১৬-২০. কোনরাড মরগান

১৬.

কোনরাড মরগান হাজার ডলার দিয়েছিল। ট্রেসি তা দিয়ে একটা সোনালী আর একটা কালো পরচুলা কিনল। গাঢ় নীলরঙের প্যান্টশার্ট কিনল। কাঁধে ঝোলানো বড়ো ব্যাগ নিতে ভুল করল না। কথা মতো কোনরাডের দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স পেল এলেন ব্রাঞ্চের নামে। বেলামি হাউসের নকসা আর আয়রন সেফের কমবিনেশন নম্বর আর রেলের টিকিটটিও হাতে পেয়ে গেল ট্রেসি। এবার বেরিয়ে পড়ল একটা গাড়ি ভাড়া করার জন্য।

লং আইল্যাণ্ডের দিকে যেতে যেতে ট্রেসি ভাবছিল, এটাও ছিল আমার ভাগ্যে। সে চলেছে চুরি করতে। আচ্ছা, আমি যদি ধরা পড়ে যাই, এত বড়ো ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?

কোনরাডের কথাগুলো মনে মনে আবৃত্তি করছিল ট্রেসি তুমি মোটেই ধরা পড়বে না। এ ব্যাপারে আমার হাত-যশ আছে বলতে পারো। আমি তোমাকে সব দিক দিয়ে বাঁচাবো।

ট্রেসি ঠিকমতো গাড়িটা চালাতে পারছিল না। সে ভাবল, ফিরে গিয়ে কোনরাডকে যদি বলি, পারলাম না, তাহলে কেমন হয়?

শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের ধারে এসে থামল সে। ভিক্টোরিয়া আমলের পুরোনো একটা জমকালো বাড়ি। নাম এমবার্স।

একটা বড়ো উইলি গাছের আড়ালে গাড়িটাকে দাঁড় করাল। বড়ো রাস্তা থেকে একটু নেমে যেতে হবে।

কোনরাডের কথাগুলো আর একবার মনে করে নিল ট্রেসি। বাড়িটা গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। সিকি মাইলের মধ্যে আর কোনো বাড়ি নেই। রাত দশটায় পুলিশের গাড়ি চক্কর দিয়ে যাবে। আবার আসবে রাত দুটোর সময়। তার আগেই ট্রেসির কাজ শেষ হয়ে দিয়ে যাবে। আইলের মধ্যে আর

ট্রেসি ঘড়ি দেখল, ঠিক এগারোটা। ফেরার সময় আছে কি? ওই দরিদ্রতার জীবনে সে আর ফিরতে পারবে না। কিন্তু পালাবার সময় যদি পুলিশের হাতে পড়ে?

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ট্রেসি সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কোনো এক অদৃশ্য, শয়তান বোধ হয় তাকে এই অন্ধ বিবরে নিয়ে এসেছে।

বাড়িটা একেবারে অন্ধকার। ট্রেসির মনে পড়ল কোনরাডের কথা। দস্তানা পরে নিতে ভুলো না। তাহলে শেষ পর্যন্ত এটা আমি করতে যাচ্ছি। বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পিটছে।

সদর দরজার বাঁ পাশে অ্যালার্মের ঘণ্টাটা আছে। পাঁচটা বোতাম আছে। লাল আলো জুলা মানে অ্যালার্ম চালু আছে। ওটাকে অকেজো করার সাঙ্কেতিক নম্বর হল তিন-দুই চার-এক-এক। লাল আলো নিভে গেলে বুঝবে অ্যালার্ম অকেজো হয়েছে। এবার চাবি নিতে হবে। ভেতরে ঢুকে আবার চাবি লাগবে। টর্চ লাইট ব্যবহার করবে। আলো জ্বালবে না একবারও। আসল ঘরটা দোতলার বাঁ ধারে, আয়রন সেটা আছে বেলামির বড়ো ফটোর পেছনে। এবার তালা খোলার ব্যাপারটা। নিমেষে কাজ শেষ করতে হবে।

কোনরাডের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দোতলায় পৌঁছে গেল ট্রেসি। সুন্দর। করে সাজানো ঘরটা দেখে তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। চার্লসকে বিয়ে করলে সে এমন একটি ঘরের মালকিন হতে পারত।

মিসেস বেলামির ফটো। উদ্ধত চেহারার মহিলা। এর ক্ষতি করাতে কোনো পাপ নেই। নম্বর মুখস্থ ছিল। আয়রন সেফ খুলে গেল। সামনে একগাদা কাগজপত্র। একেবারে পেছনের দিকে স্যাময় লেদারের ব্যাগে গয়না।

ব্যাগটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম ঘণ্টা বেজে উঠল। পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল ট্রেসির শরীর। হায় ঈশ্বর, কোনরাড কি ইচ্ছে করে এই ভুলটি করল? নাকি সত্যি সে জানত না?

এখন আর সময় নেই। স্যাময় লেদারের ব্যাগটা নিজের ঝোলা ব্যাগে পুরে নিল। তরতর করে একতলায় নেমে এল ট্রেসি। বাড়ির ঘণ্টাগুলো তখনো বাজছে। সাইরেন বাজিয়ে একটা ভ্যান ছুটে আসছে। চট করে জানলার পর্দা সরিয়ে ট্রেসি দেখল, সাদা কালো রঙের টহলদারি গাড়িটা দাঁড়িয়েছে বাড়িটার সামনে। উর্দি পরা একজন পুলিশ দৌড়ে চলে গেল বাড়ির পেছন দিকে। অন্য একজন দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজাতে। তার মানে? পালাবার আর পথ নেই। আবার তাকে জেলখানায় ঢুকতে হবে?

না-না, ওরা আমাকে কিছুতেই ধরতে পারবে না। মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে ট্রেসি অধৈর্য হয়ে মনে মনে বলে উঠল।

সদরে আবার তীব্র শব্দ করে ঘণ্টা বেজে উঠল।

লেফটেনান্ট মেলভিন ডারকিন দশ বছর ধরে সীক্লিফ পুলিশ বিভাগে চাকরি করছেন। শহরটা মোটামুটি শান্ত। এখানে যারা বসবাস করেন, তারা উঁচু শ্রেণীর মানুষ। ঝুটঝামেলাতে জড়াতে পছন্দ করেন না। অথচ লেফটেনান্ট মেলভিন কাজের লোক। ছোটোখাটো কাজে তাঁর মন ভরে না। মিসেস বেলামিকে উনি ভালোমতো চিনতেন। ভদ্রমহিলার বাড়িতে যে দামী দামী গয়না আর ছবি আছে, সেটাও ওনার জানা ছিল।

রাতে পুলিশ পেট্রল করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বড় রাস্তা ধরে যেতে যেতে শুনতে পেলেন বেলামির বাড়ির বিপদ সঙ্কেত ঘন্টাটা বাজছে। বড়ো একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে ভেবে মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন মেলভিন।

তৃতীয় বার ঘণ্টাটি বাজবার পর দরজাটা খুলে গেল। মেলভিনের মাথা তখন ঘুরে গেছে। দরজার সামনে এক যুবতী দাঁড়িয়ে। পরনে মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম নাইট গাউন। মুখে পুরু করে লাগানো প্রসাধনি ক্রিম। মাথার চুলগুলি রোলার ক্লিপ আঁটা। তার মানে চুল কোঁকড়া করা হয়েছে।

মহিলা কৈফিয়ত নেবার সুরে বললেন–কী ব্যাপার?

মেলভিন টোক গিললেন–আপনি? আপনি কে?

–আমি এলেন ব্রাঞ্চ। লুই বেলামির বাড়ির অতিথি। উনি ইউরোপ বেড়াতে গেছেন।

–তা আমি জানি, মেলভিন বোকার মতো বললেন, কিন্তু উনি তো একথা বলে যাননি যে, ওনার বাড়িতে একজন অতিথি থাকবে?

বিজ্ঞের মতো মহিলা মাথা নেড়ে বললেন–ওটাই ওনার স্বভাব। কিন্তু এই শব্দটা আমি সহ্য করতে পারছি না।

মেলভিন এগিয়ে গিয়ে কায়দা করে সুইচ টিপলেন, অ্যালার্ম বন্ধ হয়ে গেল।

মহিলা বললেন–আপনাকে দেখে যে কী আনন্দই হচ্ছে আমার কী বলব। শুতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় অ্যালার্ম বেজে উঠল। আমার স্থির বিশ্বাস বাড়িতে চোর ঢুকেছে। আমি একলা আছি। চাকররাও দুপুরে চলে গেছে।

–আমি কি চারপাশে একবার ঘুরে দেখব?

–নিশ্চয়ই।

লেফটেনান্ট মেলভিন বাড়িটা ঘুরে দেখলেন। না, কেউ লুকিয়ে নেই।

–আজকাল এই ঘণ্টাগুলো কখন কী করে বলা যায় না। কোম্পানিতে খবর দিতে হবে।

–নিশ্চয়ই দেব।

ধন্যবাদ জানিয়ে মেলভিন চলে গেলেন। ট্রেসি লক্ষ্য করল। পুলিশের গাড়িটা চলে গেছে।

তাড়াতাড়ি দোতলায় গেল। মিসেস বেলামির বাথরুমে পোশাক পাল্টাল। মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল। যাবার সময় অ্যালার্মের সুইচটা ঠিক করে দিয়ে গেল।

ম্যানহাটানে ফেরার পথে ট্রেসি হঠাৎ বুঝতে পারল, কী একটা অসাধারণ কাজ সে করেছে। পুলিশকে কীভাবে বোকা বানিয়েছে। এক বছর বাদে হো-হো করে হেসে উঠল সে।

.

১৭.

ট্রেন ছেড়েছে পেনসিলভানিয়া স্টেশন থেকে। ট্রেসির অশান্ত মনটা এখন অনেক শান্ত হয়েছে। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করে কাঁপছিল। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল এখুনি বোধহয় পিঠের ওপর একটা ভারী হাতের থাবা চাপড় মারবে। পুলিশের কণ্ঠস্বর তাকে শোনাবে–চলো ট্রেসি, বাইরের মুক্ত পৃথিবীটা তোমার আসল জায়গা নয়। তোমাকে আবার ওই সমকামিতার আসরে ফিরে যেতে হবে।

যেসব যাত্রী ট্রেনে উঠছিল, তাদের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল ট্রেসি। কাউকে তেমন সন্দেহজনক মনে হয়নি। নিজেকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছিল, চুরির ঘটনাটা এখনো পর্যন্ত জানাজানি হওয়া সম্ভব নয়। হলেও ওকে জড়ানো যাবে না। সেন্ট লুই স্টেশনে কোনরাড পঁচিশ হাজার ডলার নিয়ে অপেক্ষা করবে। এত টাকা নিয়ে কোথায় যাবে? লণ্ডন প্যারিস প্রভৃতি শহরের নাম মনে এল। মনটা তখন হালকা পাখি হয়ে নীল আকাশে দুটি ডানা মেলে দিয়েছে।

কামরার দরজাটা ভালো করে বন্ধ করল। থলে থেকে স্যাময় চামড়ার ব্যাগটা বের করল। ব্যাগটা ভোলা মাত্র চোখ দুটো ধাঁধিয়ে গেল তার। চুনি, পান্না ও হীরে, মুক্তো সব নিয়ে কয়েক লক্ষ ডলার হবে। নিজের কৃতিত্বকে বাহবা দিল। নরম গদিতে গা এলিয়ে তার অভিযানের ইতিবৃত্তটা মনে মনে ভাববার চেষ্টা করল।

সেন্ট লুই স্টেশনের দিকে ট্রেসি এখন ছুটে চলেছে। পুলিশকে বোকা বানাতে পেরেছে, সত্যি উপস্থিত বুদ্ধি না থাকলে তাকে ধরা পড়তেই হত। নিজের বুদ্ধিকে আর একবার বাহবা দিল।

দরজায় কে যেন টোকা দিল? গয়নার ব্যাগটা থলের মধ্যে চালান করে দিল ট্রেসি। ট্রেনের টিকিটটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল।

ধূসর রঙের স্যুট পরা দুজন দাঁড়িয়ে আছে। একজনের বয়স তিরিশ বত্রিশের বেশী হবে না। অন্যজন বছর চল্লিশের। কমবয়েসীটাকে বেশ সুন্দর দেখতে। বুদ্ধিদৃপ্ত চোখ।

বয়স্ক ব্যক্তিটি পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে দেখালেন। সেখানে লেখা আছে ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেসটিগেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন বিভাগ।

উনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন–আমি স্পেশ্যাল এজেন্ট ডেনিস ট্রেভার। ইনি সিক্রেট এজেন্ট টমাস বাওয়ার্স।

ট্রেসির ঠোঁট শুকিয়ে গেল। জোর করে ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসির প্রলেপ এনে সে বলল–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কিছু গণ্ডগোল হয়েছে কি?

