১.২ সিনেমা জগতের রাজধানী

০৬.

হলিউড, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৪৬। পৃথিবীর সিনেমা জগতের রাজধানী। এখানে আসে প্রতিভাবান ও লোভী, সুন্দর ও আশাবাদী এবং মনের দিক থেকে অস্বাভাবিক বহু মানুষ। এখানে পাম গাছ হাওয়ায় দোলে, রিটা হেওয়ার্থের নগ্ন যৌবন কাছে ডাকে। এখানে তুমি রাতারাতি তারকা হতে পারো। লোক-ঠকানোর খেলাঘর, বেশ্যালয়, কমলার বাগান, মন্দির। এখানে নানা রঙের খেলা। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের পছন্দমত রং দেখে।

হলিউডে আসার জন্যেই পৃথিবীতে এসেছে টবি টেম্পল। আর্মির ব্যাগ কাঁধে, পকেটে তিনশো ডলার। থাকে কাহুয়েংগা বুলভার্দ-এর সস্তা বোর্ডিং হাউসে। পয়সা ফুরানোর আগেই কাজ চাই, হলিউডে ভালো পোষাক ছাড়া চলে না। পোষাক কিনে বাকী রইল, কুড়ি ডলার। হলিউডে ব্রাউন ডারবী নামের রেস্তোরাঁয় চিত্রতারকারা ডিনার খায়। দেয়ালে বিখ্যাত সব নায়ক-নায়িকার কার্টুন। এখানে ঢুকে টবি চিত্রজগতের আবহাওয়াটা অনুভব করতে পারে। বছর কুড়ি বয়সের সুন্দরী হোসটেসের মাথায় লাল চুল। সে এগিয়ে এসে বলে–আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

আত্মসংবরণ করতে পারলো না টবি। সে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে সুন্দরী যুবতীর তরমুজ-স্তন মুঠোয় চেপে ধরে। মেয়েটির মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। সে চীৎকার করতে যাচ্ছিল। কিন্তু টবি বললো

কিছু মনে করবেন না, মিস, আমি অন্ধ…।

 –ওহ! আমি দুঃখিত।

ভুল ভেবেছিল বুঝে যুবতী লজ্জিত। সে টবির হাত ধরে টেবিলে নিয়ে যায়, বসতে। সাহায্য করে, অর্ডার নেয়। একটু পরে ফিরে এসে সে দেখে, টবি দেয়ালের ছবিগুলো দেখছে। যুবতীর দিকে তাকিয়ে টবি বলে–

অলৌকিক ব্যাপার! আমি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছি?

 এমন নিষ্পাপ মুখ, এমনই মজা ওর কথা বলার ভঙ্গীতে, যুবতী হাসি চাপতে পারলো না। ডিনারের সময় সে হাসলো। রাতেও হাসলো, যখন যুবতীর শরীরে শরীর মেলাতে মেলাতে কমেডিয়ান টবি মজার মজার কথা বলছিল।

…হলিউডে অনেক বিচিত্র ধরনের কাজ করছে টবি। কেননা এই ফিল্মী দুনিয়ার হাওয়াটা সে বুঝে নিতে চায়। সিরো-য় সে পার্কিং বয়ের কাজ করে। সে গাড়ীর দরজা খোলে, বিখ্যাত চিত্রতারকারা তার হাসিমুখের দিকে ক্রুক্ষেপ না করে যে যার নিজের কাজে চলে যায়। দামী, আঁটসাঁট পোষাক পরা, তাদের সুন্দরী বান্ধবীদের দেখে টবি ভাবে? তোমরা যদি জানতে আমি ভবিষ্যতে কতো বড় স্টার হব… ।

বাধ্য হয়ে টবি একের পর এক এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কিন্তু সে জানে এতে কোনো লাভ নেই। এজেন্টরা স্টারের কাছে যায়। স্টার কি কখনও এজেন্টের পায়ে ধরে? যদি তুমি স্টার না হও, এজেন্টের কাছে গিয়ে কী হবে? সব থেকে নামকরা হলিউড এজেন্টের নাম হল ক্লিফটন লরেন্স। টবি ভাবল, ক্লিফটন লরেন্স আমার এজেন্ট হলে কেমন হয়।

 ফিল্মি দুনিয়াতে দুটি বইকে সবাই বাইবেল বলে গণ্য করে। একটির নাম ডেলি ভ্যারাইটি, অন্যটি হলিউড রিপোর্টার। টবি দুটো পত্রিকা নিয়মিত পড়ছে। টেয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স ফর এভার অ্যামবার-এর চিত্রসত্ত্ব কিনে নিয়েছেন। অটো প্রেমিংগার এই বইটার পরিচালনা করবেন। হুইসল স্টপ বইতে অভিনয় করছেন আভা গার্ডনার, জর্জ র‍্যাফট এবং জরজা কার্টরাইটের মতো বিখ্যাত স্টারেরা। লাইফ উইথ ফাদার-এর চিত্রসত্ত্ব কিনেছেন ওয়ার্নার ব্রাদার্স এবং…

থমকে থামতে বাধ্য হয় টবি। তার হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত হয়েছে। সে পড়ল–প্রযোজক স্যাম উইনটার্স প্যান প্যাসিফিক স্টুডিওর ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

 যুদ্ধ ফেরত স্যাম উইনটার্স প্যান প্যাসিফিক স্টুডিওর চাকরিতে ফিরে আসেন। ছমাস পরে স্টুডিওর প্রধান অধিকর্তা ছাঁটাই হয়ে যান। প্রোডাকশন-ইন-চার্জ হিসেবে সাময়িকভাবে স্যাম উইনটার্সকে কাজ করতে বলা হয়। তিনি এত ভালো কাজ দেখালেন যে, নতুন লোক খোঁজা বন্ধ করে দেওয়া হল। তাকেই ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রোডাকশন ইন-চার্জ করা হল। এই কাজটা করতে হলে মনের ওপর চাপ পড়ে। এতে আলসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবু স্যাম উইনটার্স এই কাজটাকেই সব থেকে বেশী ভালোবাসেন।

হলিউড এক তিন রিংওলা সার্কাসের মতো। কিছু চরিত্র উন্মাদ হয়ে নেচে চলেছে। যে কোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে। অধিকাংশ অভিনেতা অভিনেত্রী পরিচালক এবং প্রযোজক অসম্ভব আত্মকেন্দ্রিক। তারা অহঙ্কারী, অকৃতজ্ঞ, শয়তান এবং অন্যের ক্ষতি করতে ভালোবাসেন। কিন্তু স্যাম, এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁর কাছে একটাই বিষয়, লোকটার প্রতিভা আছে কিনা। তিনি জানেন, প্রতিভা হল সেই জাদুকরের অদৃশ্য চাবি, যা দিয়ে যে কোনো সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

স্যামের সেক্রেটারী লুসিল এলকনস কাজের মেয়ে। বস বদলালেও সেক্রেটারী কখনও বদলে যাবে না।

–ক্লিফটন লরেন্স দেখা করতে চাইছেন।

 –ওকে পাঠিয়ে দাও।

স্যাম লরেন্সকে পছন্দ করেন। লোকটার স্টাইল আছে। ফ্রেড অ্যালেন বলেছিলেন হলিউডে যতটা আন্তরিকতা আছে, তা একটা পোকার নাভিতে লুকোনো যায়। তারপরেও সেখানে একজন এজেন্টের লুকোনোর মতো জায়গা থাকে। অবশ্য তার পুরো শরীরটা নয়, তার হৃদয়।

ক্লিফটন লরেন্সের ক্ষেত্রে অবশ্য একথাটা বলা যায় না। হলিউডে তার নাম এখন গাথায় পরিণত হয়েছে। চিত্রজগতের অধিকাংশ খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে সে এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চলচ্চিত্র জগতের এইসব নামকরা স্টারদের কাজের প্রয়োজনে তাকে প্রায়ই লন্ডন, রোম, সুইজারল্যান্ড আর নিউইয়র্ক যেতে হয়। প্রতি সপ্তাহে সে হলিউডের তিনটে স্টুডিওর প্রোডাকশন-ইন-চার্জদের সঙ্গে তাস খেলে। বছরে দুবার সে প্রমোদ তরণী ভাড়া করে। আধডজন সুন্দরী মডেল জোগাড় করে সেরা স্টুডিওগুলোর বড়ো কর্তাদের পাঠায় মাছ ধরতে। সাতদিন ধরে চলে সেই মাছ ধরাধরির খেলা। মালিবুর সমুদ্র সৈকতে তার একটা চমৎকার সুন্দর বাংলো আছে। বন্ধুরা চাইলে সে বাংলো ব্যবহার করতে পারে। দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে এভাবেই ক্লিফটন হলিউডের সঙ্গে একটা ইস্পাতকঠিন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এতে দুপক্ষেরই লাভ।

চমৎকার স্যুট তার পরনে। ভেতরে এসে নিখুঁত ম্যানিকিওর করা হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে সে বলল–ডিয়ার বয়, কেমন চলছে সব?

দিনগুলো জাহাজ হলে আজকের দিনটা ডুবন্ত টাইটানিক জাহাজ। কালরাতে প্রিভিউ কেমন লাগল?

-প্রথম কুড়ি মিনিটের দৃশ্যগুলো কাটছাঁট হল। সমাপ্তির অংশটা বদলে দাও। ফিল্মটার অনেক কিছু হিট আছে। কিন্তু…

–বুলস-আই, আমরা ঠিক তাই করেছি। আমার জন্য কোনো নতুন ক্লায়েন্ট আসে কি?

–দুঃখিত। সবাই এখন ব্যস্ত। শুক্রবার ডিনারে দেখা হবে। এখন চলি কেমন?

 ক্লিফটন চলে গেল।

ইন্টারকম টেলিফোনে লুসিল জানাল ড্যালাস বার্ক দেখা করতে চাইছেন। মেল ফসও বসে আছেন। মেল বলছেন ব্যাপারটা খুবই জরুরী।

মেল ফস প্যান প্যাসিফিক স্টুডিওর টেলিভিশন বিভাগের ইন-চার্জ।

স্যাম ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল–মেলকে কাল সকাল আটটায় পোলো গ্রাউন্ডে ব্রেকফাস্টের সময় দেখা করতে বলল।

লুসিলের টেলিফোন বাজল।  –হ্যালো মিস্টার উইনটার্সের অফিস থেকে বলছি।

আমার নাম টবি টেম্পল। আমি আর্মিতে ওনার সঙ্গে ছিলাম, হলিউডে এলে উনি আমাকে ওনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন।

মিস্টার উইনটার্স মিটিং করছেন। আপনাকে পরে ফোন করব।

নিজের টেলিফোন নম্বর বলল টবি। কাগজটা ওয়েস্ট পেপার বাক্সেতে ফেলে দিল লুসিল। আর্মিতে পুরোনো বন্ধু হলে দেখা করার এই কৌশলটা সেও জেনে গেছে। মানুষ যে কত রকম ছুতো খোঁজে।

 হলিউডের চলচ্চিত্র জগতের এক খ্যাতিমান পরিচালক ড্যালাস বার্ক। যে সমস্ত কলেজে সিনেমা নির্মাণ সেখানে হয়, সেখানে ড্যালাস বার্কের তৈরি ফিল্ম দেখানো হয়। তার অন্তত ছটা ফিল্মকে চলচ্চিত্র সমালোচকরা চিরন্তন ক্লাসিকের মর্যাদা দিয়েছেন। প্রত্যেকটা ফিল্মে নতুনত্বের ছাপ ছিল, ছিল প্রতিভার অসাধারণ বিচ্ছুরণ। সে ড্যালাস বার্কের বয়স এখন সত্তরের কোঠায়। একদা চেহারা ছিল বিশাল। এখন শুকিয়ে গেছে। পোশাকগুলো পাল্টানো হয়নি বলে সেগুলোকে ঢিলেঢালা বলে মনে হয়।

 –ড্যালাস, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল বলে আনন্দিত।

-তোমাকে দেখে খুশী হলাম ছোকরা, আমার এজেন্টকে তুমি চেনো?

 –নিশ্চয়ই। কেমন আছো পিটার?

