২১.
আগুনে ঝলসে গেছে এমিল জেপলির দেহ। ফরমুলার হদিস মেলেনি।
সিকিউরিটি ফোর্সের প্রধানকে লিজা বলল–ল্যাবোরেটরিতে দিনরাত পাহারা থাকার কথা ছিল না?
-ইয়েস মাদাম।
–কতদিন ধরে ইনচার্জের দায়িত্বে আছো?
–পাঁচ বছর।
–তোমায় বরখাস্ত করা হল। কত জন কর্মচারী আছে তোমার?
–পঁয়ষট্টি জন।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাদের সরিয়ে নেবে।
মিস রফ, কাজটা কি ভালো হল?
–গেট আউট।
.
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটা কপি দেখিয়ে রিস উইলিয়ামস বলল, ওরা লিখেছে কোম্পানির অভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন।
ব্যাঙ্কার জুলিয়াস বাদরাট ফোন করে জানাল বিকেল চারটের সময় আসছি। মিস্টার জেপলির মৃত্যুতে দুঃখিত।
অথচ এমিল জেপলির নাম খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়নি।
–হাঙর রক্তের গন্ধ পায়। রিস্ বলে উঠল।
স্যার অ্যালেকের ফোন এল। ফাইন্যানসিয়াল টাইমস রফ অ্যান্ড সন্সের নানা সমস্যা নিয়ে মস্ত বড়ো হেডলাইন দিয়ে প্রবন্ধ ছাপিয়েছে। তাই অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে। সে এখন কী করবে?
–পরে বলছি।
ইভো পালাজজি ফোনে জানাল, কয়েক ঘণ্টা আগে ইতালির এক মন্ত্রীকে ঘুষ নেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘুষ হিসেবে টাকাটা আমাদের কাছ থেকেই ওই মন্ত্রী নিয়েছিল। ইতালির বাইরে যাবার সময় ইতালি সরকারের চাপে পড়ে এয়ারপোর্টে তাকে ধরা হয়।
–ঘুষ দেওয়ার কারণ?
–তাহলে ইতালিতে কারবার চালানো যেত না।
এখন কী হবে?
–ইতালিতে গরিব ছাড়া কেউ জেলে যায় না।
শার্ল ও ওয়ালথারও ফোনে জানাল–প্রেস কোম্পানির বিরুদ্ধে নানা কুরুচিকর মন্তব্য করছে। ক্রেতাদের আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলছি। পাবলিককে শেয়ার বিক্রি করার এখনও সময় আছে। এরপরে এ সুযোটুকুও হারাতে হবে আমাদের।
.
মারিয়া মারতিনেলি। ইতালিয়ান মেয়ে।
সুইজারল্যান্ডে এলিজাবেথ রফ আর মারিয়া একই ক্লাসে পড়ত।
মারিয়া একজন মডেল। মিলানের এক ইতালিয়ান সংবাদপত্র প্রকাশকের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ও এখনও নিজকে চিঠিপত্র দেয়।
টেলিফোন বুক থেকে নম্বরটা নিয়ে লিজা তাকে ফোন করল।
হ্যাঁ, লিজা, টনি ডির্ভোস পেলেই আমরা বিয়েটা সেরে নেব।
–মারিয়া, আমার একটা কাজ করে দেবে।
তারপর এক ঘন্টার প্রতীক্ষা।
মারিয়া ফোন করল। টনি খবর নিয়ে জেনেছে, যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে যে বিদেশে টাকা পাচার করছে, এ খবরটা পুলিশকে কেউ জানিয়ে দিয়েছিল।
–সে কে?
–ইভো পালাজজি!
.
রফ অ্যান্ড সন্সের ল্যাবোরেটরিতে বিস্ফোরণের ব্যাপারটা তদন্ত করে ডিটেকটিভ ম্যাক্স জেনেছে যে, ইচ্ছে করেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।
–বিস্ফোরফের নাম?
রাইলার টেন। সেনাবাহিনীতে সাপ্লাই করে রফ অ্যান্ড সন্স। এই বিস্ফোরক পদার্থ ওদের ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়।
কোন্ শাখা?
.
বিকেল চারটে।
চেয়ারে বসে ব্যাঙ্কার জুলিয়াস।
মিস রফ, শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে আমরা ঋণের টাকা এখনই ফেরত চাইছি।
–এজন্য তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছিল।
জানি, কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
রফ অ্যান্ড সন্স ছোটোখাটো কোনো কোম্পানি নয়।
–অস্বীকার করছি না। কিন্তু কোম্পানিতে অনেক ঝামেলা। সামলানোর মতো উপযুক্ত লোকের অভাব।
–যদি প্রেসিডেন্ট বদলে যায়?
–আমরা সে কথাও ভেবেছি। কিন্তু আপনার বোর্ডের বর্তমান সদস্যদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারে।
–রিস্ উইলিয়ামস হলে কেমন হয়?
.
২২.
টেমস মেরিন পুলিশ ডিভিসনের কনস্টেবল টমাস হিলার। তার এখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কাল সে ভালো ঘুমোত পারেনি। ফ্লো তার বান্ধবী, প্রেমিকা। এবং তারা নিয়মিত শরীরে শরীর রাখে। কিন্তু কাল সারারাত ফ্লো চিল চিৎকার করায় সে কিছুই করতে পারেনি।
এখন টমাসের খিদে পেয়েছে। কীসের খিদে? যৌন খিদে। সে অতৃপ্ত। ফ্লো স্তনদুটো তুলে ধরে বিছানায় উলঙ্গ হয়ে শুলে কী হবে, যতবার টমাস এগিয়ে গেছে, ততবার চিৎকার করে সরিয়ে দিয়েছে।
হাওয়ার ঝাপটায় বৃষ্টির জল তিরিশ ফুট লম্বা পুলিশ বোটের হুইল হাউসে ঢুকে পড়েছে। টমাসের পোশাক ভিজে গেছে। টেমস নদীতে পাহারা দেবার কাজ টেমস ডিভিসনের। বিস্তৃতি ৫৪ মাইল–আর্টফোর্ড ক্রীক থেকে স্টেইনস ব্রিজ পর্যন্ত। আর আধঘন্টা। তারপর টমাসের ডিউটি শেষ। ফিরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্লোর সঙ্গে বিছানায় যাবে। যৌনমিলনের পর ঘুমোবে।
নদীতে কাদাজল মিশেছে। বৃষ্টির জলে নদী ভরপুর।
ঠিক এইসময় স্টারবোর্ডের দশ গজ দুরে কী একটা ভেসে উঠতে দেখা গেল। মরা, বড়ো, সাদা মাছের মতো। বোটে তুললে গন্ধ ছাড়বে। বোটের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। সময় নষ্ট হবে। তাহলে তার ফিরতেও দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে কনস্টেবল, ওটার ব্যাপারে কিছু বলবে না। কিন্তু বলে ফেলল।
সার্জেন্ট, স্টারবোর্ডের কুড়ি ডিগ্রিতে মস্ত বড়ো মরা মাছের মতো নদীতে কী একটা ভাসছে।
একশো হর্সপাওয়ার ডিজেল ইঞ্জিন শ্লথ হল। বোটের গতি কমে গেল।
–কোথায়? সার্জেন্ট গাসকিনস জানতে চাইল।
–এই তো একটু আগেও দেখেছি। এখন দেখা যাচ্ছে না। সার্জেন্টও তাড়াতাড়ি ডিউটি শেষ করতে চাইল–কত বড়ো? নৌকোর পথ আটকে দেবার মতো?
হ্যাঁ।
কিন্তু পেট্রল বোট ঘুরতেই জিনিসটা দেখা গেল।
মাছ নয়–এক যুবতীর উলঙ্গ লাশ। মাথায় সোনালি চুল। গলায় লাল রিবন বাঁধা।
.
২৩.
এবং এই সময় ডিটেকটিভ ম্যাক্স ন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসে এসে ঢুকল।
–এসব মার্ডার কেসে স্যার অ্যালেক নিকলসকে কি আপনি সন্দেহ করেন? ইন্সপেক্টর ডেভিডসন জানতে চাইল।
দুজন সম্ভাব্য অপরাধীর মধ্যে একজন।
-দেখা যাক সি-ফোর ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স, সি-ইলেভেন ও সি-থারটিন ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স বিভাগ কী বলে?
-স্যার অ্যালেক নিকলসের নামে কোনো পুলিশ রেকর্ড নেই। তবে আসল খবরের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
.
লন্ডনের বড়ো বড়ো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ম্যাক্স ফোন করেছে। প্রথমে কেউ সহযোগিতা করতে চায়নি। সবাই আতঙ্কিত। পরে যখন জানতে পারল স্যার অ্যালেক নিকলসের ব্যাপার সন্ধান করছে, তখন অনেকেই মুখ খুলল।
ব্যাঙ্ক, ফিনান্স কোম্পানি, ক্রেডিট রেটিং, ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স-কোনো অফিসেই ম্যাক্স কোনো মানুষের সঙ্গে কথ বলছে না। সে শুধু কম্পিউটারে চোখে রাখে।
.
ম্যাক্স কম্পিউটারের কনসোল বোর্ডে মেশিন নিয়ে নাড়াচাড়া করে, যেন কোনো সঙ্গীতজ্ঞ পিয়ানো বাজাচ্ছে। এ ব্যাপারে ম্যাক্স এক বিস্ময়!
ডিজিট্যাল, লো-লেভেল হাই-লেভেল, ফরট্রান, ফরট্রানফোর, আইবিএম ৩৭০, পিডিপি ১০ ও ১১, অ্যালগল ৬৮। ব্যবসার খাতিরে কোবোল। পুলিশের জন্য বেসিক। চার্ট ও গ্রাফের জন্য হাই স্পিড এপিএল। লিপস এপিভি এল-১, বাইনারী বোর্ডে সিপিভি ইউনিটকে ম্যাক্স প্রশ্ন করছে।মিনিটে ১১০০ লাইন করে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। জায়ান্ট কম্পিউটারগুলি এত খবর মজুত রেখেছে। আধুনিক সভ্য জগতে মানুষের গোপন নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। কম্পিউটার সব খবর ফাঁস করে দেয়। প্রয়োজন শুধু ধৈর্য। যেমন–সোস্যাল সিকিউরিটি নম্বর, ইনসিউরেন্স পলিসি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ট্যাক্স দিয়ে থাকলে তার রসিদ বাড়ি মর্টগেজ দিলে, গাড়ি বা স্কুটার কিনলে, হাসপাতালে বা আর্মিতে রেকর্ড থাকলে, পাসপোর্ট বা টেলিফোন থাকলে, জন্ম, বিবাহ, এমনকি ডিভোর্স হলে সমস্ত রেকর্ড কম্পিউটার ধরে রাখে। শুধু খুঁজে নিতে হয়।
যেমন এখন দেখা যাচ্ছে, স্যার অ্যালেক নিকলসের বেশি অঙ্কের বেশ কয়েকটা বেয়ারার চেক। অ্যালেক কাকে টাকা দিচ্ছে ট্যাক্স? ব্যবসা? ব্যক্তিগত খরচ? –না!