–হ্যাঁ হয়েছে ম্যাডাম। কয়েক মিনিট আগে ট্রেনটা নিউ জার্সিতে ঢুকেছে। চুরি করা জিনিস অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া আইনত দণ্ডনীয়।

ট্রেসির মনে হল, সে বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে–যাচ্ছে।

ডেনিস ট্রেভার বলল–আপনি দয়া করে আপনার মালপত্র খুলে দেখাবেন কি? মনে রাখবেন, এটা কিন্তু আমার অনুরোধ নয়, এটা আমার আদেশ।

শেষ চেষ্টা করার জন্য ট্রেসি আমতা আমতা করে বলেছিল–নিশ্চয়ই দেখাব। তবে। এভাবে আমাকে বিরক্ত করাটা উচিত হয়নি। আপনাদের কাছে তল্লাসী পরওয়ানা আছে তো?

টমাস বাওয়ার্স বলে বসল–পরওয়ানার দরকার নেই। একটা বিশেষ অপরাধে আপনাকে আমরা গ্রেপ্তার করছি মিস হুইটনি।

হায় ঈশ্বর, এরা আমার আসল নামটা পর্যন্ত জেনে গেল।

ট্রেসির ঝোলানো ব্যাগ খুলতেই স্যাময় লেদারের গয়নার ব্যাগটা বেরিয়ে এল। সেখান থেকে পাওয়া গেল অনেক লক্ষ টাকার গয়না। ট্রেসির পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। সে ধপ করে বসে পড়ল।

এবার ডেনিস পকেট থেকে একটা লিস্ট বের করে সবকিছু মিলিয়ে নিল। সব ঠিক আছে?

–আপনারা খবর পেলেন কী করে?

এই প্রশ্নটা না করে ট্রেসি থাকতে পারল না।

–সে খবর আপনাকে দিতে আমরা বাধ্য নই। আপনি এখন আমাদের হাতে বন্দী, যদি আপনার কিছু বক্তব্য থাকে, তাহলে আদালতে বলবেন।

টমাস বাওয়ার্স বলল–দুঃখিত, আপনার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সব কথা আমাদের জানা আছে।

ডেনিস, ট্রেভার বললেন–অত ভদ্রতা করার দরকার নেই।

তারপর উনি পকেট থেকে একটা হাতকড়া বের করলেন।

ট্রেসি কাঁপতে কাঁপতে বলল–এটা কি না করলেই নয়?

–করতেই হবে। হাতকড়া পরাতে যাচ্ছে, এমন সময় টমাস ডেনিসকে বলল–বাইরে চলুন। আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলব।

দুজনে বাইরে এসে দাঁড়াল। ট্রেসি ওদের কথাবার্তা ভালো ভাবেই শুনতে পাচ্ছিল।

–মেয়েটা তো পালিয়ে যেতে পারবে না। হাতকড়া পরানো কি সত্যি দরকারী?

–কেন ছেলেমানুষী করছো টমাস? চাকরি তো বহুদিন হল।

দুজনে বেশ তর্কাতর্কি করে আবার কামরাতে ফিরে এল। ডেনিস বললেন, ঠিক আছে আপনাকে হাতকড়া পরানো হচ্ছে না। তবে পরের স্টেশনে আপনাকে নামিয়ে দেওয়া হবে। এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করবেন না। আমরা বেতারে খবর দিতে যাচ্ছি, পুলিশের গাড়ি পাঠাতে পরের স্টেশনে। _ কম বয়সী টমাস বাওয়ার্স বলল–এর থেকে বেশী সাহায্য আপনাকে আমি করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আশা করি, আমার সহযোগিতার দাম আপনি রাখবেন।

এজেন্ট দুজন বাইরে গেল, ট্রেসির কামরা দেখিয়ে কনডাকটারকে কী সব যেন বলল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।

গাড়ি ছুটে চলেছে প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। ট্রেসি ভাবতে পারছে না, কী করে এফ. বি. আই-এর কাছে খবর গেল। কোনরাড মরগান নিশ্চয়ই গয়নাগুলো চুরি করে পুলিশের হাতে তুলে দেবে না। তাহলে? তাহলে কে এই কাজ করেছে?

পরের স্টেশনে ট্রেনটা এসে দাঁড়াল। ট্রেসি কোট পরে নিল। স্যুটকেসটা পায়ের কাছে রেখে সে এখন পুরোপুরি তৈরী। এবার এজেন্ট দুজন আসবে। কিন্তু কই কেউ আসছে না তো?

এক এক মুহূর্তকে তখন অনন্ত সময় বলে মনে হচ্ছে ট্রেসির। শেষ পর্যন্ত কনডাকটারের গলা সে শুনতে পেল–যাঁরা গাড়িতে আছেন…

তার মানে নামতে বলছে। প্ল্যাটফর্মেই পুলিশ থাকবে বোধ হয়। ট্রেসি স্যুটকেস হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল।

কনডাকটার এগিয়ে এল–এখানেই নামছেন ম্যাডাম, সাবধানে নামবেন, আপনার যা। অবস্থা।

ট্রেসি মনে মনে ভাবল কী অবস্থা? প্রশ্ন করতেও ভয় লাগছে।

কনডাকটার বলল–আপনার দাদারা বলে গেছেন, আপনার ওপর কড়া নজর রাখতে। আপনার নাকি বাচ্চা হবে? এখন সাবধানে চলাফেরা করা দরকার।

–আপনার দাদারা?

ট্রেসি হাঁ হয়ে গেল।

–হ্যাঁ দারুণ লোক ওঁরা। আপনার জন্য কত চিন্তাভাবনা করছিলেন।

ট্রেসি প্ল্যাটফর্মে নেমে জানল, দাদারা ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সি ধরে চলে গেছে। চলে গেছে দশ লাখ ডলারের গয়না নিয়ে।

ট্রেসি একটা ট্যাক্সি ধরে এয়ারপোর্টে রওনা দিল। ওরা দুজন যখন ট্যাক্সি ধরেছে, তখন ওরাও নিশ্চয়ই এয়ারপোর্টে যাবে। রাগে সমস্ত শরীরে তখন জ্বালা ধরে গেছে তার। লোক দুটো জোচ্চুরি করে ওকে ঠকিয়েছে। তবে দারুণ অভিনয় করেছে লোক দুটো।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখল, লোক দুটো ডিপারচার গেটে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। লাইন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে ওরা মেক-আপ পাল্টে ফেলেছে। কম বয়সীটার গোঁফ অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখের তারা আর নীল নয়, এমন কী চশমাও নেই। বয়স্ক জন পরচুলা খুলে ফেলাতে তার, মাথায় বিরাট একটা টাক চকচক করছে। তবে পোশাকটা পাল্টাবার সময় পায়নি।

–কিছু একটা ভুলে যাচ্ছেন আপনারা? ট্রেসি সোজাসুজি ওদের কাছে গিয়ে বলল।

ছোটো জন বলল–এখানে কী করছেন? স্টেশনে গাড়ি আসবে পুলিশের।

ট্রেসি পাল্টা প্রশ্ন করল আপনারা না গেলে কী করে হবে?

–আমাদের অন্য একটা জরুরী কাজ আছে, এই প্লেনেই যেতে হবে।

ট্রেসি বুঝতে পারছে না, এখন তার কী করার দরকার। সে বলল–তাহলে আমার গয়নাগুলো ফেরত দিন।

–তা আমরা পারি না, পরে অফিস থেকে রসিদ পাঠিয়ে দেব।

–রসিদ চাই না, আমার গয়না চাই।

ট্রেসি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে আনল।

লোক দুটো চমকে উঠেছে কী হচ্ছে কি? তিনজনেই কি একসঙ্গে জেলে যাব নাকি?

পুলিশ অফিসারটি এগিয়ে এসেছে কী হয়েছে ম্যাডাম, কোনো গণ্ডগোল?

–না, তেমন কিছু নয়। এরা আমার হারিয়ে যাওয়া গয়নাগুলো পেয়েছেন। ভাগ্যিস পেয়েছেন, না হলে থানায় যেতে হত।

ট্রেসি আরো বলল–এঁরা বলছিলেন আপনি যদি আমাকে ট্যাক্সি পর্যন্ত পৌঁছে দেন।

ট্রেসি তারপর লোক দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল–আর কোনো ভাবনা নেই, এবার গয়নার ব্যাগটা দিয়ে দিন।

ওরা শেষ চেষ্টা করল ট্রেসির সঙ্গে যাবার, কিন্তু ট্রেসি বলল–আপনাদের প্লেন ছটায় ছাড়বে। আর বেশী দেরী করা বোধহয় উচিত হবে না।

ব্যাগটা নিয়ে দুজনকে পাঁচটা করে ডলার দিয়ে আরো একবার নিজেকে ধন্যবাদ দিল ট্রেসি। তারপর পুলিশ অফিসারের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সে স্বাভাবিক গলায় বলল–পৃথিবীতে এখনো কত সৎ লোক আছে, তাই না?

.

১৮.

টমাস বাওয়ার্স অথবা জেফ স্টিভেন্স প্লেনের জানলার দিকে বসে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিল।

ডেনিস ট্রেভার অথবা ব্রান্ডন হিগিন্স তার কাছে বসে সান্ত্বনা দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে- আরে এতে কাঁদার কী আছে? সামান্য টাকার ব্যাপার তো, ভবিষ্যতে এমন অনেক টাকা আমরা আয় করতে পারব।

হিগিন্স হাসছে। এতে হাসির কী আছে? মেয়েটা যেভাবে ওদের বুন্ধু বানিয়ে গেল, ভাবাই যায় না। কোনরাড মরগান বলেছিলেন, মেয়েটা একেবারে আনাড়ি। এই প্রথম কাজে নামছে, ওকে ঠকানো কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু মেয়েটা যেমন সুন্দরী তেমনই ধূর্ত। এমন একটা মেয়ে পেলে উইলিকাকা খুবই খুশী হতেন।

জেফের শিক্ষা গুরু এই উইলিকাকা। জেফের মা একটা মস্ত বড়ো কারখানা চালাতেন। সেখানে চাষবাসের জিনিসপত্র তৈরী হত। তাঁর সঙ্গে এক মেয়েভুলানো পুরুষের বিয়ে হয়। তিনি কোনো কাজই করতেন না। বড়ো বড়ো প্ল্যান তৈরী হত কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো প্ল্যান আর সফল হত না। জেফের বাবার কাজ ছিল, স্ত্রীর কাছ থেকে যে করেই হোক টাকা আদায় করা এবং উচ্চুঙ্খল জীবনযাপন করা। তা নিয়ে বাবা আর মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হত। কিশোর বয়সে জেফ প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে কোনো দিন বিয়ে করবে না।

