রেজ অফ অ্যাঞ্জেল (জলপরীর আর্তনাদ) – সিডনি সেলডন
ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন
নিউইয়র্ক : ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯।
আজ থেকে প্রায় দু-হাজার বছর আগের কথা। সে সময় রোমে একধরনের নিষ্ঠুর প্রাণসংহারী খেলা চলতো বিভিন্ন সার্কাস প্রতিষ্ঠানে। এই খেলা হতো মনুষ্যরূপী অসহায় শিকারদের সঙ্গে ক্ষুধার্ত নেকড়ে বা সিংহদের। শিকারীরা অত্যন্ত সতর্কভাবে শিকারের ওপর নজর রাখত। তারপর ধীর অথচ স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে যেত এবং ঝড়ের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো নিরীহ শিকারদের ওপর। মুহূর্তের মধ্যে, নির্মমভাবে তাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতো। এইভাবে অনুষ্ঠিত হত মল্লভূমির হত্যা পর্ব।
কিন্তু মানুষ বিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেছে। সে এখন আগের তুলনায় অনেক সুসভ্য ও আধুনিক মনস্ক হয়েছে। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অতীতের সেই প্রাণসংহারী খেলার গতি-প্রকৃতি পাল্টেছে। শিকার ও শিকারীর চেহারার মধ্যে এসেছে পরিবর্তন। অতীতের মল্লভূমির একচ্ছত্র নায়ক সুয়েতোমিয়াসের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আদালতের স্টেনোগ্রাফার, যার কাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ নথীভুক্ত করা।
সুদুর অতীতের রোমের সেই মল্লভূমির উদ্ভব ঘটেছে একালের ম্যানহাটানের ফৌজদারী আদালতের ষোলো নম্বর এজলাসে। এখানে এসেছেন বিভিন্ন সংবাদপত্রের ডজন খানেক সাংবাদিক ও বেশ কিছু দর্শনার্থীরা। এঁরা সকাল সাতটা থেকে এজলাসের বাইরে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছিলেন–যাতে এজলাসের ভেতরে বসতে পারেন এবং খুনের মামলার চাঞ্চল্যকর বিবরণ পরিষ্কারভাবে জানতে পারেন। দৈনিক পত্রিকার শিরোনামে এই খুনের ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনাটি সব মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে।
এই প্রাণসংহারী খেলায় যাকে শিকার হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে তিনি বছর বত্রিশের এক যুবক। নাম মাইকেল মোরেটি। মোরেটি শান্ত স্বভাবের, ভদ্র, মার্জিত চেহারার ব্যক্তি। তার মুখশ্রী সুন্দর হলেও এক ধরনের বন্যতা ও হিংস্রতার ছাপ সেই মুখে স্পষ্ট। মাইকেলের মাথায় একরাশ কালো চুল। পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তার দুচোখের তারায় গভীর দৃষ্টি। তার পরনে হালকা নীল রঙের শার্টের ওপর ধূসর রঙের স্যুট। গলায় নীল রঙের রেশমী টাই বাঁধা। আর পায়ে পালিশ করা ঝকঝকে চামড়ার জুতো। মাইকেল মোরেটি শান্তভাবে : বিবাদীর টেবিলে বসে আছেন। তার দুচোখে চঞ্চলতা ও উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তিনি এজলাসের চারদিকে বার বার দৃষ্টিপাত করছেন।
এই খেলায় আরেক চরিত্র হলেন রবার্ট ডি সিলভা। তিনি মাইকেল মোরেটির প্রতিপক্ষ। অর্থাৎ শিকারী সিংহের ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন। এই আদালতে তিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে এসেছেন। তিনি পেশায় নিউইয়র্ক কাউন্ট্রির দুদে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি। সারা জীবন তিনি কাজের পেছনে ছুটে বেড়িয়েছেন। উচ্চতায় তিনি যদিও খুব বেশি নন তবে তার দৈহিক গঠনশৈলী খুবই আকর্ষণীয়। ডি সিলভা মুষ্টিযুদ্ধে পারদর্শী। তিনি যৌবনে একাধিক মুষ্টিযুদ্ধে প্রতিযোগী হিসাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মুখের ক্ষত চিহ্নগুলি এখনও তার প্রমাণ স্বরূপ বিরাজ করছে।
রবার্ট ডি সিলভা একজন উচ্চাকাঙ্খী মানুষ। যেকোনো ভাবে উচ্চাকাঙ্খ পূরণ করতে তিনি বদ্ধ পরিকর। তিনি আজ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, সেখানে আসতে হলে টাকা। বা খুঁটির জোরের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তিনি এ দুটোকে সাহায্যের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেননি। সকলের ধারণা ডি সিলভা অসহায় জনগণের সেবায় ব্রতী হয়েছেন। যে কোনো কাজে জনগণ তাকে পাশে পাবার আশা করেন। তাই তিনি অনায়াসে উন্নতির শিখরে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু মানুষের ধারণা ছিল ভুল। ওটা ছিল ডি সিলভার বাইরের মুখোশ। এই ছদ্মবেশের আড়ালে তিনি ছিলেন এক ভয়ংকর নিপুণ যোদ্ধা, ক্ষমা করা বা ভুলে যাওয়া কথাগুলি তার অভিধানের পাতা থেকে মুছে গেছে।
সাধারণত তিনি ছোটো খাটো মামলায় ফৌজদারী আদলতে আসেন না। মামলায় সওয়াল করার মতো তার অধীনে প্রচুর কর্মচারী আছেন। তাদের কাউকে কিংবা ইচ্ছে করলে সিনিয়ার সহকারীদের যে কাউকে পাঠাতে পারতেন। এটা মাইকেল মোরেটির মামলা। এ এক অসাধারণ জটিল মামলা, তাই তিনি নিজেই এই মামলার তদারকির দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি নিজেই এই মামলায় সওয়াল করবেন বলে স্থির করেছেন।
মাইকেল মোরেটির কেসটি নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হয়েছে। তার সম্পর্কে দেশের সবকটি দৈনিক সংবাদপত্রে নানারকম চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। নিউইয়র্কের পূর্বাঞ্চলে পাঁচটি কুখ্যাত মাফিয়া পরিবারের বসতি। সেখানকার সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয় ওইসব মাফিয়াদের অঙ্গুলি হেলনে। এদের মধ্যে একটি হল গ্র্যানেলি। এই দলটির বিশাল প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। এই দলে কর্মীর সংখ্যাও অনেক। গ্র্যানেলির ডন বা নেতা হলেন আন্তোনিও গ্র্যানেলি। ইনি হলেন মাইকেল মোরেটির শ্বশুর। আন্তোনিও গ্র্যানেলির বয়স হয়েছে, তাই সকলের স্থির বিশ্বাস শ্বশুরের অবর্তমানে ডনের পদটি মাইকেল মোরেটির দখলে আসবে। আর সেই জন্যই তাকে মাফিয়া বিদ্যায় শিক্ষিত করার প্রস্তুতি চলছে। মাইকেল মোরেটি ইতিমধ্যে ডজন খানেক অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। মোরেটি শুধু মানুষের হাড় ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেন না, খুন করাতেও হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু মজার কথা এই যে, ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি ডি সিলভা তার বিরুন্ধে অতীত মামলায় এইসব অপরাধের কোনোটিরই প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি। প্রমাণ ছাড়া কোনো কেই আইনে যুক্তিগাহ্য হয় না।
মোরেটি খুব নিখুঁত এবং পরিকল্পিতভাবে একেকটি অপরাধ সংঘটিত করতেন। আর এমন সাবধানতা অবলম্বন করতেন যাতে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকে। এর ফলে প্রমাণ সংগ্রহ করতে সরকারকে নাস্তানাবুদ হতে হতো। তবুও তারা প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারতো না।
এবার আসরে নামলেন ডি সিলভা স্বয়ং। মোরেটির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। এ কাজে তিনি পুরো তিনটি বছর ব্যয় করলেন, তারপর পরিশ্রমও করতে হয়েছে তাকে প্রচুর। এমন সময় অনভিপ্রেতভাবে একটি ঘটনা ঘটলো। কিছুদিন আগে পুলিশ একটি লোককে গ্রেপ্তার করেছিল, সে ডাকাতি করতে গিয়ে খুন করেছে। অনেক কসরত করে পুলিশ তার নাম জানতে পেরেছে, ক্যামিলো স্টেলা। মোরেটির পরিচালনাধীন মাফিয়া পরিবারের খুনে সদস্য ওই স্টেলা।
এই খবর রবার্ট ডি সিলভার কানে পৌঁছলো। তিনি ভাবলেন আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি। অপ্রত্যাশিতভাবে সৌভাগ্য দেবী আমার হাতে ধরা দিয়েছে। তিনি খুব খুশি। ঠার পরিশ্রম এতদিনে সার্থক হয়েছে। ডি সিলভা জানতেন ক্যামিলো যে অপরাধে অভিযুক্ত তাতে বিচারে তার ফাঁসি অবধারিত।
রবার্ট ডি সিলভা বিচক্ষণ উকিল। তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এল, যদি এই লোকটিকে কোনোভাবে আয়ত্বে আনা যায় তাহলে মোরেটির বিরুদ্ধে যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রামাণ আদালতে পেশ করতে তার অসুবিধা হবে না, যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ক্যামিলোর সঙ্গে দেখা করতে জেলখানায় গেলেন। তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন–তার যাতে ফাঁসি না হয় সেই ব্যবস্থা তিনি করবেন বিনিময়ে তাকে কিছু খবর জানাতে হবে। আর সেই খবরগুলি যেন সত্যি ও পাকা হয়। সেসব খবর মাইকেল মোরেটির বিভিন্ন অপরাধ ও তাদের পরিকল্পনা। বিষয়ক।
বলা বাহুল্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ক্যামিলল স্টেলা রবার্টের কথায় সম্মত হল। ব্যাপারটা যে এত সহজে হয়ে যাবে তা রবার্টের ধারণার অতীত ছিল। ক্যামিলো তার চুক্তিতে সম্মতি দেওয়ায় তিনি পুলকিত হয়েছিলেন। এর পেছনে একটা কারণ ছিল। এই মামলায় তিনি জিততে পারলে তার উচ্চাশা পূরণ তথা স্বার্থসিদ্ধি হবে। যদি ক্যামিলো স্টেলা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার জবানবন্দী দেয় এবং এতে মাইকেল মোরেটির যাবতীয় অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে মাইকেল মোরেটির আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড অবশ্যম্ভাবী। এটা কেউ রুখতে পারবে না। বরং মোরেটি তা মেনে নিতে বাধ্য হবে। এটা ডি সিলভা ভালোভাবেই জানতেন, যে এর ফলে পূর্বাঞ্চলের সবচাইতে বড় ও প্রভাবশালী কুখ্যাত মাফিয়া পরিবারটি শিরদাঁড়া ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। এছাড়া তার নিজেরও স্বার্থসিদ্ধি সফল হবে। এতবড় কৃতিত্বের জন্য তাঁকে নিশ্চয়ই পুরস্কৃত করা হবে। আর সেটি হবে অ্যালবানির গভর্নরের ওই আসনটি। উচ্চাকাঙ্খী স্বার্থলোভী ডি সিলভা শুধু আইন ব্যবসার সাফল্যে তৃপ্ত নয়, আমেরিকার রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে ফুটে ওঠার আশা মনে মনে পোষণ করছিলেন বহুদিন ধরে। নিউইয়র্কের অন্যান্য গভর্নররা এর মধ্যেই হোয়াইট হাউসে যে যার আসন পাকা করে ফেলেছেন। সেই হোয়াইট হাউসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা এতদিনে পূরণ করতে চলেছেন রবার্ট। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বুকের ভেতরে লালিত বাসনা পূরণ করতে হলে মাইকেল মোরেটিকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসাতেই হবে। তাহলে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে আর কোনো বাধা থাকবে না। সময়ও তার অনুকুলে। এছাড়া রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী ও তুখর রাজনৈতিক নেতারাও তাকে সহায়তা করছেন। মোরেটিকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারলেই ওইসব রাজনৈতিক নেতাদের বদান্যতায় গভর্নর পদের নির্বাচনে আগামী বছর প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াতে পারবেন। তাই যেভাবেই হোক মোরেটিকে কুপোকাৎ করতে হবে।
গোড়া থেকেই ডি সিলভা সতর্ক ছিলেন। কোনোরকম ঝুঁকির মধ্যে যাননি, মাইকেল মোরেটির বিরুদ্ধে মামলাটি তিনি সযত্নে সাজিয়েছিলেন। এইসব সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাড় করার কাজে তিনি যাদের নিযুক্ত করেছিলেন তারাও খুব আন্তরিকভাবে তাদের কাজ সম্পন্ন করেছে। আইনের কোনো ফাঁক ছিল না তাতে, যার মাধ্যমে আসামী মোরেটি বেকসুর খালাস পেতে পারেন।
এদিকে জুরি বাছাই করতে ডি সিলভার পুরো ছ-সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল। ডি সিলভা বিচারককে অনুরোধ করেছিলেন দুজন অতিরিক্ত জুরীকে বিকল্প হিসাবে রাখতে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে প্রথম থেকেই এই মামলার জুরীদের নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল, তাও ডি সিলভার বিশেষ আর্জিতে। যাতে কোনো বাইরের লোক জুরীদের বাড়ীতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য বাড়ীর দরজায় তালা লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মামলার একমাত্র রাজসাক্ষী ছিল ক্যামিলো স্টেলা। যে একসময় মাইকেল মোরোটির দলের খুনে গুণ্ডাদের একজন ছিল। রবার্ট ডি সিলভা তাকেও নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আবদ্ধ করেছিলেন। অতীতের একটি ঘটনাই ডি সিলভাকে সতর্ক থাকতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। বহুদিন আগে এই রকমই একটি মামলার প্রধান অভিযুক্ত ছিল এক মাফিয়া চক্রের সর্দার। তার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী করা হয়েছিল আবে কিড টুইস্ট নামে এক ব্যক্তিকে। কনি দ্বীপপুঞ্জের হাফ মুন হোটেলের ছতলার একটি ঘরে আবে কিডের থাকার ব্যবস্থা করেছিল পুলিশ। দুজন পুলিশ অফিসারকে তার পাহারায় নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এত কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রেখেও একদিন সেই রাজসাক্ষীর অন্তিম পরিণতি হয়েছিল মৃত্যু, দেখা গেল সে ওই ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছে এবং এতেই তার মৃত্যু হয়। অবশ্য এ বিষয়ে একটা সন্দেহ সবার মনে উঁকি দিয়েছিল, তা হল, সে নিজে জানালা দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে নাকি ওই পাহারাদার পুলিশ দুজন তাকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে? তা রহস্যই থেকে গিয়েছে। সেই পুরনো ঘটনার স্মৃতি ডি সিলভাকে এতখানি দৃঢ় করেছিল। তা মনে রেখেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে ক্যামিলোর প্রহরার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এমনকি প্রতি রাতে ক্যামিলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হতো। বিচারের আগে পর্যন্ত সুনিশ্চিত নিরাপত্তা বজায় রেখেছিলেন
বিচার পর্ব শুরু হল। তাই ক্যামিলো স্টেলার নিরাপত্তার কোনো অভাব রাখেন নি ডি সিলভা। জেলের একটি সেলে তাকে আটকে রাখা হল এবং চারজন সশস্ত্র ডেপুটি পুলিশ চব্বিশ ঘণ্টা তার প্রহরারত ছিলেন। মাইকেল মোরেটির দ্বারা স্টেলারের যাতে কোনোরকম ক্ষতি না হয় তার জন্য এই নিচ্ছিদ্র প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বিচারের পঞ্চম দিনে জেনিফার পার্কার নামে একজন সরকারী উকিল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিল। সে ছাড়া আরও পাঁচজন উকিল ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। তারা সবই সরকারী উকিলের টেবিলের ওপাশে বসেছিলেন।
জেনিফার পার্কারের বয়স কম, মাত্র চব্বিশ। পাতলা ছিপছিপে গড়ন তার। গায়ের রং ফ্যাকাশে, চোখের মণি দুটি সবুজ রঙের। সেই চোখের দৃষ্টি ভাবুকতাময়। মাথায় কালো একরাশ চুল। সে যেমন সাহসী তেমনি আবেগপ্রবণও বটে। তাছাড়া সে যত না সুন্দরী তার চেয়ে বেশী আকর্ষণীয়া। তাই তাকে যে দেখবে তার মনে ওই মুখটি চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
সরকারী উকিল হিসেবে অংশগ্রহণের প্রথম দিন জেনিফার পার্কারের বিশ্রীভাবে শুরু হয়েছিল। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিসে শপথ গ্রহণের সময় ঠিক করা ছিল সকাল আটটায়। তাই আগের দিন রাতে সে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলি গুছিয়ে রেখেছিল। যাতে তার তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে, সেই জন্য ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন। সময় নির্দেশিত ছিল ভোর ছটা।
কিন্তু ভাগ্য তার বিরূপ ছিল। তাই নির্দিষ্ট সময়ে ঘড়ির অ্যালার্ম বাজেনি। আর জেনিফারের ঘুমও ভাঙেনি। ঘুম যখন ভাঙলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। চোখ খুলেই ঘড়ির দিকে তাকলো। সে চমকে উঠলো। ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা ছুঁই ছুঁই করছে। সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাতে পোশাক পরলো। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে সে মোজা ছিঁড়ে ফেলল, জুতোর হিল খুলে ফেলল।
অগত্যা তাকে আবার জামাকাপড় পাল্টাতে হল। তারপর অ্যাপার্টমেন্টর দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এল। সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল যে সদর দরজা খোলার চাবি ফ্ল্যাটের ভেতর রেখে এসেছে। সেটা আনতে একেবারেই ভুলে গেছে। জেনিফারের ইচ্ছে ছিল বাসে চেপে ফৌজদারী আদালত ভবনে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। তাই অগত্যা তাকে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করতে হল। তবে ট্যাক্সিতে চড়ার মতো আর্থিক অবস্থা জেনিফারের ছিল না। তবুও সে যথাসময়ে আদালত ভবনে হাজিরার উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি ভাড়া করল। উপরন্তু ওই ট্যাক্সি ড্রাইভার অনেক রাস্তা ঘোরাল। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে সেখানে গিয়ে জেনিফার পৌঁছল। ইতিমধ্যে পনেরো মিনিট সময় পার হয়ে গেছে। ফৌজদারী আদালত ভবনটি ছিল ১৫৫ নম্বর লিওনার্ড স্ট্রীটে। যখন সেখানে সে পৌঁছলো তখন সোয়া আটটা বেজে গেছে।
ফৌজদারী আদলত ভবনে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভার অফিস। বিশাল অফিস কক্ষটি দামী দামী সব আসবাবপত্রে সজ্জিত। এই ঘরটি দেখলেই ডি সিলভার রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। ঘরের মাঝখানে বিরাট একটা ডেস্ক। ডেস্কের ওপাশে চামড়ার গদিমোড়া একটা আরাম কেদারা, উল্টোদিকে পরপর তিনটি চেয়ার সাজানো। ঘরের একদিকে রয়েছে। একটা কনফারেন্স টেবিল, আর টেবিলটিকে ঘিরে রেখেছে বারোটি চেয়ার। চার দেয়ালে ক্যাবিনেট আটকানো। সেগুলি মোটা মোটা আইনের বইতে ঠাসা। এছাড়া দেয়ালের গায়ে কয়েকটি ছবি টাঙানো আছে। সেগুলির কোনোটি জে এডগার হুভার ফটো, কোনোটি জন লিন্ডসের ফটো। এইসব ছবিতে এঁদের প্রত্যেকের নাম সই করা আছে। এইসব ছবিগুলো ঘরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
জেনিফার পার্কারের যাওয়ার আগে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস পঁচিশজন তরুণ আইনজীবীদের আগমনে ভরে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সদ্য ল পাস করেছে। তারা সবাই আগ্রহী নিউইয়র্ক কাউন্টির ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভার-এর সহকারী হিসাবে যোগ দিতে।
ডি সিলভা তরুণ আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে উদ্যত হলেন। হঠাৎ জেনিফার পার্কার সেই ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। দেরী হওয়ার জন্য সে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।
বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ডি সিলভা বলছিলেন, এমন সময় জেনিফার অবিবেচকের মতো ঢুকে পড়ায় তার ভাষণে ছেদ পড়লো। ফলে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে জেনিফারকে ধমকে বললেন–কি ভেবেছো তুমি? তোমার ইচ্ছেমতো কি এখানে আসবে?