মাংসের বিল, ডেন্টিস্টের বিল, হেয়ার ড্রেসারের বিল দেওয়া হয়নি।
মেয়েদের জন্য পোশাক কেনা হয়েছে সার লরেন্স আর জন বেটস থেকে।
হোয়াইটস ক্লাবে টাকা দেওয়া হয়েছে।
মোটর ভেহিকলস লাইসেনসিং সেন্টার।স্যার অ্যালেক বেনটলি আর মরিস গাড়ির মালিক।
মেকানিকের বল? -সাত বছরে কোনো বিল দেওয়া হয়নি।
স্যার অ্যালেক নিকলস নিজের গাড়ি নিজেই সারায়। গাড়ির যান্ত্রিক কলাকৌশল তার জানা আছে। এ মানুষের পক্ষে জীপের ব্রেক বিকল করে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। লিফটের ড্রামও বিগড়ে দিতে পারে।
কম্পিউটার বলছে, স্যার অ্যালেকের আয় কম, অথচ ব্যয় বেশি।
জানা গেল, স্যার অ্যালেক সোহোর এক ক্লাবের মালিকের কাছ থেকে টাকা ধার করেছে।
লোকটার নাম টড মাইকেলস। সে বেশ্যার দালাল, মদ, হেরোইন, সুদখোর, ব্ল্যাকমেলার, মহাজন। বহুবার তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে শাস্তি দেওয়া যায়নি।
ম্যাক্স সোহোয় গেল। সন্ধান নিয়ে দেখা গেল, অ্যালেকের বউ ভিভিয়ান জুয়া খেলে ধার তৈরি করেছে।
ম্যাক্স নিঃসন্দেহ হল, স্যার অ্যালেক নিকলসকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। তার বর্তমানে অর্থের প্রয়োজন। লাখ লাখ ডলারের শেয়ার আছে তার। কিন্তু শেয়ার বিক্রিতে বাধা পাচ্ছে। অতএব স্যার অ্যালেককে খুনের ব্যাপারে সন্দেহের তালিকায় রাখা যেতে পারে।
.
এবার রিস্ উইলিয়ামস।
কম্পিউটার বলছে
সুপুরুষ, ওয়েলসে জন্ম, বয়স ৩৪। বিয়ে করেনি, রফ অ্যান্ড সন্সের একজন উঁচু দরের অফিসার। লন্ডনে সেভিংস অ্যাকাউন্টে পঁচিশ হাজার পাউন্ড, কারেন্ট অ্যাকাউন্টে আটশো, জুরিখের ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিটে কত রেখেছে জানা যাবে না। না, মেয়েদের জন্য উপহার কেনার কোনো বিল নেই। ক্রিমিনাল রেকর্ড-নেই।
এইসব তথ্যের অন্তরালে সত্যিকারের রিস উইলিয়ামস লুকিয়ে আছে। ম্যাক্সের মনে পড়ল–এলিজাবেথ রফকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় ওই লোকটা আপত্তি করছিল। কেন? কাকে আড়াল করতে চাইছে? মিস রফকে? না, নিজেকে?
পুলিশ ডিটেকটিভ ম্যাক্স সেদিন সন্ধ্যায় রোমের দিকে যাত্রা করল।
.
২৪.
ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিক্স ও সিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডাটা থাকে আনাগ্রাফে.বিল্ডিং-এ। ম্যাক্স এখানে এসআইডি ও ব্যাঙ্ক কম্পিউটারের সঙ্গে কথা বলল। দশ বছর ধরে ইভো পালাজজি যে জীবন গড়ে তুলেছিল তা একদিনের মধ্যে ম্যাক্সের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল।
ইভো পালাজজির দুটো বউ, দুটো সংসার, দুটো অস্তিত্ব, দুটো জীবন।
আমিসির মুদির বিল, বিউটি সেলুনের বিল, ভায়াকনদত্তির দোকান থেকে–এনজেলো থেকে স্যুট, কারদুসি থেকে ফুল, আইরিন গ্যালিৎজিন থেকে দুটো ইভিনিং ড্রেস, ছটা বাচ্চার জন্য টিউশনে ফি।
ছটা বাচ্চা কেন?
আনাগ্রাফের কম্পিউটার বলছে, ইভোর তিনটি মেয়ে।
ওলিসিয়াটায় ইভোর বাড়ি। আবার ভায়া মতেমিয়াও-এ তার ফ্ল্যাট আছে।
ইভো পালাজজি নামে দুজন পুরুষ নেই। একজনই–দুটো সংসার। স্ত্রী সিমনেত্তা, তিনটি মেয়ে। রক্ষিতা দোনাতো, তিনটি ছেলে।
ইভো হাতের কাজ করতে ভালোবাসে। সম্প্রতি করাত ও যন্ত্রপাতি কিনেছে। স্থপতি হিসেবে ওর নামডাক আছে। লিফটের ব্যাপারেও নিশ্চয়ই কিছু জানা আছে।
কম্পিউটার তথ্য দিয়েছে ব্যাঙ্কের লোনের জন্য সে সম্প্রতি আবেদন করেছিল। পায়নি। ব্যাঙ্ক ওর স্ত্রীর সই চেয়েছিল। তাই আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
এবার ইইউআর ও পলিজিয়া সায়েন্টিফিক সেন্টারের মস্ত বড়ো কম্পিউটার কী তথ্য দিচ্ছে দেখা যাক
ক্রিমিন্যাল রেকর্ড?
তেইশ বছর বয়সে মারামারি করার অপরাধে তাকে দুমাস জেল খাটতে হয়েছিল।
এছাড়া–
ভায়া মতেমিয়াও-এ ওর রক্ষিতার বাড়ির আশেপাশের লোকেরা ওদের নামে অভিযোগ করেছে–ভীষণ চেঁচামেচি, মারামারি হয়।
তার মানে ইভো আর দোনাতেল্লার মধ্যে তর্কাতর্কি, ঝগড়া, মারামারি হয়। জানা গেল, ইভোর রক্ষিতা এসব কথা ফাঁস করে দিতে চাইছে। টাকা চাইছে? তাই কি ব্যাঙ্কের ঋণের জন্য ইভো আবেদন করেছিল? ইভো পালাজজি, দাম্পত্য জীবন, সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য বহুদূর যেতে পারে।
এয়ারপোর্টে যে লোকটাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তার কাছ থেকে পাওয়া টাকার : একটা অংশ পুলিশ ইভোকে উপহার হিসাবে দিয়েছে। এতোই টাকার দরকার তার?
ম্যাক্স আবার দুপুরে প্লেনে চড়ে প্যারীতে ফিরে এল।
.
২৫.
দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে নত্ৰদাম এল ম্যাক্স, বাসে। সাড়ে সাত ফ্রা খরচ হল। ট্যাক্সিতে এলে লাগত ৭০ ফ্রাঁ।
সস্তা দামের হোটেল যুবল-এ উঠল সে।
সে বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফোনে যোগযোগ করল। ব্যবসায়ীরা প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ম্যাক্স মানেই ঝামেলা। ওর কাছে গোপনীয়তা বজায় রাখা যায় না। কিন্তু : যখন জানতে পারল, অন্যের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাচ্ছে ম্যাক্স, তখন তাদের মুখে হাসি।
–বেশ তো, আমাদের কম্পিউটারের সঙ্গে কথা বলল।
.
শার্ল ও হেলেন রফ মারতেইল সম্পর্কে কম্পিউটার জানালো–
রু ফ্রাঁসোয়া প্রিমিয়ার ফাইভ নম্বর বাড়ি। ২৪শে মে, ১৯৭০ সালে বিয়ে হয়েছে, কোনো সন্তানসন্ততি নেই। হেলেন এর আগে তিনবার বিয়ে করে ডির্ভোস করেছে। ব্যাঙ্কের। অ্যাকাউন্টটা হেলেনের নামে।
দেখা গেল শার্লের জন্য যা কিছু খরচ-জুতো, টুপি, পোশাক, রেস্তোরাঁর বিল–সবেতেই হেলেন সই করেছে।
আর কিছু?
ডাক্তারের বিল। ডাক্তারি রিপোর্টনার্ভাস ব্রেক ডাউন। উরু ও পাছায় কালশিটে ক্ষত। এর কারণ কী? জানা যায়নি।
আর?
আর চার মিলিয়ন ফ্রাঁ খরচ করে রেনে দীশাপ আর তার বন্ধু শার্ল দেসাঁ ওরফে শার্ল মারতেইল আঙুরের খেত কিনেছিল।
টাকা কোথা থেকে পেল?
মাসির বাড়ি থেকে।
তার মানে?
ওটা একটা ফরাসি গালাগাল। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নিয়েছিল।
লাভ পাওয়া গেছে?
না, ক্ষতি হয়েছে।
ইনসিওরেন্স কম্পিউটার জানালো, জুয়েলার পিয়েরের সাহায্যে শার্ল মারতেইল বউ হেলেনের সিন্দুকে রাখা দামি গয়নাগুলোর নকল করে আসলগুলোর বিক্রি করে দিয়েছিল। এর বিনিময়ে কুড়ি লাখ ফ্রাঁ পেয়েছিল শার্ল দেসাঁ ওরফে মারতেইল।
এছাড়া পাহাড়ে চড়ার একজোড়া জুতোর বিল রয়েছে।
কার জন্য? শার্লের জন্য? অবিশ্বাস্য! যে বউয়ের গয়না চুরি করে ব্যবসা করে, নিজের নামে যে একটাও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেনি, সে যাবে পাহাড়ে উঠতে? না, ব্যাপারটা কেমন গরমিল লাগছে।
বুটজোড়া কেনা হয়েছে টিমউয়্যার স্পোর্টস শপ থেকে।
জুতোর সাইজ দেখতে চাই।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল–৩৬ সাইজের বুট। মেয়েদের।
তার মানে হেলেন রফ মারতেইল পাহাড়ে চড়ে এবং ওই সময় স্যাম রফ খুন হয়েছিল।
.
২৬.
প্যারীর রু আরমেগো। বিশেষ ঘিঞ্জি নয়। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর বেশির ভাগই একতলা আর দোতলা।
ইন্টারপোলের হেডকোয়াটার্স। ২৬ নম্বর। আটতলা বিল্ডিং। ইস্পাত, পাথর ও কাঁচ দিয়ে তৈরি। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়ার সংগঠন।
ম্যাক্স জানতে পারল, ওপরে মাফ ফিল্ম দেখানো হচ্ছে।
–স্নাফ ফিল্ম কী?
তিনতলায় সিনেমার পর্দার সামনে বসে আছে ইন্টারপোলের সদস্যরা। ফরাসি পুলিশের ইন্সপেক্টর, সাধারণ পোশাকে পুলিশ ডিটেকটিভ এবং ইউনিফর্ম পুলিশরা।
ম্যাক্স পেছনের সিটে বসল।
রেনে আলমেইদি, ইন্টারপোলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
তিনি বলতে থাকেন–গত কয়েকবছর ধরে এ ধরনের ব্লুফিল্ম দেখানো চলছে। যৌন বিকারগ্রস্ত পুরুষরাই এই সব পর্নোফিল্ম দেখে থাকে। দু-দিন আগে একটা ব্লু ফিল্মের রিল আমাদের হাতে এসেছে। লোকটা গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। তার অ্যাটার্চির মধ্যে এই রিলটা ছিল। এখন আমরা সেটাই দেখব।
ঘর অন্ধকার।
স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা যুবতী মেয়ের নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে, বিশাল এবং নির্লোম দেহের এক পুরুষ তার ওপর চেপেছে। ক্লোজআপ ছবি, মস্ত বড়ো পুরুষাঙ্গটি স্ত্রীর অঙ্গের গোপন গহ্বরে প্রবেশ করেছে। গলায় লাল রিবন বাঁধা মেয়েটার। মেয়েটাকে ম্যাক্স চেনে না বটে, কিন্তু লাল রিবন বাঁধা এই রকম একটি নারীর লাশ সে কোথায় যেন দেখেছিল!
ফিল্ম চলছে–
মেয়েটার চরম পুলকের মুহূর্তে পুরুষের বলিষ্ঠ হাত তার গলা টিপে ধরল। মেয়েটার প্রাণহীন দেহ। ক্লোজআপে দেখানো হয়েছে।
ম্যাক্স এতক্ষণে মনে করতে পারল, জুরিখে নদী থেকে যে মেয়েটির লাশ তোলা হয়েছিল, তার গলাতেও লাল ফিতে বাঁধা ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হল। জুরিখ, লন্ডন, রোম, পর্তুগাল, হামবুর্গ, প্যারী–সর্বত্রই এই প্রকৃতির খুনের ঘটনা ঘটেছে।
–ম্যাক্স, রেনে আলমেইদি বলতে থাকে, সব কটি ঘটনায় দেখা গেছে, মেয়েরা যুবতী, মাথায় সোনালি চুল, নগ্ন দেহ, গলায় লাল ফিতে। যৌনসঙ্গমের পর গলা টিপে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার মানে, খুনি একজন যৌনবিকারগ্রস্ত রোগী। পয়সা আছে। পাসপোর্ট দেখিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে এই জঘন্য কাজ করে চলেছে।
রেনের সহকারীর কাছ থেকে ম্যাক্স জানতে পারল, ব্রাসেলসের একটা ছোটো কোম্পানি পর্নোফিল্মের স্টক করেছে। কারা এই সব ফিল্ম কিনেছে, তারও লিস্ট তারা পেয়েছে। ম্যাক্স লিস্টটা দেখতে চাইল।
.
