অ্যাডাম বাইরে গেছে, এক মাস হয়ে গেল। জেনিফার তার কোনো খবর পাচ্ছে না। জেনিফার মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়েছে। তার প্রতি দুস্তর একটা আকর্ষণ সে অনুভব করছে। হঠাৎ একদিন টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলতেই জেনিফার ও প্রান্ত থেকে অ্যাডামের গলার স্বর শুনতে পেল। অ্যাডাম বলছেন–একটু আগে ফিরেছি, দুপুরে আমরা দুজনে লাঞ্চও খাব।
এতদিন বাদে অ্যাডামের গলা শুনে জেনিফারের শরীর রোমাঞ্চে শিউরে উঠল। কোনো রকমে সে উত্তর দিল–
-তাহলে কথা রইল প্লাজা হোটলের এক রুমে তুমি চলে আসবে।
–অবশ্যই।
জেনিফার জানে ওই ওক রুমে যত ব্যবসায়ী ও দালালদের আস্তানা। আগে কোনো যুবতী মেয়েরা ওখানে যেতে সাহস করত না।
জেনিফার অন্য দিনের তুলনায় একটু আগে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে এসে হাজির হল এক রুমে। অ্যাডাম এল একটু পরে। জেনিফার দেখল অ্যাডামের গায়ের রং তামাটে দেখাচ্ছে। তবে কি ওর কল্পনা অমূলক নয়? সত্যি সত্যি কি অ্যাডাম এতদিন সুন্দরী স্বল্পবাস যুবতীদের নিয়ে ফুর্তি করে বেরিয়েছে সমুদ্রের তীরে? কেননা জেনিফার জানে একটানা বেশ কিছুদিন বালির ওপর শুয়ে থাকলে রোদের তাপে রং তামাটে হয়ে যায়। ভয়ে জেনিফারের মুখ শুকিয়ে গেল।
অ্যাডাম ওয়ার্নার দূর থেকেই জেনিফারকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে জেনিফারের মুখোমুখি বসলেন। জেনিফারের হাত তুলে নিলেন নিজের হাতে। তার হাতের উষ্ণ পরশ জেনিফারের ভেতরে একটা শিহরণ জাগালো। বিবাহিত পুরুষদের সংস্পর্শ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার সাবধান বাণী সে এই মুহূর্তে ভুলে গেল। ক্রমশ সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে বুঝতে পারছে তার ইচ্ছাশক্তি লোপ পেয়েছে। অন্য কিছুর আকর্ষণে সে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে অ্যাডামের হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে। সমস্ত বাধা লঙ্ঘন করার প্রবল স্পৃহা তার মনকে নাড়া দিচ্ছে। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে যে সে আর অ্যাডাম দুজনে নগ্ন হয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে। কথাটা ভাবামাত্র তার চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
সেই মুহূর্তে অ্যাডাম জেনিফারকে চমকে দিয়ে একটা সবুজ রঙের স্কার্ফ দিলেন। তিনি বললেন–এটা তোমার জন্য মিলান থেকে এনেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে তো জেনিফার?
সবুজের ওপর সোনালী সুতোর কারুকাজ স্কার্ফটার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জেনিফার ভাবল মিলান অর্থাৎ ইটালি। সে শুনেছে ওখানকার মেয়েরা পরীদের মতো অপরূপা হয়।
জেনিফার খুশীর সুরে বলল–বাঃ, চমৎকার দেখতে তো এটা। তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ অ্যাডাম। শুনেছি ওই জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর। ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে নাকি ওই জায়গাটা হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমি অবশ্য কখনও মিলানে যাইনি, তবে ওখানকার মন্দির, মঠ আর গীর্জার অনেক ছবি আমি দেখেছি।
-হ্যাঁ, জায়গাটা ভারী সুন্দর। ওখানকার মঠ, মন্দির ও গীর্জাগুলোর শিল্প ও ভাস্কর্যের কোনো তুলনা নেই।
তখন অ্যাডামের সঙ্গ জেনিফারকে আবেশ বিহ্বল করে তুলেছিল। অ্যাডামের হাতের স্পর্শ ও দুচোখের মনোমুগ্ধকর দৃষ্টি তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। চারপাশের কিছুর প্রতি তার দৃকপাত ছিল না। হঠাৎ তারা আবিষ্কার করল যে পেটের খিদের থেকে আরেকটি খিদে রয়েছে তাদের শরীরের প্রতিটি কোণে। সে খিদেকে অগ্রাহ্য করা তাদের কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
জেনিফার মনে মনে বলল–ওর মোহ মুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে একটি কাজ করতে হবে। তা হল ওর শরীরী আবেদনে সাড়া দেওয়া, সে অ্যাডামকে ফিস ফিস করে বলল চলো আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাই।
ওরা হোটেলের বিল মিটিয়ে বাইরে এল। সেখানে প্রচুর লোকের আনাগোনা চলছিল। সেই ভীড়ের মধ্যে জেনিফার গিয়ে দাঁড়াল। আর অ্যাডাম গেল হোটেলের কাউন্টারের দিকে। তিনি দুজনের জন্য ঘর বুক করলেন। রেজিস্টারে নিজের নাম নথীভুক্ত করলেন। এবার জেনিফারের কাছে ফিরে এলেন অ্যাডাম। তাপর দুজনে এলিভেটরে চাপলেন বুক করা ঘরের উদ্দেশ্যে।
তারা প্লাজা হোটেলের নির্দিষ্ট ঘরটিতে এসে উপস্থিত হল। সেই ঘরটি নানারকম আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। অনেক নীচের থেকে শহরের ব্যস্ত যানবাহনের আওয়াজ ওপরের এই ঘরে ভেসে আসছে। জেনিফারের মনে হল সে যেন ম্যাজিক দেখছে। আর পরবর্তী ঘটনাগুলো চোখের নিমেষে ম্যাজিকের মতো ঘটে গেল। অ্যাডাম নিজের হাতে একটি একটি করে জেনিফারের পোশাক খুলে দিল। সে একেবারে নগ্ন হয়ে গেল। তারপর তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন অ্যাডাম। তারপর তাদের দুজনের দেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। এই দৈহিক সঙ্গ লাভের জন্য দুজনেই উন্মুক্ত হয়েছিল এতদিন। অ্যাডামকে দেহদান করে জেনিফার যে সুখ পেয়েছে তা ও কোনোদিন ভুলতে পারবে না। তার মনের স্মৃতিপটে এই ঘরের ভেতরের মুহূর্তগুলো আজীবন গাঁথা থাকবে। মিলনকালে তার একটি কথাই মনে হচ্ছিল যে সে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে চলল তাদের দেহমিলনের চরম আনন্দের সুখ ভোগ। জেনিফারের সমস্ত শরীর ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ল। সে অ্যাডামের পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে অ্যাডামের রোমশ বুকে হাত বুলোত লাগল।
নীরবতা ভঙ্গ করে অ্যাডাম বললেন–মনে হচ্ছে আমি আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম।
অ্যাডামের কথা শুনে জেনিফার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
বিস্মিত চোখে অ্যাডাম একপলক দেখলেন জেনিফারকে, তারপর বললেন–এতে হাসির কি হল?
জেনিফার চোখে মুখে হাসির ভাব ফুটিয়ে বলল–আমি এতদিন ভাবতাম একবার–তোমার পাশে শুলেই আমি তোমার হাত থেকে মুক্তি পাবে।
জেনিফারের দিকে কাত হয়ে শুয়ে অ্যাডাম বললেন–এখন কি তোমার ভাবনাটা পাল্টে গিয়েছে?
একটু ইতস্তত করে জেনিফার বলল–এখন আমি ভাবছি, তোমার জন্যই হয়তো ঈশ্বর আমাকে তৈরি করেছেন। এখন আর তোমাকে ছাড়া আমি একমুহূর্ত থাকতে পারবো না।
জেনিফারের ইঙ্গিতটা বুঝতে অ্যাডামের একটু অসুবিধা হল না। তাই তিনি বললেন আগামী সোমবার আমার স্ত্রী মেরিবেথ ইউরোপ যাচ্ছে। সঙ্গে তার পিসীও যাচ্ছেন। ফিরবে সেই একমাস পরে, এই একটা মাস আমরা একে অপরের সঙ্গসুখ লাভ করবে।
.
জেনিফার আর অ্যাডাম ওয়ার্নার প্রতি রাতে মিলিত হয়ে চরম তৃপ্তি ভোগ করতে লাগল। মাঝে মধ্যে অ্যাডাম জেনিফারের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটাতে আসতেন। একদিন তিনি জেনিফারকে বললেন–এখানে আমি আর তোমাকে থাকতে দেবো না। আজ তুমি আমি কেউই অফিসে যাব না। তোমার থাকার মতো একটা বাড়ির সন্ধান করবো আজ সারাদিন ধরে।
তারা দুজনে সারাদিন ধরে বাড়ির খোঁজে একদি ওদিক ঘুরে বেড়াল। প্রচুর অ্যাপার্টমেন্ট দেখল। সবকটিই জেনিফারের অপছন্দ হল। শেষ পর্যন্ত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। তখন তারা বেলমেন্ট টাওয়ার্সে একটা বাড়ির সন্ধান পেল। জায়গাটা ও বাড়িটি তাদের মনের মতো হল।
সেই বাড়িটিতে ঘরের সংখ্যা পাঁচটি। প্রতিটি ঘরই দামী দামী আসবাবপত্রে সাজানো।
অ্যাডাম সাগ্রহে জানতে চাইলেন কি পছন্দ হয়েছে তো?
জেনিফার খুশীর স্বরে জবাব দিল–খুব পছন্দ হয়েছে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে একটা বড়ো সমস্যা দেখা দিয়েছে, এতবড় বাড়ির ভাড়া দেওয়ার মতো আর্থিক পরিস্থিতি এখনও আমার তৈরি হয়নি।
অ্যাডাম বললেন–এটা আমরা লিজ নিয়েছি, কোম্পনীর নামে। ভি. আই. পি.-দের থাকার ব্যবস্থা এখানে করা হয়। আমি ওদের জন্য অন্য ব্যবস্থা করে দেবো। আজ থেকে তুমি এখানে থাকবে।
অসম্ভব। তুমি তো জানো আমার বার্ষিক আয় কত? এত ভাড়া দেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
–তুমি কিছু চিন্তা কেরো না, সেসব আমি দেখবো।
স্ত্রীর অগোচরে রোজ সন্ধ্যায় অ্যাডাম আসতেন জেনিফারের নতুন ফ্ল্যাটে। কাজকর্ম নিয়ে তারা দুজনে আলোচনা করতেন, মাঝে মধ্যে রানি বা দাবা খেলে সময় কাটাতে তারা। জেনিফার নিজের হাতে দুজনের জন্য ডিনার তৈরি করতো। তারা দুজনে একসঙ্গে বসে ডিনার সারতো আর তার ফাঁকে ফাঁকে নানারকম গল্প চলতো।
এখন অ্যাডামের সঙ্গে জেনিফারের ঘনিষ্ঠতা আরও গম্ভীর হয়েছে। এখন দুজনে পরস্পরের খুব কাছাকাছি এসেছে। তবে তারা আগের মতো নিঃসঙ্কোচে কোথাও বেড়াতে যেতে বা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না। কোথা থেকে লজ্জা সংকোচ এসে তাদেরকে বাধা দেয়। অবশ্যই এর পেছনে কাজ করছে দুর্নাম রটনার ভয়। তাই তারা ইচ্ছে হলে শহরের বাইরে চলে যায়। সেখানে ছোটোখাটো কোনো রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রথম দিকে ক্রমে ক্রমে দেখা গেণ্ডামকে সে আরও গ্রহনের সব কথা ডিনার সারে।
সকাল থেকে রাত অবধি অ্যাডামের রবিবারটা কাটে জেনিফারের সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তারা দুজনে ব্রেকফাস্ট খায়। গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে তারা ঘরে বসেই প্রার্থনা করে। জেনিফার জানে অ্যাডামের সঙ্গে তার প্রেম প্রেম খেলা করা ভয়ংকর অন্যায়, এই খেলা বেশীদিন চলবে না, চলতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কিছুতেই অ্যাডামের মোহ থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অ্যাডামের সঙ্গসুখ যেন তাকে সারাক্ষণ আবিষ্ট করে রাখে। দেহদান করে যে এত তৃপ্তি ও সুখ পাওয়া যায় তা জেনিফার আগে জানতো না। অ্যাডাম যে তাকে এত আনন্দের অধিকারিনী করেছে তার জন্য জেনিফারকে অনেক মূল্য দিতে হবে কোনোও একদিন, তা জেনিফার নিশ্চিত করে জানে।
অ্যাডামের যত্নআত্তিতে জেনিফারের কোনো গাফিলতি নেই। সে শুনেছে অনেক প্রেমিক নাকি প্রেমিকার সঙ্গে রাত্রিযাপন কালে অতর্কিতে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। নয় হৃদরোগে অথবা উচ্চ রক্ত চাপজনিত কারণে। তাই জেনিফার আপকালীন ব্যবস্থা হিসাবে অ্যাডামের গৃহ চিকিৎসকের নাম ঠিকানা, এমন কী টেলিফোন নম্বরও লিখে রেখেছে নিজের টেলিফোন গাইডে। অ্যাডামের স্ত্রী মেরিবেথের মতো সে অ্যাডামের প্রিয় খাবার রান্না করা থেকে জামাকাপড় কেচে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজ একা হাতে করে। মেরিবেথের অভাব সে অ্যাডামকে বুঝতে দেয় না। অ্যাডাম ঘুমিয়ে পড়লে তারপর সে তার হাতে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। তার মনে হয় এই আশ্রয়টি যেন তার দেহমনে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করে।