বাবার আপন ভাই উইলিকাকার একটা ছোটো কার্নিভাল ছিল। তিনি যখন ওহিয়োর ম্যারিয়নের কাছে আসতেন, তখন একবার দাদার বাড়ি ঘুরে যেতেন। ভারী হাসি খুশী মেজাজের মানুষ। যখনই আসতেন ভাইপো জেফের জন্য মজার মজার উপহার আনতেন। ছোটোবেলাতেই জেফ ওনার কাছ থেকে ম্যাজিকের খেলা শিখে নিয়েছিল। উইলিকাকা কার্নিভালে ম্যাজিক দেখিয়ে খেলা শুরু করেছিলেন। পরে ওই কার্নিভালটি তিনি কিনে নেন।

জেফের যখন চোদ্দো বছর বয়স, তখন অ্যাকসিডেন্টে মা মারা গেলেন। দুমাস বাদে বাবা উনিশ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করলেন। মেয়েটি এক মদের দোকানে ওয়েট্রেস ছিল। এই ঘটনার জন্য বাবাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারেনি জেফ।

এই সময় বাবা সেলসম্যানের চাকরি নিয়ে সপ্তাহে তিনদিন শহরের বাইরে ট্যুরে যেতেন। একদিন জেফ আর তার সম্মা বাড়িতে ছিল। গভীর রাতে হঠাৎ জেফের ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খোলার একটা শব্দ পেল সে, কয়েক মুহূর্ত পরে একটা নগ্ন শরীর এসে তার গায়ে ঠেকল। জেফ চিৎকার করতে যাচ্ছিল, তার সম্মা বলে উঠল, আমার ভীষণ ভয় করছে জেফ। বাইরে বাজ পড়ছে। আমাকে জড়িয়ে ধরো।

–কিন্তু বাজ তো পড়ছে না।

–পড়তেও তো পারে, তারপর সম্মা এমন একটা প্রস্তাব করল, যেটা শুনে জেফ শিউরে উঠেছিল। সে ভাবতেই পারেনি, সম্মার কাছ থেকে এমন একটা আমন্ত্রণ আসতে পারে।

সত্মা চলে গেল। জেফ বলে গেল, আসছি, ঝটিতি পোশাক পরে জানলা দিয়ে জেফ বেরিয়ে গেল, আর ফিরে এল না। এল কানসাসে। দেখা করল উইলিকাকার সঙ্গে। হঠাৎ চলে আসার কারণ জানতে চাইলে জেফ হাসতে হাসতে বলেছিল, সত্যার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না।

উইলিকাকার সঙ্গে বাবার কথা হল টেলিফোনে। ঠিক হল, জেফ এবার উইলিকাকার সঙ্গেই থেকে যাবে।

কার্নিভালের নিজস্ব একটা জগত আছে। একদিন উইলিকা সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন। উদগ্রীব দর্শককে কীভাবে ঠকাতে হয়, তাও শিখে নিল জেফ।

কার্নিভালের বন্ধুরা ক্রমশ জেফের বন্ধু হয়ে উঠল। ওই দলে কিছু যুবতী ছিল, যাদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। জেফ মায়ের বুদ্ধি আর বাবার রূপটা পেয়েছিল। এইসব মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কে আগে জেফের কৌমার্য হরণ করবে, তা নিয়ে একটা জোর লড়াই শুরু হয়ে গেল। জিমন্যাস্টিকের খেলা দেখানো মেয়েটি শেষ পর্যন্ত জিতে গেল।

উইলিকাকা জেফকে সব কিছু শেখালেন। বললেন একদিন এসব তোমারই হবে জেফ, এখন থেকে না শিখে রাখলে পরে অসুবিধায় পড়তে হবে।

জেফ একটা বিচিত্র খেলা শিখল প্রথমে, লম্বা টেবিলের অন্য প্রান্তে কাপড়ের তৈরী ছটা বেড়াল, খেলুড়েকে একটা বল দেওয়া হয়, ওই বল দিয়ে ছটা বেড়ালকে কাত করতে পারলে বাজি জেতা যায়। বেড়ালগুলো পায়ের বদলে কাঠের চাকতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকে দলের একজন। ইশারা পাওয়া মাত্র সে কাঠের ছড়ি আটকানো একটা বেড়ালকে সোজা করে দেয়। খেলুড়ে তাই হেরে যায়।

–আরে ফেলতে পারলেন না। খুবই সহজ ব্যাপার। বলতে শোনা যায় খেলার পরিচালককে। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের তলার লোকটি কাঠের ছড়িটাকে আলগা করে রাখে। পরিচালক বল ছোঁড়ে, আর ছটি বেড়াল কুপোকাত হয়ে যায়।

–নিন, আবার পরীক্ষা করুন। পরিচালক তাকে আবার ডাকে। সঙ্গে বান্ধবী আছে। তার কাছে হিরো সাজতে হবে। সুতরাং আবার পয়সার খেলা।

এইভাবে লোক ঠকানোর ব্যাপারগুলো জেফ অতি সহজেই শিখে ফেলল। উইলিকাকা তার এই কাজে খুবই খুশী হয়েছেন।

বছর চারেক সে কার্নিভালে কাটিয়েছিল। নানা চরিত্রের মানুষের সঙ্গে পরিচিতি অর্জন করল। কীভাবে মানুষের মনে লোভের সুড়সুড়ি দিতে হয়, তা শিখে ফেলল। এখন তার বয়স আঠারো বছর। চোখে পড়ার মতো সুন্দর হয়েছে। তার মাথায় কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি আরো সুন্দর। পুরুষ এবং শিশুরা সকলেই জেফের সান্নিধ্য চাইছে। খদ্দেররা খুব সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল।

একদিন উইলিকাকা বললেন–শহুরে লোকগুলোর ব্যাপারে এতটা ভাবনা-চিন্তা করবে না, ওদের বাবারা এক-একজন শেরিফ।

ছুরি ছোঁড়ার খেলাটা যে দেখাত, তার বউয়ের জন্য জেফকে কার্নিভাল ছাড়তে হল। তখন কার্নিভাল জর্জিয়ার মিল্ডগেভিলে তাঁবু ফেলেছে। সিসিলির বিখ্যাত ছুরি ছোঁড়া খেলোয়াড় জোরবিনির সঙ্গে নতুন একটা কনট্রাক্ট হল। যৌবনবতী স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে দূর থেকে সে ছুরি ছুঁড়ে মারে। দারুণ উত্তেজক খেলা, লোকটার নাম হয়ে গেল গ্রেট জোরবিনি।

তখনো পুরোপুরি কার্নিভাল শুরু হয়নি। জোরবিনি তার স্টেজ এবং সাজসরঞ্জাম সাজাবার কাজে ব্যস্ত। জোরবিনির বউ জেফকে ডাকল তার হোটেলে।

সে বলল–জোরবিনি আজ সারাদিন এখানে কাজে ব্যস্ত থাকবে। চলো না আমরা একটু ফুর্তি আমোদ করি। জেফ ভাবল, মন্দ কী?

–এক ঘণ্টা পরে এসো। জোরবিনির বউ বলল।

–একঘণ্টা কেন?

বউটা হেসে বলল–তৈরী হতে এক ঘণ্টা সময় নেবো।

একটা ঘণ্টা বুঝি আর কাটতে চাইছে না। শেষ পর্যন্ত জেফ পৌঁছালো জোরবিনির বউয়ের ঘরে। অর্ধনগ্ন অবস্থায় বউ দরজা খুলে দিল। জেফ ওকে হাত বাড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল, বউটা পিছলে সরে গিয়ে বলল, চলো, ভেতরে চলো।

বাথরুমে ঢুকে জেফের চোখ একেবারে আটকে গেছে। বাথটবে ছরকমের বিভিন্ন স্বাদের আর রঙের জেলি রয়েছে, গরম জলে মেশানো অবস্থায়।

–এসব কী?

–শেষ পাতে যা খাও, নাও, এবার জামাকাপড় খুলে এর মধ্যে নেমে পড়ো। বউটার কথা মতো কাজ করল জেফ। চটচটে জেলির সংস্পর্শে এসে শরীরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। দেখতে দেখতে বউটাও বাথটবে নামল। জেফের গা চাটতে শুরু করল অদ্ভুত ভাবে। এ ধরনের উন্মাদনা জেফ কোনো দিন অনুভব করেনি। হঠাৎ বাথরুমের দরজা খুলে জোরবিনি ঢুকে পড়ল। নিজের ভাষায় কী যেন বলল সে। তবে সে যে ভীষণ ক্ষেপে গেছে, তা বোঝা গেল।

জোরবিনি বোধহয় ছুরি আনতে শোবার ঘরে গিয়েছিল। এই ফাঁকে কোনরকমে পোশাকগুলো তুলে জানলা দিয়ে লাফ মেরে জেফ বাইরের গলিতে পড়েছে। উলঙ্গ অবস্থায় ছুটছে। দু-একটা ছুরি সাঁ সাঁ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে গেল জেফ। চোখের আড়ালে গিয়ে তার জেলি মাখানো গায়ের ওপর প্যান্ট অর জামা চাপাল। চলে এল বড়ো রাস্তায়। প্রথম বাসটা ধরে শহর থেকে পালাল। ছমাস বাদে তাকে দেখা গেল ভিয়েতনামে।

.

ভিয়েতনামের যুদ্ধ জেফকে আরো নিষ্ঠুর এবং হৃদয়হীন করে তুলল। শাসক গোষ্ঠীর আমলা তন্ত্রকে নতুন করে ঘেন্না করতে শিখল সে। সে ভাবতেই পারেনি, অর্থ, সম্পদ আর মানুষের প্রাণের এমন অপচয় চোখের সামনে কোনোদিন দেখতে হবে।

যুদ্ধ থেকে ছাড়া পাবার কয়েক সপ্তাহ আগে সে খবর পেয়েছিল উইলিকাকা মারা গেছেন। কার্নিভালের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। তার মানে অতীতটা এখন চিরদিনের মতো অতীত হয়ে গেল। শুধু ভবিষ্যতের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে হবে।

এর পরের কয়েকটা বছর দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে কেটে গিয়েছিল। জেফের কাছে সমস্ত পৃথিবীটা এখন এক কার্নিভাল। খালি ঠকিয়ে যাও সবাইকে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিল এক ডলারে রাষ্ট্রপতির রঙিন ফটো দেওয়া হবে। হাজার হাজার ডলার এল। ফটোর বদলে রাষ্ট্রপতির ছবি দেওয়া ডাকটিকিট একটা করে পাঠিয়ে দিল সবাইকে।

পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিল–পাঁচ ডলার না পাঠালে পশ্চাতে হবে। কীসের জন্য এই পাঁচ ডলার তার কোনো উল্লেখ থাকল না। তবু পাঁচ ডলারের বন্যা বয়ে গেল।

এভাবেই চলছিল, লোক ঠকিয়ে। হঠাৎ এক বন্ধুর কাছ থেকে চাকরির খবর পেল। একটা প্রমোদ তরণী তাহিতি যাচ্ছে। সেখানে কাজের লোক চাই। সমুদ্র ভীষণ ভালোবাসে জেফ। নাবিক হিসাবে সেই চাকরিতে যোগ দিল সে।

জাহাজটা দারুণ সুন্দর দেখতে। দুধসাদা রঙের। সমুদ্রের বুকে রাজহাঁসের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুন্দর কেবিন আছে, ক্যাপ্টেন, স্টুয়ার্ট, আর রাঁধুনি ছাড়া পাঁচজন নাবিক আছে। জেফের কাজ হল পাল তোলা আর নামানো। এছাড়া তাকে আর একটা কাজ করতে হত। জাহাজের পেতলের অংশগুলো ঘষে মেজে পরিষ্কার রাখতে হত।

একটা দল হাওয়াই দ্বীপের তাহিতিতে ফুর্তি করতে চলেছে। জেফের বন্ধু বলেছে। মালিকের নাম হল্যান্ডার।

এই হল্যান্ডারের এক পঁচিশ বছরের সোনালী চুলের সুন্দরী যুবতী, তার পুরো নাম লুই হল্যান্ডার, মেয়েটির বাবা মধ্য আমেরিকার প্রায় আধখানার মালিক, অর্থাৎ ভীষণ বড়লোক। লুই হল্যান্ডার বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে বেরিয়েছে।

দ্বিতীয় দিনে জেফ একমনে কাজ করছিল। হঠাৎ লুই তার পাশে এসে দাঁড়াল।

–জাহাজে নতুন মনে হচ্ছে? লুই-এর দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল জেফ। আহা এমন সৌন্দর্য এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল।

–তোমার নাম কী?