২৭.
বার্লিন। নিকসড কম্পিউটার। কিছু জানতে গেলে বিশেষ পাঞ্চ কার্ড প্রায়োজন হয়।
ওয়ালথার গ্যাসনার?
কম্পিউটারের স্ক্রিনে ওয়ালথার গ্যাসনারের অঙ্কের মতো নিখুঁত এবং ফটোর মতো স্বচ্ছ বিবরণ ফুটে উঠল। কোন্ কোন্ হোটেলে যায়, কোন্ মদ পছন্দ করে, কোন্ খাবার ইত্যাদি। সুদর্শন, সুপুরুষ। স্কি খেলার এক্সপার্ট, বয়সে বড়ো এক ধনী মহিলাকে সে বিয়ে করেছে।
একটা চেক। কনসালটেশনের জন্য ডক্টর হেসেনকে দুশো মার্ক দেওয়া হয়েছে। ড্রেসডনার ব্যাঙ্কে ডাক্তারের অ্যাকাউন্ট আছে।
ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে ফোনে কথা বলল ম্যাক্স।
–ডক্টর হেসেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
চোখ বুজে একটুক্ষণ বসে রইল ম্যাক্স। হ্যাঁ, সূত্র একটা পাওয়া গেছে।
হ্যালো, ডক্টর হেসেন।
–এখন সময় নেই।
সময় আপনাকে দিতেই হবে। ওয়ালথার গ্যাসনার কেন আপনার কাছে গিয়েছিল বলতে পারেন?
–পেশেন্টের ব্যাপার অন্য কাউকে বলি না।
ম্যাক্স কম্পিউটারকে বলল–ডক্টর হেসেনের ব্যাপারে খবর চাই।
তিন ঘন্টা পরে ম্যাক্স আবার ডক্টর হেসেনকে ফোনে যোগাযোগ করল।
–আমি তো জানিয়েছি, রোগীর গোপন খবর বলতে পারব না। কোর্ট অর্ডার নিয়ে আসতে হবে।
–ডক্টর, আমার সামনে তোমার গত পাঁচ বছরের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন। তুমি সরকারকে ফাঁকি দিচ্ছো। আয়ের শতকরা পাঁচশো ভাগের সুদ জমা দিচ্ছে না। কথাটা জার্মান ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের কানে গেলে কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছো। মিউনিখে তোমার সেফ ডিপপাজিট আছে। ওরা যদি খুলে ফেলে
-ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমার নাম বলো।
সুইস ক্রিমিনাল পুলিশের ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং।
–বলুন, আপনি কী জানতে চাইছেন?
–আমি ওয়ালথার গ্যাসনারের ব্যাপারে–
ও অ্যাপয়ন্টমেন্ট না করেই এসেছিল। বলল, ওর এক বন্ধু নাকি সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে, যে-কোনো সময় মানুষ খুন করতে পারে। ওর তাকে পাগলা গারদে দেবার ইচ্ছে নেই। আমি বলেছিলাম, মানসিক রোগীর দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। তবে আমার ধারণা, বন্ধু বান্ধব নয়, ও নিজেই একজন সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট।
না, মিলছে না। ব্যাপারটা কেমন খাপছাড়া লাগছে।
সকালে ম্যাক্স জুরিখে ফিরে এল। টেবিলে ইন্টারপোলের টেলিটাইল। ম্যাক্স দেখল রফিল্ম ক্রেতাদের লিস্ট–আটজন। ওই তালিকায় রফ অ্যান্ড সন্সের নামও আছে।
.
চিফ ইন্সপেক্টর অবাক। আবার বড়ো কেস ম্যাক্সের হাতে এসেছে, বরাত সত্যিই ভালো।
স্যাম রফের মৃত্যু, জীপ অ্যাক্সিডেন্ট, লিফট ভেঙে পড়ে যাওয়া ইত্যাদির জন্য তুমি কাকে সন্দেহ করছ?
চারজন বোর্ড মেম্বারের মধ্যে একজন খুনি।
-সে কে? কে লিজ রফকে হত্যা করতে চাইছে?
–সে লোকটা হল রিস্ উইলিয়ামস। সে স্যাম রফের মৃত্যুর সময় ঘটনাস্থলে ছিল।
.
২৮.
মিসেস রিস্ উইলিয়ামস! এলিজাবেথ রফের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না এককালে কাগজে সে এই নামটা অনেকবার লিখেছে। আজ তার আঙুলে এনগেজমেন্ট রিং।
রিস্ উইলিয়ামস আর এলিজাবেথ রফ–তারা এখন বোয়িং ৭৩৭-৩২০ বিমানে। অতলান্তিক সমুদ্রের পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে ইরানি ক্যাভিয়ার আর ডম পেরিংটন মদ দিয়ে ডিনার সারা হয়েছে।
উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আছে রিস্ উইলিয়ামস।
লিজা তাকিয়ে আছে কী সুন্দর, সুপুরুষ!
হাসছো যে?
না, আমি সুখী; তাই…।
সে কত সুখী, তার স্বামী কোনোদিন জানবে না। সে রিকে খোর পর থেকেই তার প্রেমে পড়েছে। তাকে সে ভালোবাসে। সে হতে চায় রিসের বাস, রে মা। কিন্তু রিস্? সে তাকে ভালোবাসবে তো?
ব্যাঙ্কার জুলিয়াসের সঙ্গে মিটিং শেষ হল লিজার।
সে রিসের অফিসে এসে ঢুকল।
রিস, তুমি আমায় বিয়ে করবে? মানে,…তুমি তাহলে রফ অ্যান্ড সন্সের প্রেসিডেন্ট হতে পারবে। ব্যাঙ্ক তাহলে টাকা শোধের জন্য চাপ দেবে না। এই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তোমাকে আমার গলায় মালা দিতে হবে। কোনো পরিবারের অন্যান্য মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। অবশ্য তুমি স্বাধীনভাবে জীবন-যাবন করতে পারবে, ইচ্ছে হলে…
–অবাক হলাম। প্রত্যেক দিন তো সুন্দরী মেয়েদের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাব না।
হ্যাঁ, তুমি হবে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। তবে ব্যাঙ্কের স্টক এবং ভাটাধিকার আমার
দায়িত্বেই থাকবে।
–আমি যদি কোম্পনি চালাই।
হ্যাঁ, তুমি চালাবে। তবে শেয়ারের ব্যাপারটা আমার অধিকারে থাকবে। এটা আমি কাউকে দেব না।
তার মানে? রিস মনে মনে চটে গেল। সে ঠিক করে রেখেছিল, প্রেসিডেন্ট হয়ে শেয়ার বেচার অধিকার সবাইকে দেবে। কিন্তু এখন সে গুড়ে বালি।
তার আগে লিজ রফকে জানতে হবে, শেয়ার বেচায় বাধা পেয়ে কে কোম্পানির ক্ষতি করে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছে, কে খুন করেছে স্যাম রফকে। লিজ রফকে খুন করার চেষ্টা করছে কে? রিসূকে সে এসব কথা জানায়নি, বলার সময় এলেই বলবে।
জুরিখে এলিজাবেথ রফ ও রিস্ উইলিয়ামসের বিয়ের পার্টি দেওয়া হল। এসেছে অ্যালেক ও ভিভিয়ান, ইভো পালাজজি ও সিমনেত্তা এবং শার্ল ও হেলেন। আসতে পারেনি অ্যানা ও ওয়ালথার–অসুস্থ। বাকি সবাই ওদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
হেলেন বলল–রিসের সঙ্গে তোমার এত গভীর প্রেম, আগে জানতাম না!
শার্ল মদ খাচ্ছে।
বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ল্যাবরেটরির বিস্ফোরক প্যারীর অফিস থেকেই তৈরি হয়েছিল।
ইভো হাসছে।
ইতালি থেকে টাকা নিয়ে পালাতে গিয়ে যে ধরা পড়েছিল, তার সম্বন্ধে ইভোই পুলিশের কাছে জানিয়ে দিয়েছিল।
শার্ল? ইভো? অ্যালেক? ওয়ালথার? কে খুনি?
.
বোর্ড মিটিং-এ শার্ল বলল–রিস, তুমি এখন প্রেসিডেন্ট। শেয়ার বেচার পারমিশন পাওয়া যাবে তো?
–স্টক লিজ নিজে দেখছে।
না, শেয়ার বিক্রি করা যাবে না। লিজা জানিয়েছিল।
মিটিং শেষ হলে রিস্ বলল লিজা, চল আমরা রিও থেকে হনিমুন সেরে আসি। ওখানকার অফিসে যাওয়া প্রয়োজন। শুনলাম, ম্যানেজার এই সংস্থায় থাকতে চাইছে না। তা হলে কোম্পানির খুব ক্ষতি হবে। তোমাকে না নিয়ে গেলে সবাই নিন্দা করবে।
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব।
রিওতে এখন গ্রীষ্মকাল। প্রিন্সেপ সুগার লোফ হোটেল। চারটে বেডরুম, লিভিংরুম, রান্নাঘর ভাড়া করা হয়েছে। খোলা বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। রুপোর ফুলদানিতে ফুল, শ্যাম্পেন, হুইস্কি, চকোলেট–সব আছে।
হোটেলটা ভালোই, ম্যানেজার এসে মাঝে মাঝে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে।
একটা ফোন পেয়ে রিস্ চলে গেল। পাতলা সিল্কের নাইট গাউন পরে বালিশে চুল ছড়িয়ে দিয়ে লিজা প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে।
কোথায় গিয়েছিল রিস্?..
রিওর বাইরে রফ অ্যান্ড সন্সের ফ্যাক্টরি। সেখানকার প্ল্যান্ট ম্যানেজার সিনর টমাস। মাঝবয়সী। সে আর রফ অ্যান্ড সন্স-এ কাজ করতে চাইছে না। অন্য কোম্পানি তাকে ভালো মাইনে দেবে।
-কিন্তু আমাদের সঙ্গে তোমার যে কনট্রাক্টরিস বলল।
–ও ছিঁড়ে ফেলে দেব। সুখ যদি না থাকল তাহলে ওই কাগজ দিয়ে কী হবে?
–ওরা কি জানে তুমি জেলে যাচ্ছ?
–জেল? কেন?
–বিদেশে ব্যবসা করতে গিয়ে কাকে কাকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে ইউনাইটেড স্টেটস সরকার। রবারটো, তুমিও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। কোম্পানির স্বার্থে আইন অমান্য করেছে। এখানে থাকলে কিছু একটা ভাবা যেত। থাকছে না যখন, গুড বাই।
আমাকে এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এখন সরে যাচ্ছো?
তুমিই সরে যাচ্ছো রবারটো।
–বেশ, আমি এখানেই থাকব। তাহলে ব্যাপারটা ফাস হবে না আশা করি?
নিশ্চয়ই না।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা।
নাইট ক্লাবে দেখা গেল রিস্ এক সুন্দরী স্পেনিস তনয়ার সঙ্গে নাচছে।
লিজা এগিয়ে এল–মেয়েটাকে সরিয়ে দিল। বলল, এখনও আমার স্বামীর সঙ্গে নাচার সুযোগ হয়নি আমার।
বাজনার মৃদু শব্দ। তালে তালে নাচছে ওরা দুজন। লিজের উরু স্পর্শ করে রিসের পুরুষাঙ্গ। সেটা শক্ত হয়ে উঠেছে।
ওরা হোটলে ফিরে এল। দুজনেই প্রত্যেকটি পোশাক খুলে ফেলল। নগ্নতা, সান্নিধ্য, আলিঙ্গন, চুম্বন। সব কিছু দ্রুত গতিতে ঘটে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত গতি। তারপরেই কামনার, বিস্ফোরণ। নিথর ক্লান্ত দুটি শরীর বিছানায় নেতিয়ে পড়ল।
এলিজাবেথ এখন মিসেস রিস্ উইলিয়ামস। সে সুখী এবং সুখী।
.
