০৬.
অলিভারের দিনগুলো কেটে চলেছে আনন্দময় উত্তেজনার মধ্যে। জীবনের প্রতিটি প্রহরকে উনি কাজে লাগাতে চাইছেন। একটির পর একটি রাজনৈতিক সম্মেলন, প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, ভাষণ দেওয়া, সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়ানো। ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রেড জার্নাল এবং লেক্সিংটনের হেরাল্ড লিডার পত্রিকাতে তাঁর সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক জীবনেও অলিভার এক সফল পুরুষ। এর অন্তরালে কী আছে, অন্তরালে আছে ওই বিয়ের অনুষ্ঠান, সেনেটর টড ডেভিসের কন্যা তার ঘরণী, ব্যাপারটা সাংবাদিকদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়।
ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকতে অলিভার পছন্দ করেন। সুন্দর একটা শহর যার ঐতিহাসিক পটভূমি আছে, আছে নদীর ধারে সুরম্য উপত্যকা। কেনটাকির অসাধারণ পর্বতমালার সৌন্দর্য। তাকে বেশির ভাগ সময় ওয়াশিংটনে থাকতে হয়, ভালো লাগে না, মোটই ভালো লাগে না।
কর্মব্যস্ত দিনগুলো সপ্তাহে অতিক্রান্ত হয়ে যায়, সপ্তাহ চলে যায় মাসে। অলিভার তার কার্যধারার শেষ বছরে এসে উপস্থিত হলেন।
পিটার ট্যাগারকে তিনি তার চীফ সেক্রেটারী করে দিয়েছেন। এই নির্বাচনটা যথার্থ হয়েছে। ট্যাগার সব সময় প্রেসের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত থাকেন। জীবনের প্রাচীন মূল্যবোধগুলোকে আঁকড়ে চলার চেষ্টা করেন। তার কালো চোখে ঝরে পড়ে অসীম আনুগত্য, অলিভার এবং মহান মার্কিন দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতি।
.
টড ডেভিস প্রতি মাসে অলিভারের সঙ্গে দেখা করেন। কুশল বিনিময় হয়।
একদিন টড পিটার ট্যাগারকে বললেন–সবসময় অলিভারের ওপর নজর রেখো কেমন? এক মুহূর্ত সময় যেন বাজে নষ্ট না হয়।
অক্টোবরের কনকনে ঠান্ডা, সন্ধ্যেবেলা। অলিভার এবং সেনেটর ডেভিড অলিভারের গাড়িতে বসেছিলেন। দুজন পুরুষ ও জ্যান গাব্রিয়েলে ডিনার খেতে গেছে। তারা এগজিকিউটিভ ম্যানসনে ফিরে এল। জ্যান তাদের এগিয়ে দিয়ে এল।
জ্যানকে দেখে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে অলিভারকে, আমার ভালোই লাগছে।
টড আমি ওকে সুখী রাখার চেষ্টা করছি।
সেনেটর ডেভিস অলিভারের দিকে তাকালেন।
তিনি বললেন আমার মেয়েও তোমাকে খুব ভালোবাসে।
–আমিও ভালোবাসি।
সেনেটর ডেভিসের কণ্ঠস্বরে ভেসে এল–এবার তোমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার জন্য লড়তে হবে। এবং অবশ্যই তুমি জিতবে।
.
অলিভারের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর- কী বললেন স্যার?
-কেন আগে আমি বলিনি, তোমার নাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ওয়াশিংটনে, আমরা প্রথম থেকে প্রচার পরিকল্পনা শুরু করবো।
পরবর্তী প্রশ্ন করতে অলিভার ভয় পেয়েছেন–সত্যি সত্যি আপনি বলছেন আমার সুযোগ আছে?
সুযোগ? এটা তো জুয়া খেলা।
–আমি কখনও জুয়া খেলি না, জয়ের সম্ভাবনা না থাকলে আমি সেই খেলায় অংশ নিই না।
অলিভার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মনে পড়ে গেল, কে যেন বলেছিল-একদিন আপনার হাতে পৃথিবীর সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে।
–টড, আপনি আমার জন্য যা করছেন তার জন্য আমি আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
টড অলিভারের পিঠ চাপড়ে বললেন–একজন মানুষের উচিত তার জামাইকে সবভাবে সাহায্য করা, তাই নয় কী?
জামাই–এই শব্দটা অলিভারকে বিদ্ধ করল।
সেনেটর স্বাভাবিকভাবে বললেন–অলিভার, তোমার একটা কাজ কিন্তু আমাকে বিরক্ত করেছে। তামাকের ওপর করের বিলটা কি করে অনুমোদন পেল?
আমাদের ফিক্সটাল বাজেটে টাকা কম পড়েছিল তাই বাধ্য হয়ে…
–তুমি তো ভেটো দিতে পারতে।
অলিভার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ভেটো দেব?
সেনেটরের মুখে ছোট্ট হাসি অলিভার, ভেবে দেখো আমি কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ভাবছি না। আমি ভাবছি সেইসব বন্ধুদের কথা যারা তামাক উৎপাদনে লক্ষ লক্ষ ডলার লগ্নী করেছে। নতুন করে কর চাপালে তাদের অবস্থা কী হবে একবার ভেবে দেখেছো কি?
কিছুক্ষণের নীরবতা।
অলিভার, আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
অলিভার বললেন–না, আমার মনে হয়েছে এই ব্যাপারটা ভালোই হবে।
এই সিদ্ধান্তটা অনুচিত।
অলিভার বললেন–আমি শুনেছি আপনি আপনার তামাকের ব্যবসা বেচে দিচ্ছেন?
টড ডেভিস অবাক হয়ে তাকালেন–আমি কেন তা করবো?
তামাকের কোম্পানিরা নাকি কোর্টে গিয়ে আবেদন করবে। তাদের উৎপাদনের হার কমে গেছে।
–তুমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছে। অনেকগুলো জগত এখানে পড়ে আছে। দেখো চীন, আফ্রিকা এবং ভারতবর্ষে আমাদের বিজ্ঞাপন শুরু হবে।
তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন এবং উঠে পড়লেন। বললেন–আমাকে এক্ষুনি ওয়াশিংটনে ছুটতে হবে। কমিটির মিটিং আছে।
–আপনার যাত্রা শুভ হোক।
.
অলিভার বললেন–পিটার এখন আমি কী করবো? এই বছর যে করের বিধিটা অনুমোদন হল তার কী হবে?
পিটার ট্যাগার কয়েকটা কাগজের টুকরোর ওপর চোখ মেলে দিয়েছিলেন। তিনি বললেন–সব উত্তর এখন দেওয়া যাবে না। সেনেটরের সাথে কথা বলতে হবে। আশা করি সমস্যাটার সমাধান হবে। চারটের সময় আমরা একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকবো কেমন?
অলিভার কাগজগুলো পরীক্ষা করে বললেন–হ্যাঁ, ভালোই সাজানো হয়েছে।
–তোমার কি আর কিছু বলার আছে?
না, আর কিছু বলার নেই। চারটের সময় দেখা হবে কেমন?
পিটার চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়েছেন।
অলিভার তাকে ডেকে বললেন–পিটার, সত্যি করে বলুন তো আমি কি কোনদিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হতে পারবো?
সেনেটর কী বললেন?
-উনি তো আমাকে আশ্বাস দিলেন।
-তাহলে নিশ্চয় হবে। পিটার আরও বললেন–সেনেটরের সাথে আমার অনেকদিনের পরিচয়, তিনি কখনও ভুল পদক্ষেপ ফেলেন না। যদি উনি বলে থাকেন তাহলে কেউ তোমাকে হারাতে পারবে না।
কে যেন বলল–ভেতরে আসতে পারি?
দরজা খুলে গেল, অল্প বয়েসী সেক্রেটারী ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তার হাতে ফ্যাক্সের কাগজ। কতই বা বয়স হবে, কুড়ি একুশ হবে হয়তো, উজ্জ্বল দুটি চোখ, সবসময় জিজ্ঞাসু।
গভর্নর আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি জানতাম না আপনি এখানে আছেন।
–ঠিক আছে মিরিয়াম।
মিরিয়ামের মুখে একটু লজ্জা কাগজগুলো সে অলিভারের ডেস্কের ওপর রেখে দিল। চলে গেল অত্যন্ত দ্রুত।
ট্যাগার বললেন–মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী।
-হ্যাঁ।
অলিভার এব্যাপারে খুব সাবধানে থেকো কিন্তু।
–হ্যাঁ, কিন্তু আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটার কী হবে?
–পথটা খুব একটা ভালো না, কত মিরিয়াম, অ্যালিস আর ক্যারেন আসবে, তোমার ওভাল অফিসে।
–আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি পিটার, এব্যাপারে আপনি বৃথা চিন্তা করবেন না।
–ঠিক আছে, ট্যাগার তার ঘড়ির দিকে তাকালেন, এখন আমাকে যেতে হবে। বেডসিকে সঙ্গে নিতে হবে, বাচ্চাদেরও লাঞ্চে নিয়ে যাব। তিনি হাসলেন, আমি কি বলেছি আজ সকালে রেবেকা কী বলেছে? আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি। সে সকাল থেকে টিভি মুখে বসে আছে। কত কিছু বায়না ধরেছে।
আহা, ট্যাগারের কণ্ঠস্বরে পিতৃত্বের অহংকার।
.
রাত দশটা, অলিভার জ্যানের কাছে চলে গেলেন। বললেন–হ্যাঁনি আমাকে এখনি যেতে হচ্ছে। দরকারি আলোচনা আছে।
জ্যান অবাক হয়ে তাকালো- এখন এই রাত্রিবেলা?
দীর্ঘশ্বাস-হ্যাঁ, কাল সকালে বাজেট কমিটির অধিবেশন আছে। তার আগে ব্রিফ তৈরি করতে হবে।
–তুমি বড্ড পরিশ্রম করছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা কোরো কেমন?
অলিভার কিছু বলতে পারলেন না। স্ত্রীকে চুমু দিলেন, বললেন চিন্তা করো না, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো কেমন?
নীচের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অলিভারার ড্রাইভারকে বললেন–তোমাকেআজ আর দরকার নেই। আমি ছোট গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি।
.
মিরিয়াম একেবারে উলঙ্গ–তোমার দেরী হয়েছে সোনা!
উনি এগিয়ে এলেন, বললেন–দুঃখিত, আমি না আসা অবধি তুমি শুরু করোনি ভালো লাগছে।
মেয়েটির মুখে হাসি আমাকে শক্ত করে জাপটে ধরো।
আলিঙ্গন, চুম্বন, দুটি শরীর মিলেমিশে একাকার।
–তাড়াতাড়ি সবকিছু খোল, খুব তাড়াতাড়ি।
.
–ওয়াশিংটন ডিসিতে যাবে?
মিরিয়ামের চোখে বিস্ময় তুমি কি সত্যি বলছো?
–হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গিনী হবে।
–যদি তোমার স্ত্রী এই ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে?
–জানতেই পারবে না।
ওয়াশিংটন কেন?
–এখন সব বলতে পারবো না, ব্যাপারটার মধ্যে উত্তেজনা আছে।
–আমি যাব, তুমি যেখানে আমাকে নিয়ে যাবে। যতদিন তুমি আমাকে ভালোবাসো।
-তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, শব্দগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে এল। আগেও অনেকবার এসেছে ভবিষ্যতেও আসবে।
আমাকে আবার আদর দাও।
–এক সেকেন্ড, কিছু একটা করতে হবে।
উনি উঠে দাঁড়ালেন, পকেট থেকে একটা ছোটো বোতল বের করলেন, কিছুটা ঢেলে দিলেন গ্লাসের মধ্যে। পরিষ্কার তরল।
–এটা খাবার চেষ্টা করো।
মিরিয়াম জিজ্ঞাসা করল–এটা কী?
–আমি শপথ করে বলছি তোমার এটা ভালো লাগবে।
মিরিয়াম একটুখানি খেল প্রথমে, পরে বাকিটা খেয়ে নিল। তারপর হাসতে হাসতে বলল–স্বাদটা খুব একটা খারাপ নয়।
–তুমি আরও যৌনকাতর হয়ে উঠবে।
হ্যাঁ, এখনই আমার মধ্যে যৌন উত্তেজনা জেগেছে, দেরী কোরো না, তাড়াতাড়ি বিছানাতে এসো।
আবার ভালোবাসার সর্বনাশা খেলা শুরু হল। মেয়েটির গলা আবেগে বুজে এসেছে হ্যাঁ, হ্যাঁ, এত আনন্দ আমি কখনও পাইনি। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে।
মিরিয়াম, কোনো উত্তর নেই, আবার ডাক-মিরিয়াম!
মেয়েটি শুয়ে আছে অচেতন হয়ে।
কুকুরীর বাচ্চা, এই ঘটনাটা আমার বেলায় ঘটল।
এবার উনি উঠে দাঁড়ালেন, আরও অনেক মেয়েকে এই একই তরল খাইয়েছেন, কারো ক্ষেত্রে কোনো খারাপ প্রভাব পড়েনি। তাকে এখন আরও সতর্ক হতে হবে। ব্যাপারটার ঠিক মতো ব্যবস্থা করতে না পারলে গোলমাল হয়ে যাবে। স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাবে। কী করে তা সম্ভব? তিনি ঝুঁকেমিরিয়ামের পালস দেখলেন। হ্যাঁ, এখনও স্পন্দন হচ্ছে। হায় ঈশ্বর, কিন্তু মেয়েটিকে এখানে ফেলে রাখা যাবে না। তাহলে? কোথায় রাখা যায়?
আধঘণ্টা লাগল পোশাক পরতে, অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মেয়েটির সব চিহ্নকে সরিয়ে দিতে। উনি দরজা খুললেন, অলিন্দটা একেবারে ফাঁকা। মেয়েটিকে কাঁধের ওপর তুলে ধরেছেন। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। গাড়িতে শুইয়ে দিলেন। মধ্যরাত। রাস্তাঘাট একেবারে কঁকা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চলে গেলেন জুনিপার হিল পার্কে। না, কাছে পিঠে কেউ নেই, তিনি মিরিয়ামের অচেতন দেহটা গাড়ি থেকে বের করলেন। তাকে পার্কের বেঞ্চির ওপর শুইয়ে দিলেন। না, মেয়েটিকে এখানে এভাবে ফেলে দেওয়া উচিত হল না, কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। আমার ভবিষ্যৎ সরু সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েক ফুট দূরে একটা পাবলিক ফোন বুথ। তিনি সেখানে চলে গেলেন। ডায়াল করলেন ৯১১।
অলিভার বাড়ি ফিরে এসেছেন, জ্যান তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
জ্যান বলল–মধ্য রাতে? কী হল? ভালোভাবে সময়টা কেটেছে তো?