–আমি দুঃখিত স্যার, আমি–জেনিফার আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে ডি সিলভা বলে উঠলেন–খবরদার! মুখে মুখে কথা বোল না! আর কখনও যেন এরকম দেরী না হয়!
ঘরের ভেতর উপস্থিত অন্যান্য আইনজীবীদের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো জেনিফারের দিকে। তাদের সেই দৃষ্টিতে সহানুভূতির ছায়া ছিল। জেনিফার ধীরে ধীরে তাদের একজনের পাশে গিয়ে বসে পড়লো, আবার ডি সিলভা বলতে শুরু করলেন।
–তোমাদের আসার কারণ আমার জানা আছে। দিনের পর দিন আমার সঙ্গে থেকে তোমরা আইনের মারপ্যাঁচগুলো শিখবে, আইনের মোক্ষম মারণাস্ত্রগুলো সম্পর্কে অবহিত হবে। তারপর একদিন তোমরা ফৌজদারী উকিল হবে। তোমাদের এই প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমিও চাই তোমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন একদিন আমার যোগ্য হয়ে উঠবে এবং আমার আসনে আসীন হবে। তোমরা সেই যোগ্যতা নিশ্চয়ই অর্জন করতে পারবে। ভাষণ শেষ করলেন রবার্ট ডি সিলভা। তিনি তার সহকারীকে ডাকলেন। সহকারী কাছে আসতে রবার্ট বললেন–এইসব নবাগত তরুণ আইনজীবীদের শপথ গ্রহণ করতে বলো।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হল। রবার্ট ডি সিলভা একটা চুরুট ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তাহলে এবার তোমরা কাজে যোগ দাও। বিভিন্ন মামলার খসড়া, সমন ও পরোয়ানার বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করো। বর্তমানে আমার হাতে একটা মামলা আছে। আমার মনে হয় তোমরা সে সম্পর্কে খবরের কাগজ থেকে অনেক কিছু জেনেছো। ওই মামলার জন্য আমি ছ-জন সহকারী নিয়োগ করতে চাই। তারা আমাকে ওই মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করবে। আমি তাদের দিয়ে আমার প্রয়োজনীয় কাজগুলো করিয়ে নেবো।
রবার্ট কথা শেষ করতেই জেনিফার হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে আরও পাঁচ জন হাত তুললাম। রবার্ট কিছুক্ষণ ভাবলেন। তাপর তাদের দুজনকেই সহকারী হিসেবে নিয়ে নিলেন।
ছ-জন সহকারীকে পরিচয়পত্র দেওয়া হল। তারপর ডি সিলভা তাদের ১৬ নম্বর, এজলাসে যেতে হুকুম করলেন।
জেনিফার ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির ব্যবহারে একটুও ক্ষুদ্ধ হয়নি। বরং সে খুব খুশী হয়েছে, নিউইয়র্ক কাউন্টির ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অন্যতম সহকারী হতে পারার জন্য। তাই সে আনন্দে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির রুক্ষ কড়া কথাগুলো আর মনে রাখেনি। এর ফলে সে কিছুটা গর্বিতও হয়েছিল। জেনিফারের বিশ্বাস যে সে রবার্ট ডি সিলভার মতো রাগী মানুষকে ভুল বুঝবে না। তার দেওয়া যে কোনো কাজ জেনিফার সাফল্যের সঙ্গে করতে পারবে এমন একটা আস্থা সে মনে মনে লালন করতো। বিচার, আপীল, প্রতরণা এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধ জগতের আইন বিষয়ক দপ্তরের দায়িত্বে আছেন একজন করে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি। নিউইয়র্ক শহরে মোট পাঁচটি বরো আছে। এই প্রত্যেক বরোর জন্য একজন করে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি নিযুক্ত আছেন। তাদের সাহায্য করার জন্য আছে দুশোর বেশি সহকারী ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি। এইরকম একটি বরোর ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি হলেন রবার্ট ডি সিলভা, তিনি যে বয়োর ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির পদে আছেন সেটি হল ম্যানহাটান। এটি অন্য চারটির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই জেনিফার ভাবছিল, আইন বিষয়ক ওই চারটি দপ্তরের মধ্যে কোনটির কাজ দেখাশোনা–করতে হবে তাকে।
মামলা চলাকালীন জেনিফার এজলাসে উপস্থিত থেকে ডি সিলভার সওয়ালের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। রবার্টের তদন্তের দক্ষতা দেখে জেনিফার মুগ্ধ হয়ে গেছে। একবার সে এই মামলার আসামী মাইকেল মোরেটিকে দেখলো। এতদিন মোরেটি সম্পর্কে জেনিফার খবরের কাগজের খবরগুলি পড়েছে। কিন্তু আজ চোখের সামনে মোরেটিকে দেখে সে বিস্মিত না হয়ে পারলো না। সে ভাবছিল এমন একজন রোগা চেহারার মানুষ কি করে নৃশংস নিষ্ঠুর হতে পারে। নিজের চোখে না দেখলে নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাস করতেই পারতো না যে মাইকেল মোরেটি একজন কুখ্যাত মাফিয়া ডন ও খুনী। জেনিফারের মনে হল সে যেন কোনো সিনেমা হলে বসে বসে কোনোও ফিল্মের ছবি ভোলা দেখছে। প্রকৃত পক্ষে মাইকেল মোরেটিকে দেখলে কোনো ফিল্মের নায়ক বললে ভুল হবে না। মোরেটি এখন স্থির হয়ে বসে আছে। কিন্তু তার কালো দুটি চোখ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সেই চোখের চাহনি সারা এজলাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হয় সে যেন কিছু একটা খুঁজছে। হয়তো বা বাঁচার তীব্র তাগিদে কোনো একটি সুযোগের সন্ধানে রয়েছে। তবে তার সে চেষ্টা ফলবতী হবে না। কেননা রবার্ট ডি সিলভা মোরেটির বাঁচার সব রাস্তাই চারদিক থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন।
রাজসাক্ষী ক্যামিলল স্টেলাকে আদালত চত্বরে হাজির করা হয়েছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষীর কাঠগড়ায়, পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন রবার্ট ডি সিলভা। এসে থামলেন। কাঠগড়ার সামনে। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্টেলা শপথ বাক্য উচ্চারণ করছে–যা বলবো সত্য বলবো, সত্যি বই মিথ্যা বলবো না।
রবার্ট বলতে আরম্ভ করলেন–মিঃ স্টেলা, মাননীয় জুরীদের আগে আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে নরহত্যার মামলার অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে। যেহেতু আপনি সরকারের পক্ষে সাক্ষী দিতে সম্মত হয়েছেন তাই আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সামান্য লাঘব করা হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে যে খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে তা অনিচ্ছাকৃত খুন বলে বিবেচনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রও তা মেনে নিয়েছে। এবার বলুন আমি যা বললাম তা সত্যি কিনা?
– হ্যাঁ স্যার। শব্দ কয়টি উচ্চারণের সময় ক্যামিলোর গলা কেঁপে উঠেছিল।
–মিঃ স্টেলা, আপনি কি মাইকেল মোরেটিকে চেনেন?
হ্যাঁ স্যার। আমি মাইকেলের দলে কাজ করতাম। প্রায় দশ বছর ধরে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে।
তাহলে আমি কি ধরে নেবো আপনি আসামীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন? এবার আসামী পক্ষের উকিল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন–অবজেকশন। আসামী অর্থাৎ মাইকেল মোরেটির উকিলের নাম টমাস কোলফ্যাক্স। বয়স তার পঞ্চাশের কাছাকাছি। কাঁচাপাকা মাথার চুল। তিনি মাফিয়া চক্র সংক্রান্ত আইন দেখাশোনা করেন। এছাড়া তিনি একজন খ্যাতনামা উকিলও বটে।
টমাস আবার বললেন–ধর্মাবতার, ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি সাক্ষীকে প্ররোচিত করছেন, এখানেই আমার আপত্তি আছে।
এই মামলার প্রধান বিচারক ছিলেন লরেন্স ওয়াল্ডম্যান। তিনি আসামী পক্ষের উকিলের আপত্তি স্বীকার করে নিয়ে বললেন–অবজেকশন সাসটেইন্ড।
রবার্ট ডি সিলভা একটুও দমলেন না। তিনি আবার জেরা করতে শুরু করলেন আচ্ছা মিঃ স্টেলা, মাইকের দলে আপনি কি কাজ করতেন?
–আমার কাজ ছিল কোনো ঝামেলা হলে অর্থাৎ কেউ বেগড়বাই করলে তাকে শায়েস্তা করার জন্য মাইক আমাকে পাঠাতো।
–কিভাবে তাকে শায়েস্তা করতেন?
মারধোর করে।
–এ ধরনের একটা উদাহরণ দিতে পারেন মহামান্য বিচারকের কাছে?
আসামীপক্ষের উকিল আবার আপত্তি জানালে তা জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যান অগ্রাহ্য করলেন। তিনি বললেন–সাক্ষী ইচ্ছে করলে উত্তর দিতে পারে।
ক্যামিলো স্টেলা ঘাড়ের দপদপানি অনুভব করল। তবুও সে বলল হুজুর, আমার মনিব মাইক সুদের কারবারী, তার কাছ থেকে অনেকেই চড়া সুদে টাকা ধার নিতো। যে সময় মতো টাকা শোধ করতো না তখন আমায় ডাকতেন মনিব। জিমি সেরানো নামে একটি লোক মাইকের কাছ থেকে টাকা ধার করেছিল। দু-তিন বছর পরেও সে টাকা শোধ করেনি। তাই মাইক আমাকে পাঠিয়েছিলেন জিমিকে শিক্ষা দেবার জন্য। হুজুর আমি প্রথমে জিমি সেরানোর দুটি পা ভেঙে দিলাম।
রবার্ট ডি সিলভা আড়চোখে জুরী মহোদয়দের দিকে তাকালেন। ক্যামিলো স্টেলার এই ভয়ানক হিংস্র কার্যকলাপের বিবরণ শুনে তাদের কি প্রতিক্রিয়া তা প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যেই ডি সিলভা জুরীদের দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে জুরীগণও এই বীভৎস কুৎসিত ক্রিয়াকলাপে শিহরিত হয়েছেন।
টাকা ধার দেওয়া ছাড়া মাইকেল মোরেটি আর কি কি ধরনের কাজ করতো বলে আপনি জানেন মিঃ স্টেলা?
–অনেক রকম কাজ, যেমন ওয়াটার ফ্রন্ট, যেখানে জাহাজের খালাসি ও বন্দরের কুলি মজুরদের বাস। সেখানকার যে ইউনিয়ন নেতা তার সঙ্গে মাইকের ভালো সম্পর্ক। আছে। এছাড়া মাইক আরও অন্যান্য কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
–মিঃ স্টেলা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এডি আর অ্যালবার্ট র্যামোসূকে খুন করা হয়েছে। আর তা করা হয়েছে মাইকেল মোরেটির নির্দেশে। সুতরাং সেই অভিযোগে অভিযুক্ত মাইকেল মোরেটির বিচার হচ্ছে এই আদালতে।
স্টেলা অস্পষ্ট স্বরে বলল–জানি হুজুর।
–সেই সময় কি আপনি ওই অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন?
স্টেলা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল–হ্যাঁ হুজুর।
–কেন আসামী র্যামোস ভাইদের খুন করতে চেয়েছিল?
উত্তর দেওয়ার আগের মুহূর্তে ক্যামিলো স্টেলা মাইকেল মোরেটির দিকে তাকালো। তাদের দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হল। পর মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিয়ে স্টেলা বলতে শুরু করল–মাইক ঘৌড়াদৌড়ের ওপর বেআইনী জুয়ার এক ব্যবসা করতেন। ওই ব্যবসা দেখাশোনার ভার ছিল এডি ও অ্যালবার্ট দু-ভাইয়ের ওপর। একদিন মাইক লোক মারফত খবর পেলেন যে ওই দুভাই জুয়ার ব্যবসা থেকে টাকা আত্মসাত করছে। কিছুমাত্র চিন্তা না করে মাইক ওই বেইমান দুই ভাইকে কঠিন শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন। সমুদ্রের ধারে মাইকের নিজস্ব একটা ক্লাব আছে। মাইক তার নাম দিয়েছিলেন দ্য পেলিক্যান, আর নিজেই ওটা পরিচালনা করতেন উনি। সেখানে এক পার্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমাকে দিয়ে মাইক ওদের দু-ভাইকে নেমতন্ন করে আনলেন। পরিকল্পনা মতো নির্দিষ্ট দিনে আমি নিজে গিয়ে এডি আর অ্যালবার্টকে নিয়ে এলাম ওই ক্লাবে। মাইক আগে থেকেই সেখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা তিনজনেই গাড়ি থেকে নামলাম। আমি একপাশে সরে যেতেই মাইক ওদের দুজনকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ওরা মাটিতে পড়ে গেল।
–ওরা দুজনেই মারা গিয়েছিল?
হুঁ হুজুর।
তারপর আপনারা কি করলেন মিঃ স্টেলা?
–ওদের দুভাইকে খতম করার পর মাইক আর একটুও দেরী করলেন না, আমার সহায়তায় ওদের কবর দিয়ে দিলেন।
স্টেলার বক্তব্য শেষ হতেই এজলাসের ভেতর মৃদু গুঞ্জন উঠল। সেই অবসরে জেনিফার পার্কার ঘাড় ফিরিয়ে মাইকেল মোরেটির দিকে তাকালো। সে হয়তো মোরেটির মুখের অভিব্যক্তি অনুভব করার চেষ্টা করছিল। তার মধ্যে কোনো রকম বিকৃতির লক্ষণ দেখতে পেল না. জেনিফার। মাইক আগের মতোই অনড়, অটল ভাবলেশহীনভাবে বসে ছিলেন। তার চোখ রবার্ট ডি সিলভা আর ক্যামিলো স্টেলার দিকে। এজলাসের গুঞ্জন স্তিমিত হওয়া পর্যন্ত রবার্ট ডি সিলভা মুখ বন্ধ করে রইলেন।
ডি সিলভা আবার ধীর শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগলেন–মিঃ স্টেলা, আপনি কি জানেন যে আপনার এই সাক্ষ্যর বয়ান অনুযায়ী এই আদালত আপনাকেও দোষী হিসেবে অভিযুক্ত করতে পারেন?
-হ্যাঁ হুজুর।
আপনি এও নিশ্চয়ই জানেন আপনার সাক্ষ্য দানের জন্য একটি মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে?
