১৬.
টনি রিজোলি তাকে দেখল। আহা, বাথরুম থেকে সে একেবারে উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসছে। ভাবল, গ্রিক মহিলাদের স্তনদুটি অত বড়ো হয় কেন?
সে অতি দ্রুত বিছানায় চলে গেল। তার গলা জড়িয়ে ধরল। ফিসফিসিয়ে বলল তোমাকে পেয়ে আমি খুবই খুশি। তোমায় দেখে ইস্তক আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
টনি রিজোলি এখন আনন্দে আছে। কুকুরীর বাচ্চা, আহা, কত সুখ আজ দেবে তাকে।
সে বলল–হ্যাঁ, এসো। আজ তোমার সব আনন্দ আমি মিটিয়ে দেব।
.
কালারি স্ট্রিটের দি নিউইয়র্কার একটি নাইট ক্লাব, সেখানেই মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছে টনির। মেয়েটি সেখানে গায়িকা হিসেবে কাজ করে। সে ভারি সুন্দর গান গায়। কিন্তু গলাটা কেমন? কুকুরের চিৎকার? সেখানে যে-সমস্ত মেয়েরা গান গায়, তারা কেউই গায়িকা হিসেবে নাম করতে পারেনি, তারা শরীরের ছলাকলায় একে অন্যকে হারিয়ে দেয়, তাদের সকলকে বাড়িতে আনা যায়, উপযুক্ত টাকার বিনিময়ে। এ মেয়েটির নাম হেলেনা, দেখতে খুব একটা খারাপ নয়, কালো চোখ আছে, মুখে ইন্দ্রিয় পরায়ণতার আভাস। শরীরটা খুবই সুন্দর। যেখানে যতটা মেদ থাকা দরকার, ততটাই আছে। বয়েস চব্বিশ বছর, রিজোলির পছন্দের তুলনায় একটু বুড়ি। কিন্তু এথেন্সের আর কোনো মেয়ের সাথে তার পরিচয় নেই। তাই এ মেয়েটিকে নিয়েই…
–তুমি কি আমাকে পছন্দ করেছ? হেলেনা জানতে চাইল।
–হ্যাঁ, না হলে তোমাকে ভাড়া করব কেন?
টনি ধীরে ধীরে মেয়েটির স্তনবৃন্তে হাত ঘোরাতে থাকল। বুঝতে পারল, মেয়েটির বৃন্তদুটি দৃঢ় হয়ে উঠছে। মোচড়ালো। উঃ, যন্ত্রণার শিৎকার।
–বেবি, মাথাটা একবার নীচু করবে কী?
হেলেনা বলল–আমি এটা করতে পারি না।
রিজোলি বলল–সত্যি?
পরের মুহূর্তে সে মেয়েটির চুলে হাত দিল।
হেলেনা বলল–কী করছ?
রিজোলি তার গালে চড় মেরে বলল–আর একটা শব্দ করলে আমি তোমার ঘাড় ভেঙে দেব।
রিজোলি তার মাথাটা নামিয়ে দিল, দুটি পায়ের ফাঁকে। বলল, কাজটা এখনই শুরু করো। আমাকে আনন্দ দাও। দেখবে, তোমার দুহাতে আমি টাকার থলে তুলে দেব।
হেলেনা বিড়বিড় করে বলছে আমাকে ছেড়ে দাও। তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছ।
রিজোলি ক্ষেপে গেছে। সে দুটি পা দিয়ে শক্ত করে মেয়েটির মুখ চেপে ধরেছে।
যা বলছি তা এখুনি করো।
রিজোলি একহাতে মেয়েটির চুল ধরে টানছে। আহা, মেয়েটির লাগছে বোধহয়।
–তুমি যেতে পারো…।
সে রিজোলির মুখের দিকে তাকাল। না এই খদ্দেরটা মনে হচ্ছে খুবই খারাপ। তার কথা অমন অসমাপ্ত থেকে গেল।
মারমারি করে কী লাভ? মেয়েটি বলল, তোমার আর আমার মধ্যে ভালোবাসা থাকা দরকার।
রিজোলির আঙুলগুলি দ্রুত খেলা করছে।
আমি তোমাকে কথা বলার জন্য ভাড়া করিনি। আর একটা ঘুষি, মেয়েটির মুখ লক্ষ্য করে চুপ করো, কাজ শুরু করো।
-ঠিক আছে, সুইট হার্ট, হেলেনা বলল, ঠিক আছে।
.
রিজোলি আজ স্বাভাবিক ছন্দে ছিল না। কিন্তু যখন সে সুখী হল, তখন হেলেনা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। সহ্যের সীমার একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে সে। হেলেনা চুপ করে জেগে থাকল যতক্ষণ না রিজোলি ঘুমিয়ে পড়ছে। শেষ অব্দি সে পোশাক পড়ে নিল। তার সর্বত্র যন্ত্রণা হচ্ছে। অন্য সময় হলে সে হয়তো ওয়ালেট থেকে টাকা ছিনিয়ে নিত। কিন্তু এখন কিছুই করল না। তার কোনো একটা অনুভূতি তাকে বাধা দিতে লাগল। সে প্রাপ্য বা বকশিশ, কোনো ধরনের টাকা না নিয়েই ঘর থেকে চলে গেল।
এক ঘন্টা কেটে গেছে। টনি রিজোলির ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় কে আঘাত করছে? রিজোলি উঠে বসলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। ভোর চারটে বেজে গেছে। মেয়েটা কোথায়?
তিনি বললেন কে?
বাইরের কণ্ঠস্বরে রাগ ঝরে পড়ছে–তোমার জন্য একটা টেলিফোন এসেছে।
রিজোলি মাথায় হাত দিলেন আমি এখুনি আসছি।
রিজোলি পাশের ঘরে গেলেন। ট্রাউজারে হাত দিলেন। ওয়ালেটটা দেখলেন। সব টাকা ঠিকই আছে। তারা মানে কুকুরীর বাচ্চা টাকা নেয়নি কেন? তিনি একটা একশো ডলার সঙ্গে নিলেন। দরজার ওপাশে চলে গেলেন। দরজা খুলে দিলেন।
লোকটি হলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনে একটা রোব আর স্লিপার। কটা। বাজে জানো কী? তুমি বলেছিলে আমাকে…
রিজোলি একশো ডলারটা ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলেন।
–আমি অত্যন্ত দুঃখিত, এত ভোরে আপনার ঘুম ভেঙে গেছে।
ভদ্রলোক বলতে থাকেন- ঠিক আছে, হয়তো কেউ খুব দরকারে ফোন করেছে। না হলে সকাল চারটের সময় কেউ ফোন করে?
রিজোলি টেলিফোন রিসিভার তুলে ধরলেন।
–রিজোলি।
একটা কণ্ঠস্বর- রিজোলি, আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে কী?
–আপনি কে বলছেন?
–স্পাইরস লামব্রো আমাকে বলেছেন, আপনাকে ফোন করতে।
–হ্যাঁ।
কী সমস্যা?
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ব্যাপারে।
কী হয়েছে?
–তার একটা ট্যাঙ্কার থেলে মারসেইলেস-এ ছিল। সেটা বেসিন ডে লা গ্রান্ডে পৌঁছে গেছে।
–তাতে কী?
মিঃ ডেমিরিস বলেছেন, এই জাহাজটিকে এথেন্সে নিয়ে যেতে। এটা রোববার সকালে সেখানে পৌঁছে যাবে। রোববার রাত্রিবেলা আবার বেরিয়ে পড়বে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস এই জাহাজে থাকবেন।
–কী বলছেন?
উনি থাকবেন।
–এমন তো চুক্তি ছিল না।
–মিঃ লামব্রো বলেছেন, ডেমিরিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছোতে চাইছেন। উনি বোধহয় আপনার হাত থেকে মুক্তি পাবেন।
-ঠিক আছে। আমি দেখছি, মিঃ লামব্রোকে আমার হয়ে ধন্যবাদ জানাবেন।
–ঠিক আছে আমি জানাব।
রিজোলি রিসিভার রেখে দিলেন।
সব কিছু ঠিক আছে রিজোলি? বৃদ্ধ ভদ্রলোক জানতে চাইলেন।
–হ্যাঁ, সব কিছু ঠিক আছে। টনি ঘাড় নাড়তে নাড়তে জবাব দিলেন।
.
রিজোলি এই টেলিফোন নিয়ে ভাবতে থাকলেন। ব্যাপারটা তাঁকে আনন্দ দিয়েছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে তিনি দৌড় করাতে পেরেছেন। আহা, এবার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। রোববার, তার মানে হাতে আরও দুটো দিন আছে।
রিজোলি জানেন, তাঁকে আরও সাবধানী হতে হবে। যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, এক জোড়া চোখ তাকে অনুসরণ করছে। ওই কুত্তির বাচ্চাগুলোকে সাবধান। এখানকার পুলিশ নাকি বাতাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায়। রিজোলি মনে মনে ভাবলেন, আমারও যখন সময় আসবে,আমিও প্রতিশোধ নেব।
.
পরের দিন সকালবেলা রিজোলি পাবলিক টেলিফোন বুথে পৌঁছে গেলেন। এথেন্সের মিউজিয়ামের নাম্বারে ফোন করলেন।
রিজোলি দেখতে পেলেন, একজন মানুষ দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তার ধারে আর একজন মানুষকে দেখা গেল। সে ফুল বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলছে। এই দুজন যে গোয়েন্দা এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, রিজোলি ভাবলেন। শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা দুজনকে দেখা গেল, এটা বোধহয় সৌভাগ্য।
কিউরেটরের অফিস।
কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
ভিক্টর? আমি টনি।
–কোনো কিছু খারাপ খবর আছে?
ভিক্টরের কণ্ঠস্বরে উদ্বিগ্নতা।
–না, রিজোলি বললেন, সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। ভিক্টর, আপনি কি সেই সুন্দর ফুলদানিটার খবর জানেন, যার গায়ে লাল চিহ্ন আছে।
কা অ্যামফোরা।
–হ্যাঁ, আমি ওটা আজ রাতে তুলে নেব।
কিছুক্ষণের নীরবতা।
–আজ রাত্রে? জানি না টনি, ভিক্টরের কণ্ঠস্বর কাঁপছে, যদি কোনো কিছু অঘটন ঘটে যায়? কথা ভুলে জপনার কি,
সব কথা ভুলে যান। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি। আপনি বারবার আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন? আপনার কি মনে আছে, স্যাল ভিজিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি? ব্যাপারটা আপনি সামলাতে পারবেন তো?
না-না, টনি, আমি তা বলতে চাইছি না।
সব কিছু আপনাকে ঠিক মতো করতে হবে, ভিক্টর। আমি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাব। সেখানে গেলে আমার কোনো সমস্যা থাকবে না। এই ঝামেলাতে আমি জড়াব না। শুধু আপনাকে ভালোবাসি বলেই বলছি।
-না-না, আপনি যা-যা করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। টনি, আজ রাতেই আমি চেষ্টা করব।
–ঠিক আছে, মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবার পর আপনি একটা নকল মাল রেখে আসলটা সরিয়ে দেবেন।
কিন্তু গার্ডরা সব কিছু পাহারা দিচ্ছে।
–তাতে কী হয়েছে, গার্ডরা তো এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নয়।
–না-না, তা নয়। তবে…
–ঠিক আছে, ভিক্টর, আমার কথা শুনুন। আপনি আসলটা সরিয়ে নকলটা রেখে দেবেন। আর একটা সেল, ডিড করে রাখবেন। আশা করি, সবকিছু বুঝতে পারছেন।
-ঠিক আছে। কোথায় দেখা হবে?
–আমরা কোথাও দেখা করব না। ঠিক ছটার সময় মিউজিয়াম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবেন। সামনে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকবে। মালটা সঙ্গে রাখবেন। ড্রাইভার আপনাকে গ্রান্ড হোটেলে নিয়ে যাবে। সেখানে ড্রাইভার আপনার জন্য অপেক্ষা করবে। আপনি প্যাকেটটা গাড়িতেই ফেলে রাখবেন। হোটেলবারে বসবেন। সামান্য মদ খাবেন। তারপর বাড়ি চলে যাবেন।
–কিন্তু প্যাকেটটা?
–ভয় নেই, তার দেখাশুনা করা হবে।
ভিক্টর ঘামতে থাকেন–আমি এর আগে কখনও এমন কাজ করিনি। আমি কোনো কিছু চুরি করিনি। সারাজীবন…।
–আমি জানি, রিজোলি বললেন, আমিও কোনদিন করিনি। ভিক্টর একটা কথা মনে রাখবেন, আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে আমাকে অনেক কুকাজ করতে হচ্ছে।
ভিক্টর বলে উঠলেন–আপনি আমার ভালো বন্ধু টনি। আপনার মতো বন্ধু আমি জীবনে কখনও দেখিনি। আপনি কি জানেন, কীভাবে আমি টাকাটা পাব, আর কবে পাব?
রিজোলি বললেন–খুব তাড়াতাড়ি, ব্যাপারটা মিটে গেলেই আমরা আরও মালের অর্ডার পাব।
রিজোলি হাসতে থাকেন, আর কখনও? আর কখনও হয়তো আপনাকে আর সাহায্য করব না। কিন্তু সত্যি কথাটা তিনি উচ্চারণ করলেন না।
.
দুটো জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে পাইরাস বন্দরে। মিউজিয়ামের সর্বত্র মানুষের ভিড়। ভিক্টর এইসব মানুষদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। তারা কোন্ জীবনের প্রতীক, তা চিন্তাভাবনা করেন। বেশির ভাগই আমেরিকান এবং ব্রিটিশ। অন্যান্য দেশ থেকেও অনেকে এসেছেন। কিন্তু এখন ভিক্টরের মনের ভেতর কে যেন মাদল বাজিয়ে দিয়েছে। কোনো কাজে তার মন বসছে না।
তিনি দুটো শোকেসের দিকে তাকালেন। এখানে এমন কিছু জিনিস আছে, যা বিক্রি করা হবে। উৎসাহী মানুষের ভিড়। দুজন মেয়ে সবকিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে।
এগুলোকে সত্যি সত্যি হয়তো বিক্রি করা হবে। কিন্তু আমি এর থেকে কী লাভ করব? আমি তো রিজোলির পরিকল্পনা মতো কাজ করব। আমি জানি, এই কাজে ধরা পড়ার সম্ভবনা আছে। তবে উল্টোদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই কাজে কোনো সমস্যা নেই। বেসমেন্টে এমন সুন্দর প্রতিকৃতি পাওয়া যাচ্ছে, ওপরে এনে রাখলে কেউ বুঝতে পারবে না।
টনি যে ফুলদানিটার কথা বলেছে, সেটা হল এই মিউজিয়ামের অন্যতম সেরা সম্পত্তি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে এটি তৈরি হয়েছিল। এটি এক অসাধারণ ফুলদানি, লাল চিহ্ন
আছে, পুরাণের প্রতীক। কালো পটভূমিতে শেষ যখন ভিক্টর এই ফুলদানিটাতে হাত দিয়েছিল, তখন তাঁর সমস্ত শরীরে শিহরণ জেগে উঠেছিল। পনেরো বছর হয়ে গেল। তিনি নিজে এই ফুলদানিটিকে একটি সুন্দর সাজানো কেসের মধ্যে রেখেছিলেন। এখন এই ফুলদানিটিকে তিনিই চুরি করতে চলেছেন? ভিক্টরের মন হাহাকার করে ওঠে, হে ঈশ্বর, তুমি আমায় করুণা এনে দাও।
.
ভিক্টর সমস্ত সন্ধ্যেবেলা পায়চারি করলেন। মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন হয়ে গেলেন। নিজেকে চোর বলে ভাবতে তার ভালো লাগছে না। তিনি অফিসে গেলেন তার দরজা বন্ধ করলেন। ডেস্কে বসে থাকলেন। তাঁর সমস্ত মুখে হতাশার ছাপ। আমি এটা করতে পারব না। অন্য কেউ হয়তো পারবে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধানের উপায় কী? কীভাবে টাকার জোগাড় হবে? প্রিজির কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আজ রাত্রেই টাকাটা চাই। কুত্তা, তা না হলে কাল সকালে তোকে মেরে মাছেদের খাইয়ে দেব। তুই কি বুঝতে পারছিস আমার কথা? লোকটা ভয়ংকর খুনে। নাঃ, আর কোনো বিকল্প পথের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েক মিনিট কেটে গেছে। ছটা বাজতে চলেছে। ভিক্টর অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। যে দুজন ভদ্রমহিলা নকল বস্তু বিক্রি করছিলেন, তারা এবার চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ভিক্টর বললেন–সিগনোমি, আমার এক বন্ধুর জন্মদিন, কী দেওয়া যায় বলুন তো?
তিনি কেসের কাছে চলে গেলেন। ভালোভাবে পরীক্ষা করার চেষ্টা করলেন। অনেকগুলো ফুলদানি আছে, ছোটো ছোটো মূর্তি। বই এবং মানচিত্র। যেন তিনি ভাবছেন, নির্বাচন কী হবে ঠিক করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই লাল ফুলদানির প্রতিকৃতির দিকে তাকালেন–আমার মনে হয়, এটাতেই চলে যাবে।
মেয়েটি বলল–হ্যাঁ, এটা একটা দারুণ জিনিস। মেয়েটি কেস থেকে ফুলদানি বের করল। সেটি ভিক্টরের হাতে তুলে দিল।
–আমাকে একটা রিসিপ্ট দেওয়া যাবে?
