তো জানতাম না?
–না, এখনো পর্যন্ত কেউ জানে না, কারণ আমি বিয়েই করিনি। সেই কারণে ব্যাপারটা গোপন রাখতে হচ্ছে। আশা করি আপনিও ব্যাপারটা গোপন রাখবেন।
এডিথ সংক্ষেপে বলল–ঠিক আছে।
লারা বলল–আমার মেয়েকে আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি। তাই এখানকার–বিল্ডিংটা এমন সুন্দর করে বানাবো যাতে তার থাকতে কোনো অসুবিধা না হয়।
এবার এডিথের কাঠিন্য কিছুটা নরম হয়ে এসেছে। সে বলল–হ্যাঁ, এটা তো একটা অন্য ব্যাপার। আপনি আমাকে দুদিন ভাবতে সময় দিন।
–ধন্যবাদ।
লারা উঠে পড়ল। লারা ভাবল যদি তার একটা দশ বছরের মেয়ে থাকতো তাহলে তিনি ওই মেয়েকে এখানে অনায়াসে রাখতে পারতেন।
.
তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। কমিউনিটি বোর্ডের অনুমতি পাওয়া গেছে। কাজ এগিয়ে চলেছে। শেষপর্যন্ত হাওয়ার্ডের কাছে সব খুলে বলেছিলেন লারা। হাওয়ার্ড বলেছিল–তুমি প্রতারণা করলে?
বিল হুইটম্যান বলল, যা হোক কিছু একটা বলতে তো হবে।
হাওয়ার্ডের একটাই সমস্যা, সে এখনও পর্যন্ত লারাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলো না।
.
অ্যাপার্টমেন্ট এবার শেষ হয়ে এসেছে। লারা ব্যস্ততার মধ্যেও ফিলিপকে ভোলেন নি। ফিলিপ কেমন আছে তা জানবার জন্য মাঝেমধ্যে তিনি আকুল হয়ে ওঠেন।
একদিন অফিসে বসে লারা হাওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলছিলেন। বিল হুইটম্যান ঢুকে ছুটি চাইলো।
কয়েক সপ্তাহের জন্য তার স্ত্রী প্যারিস যেতে চায়।
লারা বলল–এখন তোমাকে ছাড়া যাবে না, অনেক কাজ বাকি আছে। তোমার পোমোশনের সময়।
চেয়ারে হেলান দিয়ে লারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিল বলল–মিস ক্যামেরন, ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে আমি ভাবছি না। এখনও তো বিল্ডিং-এর কাজ শেষ হয়নি। যদি এখন আপনার মেয়ের খবরটা ওদের কানে চলে যায়?
লারা গম্ভীর হয়ে গেল এবার, লারা বুঝতে পারছে বিল তাকে ব্ল্যাকমেল করবার চেষ্টা করছে।
লারা হেসে বলল ঠিক আছে যাও।
পরের দিন লারা পল মার্টিনের সঙ্গে লাঞ্চ খাবার সময় ব্যাপারটা ওকে জানালেন। লারা বললেন, পল আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি, কিভাবে সমাধান করবো বুঝতে পারছি না।
সব শুনে পল বললেন, বিল কি ব্যাপারটা এডিথকে জানাতে পারে?
লারা বলল–ঠিক বুঝতে পারছি না, যদি জানায় তাহলে সত্যিই আমি সমস্যার মধ্যে পড়ে যাব। আমার সুনাম নষ্ট হবে।
পল কাধ কঁকিয়ে বললেন, না বিল কখনই বলবে না।
–আমারও তাই মনে হচ্ছে।
–তুমি কি রেনোতে যেতে চাও?
–হ্যাঁ, জায়গাটা ভালো।
–ওখানে হোটেল ও ক্যাসিনো আছে। দুটোই নীলাম হবে।
–হাওয়ার্ড বলছিল, ব্যাঙ্কে আমার কিছু লোনের অর্থ বাকি পড়ে গেছে। শোধ না করলে ব্যাঙ্ক আর ধার দেবে না।
–তোমাকে ব্যাঙ্কের কাছে যেতে হবে না।
–তাহলে কোথায় যাব?
পল বললেন–ব্যাঙ্ক বন্ড কিনবে। ওয়াল স্ট্রীটে এরকম অনেক সেভিংস আর লোন কোম্পানী আছে। তুমি পাঁচ পার্সেন্ট ইকুয়িটি রাখলে ওরা তোমাকে সিক্সটি ফাইভ পার্সেন্ট দিয়ে দেবে। থার্টি ফাইভ পার্সেন্ট যে কোনো বিদেশি ব্যাঙ্কের কাছে পাওয়া যাবে। ওরা ক্যাসিনোতে ইনভেস্ট করতে রাজী।
লারা উত্তেজিত হয়ে বলল–তাহলে পল, হোটেল আর ক্যাসিনোর মালিক হব আমি!
পল হাসলেন–ওটা আমার তরফ থেকে তোমাকে ক্রিসমাসের উপহার।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
ক্রিসমাস ডে-তে লারা নিজের ফ্ল্যাটেই রইলো। ডজনখানেক পার্টিতে ওর আমন্ত্রণ, ছিল কিন্তু উনি একটাতেও গেলেন না। পল তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে জানিয়েছেন একবার আসবেন। ফিলিপের কথা মনে পড়ে গেল লারার। ফিলিপ এখন কি করছে কে জানে, লারা জানেন না। হঠাৎ পল মার্টিন এসে হাজির হলেন। হাতে একটা সুদৃশ্য ব্যাগ।
পল বললেন–এটা তোমার উপহার।
লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল তুমি তো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, আর কেন?
লারা কৌতূহলী হয়ে বাক্সটা খুলল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল প্রথমটায়। সুদৃশ্য দামী নেকলেস। কয়েকটা দামী রুমাল, কিছু বই, একটা অ্যান্টিক ঘড়ি, আরেকটা ছোট্ট সাদা খাম।
সেই খামে লেখা ক্যামেরন রেনো হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনো।
লারা খুব খুশি হল। বললেন, শেষপর্যন্ত হোটেলটা আমার হল।
–হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত আইনগতভাবে হয়নি, তবে আগামী সপ্তাহে হবে।
–ক্যাসিনো চালাবার নিয়ম তো আমি জানি না।
–তা নিয়ে ভাববার কিছু নেই।
পল লারার হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নিলেন। তারপর বললেন–পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা তোমার জন্য আমি করতে পারবো না। এটা সব সময় মনে রাখবে কেমন?
পল মার্টিন বিদায় নিলেন লারার কাছ থেকে। আকাশটা বিচিত্র রঙ ধারণ করেছে। লারা বিছানাতে বসে রেডিও চালিয়ে দিলেন।
ঘোষকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–এখনকার হলিডে প্রোগ্রাম একটু পরেই শুনতে পাবেন। বিখ্যাত পিয়ানো বাদক ফিলিপ অ্যাডলার এর…
লারা চোখ বন্ধ করল, ফিলিপের শরীরের গন্ধটা লারা যেন পাচ্ছিলেন। আহা, হাত দুটো পিয়ানোর ওপর, মুখে সেই ভুবন জয় করা হাসি।
.
বিল হুইটম্যান কাজের লোক এবং পরিশ্রমী। তার সবসময় একটাই চিন্তা, তাহল ব্যবসার যা কিছু মুনাফা তা সবই মালিক হজম করছে। ওর ভাগে যৎসামান্য জুটছে। কি করে আরও বেশি টাকা রোজগার করা যেতে পারে সেই ধান্দাতে আছে।
বড়োদিনের পর দুদিন কেটে গেছে। ইস্টসাইড প্লাজা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। হুইটম্যান পুরো সাইটটা ঘুরে ভাবলো এই প্রজেক্টটাই ওকে অর্থ উপার্জন করার সুযোগ এনে দেবে।
ভারী যন্ত্রপাতি সব চারিদিকে ছড়ানো আছে। হুইটম্যান সেগুলি তদারকি করছিলো। ক্রেন তার হাত দিয়ে মেটাল বাকেটগুলোকে গাড়ীর মধ্যে তুলছিল। হঠাৎ ড্রাইভার কি যেন বলল হুইটম্যানকে। সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনা ঘটে গেল। ক্রেনের একটা চেন হঠাৎ ছিঁড়ে গেল। যে মেটাল ব্যাকেটগুলো তোলা হচ্ছিল সেটা হুইটম্যানের ওপর পড়ে গেল। হুইটম্যানের শরীরটা নিমেষের মধ্যে থেঁতলে গেল। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানা গেল। ক্রেনের অপারেটরের কাছ থেকে। সেফটি ব্রেকটা আচমকা স্লিপ করাতে চেনটা ছিঁড়ে যায়। বিল প্রচণ্ড কাজের লোক ছিল, তার মৃত্যুতে সকলেই অভিভূত, লারাও সর্বসমক্ষে শোক প্রকাশ করলেন।
.