২৯.
জুরিখের অফিসে বসে আছে রিস্ ও লিজা। ডিটেকটিভ ম্যাক্স এসে ঢুকল। কোনোরকম ভনিতা না করে বলল–কেউ মিস লিজা রফকে খুন করার চেষ্টা করেছে। একবার নয়দু-বার। বিফল হয়েছে। আবার খুনী আপনাকে আঘাত করার চেষ্টা করবে।
লিজ বলে–আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে। সার্ডিনিয়ার পুলিশ জীপ পরীক্ষা করে দেখেছে।
মাদাম, আপনিই ভুল করছেন। গ্যারাজে যে জীপটা আপনি দেখেছেন, ওটাতে অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি। অলিবিয়ার ভাঙাচোরা মোটর গাড়ি রাখার একটা জায়গায় অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া গাড়িটা আমি খুঁজে পেয়েছি। ওই গাড়ির মাস্টার সিলিন্ডারের বন্টু আলগা করে দেওয়া হয়েছিল। ব্রেকফুইড পড়ে যাওয়ায় গাড়ির ব্রেক ধরেনি। সামনের বাঁদিকের ফেনডার ভেঙে গেছে।
–এটা কী করে হয়? রিস চমকে উঠল।
–প্রতিটি জীপ দেখতে একই রকম হয়। পাহাড় থেকে জীপ পড়ে গেল। গাছে ধাক্কা খেল। তখনই ওরা আপনাকে খুন করত, যদি না অন্য লোকজন এসে পড়ত। ওরা তখন আপনার জীপটা সরিয়ে একটা সামান্য ভাঙাচোরা জীপ ওখানে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।
–ওরা কারা? রিসের প্রশ্ন।
–যে স্যাম রফকে খুন করেছিল। গাইড সেজে অন্য নাম নিয়েছিল। আপনার বাবা একা সুইজারল্যান্ডে যাননি। অন্য লোক ছিল।
–সে কে?
–আপনার স্বামী।
–মিথ্যে কথা! পাহাড়ে চড়ার সময় স্যামের সঙ্গে আমি ছিলাম না। রিস্ বলতে থাকে। শোনো লিজা, তোমাকে একটা গোপন খবর বলি। গত কয়েক বছর ধরে কেউ রফ অ্যান্ড সন্সের ক্ষতি করার চেষ্টা চালিয়েছে। স্যাম এ ব্যাপারে একটা রিপোর্ট পেয়েছিল। আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাইল সে। সুইজারল্যান্ডে ডেকে পাঠাল। কিন্তু স্যাম এ ব্যাপারে যাকে সন্দেহ করেছিল, সম্ভবত সে টের পেয়েছিল। তাই স্যামকে মরতে হল। আর রিপোর্টও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
–রিপোর্টটা আমি পড়েছি। রিপোর্ট বলছে, বোর্ডের কোনো সদস্য এই খুনের সঙ্গে জড়িত অথচ দেখো, এই কোম্পানিতে প্রত্যেকের নামে শেয়ার আছে। তাহলে সে কেন কোম্পানির ক্ষতি করতে চাইবে?
-না, মিসেস উইলিয়ামস, ম্যাক্স বোঝাবার চেষ্টা করল, অপরাধী আপনাদের কোম্পানির বিনাশ চায় না। সে এমন একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে চেয়েছে, যখন টাকার জন্য ব্যাঙ্ক আপনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বাধ্য হয়ে তখন স্যাম রফ বাইরে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেবে। কিন্তু সেই অপরাধীর অভীষ্ট এখনও পূরণ হয়নি। তাই আপনার ফাড়া কাটেনি।
.
৩০.
অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে ওয়ালথার গ্যাসনার। চার সপ্তাহ ধরে চলছে। ব্যথা। কমাবার ট্যাবলেট সে খায় না, পাছে ঘুমিয়ে পড়ে, যদি অ্যানা তাকে আবার আক্রমণ করে।
ডাক্তার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে। কিন্তু ওয়ালথার রাজি হয়নি। কোম্পানির ডাক্তার হওয়ায় পুলিশে রিপোর্ট করেনি।
অ্যানা যখন তাকে কাচির ধারালো ফলা দিয়ে আঘাত করল, সে তখন কোনোমতে অ্যানাকে জোর করে বেডরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
অ্যানা চেঁচাচ্ছিল–আমার বাচ্চারা কোথায়?
সেই থেকে অ্যানা শোবার ঘরে বন্দি। খাবার দিয়ে আসে ওয়ালথার, তখন তার চিৎকার শোনা যায়–আমার বাচ্চারা কোথায়?
ঝি মেনডলার কাজ করতে এসেছে। সপ্তাহে একদিন করে আসে ও। বাড়িটা সুনসান। কিছু খুচরো পয়সা আর সোনার পিলবক্স হাতিয়ে নিল সে।
বেডরুমে তালাবন্ধ দেখে সে ভাবল, ভেতরে কিছু আছে নাকি। দরজার হাতল ঘোরাল। ভেতর থেকে একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেল–আমাকে বাঁচাও! পুলিশের খবর দাও! এখানে আমাকে আটকে রাখা হয়েছে।
কোথা থেকে ওয়ালথার গ্যাসনার এসে ঝিকে ওখান থেকে সরিয়ে দিল–এখানে তুমি, কী করছ? গেট আউট, তোমাকে আর চাই না, তোমার এজেন্সিকে বলে দেব। চলে যাও।
ঝি দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। উপরি হিসাবে খুচরো পয়সা আর সোনার পিলবক্স পেয়ে সে মহাখুশি।
.
জুরিখে পুলিশ ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং প্যারীর ইন্টারপোল হেডকোয়াটার্সের রিপোর্টে চোখ দিয়ে বসে আছে। রফ অ্যান্ড সন্স একই স্টক থেকে ব্লু ফিল্ম কিনেছে। জেনারেল এগজিকিউটিভের অ্যাকাউন্টে কেনা হয়েছে। যে এজেন্ট কিনেছে সে এখন ওই কোম্পানির এজেন্ট নয়। খোঁজখবর চলছে।
.
৩১.
রিসের প্রাইভেট ফোন বেজে উঠল।
–হ্যালো নারীকণ্ঠ। হেলেন রফ মারতেইল বলছি। রিস, তুমি কি এর মধ্যেই লিজার পোষা হয়ে গেছো? বিকেলে আসছো তো? নয়তো আমাকেই জুরিখে যেতে হয়।
-না-না, তোমাকে আসতে হবে না। আমিই যাব।
–গুড, আমদের পুরোনো জায়গায়
এই মহিলার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত যৌন মিলনের অভিজ্ঞতা রিসের আছে। মেয়েটা কামনা জাগাতে পারে। হেলেন রফ মারতেইল তার স্বামী শার্লকে পছন্দ করে না। রিকে সে কাছে পেতে চায়।
রিস এলিজাবেথের অফিসে এসে ঢুকল।
লিজা ফিসফিস করে বলল–চলো রিস, আমরা বাড়ি যাই। তারপর বিছানায় শুয়ে
–তোমায় যৌন ক্ষুধায় ধরেছে দেখছি। আমাকে বিকেলে প্যারীতে যেতে হবে।
–আমিও যাব।
দরকার নেই। ছোট্ট কাজ। রাতেই ফিরে আসব।
.
লেফট ব্যাঙ্কের ছোট্ট হোটেলের ডাইনিং রুম। হেলেন রফ মারতেইল বসে আছে। সে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। দেহ নিয়ে বিচিত্র খেলা খেলতে পারে। কিন্তু তার খেলার মধ্যে আছে নিষ্ঠুরতা, আততায়ীর মতো। সে করুণা করতে জানে না।
–ডার্লিং, তোমায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। বলল, কেমন লাগছে বিয়েটা? বিছানার ব্যাপারে লিজা নিশ্চয়ই খুব যত্নশীল।
হেলেনের আঙুল খেলা করছে রিসের হাতের ওপর। রিস্ জানে, বিছানায় হেলেন নেকড়ে বাঘের মতো হয়ে যায়। বন্য, চতুর ও কুশলী, প্রবল যৌন আকাঙ্ক্ষা। সহজে তৃপ্ত হয় না।
রিস্ তার হাত সরিয়ে নিল। হেলেনের দৃষ্টিতে শীতলতা।
রফ অ্যান্ড সন্সের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে কেমন লাগছে রিস?
ওহো, রিস তো হেলেনের উচ্চাশার কথা ভুলেই গিয়েছিল! হেলেন বলেছিল, স্যাম সরে গেলে আমরা দুজনে মিলে কোম্পানি চালাতে পারি।
ক্ষমতার লোভে হেলেনের যৌনকামনা বাড়তে থাকে এবং তা বিপজ্জনক।
–বলল, আমায় ডেকেছ কেন?
–রিস, ভুলে যেও না, তুমিও উচ্চাশা পোষণ করো, আমারই মতো। না হলে স্যামের পাশে পাশে ছায়ার মতো এই কোম্পানিতে পড়ে ছিলে কেন? কারণ তোমার উচ্চাশা ছিল, একদিন রফ অ্যান্ড সন্সের সর্বেসর্বা হবে।
-স্যামকে আমি পছন্দ করতাম। তাই ওর সঙ্গে থাকতাম।
–তাই নাকি! এখন স্যামের সুন্দরী মেয়ে তোমার ঘরনী হয়েছে।
প্লাটিনামের লাইটারের আগুনে পাতলা কালো চুরুট ধরাল হেলেন। বলল, শার্লের কাছে। শুনলাম, এলিজাবেথ শেয়ার বিক্রিতে বাধা দিচ্ছে?
–হ্যাঁ, তাই।
–আচ্ছা রিস, ভেবে দেখো তো, লিজার অ্যাক্সিডেন্ট হল, সে মারা গেল, তারপর তারপর তোমার হাতে এল অতুল সম্পদ।
রিস্ ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
.
৩২.
ওলগিয়াতা। বাড়ির জানালা দিয়ে ইভা পালাজজি বিশ্রী একটা দৃশ্য দেখতে পেল।
দোনাতেল্লা, সঙ্গে তিন ছেলে। ড্রাইভওয়ে ধরে এগিয়ে আসছে। সিমনেত্তা ওপরের ঘরে ঘুমোচ্ছ। ইভোর ভাগ্য ভালো। সে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল–দোনাতেল্লার সঙ্গে সে সর্বদা সুন্দর ব্যবহার করেছে। অথচ সেই দোনাতেল্লা তার : জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। সংসার ভাঙতে চাইছে।
ছেলেরা বাবাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেল।
তোমার বউ কোথায়? ওর সঙ্গে দেখা করব। ছেলেরা, এসো।
ইভো এখন একেবারে কুঁকড়ে গেছে। ভালোমানুষ বলে নিজের প্রতি আস্থা আছে তার। অনেক কষ্ট করে সে জীবনে উন্নতি করেছে। সামান্য ভুলে সে ওসব হারাতে চায় না। কিন্তু এজন্য তার অপছন্দের একটা কাজ করতে হবে।
ইভো বলল–আর পাঁচটা দিন সময় চাইছি। কথা দিচ্ছি। টাকা তোমাকে দেব।
.
হাউস অফ কমন্সে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক চলেছে। রক্ষণশীল দলের মতে, শ্রমিকদের ধর্মঘট দেশের অর্থনৈতিক ধ্বংসের কারণ। শ্রমিকশ্রেণীর ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নিতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তাই নিয়েই চলেছে বিতর্ক, কথাবার্তা।
স্যার অ্যালেক নিকলস বক্তৃতা মঞ্চে উঠে দাঁড়াল-শ্রমিকরাই দেশের বন্ধু। দেশকে মহান করে তুলেছে। ওরা মিল চালায়, ফ্যাক্টরির চাকা ঘোরায়। ওরা দেশের মেরুদণ্ড। কিন্তু জাতীয় জীবনে কখনও কখনও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। শ্রমিকদের প্রয়োজনে ত্যাগের পথে চলতে হবে।
বক্তৃতা শেষ হল। পেছনে কারা যেন হাততালি দিয়ে উঠল। এমন সময় এক কর্মচারী এসে বলল–স্যার অ্যালেক, তাড়াতাড়ি বাড়িতে যান। দুর্ঘটনা
অ্যালেক বাড়ি ফিরে এল। দেখল অচৈতন্য ভিভিয়ানকে অ্যাম্বুলেন্সে ভোলা হচ্ছে।
কী হয়েছে ডক্টর?