–হ্যাঁ, মিঃ ভিক্টর। আমরা কি এই জিনিসটাকে ভালোভাবে প্যাক করে দেব?
ভিক্টর বললেন–না-, তার কোনো দরকার নেই, আপনি এটাকে পেপার ব্যাগের মধ্যে পুরে দিন।
সবকিছু ঠিকঠাক এগিয়ে যাচ্ছে। ওই নকল বস্তুটা একটা কাগজের ব্যাগে পুরে দেওয়া হয়েছে। রিসিপ্ট দেওয়া হয়েছে।
ধন্যবাদ।
মনে হচ্ছে, আপনার বন্ধু এটা পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে যাবে।
–হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
ভিক্টর ব্যাগ নিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। তার হাত দুটো কাঁপছে। তিনি অফিসে ঢুকে পড়লেন।
দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ব্যাগ থেকে ওই নকল ফুলদানিটা বের করলেন। সেটিকে ডেস্কের ওপর রাখলেন। ভিক্টর ভাবলেন, খুব তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতে হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি। তার সমস্ত মন জুড়ে আশঙ্কার মেঘ। আতঙ্কঘন অনুভূতি। মাথা কাজ করছে না। আমি কি অন্য কোনো দেশে চলে যাব? স্ত্রী-পুত্র পরিবারের সাথে কখনও দেখা করব না? আত্মহত্যা করব? পুলিশের কাছে গিয়ে সবকিছু বলব? বলব, কীভাবে আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু যখন সবাই সত্যিটা জানতে পারবে, আমি একেবারে শেষ হয়ে যাব। নাঃ, এই সমস্যা সমাধানের আর কোনো পস্থা নেই। যে টাকাটা আমি ধার করেছি, সেটা আমাকে শোধ করতেই হবে। না হলে প্রিজি আমাকে মেরে ফেলবে। হা ঈশ্বর, আমার বন্ধু টনি আছে বলেই আমি হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে যাব। টনি না থাকলে আমি কবেই মরে যেতাম।
ভিক্টর ঘড়ির দিকে তাকালেন। সময় এগিয়ে চলেছে। ভিক্টর উঠে দাঁড়ালেন। তার পা-দুটো তখনও কাঁপছে। তিনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। জোরে জোরে নিশ্বাস নিলেন। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। হাত ঘেমে গেছে ঘামে। হাতে হাত মুছে নিলেন। ওই নকল জিনিসটা পেপার ব্যাগের ভেতর পুরে নিলেন। দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজার সামনে একজন গার্ডের থাকার কথা। ছটা পর্যন্ত সে থাকে। মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর আর একজন গার্ড এসে যায়। তাকে অনেকগুলো ঘরের ওপর নজর রাখতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে সে অনেক সময় দূরের বারান্দায় চলে যায়। সেখান থেকে সব ঘর দেখা যায় না।
ভিক্টর অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। গার্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভিক্টরের আচরণের মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধ।
–আমাকে ক্ষমা করবেন মিস্টার, আমি জানতাম না, আপনি এখনও অফিসে আছেন।
–হ্যাঁ, এবার আমাকে বেরোতে হবে।
আপনি কি জানেন, গার্ড বলল, আমি আপনাকে হিংসা করি?
কেন?
–আপনি এইসব সুন্দর সুন্দর জিনিস সম্পর্কে কত তথ্য জানেন। আমি এখানে ঘুরি, ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি, ওরা হল ইতিহাসের এক-একটি টুকরো স্মৃতি। তাই নয় কি? আমি কিন্তু বেশি খবর জানি না। আপনি হয়তো একদিন আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন। মনে হচ্ছে…
লোকটা বকেই চলেছে- হ্যাঁ, একদিন, তোমাকে সব কথা বলতে পারলে আমারও ভালো–
ঘরের একেবারে কোণে ভিক্টর পৌঁছে গেছেন। দেখতে পাচ্ছেন সেই ক্যাবিনেটটা, অসাধারণ ফুলদানিটা যার মধ্যে আছে। এখনই ওই গার্ডের হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে।
অ্যালার্ম সার্কিটে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বেসমেন্টে। তুমি কি একটু চেক করবে?
–হ্যাঁ, জিনিসগুলো অনেকদিনের পুরোনো, তাই বোধহয় গোলমাল করছে।
–এখনই একবার যাও না ভাই। সবকিছু ঠিকঠাক না দেখে আমি কী করে যাই বল তো?
–ঠিকই বলেছেন মিস্টার, আমি এখুনি আসছি।
ভিক্টর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন। গার্ড চলে গেল। হলের ওপাশে, বেসমেন্টের দিকে। যখনই সে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল, ভিক্টর তৎপর হয়ে উঠলেন। তার হাতে ওই প্যাকেট, তার ভেতর নকল ফুলদানি। তিনি চাবি নিলেন। ভাবলেন, শেষ অব্দি আমি কাজটা করতে চলেছি। চুরির কাজ। চাবিটা হাত গলে পড়ে গেল মাটির ওপর। এটা কি কোনো চিহ্ন? ভগবান কি আমাকে একাজ করতে বারণ করছেন? ঘামের স্রোত, সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দিয়েছে। ভিক্টর নীচু হলেন। চাবিটা খুঁজলেন। তাকিয়ে থাকলেন ফুলদানিটার দিকে অসাধারণ দেখতে। এত সুন্দরভাবে এটাকে তৈরি করা হয়েছে! আহা, কত হাজার বছর আগে। সত্যি, গার্ড ঠিক কথা বলেছে, এটা হল ইতিহাসের এক স্মারক চিহ্ন। এমন জিনিস কি কখনও চুরি করতে হয়।
ভিক্টর চোখ বন্ধ করলেন। এক মুহূর্তের জন্য, চারপাশে তাকালেন। কেউ তার ওপর নজর রাখেনি। তিনি কেসটার চাবি খুলে দিলেন। আস্তে আস্তে আসল ফুলদানিটা তুলে নিলেন। নকল ফুলদানিটা পেপার ব্যাগ থেকে বার করলেন। আধারের ওপর বসিয়ে দিলেন। বাঃ, চমৎকার হয়েছে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। একটা কথা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। নকল? এটা একেবারেই নকল, কিন্তু কে জানবে? একমাত্র আমি জানি, ভিক্টর ভাবলেন, দু-একজন বিশেষ পণ্ডিত হয়তো জানতে পারেন। বাইরে থেকে দেখলে কিছুই বুঝতে পারা যাবে না। কেউ কাছে এসে পরীক্ষা করবে না। ভিক্টর চাবি বন্ধ করে দিলেন। আসল ফুলদানিটা এখন পেপার ব্যাগের মধ্যে চলে গেছে। সঙ্গে আছে একটা রিসিপ্ট।
তিনি রুমাল নিলেন মুখ মুছলেন, হাত মুছলেন। সব কাজ হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা বেজে দশ মিনিট। এখন তাড়াতাড়ি করতে হবে। দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, গার্ড সেদিকে এগিয়ে আসছে।
–অ্যালার্ম সিস্টেমে তো কিছু হয়নি।
–ঠিক আছে। আমাদের সব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
গার্ড হাসল, আপনি এখন চললেন, তাই তো?
-হ্যাঁ, শুভরাত্রি।
সামনের দরজায় দ্বিতীয় গার্ড দাঁড়িয়ে ছিল। সেও এখন যাবার জন্য তৈরি। সে পেপার ব্যাগের দিকে তাকাল। বলল, সব কিছু পরীক্ষা করতে হবে। এটাই এখানকার নিয়ম।
–ঠিক আছে, ভিক্টর বললেন, তিনি ব্যাগটা গার্ডের হাতে দিলেন।
গার্ড ভেতর দিকে তাকাল, ফুলদানিটা বের করল। রিসিপ্টটা দেখল।
–বন্ধুর জন্য উপহার, ভিক্টর বললেন, সে একজন ইঞ্জিনিয়ার।
তার গলা কাঁপছিল। কিন্তু কেন? আমাকে এখন স্বাভাবিক অভিনয় করতে হবে।
সুন্দর! গার্ড ব্যাগটা ভিক্টরের হাতে তুলে দিল।
আর একটা ভয়ংকর মুহূর্ত কেটে গেল।
ভিক্টর ব্যাগটা বুকের কাছে ধরলেন- শুভরাত্রি।
গার্ড দরজা খুলে দিয়ে বলল–শুভরাত্রি।
ভিক্টর বাইরে এলেন। রাতের বাতাস শীতল হয়ে উঠেছে, প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলেন তিনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। লক্ষ লক্ষ ডলার এখন তার হাতের মধ্যে। কিন্তু এইভাবে? তিনি ভাবতে পারছেন না। মনে হচ্ছে, তিনি যেন দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। একটুকরো ইতিহাস বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। কার কাছে? মুখহীন কজন বিদেশির কাছে?
তিনি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেন। রিজোলির কথা মতো একটা ট্যাক্সি মিউজিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভিক্টর সেখানে চলে গেলেন। হাত তুললেন। বললেন, হোটেল গ্রান্ডে ব্রেটাগনে।
ট্যাক্সি এগিয়ে গেল। ভিক্টর সিটে এলিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, কেউ বোধহয় তার সমস্ত শক্তিকে শুষে নিয়েছে। মনে হচ্ছে, একটা ভয়ংকর যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তিনি জয়লাভ করেছেন। কিন্তু যুদ্ধের শেষ হাসি তিনি হাসবেন কী?
ট্যাক্সি হোটেল গ্রান্ডের সামনে এসে দাঁড়াল।
ভিক্টর বললেন–এখানে একটু অপেক্ষা করো কেমন?
শেষবারের মতো তিনি ওই অসাধারণ ঐতিহ্যমণ্ডিত বস্তুটির দিকে তাকালেন। আহা, ব্যাকসিটে সেটা পড়ে রইল। ভিক্টর অতি দ্রুত ট্যাক্সি থেকে নেমে গেলেন। হোটেল লবিতে পৌঁছে গেলেন। দরজার ওপারে চলে গেলেন। তাকিয়ে থাকলেন। একজন মানুষ ট্যাক্সিতে প্রবেশ করছে। একটুবাদে ট্যাক্সিটা অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে গেল।
তাহলে সব কাজ ঠিক মতো হয়েছে। আহা, আমার জীবনটা আর কখনও আগের মতো হবে না। সারা জীবন আমাকে এই কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হবে। একটা দুঃস্বপ্নের যাত্রা শুরু হল।
.
রোববার দুপুরবেলা। তিনটে বেজেছে। টনি রিজোলি হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন। প্লাটিয়া ওমোনিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি একটা সুন্দর জ্যাকেট পরেছেন। সঙ্গে সবুজ ট্রাউজার। দুজন ডিটেকটিভ তাকে অনুসরণ করছিলেন। একজন বললেন–মনে হচ্ছে, লোকটা বোধহয় সার্কাস দেখাবে, এমনই পোশাক পরেছে।
–মেটাক্সা স্ট্রিট, রিজোলি একটা ট্যাক্সি ভাড়া নিলেন। গোয়েন্দা তার ওয়াকিটকিতে বলল।
-লোকটা ট্যাক্সি নিয়ে পশ্চিমদিকে চলেছে।
একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল আমরা তাকে দেখতে পেয়েছি। আমরা অনুসরণ করছি। আপনারা হোটেলে ফিরে যান।
–ঠিক আছে।
ট্যাক্সিকে অনুসরণ করছে একটি সিডান গাড়ি, বেশ কিছুটা দূর থেকে। ট্যাক্সিটা দক্ষিণ দিকে গেল, মোনাসটিরাকি পার হয়ে, সিডানও এগিয়ে চলেছে। এই সিডানে একজন ডিটেকটিভ বসে আছেন, ড্রাইভারের পাশে, হাতে হ্যান্ড মাইক্রোফোন।
সেন্ট্রাল। ইউনিটফোর। লোকটা ট্যাক্সিতে চড়ে ফিলহেলিনন স্ট্রিটে পৌঁছে গেছে। মনে হচ্ছে একটু অপেক্ষা করতে হবে।… না না ওরা পেটা স্ট্রিটে চলে গেল। বোধহয় প্লাকার দিকে যাবে। আমরা এখনও অনুসরণ করব কী?
ইউনিট ফোর, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।
শব্দ ভাসছে।
–ইউনিট ফোর, আমরা সব কিছু জানতে পেরেছি। সে প্লাকাতে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়েছে। তার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতে হবে।
–লোকটা লাল চেক জ্যাকেট পরেছে। সবুজ ট্রাউজার। তাকে কোনোভারেই চোখের আড়াল করা চলবে না। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করো। ট্যাক্সি থেমেছে। ও প্লাকাতে নেমে পড়েছে।
-ঠিক আছে, আমরা এই খবরটা পাঠাচ্ছি।
–ঠিক আছে।
.
প্লাকা। দুজন ডিটেকটিভকে দেখা গেল ট্যাক্সি থেকে নেমে আসা লোকটির ওপর কড়া নজর রাখছে।
–কোথা থেকে জোকারের মতো পোশাকটা কিনেছে বলো তো?
একজন হাসতে হাসতে মন্তব্য করল।
তারা পেছন দিকে চলে গেল। এটা হল শহরের এক প্রাচীন অংশ। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলল লুকোচুরি খেলা। রিজোলি ইচ্ছে করেই বোধহয় তাদের চোখের ধুলো দেবার চেষ্টা করছেন। একটির পর একটি বার তিনি পেরিয়ে গেলেন। স্যুভেনিরের দোকান, আর্ট গ্যালারি। অ্যানাফিয়োটিকা ধরে হাঁটলেন। একটা দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। এখানে প্রাচীন যুগের অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে তৈলাধার, মোমবাতি- আরও কত কিছু।
এখানে লোকটা কী করছে?
মনে হচ্ছে আরাম করে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছে। এখনও তার ওপর নজর রাখতে হবে।
তারপর? অ্যাগুও গেরেভা পার হয়ে রিজোলি এগিয়ে চললেন জাইনস রেস্টুরেন্টের দিকে। দুজন ডিটেকটিভ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকল। তার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখল।
দুজন ডিটেকটিভ এখন খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে উঠেছে।
আমার মনে হচ্ছে, লোকটা বুঝি এখনই এখান থেকে চলে যাবে। বাড়ি ফিরতে পারলে ভালো হত। ঘুম-ঘুম পাচ্ছে।
না-না, এখন জেগে থাকতে হবে। চোখের পাতা জড়িয়ে এলে লোকটা পালিয়ে যাবে। নিকোলিনো তাহলে আমাদের গাধা বলবেন।
–আমরা কী করে লোকটাকে চোখের বাইরে যেতে দেব? ও তো এখানে গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
অন্য ডিটেকটিভ কথা বলার চেষ্টা করলেন ঠিক আছে, আর একটু কষ্ট স্বীকার করো না ভাই।
–আমি তো করছি।
–ঠিক আছে, ওর মুখের দিকে তাকিয়েছ কী?
–না।
–আমিও দেখিনি, এসো তো দেখা যাক।
দুজন গোয়েন্দা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলেন। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তারা এক সম্পূর্ণ অজানা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এ কী! একে অনুসরণ করার কথা তো বলা হয়নি!
.
ইন্সপেক্টর নিকোলিনো এই কথা শুনে অত্যন্ত রেগে গেছেন।
–আমি তিনটে দল করলাম, রিজোলিকে চোখে চোখে রাখার জন্য। আপনারা সকলেই এই কাজে সুদক্ষ। আগে অনেক এ ধরনের কাজ করেছেন। তা সত্ত্বেও রিজোলি কীভাবে আপনাদের চোখের সামনে থেকে চলে গেল? আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!
গোয়েন্দারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন।
একজন বিড়বিড় করে বলার চেষ্টা করেন ইন্সপেক্টর, সত্যি আমরা এই খেলাতে হেরে গেছি। প্রথম দল শয়তানটাকে একটা ট্যাক্সিতে দেখেছিল।
-তারপর? ট্যাক্সিটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়? সেই পুরোনো গল্প। তাই তো?
-না স্যার, আমরা ট্যাক্সির ওপর কড়া নজর রেখেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম ট্যাক্সির মধ্যে ওই শয়তানটাই বসে আছে। সে একটা বুনো পোশাক পরেছিল। রিজোলি বুদ্ধি করে ট্যাক্সিতে আর একটা যাত্রীকে লুকিয়ে রেখেছিল। ট্যাক্সির মধ্যেই তারা পোশাক বদলা বদলি করে। আমরা ভুল লোককে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
–রিজোলি ঠিক ট্যাক্সিতে উঠল কী করে?
–কীভাবে তা বুঝতে পারছি না।
–আপনারা লাইসেন্স নাম্বার নোট করেছেন?
–না স্যার, ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি।
–যে লোকটাকে ধরা হল তার পরিচয় জানা গেছে?
-সে রিজোলির হোটেলের একজন বেলবয়। বেচারা কিছুই জানে না। রিজোলি তার হাতে একশো ডলারের নোট গুঁজে দিয়েছিল। রিজোলি বলেছিল, কারোর সাথে লুকোচুরি খেলা খেলতে হবে।
ইন্সপেক্টর নিকোলিনো গভীর নিশ্বাস ফেললেন। তিনি বললেন–এই মুহূর্তে রিজোলির সন্ধান পাব কী করে? কাউকে কি চেনেন, যে রিজোলির খবর দিতে পারে?
-না স্যার, তেমন কোনো লোকের সঙ্গে আমার জানাশোনা নেই।
.