দুঃখিত সোনা, দীর্ঘক্ষণের আলোচনা, বাজেট নিয়ে সকলেই আলাদা মত প্রকাশ করছে।
জ্যান বলল তোমাকে এত বিবর্ণ দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি খুব ক্লান্ত?
-হ্যাঁ, আমি একটু ক্লান্ত।
জ্যান হাসল, চল, বিছানাতে যাই।
অলিভার জ্যানের মাথায় চুমু দিয়ে বলল–খুব ঘুম পাচ্ছে জ্যান, এই মিটিংটা আমাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
.
পরের দিন সকালে স্ট্রেট জার্নাল পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম–গভর্নরের সেক্রেটারীকে অচেতন অবস্থায় পার্কে পাওয়া গেছে। রাত দুটোর সময় পুলিশ মিরিয়াম হেডলার নামে এক অচেতন মহিলাকে দেখতে পেয়েছে, বৃষ্টির মধ্যে সে শুয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছে। তাকে মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার অবস্থা মোটই ভালো নয়।
প্রতিবেদনটা অলিভার পড়ছিলেন। পিটার দৌড়ে এলেন অফিসে, সঙ্গে খবরের কাগজের একটি কপি।
–অলিভার এটা দেখেছো?
ব্যাপারটা সাংঘাতিক। প্রেসকে এক্ষুনি ডাকা দরকার।
কী হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?
অলিভার মাথা নাড়লেন–আমি কিছুই জানি না। আমি হাসপাতালে কথা বলেছি। মেয়েটির কোমা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে।
ট্যাগার তাকালেন- মনে হয় মেয়েটি সেরে উঠবে তাই তো?
লেসলি চেম্বারস এই খবরটা দেখতে পায়নি। সে তখন ব্রাজিলে গেছে, একটা টেলিভিশন স্টেশন কিনবে বলে।
.
পরের দিন সকালবেলা, ফোন এসেছে হাসপাতাল থেকে গভর্নর, আমরা ল্যাবরেটরী টেস্ট শেষ করলাম। পেশেন্ট এমন একটা নিষিদ্ধ বস্তু খেয়েছে যেটা বাজারে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। একে একস্ট্রাসি বলা হয়ে থাকে, তরল অবস্থায় মেয়েটি এটা পান করে। ব্যাপারটা বেআইনী।
–তার অবস্থা কেমন?
–ও এখনও অচেতন অবস্থায় আছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা মারাত্মক।
–আমাকে খবর দেবেন কেমন?
–হ্যাঁ গভর্নর, আপনাকে জানাবো।
.
অলিভার রাসেল একটা মিটিং-এ ব্যস্ত ছিলেন, সেক্রেটারী ইন্টারকম বাজিয়ে দিয়েছেন।
–আমাকে ক্ষমা করবেন গভর্নর, আপনার জন্য একটা টেলিফোন কল।
–আমি বলেছিলাম এই সময় বিরক্ত না করতে।
–সেনেটর ডেভিস।
–আচ্ছা।
সকলের দিকে তাকিয়ে পরে কথা হবে কেমন, আমাকে ক্ষমা করবেন।
ওঁরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অলিভার ফোনটা তুলে ধরলেন টড?
অলিভার কী ব্যাপার বলো তো, তোমার একজন সেক্রেটারীর অচেতন দেহ পাওয়া গেছে? পার্কের বেঞ্চে?
ব্যাপারটা খুবই দুঃখের টড।
–কী বলছো কী? সেনেটর ডেভিস জানতে চাইলেন।
–আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
–তুমি ভালো করে বুঝতে পারছো আমি কী বলছি?
টড আপনি ভাববেন না। আমি ভগবানের দিব্যি করছি, এই ঘটনা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
না, সেনেটরের,গলা ক্রমশ গম্ভীর, তুমি জানো কীভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়াশিংটনে। এটা একটা ছোট্ট শহর। আমরা চাই না তোমার চরিত্রের সাথে এমন কোনো কলঙ্ক জড়িয়ে যাক। আমি এই ঘটনাতে খুবই অবাক হয়ে গেছি। অলিভার, তুমি বোকার মতো কাজ করলে কেন?
–আমি শপথ করছি, এ ব্যাপারের সঙ্গে আমি বিন্দুমাত্র যুক্ত নই।
–তুমি সত্যি বলছো?
–হ্যাঁ।
লাইনটা স্তব্ধ হয়ে গেল। অলিভার বসে পড়লেন, আরও আমাকে সাবধান ও সতর্ক হতে হবে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন। রিমোট কন্ট্রোলের দিকে এগিয়ে গেলেন। টেলিভিশন সেট খুলে দিলেন। খবর হচ্ছে। একটা ব্যস্ত রাস্তার ছবি। মোটরের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক মহিলা সাংবাদিক, হাতে মাইক্রোফোন, বলছে–এই নতুন চুক্তিটা কাল মধ্যরাত থেকে কার্যকরী হবে। এর ফলে অনেক মানুষের মনে শান্তির বাতাবরণ নেমে আসবে। হাজার হাজার অসহায় মানুষকে আর মরতে হবে না।
এবার ডানা ইভান্সের ছবি আরও কাছ থেকে দেখানো হল। অত্যন্ত যৌনবতী, রূপ এবং রহস্যের মিশেল। উনি বলে চলেছেন এখানকার মানুষ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত, তারা এখন শান্তি চাইছে। জানি না শেষ পর্যন্ত শান্তি আসবে কি না। আমি ডানা ইভান্স, ডব্ল টি ই–র জন্যে সারাজোভা থেকে কথা বলছি, ওয়াশিংটন ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজের।
ডানা ইভান্স, ওয়াশিংটন ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজ থেকেবিদেশি প্রতিনিধি। প্রত্যেকদিন উনি খবর পড়েন, অলিভার খবর দেখার চেষ্টা করেন, উনি হলেন এখনকার সেরা সাংবাদিক।
আহা, অসাধারণ রূপ আছে মেয়েটির। অলিভার ভাবলেন, এর আগেও ভেবেছেন। কিন্তু কীভাবে ওকে কজা করা যায়? উত্তরটা তার অজানা।
.
০৭.
ডানা ইভান্স এক কর্নেলের কন্যা। এগারো বছর বয়সে পাঁচটি আমেরিকান শহরে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। এমনকি চারটি বিদেশেও সে ঘুরে এসেছে। মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছে মেরিল্যান্ডে, জর্জিয়াতে, টেক্সাসে, কানসাসে, নিউ জার্সিতে। পড়াশোনা করেছে জাপান, জার্মানি ইতালি এবং পুয়ের্তো রিকোতে।
ছোটবেলা থেকেই নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল তার। সব ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী, মনটা ছিল অন্তর্মুখী।
-আমি জানি তোমাকে ছমাস অন্তর অন্য জায়গায় যেতে হচ্ছে। মা বলেছিলেন।
ডানা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল–কেন?
ডানার বাবাকে যখনই নতুন পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, ডানার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে–আমরা আবার নতুন দেশে যাব, তাই না মা?
ডানা এই ঘোরাঘুরিটা পছন্দ করতো, মা সঙ্গতকারণেই চাইতেন না।
–যখন ডানা তেরো, মা বলেছিলেন- জিপসীর জীবন আর বইতে পারছি না আমি। আমি ডিভোর্স করবো।
ডানা খবরটা শুনে খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কারণ এখন থেকে সে আর দেশ দেশান্তরে বেড়াতে পারবে না।
ডানা জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কোথায় থাকবো মা?
ক্যালিফার্নিয়ার ক্লারেমন্টে, আমি সেখানেই বড় হয়ে উঠেছি। একটা ছোট্ট সুন্দর শহর। দেখো ওই শহরটাকে তুমি ভালোবেসে ফেলবে।
.
ডানার মা ঠিক কথাই বলেছিলেন। সত্যিই শহরটা সুন্দর। এই শহরের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। শহরটার অবস্থিতি সানগাব্রিয়েল পাহাড়ের পাদদেশে, লস এঞ্জেলেস কান্ট্রিতে। তেত্রিশ হাজার জনসংখ্যা। রাস্তার দুপাশে সুন্দর গাছের সারি। তবে ডানা শহরটাকে খুব একটা পছন্দ করতে পারেনি। বিশ্ব পথিককে এখন এক শহরে বন্দিনী জীবন কাটাতে হচ্ছে।
ডানা দুঃখিত চিত্তে মায়ের কাছে জানতে চাইল–আমরা এই শহরে বরাবর থাকবো নাকি?
-কেন সোনামনি কী হয়েছে?
না, এখানে থেকে আমি হাঁফিয়ে উঠছি।
.
স্কুলে ডানার প্রথম দিন, মন হতাশায় আচ্ছন্ন।
কী হয়েছে? স্কুলটা কি তোমার ভালো লাগছে না?
না, এখানে বাচ্চা ছেলেমেয়ে পড়ে।
ডানার মা হেসে উঠেছিলেন- দেখবে সকলের সাথে তোমার বন্ধুত্ব হবে।
.
ডানাকে ক্ল্যারেমন্ট হাইস্কুলে ভরতি করা হল। তারপর সে স্কুল নিউজ পেপারে রিপোর্টারের কাজ শুরু করল। এই কাজটা সে সত্যিই ভালোবাসতো। তবে ধরতে পারছে না বলে তার মনে ভীষণ কষ্ট।
ডানা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হলে আমি আবার সারা পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বো।
.
এখন ডানা অষ্টাদশী, ক্ল্যারেমন্ট কলেজে নাম লেখালো। জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করল। কলেজ সংবাদপত্রের রিপোর্টার হল। পরবর্তী বছরে সে ফোরাম পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পেল।
ছাত্রছাত্রীরা তার কাছে নানা সুযোগ সুবিধার জন্য আসতো। বলতো–ডানা, আগামী সপ্তাহে আমরা নাচ প্রতিযোগিতার আসর করছি। তুমি অনুগ্রহ করে রিপোর্টটা ছাপবে তো?
…মঙ্গলবার ডিবেট সোসাইটির বার্ষিক অধিবেশন, রিপোর্টটা প্রথম পাতায় ছেপো কিন্তু।
ডানা বুঝতে পারলো, সাংবাদিকের হাতে আসল ক্ষমতা লুকিয়ে থাকে।
.
বড় হয়ে ডানা যখন আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতো, মনটা তখন দুঃখের পরিপূর্ণ থাকতো। বড্ড বেঁটে সে, পাতলা, তখনও বুক বলতে কিছু নেই, পাশাপাশি অন্য মেয়েরা কত সুন্দরী। আমি হলাম রাজহংসীর মধ্যে এক বিচ্ছিরি পাতিহাঁস, ডানা মনে মনে ভাবতো। শেষ অবধি ডানা আর আয়নার দিকে তাকাতো না। বুঝতে পারতো, চোদ্দ বছর বয়সেই তার শরীরে একটা পরিবর্তন এসেছিল। ষোল বছর বয়সে সে আরেকটু সুন্দরী হয়ে ওঠে। তখন সে সপ্তদশী, ছেলেরা তাকে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করলো। বুকটা তখন আরও ধারালো এবং তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। চোখের তারায় জেগেছে ইশারা, ঠোঁটের কোণে তখন সে আমন্ত্রণী হাসি আনতে পারছে।
বারো বছর বয়স থেকেই ডানার মনে একটা প্রচণ্ড ইচ্ছে, কীভাবে সে তার কুমারীত্ব হারাবে। সুন্দর একটা রাত এসে তাকে ডাকবে, আকাশে থাকবে চাঁদের জ্যোৎস্না, কোনো এক দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে যাবে সে। সমুদ্রের জল ধীরে ধীরে তার শরীর স্পর্শ করবে। তটভূমিতে গান বাজবে, একটি সুন্দর অচেনা আগন্তুক এসে তার সামনে দাঁড়াবে। তার চোখের তারায় তাকিয়ে থাকবে। তার আত্মার মধ্যে হাতের পরশ রাখবে। তাকে। আলিঙ্গন করবে। সে কোনো কথা বলবে না। কাছাকাছি পাম গাছের তলায় রচিত হবে এই ফুলশয্যা। তারা দুজনেই নগ্ন হবে। পাগলের মতো একে অন্যকে ভালোবাসবে। মনের অন্তরালের গান তখন তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাবে।
.
শেষ অবধি ডানা তার কুমারীত্ব হারালো এক আঠারো বছরের লাল চুলের কিশোরের কাছে। তার নাম রিচার্ড ডভিন্স, ফোরাম পত্রিকাতে ছেলেটি তার সঙ্গে কাজ করতো। ডানাকে সে আংটি পরিয়েছিল। এক মাস বাদে বাবা মার সাথে অন্য কোথাও চলে গেল। এরপর ডানা আর ওই ছেলেটির কথা মনে রাখেনি।
.
স্নাতক পরীক্ষা হতে আর একমাস বাকি। ডানা স্থানীয় সংবাদপত্রের অফিসে গেল, দেখল সেখানে রিপোর্টারের চাকরি পাওয়া যায় কিনা। কাগজের নাম ক্ল্যারেমন্ট এক্সামিনার।
যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তিনি ডানার জীবনপঞ্জীর দিকে তাকিয়ে বললেন–তাহলে আপনি ফোরামের সম্পাদিকা ছিলেন, তাই তো?
ডানার মুখে হাসি আপনি ঠিকই বলেছেন।
–আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি। ডানার মন আনন্দে আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে। কোন্ কোন্ দেশে সে যাবে তার তালিকা তৈরি করেছে রাশিয়া, চীন এবং আফ্রিকা।
ডানা বলেছিল–আমি হয়তো এখনই বিদেশে সংবাদদাতা হিসাবে কাজ পাবো না। কিন্তু এই কাজটা করতে আমি খুবই আগ্রহী।
–হ্যাঁ, প্রথমে আপনাকে শিক্ষানবীশ থাকতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে উন্নতি হবে।
ডানা সত্যি কাজটা পেয়ে আনন্দিত হয়েছিল।
.