পল মার্টিনকে ফোন করে লারা বললেন হুইটম্যানের খবরটা শুনেছো?
–হ্যাঁ, টেলিভিশনে দেখলাম।
–তুমি?
–এ ব্যাপারে আবার যেন পাগলের মতো কিছু ভেবে বসোনা। তুমি তো জানো ভালো লোকেরা শেষপর্যন্ত জিতে যায়।
লারার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। লারা ভাবছে, এর অন্তরালে হয়ত পল মার্টিনের কালো হাতের ছাপ আছে।
.
লারা আর হাওয়ার্ড রেনোতে রওনা দিল। নীলামে লারাই সবথেকে বেশি ডাক দিয়ে ক্যাসিনো আর হোটেল কিনে নিয়েছেন। পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
সাময়িক ক্ষতি স্বীকার করে লারা বাজী জিতে গেছে। হোটেলটা সত্যিই বিরাট, দেড় হাজার ঘর আছে, আছে বিরাট সুসজ্জিত ক্যাসিনো।
হাওয়ার্ড এই ব্যাপারে খুবই নিস্পৃহ, সে বলল–ক্যাসিনোর নিয়মকানুন আমি কিছুই জানি না। এর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইছি না।
–তুমি কি বলছছা হাওয়ার্ড, ক্যাসিনো একটা কামধেনু। এর অর্থ কোনো দিন ফুরোবে না।
–কে চালাবে ক্যাসিনো?
–লোক রাখা হবে।
–এটা তো একটা জুয়া, মেয়ে হলে ভালো হয়।
লারা জবাব দিল–ওসব ব্যাপার পল ভালো জানে।
–ওকে আবার টানছো কেন?
লারা এই কথা শুনে একটু ক্ষুণ্ণ হল।
আবার সে বলল, তুমি তো কুইন্স প্রজেক্টটাও ভালো বলোনি। হাউসটনের শপিং সেন্টার চলবে না বলেছিলে। এখন দেখছো ও দুটো থেকে আমরা কি পরিমাণ অর্থ পাচ্ছি।
হাওয়ার্ড গম্ভীর হয়ে বলল–লারা আমি ওই দুটো চুক্তিকে কোনোদিন খারাপ বলি নি। তুমি বড্ড তাড়াতাড়ি ছুটে চলেছে। এখন কোনো কিছুই আর তোমার নাগালের মধ্যে নেই। বেশি খেলে কিন্তু বদহজম হতে পারে। ||||||||||
হাওয়ার্ডের কথা শুনে লারা হেসে ওঠে। হাওয়ার্ডের গাল টিপে বললেন–যাও খোকা বাবু, এখন বিশ্রাম করো।
.
ক্যাসিনো এবং হোটেল আরম্ভ করার ব্যাপারে কথাবার্তা পাকা করে লারা নিউইয়র্কে ফিরছিলেন। সঙ্গে হাওয়ার্ড। একটা মিউজিক স্টোরের কাঁচের দেওয়ালে ফিলিপ অ্যাডলারের পোস্টার দেখতে পেলেন। পরে হাওয়ার্ডকে জিজ্ঞাসা করলেন হাওয়ার্ড, তুমি ফিলিপ অ্যাডলার সম্পর্কে কিছু জানো?
–তেমন কিছু জানি না। আজকের দুনিয়ার বিখ্যাত কনসার্ট পিয়ানিস্ট। ওর সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার খুব নাম আছে। উনি স্কলারশিপ ফাউন্ডেশন তৈরি করেছেন। যারা দুস্থ তাদের জন্য।
–ফাউন্ডেশনের নামটা জানো?
–ফিলিপ অ্যাডলার ফাউন্ডেশন।
লারা বলল–আমি ওই ফাউন্ডেশনে কিছু টাকা সাহায্য করতে চাই। ওদের ঠিকানায় আমার নামে দশ হাজার ডলারের একটা চেক পাঠিয়ে দাও।
হাওয়ার্ড এই কথা শুনে অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–তুমি এইসব ক্ল্যাসিক্যাল । মিউজিকের ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নও শুনেছিলাম, হঠাৎ?
–এবার কিছুটা উৎসাহী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। হাওয়ার্ডের কাছে ক্যামেরন এখনও পর্যন্ত দুর্বোধ্য মহিলা হয়েই থেকে গেলেন।
.
খবরটা পড়ে লারা অবাক হয়ে গেল। লেখা আছে : বিখ্যাত অ্যাটর্নি পল মার্টিনের সঙ্গে মাফিয়াদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক। লারা এক নিশ্বাসে প্রতিবেদনটা পড়ে ফেললেন।
তারপর পলকে ফোন করে বললেন–কি ব্যাপার পল, তোমার নামে কাগজে?
পলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। শোনো ডার্লিং সামনেই ইলেকশন, আমার নামে না ছাপলে কাগজ বিক্রি হবে কেন? এবারেও ওরা হেরে যাবে কমিশন নিয়ে, তুমি কিছু ভেবো না, বলল আজ কোথায় ডিনার করবে?
–মলবেরী স্ট্রীটের একটা ছোট্ট হোটেলে।
–তুমি চেনো? জায়গাটা সত্যিই চমৎকার। কেউ আমাদের বিব্রত করবে না। লারা ফোন ছেড়ে দিল। তারপর চলে গেল বাথরুমে। ডিনারে তারা মুখোমুখি বসেছিলেন। পল জিজ্ঞাসা করলেন–শুনলাম–পেনিং কমিশনের মিটিং ভালো হয়েছে?
–হ্যাঁ, ওদের সহানুভূতিশীল বলে মনে হয়েছে।
–মনে হয় তোমার কোনো সমস্যা হবে না। ক্যাসিনো চালানোর জন্য আমি তোমাকে। ভালো কর্মচারী দেবো।
তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে পল বললেন–তোমার কনস্ট্রাকশনের কাজ কেমন চলছে?
–চমৎকার। তিনটি প্রজেক্ট একসঙ্গে চলছে।
–মাথায় বেশি বোঝা চাপিও না কেমন!
.
তৃতীয় অধ্যায়
দুসপ্তাহ কেটে গেছে, ফিলিপের কোনো খবর আসছে না। চেক পাঠানো হয়েছে ফাউন্ডেশনে কিন্তু তার কোনো উত্তর নেই। স্টিভ মার্চিসনের সঙ্গে লড়াইতে লারা দুবার জিতেছেন। এরমধ্যে একদিন বিকেলবেলা সাইট থেকে ফিরে লারা চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ফোনটা বেজে উঠল, রিসিভার তুলতেই ও প্রান্তে ভেসে উঠল ফিলিপ অ্যাডলারের কণ্ঠস্বর।
টেক্সাসের একটা হোটেলের বলরুমে ফিলিপের সঙ্গে দেখা হল লারার। ওইখানে ফিলিপের একটা প্রোগ্রাম ছিল। প্রথমে লারাকে দেখতে পায়নি। তারপর দেখেই বলল– আসুন আসুন মিস ক্যামেরন। আপনি আসায় আমি খুবই খুশি হয়েছি!
লারা কোনোরকমে বললেন–হ্যাঁ, আমিও, তখন তার সমস্ত শরীরের ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে চলেছে।
উনি বললেন–এখানে বড্ড ভীড়, একটু ফাঁকায় গিয়ে বসলে কেমন হয়?
ফিলিপ হেসে বলল–আপনি কি ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক শুনতে ভালোবাসেন?
–হ্যাঁ, ভালোবাসি বইকি।
ফিলিপ আবার বলল–আপনার কনট্রিবিউশানের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ওটা ফাউন্ডেশনের কাজে আসবে।
–আপনার এই ফাউন্ডেশনের ব্যাপারে আমি সত্যিই আগ্রহী মিঃ অ্যাডলার। লারা হাসবার চেষ্টা করল। তারপর বলল–একটা কথা বলবো?
–বেশ তো বলুন না?
–পরের সপ্তাহে সন্ধ্যেবেলা আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?