জানি না। একটা উড়ো ফোন পেয়ে এখানে এসে দেখি লেডি নিকলস বেডরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন। তার হাঁটু দুটো পেরেক দিয়ে মাটির সাথে আটকে দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখছি। তবে একটা কথা, উনি আর মাটিতে পা ফেলে জীবনে হাঁটতে পারবেন না।
অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে অ্যালেকও হাসপাতালে এল।
ভিভিয়ানের জ্ঞান ফিরে এল। সে জানাল, দুটো লোক, মুখোশে মুখ ঢাকা, তার পা দুটো ভেঙে দিয়েছে।
ভিভিয়ান মুখ ভার করে বলল–আমি আর হাঁটতে পারব না, নাচতে পারব না। অ্যালেক, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো।
নৈরাশ্য ও যন্ত্রণায় অ্যালেকের চোখ ফেটে জল এল। বিপদের মধ্যেও তার হৃদয়ে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। ভিভিয়ান আর অন্য পুরুষের সংসর্গ কামনা করবে না। সে স্বামীর কাছেই থাকবে। সে তার পঙ্গু স্ত্রীর যত্ন নিতে পারবে।
.
৩৩.
জুরিখ। ৪ঠা ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার।
জুরিখের ক্রিমিন্যাল পুলিশের হেডঅফিসে একটা ফোন এল।
চিফ ইন্সপেক্টর ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাংকে বলল–রফ কেসের সমস্যা সমাধান হয়ে । গেছে। অপরাধীর সন্ধান মিলেছে। তুমি এখনই বার্লিন এয়ারপোর্টে চলে যাও।
ম্যাক্স চলে গেল।
চিফ ইন্সপেক্টর ফোন তুলে দিলেন–হ্যালো মিসেস এলিজাবেথ রফ উইলিয়ামস, ভালো খবর আছে। আপনি এখন বডিগার্ড ছাড়াই চলাফেরা করতে পারবেন খুনীর সন্ধান মিলেছে।
–খুনি কে?
–ওয়ালথার গ্যাসনার।
.
পুলিশ বাড়িটা ঘিরে ফেলল।
পুলিশের গাড়ির সামনের সিটে দুজন ডিটেকটিভ, পেছনের সিটে মেজর ওয়েলম্যান ও ডিটেকটিভ ম্যাক্স।
–আমাদের সাবধানে এগোতে হবে। মেজর বলল। ওয়ালথার ওর বউকে আটকে রেখেছে।
–আর ওয়ালথার?
–তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তোমাকে তাই ডেকেছি।
কী ভাবে?
–তুমিই আমাদের জানিয়েছিলে ওয়ালথার এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছিল। অন্যান্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে ওর চেহারার বর্ণনা দেওয়া হল। ওরা বলল, ও আরও দুজন ডাক্তারের কাছে যায়, ছদ্মবেশে। মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজ নেয়। ও যে একজন মনোবরাগী, তা ও জানত। ইতিমধ্যে ওর বউ পুলিশে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। পুলিশ গিয়েছিল। অ্যানা বলেছিল, না, কিছু হয়নি। আজ সকালে ওদের ঝি ফোন করেছিল। বলল, ওয়ালথার গ্যাসনার নাকি ওর বউ অ্যানাকে ঘরে তালাবন্ধ করে ফেলে রেখেছে। তাদের বাচ্চাদের খুন করেছে। অ্যানা সোমবার ওই ঝিকে বলেছিল, তার স্বামী তাকে খুন করতে পারে।
সোমবার! এত দেরি করে মেয়েটা
–মেয়েটা কোনো ঝুট ঝামেলায় যেতে চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত ওর পুরুষবন্ধু ওকে বোঝায়, ও তাই আজ সকালে ফোন করেছে।
গ্যাসনার এস্টেটের প্রবেশ পথ থেকে কিছুটা দূরে পুলিশের গাড়ি দাঁড়াল।
ডিটেকটিভ দুজন গাড়ি থেকে নেমে এল। বলল–মেজর, লোকটা বাড়ির ভেতরেই আছে। জানালা বন্ধ।
পুলিশ তখন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। বর্ম পরে টেলিস্কোপ রইফেল আর টিয়ার গ্যাস নিয়ে তৈরি।
ছক অনুযায়ী কাজ শুরু হল।
মেজরের ইঙ্গিতে নীচের এবং ওপরের ঘরগুলোয় জানালায় টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ছোঁড়া হল। সামনের ও পেছনের দরজা ভাঙা হল।
ম্যাক্স ও মেজর ভেতরে ঢুকল। দুজন পুলিশ ডিটেকটিভ হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল ওয়ালথার গ্যাসনারের। পরনে ওর ঢিলে রাতপোশাক ও পায়জামা। কয়েক দিন দাড়ি কামানো হয়নি। মুখ শুকনো, চোখ ফোলা।
ওয়ালথার গ্যাসনারকে দেখে ম্যাক্স অবাক হল। কম্পিউটার যে ওয়ালথার গ্যাসনারের কথা বলেছিল, তার সঙ্গে এর মিল নেই। এ যেন মনে হয় নকল ওয়ালথার গ্যাসনার!
মেজর বলল–হের গ্যাসনার, আপনাকে আমরা গ্রেপ্তার করছি। আপনার স্ত্রী কোথায়?
–ও চলে গেছে। আমি
সেই মুহূর্তে ওপরের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক পুলিশ ডিটেকটিভ–পাওয়া গেছে! মিসেস অ্যানা গ্যাসনারকে পাওয়া গেছে! তালাবন্ধ ঘর থেকে তাকে পাওয়া গেছে।
কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল অ্যানা গ্যাসনার। শনের মতো চুল, মুখে সাদা দাগ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে, ও আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলেছে।
ওয়ালথার অসহায় দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে প্রাণহীন মনে হল।
অ্যানা চেঁচিয়ে বলল–আমার বাচ্চাদের তুমি মেরে ফেলেছ?
–ও কি ঠিক বলছে? মেজর ওয়ালথারকে প্রশ্ন করল।
ওয়ালথার ঘাড় নাড়ল–হ্যাঁ। এক নিমেষে সে যেন অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। পরাজয়ের ছায়া চোখের পাতায়। হ্যাঁ, ওরা আর বেঁচে নেই।
–ডেডবডি দুটো আমরা দেখতে চাই।
ওয়ালথারের গাল বেয়ে চোখের জল নেমে এল।
–কোথায় তাদের লাশ রেখেছ? মেজর ওয়েডম্যান আবার জানতে চাইল।
–ওরা সেন্ট পলস গির্জার কবরখানায় শুয়ে আছে। ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং এবার জবাব দিল, জন্ম মুহূর্তেই তাদের খুন করা হয়। পাঁচ বছর আগে।
.
৩৪.
জুরিখ। ৪ঠা ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার। রাত ৮টা।
হিমেল রাত। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। তুষার উড়ছে হাওয়ায়। পাউডারের মতো। চারপাশ অন্ধকার। কেবল রফ অ্যান্ড সন্সের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর আলোগুলো ম্লান হয়ে জ্বলছে।
রাত বাড়ছে। এলিজাবেথ অফিসে কাজ করছে। আর ভাবছে, জেনেভার মিটিং সেরে কখন তার স্বামী রিস্ উইলিয়ামস ফিরে আসবে। বিল্ডিং ফাঁকা। ওর মন চঞ্চল, কাজে মন দিতে পারছে না। মনে পড়ে যাচ্ছে ওয়ালথার গ্যাসনার আর অ্যানা রফ গ্যাসনারের কথা। লিজা প্রথম যখন ওয়ালথারকে দেখেছিল, সে ছিল সুন্দর সুদর্শন এক যুবক। পাগলের মতো বউকে ভালোবাসত। ভালোবাসত, নাকি ভনিতা করত! বিশ্বাসই হয় না। ওয়ালথার এমন ভয়ংকর নীচ জঘন্য কাজ করতে পারে। অ্যানার কথা ভেবে তার কষ্ট হয়। কিছুতেই ফোনে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ইচ্ছে হয়, এখুনি বার্লিনে ছুটে যায়।
ফোন বেজে উঠল। স্যার অ্যালেকের ফোন। লিজা খুশি।
-শুনলে ওয়ালথারের কাণ্ডকারখানার কথা?
–হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
–ঠিক বলেছ। ওয়ালথার নির্দোষ। ও নিরাপরাধ।
কিন্তু পুলিশ ওকে
–ওরা ভুল করেছে। স্যাম আর আমি আগেই ওয়ালথারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। যাকে আমরা খুঁজছি সে ওয়ালথার নয়।
–তার মানে? তোমরা কাকে খুঁজছিলে? লিজা ঘাবড়ে যায়।
–এত কথা ফোনে…তাছাড়া তোমাকে একা পাওয়া যায় না। তাই বলা হয়নি।
..গত কয়েক বছর ধরে এমন এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষতি করতে চাইছে, যে এর সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ আমেরিকার ফ্যাক্টরিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, পেটেন্ট চুরি হয়েছে। ভুল লেবেল বিষাক্ত ওষুধের শিশির গায়ে সাঁটা হয়েছে। আমি স্যামকে বলেছিলাম, একজন প্রাইভেট গোয়েন্দার ওপর এই কাজের দায়িত্ব দিতে। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আর কানাকানি করিনি।
এলিজাবেথের মনে হল, তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে। অ্যালেকের কণ্ঠস্বর ফোনে, কিন্তু মনে হচ্ছে তার স্বামী রিস্ উইলিয়ামস কথা বলছে।
অ্যালেক বলে চলেছে বাইরের এক ডিটেকটিভের হাতে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওরা রিপোর্ট দিয়েছিল। সেই রিপোর্ট নিয়ে স্যাম সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিল। স্যাম ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
–অ্যালেক, তুমি আর আমার বাবা ছাড়া এই গোপন রিপোর্টের কথা আর কেউ। জানতো কী?
না, তবে স্যামের ধারণা, কোম্পানির টপমহলের কেউ এসবের সঙ্গে যুক্ত?
টপ মহলের কেউ…
–আচ্ছা, আমার বাবা রিসকে কি এব্যাপারে কিছু বলেছিল? টেনে টেনে কথা বলছে। লিজা।
না, কেন একথা বলছ?
তাহলে? তাহলে কী করে রিস্ এই রিপোর্টের কথা জানতে পেরেছিল? নিশ্চয়ই ও ওটা চুরি করেছিল। একটা মাত্র কারণেই রিস শ্যামনিজে গিয়েছিল। তার বাবাকে সে হত্যা করতে চেয়েছিল।
ফোন রেখে দিল লিজা। আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরেছে। মাথা ঘুরছে, কে যেন তার কানে কানে বলল তোমার স্বামী রিস্ উইলিয়ামস্ খুনি। হ্যাঁ, সে খুন করেছে। খুনি সে!
মনে পড়ে গেল জীপ অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার আগের মুহূর্তগুলো। সে রিকে জানিয়েছিল, সার্ডিনিয়াতে যাচ্ছে সে।
আবার লিফট ক্রাশের ব্যাপারটা। মিটিং-এ রিস্ এল না। পরে এল। যখন মিস আরলিং আর সে ছাড়া অফিসে কেউ নেই। আবার খানিকবাদে চলে গেল। ওকি সত্যিই চলে গিয়েছিল? আর যাওয়ার আগে লিফটকে বিকল করে দিয়ে গিয়েছিল।
শরীর কাঁপছে লিজার। মনের মধ্যে চলেছে চাপানউতোর। রিস্ নয়, রিস খুনি হতে পারে না। সে টলমল পায়ে রিসের অফিসে ঢুকল। রিস্ যে নির্দোষ, সেই প্রমাণই সে খুঁজতে এসেছে।
.