ডানার হাতে কফির কাপ তুলে দেওয়া হল। অতি সহজেই সে কাজগুলো বুঝে নিল। রোজ নিয়মমতো অফিসুেযেত, সকলের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সকলকে সাহায্য করতে সদাই উন্মুখ।
ছ-মাস কেটে গেছে, ডানা তখনও শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করছে। একদিন সে ম্যানেজিং এডিটার বিল গ্রাউওয়েলের সঙ্গে কথা বলতে গেল।
ডানা বলল–আপনি কি এবার আমাকে একটা কাজ দেবেন?
ভদ্রলোক তাকালেন না, তিনি বললেন–এখনও সময় হয়নি, আমার কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
ডানা ভেবেছিল, এভাবে কেন আমাকে শোষণ করা হচ্ছে? আমি এই বাঁধন ছিঁড়ে একদিন বেরোবই। কোন কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।
.
একদিন সকালে ডানা ফাঁকা টেলিটাইপ রুমে বসেছিল, কফির কাপ শেষ হয়ে গেছে, প্রিন্ট আউট দেখা যাচ্ছে, ডানা পড়ল–অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, কারমন ক্যালিফোর্নিয়া, ক্লারেমন্টে আজ সকালে একজনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। ছবছরের একটি ছেলেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
ডানা গল্পের বাকিটা পড়ল, খোলা চোখে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টেলি টাইপের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। সে প্রিন্ট আউটটা বের করল, পকেটে পুরে নিল। কেউ এটা দেখতে পায়নি।
ডানা বিল গ্রাউওয়েলের অফিসে ঢুকল, বলল–মিঃ গ্রাউওয়েল, আজ সকালে কেউ দুবছরের একটা ছেলেকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতে হবে তাই তো?
বিল গ্রাউওয়েল খুবই উত্তেজিত কিন্তু কিছুই তো লেখেনি? খবর আসছে না কেন? তুমি কোথা থেকে শুনেছো?
–আমি ওই জায়গা দিয়ে হাঁটছিলাম, অনেকে বলাবলি করছিল।
কাউকে পাঠাবো?
–আমি যাব? যে দোকানের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে তার মালিক আমাকে ভালো চেনে। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন।
ডানার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক উদাসীনভাবে বলেছিলেন, ঠিক আছে, যাও।
ডানা দোকানের মালিকের সাথে কথা বলল। তার গল্পটা ক্ল্যারেমন্ট এক্সামিনার কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হবে। প্রতিবেদনটা ভালোই হয়েছে। বিল গ্রাউওয়েল বললেন–কাজটা ভালো হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ ডানা।
.
এক সপ্তাহ আগে টেলিটাইপ রুমে ডানা একা বসেছিল, এখন ব্যাপারটা পাল্টে গেছে। সাতদিন বাদে আবার সে বসে আছে, খবর ফুটে উঠেছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস–পামোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, মহিলা জুডো শিক্ষিকা এক ধর্ষককে ধরে ফেলেছেন।
ডানা আগের মতোই প্রিন্ট আউটটা ছিঁড়ে ফেলল। পকেটে পুরে দিল। ছুটে গেল বিল গ্রাউওয়েলের কাছে।
কণ্ঠে উত্তেজনা এনে বলল আমার পুরোনো রুমমেট এখনই আমাকে ফোন করেছিল, সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেছে এক ভদ্রমহিলা একটা পুরুষকে আঘাত করছে। আমি এই সংবাদটা কভার করতে যাব?
গ্রাউওয়েল বললেন–এক্ষুনি যাও।
ডানা পামোনাতে গাড়ি নিয়ে ছুটে গেল। জুডো প্রশিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলল। আবার তার প্রতিবেদনটা প্রথম পাতায় প্রকাশিত হল।
বিল গ্রাউওয়েল অফিসে এসে জিজ্ঞাসা করলেন–ডানা, তুমি এসব খবর পাও কোথা থেকে?
ডানা বলল–আমার অনেক সোর্স আছে।
তার কথা শেষ হয়নি, ভদ্রলোক বললেন–এখন থেকে তুমি কভারস স্টোরিতে নিয়মিত লিখবে কেমন?
পরদিন ক্লারেমন্ট এক্সামিনার কাগজটা বিক্রি করে দেওয়া হল ওয়াশিংটনের ওয়াশিংটন ট্রিবিউন পত্রিকার হাতে।
.
খবরটা ডানার কাছে পৌঁছে গেছে, ক্ল্যারেমন্ট এক্সামিনারের বেশির ভাগ সদস্যের মনে ঘন হতাশার ছাপ। বোঝা গেল, সকলকেই চাকরি হারাতে হবে। ডানা কিন্তু একথা ভাবলো না। সে ভাবলো এখন থেকে আমি ওয়াশিংটন ট্রিবিউনে কাজ করতে পারবো। আমি কেন হেডকোয়াটার্সের কাজে যোগ দেব না?
সে সোজা বিল গ্রাউওয়েলের অফিসে গিয়ে বলল–আমি দশদিনের ছুটি নেব।
ভদ্রলোক ডানার দিকে অবাক চোখে তাকালেন–ডানা, সকলে ভয় পাচ্ছে, বাথরুমে যেতে পর্যন্ত সাহস করছে না, তুমি ভয় পাওনি?
–কেন আমি ভয় পাব? আমি তো আপনার সবসেরা সাংবাদিক, আমি ওয়াশিংটন ট্রিবিউনে চাকরি পাব।
–তুমি সত্যি বলছো? ঠিক আছে ম্যাক বেকারের সাথে কথা বল। তাকে ওয়াশিংটন ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শুধু খবরের কাগজ নয়, টিভি স্টেশন, রেডিও সবকিছুর।
নামটা ডানা মনের খাতায় গেঁথে নিল।
.
০৮.
ওয়াশিংটন ডিসি। একটা মস্ত বড় শহর। ডানা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, এটা হল বিশ্বের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ডানা বাতাসের মধ্যে বিদ্যুতের পরশ পেল বুঝি। এখান থেকে আমার কাজ শুরু করতে হবে।
সে প্রথমে ডেনেসা হোটেলে গেল। ওয়াশিংটন ট্রিবিউন পত্রিকার অফিস কোথায় তা জেনে নিল। ছনম্বর স্ট্রিটে অফিসটা অবস্থিত। একটা ব্লক জুড়ে। চারটে আলাদা বড় বড় বাড়ি আছে। মনে হয় এই অফিস বোধহয় শূন্যে পৌঁছে গেছে। ডানা মেন লবিতে হেঁটে গেল। ইউনিফর্ম পরা গার্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
–আপনাকে সাহায্য করতে পারি মিস?
–আমি এখানে চাকরি করি, ট্রিবিউনে, ম্যাক বেকারের সাথে দেখা হবে?
আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে কী?
–না, করা নেই।
–তাহলে পড়ে আসবেন, গার্ড অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
একজন বললেন–সারকুলেশন বিভাগের প্রধানের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।
গার্ড একটা নাম্বার ডায়াল করলেন।
একটা এলিভেটর নেমেছে। লোজন বেরিয়ে আসছে। ডানা সেদিকে এগিয়ে গেল। গার্ড তাকে দেখতে পায়নি। সে বোম টিপে দিল, আরেকজন ভদ্রমহিলা সঙ্গে ছিল। ডানা জানতে চাইল-ম্যাক বেকার কোন তলায় বসেন?
মেয়েটি বলল–থার্ড ফ্লোরে। তোমার গলায় পরিচয় পত্র নেই কেন?
ডানা মিথ্যে কথা বলল–আমি হারিয়ে ফেলেছি।
এলিভেটর থার্ড ফ্লোরে পৌঁছে গেছে, ডানা বেরিয়ে এল। অনেকক্ষণ কথাহীনভাবেদাঁড়িয়ে থাকল। অসংখ্য কিউবিকল, মনে হচ্ছে একশোর বেশি হবে। একহাজার লোক সেখানে গিজগিজ। কত রঙের সংকেত চিহ্ন, সম্পাদকীয়, শিল্প, মেট্রো, খেলাধুলা, ক্যালেন্ডার।
ডানা জানতে চাইল এক কর্মচারীর কাছে মিঃ বেকারের অফিসটা কোথায়?
হলের একেবারে শেষে, ডান দিকে।
ডানা এগিয়ে চলল, ধাক্কা লেগে গেল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কাগজ ছড়িয়ে পড়ল।
ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠল- চোখ বন্ধ করে চল নাকি।
–এটা একটা দুর্ঘটনা, আমি কি আপনাকে সাহায্য করব?
ভদ্রলোক আরও রেগে গেছেন। বললেন–না, সাহায্যের দরকার নেই।
ডানা একটু হেসে বলল–ওয়াশিংটনের সবাই আপনার মতো নির্মম নাকি?
ডানাউঠে দাঁড়াল। মিঃ বেকারের কিউবের দিকে পৌঁছে গেল। গ্লাস উইনডোর ওপর লেখা আছে ম্যাক বেকার। অফিসটা ফাঁকা। ডানা একটা চেয়ারে বসে পড়ল। অফিসের জানলা দিয়ে তাকালো। বাইরে কাজকর্ম এগিয়ে চলেছে।
এটা ক্ল্যারেমন্ট এক্সামিনারের মতো নয়, হাজার হাজার মানুষ কাজ করছে। সর্বত্র লোকে গমগম করছে।
ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?
একজন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
তার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেছে এখানে বসে আপনি কী করছেন?
ডানা ঢোক গিলেছে–আপনি নিশ্চয়ই মিঃ বেকার, আমি ডানা ইভান্স।
–আমি জানতে চাইছি আপনি এখানে বসে কী করছেন?
–আমি ক্ল্যারেন্ট এক্সামিনারের রিপোর্টার।
–তাতে কী হয়েছে?
–এই কাগজটা আপনি কিনেছেন।
–হ্যাঁ, তাতে কী?
ডানা আমতা আমতা করে বলল–আমি এখানে কাজ করতে এসেছি। আমি তো ওখানে কাজ করতাম, এখন আমি আপনার কর্মচারী তাই?
ভদ্রলোক অবাক চোখে ডানার দিকে তাকালেন। তিনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন, বলেই ফেললেন–কে আপনাকে এখানে প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছে?
–আমি তো বলেছি, আমি ক্ল্যারেমন্ট এক্সামিনারের সংবাদদাতা ছিলাম।
–আপনি দয়া করে ক্ল্যারেমন্টেই ফিরে যান। নাকি আমি দারোয়ানকে ডাকতে বাধ্য হব?
ডানা উঠে দাঁড়াল, কঠিনভাবে বলল–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিঃ বেকার, আপনার আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ডানা ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল।
ম্যাক বেকার ডানার দিকে তাকালেন, মাথা নাড়লেন, পৃথিবীটা পাগলে ভরে গেছে।
.
বিশাল সম্পাদকীয় দপ্তর, অনেক রিপোর্টার কাজে ব্যস্ত, কেউ কেউ টাইপ করছে, কেউ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে আমি কাজ করবো, ব্যাপারটা ভাবতেই ডানা শিহরিত হয়ে উঠল।
ডানা ম্যাক বেকারকে দেখতে পেল, ডানার দিকে এগিয়ে আসছেন উনি। আবার এখানে ওই ভদ্রলোক? ডানা একটা কিউবিকলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল, ভদ্রলোক যাতে তাকে দেখতে না পান।
বেকার এক রিপোর্টারের কাছে গেলেন। বললেন–স্যাম, ইন্টারভিউটা নেওয়া হয়েছে।
–আমি জর্জ টাউন মেডিকেল সেন্টারে গিয়েছিলাম। ওই নামে কেউ আসেনি। টেলারের স্ত্রী ওখানে ভর্তি হয়েছেন।
ম্যাক বেকার রেগে গেলেন–এটা বাসি খবর, এখনও পর্যন্ত ইন্টারভিউ করা শিখলে না?
ডানা অবাক হয়ে গেল, সত্যিই তো, কীভাবে ইন্টারভিউ করতে হয় স্যাম তা বুঝতেই পারেননি বোধহয়।
.
ত্রিশ মিনিট কেটে গেছে, ডানা জর্জ টাউন মেডিকেল সেন্টারে ঢুকে পড়ল। সে ফুলের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।
একজন ক্লার্ক প্রশ্ন করল–আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
ডানা একটু ইতস্তত করে বলল–পঞ্চাশ ডলারের ফুল দেবেন তো।
ক্লার্ক তার হাতে ফুলের গোছা তুলে দিল। ডানা বলল–হাসপাতালের মধ্যে কোনো দোকান আছে কি? যেখান থেকে উপহার পাওয়া যেতে পারে?
-হ্যাঁ একটা গিফট শপ আছে।
গিফট শপে অনেক মানুষের ভিড়। শুভেচ্ছা পত্র রয়েছে, সস্তার খেলনা, বেলুন আর ব্যানার। জামফুড আরও কত কি। কতকগুলো স্যুভেনিয়রের ক্যাপ পাওয়া গেল। ডানা তার থেকে একটা বেছে নিল। যাতে মনে হতে পারে সে কোনো জায়গার কর্মচারী। ভালো দেখে একটা কার্ড কিনলো। ভেতরে কিছু একটা লিখল।
এবার সে এগিয়ে গেল ইনফরমেশন ডেস্কের দিকে। বলল–শ্রীমতী রকস্টার স্টিভ টেলারের জন্য কিছু ফুল উপহার দেব।
রিসেপশনিস্ট মাথা নেড়ে বলল–স্টিভ টেলার নামে কেউ তো এখানে ভর্তি হননি?
ডানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল- সত্যি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে এই উপহার।
ডানা কার্ডটা খুলে ফেলল। সেটা রিসেপশনিস্টকে দেখাল। লেখা আছে, সেরে উঠুন। তলায় সই-আর্থার, ক্যানন।
ডানা বলল–আমি কি এগুলো ফেরত নিয়ে যাব?
ডানা যাবার জন্য পা বাড়াল।
রিসেপশনিস্ট তার দিকে তাকিয়ে বলল–একটুখানি অপেক্ষা করুন। আমি কি এই ফুলগুলো নিয়ে যাব?