–হ্যাঁ হুজুর।
–তাহলে মিঃ স্টেলা, আপনি স্বীকার করছেন র্যামোস ভাইদের পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় মাইকেল মোরেটি নিজের হাতে খুন করেছেন, আর তার সাকরেদ আপনি তা দেখেছিলেন।
আসামী পক্ষের উকিল টমাস কোলফ্যাক্স আবার উঠে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বললেন অবজেকশন মী লর্ড! ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি সাক্ষীকে প্ররোচিত করছেন।
জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যান বললেন–ঠিক আছে, আপনার আপত্তি গ্রাহ্য হল।
ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি ডি সিলভা এজলাসের ভেতর বসে থাকা জুরীদের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন, তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখে তিনি সুনিশ্চিত হলেন যে, এই কেসে তার জয় অবধারিত। তিনি উৎসাহিত হয়ে আবার ক্যামিলো স্টেলার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন মিঃ স্টেলা, আমি জানি এই আদালতে এসে আপনি সত্য গোপন না করে নির্ভীক চিত্তে সাক্ষ্যদান করেছেন। এতে আমরা সবাই আপনার সাহসিকতার প্রশংসা না করে পারছি না। আমি নিউইয়র্কের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই কথাগুলো বলেই রবার্ট ডি সিলভা তার দীর্ঘ জেরার ইতি ঘটালেন। তারপর আসামী পক্ষের উকিল টমাস কোলফ্যাক্সকে বললেন–এবার আপনি জেরা শুরু করতে পারেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে টমাস কোলফ্যাক্স চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ তিনি ঘড়িটার দিকে তাকালেন।
টমাস কোলফ্যাক্স দেয়াল ঘড়িটার দিকে আঙুল তুলে বিচারককে দেখিয়ে বললেন এখন বারোটা বাজে। এটা লাঞ্চের সময়, আমি চাই না আমার জেরার মাঝখানে লাঞ্চের বিরতি হোক। আমি অনুরোধ করছি আপনি এখনই যেন লাঞ্চের বিরতি ঘোষণা করে দেন।
জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যান আসামীপক্ষের উকিলের অনুরোধ মেনে নিলেন। তিনি বেঞ্চের ওপর হাতুড়ি ঠুকে জানিয়ে দিলেন যে দুপুর দুটো পর্যন্ত আদালত মুলতবি রইল।
বিচারক এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাশের দরজা দিয়ে তার কক্ষে প্রবেশ করলেন। এরপর উপস্থিত সবাই যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, জুরী:ভদ্রমহোদয়গণ বাইরে বেরিয়ে গেলেন। চারজন সশস্ত্র ডেপুটি ক্যামিলো স্টেলাকে বেষ্টন করে সাক্ষীর কামরায় নিয়ে গেলেন। ক্যামিলল স্টেলার সাক্ষ্যদান কালে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িক পত্রিকার প্রতিনিধিরা ওই বিচার সভায় উপস্থিত ছিলেন। তারাও সবাই রবার্ট ডি সিলভার জেরা ও ক্যামিলোর সওয়াল জবাব শুনেছেন। এবার তারা সমস্বরে রবার্ট ডি সিলভাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলেন। তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলেন–শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা কতদুর গড়াবে বলে আপনার ধারণা। এ মামলার নিষ্পত্তি হলে আপনি কি সত্যিই ক্যামিলল স্টেলার জীবন রক্ষা করতে পারবেন, মিঃ ডি সিলভা।
এই মামলার আগে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা,আদালতের ভেতর রিপোর্টারদের উপস্থিতি পছন্দ করতেন না। কিন্তু এখনকার পরিবেশ ও পরিস্থিতি একটু অন্য রকম। নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের স্বার্থসিদ্ধির পরিপূরক হিসেবে এই সময় রিপোর্টারদের আগমন তার কাছে ভীষণ জরুরী, এটা উপলব্ধি করতে পেরেই তিনি রিপোর্টারদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। বরং বিনীত ও নম্রভাবে তাদের সব প্রশ্নের জবাবদিহি করতে লাগলেন হাসি মুখে। গভর্নরের পদে উন্নীত হবার জন্য তাকে এখন বিনয়ের অবতার হতে হবে এবং এদের সঙ্গে শান্ত স্বরে কথা বলতে হবে।
ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা, আসামীর কি ধরনের সাজা হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
রবার্ট ডি সিলভা বিনীতভাবে জবাব দিলেন-দেখুন, আসামীর দোষ গুণ বিচার করবেন বিচারক ও জুরীগণ। এটা তাদের কর্তব্য, এক্ষেত্রেও মিঃ মাইকেল মোরেটির বিচারের রায় তারাই দেবেন, আমি আর কি বলবো?
জেনিফার ডি সিলভার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
হঠাৎ জেনিফারের চোখ গিয়ে পড়ল মাইকেল মোরেটির ওপর। সে দেখতে পেল আসামী মিঃ মোরেটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অদ্ভুত শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা বা উত্তেজনার লেশমাত্র নেই।
ইতিমধ্যে রিপোর্টাররা সবাই চলে গেছে। রবার্ট ডি সিলভা ততক্ষণে তার সহকারীদের নিয়ে মামলা সংক্রান্ত আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁদের আলোচনা শোনার জন্য জেনিফার উদগ্রীব হয়ে উঠল। সে অস্থির হল এখনকার আলোচনার বিষয়বস্তু জানার জন্য। তার এই মানসিক অস্থিরতার মধ্যে একজন অপরিচিত লোক হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটির হাতে একটা বড় ম্যানিলা খাম।
লোকটি জেনিফারকে জিজ্ঞাসা করল–আপনিই কি জেনিফার পার্কার?
হতভম্ব হয়ে জেনিফার কয়েক সেকেন্ড ওই লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল–হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে আপনার কী প্রয়োজন?
চীফ এটা আপনাকে দিতে বলেছেন। এর ভেতরে যেসব কাগজপত্র আছে তাতে মাফিয়া ডন মাইকের নানা কুকীর্তির ঘটনাবলী ও দিন তারিখ লেখা আছে। আপনি এটা স্টেলার কাছে পৌঁছে দিন। আর বলবেন, এখানে সেগুলি যেন স্টেলা ভালো করে মুখস্থ করে নেয়, যাতে কোলফ্যাক্সের জেরার মুখে সব উল্টোপাল্টা না বলে বসে। জেরার চাপে হয়তো স্টেলা এতক্ষণ যা বলেছে সব ভুলে যাবে, তাই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বলেই লোকটি জেনিফারের দিকে খামটিকে এগিয়ে দিল।
জেনিফার খামটি হাতে নিল। মনে মনে রবার্ট ডি সিলভাকে কৃতজ্ঞতা জানালো সে এই ভেবে যে তিনি তার নামটি মনে রেখেছেন।
লোকটি এবার তাড়া দিয়ে বলল দয়া করে তাড়াতাড়ি যান, লাঞ্চের বিরতিটুকুর মধ্যেই এটাকে স্টেলার পড়ে ফেলতে হবে।
যাচ্ছি স্যার। বলেই একছুটে এসে হাজির হল জেনিফার যেখানে স্টেলাকে রাখা হয়েছে সেখানে। হাতে তার সেই ম্যানিলা খামটি।
সঙ্গে সঙ্গে একজন সশস্ত্র ডেপুটি জেনিফারকে বাধা দিয়ে বললেন–বলুন, আপনি কোথায় যাবেন?
–কিভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করবো?
তেজোদ্দীপ্ত স্বরে জেনিফার বলল–আমি ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস থেকে আসছি। মিঃ ডি সিলভা স্টেলাকে একটা খাম পাঠিয়েছেন। সে ব্যাগ থেকে তার পরিচয়পত্র বের করল এবং প্রহরারত ডেপুটিকে দেখালো।
সেই প্রহরী তার কর্তব্য কাজে অবহেলা করলেন না। তিনি পরিচয়পত্রটি বেশ ভালো করে পরীক্ষা করলেন এবং নিঃসন্দেহ হতেই তিনি রাজসাক্ষী স্টেলার ঘরের দরজা খুলে দিলেন। জেনিফার সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল। জেনিফার দেখলো ঘরটি খুবই ছোট। আরামের কোনো উপকরণ সামগ্রী নেই কিছু। আসবাব বলতে একটা ভাঙা ডেস্ক, একটা সোফা আর কয়েকটি কাঠের চেয়ার। এসবই পুরনো আমলের জিনিস। র্যামোস ভাইদের খুনের মামলার রাজসাক্ষী ক্যামিলো স্টেলা সেই ঘরে একটি চেয়ারে চুপচাপ বসেছিল। তার একটি হাত থরথর করে কাঁপছিল, তাকে চারজন সশস্ত্র প্রহরী পাহারা দিচ্ছিল।
জেনিফারকে দেখে একজন প্রহরী সন্দিহান হয়ে উঠল। সে বলল–এখানে বাইরের কারও প্রবেশ নিষেধ।
বাইরে যে ডেপুটি প্রহরায় ছিলেন তিনি আশ্বস্ত করে বললেন–অ্যাল ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস থেকে এসেছেন, ওঁর লোক, ওঁকে ছেড়ে দাও।
খামখানা ক্যামিলল স্টেলার হাতে দিয়ে জেনিফার ওই অচেনা লোকটির শেখানো কথাগুলো আওড়ে গেল।
এরপর জেনিফার লাঞ্চ খাবার উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে এল। আদালতের ভেতরেই একটি খালি এজলাসের ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল। দুটি বড় টেবিল, এই টেবিল দুটি রয়েছে জজের বেঞ্চের ঠিক নিচে। একটির গায়ে বিবাদী লেখা, অন্যটির গায়ে বাদী লেখা। একপাশে জুরীদের বসার চেয়ার। সেগুলি চারটি করে দুটি সারিতে রয়েছে। এইসব দেখে গণতান্ত্রিক দেশের আইন ব্যবস্থার প্রতি জেনিফার শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলো না। সভ্যতা ও বর্বরতার মধ্যে পার্থক্যের দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিরাজ করছে এই আদালত কক্ষটি। প্রতিটি স্বাধীন দেশের জনগণ সুবিচার পাওয়ার দাবী করতে পারেন। এই অধিকারের দাবী ফলপ্রসূ হতে পারে একমাত্র জুরীদের মাধ্যমে। যদি কোনো দেশের নাগরিকরা জুরীদের মাধ্যমে বিচারের অধিকার হারিয়ে ফেলে তাহলে সেই দেশকে পরাধীন বলে পরিচিতি অর্জন করতে হবে। যেহেতু জেনিফার নিজে এখন এই আইন ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত হয়ে আছে, তাই এই পরিত্যক্ত ফাঁকা এজলাসে দাঁড়িয়ে তার খুব গর্ব হচ্ছে। আইনের অধিকার ও তার মর্যদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বদা সে সচেষ্ট থাকবে। এখানে দাঁড়িয়ে সে আনা ভাবনায় মশগুল হয়ে গিয়েছিল। জেনিফার খেয়ালই করেনি যে কখন সময়টা গড়িয়ে গেছে। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতেই সে সামনের দিকে পা বাড়ালো।
এমন সময় জেনিফারের কানে এল অনেকগুলো লোকের চীৎকার। সেই চীৎকার ভেসে আসছে আদালত ভবনের একটি অংশ থেকে, ক্রমশ সেই চীৎকার হট্টগোলে পরিণত হল। অতর্কিতে বিপদ ঘন্টা বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং রবে। জেনিফার পেছনে ফিরল। সে এগিয়ে। গেল। আদালত ভবনের সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে সে হতচকিত হয়ে গেল। তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। সে শুধু অপলক দৃষ্টিতে উদভ্রান্ত মানুষের ছোটাছুটি দেখছিল। পুলিশ রাইফেল উঁচিয়ে আদালত ভবনের প্রবেশ দ্বারের দিকে ছুটে যাচ্ছে। জেনিফার ভাবলো মাইকেল মোরেটি হয়তো পুলিশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আদালত থেকে পালিয়েছেন। আসল খবরটা জানার জন্য সে দ্রুত পায়ে করিডোরে এসে হাজির হল। সেখানকার মানুষ জন এমন আচরণ করছেন তা কেবলমাত্র পাগলদের ক্ষেত্রে সম্ভব। তখনও একটানা বিপদসংকেত ঘন্টা বেজে চলেছে। আর মানুষের ছোটাছুটিরও বিরাম নেই।
এতক্ষণ খবরের কাগজের সাংবাদিকরা টেলিফোনের মাধ্যমে তাদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। তারা মোরেটি মামলার সমস্ত খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অফিসকে জানাচ্ছিল। তাদের মধ্যেও চাঞ্চল্য দেখা দিল। ব্যাপারটা কি জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠল তারা। স্বচক্ষে ব্যাপারটা অনুধাবন করার জন্য তারাও এসে দাঁড়িয়েছে করিডোরে।
ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিলেন। তিনি বেশ কিছু পুলিশকে কিসব হাত নেড়ে বলছিলেন। তার মুখে রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। কে যেন শুষে নিয়েছে সব রক্ত। এসব কিছু জেনিফারের নজর এড়াল না।
কোনও ভাবে ডি সিলভাকে সাহায্য করা যায় কিনা এই আশায় জেনিফার ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। রবার্ট ডি সিলভা কয়েকজন ডেপুটির সঙ্গে কথা বলছিলেন। এরাই রাজসাক্ষী ক্যামিলল স্টেলার প্রহরার ভারপ্রাপ্ত প্রহরী। তাদের মধ্যে একজন জেনিফারকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারলো। সে তৎক্ষণাৎ ডি সিলভাকে কিছু একটা বলল। ডি সিলভার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি এসে পড়ল জেনিফারের ওপর। তারপর ডি সিলভার নির্দেশে জেনিফারকে ঘিরে ধরতে মাত্র পাঁচ সেকেন্ড সময় নিয়েছিল পুলিশ ডেপুটিরা।
জেনিফারকে তারা জানালো এখন সে তাদের হাতে বন্দী। কারণটা বুঝে ওঠার আগেই তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হল।
জেনিফারের বিচার শুরু হল। বিচার স্থল জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যানের কামরা। সেখানে জজ লরেন্স ও জেনিফার ছাড়াও হাজির ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা ও আসামী পক্ষের উকিল টমাস কোলফ্যাক্স।
জজ ওয়াল্ডম্যান বলতে শুরু করলেন–মিস পার্কার, যে কোনো আসামীর বিবৃতি দেবার আগে একজন উকিলের পরামর্শ ও সাহায্য নেবার অধিকার আছে। আপনার ক্ষেত্রে তার অন্যথা হবে না। আপনি চাইলে আমরা তার ব্যবস্থা করতে পারি। অথবা আপনার ইচ্ছে হলে আপনি চুপ করে থাকতে পারেন, সে অধিকারও আপনার আছে।
জেনিফার দৃঢ় চিত্তে বলল–তার কোনো প্রয়োজন নেই, আপনারা ব্যস্ত হবেন না। ঘটনা ঘা ঘটেছে তা আমি নিজেই বলতে পারবো, এ বিশ্বাস আমার আছে।
রবার্ট ডি সিলভা জেনিফার পার্কারের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই সে স্পষ্ট। দেখতে পেল তার কানের রগের দাপাদাপি।
রাগে ডি সিলভার চোখ দিয়ে আগুন ঝরছিল। তিনি জোরালো কন্ঠে প্রশ্ন করলেন জেনিফারকে–ওই প্যাকেটটা ক্যামিলো স্টেলাকে কে দিতে বলেছে আর তার বিনিময়ে তুমি কত টাকা পেয়েছো?
রাগে, অপমানে, উত্তেজনায় জেনিফার পার্কার থর থর করে কেঁপে উঠল। সে ডি সিলভার চোখে চোখ রেখে পরিষ্কার কণ্ঠস্বরে বলল–কে টাকা দিয়েছে আমাকে? আমি কারও টাকা নিইনি?
ওই কামরায় একটি ডেস্ক ছিল। তার ওপর একটি বড় ম্যানিলা খাম পড়ে ছিল। সেটা ডি সিলভা হাত বাড়িয়ে বললেন–এটা তাহলে কোথা থেকে এল, এটাকেই বা তুমি কেন আমার সাক্ষী ক্যামিলো স্টেলাকে দিতে গেলে? এসব কি তুমি বিনা স্বার্থে করেছো?
জেনিফারের উত্তরের আশা ডি সিলভা করেন না। তিনি জজের ডেস্কের সামনে আবার এগিয়ে গেলেন, ডেস্কের ওপর খামটাকে উল্টো করে ধরলেন, তারপর মুখ খুলে খামটিকে আঁকাতে শুরু করলেন। একটু আঁকাতেই মুখ খোলা খামটি থেকে বেরিয়ে এল হলদে রঙের একটা ক্যানারি পাখির মৃতদেহ। তার ঘাড়টা কে যেন ভেঙে দিয়েছে। তা দেখেই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠল জেনিফার পার্কার, সে তোতলাতে শুরু করল। সে অনেক কষ্টে বলল–আপনার একজন লোক এটা আমার হাতে দিয়ে স্টেলাকে দিতে বলেছে।
আমার লোক? গর্জে উঠলেন ডি সিলভা, কোথায় সে? কার কথা বলছ তুমি?
–আমি–আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না।
অথচ, তুমি এটা জানো যে, লোকটা আমার দলের, ডি সিলভার গলায় অবিশ্বাস।
–আমি মিথ্যে বলছি না। জেনিফারের কণ্ঠে মিনতি–আমি স্বচক্ষে ওই লোকটিকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। আপনার সঙ্গে কথা বলল, তারপর আমার কাছে এগিয়ে এল, খামটা তুলে দিল, বলল, স্টেলাকে দিয়ে দিতে। আমি ভাবলাম, আপনারই নির্দেশে-লোকটি আমার নামটাও জানে।
–জানতে তো হবেই। এবার বলো তো, কাজটা করার জন্য কত টাকা পেয়েছো?