–দুঃখিত, আমি আগামীকালই রোম যাচ্ছি। তিন সপ্তাহ বাদে ফিরবো। তারপর হতে পারে।
লারা বলল–ঠিক আছে, তারপর হবে। আরো দুজন লোক এসে মিউজিক নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলো। লারা বিন্দুবিসর্গ কিছুই বুঝতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল তার এ বুঝি একটা অন্য জগত, এখানে ঢুকতে গেলে অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
.
একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই টেরি হিলের কাছ থেকে একটা শুভ সংবাদ পেল লারা, পেনিং কমিশনের কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়া গেছে। লারা সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার্ডকে ব্যাপারটা জানালেন। তখনই ইন্টারকমে ক্যাথির আওয়াজ ভেসে এল। মিঃ অ্যাডলার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
হাওয়ার্ডের দিকে লারা তাকাল। লারা ভাবতে পারেনি মিঃ অ্যাডলার এত তাড়াতাড়ি আসবে।
ফিলিপ বলল–আজ সন্ধ্যেবেলা যদি কঁকা থাকেন তাহলে একসঙ্গে ডিনার করবো।
লারা পল মার্টিনের সঙ্গে সন্ধ্যোবেলা ডিনার করবে এমনটাই ঠিক ছিল। তবুও সে সংক্ষেপে বলল–সন্ধ্যেবেলা আমি কঁকাই আছি।
–বাঃ। কোথায় খেতে আপনার ভালো লাগে?
–ওটা কোনো ব্যাপার নয়, বাসকিউতে চলে আসুন। ঠিক আটটার সময়।
–যাব, রিসিভার নামিয়ে লারা একবার হাসলেন।
হাওয়ার্ড বললেন কি ব্যাপার, কি বলল অ্যাডলার?
লারার চোখ দুটিতে রহস্য, হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে লারা থেমে থেমে উচ্চারণ করল–শোনো হাওয়ার্ড, আমি শেষ অবধি ফিলিপ অ্যাডলারকে বিয়ে করতে চাইছি।
হাওয়ার্ডের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, সে বলল–তুমি রসিকতা করছো?
লারা বলল–না। আমি গুরুত্ব দিয়ে কথাটা বলছি।
এই কথা শুনে হাওয়ার্ডের মুখখানা বিষণ্ণ হয়ে গেল। লারাকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতেই হবে।
লারা মনে মনে বলল–আমি ওকে কিশোরী বয়স থেকেই চিনি। সারাটা জীবন ধরে ও আমার চেনা মানুষ। প্রকাশ্যে বললেন–ফিলিপ খুব ভালো লোক।
–লারা তুমি আবার একটা ভুল করছো।
ফোন বেজে উঠল। লারা বলল–কে? পল তুমি!
–সন্ধ্যেবেলা ডিনারে আসছো তো? ঠিক আটটা কেমন?
পলের কণ্ঠস্বর লারার কানে গেল না। নিজেকে কেমন একটা অপরাধী বলে মনে হল লারার। অতি কষ্টে লারা বলল–পল আমি দুঃখিত, যেতে পারছি না। হঠাৎ জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে, আমি তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
তোমার শরীর খারাপ নয় তো?
–হ্যাঁ, শরীর ঠিক আছে, কিন্তু কয়েকজন রোম থেকে আসছে। তাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
লারা কিছুটা মিথ্যা কথা বলল। পলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আমার দুর্ভাগ্য, আচ্ছা কোনো একদিন সন্ধ্যেবেলা হবে কেমন?
.
আটটার সময় রেস্তোরাঁয় লারা পৌঁছেছিলেন। ফিলিপ বলল–তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
–তাই নাকি?
সুন্দর বলতে কি রকম তা লারা এখনও জানতে পারল না।
দুজন অনেকক্ষণ কথা বললেন। ফিলিপ একদৃষ্টিতে লারার দিকে তাকিয়েছিল।
লারা হঠাৎ ওকে জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা ফিলিপ, তুমি বিয়ে করেছো?
–না, আমার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব। আমি এক বিশ্ব পথিক। আজ লন্ডন কাল টোকিও করে বেড়াচ্ছি। বিয়ে করার সময় কোথায়?
–ফিলিপ তোমার ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে। কে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে বলে তো?
লারা বাচ্চা মেয়ের মতো ভঙ্গী করল। ফিলিপ হেসে বলল–আমরা ভিয়েনার লোক, মা পিয়ানোর শিক্ষিকা ছিলেন। হিটলারের হাত থেকে বাঁচতে ওরা বোস্টনে পালিয়ে এসেছিলেন। আমি ওখানে জন্মাই। তারপর…
ফিলিপ নিজের কথা বলতে শুরু করল।কিভাবে ছোট্ট ফিলিপ আজকের বিখ্যাত পিয়ানিস্ট ফিলিপ হয়েছে, সেটা বুঝি এক রূপকথা। এই গল্প শুনে লারার মনে হল ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক সম্বন্ধে তাকেও কিছু জানতে হবে।
.
লারা এই প্রথম অনুভব করলেন তিনি সত্যিকারের প্রেমে পড়েছে। সেই কিশোরী বয়স থেকে যে মূর্তি তার মনের মণিকোঠায় সযত্নে আঁকা ছিল, সেই মূর্তি আজ রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কল্পনা থেকে বাস্তব উত্তরণ ঘটে গেছে।
ফোনটা বেজে উঠল। ও প্রান্তে পল মার্টিনের কণ্ঠস্বর–ঠিকমতো ফিরেছো তো লারা?
–হ্যাঁ।
–তোমার মিটিং কেমন হল?
–চমৎকার।
–তাহলে আগামীকাল সন্ধ্যেবেলা ডিনারে এসো।
লারা বলল–ঠিক আছে।
কিন্তু আবার যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়? পল মার্টিনের মুখ তার মনের ক্যানভাস থেকে হারিয়ে গেছে। এখন সেখানে ফুটে উঠেছে একটিমাত্র মুখের ছবি। তা হল ফিলিপ অ্যাডলারের।
.
চতুর্থ অধ্যায়
পরের দিন ভোরবেলা লাল গোলাপ পেয়ে লারা খুব খুশি হল।ফিলিপ তাহলে কাল রাতে… ভেতর থেকে কার্ডটা বের করে লারা পড়লেন। আজকের সন্ধ্যেবেলা ডিনারের আগে এই উপহার পাঠালাম, পল।
নামটা পড়ে লারার মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। সকাল বেলা লারা ভেবেছিল ফিলিপ আসবেন, কিন্তু এলেন না। সারা দিনই তার প্রোগাম আছে। লারা নতুন সেক্রেটারীর ইন্টারভিউ! নিলেন। মোট দুজন ক্যান্ডিডেট ছিল। গার্টরুড মিকস্ বলে বছর ত্রিশেক এক মহিলাকে লারার পছন্দ হল। তাকে নেওয়া হবে বলে ঠিক করা হল।
বিকেল পাঁচটা নাগাদও ফিলিপের ফোন এল না। লারা খুবই অবাক হয়েছেন। শেষপর্যন্ত নিজেই ফোন করে জানতে পারলেন, ফিলিপ বাইরে চলে গেছে।
স্টিভ মার্চিসন পরের দিন লারার অফিসে গিয়ে হাজির, মোটাসোটা চেহারা। মুখটা গম্ভীর, স্টিভ উত্তেজিত হয়ে বলল–দেখুন মিস ক্যামেরন, আপনি কিন্তু ভালো করছেন না। এভাবে আমার সর্বনাশ করছেন কেন?
লারা বলল–আপনি কি বলছেন?
–দেখুন এসব বলে লাভ নেই। শহরে অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। আপনি কেন আমার পছন্দের জায়গাগুলোতে হাত লাগাচ্ছেন বলুন তো?
লারা হেসে বলল–কিছু খাবেন?
–না।
কিছুক্ষণ লারা চুপ করে বসে রইল। তারপর রিসিভারটা বেজে উঠল, পলের ফোন।
.
ডিনারের পর সন্ধ্যেবেলা পলকে নিয়ে লারা নিজস্ব ফ্ল্যাটে গেলেন।
পল বললেন–কি ব্যাপার লারা, তুমি এত গম্ভীর কেন?
–কিছু নয়, লারা হাসার চেষ্টা করলেন।
পল জানতে চাইলেন–রেনো প্রজেক্টটা কবে শুরু হবে?