প্রথম দিকে জেনিফারের ধারণা ছিল তাদের পরস্পরের প্রতি দৈহিক আসক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। ক্রমে ক্রমে দেখা গেল তার ধারণা ভুল। তাদের দৈহিক আকর্ষণ কমা তো দুরের কথা বরং আরও বেড়েছে। অ্যাডামকে সে আরও গভীরভাবে ভালোবাসলো। তাকে ছাড়া তার একমুহূর্ত চলে না। অ্যাডামের কাছে তার জীবনের সব কথা অকপটে বলে গেল। তার এখন একটাই কাজ কেবল অ্যাডামের সেবাযত্ন করা। সে সবসময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে কোনোভাবেই যেন তাদের এই সুখের দিনগুলির অবসান না হয়। আর সবসময় অ্যাডাম যেন তাকে এইভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে।
কিন্তু ঈশ্বর জেনিফারের ওই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন নি। তাদের ওই সুখসাগরে ভেসে যাওয়ার ইতি ঘটল। জেনিফার আর অ্যাডামের সুখ ও আনন্দের দিনের মেয়াদকাল ছিল মাত্র একমাস, কারণ একমাস বাদে অ্যাডামের স্ত্রী মেরিবেথ ইউরোপ থেকে ফিরে আসার আগের রাত। সে রাতে অ্যাডাম জেনিফারের ফ্ল্যাটে এলেন। শেষবারের মতো দুজনে একসঙ্গে ডিনার করলেন। তারপর দুজনে দৈহিক সুখের স্বাদ গ্রহণে মেতে উঠলেন। শেষে ক্লান্ত হয়ে অ্যাডাম একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন।
সে রাতে জেনিফার দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। সে অ্যাডামের বুকের ওপর শুয়ে সারা রাত কাটিয়ে দিল। সুখের অনুভূতিতে ভরা গত কদিনের স্মৃতি ভাবতে লাগল সে।
পরদিন সকাল। অ্যাডাম ও জেনিফার ব্রেকফাস্ট খেতে মুখোমুখি বসেছে টেবিলে। খেতে খেতে অ্যাডাম বললেন–জেনিফার, তুমিই একমাত্র মেয়ে যাকে আমি অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছি।
মেরিবেথকে বিয়ে করার পরেই অ্যাডাম বুঝতে পেরেছিলেন তিনি কতবড় একটা ভুল করেছেন। একমাত্র আবেগ ও সহানুভূতির তাগিদেই ওই সময় এমন বোকার মতো কাজ করেছিলেন তিনি। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন মা-বাবাকে হারিয়ে মেরিবেথ এই বিশাল পৃথিবীর কোনো এক অন্ধ গলিতে একাকী ঘুরে বেড়াতো। তাই তাকে বিয়ে করে মহানুভবতার কাজ করেছেন। এর সঙ্গে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছিলেন।
মেরিবেথকে তিনি সত্যিই ভালোবাসেন। মেরিবেথ যাতে আঘাত পায় এমন কোনো আচরণ তিনি করেন না। তবে জেনিফারকে যে তিনি ভালোবাসেন সেটাও অস্বীকার করতে পারেন না। এই ভাবনাটা তাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল। শেষ অবধি তিনি স্থির করলেন, এই বিষয়ে মামাশ্বশুর স্টুয়ার্ট নিডহ্যামের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। স্টুয়ার্ট তাকে ভীষণ স্নেহ করেন। সুতরাং অ্যাডামের অবস্থা তিনি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
অ্যাডাম স্টুয়ার্টের অফিসে এসে হাজির হলেন। স্টুয়ার্ট তাকে দেখে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ভালোই হয়েছে তুমি এসেছো অ্যাডাম, কিছুক্ষণ আগে নির্বাচন কমিটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি টেলিফোনে। ওঁরা তোমাকে সেনেটর হবার উপযুক্ত মনে করছেন। তাই তোমাকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বলছেন, পার্টির থেকে তুমি সাহায্য পাবে।
অ্যাডাম হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন তা ভুলে গেলেন। মুহূর্তখানেক পরে আমতা আমতা করে বললেন–আমি ইয়ে–এ তো খুব আনন্দের কথা।
স্টুয়ার্ট সোৎসাহে বলতে লাগলেন–খুব সুষ্ঠু ও শান্তভাবে সবকিছু পরিচালনা করতে হবে আমাদের। সবার আগে একটা নির্বাচনী তহবিল খুলতে হবে। কোথা থেকে শুরু করবো তা আমি তোমায় বুঝিয়ে বলছি।
সেনেটর পদপ্রার্থী হিসেবে অ্যাডামকে ভোটে দাঁড় করাতে কি কি পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছেন তা নিয়ে আলোচনা করলেন তাঁর সঙ্গে স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম। প্রায় দু-ঘন্টা পর আলোচনা শেষ হতে অ্যাডাম বললেন–স্টুয়ার্ট একটা বিশেষ কারণে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি আমি।
স্টুয়ার্ট ব্যস্ত হয়ে বললেন–দুঃখিত, অ্যাডাম। আমার একজন মক্কেল এসেছে। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। হাতে একদম.সময় নেই। মামাশ্বশুরের কথা শুনে অ্যাডাম আন্দাজ করতে পারলেন হয়তো সমস্যাটা স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম অনুধাবন করতে পেরেছেন।
সেদিন দুপুরে এক ডেয়ারী রেস্তোরাঁয় অ্যাডাম ও জেনিফার লাঞ্চ খেতে এসেছেন। অ্যাডামের চোখমুখ উৎসাহ উদ্দীপনায় টগবগ করে ফুটছে। তিনি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন–একটা সুখবর আছে, জেনিফার। আমি সেনেটর পদের পার্থী হয়ে এবার ভোটে দাঁড়াচ্ছি।
জেনিফার আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সে বলল–বাঃ! এতো দারুণ খবর! দেখবে একদিন সেনেটর হিসেবে তোমার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
অ্যাডাম বললেন–নিউইয়র্কের মতো জায়গায় ভোটে জেতার জন্য জোর লড়াই করতে হবে।
জেনিফার জানতো অ্যাডাম অসম সাহসী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই তিনি যে কোনো লড়াইতে নামেন এবং জয়লাভও করেন। তার পূর্ব অভিজ্ঞতাই এর প্রমাণ। একবার জটিল একটা মামলা থেকে তাকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। তাই সে জোর দিয়ে বলল–ওসব তোমার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। তোমার জন্য আমার গর্ব হয়।
অ্যাডামের একটি হাত জেনিফারের হাতের মুঠোর মধ্যে।
অ্যাডাম অন্তরঙ্গ সুরে বললেন–দাঁড়াও, দাঁড়াও, এখনই অত ভেবো না। আমাকে অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে।
জেনিফার আন্তরিকভাবে বলল–তোমায় আমি ভালোবাসি বলেই তো তোমার জন্য আমি গর্ববোধ করি।
নির্বাচনী প্রচার অভিযান নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন জেনিফারের সঙ্গে অ্যাডাম। শুভাকাঙ্খী হিসেবে জেনিফার চায় অ্যাডাম সেনেটর হোন। কিন্তু তাতে একটা সমস্যা দেখা দেবে। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে। অ্যাডাম সেনেটর হলে নানা কাজে ব্যস্ত থাকবেন। তখন জেনিফার তার সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হবে। সে নিজে অবিবাহিতা আর অ্যাডাম বিবাহিত। তাদের দুজনের গোপন প্রেম ও দৈহিক সম্পর্কের কথা লোকসমক্ষে প্রকাশিত হলে অ্যাডামের রাজনৈতিক জীবনে চরম বিপর্যয় ঘটবে। অ্যাডামের পক্ষে সেটা খুব শুভ হবে না। আবার তার স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। এইসব ভাবনাগুলো জেনিফারকে নিরাপত্তাহীন ও নিঃসঙ্গ করে দিতে চাইল। তবুও সে অ্যাডামকে উৎসাহিত করতে লাগল।
অ্যাডামের প্রেমে পড়ার পর অনিদ্রা আর দুঃস্বপ্নের বোগ তাকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু আবার সেই রোগ এসে হানা দিল তার চোখে। সে সারারাত জেগেই কাটাতে লাগল।
.
একদিন জেনিফার একটি অদ্ভুত খবর পেল। একজন বিধবার সম্পত্তি ষড়যন্ত্র করে দখল নিচ্ছে তার মেয়ে জামাই। সেই খবরটি জেনিফারকে আকৃষ্ট করল। সে মন দিয়ে পুরো খবরটি পড়ল, খবরটি হল এই রকম–হেলেন কুপার নামে এক মধ্য বয়স্কা বিধবা ভদ্রমহিলা তার একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে একটি বাড়িতে বাস করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর গচ্ছিত চল্লিশ লাখ ডলার হেলেন পান। তিনি সেই টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছিলেন। হেলেন যে বাড়িতে থাকতেন সেখানকার সুপারিনটেন্ডের প্রেমে পড়ে তার মেয়ে এবং পরে ওদের বিয়ে হয়। বিয়ের, মাস ছয়েক পরে হেলেনের মেয়ে ও জামাই তার সম্পত্তি হস্তগত করার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা আদালতে গিয়ে আবেদন পেশ করে এই মর্মে যে শ্রীমতী কুপারের মধ্যে মানসিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। তাই তাকে সরকারীভাবে অক্ষম ঘোষণা করা হোক এবং যাবতীয় বিষয়সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তাদের করা হোক। আবেদনের সঙ্গে শ্রীমতী কুপারের মেয়ে জামাই শহরের তিনজন সেরা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের রিপোর্টও দাখিল করেছিলেন আদালতে। তারা জানিয়েছে ওই তিনজন ডাক্তার শ্ৰীমতী কুপারের মানসিক বৈকল্য সম্পর্কে একমত হয়েছেন। তাদের তিনজনের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আদালত শ্রীমতী কুপারকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাবার নির্দেশ দিলেন। আর তার সমস্ত সম্পত্তি তার মেয়ে জামাইকে হস্তান্তর করলেন।
রিপোর্টটা পড়া শেষ করে জেনিফার কেন বেইলিকে বলল–কেন, আমার মনে হচ্ছে এটা সাজানো কেস।
কেন বলল–আমিও তাই ভাবছি। তবে তুমি এখানে কিছু করতে পারবে না।
এটা সত্যি যে শ্রীমতী কুপার জেনিফারের মক্কেল নন। তাঁর মেয়েজামাই যদি তাকে কৌশলে পাগলা গারদে পাঠিয়ে থাকে তাহলে তারা জেনিফারের মধ্যস্থতা পছন্দ করবে না। তাছাড়া সেরা তিনজন মানসিক চিকিৎসক তাকে মানসিক রোগী বলে সাব্যস্ত করেছেন। সেক্ষেত্রে শ্রীমতী কুপারের করণীয় কিছু নেই। তবুও জেনিফার একগুয়ের মতো বলল–কেন, আমি শ্ৰীমতী কুপারের পাশে দাঁড়াবো, তার সঙ্গে আজই দেখা করবো।
হিদাস অ্যাসাইলামে গিয়ে জেনিফার সুপারিনটেন্ডেন্টের সঙ্গে দেখা করল। এই পাগলা গারদটি ওয়েস্টবেস্টারের বিশাল জঙ্গলের ধারে অবস্থিত। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। একটি মাত্র দ্বার। তার দুপাশে দুজন রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে।
সুপারেন্টেনডেন্ট বিনয়ের সঙ্গে বললেন–হেলেন কুপারের সঙ্গে কারো দেখা করার অনুমতি নেই। তবে আপনার ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু আপনি যে এখানে এসেছেন তা খাতায় লেখা হবে না গোপন থাকবে। যদি আপনি রাজী থাকেন তাহলে ওঁকে এখানে আনার ব্যবস্থা করতে পারি।
-ধন্যবাদ।
রোগা পাতলা গড়নের মহিলা শ্ৰীমতী হেলেন কুপার। বয়স ষাটের কাছাকাছি। এই বয়সেও তার দেহে সৌন্দর্যের বান ডাকছে। তার চোখের তারা দুটি ঘন নীল। তার চোখমুখ অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করছে। জেনিফারকে দেখে তিনি ভীষণ খুশী।
–আপনার পরিচয় আমার জানা নেই, আপনার এখানে আসার কারণও আমার অজ্ঞাত, তবুও কেন জানি না আপনাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে–হেলেন কুপার হাসিমুখে জেনিফারকে বললেন।
জেনিফার বলল–আমি একজন এ্যাটর্নি। একজনের পাঠানো একটা রিপোর্ট পড়ে জানতে পারলাম আপনি এখানে আছেন, অবশ্য তাকে আমি চিনি না।
হেলেন কুপার বললেন–একাজ অ্যালবার্ট ছাড়া আর কারও নয়।
–অ্যালবার্ট কে?
–গত পঁচিশ বছর সে আমার বাটলার ছিল। আমার মেয়ে ডরোথি। সে বিয়ে করার পর তাকে তাড়িয়ে দেয়। আপনার বয়স কম তাই আমাদের চারপাশে দিনের পর দিন কি পরিবর্তন হচ্ছে তার খোঁজ আপনি জানেন না। মানুষের মনের মধ্যে দয়া মায়া মমতা স্নেহ ভালোবাসা শ্রদ্ধা করুণা এসব কিছুই আর তিলমাত্র নেই। তার পরিবর্তে এসে ঠাঁই পেয়েছে লোভ ইর্ষা। তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
–আপনি কি আপনার মেয়ের মধ্যে এসব কিছু দেখতে পেয়েছেন? জেনিফার জানতে চাইল।
না, ডরোথির কোনো দোষ নেই। আসল শয়তান হল ওর স্বামী। আমার মেয়েকে সুশ্রী বলা চলে না। হাবার্ট ওকে বিয়ে করেছে কেবল টাকার লোভে। তাই যখন সে জানতে পারল সমস্ত বিয়ষসম্পত্তির মালিকানা আমার নামে তখন সে এটা ভালো মনে মেনে নিতে পারেনি।
–আপনার জামাইয়ের এই মনোভাব আপনি জানলেন কি করে?