সবাই বসল।

স্যাম বলল–ড্যালাস তোমার কাহিনীটা বলো।

খুব সুন্দর গল্প।

 –বলল ড্যালাস, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

–শোনো পৃথিবীতে সবাই কী পেতে সব থেকে বেশী আগ্রহী বলল তো? না-না, টাকা পয়সা, গাড়ি-বাড়ি, ধন-দৌলত, ঐশর্য-সম্পত্তি কিছুই নয়। ভালোবাসা এবং কোন ভালোবাসা সব থেকে পবিত্র? না-না আমি জানি তোমরা এখানেও ভুল উত্তর দেবে। নারী এবং পুরুষের তীব্র শারীরিক আকর্ষণ নয়, সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা। কাহিনীর শুরুতে একটি উনিশ বছরের মেয়ে ধনী পরিবারের সেক্রেটারীর কাজ করছে। হাই সোসাইটির পরিবেশ দেখানোর সুযোগ পাওয়া যাবে। শেষ অব্দি এমন এক অভিজাত বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে তার বিয়ে হল যার শরীরে নীল রক্তের ধারা বইছে।

মনোযোগ দিয়ে স্যাম শুনছে না। সে জানে, এই গল্পটা কারোর নকল কিন্তু কোন্ সিনেমার? ব্যাক স্ট্রিট অফ লাইফ? যাই হোক, গল্পটা স্যাম কিনবে। গত কুড়ি বছর কেউ তার সামনে এত বড়ো সুযোগ এনে দেয়নি। অনেক দিন ধরে তার ইচ্ছে, ড্যালাস বার্ককে কোনো ফিল্ম পরিচালনার সুযোগ দেবে। অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। ড্যালাস বার্কের শেষ তিনটে ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পুরোনো ধরনের ফিল্ম, অনেক পয়সা খরচ হয়েছিল। সকলে বলে থাকে, চিত্রনির্মাতা হিসেবে ড্যালাস বার্কের দিন শেষ হয়ে গেছে।

কিন্তু মানুষটা বেঁচে আছে। ওর পয়সা চাই, ওকে মোশন পিকচার রিলিফ হোমে ঠাই দেবার প্রস্তাবে চটে গিয়েছিল। বলেছিল তোমাদের করুণা চাই না, কার সঙ্গে কথা বলছো জানো? যে এক সময় ডগলাস ফেয়ার ব্যাঙ্কস, জ্যাক ব্যারিমোর, মিলটন সিলস আর বিল ফারনাসের মতো তারকাদের পরিচালনা করেছে। আমার কাছে তোমরা অনেক ছোটো।

 একথা সত্যি। তার প্রতিভা আজ উপকথায় পরিণত, কিন্তু বাঁচতে গেলে দুবেলা দুমুঠো খাবার দরকার। প্রতিভা ভেঙে তো আর বাঁচা যায় না।

 যেদিন থেকে ফিল্ম প্রোডিউসার হয়েছে স্যাম, এই ড্যালাস বার্কের এজেন্টকে সে খবর দিয়েছে। ফিল্মের গল্পের সম্পর্কে ড্যালাস বার্ক আগ্রহ প্রকাশ করলে স্যাম কিনবে। আধুনিক–ফিল্মে ব্যবহারের অযোগ্য আইডিয়া কোনো কাজে আসবে না। তবু প্রত্যেক বছর গল্প কিনবে এবং পয়সা দেবে স্যাম। এমন পয়সা যাতে ড্যালাস বার্কের সারা বছর চলে যায়। স্যাম যখন আর্মিতে ছিল তখনও ওর নির্দেশে এই নিয়ম চলেছে।

ড্যালাস বলছে মাকে চেনে না মেয়ে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে। মা গোপনে মেয়ের খোঁজ নেয়। মেয়ের বড়োলোকের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। মা লুকিয়ে চার্চের পেছনে বসে বিয়েটা দেখছে। মুখের ওপর ওড়না চাপা দিয়েছে, যাতে কেউ তাকে দেখে না ফেলে। কী বলো, এই দৃশ্য দেখে সবার চোখে উপছে পড়ে জল আসবে, তাই নয় কি?

–স্টেলা ড্যালাসের গল্প, এজেন্টের দিকে আড়চোখে তাকাল স্যাম। সে লজ্জা পেয়ে জুতোর দিকে তাকিয়ে আছে।

দারুণ গল্প।

স্যাম বলল–খুব ভালো ফিল্ম হবে। স্টুডিও এ ধরনের ফিল্ম চায়। পিটার, টাকা পয়সার ব্যাপারে বিজনেস সেকশনের সঙ্গে কথা বলল।

এজেন্ট ঘাড় নাড়ল।

ড্যালাস বার্ক বলল–ওদের বলো, বেশ টাকা চাই। না হলে গল্পটা আমি ওয়ার্নার ব্রাদার্সের কাছে বেচব। বন্ধু বলে তোমার কাছে আগে এসেছি।

স্যাম বলল আমি জানি।

ওরা অফিস ছেড়ে চলে গেল। স্যাম ভাবল, কোম্পানির পয়সা এ ভাবে দাতব্য করার অধিকার তার নেই। আবেগের খাতিরে সে একাজ করতেই পারবে না। তবে ড্যালাস বার্কের মতো মানুষের কাছে কিছু ঋণ আছে। তার একার নয়, গোটা হলিউড ফিল্ম ইনড্রাস্ট্রির। এইসব মানুষ না থাকলে হলিউড কখনও আজকের হলিউড হতে পারত না।

.

০৭.

ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ আর ককটেলের আসরে বড়ো বড়ো প্ল্যান নিয়ে আলোচনা হয়। এটাই হলিউডের চিরন্তন রেওয়াজ। বেভারলি হিলস হোটেলের পোলো লাউন্সে মেলা ফস অপেক্ষা করছিল। আটমাস আগে প্যান প্যাসিফিক স্টুডিওতে টি. ভি শাখার বড়কর্তা হয়েছে সে। তবে এখন এই টি. ভি প্রমোদের জগতে এক পা-এক পা করে হাঁটতে থাকা এক দুধের শিশু। কিন্তু শিশুটা দ্রুত বাড়ছে।

–মেল, কোনো ভালো খবর আছে?

 –ভালো খবর নয়, ঝঞ্জাট।

–দ্য রেডার্স নিয়ে ভালো ঝামেলা চলছে। টি. ভি. নেটওয়ার্ক ওটা ক্যানসেল করবে কেন?

-শোটা চলছে কিনা সেটা বড় কথা নয়।

 –ঝঞ্ঝাটটা কোথায়?

জ্যাক নোলানকে নিয়ে। এ সপ্তাহের পিক ম্যাগাজিন পড়েছো?

 –না, ওসব কেচ্ছা কাহিনী ভরা ম্যাগাজিন আমি পড়ি না।

–সন অফ এ বীচ-জ্যাক নোলান লেসের মেয়েলী পোশাক পরে পার্টিতে গেছে ফটো তুলতে। নেটওয়ার্ক ওকে চায় না।

–সমকামী? স্যাম জানতে চাইল।

নিউ ইয়র্কে আগামী মাসের বোর্ড মিটিং-এ খুব ভালো রিপোর্ট দেওয়া যাবে টেলিভিশন শাখা সম্পর্কে, স্যাম আশা করেছিল। তোর মনটা হতাশ হয়ে গেল। তার মানে দ্য রেডার্স চলবে না।

***

অফিসে ফিরে ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানির প্রধান উইলিয়াম হান্টকে ফোন করল স্যাম। হান্ট পেশায় ছিল এক আইনজীবী। এখন টি. ভি. নেটওয়ার্কের বড়োকর্তা হয়ে বসেছে। টি. ভি.-র ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি বলে স্যাম ওর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ পায়নি।

–মর্নিং বিল।

 –স্যাম, অনেক দিন পরে।

 –এই ব্যবসার এটাই খারাপ। দেখা সাক্ষাৎ করার সময় থাকে না।

 –সত্যি ।

 –পিক পত্রিকার লেখাটা পড়েছো?

 –হ্যাঁ, তুমি তা জানোও। আমি শো-টা ক্যানসেল করেছি।

 –না, জ্যাক নোলানকে ফাঁসানো হয়েছে।

 –তুমি গল্প লেখক হবার চেষ্টা করছো?

না, গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিনে স্রেফ ইয়ার্কি মারতে ওই মেয়েলী পোশাক পরেছিল জ্যাক।

 –আমি কিন্তু

–তুমি কি জানো, আগামী বছরে আমাদের স্টুডিওর লোরোডো নামের এক ওয়েস্টার্ন ফিল্মের নায়ক হবে এই জ্যাক নোলান।

–সত্যি বলছো?

–হ্যাঁ, আমি অকারণে মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন? তিরিশ লাখ ডলার খরচ করে ফিল্ম তোলা হবে। জ্যাক নোলান সমকামী উদ্ভট চরিত্রের নোক, এই খবরটা সবাই জানলে তার ফিল্ম কোনো প্রদর্শক কিনবে কি? ফিল্মটা ফ্লপ হবে। এই ঝুঁকি আমি নিতে পারব না।

–কিন্তু

দ্যাখো বিল, পিক-এর মতো কেচ্ছা ম্যাগাজিন কী বলল না বলল, তার জন্য তুমি একজন প্রতিভাবান অভিনেতার ভবিষ্যত নষ্ট করবে? শো-টা তোমার ভালো লাগে কিনা, বুকে হাত দিয়ে বলো তো।

-খুব ভালো লাগে। খুব ভালো শো। কিন্তু স্পনসর ছাড়া…

–এটা তোমার নেটওয়ার্ক। আমি তোমাকে হিট শো উপহার দেব। সাফল্য নিয়ে খেলা করো না।

–বেশ।

 –মেল ফস দ্য রেডার্স সম্বন্ধে পরের বছরের প্ল্যান, তোমাকে বলেছে?

–না।

–ও তোমায় অবাক করতে চেয়েছিল। পরের বছর দ্য রেডার্স টিভির সেরা শো হবে। অতিথি তারকারা যোগ দেবে। নামজাদা ওয়েস্টার্ন লেখকের হাত থেকে বেরিয়ে আসবে চোখাচোখা সংলাপ। আউটডোরে হবে লোকেশন শু্যটিং।

একটু আমতা আমতা করে বিল হান্ট বলল–মেল ফসকে ফোন করতে বলো। আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

-ও ফোন করবে।

 –স্যাম, আমার অবস্থাটা বোঝো। আমি কারো ক্ষতি করতে চাইনি।

আমি জানি। তাই সত্যি কথাটা তোমাকে বললাম।

 –ধন্যবাদ।

–আগামী সপ্তাহে একসঙ্গে লাড্ডু খাওয়া যাবে।

 –বেশ সোমবার তোমায় ফোন করব।

 ক্লান্ত স্যাম ফোন রেখে দিল। জ্যাক নোলান পাগল, বদ্ধ উন্মাদ। অনেক আগেই ওকে পাগলা গারদে ভর্তি করা উচিত ছিল। কিন্তু, এইসব পাগলগুলোর ওপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যৎ। স্টুডিও চালানো আর ঝড়ের মধ্যে নায়গ্রা জলপ্রপাতের উঁচুতে তারের মধ্যে দিয়ে হাঁটা দুটোর মধ্যে কোনো তফাত নেই। পাগল ছাড়া এই কাজ কেউ সাধ করে করে?

ফোনে মেল ফসের সঙ্গে কথা বলল স্যাম

দ্য রেডার্স টিভি ও রেডিওতে চালু রইল।

 –সে কী?

হ্যাঁ, তুমি নিজে জ্যাক নোলানের সঙ্গে কথা বলো। বলো, এরপর যদি ও আর পাগলামি করে, তাহলে ওকে আমি শহর থেকে তাড়িয়ে দেব।

ফোন রেখে স্যাম ভাবল, ফসকে প্রোগ্রামের পরিবর্তনের কথাটা বলা হয়নি। লোয়োডো নামের ওয়েস্টার্ন ফিল্মের চিত্রনাট্য লেখক জোগাড় করতে হবে।

ঠিক তখন দরজা খুলে ভেতরে এল লুসিল। তার মুখ ফ্যাকাশে। বোঝা গেল কোথাও একটা দারুণ বিপর্যয় ঘটে গেছে। সে বলল স্টেঞ্জ ট্রেনে আগুন ধরেছে। এক্ষুনি ওখানে যেতে হবে।

.

০৮.

ছবার চেষ্টা করেও স্যাম উইনটার্সের সঙ্গে টবি যোগাযোগ করতে পারল না। নাইট, ক্লাব আর স্টুডিওতে ঘুরে ঘুরে কোনো লাভ হচ্ছে না। টবি এখন রিয়েল এস্টেট আর ইনসিওরেন্স এজেন্টের কাজ করছে। বারে অখ্যাত নাইট ক্লাবে শো দেখাচ্ছে। স্টুডিওর দরজা বোধহয় তার মুখের ওপর চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।

 এক সহৃদয় বন্ধু বলল ভুল করছে, এভাবে হয় না। ওরা তোমার কাছে আসবে। ব্যাপারটা অনেক সম্মানজনক হবে।

–তা কি আর হবে?

 –অ্যাক্টারস ওয়েস্ট-এ যোগ দাও না।

 –অ্যাকটিং স্কুল?