–আমি আর হাওয়ার্ড আগামী সপ্তাহে যাব। সম্ভবত কয়েক মাস লাগবে।
–হুঁ। বলেই পকেট থেকে ছোট্ট একটা জুয়েলারী বাক্স বের করলেন পল। লারার হাতে দিয়ে বললেন–খুলে দ্যাখো।
লারা জুয়েলারী বাক্সটা খুলল। একটা দামী ডায়মন্ড নেকলেস। লারা বললেন–তুমি তো আমাকে অনেক দিয়েছো পল, আবার আমাকে ঋণী করছো কেন?
–তোমাকে আমি ভালোবাসি লারা, এই কথাগুলো বলে পল লারাকে জড়িয়ে ধরলেন। পল মার্টিনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের চরম সময়েও লারার মনের ক্যানভাসে বার বার ফিলিপ অ্যাডলারের মুখখানা ভেসে উঠেছিল।
.
রেনো হোটেলের কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ক্যামেরন টাওয়ার্সের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। লারার মনটা বড় উদাসীন। ফিলিপের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। হাওয়ার্ড লারাকে সাবধান করে দিয়ে বলল–স্টিভ তোমার ওপর প্রতিশোধ নেবে বলেছে। লোকটা কিন্তু বিপজ্জনক।
লারা বলল–আমিও, তুমি বুঝতে পারছে না আমিও কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি।
–তুমি লস এঞ্জেলসের প্রপার্টিটা নিয়ে এগোও। আচ্ছা কাল সকালেই আমরা প্লেনে চাপবো কি?
–হ্যাঁ। সব কিছু ঠিক আছে।
হাওয়ার্ড চলে গেল।
.
গাড়ীতে যেতে যেতে লারার নজরে পড়লো একটা পোস্টার। সেখানে লেখা আছে হলিউডের রঙ্গালয়ে ফিলিপ অ্যাডলারের একক প্রোগ্রাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুখানা টিকিট কিনলেন, যথারীতি হাওয়ার্ডকে নিয়ে হাজির হল। ফিলিপের একক প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। লারা মুগ্ধ চোখে ফিলিপের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
হাওয়ার্ড এসব ব্যাপার মোটেই পছন্দ করছে না।
অনুষ্ঠানের পর লারা ফিলিপের সঙ্গে দেখা করল। ফিলিপ ক্ষমা চেয়ে বলল, লারা, তুমি যে এখানে আছো, তা তো আমি জানতাম না।
শেষ অবধি ফিলিপের সাথে লারা বেভারলি হিলটনে পার্টিতে এল। তারপর? কথায় কথায় লারা ফিলিপকে জানাল।
–আগামীকাল আমি নিউইয়র্কে ফিরে যাচ্ছি, কাল সকালে একবার ব্রেকফাস্টের টেবিলে আসতে পারবে কি?
ফিলিপ বলল–সম্ভব নয়, আমি কাল ভোরেই টোকিও চলে যাচ্ছি। সারা বছরটাই আমার এমন প্রোগ্রামে ঠাসা।
–তাহলে আর কি হবে? লারার মুখে কিশোরীর বিষণ্ণতা।
.
পঞ্চম অধ্যায়
পরের কয়েকটি সপ্তাহ ধরে লারা নিজের ব্যবসার কাজে খুবই ব্যস্ত ছিল। বিভিন্ন জায়গায় কাজ চলেছে। স্টিভ মার্কিন প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করছে। লারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।
হাওয়ার্ডকে লারা বললেন বাড়িতে ঘুরে আসতে। হাওয়ার্ড কিন্তু কোনোভাবেই লারাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। হাওয়ার্ডের মাঝেমধ্যে মনে হয় সে বোধহয় লারাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসার ধরন কেমন তা সে জানে না। পল মার্টিন কিংবা ফিলিপ অ্যাডলারের সঙ্গে লারার সম্পর্ককে হাওয়ার্ড মন থেকে মানতে পারেনি।
.
অফিসে বসে লারা হাওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলছিল। পার্সোনাল ফোনটা বেজে উঠল, লারা ধরলো না, হাওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলো-কি ব্যাপার, ফোনটা ধরো।
–না। লারা গম্ভীর মুখে বললেন। অপর প্রান্তে পল মার্টিন রিসিভারটা ধরে রাখলেন বেশ কিছুক্ষণ। তবে কি লারা নেই? কিংবা অন্য কেউ ওর সামনে বসে আছে কি?
পল বুঝতে পারছে লারা এখন আগের থেকে আরও বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। পল । লারাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসেন। কিন্তু লারা কি সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চায়?
পরদিন সকালে লারা এল আমস্টার্ডামে। ওখানকার গ্র্যান্ড হোটেলে তার জন্য একটা সুইট বুক করা ছিল। হোটেলটা সুন্দর। ক্লার্ককে জিজ্ঞাসা করলেন ফিলিপ অ্যাডলারের প্রোগ্রামটা কোথায়?
ক্লার্ক জায়গাটার নাম করলো। লারা বললেন–আমার জন্য একটা টিকিট আনতে হবে। নিজের রুমে পৌঁছেই হাওয়ার্ডের ফোন পেল লারা। লারা বলল–হ্যাঁ, ফ্লাইট খুব ভালো এসেছে। হাওয়ার্ড বলল–সেভেনথ এভিনিউতে প্রজেক্ট এর জন্য আমি দুটো ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলেছি।
–হ্যাঁ। তোমার কাজ চালিয়ে যাও। হাওয়ার্ড সত্যিই তার শুভাকাঙ্খী, লারা নিজেকে একজন ভাগ্যবতী বলেই মনে করলেন।
.
প্রোগ্রাম শেষ হল, ফিলিপ অ্যাডলার দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে অভিবাদন জানালেন। জনগণ তার নামে জয়ধ্বনি করে উঠল। পর্দা পড়ে গেল, গ্রীনরুমে ফিরে ফিলিপ লারাকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
দুজনে এগিয়ে চলল রেস্তোরাঁর দিকে। লারা জিজ্ঞাসা করলেন, এখান থেকে তুমি কোথায় যাবে?
আগামী কাল যাবো মিলান, তারপর ভেনিস। এরপর ভিয়েনা, প্যারিস এবং সবশেষে নিউইয়র্ক।
লারা বলল–বাঃ ভারী রোমান্টিক ব্যাপার তো?
–হ্যাঁ। আমার কিন্তু রোমান্টিক ভালো লাগে না, কোথায় থাকি কোথায় যাই তার কোনো ঠিকানা থাকে না। আমার এই ভবঘুরে জীবনটা একেবারে মাথার ওপর চেপে বসেছে।
–নামী দামী মানুষ হয়ে তুমি এ কি কথা বলছো?
ফিলিপ লারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। রেস্তোরাঁ থেকে দুজনে গাড়ীতে উঠল। শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল দুজনে।
লারা বলল–সত্যি জায়গাটা খুব সুন্দর।
-তুমি এখানে আগে আসোনি?
–না।
–তুমি কি ব্যবসার কাজে এসেছো?
–না।
–তাহলে?
–আমি শুধু তোমাকে দেখতে এখানে এসেছি।
ফিলিপ ভাবতে পারেনি লারা শুধু তাকে দেখার জন্য এতদূর আসবেন। সে বলল আমি খুব খুশি হয়েছি লারা।
–আরেকটা ব্যাপার, আমি তোমাকে বলেছিলাম ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ব্যাপারে আমি আগ্রহী, কিন্তু সেটা একটা বানানো কথা।
মৃদু হেসে ফিলিপ বলল–আমি জানি।
ফিলিপ আরো বলল–তুমি যার কাছে শিখতে গিয়েছিলে উনি আমার পরিচিত। উনি সব বলেছেন।
লারা জিজ্ঞাসা করল–তোমার সঙ্গে কী কারো কোন সম্পর্ক আছে কি?
–তার মানে?
লারা বললেন–যদি আমার সম্পর্কে তোমার আগ্রহ না থাকে তাহলে বরং… ফিলিপ লারার হাতটা চেপে ধরলো। বলল–চলো এসে গেছি। এবার নামা যাক।
দুজনে হোটেলে ঢুকলেন। রুমের মধ্যে এসে দেখা গেল হাওয়ার্ডের পাঠানো অনেকগুলো ম্যাসেজ পড়ে আছে। এই মুহূর্তে ওই ম্যাসেজের দিকে চোখ রাখলেন না লারা। ফিলিপ তাকে কাছে ডাকছে। নিজের উষ্ণ ঠোঁটটা ফিলিপ রাখলো লারার ঠোঁটে।
নিজের রুমে ফিরে হাওয়ার্ডকে লারা ফোন করলেন। লারা বললেন–কোনো খবর আছে কি?