আলো জ্বলে উঠল।
ডেস্কের-ওপরে এনগেজমেন্ট বুক। সেপ্টেম্বরে জীপ অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার সময় রিস নাকি নাইরোবিতে গিয়েছিল। কথাটা কি সত্যি? পাসপোর্ট দেখলেই জানা যাবে।
কিন্তু ডেস্কের নীচের ড্রয়ার তালা দেওয়া। তালা ভাঙবে? বিশ্বাসভঙ্গ করবে নিজের স্বামীর সঙ্গে? আর কি ফিরে পাবে সেই বিশ্বাস?
না, আর নয়। চিঠি খোলার ধাতবদণ্ড দিয়ে সে তালা ভেঙে ফেলল। ড্রয়ার টানল। একটা খাম রিস্ উইলিয়ামসের নামে। একটা মেয়েলি হাতে লেখা চিঠি। লিখেছে হেলেন রফ মারতেইল। লিখেছে?
ডার্লিং, ফোনে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের প্ল্যানগুলোর কথা মনে আছে তো। ওগুলোকে ঠিকঠাকভাবে করতে হবে। এজন্য আমাদের আবার দেখা হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
চিঠিটা আর পড়ল না এলিজাবেথ রফ। এবার সেই চুরি করা গোপন রিপোর্ট। বিস্ফারিত চোখে সে দেখছে।
বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা–মিস্টার স্যাম রফ–একান্ত গোপনীয়। কোনো কপি নেই।
মাথা ঘুরছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে লিজার। কল্পনায় খুনির মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। খুনি–তার স্বামী!
এমন সময় ফোন বেজে উঠল। আওয়াজ লক্ষ্য করে কোনোরকমে নিজের চেম্বারে এসে ঢুকল। ফোন তুলল।
–মিসেস উইলিয়ামস, লবির অ্যাটেনড্যান্টের খুশি-খুশি গলা। আপনি অফিসে আছেন । কিনা, তাই জানতে ফোন করলাম। মিস্টার উইলিয়ামস এখুনি ফিরে আসছেন।
কেন? আবার একটা খুনের মহড়া দেবে নাকি?
লিজের অবর্তমানে রফ অ্যান্ড সন্সের একমাত্র অধীশ্বর হবে রিস্ উইলিয়ামস।
লিজাকে এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। তার মুখ দেখলেই রিস্ বুঝতে পেরে যাবে। সে কি অভিনয় করবে? কিছুই হয়নি এমন ভান করবে? না-না, তা সম্ভব নয়।
সে পারবে না। তাকে পালাতেই হবে। কিন্তু কোথায়? যেখান থেকে রিস্ তাকে খুঁজে । পাবে না।
অন্ধ আতঙ্কে লিজা তখন হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হয়ে গেছে। দ্রুত হাতে পার্স আর কোটটা তুলে নিল, পাসপোর্টটাও নিতে ভুলল না।
প্রাইভেট লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল লিজ। ইনডিকেটারের দিকে তাকাল–লিফট উঠে আসছে–আটতলা নয়-তলা দশতলা–
এলিজাবেথ রফ উইলিয়ামস প্রাণের ভয়ে দ্রুত সিঁড়ির পথ ধরল।
.
৩৫.
সিভিটাভেশিয়া আর সার্ডিনিয়ার মাঝে খাঁড়ি। ফেরিবোটে করে খাঁড়ি পার হতে হয়। শুধু মানুষ নয়, মোটর গাড়িও ভোলা হয় বোটে।, লিজা ভাড়া করা একটা গাড়িতে এসেছে। প্লেনে ওঠেনি। তাহলে রেকর্ড থাকত। বোটে ওসবের বালাই নেই। সার্ডিনিয়ায় অনেকেই ছুটি কাটাতে যাচ্ছে।
সে জানে, কেউ তাকে অনুসরণ করেনি। তবুও আতঙ্কিত মন ভরসা পাচ্ছে না। রিস, উইলিয়ামস সব কিছু করতে পারে। লিজাকে হাতে পেলে, সে আর স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কারণ স্যাম রফের খুনের একমাত্র সাক্ষী ওই লিজা।
ছোটা একটা ভাড়া করা গাড়িতে চড়ে ইতালীগামী অটোরুটে গাড়ি থামিয়ে বুথ থেকে সে অ্যালেককে ফোন করল। পাওয়া গেল না।
–ঠিক আছে, অ্যালেককে জানিয়ে দেবেন, আমি সার্ডিনিয়াতে যাচ্ছি।
এবার ডিটেকটিভ ম্যাক্স। সেও নেই।
-ঠিক আছে, ম্যাক্স এলে তাকে বলে দেবেন আমি সার্ডিনিয়ার যাচ্ছি।
সার্ডিনিয়া ভিলায় সে একা থাকবে। অবশ্য, পুলিশ তার পাহারায় থাকবে, সে জানে।
ফেরিঘোট ওলবিয়ায় এসে ভিড়ল। সেখানে পুলিশ ডিটেকটিভ ব্রুনো ক্যামপানা লিজার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ব্রুনো বলল–আপনি না আসা পর্যন্ত আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সুইস পুলিশ জানিয়েছে, আপনি আসতে পারেন। তাই প্লেন ও ফেরিবোটের ওপর আমরা নজর রেখেছিলাম।
লিজা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ওই বুদ্ধিমান বিচক্ষণ পুলিশ ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং এর। তাহলে সে খবর পেয়েছে।
ড্রাইভারের আসনে বসল ডিটেকটিভ ব্রুনো। পাশে লিজা।
ওলবিয়ার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি কস্টা স্পেরালদার দিকে ছুটছিল। লিজা তাকাল বাইরের দিকে, রিসের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানকার প্রতিটি জায়গার সাথে।
আমার স্বামীর কোনো খবর?
–ও এখন প্রাণ নিয়ে ছুটছে। তবে বেশি দূর যেতে পারবে না। হয়তো কাল সকালের মধ্যেই ওকে অ্যারেস্ট করা হবে।
এ খবর এলিজাবেথকে যন্ত্রণাদদ্ধ করে তুলল। রিসূ, রিসূকে ও ভালোবাসে। তার স্বামী রিস্ এখন পালাচ্ছে। তার পেছনে এখন ধাওয়া করেছে মানুষ শিকারীরা। পলাতক পশুর মতো রিস্ এখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত!
ব্রুনো বলল–কী ভাবছেন? সিরোক্কো বইবে। আমরাও ওই ভেবে ভয় পাচ্ছি, আজ রাতে আমরা সবাই ব্যস্ত থাকব।
সিরোক্কোর মরু বাতাসের ঝড় এলে মানুষ ও পশু পাগল হয়ে যায়। এই সময় অপরাধের ঘটনা বেড়ে যায়। এইসব ক্ষেত্রে বিচারকরা অপরাধীর শাস্তি কিছুটা লাঘব করেন।
গাড়ি এসে থামল। অন্ধকার ভিলা।
ডিটেকটিভ ব্রুনো বলল–মিসেস উইলিয়ামস। এক হাতে তার পিস্তল, অন্য হাতে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলছে। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালল। বিপদের ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। বলা যায় না, শত্রু এখানে আগে থেকেই ঘাপটি মেরে বসে আছে। দাঁড়ান, আগে বাড়িটা ভালো করে দেখে নিই।
এক-একটা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখল বুনো। ক্লোজেট, আনাচে-কানাচে সর্বত্র। এমনকি জানালা দরজা বন্ধ কিনা তাও দেখে নিল। না, কেউ নেই।
নীচের তলায় ফিরে এল ডিটেকটিভ ব্রুনো–হেড অফিসে একটা ফোন করতে হবে। যদি কিছু মনে না করেন।
লিজা তাকে পড়ার ঘরে নিয়ে এল। ডিটেকটিভ ব্রুনো ফোন করল–ডিটেকটিভ ব্রুনো ক্যামপানা বলছি। আমরা এখন ভিলায়। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি বদলাও।
চেয়ারে বসে আছে এলিজাবেথ। অজানা আতঙ্কে স্নায়ু টানটান। সে জানে, কাল সকালে সে নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারবে না। খবর পাবে, রিসূকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, নতুবা গুলি করা হয়েছে। রিস্ সম্পর্কে তার মনে এখনও আস্থা আছে-রিস্ এসব করতে পারে না।
মিসেস উইলিয়ামস, ডিটেকটিভ ব্রুনো বলল, আমার বউ বলে, আমি খুব ভালো কফি তৈরি করতে পারি। আপনি বসুন, আমি কফি নিয়ে আসি।
ডিটেকটিভ ব্রুনো চলে যেতেই তাকে চিন্তারা এসে গ্রাস করল। অ্যালেকের কাছে যখন সে ফোন করেছিল, তখনও তার ধারণা ছিল, রিস্ নিরাপরাধ। রিস্ একাজ করতে পারে না। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। লিজের বাবাকে খুন করে তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে, আবার তাকে খুন করা, কোনো মানুষের পক্ষে… না-না, এ অসম্ভব।
ওহ যিশু, আর ভাবতে পারছি না!
কিন্তু না ভেবেও উপায় নেই। হয়তো পনেরো বছরের মেয়ে লিজাকে দেখার পর থেকেই রিস্ উইলিয়ামস রফ অ্যান্ড সন্সের সর্বেসর্বা হবার দুঃস্বপ্ন দেখে আসছিল হয়তো। তাই ঠিক করেছিল, স্যাম রফকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে বোকা মেয়েটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে। অবশ্য রিসের প্রতি লিজই প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিল। এটাই পরিতাপের বিষয়। হয়তো হেলেন রফ মারতেইল আর রিস্ উইলিয়ামসের মধ্যে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক থাকায় ওরা দুজনে মিলে ছকটা করেছিল।
ডিটেকটিভ ব্রুনো ক্যামপানা কফির কাপ এগিয়ে দিল–মিসেস উইলিয়ামস, কফিটা খান, ভালো লাগবে।
কফিতে চুমুক দিয়ে কেমন বিস্বাদ লাগল লিজার। সে ডিটেকটিভের দিকে তাকাল।
–এটু স্কচ মিশিয়ে দিয়েছি। ক্লান্তি দূর হবে। তারপর ডিটেকটিভ বলল–পেট্রল কার এল বলে। দুজন পুলিশ সারারাত বাড়িটা পাহারা দেবে। আমি নীচের তলার ঘরে থাকব। আপনি বেডরুমে চলে যান। ঘুমিয়ে নিন। তাজা লাগবে শরীর।
লিজের শরীরে এখন এক বিশ্রী অবসাদ। সে আর বসে থাকতে পারল না। বিছানায় শুয়ে পড়ল। আসলে ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল।
তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে লিজের সামনে সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল–অন্ধকার রাস্তা। পুলিশের গুলি। রিস মরতে বসেছে।
তাড়াতাড়ি চোখ খুলল। কেঁপে উঠছে শরীর। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। সে জেগে থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখের পাতার গুরুভার সে বইতে পারল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল।
.
৩৬.