 –তার থেকে বেশী, এরা নাটক প্রযোজনা করলে সব স্টুডিওর লোক দেখতে আসে।

***

অ্যাক্টারস ওয়েস্টকে দেখলেই মনে হয় এটা পেশাদারদের জন্য একটা আদর্শ জায়গা। দেওয়ালে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের ফটো ঝুলছে। তাদের অনেকেই আজ সফল চলচ্চিত্র তারকা।

সোনালী চুলের সুন্দরী রিসেপসনিস্ট এক গাল হেসে বলল আমি কোনো সাহায্য করতে পারি?

 আমি টবি টেম্পল। ছাত্র হতে চাই।

অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আছে?

 –না, মানে–

–আমি দুঃখিত। মিসেস ট্যানার বলে দিয়েছেন, অভিজ্ঞতা না থাকলে কাউকে না। নিতে।

-ঠাট্টা করছেন?

না, এটাই নিয়ম।

 –সে কথা বলছি না। আপনি সত্যি আমায় চিনতে পারছেন না?

না তো।

–হ্যায় জেসাস। লেল্যান্ড হাওয়ার্ড ঠিকই বলেছে। ইংল্যান্ডের মঞ্চ অভিনেতাদের হলিউড চেনে না। আমি ঠাট্টা করছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনি আমায় চেনেন।

–আপনি পেশাদার অভিনেতা?

 –হ্যাঁ।

 –কোথায় অভিনয় করেছেন? কোন ভূমিকায়?

 –এখানে নয়, ইংল্যান্ডে রেপারটরিতে।

 –ঠিক আছে। মিসেস ট্যানারের সঙ্গে কথা বলছি।

রিসেপসনিস্ট ভেতরে চলে গেল। একটু পরে এসে বলল মিসেস ট্যানার আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। গুড লাক।

ওকে চোখ মেরে টবি টেম্পল মিসেস ট্যানারের অফিসে ঢুকল। মিসেস ট্যানারের মাথায় কালো চুল। সুন্দর মুখে আভিজাত্যের ছাপ। মিসেস ট্যানার উঠে দাঁড়ালেন।

–তুমি আমাদের ছাত্র হতে চাও?

 –হ্যাঁ।

 –কেন জানতে পারি কি?

–যেখানে যাই, এই স্কুল আর আপনাদের প্রযোজিত নাটকের আলোচনা হয়। আপনাদের এত সুনাম, তাই।

-আমি তা জানি। তাই আমি আজেবাজে লোকদের কখনও ঠাই দিই না।

 –অনেকে নিশ্চয়ই চেষ্টা করে।

 –অনেকে করে। তোমার নাম টবি টেম্পল?

নামটা হয়তো আপনি শোনেন নি। গত কয়েক বছর ধরে আমি ইংল্যান্ডে

রেপারটারিতে অভিনয় করেছে। তাই তো? ব্রিটিশ অভিনেতাদের ইউনিয়ন ওখানে আমেরিকানদের অভিনয় করতে দেয় না। আমরাও এখানে তাদের ঠাই দিই না। আমি দুঃখিত। পেশাদার অভিনেতা ছাড়া কাউকে নেব না।

অ্যালিস ট্যানারের বাঁ পা-টা ধাতুর ভারী ব্রেসে মোড়া। টবি ভাবল, হয়তো পোলিও।

থামুন।

টবির স্বর চাবুকের মতো।

মহিলা চমকে থামলেন। টবির সামনে সাফল্যের সিঁড়ি। যা কিছু সে চেয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত করায়ত্ত করেছে। আজও সে সার্থক হবে।

লেডি, প্রতিভাকে কোনো নিয়ম দিয়ে বিচার করা যায় না। ও. কে, আমি কেন অভিনয় করি না? কেননা আপনার মতো লোকেরা আমাকে সুযোগ দেয়নি।

বিখ্যাত অভিনেতা ডবলিউ. সি. ফিলটনের কণ্ঠস্বরে টবি কথা বলছে।

 –অ্যালিস ওকে থামাতে চায়। টবি থামে না। সে একের পর এক অভিনেতার গলা নকল করছে।

জিমি ক্যাগনি বলছে, বেচারাকে একটা সুযোগ দাও।

হলিউডের জনপ্রিয় তারকা জেমস স্টুয়ার্ট বলছে, আমি এক মত।

হলিউডের আর এক প্রসিদ্ধ নায়ক ক্লার্ক গেবল বলছে, এর সঙ্গে অভিনয় করতে পারলে কত ভালো হত।

চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক ক্যারি গ্রান্ট বলছে ছেলেটা সত্যি দারুণ অভিনেতা।

টবি টেম্পলের মুখ থেকে শব্দের স্রোত ছুটে আসছে। অসাধারণ রসিকতা। নৈরাশ্যের সীমানা সে ছুঁয়েছে। নিজের অপরিচিতির অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে এখন যা কিছু একটা আঁকড়ে তাকে ভেসে উঠতেই হবে। একটা ডিঙি নৌকা তার চাই। শব্দের নৌকা, শুধু মাত্র শব্দ, শব্দ দিয়ে সে তার স্বপ্নের সিঁড়ি সাজাতে পারে। না হলে আবার তাকে অপরিচিতির অন্ধকারে ডুবতে হবে। ঘামে ভিজে গেছে তার সমস্ত শরীর। সে সারা ঘর ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি চিত্রতারকার শরীরের অভিব্যক্তি নিখুঁতভাবে তুলে ধরছে। গতির ভঙ্গিগুলো অনুসরণ করছে। সে উন্মাদ, সে ভুলে গেছে কেন এখানে এসেছে।

অ্যালিস ট্যানার হঠাৎ বলে থামো-থামো।

হাসতে হাসতে ট্যানারের চোখে জল এসে গেছে।

–তুমি উন্মাদ, তুমি কি তা জানো?

 –ভালো লাগল?

না, বিশেষ ভালো লাগেনি।

 তবে হাসছেন কেন?

 –তোমাকে দেখে, এইসব চিত্র তারকার ভঙ্গি আর কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে কী লাভ? তুমি এক প্রতিভাবান তরুণ। অন্যদের অনুকরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি কমেডিয়ান। তুমি এমনিতেই মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাবে। যদি তুমি কঠোর পরিশ্রম করো, তা হলে একদিন মস্ত বড়ো অভিনেতা হবে। সেদিন হয়তো আমাকে আর মনে থাকবে না। পরিশ্রম করতে রাজী তো?

টবি মৃদু হেসে বলল– শার্টের হাতা গুটিয়ে কাজ করা যাক।

.

০৯.

অ্যাক্টারস ওয়েস্টের দুটো বিভাগ।

শো-কেস গ্রুপে অভিজ্ঞ অভিনেতা এবং অভিনেত্রীরা থাকে। তারা নাটক করলে স্টুডিওর স্কাউটরা প্রতিভার সন্ধানে নাটক দেখতে আসে।

যারা নতুন তারা ঠাঁই পায় ওয়ার্কশপ গ্রুপে। টবি অনভিজ্ঞদের এই ওয়ার্কশপে ঠাই পেয়েছে। ছমাস বা এক বছর পর সেও শো-কেস গ্রুপে চলে যাবে।

ক্লাসগুলোতে তার আগ্রহ আছে কিন্তু শ্রোতা নেই। শ্রোতার প্রশংসা নেই।

অ্যালিস ট্যানার এক অভিজাত এবং সুন্দরী মহিলা। পলিওর দরুন পঙ্গু, কিন্তু টবির কাছে এই মহিলার একটা আলাদা যৌন আকর্ষণ আছে। মহিলা এখনও তাকে শো-কেস গ্রুপের নাটকে ঠাই দিতে রাজী হচ্ছে না। সুতরাং টবির সাফল্য এবং কিন্তুর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ওই মহিলা।

 শো-কেস গ্রুপের নাটক দেখেছে টবি। পাশে তার গ্রুপের ক্যারন নামে একটা মোটা মেয়ে টবির সঙ্গে সহবাস করতে চায়। কিন্তু ওর শরীর ছোঁওয়া আর গরম চর্বির বালতিতে ঢোকা একই ব্যাপার।

পর্দা ওঠার আগে ক্যারেন দেখতে পেল, নাটক দেখতে এসেছে লস এঞ্জেলস টাইমস এবং হেরাল্ড এক্সপ্রেসের সমালোচকরা। এসেছে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফকস, এম. জি. এম, আর ওয়ানার ব্রাদার্সের স্কাউটরা। সুযোগ পেলে টবি ওদের সামনে তার প্রতিভা দেখিয়ে দেবে। কিন্তু সেজন্য ছমাস কেন? মাত্র ছ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে সে রাজী নয়।

***

পরের দিন সকালে অ্যালিসের কাছে গেল টবি।

নাটক কেমন লাগল?

–আমি এখনও তৈরি হইনি। আমি বুঝতে পেরেছি। হয়তো আমার অভিনয়ের ধান্দা ছেড়ে ইনসিওরেন্স এজেন্ট হওয়া উচিত। হয়তো আমি যা ভাবছি, সেটা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যি সত্যি আমার কোনো প্রতিভা নেই।

আছে টবি। এভাবে কথা বলো না।

 –এ শহরে আমি একা, কথা বলার মতো কেউ নেই।

 –আমি আছি। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।

নীল চোখে মহিলার দিকে টবি তাকাল। এক পা-এক পা করে এগিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফেরত চলে এল। হাঁটু গেড়ে বসল। মহিলার কোলে মাথা রাখল। অ্যালিস তার চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটল। সে অ্যালিসের স্কার্ট তুলল। ইস্পাতের ব্রেস খুলে রোগা উরুতে চুমু খেল। ভালোবাসার কথা বলতে বলতে সে অ্যালিসের পোশাক খুলল। তার চুম্বন ঠোঁটের থেকে গোপন অঙ্গে নেমে এল। নগ্ন রমণীকে চামড়ায় মোড়া কোচে শুইয়ে শরীরে শরীর মিলিয়ে দিল টবি টেম্পল।

সেই সন্ধ্যায় অ্যালিস ট্যানারের ঘরে জায়গা পেল সে।

 সেই রাতে অ্যালিস ট্যানারের প্রেমের শয্যায় শুয়ে টবি টেম্পল টের পেল, মনের দিক থেকে অ্যালিস এক নিঃসঙ্গ রমণী। তার মনের কথা শোনার মতো কেউ নেই। তাই হয়তো মুখের ওপর সে কাঠিন্যের একটা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। বোস্টনে তার জন্ম হয়েছিল। বাবা ছিল ধনী, মেয়েকে টাকা ছাড়া সে কিছুই দেয়নি। ছোট্টবেলা থেকে অ্যালিসের স্বপ্ন ছিল সে একজন অভিনেত্রী হবে। কলেজে পড়ার সময় তার পলিও রোগ হয়। স্বপ্ন সেখানেই শেষ। যে ছেলেটি তাকে ভালোবাসত, রোগের খবর শুনে সেও চলে গেল। এক সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারকে বিয়ে করেছিল অ্যালিস। সেও দুমাস পরে আত্মহত্যা করল। যে অনুভূতিগুলো এতদিন তার মনের ভেতর গুমরে একা কাদত আজ তা স্রোতের মতো ঝরছে। আজ সে সুখী।

কিন্তু টবি চাইছে, পরের শো-কেস গ্রুপে অভিনয় করতে, তাহলে স্টুডিওর স্কাউটদের নজরে আসবে।

অ্যালিস বলল–ডার্লিং, তাড়াতাড়ি বড়ো হতে চেয়ো না। তাতে ক্ষতি হবে। প্রথম দেখায়, যদি তোমাকে ওরা ভালো না বাসতে পারে তাহলে দ্বিতীয়বার আর আসবে না। ঠিকমতো তৈরি হও। এটাই জীবনের সব থেকে বড় সিদ্ধান্ত।

সেই মুহূর্তে শয্যা সঙ্গিনীকে শত্রু বলে ভাবল টবি। তবে রাগ চেপে হেসে বলল–নিশ্চয়ই, আমার ধৈর্য নেই, আমি সফল হতে চাই। শুধু আমার জন্য নয়, তোমার জন্যও।

–সত্যি টবি! আমি তোমায় ভালোবাসি।

 –আমিও।

টবি জানে, তার স্বপ্ন এবং অস্তিত্বের মাঝে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে ওই কুত্তিটা। তাকে এড়িয়ে যেতে হবে। তাকে শাস্তি দিতে হবে।

রাতে বিছানায় শুয়ে নানা বিচিত্র কাজ করল টবি। অ্যালিসকে দিয়ে সে এমন কাজ করাল যা বেশ্যা ছাড়া আর কাউকে বলা যায় না। জঘন্যভাবে নগ্নিকাকে ব্যবহার করল টবি। কুকুরকে যেমন করে তার মালিক ট্রেনিং দেয়, সেইভাবে টবি অ্যালিসকে ট্রেনিং দিচ্ছে। যত নীচে অ্যালিস নামছে, টবির মনে হচ্ছে সেও তত নীচে নামছে। এই পথের শেষ কোথায়?