–ক্যাসিনো নিয়ে কিছু অভিযোগ উঠেছে। আমার ম্যাসেজগুলো পড়া হয়েছে?
–না, পড়িনি। ও নিয়ে তুমি ভেবো না হাওয়ার্ড। লারা জানেন যে কোনো সমস্যা হলে পল মার্টিন তার সমাধান করে দেবেন।
.
ভোর চারটে, পল মার্টিনের ঘুমটা ভেঙে গেল। অনেকগুলি ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন উনি। কিন্তু একটারও উত্তর আসেনি। কি ঘটেছে? লারাকে একবার সাবধান করে দেওয়া প্রয়োজন। কোনো ভাবেই তিনি লারাকে জীবন থেকে হারাতে চাইছেন না।
.
ষষ্ঠ অধ্যায়
মিলানে লারা আর ফিলিপ একটা বিলাস বহুল হোটেলে উঠেছিল। সেখানে সবসময় দুজনকে একত্রে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। ফিলিপের অনুষ্ঠান যেখানেই ছিল সেখানেও লারা সঙ্গে গেলেন। লারা বুঝতে পারলেন ফিলিপ কত বড় দরের আর্টিস্ট।
ঘোরা তখনও শেষ হয়নি, নিজস্ব প্লেনে লারা ফিলিপকে নিয়ে পৌঁছোল ভেনিসে। লারার যে একটা প্লেন আছে সেটা ফিলিপ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি। ভেনিসেও ওরা একটা প্রথম শ্রেণীর হোটেলে উঠেছিল।
এবার ভিয়েনা যেতে হবে। ভেনিসে লারা হাওয়ার্ডকে ফোন করলেন। হাওয়ার্ড জানতে চাইল–তুমি এখন কোথায়?
লারা বলল–ভেনিসে, জায়গাটা চমৎকার।
হাওয়ার্ড বলল–আমাদের অনেক কাজ কিন্তু আটকে গেছে।
–দেখো হাওয়ার্ড, তুমি কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাও।
–সেকি তুমি একবারও দেখবে না?
–এখন নয়।
–তাহলে আমি এগুচ্ছি, তুমি কবে আসবে লারা?
–ঠিক জানি না।
লারা ফোনটা রেখে দিল। মনটা অশান্ত হয়ে উঠেছে। সেই রাতে ফিলিপ লারাকে প্রথম উপহার দিল। সুন্দর রিস্টওয়াচ। এতদিন অসংখ্য উপহার লারা পেয়ে এসেছেন। কিন্তু এটা একেবারেই আলাদা।
ভেনিসের অনুষ্ঠানের পরের দিন ওরা ভিয়েনার পথে রওনা হলেন।
.
ভিয়েনা মোজার্ট আর বেটোভেনের শহর। অনেক কথাই লারার মনে পড়ে গেল। এই শহর লারার বাবা আর মায়ের শহর। এখানে লারা জন্মেছিলেন। ওরা শহরের সেরা হোটেলে উঠেছিলেন। ফিলিপের একক অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানের পরে এবং আগে লারাকে সঙ্গে নিয়ে ফিলিপ নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়ালো। সেই রাতে ফিলিপের কোলের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে লারা চোখ বুজেছিলেন। হঠাৎ পল মার্টিনের মুখখানা ভেসে উঠল মনের পর্দাতে।
.
পল খুবই চিন্তিত, নিশ্চয়ই কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। লারা কোথায় গেল তা ভাবতে হবে?
কিন্তু কেন? পল মার্টিনের হঠাৎ মনে হল, লারা ইচ্ছে করেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
.
ডানিয়ুব নদীর ধারে লারা এবং ফিলিপ বসে আছেন। ডিনার শেষ হয়েছে, আকাশের গায়ে চাঁদ, গরমের হাওয়ায় গাছের পাতা কাঁপছে, দুরে নদীর ওপর জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। লারার হঠাৎ মনে হল অসংখ্য তারা বুঝি আকাশে আলো ছড়াচ্ছে। এত খুশির পরিবেশ এর আগে লারার জীবনে কখনো আসেনি।
লারার একটা হাত ফিলিপের হাতের মুঠোয়। হঠাৎ লারা দেখলো–একটা তারা ক্রমশ সামনের দিকে ছুটে আসছে। ফিলিপ বলল–লারা চোখ বুজে কামনা কর তুমি যা চাও।
লারা চোখ বুঁজে ফেললেন।
ফিলিপ বলল–প্রার্থনা করেছো?
লারা বলল–হ্যাঁ।
–কি প্রার্থনা করলে?
লারা বলল–বলবো না। বললে সেটা ফলবে না। লারা রহস্যময় হাসি হাসল।
ফিলিপ এক হাতে লারাকে জড়িয়ে ধরেছে। জাহাজের শব্দ, নদীর আওয়াজ। বাতাসের আনাগোনা, রাতের নিজস্ব সংলাপ সব কিছু মিলেমিশে তখন একাকার হয়ে গেছে।
হঠাৎ একসময় তারা বলল–ফিলিপ আমরা তো এবার বিয়ে করতে পারি?
ফিলিপ বলল–তা হয় না।
–কেন?
–আমি ভবঘুরে, আমার থাকার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। তুমি আমাকে বিয়ে করে কি পাবে বলো?
লারা চুপ করে রইল। তারপর বলল–না।
–ঠিকই বলেছে। আগামীকাল প্যারিসে আমি তোমাকে একটা…
–আমি তোমার সঙ্গে প্যারিসে যাব না।
ফিলিপ বলল–কেন? লারাকে সে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না।
তারপর লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বললেন–আমার আর তোমাকে দেখার ইচ্ছে নেই।
ফিলিপ হতবাক। বলল–কেন, লারা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
–আমিও তোমাকে ভালোবাসি ফিলিপ, কিন্তু আমি তো তোমার মতো শিল্পী নই। তোমার অসংখ্য মহিলা ফ্যান আছে, আমি ফ্যানের সংখ্যা বাড়াতে চাইছি না। তুমি যা চাও সব কিছুই পেতে পারো।
ফিলিপ বলল–লারা আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো নারীকে চাই না। কিন্তু এজন্য আমাদের বিয়ে হতে পারে না।
…আমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসি কিন্তু আমরা দুটো আলাদা জগতের বাসিন্দা। লারা বলে উঠল–আমি তোমাকে আর দেখতে চাই না ফিলিপ।
–না লারা, প্লিজ অবুঝ হয়ো না।
–না, এবার আমাকে যেতে হবে।
–লারা।
লারা জবাব না দিয়ে ওখান থেকে উঠে গেল। নিজের রুমে গিয়ে বলল–হাওয়ার্ড আগামীকাল ওখানে ফিরছি।
লারার কথার মধ্যে বিষণ্ণতা জেগেছে। রিসিভারটা রেখে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। ভাবল; আমি কি আবার ভুল করলাম? ফিলিপকে আমি হারাতে পারবো না। প্যারিসে যাব কি? ফিলিপকে ছাড়া থাকতে পারবো না!
ফিলিপও চুপচাপ বসে আছে। লারার সঙ্গে সে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। সব মেয়েরা সমান!
–পরের দিন ভোরবেলা ফোনের আওয়াজে লারার ঘুম ভেঙে গেল।
–কে? হাওয়ার্ড?
–না। আমি ফিলিপ।
লারার গলার স্বর আটকে গেল। লারা বলল–বলো।
–প্যারিসেই আমাদের বিয়ে হলে কেমন হয় লারা?
লারা আর কোনো কথা বলতে পারল না। আনন্দে উত্তেজনায় তার সমস্ত শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে।
.
সপ্তম অধ্যায়
সমস্ত খবরের কাগজে লারা আর ফিলিপের বিয়ের খবরটা বেরিয়েছে। হাওয়ার্ড এই খবরটা পড়ে কেমন যেন হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে মদ খেল। দুদিন ধরে। মদে একেবারে চুর হয়ে রইল। তিন দিনের মাথায় বলল–খবরটা কি সত্যি লারা?
–হ্যাঁ।
হাওয়ার্ড বলল–তোমাকে খুব খুশি লাগছে লারা।
–আমি জীবনে এত খুশি কখনও হইনি।
হাওয়ার্ড জানতে চাইল কবে আসছো?
–ফিলিপের একটা প্রোগ্রাম আছে লন্ডনে, ও লন্ডনে চলে যাবে আমি তোমাদের ওখানে ফিরবো।
–বিয়ের ব্যাপারে পল মার্টিনের সঙ্গে কথা বলেছে?