জেনিফারের মুখে কথা নেই। সে বোকার মতো কেবল তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা তার কাছে দুঃস্বপ্ন ঠেকল–সে তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ছটা বাজতে আর কিছুক্ষণ বাকি আছে। তারপর সে বিছানা থেকে উঠে পড়বে। চোখ মুখ ধোবে। পোশাক পরবে, তারপর ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস গিয়ে উপস্থিত হবে। সেখানে আজ ডি সিলভা তাকে সহকারী হিসেবে শপথ গ্রহণ করাবেন।
কী হল, বল, কত পেয়েছো?
রবার্ট ডি সিলভা তখন রাগে ফেটে পড়লেন। আচমকা দুঃস্বপ্নের রেশ কেটে গেল জেনিফারের।
আপনি কি আমাকে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করতে চাইছেন?
–অভিযুক্ত করছি কিনা প্রশ্ন করা হচ্ছে? রবার্ট ডি সিলভা ক্ষিপ্ত হয়ে দুহাতের মুঠো পাকাতে লাগলেন, শুনুন ভদ্রমহোদয়া, আমি এখনও আসল কাজ শুরু করিনি। আমার জেরার চোটে জেরবার হয়ে যাবেন। লম্বা জেল হবে।
যেদিন বাইরে আসবেন, সেদিন আর এই উঠতি বয়স থাকবে না, টাকাটা ভোগ করার সময় যাবে পেরিয়ে।
না, আমি কোনো টাকা নিইনি। জেনিফার প্রতিবাদী হয়ে উঠল।
এতক্ষণ ওদের দুজনের কথা চালাচালি চুপ করে শুনছিলেন টমাস কোলফ্যাক্স। তিনি এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–মাপ করবেন ধর্মাবতার, এইভাবে চলতে থাকলে বেশীদুর এগানো যাবে না বলে আমার মনে হয়।
–ঠিকই বলেছেন। জজ ওয়াল্ডম্যান তাকালেন ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির দিকে। এখন আপনার কী করবার আছে ববি? স্টেলা কি জেরার সামনে দাঁড়াতে চাইবে?
রবার্ট ডি সিলভা বললেন–এখন জেরা করে কোনো সুরাহা হবে না। স্টেলা দারুণ ঘাবড়ে গেছে। জেরার উত্তর দেবার মতো ওর মানসিকতা এখন নেই।
ধর্মাবতার, আসামী পক্ষের উকিল টমাস কোলফ্যাক্স ধীর গলায় বললেন রাজসাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ যদি না পাই তাহলে এ মামলা খারিজ করে দেওয়ার আবেদন আদালতের কাছে পেশ করব।
–ববি, আপনি কিছু বলুন, ববি। জজ বললেন, এই মামলা খারিজ হতে পারে, এ সম্পর্কে আপনার রাজসাক্ষীর কি কোনো ধারণা আছে?
আছে ধর্মাবতার, ও এত ভয় পেয়েছে যে ওর মনে হচ্ছে, ওকে নিশ্চয়ই মাফিয়াদের হাতে মরতে হবে, কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।
–এই পরিস্থিতিতে আসামী পক্ষের উকিলের আবেদন আমাকে গ্রাহ্য করতে হচ্ছে। জজ ওয়াল্ডম্যানের গম্ভীর গলা, মামলা খারিজ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই।
বিচারকের রায় শুনে রবার্ট ডি সিলভা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। মনে মনে রাগে তিনি ফেটে পড়লেন। দিনের পর দিন ধরে মামলাটা একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন। সেই মামলা আজ খারিজ হয়ে যাবে। মাইকেল মোরেটির সামান্যতম ক্ষতি তিনি করতে পারবেন না। তিনি হতাশ হলেন। পরক্ষণেই এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন, মোরেটি তার হাত ফসকে: চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু মিস জেনিফার পার্কার আছে তার হাতের মুঠোয়। যে অপূরণীয় ক্ষতি সে করেছে, তার শাস্তি ভোগ তাকে করতেই হবে। সুদে আসলে তিনি সব আদায় করে নেবেন।
আসামীকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হল। বিচারক তার রায় শোনালেন–জুরীদেরও মামলা খারিজ করে দেবার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ হুজুর। আসামী পক্ষের উকিল টমাস কোলফ্যাক্স মাথা নীচু করে অভিবাদন জানাল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে জয়ের উল্লাসের প্রকাশ নেই।
আর যদি কিছু বলার না থাকে তা হলে–
বিচারককে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ডি সিলভা বললেন–এখনও অনেক কিছু বলার আছে হুজুর। শেষ হয়নি কিছুই। তারপর তিনি জেনিফারের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, গোপন সাক্ষীকে প্রভাবিত করা, এবং আদালতের কাজে বাধাদানের প্রচেষ্টার অভিযোগে আমি এই যুবতীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার আর্জি জানাচ্ছি। রাগে তখনও ডি সিলভা ফুলছেন।
জেনিফারও রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আপনি যে সমস্ত অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে করেছেন সেগুলো একটাও আমি করিনি। জেনিফারের গলায় জোরালো প্রতিবাদী সুর। আপনি কোন কিছু প্রমাণ করতে পারবেন না। না বুঝে আমি একটা কাজ করে ফেলেছি, সেটাই আমার অপরাধ। তবে আবার বলছি, এই কাজের জন্য আমাকে কোনো ঘুষ দেওয়া হয়নি। আমি ধরে নিয়েছিলাম, প্যাকেটটা পৌঁছে দেওয়া মানে, আপনার নির্দেশ পালন করা। এছাড়া আর কিছু নয়।
–আপনি কী ভাবছেন জানি না, বিচারক বলে উঠলেন, তবে পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়। জেনিফারের দিকে তাকালেন তিনি–আমি চাই, ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখা হোক এবং প্রয়োজনে আপনার আইনজীবীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে এবং কোনো আদালতে আপনি যাতে ওকালতি করতে না পারেন, সরকারী তরফে আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।
বিচারকের মুখ থেকে একথা শুনতে হবে বলে জেনিফার আশা করেনি। সে যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিল। বলল–ধর্মবতার, আমি…
বিচারক তার কোনো কথা না শুনে আদালতের কাজ বন্ধ করে দিলেন।
জেনিফার অবাক এবং হতভম্ব। সে ওই নির্মম ও নিষ্ঠুর মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। না, এই মুহূর্তে তার কথা কেউ শুনবে না।
জেনিফারের বলার অপেক্ষা রাখে না ক্যানারি পাখিটা। বিচারকের ডেস্কের ওপর সে পড়ে আছে। মরণের মধ্যে দিয়ে সে যা কিছু বলার বলে গেছে।
–সেদিন সন্ধ্যেবেলা। টিভি, রেডিওর খবরে দেখা গেল জেনিফার পার্কারের ছবি। সেদিন জেনিফার যেন একটা তাজা খবর। চারদিকে রটে গেল, ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির সহকারী জেনিফার পার্কার এক রাজসাক্ষীকে একটি ঘাড় মটকানো ক্যানারি পাখি দিয়েছে। টিভি স্কিনে ফুটে উঠেছে–জজ ওয়াল্ডম্যানের ঘর থেকে জেনিফার পার্কার বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখে বিভিন্ন গণমাধ্যম তার দিকে ছুটে আসছে। সে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।
তখন কাগজ, টিভি, রেডিওর ক্যামেরাম্যান ও রিপোর্টারদের প্রশ্নের বিষতীর তার দিকে ছুটে আসছে।
মিস পার্কার, হলদে ক্যানারি পাখিটা আপনি কোথায় পেলেন?
–মাইকেল মোরেটির সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
–আপনি কি জানতেন, এই মামলায় রবার্ট ডি সিলভা জয় লাভ করলে তিনি আগামী গভর্নর হবেন?
ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি আপনার বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেছেন, আপনি যাতে কোনো কোর্টে কাজ করতে না পারেন, তার ব্যবস্থা করবেন। আপনি কি এর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে জেনিফারের কান তখন ঝালাপালা কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্যও তার দুটি ঠোঁট ফাঁক করেনি।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা।
টনিজ প্লেস রেস্তোরাঁ।
মাইকেল মোরেটি তার দলের সাগরেদদের নিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন। অবশ্য এই হোটেলের মালিক তিনি নিজেই। মামলায় তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। সেই উপলক্ষে চলল মদের ফোয়ারা। সবাই গলা পর্যন্ত মদ খেল। আনন্দ ফুর্তি করল।
মাইকেল মোরেটি বসল বারে টিভির সামনে। মদের গ্লাস হাতে। চোখ টিভির সাদা পর্দায়, হাতের গ্লাস তুলে ধরলেন। মনে মনে জেনিফারকে অভিবাদন জানালেন। তারপর ঠোঁট রাখলেন গ্লাসে।
উকিল মহলে আজকের ঘটনাটা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তারা দ্বিধাবিভক্ত। একদল জেনিফারকে ঘুষ দিয়ে মাফিয়ারা কাজটা করে নিয়েছে। আর একদলের বিশ্বাস, িেলফার থাকার নিরাপরাধ, সে পরিস্থিতির শিকার। তবে তারা একটা ব্যাপারে একমত–জেনিফার পার্কার আর নিজের পেশায় ফিরতে পারবে না। দেশের কোনো আদালতে সে কাজ করতে পারবে না।
ওয়াশিংটনের একটি ছোটো শহর, নাম কেলসো।
এখানেই জেনিফারের জন্ম হয়। তার বাবা অ্যাবনার পার্কার পেশায় আইনজীবী। তিন জাতি–ইংরেজ, আইরিশ ও স্কটিশ-এর রক্তধারা তার শরীরে প্রবাহিত। মাঝারি উচ্চতা, কালো চুল মাথায়। ঘন সবুজ দুটি চোখের তারা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আবেগি ও অনুভূতিপ্রবণ। আইনের প্রতি তিনি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তবে অর্থ রোজগারের ব্যাপারে তার আগ্রহ বিশেষ দেখা যায়নি। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তিনি মনে মনে আগ্রহী ছিলেন। কাজের শত ব্যস্ততার মধ্যে তিনি কিন্তু মেয়ে জেনিফারের জন্য সময় বের করে নিতেন। মেয়ের সঙ্গে আইন বিষয়ক আলোচনা করতেন। তার মক্কেলদের হাজার রকম সমস্যা। তিনি সহজ করে সেইসব মামলার আনুপূর্বিক বিবরণ শোনাতেন। বড়ো হয়ে জেনিফার বুঝতে পেরেছিল, বাবা নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বলে ও ভাবের আদান-প্রদান করে সময় কাটাতেন।
জেনিফারের মা ছিলেন খুব সুন্দরী। অথচ তার স্বভাব ছিল বাবা অ্যাবনারের বিপরীত। তিনি বাড়িতে বেশী সময় থাকতেন না, বাইরে কেটে যেত। দিনরাত কী নিয়ে মা অত ব্যস্ত থাকত, সে রহস্য জেনিফারের কাছে আজও অজানা।
স্কুল ছুটির পর জেনিফার বাবার কাছে চলে যেত আদালতে। বাবা কাজকর্ম করত। সে নিবিষ্ট মনে সেগুলো লক্ষ্য করত। দেখত, বাবা তাঁর মক্কেলদের নিয়ে নানা জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। সে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করত। বাবার মক্কেলরা অবশ্য মনে মনে জানত অ্যাবনার উকিলের মেয়ে জেনিফার ভবিষ্যতে ওকালতি পেশাকেই বেছে নেবে, তাই তারা এ বিষয়ে বাবাকে কোনো কথা বলত না।
আইন শাস্ত্র জেনিফারের কাছে ছিল প্রথম প্রেম, ছোট্ট বয়স থেকেই। ফলে যে বছর সে পনেরোতে পড়ল, সেই বছরই সে আইনের জগতে প্রাথমিক অধিকার অর্জন করল। এই বয়সে অন্যান্য কিশোরী মেয়েরা ভালোবাসার প্রেমে পড়ে, সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য মন উসখুশ করে। অথচ জেনিফার। সে তখন গরমের ছুটি কাটাচ্ছে। বাবার কাছে, তার কাজে নানাভাবে সাহায্য করছে। সে শিখেছিল ব্রিফ আর উইল পড়ার ধরন।
জেনিফার বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোত না। অবশ্য কিছু ছেলে তাকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তার ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করেছিল। কিন্তু জেনিফার কাউকে। পাত্তা দেয়নি।
মেয়ের এমন ভাব দেখে বাবা অবাক হতেন। সমবয়সী ছেলেদের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাবে জেনিফার বলেছিল, বাবা, ওরা সবাই ছেলেমানুষ। কাঁচা বয়স, আমার ওদের ঠিক ভালোলাগে না।
জেনিফারের মনে একটা ধারণা ছিল, তার স্বামী হবে তার বাবার মতোই এক আইনজীবী।
ষোলো বছর বয়সে জেনিফারের জীবনে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। এর জন্য সে মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না। আঠারো বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে তার মা বাড়ি ত্যাগ করল।
অ্যাবনার স্ত্রীর এই আচরণে মনে মনে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিলেন। বাতাসে ভর করে হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ল–অ্যাবনার উকিলের স্ত্রী প্রতিবেশীর আঠারো বছরের ছেলের হাত ধরে ঘর থেকে পালিয়েছে।
সাধারণ মানুষদের চোখে বাবা ছিলেন অত্যন্ত ভাল মানুষ। তারা বাবার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছিল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এর ফল হল উল্টো। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাবা মানসিক দিক থেকে এত আঘাত পেয়েছিলেন যে দুঃখ ভোলার জন্য মদ ধরলেন। জেনিফারও অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু এর ফল হল উল্টো, বাবার ভাঙা সংসার ও মন জোড়া লাগাতে পারেনি। এরপর বাবা মাত্র সাত বছর বেঁচে ছিল।
পরের বছরই স্কুলের পাট শেষ হল জেনিফারের। সে ভাবল, কলেজে ভর্তি হবে না। পুরো সময়টা সে তাহলে বাবার সঙ্গে কাটাতে পারবে। কিন্তু বাবা বেঁকে বসলেন। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন-জেনি, তোমাকে আমার সহকারী হতে হবে। তাই কলেজে ভর্তি হয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে আইনের ডিগ্রিটা নিয়ে নাও।
গ্র্যাজুয়েট হয়ে জেনিফার এল সিয়াটলে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন স্কুলে ভর্তি হল। আইন সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা সে আগেই লাভ করেছিল। তাই সহযোগীদের মতো ফৌজদারী আর দেওয়ানি আইনের হরেক রকম ব্যাখ্যা নিয়ে তাকে চিন্তিত হতে হয়নি। সে পরম নিশ্চিন্ততার মধ্যে তখন দিন কাটাচ্ছে। সে থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরিতে। সেখানকার একটি লাইব্রেরিতে সে একটা কাজ পেল।
সিয়াটল জায়গাটার সাথে সে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল। দুজন সহপাঠীর সঙ্গে তার বেশ আন্তরিক হৃদ্যতা তৈরী হয়েছিল–আমিনি উইলিয়ামস আর জোসেফাইন কলিন্স।
রবিবার এবং যে কোনো ছুটির দিনে তারা তিনজনে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ত। শহরে মাঝখানে ছিল গ্রিন লেক, সেখানে তারা নৌকা বাইত। কখনও বা লেক ওয়াশিংটনে চলে যেত। গোল্ড কাপ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত। এখানে হেসটি টেসটি নামে একটি স্ন্যাকসের দোকান ছিল। এখানকার আলুভাজা ছিল খুব বিখ্যাত। তিন জনে হৈ-হৈ করে সেই দোকানে গিয়ে ঢুকত।
এই সময় দুজন পুরুষ তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। নাম নোয়া লারকিন, মেডিকেল নিয়ে পড়াশুনা করছে। দ্বিতীয় জন নোয়ার সহপাঠী, বেন মুনরো। জেনিফার তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে যেত, তাদেরকে সঙ্গ দিত। কিন্তু নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে। তার কাছে প্রেম ও ভালোবাসার চেয়ে পড়াশুনা ও ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আর একটা টার্ম বাকি আছে, জেনিফারের বাবা মারা গেলেন। সারা শহর সেদিন উজিয়ে এসেছিল তার মৃত বাবাকে শেষ দেখা দেখবে বলে। প্রায় শখানেক লোক তার শব যাত্রায় যোগ দিয়েছিল।
বাবার মৃত্যুতে শোকে তার বুক ফেটে গেল। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করল না। সে হারাল তার বাবাকে, সে হারাল তার শিক্ষক, পথ প্রদর্শক এবং গুরুস্থানীয় এক মানুষকে।
বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে জেনিফার সিয়াটল ফিরে এল। বাবা তার একমাত্র কন্যা সন্তানের জন্য রেখে গিয়েছিলেন মাত্র এক হাজার ডলার। নিজের জীবন চলবে কী করে? তার ভবিষ্যতই বা কী? নানা প্রশ্ন তখন তার মনে ভিড় জমিয়েছে। সে কি কেলসো তে ফিরে যাবে? ওখানে ওকালতি করবে শুধু? না, তা সম্ভব নয়। তাকে দেখিয়ে সকলে আঙুল তুলে বলবে, ওর মা ছেলের বয়সী একটা পুরুষকে নিয়ে কেটে পড়েছিল, স্বামী সংসার, এমনকী মেয়েটার কথাও ভাবেনি।
ল স্কুলে তার রেজাল্ট প্রথম থেকেই ভালো ছিল। তাই দেশের বিভিন্ন আইন প্রতিষ্ঠান থেকে সে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেবার ডাক পেল।
ওই কলেজে ফৌজদারি বা ক্রিমিন্যাল আইনের অধ্যাপক ছিলেন ওয়ারেন ওকস। তিনিই একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এদেশে কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের কাজ পাওয়া সহজ কথা নয়।
পড়াশুনা শেষ হল, এবার কী করবে সে, একথাই ভাবছিল জেনিফার। সেদিন ক্লাস শেষে প্রফেসার ওকস তাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালেন।
জেনিফার তার ঘরে গেল।
-শোনো জেনি, ম্যানহাটানের ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেরাটিকে তারা সহযোগী হিসাবে নিতে চাইছেন। তিনি চিঠি পাঠিয়েছেন। তুমি রাজী আছে চাকরিটা নিতে?