 টবির মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছিল। সেটা কাজে লাগানোর সুযোগ এসেছে।

অ্যালিস ট্যানার জানাল, ওয়ার্কশপের ছাত্রছাত্রীদের একটা শো হবে। উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রী এবং অতিথিরা সেই শো দেখবে। প্রত্যেক ছাত্রকে একক প্রোগ্রাম করার সুযোগ দেওয়া হবে।

শো-এর দিন সকালে ক্লাস শেষ হবার পর টবি তার সহপাঠিনী ক্যারেনকে বলল আমার একটা উপকার করবে?

নিশ্চয়ই টবি। ক্যারনের স্বরে আগ্রহ এবং বিস্ময় একসঙ্গে ঝরছে।

কিন্তু ওর মুখে দুর্গন্ধ কাছে গিয়ে কথা বললে গা গুলিয়ে ওঠে। একটু সরে দাঁড়িয়ে টবি বলল–পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে মজা করব। এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্সের সেক্রেটারীকে ফোন করে বলো, তুমি স্যাম উইন্টার্সের সেক্রেটারী। স্যাম উইন্টার্স চাইছেন, ক্লিফটন লরেন্স যেন আজকের শো-এ নতুন একটা প্রতিভাবান কমেডিয়ানের অভিনয় দেখেন। বক্স অফিসে ওনার জন্য টিকিট থাকবে।

এই কথা শুনে ক্যারনের চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল। সে বলল জেসাস, তুমি বলছো কী? লেডি ট্যানারের কানে এ খবর গেলে কী হবে, জানো কি? ওয়ার্কশপ গ্রুপের থিয়েটারে বাইরের কাউকে ডাকার অনুমতি তিনি দেন না।

–কোনো গন্ডগোল হবে না।

ক্যারনের হাত ধরে টবি বলল আজ বিকেলে কোনো কাজ নেই তো?

 সে বুঝতে পারছে, ক্যারনের নিঃশ্বাস ক্রমশ দ্রুত না, তুমি যদি কিছু করতে চাও।

–আমি কিছু করতেই চাই।

তিন ঘণ্টা পরে সঙ্গমে তৃপ্তি এবং অভিভূত হয়ে ক্যারন ক্লিফটন লরেন্সকে ফোন করল।

হলে বিভিন্ন ক্লাসের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বসেছে। সঙ্গে তাদের অতিথি। টবির নজর পড়ল, তৃতীয় সারিতে বসা ক্লিফটন লরেন্সের দিকে। ব্যাপারটা লরেন্স বুঝতে পারেনি। সে নিজেই চলে এসেছে।

দ্য সীসাল-এর একটা দৃশ্য অভিনয় করছে দুজন ছাত্রছাত্রী। টবির ভয়, লরেন্স উঠে না যায়। ওদের অভিনয় শেষ হল। এবার টবির পালা। এই প্রথম এত বড়ো একটা সুযোগ পাচ্ছে সে। বুকের ধুকপুকানি শব্দটা শুনতে পেল।

অ্যালিস কানে কানে বলল–গুড লাক, ডার্লিং।

সে জানে না, টবির নিয়তি ক্লিফটন লরেন্সের রূপ ধরে এখন অপেক্ষা করছে। নিঃশব্দে ঈশ্বরের কাছে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করল টবি। বলল–হ্যালো, আমার নাম টবি টেম্পল। নামটা কেন হল? বাবা-মা বাচ্চার নাম যেভাবে পছন্দ করে। শুধু আমার চেহারা দেখে মা নাম দিয়েছিল টবি।

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল। নিষ্পাপ মুখ, স্বপ্নিল চোখ। রসিকতাগুলো বাজে, কিন্তু শ্রোতারা তাকে ভালোবাসে, আহা বেচারা, ওরা হাসে, প্রশংসা করে।

 বিখ্যাত ফিল্মস্টার জিমি ক্যাগনির কণ্ঠস্বরে সে বলে–ইউ ডার্টি ব্যাট, কাকে অর্ডার দিচ্ছিস?

এডওয়ার্ড জি. রবিনসন নামে এক খ্যাতিমান অভিনেতার কণ্ঠস্বর নকল করে টবি জবাব দিল–তোকে অর্ডার দিচ্ছি। ইউ. পাংক, আমি ছোট্ট সিজার, আমি বস। তুই ফালতু, কিচ্ছু না।

শ্রোতারা এই কাল্পনিক সংলাপ শুনে হো-হো করে হেসে উঠল।

চলচ্চিত্রের মহান নায়ক হামফ্রে বোগাটের কথন ভঙ্গী নকল করে টবি বলল–পাংক, তোর চোখে থুথু ছুঁড়ে দেব। আমার ঠোঁট যদি দাঁতের সাথে লেপটে যায়, তবুও।

আবার হাসির শব্দ, সত্যি সত্যি শ্রোতারা টবিকে ভালোবাসে। টবি বুঝতে পারছে, তার পায়ের নীচের জমি আরও শক্ত হয়ে উঠছে। সামনে বসে থাকা দর্শকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারছে।

বিখ্যাত তারকা পিটার লোরের কণ্ঠস্বর নকল করে টবি বলল ছোট্ট মেয়ে তার ঘরে খেলা করছিল। দেখে আমার উত্তেজনা হল। কী যে হল আমার। আমি ওর ঘরে ঢুকলাম। দড়ির ফাঁসটা শক্ত করে ওর গলায় এঁটে দিলাম। মেয়েটা মরে গেল।

আবার হাসির উতরোল।

এবার লরেল হার্ডির গলা নকল করে লোক হাসাবার চেষ্টা করল টবি। সেই মুহূর্তে থিয়েটার ছেড়ে চলে গেল এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স।

সন্ধ্যার বাকি সময়টা টবির কাছে অস্পষ্ট ছায়ার মতো কেটে গেল।  

শো শেষ হল। অ্যালিস ট্যানার বলল–ডার্লিং। খুব ভালো হয়েছে তোমার শো।

 অ্যালিসের দিকে তাকাতে পারছে না টবি। সে তখন ব্যর্থতার যন্ত্রণায় মরছে। তার স্বপ্নের পৃথিবী ভেঙে গেছে। জীবনে একটা সুযোগ সে পেয়েছিল। সুযোগটা কাজে লাগাতে পারল না। ক্লিফটন লরেন্স তার শো-এর মাঝখানে উঠে গেল। কিন্তু কেন? তার শো কি সত্যি ভালো হয়নি? লোকগুলো এমনি এমনি হাততালি দিচ্ছিল। হলিউডের সেরা এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স। লোকে বলে সে প্রতিভার সেরা জহুরি। তার দৃঢ় বিশ্বাস টবি টেম্পলের মধ্যে কোনো প্রতিভা নেই।

ক্লিফটন লরেন্স যদি এই কথা ভেবে থাকে, তাহলে সেটাই চূড়ান্ত?

–আমি বাইরে যাচ্ছি। টবি অ্যালিসকে বলল।

 ভাইন স্ট্রিট। কলোম্বিয়া পিকচার্স, আর. কে. ও প্যারামাউন্ট স্টুডিওর পাশ দিয়ে টবি হাঁটছে, সব দরজায় তালা ঝুলছে। হলিউড বুলেভার্দ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল, নোটিশ বোর্ডে লেখা আছে, হলিউড ল্যান্ড। আসলে হলিউড ল্যান্ড বলে কিছুই নেই। মনের একটা তাড়নার মধ্যে মানুষ এখানে আসে। স্বপ্নের ঘোরে ঘুরতে থাকে। তারকা হবার স্বপ্ন। হলিউড মানেই তাদের কাছে অলৌকিক কিছু একটা। হলিউড মানে আশ্চর্য এবং অলৌকিক মিথ্যে প্রতিশ্রুতির আসর। মায়াবিনী কুহকিনী রমণীরা একসময় দ্বীপের বুকে ঘুরে ঘুরে ভালোবাসার গান গাইত। ইউলিসিসের সহযাত্রী গ্রিক নাবিকদের কাছে ডাকত। তাদের সাথে গোপন সঙ্গমে মিলিত হত। সঙ্গম শেষে তাদের ধ্বংস করত।

টবি জানে না, ভবিষ্যতে কী লেখা আছে। তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেছে। সে শুধু চেয়েছিল, মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে, মানুষকে আনন্দ দিতে। এ জীবনে আর কোনো কাজ সে জানে না। এখন একঘেয়ে কাজ করে দিন গত পাপক্ষয় করতে হবে। সারা জীবন সে অজ্ঞাত অপরিচিত হয়েই বেঁচে থাকবে। নিয়তি তাকে খাঁচার মধ্যে বন্দী করেছে। ভবিষ্যৎ? এক হাজারটা অনামী শহরে তিক্ত এবং নিঃসঙ্গ জীবন। যাদের মুখে সে হাসি ফুটিয়েছিল সেইসব মানুষগুলো আজ কোথায়? যারা তাকে দেখে খুশী হয়েছিল তারা কি কেউ বেঁচে নেই? টবি ভাবল, তার বিবর্ণ অতীত তাকে তাড়া করছে, অস্পষ্ট আততায়ীর মতো তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে।

সে কাঁদল। সে জানে, সে মরে গেছে।

অ্যালিসের বাংলোয় ফিরে এল টবি টেম্পল। তখন পুবাকাশে সূর্য উঠেছে। একদিন সে ভেবেছিল, এই মহিলা তার সামনে একটা জাদু জগতের দরজা খুলে দেবে। আজ সে জানে, জাদুর দুনিয়ার অস্তিত্ব নেই। অন্তত টবির জন্য তা তো নেই-ই। সাতাশ বছর বয়স হয়েছে তার। সে এখন কোথায় যাবে, কী করবে, কিছুই জানে না। তার কোনো ভবিষ্যত নেই, এটা নিশ্চিত।

 ক্লান্ত টবি চোখ বুজে কোচে শুয়ে আছে। নগরী এবার জেগে উঠবে। নিজের মায়ের। কথা মনে পড়ে গেল টবির। মা মাখনে আপেল ভাজছে রান্না ঘরে। রান্নার গন্ধের সঙ্গে মিশেছে তার মায়ের শরীরের গন্ধ। মা বলছে, ঈশ্বর চান একদিন তুই বড়ো হবি টবি। লোকের মুখে মুখে তোর নাম প্রচারিত হবে।

…প্রকাণ্ড স্টেজে ফ্লাডলাইটের আলোয় টবি একা দাঁড়িয়ে আছে। কী বলার কথা সে ভাবতে চেষ্টা করছে। সংলাপ ভুলে গেছে। গলায় স্বর ফুটছে না। মনে আতঙ্ক জেগেছে। শ্রোতারা তাকে মারবে বলে স্টেজের দিকে ছুটে আসছে। শ্রোতারা তাকে ঘিরে চিৎকার। করছে–টবি! টবি! টবি!

 টবির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। হঠাৎ জেগে উঠল সে। দেখল, অ্যালিস ট্যানার তাকে ধাক্কা দিচ্ছে।

অ্যালিস বলল উবি, ওঠো, ফোন ধরো। ক্লিফটন লরেন্স ফোন করেছেন।

***

সাজানো গোছানো ছোট্ট বাড়ি। উইলশায়ার-এর দক্ষিণে। বেভারলি ড্রাইভের ধারে। এটাই ক্লিফটন লরেন্সের অফিস। ফরাসি ইমপ্রেসনিস্ট আর্টিস্টদের আঁকা পেন্টিং। দেখলে মন ভরে যায়। চোখ জুড়িয়ে যায়। গাঢ় সবুজ মার্বেলের চুল্লি, দামী সোফা সেট, পুরোনো চেয়ার। মেয়েটির একমাথা লাল চুল। দেখতে সুন্দরী, বলল মিস্টার টেম্পল, চা?

–এক চামচ চিনি প্লীজ।

 টবি জানে না, ফর্টনাম ও ম্যাসনের আমদানি করা স্পেশ্যাল ব্রেন্ডের, এই চায়ের দাম কত। এ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে এই চা পান করতে তার খুবই ভালো  লাগছে। ভালো লাগছে এই ঘরের সবকিছু। এখানে এলে মনে হয়, পৃথিবীর কোথাও এক টুকরো দুঃখ নেই। ছোটো খাটো চেহারার ক্লিফটন লরেন্সকেও খুব ভালো লাগছে তার।

মিস্টার লরেন্স, আপনার সঙ্গে দেখা হল বলে আনন্দিত। আপনাকে ভুল খবর দিয়ে চালাকি করেছি বলে আশা করি আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

চালাকি? আমি কাল গোল্ডউইনের সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছি। তোমার চালাকিটা আমি আগেই ধরে ফেলেছিলাম। কিন্তু তবু কেন গেলাম বলো তো? আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তোমার সাহস যতটা প্রতিভা ততটা আছে কিনা। দেখলাম তোমার প্রতিভা আছে। তা কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

–কিন্তু আপনি শো ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কেন?