–সে নিজের মুখে বলেছে। কোনো যুক্তির ধার ধারে না। আমার মৃত্যু পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে চাইল না, তার ইচ্ছে আমি জীবিত থাকতেই ডরোথির নামে সব সম্পত্তি লিখে দিই। তাহলেই তো ও কিস্তিমাৎ করতে পারবে। আমি জামাইকে একেবারে বিশ্বাস করি না।
শ্ৰীমতী কুপার, আপনি কি সত্যি সত্যি মানসিক দিক থেকে অসুস্থ? আড় চোখে জেনিফারের দিকে তাকিয়ে শ্রীমতী কুপার বললেন–কখনই না। তবে ডাক্তারদের মতে আমি সিজোফ্রেনিয়া আর পারানাইয়ার রোগী।
জেনিফার নিশ্চিত যে শ্রীমতী কুপার কোনভাবেই মানসিক রোগে ভুগছেন না।
–আপনাকে কি আপনার মেয়েজামাই জানিয়েছে যে এ ব্যাপারে তারা তিনজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই আপনাকে মানসিকভাবে সুস্থ নন বলে রায় দিয়েছেন।
শ্রীমতী হেলেন কুপারের চোখমুখ বিষাদের ছায়ায় ঢেকে গেল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন–আমায় বিষয় সম্পত্তির মোট মূল্য চল্লিশ লাখ ডলার। ওই টাকার শতকরা একভাগ দিয়ে বিশ্বের যে কোনো ডাক্তারকে কেনা যায় মিস পার্কার। তাছাড়া এখন আমার জামাই ওইসব বিষয়সম্পত্তির মালিক। তার হাত থেকে আমি কিছুতেই মুক্তি পাব না।
–আমি আপনার জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করবোবলেই জেনিফার সেখান থেকে বিদায় নিল।
প্লাজা টাওয়ার্স। নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা বিলাসবহুল অঞ্চল। এখানে সব ধনী ব্যক্তিদের বসবাস। বিশাল এলাকা জুড়ে এই টাওয়ার্সটি তৈরি করা হয়েছে। শ্রীমতী কুপারের মেয়ে জামাই এই অঞ্চলের বাসিন্দা। জেনিফার তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেল। সে নির্দিষ্ট বাড়িতে এসে পৌঁছল। সদর দরজার নেমপ্লেটে লেখা মিঃ অ্যান্ড মিসেস হাবার্ট হর্থন।
জেনিফার ভেতরে ঢুকল দরজা ঠেলে। সে দেখল মেয়ে সম্পর্কে শ্ৰীমতী কুপার একটিও মিথ্যে কথা বলেননি। রোগা, লম্বা, ট্যারা দেখতে ডরোথিকে। ডরোথির স্বামীকে হঠাৎ কেউ দেখলে ভাববে উনি বুঝি ওর বাবা। ডরোথির থেকে বয়সে অনেক বড় তিনি। চোখমুখ ও চেহারায় শয়তানের বাসা বাঁধা যেন।
-কি ব্যাপার বলুন তো, কেন এসেছেন এখানে–কথাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে হাবার্টের মুখ থেকে বিশ্রী আওয়াজ বেরোল।
জেনিফার ডরোথির দিকে তাকিয়ে বলল–আপনার মায়ের ব্যাপারে কিছু কথা ছিল।
ডরোথি বলল ঠিক আছে বলুন।
–ওঁর ভেতর পাগলামির লক্ষণ কখন দেখতে পেয়েছিলেন?
–আমাদের বিয়ের পর থেকে। আমার শাশুড়ি অর্থাৎ ডরোথির মা আমাকে সহ্য করতে পারেন না। তাছাড়া ডাক্তাররাও সে কথা বলেছেন।
ভুল বলেছেন, কেউই ঠিক রিপোর্ট দেননি। আমি ডাক্তারদের রিপোর্টগুলো দেখেছি। জেনিফার বলল।
হাবার্ট চীৎকার করে উঠল। ঠিক রিপোর্ট দেননি, একথার অর্থ কি?
–আসলে আপনি ও আপনার স্ত্রী ওঁর আচরণ সম্পর্কে ডাক্তারদের যা বলেছেন তার ওপর নির্ভর করে ওঁরা রিপোর্ট তৈরি করেছেন। যে সব লক্ষণ দেখা দিলে পাগল বলে প্রতিপন্ন করা যায় সেইসব লক্ষণ শ্রীমতী কুপারের মধ্যে কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই। তাই বলছিলাম ওঁরা যে রিপোর্ট দিয়েছেন তা ভুল, ঠিক নয়।
হাবার্ট বলল–আপনার কথাই যে ঠিক তার কি মানে আছে। আমরা তো জানি বহুদিন আগেই আমার শাশুড়ির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর আদালতও তা ঘোষণা করেছে।
জেনিফার বলল–হ্যাঁ, আদালতের রায়ও আমি পড়েছি, সেখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিছুদিন অন্তর অন্তর আপনার শাশুড়িকে পরীক্ষা করাতে হবে।
হাবার্ট এবার দমে গেলেন। তিনি স্বাভাবিকভাব বললেন–আপনার বক্তব্য অনুযায়ী, আমার শাশুড়িকে ভালো ভাবে চিকিৎসা করালে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন? তাহলে তাকে আর পাগলা গারদে রাখার দরকার হবে না?
জেনিফার বলল–এই তো খুব সহজেই বুঝে ফেলেছেন। ওঁকে যাতে পাগলা গারদ। থেকে বের করে আনা যায় তার ব্যবস্থা আমি করবো। এবার জেনিফার ডরোথিকে লক্ষ্য করে বলল–আপনার মার যাবতীয় রোগের বিবরণ আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়েছি। তার থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি কোনোদিনই মানসিক রোগের শিকার হননি। তিনি দেহ ও মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ।
হাবার্ট বললেন–আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু সবাই জানে উনি একজন বৃদ্ধ উন্মাদ।
–আপনি কি আপনার শাশুড়িকে বলেছিলেন তার সব বিষয় সম্পত্তি আপনাকে দিয়ে দিতে? হঠাৎ প্রশ্নটা করায় হাবার্ট চমকে উঠেলেন। তবুও তিনি বললেন–এসব জেনে । আপনার কী লাভ।
কয়েক মুহূর্ত হাবার্টের দিকে তাকিয়ে জেনিফার বলল–আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। ধন্যবাদ, বলেই জেনিফার দরজার দিকে পা বাড়াল।
হাবার্ট এক লাফে জেনিফারের সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। তারপর আহত বাঘের মতো গর্জন করে বললেন–বুঝতে পেরেছি, টাকার অঙ্কটা আপনার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। আপনাকে এক হাজার ডলার দিচ্ছি। চুপচাপ এখান থেকে চলে যাবেন নাক গলাবেন না।
–দুঃখিত, আপনার সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতায় আসতে চাই না আমি।
আপনার কি ধারণা এর জন্য আমার শাশুড়ি আপনাকে আরও বেশি টাকা দেবেন?
জেনিফার হাবার্টের চোখে চোখ রেখে কর্কশ স্বরে বলল–আমি আপনার মতো অর্থপিশাচ নই।.
আদালতে নতুন করে মামলা দায়ের করলে জেনিফার। সে আবেদন পেশ করল শ্ৰীমতী হেলেন কুপার সত্যিই মানসিক রোগের শিকার কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করল। সরকারী মানসিক চিকিৎসকদের দিয়ে শ্রীমতী কুপারের পরীক্ষা করা হল। তাকে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ বলে ঘোষণা করলেন। আদালতের নির্দেশে হিদার্স অ্যাসাইলাম থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হল এবং আগের রায় খারজি করে তাকে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হল।
.
নিউ জার্সির খামারবাড়ি। সেখানে অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি ও মাইকেল মোরেটি একসঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন। খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন মাইকেল। সেদিনের প্রভাতী সংস্করণে প্রকশিত একটি প্রতিবেদনের ওপর তার চোখ আটকে গেল। তিনি আগ্রহান্বিত হয়ে প্রতিবেদনটি পড়লেন–শ্রীমতী হেলেন কুপার নামে এক ধনী বিধবাকে তাঁর মেয়ে জামাইয়ের ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধার করেছে জেনিফার পার্কার নামী একজন এ্যাটর্নী। শ্ৰীমতী কুপারকে তার মেয়ে জামাইরা পাগল প্রতিপন্ন করে তার যাবতীয় সম্পত্তি কুক্ষিগত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে জেনিফার আদালতে মামলা করে প্রমাণ করেছে যে শ্রীমতী কুপার সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। তারপর আদালতের সাহায্যে শ্ৰীমতী কুপারের সমস্ত বিষয়সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে দিয়েছে।
পড়া শেষ করে মাইকেল শ্বশুরকে বললেন–মেয়েটির ক্ষমতা আছে বটে।
অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি প্রশ্ন করলেন–কোন মেয়েটি?
মাইকেল কাগজে জেনিফারের ছবি দেখিয়ে বললেন–এই যে জেনিফার পার্কার। আমি ভাবছি আমাদের কিছু কিছু কাজ ওকে দিয়ে করাবো।
অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি আঁতকে উঠলেন না! না! একদম নয়, ওসব মেয়ে উকিল দিয়ে আমাদের কাজ চলবে না।
টনি, ওর প্রতিভা আছে।
তা মানি, কিন্তু দেখবে, আমাদের পরিবারের গোপন তথ্য যেন বাইরে ফঁস না হয়ে যায়।
–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
.
সেদিন দুপুরবেলা। জেনিফার নিজের অফিসে বসে একমনে একটা মামালার ব্রীফ পড়ছে, এমন সময় তার টেলিফোনটা বেজে উঠল।
রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ওপ্রান্ত থেকে অচেনা পুরুষের কণ্ঠস্বর জেনিফার শুনতে পেল।
-আমি মাইকেল মোরেটি বলছি। আপনার সঙ্গে দেখা হবে কি? বিশেষ প্রয়োজন আছে।
মাইকেল মোরেটি? নামটা শুনেই তার সারা শরীরে শিহরণ জাগল। অতীতের এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তার মনে পড়ে গেল।
–বলুন, আপনার কি প্রয়োজন মিঃ মোরেটি।
–সেটা টেলিফোনে বলা যাবে না, মিস পার্কার। তবে এটা জেনে রাখুন আমার প্রয়োজন মিটলে আপনি আপনার যোগ্য পারিশ্রমিক পেয়ে যাবেন।
জেনিফার ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলছিল তবুও সেটা প্রকাশ না করে বলল–মিঃ মোরেটি, আপনার প্রয়োজন মেটাতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া আমার পারিশ্রমিকের ব্যাপারটা আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কথাটা শেষ করেই সে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
জেনিফার যে লাইন কেটে দিয়েছে সেটা মোরেটি প্রথমে বুঝতে পারেন নি। যখন বুঝতে পারলেন তখন অনেকটা সময় চলে গেছে। মেয়েদের যে এত তেজ থাকতে পারে তা আগে তিনি জানতেন না। জেনিফারের ব্যবহার তাকে রুষ্ট করেনি বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। জেনিফার জানে না এইভাবে তার মুখের ওপর তাকে প্রত্যাখ্যান করার ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে। তাঁর ক্ষমতাও যে কত অসীম তা হয়তো জেনিফার জানে না। তা নাহলে এই ভুলটা সে করতো না। যদিও কোনোদিন সময় সুযোগ আসে তাহলে জেনিফারের সব তেজ দম্ভ ভেঙ্গে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন তিনি।
.
স্টুয়ার্ট নিডহ্যাম অ্যাডামকে বললেন–নির্বাচনী তহবিলের জন্য টাকা সংগ্রহের প্রথম পদক্ষেপ হবে শহরের বড় বড় বহুজাতিক সংস্থাগুলি, সেইসব সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে পার্টি দিতে হবে। তাদের ডিনারে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তারপর তাদের কাছ থেকে টাকা চাইব। এমনকি টিভিতেও সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যাডাম, তুমি শুনতে পাচ্ছো?
সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডাম ওয়ার্নার ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন তার মামাশ্বশুরকে। বললেন–হ্যাঁ, শুনছি স্টুয়ার্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অ্যাডামের মন পড়েছিল জেনিফারের দিকে, তার আশা নির্বাচনী প্রচার অভিযানে তার সঙ্গী রূপে জেনিফারও অংশগ্রহণ করুক। জয়লাভের আনন্দ তার সঙ্গে শেয়ার করার বাসনা তিনি প্রতিমুহূর্তে করছিলেন। জেনিফারের প্রসঙ্গটা স্টুয়ার্ট নিডহ্যামের কাছে উত্থাপন করতে গিয়েও তিনি বহু চেষ্টা করেও পারেননি। বরং ফল হয়েছে উল্টো। প্রতিবারই স্টুয়ার্ট অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। মনে হয় তিনি যেন আগে থেকে বুঝতে পেরে সাবধান হয়ে যেতেন।
এইরকম অবস্থায় অ্যাডাম নিজেকে অসহায় বোধ করেন। অ্যাডাম জানেন তার স্ত্রী মেরি-বেথ ও জেনিফার সম্পূর্ণ আলাদা জগতের মানুষ। তাদের দুজনের কেউ একে অন্যের তুল্য নয়।
জেনিফার আমার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। আমার সবকিছুতেই ওর সুখ। অন্যদিকে মেরিবেথ নিজের জগৎ নিয়েই বেশি খুশি থাকতে ভালোবাসে। অ্যাডাম মনে মনে দুজন নারীর মূল্যায়ণ করতে লাগলেন। জেনিফার সূক্ষ্ম রসবোধে আপ্লুত। আর মেরিবেথ রসকষহীন। মেরিবেথ সঙ্গে থাকলে মনে হয় আমার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় জেনিফারের পাশে থাকলে আমি যুবকের মতো মনোবল পাই। মেরিবেথ আমার ওপর নির্ভরশীল আর জেনিফার আত্মনির্ভরশীল।
আমার প্রেমিকা জেনিফারের সঙ্গে আমার যেমন বহুলাংশে মিল আছে তেমনি আমার স্ত্রী মেরিবেথের সঙ্গে অমিলও আছে প্রচুর। এত অমিল থাকা সত্ত্বেও আমি মেরিবেথকে ছেড়ে যেতে কখনই পারবো না।
শ্ৰীমতী হেলেন কুপারের মামলাটা মিটে গেছে বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। তিনি পাগলাগারদ থেকে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। এরপর থেকে জেনিফারের হাতে একের পর এক মামলা আসছে। এবং প্রত্যেকটিতেই তিনি সফল হচ্ছেন। এবার বনি গ্যারেট নামে এক যুবতী মেয়ের একটি জটিল মামলার সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ল। বনি গ্যারেট একবছর আগে রাস্তা পেরোতে গিয়ে একটি ট্রাকের নীচে পড়ে যায়, ফলে সে মারাত্মক ভাবে জখম হয়। হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডাক্তাররা তার দুটি হাত ও পা কেটে বাদ দেন। সম্পূর্ণ পঙ্গু ও অসহায় হয়ে তাকে জীবন কাটাতে হয়। সে যে ট্রাকের নীচে পড়েছিল তার মালিকের বিরুদ্ধে সে মামলা দায়ের করে। তার উকিল তার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করেছিলেন। কিন্তু বিচারকের রায়ে সে তার ক্ষতিপূরণ পায়নি। বিচারক তার দাবী বাতিল করে দেন। এবার সেই মামলাটা ফাদার রায়ানোর মাধ্যমে জেনিফারের হাতে আসে। জেনিফার নতুন করে মামলাটি শুরু করে এবং সফলও হন। ট্রাকের মালিক ক্ষতিপূরণ বাবদ বনিকে ষাট লক্ষ ডলার দেন।
এই মামলায় জয় হবার পরের দিনের সবকটি দৈনিক সংবাদপত্রের শিরোনামে শুধু একটিই নাম জেনিফার পার্কার। ওই মামলার সমস্ত বিবরণ ও জেনিফারের ভূয়সী প্রশংসা ওই কাগজগুলিতে ছাপা হয়েছিল। সেদিনও সে অফিসে গেল। টেবিলের ওপর ফুলদানীতে সে দেখতে পেল চার ডজন টকটকে লাল গোলাপের হাসি। তার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। সে ভাবল অ্যাডাম এত কাজের মাঝেও তাকে ভোলেনি। তাকে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
গোলাপ ফুলের গুচ্ছের মাঝখানে রাখা একটি সাদা কার্ড সে দেখতে পেল। সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল এটি অ্যাডাম পাঠাননি। এই কার্ডের প্রেরক মাইকেল মোরেটি। নামটি দেখেই তার শরীর মন রাগে ঘেন্নায় জ্বলে উঠল। জেনিফারকে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন।
কিভাবে এর জবাব দেবে জেনিফার ভাবছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তার সেক্রেটারী সিনথিয়া ইন্টারকমে জানাল অ্যাডাম টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
রিসিভার তুলে নিয়ে জেনিফার বলল হ্যালো, ডার্লিং।
অভিনন্দন তোমার জয়লাভের জন্য। তুমি যেভাবে একের পর এক জটিল মামলাগুলির সমাধান করছে তাতে খ্যাতির শীর্ষে উঠতে তোমার বেশিদিন লাগবে না।
–আমার সৌভাগ্য।
না না, তোমার সৌভাগ্য নয়, সৌভাগ্য তোমার মক্কেলদের।
জেনিফার কোনো মন্তব্য করল না।
অ্যাডাম আবার বললেন–আজ বিকেলে একটু বেরোতে পারবে, ডার্লিং?
জেনিফার উৎসাহিত হয়ে বলল হ্যাঁ, পিরবো। কখন কোথায় যেতে হবে?
–ম্যারিওতে, বিকেল ছটায়।
ঠিক আছে। রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। এরপর সে সিনথিয়াকে ডাকল এবং ওই গোলাপ ফুলের গুচ্ছগুলো তাকে দিয়ে দিল।
ম্যারিও রেস্তোরাঁতে ছটা বাজার আগেই এসে অপেক্ষা করছেন অ্যাডাম। জেনিফার এসে পা রাখল ওই রেস্তোরাঁতে। সে দেখল অ্যাডাম কোণের একটা টেবিলে বসে আছেন। সে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিল, অ্যাডামের প্রস্তাব যতই নির্মম হোক না কেন সে নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা করবে। অ্যাডামের চোখমুখও খুব শুকনো দেখাচ্ছে। হয়তো তিনিও মানসিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত। জেনিফার অ্যাডামের মুখোমুখি বসল। তার হাত নিজের হাতে নিয়ে অ্যাডাম বললেন–জেনিফার, মেরিবেথ আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছে।
জেনিফার চমকে উঠল। সে বোকার মতো অ্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ওঁর বক্তব্য কিছুই বুঝল না।
জেনিফার জানে না ঘটনার সূচনা হয়েছিল আগের দিন একটি ডিনার পার্টিতে। নির্বাচনী তহবিল গড়াকে কেন্দ্র করে একটি ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। সেই পার্টিতে সস্ত্রীক অ্যাডামও উপস্থিত ছিলেন, ডিনার শেষে তিনি একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। তারপর তারা যথাসময়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে মেরিবেথ গম্ভীর মুখে চুপচাপ ছিল।
জয়লাভের আশু সম্ভাবনায় অ্যাডাম পরিতৃপ্ত, তাই তিনি স্ত্রীর ভাবান্তর লক্ষ্য করেননি। অতএব শুতে যাবার আগে তিনি বললেন–আজকের সন্ধ্যাটা দারুণ কাটলো, তাই না মেরি?
মেরিবেথের সংক্ষিপ্ত উত্তর–হ্যাঁ।
কয়েক মুহূর্ত অ্যাডামের দিকে তাকিয়ে মেরিবেথ গম্ভীর গলায় বলেছিল–তোমার ও জেনিফারের সম্পর্কে আমার কিছু বলার ছিল।
সরাসরি আঘাতটা যে নিজের স্ত্রী করতে পারবে এইভাবে তা অ্যাডামের ভাবনার অতীত ছিল। একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন তিনি, ভাবছিলেন ওই সম্পর্কের কথা বেমালুম অস্বীকার করবেন। আবার মেরিবেথ বলল–কয়েকদিন আগেই কথাটা আমার কানে আসে। কি করবো ভেবে পচ্ছিলাম বলে এতদিন নীরবে সব সহ্য করেছি। কিন্তু এখন আর সহ্য করতে পারছি না। আমি স্থির করেছি, আমি তোমার সুখের পথে আর কাটা হব না।
অ্যাডাম বলার চেষ্টা করলেন–মেরিবেথ, আমি তোমার কথা কিছুই…।
মেরিবেথ তাকে বাধা দিয়ে বলল–আমি জানি আমাদের সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। হয়তো আমারই দোষ। স্ত্রী হিসেবে যা দেবার আমি তোমাকে তা দিতে পারিনি। কিন্তু আমি তোমাকে এখনও ভীষণ ভালোবাসি, তোমাকে আঘাত আমি করতে পারবো না। এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তোমার সামনে পড়ে আছে। আমি সেটা নষ্ট করতে চাই না। আমি তোমায় সুখী করতে পারি না। যদি জেনিফার পার্কারের সংস্পর্শে এসে তুমি সুখী হও তাতে আমি বাধা দেব না।
অ্যাডাম নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি চমকে উঠে বললেন–কি বলছো মেরি? যা ঘটেছে তাতে তো তোমার কোনো দোষ নেই, আমি…।
-প্লিজ অ্যাডাম, তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আর। আমি যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়েছি।
অ্যাডাম আমতা আমতা করে বললেন কিন্তু কিন্তু, তোমার কি হবে, মেরি?
মেরিবেথ মুখ টিপে হেসে বলল–আমার জন্য চিন্তা কোরো না অ্যাডাম, আমি ভালই। থাকবো।
আমায় কিছু বলতে দাও, মেরি।
-তোমার কিছু বলার নেই। যা বলার আমিই বলে দিয়েছি। তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে তোমার জীবনটাকেই অতীষ্ঠ করে তুলবো শুধু, এতে তোমার বা আমার কোনো লাভই হবে না। নিশ্চয়ই আমার থেকে জেনিফারের মধ্যে আকর্ষণী শক্তি বেশি আছে। তাই সে তোমার মন প্রাণ জুড়ে বসে আছে। সবসময় তুমি ওর কথা ভাবো। কথাগুলো বলতে বলতে মেরিবেথ অ্যাডামের দিকে এগিয়ে এল। আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। তার মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল কতদিন বাদে তোমায় এত কাছে পেলাম বলোতো অ্যাডাম? তুমি আমায় ভালোবাসো না আমি জানি। তাই নতুন করে কিছু বলার দরকার নেই। কিন্তু একবার–এই শেষবার আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে, প্লীজ? আগের মতো আদর করবে? শুধু একবার তোমায় কাছে পেতে চাই আগের মতো।
–সত্যিই মেরি তোমার, তুলনা নেই।
ধন্যবাদ অ্যাডাম। মেরিবেথ হেসে বলল–আমি আজ থেকে তোমার সেরা বন্ধু হলাম। আমি চিরকাল তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখবো।
আগের রাতের মেরিবেথের ওই মারাত্মক সিদ্ধান্ত ঘোষণার কথা আবার মনে পড়ে গেল অ্যাডাম ওয়ার্নারের। তার বুকের ভেতরটা ঝড়ের তাণ্ডবে মুচড়ে যেতে লাগল।
জেনিফারকে অ্যাডাম বললেন–মেরিবেথই ডিভোর্সের পরিকল্পনা করেছিল। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলা উচিত তা জেনিফার ভেবে পাচ্ছে না। জেনিফারের ভাবনার সঙ্গে এর কোনো সংগতি নেই।
অ্যাডাম আবার বললেন আমাদের দুজনের কথা ভেবে ও এই সিদ্ধান্তে এসেছে। আর ও নিশ্চয়ই এতে সুখীই হবে।
–কথাটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না আমার।
–জানি, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, আমরা বিয়ের পর থেকেই ভাইবোনের মতো রাত কাটিয়েছি। কথাটা তোমায় আগে বলিনি। এখনও বলতে সংকোচ হচ্ছে, তবু বলছি, মেরিবেথের মধ্যে সেক্সের অভাব।
জেনিফার আশ্চর্য হয়ে বলল–তাই নাকি?
-হ্যাঁ, ও তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলেছে।
মেরিবেথ, তার সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনে জেনিফার বেশ বিচলিত হয়ে পরল। সে বলল–ওঁর সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় অ্যাডাম। তার সামনে আমাকে অপ্রস্তুতে পড়তে হবে। তবে তুমি যদি বলো তাহলে আমি দেখা করতে রাজী আছি।
এবার চলো ফেরা যাক। তোমাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি।
না, তোমাকে যেতে হবে না, আজ আমি একাই যাব।
.
অ্যাডাম ওয়ার্নারের বাড়ির পাশ দিয়ে হাডসন নদী বয়ে গেছে। কয়েক একর জমির ওপর তার বাড়িটি অবস্থিত। পরদিন সকালে জেনিফার এসে হাজির হল সেখানে। সে নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছিল। নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে সে গাড়ি থেকে নামলো। সে দরজার গায়ে লাগানো কলিং বেল টিপলো।
কিছু সেকেন্ড কেটে গেল। চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এক সুন্দরী মহিলা দরজা খুলে দিল। এই বয়সেও তার চেহারা অসম্ভব আকর্ষণীয়। সুন্দরীর পরনে উলের স্কার্ট ও সিল্কের ব্লাউজ এবং গলায় মুক্তোর মালা। লম্বা বাদামী চুল। জেনিফার অনুভব করল কেমন যেন সেকেলে রুচি ও ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী এই মহিলাটি।
সুন্দরী মহিলা সলজ্জ হেসে বলল–আমি মেরিবেথ, ভেতরে এসো। তারপর জেনিফারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। ১. জেনিফার তার পেছন পেছন বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বিশাল বিশাল সব ঘর। সেগুলি দামী ও দুর্লভ প্রাচীন শিল্প সামগ্রী ও সুন্দর সুন্দর ছবি দিয়ে সাজানো। তারা ড্রইং রুমে এসে বসল। একজন বাটলার রুপোর টি সেটে চা এনে দিল।
চা খেতে খেতে মেরিবেথ বলতে শুরু করলো–অ্যাডামকে নিশ্চয়ই তুমি খুব ভালোবাসো।
জেনিফার লজ্জিত হয়ে বলল–মিসেস ওয়ার্নার, আমাদের তেমন কোনো প্ল্যান নেই।
অন্তরঙ্গতার সুরে মেরিবেথ বলল–তা আমার জানার দরকার নেই। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি। কিন্তু বিয়েটা সুখের হয়নি। তা অবশ্য তোমাকে অ্যাডাম বলেছে। কিন্তু আজও আমরা উভয়ে উভয়কে আগের মতোই ভালোবাসি। প্রথম দেখাতেই আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ছোট থেকেই আমাদের দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। যেখানে গিয়েছি সেখানেই আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা যেত। যা খেতাম দুজনে ভাগ করে খেতাম। মানুষ তো আর সব সময় এক থাকে না। তাই আমাদের সম্পর্কের মধ্যেও চিড় ধরল।
মেরিবেথের দিকে তাকিয়ে জেনিফার বলল–আমি আপনার কাছে কতটা কৃতজ্ঞতা ভাষায় বোঝাতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম আমাদের এই সাক্ষাৎকার হয়তো কুৎসিত তর্কযুদ্ধে পরিণত হবে। আপনি আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করছেন। তাই অ্যাডামকে সমর্থন না করে পারছি না আমি সত্যিই আপনার কোনো তুলনা হয় না।
মেরিবেথ বলল–ধন্যবাদ। তবে আমি এখনই ডিভোর্স নিচ্ছি না। অ্যাডামের স্বার্থের কথা চিন্তা করে নির্বাচন অবধি আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।
মেরিবেথের মুখে নির্বাচনের কথা শুনে জেনিফার চমকে উঠল। সে এই ব্যাপারটা নিয়ে অত চিন্তা-ভাবনা করেনি।
–সবাই ধরে নিয়েছে অ্যাডাম সেনেটর হবে, এই সময় ডিভোর্স করলে ব্যাপারটা আর কারও অজানা থাকবে না। এর ফলে ওর ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকছে। আর তো মাত্র ছটা মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। কিন্তু তোমার এতে আপত্তি নেই তো?