জেনিফারের মনে তখন বাঁধভাঙা আনন্দ। এ তো অভাবিত, মেঘ না চাইতেই জল। ম্যানহাটান মানে নিউইয়ক। তার চোখের সামনে ফুটে উঠল সেই দৃশ্য, ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস ঘরে বসে সে কাজ করছে। সহসা তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল ইয়েস স্যার, আমি চাকরিটা নেব।
প্লেনে করে জেনিফার নিউইয়র্কে এল। বার-এর পরীক্ষা দিল, কেলসোতে ফিরে এল। বাবার অফিস পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। বাবার এই অফিসের সঙ্গে তার জীবনের কত স্মৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আইন শাস্ত্রে তার হাতেখড়ি হয়েছিল তার বাবার কাছেই।
তখন জেনিফার বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন পাঠাগারে একটা চাকরি করছে। বার-এর পরীক্ষায় পাশ করার খবরটা সে পেল।
অবশ্য এ ব্যাপারে জেনিফারের কোনো উদ্বেগ ছিল না। সে জানত, এই পরীক্ষায় পাশ সে করবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। মনে পড়ে গেল প্রফেসার ওকসের কথাগুলি আমাদের দেশে যত কঠিন পরীক্ষা আছে তার মধ্যে একটি হল এটি।
ওই দিনই জেনিফারের কাছে আর একটি সুখবর এসে পৌঁছল। নিউইয়র্কের ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস থেকে কাজে যোগ দেবার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে।
এক বুক আশা নিয়ে জেনিফার পার্কার ম্যানহাটানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
.
থার্ড এভিনিউর একেবারে শেষ সীমানায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিল সে। একটা মাত্র ঘর। বড়ো কৌচ আছে একটা–শোওয়া এবং বসার জন্য। ঘরে মাত্র একটা জানলা। বহু বছর আগে জানলায় কালো রঙের পোচ দেওয়া হয়েছিল, তা আজ প্রকটিত। ঘরের অন্য সব আসবাবের দিকে তাকিয়ে জেনিফারের চোখ ফেটে জল এল।
নিজেকে প্রবোধ দিল সে, মাত্র তো কটা দিন। নিজের পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ভালো কোনো জায়গায় চলে যাব। এ ব্যবস্থা তো চিরস্থায়ী নয়।
কিন্তু তার এসব কল্পনা যে অবাস্তব, তা সে কখনো ভাবেনি। নাহলে মাত্র বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে তার স্বপ্নের মিনার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে? প্রথম দিন কাজে যোগ দিতে এসে যে বিশ্রী ঘটনার মুখোমুখি সে হয়েছে, তা তো আগেই বলা হয়েছে। মিথ্যে দুর্নাম মাথায় নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হল ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির অফিস থেকে। এবার যে কোনোদিন তার নাম বার কাউন্সিল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। তার মানে জীবনে কোনোদিন কোথাও সে উকিলগিরি করতে পারবে না।
টেলিভিশনের স্ক্রিনে জেনিফারের ছবি, ম্যাগাজিনে জেনিফারের ফটো, রেডিওতে জেনিফারের খবর–ওঃ অসহ্য। জেনিফার ম্যাগাজিন পড়া, টিভি দেখা, রেডিও শোনা বন্ধ করে দিল। পথে ঘাটে দোকানবাজারে কেবল একটাই আলোচনা-জেনিফার। তার। দিকে লোকেরা কৌতূহলী চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। এই উপদ্রবের হাত থেকে নিস্তার পেতে সে বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিল। সব সময় দরজা জানলা বন্ধ করে ঘুপচি ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে রইল।
বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে দিল জেনিফার। ঠিক করল, ললাটাকম্বল নিয়ে ওয়াশিংটনে ফিরে যাবে। ওকালতি নয়, অন্য কোনো পেশা বেছে নিতে হবে। তার মনে তখন হাজার চিন্তার আনাগোনা। এইভাবে কি জীবন বাঁচে, এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো। আচ্ছ, যদি রবার্ট ডি সিলভাকে সব কিছু খোলাখুলি বলে আরেকবার সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রার্থনা জানায়? উনি কি তার অনুরোধ রাখবেন না?
চিঠি লিখতে বসল সে। একটার পর একটা কাগজ নষ্ট হল। খসড়া লেখা হল। অথচ শেষ পর্যন্ত সেটা আর পাঠানো হল না।
এইভাবে দিন কাটাতে কাটাতে জেনিফার হাঁপিয়ে উঠল। বন্ধু বান্ধবহীন। এত বড়ো শহরে সে একা। সে যেন সমাজচ্যুত এক জীব। বন্ধ ঘরের মধ্যে তার কেটে যেত সারাদিন, রাতের বেলা সে পথে বেরোত। নির্জন রাস্তা। একাকী হাঁটত। এমনকী, সমাজের নীচুতলার হতভাগা মানুষগুলো যাদের রাস্তাই আশ্রয়, তারা পর্যন্ত জেনিফারের থেকে দূরে দূরে থাকত। হয়তো তার দুচোখে তারা তাদের নিজেদের একাকিত্ব আর হতাশার ছবি প্রত্যক্ষ করেছিল।
রাতের বেলা নির্জন বড়ো রাস্তা ধরে জেনিফার আপন মনে. ধীর পায়ে হাঁটত, আর ভাবত, সেদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা। ভাবত আর ইচ্ছে মতো ঘটনাটির পরিণতি পাল্টে দিত কল্পনায়। সে কল্পনা করত লোকটি তার হাতে সেদিন একটা বড়ো খাম তুলে দিয়েছিল স্টেলাকে দেবার জন্য। সে লোকটির পরিচয় পত্র দেখতে চাইল। লোকটি তখন ভয়ে চম্পট দিল।
আবার তার কল্পনায় ভেসে উঠল, খামের মুখ খুলতেই দেখা গেল ভেতরে একটা ক্যানারি পাখি ঘাড় মটকে পড়ে আছে। লোকটাকে গ্রেপ্তার করার জন্য তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
না, এসব কিছুই সেদিন ঘটেনি। সেদিন যা ঘটেছিল, তা স্রেফ তার বোকামির ফল। যা তার ভবিষ্যতকে বারোটা পাঁচ করে দিয়েছে।
জেনিফারের যেন চমক ভাঙল-কে বলেছে সে আর ওকালতি করতে পারবে না? ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি? না কি খবরের কাগজ? সে এখনও সম্পূর্ণভাবে একজন আইনজীবী। যতক্ষণ না সরকারীভাবে তার ওকালতি করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ সে পুরোদস্তুর এ্যাটর্নি।
নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা পেল সে মনের গভীরে। একটি চাকরি করার জন্য অনেক নামী আইন প্রতিষ্ঠান তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। সে খুঁজে খুঁজে সেইসব প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বর বের করে যোগাযোগ করল। কিন্তু হায়, তার সে গুড়ে বালি। তাদের মধ্যে অনেকেই অফিসে নেই। সে তার নিজের নম্বর দিয়েছিল, পরে যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু কোনো ফোন পায়নি সে। তার বুঝতে দেরী হল না, ফৌজদারী আদালতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এর জন্য দায়ী। কোলাহল থেমে গেছে, কিন্তু তার রেশ সবাইকে এখনও ছুঁয়ে আছে।
কিন্তু জেনিফার দমবার পাত্রী নয়। হতাশা আর অপমানকে অগ্রাহ্য করে সে তার প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। জেনিফার একজন পেশাদার আইনজীবী হতে চাইছে, ওকালতি করাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এতএব, যতক্ষণ না কেউ তাকে বাধা দেবে, ততক্ষণ সে তার এই চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
ম্যানহাটানের সবকটা ছোটো বড়ো আইন প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেন্টু মারল। রিসেপসনিস্টের কাছে নিজের পরিচয় দিল। পার্সোনেল বিভাগের বড়ো কর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাকে হতাশ হতে হয়েছে। যদি বা দু-একজন তার সঙ্গে দেখা করেছে। অবশেষে এমন ব্যবহার করেছে যে, নিছক কৌতূহল মেটানোর জন্যই তারা তার সাথে কথা বলেছে। তাকে বলা হল, শূন্যপদ খালি নেই।
কেটে গেল বিয়াল্লিশ দিন, দেড় মাস। ধীরে ধীরে জেনিফারের ট্যাকে টান পড়তে শুরু করেছে। সে ঠিক করল, আরও সস্তার কোনো ঘরে উঠে যাবে। কিন্তু পেল না। ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ খাওয়া বন্ধ করে পয়সা বাঁচাল। প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য সস্তার ডিনার খেত। কিন্তু ওই নিকৃষ্ট ও জঘন্য রুচির খাবার তার গলা দিয়ে নামত না। স্যালাড খেয়ে খেয়ে সে পেট ভরাত। আর বিয়ার। অবশ্য বিয়ার তার অপছন্দের পানীয়। কিন্তু ওই বিয়ার তার খিদে মেটাতে পুরোপুরি সাহায্য করছে।
জেনিফার নামী প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে আশা ভরসা ছেড়ে দিল। সে ছুটল অনামী প্রতিষ্ঠানগুলিতে। সেখানেও তথৈবচ। চাকরি জুটল না। কিন্তু হার মানবে না সে। সে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। উৎসাহ বহু গুণ বেড়ে গেল। ওকালতি সে করবেই। স্থির করল, নিজেই একটা আইনের অফিস খুলবে। কিন্তু ঘর ভাড়া, বইপত্র, আসবাব, সেক্রেটারী, টেলিফোন, কাগজকলম, সীলমোহর–এসবের খরচ? কোথা থেকে পাবে? প্রায় দশ হাজার ডলার। নাঃ, এ ভাবনাও তাকে ত্যাগ করতে হল। যদি কারও অফিসে ভাড়া দিয়ে নিজের স্বাধীন ব্যবসা শুরু করতে পারে, তা হলে কিছু একটা হবে।
অতএব খবরের কাগজের পাতা উল্টেপাল্টে দেখে একটা বিজ্ঞাপনঅফিসের জন্য জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়।
ঠিকানাটা ছিল ব্রডওয়ে এলাকার। বহু পুরোনো হাড় জিরজিরে একটা বাড়ি। জেনিফার অফিসের নম্বর মিলিয়ে এগারো তলায় এসে হাজির হল। দরজার ওপর দুটো সাইনবোর্ড কেনেস বেইলি-পেশাদার বেসরকারী গোয়েন্দা। তার নীচে রকফেলার কালেকশন এজেন্সি। অনেকগুলো অক্ষর সাইনবোর্ড থেকে উঠে গেছে।
দরজা ঠেলল জেনিফার, ঘরে ঢুকল। জানলা বিহীন, তিনটে ক্ষতবিক্ষত নড়বড়ে টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার। পাশাপাশি দুটি টেবিলে দুজন লোক বসে।
মধ্যবয়সী টাকমাথাওয়ালা লোকটি কয়েকটি কাগজে তাকিয়ে আছে, নিবিষ্ট মনে। পরনের পোশাক খুব একটা ধোপদুরস্ত নয়।
আর দ্বিতীয় লোকটির কানে রিসিভার তিরিশের কোটা পার হয়েছে, তামাটে রঙের চুল, নীল দুটি চোখের তারা। ফ্যাকাশে গায়ের চামড়া, তারা ওপর ছোপছোপ দাগ। টাইট জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরনে। পায়ে মোজা আর ক্যানভাসের জুতো।
মিসেস ভেসার, নিশ্চিন্তে থাকুন। লোকটি ফোনে বলছে, আপনি আমাদের মতো সেরা গোয়েন্দার ওপর কেসটা যখন দিয়েছেন, তখন আস্থা রাখতে পারেন। তদন্ত চলছে, যে কোনো দিন আপনার স্বামীর খবর পেয়ে যাবেন।
কিন্তু জানেন তো, খোঁজাখুজির জন্য কত টাকা খরচ হয়। আমাদের আরো কিছু টাকা লাগবে। নানা, ডাকে নয়। ও সব ভীষণ ঝামেলা। বরং হাতে-হাতে টাকাটা দেওয়া ভালো। আজ একটা কাজে ও পাশেই যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে আমি দেখা করে নেব। ঠিক আছে, এখন রাখছি।
রিসিভার নামাল, চোখ তুলল, সে দেখতে পেল জেনিফারকে, চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়াল। স্মিত হাসি দেখা দিল ঠোঁটে।
আমি কেনেথ বেইলি। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
তখন সেই ঘরে জেনিফার যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। সে স্পষ্ট জানাল–আপনারা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।
এবার বুঝতে পেরেছি, কেনেথের চোখে বিস্ময়। এতক্ষণে টাকমাথা কাগজের ওপর থেকে চোখ সরাল। জেনিফারের দিকে সে দুটি ঘুরে এল।
কেনেথ তাকে দেখিয়ে বলল–অটো ওয়েনজেল, রক ফেলার কালেকশান এজেন্সির মালিক।
–হ্যালো, অটো ওয়েনজেলকে শুভেচ্ছা জানাল জেনিফার। এবার কেনেথ বেইলিকে জিজ্ঞাসা করল–বেসরকারী গোয়েন্দা তাহলে আপনি?
-হ্যাঁ, কিন্তু আপনার ব্যবসা?
আমার? জেনিফারের জবাব, আমার পেশা ওকালতি। আমি একজন উকিল।
কেনেথ বেইলি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। মনে হল, তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, জেনিফার একজন উকিল। –আপনি কি সত্যিই এখানে অফিস ভাড়া নিতে এসেছেন?
জেনিফারের দৃষ্টি একবার ঘুরে ফিরল ভ্যাপসা ওই ঘরের চারদিকে। তার কল্পনায় ভেসে উঠল একটি ছবি-দুজন পুরুষের মাঝখানে একটি মহিলা বসে কাজ করছে।
–না, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। আরও দু-একটা জায়গা দেখি, তারপর না হয়–
প্রত্যেক মাসে নব্বই ডলার ভাড়া।
নব্বই ডলার? তাহলে আর এই ছোট্ট ঘর কেন, গোটা বাড়িটাই কিনে নিতে পারি।
জেনিফার ফিরে আসার জন্য পা বাড়াল।
যাচ্ছেন কোথায়। দাঁড়ান একটু।
জেনিফার থামকে দাঁড়াল। কেনেথ বেইলির দিকে ঘুরে তাকাল।
–একটু কম-সম করে দেবেন। কেনেথ গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, নব্বই দিতে হবে না। ষাট দিলেই হবে। আপনার পসার জমুক। তারপর না হয় ভাড়া বাড়ানোর কথা ভাবা যাবে।
জেনিফার খুব ভালো করে জানে, এর থেকে সস্তা দামে ঘর পাওয়া যাবে না। আবার এই ভ্যাপসা ঘরে মক্কেল পাওয়াও কষ্টজনক। তাছাড়া তার কাছে ষাট ডলারও নেই।
–বেশ, জেনিফার জবাব দিল। আমি রাজী।
-দেখবেন, এখানে আপনার কারবার কেমন রম করে চলবে। কেনেথ বেইলি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। আপনার দপ্তর কবে আনবেন?