–জেফ স্টিভেন্স।

–জানো আমি কে?

–না।

–এই জাহাজটা আমার।

–তাহলে আমি আপনার কাছে চাকরি করছি।

হল্যান্ডার একটু হেসে বলল–হ্যাঁ তাই।

–মাইনের টাকাটা যদি পুরো আদায় করতে চান তাহলে আমাকে আমার মতো কাজ করতে দিন, নিস্পৃহ কণ্ঠে জেফ বলেছিল।

রাত্রে জাহাজের অন্য কর্মীরা হৈ হৈ করে হুল্লোর করত, জেফ কিন্তু গুটিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকতো। এদের তুলনায় সে কতটা নিকৃষ্ট। এদের শিক্ষাদীক্ষা বংশ পরিচয় সবকিছু বলবার মতো, কিন্তু সে কিছুই শেখেনি, উইলিকাকার কার্নিভাল ছাড়া আর কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার।

জাহাজের একজন কর্মী ছিলেন অধ্যাপক। তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে চাকরী করতেন। দুষ্প্রাপ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি চুরি করে বিক্রি করতেন। এই অপরাধে তার চাকরী চলে গেছে। তিনি জেফের সঙ্গে গল্প করতেন। তার স্বপ্ন আফ্রিকার প্রাচীন প্যারিস অর্থাৎ কার্থেজ শহরে গিয়ে খননকার্য চালাবেন। ইতিহাসের বিস্মৃত সূত্র আবিষ্কার করবেন। জেফের আগ্রহ দেখে তিনি বলেছিলেন তখন তুমিও আমার সঙ্গে থাকবে। কিছুকাল বাদে ওই অধ্যাপক মারা যান। জেফ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল এই জীবনে অন্তত একবার কার্থেজে যাবে।

তাহিতিতে পৌঁছবার আগের দিন লুই হল্যান্ডার জেফকে ডাকল তার কেবিনে।

জিজ্ঞেস করলো–কেমন লাগছে তোমার এখানে।

–মন্দ কি।

–কী ধরনের মেয়েদের তুমি পছন্দ করো?

–তাতে আপনার কী দরকার?

জেফের ওই কাঠ কাঠ উত্তর শুনে হল্যান্ডারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল।

কাল রাতে একটা ডিনার পার্টি দিচ্ছি, তুমি অবশ্যই এসো কিন্তু। উত্তর দেবার আগে । জেফ তাকালো ওই সোনালী চুলের মেয়েটির দিকে। তার আত্মারাত্মা কেঁপে উঠল। কিন্তু এ এক অসম আমন্ত্রণ, শেষ পর্যন্ত জেফ ঘাড় কাৎ করলো।

এভাবেই একটা অভাবনীয় ঘটনার সূত্রপাত হল।

.

এবার হল্যান্ডার-এর পরিচয়টা দেওয়া যাক। বয়েস মাত্র একুশ হলে কি হয়, ইতিমধ্যেই দু-দুবার স্বামী পাল্টেছে সে। তৃতীয় স্বামীর সঙ্গে এখন চলেছে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা। পরদিন বন্দরে জাহাজ নোঙর করলো। একে একে সকলেই তীরে নেমে যাচ্ছে। এমন সময় জেফের ডাক পড়ল ব্যক্তিগত কেবিনে। সেখানে ঢুকে জেফ চোখ সরাতে পারলো না। চোখের সামনে এমন একটা আগুন-যৌবনের মেয়ে যদি খাটো স্কার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে অবস্থা কেমন হয়।

–দেখো না জিপটা কিছুতেই লাগাতে পারছি না।

জেফ কাছে গিয়ে পোশাকটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো, কাচুমাচু মুখে বলল, ম্যাডাম, এখানে হুক লাগাবার ব্যবস্থাই নেই।

হল্যান্ডার দুষ্ট্রহাসি হেসে বলল–সেখানেই তো আসল সমস্যা। আশা করি তুমি আমাকে সমাধানের উপায়টা বাতলাতে পারবে।

এরপর যা হল ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় কি? ডেকের ওপর আদিম লীলার সাক্ষী হয়ে রইল সমুদ্রের বুক থেকে ছুটে আসা লোনা বাতাস আর উজ্জ্বল নীল আকাশ।

তারপর প্রতি রাতে একই অভিনয়ের পুনরাবৃত্তি হতে থাকল। চলতে থাকলো অভিসারের পালা। বন্ধুরা ঠাট্টা করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেলুই আরেকটা খেলার পুতুল ধরেছে।

কিন্তু যখন সকলে খবর পেল লুই সত্যি সত্যি জেফকে বিয়ে করতে চলেছে, তখন তারা অবাক না হয়ে পারলো না। কোথায় লুই আর কোথায় জেফ? জেফের অতীত সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, আর লুই কিনা চতুর্থ বারের জন্য জেফকেই বেছে নিল তার স্বামী হিসেবে?

জেফ তার অভাবিত ভাগ্য উন্নতিতে ভীষণ অবাক হয়ে যায়। তার মধ্যে কি এমন আছে যা দেখে লুই তার প্রেমে পড়েছে? কিন্তু জেফের মধ্যে একটা আশ্চর্য পৌরুষ আছে, সুন্দর দেখতে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বুদ্ধির সাহচর্য। স্বামী হিসেবে তাকে গ্রহণ করতেই হবে।

বিয়ের প্রস্তাব পেতেই জেফ সত্যিই চমকে উঠেছিল। কিন্তু তার মধ্যেও একটা সুপ্ত বাসনা ইতিমধ্যেই উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। কতদিন আর সে বানজারা জীবন যাপন করবে? এবার তো তাকে ঘরসংসার গুছিয়ে নিতে হবে।

তিনদিন বাদে তাহিতির এক গির্জাতে গিয়ে হল্যান্ডারের সাথে জেফের বিয়ে হয়ে গেল।

নিউ ইয়র্কে ফিরে আসার পর লুই হল্যান্ডারের অ্যাটর্নি স্কট ফোগটি জেফকে ডেকে পাঠালেন। শান্ত নিরুত্তাপ এই ভদ্রলোক। হাসি শব্দটার মানে বোধহয় ভুলে গেছেন।

তিনি জানালেন–একটা কাগজে আপনাকে সই করতে হবে।

জেফ জানতে চাইল–কী কাগজ?

–এটা একটা না-দাবীপত্র। এতে লেখা আছে যদি ভবিষ্যতে আপনার সাথে হল্যান্ডারের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাহলে আপনি সম্পত্তির ব্যাপারে কোনোভাবেই নাক গলাতে পারবেন না এবং…

অ্যাটনীর কথা শেষ হবার আগেই জেফ বলল–দিন কোথায় সই করতে হবে। আমি টাকার জন্য ওকে বিয়ে করিনি।

অ্যাটর্নী একটু আশ্চর্য হয়ে দলিলটা বাড়িয়ে দিলেন, সই করে নীচে নেমে এল জেফ, ড্রাইভার সমেত একটা দামী গাড়ি তাকে দেওয়া হয়েছে। গাড়িতে বসে মনে মনে সে ভাবতে লাগল, আমি হলাম এক নাম করা প্রতারক, আর কত সহজে এই দামী পত্রটা সই করে দিয়ে এলাম। কিন্তু, মানুষ যে কখন কোথায় কি অভিনয় করে কেউ তা জানে না।

নাম করা দর্জির দোকান থেকে দারুণ সুট তৈরি করা হল। জেফের চেহারা তখন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এমন কি লুই-এর তিন-চারজন বান্ধবী জেফের সাহচর্যে আসতে চাইছে।

লুই-এর দাদা বাজ হল্যান্ডারের সুপারিশে জেফকে নিউইয়র্কের বিখ্যাত পিলগ্রিম ক্লাবের সদস্য পদ দেওয়া হল। বাজ একটু মোটাসোটা মাঝবয়েসী পুরুষ। হারভার্ড ফুটবল টিমে দারুণ ব্যাক ছিল। এখনও জাহাজ আছে। আছে মাংস প্যাক করার কোম্পানী। আরও ছোট ছোট ব্যবসা। জেফ স্টিভেন্সকে সে কখনই পছন্দ করে না। কিন্তু বোনের মুখের ওপর না বলতে পারছে না।

বারবার সে বলতো–তুমি আমাদের বংশের ঠিক উপযুক্ত নও। যতদিন আমার বোন তোমাকে পছন্দ করবে ততদিন পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু মনের থেকে তোমাকে যদি অপছন্দ করতে শুরু করে তাহলে জেফ আমিও আর তোমার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেবো না।

বাজ হল্যান্ডারের এই গা জ্বালা কথাগুলো জেফের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মুখে সে কিছু বলেনি।

পিলগ্রিম ক্লাবের বাজের বন্ধু-বান্ধবরাও ওকে নিয়ে ঠাট্টা হাসি করতো। জেফ কিন্তু সহজ সরল ভাবে কার্নিভালের গল্পগুলো বলতো। মাঝেমধ্যে সেখানে রঙ চড়াতো, সবাই এসব গল্প শুনে খুব মজা পেতো।

জেফ আর লুই থাকতো ম্যানহাট্টনের পূর্ব দিকে। কুড়িটা ঘরওয়ালা একটা বিশাল বাড়িতে। ঘরে অসংখ্য চাকর-বাকর। এছাড়া লং আইল্যান্ড, বাহামা দ্বীপ, কর্ডিনিয়া আর প্যারিসেও লুই-এর. বড়ো বড়ো বাড়ি আর ফ্ল্যাট আছে। আছে ব্যবহার করার জন্য দশ। বারোটি গাড়ি।

কিছুদিন এইভাবে কেটে গেল, একদিন সকালে হাই তুলতে তুলতে জেফ বলল লুই, কতদিন আর বসে বসে তোমার অন্ন ধ্বংস করবো? লোকে তাহলে বলবে কি? আমাকে গায়ে-গতরে কিছু করতে দাও।

শেষ পর্যন্ত লুইকে রাজী করাতে পারলো জেফ। বাজকে বলতেই জেফকে তার শেয়ার কেনাবেচার ব্যবসায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল।

উপার্জনের একটা ভালো ব্যবস্থা হয়েছে, এবার বাচ্চা চাই।

লুই রাজী হয়েছে। একদিন পিলগ্রিম ক্লাবে বাজের সঙ্গে জেফ ডিনার খাচ্ছে, বাজের পার্টনাররাও আছে।

বাজ ঘোষণা করলো–এবারের বাৎসরিক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে আমরা মাংস প্যাকিং-এর ব্যবসাতে প্রায় চল্লিশ শতাংশ লাভ করেছি।

একজন পার্টনার হাসতে হাসতে বলল, তুমি ইন্সপেকটরকে ঘুষ দিয়েই তো এসব । করেছে। বাজে মাংস কিনে তার ওপর এ ক্লাশ মাংসের ছাপ লাগিয়ে নিয়েছে।

জেফ এতটা ভাবতে পারেনি–আরে ওই মাংস তো বাচ্চারা পর্যন্ত খাবে, কি সর্বনাশ, বাজ, ওই ভদ্রলোক নিশ্চয় ঠাট্টা করে এসব বলছে।

বাজ দাঁত বের করে হাসতে শুরু করে দিল। বলল–দেখো কার মুখে কোন নীতির বুলি।

পরের তিন মাসে জেফ গোপন কারবারের আরও অনেক গোপন খবর পেল। জেফ বুঝতে পারলো কালো পথ কোথায় চলে গেছে।

জেফ মনে মনে ভাবলো এরা সব ভদ্রলোক, কিন্তু এখন বুঝতে পারলো এরা সব জোচ্চোর, বউয়েরা সবকিছু জেনে চুপ করে আছে। স্বামীদের টাকায় ফুর্তি করছে। আর লোক ঠকিয়ে চলেছে।

একদিন জেফ সব কথা লুইকে বলল।

হাসতে হাসতে লুই বলল, জেফ বেশি সরল হবার চেষ্টা কোরো না। জীবনটাকে উপভোগ করছো করে যাও।

জেফ বিন্দুমাত্র সরল লোক নয়। কিন্তু লুইকে ভালেবেসে বিয়ে করেছে, লুইকে সঙ্গিনী করে ভবিষ্যৎ জীবনটা সুখে শান্তিতে কাটাবে–সত্যি সত্যি এমন একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সে।

অন্যদিকে মন চাইল–আমাদের একটা বাচ্চা হোক, তোমার একটা আমার একটা, একবছর হয়ে গেল আমাদের বিয়ে হয়েছে।

জেফের গায়ে হাত বুলিয়ে লুই বলল–একটু ধৈর্য ধরো লক্ষ্মীটি, আমি ডাক্তার দেখিয়েছি, এবার তুমি একবার দেখিয়ে নাও।

জেফও ডাক্তার দেখালো, সেও ঠিক আছে, তবু বাচ্চা আসে না কেন?