না না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে এক মত। দেখবেন অ্যাডাম সেনেটর হিসেবে খুব নাম করবেন।
মেরিবেথ বলল–আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি অ্যাডাম ওয়ার্নার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত।
এরপর জেনিফার আগামী দিনগুলির কথা নতুন করে ভাবতে বসলো। আর কিছুদিন পরে সে অ্যাডামের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা পড়বে। অ্যাডাম সেনেটর হয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে যাবে। তাকেও সেখানে চলে যেতে হবে। তখন সে আর নিউইয়র্কের স্বাধীন উকিল থাকবে না, হয়তো অ্যাডামের ইচ্ছেতে তাকে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিতে হবে।
মেরিবেথকে বিদায় জানিয়ে জেনিফার ফিরে এল নিজের ফ্ল্যাটে। তার কয়েক সেকেন্ড পড়ে অ্যাডামের ফোন এল। জেনিফার হ্যালো বলতেই অ্যাডাম জানতে চাইল-মেরিবেথকে কেমন লাগল জেনি?
চমৎকার, অ্যাডাম।
–মেরিবেথও তোমার সম্পর্কে ওই একই কথা বলেছে। আচ্ছা আমাদের বিয়েটা টাইমস স্কোয়ারে হলে কেমন হবে, বলো তো?
-খুব ভালো হবে, তবে আমাদের আরও ছটা মাস অপেক্ষা করতে হবে, ডার্লিং।
–কিন্তু, কেন বলো তো?
–নির্বাচন শেষ হোক, তুমি জয়যুক্ত হও, সেনেটর পদ লাভ করো, তারপর না হয় করা যাবে। তোমার ডিভোর্সের খরবটা জানাজানি হলে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তোমার চরিত্রে কালি ছেটাবে, এতে তোমার ক্ষতি হতে পারে। আমি হতে দিতে পারি না। তাই ছমাস অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
.
এদিকে অ্যাডাম ওয়ার্নার ও জেনিফার পার্কার অবাধে মেলামেশা করতে শুরু করেছেন। তবে তারা একটু সতর্ক হয়েছেন। অ্যাডামের নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়েছে, প্রতিটি গণমাধ্যমের সাহায্যে অ্যাডাম ইতিমধ্যেই দেশের জনমানসের খাতির ও শ্রদ্ধা লাভ করেছেন। তাই তাদের, ঘনিষ্ঠতা লোকসমক্ষে এসে পড়লে ঝঞ্ঝাট বাড়বে বই কমবে না।
একরাতে জেনিফারের ফ্ল্যাটে দুজনে বসে বসে ফায়ারপ্লেসে আগুনের উষ্ণ তাপ উপভোগ করছেন। এমন সময় অ্যাডাম বলল–প্রেসিডেন্টের বউ হতে তোমার কেমন লাগবে, জেনি?
–ভীষণ ভালো লাগবে।
–আমি ভোটে জিতলে তোমাকেও আমার সঙ্গে ওয়াশিংটনে গিয়ে থাকতে হবে জেনি, নাকি নিউইয়র্ক থেকে তোমার আইন ব্যবসা চালিয়ে যাবে?
–আমি শুধু তোমাকে চাই, আর কিছুতে আমার লোভ নেই অ্যাডাম।
জেনিফারের ঘন তামাটে চুলে বিলি কাটতে কাটতে অ্যাডাম বললেন, আমার জন্য তোমাকে ওকালতি ছাড়তে হবে না। তবে তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও ভালো লাগবে না জেনি।
তারা অনেক রাত অবধি গল্প করলেন, শেষে একসময় দুজনে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
এদিকে জেনিফারের পসার আকাশচুম্বী হয়ে উঠল। তার মক্কেলদের নামের তালিকায়। কে নেই? বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, চেয়ারম্যান, সেনেটর, ফিল্মস্টার, খেলোয়াড়, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সবাই এসে তার অফিসে ভীড় করেন। তাছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন আর রাজনৈতিক দলের নেতাদের থেকে শুরু করে চোর, ডাকাত, পকেটমার, ধাপ্পাবাজ, বেশ্যা কেউ বাদ গেল না। জেনিফার যেমন জলের মতো টাকা আয় করতে লাগল তেমনি, তার অফিসের কর্মচারীরাও মোটা টাকার বেতন ও বোনাস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হল না। এর পাশাপাশি আছে নানারকম দামী উপহারের সম্ভার।
বিভিন্ন নামী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাকে মামলা লড়তে হয়। এর ফলে দেশ বিদেশের সেরা আইনজ্ঞদের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে।আর এঁদের মধ্যে অনেকেই তাদের স্বীয় দেশে এক একজন আইনের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। জেনিফার নিজের প্রতিভা বলে এঁদের অনেককেই পরাস্ত করতে পেরেছে। এবার আইনের উচ্চতর শিক্ষণ লাভের জন্য সে আমেরিকার কলেজ অফ ট্রায়াল ল ইয়ার্সে ভর্তি হল।
খবরটা পেয়ে অ্যাডাম চমকে উঠলেন, জেনিফারকে ফোনে বললেন–তোমার ক্ষমতার বাহবা না দিয়ে পারছি না। যেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় উকিলরা অনেক কসরত করে ভর্তি হন, আর সেখানে কিনা তুমি ভর্তি হয়েছে?
–সেদিক থেকে মেয়ে উকিল হিসেবে আমি একটা নজির সৃষ্টি করতে পেরেছি, কী বলল।
মামলার জন্য তাকে ম্যানহাটানে যেতে হয়। সেখানে তাকে প্রবল প্রতিপক্ষ ডি সিলভার মুখোমুখি হতে হত। যতই জেনিফারের কৃতিত্বের পারদ বাড়ছিল ততই রবার্ট সিলভার জমে থাকা পুরনো রাগও বাড়ছিল। একদিন একটি মামলার আসামী পক্ষের উকিল হয়েছিল জেনিফার আর সরকারী উকিল রবার্ট ডি সিলভা ছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী। জেনিফার সওয়াল করার সময় রবার্ট ডি সিলভার বিরুদ্ধে এমন একটি যুক্তি দেখিয়েছিল যা শুনে বিচারক পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন।
ওই মামলায় রবার্ট ডি সিলভা সাক্ষী হিসেবে বারো জন বিশেষজ্ঞকে এনেছিলেন। তারা সবাই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু জেনিফারের হাতে কোন বিশেষজ্ঞ ছিল না। সওয়াল করতে উঠে সে জুরীদের উদ্দেশ্যে বলল–আকাশের বুকে যেসব তারা বা নক্ষত্র আছে তাদের দূরত্ব মাপতে বা স্পেসশিপ তৈরি করতে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সময় আমরা সাধারণ মানুষদের ডাকি। তাদের মতামত নিই, কিন্তু তাদের কেউই বিশেষজ্ঞ নন। আমি জানি খ্রীষ্টধর্মের প্রবর্তক ঈশ্বরের সন্তান যীশু, তিনিও এই কাজ করেছিলেন। তার এই যুক্তি খন্ডন করার সাধ্য রবার্ট ডি সিলভার ছিল না। শেষপর্যন্ত সেই মামলায় জেনিফারেরই জয় হল।
.
প্রতিবারই জেনিফার লক্ষ্য করেছে মামলা জেতার পর তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চার ডজন তাজা গোলাপ ফুল পাঠান মাইকেল মোরেটি। ক্রোধে অন্ধ হয়ে সে কার্ডটাকে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে এবং সেক্রেটারী সিনথিয়াকে ডেকে নির্দেশ দিত ওই ফুলগুলো ফেলে দিতে। মাইকেলের এই বেয়াদপি সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারতো না। শেষে বিরক্ত হয়ে মাইকেলকে কড়া ও তিক্ত ভাষায় একটা চিঠি লিখে পাঠাল। তাতে উল্লেখ ছিল–তিনি যেন আর কখনও তাকে গোলাপ ফুল না দেন। মাইকেল মোরেটি চিঠিটি পড়ে কি বুঝেছিলেন তা তিনি নিজেই জানেন। কিন্তু মামলায় জেতার পর জেনিফারকে গোলাপ ফুল ও অভিনন্দন বার্তা পাঠানো বন্ধ করেননি।
.
কিছুদিন বাদে ফাদার রায়ান একজন মক্কেল পাঠালেন জেনিফারের কাছে। এই মক্কেলটির বিরুদ্ধে ব্যাঙ্ক ডাকাতির অভিযোগ আনা হয়েছে। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। নাম তার পল রিচার্ডস। এক বর্ষার দিনে একটি ব্যাঙ্কে ঢুকে দেড় লাখ ডলার লুঠ করে সে পালিয়ে গিয়েছিল একটি সবুজ রঙের সিভানে চেপে। তার পরনে ছিল লম্বা কালো বর্ষাতি। কলার তুলে মুখটাকে ঢেকে রেখেছিল। লম্বা বর্ষাতির আড়ালে একটি বন্দুক লুকিয়ে রাখতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি। তাই সে এই ঘোর বর্ষার দিনটি ডাকাতি করার জন্য বেছে নিয়েছিল।
ব্যাঙ্কে ঢুকে বন্দুক দেখিয়ে সে ক্যাশিয়ারকে নির্দেশ দিয়েছিল সব টাকা কড়ি তার হাতে তুলে দেবার। ক্যাশিয়ারও ভয়ে নীরবে পল রিচার্ডসের নির্দেশ মেনেছিল। সেইসময় যারা ওই ব্যাঙ্কে উপস্থিত ছিলেন তারা বলেছেন ওই গাড়ির নম্বর প্লেটের ওপর এত কাদা মাখানো ছিল যে তাদের পক্ষে ওই নম্বর পড়া সম্ভব হয়নি।
ওই ডাকাতির তদন্তের ভার পড়েছিল এফ বি আই-এর ওপরে। এফ বি আই কম্পিউটারের সাহায্যে জানতে পেরেছে ওই ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে পল রিচার্ডসের দ্বারা। বার বার ওই নামটি কম্পিউটারের পর্দায় ফুটে উঠছিল। এখন সে জেল হাজতে বন্দী। আছে।
ফাদার রায়ানের অনুরোধে মামলাটি হাতে নিল জেনিফার। সে পল রিচার্ডসের সঙ্গে কথা বলার জন্য জেলে এসে হাজির হল।
জেনিফার লক্ষ্য করল, লোকটির বয়স পঞ্চাশের ওপর, চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে, তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিল সত্যিই কি এই লোকটি ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছে?
পল জেনিফারকে দেখেই বলল বিশ্বাস করুন, আমি ব্যাঙ্ক ডাকাতি করিনি। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করছি।
জেনিফার এখন আর দিব্যি বা শপথে প্রভাবিত হয় না। সব মক্কেলই নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য এইরকম দিব্যি বা শপথ করে থাকে। তাই সে বলল–আগে আমার কথা শোনেন, যে মক্কেল মিথ্যে সাক্ষী দেয়, তার মামলা আমি নিই না।
বিশ্বাস করুন, করুণ স্বরে আবার পল রিচার্ডস বলল।
–তবে এফ বি আই তোমাকে গ্রেপ্তার করল কেন?
একবার ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে গিয়ে আমি ধরা পড়েছিলাম। সেও দশ বছর আগের কথা।
–সেবার কি তুমি রেনকোট পরে ও ছোটো বন্দুক নিয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকেছিলে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ
–এবারের ডাকাতি তুমি করোনি বলছো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তাহলে কে করলো?
–অন্য কেউ হবে, আমি বলতে পারবো না।
এই মামলার প্রাথমিক শুনানী পড়েছে জজ ফ্রেড স্টিভেন্স-এর এজলাসে। ইনি ভয়ংকর কড়া মেজাজের মানুষ। এঁর মন কঠিন ধাতুতে গড়া। এঁর বিচারে যদি কেউ দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে তিনি সেই আসামীকে বহুদূরের এক দ্বীপে স্থানান্তরিত করবেন যেখান থেকে কেউ জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারে না। এছাড়া তিনি ইসলামদের মতো চুরির অপরাধে অভিযুক্ত আসামীর দু হাত কেটে ফেলার বিধানকেও সমর্থন করেন। এসবই জেনিফারের অজানা নয়। এই ধরনের বিচারকের কাছে নিজের মক্কেলের নির্দোষিতা প্রমাণ করা ভীষণ শক্ত কাজ। তাই পল রিচার্ডসের মামলা ওঁর এজলাসে পড়েছে শুনে সে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে কেন বেইলির সাহায্য নিল।
কেন এলে তার কাছে জজ স্টিভেন্স সম্পর্কে গোপন তথ্য জানতে চাইল জেনিফার। কেন বেইলি শুনে চমকে উঠল। সে তাকে নিরস্ত করতে চাইল। কিন্তু জেনিফার জেদী মেয়ের মতো বলল–যেভাবেই হোক আমাকে এই মামলাটা লড়তে হবে।
এবার আর রবার্ট ডি সিলভা নয়। এবার ব্যাঙ্ক ডাকাতির ওই মামলার দায়িত্ব ভার নিয়েছেন সরকারী উকিল কার্টার গ্লিফোর্ড। কার্টার গ্লিফোর্ডের বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞ ব্যক্তি। একদিন তিনি জেনিফারকে বললেন কি মিস পার্কার, মামলা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে?
জেনিফার শান্তভাবে বলল–আমি আমার মক্কেলকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবো মাত্র মিঃ গ্লিফোর্ড।
মিঃ গ্লিফোর্ড মুচকি হেসে বললেন, এবার তাহলে আপনার হার নিশ্চিত। তা নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হবে।
.
জজ ফ্রেড স্টিভেন্সের এজলাসে মামলা শুরু হল–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম পল রিচার্ডস।
জজ বললেন–আসামী হাজির? পেশকার বলল হাঁ হুজুর।
দুপক্ষের উকিলরা এসেছেন?
–হ্যাঁ ধর্মাবতার।
সরকারী তরফের উকিল কার্টার গ্লিফোর্ড এবং আসামী তরফের উকিল জেনিফার পার্কার উঠে দাঁড়ালেন। তারা যে যার পরিচয় দিলেন।
জেনিফারের দিকে তাকিয়ে বিচারক বললেন–আপনার প্রতিভা ও সুনামের কথা আমি শুনেছি, মিস পার্কার। একটা কথা জেনে রাখুন, আমি অযথা আদালতের সময় নষ্ট করতে দেব না। সওয়াল আর শুনানী শেষ হলেই আমি বিচারের দিন ধার্য করবো। আপনি কি জুরীদের মতামত নিতে আগ্রহী?