দপ্তর এসে গেছে। আপনার সামনে।
কেনেথ বেইলি নিজে হাতে একটা ছোটো সাইন বোর্ডে লিখল–জেনিফার পার্কার এ্যাটর্নি বার ল। সেটা দরজার বাইরে টাঙিয়ে দিল।
সাইন বোর্ডের দিকে জেনিফার অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মুগ্ধ দৃষ্টিতে। কেমন একটা মিশ্র অনুভূতি তার মনে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাকে দুঃসময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে হয়েছে। কিন্তু কখনও কল্পনা করতে পারেনি, এক বেসরকারী গোয়েন্দা আর এক বিল কালেকটরের নামের নীচে তার নামের সাইনবোর্ড ঝুলবে। একই ঘরে বসে তাকে মক্কেলের সাথে কথা বলতে হবে। অবশ্য সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদার দিক থেকে সে ওদের থেকে অনেক উঁচুতে। তবে একটা কথা ভেবে জেনিফার মনে মনে গর্বিত হল–এত দিনে সে এ্যাটর্নির স্বীকৃতি পেয়েছে, চাকরির জন্য আর তাকে দোরে দোরে ঘুরতে হবে না। সে আজ এক স্বাধীন ব্যবসায়ী, স্বাধীন আইনজীবী, ওকালতিই যার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ও পেশা।
স্বাধীন ব্যবসা তো হল, কিন্তু মক্কেল কোথায়? তবে পসার যতদিন না জমে, ততদিন তাকে কষ্ট করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনের খরচ থেকে কতগুলোকে বাদ দিতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তাই তাকে করতে হবে। অতএব দুপুরের লাঞ্চ গেল বন্ধ হয়ে। টোস্ট আর কফি খেয়ে ব্রেকফাস্ট সারত। সারাদিন আর কিছু খেত না। রাতের ডিনারে কেবল পাউরুটি আর আলুর দম।
নটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে জেনিফার তার অফিসে চলে আসত। সারাদিন মক্কেলের প্রতীক্ষায় হাপিত্যেশ করে কেটে যেত। অথচ ওরা? ওরা কত ব্যস্ত। টেলিফোনে মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলে।
জেনিফার ওদের কথা শোনে–কোথায় কার বউ, অথবা স্বামী কিংবা ছেলেমেয়ে বাড়ি থেকে না-বলে পালিয়েছে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রথমটায় কেনেথ বেইলিকে দেখে জেনিফারের মনে হয়েছিল, লোকটা একটা ধাপ্পাবাজ। মিথ্যে আশা দিয়ে টাকা পকেটে পোরার ধান্দা। কিন্তু তার ধারণা ভুল। –লোকটা চালাক এবং পরিশ্রমী। মক্কেলদের কাজ করে দেয়।
আর অটো ওয়েনজেল? লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না জেনিফার। ঘনঘন টেলিফোন আসে। কথা বলে, আর খসখস করে কাগজে কী সব লেখে। তারপরেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। কোথা থেকে ঘুরে ফিরে ঘন্টা খানেক বাদে অফিসে এসে ঢোকে।
কিছুদিন বাদে জেনিফার জানতে পারল, বিভিন্ন কালেকশন এজেন্সির হয়ে অটো কাজ করে। গাড়ি, বাড়ি, ওয়াশিং মেশিন কিনে যারা কিস্তির টাকা শোধ করতে পারেনি, তাদের কাছ থেকে ওইসব জিনিসগুলি সংগ্রহ করে আনাই ওর কাজ।
–আপনি মক্কেল পাচ্ছেন? বেইলির কৌতূহলী দুটি চোখ।
ব্যবস্থা ঠিকই একটা হবে। জেনিফার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
–হাল ছাড়বেন না যেন। কেনেথ বলল, ভুল সবারই হতে পারে।
কথাটা শুনে জেনিফারের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। ধূর্ত লোক, মক্কেল যে পাচ্ছে না সে, সেটা টের পেয়ে গেছে। হয়তো তার দুর্নামের কাহিনীও সে জেনেছে।
কেনেথ বেইলি একটা বড়ো রোস্ট বীফ স্যান্ডউইচ প্যাকেট থেকে বের করল। জেনিফার কে সে আন্তরিকতার সুরে বলল–নেবেন একটু? খেয়ে দেখুন।
খাবারটা দেখেই জেনিফার বুঝেছিল, খুব সুস্বাদু। খাওয়ার লোভ হচ্ছে বটে। তাসত্ত্বেও নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, না, ধন্যবাদ। লাঞ্চে কিছু খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই।
খাবারের একটা টুকরো কেনেথ গালে দিল। জেনিফার তাকিয়ে আছে সে দিকে। কেনেথ আড়চোখে লক্ষ্য করল। সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল–আপনি কি সত্যি বলছেন?
ধন্যবাদ। জেনিফার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমাকে এখুনি বেরোতে হবে, একজনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
জেনিফারের ফিরে যাওয়ার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকাল কেনেথ। সে নিজেকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করে মুখ দেখলেই যে কোনো মানুষের স্বভাব চরিত্র বলে দিতে পারে। অথচ? অথচ জেনিফার তাকে এ ব্যাপারে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েটা কী ধরনের,, আন্দাজ করতে পারছে না সে। খবরের কাগজ পড়ে আর টেলিভিশন দেখে সে নিশ্চিত হয়েছিল যে মাইকেল মোরেটির বিরুদ্ধে সরকার যে খুনের মামলা রুজু করেছিল, সেটা ভেঙে দেওয়ার জন্য জেনিফারকে কেউ ঘুষ দিয়েছিল। কিন্তু জেনিফারকে দেখে তা তো মনে হয় না। তার ওঠাবসা বা হাবভাবে তার কোনো চিহ্ন নেই। ও আদৌ ঘুষ নিয়েছিল কিনা, সেটাই সন্দেহ। মেয়েদের কেনেথ খুব একটা সুনজরে দেখে না। অসুখী দাম্পত্য জীবন তার। কিন্তু জেনিফার তার চোখে অন্য সাধারণ পাঁচটা মেয়ের মতো নয়, সে স্বতন্ত্র এক নারীসত্তা।
দিন কাটছে, জেনিফারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। শেষ সম্বল আঠারো ডলার ঘর ভাড়ার টাকা বাকি পড়ে গেছে। আর কয়েকদিন বাদে অফিস ঘরের ভাড়া দিতে হবে। নিউইয়র্কে থাকার ক্ষমতা, এমন কী খেয়ে বেঁচে থাকবে, সে সম্বলও নেই।
কিন্তু এভাবে হেরে গেলে চলবে না, বাঁচতেই হবে তাকে। আবার সে নামী-অনামী আইন প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করল–একটা চাকরি যদি কোনো রকমে জোটাতে পারে, এই আশায়? সে কখনও অফিস ঘরে বসে এসব ফোন করত না। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। কেউ তাকে চাকরি দিতে চাইছে না। কেলসোতেই তাকে ফিরে যেতে হবে। যদি কোনো আইনবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ পায়। নয়তো বাবার কোনো উকিল বন্ধুর কাছে যাবে, তার সেক্রেটারী হয়ে কাজ করবে। অবশ্য ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও সম্মানজনক নয়, তবুও এছাড়া কোনো উপায় নেই।
জেনিফার পার্কারকে ভাগ্যের কাছে মাথা নোয়াতে হবে। নত মস্তকে নিউইয়র্ক ছাড়তে হবে। বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু কীভাবে? খরচের ব্যাপার রয়েছে। সে নিউইয়র্ক পোস্ট পত্রিকা ঘেঁটে একটা বিজ্ঞাপন বের করল। সিয়াটলে ফিরে যাবার জন্য সঙ্গী চাই। যে ভাড়া ভাগাভাগি করতে চায়।
জেনিফার ফোন করল। কিন্তু উত্তর পেল না। সে ঠিক করল, পরদিন সকালবেলা আবার ওই নম্বরে ফোন করবে।
পরদিন সকালে জেনিফার তার অফিসে এল, শেষবারের মতো ভেতরে কেনেথ বেইলি বসে আছে। টেলিফোনে কথা বলছে কার সঙ্গে, অটো ওয়েনজেল নেই।
কেনেথের পরনে নীলরঙের জিনসের টাউজার্স আর ভি কলারের একটা কাশ্মিরী সোয়েটার।
আপনার স্ত্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে একটা কথা কী জানেন, কেনেথ ফোনে মক্কেলকে বলছে, উনি জানিয়েছে, আর বাড়িমুখো হবে না। তবে আপনাকে আমি ঠিকানা বলে দেব। আপনি যাবেন, তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।
একটা হোটেলের নাম আর ঠিকানা বলল, যেটা শহরের মাঝখানে অবস্থিত। ফোন নামিয়ে রাখল।
তারপর জেনিফারের দিকে চোখ তুলে বলল–আজ দেরী দেখছি, কারণ কী?
মি. বেইলি, জেনিফারে ঢোক গিলে বলল, আমাকে বোধহয় তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখান থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিন, আমি সম্ভব মতো তাড়াতাড়ি আপনার ভাড়াটা পাঠিয়ে দেব।
কেনেথ বেইলি তাকিয়ে আছে জেনিফারের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে খুব ভালোভাবে জরিপ করল।
জেনিফার তার এই আচরণে কেমন অস্বস্তিবোধ করল–মিস্টার বেইলি, আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না যে।
–আপনি সত্যিই কি ওয়াশিংটনে চলে যাবেন?
জেনিফার নীরবে ঘাড় নাড়ল।
–বেশ। কেনেথ বেইলি বলতে থাকে, যাবার আগে, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কাজ করে দেবেন? আমার এক উকিল বন্ধু একটা কাজ করে দেওয়ার জন্য কয়েকদিন ধরে আমাকে খুব পীড়াপীড়ি করছে। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমি কত ব্যস্ত। সময় পাই না। কয়েকজন সাক্ষীর নামে শপিনা পাঠাতে হবে। প্রত্যেকটা শপিনার জন্য সাড়ে বারো ডলার দিতে রাজী আছে সে, সেইসঙ্গে গাড়ি ভাড়া। বলুন, কাজটা আপনি আমার হয়ে করে দেবেন?
এক ঘণ্টা বাদে জেনিফার পার্কার গিয়ে হাজির হল পিবডি অ্যাণ্ড পিবডির সুসজ্জিত অফিসে। ঠিক এরকম একটা অফিসে কাজ করার স্বপ্ন বহু দিন ধরে দেখে আসছিল সে। অফিসের পেছন দিকে ছোটো একটা কামরায় জেনিফারকে নিয়ে আসা হল, সেখানে যিনি বসেছিলেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারী। জেনিফার দেখল, কাজকর্ম সামলাতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে উঠেছেন তিনি।
কতগুলো শপিনা সেক্রেটারী ওর হাতে তুলে দিল। বলল–ধরুন, এগুলো ঠিকানা মিলিয়ে দিয়ে দেবেন। গাড়িভাড়া আপনি এখান থেকে পাবেন। কতটা পথ গেলেন নোট করে রাখবেন। আপনার গাড়ি আছে?
না, আমার–
কোনো অসুবিধা নেই। সাবওয়ে ধরুন। গাড়িভাড়া যা খরচ হবে আমরা দিয়ে দেব।
–ঠিক আছে।
ব্রংক্স, ব্রুকলিন আর কুইন্স অঞ্চলে শপিনা বিলি করতে করতে সারাদিন কেটে গেল জেনিফার। সন্ধ্যা আটটা বেজে গেল। হাতে পেল পঞ্চাশ ডলার আজকের রোজগার। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এল। ঠান্ডায় হাত-পা যেন বরফ হয়ে গেছে। শরীর ক্লান্ত। তবু মনকে সে সান্ত্বনা দিল, কিছু টাকা রোজগার করতে পেরেছে তো। নিউইয়র্কে এই তার প্রথম উপার্জন। আরও কয়েকটা দিন তাকে শপিনা বিলি করতে যেতে হবে।
কাজটা মোটেও সোজা নয়। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো। কিছুটা লাঞ্ছনা ও অপমানও ভোগ করতে হয়। কেউ কেউ তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ অশ্লীল ইঙ্গিত করেছে, গালিগালাজ করতেও ছাড়েনি। শাপ-শাপান্তের ঢেউ ছুটিয়ে দিয়েছে। হুমকি আর ভয় দেখানোও বাদ যায়নি। তবে এই কাজ করতে এসে এক দারুণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। দুটি বাড়ির দুই পুরুষ তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে অশ্লীল ভাষায় বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে। আবার তাকে শপিনা দিতে যেতে হবে। আবার তাকে ওই বিশ্রী পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহ মিইয়ে গেল, হতাশা চাগাড় দিয়ে উঠল। তবে এইটুকুই সান্ত্বনা, নিউইয়র্কে যতদিন থাকবে, ততদিন আশার একটা ক্ষীণ আলো সে দেখতে পাবে।
গরম জলের টবে সে নিজেকে ডুবিয়ে দিল। উষ্ণ জলধারার পরশ। ক্লান্ত শরীরে যেন আরামের স্পর্শ। স্নান করতে করতে সে ঠিক করল, আজ একটা ভালো রেস্তোরাঁয় যাবে। ডিনার খাবে। সুন্দর পরিষ্কার চাদর দিয়ে টেবিলগুলো ঢাকা থাকবে। হাতের সামনে থাকবে সাদা ধবধবে ন্যাপকিন। মৃদু মৃদু বাজনা বাজবে। সে সাদা ওয়াইন খুব আমেজ করে খাবে, আর
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ। জেনিফারের চিন্তারা তখন শতছিন্ন হয়ে গেছে। সে ঘাবড়ে গেল। গত দুমাসের মধ্যে একবারের জন্য তো কলিংবেলটা বেজে ওঠেনি। নিশ্চয়ই খিটকেলে ল্যান্ডলেডি এসেছে, বকেয়া ভাড়া চাই।
জেনিফারের ওঠার যেন তাড়া নেই। আসলে গরম জলে ডুবে থাকতে তার আরাম লাগছিল। সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে যাবে। সে মরা মাছের মতো পড়ে রইল।
খানিকবাদে আবার কলিংবেল সশব্দে বেজে উঠল। ইচ্ছে করছে না, তবু উঠতে হল। কোনোরকমে স্নানের টব থেকে উঠে গায়ে টেরি ক্লথের একটা চাদর চাপিয়ে সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
কাকে চান?
মিস জেনিফার পার্কার আছেন? দরজার ওপার থেকে একটি পুরুষের গলা শোনা গেল।
-হ্যাঁ, আছেন।
–আমার নাম অ্যাডাম ওয়ার্নার। আমি একজন উকিল।
উকিল? তাকে খুঁজছে? ব্যাপার কী? সিকিউরিটি চেন লাগিয়ে দরজার পাল্লা একটু ফাঁক করল জেনিফার।
পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের এক যুবক। লম্বা, চওড়া কাঁধ, খুব ফর্সা। চোখে চশমা। তার নীলচে ধূসর দুটি চোখের তারায় কৌতূহলের ছোঁয়া, জেনিফার স্পষ্ট দেখতে পেল। পরনে তার দামী পোশাক।
–আমি কি ভেতরে আসতে পারি? বাইরে থেকে অ্যাডাম ওয়ার্নার জানতে চাইল।
না, গুণ্ডা-বদমাস বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে এত দামী স্যুট, ইটালিয়ান গুচ্চি কোম্পানীর দামী জুতো আর নীল টাই থাকত না। আর হাতে নখগুলোও হত নোংরা আর কদর্য।
–এক মিনিট। একটু পিছিয়ে এল জেনিফার। চেন আলগা করল। দরজা সম্পূর্ণ খুলে গেল।
অ্যাডাম ওয়ার্নার ঘরের ভেতরে ঢুকল। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। জেনিফারের বুঝতে বাকি রইল না, এই ভ্যাপসা ঘরে ঢুকে অ্যাডাম মোটেও স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না। হাঁপিয়ে উঠছে যেন। সুখী ও বিলাসবহুল জীবন যাত্রায় উনি যে অভ্যস্ত তা তার চেহারা ও পোশাক-আশাকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
-বলুন মি. ওয়ার্নার–জেনিফার বলল, আপনার প্রয়োজন কী?
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা তীব্র উত্তেজনা অনুভব করল সে। হয়তো কোনো আইন প্রতিষ্ঠান থেকে উনি এসেছেন, ইতিমধ্যে কম জায়গায় তো সে ঘোরাঘুরি করেনি। নিশ্চয়ই বলতে এসেছে, আমাদের প্রতিষ্ঠান আপনাকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। ইস, নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে দুঃখবোধ করল, আগে থেকে জানলে একটা সুন্দর নীল রঙের তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে নিতাম। চুলটা ভালো করে আঁচড়ে নিতাম। আর এখন চুলের যা হাল, ভেজা জবজব করছে।
মিস পার্কার। মিঃ ওয়ার্নার বলতে থাকল–নিউইয়র্ক বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমি আসছি। শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির আমি একজন মেম্বার। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা এবং জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যান চান, বার থেকে আপনার নাম কেটে দিতে। এমনকী ওকালতি পেশা আপনার চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে। এই মর্মে অ্যাপিলেট ডিভিশনের কাছে তারা একটি আবেদন পেশ করেছেন। আপনাকে এই খবরটাই আমি জানাতে এসেছি।
.