-খাবারটা ভালো কিনা তা দেখার জন্য আমরা কী করি? এক চামচ খেলেই তো বুঝতে পারা যায়, তাই নয় কি? আমি এক মিনিটে বুঝে গেছি।

টবির মনের ভেতর আশার আগুন আবার জ্বলে উঠেছে। গত রাতে সে হতাশার অন্ধকারে শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। এখন আবার জীবনের সজীব সবুজ উপত্যকায় পা রাখতে পেরেছে।

ক্লিফটন লরেন্স বলল–তরুণ এবং অনভিক্ষ কোনো অভিনেতাকে সাফল্যের চূড়ায় ধাপে ধাপে ওঠাবার মধ্যে একটা আলাদা উত্তেজনা লুকিয়ে আছে তা তুমি স্বীকার করো টবি? আমি তোমাকে ক্লায়েন্ট হিসেবে নিলাম। তবে শর্ত একটা। কখনও আমার মুখের ওপর কথা বলবে না। আমাকে মেজাজ দেখানো চলবে না। তাহলেই কিন্তু আমি আর ক্লায়েন্ট হিসেবে কাজ করব না।

–হ্যাঁ স্যার, আমি বুঝেছি।

–সত্যের মুখোমুখি হওয়া ভালো। তোমার শো-টা জঘন্য, এটা স্বীকার করতেই হবে। একেবারে নীচু স্তরের।

টবির মনে হল, ক্লিফটন লরেন্স তার পেটে একটা লাথি মেরেছেন। কিন্তু এখানে তাকে ডেকে আনা হল কেন? তবে কি শেষ অব্দি উনি তাকে নেবেন না?

 –ক্লিফটন বলতে থাকে–গতরাতে অ্যামেচারদের শো ছিল। তুমিও অ্যামেচার। তারকা হবার জন্য কী কী করতে হবে, আমি তোমাকে তাও বলব। তোমার রসিকতাগুলো আমাকে মোটেই আনন্দ দিতে পারেনি।

-হ্যাঁ, স্যার। হয়তো তেমন সুবিধের নয়।

 –তোমার কোনো স্টাইল নেই। এমন স্টাইল যা তোমার একান্ত নিজস্ব।

 –কিন্তু শ্রোতারা

স্টেজে কীভাবে চলাফেরা করতে হয়, তুমি তা জানোনা।

টবি চুপ করে থাকল।

–কিন্তু এতো খারাপ পারফরম্যান্স হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে ডাকা হল কেন বলোতো? যেহেতু তোমার এমন কিছু আছে, যা পয়সা দিয়ে কিনতে পারা যায় না।

–সেটা কী?

–তোমায় সেটা বুঝতে হবে। ঠিক মতো তালিম পেলে আর তোমার জন্য ভালো প্রোগ্রাম লেখা হলে, তুমিও একদিন মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতে নামকরা অভিনেতা হবে। তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

টবির মনে হল, সে বুঝি তারকা হয়ে গেছে। মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। মা বলেছিল, তুই একদিন মস্ত বড়ো আর্টিস্ট হবি।

–যে আর্টিস্ট জনতাকে আনন্দ দেবে, মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাবে, তার সাফল্যের অন্তরালে কী আছে বলো তো? আছে তার ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বকে আমরা পয়সা দিয়ে কিনতে পারি না। ডিয়ার বয়, তুমি সেই সৌভাগ্যজনদের একজন। তুমি কি জানো, কালকে হলিউডের সেরা কমেডি লেখক ও. হ্যানলন ও রেইনজারের সঙ্গে তোমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে?

–কিন্তু আমার তো টাকা নেই?

–তাতে কিছু আসে যায় না। পরে শোধ করবে।

 টবি টেম্পল চলে গেল। ক্লিফটন লরেন্স চোখ বন্ধ করল। তার চোখে জেগে থাকে টবির নিষ্পাপ মুখ নীল চোখে বিশ্বস্ত চাউনি। অনেক বছর ধরে ক্লিফটন এই কাজ আর করতে চায়নি। অপরিচিত কাউকে বিখ্যাত করতে হলে, মনে ভেতর একটা শিহরণ আসে সত্যি, কিন্তু তার জন্য অনেক রাতের ঘুম বিসর্জন দিতে হয়। এই বয়েসে সেটা সহ্য করতে পারে না ক্লিফটন। তার ক্লায়েন্টরা প্রত্যেকেই বিখ্যাত। তারকা স্টুডিওগুলো তাদের ফিল্মে নামানোর জন্য লাফালাফি করে। তবে এতে মনে কোনো উত্তেজনা জাগে না।

***

ওয়েস্ট লস এঞ্জেলসের পিকো বুলেভার্দের ধারে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স স্টুডিওর ভেতর আছে কাঠের একটা ছোট্ট বাংলো। সেখানে কমেডি লেখক ও. হ্যানলন এবং রেইনজারের অফিস। ক্লিফটন লরেন্সের অফিসের মতো জাঁকজমক নেই। মাঝবয়সী একজন সেক্রেটারী, জানলার কাঁচ ভেঙে গেছে। সেখান দিয়ে হু-হু করে হাওয়া এবং রোদ্দুর দুটোই ঢুকছে। দেওয়ালে নোংরা সবুজ রং। অনেক দিন রং করানো হয়নি। মেঝেতে নোংরা বাদামি কার্পেট। দুটো ডেস্কে কাগজ পেনসিল এদিক ওদিক ছড়ানো। কফির পেয়ালা দেখলে বোঝা যায়, ভালো কোনো পিওন এখানে নেই।

 হাই টবি। সব আগোছালো কেন? জানো তো ঝি ছুটি নিয়েছে। আমি ও. হ্যানলন এ—

রেইনজার।

 –হ্যাঁ, রেইনজার।

ও. হ্যানলন মোটাসোটা। ভুড়ি আছে, চোখে চশমা। রেইনজার আবার রোগা আর বেঁটে। গত দশ বছর ধরে ওরা একসঙ্গে কমেডি লিখছে। এখন ওরা হলিউডের সেরা পেশাদার কমেডি লেখক। দুজনের বয়স তিরিশের কোঠায়।

–তোমরা নাকি আমার জন্য কমেডি লিখবে?

টবি, ক্লিফটন লরেন্সের ধারণা, তুমি আমেরিকার নতুন সেক্স সিমব। তুমি নাকি যখন তখন অভিনয় করে দেখাতে পারো। এখানেও দেখাবে?

–সিওর, কিন্তু এখানে? এভাবে?

 –কী চাই এক্সট্রা? ও. স্যানলন ফোনে মিউজিক ডিপার্টমেন্টকে একবার ডাকো তো।

 টবি ভাবল, ওরা আমাকে ডোবাতে চাইছে। পরে ক্লিফটন লরেন্সকে বলবে, এই লোকটাকে দিয়ে কিছু হবে না। নাঃ, সেই সুযোগ আমি তোমাদের দেব না। নকল হাসি ফুটিয়ে টবি অ্যাবট আর কসটেলোর কমেডি নকল করল।

-হাই ল্যু, লজ্জা করো না! তুমি ভবঘুরে হচ্ছে কেন? চাকরি করো না কেন?

করি।

 –কী চাকরি?

চাকরি খোঁজার চাকরি। সারাদিন ওতেই ব্যস্ত থাকি। রাতে ঠিক সময়ে ফিরে ডিনার খাই।

টবির কথার মধ্যে দুই কমেডি লেখক নীচু স্বরে কথা বলছে। তাদের সংলাপ শুনে মনে হচ্ছে টবি টেম্পল এই ঘরে নেই।

-টবি স্টেজে দাঁড়াতে শেখেনি।

 –হাত দুটো এমনভাবে নাড়াচ্ছে যেন কাঠ কাটছে।

বড় বাড়াবাড়ি করছে।

কমেডির কথাগুলো ফালতু।

টবি চটে উঠল।

ইউ বাস্টার্ডস। আমি চললাম, আর তোমাদের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই।

 রেইনজার অবাক হয়ে বলল–হাই। তোমার কী হল?

-হোয়াট দ্য ফাক– হ্যানলনকে বলল।

আমরা কি ওর মনে আঘাত দিয়েছি?

 –দেখো, তোমরা আমায় পছন্দ করো না।

 –আমরা তোমায় ভালোবাসি।

 –তাহলে একথা বললে কেন?

–টবি, তোমার আসল ঝামেলাটা কী, তুমি কি তা জানো? তোমার আত্মবিশ্বাস নেই। মেজাজ ঠান্ডা করে বসো। তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। তুমি যদি বব হোপ হতে তাহলে এখান আসতে কেন?

ও. হ্যানলন বলল–বব হোপ এখন কারমেলে গলফ খেলছে। তুমি গলফ খেলো?

-না।

গলফ খেলার সম্বন্ধে রসিকতাগুলো মাঠে মারা গেল। সিসা, কফি আনো। টবি, তুমি কি জানো, এ দেশে কত জন কমিক অভিতে আছে? তিরিশ কোটির বেশি। উঁচুদরের অভিতো বলতে মাত্র দুজন। কমেডি সব থেকে বড়ো শক্ত কাজ। মানুষকে হাসানো খুব সহজ নয়। তুমি কমিক অভিনেতা হও আর কমেডিয়ান হও।

তফাতটা কী?

অনেক তফাত। কমিক অভিনেতা হাসির দরজা খুলে দেয়। কমেডিয়ান দরজা খুললে তবে হাসি আসে।

কমেডিয়ানরা কেউ সফল আর কেউ কেন ব্যর্থ বলতে পারো?

রেইনজার হঠাৎ টবিকে প্রশ্ন করল।

কমেডিটা কেমন লেখা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে।

বাজে কথা। শেষ নতুন রসিকতা কে লিখে গেছেন বলোতো? প্রাচীন গ্রিক কমেডি রচয়িতা নাট্যকার অ্যারিসটোফেনিস। একই রসিকতা একজন বললে লোকে যত হাসবে, বিখ্যাত অভিনেতা জর্জ বার্নস বললে লোকে বেশি হাসবে। কেন বলো তো? আসলে এর অন্তরালে আছে কমেডিয়ানের ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব না থাকলে তুমি কিছু নও। ব্যক্তিত্ব থেকেই একজন কমেডিয়ানের আসল চরিত্র সৃষ্টি হয়। বব হোপের কথা ধরো। ম্যাক বেনীর রসিকতাগুলো বব হোপ বললে আমরা হাসব কি? কারণ ব হোপের ব্যক্তিত্ব স্মার্ট এবং শহুরে। সে দ্রুত রসিকতাগুলোকে উচ্চারণ করবে। আবার বব হোপের রসিকতাগুলো ম্যাক বেনী বললেও আমরা হাসব না। ম্যাক বেনী কথা বলতে বলতে বিশেষ জায়গায় থামলে আমরা হেসে উঠি। মার্কস ব্রাদার্সের প্রত্যেকের দায়িত্ব আলাদা ধরনের। ফ্রেড অ্যালেনের তুলনা নেই। তুমি ওদের নকল করছে কেন? নকল করে কখনও বড়ো হওয়া যায় না। তোমাকে বড়ো হতে হলে নিজস্ব একটা চরিত্র সৃষ্টি করতেই হবে। তুমি স্টেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সকলে বুঝতে পারবে, তুমি টবি টেম্পল, বুঝেছো?

-হ্যাঁ, মাথা নীচু করে টবি দাঁড়িয়ে থাকল।

–তোমার মুখ দেখলে তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। এটাই তোমার সবথেকে বড়ো সম্পদ। ক্লার্ক গেবলেরও তোমার মতো সরল নিষ্পাপ মুখ আছে। তোমার মুখটাকে ঠিক মতো ব্যবহার করলে সৌভাগ্যের দরজা একদিন খুলে যাবে।

রেইনজার বলল–তাছাড়া সুন্দরী মেয়েদের শরীরে দরজার তোমার কাছে খুলে যাবে।

-তোমার মুখটা এমন নিষ্পাপ, তুমি খারাপ কথা বললে, কিংবা খিস্তি করলেও সেটা মজার বলে মনে হবে। লোকরা এসব কথার মানে বোঝে না। তোমার জন্য আমরা রসিকতা লিখব না আমরা তোমার জন্য একটা আলাদা টাইপ চরিত্র সৃষ্টি করব কেমন?