ডানা বলল–দুঃখিত, ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যানন বলেছেন এগুলো আমি যেন নিজের হাতে পৌঁছে দিই।
রিসেপশনিস্টের দিকে তাকিয়ে আবার সে বলল–আপনার নামটা আমি জানতে পারি কী? তাহলে আমি মিঃ ক্যাননকে বলব আমি কাকে ফুলের তোড়া দিয়ে এসেছি।
মুখে ভয়ার্ত প্রতিচ্ছবি–ঠিক আছে, আমি কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে চাইছি না। আপনি দুশো পনেরো নম্বর ঘরে চলে যান। কিন্তু ফুলের তোড়া দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসবেন কেমন?
পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। দেখা গেল ডানা রকস্টার স্টিভ টেলারের বউয়ের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
স্টাসি টেলারের বয়েস কত হবে? চব্বিশ পার হয়ে পঁচিশ বোধহয়। তাকে দেখতে কেমন চট করে বলা সহজ না। এই মুহূর্তে তার মুখে বিবর্ণতার আভাস। মুখ বেশ ফুলে উঠেছে। তিনি এক গ্লাস জল খাবার চেষ্টা করছেন।
ডানা এগিয়ে গেল।
সে বলল–আপনার জন্য ফুলের তোড়া।
কোথা থেকে এসেছে?
ফিসফিসে কণ্ঠস্বর।
ডানা কার্ডটা সরিয়ে ফেলেছে–বলল, একজন মানুষ আপনাকে দিয়েছে, যে আপনাকে সত্যিই শ্রদ্ধা করে।
ভদ্রমহিলা ডানার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছেন আপনি কি জলের গ্লাসটা আমার হাতে তুলে দিতে পারেন?
ডানা এগিয়ে গেল, ফুলের তোড়া রেখে দিল, জলের গ্লাসটা তার হাতে তুলে দিল। বলল আর কিছু করবো কী?
ঠোঁট ফুলে গেছে, ভদ্রমহিলা বললেন–আমি এখান থেকে বাইরে যেতে চাইছি। আমার স্বামী আমার কোনো অভ্যাগতদের এখানে আসতে দিচ্ছে না। ডাক্তার আর নার্সদের মধ্যে থাকতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
ডানা চেয়ারে বসে পড়ল। জানতে চাইল–আপনার কী হয়েছিল?
ভদ্রমহিলা বললেন–আপনি জানেন না? আমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল।
ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখের। ডানা সন্দেহজনকভাবে মন্তব্য করল।
বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, এই মহিলাকে ভীষণভাবে আঘাত করা হয়েছে।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে, ডানা সত্যি গল্পটা জানতে পেরেছে।
.
ডানা আবার ওয়াশিংটন ট্রিবিউনের লবিতে ফিরে গেল, অন্য একজন গার্ড সেখানে দাঁড়িয়েছিল- আপনাকে সাহায্য করবো কী?
ডানা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল–মিঃ বেকারকে বলুন, আমি এখনি আসছি। অনেকটা দেরী হয়ে গেল। উনি হয়তো রাগ করবেন।
ডানা এলিভেটরের দিকে ছুটে গেল, বোতাম টিপল। প্রহরী তার দিকে তাকালো, তারপর ডায়াল করল- হ্যালো, মিঃ বেকারকে বলুন এক তরুণী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
এলিভেটর এসে গেছে, ডানা ঢুকে পড়ল, বোতাম টিপে দিল।
নির্দিষ্ট জায়গায় এসে এলিভেটর থেমে গেল। আরও বেশি কাজের চাপ। ডানা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছে না। ডানা একটা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। টাইপ ঘর, গল্পটাকে এখনই সাজাতে হবে। কিন্তু কী করে? একটা টাইপ কি ফাঁকা পাওয়া যাবে? হ্যাঁ পেয়ে গেছে, সে টাইপ করে ফেলল, হঠাৎ তার ঘরে কার ছায়া?
ম্যাক বেকার চিৎকার করছেন আপনি এখানে কী করছেন?
আমি একটা কাজের সন্ধানে এখান এসেছি মিঃ বেকার। আমি গল্পটা লিখেছি, দেখুন তো আপনার ভালো লাগে কিনা?
আপনি আবার ভুল করছেন, বেকার বোমার মতো ফেটে পড়লেন–আপনি এভাবে কাজ করতে পারেন না, অন্য কারোর ডেস্কে বসার অধিকার আপনার নেই। আপনি নরকের অন্ধকারে চলে যান। না হলে আমি এক্ষুনি সিকিউরিটিকে ডাকতে বাধ্য হব। আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
-কিন্তু…
–এক্ষুনি বেরিয়ে যান।
ডানা উঠে দাঁড়াল, সত্যি খারাপ লাগছে তার, সে ম্যাক বেকারের হাতে কাগজগুলো তুলে দিল। এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল।
ম্যাক বেকার অবাক হয়ে কাগজের দিকে তাকালেন। তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। কোথায় ছুঁড়ে ফেলবেন? কাছাকাছি ওয়েস্ট বাস্কেট আছে কী?
শেষ বার কী যেন মনে করে ম্যাক টাইপ করা শব্দগুলোর দিকে তাকালেন। প্রথম শব্দটাই তাকে অবাক করে দিল। ডানার গল্পটা এইভাবে শুরু হয়েছে স্টাসি টেলার, তার মুখে আঘাতের চিহ্ন, বলছেন উনি নাকি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে পড়েছেন। কিন্তু এই ঘটনার পেছনে অন্য একটি গল্প আছে। তিনি বিখ্যাত রকস্টার স্টিভ টেলারের স্ত্রী। স্টিভ টেলার ওঁকে মাঝে মধ্যে আঘাত করেন। যতবার উনি গর্ভবতী হয়ে যান, স্বামীর কাছ থেকে আঘাত সইতে হয়। কারণ রকস্টার সন্তানের বাবা হতে চান না।
ম্যাক স্তব্ধ হয়ে গেছেন, তাঁর সমস্ত শরীরে শীতল শিহরণ। তিনি পুরো প্রতিবেদনটা পড়ে ফেললেন। কিন্তু ডানাকে কোথাও দেখা গেল না।
কাগজগুলো হাতে নিয়ে তিনি থরথর করে কাঁপছেন। তিনি এলিভেটরের দিকে ছুটে গেলেন। ডানা সেখানে আছে কি? তাকালেন সবদিকে, শেষ পর্যন্ত ডানাকে দেখা গেল, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, মিটি মিটি হাসছে।
উনি চিৎকার করে বললেন–এই গল্পটা কোথা থেকে পেলেন?
ডানা শান্তভাবে জবাব দিল–আমি তো আগেই বলেছিলাম স্যার, আমি হলাম একজন রিপোর্টার।
ভদ্রলোক বললেন–এক্ষুনি আমার অফিসে চলে আসুন।
.
ম্যাক বেকারের অফিস।
ম্যাক বেকার বললেন–কাজটা কিন্তু সত্যিই উত্তেজক। আশা করি আপনি করতে পারবেন।
–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি আমাকে চাকরিটা দিয়েছেন বলে।
ডানা চিৎকার করে বলতে লাগলো দেখবেন স্যার, আমি আপনার সবসেরা রিপোর্টার হব। আমি কথা দিচ্ছি। আমি আপনার পত্রিকার ফরেন করসপন্ড হতে চাইছি। হয়তো আজ অথবা আগামীকাল আমার স্বপ্ন সফল হবে।
–ট্রিবিউনে কোনো চাকরি খালি নেই। তবে ভবিষ্যতে কিছু একটা হতে পারে।
ডানার চোখে বিস্ময়–কিন্তু আমি ভেবেছিলাম….
একটুখানি অপেক্ষা করুন।
ডানা দেখল ভদ্রলোক কলম নিয়ে কী যেন লিখছেন।
একটু বাদে উনি বললেন আপনি কখনও ডব্ল টি ই দেখেন? ট্রিবিউন এন্টারপ্রাইজের টেলিভিশন স্টেশন।
না, স্যার।
এখন থেকে আপনাকে ওটা দেখতে হবে। সেখানে চাকরি খালি আছে। একজন লেখক কাজটা ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি তার জায়গাতে কাজ করবেন।
ডানা জানতে চাইল- কী করতে হবে?
দূরদর্শনের জন্য কপি লিখতে হবে।
দূরদর্শনের জন্য কপি? আমি তো কিছুই জানি না।
–খুবই সোজা, প্রোডিউসার আপনাকে বিভিন্ন নিউজ সার্ভিস থেকে নিউজ তুলে দেবেন। আপনি সেগুলোকে গল্পের আকারে সাজিয়ে ফেলবেন। যাতে অ্যাঙ্কার সেগুলো পড়তে পারে।
ডানা বসে থাকল, নীরব হয়ে।
–আমি একজন সাংবাদিক।
–এখানে পাঁচশো জন সাংবাদিক আছে, তারা অনেক বছর ধরে কাজ করছে। আপনি এখনই চার নম্বর বিল্ডিং-এ চলে যান। মিঃ হকিন্সকে খোঁজ করুন। দেখবেন টেলিভিশনের চাকরিটা আপনার খারাপ লাগবে না। ইতিমধ্যে আমি হকিন্সকে ফোন করছি।
ডানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল- আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ বেকার, যদি কখনও মনে হয়…
–আপনি এখনই এখান থেকে বেরিয়ে যান।
.
ডব্ল টি ই টেলিভিশনের স্টুডিও, সমস্ত সাততলা জুড়ে, তার চার নং বিল্ডিং-এ, প্রোডিউসার টম হকিন্স, ডানা তার ঘরে ঢুকে পড়ল- প্রথম প্রশ্ন- আপনি কখনও টেলিভিশনে কাজ করেছেন?
না স্যার, আমি খবরের কাগজের সাংবাদিক। এটা তো ডায়নোসরদের যুগ, আমরাই বর্তমান, জানি না ভবিষ্যৎ কী হবে।
কত মানুষ, ডেস্কে বসে কাজ করছেন, মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিউজ সার্ভিস থেকে অবিরাম খবর আসছে। খবরগুলোকে অনুবাদ করতে হচ্ছে।
সারা পৃথিবী থেকে খবর আসছে, হকিন্স বুঝিয়ে দিলেন, আপনাকে সেই খবরগুলো বাছতে হবে। মাইক্রো ওয়েভের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। এছাড়া পুলিশ চ্যানেল আছে, সেলফোনের মাধ্যমে খবর আসবে। স্ক্যানার আছে, মনিটর, মিনিটে মিনিটে খবর আসে। বুঝতে পারছেন কত তাড়াতাড়ি কাজগুলো করতে হবে।
ডানা জানতে চাইল- এখানে কজন রাইটার কাজ করেন?
ছজন, আপনাকে একটা ভিডিও কো-অর্ডিনেটরের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। আরও কতজনের সঙ্গে আপনি কাজ করবেন।
…এই দেখুন, এরা হলেন সঞ্চালক এবং সঞ্চালিকা। জুলিয়া আর মাইকেল।
জুলিয়া অসামান্য রূপসী, চেস্টনাটের মতো তার চুলের রং। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কাজটার মধ্যে আনন্দ আছে।
মাইকেল টাটে, অ্যাথলেটের মতো চেহারা, মুখে পুরুষ সুলভ হাসি।
হকিন্স পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের নতুন রাইটার ডানা।
–আমি ডানা, স্যার। ডানা বলল।
হকিন্স ডানাকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন। অ্যাসাইমেন্ট বোর্ডটা দেওয়ালে টাঙানো ছিল।
উনি বললেন–এখানে অনেকগুলো গল্প লেখা আছে। যেগুলো আমি পছন্দ করব, সেগুলোকে স্লগ বলা হয়। প্রত্যেক দিন বারবার এই বোর্ডের দিকে তাকাতে হবে। সারাদিন ধরে সংবাদ আসবে। মনে রাখবেন, প্রতিটি সংবাদই গুরুত্বপূর্ণ।
-ঠিক আছে, ডানা চিন্তিত মুখে জবাব দিয়েছিল।
.
প্রথম রাতের অনুষ্ঠানটা খুবই খারাপ হয়েছে। ডানা ঠিক মতো লিখতে পারেনি। সব কেমন গোলমাল হয়ে গেছে। তাই দেখা গেল জুলিয়া-মাইকেলের লেখাটা পড়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। মাইকেলও শেষ পর্যন্ত জুলিয়ার বক্তব্যটা বলেছে।
ব্রডকাস্ট হয়ে গেছে, ডিরেক্টর ডানাকে ডাকলেন- মিঃ হকিন্স আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি এখনই যান।
হকিন্স ডেস্কে বসেছিলেন, থমথম করছে তার রাগী মুখ।
–আমি জানি, ডানা আহত আর্তনাদে বলে ওঠার চেষ্টা করে, ভুল হয়েছে, পরবর্তীকালে আর হবে না।
হকিন্স ডানার দিকে তাকালেন–ভবিষ্যতে এমন যেন না হয়। তাহলে কিন্তু ফল ভালো হবে না।
আবার বললেন তিনি কাল সকাল আটটায় এখানে চলে আসবেন, কথাটা যেন মনে থাকে।
দুপুরের খবরটা অনেক ভালো হয়েছে। টম হকিল ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ডানা বুঝতে পারল। ছন্দে ফিরতে হবে, গল্পটা লিখতে হবে। টেপ এডিটরের সাথে কাজ করতে হবে। এমনভাবেই এক-একটি সুন্দর উপস্থাপনা।
তখন থেকেই এই কাজটা ডানার দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে ঢুকে গেল।
.
আটমাস বাদে ডানার জীবনে সত্যি একটা পরিবর্তন এল। তখন সে আরও উঁচু পদে উঠে গেছে।
একদিন ডিরেক্টর রব ক্লাইন চিৎকার করছিলেন–ও কোথায় গেল?
–আমি জানি না।
কতক্ষণ ওকে দেখা যায়নি?
–অনেকক্ষণ।
–ওর অ্যাপার্টমেন্টে ফোন করা হয়েছে?
–আনসারিং মেশিন উত্তর দিচ্ছে।
–আশ্চর্য, মাত্র বারো মিনিট সময় আছে।
জুলিয়ার হয়তো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মাইকেল হেসে বলল, ও হয়তো মরেই গেছে।
এটা কোনো কাজের কথা হল না। জুলিয়া কেন ফোন করল না।
ডানা বলল–আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার।
ডিরেক্টর ডানার দিকে অধৈর্য হয়ে তাকালেন–হ্যাঁ, কী বলছ বলো?