একদিন সকালে মাথাব্যথা করছিল জেফের। লুই-এর ওষুধের বাক্সে অ্যাসপিরিন খুঁজতে গেল। সেখানে একগাদা গর্ভনিরোধক পিল দেখতে পেল।

জেফ বুঝতে পারলো, ব্যাপারটা আসলে কি। দুপুরে ক্লাবে গিয়ে টেবিলে না বসে আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়েছিল, বাজ এলে খাবার টেবিলে যাবে এমনই ইচ্ছে ছিল তার। ০ হঠাৎ জেফের কানে শব্দ ভেসে এল, কারা যেন লুইকে নিয়ে কথা বলছে। লুই যে..

বহুচারিণী এবং ইতালীয়ান বাবুর্চির সঙ্গেও যে তার অবৈধ সম্পর্ক আছে একথাটা জেফের কানে গেল। সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। অবাধ ব্যাভিচারের পথ প্রশস্ত রাখতেই লুই নাকি জেফের মতো কার্নিভালের লোককে বিয়ে করেছে এমন কথাও শুনতে পেল।

বাড়ি ফেরার পথে জেফ প্রতিজ্ঞা করলো, আগে এই ইতালীয়ান বাবুর্চিটাকে সে খুন। করবে, পরে লুইকে হত্যা করবে। সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে যে লুইকে ভালোবাসতো জেফ সেই লুই কিনা এই প্রতিদান দিচ্ছে?

শেষ অবধি মাথা ঠান্ডা করল জেফ। বাজ, এডজেলার, মাইক কুইন্সি আর তাদের বৌরা নিশ্চয় আড়ালে-আবডালে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু এখনই ভেঙে পড়লে চলবে না। অন্য একটা পথ বের করতে হবে। সে লুই-এর সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে চলল।

পরের সপ্তাহে জেফ বুদ্ধি খেলিয়ে একটা প্লান বের করল। সময় বুঝে ক্লাবে লাঞ্চ করার সময় বলল–কম্পিউটার নিয়ে জালিয়াতি হয় সে সম্বন্ধে তোমরা কি জানো?

একজন বলল–কেন তুমি কিছু করতে চাও নাকি?

–আমি কিন্তু এ ব্যাপারে ঠাট্টা করছি না, এটা একটা বড়ো সমস্যা। এর সাহায্যে ব্যাঙ্ক আর বীমা কোম্পানীগুলিকে কোটি কোটি টাকা ঠকানো হচ্ছে জানো কি? সম্প্রতি একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে এমন একটা কম্পিউটার তৈরি করেছে যাতে জালিয়াতি করা যায় না।

মাইক কুইন্সি জানতে চাইল তুমি কি চাও লোকটার পেছনে আমরা টাকা ঢালি?

–সত্যি কথা বলতে কি ওকে মদত দেবার জন্য আমি টাকার জোগাড়ে বেরিয়েছি। আমি জানতে চাইছিলাম কম্পিউটার সম্পর্কে তোমরা কিছু জানো কি না?

–আমরা কিছুই জানি না, তবে কেউ যদি আবিষ্কার কিছু করে তাহলে তাকে আমরা মদত দিতে পারি। বাজের কথা শুনে অন্য বন্ধু-বান্ধবরা হো হো করে হেসে উঠলো।

দুদিন বাদে জেফ বলল–দুঃখিত আজ তোমাদের টেবিলে বসতে পারছি না, আমার এক অতিথি আসবেন, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ওয়েটার সাদা চুল, আধবুড়ো এক বৃদ্ধকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।

মাইক কুইন্সি বলল–হ্যায় ভগবান, উনি, প্রফেসার অ্যাকারমান।

–অ্যাকারমান কে?

–বাজ তুমি কি ফাইনান্স রিপোর্ট পড়োনি? পড়লে জানতে, উনি প্রেসিডেন্টের জাতীয় বিজ্ঞান পর্ষদের সভাপতি। আমাদের দেশের সব থেকে বড়ো বিজ্ঞানী।

–আমার শালার সাথে ওঁর কি কাজ থাকতে পারে? জেফ আর অধ্যাপক লাঞ্চ খেতে খেতে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছিলেন, বাজ এবং তার বন্ধুরা ক্রমশ ছটফট করতে শুরু করেছে। প্রফেসার চলে যেতেই বাজ জেফকে ডাকলো এই যে লোকটা কে?

জেফ অপরাধীর মতো মুখ কাঁচুমাচু করে বলল তুমি অ্যাকারমানের কথা বলছো?

–হ্যাঁ, কি কথা হচ্ছিল এতক্ষণ?

–আমাদের…, বাজের বন্ধুরা জেফের দিকে তাকিয়ে আছে।

–আমি ওঁর সম্বন্ধে একটা বই লিখবো ভাবছিলাম।

–তুমি কি লেখক?

–না, লিখতে তো পারি!

তিনদিন বাদে জেফের সঙ্গে অন্য এক ভদ্রলোক লাঞ্চ খেলেন। বাজ ওকে চিনতে পেরেছে-উনি তো সেমুর জ্যারেট, কারেন্ট ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার কোম্পানির চেয়ারম্যান। জেফের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক হল কি করে?

দেখা গেল এবারও জেফ খুব অন্তরঙ্গভাবে সেমুর জ্যারেট-এর সঙ্গে কথা বলছে।

–জেফ, ঠিক করে বলো তো জ্যারেটের সঙ্গে তোমার কি কাজ?

জেফ বলল–কিছু না, একটু গল্প করছিলাম, বলতে বলতে দরজার দিকে পা বাড়াল।

বাজ বলল–অত তাড়াহুড়োর কি আছে, সেমুর জ্যারেট ভীষণ ব্যস্ত মানুষ ত, অকারণে উনি তোমাকে এতটা সময় দেবেন না। ঠিক করে বললো তো?

জেফ বলল–সত্যি কথাটাই বলছি, সেমুর ডাকটিকিট জমায়। একটা খুব দামী ডাকটিকিট ওঁকে জোগাড় করে দিতে হবে, তাই আমাকে অনুনয় বিনয় করছিলেন।

–এই তোমার সত্যি কথা…, মনে মনে ভাবলো বাজ।

পরের দিন চার্লস বার্লেটের সঙ্গে ক্লাবে জেফ লাঞ্চ খাচ্ছিল। বার্লেট হলেন বেসরকারী পুঁজি লগ্নিকরার সবচেয়ে বড়ো সংস্থা বার্লেট অ্যান্ড বালেট কোম্পানীর সভাপতি। দুজনকে প্রায় মুখে মুখ ঠেকিয়ে কথা বলতে দেখে বাজ, অ্যাডজেলার, অ্যালান আর মাইক অবাক হয়ে গেল।

–তোমার শালা দেখছি উঁচু মহলে ঘোরাফেরা করছে এখন। কী ব্যবসা কাঁদছে, এডজেলার প্রশ্ন করল।

–জানি না, তবে জানতে হবে, জ্যারেট আর বার্পেটের মতো লোকেরা যখন ঝুঁকেছেন তখন বুঝতে পারছি মোটা অঙ্কের খেলা হবে।

ওরা দেখল বার্টে উঠে দাঁড়িয়েছেন, ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে জেফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে গেলেন।

–বোসো জেফ। তোমার সঙ্গে কথা আছে। বাজ হাত ধরে বসালো জেফকে।

–অফিস যেতে হবে, কাজ আছে। জেফ বসতে চাইছে না।

–কাজ? তুমি আমার অফিসেই কাজ করো আর আমাকেই কাজ দেখাচ্ছো?

–জেফ বলল–বল, কী কথা শুনতে চাইছো?

–কার সাথে লাঞ্চে খাচ্ছিলে?–আমার পুরোনো বন্ধুরা।

–চার্লি বার্লেট তোমার পুরনো বন্ধু?

–ওই আর কি?

–কি বিষয়ে কথা হচ্ছিল?

–চার্লি পুরনো গাড়ি পছন্দ করেন। আমি ওঁকে প্যাকার্ড গাড়ি পাইয়ে দেব বলেছি।

এবার বাজ বলল–জেফ আর বাজে বোকো না, তুমি গাড়ি বিক্রি করো না, বই তুমি কোনোদিন লেখো না। আসল ব্যাপারটা খুলে বলোত।

জেফ আমতা আমতা করতে থাকে–মানে, মানে?

–তুমি টাকা জোগাড়ের ধান্দায় আছো তাই না জেফ? অ্যাডজেলার জানতে চাইল।

একটু ঘাবড়ে না গিয়ে তাড়াতাড়ি জেফ বলল–না।

বাজ তার মোটা হাতটা জেফের ঘাড়ে রেখে বলল–কি হচ্ছে জেফ এসব? আমাকে। সব কথা খুলে বলো? এক পরিবারের লোক আমরা।

তারপর খুব দরদ মেশানো গলায় বাজ বলল–ওই অল প্রফ কম্পিউটারের বিষয়?

জেফ এবার সত্যিই ধরা পড়ে গেছে। বাজ আর তার বন্ধুরা উল্লাসিত।

বাজ বলল–তুমি কেন বলোনি প্রফেসর আকারমান এর সঙ্গে যুক্ত আছেন?

–আমি ভেবেছিলাম তোমরা এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না।

–ভুল ভেবেছিলে, পুঁজির দরকার হলে আমরা সকলেই সাহায্য করবো। তুমি এত কিন্তু কিন্তু করছো কেন?

বাজের কথার মধ্যে সহানুভূতি ঝড়ে পড়ছে।

চালাক জেফ বলল–আমার আর প্রফেসারের পুঁজির দরকার নেই। জ্যারেট আর বালেট…

জেফের মুখের কথা টেনে বাজ বলল–ওঁরা দুজন এক নম্বরের শয়তান, ওঁদের শয়তানিতে তুমি যেন ফেঁসে যেও না।

অ্যাডজেলার বলল–জেফ, বন্ধুদের মধ্যে লেনদেন করলে ভয়টা থাকে না।

–কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেছে।

–সইসাবুদ হয়ে গেছে কী?