–না। ফিরে গিয়ে বলবো।
–তুমি ফিরে এলে আমি খুবই খুশি হব।
লারা ফিলিপের কাছে গিয়ে হাজির হল। বিবাহিতা লারাকে অপূর্ব সুন্দরী দেখাচ্ছে।
.
প্যারিসের পালা শেষ করে লারা ক্যামেরন প্লাজায় ফিরে এসেছেন। সঙ্গে ফিলিপ। লারার পরিচয় এখন লারা ক্যামেরন নয়, এখন তিনি লারা অ্যাডলার নামে পরিচিত।
লারা অফিসে গিয়ে হাজির হল। পল মার্টিনের অনেকগুলি ম্যাসেজ জমেছিল। একটিতে লেখা আছে–শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছে, কথাটা সত্যি?
ফিলিপ অফিস ঘরে ঢুকে জানতে চাইল–কার চিঠি?
–আমার এক পুরোনো বন্ধুর।
ফিলিপ এগিয়ে এসে লারার কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে বলল–ভদ্রলোক কি এমন কেউ যার প্রতি আমি ঈর্ষাবোধ করতে পারি?
লারা হেসে উঠে বলল–পৃথিবীর কারোর ওপরেই তোমার ঈর্ষা করার নেই। একটা কথা জেনে রাখো ফিলিপ, এই পৃথিবীতে তুমি একমাত্র পুরুষ যাকে আমি সত্যি সত্যি ভালোবেসেছি!
.
বিকেল বেলা ক্যামেরন প্লাজাতে নিজের ঘরে লারা বসেছিল। পিয়ানোর সামনে ফিলিপ। প্রথমটায় অবাক হয়েছিল ফিলিপ, এই পিয়ানোটা লারা তাকে উপহার দিয়েছেন।
কিছুক্ষণ বাদে সেক্রেটারী লারাকে ডাকল। লারা অফিস ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। রিসিভারটা টেবিলে রাখা আছে। ও প্রান্ত থেকে লম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল-শেষ পর্যন্ত তুমি ফিরেছো?
ঠান্ডা গলায় লারা বলল–হ্যাঁ।
পরের কণ্ঠস্বর–আমি তোমার কাজে আঘাত পেয়েছি।
–দুঃখিত পল। ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেছে।
–কাল আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করতে পারি কি?
লারা বুদ্ধিমতী, এখন পলকে চটানো উচিত নয়। লারা বলল ঠিক আছে। যাব।
রিসিভারটা নামিয়ে রাখল লারা, পল খুবই রেগে আছে। এখন পল যদি কিছু একটা করে বসেন তাহলে কি হবে?
.
ক্যামেরন সেন্টারের সমস্ত স্টাফ লারাকে অভিনন্দন জানালেন। সকলেই ওর বিয়েতে খুশি হয়েছে। শুধু হাওয়ার্ড গম্ভীর মুখে বলল–এখন থেকে তোমাকে মিসেস অ্যাডলার বলে ডাকতে হবে?
লারা হেসে বলল–ব্যবসার ক্ষেত্রে আমি মিস ক্যামেরন হিসাবেই পরিচিত থাকতে চাই।
–অনেক কাজ জমে আছে, হাওয়ার্ড বলল।
–বেশ তো এক এক করে বলে যাও।
রেস্তোরাঁতে পল মার্টিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। শরীরটা জীর্ণ। মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। চোখের কোণে রাত জাগার কালিমা। লারা এসে উল্টোদিকের চেয়ারে বসলেন। পল মৃদু হাসলেন। বললেন–এসো লারা, কেমন আছো?
লারা বলল–অনেকদিন তোমাকে দেখিনি।
–আমি তোমাকে বোকার মতো কিছু ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল না…
–আমারও ছিল না। সব কিছু হঠাৎ ঘটে গেল।
–হ্যাঁ, তোমাকে বেশ চমৎকার লাগছে। পল মৃদু হেসে বললেন।
লারা বলল–ধন্যবাদ পল।
পল জানতে চাইলেন–ফিলিপ অ্যাডলারের সঙ্গে তোমার কোথায় দেখা হয়েছিল?
–লন্ডনে।
–তারপর তুমি ওর প্রেমে পড়ে গেলে!
পল মার্টিনের কণ্ঠস্বরে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ ঝরে পড়ছে। লারা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন–পল, আমার আর তোমার সম্পর্কটা চমৎকার ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে সেটা যথেষ্ট ছিল না। আমি একজন বিবাহিত সঙ্গী চাইছিলাম।
পল হাসলেন, লারা বলল–আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি। কিন্তু আমার জীবনে তা ঘটে গেছে।
লারা বলল–আমি তোমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারছি পল, কিন্তু কথা দিচ্ছি আমাদের সম্পর্কে এতে কোনো চিড় ধরবে না।
পল বললেন–জানি না ভবিষ্যতে কি হবে, লারার হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে বললেন–দেখো লারা আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। অ্যাডলার তোমাকে বিয়ে করেছে, আমি বিয়ে না করলেও তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই। আমি তোমার সুখের জন্য জীবনটা পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারি।
ধন্যবাদ পল, তোমার কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি…।
লারা থেমে গেল, এগুলো কি তার আন্তরিক সংলাপ নাকি ইচ্ছে করেই মুখ থেকে এই কথাগুলো উগরে দিচ্ছেন তিনি?
পল বললেন–তোমার স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাও।
–পরের সপ্তাহে একটা পার্টি দেব। সেখানে আসবে তো?
–নিশ্চয়ই যাব।
লারা বিদায় নিল, হনিমুনের চিন্তা তার মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা এখন পুরোদস্তুর ফিলিপের ঘরনী হয়ে গেছে। অফিসের কাজের জন্য একটি সুন্দরী চটপটে মেয়েকে রেখেছে। মেয়েটির নাম মারিয়ান বেল। ফিলিপ নিজের শিল্প সৃষ্টি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জীবনের অনেক কথাই লারা ফিলিপকে অকপটে শুনিয়েছে। চার্লস কোহনের কথা যেমন বলেছে, সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের কথাও বাদ দেয়নি। ফিলিপের কাছ থেকেও অনেক গল্প শুনেছে সে।
শিল্পী ফিলিপকে দেখে লারা অবাক হয়ে যায়।
পিয়ানোর সামনে যখন ফিলিপ বসে, মনে হয় সে বুঝি অন্য জগতে পৌঁছে গেছে। প্রত্যেক দিন রাতে ডিনারের পর ওরা দুজন অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকেন। নানা বিষয়ে কথা বলেন। মাঝেমধ্যে খুনসুটি করেন। মনে হয় এই পৃথিবীতে ওরা বুঝি একমাত্র সুখী দম্পতি।
.
একদিন রাতে লারা ফিলিপকে বলল–দেখো ফিলিপ, তুমি আর আমি আগামী সপ্তাহে রেনোতে যাব।
–ওখানে কি আছে?
–ওখানে আমাদের হোটেল আর ক্যাসিনো আছে। তারই উদ্বোধন।
–তাই?
ফিলিপ আরও বলল–আমার সময় কি হবে? ছ-সপ্তাহের জন্য প্রোগ্রাম ট্যুর ঠিক হয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে জাপান, সেখান থেকে…
–না, তা হবে না। আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না।
ফিলিপ হেসে বলল–তাহলে তুমি আমার সঙ্গে চল।
লারা বলল–শোনো ফিলিপ, এখন ব্যবসার কত চাপ। কি করে যাব বলো?
ফিলিপ বলল–তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আমি আগেই তোমাকে এ ব্যাপারে সাবধান করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, ভবঘুরে শিল্পীর জীবনে বিবাহিত সুখ থাকে না। তোমাকেও আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে বলতে পারি না। কিন্তু কি করে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে তো?
–আমিও তা জানি ফিলিপ, কিন্তু আমার মন যে একেবারে বদলে গেছে।
ফিলিপ বলল–কিছুই বদলায় নি। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। আমি বাইরে গেলে আগে কিছু হতো না। এখন তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।
এরপর লারার কিছু বলার ছিল না। লারা বুঝতে পারল ফিলিপকে আটকানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সামনে একটা একাকীত্বের যন্ত্রণাদগ্ধ প্রহর অপেক্ষা করে আছে। লারা আরও বুঝলেন ফিলিপকে তিনি বিয়ে করেছেন কিন্তু নিজের করে নিতে পারেন নি। তা বুঝি কখনও সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে যে তিন চারজন সুপারস্টার আছে, ফিলিপ অ্যাডলার তাদের মধ্যে একজন। সারা পৃথিবী জোড়া ফিলিপের নাম। এই ফিলিপকে লারা আটকে রাখবেন কি করে?