গ্রিসের সাতটা প্রধান বন্দর আছে- থেসালোনিকি, পাট্টাস, ভোলোস, ইগোমেনিটিসা, কাভালা, ইরাকলিয়ন এবং পাইরাইয়স।
এথেন্সের সাত মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পাইরাইয়স বন্দরের অবস্থান। এটিকে আমরা গ্রিসের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বন্দর বলতে পারি। শুধু তাই নয়, এই বন্দরটি হল ইউরোপের অন্যতম প্রধান বন্দর। পোর্ট কমপ্লেক্সের মধ্যে চারটি জেটি আছে। তিনটি রুটে প্রমোতরণী ছাড়ে। সমুদ্রগামী জাহাজও সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে। চতুর্থটির নাম হেরাকলেস, এখান থেকে শুধু মালবাহী জাহাজ দূর সমুদ্রে যাত্রা করে।
হেরাকলেসের কাছে নোঙর করা আছে থেলে নামক জাহাজটি। সেটা একটা বিরাট ট্যাংকার, মনে হচ্ছে বুঝি বিরাট আকৃতির একটি দৈত্য। যে-কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
চারজনকে সঙ্গে নিয়ে টনি রিজোলি ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেছেন। রিজোলি ওই বিরাট জাহাজটার দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবছেন- যাক, শেষ পর্যন্ত ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছোতে পেরেছি। বন্ধু ডেমিরিসের ভাগ্য পরীক্ষা হবে।
তিনি তার সঙ্গে আসা মানুষদের দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমাদের দুজন এখানে অপেক্ষা করবে। বাকি দুজন আমার সঙ্গে এসো। দেখো, জাহাজ থেকে কেউ যেন যেতে না পারে।
–ঠিক আছে।
রিজোলি এবং দুজন মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। তারা খানিকটা পথ এগিয়ে গেল। একজন এসে জানতে চাইল আমি কি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?
–মিঃ ডেমিরিসের সঙ্গে দেখা করতে পারব?
মিঃ ডেমিরিস মালিকের কেবিনে বসে আছেন। তিনিও আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
যাক, দুয়ে দুয়ে চারই হয়েছে। রিজোলি হেসে উঠলেন–ঠিক আছে, উনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন? জাহাজ কখন ছাড়বে?
মাঝরাতে, আমি কি পথ দেখাব?
–ধন্যবাদ।
ওরা ডেকের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। শেষ অব্দি একটা মইয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। সরু প্যাসেজ। ইতিমধ্যে তারা প্রায় ডজন খানেক কেবিন পার হয়ে গেছেন।
শেষ কেবিনের সামনে ওরা এসে দাঁড়াল। সেলার দরজাতে শব্দ করতে যাবে, রিজোলি তাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন–আমরা নিজেরাই আমাদের উপস্থিতি ঘোষণা করব কেমন? তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না ভাই।
রিজোলি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
রিজোলি যা ভেবেছিলেন, কেবিনটি তার থেকে অনেক বড়। এখানে একটা সুন্দর সাজানো শয্যা আছে, কৌচ, ডেস্ক- কোনো কিছুর অভাব নেই। দুটো ইজিচেয়ার চোখে পড়ল। ডেস্কের পাশে বসে আছেন কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস।
ডেমিরিস রিজোলিকে দেখলেন। কঁপতে শুরু করলেন। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে তিনি বলতে থাকেন এখানে…এখানে আপনারা কী করছেন?
তার কণ্ঠস্বর ফিসফিসানির মতো শোনাচ্ছে।
–আমার বন্ধু আর আমি ঠিক করলাম, আপনাকে শুভ কামনা জানার কোস্টা।
আপনি কী করে জানলেন যে আমি এখানে আছি? আমি তো আপনাদের আশা করিনি।
–তা আমি জানি। রিজোলি বললেন। তারপর নাবিকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ পল।
নাবিক বেরিয়ে গেল। রিজোলি ডেমিরিসের দিকে তাকিয়ে আরও কিছু বলতে লাগলেন।
–আপনি আমার অংশীদার, একটা শুভ কাজ শুরু হতে চলেছে। আমার কর্তব্য আপনাকে গুডবাই জানানো। তাই নয় কী? কিন্তু আপনি আমাকে না বলে কোথায় চলে যাচ্ছিলেন?
ডেমিরিস সঙ্গে সঙ্গে বললেন–নাতো, আমি কোথাও যাচ্ছিলাম না। আমি সব কিছু দেখার জন্য এখানে এসেছি। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। কাল সকালে এই জাহাজটা যাত্রা শুরু করবে।
রিজোলি আর একটু কাছে এলেন। যখন তিনি কথা বলছিলেন, তার গলার স্বর নরম হয়ে এসেছিল।
রিজোলি বলললেন–কোস্টা বেবি, আপনি আবার মস্ত বড়ো ভুল করছেন। এই পৃথিবীতে আপনার লুকোবার কোনো জায়গা নেই। আপনার আর আমার মধ্যে ভদ্রলোকের একটা চুক্তি হয়েছে। মনে আছে তো? আপনি জানেন, চুক্তি ভঙ্গ করলে কী হয়? তাদের কুকুরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। মরতে হয় নৃশংসভাবে।
ডেমিরিস ঢোক গিলে বললেন–আমি আপনার সঙ্গে একা কথা বলতে চাইছি।
রিজোলি তার লোকেদের বাইরে যেতে ইঙ্গিত করলেন, বললেন–তোমরা বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো।
তারা চলে গেল। রিজোলি আর্মচেয়ারে বসে পড়লেন।
-কোস্টা, আমি কি আপনাকে হতাশ করেছি?
-কেন এভাবে কথা বলছেন? ডেমিরিস জানতে চাইলেন। আমি আপনাকে টাকা দেব, আপনি যত টাকা চাইছেন, তার থেকে অনেক বেশি। শুধু আমাকে মুক্তি দিন।
–মুক্তি কীসের জন্য?
-আমি এই জাহাজে চড়ে চলে যাব। একা। আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন না। দোহাই ঈশ্বরের, অনুগ্রহ করে আমাকে শুধু এইটুকু সাহায্য করুন।
ডেমিরিসের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারা গেল, তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছেন।
–আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারেন না। যদি একবার আমার দোষ প্রমাণিত হয়, তাহলে সরকারের চোখে আমি একটা বিশ্বাসঘাতক চিহ্নিত হব। সরকার আমরা সমস্ত জাহাজ বাজেয়াপ্ত করবে। আমি আপনাকে সব দেব। আপনি যা চাইছেন, তার থেকে অনেক বেশি। দয়া করে আমার কথাটা শুনুন।
টনি রিজোলি হেসে উঠলেন আমার আর কিছু চাইবার নেই এই পৃথিবীর কাছে। সব আমি পেয়ে গেছি। কতগুলো ট্যাংকার আপনার আছে? কুড়িটা? তিরিশটা? আমি আর আপনি মিলে সবকটা ট্যাংকারকে সব সময় ব্যস্ত রাখব। আপনাকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে, দু-একটা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
–আপনি…আপনি কী বলছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–সময় হলে সবই বুঝতে পারবেন, টনি রিজোলি উঠে দাঁড়ালেন। আপনি ক্যাপটেনের সঙ্গে কথা বলুন। বলুন, কয়েকটা বেশি জায়গায় থামতে হবে। বিশেষ করে ফ্লোরিডার বন্দরে।
ডেমিরিস ইতস্তত করতে থাকেন–ঠিক আছে, কাল সকালে আপনি আসবেন কী?
রিজোলি হেসে ফেললেন–আমি কোথাও যাচ্ছি না। খেলাটা শেষ হয়ে গেছে। মাঝপথে আপনি পালাবেন, আমি সব খবর পেয়েছি। ঠিক আছে, আমিও আপনার সঙ্গে পালাব। আমাদের সঙ্গে হেরোইনের প্যাকেট আছে। কোস্টা, এটা খুব সুন্দর বোঝাপড়া। আমরা স্টেট মিউজিয়াম থেকে দামি জিনিসপত্র বাইরে পাচার করব। আপনি সেগুলো আমার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবেন। এটাই হল আপনার কাজের শাস্তি। আপনি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার খেলা খেলতে চেয়েছেন, তার জন্য আপনাকে কিছুটা শাস্তি তো পেতেই হবে।
ডেমিরিসের চোখ ভয়ার্ত হয়ে উঠল–সে কী? আমাকে এভাবে ফাসাবেন না। দোহাই
ডেমিরিস কথা শেষ করতে পারলেন না। রিজোলি তার ঘাড় চাপড়ে বললেন–ভয় কী? আমি কথা দিচ্ছি, আমার অংশীদার হিসেবে আপনি জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দে কাটাতে পারবেন।
রিজোলি দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেলেন। দরজা খুললেন।
-ঠিক আছে, এবার আসল কাজটা শুরু হোক।
কোথায় জিনিসটা থাকবে?
-যে-কোনো জাহাজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার অনেক জায়গা থাকে। রিজোলি আসল উদ্দেশ্যটা বললেন না। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের জাহাজে কোনোদিন পুলিশি তল্লাশি হয় না। তিনি এক গণ্যমান্য মানুষ। সব সন্দেহের উর্ধ্বে তার অবস্থান।
এক বস্তা আলুর মধ্যে এটাকে ঢুকিয়ে রাখলে কেমন হয়? বস্তাটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হবে। গ্যালির নীচে ফেলে রাখতে হবে। আর ওই ফুলদানি? ফুলদানিটার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত ভাবে নিতে হবে। রিজোলি ডেমিরিসের দিকে তাকালেন। তার চোখে লোভের আগুন জ্বলে উঠেছে আশা করি এই কাজটা আপনি ভালোভাবে করতে পারবেন। আপনার কোনো অসুবিধা নেই তো?
ডেমিরিস কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। অবাক বিস্ময়ে তিনি দেখলেন, গলা বসে গেছে, স্বর ফুটে বেরোচ্ছে না। ..
রিজোলি বললেন–ঠিক আছে, এবার তাহলে যাত্রা শুরু হোক।
রিজোলি আর্মচেয়ারে বসলেন শক্ত হয়ে, বললেন–আহা, ভারি সুন্দর তো! কোস্টা এখানে আপনি, আমি এবং আমার ছেলেরা অন্য কোনো জায়গা খুঁজে নেব।
ডেমিরিস শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে বলতে থাকেন ধন্যবাদ আপনাকে, অশেষ ধন্যবাদ।
.
– মধ্যরাত, বিরাট ট্যাংকার এবার যাত্রা শুরু করেছে। দুটি টাগবোট সামনে আছে। তারাই পথপ্রদর্শকের কাজ করবে। হেরোইনের প্যাকেট লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ফুলদানিটা। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের কেবিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
টনি রিজোলি তার সাঙ্গপাঙ্গদের ডেকে নিয়ে বললেন–তোমরা সবাই রেডিয়ো রুমে চলে যাবে। ওয়ারলেসের সংযোগ ছিন্ন করে দাও। আমি চাই না, ডেমিরিস কোথাও সংবাদ পাঠাক।
–ঠিক আছে, ডেমিরিস এক ভেঙে পড়া মানুষ। তাহলেও রিজোলি কোনো রিস্ক নিতে চাইছেন না।
.
যাত্রা শুরুর আগে পর্যন্ত রিজোলির মন নানা চিন্তায় আচ্ছাদিত। অনেকসময় শেষ মুহূর্তে অযাচিত বিপদ দেখা দেয়। দীর্ঘ জীবনের উত্থান-পতনে এমন অনেক মুহূর্তের সামনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি স্বপ্নেও আমরা যে ঘটনা কল্পনা করতে পারি না, অনেক সময় তাও ঘটে যায়। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস, বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। আকাশ অব্দি যার হাত প্রসারিত, এখন আমার পার্টনার হিসেবে কাজ করছেন? ভাবতে ভালো লাগে। রিজোলি চিন্তা করলেন, ওই বেজন্মাটাকে আরও বোকা বানাতে হবে। তার সমস্ত জাহাজ একদিন আমার বশীভূত হবে। আমি যেখানে খুশি যেতে পারব। মাল পাচার করতে পারব। তখন আমিই হব পৃথিবীর সুখীতম সম্রাট। আহা, এমন সৌভাগ্য যে আমার কখনও হবে, আমি ভাবতেও পারিনি! বুদ্ধির সাহায্যে আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। মিউজিয়ামের সব কিছু ফাঁক করে দেব। ওই মিউজিয়াম সত্যি সত্যি সোনার খনি। আহা, ওর সবকিছু আমি অধিকার করব। আমার ছেলেদের ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। ওরা বুঝতেও পারবে না, কোন্ কাজ করছে।
টনি রিজোলি ঘুমের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে শুরু করলেন। স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্ন দেখলেন সোনাতে বোঝাই একটি জাহাজ স্থির উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছে। সেখানে সুন্দরী মেয়েরা মদ পরিবেশন করছে।
.
সকাল হয়েছে। রিজোলির ঘুম ভেঙে গেল। ব্রেকফাস্টের জন্য তারা ডাইনিংরুমের দিকে এগিয়ে চললেন। ছজন ক্রু সদস্য ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। একজন স্টুয়ার্ট
বললেন–শুভ সকাল।
–মিঃ ডেমিরিস কোথায়? রিজোলি জানতে চাইলেন? উনি কি প্রাতরাশ করবেন না?
না, উনি ওঁনার কেবিনে বসে আছেন। উনি বলছেন, আপনি এবং আপনার বন্ধুদের সবকিছু সরবরাহ করতে। বলুন স্যার, কীভাবে আপনার কাজে লাগতে পারি।
আহা, ওঁনার মতো মানুষ আর হয় না। রিজোলি হেসে ফেললেন–আমাকে অরেঞ্জ জুস দেবেন? শুয়োরের মাংস আর ডিম? তোমরা কী নেবে ছেলের দল?
–যেটা আপনার অভিরুচি। অর্ডার দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। রিজোলি বললেন মাথাটা ঠান্ডা রেখো। চোখের দৃষ্টিকে অনেক দূর প্রসারিত করো। আচরণের মধ্যে ভদ্রতার ছাপ আনবে কেমন? মনে রেখো, আমরা সবাই পৃথিবীর অন্যতম ধনী মানুষের সম্মানীয় অতিথি।
.
ডেমিরিস সেদিন লাঞ্চের আসরেও আসেননি। এমনকি ডিনারের সময়ও তাকে দেখা গেল না।
রিজোলি তার সাথে কথা বলার জন্য কেবিনে ঢুকেছিলেন।
ডেমিরিস কেবিনে বসেছিলেন। তাঁর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বুঝি অর্ধমৃত। ভয়ংকর বিপদের সন্ধানে বসে আছেন একা।
রিজোলি বললেন–আরে, এতে ভেঙে পড়ার কী আছে? জীবনে উত্থান-পতন তো থাকবেই, আমি কথা দিচ্ছি, আপনাকে বিপদে ফেলব না। আপনি আমার কাজের অংশীদার, ব্যাপারটা ভেবে দেখুন তো। আপনি এমন আচরণ করছেন, যেন আপনার ভীষণ অসুখ করেছে। উঠুন, অনেক কাজ করতে হবে। স্টুয়ার্টকে বলেছি, এখানে খাবার পাঠিয়ে দিতে।
ডেমিরিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ঠিক আছে, আপনি কি আমাকে একটু একা থাকতে দেবেন?
রিজোলি ঘোঁত ঘোঁত করে বললেন–ঠিক আছে, ডিনারের পর ঘুমোবার চেষ্টা করুন। আপনাকে দেখে একটা বিধ্বস্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
.
সকাল হয়েছে, রিজোলি ক্যাপটেনের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
তিনি বললেন আমি টনি রিজোলি, আমি মিঃ ডেমিরিসের একজন অতিথি।
–ডেমিরিস আমাকে সব কিছু বলেছেন। মনে হচ্ছে পথ পাল্টাতে হবে। আপনি কি অন্য কিছু নির্দেশ দেবেন?
–হ্যাঁ, আমি জানি। আমরা কখন ফ্লোরিডার উপকূলে পৌঁছোব?
–তিন সপ্তাহের মধ্যে, মিঃ রিজোলি।
–ঠিক আছে। আমি আপনার সাথে পরে কথা বলব।
রিজোলি চলে গেলেন। বিশাল এই জাহাজটির সর্বত্র তখন তার দৃপ্ত পদচিহ্ন আঁকা হচ্ছে। মনে মনে স্বপ্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন তিনি। ভাবতেও পারেন নি, কোনো একদিন এত বড়ো জাহাজের অধীশ্বর হবেন তিনি। কীভাবে তার জীবন কেটেছে, অতীতের দিনগুলো তার মনে পড়ে গেল। আহা, আজ পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয়। মনের ভেতর এমন উন্মাদন আগে কখনও জাগেনি তো!
.
সময় এগিয়ে চলেছে। রিজোলি মাঝে মধ্যেই কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের কেবিনে ঢুকে পড়েন।
–আঃ, আজকে আপনাকে আর একটু ভালো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এখানে কোথাও থামলেও চলে।
ডেমিরিস আর কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই। তাকে দেখে একটা ডুবন্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে। অসহায় এবং একা। পৃথিবীর সব খেলাতে যিনি হেরে গেছেন।
.