-যদি জুলিয়া আসতে না পারে, আমি কি সঞ্চালিকার কাজটা করব?
উনি সহকারীর দিকে তাকালেন–ব্যাপারটা ভুলে যাও। সিকিউরিটিকে ডাকো, যদি মেয়েটি আসে…।
ফোন তুলে ডায়াল করা হল–জুলিয়া ব্রিংকম্যান কি এসেছে? যদি আসে, এখানে তাড়াতাড়ি আসতে বলল। একটা এলিভেটর আটকে রেখো।
–ঠিক আছে।
ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে আবার তার ঘড়ির দিকে তাকালেন মাত্র সাত মিনিট আছে।
ডানা উঠে দাঁড়িয়েছে। মাইকেল বলল–আমি কি সবটা পরিচালনা করব?
ডিরেক্টর বললেন না, দুজনকে চাই। তিনি আবার ঘড়ির দিকে তাকালেন, মাত্র তিন মিনিট, বুঝতে পারছি না, মেয়েটার কী হল?
ডানা শেষ পর্যন্ত বলে স্যার, আমি সবকটা শব্দ জানি। আমি এটা লিখেছি।
উনি তাকালেন না, তোমার মেকাপ নেওয়া হয়নি। তোমার পোশাকটাও ভালো নয়।
সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের ঘর থেকে একটা ভয়ার্ত শব্দ ছুটে এল–দুমিনিট বাকি আছে, এবার যেতে হবে।
মাইকেল হাত ঝাঁকাল। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
–প্লীজ-প্লীজ, ডানা ডিরেক্টরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। শুভরাত মিঃ ক্লাইন।
সে দরজা ঠেলে এগিয়ে গেল।
ডিরেক্টর অসহায়ের মতো হাতে হাত ঘষলেন- তুমি এটা করতে পারবে?
ডানা বলল–আমার ওপর ভরসা রাখুন।
আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন–ঠিক আছে। চলে যাও, ওঃ, আমি কেন মায়ের কথা শুনে ডাক্তার হলাম না?
ডানা প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেল। মাইকেল টাটের পাশে বসে পড়ল।
তিরিশ সেকেন্ড, কুড়ি-দশ-পাঁচ।
ডিরেক্টর ইঙ্গিত করলেন, লাল আলো জ্বলে উঠল।
শুভ সন্ধ্যা, ডানা গড়গড় করে পড়তে থাকে, ডবলিউ টি ই দশটার খবরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আপনাদের জন্য একটা ভয়ংকর খবর আছে, ঘটনাটা হল্যান্ডে ঘটেছে। আর্মস্টারডামে একটা বিস্ফোরণ হয়েছে।
ভালোভাবেই কাজটা উতরে গেল।
.
পরের দিন সকালবেলা, বব ক্লাইন ডানার অফিসে এসেছেন। – খারাপ খবর আছে, গতরাতে জুলিয়া অটোমোবাইল অ্যাকসিডেন্টে পড়েছে। তাকে আর চেনা যাচ্ছে না। মুখটা একেবারে বিকৃত হয়ে গেছে।
ডানা চিৎকার করল–সে কী? আমি তো ভাবতেই পারছি না।
–হ্যাঁ, তাকে দেখলে আর চেনা যাবে না।
–প্লাস্টিক সার্জারি?
–না, জুলিয়া বোধহয় আর এই পেশাতে আসতে পারবে না।
–আমি ওকে দেখতে যাব, কোথায় আছে?
–অডিগনে চলে গেছে, পরিবারের লোকেদের কাছে।
–আমার খুবই খারাপ লাগছে।
–কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়।
তিনি ডানার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। গতরাতে তুমি ভালোই বলেছ, কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত তোমাকেই সঞ্চালিকার কাজটা করতে হবে।
.
ডানা ম্যাক বেকারের ঘরে পৌঁছে গেল–আপনি গতকালের খবরটা দেখেছেন তো?
ভদ্রলোক বললেন–হ্যাঁ, তুমি ভালোই বলেছ, কিন্তু মেকাপ নিতে হবে। ভালো পোশাক পরতে হবে।
ডানা বলল–ঠিক আছে, এবার দেখবেন।
ম্যাক বেকার বললেন–তোমার গলাটা খুব একটা খারাপ নয়।
পঞ্চম রাত, ডিরেক্টর ডানাকে বললেন–এবার সত্যি তুমি একাজের যোগ্য হয়ে উঠেছ।
.
ছমাসের মধ্যে ডানা ওয়াশিংটনের কেউকেটা হয়ে উঠল। সে কমবয়সি, আকর্ষণীয়া ব্যক্তিত্ব আছে তার। আছে বুদ্ধির ছটা–আর কী চাই? এক বছরের মধ্যে তাকে বিশেষ কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হল। হেয়ার অ্যান্ড নাউ নামে একটি অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ইন্টারভিউ তাকে নিতে হয়। এই অনুষ্ঠানটা দর্শক মহলে। খুবই জনপ্রিয়। ডানার ইন্টারভিউর ধরনটা খুবই সুন্দর। আন্তরিক এবং সহানুভূতিসম্পন্ন। বিখ্যাত মানুষেরা প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করেন। তারপর তারা অন্তরঙ্গ হয়ে যান।
.
রাত হয়েছে, ডানা আন্তর্জাতিক খবরের দিকে চোখ রেখেছে। বিদেশের সংবাদদাতাদের ওপর তার ভীষণ রাগ। তারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে। তারা পৃথিবীর সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছে দেয়।
নিজেকে হতাশ মনে হল ডানার।
.
দুবছরের শর্ত–ডব্লিউ টি ই-র সঙ্গে। এবার তা শেষ হবার পথে। প্রধান করসপনডেন্ট ফিলিপ কোলে একদিন ডানাকে ডেকে পাঠালেন।
–ডানা, তুমি ভালো কাজ করেছ। আমরা সবাই তোমার কাজে খুবই গর্বিত।
–আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ফিলিপ।
–তোমার সাথে নতুন চুক্তি করতে হবে।
–আমি ছেড়ে দেব।
কী, বলছ কী?
–আমার শর্ত শেষ হয়ে গেলে আমি আর এখানে থাকব না।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেছেন- তুমি কী করবে?
–এই কাজটা আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু আমি বিদেশী সংবাদদাতা হতে চাইছি।
–সে জীবনটা খবুই কষ্টের, ভদ্রলোক বললেন, কেন তুমি এই কাজ চাইছ?
–আমি নামকরা লোকের সঙ্গে কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সেই একইরকম গল্প। কে কার পঞ্চম স্বামীর সাথে ডিনার খেয়েছে, কে তৃতীয় স্ত্রীর সাথে শুয়েছে। নাঃ, আর ভালো লাগছে না।
ডানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–আমি দুঃখিত, এখানে আর থাকতে পারছি না।
সে লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
–একটু অপেক্ষা করো। তুমি এই কাজটা সত্যি করতে পারবে?
ডানা শান্তভাবে বলল–হ্যাঁ, এটাই আমার ছোটোবেলার স্বপ্ন।
ভদ্রলোক একমুহূর্ত কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন–তুমি কোথায় যেতে চাও?
এক মুহূর্তের মধ্যে ডানা জবাব দিল, সারাজেভো।
.
০৯.
অলিভার রাসেল ভাবতেই পারেননি, গভর্নরের জীবনটা এত সুন্দর হতে পারে। প্রতিমুহূর্তে ক্ষমতার স্বাদ। নিষিদ্ধ আনন্দের উত্তেজনা। ক্ষমতাকে এক আবেদনি রক্ষিতা বলা যায়। অলিভার তাকে খুবই ভালোবাসেন। হাজার হাজার মানুষের জীবন তার ওপর নির্ভর করছে। ভাবতেই ভালো লাগে। সকলের ওপর প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমশ বাড়ছে। জীবনটা এখন একেবারে পাল্টে গেছে। সেনেটর ডেভিসের কথা মনে পড়ল–এটার সবেমাত্র পথ চলা শুরু হল। মনে রেখো, তুমি কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছ, সাবধানে পা ফেলবে।
হ্যাঁ, এখন অলিভার অনেক চালাক হয়ে গেছেন। অসংখ্য ঘটনা আছে তার জীবনে। কিন্তু তিনি খুব সুন্দরভাবে সেই ঘটনাগুলো পরিচালনা করেন। এই ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার।
সময়-সময় অলিভার মিরিয়ামের অবস্থা জানতে চান।
–গভর্নর, উনি এখনও কোমাতে আছেন।
আমাকে তাজা খবর জানিও কিন্তু।
.
গভর্নর হিসেবে অলিভারের অন্যতম কাজ হল রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করা। সেই ভোজসভায় শহরের বিশিষ্ট মানুষরা উপস্থিত থাকেন। আসেন ক্রীড়াজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা, বিনোদনের সম্রাটরা, রাজনৈতিক নেতারা, বিদেশি অতিথি অভ্যাগতরা।
জ্যান এখন এক সর্বময়ী কত্রী হয়ে উঠেছে।
একদিন জ্যান অলিভারের কাছে এসে বলল–বাবার সঙ্গে কথা বলেছি, আসছে সপ্তাহের শেষের দিকে বাবা তার বাড়িতে একটা পার্টি দিচ্ছে। বাবা চাইছে, আমরা যেন ওই পার্টিতে যাই। ওখানে এমন কজন আসবেন, তোমার সঙ্গে তাদের আলাপ করা দরকার।
.
ওই শনিবার, সেনেটর ডেভিসের বাড়িতে দারুণ পার্টির আসর। অলিভার অনেকের সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হলেন। তারা ওয়াশিংটনের বিখ্যাত ব্যবসাদার। অসাধারণ পার্টি। অলিভার আনন্দ উপভোগ করলেন।
–অলিভার, সময়টা যেন ভালো কাটে।
–হ্যাঁ, এই পাটিটা আমার মনে থাকবে।
পিটার ট্যাগার বললেন–মনে রেখো, দিনগুলো এভাবেই কাটাতে হবে। পরে আবার দেখা হবে, কেমন?
সেনেটর ডেভিস এগিয়ে গেলেন। কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক এসেছেন।
ইতালিয় রাষ্ট্রদূতকে চোখে পড়ল। বছর ষাট বয়স হয়েছে। সিলিকান বৈশিষ্ট্য আছে তার চেহারাতে, তার স্ত্রী সিলভা, অসাধারণ রূপবতী মহিলা, এমন সৌন্দর্য অলিভার জীবনে কখনও দেখেননি। বিয়ের আগে তিনি এক অভিনেত্রী ছিলেন। এখনও ইতালিতে তিনি খুবই জনপ্রিয়। অসাধারণ দুটি বাদামী চোখ। ম্যাডোনার মতো মুখ। রুবেনস–এর মুখচ্ছবির মতো চেহারা, স্বামীর থেকে পঁচিশ বছরের ছোটো।
সেনেটর ডেভিস ওই দম্পতিকে অলিভারের কাছে নিয়ে গেলেন। পরিচয়ের পালা শেষ হল।
অলিভার বললেন আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি।
ভদ্রমহিলার মুখে হাসি আপনার কথা অনেক শুনেছি।
খারাপ কিছু শোনেননি তো?
রাষ্ট্রদূত বললেন–সেনেটর ডেভিস, আপনার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
অলিভার সিলভার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি গৌরবান্বিত বোধ করছি।
সেনেটের ডেডিস এগিয়ে এলেন, দম্পতিদের নিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন। ফিরে এলেন অলিভারের কাছে। বললেন–গভর্নর, নিষিদ্ধ ফল, একটা কামড় দিলেই তোমার ভবিষ্যৎ গুডবাই বলে চলে যাবে।
–আমাকে এরকম ভাববেন না যেন।
না, আমি কিন্তু এ ব্যাপারে খুবই চিন্তিত।
সন্ধ্যে শেষ হয়ে গেল। সিলভা এবং তার স্বামী এবার চলে যাবেন।
–আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুবই ভালো লাগল। ইতালিয় রাষ্ট্রদূত বললেন।
সিলভা অলিভারের হাতে হাত দিলেন। মৃদু চাপ দিয়ে বললেন–আপনার সাথে আবার দেখা হবে তো?
অলিভার ভাবলেন, না, শ্বশুরমশাইয়ের কথাটা মনে রাখতে হবে।
.
দুসপ্তাহ কেটে গেছে। অলিভার ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরে এসেছেন। কাজে ব্যস্ত আছেন। হঠাৎ সেক্রেটারির কণ্ঠস্বর- গভর্নর, সেনেটর ডেভিস আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
–এখানে এসেছেন? ওনাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
অলিভার জানতেন, তার শ্বশুরমশাই ওয়াশিংটনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিলের স্বপক্ষে লড়াই করছেন। উনি কেন ফ্রাঙ্কফুর্টে এলেন?
দরজা খুলে গেল। সেনেটর ভেতরে ঢুকলেন। সঙ্গে পিটার ট্যাগার।
সেনেটর টড হাসলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন–গভর্নর, তোমার সঙ্গে কথা বলতে এলাম।
টড, আপনাকে দেখে ভালোই লাগছে। পিটার, শুভ সকাল।
সেনেটর ডেভিস বললেন–আশা করি আমি তোমাকে বিরক্ত করছি না।
-কেন বলুন তো, কিছু খারাপ হয়েছে কী?
সেনেটর ডেভিস ট্যাগারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন–না, কোনো কিছু খারাপ হয়নি। সব কিছুই ঠিক মতো চলছে।
অলিভার দুই আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–একটা ভালো খবর আছে। আমরা কি বসব?
–হ্যাঁ, আমাকে ক্ষমা করবেন। কী খাবেন? কফি, নাকি হুইস্কি?
–না, আমরা যথেষ্ট খেয়ে এসেছি।
অলিভার তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
–আমরা এই মাত্র ওয়াশিংটন থেকে উড়ে আসছি। অনেকে চাইছেন, তোমাকে আমাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট করতে।
অলিভারের সমস্ত শরীরে শিহরণ। আপনি সত্যি বলছেন!