–কথা দিয়েছি।

–ওরকম অনেক কথা দেওয়া হয়, গুলি মারো তো।

–তোমাদের সাথে ও নিয়ে আলোচনা করাই ভুল হয়েছে, জেফ প্রতিবাদের সুরে বলল, এই ব্যাপারে প্রফেসর অ্যাকারমানের নাম উল্লেখ পর্যন্ত করা যাবে না।

–তা আমরা জানি, মাইক বলল–প্রফেসর কি মনে করেন জিনিসটা কাজ দেবে?

–উনি এ ব্যাপারটা বার বার পরীক্ষা করেছেন।

একটু বাদে বাজ জানতে চাইল–প্রথমে কত টাকা লগ্নী করতে হবে?

–বিশ লাখ ডলার দরকার। শুরু করতে গেলে আড়াই লাখ হলেই চলবে। বালেট কথা দিয়েছেন–

আবার সেই বালেট, বাজ ঝাঁঝিয়ে উঠল–ওই টাকাটা আমরা দিতে পারবো।

কাগজ কলম আনার কথা বলা হল। চুক্তিটা ওখানেই করতে হবে। বাজ বলল কাল সকালে তোমাকে আড়াই লক্ষ ডলার দিয়ে দেবো।

জেফ বলল–বাজ আমি যে বার্লের্টকে কথা দিয়েছি।

–বালেটকে গুলি মারো, তুমি কার বোনকে বিয়ে করেছো? নাও লেখো।

–কিন্তু বাজ এখনও জিনিসটাকে আমরা পেটেন্ট করাইনি, শেষ ক্ষীণ আপত্তি জানানোর চেষ্টা করল জেফ।

–বাজে কথা ছেড়ে সইটা করো তো।

বাজ জেফের হাতে কলমটা ধরিয়ে দিল।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও জেফ লিখতে শুরু করল–এতদ্বারা আমি SUCABA নামের একটি গণনাকারী কম্পিউটার সম্পর্কিত আমার সমস্ত অধিকার, স্বত্ত্ব, স্বামীত্ব দান করছি ডোনাল্ড বাজ হল্যান্ডার, অ্যাডজেলার, অ্যালান টমসন এবং মাইক কুইন্সিকে, আড়াই লক্ষ ডলারের বিনিময়ে।

জেফ সই করে কাগজটা ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল–ঠিক আছে তো সবকিছু? এসব ব্যাপার আমি ভালো বুঝি না।  

–দাও এর একটা কপি করে দিই। কপি করা হল, সবাই সই করল।

পরদিন সকালে আড়াই লাখ ডলারের চেক পেয়ে গেল জেফ।

বাজ জানতে চাইল-কম্পিউটার কোথায়?

–দুপুরবেলা ওটা ক্লাবে পৌঁছে যাবে, সকলে একসঙ্গে দেখুক এটাই আমার মনোগত বাসনা।

ঠিক দুপুর বারোটার সময় একজন এসে বাজদের টেবিলে দেখা করল। জিনিসটা সে সঙ্গে এনেছে। ছোট্ট প্যাকিং বাক্স দেখে বাজ আর তার বন্ধুরা খুবই খুশি হয়েছে। খুব সাবধানে মোড়কটা খুলল। ভেতরে কাঠের একটা চৌকো ফ্রেম। অনেকটা প্লেটের মতো, মধ্যেটা ফাঁকা, তার লাগানো আছে। বড় বড় পুঁতির মতো জিনিস গাঁথা।

আরে এটা তো একটা অ্যাবাকাস–চীন দেশে এটা দিয়ে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করা হয়।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল অ্যালান টমসনের–আরে SUCABA হল উল্টো করে লেখা ABACUS। এটা কী ধরনের রসিকতা?

ঠিক হল এখনই ব্যাঙ্কে ফোন করা হবে, চেকটার পেমেন্ট বন্ধ করতে হবে। ব্যাঙ্কে টেলিফোন করে জানা গেল জেফ স্টিভেন্সকে সকালেই টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কিছুক্ষণ আগে জেফ স্টিভেন্স নাকি জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে।

অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর শেষপর্যন্ত প্রফেসার ভেরমান অ্যাকারমানের ঠিকানাতে ওরা পৌঁছলো।

উনি বললেন, জেফ স্টিভেন্স খুব ভালো লোক, আমাকে নিয়ে একটা বই লিখবেন বলে কথা দিয়েছেন।

সেমুর জ্যারেট প্রথমে মুখ খুলতে রাজী হননি। পরে বললেন–জেফ স্টিভেন্স আমাকে একটা দুলর্ভ ডাকটিকিট দেবেন।

চার্লি বার্লেটও জানালেন–জেফ ১৯৩৭ সালের একটা প্যাকার্ট গাড়ির সন্ধান দিয়েছেন। বাজ আর তার বন্ধুরা শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা করলো যে করেই হোক জেফকে জেল খাটাতে হবে। তারা অ্যাটর্নীর কাছে ছুটল। অ্যাটর্নী সই করা চুক্তি পটাতে ভালো ভাবে চোখ বুলিয়ে পরীক্ষা করলেন। দুঃখিত মুখে তিনি জানালেন–কিছুই করা যাবে না।

রেনোতে গিয়ে লুইয়ের বিরুদ্ধে জেফ ডিভোর্স নিল। সেখানে গুছিয়ে বসবাস করতে করতে তার সঙ্গে আলাপ হল কোনরাড মরগানের। একসময় কোনরাড উইলিকাকার কার্নিভালে কাজ করতো। কোনরাড বলেছিল–একটা ছোট্ট উপকার আমার করে দিতে হবে। নিউ ইয়র্ক থেকে একটা মেয়ে ট্রেনে চেপে সেন্ট লুই যাচ্ছে, তার সঙ্গে কিছু দামী জিনিসপত্র থাকবে।

ট্রেনের জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ট্রেসির মুখখানা ভেসে উঠল। জেফের ঠোঁটের কোণে তখন ফুটে উঠেছে ক্রুর হাসির চিহ্ন।

.

নিউ ইয়র্কে ফিরে ট্রেসি। এল কোনরাড মরগানের জুয়েলারীর দোকানে। ভেতরে ঢুকে বসার পর কোনরাড বলল–তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম, সেন্ট লুই স্টেশনে অনেক অপেক্ষা করার পরেও

–সেন্ট লুইতে তুমি যাওনি।

–কি বললে, আমি যাইনি?

–যাবার কোনো পরিকল্পনা তোমার ছিল না। তুমি দুজন ঠগ প্রতারককে পাঠিয়েছিলে আমার কাছ থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে আনার জন্য।

হতভম্ব কোনরাড বলল–তুমি কী বলছো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

–প্রথমে ভেবেছিলাম কথাটা তোমার এখান থেকেই ফাস হয়ে যাবে। পরে বুঝলাম এটা তোমার কাজ। তুমি নিজের হাতে আমার ট্রেনের টিকিটটা কেটেছে। তাহলে অন্যেরা কী করে আমার কামরার নম্বর জানবে? আমি ছদ্মবেশে ছদ্মনামে ট্রেনে গিয়েছিলাম।

–তুমি কি বলতে চাইছো ট্রেসি, গয়নাগুলো কেউ কি তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে?

–না, শেষ পর্যন্ত পারেনি, তোমার দোস্তরা প্লেন ধরতে ব্যস্ত ছিল। ওগুলো তো আমার কাছেই রয়ে গেছে।

কোনরাড চুলে গেল, একটু বাদে আবার ফিরে এল, মুখে হতাশার ছাপ–দুঃখিত ট্রেসি, একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে, তুমি দারুণ চালাক মেয়ে, ঠিক আছে পঁচিশ হাজার ডলার তোমার পাওনা হয়েছে, গয়নাগুলো দাও।  ট্রেসি বলল–না পঞ্চাশ হাজার ডলারের এক টাকা কম হলে চলবে না।

–কি বললে?

–একই জিনিস আমাকে দু-দুবার চুরি করতে হয়েছে। প্রত্যেকবারের পারিশ্রমিকের জন্য আমি মাত্র পঞ্চাশ হাজার ডলার চাইছি।

–না অতো দিতে পারবো না।

–ঠিক আছে লাস ভেগাসে ওই গয়নার খদ্দের পেতে আমার এক মুহূর্ত দেরী হবে ।

ট্রেসি উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালো।

–পঞ্চাশ হাজার?

ট্রেসি ঘাড় নাড়লল, হ্যাঁ, ওই টাকাটা পেয়ে ট্যাক্সিতে বসার পর আমি তোমাকে একটা স্টেশনের লকারের চাবি দেবো যেখানে গয়নার থলিটা রাখা আছে।

ট্যাক্সিতে বসে ট্রেসি বলল–ধন্যবাদ মিঃ মরগান, তোমার সঙ্গে ব্যবসা করার মধ্যে অনেক আনন্দ আছে।

.

১৯.

ড্যানিয়েল কুপার আগে থাকতেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। লুই বেলামির বাড়িতে চুরির ব্যাপারে তাদের সকলকে ডেকে পাঠানো হবে। জে. জে. রেনন্ডের অফিসে এই মিটিংটা শুরু হয়েছে।

মিটিং চলছে, রেনল্ড খোঁচা দিতে ছাড়লেন না–অপরাধী ধরার ব্যাপারে ড্যানিয়েলের সুনাম আকাশ ছোঁয়া। সবসময় কেন সে যে পাচার মতো মুখ করে বসে থাকে।

রেনল্ড বলছিলেন–বেলামির বাড়ির চুরির রিপোর্ট তো তোমরা শুনলে, আরেকটা খবর জেনে নাও, বেলামি আমাদের পুলিশ কমিশনারের কাজিন। কমিশনার কিন্তু ব্যাপারটাতে খুবই চটে আছেন।

একজন জানতে চাইল–পুলিশ কী করেছে?

রেনল্ড জবাব দিলেন, পুলিশ এই ব্যাপারটার কিছুই করতে পারেনি। চোরের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলা হোল, বলেছিলেন পুলিশ কর্তা। কিন্তু চোরটাকে ধরতে পারেনি।

–মেয়েটার বর্ণনা কেমন?

–নাইট ড্রেসটাই ওরা দেখেছিল ভালো। তাছাড়া, চুলে চুল কুঁচকোবার ক্লিপ আঁটা ছিল, তাই রংটা জানা যায়নি। মুখেও পুরু করে ক্রীম জাতীয় জিনিস মাখা ছিল তাই রং বা অন্য কিছু বোঝা যায়নি।

ড্যানিয়েল বলল হ্যাঁ জানতে পেরেছি।

সবাই চমকে উঠল।

–আমি মেয়েটাকে চিনি।

ড্যানিয়েল কুপার তার রিপোর্ট পড়ে শোনালো। আমি শুধু যুক্তি দিয়ে কাজ করি। প্রথমেই চলে গেলাম লং আইল্যান্ডে। জায়গাটা এমন যে গাড়ী না হলে ওখানে সহজে পৌঁছনো যায় না। গাড়ী ভাড়া দেওয়া কোম্পানীগুলোতে হানা দিলাম। না না, আমায় বাধা দেবেন না, মেয়েরা খুব কম গাড়ী ভাড়া নেয়। মেয়েটির বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এমন একটি মেয়ে বাজেট রেন্ট কোম্পানী থেকে গাড়ী নিয়েছিল খবর পেলাম। রাত আটটায় নিয়ে দুটোতে ফেরত দিয়েছে।

–এটাই যে চুরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, তার প্রমাণ কী? রেনল্ড সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

–শুনুন গাড়ীটার মাইল মিটার চেক করে দেখেছি যেতে ৩২ আর আসতে ৩২ মোট ৬৪ কিমি. উঠেছে। এখান থেকে যে লং আইল্যান্ড ৩২ কিমি সে তো আপনারা জানেন। গাড়ীটা এলেন ব্রাঞ্চের ছন্দনামে নেওয়া হয়েছিল।

এতদূর এগিয়ে গেছে ওই ডিটেকটিভ, রেনল্ড বুঝতেই পারছেন না।

ডিটেকটিভ বলল–ওর আসল নাম ট্রেসি হুইটনি।

কে একজন বলল–এটা কি করে জানলে?