সময় আর একটু এগিয়ে গেল। রিজোলি স্বপ্নের কাছাকাছি চলে এসেছেন। এখন তিনি অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অথচ এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। জীবনে অনেক কঠিন কাজে অংশ নিয়েছেন, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। একটা সপ্তাহ কেটে গেছে, আর একটা সপ্তাহও কেটে গেল। জাহাজ এখন উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দিকে এগিয়ে চলেছে।
শনিবার সন্ধ্যেবেলা, রিজোলি জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চারপাশে সমুদ্রের বিপুল জলরাশি, মাঝে মধ্যে বজ্রপাত।
প্রথম মেট বলল–আবহাওয়া খারাপ হবে মিঃ রিজোলি। ব্যাপার খুব একটা সুবিধার লাগছে না।
রিজোলি কাধ কঁকিয়ে বললেন–কোনো কিছুই আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না মশাই।
সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। জাহাজের নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তরঙ্গে বোধহয় সে ডুবে যাবে।
রিজোলির মনের ভেতরও অশান্তির আবহাওয়া। আমি কি একজন ভালো নাবিক নই? কিন্তু খারাপটাই বা কিসে? রিজোলি তাঁর নিজস্ব কেবিনে চলে এলেন। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন। এই সময় স্বপ্নের ভেতর কোনো সোনালি জাহাজ কিংবা উলঙ্গ মেয়েরা আসেনি। কালো স্বপ্ন, যুদ্ধ শুরু হয়েছে, অস্ত্রের ঝনঝনানি তিনি শুনতে পাচ্ছেন, বিস্ফোরণের শব্দ।
রিজোলির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে চারপাশে তাকালেন। কেবিনটা দুলছে কেন? সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে পড়েছে জাহাজটি! করিডরে পায়ের শব্দ। কী হচ্ছে সেখানে?
টনি রিজোলি তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন। করিডরে পৌঁছে গেলেন। দেখা গেল, তিনিও ঠিক মতো তাল রাখতে পারছেন না।
লোকগুলো সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। কী, হয়েছে কী?
–বিস্ফোরণ! জাহাজে আগুন লেগেছে। আমরা ডুবছি, এখন তাড়াতাড়ি ডেকে চলে আসুন।
বিস্ফোরণ? আগুন? রিজোলি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই শব্দ দুটোর বুনো শুয়োরের মতো তাকে আক্রমণ করেছে। জাহাজটা ডুবে গেলে কী হবে? আমার সব স্বপ্নের সমাধি? কিন্তু অনেক কাজ যে করতে হবে। আগে ডেমিরিসের জীবন বাঁচাতে হবে। ডেমিরিসই আমার চাবিকাঠি। সফল জীবনের ছাড়পত্র। কীভাবে তার কাছে খবর পৌঁছোনো যাবে? হঠাৎ টনির মনে হল, তিনি তো ইচ্ছে করেই বেতার ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিলেন।
রিজোলি কোনোমতো ভারসাম্য রক্ষা করে চললেন। সরু পথ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ডেকের ওপর লাফিয়ে পড়লেন। আহা, ঝড় থেমে গেছে। সাগর আগের মতোই শান্ত। আকাশে চাঁদের জোছনা। পৃথিবীর কোথাও কোনো অশান্তি নেই।
আর একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। আর একটা আগুন লেগে গেছে, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। জলের মধ্যে অগ্নিকুণ্ড ভাসছে, জাহাজটা অত্যন্ত দ্রুত ডুবছে। একটির পর একটি লাইফবোট ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে গোটা জাহাজে বুঝি আগুন ধরে গেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস কোথায়?
রিজোলি অনেক ধরনের শব্দ শুনতে পেলেন। আর্তনাদের শব্দ। বিস্ফোরণের শব্দ। তিনি তাকিয়ে থাকলেন শূন্য চোখে। একটা হেলিকপ্টার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
আমরা কি বেঁচে গেলাম? রিজোলি মনে মনে ভাবলেন। তিনি হেলিকপ্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন।
জানালা দিয়ে একটা মুখ বেরিয়ে এল। এই মুখটা কার?
রিজোলি অবাক হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন, কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস। তিনি হাসলেন, তিনি হাত নাড়ছেন। তিনি দিগ্বিজয়ী সম্রাট।
রিজোলির পা থেকে মাথা অব্দি জমে বরফ হয়ে গেছে। মাথাটা কাজ করছে না। প্রথম থেকে কী ঘটেছে, এখন তা অনুমান করতে পারছেন। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস একটা হেলিকপ্টার পেলেন কী করে? মধ্যরাতে? তার মানে? কত বুদ্ধিমান মানুষ তিনি।
রিজোলি বুঝতে পারলেন, এবার তাকে জলে ডুবে মরতে হবে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস তার সাথে ব্যবসা করতে চাননি। কুকুরির বাচ্চাটা এইভাবে তাকে বোকা বানিয়েছেন! প্রথম থেকে সব কথা মনে পড়ে গেল তার। ডেমিরিস পালিয়ে যাচ্ছেন, তার মানে? ওই ফোনটা কে করেছিলেন? স্পাইরাস লামব্রোর নাম করে? ওটা এসেছিল ডেমিরিসের কাছ থেকে। এইভাবে ডেমিরিস আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছেন। এই কাজে তিনি সফল হয়েছেন। তিনি আমাকে জাহাজে ডেকে এনেছেন। ভালো মানুষের মতো ভয় পাওয়ার অভিনয় করেছেন। রিজোলি সব কিছু বুঝতে পারছেন, কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই।
ট্যাংকারগুলো ডুবতে শুরু করেছে। রিজোলি ভাবলেন, ঠান্ডা সমুদ্রের জলে এখন আলিঙ্গন করতে হবে আমাকে। পা অব্দি জল উঠে এসেছে। এবার? এবার আমি ডুবে মরব, চারপাশে অথৈ জলরাশি! আমাকে বাঁচাবার মতো কিছু নেই!
রিজোলি শেষবারের মতো হেলিকপ্টারের দিকে তাকালেন। চিৎকার করে বললেন ফিরে আসুন, আমি আপনাকে সব দেব।
উন্মত্ত বাতাস তার কণ্ঠস্বর কোথায় ভাসিয়ে দিল।
টনি রিজোলি শেষবারের মতো দেখলেন, জাহাজটা ডুবতে বসেছে। দেখতে পেলেন, আকাশে জ্যোৎস্নার অপূর্ব দৃশ্য। তার মধ্যে সুন্দর পাখির মতো উড়ে চলেছে ওই হেলিকপ্টার!
.
১৭.
সেন্ট মরিতজ। ক্যাথেরিন ভাবতে পারেনি, আঘাতটা তাকে এভাবে আক্রমণ করবে। অনেকক্ষণ সে তার হোটেল-ঘরে কৌচের ওপর একা একা বসেছিল। লেফটেনান্ট হান্স বার্গম্যানের শব্দগুলো তার কানে ঢুকছে না। উনি হলেন স্কি পেট্রলের প্রধান। কির্ক রেনল্ডস মারা গেছে, বার্গম্যানের কণ্ঠস্বর, ক্যাথেরিনের মনের সমুদ্রে তোলপাড়। ক্যাথেরিন কোনো শব্দ শুনতে চাইছে না। আবার সেই আতঙ্কঘন পরিবেশ। যেসব মানুষেরা আমাকে ভালোবাসে, কাছে আসে, তারা মৃত্যুর দেশে পৌঁছে যায় কেন? ক্যাথেরিনের মন এখন শূন্য। ল্যারি মারা গেছে। এবার কির্কের পালা। অন্যান্যরা নোয়েলে, নেপোলিয়ান ছোটাস, ফ্রেডারিক স্টাভরস, একটি পর একটি দুঃস্বপ্ন।
ক্যাথেরিনের চোখের তারায় এখন কোনো ভাষা নেই। কুয়াশার অন্ধকারে সব কিছু হারিয়ে গেছে। হান্স বার্গম্যানের কণ্ঠস্বর শোনা গেল- শ্ৰীমতী রেনল্ডস, শ্রীমতী রেনল্ডস!
ক্যাথেরিন তাকাবার চেষ্টা করল। সে বলল–আমি শ্ৰীমতী রেনল্ডস নই, আপনার কোথাও একটা ছোট্ট ভুল হচ্ছে। আমার নাম ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার। কির্ক আর আমি ছিলাম পরস্পরের বন্ধু।
–ঠিক আছে।
ক্যাথেরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল–কীভাবে? কীভাবে ঘটনাটা ঘটল? স্কি খেলাতে কির্কের দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়।
আমি জানি। এর আগে এখানে উনি অনেকবার স্কি করতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। আপনাকে সত্যি কথা বলব? মিস অলেকজান্ডার, এই ঘটনাটা শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। আমরা লাগাল-এ ওঁনার মৃতদেহ পেয়েছি। একটা স্লোপের ধারে। গত সপ্তাহে এই জায়গাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন তিনি নিষেধাজ্ঞা শোনেন নি? আমরা একটা সূচক চিহ্ন টাঙিয়ে রেখেছিলাম। মনে হয় উন্মত্ত বাতাস ওই চিহ্নটাকে সরিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনাটার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কীভাবে জবাবদিহি করব বুঝে উঠতে পারছি না।
সরি। এই একটিমাত্র শব্দ, এই শব্দ দিয়ে কি সবকিছু মুছে ফেলা যায়?
মিস আলেকজান্ডার, শেষকৃত্যের কাজ কীভাবে হবে? কিছু ভেবেছেন কী? তার মানে? মৃত্যুতেই সব কিছুর অবসান হয় না। আরও অনেক কিছু ভাবতে হবে। কফিনের ব্যবস্থা, কোথায় এক টুকরো জমি পাওয়া যাবে। ফুল কিনতে হবে, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের খবর দিতে হবে। ক্যাথেরিন আবার সেই আর্তনাদের জগতে ফিরে গেল।
মিস আলেকজান্ডার।
–আমি কির্কের পরিবারের সকলের কাছে খবর পৌঁছে দিচ্ছি।
–আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
.
লন্ডনে ফিরে আসা, শোকসন্তপ্ত একটা অভিযান। যে পাহাড়ের বুকে কিককে নিয়ে ক্যাথেরিন ঘুরে বেড়িয়েছিল, সেই পাহাড়টা এখন ভৌতিক অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাথেরিনকে আবার নতুন করে বাঁচার রসদ জোগাড় করতে হবে। নিজের ওপর সব আস্থা হারিয়ে ফেলেছে সে। মনে হচ্ছে, এখন থেকে আর কখনও সে সুখী জীবনের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতে পারবে না।
আহা, কির্ক এত শান্ত ভদ্র স্বভাবের মানুষ, ওকে আরও বেশি ভালোবাসা উচিত ছিল। ক্যাথেরিন ভাবল, কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল। কে দায়ী? কোনো কালো হাত? না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, কারোর অভিশাপ। আমার সমস্ত জীবনে সেই অভিশাপটা ছায়ার মতো আমাকে ঘিরে থাকবে। আমাকে যারা ভালোবাসবে, আমার সাহচর্যে আসবে, তারা সবাই ধ্বংস হবে। তার মানে এই পৃথিবীতে আমাকে একা একা থাকতে হবে।
.
ক্যাথেরিন লন্ডনে ফিরে এসেছে। কাজের মধ্যে মন দেবার চেষ্টা করছে। সে নিজের ফ্ল্যাটে একা একাই থাকে। কারোর সাথে দেখা করে না। কারোর সাথে কথা বলে না। হাউসকিপার অ্যানা তার জন্য খাবার তৈরি করে দেয়। ক্যাথেরিনের ঘরে পৌঁছে দেয়। ক্যাথেরিন খাবারে মুখ দেয় না। বেচারি অ্যানা, সে আর কী করতে পারে।
একদিন সে বলল–মিস অলেকজান্ডার, এভাবে তো আপনি মারা যাবেন। কিছু খাবার চেষ্টা করুন।
কিন্তু খাবারের কথা চিন্তা করলেই গা গুলিয়ে ওঠে। কির্কের সুন্দর মুখটা মনে পড়ে যায়।
.
পরের দিন ক্যাথেরিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার মনে হল যেন বুক জুড়ে সে ভালোভাবে নিশ্বাস নিতে পারছে না। অসম্ভব একটা ভার সে বয়ে নিয়ে চলেছে। অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে।
এভাবে কতদিন থাকব, ক্যাথেরিন ভাবল, কিছু একটা করতে হবে।
ইভলিন কেই-এর সাথে এব্যাপারে সে আলোচনা করল।
যা ঘটেছে, তার জন্য আমি নিজেকে দোষারোপ করছি।
-এভাবে কথা বলে কী লাভ ক্যাথেরিন? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। বাকি জীবনের দিকে তাকাও।
–হ্যাঁ, জানি আমি, অতীত কখনোই আর ফিরে আসবে না। কিন্তু নিজেকে বড্ড বেশি দোষী বলে মনে হচ্ছে আমার। কারও কাছে মনের সব কথা খুলে বলতে পারলে ভালো হত। আমি কি কোনো মনোরাগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হব?
–আমি একজনকে জানি, অত্যন্ত ভালো মানুষ, ইভলিন বলল, সত্যি কথা বলতে কী, মাঝে মধ্যে উনি উইমসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ওঁনার নাম অ্যালান হ্যামিল্টন। আমার এক বন্ধু আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল, ডাঃ হ্যামিল্টনের সাথে তার দেখা হয়। হ্যামিল্টন তাকে প্রায় সারিয়ে তুলেছেন। এখন তার মন আনন্দে উৎফুল্ল। তুমি কি একবার! ডাঃ হ্যামিল্টনের সঙ্গে দেখা করতে যাবে?
উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি কী বলব? আমি কী বলতে পারি?
–ক্যাথেরিন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। কবে যেতে হবে বলো?
আমি একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে রাখার চেষ্টা করছি। উনি খুব ব্যস্ত থাকেন। চট করে অ্যাপয়ন্টমেন্ট পাওয়া যায় না।
-ঠিক আছে ইভলিন, তোমার এই উদ্যমকে আমি প্রশংসা করছি।
ক্যাথেরিন উইমসের অফিসে চলে গেল। কির্ক সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কিছু জানা আছে ওই ভদ্রলোকের। ক্যাথেরিন ভাবল।
–উইম, কির্ক রেনল্ডসকে মনে আছে? কদিন আগে স্কি অ্যাকসিডেন্টে যার মৃত্যু হয়েছে।
–হ্যাঁ, ওয়েস্ট মিনিস্টার ৪৭১, তাই তো?
ক্যাথেরিনের চোখে দ্যুতি কী? সে বুঝতে পারল, উইম কির্কের টেলিফোন নাম্বার বলে যাচ্ছে। কিন্তু এটাই কি সব? কতগুলো সংখ্যা? মানুষ কোথায় উইম? মানুষ? আবেগ বাসনা-কামনা-অভিমান? উইম কি এভাবেই এক সাংকেতিক জগতের বাসিন্দা হয়ে যাবে?
না, এখানে আর বেশিক্ষণ থেকে লাভ নেই। ক্যাথেরিন ভাবল। যে মানুষ হারিয়ে গেছে, তার স্মৃতি রোমন্থন করে কী লাভ? মনটা অকারণে আরও দুঃখকাতর হয়ে উঠবে।
.
ইভলিন কথা রেখেছিলেন। অ্যাপয়ন্টমেন্টের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী শুক্রবার। ইভলিন ভেবেছিলেন কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে ফোন করে সবকিছু জানাবেন। পরে ভাবলেন, কিন্তু এই ব্যাপারটা এতই সাধারণ, এটা জানিয়ে ওঁনাকে বিরক্ত করে কী লাভ!
আলান হ্যামিল্টনের অফিস হল উইমপোল স্ট্রিটে। ক্যাথেরিন সেখানে গেল। অ্যালানের সাথে দেখা করার জন্য সে উদগ্রীব। মনটা একেবারেই ভালো নেই। কী বলবে তা বুঝতে পারছে না। একজন অপরিচিত মানুষের কাছে কতটা সাহায্য চাওয়া যেতে পারে? ক্যাথেরিন ভাবল, কিন্তু উনি তো পেশাদার ডাক্তার। উনি নিশ্চয়ই আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
কাচের দরজার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রিসেপশনিস্ট বলল–ডাঃ হ্যামিল্টন আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন মিস আলেকজান্ডার।
আমি কি তৈরি? ক্যাথেরিন ভাবল, তার মনে হঠাৎ আতঙ্ক দেখা দিল। আমি এখানে কেন এসেছি? আমি কয়েকজন অশিক্ষিত মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করব? ওরা আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবে কি?
ক্যাথেরিন হঠাৎ বলে বসল না, মিস, আমি আমার মন পরিবর্তন করেছি। কোনো ডাক্তারের সাহায্য আমার প্রয়োজন নেই। যদি অ্যাপয়ন্টমেন্টটা ক্যানসেল করেন তাহলে ভালো হয়।
–ঠিক আছে। একটুখানি সময় দিন।
কিন্তু… রিসেপশনিস্ট ডাক্তারের অফিসের ভেতর চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। দরজা খুলে গেল। অ্যালান হ্যামিল্টন নিজেই বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। বছর চল্লিশেক বয়স, লম্বা, এবং সোনালি চুল। চোখের তারা নীল। আন্তরিকতার চিহ্ন আছে আচরণে। তিনি ক্যাথেরিনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
কী ব্যাপার? আমাকে কি আপনার পছন্দ হচ্ছে না?
ক্যাথেরিন আমতা আমতা করতে থাকে কেন?