টবি হেসে বলল–জামার হাত গুটিয়ে কাছে নামা যাক।

তার মনে হল, অনেকক্ষণ বৃষ্টির পরে শেষ বিকেলে আকাশে একটুকরো রোদ্দুর উঠেছে।

.

ও. হ্যানলন এবং রেইনজারের সঙ্গে স্টুডিওয় এসে লাঞ্চ খাচ্ছে টবি। সেখানে বিখ্যাত চিত্র-তারকারা লাঞ্চ খায়। টাইরোন পাওয়ার, লরেটা ইয়ং, বেটি গ্র্যাবল, ডন, অ্যামেচে, অ্যালিস ফে, রিচার্ড উইডমার্ক, ভিক্টর ম্যাচিওর। আর কত নাম বলব। টবি ওদের দেখে খুশী হয়। সে জানে, একদিন সে ওদের ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাবে।

 অ্যালিস ট্যানারও খুশি হয়েছে টবির এই সাফল্যে–টবি ডার্লিং, তুমি বড় হবে। আমার কী আনন্দ।

টবি শুধু হাসল।

টবি, ও. হ্যানলন আর রেইনজার নতুন কমেডিয়ান চরিত্র নিয়ে আলোচনা করছে।

ও. হ্যানলন বলল–লোকটার ধারণা সে বাস্তববাদী অভিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু মুখ খুলতেই তার বোকামি বোঝা যায়।  

–লোকটা কী করে? কথা বলতে গেলেই সব গুলিয়ে ফেলে?

–লোকটা তার মায়ের সঙ্গে থাকে। সে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসার কথাটা মুখে বলতে সাহস করছে না। পাঁচ বছর ধরে ভালোবেসে বিয়ে করার সুযোগ পাচ্ছে না।

–ওটা দশ বছর করা যাক।

-হ্যাঁ, দশ বছর, বিয়ে করার কথা উঠলেই মায়ের নতুন একটা রোগ হয়। টাইম ম্যাগাজিন প্রত্যেক সপ্তাহে ফোন করে নতুন রোগের নাম জেনে নেয়।

সত্যিকার পেশাদারদের সঙ্গে আগে কখনও কাজ করেনি টবি। সে মুগ্ধ। তিন সপ্তাহ সময় লাগল স্ক্রিপ্ট লিখতে। দু-একটা কথা বদলাতে হল। এবার এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স টবিকে ডেকে পাঠাল।

–টবি, শনিবার রাতে তোমার প্রোগ্রাম রোলিং বল-এ।

 –সেটা কোথায়?

 –ওয়েস্টার্ন এভিনিউর একটা ছোট্ট ক্লাব।

নাম শুনিনি।

 –ওরাও তোমার নাম শোনেনি। প্রোগ্রামটা ফ্লপ হলে কেউ জানবে না।

শুধুমাত্র ক্লিফটন লরেন্স ছাড়া।

.

রোলিং বল একটা ছোট্ট এর আগে এই ধরনের হাজারটা বারে শো দেখিয়েছে টবি। এখানে মাঝ বয়সী পুরুষ আড্ডা দিতে আসে। ওয়েট্রেসরা টাইট স্কার্ট আর লোকাট ব্লাউজ পরে। মাতাল পুরুষদের সঙ্গে নোংরা রসিকতা করে আনন্দ পায়। এখানে সস্তার হুইস্কি পাওয়া যায়। এক গ্লাস বিয়ার। অর্কেস্ট্রার তিনজন মিউজিসিয়ানকে দেখে মনে হল সমস্ত পৃথিবীর বোঝা যেন তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রথমেই এল এক সমকামী গাইয়ে। তারপর টাইট প্যান্ট পরা মেয়েরা। এক অ্যাক্রোবেটিক নর্তকীকে দেখা গেল। ঘুমন্ত কেউটে সাপ নিয়ে স্ট্রিপনিজ নর্তনী ছলাকলা দেখাল।

একটা টেবিল ঘিরে বসেছে ক্লিফটন লরেন্স, ও, হ্যানলন, রেইনজার এবং টবি টেম্পল।

 শ্রোতাদের বিদ্রূপ করে টবি বলল–বিয়ার ড্রিঙ্কারস।

ক্লিফটন বলল–এদের এত ছোটো করে না টবি। যারা শ্যাম্পেন খায়, তাদের হাসানো। সব থেকে শক্ত। কেন বলো তো? সারা দিন খেটে রাতে এখানে আসে বিনোদনের জন্য। পয়সার বদলে এরা সত্যিকারের মজা চায়। এদের হাসাতে পারলে তুমি জগতের সবাইকে হাসাতে পারবে।

মাস্টার অফ সেরিমনিজ টবির নাম ঘোষণা করল।

ও. হ্যানলন বলল–টাইগার, তোমার খেলা দেখাও।

টবি উঠে দাঁড়াল।

.

স্টেজে টবি টেম্পল যেন অরণ্যের আঁধারে বিপন্ন এক প্রাণী। অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে।

-ভালোবাসো, আমাকে ভালোবাসো

শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নীরব প্রার্থনা জানাল টবি।

সে শো শুরু করল। তার রসিকতাগুলো কেউ শুনছে না। কেউ হাসছে না। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ওরা নগ্নিকা নর্তকীদের দেখতে চায়। অনেক শনিবার রাতে অপদার্থ কমেডিয়ানরা একইভাবে স্টেজে এসেছে। কমেডিয়ানদের ব্যাপারে ওদের কোনো আগ্রহ নেই। তবু রসিকতাগুলো বলে যাচ্ছে টবি, যন্ত্রের মতো। আর কী-ই বা করতে পারে সে।

ক্লিফটন লরেন্স এবং তার দুই লেখক সঙ্গীর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

 শ্রোতারা শুনছে না, শ্রোতারা হাসছে না। তারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। ব্যান্ড স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ম্যানেজার। টবির প্রোগ্রাম এবার শেষ হবে। বাজনা শুরু হবে। সকলে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে। সব শেষ হচ্ছে। টবির হাত ঘামে ভিজে গেছে। সে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলেছে। টবি কথা বলে যাচ্ছে।

সামনের টেবিলে এক মাঝবয়সী মহিলা হঠাৎ টবির মুখ থেকে ছুটে আসা একটা রসিকতা শুনে হো-হো করে হেসে উঠল। তার সঙ্গীরা এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কথাবার্তা বলছিল। তারাও শুনল, হাসল। পরের টেবিলের লোকেরাও শুনছে হাসছে। কথাবার্তা বন্ধ হয়েছে। ওরা শুনছে, ওরা হাসছে, হাসির শব্দ চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। এতক্ষণ ওরা ছিল সামান্য জনতা। এখন পরিচিতি পাল্টে হয়ে গেছে শ্রোতা। সস্তার বার, বিয়ার গেলা পাবলিক। তাতে কিছু এসে যায় না। ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। ওরা আরও–আরও রসিকতা শুনতে চাইছে। ওরা টবিকে ভালোবেসেছে। এই জঘন্য বারে কত কমেডিয়ান এর আগে এসেছে। যান্ত্রিক শব্দ উচ্চারণ করেছে। কিন্তু কেউ টবির মতো ওদের মন জয় করতে পারেনি। ওরা হাততালি দিচ্ছে। ওরা টবিকে উৎসাহ দিচ্ছে। ওদের উল্লাসে বারটা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

ওরা দেখছে, এক নতুন তারকার জন্ম।

ওরা জানে না, ওরা কি জানে? হা, ক্লিফটন লরেন্স জানে, ও, হ্যানলন এবং রেইনজার  জানে, টবি টিম্পল জানে।

ঈশ্বর শেষ অব্দি কথা রেখেছেন এবং এখনই।

.

১০.

 ক্লিফটন লরেন্স বলল–লাস ভেগাসে তোমার প্রোগ্রাম বুকিং হয়ে গেছে। ডিক ল্যানড্রি সব ব্যবস্থা করবে। তার নাম শুনেছো? সে নাইটক্লাব ডিরেক্টদের মধ্যে সবার সেরা।

টবি জানতে চাইল–কোন হোটেল? ফ্লেমিংগো নাকি থান্ডার বার্ড?

দ্য ওয়েসিস।

দ্য ওয়েসিস, টবি বুঝতে চাইল, ক্লিফ রসিকতা করছে কিনা।

আমি কখনও ওই হোটেলের নাম শুনিনি।

–আমি জানি, তুমি ওই হোটেলের নাম কখনও শোেনন নি। ওরাও তোমার নাম শোনেনি। ওরা তোমাকে নয়, আমাকে বুকড করেছে। আমি বলেছি তোমার কথা।

 –টবি বলল তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি কথা দিচ্ছি, প্রোগ্রামটা ভালো হবে।

শয্যাসঙ্গিনী এবং একদা শিক্ষয়ত্ৰী অ্যালিস ট্যানারের কাছে খবরটা পৌঁছে দিল টবি টেম্পল। অ্যালিস খুশী হয়ে বলল–আমি জানতাম, তুমি মস্ত বড়ো তারকা হবে। ডার্লিং, ওরা তোমাকে ভালোবাসে। আমি কখন যাব? তোমার প্রোগ্রামের প্রথমরাতে আমি কোন্ পোশাক পরব বলল তো?

-তোমাকে নিতে পারলে ভালোই হত। কিন্তু তাতো হবে না। ওখানে রিহার্সাল নিয়ে দিনরাত আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে।

বুঝেছি, কতদিন পরে ফিরবে?

বলতে পারব না। ওপেন বুকিং।

যত তাড়াতাড়ি পারো খবর দিও কিন্তু, কেমন?

অ্যালিসকে একটা যান্ত্রিক চুমু খেয়ে দ্রুত বিদায় নিল টবি।

টবি টেম্পলের আনন্দের জন্যই কি সৃষ্টির হয়েছিল নেভাদার লাস ভেগাস? প্লেনে তার সঙ্গে ছিল প্রতিভাবান কমেডি লেখক ও. হ্যানলন এবং রেইনজার। এয়ারপোর্টে ওয়েসিস হোটেলের মস্ত বড়ো লিমুজিন গাড়ি অপেক্ষা করছিল।

ড্রাইভার বলল–মিস্টার টেম্পল, ফ্লাইটে কেমন কাটল?

 কে সফল হবে, সাধারণ মানুষ আগে থেকে কি টের পায়? টবি ভাবল। উদাসীনতার চিহ্ন মাখা মুখে সে জবাব দিল–যেমন সচরাচর কাটে, সেই একঘেয়ে।

ও. হ্যানলন এবং রেইনজার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল। ওদের দিকে তাকাল টবি, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে। ওদের আন্তরিকতা বেড়েছে, শো বিজনেসে ওরা এখন সেরা টিম।

ওয়েসিস মস্তবড়ো হোটেল নয়। তবে তার সামনে প্রকাণ্ড বিজ্ঞাপনে জ্বল জ্বল করছে টবি টেম্পলের নাম। লেখা হয়েছে-৪ঠা সেপ্টেম্বর থেকে প্রোগ্রাম শুরু। লিলি ওয়ালেস আর টবি টেম্পল।

ও, হ্যানলন বলল–ইয়া, লিলি ওয়ালেস, একদম ঘাবড়ে যেও না টবি। প্রোগ্রাম শুরু হলে তুমি ওর ওপর উঠবে।

ওয়েসিসের ম্যানেজার পার্কার নিজে টবি টেম্পলকে তার ঘরে নিয়ে গেল। সে বলল আপনি এখানে আসাতে আমি খুবই খুশি হয়েছি মিস্টার টেম্পল। কোনো দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন। এতটুকুও কিন্তু কিন্তু করবেন না।

 –টবি জানে, এই ভদ্রতা বিখ্যাত হলিউড এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্সের খাতিরে। ক্লিফ এই প্রথম তার কোনো ক্লায়েন্টকে শো দেখাবার জন্য পাঠিয়েছে। ম্যানেজারের আশা, পরে ক্লিফ হয়তো সত্যিকারের বড়ো তারকাদের পাঠাবে।

তিনটি বেডরুম, মস্ত বড়ো লিভিং রুম। বার আছে, আছে ঝুলবারান্দা। সবই টবির একার জন্য। টেবিলের ওপর দামী পানীয়। ফুল, ফল, পনির–সব কিছু ঠিক জায়গায় সাজানো।

–আশা করি আপনার কোনো অসুবিধা হবে না মিস্টার টেম্পল।

টবি চারপাশে তাকাল। মনে হল, সে বুঝি স্বপ্নের পৃথিবীর নায়ক হয়ে গেছে। সেইসব হোটেলের কথা মনে পড়ল। যেখানে এতদিন সে শো দেখিয়ে বেরিয়েছে। আরশোলা এবং ছারপোকায় ভর্তি জঘন্য ঘরে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছে।

মিস্টার টেম্পল, তিনটের সময় মিস্টার ল্যানড্রি আসবেন। তখন রিহার্সাল হবে।

ধন্যবাদ।

 –কোনো কিছুর দরকার হলে বলবেন।

অভিবাদন জানিয়ে ম্যানেজার বিদায় নিল।

চারপাশে তাকাতে তাকাতে টবি ভাবল, এখন থেকে এমন জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত হবে সে। তার জন্য থাকবে অগুনতি সুন্দরী, সীমাহীন প্রশংসা এবং গুনতে পারা যাবে না এমন টাকা। হাততালি–শুধু হাততালির শব্দ শুনবে সে। মানুষ হাসবে এবং খুশী হবে। টবিকে ভালোবাসবে। শ্রোতার প্রশংসা এবং দর্শকের ভালোবাসাই একজন অভিনেতার কাছে সেরা খাদ্য ও পানীয়। এই জীবনে বাঁচতে গেলে আর কিছুর প্রয়োজন নেই তার।

.