একটা অদ্ভুত আর্তনাদে ঘুম ভেঙে গেল লিজার।
সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। অদ্ভুত তীব্র আর্তনাদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। জানালার বাইরে থেকে শব্দটা ভেসে আসছে।
সে টলতে টলতে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। আঃ, কী চমৎকার উঁদনি রাত। যেন শিল্পী দামিয়েরের আঁকা ছবি। শীতের হাওয়া বইছে। কালো ন্যাড়া গাছগুলোর পাতায় ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। দূরে এবং নীচে সমুদ্র, যেন তপ্ত কড়াইতে রাখা জল, ফুটছে।
আর্তনাদ–আবার–আবার।
আসল ব্যাপারটা এলিজাবেথ বুঝতে পারল। সাহারা মরুভূমি থেকে গরম মরু বাতাস তীব্র গতিতে পাথরের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তার ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে ওই শব্দ। যেন পাথর দুঃখের গান গাইছে, বিলাপ করছে। অথচ-অথচ তার কল্পনায় ভেসে উঠল–তার স্বামী রিস্ বুঝি হাহাকার করছে। সে কাঁদছে, সে সাহায্য প্রার্থনা করছে। শব্দটা সহ্য করতে পারল না লিজা। দু হাতে কান চাপা দিল। জানালার কাছ থেকে সরে এল। তবু সে শুনতে পাচ্ছে সেই বিলাপ ধ্বনি।
লিজ টলছে। দুর্বল লাগছে। বেডরুম থেকে বেরিয়ে এল–জোরে ডাকল, ডিটেকটিভ ক্যামপনা।
সাড়া নেই।
এ ঘর থেকে ও ঘর–আসবাবপত্রে হাত রেখে রেখে মাতালের মতো সে পা ফেলছে।
নিশ্চয়ই বাইরে পুলিশ পেট্রলকারের পুলিশদের সঙ্গে গল্পে মেতে আছে ব্রুনো। না, কেউ নেই। কেবল নিঃসীম অন্ধকার, আর হাওয়ার গর্জন।
সে ভাবল, থানায় ফোন করি? কী হয়েছে জানতে হবে।
না, ডায়াল টোন নেই, কানেকশান ছিন্ন। ঠিক তখনই বাড়ির সবকটা আলো নিভে গেল।
.
৩৭.
লন্ডন।
ওয়েস্ট মিনিস্টার হসপিটাল। এখানেই মিসেস ভিভিয়ান নিকলসের হাঁটুর অপারেশন করা হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে তার জ্ঞান ফিরে এল। আট ঘণ্টা ধরে অপারেশন চলেছে। কিন্তু ডাক্তাররা সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। ভিভিয়ান কোনো দিন দুপায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারবে না। সে এখন অ্যালেককে খুঁজছে। তাকে তার খুব প্রয়োজন। বিড়বিড় করে বলল, অ্যালেক তুমি কোথায়? একবার আমার পাশে বসো, বলো, আগের মতো তুমি আমাকে ভালোবাসবে কিনা?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্যার অ্যালেক নিকলসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল, কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না।
.
জুরিখ। ক্রিমিনাল পুলিশ দপ্তরে ইন্টারপোল রিপোর্ট পাঠিয়েছে
যে র’ ফিল্ম স্টক থেকে ব্লুফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, রফ অ্যান্ড সন্সের একজন প্রাক্তন এজেন্ট সেই স্টক থেকেই র ফিল্ম কিনেছিল। করোনারি থ্রম্বসিসে তিন দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে তার মৃত্যু হয়েছে। তাই ফিল্ম কেনার ব্যাপারে আর কোনো খবর জানা যাবে না।
.
বার্লিন।
শহরের একটি সুন্দর মফঃস্বল অঞ্চল। ওয়ালথার গ্যাসনার একটি প্রাইভেট স্যানাটোরিয়ামের ওয়েটিং রুমে বসে আছে। বসে বসে দশ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছে সে এখানে। তার স্ত্রী অ্যানা ভর্তি আছে। মনোররাগের চিকিৎসা হচ্ছে তার।
ওয়ালথারকে কিছু খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু সে কারো কথা কানে নিচ্ছে না। সে তার অ্যানা, তার ভালোবাসার প্রতীক্ষায় বসে আছে। তার জন্য সে অনন্ত প্রহর অপেক্ষা করতে পারে।
.
ইতালি। ওলজিয়াটায় সিমনো ফোন ধরল। মহিলাকণ্ঠ শোনা গেল।
মিসেস পালাজজি, আমি দোনাতো স্পোলিনি। অবশ্য আমাদের আগে কখনও দেখা হয়নি। আমাদের দুজনের অনেক মিল। আসুন না, কাল পিয়াজা দেল পোপোলোতে। বেলা একটায়। দুজনে বসে লাঞ্চ করা যাবে।
–তোমায় তো চিনি না, কী করে চিনব?
–আমার তিন ছেলে আমার সঙ্গে থাকবে।
.
ফ্রান্স।
লা ভেসিনেৎ-এর ভিলা।
হেলেন রফ মারতেইল চিঠি পড়ছে। স্বামীর। ড্রাইং রুমে বসে।
–আমি অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, শার্ল মারতেইল লিখেছে, আমাদের আর দেখা হবে না। সন্ধান করে লাভ নেই।
চিঠিটা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলে দিল হেলেন–শার্ল, তোমাকে আমি ঠিক খুঁজে বের করবই।
.
রোম।
এখন পুলিশ ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে। সার্ডিনিয়ার পুলিশ স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যর্থ প্রয়াস। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে সে বলল–দেখো, একজনের জীবন-মরণের সমস্যা। সার্ডিনিয়াতে আমাকে এখুনি পৌঁছোতে হবে। বিশ্বাস করো।
–আমি বুঝেছি সিনর। কিন্তু কোনো সাহায্য আপনাকে করতে পারছি না।
ম্যাক্স জানে, ঝড়ের জন্য প্লেন ছাড়ছে না। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন। সিরোক্কো থামলে তবেই আবার যাতায়াত ব্যবস্থা শুরু হবে।
কখন প্লেন ছাড়বে?
তা কম করে বারো ঘণ্টার অপেক্ষা।
-বারো ঘণ্টা! হয়তো এলিজাবেথকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না।
.
৩৮.
শত্রুরা অন্ধকারকে পছন্দ করে। আঘাত হানার জন্য অদৃশ্য হায়নার মতো অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে।
এলিজাবেথের বুঝতে আর বাকি রইল না, পুলিশ ডিটেকটিভ ব্রুনো ক্যামপানা তাকে খুন করার উদ্দেশ্যেই এখানে এসে উঠেছে।
ও নিশ্চয়ই রিস্-এর দলের লোক।
সুইস ডিটেকটিভ ম্যাক্সের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল–কেউ একা জীপ অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটায়নি। সে এমন একজন, যার এই দ্বীপের নাড়ি নক্ষত্র জানা, বাইরে থেকে হত্যাকারীকে সে সাহায্য করেছে।
ক্যামপানা দারুণ কৌশল করেছিল।
আপনার জন্য আমরা চিন্তিত, প্রতিটি নৌকোয় নজর রেখেছি, এয়ারপোর্টে লোক রেখেছি।
রিস্ অভ্রান্তভাবে বুঝতে পেরেছে, লিজা সার্ডিনিয়ার ভিলাতে এসেই উঠবে।
প্রথম থেকেই ক্যামপানা তাকে ভুল বুঝিয়েছে। থানায় না নিয়ে গিয়ে ভিলায় এনে তুলেছে। নিশ্চয়ই ও পুলিশ হেডকোয়াটার্সে ফোন করেনি, ফোন করেছিল রিসূকে। ওকে জানিয়েছে, আমরা ভিলায় পৌঁছে গেছি।
লিজা বুঝতে পারছে, তার এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু শরীরে সে বল পাচ্ছে না। হাত-পা যেন ভারী বোঝা, চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। নিশ্চয়ই ডিটেকটিভ ব্রুনো কফির সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছে।
সে রান্নাঘরে এল। জলের সাথে ভিনিগার মেশাল। খেয়ে নিল। বমি করল। তবুও স্নায়ুগুলো দুর্বল, তার মস্তিষ্ক ঠিক মতো কাজ করছে না।
সে নিজেই নিজের মনকে বোঝাল-লিজা, তুমি এভাবে মরতে পারো না। তুমি লড়বে। ওরা তোমায় খুন করতে আসছে। রিস, এসো। আমায় খুন করো, এসো।
বাইরে তখন মরু বাতাসের দাপাদাপি। কখনও বাতাসে ভাসছে আর্তনাদ, কখনও বিদ্রূপ, আবার কখনও সাবধান ধ্বনি।
লিজা কি পালিয়ে যাবে? না কি এখানে থাকবে?
লিজা জানে, খুনের ব্যাপারটাকে রিস দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেবে।
সে তাকাল স্যামুয়েল রফের পোটেট্রের দিকে, তার পূর্বপুরুষ।
–এলিজাবেথ, ওকে আটকাও।
কে বলল? স্যামুয়েল?
সম্ভব নয়। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
লিজা চোখ আর খুলে রাখতে পারছে না। ভীষণ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার।
আমি রিকে জিততে দেব না। এমনভাবে ব্যাপারটাকে আমি সাজাব, সবাই বুঝবে এটা স্রেফ খুন।
ছুঁড়ে মারল টেবিল ল্যাম্প আয়না লক্ষ্য করে।
কোনোটাই গোটা রইল না।
চেয়ারটা ছুঁড়ে দেওয়ালে এমনভাবে মারল, সেটা গেল ভেঙে।
বুককেসের বইগুলো টেনে নামাল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। কত বইয়ের পাতা ছিঁড়ল। সব ঘরময় ছড়িয়ে গেল। পুলিশ এসব দেখবে, আর সন্দেহ জাগবে
হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া ঢুকল। কাগজগুলো জানালার বাইরে উড়ে গেল।
অর্থাৎ?
লিজা এখানে একাকি নয় আর।
.
রোম।
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট। একটা প্লেনকে নামতে দেখে ম্যাক্স ছুটে গেল–
–আমাকে সার্ডিনিয়ায় পৌঁছে দেবে?
ব্যাপার কী বলুন তো? একজনকে এইমাত্র ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসছি। ঝড়ের যা দাপট!
–আমায় পৌঁছে দেবে।
–দিতে পারি। চার্জ বেশি লাগবে। তিনগুণ।
ম্যাক্স রাজি। হেলিকপ্টারে উঠে বসল সে।
–পাইলট, একটু আগে তুমি বললে না, একজনকে পৌঁছে দিয়ে এলে সার্ডিনিয়াতে, তার নামটা বলতে পারো?
উইলিয়ামস।
.
এই মুহূর্তে অন্ধকারই এলিজাবেথের উপকারী বন্ধু। সে নিজেকে অন্ধকারের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে, আততায়ীকে আড়াল করতে পারছে। লুকোতে হবে। কোথায়? সিঁড়ির মাথায় ছুটে গেল। কী যেন লাফিয়ে উঠল। আর্ত চিৎকার করে উঠল লিজা। না, কেউ নয়। জানালার বাইরে গাছের ডালে হাওয়া ঝাপটা দিচ্ছে। তারই ছায়া। কিন্তু তার আর্তচিৎকার নিশ্চয়ই। নীচে রিসের কানে চলে গেছে।
রিসকে বাধা দাও। কিন্তু কী ভাবে? তার পূর্বপুরুষ স্যামুয়েল রফ হলে কী করত?
ওপর তলার ঘরের দরজাগুলো সব বন্ধ করে দিল লিজা।
ক্র্যাকোর ইন হুদি বস্তির কাঠের গেট। নিজেকে বাঁচাতে সে রাতের প্রহরী আরামকে খুন করেছে। তারপর পালিয়েছে। কারো হাতে যেন ধরা পড়তে না হয়।
এলিজাবেথ সেই স্যামুয়েলের উত্তরাধিকারী, রক্তে তারই বংশের ধারা-ব্লাডলাইন! সে যেন এই মুহূর্তে স্যামুয়েলে রূপান্তরিত হয়েছে।
ফ্লাশলাইটের আলোকে যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে? কে? নিশ্চয়ই রিস্।
লিজা টাওয়ার রুমে ঢুকে পড়ল। তালা বন্ধ করে দিল। এবার দরজা ভাঙার পালা। পুলিশ দেখবে। সব দেখে শুনে বুদ্ধিমান পুলিশ ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং বলবে, এটা মার্ডার, অ্যাক্সিডেন্ট নয়। লিজা দরজায় ব্যারিকেড তৈরি করতে লেগে গেল। টেবিল, চেয়ার, আর্মচেয়ার, তার ওপরে আবার টেবিল–সব দরজার সঙ্গে সাঁটিয়ে দিল।
দরজা ভাঙার শব্দনীচের তলায়। ফ্রেঞ্জ ডোরের বাইরে পাগলা হাওয়ার শোকার্ত আর্তনাদ। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো গোলমাল হয়েছে। রিস্ দরজা ভাঙছে? সাহস তো বড়ো কম নয়। এখানে এমন কিছু নেই, যা দিয়ে নিজেকে বাঁচাবে। অস্ত্রও নেই। অতএব অন্ধকারই ভরসা।
কিন্তু রিস্ এত দেরি করছে কেন? এখনও আসছে না কেন? যদি মৃতদেহ রিস্ অন্যত্র না সরায়, পুলিশ তো দেখবে, ফার্নিচার, আয়না, দরজা সব ভাঙা। পুলিশের নিশ্চয়ই সন্দেহ হবে। তাই তো?