আমি কিন্তু সত্যিই ভালো ডাক্তার। আপনি আমার রিসেপশন অফিসে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সুস্থ বলে মনে করছেন। এটাকে নোট করে রাখতে হবে।
ক্যাথেরিন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলে ওঠে–আমি দুঃখিত, আমার কোথাও ভুল হয়েছে। কারোর সাহায্য আমার দরকার নেই।
আপনার কথা শুনে খুবই ভালো লাগছে, অ্যালান হ্যামিল্টন বললেন, আহা, আমার সব পেশেন্টরা যদি আপনারা মতো চিন্তা করতে পারতেন! এত কষ্ট করে আপনি এলেন, আর একটু সময় থাকতে আপনার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। ততক্ষণ ভেতরে আসবেন কি? আসুন, আমরা পাশাপাশি বসে এক কাপ কফি খাই।
-না, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি ভেতরে যেতে পারব না।
–ঠিক আছে, আমি আপনার বেশি সময় নেব না।
ক্যাথেরিন ইতস্তত করল- ঠিক আছে, এক মিনিটের জন্য আমি যেতে পারি।
ক্যাথেরিন ডাক্তারকে অনুসরণ করল। শান্ত শুভ্র পরিবেশ, সুন্দরভাবে সাজানো, মনে হচ্ছে এটা বোধহয় একটা লিভিংরুম। দেওয়ালে প্রিন্ট ঝুলছে, কফি টেবিল, এক সুন্দরী মহিলার ছবি, পাশে এক তরুণ। ঠিক আছে এত সুন্দর অফিসে এলে মনটা তো ভালো হবেই। কিন্তু এতে কী প্রমাণিত হচ্ছে?
ডাক্তার হ্যামিল্টন বললেন–একটুখানি বসুন। এক মিনিটের মধ্যে কফি তৈরি হবে।
–ডাক্তার, আপনার সময় নষ্ট করছি বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।
–এজন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
ডাক্তার ইজিচেয়ারে বসলেন। ক্যাথেরিনের মুখের দিকে তাকালেন। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, তিনি ক্যাথেরিনকে পরীক্ষা করছেন।
–আপনার তো অনেক সমস্যা? সহানুভূতির সুরে তিনি বললেন।
–আপনি কী করে জানলেন? ক্যাথেরিন অবাক হয়ে গেছে। তার কণ্ঠস্বরে রাগী ভাব ফুটে উঠেছে।
–আমি ইভলিনের সঙ্গে কথা বলেছি। সেন্ট মরিতজ-এ যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত।
-সত্যি? আপনি তো এত ভালো ডাক্তার, আপনি কি কির্ককে আবার জীবন দিতে পারেন?
বলতে বলতেই চারপাশটা রহস্যাবৃত হয়ে গেল। ঝড় উঠেছে। ক্যাথেরিন ভাবতেই পারছে না, নিজেকে সে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। শেষপর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে সে শুধু বলল আমাকে একা থাকতে দিন ডাক্তার। আপনার দুটি পায়ে পড়ি। এখানে আমাকে আর আটকে রাখবেন না।
অ্যালান হামিল্টন অবাক চোখে তার এই নতুন পেশেন্টকে দেখলেন। কোনো কথা বললেন না।
ক্যাথেরিনের ফুঁপিয়ে কান্না শেষ হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত সে বলতে থাকে ডাক্তার, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। এখন কি আমি যেতে পারি?
ক্যাথেরিন উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
মিস আলেকজান্ডার, আমি জানি না, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব। আমি চেষ্টা করতে পারি। আমার আচরণের দ্বারা আপনি কোনোভাবেই আহত হবেন না, একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
ক্যাথেরিন দরজার দিকে যেতে যেতে আবার ফিরে আসার চেষ্টা করল। তার চোখ জলে ভরে গেছে।
–কেন যে কান্না আসছে, মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে গেছি, আর কখনও জীবনে ফিরে আসতে পারব না।
অতি কষ্টে ক্যাথেরিন কয়েকটি শব্দ উচ্চরণ করে। অ্যালান হ্যামিল্টন উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ক্যাথেরিনের দিকে হেঁটে গেলেন।
-তাহলে? আপনি কেন আমাকে বন্ধু বলে ভাবছেন না? একটুখানি বসবেন কি? আসুন না, আমরা দুজনে মুখোমুখি বসে কোনো কথা নিয়ে আলোচনা করি। দেখা যাক কফির কত দূর?
পাঁচ মিনিটের জন্য ডাক্তার বাইরে চলে গেলেন। ক্যাথেরিন একা বসেছিল। সে জানে না, কোথা থেকে গল্পটা শুরু হবে। আহা, ওই ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে দারুণ আকর্ষণ আছে। মনে হচ্ছে ওঁর ওপর নির্ভর করা যায়।
হয়তো উনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন, ক্যাথেরিন শেষ পর্যন্ত ভাবল।
অ্যালান হ্যামিল্টন দুকাপ কফি নিয়ে অফিসে ঢুকে পড়েছেন। একটু নীচু হয়ে তিনি বললেন মিস, ক্রিম আর সুগারের ব্যবস্থা আছে। আপনার লাগবে কী?
-না-না, অশেষ ধন্যবাদ। আপনি নিজে এত কষ্ট করছেন কেন?
–এভাবে বলবেন না, আপনি আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছেন, এটা তো আমার কর্তব্য।
ডাক্তার পাশের কৌচে বসে পড়লেন।
–আমি জানি, স্কি খেলতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তাতেই আপনার বন্ধু মারা গেছে, তাই তো?
ব্যাপারটা এত দুঃখজনক এ নিয়ে ক্যাথেরিন কোনো কথা বলতে চাইছে না। শেষপর্যন্ত সে বলল–আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। আমার বন্ধু একটা স্লোপের ওপর উঠেছিল, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। জায়গাটা বিপদজ্জনক। বিপদচিহ্ন ছিল, মনে হচ্ছে উন্মত্ত বাতাস সেই চিহ্নটাকে সরিয়ে দিয়েছে।
–এই প্রথম আপনার কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হল। তাই কি?
এই প্রশ্নের উত্তর কি আমার জানা আছে, কী উত্তর আমি দেব? আমি কি চিৎকার করে বলব, ডাক্তার, আমার স্বামী এবং তার রক্ষিতা আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। রাষ্ট্র তাদের অপরাধের শাস্তি দিয়েছে। সেটাও তো মৃত্যুর একটা ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা কি আমার মনে শোকবহ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে?
আমি কিছুই জানি না। আমি কিছু জানি না। ক্যাথেরিন ভাবল। কিন্তু তাকে তো মুখ খুলতেই হবে। আমার চারপাশে যারা থাকে, তারা সকলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ডাক্তারকে সব কথা খুলে বলা দরকার। বলেই বা কী হবে? একই গল্প, একই সমবেদনা, আমি জানি, আমার এই অসুখের উপশম কোথাও হবে না।
অ্যালান হ্যামিল্টন বুঝতে পারলেন, যে-কোনো কারণেই হোক রোগিনীর মুখের ভাব থমথম করছে। তিনি বিষয়টা পরিবর্তন করলেন।
উইম কেমন আছে? তিনি জানতে চাইলেন।
এই প্রশ্ন ক্যাথেরিনকে একেবারে অবাক করে দিল।
–উইম? হ্যাঁ, উনি ভালোই আছেন। ইভলিন বলেছে, আপনি নাকি ওঁনার চিকিৎসা করেন।
–হ্যাঁ।
–কেন? উনি কি কোনো খারাপ আচরণ করেন?
উইম আমার কাছে এসেছে। কারণ সে একটির পর একটি চাকরি থেকে বরখাস্ত হচ্ছিল। তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। পৃথিবী সম্পর্কে সে অত্যন্ত নিরা। আমি জানি না, এর অন্তরালে কী কারণ লুকিয়ে আছে। উনি সমস্ত মানুষকে ঘেন্না করেন, অন্য লোকের সাথে কথা বলতে ভয় পান।
ইভলিনের কথা মনে পড়ে গেল ক্যাথেরিনের–উইমের কোনো আবেগ নেই। কোনো কিছুর দ্বারা সে কখনও তাড়িত হয় না। এটাই তার সবথেকে বড়ো অসুখ।
–কিন্তু অঙ্কে উইমের মাথাটা খুবই পরিষ্কার। অ্যালান হ্যামিল্টন বলতে থাকেন, এখন উনি যেখান চাকরি করছেন, সেখানে প্রতি মুহূর্তে এই প্রতিভাটাকে কাজে লাগাতে পারেন।
ক্যাথেরিন মাথা নাড়লা, এত বড়ো প্রতিভাশালী মানুষ আমি কোথাও দেখিনি।
অ্যালান হ্যামিল্টন সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন মিস আলেকজান্ডার, আপনাকে অনেক ব্যথা সহ্য করতে হয়েছে। আমি জানি না, কীভাবে আপনি এই ব্যথার উপশম ঘটাবেন। আমি চেষ্টা করতে পারি।
ক্যাথেরিন উদাসভাবে বলল–সবকিছুই বিবর্ণ বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। কির্ক বেঁচে নেই, অথচ আমি বেঁচে আছি! এই ব্যাপারটা আমাকে আঘাত করছে।
শান্ত থাকবার চেষ্টা করুন। অ্যালান হ্যামিল্টন বলতে থাকেন, পৃথিবীতে অনেক কিছু ভাবরার আছে। হাসির টুকরো তার মুখে, আপনি আরও বেশি কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন। আবার এখানে আসবেন তো? যদি মনে হয়, আপনি আমাকে ঘৃণা করছেন, তাহলেও আসবেন কিন্তু।
–আমি আপনাকে ঘৃণা করছি না, ক্যাথেরিন ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, হতে পারে, নিজের মনের ওপর এখন আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
অ্যালান হ্যামিল্টন ডেস্কের কাছাকাছি চলে গেলেন। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেন। দেখলেন, প্রত্যেকটা তারিখের ওপর লাল চিহ্ন, অর্থাৎ রোজই তাঁকে অনেক রোগীর সামনে দাঁড়াতে হবে।
আসছে সোমবার? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। একটার সময়?
একটার সময় তিনি লাঞ্চ খেতে যান। কিন্তু সেদিন লাঞ্চ খাওয়াটা ত্যাগ করবেন। ক্যাথরিন আলেকজান্ডার হলেন এমন এক ভদ্ৰমিহলা, ডাক্তার ভাবলেন, যাঁকে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে।
ক্যাথেরিন অনেকক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল ডাক্তারের মুখের দিকে। এই মানুষটিকে সে কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারছে না কেন? তারপর বলল–ঠিক আছে।
-তাহলে? তখন আবার দেখা হবে।
ডাক্তার ক্যাথেরিনের হাতে একটি কার্ড তুলে দিলেন। এর মধ্যে যদি আমার সাহচর্যের প্রয়োজন হয়, অফিসের ফোন নাম্বার দেওয়া আছে, বাড়ির নম্বরও আছে, আমি খুব একটা ঘুমোতে পছন্দ করি না। যখনই প্রয়োজন হবে আমাকে ফোন করতে ভুলবেন না কিন্তু।
ধন্যবাদ। এখানে সোমবার আসছি, তাই তো?
ডক্টর হ্যামিল্টন তাকিয়ে থাকলেন, ক্যাথেরিন হেঁটে চলে যাচ্ছে। মেয়েটির মধ্যে একটা আশ্চর্য আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। আছে শান্ত স্নিগ্ধ লাবণ্যের ছটা। আমাকে আরও সতর্ক হতে হবে। কফি টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফটোগ্রাফটির ওপর তাকালেন তিনি। ভাবলেন তিনি, অ্যাঞ্জেলা এখন কোথায় আছে?
.
মাঝরাতে টেলিফোনটা ঝন্ ঝনাৎ শব্দে আর্তনাদ করতে থাকে।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস শুনতে থাকেন, অবশেষে যখন তিনি কথা বললেন, অবাক হয়ে গেছেন তিনি খেলে ডুবে গেছে? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
সংবাদটা শোকাবহ, কিন্তু সত্যি মিঃ ডেমিরিস। কোস্টগার্ডরা ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছে।
–কেউ কি বেঁচে আছে?
–না, স্যার। সকলেই মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে।
–সত্যি, ঘটনাটা আমাকে আঘাত করেছে। কেউ কি এই দুর্ঘটনার বিষয়ে কিছু জানে? |||||
||||| –না, কেউ হয়তো জানাতেও পারবে না। সব চিহ্ন তো সমুদ্রের তলায় চলে গেছে।
হায়, সমুদ্র, সমুদ্র আবার ভয়ানক আচরণ করল! ডেমিরিস ফিসফিস করে বলতে থাকেন।
–আমরা কি বীমা কোম্পানির কাছে আবেদন করব?
যখন মানুষগুলোই চলে গেছে, সামান্য কটা টাকা নিয়ে আর কী হবে? হ্যাঁ, একটা আবেদন তো করতেই হবে।
ডেমিরিস হাসলেন। দুর্মূল্য ওই ফুলদানিটা তিনি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় রেখে দেবেন।
এবার সময় এসেছে, শালাবাবুর সঙ্গে বোঝাপড়াটা খেলতে হবে।
পরিতৃপ্ত ডেমিরিস মনে মনে পশথ নিলেন। কঠিন উচ্চারণে ভরা সেই শপথ।
.
১৮.
স্পাইরস লামব্রো অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছেন। যে-কোনো মুহূর্তে কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটা ভেসে আসবে। রেডিয়ো বাজছে। কাগজের সর্বশেষ সংস্করণগুলোর ওপর চোখ বোলাচ্ছেন। এখন আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ইতিমধ্যে তো ঘটনাটা ঘটা উচিত ছিল। কোথাও কোনো সমস্যা হল নাকি? টনি রিজোলির কাছ থেকে খবর পাওয়া গেছে। থেলে থেকে টনি জানিয়েছিলেন, জাহাজ এবার সমুদ্র অভিমুখে। যাত্রা শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে লামব্রো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমকে ফোন করেছিলেন। কোনো নাম বলেননি। বলেছিলেন, থেলে জাহাজের মধ্যে নিষিদ্ধ হেরোইন চলেছে।
তাহলে? এতদিনে তো ধরা পড়ার কথা। খবরের কাগজের প্রতিনিধিরা কি বোকা, নির্বোধ নাকি? মুখরোচক খবরটা সংগ্রহ করতে পারেনি?
ইন্টারকম বেজে উঠল- মিঃ ডেমিরিস আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।
–কেউ বোধহয় ডেমিরিসের হয়ে কথা বলছেন, তাই বলো।
না, স্যার। মিঃ ডেমিরিস নিজেই কথা বলতে চাইছেন।
কথাগুলো শুনে লামব্রো অবাক হয়ে গেলেন। মনে হল, শীতালী বাতাস তাকে আক্রমণ করেছে। এটা হতেই পারে না! অত্যন্ত শঙ্কিত হাতে তিনি রিসিভার তুলে বললেন কোস্টা?
–স্পাইরস? ডেমিরিসের কণ্ঠস্বর আনন্দ উপছে উঠছে। কেমন আছো তুমি? ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?
–ভালোই-ভালোই। তুমি কেমন আছো? আছো কোথায়?
–আমি এথেন্সে আছি।
–ও! লামব্রো ঢোক গিললেন। একটু বাদে আমরা কথা বলব, কেমন?
–আজ আমি খুব ব্যস্ত থাকব। আজকে একসঙ্গে লাঞ্চ খাবে কী? তুমি কি ফ্রি আছো? লামব্রোর একটা গুরুত্বপূর্ণ দরকার ছিল। তবুও তিনি বললেন–ঠিক আছে, লাঞ্চে দেখা হচ্ছে।
-ঠিক আছে। দুপুর দুটোর সময় ক্লাবে দেখা করো, কেমন?
লামব্রো রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপছে। কী হল? নিশ্চয়ই কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। কী হয়েছে, উনি সেটা লাঞ্চেই বুঝতে পারবেন।
.
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস স্পাইরসের জন্য তিরিশ মিনিট অপেক্ষা করেছেন। শেষ পর্যন্ত স্পাইরস এসে বললেন–দেরি হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
-না-না, তুমি কত ব্যস্ত মানুষ! তোমার তো দেরি হতেই পারে।
স্পাইরস ডেমিরিসকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা কি তার মুখে ছাপ ফেলেছে? না, ভালোভাবে দেখে তার মনে হল, গত কয়েকদিন ডেমিরিসের জীবনে এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, যার জন্য সে চিন্তিত। তাহলে? সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তাই নয় কি?
–আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে, ডেমিরিস আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে। তুমি কী খাবে? দেখা যাক, আজকের মেনুটা কী?
মেনুকার্ডের দিকে তাকিয়ে থাকেন ডেমিরিস।
–আহা, আজ স্ট্রিডিয়া পাওয়া যাচ্ছে! তুমি ওয়েস্টার খাবে কি স্পাইরস?
না, আমার এখন খুব একটা খিদে নেই।
স্পাইরস বোধহয় তার খাবার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছেন।
ডেমিরিসকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা অজানা কারণে তিনি খুবই উৎফুল্ল। কিন্তু কেন? লামব্রোর অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। কী করবেন? কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।
অর্ডার দেওয়া হল। ডেমিরিস বললেন–স্পাইরস, তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
স্পাইরস জানতে চাইলেন–কী জন্য?
–তুমি একটা ভালো খদ্দের পাঠিয়েছিলে–রিজোলি।
লামব্রোর ঠোঁট দুটো শুকিয়ে গেছে রিজোলির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?
-হ্যাঁ, চমৎকার মানুষ! উনি একটা বড়ো ব্যবসার কথা বলেছেন। আমাদের ভাগ্য একেবারে ফেঁপে ফুলে যাবে। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, রিজোলি বোধহয় আর বেঁচে নেই।
স্পাইরস চমকে উঠলেন কেন? কী হয়েছে তার?
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ ও বোধহয় মরে গেছে।
–কেন? কী করে দুর্ঘটনা ঘটল?
-হ্যাঁ, দুর্ঘটনাই বলতে পারো, স্পাইরস। ডেমিরিস তাকিয়ে থাকলেন তাঁর শালাবাবুর চোখের দিকে। আসলে বিশ্বাসঘাতককে এভাবেই শাস্তি দেওয়া উচিত।
–আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না!
সত্যি বুঝতে পারছ না? তুমি আমাকে শেষ করতে চেয়েছিলে। তোমার এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমি তোমাকে খোলাখুলি বলে রাখছি, আবার চেষ্টা করে দেখো। দেখো নতুন কোনো পন্থা উদ্ভাবন করতে পারো কিনা। তবে তোমার এই কাজে তুমি কখনোই সফল হবে না।
-সত্যি, তুমি কী বলছ, আমি বিন্দুবিসর্গ কিছু বুঝতে পারছি না।
–স্পাইরস, নিজেকে খুব চালাক বলে মনে করো, তাই তো? তোমার অবস্থা খুবই খারাপ। তবে আগে তোমার বোনের ব্যাপারটা আমি দেখব। তারপর তোমার পালা।
খাবার এসে গেছে। ডেমিরিস বললেন–এসো, ভবিষ্যতে কী হবে, তা ভেবে আজকের সুন্দর লাঞ্চটা মাটি করো না যেন।
কিছুক্ষণ বাদে কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস এই লাঞ্চের সাফল্যের বিষয়ে ভাবতে থাকলেন। আহা, একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়া হয়েছে। স্পাইরস লামব্রোকে দেখে মনে হল, তিনি বুঝি এক ফেলে দেওয়া মানুষ। ডেমিরিস জানেন, স্পাইরস তার বোনকে কতখানি ভালোবাসেন। ডেমিরিস দুজনকেই শান্তি দেবেন। কঠিন শাস্তি, হয়তো বা মৃত্যুদণ্ড!
–কিন্তু কিছু কাজ বাকি থেকে গেছে। একটা মস্ত বড়ো কাজ। ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার। কির্ক রেনল্ডসের মৃত্যুর পর মেয়েটির অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। এক হিস্টিরিয়া রোগিনীতে পরিণত হয়েছে সে।
ক্যাথেরিনের সাথে দেখা হলে কী কী বলা যায়, ডেমিরিস তার মহড়া দিতে থাকলেন।
–ব্যাপারটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমি ভাবতে পারছি না।
–এই ঘটনাটার জন্য আমি দুঃখিত, ক্যাথেরিন। আমি জানি, তুমি কির্ককে কতখানি ভালোবাসতে। কিকের মৃত্যু আমাদের দুজনের কাছেই একটা খারাপ খবর।
না, পরিকল্পনা পাল্টাতে হবে, ডেমিরিস ভাবলেন। রাফিনাতে যাবার মতো সময় এখন হাতে নেই। ক্যাথেরিনের সাথে শেষ বোঝাপড়াটা তাড়াতাড়ি করতে হবে। কারণ ক্যাথেরিনের হাতে সেই গুপ্ত খবরটা আছে–নোয়েলে পেজ এবং ল্যারি ডগলাস সংক্রান্ত ব্যাপারে। তাকে আর বেশি দিন এই পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিন ডেমিরিস নিশিন্ত হয়ে বাঁচতে পারবেন না। কীভাবে এই মৃত্যুটা হবে? কোনো একটা পন্থা তো বের করতেই হবে। ক্যাথেরিনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই ডেমিরিসের পথ একেবারে পরিষ্কার। অপরাধের কোনো চিহ্ন থাকবে না।
ডেমিরিস ডেস্ক থেকে টেলিফোনটা তুলে নিলেন। একটি নাম্বার ডায়াল করলেন। একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
ডেমিরিস বললেন–সসামবার আমি কাউলুনে পৌঁছোব, সেখানে থেকো কিন্তু।
রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। উত্তরে কী শোনা গেল, তা জানতে তিনি মোটেই আগ্রহী নন।
.
প্রাচীর ঘেরা এই শহরে ডেমিরিসের একটা ফাঁকা বাড়ি আছে। দুজনের মধ্যে সেখানেই দেখা হল।
–এটা কিন্তু একটা অ্যাকসিডেন্ট হবে। সেইভাবে সব ব্যবস্থা করতে পারবে তো?
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস জিজ্ঞাসা করলেন।
এটা পরিষ্কার একটা অপমান। সমস্ত শরীর রাগে কেঁপে উঠেছে। কথাটা হল, তুমি কি রাস্তা থেকে কাউকে তুলে এনেছ? সে ভেবেছিল, চিৎকার করে অনেক কিছু বলবে, কী ধরনের অ্যাকসিডেন্ট আপনি পছন্দ করবেন? ঘরের মধ্যে? আমি অনেক কিছু করতে পারি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে হঠাৎ পড়ে যেতে পারে। ঘুষি মেরে তার নাকটা আমি ফাটিয়ে দিতে পারি। ঘটনাটা মারসেইলসে ঘটবে কী? হয়তো এমন হল, মদ খেতে খেতে সে বেসামাল হয়ে গেল। বাথটবের মধ্যে ডুবে মরুল। হেরোইন বেশি মাত্রায় খেল। তিনটে পন্থা আছে- ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেল চিরনিদ্রার জগতে, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। সুইডিস ডিটেকটিভরা ভাববে, সবটাই বুঝি একটা অ্যাকসিডেন্ট। অথবা, যদি আপনি মনে করেন, বাইরে কাজটা করতে হবে, আমি একটা ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্টের ব্যবস্থা করতে পারি, প্লেন ক্রাশ। কিংবা সমুদ্রে জাহাজের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
কথাগুলো শেষ পর্যন্ত সে আর উচ্চারণ করেনি। সে জানে, উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি কত শক্তিশালী। এই মানুষটি সম্পর্কে সে হাড় হিমকরা অনেক গল্প শুনেছে। গল্পগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে গদগদ হয়ে বলল–ইয়েস স্যার। আমি একটা সুন্দর দুর্ঘটনার ব্যবস্থা করতে পারি। কেউ তা বুঝতেই পারবে না। কথাগুলো তার পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু ওই লোকটাকে বোকা বানানো কী সহজ। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। জানালার ধারে চলে গেল। রাস্তা থেকে শব্দ ভেসে আসছে। নানা ভাষার কচকচানি। তারা এই প্রাচীর ঢাকা শহরের বাসিন্দা।
ডেমিরিস তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। শান্ত অভিব্যক্তিহীন শীতল সেই চাউনি।
শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন–পন্থাটা তুমিই নির্ধারণ করো। তোমার ওপর আমার অগাধ আস্থা।
–ইয়েস স্যার। কাউলুনে তাকে পাব কী?
–না, লন্ডনে। তার নাম ক্যাথেরিন, ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার। সে আমার লন্ডন অফিসে কাজ করে।
তার সঙ্গে দেখা হবে কী করে?
ডেমিরিস এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন- আগামী সপ্তাহে লন্ডনে একদল প্রতিনিধি যাবে। আমি তোমাকে সেই দলে ঢুকিয়ে দেব। একটা কথা
ইয়েস স্যার।
–আমি চাই না, কেউ তার দেহটাকে সনাক্ত করুক।
.
১৯.
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ডাক শুভ সকাল ক্যাথেরিন, আজ কেমন আছো?
অনেক ধন্যবাদ কোস্টা, আজ কেন জানি না মনটা আমার ভালোই লাগছে।
–ভালো আছো তো?
–হ্যাঁ।
–ঠিক আছে। তোমার মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে আমি যে কী আনন্দ পাচ্ছি, কাকে বোঝাব।আমাদের কোম্পানির একদল প্রতিনিধি লন্ডনে আসছে। আমাদের কী ধরনের কাজকর্ম হচ্ছে তা খুঁটিয়ে দেখবে। তুমি ওদের দায়িত্ব নিও কিন্তু। দেখো, যেন কোথাও অসুবিধা না হয়।
–আপনার এই কাজ করতে পেরে আমি তো খুশিই হব। কখন ওরা এখানে আসবে?
কাল সকালে।
–আমি সব কিছু নিজের হাতে করব। আপনি কিছু ভাববেন না।
–তোমার ওপর আমার অগাধ আস্থা ক্যাথেরিন। তুমি আছো বলেই তো আমি শান্তভাবে আমার কাজকর্ম সামলাচ্ছি।
–অত বলতে হবে না।
গুডবাই ক্যাথেরিন।
এইভাবে কথাটা থেমে গেল।
.
কাজ শুরু হয়ে গেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস চেয়ারে বসলেন। গভীরভাবে চিন্তা করলেন, ক্যাথেরিন আলেকজান্ডারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার পর আর কে কে বাকি থাকবে? না, এবার তিনি তার দুর্বিনীতা স্ত্রী ও তার উদ্ধত ভাইয়ের দিকে পুরো দৃষ্টি দিতে পারবেন।
অফিস থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি আসছে। তোমাকে সেখানে থাকতে হবে। ওদের সাহচর্য দিতে হবে। আশা করি বুঝতে পারছ।
মেলিনা অবাক হয়ে গেছেন। কী আশ্চর্য এমন একটা প্রস্তাব? সম্পর্কটা অন্য দিকে যাচ্ছে নাকি?
.
রাতের ডিনার শুরু হয়ে গেছে। তিনজন এসেছেন, তারা খেয়েছেন, চলে গেছেন। মেলিনা ভাবতে থাকেন, এত নিস্পৃহ ডিনার এর আগে কোথাও হয়েছে কী?
মেলিনাকে ওঁদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। তাঁর সম্পর্কে কিছু প্রশংসার বাক্য ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। মেলিনা ভুলেই গিয়েছিলেন শেষ কবে কোস্টা তার ব্যাপারে এত কথা বলেছেন। কোস্টা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছিলেন। প্রশংসার বাণী। ওঁরা অবাক হয়ে শুনছিলেন। মনে হচ্ছিল, ওঁরা বোধয় এক মহান মানুষের সংস্পর্শে এসে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। মেলিনা কথা বলার বিশেষ সুযোগ পাননি। যখনই তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কোস্টা বাধা দিচ্ছিলেন। শেষ অব্দি মেলিনা চুপটি করে বসে থাকতে বাধ্য হন।
তাহলে আমাকে এখানে আনা হল কেন? মেলিনা অবাক হয়েছেন।
সন্ধ্যা শেষ হয়ে আসছে। এবার ওঁরা তিনজন চলে যাবেন।
ডেমিরিস বললেন–কাল সকালে আপনারা লন্ডনের দিকে উড়ে যাবেন। আমার মনে হয় সেখানে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
তারা তিনজন চলে গেলেন।
.
পরের দিন সকালবেলা প্রতিনিধি দল লন্ডনে নামলেন, সংখ্যায় তারা ছিলেন তিনজন। তিনটি বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে এসেছেন।
একজন মার্কিন বাসিন্দা জেরি হ্যালি। লম্বা মোটাসোটা ভদ্রলোক। মুখের ওপর বন্ধুত্বের ছাপ। মুখখানা গোলগাল চোখের তারার রং ধূসর। এত লম্বা হাত ক্যাথেরিন কখনও দেখেনি। ক্যাথেরিন এঁদের দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এঁরা সকলেই নিজের মতো করে জীবন কাটাতে ভালোবাসেন। সবসময় কাজ করেন। জীবনটা ঘাত-প্রতিঘাতে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। নতুন কিছু করার নেশা এঁদের পেয়ে বসেছে।
দ্বিতীয়জন ফরাসি দেশের বাসিন্দা, ইভেস রেনার্ড। বেঁটেখাটো এবং সবল দেহের অধিকারী। চেহারার মধ্যে একটা আলাদা অভিব্যক্তি আছে। ঠান্ডা চোখের তারা। মনে হয়, উনি যেন অন্তর্ভেদী চাউনিতে সবকিছু দেখতে পান। তাকে দেখে ক্যাথেরিনের মনটা কেমন বিষিয়ে উঠেছিল। ভদ্রলোক আত্মকেন্দ্রিক, নিজের মধ্যেই থাকতে ভালোবাসেন। এঁকে কেন পাঠানো হয়েছে। ক্যাথেরিনের মনে ঘৃণার উদ্রেক হল। যাক, আমার ওপর যে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমি তা পালন করবই।
এই দলের তৃতীয় সদস্য হলেন ডিনো মাত্তুসি। ইতালি থেকে এসেছেন। বন্ধুত্বের আচরণ আছে তার শরীরের সবখানে। মনে হয়, সব ব্যাপারেই তিনি অতিমাত্রায় উৎসাহী।
মাত্তুসি বললেন–মিঃ ডেমিরিস আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। আপনাকে উনি খুবই ভালোবাসেন।
-না-না, এসব বানানো কথা।
–আপনি লন্ডন শহরে আমাদের সাহায্য করবেন, তাই তো? আপনার জন্য আমি একটা ছোট্ট উপহার এনেছি।
উনি ক্যাথেরিনের হাতে একটা ছোট্ট বাক্স তুলে দিলেন। আহা, এর ভেতর সিল্কের স্কার্ফ রয়েছে।
ক্যাথেরিন এতটা আশা করেনি। অবাক হয়ে সে বলল–ধন্যবাদ, ভারি সুন্দর এই স্মারকটি! এবার অফিসের দিকে যাত্রা শুরু করা যাক।
কী একটা শব্দ শোনা গেল। তারা সকলে পেছন ফিরে তাকালেন। অল্প বয়সী একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ধরা সুটকেস তিনটে চতুর্দিকে ছিটকে পড়েছে। সে সেগুলো তোলার চেষ্টা করছে। ছেলেটিকে দেখে বছর পনেরোর বলে মনে হচ্ছে। বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতি, বাদামি চুল, সবুজ চোখ। দেখলে মনে হয় সে অপুষ্টির শিকার।
–ঈশ্বরের দোহাই, রেনার্ড বললেন, এইসব জিনিসগুলোর ব্যাপারে আমাদের আরও তৎপর হওয়া উচিত।
ছেলেটি বলল–আমি দুঃখিত। আমায় ক্ষমা করবেন। সুটকেসগুলো কোথায় রাখব?
রেনার্ড অধৈর্যভাবে বলে উঠলেন–যেখানে খুশি রাখতে পারো। পরে সেগুলো আমরা নিয়ে নেব।
ক্যাথেরিন ওই ছেলেটির দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়ে ছিল।
ইভলিন বলেছিলেন- এথেন্সে ছেলেটি অফিস বয়ের চাকরি করত। না, ওকে আর রাখা যাবে না। আমরা আর একটা ভালো অফিস বয়ের সন্ধান করব।
ক্যাথেরিন জানতে চাইল–তোমার নাম কী?
–আটানস, ম্যাডাম। তার চোখে জল এসে গেছে।
-ঠিক আছে আটানস, তুমি সুটকেসগুলো একটা ফাঁকা ঘরে রেখে যাও। দেখো, যেন সেগুলো ঠিক মতো থাকে।
ছেলেটি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল–ম্যাডাম, অনেক ধন্যবাদ।
ক্যাথেরিন পেছন ফিরে তাকালেন। বললেন, আপনারা আমাদের কাজকর্ম দেখবেন, তাই তো? মিঃ ডেমিরিস তাই বলেছেন। আমি সব ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য করব। যদি কোনো তথ্যের দরকার হয়, একটু আগে বলবেন। সব তথ্য আপনাদের হাতে তুলে দেব। এখন আসুন, আমি উইম এবং আমাদের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আপনাদের পরিচয় করাচ্ছি।
তারা করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেন। ক্যাথেরিন উইমের অফিসে গিয়ে পৌঁছোলেন।
উইম তাদের দিকে তাকালেন গ্রিসের জনসংখ্যা কত জানেন? ৭০ লক্ষ ৬ হাজার।
লোকগুলো অবাক হয়ে গেছেন। পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন তাঁরা।
ক্যাথেরিন হেসে উঠলেন। সত্যি তো, উইমের কথা বলার ধরনটাই এই রকমের।
ক্যাথেরিন বলল–আপনাদের অফিস তৈরি হয়েছে, আপনারা কি এখনই অফিসে যাবেন?
আবার তারা করিডরে এলেন। জেরি হ্যালিজিজ্ঞাসা করলেন–ওর মাথায় কি ছিট আছে? আমি বুঝতে পারছি না।
ক্যাথেরিন বলল–উইম সব ব্যাপারে খবর রাখতে ভালোবাসেন। কিন্তু অঙ্কে তার মাথাটা খুবই পরিষ্কার। তাই চাকরিটা এখনও বেঁচে আছে।
কী আশ্চর্য, কথা বলার ধরন দেখে আমার হাসি পাচ্ছে!
হ্যালিমন্তব্য করলেন।
–পরে দেখা হলে উচিত শিক্ষা দেব।
ফরাসি ভদ্রলোক বললেন–আর দেখা হবে কী?
–আপনাদের জন্য একটা ভালো হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনারা কি একই হোটেলে থাকবেন, নাকি বিভিন্ন হোটেলে?
মাত্তুসি বললেন–আমরা বিভিন্ন হোটেলে থাকতে চাইব।
ক্যাথেরিন কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু এখন কিছু বলা উচিত নয়। যদি আগন্তুকরা বিভিন্ন জায়গায় থাকতে ভালোবাসেন, সে বাধা দেবে কেন?
.
উনি যতটা ভাবতে পারেননি, ক্যাথেরিন সত্যি তার চেয়েও বেশি সুন্দরী। ক্যাথেরিনের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথেরিন সম্পর্কে একটা ছবি এঁকেছিলেন মনের ক্যানভাসে। দেখার পর ব্যাপারটা আরও উৎসাহব্যঞ্জক বলেই মনে হচ্ছে। যন্ত্রণার ছাপ আছে মুখের সর্বত্র। আমি ক্যাথেরিনের চোখের ভাষা পড়তে শিখেছি। আমি বোঝাব, যন্ত্রণা কত ভয়ংকর হতে। পারে। আনন্দের যন্ত্রণা, বিচ্ছেদের বেদনা।
তারপর? নাটকের শেষ অঙ্কে পৌঁছে আমি কী করব? আমি ওকে এমন একটা জগতের বাসিন্দা করে দেব, যেখানে কোনো দুঃখ নেই। তার আগে? তার আগে ওর সঙ্গে কিছু সুখী সম্পৃক্ত প্রহর কাটাতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তকে আরও সুন্দর করে তুলতে হবে।
হ্যাঁ, আমি মনে মনে এই শপথ নিলাম।..
.
ক্যাথেরিন প্রতিনিধি দলের প্রত্যেক সদস্যকে তাদের অফিসগুলো দেখিয়ে দিল। যেখানে তারা থাকবে সেই হোটেলগুলো। এবার ক্যাথেরিন ডেস্কে ফিরে এসেছে। করিডর থেকে ক্যাথেরিন শুনতে পেল ওই ফরাসি ভদ্রলোক ছোটো কিশোর ছেলেটিকে কী যেন বলছে।
–এটা, আমার ব্রিফকেস নয়। বোকা হাঁদা, আমারটা হল বাদামি রঙের। তুমি কি ইংরেজি বুঝতে পারো?
না স্যার, আমি বুঝতে পারি না। ছেলেটির কণ্ঠস্বরে ভয় ফুটে উঠেছে।
ক্যাথেরিন ভাবল, এখনই কিছু করা দরকার।
.
ইভলিন কেই বলে উঠলেন–আমার কোনো সাহায্য লাগবে কি?
ইভলিন, যদি দরকার হয়, আপনাকে আমি ডেকে নেব।
তারপর কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে। আটানস ক্যাথেরিনের অফিসের বাইরে এসে দাঁড়াল। ক্যাথেরিন ডাকল তুমি কি ভেতরে আসবে? ছেলেটির চোখে মুখে ভয়ার্ত প্রতিচ্ছবি।
–আমি কি আসতে পারি? দরজাটা বন্ধ করে দাও।
–হ্যাঁ, ম্যাডাম।
–চেয়ারে বসো আটানস। নামটা আমি ঠিক বলছি তো।
–ঠিক বলছেন ম্যাডাম।
ক্যাথেরিন সহজ হবার চেষ্টা করল।
-বলো কেন ভয় পেয়েছ?
–না-না, ম্যাডাম, আমি, বসতে পারব না।
ক্যাথেরিন তার মুখের দিকে তাকাল। বুঝতে পারল, কোনো একটা ঘটনা কিশোরটিকে অবাক করে দিয়েছে। সমস্যটা কী? জানাবার চেষ্টা করতে হবে।
–আটানস, সত্যি করে বলো তো, কেউ তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে কিনা? তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
–ম্যাডাম, আমি কিছু বলতে চাইছি।…
কিন্তু ছেলেটি কোনো কথা বলছে না কেন? কেউ বোধহয় ওঁর মনটাকে ভেঙে দিয়েছে।
–ঠিক আছে, ভবিষ্যতে দেখা হলে কথা হবে কেমন? ক্যাথেরিন হাসতে হাসতে বলল।
.
প্রতিনিধিদল তাদের কাজ করতে শুরু করছেন। কনস্টনটিন ডেমিরিসের বিভিন্ন ফ্যাক্টরি তারা ঘুরে ঘুরে দেখবেন। বিশাল এই সাম্রাজ্যের কাজ কেমন হচ্ছে, সবকিছু বুঝতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো? ডিনো মাত্তুসি সম্পর্কে ক্যাথেরিন বিশেষভাবে ভাবনাচিন্তা করছে। লোকটার গতিবিধি সন্দেহজনক। ক্যাথেরিনকে তিনি এমন কিছু প্রশ্ন করছেন, যার উত্তর হয় না। দেখা যাচ্ছে, তিনি লন্ডনের ব্যাপারে অতিমাত্রায় উৎসাহী। কোম্পানির ব্যাপারটা নিয়ে তার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তিনি শুধু ক্যাথেরিনের ফেলে আসা জীবনকাহিনী শুনতে চাইছেন।
ডিনো প্রশ্ন করলেন- আপনি কি বিবাহিতা?
–না।
-কিন্তু আপনার তত বিয়ে করা উচিত ছিল।
–হ্যাঁ।
–আপনাদের কি বিচ্ছেদ হয়ে গেছে?
ক্যাথেরিন এই কথোপকথন বন্ধ করার জন্য বলে ফেলে–আমি একজন বিধবা।
ডিনো অবাক হয়ে তাকালেন- আপনার একজন বন্ধু আছে কী? আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, আপনার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু আছে।
–আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না।
ক্যাথেরিন ভেবেছিল শক্তভাবে জবাব দেবে–এটা আপনার কোনো ব্যাপার নয়। na, সেটা সে মুখে বলেনি।
আপনার কি বিয়ে হয়েছে?
–হ্যাঁ, আমার স্ত্রী আছে। চারটে ছোটো বাচ্চা আছে। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে পারছি না। মনটা খুবই খারাপ।
মাঝে মধ্যেই আপনাকে বাইরে যেতে হয়, তাই না?
–ডিনো তাকালেন- হ্যাঁ, আপনি আমাকে আমার ডাক নামে ডাকতে পারেন। ক্যাথেরিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন তিনি। তাঁর গলার স্বর পাল্টে গেছে কোনো কোনো সময় বাইরে গেলে অজানা অচেনা আনন্দের সামনে দাঁড়াই। আশা করি, আপনি আমার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারছেন।
ক্যাথিরিন হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল না।
.
বারোটা বেজে পনেরো। মধ্য দুপুর। ডঃ হ্যামিল্টনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। অবাক হয়ে গেল ক্যাথেরিন, এখনও নামটা মনে আছে! কীভাবে ক্যাথেরিন তার কাছে গিয়েছিল, সবকিছু মনে পড়ে গেল তার। তবে এখন সে অন্য মন নিয়ে চেম্বারের দিকে এগিয়ে চলেছে। রিসেপশনিস্টকে দেখা গেল না। লাঞ্চে গেছে বোধহয়। ডাক্তারের অফিসের দরজা খোলা। অ্যালান হ্যামিল্টন বোধহয় আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
অ্যালান বললেন–ভেতরে আসুন।
ক্যাথেরিন অফিসের মধ্যে ঢুকে গেল। চেয়ারে বসে পড়ল।
–গত সপ্তাহ কেমন কেটেছে? ভালো তো?
ক্যাথোরিন মনে মনে ভাববার চেষ্টা করে। ভালোেমন্দের বিচার সে করতে পারবে কি? এখনও কির্কের ঘটনাটা তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
হ্যাঁ, ঠিকই কেটেছে। নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি।
–এটাই তো করা উচিত।
–আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করব। উত্তর দেবেন? আপনি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের অফিসে কতদিন চাকরি করছেন?
-চার মাস।
কাজ ভালো লাগছে?
–মনটাকে তো শান্ত করতে পারছি। ডেমিরিসের কাছে আমার ঋণের কোনো শেষ নেই। উনি যে আমার জন্য কী করেছেন, আমি তা গুণে শেষ করতে পারব না।
ক্যাথেরিন মিষ্টি করে হাসল।
অ্যালান হ্যামিল্টন মাথা নেড়ে বললেন–আপনি যা বলতে এসেছেন, সবকিছু খুলে বলতে পারেন।
এক মুহূর্তের নীরবতা। শেষ পর্যন্ত ক্যাথেরিন ভেঙে পড়ল আমার স্বামী ডেমিরিসের অফিসে কাজ করত। সে ছিল একজন পাইলট। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল, নৌকোটা ডুবে গিয়েছিল, আমি স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন আমি আবার স্মৃতি ফিরে পেলাম, ডেমিরিস আমাকে চাকরিটা দিয়েছিলেন।
অনেক কথাই বলা হল না, দুঃখ-যন্ত্রণার কথা, আতঙ্কের কথা। এসব কথা আমি কী করে বলব? আমি কী করে বলব, আমার স্বামী আমাকে মারতে চেয়েছিল। কারণ আমি তাকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিলাম না।
অতীতের কথা ভেবে কী লাভ? আমাদের কারো পক্ষেই বোধহয় সেটা সুখদায়ক হয় না।
ক্যাথেরিন কথাগুলো বলবে না ভাবল। বলেও ফেলল।
আপনার নাকি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে?
–হ্যাঁ।
–একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল? নৌকো ডুবে গিয়েছিল?
-হ্যাঁ, ক্যাথেরিনের ঠোঁট শুকনো হয়ে গেছে। যতটা সম্ভব বলার চেষ্টা করেছে সে। এখনও তার মনের ভেতর সংশয় আর দ্বিধা। সে কি সব কথা বলবে? সাহায্য চাইবে? নাকি কিছুই বলবে না। ডাক্তারকে এই অবস্থায় বসিয়ে রেখে চেম্বার থেকে একলা চলে যাবে।
অ্যালান হ্যামিল্টন ভালোভাবে ক্যাথেরিনের দিকে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন–আপনার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে?
ক্যাথেরিনকে বোধহয় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে এনে দাঁড় করানো হয়েছে না, আমার স্বামী বেঁচে নেই।
মিস আলেকজান্ডার, যদি আপনাকে ক্যাথেরিন বলে ডাকি, আপনি কি রাগ করবেন?
–না।
–আমি অ্যালান। ক্যাথেরিন, কীসে আপনি ভয় পাচ্ছেন?
–কেন, আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে যে আমি সব সময় ভয় পাচ্ছি?
–আপনি কি ভীত নন?
না।
দীর্ঘকালের নীরবতা।
ক্যাথেরিন কথা বলতে সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছে। তার ভয় হচ্ছে বোধহয় অতীতের জঘন্য ছবিগুলো আবার সামনে এসে দাঁড়াবে।
শেষ পর্যন্ত সে বলেই ফেলল- আমার চারপাশের লোকেরা কেন মারা যাচ্ছে বলুন তো?
আঘাতটা সরাসরি। ডাক্তারবাবু জবাব দিলেন আর আপনি নিজেকে সেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, তাই তো?
না-না, আমার মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
–এটা মাঝে মধ্যেই ঘটে থাকে, যেসব ঘটনাগুলো ঘটছে, আমরা নিজেদের সেই ঘটনার জন্য দায়বদ্ধ করি। যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ভাবে, তারাই এর জন্য দায়ী। মনে করুন, কেউ একজন অভিশাপ দিল, একজন মারা গেল, ওই লোকটির অবস্থা কী হয় বলুন তো? এসব চিন্তা ভাবনা মন থেকে দূর করুন। যা ঘটবার তা ঘটবেই। আপনি কেন নিমিত্তের দায়ভার নেবেন?
-না-না, ডাক্তার, আমি কিছুতেই আমার অস্থির মনকে শান্ত করতে পারছি না। আপনি যা ভাবছেন ঘটনাগুলো তার থেকেও বেশি ভয়াবহ।
ডাক্তার ক্যাথেরিনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কয়েকটা শব্দ ভেসে এল তার মুখ থেকে ঘটনাগুলো এখন উচ্চারণ করা যাবে কি?
ক্যাথেরিন বলতে থাকে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। জানি না, হত্যা নাকি দুর্ঘটনা তার রক্ষিতাকেও মেরে ফেলা হয়েছে। যে দুজন আইনবিদ তাদের হয়ে লড়াই করেছিলেন তারাও কেউ বেঁচে নেই। এবার বোধহয় কির্কের পালা ছিল। তাকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কথা বলতে বলতে ক্যাথেরিনের গলা বসে গেছে।
–আপনি নিজেকে এই সমস্ত শোকাবহ ঘটনার জন্য দায়বদ্ধ করছেন, তাই তো? তাই আপনার কাঁধের ওপর অনেক বোঝ। আমি কি ঠিক বলছি?
না, এভাবে বলতে পারব না। তবে সবসময় মনটা আমার শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। অন্য কারোর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতে আমি ভয় পাই। আমার মনে হয়, আমার বন্ধুত্ব সেই লোকটির জীবন নাশের কারণ হবে।
ক্যাথেরিন, আপনি কি কারও জীবনের দায়িত্ব নিতে পারেন? এই পৃথিবীতে কেউ পারে না। জন্ম আর মৃত্যুর ওপর আমাদের কারও হাত নেই। আপনি খুব সরল। অনভিজ্ঞা। ভেবে দেখুন তো ঠান্ডা মাথায়, যেসব মৃত্যুর ঘটনা আপনি বললেন, তার সঙ্গে আপনার যোগসূত্রতা কতখানি? এ ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হবে।
আপনি অত্যন্ত সাধারণ। এইসব মৃত্যুর সাথে আপনার কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই।
ক্যাথেরিন ভাবতে থাকে। কথাটা সে বিশ্বাস করবে কী? এই লোকগুলো কেন মারা গেছে? তাদের কাজের জন্য। আমার জন্য নয়! কিন্তু কির্ক? এটা তো একটা দুর্ভাগ্যজনক অ্যাকসিডেন্ট। তাই নয় কি?
.
অ্যালান হ্যামিল্টন তখনও শান্তভাবে তার রোগিনীকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ক্যাথেরিনের মুখ থমথম করছে। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, ক্যাথেরিন চিন্তার জগতে হারিয়ে গেছে। ক্যাথেরিন ভাবছে, ডাক্তার মানুষটি ভারি চমৎকার। আর একটা বোধ তার মনের ভেতর জন্ম নিচ্ছে। আহা, এর সাথে আগে দেখা হল না কেন? অ্যালানের বউয়ের ছবি, ছেলেমেয়েরা–কফি টেবিলের ওপর বসানো আছে।
ধন্যবাদ, ক্যাথেরিন বলল, ব্যাপারটা আমাকে বিশ্বাস করতেই হরে। আজ অথবা আগামীকাল, তা না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।
অ্যালান হ্যামিল্টন হেসে উঠলেন–আপনি আবার কবে আসবেন?
-কেন?
মাঝে মধ্যে আপনাকে আসতেই হবে। আমার চিকিৎসার এটা হল একটা পদ্ধতি।
ক্যাথেরিন ইতস্তত করে বলে উঠল–সময় হলেই আবার আসব অ্যালান।
ক্যাথেরিন চলে গেছে। অ্যালান হ্যামিল্টন কিছু একটা ভাববার চেষ্টা করলেন।
এর আগে তিনি অনেক সুন্দরী মহিলার সেবা করেছেন। অবশ্য সেবা নয়, পরিষেবা। অনেক দিন ধরেই তিনি ডাক্তারি বিদ্যার সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ তার প্রতি যৌন ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারি ব্যাপারে খুবই ওয়াকিবহাল। তিনি একজন মনোবিশারদ। তার আবেগকে সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখেন। পেশেন্টের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখলে চিকিৎসার ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। তবে ভালো সম্পর্ক তো রাখতেই হবে। তা না হলে এই কাজে তিনি সফলতা পাবেন না।
অ্যালান হ্যামিল্টন এক সুন্দর পটভূমিকার মানুষ। তার বাবা ছিলেন সার্জেন। একজন নার্সকে বিয়ে করেছিলেন। অ্যালানের ঠাকুরদা ছিলেন এক বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট। ছোটোবেলা থেকেই অ্যালান চোখের সামনে চিকিৎসা বিদ্যার নানা ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। তখন থেকেই অ্যালানের একমাত্র স্বপ্ন ছিল, বড়ো হয়ে তিনি একজন ডাক্তার হবেন। বাবার মতো একজন সার্জেন। কিংস কলেজের মেডিকেল স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর সার্জারি নিয়ে বিশেষ পাঠ নিয়েছেন।
এই ব্যাপারটির প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর তৃতীয় রাইচ পোল্যান্ডের সীমান্ত ঘেঁষে প্রবেশ করে। দুদিন বাদে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়েছিল।
–তখনই অ্যালান হ্যামিল্টন সার্জেন হিসেবে তার নাম লিখিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালের ২২শে জুন, অক্ষশক্তি পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, নরওয়ে দখল করে নিয়েছে। ফ্রান্সেরও পতন ঘটেছে। যুদ্ধের আগুন পৌঁছে গেছে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে।
প্রথমদিকে কয়েকশো বিমান ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন শহরের ওপর ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ করেছে। পরে বিমানের সংখ্যা বাড়িয়ে দুশো করা হয়েছে। তারপর এক হাজার। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চিন্তা করা যায় না। চারপাশে রক্তাক্ত মানুষের কাতরানি। মানুষ মরছে, দেখার কেউ নেই। একটির পর একটি শহরে আগুন ধরে যাচ্ছে। হিটলার ব্রিটিশ শক্তিকে বুঝতে পারেনি। এই আক্রমণ ব্রিটেনের দেশপ্রেমকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা শান্তি এবং স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব পণ করেছে।
শুরু হয়েছে প্রতি-আক্রমণ, দিনেরাতে যুদ্ধ। অ্যালান হ্যামিল্টন সারারাত জেগে আছেন। ষাট ঘণ্টা তাকে কাজ করতে হয়েছে। এমারজেন্সি হাসপাতালে তাকে ডিউটি দেওয়া হয়েছে। তিনি তার পেশেন্টদের নিয়ে ওয়ারহাউসে চলে গেছেন। অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন।
অক্টোবর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ চলেছে। ঘনঘন সাইরেন বেজে উঠছে। লোকেরা শেলটারের তলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অ্যালান তখনও ব্যস্ত আছেন তাঁর কাজে। তিনি বুঝি কখনও রোগীদের ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একজন ডাক্তার বললেন–অ্যালান এখানে থেকো না, তোমাকে মরতে হবে। এখুনি চলে এসো।
–এক মিনিট…
অ্যালান তখনও মন দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করছেন, আহা, এরা কত অসহায়।
–অ্যালান?
অ্যালান বেরিয়ে যেতে পারেননি। তিনি জানতেন না, তার পরেই কী হবে। পাশেই একটা বোমা পড়ল। সমস্ত বাড়িটা কেঁপে উঠল। ঘরে ঘরে আগুন ধরে গেছে।
কোমাতে ছিলেন ছ দিন, কেউ ভাবেননি অ্যালান বেঁচে উঠবেন।
শেষ পর্যন্ত বেঁচে উঠলেন। সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। ডান হাতের হাড়গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে সেগুলোকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হল। দেখা গেল, অ্যালান আর কোনোদিন অপারেশন করতে পারবেন না।
এক বছর সময় লেগেছিল অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরে আসতে। ততদিনে ভবিষ্যৎটা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। একজন মনস্তত্ত্ববিদের কাছে তাকে থাকতে হয়েছিল। প্রথম দিকে অ্যালান কিছুই বলতে পারতেন না।
অ্যালানকে বলা হয়েছিল বন্ধু, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। অতীতের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে কী লাভ? ভবিষ্যতের জন্য বেঁচে থাকুন।
এখন আমি কী করব? অ্যালান জানতে চেয়েছিলেন।
–আপনি শিক্ষিত বুদ্ধিমান পেশাদার মানুষ, অন্য ভাবে জীবনটা শুরু করতে হবে।
–আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না।
–আপনি তো মানুষের যন্ত্রণার উপশম ঘটাতেন, কী আমি ঠিক বলেছি? এবার আপনাকে কাজের ধারাটা একটু পালটাতে হবে। এখন আর শরীরের পরিচর্যা নয়, মন নিয়ে কাজ করতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, একজন ভালো মনোবিশারদ হবার সবরকম গুণ আপনার মধ্যে মজুত আছে। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। লোকের প্রতি সহানুভূতিও পোষণ করেন। আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখবেন।
এমন ভাবে জীবনের গতিবিধি বদলানো যায় কী? শেষ পর্যন্ত অ্যালান তাই করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং দেখলেন, এইসব মানুষদের সেবা করার মধ্যে একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ নানা কারণে হঠাৎ মানসিক রোগী হয়ে ওঠে। অ্যালান তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সমবেদনার বাণী। এভাবেই এতদিন কেটে গেল। আজ ক্যাথেরিনকে দেখার পর অ্যালানের মনে অন্য ভাবনার অনুরণন। তিনি বুঝতে পারছেন, বেচারি ক্যাথেরিনের দুঃখযন্ত্রণার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। অ্যালানের কেবলই মনে হচ্ছে, যাই ঘটুক না কেন, এই মেয়েটিকে আমি সারিয়ে তুলবই। তাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে।
অ্যালান হ্যামিল্টনের সঙ্গে কথা বলে ক্যাথেরিন তার অফিসে ফিরে এসেছে। উইমের সঙ্গে দেখা করতে গেল সে।
–আজ আমি ডাঃ হ্যামিল্টনের কাছে গিয়েছিলাম। ক্যাথেরিন বলল।
–সত্যি? ভদ্রলোক দারুণ মিশুকে। ওঁনার কাছে গেলে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। উনি বলেছেন, দম্পতিদের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনা ১ শতাংশ। ডিভোর্সের ঘটনা ৭৩ শতাংশ। পারস্পরিক বিচ্ছেদের ঘটনা ৬৫ শতাংশ। গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা ৬৩ শতাংশ। কাছাকাছি পারিবারিক বন্ধুর মৃত্যুর ঘটনাও ৬৩ শতাংশ। ব্যক্তিগত আঘাতের ঘটনা ৫৩ শতাংশ।
গড় গড় করে উইম বলে চলেছেন। ক্যাথেরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আহা, \ এই মানুষটির মন বোধহয় পালটানো যাবে না।
শেষ পর্যন্ত ক্যাথেরিন ভাবল, অবাক লাগছে। এখনও কেন অ্যালানের কথাই মনে পড়ছে আমার!
.
২০.
–এথেন্স তুমি আমাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছ। তুমি একবারও সফল হওনি। আমি বলছি, আরও একটা ভালো প্ল্যানের কথা চিন্তা করো। তাহলেও তুমি সফল হবে না। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে এবং তোমার বোনকে আমি শেষ করব।–
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের মুখ থেকে ছিটকে আসা এই শব্দগুলো এখনও লামব্রোর কানের কাছে বেজে চলেছে। লামব্রোর মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, ডেমিরিস তার কথা রাখবে। ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করেছে সে। কিন্তু রিজোলির ব্যাপারটা কী হল? সমস্ত কিছু এত সুন্দর ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তিনি নিজেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন। বুঝতে পারছেন না, কী হয়েছে? কাকে জিজ্ঞাসা করবেন? সবার আগে প্রধান কাজ এখন বোনকে সাবধান করতে হবে।
লামব্রোর সেক্রেটারি অফিসে এসে গেছে–সে বলল স্যার, দশটা বেজেছে, যার সঙ্গে আপনার কথা বলার ব্যাপার ছিল তিনি এসে গেছেন। আমি কি তাকে পাঠাব?
না, আজ আমার সমস্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দাও। আজ আমি একান্ত নিজের মতো দিনটা কাটাতে চাই।
উনি টেলিফোন তুলে নিলেন। পাঁচ মিনিট বাদে মেলিনার সাথে দেখা করতে চলে গেলেন।
***
ভিলার গার্ডেনে মেলিনা দাদার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
স্পাইরস, তোমাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন? কী ঘটেছে ঠিক করে বল।
–শোন্, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।
আঙুরলতায় আচ্ছাদিত একটা ছোট্ট কুটির, সেখানে সুন্দর বেঞ্চ। স্পাইরস বসলেন। বোনের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, আহা, আমার বোনটি কত লাবণ্যবতী! সে কেন জীবনে শান্তি পেল না? সে তো একটু সুখ পেতে পারত।
-দাদা, ঠিক করে বলোতো, কী হয়েছে?
লামব্রো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্যাপারটা শুনতে তোর মোটেই ভালো লাগবে না।
-কেন? কোথাও কোনো গোলমাল হয়েছে?
–আমি বলতে চাইছি….তুই আর মোটেই নিরাপদ নয়। তোর জীবন এখন সংশয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
-কী বলছ? ধ্যুৎ, আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবন সংশয়? কে কীভাবে কেন আমাকে আক্রমণ করবে?
লামব্রো শান্তভাবে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন আমার মনে হচ্ছে কোস্টা তোকে বাঁচিয়ে রাখবে না। সে তোকে মেরে ফেলবে।
মেলিনা ফ্যালফ্যাল করে দাদার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন–তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছ?
না, মেলিনা, মজা করার জন্য আমি তোর এখানে ছুটে আসিনি। আমার সমস্ত কাজ আজ বাতিল করেছি।
-সত্যি? কোস্টা এত নির্মম! না, তার গুণের শেষ নেই আমি জানি। কিন্তু সে হত্যাকারী! না, ব্যাপারটা ভাবতে হবে।
–তুই জানিস না, এর আগে কোস্টা অনেককে মেরে ফেলেছে।
মেলিনার মুখ সাদা হয়ে গেছে। উত্তেজনা এবং ভয়ে।
–তুমি কী বলছ?
–হ্যাঁ, নিজের হাতে সে এই কাজটা করে না। ভাড়া করা গুণ্ডা লাগিয়ে দেয়। অপরাধের কোনো চিহ্ন থাকে না।
না-না, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি না।
ক্যাথেরিন ডগলাসকে মনে আছে?
–হ্যাঁ, যে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছিল?
–না, সে মারা যায়নি। সে এখনও বেঁচে আছে।
মেলিনা মাথা ঝাঁকালেন–সে কী? এটা হতেই পারে না। যে দুজন ওকে মেরেছিলেন, তাদের তো ফাঁসি হয়ে গেছে।
ল্যামব্রো বোনের হাতে হাত রাখলেন মেলিনা, ল্যারি ডগলাস এবং নোয়েলে পেজ কিন্তু ক্যাথেরিনকে মেরে ফেলেনি। এই ব্যাপারটা সাজানো। এমনকি বিচারের ব্যাপারটাও। ডেমিরিস ওই মেয়েটিকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল।
এসব কথা শুনে মেলিনা যেন এক পাষাণ প্রতিমা। অনেকক্ষণ তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। মেয়েটির কথা মনে পড়ল। একবার তার সাথে দেখা হয়েছিল।
আর হলেতে যে মেয়েটি? সে নিশ্চয়ই ক্যাথেরিন। সব কিছু মনে পড়ে গেল। শীতল একটা স্রোত। ডেমিরিস বলেছিল, সে আমার এক সহকর্মীর পরিচিতা। মিথ্যে কথা। লন্ডনে আমার অফিসে কাজ করে। এটাও সাজানো মিথ্যে।
আমি একঝলক তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। অতীত স্মৃতির বিচ্ছুরণ। বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়েটি ছিল ওই পাইলটের স্ত্রী। কিন্তু তা কী করে সম্ভব হবে। তাকে তো পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, তারা এই কাজটা ভালাৈভাবেই করেছে। এই কাজটির জন্য তাদের ফাঁসি হয়েছে।
মেলিনা হারানো স্মৃতি ফিরে পেলেন।
–আমি এই বাড়িতে মেয়েটিকে দেখেছি। হ্যাঁ, কোস্টা ওর সম্পর্কে আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল।
–এখনও সময় আছে বোন, তোর স্বামী একটা বদ্ধ পাগল। তুই এখান থেকে পালিয়ে যা।
মেলিনা দাদার দিকে তাকাল না, এটা আমার বাড়ি।
-মেলিনা, তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে বল তো? সমস্ত পৃথিবীটা আমার কাছে একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে।
কণ্ঠস্বরের মধ্যে ইস্পাত কাঠিন্য এনে মেলিনা, বললেন–ভয় পেও না, কিছুই হবে না। কোস্টা অত বোকা নয়। সে জানে, যদি আমার কোনো ক্ষতি করে, তাহলে তুমি তাকে ছেড়ে দেবে না। এই পৃথিবীতে একমাত্র তোমাকেই সে বোধহয় একটু ভয় করে।
ও তোর স্বামী, তুই ওর আসল স্বভাবটা জানিস না। তোর জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে রে।
–স্পাইরস, এত ভেবো না, আমার ব্যাপারটা আমি সামলাতে পারব।
স্পাইরস চিন্তিত মনে বোনের মুখের দিকে তাকালেন। না, কিছুতেই বোনের মন পরিবর্তন করা সম্ভব হল না।
–যখন একান্তই বাড়ি ছেড়ে যাবি না, একটা কথা দে, তুই কখনও ওর সঙ্গে একা কোথাও যাবি না। সেটা ব?
ভাইয়ের হাতে হাত রেখে মেলিনা বললেন ঠিক আছে আমি প্রতিজ্ঞা করছি।
মেলিনা কিন্তু এই প্রতিজ্ঞাটা রাখার জন্য মোটেই তৎপর ছিলেন না। আসলে স্বামীর ওপর তখনও তার অগাধ ভালবাসা এবং স্থির বিশ্বাস।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বাড়িতে এলেন। সন্ধ্যা হয়েছে। মেলিনা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারা বেডরুমের দিকে হেঁটে গেলেন।
–তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে, আমি মুখোমুখি কথা বলতে চাই।
ডেমিরিস তার ঘড়ির দিকে তাকালেন মাত্র কয়েক মিনিট সময় আছে। দরকারি এনগেজমেন্ট আছে। এখুনি বেরোতে হবে।
-সত্যি! আজ রাতে তুমি কি কাউকে হত্যা করতে চলেছ?
এই কথা শুনে ডেমিরিস স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকালেন।
–তুমি কী বলতে চাইছ, পরিষ্কার করে বলো তো?
–স্পাইরস আজ সকালে এসেছিল। আমাকে সব কিছু জানিয়েছে।
–ভবিষ্যতে ওই কুকুরটা যেন এই বাড়িতে কখনও না আসে। এটাই আমার শেষ কথা।
–এটা আমারও বাড়ি, মেলিনা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলে উঠলেন, আমরা অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম।
–কী বিষয়ে?
–তোমার বিষয়ে, ক্যাথেরিন ডগলাস এবং নোয়েলে পেজের ব্যাপারে।
এবার ডেমিরিসের পুরো মনোযোগ পড়ল স্ত্রীর ওপরে-সেটা তো একটা পুরোনো
তাই কী? স্পাইরস জানে, তুমি দুজন নিরাপরাধ মানুষকে ফাঁসির মঞ্চে চড়িয়ে দিয়েছ। কোস্টা, ব্যাপারটা কি সত্যি?
স্পাইরস একটা বোকা হাঁদারাম।
–আমি মেয়েটিকে এই বাড়িতে দেখেছি। হ্যাঁ, দেখেছি। তুমি আর অস্বীকার করতে পারবে না।
-তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তুমি ভবিষ্যতে মেয়েটিকে আর কখনও দেখতে পাবে না। আমি কাউকে পাঠিয়েছি, মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য।
মেলিনার মনে পড়ে গেল, সেই তিনজন মানুষের কথা, যাঁরা ডিনার খাবার জন্য এই বাড়িতে এসেছিলেন। বলা হয়েছিল, তারা পরদিন সকালে লন্ডনের দিকে উড়ে যাবেন। আমি বেশ বুঝতে পারছি, ওদের মধ্যে একজন হত্যাকারী লুকিয়ে আছেন।
ডেমিরিস মেলিনার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন। শান্তভাবে বললেন–তুমি তো জানো, একদিন তোমাকে এবং তোমার ভাইকেও ছাড়ব না।
তিনি মেলিনার হাতে মোচড় দিলেন।
-স্পাইরস, আমাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। তখনই তাকে মেরে ফেলতাম। কিন্তু কেন বলো তো? আরও কিছু দিন তাকে আমি নরক যন্ত্রণা ভোগ করাব। তারপর…।
–আঃ, ছাড়ো! কী, হচ্ছে কী?
–আমার প্রিয় স্ত্রী, তুমি এখনও সেই যন্ত্রণাটা পাওনি। একদিন নিশ্চয়ই পাবে।
ডেমিরিস হাত ছেড়ে দিলেন।
–আমি ডিভোর্স চাইছি। আমি একজন সত্যিকারের ভালোবাসার নারীকে গ্রহণ করব। তার আগে তোমার জীবনটা আমি নরক করে ছেড়ে দেব। তোমার জন্য বহু সুন্দর প্রকল্পনা আছে আমার হাতে। তোমার ভাইয়ের জন্যও। তার আগে এসো, শান্তভাবে কিছু কথা বলা যাক। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে? না, তা হলে হয়তো আমি ভেবে দেখতে পারি। তোমাকে আর কতদিন অপেক্ষাতে রাখব? তোমাকে নয়, আমি সেই অন্য মেয়েটির কথা বলছি।
ডেসিংরুমের দিকে তিনি হেঁটে গেলেন। মেলিনা সেখানে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন তিনি। স্পাইরস ঠিক কথাই বলেছে। এই মানুষটিকে একটা উন্মাদ বলা যেতে পারে।
নিজেকে একেবারে অসহায় বলে মনে হল। কিন্তু, নিজের জীবন সম্পর্কে এত চিন্তা করে কী লাভ? বেঁচে থেকেই বা কী হবে? মেলিনা চিন্তা করলেন। তাঁর স্বামী তার সমস্ত সম্মান কেড়ে নিয়েছেন। তাকে রাস্তার মেয়েতে পরিণত করেছেন। অনেক কথা মনে পড়ে গেল। জীবনের আর কী রইল? বন্ধু বান্ধবরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বেশ বুঝতে পারছি, ও আর আমার প্রতি এতটুকু চিন্তিত নয়। আমি তো মরতেই চাইছি, কিন্তু কীভাবে? না, আমি মরে গেলে স্পাইরসের কী হবে? স্পাইরসের জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে। স্পাইরস আমাকে খুবই ভালোবাসে।
মেলিনা জানেন, দাদা তার খুবই শক্তিশালী। কিন্তু স্বামীর শক্তি আরও বেশি। যে করেই হোক, স্বামীর সামনে বাধার প্রাচীর তুলতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর মেলিনার জানা নেই।