ডিক ল্যানড্রির বয়স কত হবে? তিরিশের কাছাকাছি। রোগা, মাথায় অল্প অল্প টাক পড়েছে। পা দুটো দীঘল এবং সুন্দর। একসময় ব্রডওয়েতে জিপসির ভূমিকায় অভিনয় করত। কোরাস থেকে সেরা ড্যান্সার হয়েছিল। তারপর নৃত্য পরিচালক। নাট্য পরিচালক। কতগুলো পরিচয় তার। রুচিবোধ আছে। দর্শক কী চায়, সে জানে। খারাপ নাটককে ভালো করতে সে পারে না। কিন্তু ডিক ল্যানড্রির পরিচালনার গুণে যে কোনো নাটক আপাত দৃষ্টিতে ভালো বলে মনে হয়। টবি টেম্পলের নাম সে শোনেনি। সমস্ত কাজ ফেলে সে কেন নেভাদার লাস ভেগাসে ছুটে এসেছে? ক্লিফটন লরেন্স তাকে অনুরোধ করেছে, টবির .. প্রোগ্রামটা দেখতে। একদিন ক্লিফটন তাকে বড়ো হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। ল্যানড্রি সেই । সুযোগের কথা ভোলেনি, অধিকাংশ অভিনেতারা পরবর্তীকালে এসব ভুলে যায়। কিন্তু ল্যানড্রি এখনও ক্লিফটনের প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতা জানায়।

টবি টেম্পলের সঙ্গে দেখা হল। মিনিট পনেরোর মধ্যে ধুরন্ধর পরিচালক ডিক ল্যানড্রি। বুঝতে পারল, কমেডিয়ান হিসেবে টবির প্রতিভা আছে। ওর রসিকতায় ল্যানড্রি নিজে হেসে উঠেছে। সাধারণতঃ সে হাসে না। মুখ গোমড়া-গোগামড়া করে রাখে। রসিকতাগুলো বড়ো নয়, কীভাবে টবি বলছে, সেটা ভাবতে হবে। যেন কত নিষ্পাপ এবং অসহায়, যেন ওর মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে। দর্শকদের ইচ্ছে হবে ওকে ভালোবাসতে। শ্রোতাদের ইচ্ছে হবে ওকে ভরসা দিতে।

ল্যানড্রি বলল–তুমি ভালো, সত্যি ভালো। আমি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছি না।

ধন্যবাদ। ক্লিফ বলেছে, ভালো হওয়াটা যথেষ্ট নয়, বড়ো হতে হবে। তুমি আমাকে শেখাবে, কীভাবে আমি বড়ো হব?

–চেষ্টা করব, কমেডিয়ান হিসেবে তোমার প্রতিভা বহুমুখী, শুধু স্টেজে দাঁড়িয়ে সংলাপ বললে হবে না, গান গাইতে হবে। আরও এমন কিছু করতে হবে, যা দর্শকদের কাছে বাড়তি পাওনা হিসেবে থাকবে। তুমি কি গান গাইতে পারো?

–ক্যানারি পাখি ভাড়া করো, অমন গান আমি জানি না। একটা ক্যানারি পাখি যা জানে।

চেষ্টা করো।

টবি চেষ্টা করে। ল্যানড্রি খুশী হয়।

–গলা ভালো নয়। কিন্তু গান শোনার কান আছে। ঠিকমতো গান লেখা হলে সেই গান তুমি গাইতে পারবে। পাবলিক ভাববে, ফ্রাংক সিনাত্রার চেয়ে টবি টেম্পল কম নয়। গীতিকারদের আমি বলব, তোমার গলার উপযোগী গান লিখতে। তুমি নাচতে পারো?

টবি চেষ্টা করে।

–চলবে। তুমি ড্যান্সার নও, তবে লোকের মনে একটা ভুল ধারণার জন্ম দেওয়া যাবে যে তুমি নাচ জানো।

–কেন নাচিয়ে গাইয়ের তো অভাব নেই।

কমেডিয়ানেরও অভাব নেই। মানুষকে কীভাবে সত্যিকারের আনন্দ দিতে হয়, সে ব্যাপারটা আমি তোমাকে শেখাব।

টবি আবার হেসে বলল–তা হলে? জামার হাতা গুটিয়ে কাজ শুরু করা যাক।

.

কাজ শুরু হল।

প্রত্যেকটা রিহার্সালে ও, হ্যানলন এবং রেইনজার উপস্থিত থাকে। দরকার মতো তারা কথা বদলায়। নাচ, গান এবং কথা এক সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।

টবির শরীরের প্রত্যেকটা পেশীতে অসহ্য যন্ত্রণা। ঘুমের মধ্যে সে গান গাইছে। ঘুমের মধ্যে তার মাথা ঘুরছে। চোখের সামনে অসংখ্য মানুষের মুখের মিছিল দেখতে পাচ্ছে সে।

এবং রোজ অ্যালিস ট্যানারের ফোন পাচ্ছে। টবি ভোলেনি কোনো কিছুই। সে ভোলে না। ওই মহিলা তার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে চেয়েছিল। সে বলেছিল–টবি, তুমি এখনও তৈরি হওনি।

 হ্যাঁ, টবি টেম্পল আজ তৈরী হয়েছে। অ্যালিস ট্যানারের সমস্ত বাধা সে দূরে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। ট্যানার কী চায়, সেটা টবি জেনে গেছে। ট্যানার চায়, শুধু শরীরের উষ্ণতা।

জাহান্নামে যাক অ্যালিস। ফোনের জবাব দেয় না টবি। এক সময় আর ফোনে আসে না। কিন্তু রিহার্সাল চলতে থাকে।

তারপরে? তারপর আরকী? ওপেনিং নাইট!

নতুন মঞ্চ বা চিত্রতারকার অভ্যুদয়ের ঘটনাটা আকাশে হঠাৎ জাগা তারার মতো। পৃথিবীর সর্বত্র অদৃশ্য টেলিপ্যাথিতে তার সংবাদ পৌঁছে যায়। লন্ডন থেকে প্যারিস, নিউইয়র্ক থেকে হলিউড অথবা সিডনি যেখানে মঞ্চ আছে, যেখানে চলচ্চিত্র তৈরী হয়, যেখানে হাজার হাজার উৎসুক মানুষ আছে, তাদের সকলের কানে কানে।

 ওয়েসিস হোটেলের স্টেজে টবি টেম্পল নামল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই জেনে গেল, দিগন্তে এক নতুন তারকার জন্ম হয়েছে।

টবির ওপেনিং নাইটে ক্লিফটন লরেন্স প্লেনে এল। অন্য ক্লায়েন্টদের অবহেলা করে সে টবির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। শো শেষ হল। অল নাইট কফিশপে বসে টবি আর ক্লিফ।

 টবি বলল–বিখ্যাত তারকারা আমার সঙ্গে ড্রেসিং রুমে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

 ক্লিফ হাসল। টবির কাছে সাফল্য সব থেকে বড়ো ব্যাপার। এটাই স্বাভাবিক। ক্লিফ  বলল–প্রতিভা সবাই চিনতে পারে। ওয়েসিস হোটেলে তোমাকে সপ্তাহে ছশো পঞ্চাশ থেকে এক হাজার ডলার দেবে।

টবির মাথা ঘুরছে–সপ্তাহে এক হাজার? ফ্যানটাসটিক!

–থান্ডার বার্ড আর এল. র‍্যানবো হোটেল কথা বলছে। টবি আমার মনে হয়, তুমি সংবাদপত্রের হেডলাইন হতে পারো। যারা হেডলাইনে পরিণত হয়, তাদের মধ্যে আর বেশী কী আছে? আজ রাতে আমি প্লেনে নিউইয়র্ক যাব। কাল লন্ডন। কয়েক সপ্তাহ পরে ফিরব। তুমি দ-হপ্তা এখানে প্রোগ্রাম করবে। মনে করো, এটা তোমার স্কুল। রোজ রাতে তোমাকে নতুন কিছু দেখাতে হবে। নতুন কিছু শিখতে হবে। দেখতে হবে, তোমার শো শ্রোতাদের মনের ভেতর সত্যি কী ধরনের আবেদন সৃষ্টি করছে। প্রত্যেক সপ্তাহে ল্যানড্রি একবার প্রোগ্রাম দেখতে আসবে। ও. হ্যানলন আর রেইনজার এখানে থাববে। ওরা সবসময় তোমাকে সাহায্য করবে।

ধন্যবাদ, ক্লিফ।

ওহো ভুলেই গিয়েছিলাম।

পকেট থেকে ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে টবির হাতে তুলে দিল হলিউডের সেরা এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স।

টবি প্যাকেটটা খুলল। হীরের তৈরী একজোড়া কাফলিং।

 টবির হঠাৎ মনে হল আকাশের দুটি উজ্জ্বল তারকা যেন।

.

যখন কাজ থাকে না তখন কমেডিয়ান টবি টেম্পল সুইমিং পুলের ধারে বিশ্রাম করে। স্নানের পোশাক পরা মেয়েরা রোদ পোহায়। টবি টেম্পল এখন এক তারকা। সব মেয়ে তার সঙ্গে শুতে চায়। টবির হঠাৎ মনে হয় তার বিছানাতে ঠাই পাবার জন্য ওই সুন্দরী মেয়েরা বুঝি একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

.

দু-দুটো সপ্তাহ কেটে গেল স্বপ্নের এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে।

ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। তারপর অসময়ে ব্রেকফাস্ট। অটোগ্রাফ খাতায় যন্ত্রের মতো সই করা। বিকেল হতে না হতেই রিহার্সাল। সুইমিংপুল থেকে মেয়ে। জোগাড় করে আবার শরীর নিয়ে খেলা।

যে মেয়েরা নাচের প্রোগ্রামে অংশ নেয়, তারা খুব টাইট কস্টিউম পরে। নাভির নীচের সমস্ত জায়গাটা কামিয়ে ফেলে। কিন্তু এমনভাবে কামায়, যেন গোপন গভীরের চারপাশের এক গুচ্ছ কেশ সহজে দেখতে পাওয়া যায়। ওই কেশগুচ্ছ মাতাল পুরুষ দর্শককে আকর্ষণ করে। বলে, হে প্রিয়তম, আমি এখানে সযত্নে তোমার জন্য এক টুকরো উর্বর জমি সাজিয়ে রেখেছি।

 একটি মেয়ে টবির বিছানার শুয়ে ওকে বলেছিল, এটা কামনা বাড়ায়। কোনো মেয়েকে টাইট প্যান্ট পরে আসতে দেখলে পুরুষ চিত্রে ঝড় ওঠে। আসঙ্গ লিপ্সায় সে অধীর হয়ে। ওঠে।

উদীয়মান কমেডিয়ান তারকা টবি টেম্পল যে সব মেয়েদের সাথে রাত কাটায়, তাদের অধিকাংশের নাম সে জানে না। নাম জানতে সে মোটেই আগ্রহী নয়। কাউকে সে আদর করে হনি বলে ডাকে। কাউকে ডাকে বেবি বলে। এইসব মেয়েরা তার কাছে কামনার অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো। উঁচু ঠোঁট আর আসঙ্গ লিপ্সায় উন্মাদ রমণীর এক-একটি শরীর।

.

 প্রোগ্রামের শেষ সপ্তাহে একদিন টবি শো শেষ করে মেকআপ তুলছিল। ডাইনিং রুম ক্যাপ্টেন দরজা খুলে চাপা গলায় বলল মিস্টার আল ক্যারুসো আপনাকে ওর সঙ্গে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছেন।

ভদ্রলোক লাস ভেগাসের এক নামজাদা মানুষ। হোটেলের মালিক। দু-তিনটে হোটলে শেয়ার আছে। লোকে বলে, ওনার সঙ্গে মাফিয়াদের গোপন যোগাযোগ আছে। তাতে টবির কিছুই যায় আসে না।

 আল ক্যারুসো তাকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা যে কত দামী, টবি সেটা জানে। লাস ভেগাসে সারা জীবন ধরে সে শো দেখাতে পারবে। আর মাতাল দর্শকদের কাছে লাস ভেগাস হল এক টুকরো স্বর্গ। টবি তাড়াতাড়ি পোশাক বদল করল ডাইনিং রুমে চলে গেল।

আল ক্যারুসোর বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে সবেমাত্র। চেহারায় খুব একটা উঁচু নয়। মাথায় ধূসর চুল। চোখের বাদামী তারা প্রতি মুহূর্তে ঝিলিক দিচ্ছে। সামান্য একটু উঁড়ি আছে। চট করে দেখলে তাকে রূপকথার সান্তাক্লজ বলে মনে হয়।

টবি টেবিলের কাছে হেঁটে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে হেসে বলল–আমি আল ক্যারুসো। বস টবি, তোমার সম্পর্কে আমি কী ভেবে রেখেছি, সেটা বলার জন্যই তোমাকে এই অসময়ে ডাকলাম।

টেবিলের ধারে আরও দুজন লোক বসে আছে। মোটাসোটা, পরনে কালো সুট। ওরা কোকা-কোলা খাচ্ছে। ওরা কোনো কথা বলছে না।

টবিরও খিদে পেয়েছে কিন্তু ওদের ডিনার শেষ হয়ে গেছে। এখন হ্যাংলার মতো খাবার চাওয়া উচিত হবে না।

 কিড, তোমার প্রোগ্রাম সত্যি আমার ভালো লেগেছে। হাসতে হাসতে আমি প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার মধ্যে একটা লুকোনো প্রতিভা আছে একথা স্বীকার করতেই হবে।

ধন্যবাদ মিস্টার ক্যারুসো।

 –আমায় শুধু আল বলে ডেকো।

স্যার আল।

ক্যারুসো হয়তো ব্যবসায়িক প্রসঙ্গ তুলবে। ক্লিফকে না বলে টবি একাই সব ঠিক করবে।

–তোমার সঙ্গে কেন দেখা করতে এসেছি জানো?

 –আমি শুনছি আল।

মিলি তোমাকে ভালোবাসে?

–মিলি? সে আবার কে? এক মুহূর্ত টবি চিন্তা করল। ক্যারুসোর বউ, নাকি তার মেয়ে?

–মিলি খুব ভালো মেয়ে। সে আমার রক্ষিতা। গত তিন-চার বছর ধরে তাকে আমি পুষেছি। না, বোধহয় পাঁচ বছর হবে। তাই না?

সঙ্গীরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

–মিলি আর নিজের বউ ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের ডাকে আমি সাড়া দিই না। মিলিও অন্য কারো সঙ্গে শুলে সঙ্গে সঙ্গে আমায় তা বলে দেয়। একমাত্র তোমার ক্ষেত্র ছাড়া সে কখনও আমাকে ঠকায়নি।

টবি কেঁপে উঠল। পা থেকে মাথা অব্দি থরথর করে কাঁপছে তার। হয় ঈশ্বর, এ কোন জালে আমি জড়িয়ে পড়লাম।

ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আমি জানতাম না যে, মিলি আপনার গার্লফেন্ড। জানলে আমি কখনও ওর শরীর ছুঁতাম না। আমি কথা দিচ্ছি, এখন থেকে আমি আর ওকে স্পর্শ করব না, মিস্টার ক্যারুসো।

আল বলো।

 –আল, আমি কথা দিচ্ছি।

হায়! মিলি তোমাকে ভালোবাসে। ও তোমাকে চায় ও তোমাকে পাবে। আমি কেন বাধার প্রাচীর তুলে দাঁড়াব। আমি যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমরা চাই তোমরা দুজন সুখী হও, বুঝেছো?

 পরের দিন টবি টেম্পলের ভয় কেটে গেল। এটা দস্যু সর্দার আল ক্যাপোনের যুগ নয়। কেউ ইচ্ছে করে কাউকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে না। তাছাড়া আল ক্যারুসো তো এক গুডা নয়। হোটেলের মালিক। ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর।

পরে এই নিয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করবে টবি। গরিলাদের নিয়ে টেবিলে বসে ছিল ক্যারুসো। পিস্তলের দরুন প্যান্ট ফুলে উঠছিল। গুছিয়ে বলতে পারলে লোকে হাততালি দেবে।

টবি আর সুইমিং পুলের ধারে যায় না। আধা ন্যাংটো মেয়েগুলোকে দেখলে ভীষণ ভয় লাগে তার। ভাবল রবিবার দুপুরের প্লেনে সে পালিয়ে যাবে। শনিবার রাতে হোটেলের পেছনে পার্কিং প্লেসে গাড়ি অপেক্ষা করবে। জিনিসপত্র সব প্যাক করে রাখা আছে। কিছুদিন সে আর লাস ভেগাসে আসবে না। বেশী সমস্যা হলে ক্লিফটন লরেন্স সব সামলে নেবেন।

শেষ রাতের শোতে শ্রোতাদের সোচ্চার অভিনন্দন পেল সে। হাততালির ঝড় বুঝি থামতেই চায় না। জীবনের শ্রেষ্ঠ তিনটি সপ্তাহ সে এখানে কাটিয়ে গেল। যখন এসেছিল, তখন সে ছিল নেহাতই এক অপরিচিত অখ্যাত। সে তখন ওয়েট্রেসদের সঙ্গে আর পোলিও রোগে পঙ্গু মহিলার সঙ্গে শুয়েছে।

এখন সে তারকা। এখন আল ক্যারুসোর রক্ষিতা পর্যন্ত তাকে পেতে উদগ্রীব। সুন্দরী মেয়েরা তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে বসে থাকে। দর্শকেরা তাকে ভালোবেসে। শ্রোতারা তার কথা শুনতে চায়। বড়ো বড়ো হোটেল তাকে আমন্ত্রণ জানায়। সে সাফল্যের সিঁড়িতে পা রেখেছে। এই তো সবে শুরু। একটা একটা করে সোপান তাকে পার হতেই হবে। উপরতলার ঘরের দরজাটা চাবি দিয়ে খুলল টবি।

 ভেতর থেকে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল–ভেতরে এসো।

 আল ক্যারুসো এবং তার দুই পুরোনো সঙ্গী, টবির মেরুদন্ডে শীতল শিহরণ। ক্যারুসো হাসছে এবং বলছে–টবি, আজকের শো দারুন হয়েছে।

–এখানকার দর্শকেরা খুবই ভালো। তারা গুণের সমঝদার।

–তুমি ওদের ভালো বোকা বানিয়েছ। আমি আবার বলছি, তোমার মধ্যে একটা লুকনো প্রতিভা আছে।

ধন্যবাদ আল।

 –তুমি খুব পরিশ্রম করো, তাই না?

ক্যারুসো দুই সঙ্গীর দিকে তাকাল। এটা বোধহয় তার এক বদভ্যাস। ওরা ঘাড় নাড়ল।

–হাই টবি, মিলি রাগ করছিল, তুমি ফোন কররানি কেন? আমি বললাম, খুব পরিশ্রম হচ্ছে তাই বোধহয়, সময় পাওনি।

ধন্যবাদ আল।

–কিন্তু টবি বিয়েটা কটার সময় হবে তা জানার জন্য তুমি তো একবার ফোন করতে পারতে।

কাল সকালে ফোন করতাম।

লস এঞ্জেলস থেকে?

 তার মানে?

আরও একবার চমকে গেল টবি।

-তোমার জিনিসপত্র প্যাক করা হয়ে গেছে। দেখো টবি, তোমার সঙ্গে এভাবে হেসে হেসে কথা বলছি বলে ভেবো না, আমি মানুষটা এইরকম। মিলির যে ক্ষতি করবে, তাকে আমি খুন করবই।

বিশ্বাস করুন ঈশ্বরের দোহাই।

–তুমি ভালো ছেলে কিন্তু বোকা। আমি অনেক প্রতিভাবান লোককে জানি, তোমার মতোই গর্দভ। আমি তোমার বন্ধু। তোমার কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। মিলির খাতিরেই চাই না। কিন্তু তুমি আমার কথা না শুনলে কী করব বলো? খচ্চরকে কী ভাবে হুকুম করতে হয়, তা আমার ভালোভাবেই জানা আছে।

টবি ঘাড় নাড়ল।

–খচ্চরের মাথায় মারতে হয়। কোন্ হাতটা তুমি বেশী ব্যবহার করো টবি?

 –ডান হাত।

দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে ক্যারুসো বলল–টবির ডান হাতটা ভেঙে দাও।

টবি টেম্পলের মাথা ঘুরছে আমতা আমতা করতে থাকে সে।

প্রথমে ও ভেবেছিল, প্রবঞ্চিত প্রেমিক বোধহয় প্রতিশোধ চাইছে। এখন দেখা যাচ্ছে, আল ক্যারুসো তার নিজের রক্ষিতাকে টবির হাতে তুলে দিতে চাইছে। টবি বেগড়বাই করলেই সর্বনাশ।

আশ্বস্ত হয়ে টবি হাসল। বলল–জেসাস্। আল, তুমি যা চাও, তাই হবে।

মিলি যা চায়–

ইয়া, মিলি যা চায়।

–আমি জানতাম, তুমি খুব ভালো মানুষ। কী হে, আমি বলিনি, টবি টেম্পল ভালো লোক?

দুই সঙ্গী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

আল ক্যারুসো এবং তার সঙ্গীরা উঠে দাঁড়াল।

বিয়ের ব্যবস্থা আমিই করব। ক্যারুসো বলতে থাকে, মরক্কো হোটেলের বড়ো ব্যানকোয়েট হল ভাড়া করা হবে। সব ব্যবস্থা আমি করব। তোমায় কোনো চিন্তা করতে হবে না।

অনেক দূর থেকে কে যেন কথা বলছে, টবি টেম্পলের কানে সেই শব্দ ভেসে আসছে। বিয়ে? টবি টেম্পলের বিয়ে? লোকটার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? এখন বিয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ার মানে কী? মানে কেরিয়ারের দফ-রফা।

–এক মিনিট দাঁড়ান। আমার পক্ষে…।

–তোমার ভাগ্য ভালো টবি। মিলি যদি আমাকে না বোঝাতত যে, সত্যি সত্যি তুমিও ওকে ভালোবাসো, তাহলে আমি ভাবতাম, মিলিকে বেশ্যা ভেবে তুমি তার শরীর ভোগ করেছে। তাহলে কী যে হত তোমার, তা ভাবতে আমার আপশোস হচ্ছে, কী বলল হে?  

মাফিয়া-সর্দারের দুই-সঙ্গী ঘাড় নাড়ল।

টবি, শনিবার, তোমার এখানকার প্রোগ্রাম শেষ, রবিবার বিয়ে হবে।

 –কিন্তু আমার অন্য বুকিং আছে।

 –ওসব পরে হবে। মিলির বিয়ের গাউন আমি নিজে কিনব, গুডনাইট টবি।

তিনজনে চলে গেল।

 মিলি মেয়েটা যে কে, টবি তা বুঝতেই পারছে না।

যীশুর দোহাই

পরমুহূর্তেই কে যেন টবির পেটে লাথি লাগয়ে দিল। অন্য একজনের হাতের লোহা টবির ডান হাতের হাড় ভেঙে দিয়েছে। টবির দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসছে। বেচারী চিৎকার পর্যন্ত করতে পারছে না।

হাসতে হাসতে ক্যারুসো বলল–কী হে, এবার আমার কথায় মন দেবে তো?

যন্ত্রণার মধ্যে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল টবি।

ও হে, ওর প্যান্টের বোতামটা খোলো তো। বাঃ, ভাগ্যবান পুরুষ তুমি। তোমার যন্ত্রটা তো বেশ বড়।

–ওহ গড প্লীজ…।

না, তোমার কোনো ক্ষতি করব না। যতক্ষণ তুমি এটা দিয়ে মিলিকে খুশী করবে। ততক্ষণ তুমি আমার বন্ধু। কিন্তু খারাপ ব্যবহার করলে তোমার এটা কেটে…তাহলে কাল দুপুর একটায় মিলির সঙ্গে তোমার বিয়ে।

–আমি পারব না। আমার হাত

ডাক্তার আসবে। প্লাস্টার করবে। ব্যথা কমানোর ওষুধ দেবে তুমি এত ভাবছো, কেন, খোকা? ঠিক সময়ে তৈরী থেকো কেমন?

ওরা দাঁড়িয়ে রইল।

ক্যারুসোর পা আবার টবির হাতের দিকে উঠেছে।

–হ্যাঁ, তৈরী থাকব। টবি বলল। এরপর সে আর কিছু বলতে পারেনি। অজ্ঞান হয়ে গেল।