হাওয়ার্ড এখন অনেক শীর্ণকায় হয়ে গেছে। কাজের চাপ বেড়ে গেছে। লারার এক প্রাক্তন কর্মচারী লারাকে নিয়ে এমন একটা বই লিখেছেন যাতে লারার জীবনের গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়েছে। এই নিয়ে লারা প্রকাশক আর লেখকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই ব্যাপারের সব কাগজপত্র হাওয়ার্ডকে দেখতে হচ্ছে।
.
রেনোতে হোটেল আর ক্যাসিনো উদ্বোধন করার পরের দিন লারা ক্যান্ডেলাইট প্রেস নামে একটা সংস্থা কিনে নিলেন। যে প্রকাশক লারার বিষয়ে বইটা প্রকাশ করেছে, এটি তারই সংস্থা। হাওয়ার্ড অবাক হয়ে গেছে। হাওয়ার্ড লারাকে জিজ্ঞাসা করল–তুমি এটা কিভাবে করলে?
লারা বলল–আমি আমার উকিল টেরি হিলকে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলাম-বেশি অঙ্কের টাকা দিতেই উনি রাজী হয়ে গেলেন।
–এবার কি করবে?
লারা হেসে বলল–বইটাকে এবার বন্ধ করে দাও। যত কপি আছে সেসব তুলে নাও। সব কপিগুলো আগুন ধরিয়ে দাও।
হাওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করল–তুমি কি প্রকাশনা সংস্থাও বন্ধ করে দেবে?
–না না। ওটা যেমন আছে তেমন থাকবে। অন্য কিছু বের করা হবে। আমাদের ট্যাক্স অনেকটা কমে যাবে।
হাওয়ার্ড আরও একবার লারার বুদ্ধির কাছে হার মানতে বাধ্য হল। সে বুঝতে পারলো লারা গভীর জলের মাছ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাওয়ার্ড বলল–আমাকে কয়েক দিন ছুটি দিতেই হবে।
–কি ব্যাপার? তুমি না থাকলে আমার কাজ দেখবে কে?
–ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, ডাক্তার বলছেন কিছুদিন আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। ইদানিং কাজ করার শক্তিটা পাচ্ছি না।
–তাই নাকি? আর কিছু হয়নি তো?
–না না। আমি হাওয়াই আইল্যান্ডে ঘুরে আসতে চাই।
–ইচ্ছে করলে আমার প্লেন নিতে পারো।
–না না। আমি কমার্শিয়াল প্লেনে চড়ে যাব।
–তুমি কিন্তু ভালো করে বিশ্রাম নেবে।
–উদ্বেগের কিছু নেই। আমি তো ঠিকই আছি।
ফিলিপ ওকে প্রতি সপ্তাহে ফোন করে। সেদিন করেছিল। তারা বলল–তুমি এখন কেমন। আছো?
–আমি খুব একাকী বোধ করছি। কিছুদিনের মধ্যেই ফিরবো।
–ঠিক বলছো?
–নিশ্চয়ই।
–আমি তোমার অপেক্ষাতে থাকলাম।
লারা রিসিভারটা রেখে দিল। ফিলিপ এখন তাইপেতে আছে, ওখানে ফিলিপের সম্মানে এক মহিলা পার্টি দিয়েছেন।ফিলিপ সবকিছুই বলেছে। কে ওই মহিলা? এই প্রথম লারা পৃথিবীর কোনো এক মহিলা সম্পর্কে একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা পোষণ করলেন।
.
একমাসে কেটে গেছে। ফিলিপ ফিরে এসেছে। লারা বেশ কিছু দিন অফিসে যাননি। লারা একদিন বললেন–ফিলিপ তুমি রেনোর হোটেলের উদ্বোধনের সময় যাওনি। আরেকটা প্রোগ্রাম আছে। শহরের মেয়র আমাকে সংবর্ধনা দেবেন। এই শহরের চাবি আমার হাতে তুলে দেবেন। তুমি থাকবে তো?
ফিলিপ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল–মনে হয় পিরবো না।
–কেন? লারার মুখ শুকিয়ে গেল।
–আমি তিন সপ্তাহের জন্য জার্মানে যাচ্ছি।
–বাঃ, ওখানে তোমার যাওয়া চলবে না, আমার এই অনুষ্ঠানে তোমাকে থাকতে হবে।
–আমি কনট্রাক্টে সই করেছি। এখন তো পিছিয়ে আসতে পারবো না।
লারা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–এই তো সবে ফিরেছো, এখন আবার চলে যাবে?
–এটা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সফর।
লারা গম্ভীর হয়ে বলল–আমাদের বিবাহিত জীবনটা বুঝি তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
–লারা তুমি ভুল বুঝো না।
লারা বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল–আমি তোমার মধ্যে একজন স্বামীকে খুঁজেছিলাম। যৌনসঙ্গী নয়।
ফিলিপ ঠান্ডা গলায় বলল–লারা তুমি ভুল করছো, আমি মোটেই তা হতে চাইছি না।
লারা বলল–ফিলিপ তুমি তো একজন শিল্পী। কিন্তু তোমার সফর দেখে মনে হচ্ছে তুমি বোধহয় ট্রাভেলিং সেলসম্যান।
লারার দুচোখে জল এস গেছে। লারা অস্পষ্ট স্বরে বললেন–তুমি আমাকে ভুলে যাও ফিলিপ।
লারা কথা শেষ করতে পারল না। কান্নায় কণ্ঠস্বর আটকে গেছে। ফিলিপ লারার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিল। বলল–লারা, ঠিক আছে আমি কথা দিচ্ছি এবার এসে অনেক দিন তোমার সঙ্গে কাটাবো।
লারা কিশোরী কন্যার মতো নরম স্বরে বলল কথা দিলে কিন্তু। তুমি না থাকলে আমি বড়ো একা হয়ে যাই ফিলিপ। তুমি কেন তা বুঝতে পারো না। পৃথিবীর কোনো কিছুতেই আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই।
ফিলিপের কোলে লারা আত্মসমর্পণ করল। এক হাত দিয়ে চিবুকটা তুলে ফিলিপ লারাকে চুম্বন করলো পরম সোহগে। লারার চোখে তখনও টলটল করছে অশ্রুকয়া। মুখে হাসি। ফিলিপের ঠোঁটের ওপর একটা আঙ্গুল রেখে লারা কিশোরীর ভঙ্গীতে বলল–মনে থাকবে তো?
–নিশ্চয়ই।
–দুটি ঠোঁট তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
জার্মানির অভিজাত নাগরিকদের পক্ষ থেকে ফিলিপকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। লারার সম্বর্ধনা সভাতে শহরের মেয়র স্বয়ং এসেছেন। পল মার্টিনও লারার সঙ্গে গিয়েছিলেন। প্রেস ফটোগ্রাফাররা দাবী করলো, লারা এবং তার স্বামীর ছবি তুলতে হবে একসঙ্গে। লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–উনি থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু…
পল বললেন–আবার চলে গেছেন?
লারা বলল, ওনার অনুষ্ঠান ছিল।
পল এবার বিদ্রূপের স্বরে বললেন–কি রকম স্বামী তোমার? আজকের দিনে তোমার পাশে নেই?
লারা কোনো জবাব দিতে পারল না।
সেদিন রাতে লারার দু-চোখের পাতায় ঘুম নাবেনি। ফিলিপ এই মুহূর্তে ওর কাছ থেকে প্রায় দশ হাজার মাইল দূরে আছে, পলের কথাটা মনে পড়ে গেল, কিরকম স্বামী তোমার?
চারপাশে তখন পল মার্টিনের বিদ্রূপপূর্ণ কণ্ঠস্বর বুঝি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। লারা দুকান দু-হাতে চেপে কেঁদে ফেললেন। মনে মনে বললেন আমি আর পারছি না। বাইরে নিস্তব্ধ রাত নামছে, গাছের পাতা একটা একটা করে ঝরে পড়ছে, রাতজাগা পাখি শব্দ করে উঠলো। লারার একাকীত্ব তখন আরও ঘন হয়ে উঠেছে।
.