না, ধর্মাবতার। আমার মতে সওয়াল আর জেরা এই মামলার পক্ষে যথেষ্ট। জজ ফ্রেড স্টিভেন্স অবাক হয়ে জেনিফারের দিকে তাকিয়ে বললেন–সে কি?
হ্যাঁ, ধর্মাবতার, আমার মতে আমার মক্কেলকে ফাঁসানোর মতো যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ সরকারী উকিলের হাতে নেই।
কার্টার গ্লিফোর্ড বাধা দিয়ে বললেন–ধর্মাবতার, যে অপরাধে আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই একই অপরাধের জন্য তাকে এর আগেও একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সাজাও পেয়েছিল সে। সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের ভেতর থেকে কম্পিউটার আসামীকে খুঁজে বের করেছে। তার বিরুদ্ধে যে মামলা রুজু করা হয়েছে তা খারিজ করার অভিপ্রায় সরকারের নেই।
বিচারক জেনিফারকে প্রশ্ন করলেন–আপনার কিছু বলার আছে, মিস পার্কার?
আছে ধর্মাবতার, এফ বি আই ধৃত ব্যক্তির কাছ থেকে ডাকাতি হওয়া কোনো টাকাকড়ির হদিস পায়নি। তাছাড়া এমন কোনো সাক্ষী নেই যিনি ডাকাতির অভিযোগে পল রিচার্ডসকে সনাক্ত করতে পারেন। অথচ মাননীয় সরকারী অ্যাটর্নি নিজের কল্পনার ওপর নির্ভর করে আমার মক্কেলকে ওই অপরাধের জন্য দায়ী করছেন।
জজ জেনিফারের কাছে জানতে চাইলেন–কিন্তু কম্পিউটার যে তথ্য দিয়েছে তার কি কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে?
জেনিফার বলল–ধর্মাবতার, ওইখানেই তো জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
জজ গম্ভীর গলায় বললেন–তা তো স্বীকার করতেই হবে। মানুষ সাক্ষীকে জেরা করা সহজ কিন্তু যন্ত্রের ক্ষেত্রে সেটা খুবই শক্ত ব্যাপার।
বিনয়ে গদগদ হয়ে কার্টার গ্লিফোর্ড বললেন–আপনি ঠিক বলেছেন ধর্মাবতার।
–এফ বি আই কি ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করে, আই বি এম-এর ৩৭০/১৬৮ কী?
জেনিফার বলে উঠল–ঠিক বলেছেন, ধর্মাবতার, এর মতো সূক্ষ্ম ও অভ্রান্ত কম্পিউটার অত্যন্ত দুর্লভ।
জজ আবার বললেন–তাহলে আপনি কি ওই কম্পিউটারের রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চান, মিস পার্কার।
এতখানি ধৃষ্টতা দেখানোর মতো সাহস আমার নেই ধর্মাবতার। এমন একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এই আদালতে উপস্থিত আছেন যিনি ৩৭০/১৬৮ কম্পিউটার প্রস্তুত করেন। যে কম্পিউটার থেকে আমার মক্কেলের নামের রিপোর্ট পাওয়া গেছে তার প্রোগ্রামার উনি।
–তিনি কে?
পেছনের সারিতে বসে থাকা একজন লম্বা রোগা ভদ্রলোক বিচারকের সামনে এসে দাঁড়াতেই জেনিফার তার পরিচয় দিলেন–এঁর নাম এডওয়ার্ড মনরো, একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। আমি ওঁকে অনুরোধ করেছি সম্ভব্য অভিযুক্ত আরও কয়েকজনের নাম কম্পিউটারের কাছ থেকে জেনে নিতে। সেই রিপোর্ট থেকে আমি দশজন লোককে বেছে নিয়েছি, যাদের সঙ্গে আমার মক্কেলের হুবহু মিল আছে। সনাক্তকরণের সুবিধার জন্য মিঃ মনরো বয়স, উচ্চতা, চোখের মনির রং, জন্মস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব, দিয়েছেন। তিনি আমার মক্কেলের নাম পেয়েছেন ওই সব তথ্যের ওপর নির্ভর করে।
এসবের মাধ্যমে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন, মিস পার্কার।
আমি বোঝাতে চাইছি এই যে কম্পিউটার ওই দশ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির মধ্যে–: একজনকে ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে সনাক্ত করেছে। … )
–একথা সত্যি? বিচারক মিঃ মনরোকে জিজ্ঞাসা করলেন।
–হ্যাঁ, ধর্মাবতার, বলে এডওয়ার্ড মনরো তার ব্রীফকেস খুললেন। তার ভেতর থেকে একটি রিপোর্ট বের করে জজের সামনে রাখলেন।
রিপোর্টটায় চোখ বোলানোর সঙ্গে সঙ্গে জজ রাগে হুংকার দিয়ে উঠলেন আমার সঙ্গে কি আপনি রসিকতা করছেন, মিঃ মনরো।
–আজ্ঞে না, ধর্মাবতার, মিঃ মনরো ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলেন।
–আপনার কম্পিউটার তো আমাকেও সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছে, জজ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, তাহলে কি আমিও ব্যাঙ্ক ডাকাতদের একজন?
জেনিফার পরিস্থিতিটা সামলাবার জন্য বলতে শুরু করল–ধর্মাবতার, আমরা সবাই জানি কম্পিউটার একটি যন্ত্র। এটি যুক্তি বা বুদ্ধির ধার ধারে না। আপনার আর আমার মক্কেলের বয়স, উচ্চতা, জন্মস্থান এক। এমন কি আপনারা দুজনেই সবুজ রঙের সিভান গাড়ি চড়েন। মাননীয় সরকারী উকিলের হাতে এটাই একমাত্র প্রমাণ। আমার বক্তব্য হল এই, দশ বছর আগে পল রিচার্ডর্স ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে ও ধরা পড়ে। সে খবর সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশের সব লোক জানতে পারে। তাই যে কোনো লোক তার অপরাধের ধরন, অনুকরণ করে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতেই পারে। আর মাঝখান থেকে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল পল রিচার্ডস নিজে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে সরকারী উকিলের যুক্তি কতটা ভিত্তিহীন।
কার্টার গ্লিফোর্ড নীরবে জেনিফারের সব অপমান হজম করে নিলেন।
জজ স্টিভেন্স কম্পিউটার রিপোর্টে আরেকবার চোখ বোলালেন। তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি বললেন–আচ্ছা মিস পার্কার, মনে করুন আমার থেকে বয়সে ছোট, রোগা ও নীল রঙের গাড়ি চড়ে এমন কেউ এই আদালতে উপস্থিত আছেন, তাহলে আপনি কিভাবে সমাধান করতেন?
ধর্মাবতার, আপনাকে তো আমি আগেই জানিয়েছি, কম্পিউটার আমাকে আরও দশজন সম্ভাব্য সন্দেহজনক ব্যক্তির নাম ও তাদের বিবরণ দিয়েছে। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী একজন আছেন এখানে, আমি তাকেও সন্দেহভাজনদের একজন ধরে নেব। এইরকম একজন হলেন রবার্ট ডি সিলভা।
জেনিফার নিজের অফিসে বসে আছে। তার হাতে ধরা একটি খবরের কাগজ। এমন সময় সেক্রেটারী সিনথিয়া পল রিচার্ডসের আগমন বার্তা জানাল।
–ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও, সিনথিয়া।
কালো রেনকোট পরিহিত পল রিচার্ডস একটু পরেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। সে বলল–আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এলাম, মিস পার্কার।
মিঃ রিচার্ডস, দেখলেন তো ন্যায়ের জয় সর্বত্র।
–হ্যাঁ, দেখলাম। আমি কিছুদিনের জন্য শহর ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি, বলেই জেনিফারের হাতে লাল ফিতেয় বাঁধা একটা লজেন্সের বাক্স দিল সে। আপনার জন্য এই ছোট্ট উপহারটি এনেছি।
জেনিফার বলল–ধন্যবাদ পল।
মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে পল রিচার্ড বিদায় নিল।
বাক্সটা খুলতেই জেনিফারের চোখের সামনে ভেসে উঠল দশ হাজার ডলার, ওই বাক্সটার ভেতর থরে থরে সাজানো। সে তো অবাক।
.
একদিন বিকেলে মাইকেল মোরেটি একটা কালো রঙের ক্যাডিলাক লিমুজিন চড়ে আদালতে এলেন। গাড়ি থেকে তিনি নামলেন না। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে ভেতরে বসে রইলেন। ঠিক সেই সময় জেনিফার আদালত থেকে বের হয়ে গাড়িটার কাছাকাছি আসতেই মাইকেল মোরেটি গাড়ি থেকে নেমে তার পথ আটকে দিলেন। জেনিফারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বললেন–আপনার জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করছি, মিস পার্কার।
জেনিফার রাগে ফুঁসে উঠে বলল–আমার পথ আটকাবার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? আমার সামনে থেকে সরে যান।
আহা, রাগ করছেন কেন? আমি আপনাকে কয়েকটা কথা বলব। দশ মিনিটের বেশি সময় নেব না। আপনাকে ধৈর্য ধরে ঠান্ডা মাথায় শুনতে হবে। অবশ্য তার বিনিময়ে আপনি পারিশ্রমিক পাবেন। আমার গাড়িতে উঠে পড়ুন, আপনার অফিসে পৌঁছে দেব। আর সেই ফাঁকে আমার কথা বলা হয়ে যাবে।
জেনিফার কৌতূহলী হয়ে উঠল। সে ভাবল দেখাই যাক না লোকটার কি মতলব। তাই সে বলল ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে যাব আমি, কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব আমি চাই।
মাইকেল সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বললেন–বলুন কি প্রশ্ন?
-খামের ভেতর মরা ক্যানারী পাখী ঢুকিয়ে আমার হাত দিয়ে ক্যামিলো স্টেলাকে পাচার করার অভিসন্ধি কে করেছিল?
মাইকেল মোরেটি স্বীকার করলেন–আমি।
রাগে জেনিফারের মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল, একবার তার মনে হয়েছিল মাইকেলকে খুন করে ফেলে। কিন্তু তা পারবে না বুঝতে পেরে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল। তারপর ড্রাইভার মোরেটির নির্দেশে জেনিফারের অফিসের দিকে গাড়ি ছোটালো।
মাইকেল মোরেটি এতক্ষণে জেনিফারকে বললেন–আপনার জন্য আমি গর্ব অনুভব করি।
–আপনি নিশ্চয়ই আমাকে একথা শোনানোর জন্য গাড়িতে তোলেন নি?
না তা তো নয়ই, এর পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে।
–সেটা কি?
অতীতে আপনার যে ক্ষতি আমি করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিন আমাকে। আমি সম্ভ্রান্ত অনেক মক্কেল পাঠাতে পারি। তারা অনেক টাকা পারিশ্রমিক দেবে। আর এতে আপনি প্রচুর টাকার মালিক হতে পারবেন।
মিঃ মোরেটি, আর কোনো কথা নয়, যথেষ্ট হয়েছে, জেনিফার যে মোরেটির ওপর মোটেই সন্তুষ্ট নয় তা হাবভাবে বুঝিয়ে দিল।
আমি আপনার উপকার করতে চাইছি আর আপনি আগের মতই রাগ দেখাচ্ছেন।
আপনার উপকার আমার দরকার নেই, প্লীজ। কোনও মক্কেল আমার কাছে পাঠাবেন না।
-কেন?
–কেননা আমি মাফিয়াদের সেবা করতে রাজী নই।
ট্রাফিকের লাল বাতি দেখে মোরেটির লিমুজিন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই সুযোগে জেনিফার গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। তারপর বলল–আমার অফিস সামনেই, আমি এইটুকু পথ হেঁটেই যেতে পারবো। লিফট দেবার জন্য ধন্যবাদ।
-আপনার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে?
আর কোনোদিন দেখা না হওয়াই ভালো, মিঃ মোরেটি। বলেই জেনিফার বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মাইকেল মোরেটি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ তিনি নিজের মনেই হেসে উঠলেন। অদূর ভবিষ্যতে তিনি যে জেনিফারকে ইচ্ছে মতো ভোগ করতে পারবেন এই সরল সত্যটা তিনি উপলব্ধি করলেন।
.
জেনিফারের মক্কেলের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। তাদের মধ্যে রিক আর্লেন ছিলেন একজন। তিনি আবার রকস্টার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি হঠাৎ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জেনিফারকে। তাই সে প্লেনে চাপল অক্টোবর মাসে একদিন। সে এসে হাজির হল মন্টি কার্লোতে। এখানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাগম ঘটেছে ওই অনুষ্ঠানে। ইউরোপের রাজা, মহারাজা আর একধিক সুইস ব্যাঙ্কের মালিক থেকে শুরু করে পেলের মতো নামী ফুটবল তারকাও আছে তাদের মধ্যে। সেই অনুষ্ঠানে রিক আর্লেন রক সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। জেনিফারের দেশ থেকে মন্টি কালোর দূরত্ব প্রায় তিন হাজার মাইল। এতদূরে একজনের আমন্ত্রণে এসে জেনিফার কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছিল, হাতে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। মক্কেলদের তার ওপর অনেক আশা। তবুও আল্পস পর্বতমালার নীচে এইরকম একটি বিলাস ব্যাসনের হাতছানি এবং পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যের আকর্ষণই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অনুষ্ঠানের শেষে খাওয়াদাওয়ার এলাহী ব্যাপারও ছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে জেনিফার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ভূমধ্য সাগরের তীরে একটি বিশাল ভিলা রিক আর্লেন ভাড়া নিয়েছিলেন। জেনিফারের অসুস্থতার খবর শুনে তিনি তাকে সেই ভিলাতে নিয়ে এলেন। জেনিফারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে রিক একজন ডাক্তার ডেকে আনলেন।
ডঃ অ্যান্ড্রে মন্টিউক্স এলেন জেনিফারকে দেখতে। আশির কোঠা পেরিয়ে গেছেন তিনি। তার সঙ্গে একটি কালো ব্যাগ। তিনি জেনিফারের খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার ইশারায় রিক আর্লেন ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
ডাক্তার এবার জেনিফারকে জিজ্ঞাসা করল–আপনার কি হয়েছে?