ওয়াল স্ট্রিটের তিরিশ নম্বর বাড়ি। নিউইয়র্কের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। মোট একশো পঁচিশজন উকিল এখানে বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। নিডহ্যাম, ফিঞ্চ, পিয়ার্স অ্যান্ড ওয়ার্নারের মতো আরও অনেক অফিস আছে–বাড়ির ওপরতলাটা জুড়ে।
প্রতিষ্ঠানের অন্যতম দুই পার্টনার স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম এবং অ্যাডাম ওয়ার্নার। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও সকালবেলা তারা দুজনে বসে চা খাচ্ছিলেন।
স্টুয়ার্ট নিডহ্যামের বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই। উচ্চাভিলাষী, দেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক নেতা আর উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা আছে। নিজের বুদ্ধি দিয়ে কখনও সখনও তাদের চালনা করার চেষ্টা করেন।
তিরিশের যুবক অ্যাডাম ওয়ার্নার সম্পর্কে নিডহ্যামের ভাগনি-জামাই। অ্যাডাম ওয়ার্নারের বাবা ছিলেন একজন সিনেটর। খুব মেধাবী। কয়েক বছরের মধ্যে আইনি পেশায় খুব নাম করে নিয়েছে। হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে সে গ্র্যাজুয়েট হয়। অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাকরির অফার এসেছিল। কিন্তু সে কোনো ফার্মেই যোগ দেয়নি। তারপর একসময় নিডহ্যাম, ফিঞ্চ অ্যান্ড পিয়ার্স-এ চাকরি নিয়েছিল। সাত বছর ধরে সে খুব মনোযোগ সহকারে কাজ করেছিল। নিজের পারদর্শিতা দেখিয়ে সে আজ এই কোম্পানীর একজন পার্টনার হতে পেরেছে। অ্যাডাম সুপুরুষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। যে কোনো মেয়ে তার চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তাকে কাছে পেতে চায়। এই কারণেই অ্যাডাম কোনো মেয়ে মক্কেলের কাজ নেয় না। ওরা ছলেবলে কৌশলে পুরুষকে তার ফাঁদে পড়তে বাধ্য করে। সে বিবাহিত, স্ত্রী মেরী বেথ। চোদ্দো বছরের দাম্পত্য জীবন। জীবনে স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারীর সঙ্গলাভের প্রত্যাশা করেনি সে।
–অ্যাডাম, আর একটু চা? নিডহ্যাম জানতে চাইল।
না, ধন্যবাদ।
আসলে চা পান করতে অ্যাডামের ভালো লাগে না। এটা একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার। কিন্তু একথা সে মামাশ্বশুর ও পার্টনার স্টুয়ার্ট নিডহ্যামের কাছে ফাস করে না, যদি তিনি চটে যান। তাই গত আট বছর ধরে নিডহ্যামের মন রেখে সে চা পান করে চলেছে।
কাল রাতে কয়েকজন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, নিডহ্যাম বলতে থাকল, ওঁরা চাইছে তোমাকে এবার যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর হবার জন্য ভোটে দাঁড় করাতে।
অ্যাডাম জানে, ওঁরা বলতে কাদের কথা বলছেন নিডহ্যাম। ওই দুই পুরোনো বন্ধু হল রাজনৈতিক আঙিনার দুই বড়ো খেলোয়াড়। অ্যাডাম মনে মনে খুব আত্মসুখ লাভ করল। তবে এটাও বুঝল সে, কথাটা নেহাত নিছক নয়, নাহলে এখন উনি এই প্রসঙ্গ তুলতেন না।
–তবে রাজী হবে কিনা, সেটাই প্রথম কথা। রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখলে জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটবে জেনে রেখো।
অ্যাডাম জানে, ভোটে জিতলে প্রচুর ক্ষমতা তার হাতে আসবে, যা উপভোগ করে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করবে। তবে তাকে এই চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে যেতে হবে। সে এক নতুন জীবন। অবশ্য স্ত্রী বেথের কাছে এই জীবনযাত্রা খুব পছন্দ হবে। তবে এখনও পর্যন্ত নিজের মন থেকে সায় পাচ্ছে না সে।
–আমি রাজী স্টুয়ার্ট, অ্যাডাম বলে উঠল।
-বাঃ, এই তো কথার মতো কথা। নিডহ্যাম কাপে আবার চা ঢালতে ঢালতে বলে উঠলেন, আমার বন্ধুরা যে কী খুশী হবে। আর একটি কথা বলার জন্য তিনি মনে মনে তৈরী হয়ে নিলেন।
খানিক বাদে বললেন–অ্যাডাম, বার অ্যাসোসিয়েশনের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি তোমার ওপর একটি দায়িত্ব ন্যাস্ত করতে চাইছে, খুব বেশী সময় লাগবে না। এক বা দুঘন্টা লাগতে পারে।
কী দায়িত্ব?
মাইকেল মোরেটির মামলার কথা বলছি। আমার ধারণা, ওর দলের কেউ ববি ডি সিলভার সেই মেয়ে সহকারীকে ঘুষ দিয়েছিল।
খবরের কাগজে খবরটা পড়েছি। অ্যাডাম বলল, সেই হলদে ক্যানারি পাখিটা তো?
হ্যাঁ। জজ ওয়াল্ডম্যান আর ববি ডি সিলভা ওই মেয়েটাকে আর ওর পেশাতে রাখতে চায় না। ওরা চাইছে বার তালিকা থেকে ওর নাম চিরদিনের জন্য মুছে দিতে। আমিও ওদের সাথে এক মত। আমাদের মহান আইন পেশার মুখে চুনকালি লেপে দিল।
–এখানে আমার কাজ কী?
এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে হবে। বেশী দেরী করা চলবে না। মেয়েটা কোন অন্যায় ও রীতি বহিভূর্ত কাজ করেছে কিনা খতিয়ে দেখবে। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিতে হবে। অতএব সেইভাবেই রিপোর্ট তৈরী করবে। ওর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার আবেদন জানাবে। তারপর ওরা ওকে শোকজ নোটিশ ধরিয়ে দেবে। এবং অন্যান্য সব কাজ করবে। তোমার কাজ এই পর্যন্ত। এটা তেমন বিশেষ কোনো কাজ নয়।
ব্যাপারটা অ্যাডামের কাছে হেঁয়ালির মতো ঠেকল–এসব ব্যাপারে আমাকে ডাকছেন কেন স্টুয়ার্ট। অনেক উকিল এখানে আছেন, যাঁরা স্বচ্ছন্দে আপনার দেওয়া দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
–কথাটা ঠিক। কিন্তু আমাদের মাননীয় জজ সাহেব চান, এ কেসটা তোমাকেই দেওয়া হোক। উনি চান শান্তিপূর্ণভাবে ব্যাপারটার ইতি ঘটাতে। তাছাড়া আমরা জানি, ববি ডি সিলভা দয়া-মায়াকে একেবারে প্রশ্রয় দেন না। উনি মেয়েটার সর্বনাশ না দেখে থামবেন না।
অ্যাডাম ওয়ার্নার নীরব। নিজের কাজের তালিকা নিয়ে মনে মনে ভাবছে সে।
অ্যাডাম, তুমি কি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না? স্টুয়ার্ট বলতে থাকে। ভবিষ্যতে আমরা ওনার কাছ থেকে প্রয়োজনে সাহায্য আশা করতে পারি?
বুঝতে পেরেছি। অ্যাডাম ওয়ার্নার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এখন আসছি।
তুমি আর চা খাবে না সত্যি?
না, ধন্যবাদ।
অ্যাডাম ওয়ার্নার এসে ঢুকল তার ঘরে। লুসিন্ডাকে টেলিফোনে ডেকে পাঠাল। লুসিন্ডা তারা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম এক সহযোগী, কৃষ্ণাঙ্গী অল্পবয়সী যুবতী।
মেয়েটি ঘরে এসে ঢুকল। অ্যাডাম বলল–সিন্ডি, জেনিফার পার্কার নামে ওই এ্যাটর্নির সমস্ত তথ্য আমি চাই। তুমি সেগুলি জোগাড় করো।
–সেই হলদে ক্যানারি পাখি? লুসিন্ডা সামান্য হাসল। এখুনি এনে দিচ্ছি। ওর সম্পর্কে কারও কিছু আর জানতে বাকি নেই।
.
সেদিন বিকেলে অ্যাডাম ওয়ার্নার মন দিয়ে মাইকেল মোরেটির মামলার বিবরণ পড়ছিল। রবার্ট ডি সিলভা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে রিপোর্টটি তার কাছে লোক মারফত পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাত তখন বারোটা। রিপোর্ট পড়া শেষ হয়নি। স্ত্রী বেথকে নিয়ে একটা ডিনার পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিল।
সে স্ত্রীকে ডেকে বলল–আমি আজ পার্টিতে যেতে পারছি না, তুমি একাই চলে যাও।
বেথ চলে গেল। একটা স্যান্ডউইচ খেল অ্যাডাম। তারপর আবার রিপোর্টের পাতায় । ডুবে গেল।সত্যি মাইকেল মোরেটির কপালের জোর আছে। জেনিফার পার্কার এর মধ্যে যদি নিয়তির মতো ঢুকে না পড়ত তা হলে কেউ ওকে জেলের বাইরে আনতে পারত না। রবার্ট ডি সিলভা নিখুঁতভাবে কেসটা সাজিয়েছেন, তার দিক থেকে কোনো খামতি নেই।
অ্যাডাম এবার পড়তে শুরু করল রবার্ট ডি সিলভা জেনিফারকে কী কী জেরা করেছিলেন, তার পূর্ণ বিবরণ–
ডি সিলভা–আপনি কি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছেন?
পার্কার-হ্যাঁ, স্যার।
ডি সিলভা–আপনি তো ল স্কুল থেকে ডিগ্রি কোর্স করেছন?
পার্কার হ্যাঁ, স্যার।
ডি সিলভা–তারপরে আপনি একটা অজানা অচেনা লোকের কাছ থেকে একটা খাম পেলেন, লোকটি খুনের মামলার রাজসাক্ষীকে সেটা পৌঁছে দিতে বলল, আর আপনি সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল করলেন। কোনো চিন্তা ভাবনা না করে, নিজের মতে। এটা কি আপনার নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক নয়?
পার্কার–ঘটনাটা ঠিক এইভাবে ঘটেনি।
ডি সিলভা–আপনি নিজেই এইভাবে ঘটনাটার বিবৃতি দিয়েছেন।
পার্কার–আমি বলতে চেয়েছিলাম, লোকটা আমার অচেনা নয়, উনি হয়তো আপনার অফিসেই কাজ করেন।
ডি সিলভা–এরকম মনে হওয়ার কারণ কী?
পার্কার–আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, ওই লোকটা আপনার সাথে কথা বলছিল, আমি দেখেছি। তারপর সে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। আমার কাছে এগিয়ে এসে খামটা তুলে দিল আর বলল, আপনার নির্দেশ আমি যেন ওটা সাক্ষীর কাছে পৌঁছে দিই। কিছু বোঝার আগেই ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে ।
ডি সিলভা–আপনি যেমন বলছেন, ঠিক তত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। আমার ধারণা, এর জন্য আগে থেকে ছক কষা হয়েছে এবং যথেষ্ট সময় খরচ করা হয়েছে। আপনাকে ঘুষ দিয়ে যে লোক ওই জিনিসটা পাচার করেছে, তাকে খুঁজে বের করার জন্য প্রচুর সময় দেওয়া হয়েছে।
পার্কার–না, স্যার। আপনি আমাকে মিথ্যে সন্দেহ করছেন। আমি
ডি সিলভা–তাই নাকি? রাজসাক্ষীর হাতে ওটা পাচার করার ব্যাপারটা আপনি তো আগে থেকে জানতেন। তাই তো?
পার্কার-খামের ভেতরে কী আছে, তা আমার জানা ছিল না।
ডি সিলভা–তাহলে আপনি স্বীকার করছেন, আপনি ঘুরে খেয়েছেন?
পার্কার–না, আমি কোনো টাকা নিইনি। আপনি আমাকে কথার প্যাঁচে ফেলতে চাইছেন।
ডি সিলভা–আপনি তা হলে পরোপকারী?
পার্কার না। আমার ধারণা ছিল, আমি কেবল আপনার নির্দেশ পালন করছি মাত্র।
ডি সিলভা–ওই লোকটা আপনাকে নাম ধরে ডেকেছিল। একটু আগেই বললেন।
পার্কার–হ্যাঁ।
ডি সিলভা–কী করে আপনার নাম জানতে পারল?
পার্কার–আমার জানা নেই।
ডি সিলভা মিথ্যে কথা ছেড়ে আসল কথায় আসুন। যেমন প্রশ্ন করছি, তার সঠিক জবাব দিন। ব্যাপারটা আপনি আগে থেকেই জানতেন?
পার্কার–না। আমি জানতাম না।
ডি সিলভা–শুনেছি, আপনি মাইকেল মোরেটির প্রেমিকা। কত দিন ধরে চলছে?
পার্কার–মিস্টার সিলভা, আপনি আপনার অধিকার ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ ঘণ্টা ধরে আমি অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আর সম্ভব নয়। আমি ক্লান্ত আমার পক্ষে আর কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আমি কি এখন উঠতে পারি?
ডি সিলভা–তাহলে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হব। মিস পার্কার, আপনি জানেন না, কী সাঙ্ঘাতিক বিপদের মধ্যে আপনি পড়েছেন। এই বিপদ থেকে আপনি রক্ষা পেতে পারেন, যদি সাফ সাফ সঠিক জবাব দেন। বাজে কথা ছেড়ে আসল কথাটা বলুন।
পার্কার–আমি বারবার বলছি এ পর্যন্ত যা কিছু বলেছি সব সত্যি। মিথ্যে কিছু বলিনি। কোনো কিছু গোপন করিনি।
ডি সিলভা-কেবল ওই লোকটার নাম গোপন রেখেছেন, যে প্যাকেটটা আপনাকে দিয়েছিল। এবার সেই লোকটার নাম বলুন আর কাজটা করে দেওয়ার জন্য কত টাকা পেয়েছেন, ঠিক ঠিক বলুন।
তিরিশটি পাতার রিপোর্ট। খুব মন দিয়ে পড়া শেষ করল অ্যাডাম ওয়ার্নার। অপমানের চূড়ান্ত করে ছেড়েছেন মিস্টার ডি সিলভা। এ প্রায় জেনিফারের গায়ের চামড়া তুলে। নেওয়ারই নামান্তর। কিন্তু রিপোর্টের প্রথম থেকে শেষ অব্দি পড়ে অ্যাডাম বুঝতে পেরেছিল, কোথাও জেনিফারের কথার হেরফের ঘটেনি। বারবার একই জবাব দিয়েছে।
ফাইল বন্ধ করে অ্যাডাম উঠে দাঁড়াল। দুপুর দুটো। আজ আর এ ব্যাপারে কিছু নয়।
.
কিন্তু অ্যাডাম ওয়ার্নার একটা ব্যাপারে পরিষ্কার হল যে, জেনিফার পার্কারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাকে অভিযুক্ত করা তার পক্ষে মোটেও সহজ হবে না। জেনিফারের অতীত সম্পর্কে সে খুব ভালোভাবে খোঁজ খবর নিয়েছে। সে কোনো দিনই অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এমন কী মাইকেল মোরেটির সঙ্গে কস্মিনকালেও তার ভাব-ভালোবাসা গড়ে ওঠেনি। যদি-যদি মাইকেল মোরেটির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক থাকত, তাহলে জেনিফার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তিটা আরও জোরালো করত। কিন্তু তেমনটি হয়নি। অতএব অ্যাডাম ওয়ার্নার ধরে নিল যে, জেনিফার পার্কারের বক্তব্যের মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই, যা কিছু বলেছে সব সত্যি।
বেলা বারোটা। টেলিফোন এল।
কাজকর্ম কেমন এগোচ্ছে? ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা জানতে চাইলেন।
-খুব ভালো।
অ্যাডাম, জেনিফার পার্কারের রিপোর্টটা পড়েছো তুমি?
–হ্যাঁ।
–ও মেয়ের বারোটা বাজিয়েই আমি ছাড়ব। ওকালতি করা ঘুচিয়ে দেব।
রবার্টের কন্ঠে ঘৃণা ও আক্রোশ। টেলিফোনের এপ্রান্তে বসেও অ্যাডাম তা স্পষ্ট বুঝতে পারল। রবার্টের নৃশংস মানসিকতা অ্যাডাম ওয়ার্নারকে বিচলিত করল।
রবার্ট, আপনি উত্তেজিত হবেন না। অ্যাডাম তাকে আশ্বস্ত করে বললও এখনও পর্যন্ত বারের একজন সদস্য। ওর নাম কাটা যায়নি।
–জানি, বেশ, তুমি যা বোঝো করো। তোমাকেই দায়িত্ব দিলাম। রবার্ট ডি সিলভার হাসি শোনা গেল। এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, শুনলাম, তুমি নাকি ওয়াশিংটনে যাচ্ছো? তুমি আমার সমর্থন সর্বদা পাবে।
ডি সিলভার কথা শুনে অ্যাডাম মোটেও অবাক হল না। এটাই তো স্বাভাবিক। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির কাছে কোনো খবর চাপা থাকে না। তিনি জানেন স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম তাকে কায়দা করে রাজনীতির মধ্যে ঢোকাতে চাইছেন। রবার্ট এখন ঝোঁপ বুঝে কোপ মারলেন।
ধন্যবাদ রবার্ট। অ্যাডাম বিনয়ী হয়ে বলল, আপনি আমাকে সমর্থন করবেন, এ তো আমার সৌভাগ্য।
-শুনে খুশী হলাম। আর হ্যাঁ, ওই কেসটা তুমি ঠিক মতো দেখো। তোমার ওপর আমি ভরসা করে আছি।
জেনিফার পার্কারের ব্যাপারে মামাশ্বশুর স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম আগেই অ্যাডামকে শুনিয়ে রেখেছিল, রবার্ট সেটাকে এবার জোরদার করার চেষ্টা করছেন। অ্যাডাম যেন দাবার বোড়ে। সুবিধা মতো ব্যবহৃত হবে। মনে পড়ে গেল রবার্ট ডি সিলভার কথাগুলি–মেয়েটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব। দেখি ওকালতি করে কী করে?
সওয়াল জবাবের বিবরণ পড়ে অ্যাডাম একটা সিদ্ধান্তে এল যে, জেনিফার পার্কারকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো জোরালো সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। এমন কী প্রমাণ করতে হবে যে, জেনিফার অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত। এটা না করা পর্যন্ত ডি সিলভার ক্ষমতা নেই ওর এক ফোঁটা ক্ষতি করতে পারেন। আসলে রবার্ট ডি সিলভা জেনিফারের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছেন অ্যাডামকে শিখণ্ডী করে।
মামাশ্বশুর স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম, জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যান, এবং ডিস্ট্রক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা যা চাইছেন, তা করা অ্যাডামের পক্ষে যদিও কঠিন কিছু নয়, কিন্তু বিবেকের শাসন তো তাকে শুনতেই হবে। বিবেক সায় দিচ্ছে না। জেনিফার পার্কারের ফাইলটা তুলে নিল অ্যাডাম। কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাগজে লিখে নিল। টেলিফোনে নম্বর ডায়াল করল।
অ্যাডাম ওয়ার্নার বার অ্যাসোসিয়েশনের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির একজন সদস্য, প্রচুর দায়িত্ব সম্পন্ন কাজ। তার থেকেও বড় কথা, এ দায়িত্ব পালন করতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রচুর পরিশ্রম করেছে সে। বছরের পর বছর তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষায় থেকেছে। বারের পরীক্ষা দিয়েছে। সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবেই আজ সে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছতে পেরেছে। সে কি পারবে জেনিফার পার্কারের বিরুদ্ধে যেতে? কয়েক জন প্রভাবশালী লোকের কথায় একজন এ্যাটর্নিকে বার থেকে বিতাড়িত করা। জেনিফার তো তারই মতো একজন উকিল। এর জন্য চাই যথেষ্ট ও উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ।
পরদিন সকাল বেলা অ্যাডাম প্লেনে চাপল। ওয়াশিংটনের সিয়াটলে এসে হাজির হল। যে স্কুলে জেনিফার আইন বিষয় পড়াশুনা করেছে সেখানে গেল। অধ্যাপকদের কাছে। জেনিফার পার্কার সম্পর্কে খোঁজখবর নিল। সহপাঠীদের সঙ্গেও কথা বলল। এমন কী যে আইন প্রতিষ্ঠানে সে হাতে কলমে শিক্ষানবিশী হয়ে কাজ করেছিল সেখানেও অ্যাডাম গেল।
এই সময় মামাশ্বশুর স্টুয়ার্ট নিডহ্যামের ফোন পেল অ্যাডাম।
–অ্যাডাম, তুমি ওখানে পড়ে আছ কেন? তোমার ওপর যে মস্ত বড়ো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা তো তাড়াতাড়ি মেটানো দরকার।
-হ্যাঁ, ওই ব্যাপারে কতগুলি সমস্যা দেখা দিয়েছে। অ্যাডাম বলল, আমি আর কয়েকটা দিনের মধ্যেই ফিরে আসছি, স্টুয়ার্ট।
-বেশ। অল্পক্ষণের নীরবতা, আবার শোনা গেল নিডহ্যামের গলা, মনে রেখো, মেয়েটার পেছনে বেশী সময় নষ্ট করা যাবে না।
.