–গাড়ী ভাড়া নেবার সময় একটা ফ্রম ভারতে হয়, সেটাতে আঙুলের ছাপ আছে, আমি সদ্য ছাড়া পাওয়া অপরাধীদের ছাপ মেলাতে গিয়ে ধরে ফেললাম। ওকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। বছর খানেক আগে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

রেনল্ড বললেন, তুমি বলেছিলে মেয়েটা নিরপরাধ।

–তখনও পর্যন্ত ছিল, এখন আর নেই।

রেনল্ড মনে মনে ভাবলেন হারামজাদীটা আবার আমাদের ওপর টেক্কা দিল। মুখে বললেন–তাহলে ওকে এক্ষুনি গ্রেপ্তার করা দরকার।

–কিসের অপরাধে? গাড়ী ধরা পড়ার জন্য? এবারে ওর গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। তবে ও আবার কিছু করলে তখন ওকে আমি ছাড়বো না।

দাঁতে দাঁত চেপে কুপার বলল।

ড্যানিয়েল তার কালো খাতাটা বের করে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখল–ট্রেসি হুইটনি। সকলে জানে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ড্যানিয়েল বার বার এই নামটা উচ্চারণ করবে।

.

২০.

হোটেলের ঘরে বসে ট্রেসি চিন্তা করছিল। এখন আবার তাকে নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু করতে হবে। আর্নেস্টাইন আর অ্যামির কথা মনে পড়লো, একটা খেলনা কিনে পাঠালো অ্যামির নামে। আড়াইশো ডলার পাঠালো আর্নেস্টাইন লিটলচ্যাপের নামে।

এবার সে ঋণমুক্ত, যেখানে খুশি যেতে পারে, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। দামী হোটেলের ঘর থেকে সেন্ট প্যাট্রিক গির্জা আর জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। তার অত্যন্ত প্রিয় আর পরিচিত শহরকে এখন বিদায় জানাতে হবে।

শেষপর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে লন্ডনে যাওয়াটাই ঠিক করলো সে।

টেলিভিশন খুললো, দুজন লোকের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। সোভিয়েত দেশে কৃষ্ণসাগরের তীরে। সোচি শহরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেলায় দুজনে মুখোমুখি হতে চলেছে।

ট্রেসি দাবা খেলার কিছুই জানে না, টিভি বন্ধ করে দিল। ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে ট্রেসি গেল এক ট্রাভেল এজেন্সীর অফিসে। কুইন এলিজাবেথ জাহাজে একটা দামী কেবিন বুক করল।

দামী দামী জিনিসপত্র কিনে যাত্রার দিন জাহাজ ঘাটে পৌঁছে গেল। দেখল রিপোর্টাররা ছেকে ধরেছে দুজন দাবাড়ুকে, মেলনিকভ আর নেগুলেস্কো। বার বার ফটো উঠছে। কোনোরকমে নিজের কেবিনে গিয়ে উঠল ট্রেসি। মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে বাইরে এল। অনেকে এসেছে প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে। ট্রেসির চোখ দুটি হঠাৎ অশ্রু সজল হয়ে উঠল। তাকে ভালোবাসার কেউ নেই।

মনে মনে হাসলো, কেন বিগবার্থা? হঠাৎ তার কথা মনে পড়ে গেল।

যাত্রার দ্বিতীয় দিন ডাইনিং কারে গিয়ে বসেছে তখন ট্রেসি, কে যেন তার দিকে হাত তুলে ডাকল তাকে।  

ট্রেসি মুখ তুলল, এফ. বি. আই-এর সেই জাল অফিসার টম বাওয়ার্স। ট্রেসির অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো, না না, এসব দিনগুলোকে ভুলতে হবে।

–কী আশ্চর্য ব্যাপার, আমি আপনার টেবিলে বসতে পারি?

–বসুন।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে লোকটি বলল, মানে বলছিলাম কি আমরা এখন তো বন্ধু হয়ে উঠতে পারি। বিশেষ করে যখন আমাদের একই উদ্দেশ্য।

ট্রেসি বলল কি বলছেন মিঃ বাওয়ার্স?

–না বাওয়ার্স না, আমার আসল নাম জেফ স্টিভেন্স।

–তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

–দাঁড়ান, আমাদের শেষ সাক্ষাৎকারের ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু বলার আছে আমার।

–বলার কিছুই নেই, একটা বোকা হাঁদা বাচ্চাও ওটা বুঝতে পারতো।

–কোনরাড মরগানের একটা উপকার আমাকে করতে হয়েছিল, জেফ একটু হাসলো, তবে ও আমার ওপর চটে আছে।

–আমিও চটে আছি, জাহাজে কেন উঠেছেন?

–আপনার যা মতলব আমারও তাই, ম্যাক্সি মিলিয়ান পিয়ের পন্ত তো এই জহাজেই চলেছে।

–সে কে?

–তার মানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষটাকে আপনি চেনেন না সে কথা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

–এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, আমি চললাম।

ট্রেসি শান্তি চায়, আর কোনো ঝামেলায় নিজেকে জড়াবে না সে।

রাতের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, ডেকে গিয়ে দাঁড়ালো ট্রেসি। মাথার ওপর তারার চুমকী বসানো কালো ভেলভেটের সামিয়ানা। নীচে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় চাঁদের আলোের ঝিকিমিকি। পাশে কে এসে দাঁড়াল এই পরিবেশে আপনি কী অসামান্য সুন্দরী হয়ে উঠেছেন–আপনি কী তা জানেন?

ট্রেসি বলল–কেন আপনি আমার কাছে আসেন বলুন তো?

ট্রেসিকে চলে যেতে দেখে জেফ বলল–একটা কথা, পিয়ের পন্ত এ জাহাজে যাচ্ছেন না, শেষ মুহূর্তে মত পাল্টিয়ে প্লেন ধরেছেন।

–আহারে, তাহলে আপনার পুরো খরচটাই তো বাজে হয়ে গেল–হুল ফুটিয়ে বলল ট্রেসি।

–তা কেন? ট্রেসির শরীর জরিপ করতে করতে জেফ বলল, জাহাজে কিছু উপার্জন হলে কেমন হয়?

–এত বেপরোয়া কি করে হয় মানুষ? মনে মনে ট্রেসি ভাবল। তারপর বলল–জাহাজ লুঠ করে পালাতে হলে প্লেন বা সাবমেরিন দরকার, সেটা কী আপনার পকেটে লুকোনো আছে?

-লুঠ করার কথা তো বলিনি, আপনি বরিস মেলনিকভ কিংবা পিয়েতর নেগুলেস্কোর নাম শুনেছেন তো? এঁরা রাশিয়া যাচ্ছেন চ্যাম্পিয়ানশিপের ম্যাচ খেলতে। ওদের সঙ্গে খেলার বন্দোবস্ত করতে পারলে কেমন হয়?

–হতে পারে, কিন্তু আমি দাবার অ আ ক খ জানি না।

এবার জেফের মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে গেল। সে বলল–এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়, আমি আপনাকে শিখিয়ে দেবো।

–আপনার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে, ডাক্তার দেখান।

পরদিন সকালে ডেকে পা দিতেই মেলনিকভের সাথে ধাক্কা লেগে গেল। ট্রেসি ছিটকে পড়ে গেল ডেকে।

গর্জে উঠলেন মেলনিকভ–দেখে হাঁটবেন তো, আরও কিছু খারাপ কথা বললেন তিনি।

ট্রেসি মনে মনে ভীষণ অপমানিত বোধ করল।

কেবিনে ফিরে এসে দেখলো জেফ স্টিভেন্সের কাছ থেকে ছটা, ডাক এসেছে। দেখা করার চিরকুটগুলো ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিল সে।

সন্ধ্যের দিকে বারে গেল ট্রেসি। পিয়েতর নেগুলেস্কো আগে থেকেই সেখানে বসেছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে গায়ে পড়ে ভাব জমালেন। ট্রেসির জন্য মদের অর্ডার দিলেন।

বললেন–জানো তো, আমি কে?

ট্রেসি ঘাড় নেড়ে মিষ্টি হেসে বলল–জানি।

–জানতেই হবে, আমি হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু।

ভদ্রলোক ট্রেসির গায়ে হাত দিয়ে একটা কু-প্রস্তাব করে বসলেন। ট্রেসির সমস্ত শরীর তখন অপমানে ঝা ঝা করছে।

জেফের সঙ্গে দেখা করতে গেল সে।

–কী ব্যাপার? জেফ জানতে চাইল।

ট্রেসি ঝোঁকের মাথায় বলল–মেলনিকভ আর নেগুলেস্কোর সম্বন্ধে যা বলেছিলেন এখনও তাই ভাবছেন নাকি?

জেফ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ট্রেসির মনের এই পরিবর্তন কেন হল?

–দুজনকে একটু শিক্ষা দিতে হবে।

–ঠিক আছে, তাহলে আমি আমার প্ল্যান মাফিক এগোই, পরবর্তীকালে আপনাকে আমি সব কিছু জানাবো।

জেফ বরিস মেলনিকভকে বোঝাচ্ছে, এই মেয়েটা ছদ্মনামে এই জাহাজে যাচ্ছে, ও দারুণ দাবা খেলে, ও বলেছে আপনাকে তুড়ি মেরে হারাবে।

এতক্ষণ মেলনিকভ মেয়েদের মগজে কিছু নেই বলেই কপচাচ্ছিলেন, নানাভাবে জেফের প্রস্তাব উড়িয়ে দিচ্ছিলেন কিন্তু এখন তার আঁতে ঘা লাগল। জেফ এবার শেষ চালটা, দিল–মেয়েটা আপনার এবং পিয়েতর নেগুলেস্কোর সঙ্গে একসাথে খেলতে চায়। হেরে গেলে দশ হাজার ডলার দেবে।

কি…কি..বলছে মেয়েটা? আমাদের দুজনের সঙ্গে একসাথে খেলবে? ওর মাথা খারাপ হয়নি। তো?

–না…ভেবে দেখুন দুজনকেই দশ হাজার করে ডলার দেবে। যে দেশে বলবেন সেখানেই টাকাটা জমা দেওয়া হবে।

এই কথা শুনে বরিসের চোখে লোভের আভা ফুটে উঠেছে–এ ধরনের পাগলী মেয়ের নাম তো আমি জীবনে শুনিনি।

–বরিস জানতে চাইলেন, মেয়েটা কোন দেশের?

–আমেরিকান।

–তাই বলুন, ওখানকার বড়োলোকগুলো পাগল হয়।

 জেফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল ঠিক আছে, মেয়েটা পিয়েতর নেগুলেস্কোর সঙ্গে খেলুক।

–নেগুলেস্কোর সঙ্গে মেয়েটা খেলবে?

বরিসের কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হল।

–বলছিলাম ও দুজনের সঙ্গেই খেলতে চাইছে, আপনি যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যান তাহলে আলাদা কথা।

বরিস চিৎকার করে উঠলেন বরিস মেলনিকভ ভয় পায় না। আমি মেয়েটাকে একেবারে শেষ করে দেবো। বলুন কবে খেলতে হবে?

জেফ বলল–মেয়েটির ইচ্ছে শুক্রবার, মানে শনিবারই তো আমরা ইংল্যান্ডে পৌঁছে যাচ্ছি।

–তিনটের সময় খেলা হবে।

–নিস্পত্তি একটা খেলাতেই হবে।

–আর বাজী দশ হাজার।

–আর একটা কথা, আপনি হেরে গেলে এক পয়সাও দিতে হবে না। শুধু সইকরা একটা ফটো উপহার দেবেন মেয়েটিকে। আপনি জিতলে দশ হাজার পাবেন। ড্র করলে কিছুই পাবেন না।

–বাজীর টাকা থাকবে কার কাছে?

–জাহাজের ক্যারিয়ারের কাছে।

–ঠিক আছে, শুক্রবার রাতে খেলবো।

পরদিন জেফ নিয়ে পড়লো নেগুলেস্কোকে। তিনিও প্রথমে রাজী হচ্ছিলেন না। তারপর দশ হাজার ডলারের বাজীর কথা শুনে আমতা আমতা করতে থাকলেন। তার চরম প্রতিদ্বন্দ্বী মেলনিকভ ইতিমধ্যে ফাঁদে ধরা পড়েছেন সেটা শুনে তিনিও রাজী হলেন। আগামী শুক্রবার রাতে তার সাথে মেয়েটির দাবা খেলা হবে।

ট্রেসি প্রায় চিৎকার করে বলল, তুমি বলছো ওরা রাজী হয়েছে?

–হ্যাঁ।

কথাটা ভালো করে বোঝার পর ট্রেসি পাগল হয়ে যাবার জোগাড়। মাত্র দুদিন জেফের কাছে শিখে সে কিনা পৃথিবীর সেরা দুই খেলোয়াড়ের সাথে দাবা খেলবে?

জেফ অনেক বুঝিয়ে রাজী করালো, যদি ট্রেসি হেরে যায় তাহলেও কুড়ি হাজার ডলার তাকে দিতে হবে না এবং জেফ ওটা জমা রাখবে ক্যাসিয়ারের কাছে।

ক্যাসিয়ারের হাতে কুড়ি হাজার ডলারের ট্রাভেলার্স চেক জমা দেওয়া হল। দাবা খেলার ব্যাপারটা ঠিক করা হল। জাহাজের সর্বত্র খবরটা ছড়িয়ে পড়লো। সবাই ছুটে এসে জেফকে বলল–মিস হুইটনি কি পারবেন?

–পারবেন বলেই বোধহয়। আমার সঙ্গে ওঁর বাজী হয়েছে, জেফ বলল।

একজন যাত্রী বলল–এই ব্যাপারে আমিও যদি কিছু বাজী ধরি?

–ধরতে পারেন। মিস হুইটনির সঙ্গে আমার কথা হয়ে আছে, দশে এক রেট ধরা হবে।

অর্থাৎ এই খেলায় যদি কেউ বাজী জেতে তবে তাকে এক ডলারে দশ ডলার দিতে হবে। সবাই ভারী মজা পেয়ে গেল। সবাই জানে দুজন গ্র্যান্ডমাস্টারের কাছে ট্রেসি হুইটনিকে হারতেই হবে। দেখতে দেখতে দু লাখ ডলারের বাজীর টাকা জমা পড়ে গেল ক্যারিয়ারের কাছে। সমস্ত যাত্রী যেন তখন ক্ষেপে গেছে।

ক্যাসিয়ার শেষপর্যন্ত ক্যাপ্টেনের কানে কথাটা তুলল। সব খোঁজ নিয়ে জানা গেল খেলার মধ্যে কোনো জোচ্চুরি নেই, কিন্তু মেয়েটি এত টাকা কেন হারতে চলেছে সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। ক্যাপ্টেন বললেন তিনি দাবা খেলা জানেন, পুরো পদ্ধতির ওপর নজর রাখবেন। শেষে তিনিও গ্রান্ডমাস্টাররা জিতবেন তার ভিত্তিতে পঞ্চাশ ডলার বাজী ধরে ফেললেন।

শুক্রবার রাত নটা, খেলা শুরু হবার মুখে দেখা গেল জেফ খুব ব্যস্ত হয়ে পায়চারী করছে, সব যাত্রীরা সেখানে হাজির হয়েছে, এমনকি জাহাজের কর্মচারীরাও এসে পড়েছে সেখানে। পাশাপাশি দুটি ঘরে খেলার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দুই গ্র্যান্ডমাস্টার কখনও একঘরে খেলবেন না।

দর্শকদের কৌতূহল বেড়ে চলেছে, মার্কিনী মেয়েটিকে কেউ চেনে না, কিন্তু সবাই জানে মেয়েটি হারছে।

খেলা শুরু হবার আগে জেফ মেলনিকভ আর নেগুলেস্কোর সঙ্গে ট্রেসির আলাপ করিয়ে দিল।

নেগুলেস্কো জানতে চাইলেন–জাতীয় পর্যায়ের সব খেলাগুলি আপনি ঠিক জিতেছেন?

—হ্যাঁ।

–কী আশ্চর্য আপনার নাম আমি শুনিনি।

মেলনিকভ খুব অভদ্র ব্যবহার করলেন ট্রেসির সঙ্গে। আপনারা আমেরিকানরা কী করে টাকা নষ্ট করতে হয়ে তা জানেন। যাকগে আমার পরিবারের লোকেরা ওই টাকাতে অনেক কিছু কিনতে পারবে।

ট্রেসি গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কিন্তু এখনও জেতেন নি মিঃ মেলনিকভ।

হো হো করে হেসে উঠলেন মেলনিকভ। মাই ডিয়ার লেডি, তুমি কে আমি জানি না, কিন্তু আমি কে সেটা আমি জানি।

রাত দশটাতে খেলা শুরু হবে। ট্রেসির পা দুটি থরথর করে কাঁপছে। কী ভুলই না করেছে জেফের কথা বিশ্বাস করে, কিন্তু এখন ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

জেফ বলল, মিঃ মেলনিকভ আপনি সাদা ঘুটি নিয়ে খেলবেন।

খেলা শুরু হল, উপস্থিত জনতা উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। কেউ তার জায়গা থেকে নড়ছে না, বলে একজন মরে গেলে অন্য একজন এসে সেই জায়গাটা দখল করে নেবে।

মেলনিকভ প্রথম চাল দেবেন, একেবারে কচুকাটা করে ফেলতে হবে মেয়েটিকে, এই ভেবে তিনি মন্ত্রীর ঘরের সামনে বোড়ে দুঘর এগিয়ে দিলেন। পাকা খেলোয়াড়ের মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়লো ট্রেসি। তারপর যেন চিন্তা করছে এমন ভাব দেখিয়ে চলে গেল পাশের কেবিনে।

নেগুলেস্কো ওকে দেখে হেসে উঠলেন। আহারে, বরিসকে হারিয়ে এলেন নাকি?

চেষ্টা করছি, নেগুলেস্কোর সামনে বসে, একটু ভাবার ভান করে সাদা খুঁটির বরাতে প্রথম চাল দেবার অধিকার হিসেবে মন্ত্রীর ঘরের বোড়েটাকে দুঘর এগিয়ে দিল ট্রেসি।

নেগুলেস্কো ধরেই নিয়েছেন আধঘন্টার মধ্যে উনি খেলা শেষে করবেন। ট্রেসি প্রত্যেকবারই ওঘরে যাচ্ছে, তারপর এঘরে ফিরে এসে চাল দিচ্ছে।

এইভাবে ট্রেসি জেফের কথা মতো মেলনিকভের চালটা নেগুলেস্কোর সঙ্গে আর নেগুলেস্কোর চালটা মেলনিকভের খেলার সঙ্গে দিতে থাকলো।

যেহেতু দুজন দুই ঘরে তাই কেউ এই কৌশলটা বুঝতে পারলো না।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দুই গ্র্যান্ডমাস্টার বুঝে ফেললেন যে এই ছোট্ট মেয়েটা দাবা খেলা দারুণ বোঝে।

ট্রেসি চারঘন্টা ধরে দুই দিকপালকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো। শেষপর্যন্ত হার বাঁচানো দায় হয়ে পড়লো ওঁদের। যখন দুটি খেলা ড্র হল তখন রাত চারটে বাজে। দুই গ্র্যান্ড মাস্টারের কালঘাম ছুটে গেছে। শেষে দুজনে ড্র-এর প্রস্তাব দিতে জনতা আনন্দে হৈ-চৈ করতে শুরু করে। তারা ভাবতেই পারেননি যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।

ভীড়ের মধ্যে থেকে জেফ ট্রেসিকে আগলে বের করে দিয়ে এল।

ট্রেসি খুব খুশি হয়েছে। দুটি অহংকারী মানুষের দর্পচূর্ণ করা হয়েছে।

–কত টাকা জেতা হল?

–দুলাখ ডলারের মতো। কাল সকালে জাহাজ সাউদাম্পটনে পৌঁছচ্ছে। ডাইনিংরুমে খাবার সময় টাকাটা ভাগাভাগি হবে কেমন?

জেফ চলে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে ট্রেসি মনে মনে ভাবলো লোকটা আমার ওপর ভরসা রেখেছিল, ওর কথার দাম আছে বটে। এমন অসাধারণ পর্যায়ের প্রতারককে ট্রেসি আর কখনও দেখেনি, যেমন দেখতে ভালো তেমন বুদ্ধি রাখে, কিন্তু ওর সাথে ট্রেসি কখনই নিজেকে জড়াবে না।

জেফ দুপা এগোতেই জাহাজের রেডিও অফিসারের সঙ্গে দেখা, মিঃ স্টিভেন্স, আমরা তো ওয়ারলেসে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, রিপোর্টাররা বোধহয় সাউদাম্পটন বন্দরেই চলে আসবে মিস হুইটনির সঙ্গে দেখা করতে।

জেফ মনে মনে শিহরিত। ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে কেউ যদি চিনে ফেলে?

–জাহাজঘাটে ফিরলে আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, টাকাটা যদি দিয়ে দেন?

–নিশ্চয়ই, দুটো বড় বড় ম্যানিলা খামে নোটের তাড়া হাতে পেল জেফ।

–একটা কথা, মহিলা এত অল্প বয়সে এত সুন্দর দাবা খেলা শিখলেন কোথা থেকে?

–কাউকে বলবেন না যেন, গলা নামিয়ে জেফ বলল–শুনেছি ববি ফিশারের কাছে।

–হতেই হবে, ক্যাসিয়ার যেন এমন কিছু আঁচ করেছিলেন।

জেফ বলল–জাহাজ ঘাটে ভেড়ার আগেই চিঠিপত্রের মেল ব্যাগ নেবার জন্য যে স্টিমার আসে, তাতে করে আমাকে তীরে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়। আমার মা খুবই অসুস্থ।

–নিশ্চয়ই।

জেফ ঘরে ফিরে এসে একটা চিরকুট লিখল, ট্রেসি টাকাটা নিয়ে আমি জলে যাচ্ছি, স্যাভয় হোটেলে দেখা কোরো।

স্টুয়ার্টকে গিয়ে বলল–সকালে এটা মিস হুইটনিকে দিয়ে দেবেন।

ঠিক সকাল ছটায় মেল নেবার জন্য লঞ্চ এসেছে। জেফ দড়ি বেয়ে নামলো লঞ্চে। শেষ বারের মতো জাহাজটাকে দেখলো।

হঠাৎ পরিচিত গলা শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ট্রেসি।

–বিশ্বাস করো একটা চিঠি রেখে এসেছি তোমার জন্যে।

–আমি কি অবিশ্বাস করেছি? স্যাভয় হোটেলে টাকা ভাগাভাগি হল।

–বিকেলে আমার সঙ্গে ডিনার খাবে ট্রেসি?

–নিশ্চয়ই।

–তাহলে তৈরী থেকে সন্ধ্যে ছটায় আসবো।

সন্ধ্যে ছটায় হোটেলে এসে জেফ শুনলো ট্রেসি দুপুরেই চলে গেছে। কোথায় গেছে কোনো ঠিকানা রেখে যায়নি।

জেফ আকাশের দিকে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলো। ট্রেসির সুন্দর মুখখানা তখন ওর মনের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে আছে।