আমি এখানে এসেছি তোমার প্রচার অভিযান শুরু করতে।দুবছর পরে ওই নির্বাচন হবে।
পিটার ট্যাগার বললেন–এটাই সঠিক সময়। পৃথিবীর সকলের কাছে তোমার নাম পাঠাতে হবে। সেই সঙ্গে পরিচয়পত্র।
সেনেটর ডেভিস বলতে থাকলেন পিটারের হাতেই তোমার প্রচার পরিকল্পনার দায়িত্ব দিতে হবে। ও সব কিছু ঠিকঠাক করবে। তুমি ওর থেকে ভালো আর কাউকে পাবে না।
অলিভার তাকালেন। বললেন–আমি রাজী আছি।
–আমার খুব ভালো লাগছে অলিভার, দুজনে মজা করে দিন কাটাব কেমন?
অলিভার সেনেটর ডেভিসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–অনেক খরচ হবে, তাই তো?
খরচের জন্য চিন্তা করো না। আমি আমার ভালো বন্ধুদের জন্য অনেক খরচা করতে পারি। শুধু তাই নয়, আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী আছে। আমি বললে তারা হাত উপুড় করে দেবে।
তিনি সামনের দিকে ঝুঁকলেন–নিজেকে কখনও ছোটো করবে না অলিভার। কয়েক মাস আগে একটা সার্ভে করা হয়েছিল। দেখা গেছে এই বিরাট দেশে তুমি হলে তিন নম্বর সফল গভর্নর। আরও দুজনকে টপকাতে হবে। কী রাখতে হবে বলো তো? অসম্ভব ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয়তা, সেটাই হল আসল চাবিকাঠি। টাকা দিয়ে আমরা সেই আকর্ষণী শক্তিকে কিনতে, পারি না, মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে ভোট দেবে। এটাই হল মোদ্দা কথা।
অলিভার ক্রমশ আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন আমাদের এই প্রচার অভিযান কবে থেকে শুরু হবে?
–আমরা এখনই শুরু করে দিয়েছি। আমরা একটা বিরাট দল তৈরি করেছি। আমরা সারা দেশে অসংখ্য প্রতিনিধি পাঠাব।
উৎসাহের চোখে সেনেটর ডেভিস বলতে থাকেন।
-আমি কি জিতব?
–প্রথম দিকে একথা বলব কী করে? সকলের চোখ খুলতে হবে। ট্যাগার বলতে থাকলেন, এটা হল সাধারণ নির্বাচন। রাষ্ট্রপতি নর্টন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। যদি তার বিরুদ্ধে তোমাকে লড়তে হত, আমি বলতাম, আশা খুব একটা নেই। কিন্তু এটা তার দ্বিতীয়বারের লড়াই, তিনি আর দাঁড়াতে পারবেন না। উপরাষ্ট্রপতি ক্যাননকে তার বিবর্ণ ছায়া বলা হয়। সামান্য আলোকরেখা পড়লেই তিনি অদৃশ্য হয়ে যাবেন।
.
চার ঘণ্টা ধরে এই অধিবেশনটা চলেছিল। অধিবেশন শেষ হয়ে গেল। সেনেটর ডেভিস বললেন পিটার, তুমি কি আমাকে একটু সময় দেবে?
-কেন দেব না সেনেটর?
উনি বেরিয়ে গেলেন।
সেনেটর ডেভিস বললেন–সকালবেলা জ্যানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে।
অলিভার মুখে হাসি এনে বললেন–তাই নাকি?
সেনেটর ডেভিস অলিভারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন–জ্যান খুবই খুশি হয়েছে।
–তার মানে?
–ঘরের আগুন জ্বলে উঠেছে। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি? মনে । রেখো, এই কাঁটা বিছানো পথ ধরেই তোমাকে এগোতে হবে।
.
সেনেটর ডেভিস এবং পিটার ট্যাগার পরস্পরের মত বিনিময় করছেন।
সেনেটর বললেন–একদল ভালো ছেলেমেয়ে নিয়োগ করতে হবে। খরচের জন্য ভেবো না। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং সানফ্রানসিসকোতে অফিস খুলতে হবে। বারোমাসের ভেতর প্রাথমিক কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। আঠারো মাস বাদে কনভেনশনের আসর বসবে। তারপর আমরা তরতর করে এগিয়ে যাব।
তিনি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে চলে এসো পিটার।
–তুমি একটা ভালো প্রেসিডেন্ট হবে। তোমাকে আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
পিটার ট্যাগার বললেন।
.
ভালোভাবেই প্রচার পরিকল্পনা শুরু হল। পিটার ট্যাগার অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তাঁকে এই ব্যাপারে বিশ্বের অন্যতম সেরা পথ-প্রদর্শক বলা যেতে পারে। ট্যাগার এক সুউন্নত মানুষ। তার মধ্যে ধার্মিক বৈশিষ্ট্য আছে। পারিবারিক দিকেও তিনি যথেষ্ট সুখী এবং সফল। সকলের সাথে মানিয়ে চলতে পারেন। অনায়াসেই মানুষের মন জয় করতে পারেন। এইভাবেই অচিরে তিনি অলিভারের ডানহাত হয়ে উঠলেন।
.
ট্যাগার জানতেন, যদি অলিভার এই লড়াইতে জিতে যান, তাহলে কনভেনশনে অন্তত দুশো জনপ্রতিনিধির ভোট পেতেই হবে। কী করে সেই ভোট নিশ্চিন্ত করা যায়, ট্যাগার তার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করতে শুরু করলেন।
–প্রত্যেকটি রাজ্যে তিনি বারবার যেতে থাকলেন। অলিভার ওই অভিযানের দিকে তাকিয়ে। আঁতকে ওঠেন। অসম্ভব পিটার, কোনোমতেই সম্ভব নয়।
ট্যাগার বলতে থাকেন সবকিছু পরস্পর সংযুক্ত। এই ভ্রমণটা করতেই হবে। লোকের সাথে না মিশলে তারা তোমাকে ভোট দেবে কেন?
.
সেনেটর ডেভিস লমবার্ডের সাথে অলিভারের পরিচয় করালেন। লমবার্ডো লম্বা চওড়া চেহারার মানুষ। দেখলেই বোঝা যায়, কথা বলেন কম, কিন্তু কাজ করেন বেশি।
অলিভার জানতে চাইলেন- এই ভদ্রলোককে কেন নিয়ে আসা হল?
উনি হলেন আমাদের সমস্যার একমাত্র প্রতিষেধক। কোনো কোনো সময় এই ধরনের। মানুষের প্রয়োজন হয়।
অলিভার আর তর্ক করার সাহস পেলেন না।
.
এবার প্রচার তার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। অলিভারকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, ভালো ভিড় চোখে পড়ছে। পেনিসিলভেনিয়াতে তিনি বললেন এই দেশের প্রথম বিষয় হল বাণিজ্য। এই কথাটা ভুললে চলবে না। আমাদের অনেকগুলো ফ্যাক্টরি খুলতে হবে।
জনগণের হাততালি।
ক্যালিফোর্নিয়াতে তিনি বললেন–আমেরিকার সব থেকে বড়ড়া শিল্প হল বিমান তৈরি করার শিল্প। একটাও এই ধরনের কারখানা যেন বন্ধ না হয়ে যায়। আমরা বন্ধ কারখানাগুলিকে আবার খুলব।
দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা।
ডেসট্রয়েটে তিনি বললেন–আমরা গাড়ি আবিষ্কার করেছি। জাপান সেই গাড়ির প্রশিক্ষণ পদ্ধতি আমাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। আমরা আবার পৃথিবীতে গাড়ি উৎপাদনে এক নম্বর জায়গায় পৌঁছে যাব। ট্রেয়েট তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
আবার সশব্দে হাততালি।
কলেজ ক্যাম্পাসে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে সহজ শর্তে ঋণ দেবার কথা ঘোষণা করলেন।
আর্মি বেসে গিয়ে বললেন–সকলকে প্রস্তুত থাকতে, আরও বললেন, সৈন্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে।
প্রথম দিকে অলিভার ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত। এখন দেখা গেল তিনি সকলের কাছেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
.
চার হাজার প্রতিনিধি এসেছেন। এসেছেন পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কর্তা ব্যক্তিরা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তারা উইভ ল্যান্ডেজড়ো হয়েছেন। টেলিভিশন ক্যামেরা বার বার জ্বলে উঠছে। পিটার ট্যাগার এবং লমবার্ডোকে দেখা যাচ্ছে। গভর্নর অলিভার রাসেল সব থেকে আগে এগিয়ে চলেছেন। তাকেই বেশির ভাগ লেন্সে তুলে ধরা হচ্ছে।
অলিভারের রাজনৈতিক দল আরও সম্ভাব্য ছজন প্রার্থীর নাম নিয়ে আলোচনা করেছে। শেষ পর্যন্ত সেনেটর টড ডেভিসের প্রভাবই খেটে গেছে। একটির পর একটি নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
আমি টড বলছি, এমা এবং সুজির ব্যাপারে কী চিন্তা ভাবনা? না, এদের দিয়ে কখনওই চলবে না। একজন অত্যন্ত রক্ষণশীল, দক্ষিণের লোকেরা কখনও তাকে ভোট দেবে না। আর একজন আবার বেশি উদার। আমি বলি কী?
–আলফ্রেড, টডের কণ্ঠস্বর, রয়ের খবর কী? না, প্রার্থী হিসেবে রয়কে কখনো মেনে নেওয়া যাবে না। আর জেরি? না, জেরি সংকীর্ণ মনের মানুষ।
কেনেথ? তার কী খবর? কেনেথের মস্ত বড়ো ব্যবসা আছে। ব্যাপারটা জনগণের চোখে ভালো নাও ঠেকতে পারে।
তা হলে? শেষ পর্যন্ত গভর্নর অলিভার রাসেলকেই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাঠানোর সুপারিশ করা হল।
.
এই পর্বটা সুন্দরভাবে কেটে গেল। প্রথম ব্যালটে অলিভার রাসেল সাতশো ভোট পেয়েছেন। দুশোর বেশি ভোট এসেছে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ছটি শিল্প সমৃদ্ধ রাজ্য থেকে। একশো পঞ্চাশটি এসেছে ছটি নিউইংল্যান্ড রাজ্য থেকে। চল্লিশটি এসেছে চারটি দক্ষিণের রাজ্য থেকে। একশো আশিটি এসেছে দুটি ফার্ম রাজ্য থেকে। বাকীটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে।
পিটার ট্যাগার তখনও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।
এবার একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম মনোনীত করতে হবে। মেলভিন উইক্স হলেন একজন ভালো প্রার্থী। ক্যালিফোর্নিয়াতে তার জন্ম। যথেষ্ট অর্থবান ব্যবসাদার। চিরকাল কংগ্রেসের সমর্থক।
–তারা একে অন্যের পরিপূরক হতে পারবেন–ট্যাগার মন্তব্য করলেন। এবার আসল কাজ শুরু করতে হবে। আমরা ওই ম্যাজিক নাম্বারের দিকে ছুটে চলেছি। – ২৭০।
ট্যাগার অলিভারকে বলেছিলেন- জনগণ একজন নবীন নায়কের সন্ধানে মগ্ন। যে নায়কের থাকবে পুরুষোচিত চেহারা, কথায় কথায় কৌতুক, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তোমার মধ্যে তারা সব কিছু দেখতে পেয়েছে।
অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি। প্রচার অভিযান প্রতি মুহূর্তে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
.
জ্যান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অলিভারের সঙ্গে থাকে। জ্যানকে এক অসাধারণ সম্পদ বলা যেতে পারে। মেয়েটি রূপসি এবং বুদ্ধিমতী। সাংবাদিকরা তাকে পছন্দ করেন। মাঝে মধ্যে অলিভার লেসলির সর্বশেষ খবর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। লেসলি মাদ্রিদে একটা সংবাদপত্র কিনেছে। মেক্সিকোতে টেলিভিশন স্টেশন স্থাপন করেছে। কানসাসে রেডিও স্টেশন। আহা, মেয়েটি আরও উন্নতি করুক।
তাহলে হয়তো অলিভারের অপরাধ বোধ কিছুটা কমে যাবে।
.
যেখানেই অলিভার যাচ্ছেন, রিপোর্টারদের দেখা মিলছে। আলোকচিত্রীরা বারবার ক্যামেরা ঝলসাচ্ছেন। প্রায় একহাজার প্রতিনিধির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। কেউ এসেছেন দূরবর্তী অঞ্চল থেকে।
এবার প্রচার অভিযান সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেল। বোঝা গেল, অলিভার রাসেল প্রেসিডেন্ট পদে সবথেকে আগে ছুটছেন। কিন্তু তার পরেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যানন হঠাৎ তাকে অতিক্রম করতে শুরু করলেন।
পিটার ট্যাগারের মুখে চিন্তা–ক্যানন কীভাবে এগোচ্ছেন? ওনাকে বন্ধ করতেই হবে।
টেলিভিশন ডিবেটের আসর ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাননের সঙ্গে অলিভারের।
ক্যানন দেশের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করবেন। ট্যাগার বললেন, এই ব্যাপারে ওনার অগাধ পান্ডিত্য। কী করা যায়, ভেবে দেখতে হবে।
.
প্রথম বিতর্কের আসর টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে।
উপরাষ্ট্রপতি ক্যানন দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বললেন–এখন আমাদের দেশ অর্থনীতির–দিক থেকে খুবই উন্নত হয়ে উঠেছে। সর্বত্র ব্যবসা বাণিজ্যের জয়গান শোনা যাচ্ছে।
দশ মিনিট ধরে তিনি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বোঝালেন। একটির পর একটি সংখ্যা তত্ত্ব তুলে ধরলেন। গাণিতিক বিশ্লেষণ।
এবার অলিভার রাসেলকে মাইক্রোফোনের সামনে এসে বলতে হল। তিনি বললেন–এই ভাষণটা শুনে খুবই ভালো লাগছে। হ্যাঁ, বড়ো বড়ো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি ভালো আয় করছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, আপনি ভুলে গেছেন ছোটো ব্যবসার কী অবস্থা? ব্যবসার অন্তরালে যে মানবিক দিকগুলি আছে, আমরা সেদিক থেকে চোখ বন্ধ করে থাকব?
ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যানন খালি ব্যবসার কথা বলেছিলেন। অলিভার তার মধ্যে একটু আবেগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দিলেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বললেন।
বোঝা গেল, রাসেল জিতে গেছেন এই তর্ক যুদ্ধে। ক্যাননকে মনে হল পোড়খাওয়া ঝানু রাজনীতিবিদ। কিন্তু সাধারণ মানুষের থেকে তাঁর অবস্থান অনেক দূরে।
ডিবেটের পরের দিন সকালবেলা, আবার একটা নকল ভোটের আসর। দেখা গেল, অলিভার রাসেল এবার ভাইস প্রেসিডেন্টের খুবই কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন।
.
আর্থার ক্যানন ঠকে শিখেছেন। শেষ বিতর্ক সভা, তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাষা জাতি ধর্মের মানুষ বাস করেন। আমাদের উচিত এটা দেখা, তারা যেন সর্বত্র সমান অধিকার পান। আমেরিকাতে স্বাধীনতার জয়গান ঘোষিত হয়। কিন্তু এই স্বাধীনতা একা ভোগ করার জন্য নয়। আমরা সবাই যেন সেই স্বাধীনতাকে ভাগ করতে পারি।
তিনি অলিভার রাসেলের কথা চুরি করলেন মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করলেন।
অলিভার রাসেল মাইক্রোফোনের সামনে এসে বললেন–আপনার ভাষণ আমার হৃদয়কে স্পর্শ করছে। কিন্তু আপনার ভাষণে কর্মহীন যুবকের কথা বলা হয়নি। মনে হচ্ছে, তারা বোধহয় বিস্মৃত মানুষ। কর্মহীন মানুষের কী জ্বালা, তা কি আপনি জানেন?
ভাইস প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারলেন–এবারেও বুদ্ধির লড়াইতে অলিভার তাঁকে হারিয়ে দিয়েছেন!
.
জর্জটাউনে সেনেটরের ম্যানসন। অলিভার, জ্যান এবং সেনেটর ডেভিস ডিনারের আসরে মগ্ন।
সেনেটর হেসে বললেন–সর্বশেষ খবর কী জানো? মনে হচ্ছে হোয়াইট হাউসটা আবার ঢেলে সাজাতে হবে।
জ্যানের মুখে আনন্দের হাসির ঝলক বাবা, তুমি সত্যি বলছ?
–আমি কখনও মিথ্যা কথা বলি না সোনা। হয়তো ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময়, কিন্তু রাজনীতির আসরে কখনও নয়। এটাই আমার রক্ত। নভেম্বর মাসে আমরা একজন নতুন প্রেসিডেন্টকে পাব। সেই ভদ্রলোক কিন্তু তোমার পাশেই বসে আছে।
.
১০.
সিটবেল্ট বেঁধে নিন।
এবার আমাদের যাত্রা শুরু হবে। ডানা উত্তেজিতভাবে চিন্তা করল। সে বেন এবং ওয়েলির দিকে তাকাল। বেন হলেন ডানার প্রোডিউসার। দাড়িওয়ালা একজন মানুষ, বছর চল্লিশ বয়স। বেশ কয়েকটা ভালো অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। সকলে তাকে শ্রদ্ধা করে। ওয়েলি এক ক্যামেরাম্যান। বছর পঞ্চাশ বয়স। যথেষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে, আছে উৎসাহের অফুরান ভাণ্ডার।
এবার আমরা কোথায় যাব? উড়ান পাখি প্যারিসে কিছুক্ষণের জন্য থামবে। তারপর তার গন্তব্য হবে সারাজেভো।
.
গত সপ্তাহে ডানা খুবই ব্যস্ত ছিল। ফরেন এডিটরের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। নানা ধরনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সারাজেভো থেকে কীভাবে খবর পাঠানো যায়, তাও জানতে হয়েছে। কাজটা ক্রমশই ভালোবেসে ফেলছে সে।
ডানা জানে, এই কাজে অনেক চ্যালেঞ্জে আছে, আছে উত্তেজনার শেষ না হওয়া শিহরণ। তবু তার স্বপ্নটা সফল হয়েছে, এতেই সে আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠেছে।
.
যাবার আগের দিন ম্যাক বেকার তাকে টেলিফোন করেছিলেন- তুমি এখনই আমার অফিসে চলে এসো। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর গম্ভীর।
–আমি সেখানে এখনই যাচ্ছি।
কী হয়েছে। আমাকে কি যেতে দেওয়া হবে না? আমাকে এখানেই থাকতে হবে? না, আমি ওনার সঙ্গে লড়াই করব।
.
দশ মিনিট কেটে গেছে। ডানা ম্যাক বেকারের অফিসের দিকে এগিয়ে চলেছে।
–আমি জানি, আপনি কী বলবেন? ডানা বলতে শুরু করে, কিন্তু আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না। আমি যাবই, ছোট্টবেলা থেকে আমি এটাই স্বপ্ন দেখেছি। আমি ওখানে ভালো কাজ করতে পারব। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখুন না।
দীর্ঘশ্বাস- ঠিক আছে, ডানা বলল, আপনি কী বলতে চাইছেন?
ম্যাক বেকার তাকালেন বললেন, যাত্রা শুভ হোক।
ডানা বিশ্বাস করতে পারছে না কী?
আমি বলছি বন ভয়েজমানে যাত্রা শুভ হোক।
–তার জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন?
-কেন তোমাকে ডেকেছি? আমি আমাদের কয়েকজন বিদেশি প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা তোমাকে কিছু উপদেশ দেবেন।
কী আশ্চর্য, এই ভদ্রলোক আমার জন্য এতটা উপকার করেছেন? ডানা আমতা আমতা করতে থাকে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–তুমি যুদ্ধের ছবি তুলতে যাচ্ছো। তুমি কি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? যে কোনো বুলেট এসে তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। কাজ করতে করতে তুমি ফিরে আসতে পারবে না। তোমাকে আরও বেপরোয়া হতে হবে। আরও সাহসী, সবসময় সাবধানে থাকার চেষ্টা করো। একা একা রাস্তায় ঘুরো না। মনে রেখো, জীবনের থেকে দামী কোনো সংবাদ এই পৃথিবীতে হতে পারে না। আর একটা ব্যাপার
এক ঘণ্টা ধরে ভাষণ চলেছিল, শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক বললেন, নিজের সম্পর্কে সাবধান থেকো। যদি কিছু হয়ে যায় তোমার, আমি কিন্তু শোকে পাগল হয়ে যাব।
ডানা ঝুঁকে পড়ে ভদ্রলোকের গালে চুমু খেল।
-কখনও একাজ করো না, উনি উঠে দাঁড়ালেন। ডানা, ওখান থেকে যদি কখনও মনে হয় তোমার মন পরিবর্তিত হয়েছে, তাহলে চলে এসো। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব।
–আমি কখনও মন পাল্টাব না, ডানা আগ্রহের সঙ্গে বলল।
ভবিষ্যতে দেখা গেল, তার এই সিদ্ধান্ত একেবারে পাল্টে গেছে।
.
প্যারিসের উড়ানে কোনো ঘটনা ঘটেনি। চালর্স দ্যা গল এয়ারপোর্টে এরোপ্লেন নামল। তিনজন এয়ার ফোর্স মিনিবাস ধরে ক্রোয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের অফিসে পৌঁছে গেলেন। সেখানে তিন ঘণ্টা থাকতে হল। রাত দশটা। ক্রোয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের প্লেন সারাজেভোতে ল্যান্ড করেছে। সিকিউরিটি বিল্ডিং-এর দিকে তারা এগিয়ে গেল। ডানার চোখে তখন নতুন স্বপ্ন।
–পাসপোর্ট? আমি দেখিয়েছি।
–আমি কর্নেল গরডন, আপনার পাসপোর্ট?
ডানা পাসপোর্ট তুলে দিল। প্রেসের ছাপ মারা আছে।
জার্নালিস্ট? কার পক্ষে লিখবেন?
ডানা বলল–আমি কারোর পক্ষে নই।
কী রিপোর্ট দিচ্ছেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। আমরা স্পাইদের ওপর কড়া নজর রাখি।
সারাজেভোতে আপনাকে স্বাগত।
.
বুলেটপ্রুফ ল্যান্ডরোভার। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েছিল। ড্রাইভার এক সুন্দর মুখের মানুষ। বছর কুড়ি বয়স। বলল–আমি জোহন, আমি আপনার ড্রাইভার হয়ে কাজ করব।
জোহন অত্যন্ত তাড়াতাড়ি গাড়ি চালায়। এখানে সেখানে গোত্তা খেতে খেতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা।
–এত তাড়াতাড়ি কী আছে? ডানা জানতে চাইল।
–হ্যাঁ, যদি জীবন্ত অবস্থায় যেতে চান।
–কিন্তু
ডানা শুনতে পেল বুলেটের শব্দ। মনে হল বুঝি বজ্রের আর্তনাদ। শব্দটা ক্রমশ কাছে আসছে।
তাহলে? না, বৃষ্টি তো পড়ছে না। অন্ধকার। ডানা বুঝতে পারল, কিছু একটা ঘটেছে। হলিডে ইন হোটেলটা সামনে চোখে পড়ল। হোটেলের সামনে ঘন অন্ধকার কেন?
গাড়িটা ছুটে বেরিয়ে গেল।
ডানা চিৎকার করল- কী হচ্ছে? এটাই তো আমাদের হোটেল।
জোহন বলল–সামনে দিয়ে ঢোকা উচিত হবে না।
সে পেছন দিকে চলে গেল। গলিপথে ঢুকল।
সকলেই পেছনের দরজাটা ব্যবহার করে।
ডানার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে– কেন?
হলিডে ইনের লবিতে অনেক মানুষের ভিড়। তারা গল্প করছে। একজন ফরাসি এগিয়ে এসে বললেন–আপনি কি ডানা ইভেন্স?
হ্যাঁ।
–আমি জাঁ পল হিউবার্ট, মেট্রোপল টেলিভিশনের তরফ থেকে এসেছি।
–আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে খুবই ভালো লাগছে। ইনি হলেন বেন, আর ইনি ওয়েলি।
এবার আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। জানি না, কী করে এখানে আপনাকে অভিনন্দন জানাব।
আরও অনেককে সেখানে দেখা গেল। পরস্পর পরিচিতির পালা চলছে।
ডানার মনে হল, পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে একজন করে জার্নালিস্টের বসবাস। এভাবেই বোধহয় হাতে হাত রেখে করমর্দনের পালা চলতে থাকবে।
ডানা জানতে চাইলেন–কতজন রিপোর্টার এখানে এসেছেন?
–দুশো পঞ্চাশজন। এত রিপোর্টারের সমাবেশ এর আগে আমি কোথাও দেখিনি। এই প্রথম আপনি কি বিদেশে আসছেন?
-হ্যাঁ।
জাঁ পল বললেন, যদি কোনো সাহায্যের দরকার হয়, তাহলে বলবেন কিন্তু।
–অনেক ধন্যবাদ। রাশিয়ান রিপোর্টার কোথায়?
–একথা জিজ্ঞেস করবেন না। এখানে কেউ কারো খবর রাখে না।
.
কিছুক্ষণ বাদে ডানা তার বিছানায় চলে গেছে। একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। একঝলক আলো আবার–আবার একটা। সমস্ত ঘরটা জ্বলে উঠেছে। ভয় করছে। যে। কোনো মুহূর্তে হোটেলটা বিধ্বস্ত হতে পারে।ব্যাপারটা অবাস্তব। এটা তো সিনেমাতে দেখানো হয়নি। সমস্ত রাত্রি ডানা জেগে কাটাতে বাধ্য হল।মাঝে মধ্যেই সে শব্দ শুনেছে, আগুন দেখেছে, ভেবেছে, এবার বোধহয় শেষের ঘণ্টা বেজে যাবে!
সকাল হয়েছে। ডান পোশাক পরে নিল। জিন্স, বুট আর জ্যাকেট। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। মনে পড়ল ম্যাকের কথা সবসময় সাবধানে থাকতে হবে। জীবন নিয়ে অযথা তর্ক করে কী লাভ?
ডানা, বেন আর ওয়েলিকে লবি রেস্টুরেন্টে দেখা গেল।
-হ্যাঁ, একটা খবর দিতে ভুলে গেছি, পরের মাসে আমার নাতির জন্ম হবে।
ভারী ভালো খবর, ডানা বলল, আমি কী কখনও এভাবে মা কিংবা দিদিমা হতে পারব?
–বেন বললেন–আমার একটা বুদ্ধি এসেছে। আমরা আগে একটা গল্প খাড়া করব। দেখব, এখানকার সাধারণ মানুষের জীবন কীভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। তারপর না হয় গল্পের গভীরে যাব, কেমন?
.
জোহন গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ল্যান্ডরোভার চালু হয়েছে। সে বলল–শুভ সকাল।
শুভ সকাল জোহন, যেখানে সত্যি সত্যি লড়াই হচ্ছে, আমরা সেখানে যেতে চাই।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সারাজেভো শহরটা পরিষ্কার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ডানার মনে হল, একটা বাড়িও বোধহয় অক্ষত নেই। আবার যুদ্ধের আওয়াজ, বুলেটের আর্তনাদ।
ডানা জানতে চাইল–এই শব্দ কখনও থামবে না?
যখন অস্ত্রের ভাণ্ডার শেষ হবে তখনই থামবে। জোহন তিক্তভাবে বলল, কিন্তু এই ভাণ্ডার কখনও শেষ হবে না।
রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। কয়েকজন পথচারী ইতস্তত এগিয়ে চলেছে। সমস্ত কাফে বন্ধ। শেলের টুকরো পড়ে আছে চারপাশে। তারা একটি বড়ো বাড়ি পেরিয়ে গেল।
এটাই আমাদের খবরের কাগজের অফিস, জোহন বলল, সার্বরা এটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। তারা উপগ্রহ অফিসে পৌঁছে গেল।
জোহন বলল আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।
লবির পাশে একটি ডেস্ক। এক রিসেপশনিস্ট বসেছিলেন, বছর আশি বয়স হয়েছে।
ডানা জানতে চাইল- আপনি কি ইংরাজি জানেন?
ভদ্রলোক বললেন–আমি নটা ভাষায় কথা বলতে পারি ম্যাডাম। আপনি কী চাইছেন?
–আমি ডব্লিউ টি-র হয়ে কাজ করছি। আমি স্যাটেলাইটে কিছুটা সময় চাইছি। এটা কি আপনি ব্যবস্থা করতে পারেন?