ইউরোপ থেকে ফিলিপ ভালোভাবেই ফিরে এসেছে। ফিলিপ অ্যাডলারের কনসার্ট সকলকেই মুগ্ধ করেছে। একদিন সন্ধ্যেবেলা ফিলিপ লারাকে বলল–লারা তোমার সঙ্গে একবার এলারবি কথা বলতে চায়। আমার সফর কতখানি কমাননা যেতে পারে, সে বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে।
ফিলিপ আরও বলল–লারা শোনো, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। তুমিও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দুজনের আলাদা জগৎ আছে। এখানে একটা নিয়ম করতে হবে। আমাদের ভালোবাসা যেমন বিসর্জন দেওয়া সম্ভব নয়, আমরা আমাদের এই সাধের জগতও বিসর্জন দেবো কেমন করে?
লারা বলল–ঠিক আছে, এসো কিভাবে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি তা ভেবে দেখা যাক।
.
হাওয়ার্ডের কাছ থেকে লারা জানতে পারল ব্যবসাতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।
রেনোতে যে ক্যাসিনো আছে তার লাইসেন্স নিয়ে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। হাউসটনের বিল্ডিংটা দেনার দায়ে দেউলিয়া হবার উপক্রম হয়েছে। নতুন করে ট্যাক্স আইন পাশ হয়েছে। লারার আর্থিক চাপ আরও বেড়ে গেছে। যেসব সেভিংস আর- লোন কোম্পানী লারার সঙ্গে ব্যবসা করছিলো তারা আর লোন দিতে চাইছে না।
লারা ভাবতে থাকল এখন কিভাবে ব্যবসাটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর জন্য একবার রেনোতে যেতে হবে।
.
পেনিং কমিশনের সামনে লারাকে হাজির হতে হল। লারার সঙ্গে ছিল তার উকিল টেরি হিল। তার শপথ নেবার সময়ে সার্টিফিকেটগুলো ভালো করে দেখা হল।
চেয়ারম্যান গম্ভীর স্বরে বললেন–মিস ক্যামেরন, ক্যাসিনোর লাইসেন্সের ব্যাপারে আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আছে।
লারার উকিল টেরি হিল জানতে চাইল–কি রকম?
চেয়ারম্যান লারার দিকে তাকিয়ে বললেন–বলুন তো মিস ক্যামেরন, ক্যাসিনোর ব্যাপারে এটাই আপনার প্রথম অভিজ্ঞতা, তাই তো?
লারা বলল–হ্যাঁ। আমি আগেই জানিয়েছি।
চেয়ারম্যান বললেন আর্থিক ব্যাপারে আপনি এত সুনিশ্চিত হলেন কী করে?
টেরি হিল বলল–এই প্রশ্নের অর্থ কি?
–এক মিনিট মিঃ হিল, আপনি বারে বারে আমাকে বাধা দেবেন না, আপনার ক্লায়েন্টকে প্রশ্ন করছি, উনি জবাব দেবেন।
লারা টেরি হিলের দিকে তাকিয়ে বলল–কনট্রোলার অ্যান্ড অ্যাকাউন্টের কাছ থেকে আমি একটা এস্টিমেট পেয়েছিলাম, তাতে জেনেছিলাম কত দর দিতে হবে।
চেয়ারম্যান বললেন–আপনার দর ছিল পাঁচ মিলিয়ন ডলার। পরের দরটার থেকে অনেকগুণ বেশি।
–তাই নাকি?
–আপনি জানতেন না? চেয়ারম্যানের প্রশ্ন।
লারা বলল–একেবারেই না।
–মিস ক্যামেরন, আপনি পল মার্টিনকে চেনেন?
টেরি হিল বলল–এই প্রশ্নের কি প্রাসঙ্গিকতা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–এক মিনিট মিঃ হিল, আমাকে প্রশ্ন করতে দিন। বলুন মিস ক্যামেরন, আপনি পল মার্টিনকে চেনেন কি না?
লারা আমতা আমতা করে বলল–হ্যাঁ। উনি আমার পরিচিত।
–ওর সঙ্গে আপনার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে কি?
–না। পল আমার বন্ধু।
–আপনি জানেন পল মার্টিনের সঙ্গে মাফিয়াদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে?
টেরি হিল বলল–আমি আপত্তি করছি। ওসব আলোচনা এখানে আসতে পারে না।
চেয়ারম্যান বললেন–ঠিক আছে আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। মিস ক্যামেরন, আপনি শেষ কবে পল মার্টিনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বলুন তো?
লারা একটু ইতস্তত করতে থাকল। বলল–সঠিক বলতে পারছি না। বিয়ের পর ওঁর সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়েছে।
–কিন্তু আপনি তো নিয়মিত টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতেন।
–আগে রাখতাম। বিয়ের পর থেকে রাখি না।
–ক্যাসিনোর ব্যাপারে পল মার্টিনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে?
লারা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পলের সঙ্গে ক্যাসিনো নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। পলই বলেছিল চিন্তার কোনো কারণ নেই। যারা ডাকে হেরে গেছে তাদের কেউ ষড়যন্ত্র করেছে।
টেরি হিলের দিকে লারা তাকাল। বলল–পলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল নীলামে জেতার পর। পল আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এরপর ক্যাসিনোর লাইসেন্স পাবার পর দেখা হয়েছিল।
–আর কোনো সময় হয়নি?
–না।
–মিস ক্যামেরন, আপনি শপথ নিয়ে কমিশনের সামনে মিথ্যে বলবেন না।
–আমি সত্যি কথা বলছি।
চেয়ারম্যানের কণ্ঠস্বর এখন গম্ভীর।–মিথ্যে হলফনামার জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হতে পারে, আপনি কি তা জানেন?
–জানি। লারা নির্বিকার।
চেয়ারম্যান এবারে টেবিলের ওপর একগোছা কাগজ রেখে বললেন, পল মার্টিনের সঙ্গে অসংখ্যবার আপনার টেলিফোনে কথা হয়েছে। এখানে এসব কথাবার্তার পনেরোটা লিস্ট আছে। এগুলো ঠিক সেই সময়ের যখন ক্যাসিনোর সীল করা দরপত্র আপনি জমা দিয়েছিলেন।
আকস্মিক এই আঘাতে লারার মস্তিস্ক একেবার স্তব্ধ হয়ে গেছে। লারা স্থির চোখে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকল।
.
ফিলিপের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কার্নেগী হলে। পুরো প্রোগ্রাম শেষ হতে মাঝরাত হয়ে গেল। হল ফাঁকা। নিস্তব্ধ রাত। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। রাস্তার আলো কমে আসছে। ফিলিপ ট্যাক্সির জন্য এগিয়ে গেল, রেনকোট পরা একটা ছায়ামূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়াল। মূর্তি বলল–এখানে এসে পৌঁছলেন কি করে?
ফিলিপ ভাবলো লোকটা রসিকতা করছে। ফিলিপ বলল–সবই অভ্যেসের ব্যাপার।
–কার্নেগী হলটা কোন দিকে?
ফিলিপ আঙুল দিয়ে দেখালো-ওই যে সোজা চলে যান।
হঠাৎ লোকটা ফিলিপকে বুক দিয়ে ঠেলে দেওয়ালের সামনে নিয়ে গেল। হাতে একটা লম্বা ছোরা বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠলো। ফিলিপ শিউরে উঠল। লোকটা ছোরাটা ফিলিপের বুকে ঠেকিয়ে বলল–মানিব্যাগটা বের করুন।
বৃষ্টি জোরে পড়ছে। ফিলিপের শীত করছে। রাস্তায় কেউ নেই। মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি। ফিলিপ বলল ঠিক আছে, দিচ্ছি।
ছোরাটা ফিলিপের গলার কাছে। ফিলিপ বলল–আমাকে ভয় দেখাবার দরকার নেই।
লোকটা বলল–তাড়াতাড়ি।
ফিলিপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে লোকটার হাতে তুলে দিল। এক হাতে লোকটা ফিলিপের রিস্টওয়াচটা খুলে নিলো। ছোরাটা নামিয়ে এনে কব্জির কাছে নিয়ে গিয়ে সোজা টেনে দিল। ফিলিপ যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। রক্তধারা রাস্তায় পড়ে বৃষ্টির জলে মিশে গেল।
ফিলিপ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তারপর সংজ্ঞাহীন দেহটা রাস্তায় পড়ে । গেল। বৃষ্টির জলের সঙ্গে তার শরীরের রক্ত মিশে একটা অদ্ভুত ছবি তৈরি হচ্ছিল। অন্ধকার রাস্তায় করুণভাবে পড়ে রইলো ফিলিপের অচেতন দেহটা।