যদি রিসের জায়গায় সে নিজে হত তাহলে? পুলিশ সন্দেহ করবে না, অথচ
হ্যাঁ, উপায় একটা আছে, ব্যাপারটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার নাকে ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে–এল।
.
৩৯.
হেলিকপ্টারে তখন ম্যাক্স হরনাং। সার্ডিনিয়ার উপকূলে চোখে পড়ল। লাল আভা। ধুলোর ঘূর্ণি। মোটর ব্লেডের বিকট গর্জন। তাকে ছাপিয়ে শোনা গেল পাইলটের চিৎকার।
ঝড়ের অবস্থা আরও খারাপ। হেলিকপ্টার নামানো যাবে কিনা সন্দেহ।
নামতেই হবে। পোরটো সালভোর দিকে চলো।
–পাহাড় চুড়োর ওপর।
–হ্যাঁ। কেন, পারবে না?
–সম্ভাবনা শতকরা সত্তর বনাম তিরিশ।
–বেশি কোন্ দিকে?
–আমাদের বিপক্ষে।
.
ধোঁয়া বের হচ্ছে, দরজার নীচ থেকে। বাইরে ঝড়ের গর্জনের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে আগুনের নৃত্য। সব বুঝেছে এলিজাবেথ, তবে দেরিতে। সে এই ঘরে বন্দি। দরজা জানালা আসবাব ভেঙে আর কী লাভ! সবই তো আগুনের গর্ভে যাবে! এমিল জেপলি ও তার ল্যাবোরেটরি যে ভাবে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, এলিজাবেথেরও সেই হাল হবে। রিসকে দোষারোপ করা যাবে না। সে বলবে, ওই সময় অন্য কোথাও ছিল। এলিজাবেথ হেরে যাচ্ছে। রিসেরই জয় হবে।
ঘরের ভেতরে ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকাচ্ছে। হলুদ ও দুর্গন্ধ যুক্ত ধোঁয়া। দম বেরিয়ে যাচ্ছে। যেন। আগুন স্পর্শ করল দরজার কাঠ।
সে ব্যালকনিতে এল। বুক ভরে টাটকা বাতাস নিল। বিল্ডিং-এর এক পাশে মহাশূন্যে দ্বীপের মতো ছোট্ট এই ব্যালকনি। এখান থেকে পালাবে কী করে?
যদি
ঝট করে সে ঘরে ঢুকে গেল। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এল। উঠে দাঁড়াল। ছাদটা ধরতে হবে। ব্যাপারটা বিপজ্জনক–চেষ্টা করছে সে ।
ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছে পর্দা, বই, কার্পেট, আসবাব-এ।
শ্লেটের ছাদ। অবশেষে হাত ঠেকাতে পারল সে। নিজেকে টেনে তুলল সে ছাদের ওপরে। ঠিক যেন, ইহুদি বস্তির দেওয়াল টপকাচ্ছে স্যামুয়েল, নিজের প্রাণ রক্ষা করার তাগিদে। লিজা একটু একটু করে ওপরে উঠছে। শ্লেটের ছাদ। একটু হাত স্লিপ করলে আর বাঁচার কোনো পথ নেই, নীচে অতল আঁধার। ।
সে তাকাল ব্যালকনির দিকে। আগুন সেখানেও ছুটে এসেছে।
অতিথিদের একটা ব্যালকনি তখনও আগুনের ছোঁয়া পায়নি। সেখানে যেতে পারবে কি লিজা? ঢালু ছাদ, আলগা শ্লেট, তার ওপর প্রচণ্ড ঝড়। পা ফসকে গেলে মৃত্যু অনিবার্য।
ঠিক এই সময় অশরীরির মতো আবির্ভূত হল স্যার অ্যালেক নিকলস।
সে চিৎকার করে বলল–ওল্ড গার্ল, খুব সাবধানে! নামো, ধীরে ধীরে পা ফেলল। খুব সাবধান!
লিজা যেন বুকে বল ফিরে পেল। সে একটা একটা শ্লেট ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। অ্যালেক তাকে ভরসা দিচ্ছে।
হঠাৎ একটা শ্লেট আলগা হয়ে গেল।
ধরো! অ্যালেক চেঁচিয়ে উঠল।
লিজা ছাদের প্রান্তভাগে চলে এসেছে। নীচে ব্যালকনি, তাকে এখন লাফাতে হবে। যদি পা ফসকায়…।
নীচের দিকে তাকাবে না। অ্যালেকের সাবধান বাণী। চোখ বুজে লাফ দাও। আমি তোমাকে ধরে নেব।
লিজা শূন্যে লাফ দিল। হাত বাড়িয়ে অ্যালেক তাকে ধরে নিল।
ওঃ কী শান্তি! লিজা চোখ বুজল।
–ওয়েলডান। অ্যালেক বলল।
পরক্ষণেই পিস্তলের নল লিজার রগের ওপর ধরল।
.
৪০.
ঝড়ের তাণ্ডবকে উপেক্ষা করে হেলিকপ্টার গাছের মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে। দূরে পোরটো সালভোর পাহাড়ের চূড়া।
–ওই তো ভিলা দেখা যাচ্ছে! পরক্ষণেই ম্যাক্স আঁতকে উঠল, ভিলা আগুনে পুড়ছে!
.
ঝড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেল এলিজাবেথ। কিন্তু অ্যালেকের কানে যায়নি। তার যন্ত্রণাকীর্ণ দুটি চোখ তখনও এলিজাবেথের দিকে নিবদ্ধ।
–এসবের জন্য ভিভিয়ানই দায়ী। অ্যালেক অনুযোগের সুরে বলল, ওর চাপে পড়েই আমাকে এসব করতে হচ্ছে। ওরা যেন আগুনের মধ্যে তোমার লাশ দেখতে পায়। আমার কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।
অ্যালেকের কথা লিজার কানে ঢুকছে না। সে তখন রিসের কথা ভাবছে। তাহলে রিস্ নয়, অ্যালেকই খুনি। তার বাবার হত্যকারী, দুবার তাকে খুন করার চেষ্টা চালিয়েছিল।
গোপন রিপোর্ট চুরি করে রিসের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
হেলিকপ্টার এখন গাছের আড়ালে।
–এলিজাবেথ চোখ বন্ধ করো। অ্যালেকের আদেশ।
না।
হঠাৎ রিস উইলিয়ামসের কথা শোনা গেল–অ্যালেক, পিস্তল নামাও।
নীচে লনের ওপরে আগুনের আভায় দেখা গেল রিস্ উইলিয়ামস, চিফ অফ পুলিশ লুইজি ফেরারো, ছজন পুলিশ অফিসার, প্রত্যেকের হাতে রাইফেল।
রিস্ আবার চেঁচিয়ে উঠল–অ্যালেক, তোমার খেল খতম। ওকে ছেড়ে দাও।
ডিটেকটিভের হাতে টেলিস্কোপিক রাইফেল–এখন গুলি চালালেই মিসেস উইলিয়ামসের বিপদ হতে পারে।
–সার যাও! রিস্ বিড় বিড় করে প্রার্থনা করছিল।
এইসময় ম্যাক্স হরনাং ছুটে এল। ওপরের ব্যালকনির দিকে তাকাল। ওদের দুজনকে দেখে থমকে দাঁড়াল। রিস্ বলল–ম্যাক্স, দেরিতে হলেও তোমার পাঠানো খবর আমি পেয়েছিলাম।
প্রচণ্ড ঝড়ে আগুনের শিখা নেচে নেচে উঠছে। সব পুড়ছে, ঠিক যেন ইনফারনোর পাহাড়! বীভৎস জ্বলন্ত নরক!
লিজা তাকাল অ্যালেকের মুখের দিকে। বন্ধুবেশি শয়তান। স্থির জ্বলন্ত দুটি চোখ।
অ্যালেক ব্যালকনির দিকে সরে গেল।
টেলিস্কোপক রাইফেল এই ক্ষণটির প্রতীক্ষায় ছিল। দেখা গেল টলমল করতে করতে অ্যালেক জ্বলন্ত বাড়ির ভেতর ঢুকছে।
ছুটে এসেছে রিস্। সে পাঁজাকোলা করে লিজাকে তুলে নিয়ে এল। নীচে লনের ওপর শুইয়ে দিল।
রিস বলল–তোমায় আমি ভালোবাসি, ডার্লিং।
তার চোখে ভালোবাসা ও যন্ত্রণার ছবি।
লিজা যেন বোবা বনে গেছে। এ সে কী ভুল করতে চলেছিল! এই ভালো মানুষটাকে সে খুনি বলে সন্দেহ করেছিল? ওঃ ভগবান, লিজা আজীবন এর শোধ দেবে। কিন্তু এখন তার দেহ অবসন্ন। কিছু ভাবতে চাইছে না মন। একবারের জন্য লিজার মনে হল, যেন অন্য কোথাও অন্য কারো ভাগ্যে এসব ঘটনা ঘটেছে।
রিসের বলিষ্ঠ দুটি হাতে লিজা আবদ্ধ। এটাই তো আকাঙ্ক্ষিত শান্তি! তবে আর কী চাই?
.
অবশেষে
এ যেন নরকের জ্বলন্ত একটা কোণ! ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা স্পর্শ করল স্যার অ্যালেক নিকলসের মাথার চুল। তার মনে হল, এ অগ্নি শিখার হুংকার নয়, ভিভিয়ান গান গাইছে, তাকে কাছে ডাকছে।
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে তার দৃষ্টি গেল বিছানায়, ভিভিয়ান সেখানে শুয়ে আছে, নগ্ন, গলায় লাল রঙের ফিতে, ঠিক যেন সোহাগের প্রথম রজনী।
ভিভিয়ান বলছে–অ্যালেক, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।
অ্যালেক অবিশ্বাস করতে পারে না। অনেক পুরুষের সঙ্গে ভিভিয়ান অনেক কিছু করেছে। তার জন্য সে শাস্তি পেয়েছে। তবে সরাসরি নয়। অ্যালেক বদলা নিয়েছে অন্য মেয়েকে ওপর। পর্নো ফিল্মের অভিনেত্রীদের ওপর, ভিভিয়ানের পাপের ফল ওরা ভোগ করে। আরও কত ভয়ংকর কাজ করেছে অ্যালেক।
ভিভিয়ান বলছে–অ্যালেক, তুমিই আমার একমাত্র ভালোবাসা।
অ্যালেক একথা জানে।
উলঙ্গ ভিভিয়ান এখন অ্যালেককে নিজের দিকে আকর্ষণ করছে। তারা পরস্পরে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছে। অ্যালেকের পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করেছে ভিভিয়ানের গোপন গভীর ভিভিয়ান যৌনতৃপ্তি লাভ করেছে এবং অনাবিল আনন্দ। ঠিক যেন যন্ত্রণাময়। ভিভিয়ারে শরীরের উত্তাপে অ্যালেক পুড়ছে। ভিভিয়ানের গলায় বাঁধা লাল রিবন, আগুনের জির হয়ে তাকে চুম্বন দিচ্ছে। ঠিক সেই ক্ষণে একটা জ্বলন্ত বিম এসে পড়ল অ্যালেকের ওপর জীবন্ত পুড়ছে সে।
আবেশ ও উন্মাদনার চরম মুহূর্তে অন্যদের মতো অ্যালেকেরও মৃত্যু হল।