–অনুগ্রহ করে আপনি তিনতলায় চলে যান।
.
দরজার সামনে লেখা আছে যুগোশ্লোভিয়ার স্যাটেলাইট ডিভিশন। রিসেপশন রুমে বেশ কয়েকজন মানুষ বসে আছেন।
ডানা নিজের পরিচয় দিল। ভেতরে ঢুকে পড়ল। কাজটা ভালোভাবেই হয়ে গেল।
.
দুঘণ্টা কেটে গেছে। ডানা আর একটি অফিসে এসেছে। ম্যানেজারের সামনে বসেছে। ভদ্রলোকের চেহারাটা ছোটো। সিগার জ্বলছে ঠোঁটে।
তিনি বললেন–আপনাকে কীভাবে সাহায্য করব?
–আমি ডানা ইভান্স। ডব্লিউ টি-র হয়ে কাজ করি। আপনার কয়েকটা ট্রাক বুক করতে হবে। স্যাটেলাইট দিতে হবে আধঘণ্টার জন্য। সন্ধ্যে, ওয়াশিংটনে ছবি পাঠাবার পক্ষে আদর্শ সময়।
ভদ্রলোক কী যেন ভাবতে লাগলেন।
-কোনো সমস্যা?
–না, একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর কোনো স্যাটেলাইট ট্রাক আছে বলে মনে হচ্ছে । সব ট্রাকই বুক করা হয়ে গেছে। আমি দেখছি, যদি কেউ অনুষ্ঠান বাতিল করে।
ডানা অবাক হয়ে তাকাল না, আমার একটু সময় চাই।
–সকলেই তাই চাইছে ম্যাডাম, নিজস্ব ট্রাক থাকলে অবশ্য অসুবিধা হত না।
ডানা আবার রিসেপশন রুমে ফিরে এল। কী করা যায় সে ভাবতে থাকল চিন্তিত মনে। যে করেই হোক এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে গেল তার। হ্যাঁ, অনেকবার তাকে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে জবরদস্ত লড়াই করতে হয়েছে। হারতে হারতে শেষ মুহূর্তে জয়ের মালাটা ছিনিয়ে নিয়েছে সে। সে জানে, এবারেও সে জিতবে, হয়তো আজ অথবা আগামীকাল।
স্যাটেলাইট অফিস থেকে সে বাইরে এল। জোহনকে বলল তুমি কি আমাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবে?
জোহনের চোখে বিস্ময় যদি আপনি চান, তাই হবে।
গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা।
–একটু আস্তে চালাও, প্লিজ, আমি ভালোভাবে সবকিছু দেখতে চাইছি।
সারাজেভো শহরটাকে এক শ্মশান বললেও বোধহয় বেশি বলা হবে। জল পাওয়া যাচ্ছে না, বিদ্যুৎ কবে হারিয়ে গেছে। প্রত্যেক ঘণ্টায় বোমাবর্ষণ হচ্ছে। বেজে উঠছে বিপদ সংকেত। মানুষ এই সংকেতকে উপেক্ষা করছে। সর্বত্র ভয়ের ছাপ। যদি বুলেটে তোমার নাম লেখা থাকে, লুকোবার জায়গা পাবে না।
প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে কিছু বিপদগ্রস্ত মানুষের ঘোরাঘুরি। মিছিল চোখে পড়ছে।
এরা বসনিয়া আর পুঁশিয়া থেকে এসেছে। এরা সবাই উদ্বাস্তু। তারা ভিক্ষে করছে, খাবার কেনবার জন্য।
দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এই আগুন নেভাবার কোনো উপায় নেই।
ডানা জিজ্ঞাসা করল- তোমাদের এখানে দমকল নেই?
–হ্যাঁ, আছে। কিন্তু কর্মীরা আসতে ভয় পায়। যখন তখন সার্বরা তাদের আঘাত করতে পারে।
যুদ্ধের শুরুতে বসনিয়া এবং হারজেগোভিনা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এই শব্দ দুটোর সঙ্গে ডানার কোনো পরিচিতি ছিল না। সারাজেভোতে এসে সে বুঝতে পারল, যুদ্ধ কী মারাত্মক হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। ডানার হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
জোহন তাকে শহরের পুরোনো অঞ্চলে নিয়ে গেল। এখানে অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষের বসবাস। দেখা হল অধ্যাপক ট্যাকের সঙ্গে। ধূসর চুলের মাঝারি উচ্চতার মানুষ। তার মেরুদণ্ডে একটি বুলেট ঢুকে গিয়েছিল। তিনি একেবারে অকর্মণ্য হয়ে গেছেন।
উনি বললেন তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি এসেছ বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। এখন আমার কাছে কেউ আসে না। তুমি যেন কী বিষয়ে কথা বলবে?
-হ্যাঁ, আমি যুদ্ধের ব্যাপারে জানতে চাইছি। ঠিক বুঝতে পারছি না।
ব্যাপারটা খুবই সহজ, এই যুদ্ধটা কেন হচ্ছে আমরা কেউ জানি না। কয়েক দশক ধরে সার্ব, ক্রোড, বসনিয়া আর মুসলিমরা শান্তিতে বসবাস করছিল। তখন মার্শাল টিটো ছিলেন যুগোশ্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট। আমরা সবাই ছিলাম পরস্পরের প্রতিবেশী, আমরা একসঙ্গে বড়ো হয়েছি, কাজ করেছি, একই স্কুলে গেছি, বিয়েতেও কোনো বাধা ছিল না।
তারপর কী হল?
তারপর দেখা দিল অবিশ্বাস। শুরু হল গুপ্তহত্যা। একে অন্যকে ঘৃণা করতে থাকল। কেন? তার কারণ আমি জানি না।
–আমি কয়েকটা গল্প শুনেছি। ডানা বলল। এই গল্পগুলো অবশ্য বিশ্বাস করা যায় না। কুয়োর মধ্যে মানুষের রক্তাক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া গেছে। পুরুষের অণ্ডকোষ, ধর্ষণপ্রাপ্ত শিশুর মৃতদেহ, কুচিয়ে কুচিয়ে কাটা হয়েছে যুবতী নারীকে। অসহায় গ্রামবাসীদের চার্চের মধ্যে বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডানা জানতে চাইল কারা এসব প্রথম শুরু করে?
প্রশ্নটার মধ্যে কী আছে বলো তো? যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তার ব্যক্তিগত মতামতের ওপর নির্ভর করছে উত্তরটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সার্বরা মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল। ক্রোড়রা ছিল নারীদের সমর্থক। যুদ্ধে সার্বরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তখনই শুরু হয়েছে রক্তাক্ত প্রতিশোধের পালা। ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না। এখনও পর্যন্ত দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সারাজেভো শহরের ওপর অসংখ্য বোমা ফেলা হয়েছে। ষাট হাজার মানুষ আহত হয়েছে। বসনীয় এবং মুসলিমদেরও হত্যা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে কেউ জানে না।
.
ডানা হোটেলে ফিরে এল। বেন বসেছিলেন। একটা খবর এসেছে। ট্রাক এবং স্যাটেলাইটের সময় পাওয়া গেছে। আগামীকাল সন্ধ্যা ছটা থেকে।
ওয়ালি বললেন–এখানেই ভালো শু্যট করা যেতে পারে। ক্যাথোলিক চার্চের পাশে একটা স্কোয়ার আছে। একটা মসজিদ আছে। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ, সবই কাছাকাছি। সবগুলিতেই বোমার আঘাত আছে। এ বিষয় নিয়ে একটা রিপোর্টিং করা যেতে পারে। কীভাবে মানুষ এখানে বসবাস করছে, তা টেলিভিশনের মাধ্যমে সকলের কাছে দেখাতে হবে।
ডানা ঘাড় নাড়ল, উত্তেজিত হা, ডিনারে দেখা হবে। আমি এবার কাজ শুরু করব।
ডানা তার ঘরের দিকে চলে গেল।
.
পরের দিন সন্ধ্যা ছটায় ওয়ালি এবং বেন স্কোয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সত্যি, চার্চের অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। ওয়ালি টেলিভিশন ক্যামেরাটা নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। বেন ওয়াশিংটন থেকে খবর আসার অপেক্ষা করছেন। তাঁ, উপগ্রহের সিগন্যাল ঠিক মতো কাজ করছে।
ডানা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। না, ভয় পেলে চলবে না। এখন কাজ করতে হবে। সাহসের পরিচয় দিতে হবে। সারা পৃথিবীর কাছে গল্পটা শোনাতে হবে।
ডানা দেখল ওয়ালি সিগন্যাল দিচ্ছেন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকাল এবং কথা বলতে শুরু করল।
–এই বোমা বিধ্বস্ত চার্চের দিকে তাকালে আপনারা বুঝতে পারবেন, এই শহরের অবস্থা এখন কেমন। লুকিয়ে থাকার মতো কোনো দেওয়াল নেই। কোনো জায়গাই আর নিরাপদ নয়। আগেকার দিনে মানুষ অসহায় হয়ে চার্চে আশ্রয় নিতেন। কিন্তু সেই আশ্রয়স্থলও বোমা বর্ষণে খুঁড়িয়ে গেছে।
হুইসেলের শব্দ শোনা গেল। ওয়ালির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। আলোর ঝলকানি। ডানা ভাবল, কী হয়েছে বুঝতে পারা যাচ্ছেনা। ওয়ালির শরীরটা ফুটপাথে পড়ে আছে। ডানা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। পাষণ প্রতিমা হয়ে। ভয়ে তার মেরুদণ্ড শিহরিত হয়ে উঠেছে। বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। চারপাশের মানুষজন আর্তনাদ করছে।
ডানা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে কোনো রকমে ছুটতে শুরু করল। না, নিজেকে বোধহয় উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।
আমাদের ফিরতে হবে। দশ মিনিট ব্যবহার করা হল না। আঃ, কী যে হল?
জনগণ উন্মত্তভাবে চিৎকার করছে। কেউ কারও কথা শুনতে পারছে না।
শেষ অব্দি ডানা কোনো রকমে গাড়ির কাছে পৌঁছোতে পেরেছিল।
.
ডানা চোখ খুলল। বিছানাতে শুয়ে আছে। বেন এবং জ্যান পল তার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
ডানা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল–কী করে ঘটল এটা?
আমি দুঃখিত, জ্যান পল জবাব দিলেন, আপনি যে মারা যাননি ঐ জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান।
টেলিফোন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। একটুবাদে শব্দ করে বেজে উঠল।
বেন ধরলেন- হালো।
সেই মুহূর্তে শুনলেন- হ্যাঁ, ডানা, ম্যাক বেকার, তুমি কি কথা বলতে পারবে?
-হ্যাঁ, ডানা উঠে বসল। টেলিফোনের দিকে হেঁটে গেল- হ্যালো, তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে সে পারছে না।
ম্যাক বেকার বললেন–তুমি এখানে চলে এসো ডানা।
তার গলায় ফিসফিসানি শব্দ, আমি বাড়িতে ফিরে যাব।
–প্রথম প্লেন ধরেই চলে এসো, কেমন?
ধন্যবাদ। ডানা রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
জ্যান আর বেন তাকে সাহায্য করলেন।
জ্যান বললেন–না, কিছুই বলার নেই।
জল গড়িয়ে পড়ছে চিবুকের ওপর।
–ওঁকে কেন হত্যা করা হল? উনি তো খুব ভালোমানুষ ছিলেন। কী ঘটেছে? মানুষ কি জানোয়ার হয়ে গেছে? কেউ কারোকে তোয়াক্কা করছে না।
বেন বললেন–ডানা, এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।
ডানার কণ্ঠস্বর ক্রমশ কঠিন। উত্তর জানতে হবে বৈকি। আমাদের সব ব্যাপার জানতে হবে। এই যুদ্ধটা বন্ধ করতে হবে। সাধারণ মানুষ মরছে। তাদের মাথা কেটে দেওয়া হচ্ছে। এটা কী ধরনের বর্বরতা? শেষ পর্যন্ত ডানা বেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি থাকব বেন, আমি কিছুতেই এখান থেকে যাব না।
বেন বললেন–ডানা, তুমি কি সত্যি থাকবে?
–আমি জানি, এখন কী করতে হবে। আপনি কি ম্যাককে ফোন করে বলে দেবেন?
কী বলছ? তোমার জীবন কিন্তু বিপদে পরিপূর্ণ থাকবে।
ডানা মাথা নাড়ল- হ্যাঁ, আমাকে থাকতেই হবে।
বেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
জ্যান পল বললেন আমি কিন্তু চলে যাব।
না, এক মুহূর্তের জন্য ডানার মনে পড়ে গেল, ওয়ালির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীরটা।
–আপনাকে থাকতেই হবে। প্লীজ, আমার কাজে আপনাকে খুব দরকার।
জ্যান পল খাটের ওপর বসে পড়লেন। ডানা এগিয়ে এল। জ্যান পলের হাতে হাত রাখল। তাকে আর একটু কাছে টেনে নিল।
.
পরের দিন সকালবেলা। ডানা বেনকে বলল–আমি এখনই কভোর অনাথ আশ্রমে যাব। সেখানে নাকি ব্যাপক বোমাবর্ষণ হয়েছে। ভালো ক্যামেরাম্যান পাওয়া যেতে পারে?
-দেখছি, পাওয়া যায় কিনা।
–অনেক ধন্যবাদ, আমি সেখানে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব।
সাবধানে যেও কিন্তু।
–আমার জন্য চিন্তা করবেন না।
জোহন ডানার জন্য অপেক্ষা করছিল।
ডানা বলল–আমরা এখনই কসভোতে যাব।
জোহন ডানার দিকে তাকাল-ম্যাডাম, ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না। যে পথটা আছে সেটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে।
দুর্ভাগ্য পড়তে শুরু করেছে জোহন, আমরা ভালোই থাকব।
–ঠিক আছে, আপনি যা বলবেন।
.
গাড়িটা এগিয়ে চলেছে শহরের মধ্যে দিয়ে। পনেরো মিনিট বাদে সেটা একটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
ডানা জানতে চাইল- আর কতদূর?
খুব একটা দূরে নয়, মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই..
ড্রাইভারের কথা শেষ হল না। ল্যান্ডরোভারের ওপর ল্যান্ডমাইনের আক্রমণ।