জেনিফার পার্কারকে অ্যাডাম কখনও চোখে দেখেনি। অথচ মেয়েটার সম্পর্কে একটা ছবি ইতিমধ্যে সে গড়ে ফেলেছে। ওই ছবির মধ্যে জেনিফারের ল্যান্ড লেডি, অধ্যাপক, সহপাঠী এবং যে আইন প্রতিষ্ঠানে সে হাতে কলমে কাজ শিখেছে–তাদের সংলাপগুলো স্থান করে নিয়েছে। রবার্ট ডি সিলভার কাছ থেকে শোনা কথার সাথে এই ছবি বা সংলাপের কোনো মিল নেই।
.
অ্যাডাম ওয়ার্নার এই মুহূর্তে জেনিফার পার্কারের সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখল। গায়ে একটা বড়ো পুরোনো তোয়ালে জড়ানো। মেকাপ বিহীন মুখ, কটা লম্বা চুল ভিজে সপসপে, তবুও ওই মুখে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আছে।
মিস পার্কার, অ্যাডাম বলতে থাকল, মাইকেল মোরেটির মামলার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে। আপনার সম্পর্কে কিছু জানার আছে আমার। সেই জন্যই আমার এখানে আসা।
-ও, তাই বলুন। জেনিফার তখন মনে মনে ভীষণ রেগে গেছে। রবার্ট ডি সিলভা এখনও তার পেছনে লেগে আছেন, তার ধ্বংস না দেখে তিনি ছাড়বেন না বুঝি।
নতুন করে কিছু বলার নেই আমার। জেনিফারের কণ্ঠস্বর কাঁপছে–আপনি আপনার রিপোর্টে যা খুশী বসিয়ে নেবেন। স্বীকার করছি, বোকামি করে ফেলেছি আমি, যার বিরুদ্ধে এদেশে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেই। ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি ধরে নিয়েছে, আমি ঘুষ খেয়েছি। রাগে জেনিফার দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল।
…আপনার কী ধারণা, আমি মাইকেল মোরেটির থেকে টাকা পেয়েছি। দেখছেন তো আমার ঘর-দোরের হাল। তাহলে ছোট্ট একটা ঘুপচি ঘরে কেউ-রাগে ও উত্তেজনায় জেনিফার তখন ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না। আমাকে একা থাকতে দিন। দয়া করে এখান থেকে চলে যান, যা ইচ্ছে আমার বিরুদ্ধে লিখুন।
ভেতর থেকে একটা কান্না উঠে আসছে। জেনিফার নিজেকে আর সংযত করতে পারল না। ছুটে সেখান থেকে চলে এল। বাথরুমে ঢুকে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সিঙ্কের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দিয়ে তখন নামছে লবণাক্ত জলের ধারা। আর একবার বোকামির পরিচয় দিল জেনিফার-সে বুঝতে পেরেছে। ওই ভদ্রলোককে ওভাবে সোজাসুজি আক্রমণ করা তার উচিত হয়নি। ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বললে হয়তো কিছু একটা হত। পরক্ষণেই জেনিফার ভাবল, সবই অলীক কল্পনা তার। লাভ কিছু হত না। এসব তদন্ত ভড়ং মাত্র।
জেনিফার জানে, এরপর কী হবে? এরপর সে উপযুক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ পাবে। তিনজন এ্যাটর্নির একটি কমিশন বসবে। তারাই পরিচালন কর্তৃপক্ষের হাতে জেনিফারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ পেশ করবেন। কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? তা তো আগে থেকেই তৈরীবার থেকে বহিষ্কার। নিউইয়র্কের কোথাও সে ওকালতি করতে পারবে না।
অবশ্য এই সিদ্ধান্ত তার একটা লাভ করে দিয়েছে। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তার নাম ছাপা হবে। বিশ্বের সবাই জানবেন সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে কে আইন ব্যবসাকে পেশা করেছিলেন? উত্তর : জেনিফার পার্কার।
জেনিফার গরম জলের কল খুলে দিল, উষ্ণ গরম জলে দেহটা ডুবিয়ে দিল। চোখ বুজে পড়ে রইল। গরম জলের স্পর্শে তার সমস্ত উত্তেজনা কেটে গেল। তন্দ্রা মতো এসেছিল তার। হঠাৎ ঠান্ডা জলের স্পর্শে নিদ টুটল। কতক্ষণ এভাবে পড়ে আছে, তা জানে না জেনিফার। বাথটব থেকে অনিচ্ছাকৃত অবসন্ন দেহটাকে টেনে তুলল। শুকনো তোয়ালে দিয়ে জল মুছে ফেলল। না, তার এখন আর খিদে নেই। অ্যাডাম ওয়ার্নারের বক্তব্য শুনে তার সব খিদে উঠে গেছে।
চুল আঁচড়াল। ক্রিম মাখল মুখে। ডিনার খাবে না সে। বিছানায় গা এলিয়ে দেবে এবার।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল সে।
অ্যাডাম ওয়ার্নার তার অপেক্ষায় তখনও বসেছিল, একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে দেখছিল। জেনিফারকে ঢুকতে দেখে মাথা তুলল। নগ্ন দেহের জেনিফারকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল, অস্বস্তি বোধ করল সে।
দুঃখিত, অ্যাডাম বলে উঠল, আমি
জেনিফার একবারের জন্যও ভাবতে পারেনি, অ্যাডাম ওয়ার্নার তার প্রতীক্ষায় বসে থাকবে। সে চমকে উঠল, মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। ছুটে চলে গেল বাথরুমে। গায়ে একটা ভোয়ালে জড়িয়ে ফিরে এল। তখন সে বেশ ক্ষিপ্ত।
–আশা করি তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে। জেনিফার পার্কারের তপ্ত গলা, আপনি এখন বিদায় হোন।
মিস পার্কার, ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রেখে অ্যাডাম বলল, আমরা ব্যাপারটা নিয়ে শান্তভাবে কি আলোচনা করতে পারি না?
–অসম্ভব। প্রশমিত রাগ আবার জ্বলে উঠেছে, শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিকে যা খুশি বলুন গিয়ে, আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনারা সকলে উঠে পড়ে লেগেছেন, মনে হয় এক দাগী আসামীর পেছনে আপনারা ছুটছেন।
মিস পার্কার, এটা আপনার ভুল ধারণা। আপনার নাম বার থেকে কেটে দেওয়া হবে কী হবে না, সেই ব্যাপারে তদন্ত করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। আপনার মুখ থেকে আমি কয়েকটা কথা শুনতে চাই।
–সে নমুনা পেলাম। এবার আসুন।
দুঃখিত, মিস পার্কার। অ্যাডাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোল।
দাঁড়ান।
থমকে দাঁড়াল অ্যাডাম ওয়ার্নার।
–আমায় মাফ করবেন। কী যে হয়েছে আমার, সবাইকে আমি শত্রু বলে মনে করি। ক্ষমা চাইছি।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে।
জেনিফারের খেয়াল হল তার পরনে তোয়ালে, ছাড়া কিছু নেই। সে বলল, বেশ, একটু বসুন। আমি পোশাক পরে আসছি।
–উত্তম কথা। ডিনার খেয়েছেন আপনি?
–আমি, কথার শেষটুকু আর বলতে পারল না জেনিফার।
সামনেই একটা রেস্তোরাঁ আছে। ফরাসি। মনে হয় তদন্তের জন্য ওটাই মোক্ষম জায়গা।
ওরা মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসল।
-এই রেস্তোরাঁর নাম অনেকেরই অজানা, অ্যাডাম বলতে থাকে, রান্নাবান্না খুব ভালো। এক ফরাসি দম্পতির হোটেল।
–খাবার মুখে তোলার মতো অবস্থা নেই জেনিফারের। খিদে পেয়েছিল ঠিকই, এই মুহূর্তে তার খিদে উবে গেছে। উত্তেজনায় সে তখনও টগবগ করে ফুটছে। কিছুতেই নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারছে না। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা সুদর্শন সুপুরুষ এ্যাটর্নি ভদ্রতার মুখোশধারী এক শয়তান। লোকটা তার শত্রু। তবে তার মননামুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব ও আকর্ষণীয় চেহারার তারিফ করতেই হয়। তবে পরিস্থিতির চাপে সে এই সন্ধ্যেটাকে মন খুলে উপভোেগ করতে পারছে না। ওই অপরিচিত লোকটি তার ভবিষ্যতকে মুঠোবন্দী করেছে। আগামী দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই জানা যাবে, তার ভবিষ্যতের গতিপথ কী?
অ্যাডামও বুঝতে পারল, জেনিফার এখন চাপা উত্তেজনা ও ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। সে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। সে সম্প্রতি জাপান থেকে ঘুরে এসেছে, বিশেষ কাজে যেতে হয়েছিল। উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসারদের সঙ্গে খানাপিনায় যোগ দিতে হয়েছিল, সেই সব গল্প বলল জেনিফারকে। গত বছর শিকার করতে গিয়েছিল আলাস্কায়। হিংস্র বন্য ভালুকের হাত থেকে কী করে যে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিল, সেই রোমাঞ্চকর কাহিনীও শোনাল। এই জাতীয় হালকা ধরনের রসালাপে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
এরপরেই শুরু হল তার জেরা। জেনিফার আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
–মিস পার্কার, আমি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। অ্যাডাম বলল, আশা করি আপনি শান্তভাবে জবাব দেবেন।
গলার ভেতরে যেন কী একটা দলা পাকিয়ে আছে, জেনিফার মুখে কিছু বলতে পারল না, কেবল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
–সেদিন আদালতে যা ঘটেছিল তার আনুপূর্বিক আমাকে বর্ণনা করুন। অ্যাডামের ধীর স্থির শান্ত কণ্ঠস্বর, কোনো কথা যেন বাদ না যায়, অবশ্য ভুলে যদি না গিয়ে থাকেন। দরকার মনে করলে একটু ভেবে নিতে পারেন।
জেনিফার ভাবল, রুখে দাঁড়াবে। বিশ্রী ব্যবহার করে লোকটাকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু ওই সুদর্শন চেহারা আর অমায়িক ব্যবহার দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল।
–বেশ শুনুন। একটু থামল জেনিফার। বোধহয় দম নিল, ফের বলতে শুরু করল। সেদিন যা যা ঘটেছিল সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে গেল। অ্যাডাম মনোযোগ সহকারে তার কথাগুলি শুনছিল।
–যে লোকটা আপনার হাতে প্যাকেটটা দিয়েছিল, অ্যাডাম প্রশ্ন করল, তাকে ডিস্ট্রিক্ট অফিসে আগে দেখেছেন আপনি, সকালবেলা শপথ নেবার সময়?
–সেদিন ওই অফিসে অনেক লোকের জমায়েত ছিল। তারা কেউই আমার চেনা নয়। ওই লোকটিকে দেখেছিলাম কিনা তাও মনে পড়ছে না।
অন্য কোথাও এর আগে ওকে দেখেছেন?
–সম্ভবত না, জেনিফারের কণ্ঠে অসহায়তার সুর। যদি বা দেখে থাকি, মনে করতে পারছি না।
আপনাকে প্যাকেটটা দেবার আগে লোকটা নাকি ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির সঙ্গে কথা বলেছিল, আপনি বলেছেন, আপনি কি দেখেছেন ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নিই ওই প্যাকেটটা লোকটার হাতে গুঁজে দিচ্ছে।
না, আমি দেখিনি।
লোকটি কি সত্যিই ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নির সঙ্গে কথা বলেছিল, না কি ভিড়ের মধ্যে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
খানিকক্ষণের নীরবতা। জেনিফারের চোখ বন্ধ। সম্ভবত সেদিনের ঘটে যাওয়ার ছবিটা সে স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই সে চোখ খুললনা, সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক জানি না।
–আপনি বলেছেন, লোকটি আপনার নাম ধরে ডেকেছিল। লোকটি আপনার নাম জানল কী করে বলতে পারেন?
-না।
–আচ্ছা, এ কাজ তো সে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে পারত। আপনাকে বেছে নিল কেন?
–এ তো সহজ কথা। আমি একটা গাধা। চোখ মেলে তাকিয়েই লোকটা আমাকে দেখেছিল, আর ঠিক করে নিয়েছিল, এই গাধাটাকেই দিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। জোরে জোরে মাথা দোলাচ্ছে জেনিফার, মিঃ অ্যাডাম। এ প্রশ্নেরও জবাব আমার জানা নেই। দুঃখিত।
দীর্ঘদিন ধরে ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা মাইকেল মোরেটিকে বাগে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনভাবে তিনি মামলাটা সাজিয়েছিলেন, মোরেটির বেরোনোর সব পথ বন্ধ। কিন্তু মামলা চলাকালীন মাঝখানে আপনি এসে সব গড়বড় করে দিলেন। ডি সিলভা আপনার ওপর ভীষণ চটে আছেন।
–আমি নিজেও নিজের ওপর ভীষণভাবে বিরক্ত। জেনিফার বলল। সে জানে অ্যাডাম ওয়ার্নারের কোনো দোষ নেই। সে তার কর্তব্য পালন করছে মাত্র। রবার্ট ডি সিলভা তাকে বার থেকে তাড়িয়ে ছাড়বেন। তারই প্রাথমিক প্রথম পদক্ষেপ হল এই জেরা। এর জন্য সে অ্যাডাম ওয়ার্নারকে মোটেই দায়ী করছে না। সে নিমিত্তমাত্র।
হঠাৎ একা থাকার এক অদ্ভুত ইচ্ছে জাগল জেনিফারের মনে। লোকে তার দুঃখ দুর্দশা দেখবে আর মুখ টিপে হাসবে, সে সেটা বরদাস্ত করতে পারছে না।
দুঃখিত। শরীরটা খারাপ লাগছে। জেনিফার বলল–বাড়ি ফিরতে চাই, যদি আপনি বলেন।
অ্যাডাম তার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখল। ক্ষণিকের জন্য, তারপর শান্ত গলায় বলল বার থেকে বহিষ্কার করার মামলা যদি আপনার বিরুদ্ধে না করা হয়, তাহলে কি আপনি সুস্থ বোধ করবেন না?
কী অবিশ্বাস্য কথা। জেনিফার অ্যাডামের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। খানিক বাদে ঢোক গিলে বলল, এটা কি সত্যি?
–আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করাকে আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করেন।
অ্যাডামের প্রশ্ন শুনে জেনিফারের মনে পড়ল তার বাবা বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি আইনের ডিগ্রিটা নিয়ে নাও, তখন তুমি হবে আমার এক সহকারী।
–হ্যাঁ, জেনিফারের নীচু কণ্ঠস্বর।
আপনার শুরু যদি কঠোর ও দুঃখপূর্ণ হয় এবং সেই সব বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারেন তাহলে ভবিষ্যৎ হয় অত্যন্ত সুখের। অবশ্য আমি এরকমটাই মনে করি।
ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠল জেনিফারের দুটি ঠোঁটে–আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
জেনিফার নিজে একটা স্বাধীন ব্যবসা দিয়েছে। আইনের প্রতিষ্ঠান। হতে পারে সেটা পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়ির একখানা নোংরা ভ্যাপসা ঘিঞ্জি ঘর, দুজন পুরুষের মাঝখানে একটা টেবিল স্পেস, তবুও সে গর্বিত এই ভেবে যে, সে একজন আইনজীবী।
বারের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি তাকে ব্যবসা চালিয়ে যাবার অনুমতি দিয়েছে। জেনিফারের হঠাৎ মনে হল সে যেন মস্ত বড়ো একটা কাজ সম্পন্ন করেছে। অ্যাডাম ওয়ার্নারের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভরে গেল তার অন্তর। আজীবন এই লোকটিকে সে মনে রাখবে।
টেবিল থেকে কাপডিসগুলো নিয়ে গেল ওয়েটার।
কী একটা বলতে যাচ্ছিল জেনিফার। কিন্তু তখন হাসি ও কান্না মিলিত হয়ে তার কণ্ঠকে যেন টিপে ধরেছে। কেবল একটি শব্দ শোনা গেল মিঃ ওয়ার্নার।
না, মিঃ ওয়ার্নার নয়। অ্যাডামের গম্ভীর গলা, আজ থেকে আমি কেবল অ্যাডাম।