মনে হচ্ছে আমার বিউবনিক প্লেগ হয়েছে।
–জিভ দেখি।
জেনিফার জিভ দেখাল। এরপর ডাক্তার শরীরের তাপ পরীক্ষা করলেন ও নাড়ির গতি পরীক্ষা করলেন।
ডাক্তার কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। সবশেষে বললেন–আপনাকে আরও ভালোভাবে দেখতে হবে, আগামীকাল আমার চেম্বারে আসুন।
জেনিফার স্বাভাবিক সুরে বলল–ঠিক আছে।
পরদিন সকাল। জেনিফার ও রিক আর্লেন গেলেন মন্টি কার্লোতে ডঃ মন্টিউক্সের চেম্বারে। ডাক্তার জেনিফারের সবরকম প্যাথোলজি টেস্টের পরামর্শ দিলেন। বললেন–আগে ল্যাবরেটরীর রিপোর্টগুলো হাতে আসুক তারপর যা বলার বলব।
–কবে রিপোর্ট পাব?
দু-তিনদিন বাদে। এখন শুধু বেডরেস্ট। যদি শরীর ভীষণ খারাপ লাগে তাহলে এই বড়ি দুটো করে খাবেন, বলে ডাক্তার তার হাতে এক শিশি বড়ি দিলেন।
ধন্যবাদ, বলে জেনিফার ডাক্তারের দিকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল দরকার মনে করলে আপনি এই নম্বরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
তারা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বিদায় নেবার পর ডঃ মন্টিউক্স ওই কাগজটায় নিউইয়র্কের একটা টেলিফোন নম্বর লেখা দেখতে পেলেন।
কিন্তু ডাক্তার বললেও আরও দু-তিনদিন এখানে থাকা জেনিফারের পক্ষে সম্ভব নয়। সে সোজা নিউইয়র্কে চলে গিয়েছিল। তবে সেদিন আর অফিসে গেল না সে।
বিকেলের দিকে অ্যাডামের টেলিফোন এল। তার গলার স্বরে উৎকণ্ঠা। সে আচমকা কোথায় চলে গিয়েছিল তা অ্যাডাম জানতে চাইছেন।
–দুঃখিত ডার্লিং। মন্টি কার্লোতে যেতে হয়েছিল একজন মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে। তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছি, তাই তোমাকে জানানো হয়নি।
–তোমার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, তুমি ভালো আছো তো?
জেনিফার ইচ্ছে করেই অসুস্থতার কথা চেপে গেল। মুখে বলল–হ্যাঁ, ভালো আছি।
তোমার নির্বাচনী প্রস্তুতি কেমন চলছে?
–ভালো। তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে? ওয়াশিংটনে একবার যেতে পারবে কি?
–না, তুমি যাও, আমার হাতে অনেক কাজ আছে। উইকএন্ডে আবার দেখা হবে।
–তাই হবে, তবে আজ রাত এগারোটায় টিভি দেখতে ভুলো না। সি বি এস-এর খবরের সময় আমার প্রোগাম আছে দেখো।
–হুঁ, অবশ্যই দেখবো।
রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। তার শরীর অবসন্ন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে গভীর ঘুমে ডুবে গেল।
পরদিন সকাল থেকেই সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। ব্রেকফাস্ট খেতে বসেও সে খেতে পারলো না। তার মনে হচ্ছে সে যেন কতদিন না খেয়ে আছে। সে দুর্বলতা বোধ করছে।
বেলা এগারোটায় ডঃ অ্যান্ড্রে মন্টিউক্স টেলিফোন করলেন। তিনি জানতে চাইলেন–জেনিফার, এখন কেমন বোধ করছেন?
জেনিফার জবাব দিল–একই রকম।
ডঃ আন্ড্রে বললেন–একটা সুসংবাদ আছে মিস পার্কার, আপনি মা হতে চলেছেন।
জেনিফার বোকার মতো টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ধাতস্থ হয়ে বলল–ঠিক বলছেন আপনি?
–ডাক্তাররা মিথ্যে বলে না। আমার মনে হয় এটাই আপনার প্রথম সন্তান?
–হ্যাঁ।
–তাহলে আপনি তাড়াতাড়ি একজন গাইনির পরামর্শ নিন।
ধন্যবাদ, ডঃ মন্টিউক্স। বলে জেনিফার রিসিভার নামিয়ে রাখল। মাথার ভেতর সব গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা ভাবনা করার মতো ক্ষমতা তার হারিয়ে গেছে।
তার হঠাৎ মনে হল, তার গর্ভের এই সন্তানের জনক অ্যাডাম ওয়ার্নার। কথাটা ভেবে আনন্দে লাফিয়ে উঠতে চাইল সে। তার মনে হচ্ছে অ্যাডাম ওয়ার্নারের দেওয়া এটাই সবথেকে মূল্যবান উপহার।
খবরটা এইমুহূর্তে অ্যাডামকে জানাতে হবে। সে একটুও দেরী না করে অ্যাডামের অফিসে ফোন করল। কিন্তু তার সেক্রেটারী জানাল তিনি অফিসে নেই। তার আর তর সইছে না। সে অ্যাডামের বাড়ীতে ফোন করতেই তার স্ত্রী মেরিবেথ টেলিফোন ধরলেন।
জেনিফার বলল–আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে অ্যাডামের সঙ্গে আমার দরকার ছিল। ওর সঙ্গে একটা জরুরী ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই।
মেরিবেথ আন্তরিকতার সুরে বলল–তুমি ফোন করায় আমি খুব খুশি হয়েছি। অ্যাডাম বাইরে গেছেন। কয়েকটি জনসভায় উনি বক্তৃতা দেবেন। তবে রাত্রে বাড়ি ফিরবেন। তুমিও সাতটার সময় এখানে চলে এসো। তোমার ডিনারের নিমন্ত্রণ রইল।
সম্মতি জানিয়ে জেনিফার রিসিভার রেখে দিল।
.
হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে জেনিফারের একটা কথাই বার বার মনে পড়ছিল–অ্যাডাম বলতেন আমি এমন দুটি সন্তান চাই যারা তোমার মতো দেখতে হবে। সে অনুভব করার চেষ্টা করছিল তার পেটের ভেতর অন্য একটি অস্তিত্বের আবির্ভাব। কিন্তু সেটা তো এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সে মনে মে হেসে ফেলল। অ্যাডামের সন্তান তার পেটের ভেতর বড় হচ্ছে। ওঃ সে এক দারুণ ব্যাপার ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তার দেহ মনে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল।
ভাবতে ভাবতে জেনিফার অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাকটিকে সে লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ হর্ণের তীব্র আওয়াজ কানে যেতেই সে সম্বিত ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি ট্রাকটিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। তার ভাগ্য সহায় ছিল তা নাহলে এতক্ষণে তার ভবলীলা সাঙ্গ হত। সে এতবড় দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পেল।
শেষ পর্যন্ত জেনিফার অ্যাডামের বাড়ি এসে পৌঁছল। তখন সন্ধ্যা সমাগত। গোধূলির স্নান আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। তুষারপাত হচ্ছে, তুষারের সাদা গুড়ো গাছের ওপর জমেছে। আগে থেকেই মেরিবেথ সদর দরজায় দাঁড়িয়েছিল। তার পরনে একটা লম্বা ঢিলে ব্রোকেডের গাউন। জেনিফার গাড়ি থেকে নেমে এল। মেরিবেথ তাকে দেখে এগিয়ে এল। হাসিমুখে জেনিফারকে অভ্যর্থনা জানাল। তারপর হাত ধরে তাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। তারা দুজনে লাইব্রেরীতে এসে বসল।
মেরিবেথ বলল–অ্যাডাম এখনও ফেরেননি, এসো আমরা গল্প করি। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব উত্তেজনার মধ্যে আছো, কিছু কি হয়েছে?
জেনিফার মেরিবেথের চোখের দিকে তাকাল। তার মনে হল এই চোখকে বিশ্বাস করা যায়। কয়েকমুহূর্ত ইতস্ততঃ করে তার মা হওয়ার সম্ভাবনার কথা. মেরিবেথকে বলেই ফেলল সে। সে আরও বলল–এই সন্তানের পিতৃত্বের জন্য দায়ী অ্যাডাম নিজে।
মেরিবেথ আশ্বস্ত হবার হাসি হেসে বলল–সে তো খুব ভালো খবর, এতটা আশা করা যায়নি।
–আপনি কবে অ্যাডামকে ডিভোর্স দিচ্ছেন, জেনিফার বলল।
–ডিভোর্স? আমি কেন অ্যাডামকে ডিভোর্স দিতে যাব, মেরিবেথ যেন আকাশ থেকে পড়ল।
জেনিফার ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বলল–কেন দেবেন না? আমি জানি আপনার সঙ্গে অ্যাডামের কোনো দৈহিক সম্পর্ক নেই।
মেরিবেথ চাপা হাসি হেসে বলল–কি বোকা তুমি! অ্যাডামকে এত সহজেই বিশ্বাস করতে পারলে?
জেনিফার বলল–আমরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসি। আমরা বিয়ে করার জন্য মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত।
মেরিবেথ ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল। তার নীল দুটি চোখে একরাশ ঘৃণা ঝড়ে পড়ছে।
–আমি ওকে ডিভোর্স দিলে ও তোমাকে বিয়ে করবে, আর নির্বাচনে জিততে পারবে না। কিন্তু আমি এই নির্বাচন ওঁকে হারতে দেবো না। অ্যাডাম নির্বাচন জিতে সেনেটর হবেন, তারপর আমরা দুজনে হোয়াইট হাউসে সুখে দিন কাটাবো। ওর জীবনে তোমার মতো মেয়ের কালো ছায়া আগেও ছিল না এখনও থাকতে আমি দেব না। ওকে যখন আমি বলবো, ওর সন্তান আমার গর্ভে, তখন উনি তোমার দিকে মুখ ফিরে তাকাবে না। তার অনেক দিনের সাধ আমি পূরণ করবো। আমিই তাকে সন্তানের বাবা ডাক শোনাবো।
মেরিবেথের কথাগুলো কানের পর্দা ভেদ করে জেনিফারের হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করে। তার হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তার মাথার ভেতরটা দপদপ করে জ্বলতে লাগল। তবুও অনেক কষ্ট সে মেরিবেথকে প্রশ্ন করল–আপনি কি অ্যাডামকে বলেছেন ওর সন্তান আপনার পেটে লালিত হচ্ছে?
-না, তবে আজ রাতে ডিনার সেরে শুতে যাবার সময় বলবো।
জেনিফার আর সহ্য করতে পারলো না। সে বোমার মতো ফেটে পড়তে চাইল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না।
মেরিবেথ মুখ টিপে হেসে বলল–ব্যাপারটা কত সোজা না, আমি অ্যাডামের বিবাহিতা স্ত্রী আর তুমি তার রক্ষিতা।
জেনিফার কানদুটো দুহাতে চেপে ধরে টলতে টলতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তার মনে হল আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সে নির্ঘাৎ অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
.
ভোটের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। এর মধ্যে অ্যাডাম কয়েকবার টেলিফোন করে জেনিফারের কুশল সংবাদ নিয়েছেন এবং নিজেরটা জানিয়েছেন। কিন্তু ভোট যুদ্ধের কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে বেশিক্ষণ কথা বলার মতো সময় পাননি।
মেরিবেথের পেটে বাচ্চা আসার ব্যাপারটা জেনিফারের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে। হয়লে কায়দা করে অ্যাডামকে তার পাশে শুতে বাধ্য করেছেন মেরিবেথ। তবুও অ্যাডামের খি থেকে না শুনলে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।
অ্যাডাম সেনেটর হিসাবে নির্বাচিত হলে জেনিফার তাকে আর পাবে না। আর এদিকে মেরিবেথও তাকে ডিভোর্স দেবেন না। স্ত্রী মেরিবেথকে ওয়াশিংটন ডিসি-তে নিয়ে যেতে বাধ্য হবেন অ্যাডাম। নিজের স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে গর্ভবতী রক্ষিতাকে বিয়ে করছে জানলে লোকে ছি ছি করবে। তাহলে অ্যাডামের রাজনৈতিক উচ্চাশার পতন ঘটবে। আর যদি অ্যাডাম ভোটে হারেন তাহলে আগের মতো ওকালতি ব্যবসায় ফিরে আসবেন। তখন স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে আর বাধা থাকবে না এবং জেনিফারকে বিয়ে করে তার মাতৃত্বকে স্বীকার করতেও অসুবিধা থাকবে না।
নির্দিষ্ট দিনে ভোটদান পর্ব হল। কিন্তু সকাল থেকেই বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। জেনিফার ভোট দিতে গেল। অ্যাডামকে ভোট দিল জেনিফার। তারপর বুথ থেকে বেরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল। এইভাবে অফিসে না গিয়ে সারা বিকেল কাটিয়ে দিল। সে জানে অ্যাডাম ওয়ার্নার নির্বাচনে জিতলে সে ভোটের রায় তার বিপক্ষে যাবে। সে স্পষ্টতই জানে তার ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হবে ওই ভোটের রায়ের পর।
একসময় জেনিফার ফ্ল্যাটে ফিরে এল। সে টি ভি খুলল। তার উদ্দেশ্য নির্বাচনী ফলাফল ও সমীক্ষা দেখে নিজের ভাগ্য বিচার করা। কিন্তু সে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। শেষে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙাল যখন তখন ভোর হয়েছে। তখনও টিভি চলছে। এডইন নিউম্যান নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করছেন।
জেনিফার সোফায় উঠে বসল। সে শুনতে পেল এডইন নিউম্যান বলছেন–এইমুহূর্তে নির্বাচনের শেষ ফলাফল বিশ্ববাসী জানতে পারবেন। নিউইয়র্কের অ্যাডাম ওয়ার্নার এবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সেনেটর পদ লাভ করেছেন। তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেনেটর জন ট্রাইব্রীজকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। অ্যাডাম ওয়ার্নার জন ট্রাইব্রীজের থেকে এক শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন।
জেনিফার মনে মনে ভাবল আশার প্রদীপ নিভে গেল। এই মামলায় সে পুরোপুরি হেরে গেল।
.
সেদিন জেনিফার অনেক বেলা করে অফিসে গেল। অফিসে পা দিয়েই সে সিনথিয়ার মুখে শুনতে পেল অ্যাডাম ফোন করেছেন।
ঠিক আছে সিনথিয়া, বলে জেনিফার নিজের কামরায় গিয়ে টেলিফোন তুলল। বলল–অভিনন্দন জানাচ্ছি, অ্যাডাম।
ধন্যবাদ, কি ব্যাপার, তুমি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। সেই সকাল থেকে তোমাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছি, জেনি। আজ কি তুমি লাঞ্চের সময় বেরোতে পারবে?
-পারবো।
তিন সপ্তাহ পর তাদের দেখা হল। জেনিফার এক দৃষ্টিতে অ্যাডামকে পর্যবেক্ষণ করছে। অ্যাডামকে ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অথচ এই মুহূর্তে জয়ের আনন্দে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হওয়ার কথা! জেনিফারের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগল। তবে কি মেরিবেথ তার মা হওয়ার কথা অ্যাডামকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই কি ওঁকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে। সামনে গরম গরম খাবার পড়ে রয়েছে কেউ ছুঁয়েও দেখল না। তারা শুধু নির্বাচনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগল।
কিন্তু মনের আসল কথা গোপন রেখে এইভাবে তো বেশীক্ষণ কাটানো যায় না। তাই অস্থির হয়ে উঠলেন অ্যাডাম, তিনি ভাবছেন কিভাবে জেনিফারকে কথাটা বলবেন। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–জেনি, মেরিবেথ আমার সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে।
জেনিফার অ্যাডামের মুখের ওই উক্তি শুনে হতবাক হয়ে গেল।
অ্যাডাম একটু ইতস্ততঃ করে আবার বলতে শুরু করলেন–আমি সত্যিই দুঃখিত, ডার্লিং, ব্যাপারটা যে কিভাবে ঘটে গেল।
থাক তোমাকে আর কৈফিয়ত দিতে হবে না।
–আমি ভীষণ বোকা না, উচ্চাকাঙ্খর লোভে মেরির কথা আমি বিশ্বাস করেছি। ওর কথামতো ভোটের আগে ডিভোর্স নিইনি, কিন্তু এখন তো সে পথও বন্ধ। জাতীয় কমিটির চেয়ারপার্সনরা আমাকে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাতে চান। তাছাড়া মেরিও মা হতে চলেছে, তাই এখন ওকে ডিভোর্স করলে আমার ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। যেদিন ব্যাপারটা জানতে পেরেছি সেদিন থেকে আমি বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি। তোমায় বলতে সংকোচ হচ্ছে, তবুও বলতে আমি বাধ্য, আমরা কি আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারি না, জেনি?
না, অ্যাডাম, সেটা আর সম্ভব নয়। সব শেষ হয়ে গেছে। আমার জন্য তুমি তোমার স্ত্রী ও সন্তানের জীবন নষ্ট করতে পারো না। ওদের বাঁচাতেই হবে তোমাকে।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল জেনিফার। এখানে থাকলে যেন তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। তবুও অ্যাডামের প্রতি সে শেষ মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিল–আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা কোরো না অ্যাডাম।
বেদনা ভরা দুটি চোখ মেলে অ্যাডাম তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেই দৃশ্য সহ্য করার মতো জেনিফারের মনের অবস্থা ছিল না। তাই সে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
.
এরপর অ্যাডাম বহুবার জেনিফারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু জেনিফার অভিমান করে ফোন ধরেনি।
গর্ভযন্ত্রণা যে কি ভয়ানক হয় তা জেনিফার আজ প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারছে। সে আর এখন একা নয়। তার জঠরে আরেকটি প্রাণের স্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে সেই ধ্বনি বাইরে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবে। সে স্থির করল গর্ভের ওই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেবে না। তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করবে।
জেনিফার ভাবছে কোথায় গর্ভপাত করানো যায়, ভেবে ভেবে সে কোনো কুলকিনারা পেল না। নিউইয়র্কের বাইরে যাবে না এই শহরেই করবে? কিন্তু এই শহরে করলে একটা সমস্যা থেকে যায়। তাহল টিভি খবরের কাগজের দৌলতে তাকে অনেকেই চিনেছে। এখানে করলে সে ধরা পড়ে যাবে। আর বাইরে করলে সে সম্ভবনা থাকে না। আসল কথা হল যে ভাবেই হোক অ্যাডাম ওয়ার্নারের ভাবী সন্তানকে এই পৃথিবীতে আসতে দেবে না।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে একসময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
.
শেষ পর্যন্ত কোনো পথ না পেয়ে জেনিফার কেন বেইলিকে ডেকে পাঠান। সে আসতে তার কাছে নিজের সমস্যার কথা অকপটে স্বীকার করল। সে কোনো রকম ভনিতা না করে বলল–কেন, তোমার চেনাজানা কোনো ডাক্তার আছে, আমি গর্ভপাত করব?
বুকের মধ্যে গভীর বেদনা কেন অনুভব করল। আবার পরক্ষণেই তার ভীষণ রাগ হল। তবুও ভেতরের সেই প্রতিক্রিয়া কেনের চোখে মুখে প্রতিফলিত হয়নি। সে মুখে বলল–কোথায় করাতে চাও?
–এমন কোন জায়গায় যেখানে আমার কোনো পরিচিত লোক নেই। এই যেমন ধরো নিউইয়র্কের বাইরের কোনো শহরে।
মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে কেন বলল–তাহলে নর্থ ক্যারোলিনায় যেতে পারো। জায়গাটা খুব কাছেই।
জেনিফার অনুনয়ের সুরে বলল–তুমি একটু ব্যবস্থা করে দাও না কেন?
… বাঃ চমৎকার! আমি…। কেন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল।
.
এরপর তিনদিন আর কেনের পাত্তা পাওয়া গেল না। চতুর্থ দিনের দিন সে এসে হাজির জেনিফারের অফিসে, আচমকা ভূতের মতো চেহারায় তাকে দেখে জেনিফার চমকে উঠল। তার মুখে তিন চারদিনের না কামানো গোঁফ দাড়ি, দুচোখের নীচে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে।
জেনিফার শঙ্কিত স্বরে জানতে চাইল, কেন, তোমার কি শরীর খারাপ?
না, আমি ভালই আছি। কেন এক টুকরো কাগজ জেনিফারের হাতে দিল। জেনিফার দেখল তাতে লেখা–ডঃ লিন্ডেন, মেমমারিয়াল হাসপাতাল, শার্লোট, নর্থ ক্যারোলিনা।
-ধন্যবাদ, কেন।
কবে যাচ্ছ? এই উইক এন্ডেই যাব ভাবছি।
–আমি কি যাব?
না থাক, দরকার হবে না, আমি একাই যেতে পারবো।
যদি ফেরার সময় অসুবিধা হয়, তবে সাহায্য করতে পারি।
–ও ঠিক হয়ে যাবে।
–যদিও জানি এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তবুও বলব, তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত?
নিশ্চয়ই, কেন।
জেনিফার খুব ভালোভাবেই জানে অ্যাডামের সন্তান মানে নিজের সন্তান। নিজের কাছে রেখে মানুষ করার চাইতে আর কিছু চাওয়ার তার থাকতে পারে না। তাহলেও সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবলে এটাকে পাগলামি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তাই ওই সন্তানকে কাছে রেখে সে কিছুতেই মানুষ করতে পারবে না। তার হৃদয় অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।
শার্লোটের কিছুটা দূরে, শহরতলী এলাকা। এখানেই একটি দোতলা বাড়ি মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরিচয় বহন করছে। জেনিফার একাই এসেছিল এখানে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই রিসেপশন, সেখানে একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা বসে আছেন। জেনিফার সেদিকে এগিয়ে গেল। তাকে দেখে ওই ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন–বলুন, আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
জেনিফার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল–ডঃ লিন্ডেনের সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন–বুঝতে পরেছি, ডঃ লিন্ডেন আপনার অপেক্ষা করছেন ওঁর চেম্বারে।
একজন কম বয়েসী নার্সের সঙ্গে জেনিফার এসে হাজির হল বিশাল একটি ঘরে। এই ঘরটিতে রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। নার্সটির নির্দেশে সে জামাকাপড় খুলে একটি গাউন পরে নিল। সে মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছে তার নিজের সন্তানের রক্তে ওই সাদা অ্যাপ্রনটা লাল হয়ে গেছে।
একটু পরে এক ভদ্রলোক এলেন। তার মাথাজোড়া টাক, নাদুস নুদুস চেহারা এবং মুখটায় যেন পাচার মুখ বসানো হয়েছে।
ভদ্রলোক হেসে বললেন–আমি ডঃ লিন্ডেন। আপনি বুঝি মিসেস পার্কার?
জেনিফার মুখে কিছু বলল না, শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ডঃ লিন্ডেন একটা কাগজের কাপ নিলেন। তারপর বেসিন থেকে জল তাতে ভরলেন, সেটা জেনিফারকে খেতে বললেন।
তখন জেনিফারের প্রতিবাদ করার মত সাহস ছিল না। সে সেটুকু নীরবে খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর ডঃ লিন্ডেন বললেন–গর্ভপাত করাতে চান?
-হ্যাঁ।
এ ব্যাপারে আপনার স্বামীর মত আছে তো?
জেনিফার আমতা আমতা করে বলল–হ্যাঁ, আমরা–আমরা দুজনেই এতে রাজী আছি। গম্ভীরভাবে ডঃ লিন্ডেন বললেন, আপনার স্বাস্থ্য তো ভালোই দেখছি।
-হ্যাঁ, আমি বেশ সুস্থ।
–গর্ভপাতের ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। আরেকবার ভালো করে ভেবে দেখুন। বাচ্চাটাকে একবার নষ্ট করে ফেললে আমি আর বাঁচাতে পারবো না। সে যাদু আমার জানা নেই।
–না না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
–বেশ, তাহলে আপনি ওই টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ুন। আমি পরীক্ষা করবো আপনাকে। জেনিফার টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ল, ডঃ লিন্ডেন তাকে নানাভাবে পরীক্ষা করতে লাগলেন।
পরীক্ষা শেষ করে মিঃ লিন্ডেন বললেন–ঠিক আছে, আপনি জামাকাপড় পড়ে নিন, মিসেস পার্কার। কাল আপনার অপারেশন হবে, এখানে আজ রাতটা থাকতে পারেন। যদি আপনার অসুবিধা না থাকে।
জেনিফার ধীরে ধীরে বলল–কেন ডঃ লিন্ডেন, আজ করা যায় না?
না আজ করা সম্ভব নয়। আপনার আগে আরও দুজন রোগী আছে। আপনার ভয়। নেই বেশি সময় লাগবে না।
অগত্যা জেনিফারকে রাজি হতেই হল।
.
পরের দিন সকাল। জেনিফার সাদা গাউন পরে সেই বিশাল টেবিলটার ওপর শুয়ে আছে। ডঃ লিন্ডেন কখন আসে তার প্রতীক্ষা করছে। দেয়ালে ঝোলানো একটা পুরোনো ঘড়ি। তার পেন্ডুলাম টিক টিক করে শব্দ তুলছে। জেনিফারের মনে হচ্ছে কে যেন তার মাথার মধ্যে ওই পেন্ডুলামের মত শব্দ করে বলছে, ছোট্ট অ্যাডাম, আমার ছেলে, আমার ছেলে।
জেনিফার কিছুতেই তার গর্ভস্থ সন্তানের কথা ভুলতে পারছে না। ওই পেন্ডুলামের শব্দটা তার অসহ্য লাগছে। সে দুহাত দিয়ে কান দুটো চেপে রাখলো। সে উপলব্ধি করলো তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে, তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ডঃ লিন্ডেন এলেন। তিনি ইঞ্জেকেশানের সিরিঞ্জ হাতে জেনিফারে দিকে এগিয়ে গেলেন। জেনিফার আর্তনাদ করে উঠল–ওটা কি?
–ঘাবড়াবেন না মিসেস পার্কার। এটা ডিসেলে ও সেনার কান। আপনি আরাম পাবেন। মনে হচ্ছে এটাই প্রথমবার।
–হ্যাঁ।
ইঞ্জেকশানটা পুশ করার পর জেনিফারের ঝিমুনি ভাব এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চেতনা প্রায় হারিয়ে ফেলল। অর্ধচেতন অবস্থায় সে টের পেল তাকে স্ট্রেচারে করে অন্য একটি ঘরে নিয়ে এসেছে। সে গর্ভের সন্তানের দুরবস্থার কথা ভেবে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল।
ডঃ লিন্ডেন তার হাতে মৃদু চাপড় মেরে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন–ভয় নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে, একটুও ব্যথা লাগবে না।
একজন নার্স একটা মুখোশ তার নাকের ওপর ধরে জোরে শ্বাস নিতে বলল। কয়েকজন। জেনিফারের পা দুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিল, তার গাউনটা টেনে ওপরে তুলে দিল তারা।
বিদায়, ছোট্ট অ্যাডাম সোনা। গর্ভের সন্তানের উদ্দেশ্যে পরম মমতায় জেনিফার কথাগুলো উচ্চারণ করল। পরক্ষণেই সে অনুভব করল একটা ইস্পাতের ছুরি তার দু হাঁটুর মাঝখান দিয়ে তলপেটে ঢুকে যাচ্ছে। সে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে এই ছুরির আঘাতে অ্যাডামের সন্তানের মৃত্যু হবে।
এমন সময় জেনিফার চীৎকার করে বলল–বন্ধ করো, বন্ধ করো অপরেশান। মাথা উঁচু করে জেনিফার দেখার চেষ্টা করল। সাদা মুখোশ পরা অনেকগুলো মুখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উঠে বসতে গিয়েও সে পারল না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তার সারা দেহ অসার হয়ে আসছে, একটা উগ্র গন্ধ তাকে কিছুতেই জেগে থাকতে দিচ্ছে না। সে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল।