দুপুর
১৩.
ঘরে যেন বাজ পড়ল। ভূত দেখলেও বোধহয় ওরা এভাবে আঁতকে উঠত না। ওরা একজন, অন্যজনের মুখের দিকে স্তম্ভিত তড়িতাহতের মত তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই দরজায় দেখা গেল তাকে। ওদের সব কজনের দিকে চোখ বুলিয়ে অস্বস্তির ভঙ্গী হাবে ভাবে ফুটিয়ে তুলে সে বলে, আমার, আমার বোধহয় আসাটা… বোধহয় উচিত হয়নি। উডি অধৈর্য মেশান ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে বলে, ড্যাম রাইট ইউ আর। টাইলার খাদে নামানো গলায় উডির ঠিক বিপরীত অভিব্যক্তি আর প্রকাশভঙ্গী থেকে বলে, কে আপনি, জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড? টাইলার তার জজসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রেখেই ঠিক আগের কথার অভিব্যক্তির ধরনে বলে। আসলে, আমি জানতে চাইছি, বলতে চাই–আপনি ঠিক কে? আসলে কে? জুলিয়া কিছু বলতে যায়। তারপর থমকে যায় নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। ওর ঠোঁট ফাঁক হয়। শুধু শোনা যায়, আমি…আমার মা রোজমেরী নেলসন…আমার বাবা…বাবা হ্যারী স্ট্যানফোর্ড। জুলিয়াকে বাদ দিয়ে অন্য কজন পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। এ কথার কোন প্রমাণ আপনার কাছে আছে? দলটার হয়ে টাইলারই আবার কথা বলে। প্রশ্নটা তোলে, ছুঁড়ে দেয় জুলিয়ার দিকে। জুলিয়া ঢোক গেলে, ওকে যথার্থই বিব্রত দেখায়, না। সেরকম কোন শক্তপোক্ত প্রমাণ বা তথ্য আমার কাছে নেই। বেনডাল এবার কথা বলে… এটা, এটা যে আমাদের কাছে একটা আঘাত তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পরেছেন? আপনি যা বলছেন তা যদি সত্যি হয় তবে…ইয়ে, আপনি আমাদের সৎ বোন হবেন। জুলিয়া ইতস্তত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ে। আপনি বেনডাল। মায়ের মুখে আপনার কথা খুব শুনেছি। জুলিয়া বেনডালের চোখে চোখ রেখে বলে, তারপর উডির দিকে ফিরে তাকায়, আপনি নিশ্চয়ই উডররাও। সবাই আপনাকে উডি বলে।
উডির মুখে প্রভাবিত হবার কোন চিহ্নই পড়ে না। বিরক্ত এবং সতর্কভঙ্গীতে দ্ব্যর্থবোধক উত্তর দেয়, পিপল পত্রিকা থেকে অনায়াসেই এসব কথা জানা যায়। টাইলার আবার কথা বলে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে কোর্টে রায় দেবার ভঙ্গীমায় বলে, আশা করি আপনি আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পারছেন। কোন দৃঢ় যথোপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া আপনাকে, আপনার কথাকে মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন। জুলিয়া নাভাস ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে সায় দেবার ভঙ্গীতে বলে, হ্যাঁ তা ঠিক। আমি কেন যে এলাম, নিজেই ঠিকঠাক জানি না, বুঝে উঠতে পারছি না। উডি ফোড়ন কাটে, বোধহয় আমি জানি । আপনার আসার কারণটি টাকা। জুলিয়া ঘরের সবার মুখের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। ভাল ভাবে সবাইকে নিরীক্ষণ করে নিয়ে কঠিন গলায় সে বলে, আপনারা আমায় ভুল বুঝেছেন। বাবার সম্পত্তির টাকায় আমার কোনো আগ্রহই নেই। আমি সেসব দাবী জানাতে আসিওনি। আমি…হয়তো কথাটা নাটকীয় শোনাবে কিন্তু আসলে সত্যিই আমি এসেছি আমার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে। কোনদিন না দেখা সব ভাইবোনেদের দেখতে। কেনডাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে নিরীক্ষণ করছিল। এবার সে বলে, তোমার মা কোথায় আছেন? টাইলার বলে, তোমার কাছে এমন কোন আইন গ্রাহ্য প্রমাণ নেই বলছ যাতে প্রমাণিত হয় তোমার সত্য পরিচয়? জুলিয়া বিষণ্ণ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে, সেটা তার আগেই ভাবা উচিত ছিল। এখন এই মুহূর্তে ওদের সবকজনের অবিশ্বাসী দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে যাচাই এবং অসম্মানের কষ্টি পাথরের নির্মম ঘষার জ্বালাবোধ করতে করতে তীব্র ঘৃণাবোধ হয়। না এলেই বোধহয় ভাল করত। না আইন সঙ্গত কোন প্রমাণ আমার কাছে হয়ত নেই। তবে এমন কিছু কিছু কথা, যা হয়ত আমি মায়ের মুখে শোনা ছাড়া, অন্য কোন ভাবে জানা সম্ভব নয়।
মার্ক ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে, যেমন? জুলিয়া মাথা একপাশে হেলিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর বলে, আমার মা প্রায়ই এ বাড়ীর পেছন দিকের একটা গ্রীন হাউসের কথা বলত। প্রচুর ধরনের… উডি ওকে বাধা দিয়ে মাঝ পথেই থামিয়ে দেয়। ঐ গ্রীন হাউসের ছবি অন্তত শদুয়েক পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এ পর্যন্ত। এছাড়া, তোমার মা আর কি বলেছিলেন? টাইলার প্রশ্ন করে, এ প্রশ্নে জুলিয়ার মুখ ঝলমল করে ওঠে, ওহ। সে যে কত কথা। তোমাদের সম্পর্কে বলতে আমার মা প্রচণ্ড ভালবাসত, তোমাদের সবার কথা এবং তোমাদের সঙ্গে যে দারুণ সুন্দর সময়টা কাটিয়ে ছিলেন, সে সম্পর্কে অনেক কিছু কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। একবার তোমাদের সবাইকে নিয়ে তিনি সোয়ান হ্রদে নৌকাবিহার করতে গিয়েছিলেন। তোমাদের একজন জলে পড়ে গিয়েছিল। কোন জন, তা আমি মনে করতে পারছি না। এ ঘটনা শুধু বেনডাল আর উডিই জানে। তারা টাইলারের দিকে তাকায়। হ্যাঁ, আমি সেদিন জলে পড়ে গিয়েছিলাম। সে স্বীকার করে। তারপর একদিন কেনাকাটা করতে বের হয়ে তোমাদের একজন হারিয়ে যায়। অন্যেরা প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল তখন সেই ঘটনায়। বেনডাল ধীর গলায় বলে, আমি সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলাম। সারা ঘর জুড়ে স্তব্ধতা এখন। ওরা নীরবে একজন অন্য জনের দিকে ইঙ্গিতবাহী দৃষ্টিতে তিন ভাই বোন দৃষ্টি বিনিময় করছিল। ঘরের পরিবেশ জুড়ে সেই হিরন্ময় নীরবতা ভেঙ্গে উডির দিকে তাকিয়ে জুলিয়া বলে, মা তোমায় একদিন চার্লসটাউনের জাহাজ ঘাটায় নিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ জাহাজ দেখাতে। তুমি সেখান থেকে আর বাড়ী ফিরে আসতে চাইছিলে না কিছুতেই। প্রায় জোর জবরদস্তী করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল সেদিন। কথা শেষ করেই সে বেনডালের দিকে তাকায়, একদিন জনগণের জন্য সরকারী বাগানের গাছ থেকে তুমি বেআইনী ভাবে বিনা অনুমতিতে একটা ফুল ছিঁড়েছিলে। প্রায় গ্রেপ্তার হতে বসেছিলে পুলিশের হাতে সেদিন তুমি।
বেনডাল ঢোঁক গেলে, মাথা নেড়ে সায় দেয়, হা সত্যিই। এরকম ভাবে একের পর এক ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা বলে চলে সে। মনোযোগী শ্রোতার মত গভীর আগ্রহে ওরা সেসব শুনতে থাকে। দেখা যায় প্রতিটি ঘটনা ওদের কারো না কারো জীবনের সঙ্গে হুবহু সত্যভাবে জড়িত। এক বর্ণও অতিরঞ্জিত নয় কোন ঘটনা। তারপর এক সময় সে থামে। আমি…আর কি বলার আছে। আর কিছু বাকি নেই বোধহয়। একথা বলে থেমে যায় সে, তারপর হঠাই যেন কিছু মনে পড়ে গেল। এভাবে বলে, দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমাদের একটা জিনিষ বোধহয় দেখাতে পারি। একটা ছবি, হাতব্যাগ খুলে মলিনতর বিবর্ণ হয়ে ওঠা একটা ছবি বের করে ওদের এগিয়ে দেয়। রোজমেরীকে ঘিরে ওরা তিন ভাই বোন। এবার ওদের তিন ভাইবোন যখন আগ্রহী, উদগ্রীব চোখে ছবিটাকে দেখছে। জুলিয়া ধীর গলায় কেটে কেটে বলে, তোমরা আমায় বিশ্বাস করছ কিনা তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আমি তো আগেই বলেছি, কখনো যে বাবাকে চোখেই দেখলাম না তার টাকা সম্পত্তির প্রতি আমার কোন আগ্রহই নেই। সেসবের লোভ আমি আসিওনি। আমি এসেছিলাম…।আবেগে বাকরুদ্ধ গলা ঝাপসা হয়ে ওঠে, জুলিয়া থেমে যায়। টাইলার ওর আবেগকে সতর্ক চোখে নিরীক্ষণ করতে করতে বলে, তোমার অবস্থানটা আমরা বুঝতে পারছি। আমাদের অবস্থানটাও তুমি বোঝার চেষ্টা করো। একেবারে শূন্য থেকে আকাশ থেকে হঠাৎ তুমি এসে হাজির হলে। তেমন কোন প্রমাণও তোমার হাতে নেই, তোমায় মেনে নিতে, গ্রহণ করার জন্য নিশ্চিত হতে। আমাদের একটু ভাবার সময় দেওয়া উচিত তোমার। হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জুলিয়া সায় দেয়। তারপর ঘরের সবার দিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে বলে, আমি ট্রিসন্ট হাউস হোটেলে উঠেছি। আমি এখন সেখানেই ফিরে যাচ্ছি। টাইলার সম্মতিসূচক ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বলে, সেই ভাল, আমরা ভাই বোনেরা একটু এ ব্যাপারে কথা বলে নিয়ে তোমার সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করব।
ওরা জুলিয়ার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। জুলিয়া ঘর ছেড়ে চলে যাবার কয়েক মুহূর্ত পর বেনডাল বলে, তাহলে? আমাদের আরো একটি বোন আছে? আমি মোটেই সেকথা বিশ্বাস করি না। উডি হিংস্র ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে বলে। মার্ক বলে ওঠে, আসলে, আমার মনে হয়…। সবাই একই সাথে কথা বলতে থাকে। বলেই চলে উত্তেজিত ভাবে। এক দুর্বোধ্য কোলাহল ছাড়া আর কারো কথাই কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। টাইলার হাত তোলে দৃঢ়তায়। সিদ্ধান্ত জানাবার কাঠিন্যসহ বলে ওঠে, এরকম করে, এভাবে আমরা কখনো কোনদিন আদৌ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব না। পুরো ব্যাপারটাকে আমাদের যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে। তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক সেটা নিতে হবে একমত হয়ে। সবার সায় থাকতে হবে। উডি মাথা নাড়ে, একদম ঠিক কথা। টাইলার মাথা তোলে, ঘরের অন্য কজনের মুখের দিকে নজর বুলিয়ে বলে, বেশ। ধরা যাক আমরা সবাই জুরি, মেয়েটি নিজেকে আমাদের সৎ বোন হিসেবে পরিচয় দিতে চাইছে, তার দোষ অথবা নির্দোষিতা বিচার করছি। জুরিদের রায় বের হয়ে আসে মত প্রকাশের ভোটের মধ্যে দিয়ে। আমরাও : সেই পথই অবলম্বন করব। প্রথম মত এবং ভোটটি আমিই দিচ্ছি তাহলে। আমার মত মেয়েটি জোচ্চর। আমার ভোট তার বিরুদ্ধে, বিপক্ষে।
জোচ্চর! তুমি কি করে এত নিশ্চিতভাবে তা বলতে পারছ? মেয়েটি আমাদের ছোট বেলার যে সব ঘটনা বলল, জানে। তারপরও এরকম কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ ওর প্রতি একতরফা ভাবে অন্যায়-অবিচার করা। বেনডাল তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলে। টাইলার, বেনডালের দিকে তাকায়, মুচকি হেসে, বলে, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এ বাড়ীতে একজন চাকর-চাকরানী কাজ করত? বেনডাল আচমকা ঐ ধরনের প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে যায়। অবাক চোখে তাকায়, কেন? ডজন খানেক তাই নয় কি? তারা অনেকেই আমাদের ছোটবেলার ঐ সব ঘটনা জানে। জানা সম্ভব, তাই না? এবং তাদের কারো পক্ষে যে কোনভাবে আমাদের সঙ্গে রোজমেরীর ঐ ছবিটা পাওয়াও তখন মোটেই অসম্ভব ছিল না। টাইলার কি বলতে চাইছে বেনডাল এবং অন্যেরাও সহজেই বুঝতে পারে। এবং অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে জজের কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। মার্ক বলে, তাহলে চক্রান্ত? টাইলার মুখে বলে, কিন্তু আমরা প্রমাণ করব কী করে, ও জাল বা নকল। আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই।
সেটার উত্তর তোমরা কাল পাবে।
সাইমন ফিৎজেরাল্ড ধীরে ধীরে কেটে কেটে বলেন, আপনি বলছেন, এত বছর পর জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড-এর আবির্ভাব ঘটেছে? একজন মহিলা এসে হাজির হয়েছেন, যিনি নিজেকে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড বলে দাবী করছেন। টাইলার ওনাকে সংশোধন করার ভঙ্গীতে বলে। এবং আপনারা তাকে বিশ্বাস করছেন না? স্টিভ সোলানে প্রশ্ন করে, নিশ্চয়ই নয়। ওর পরিচয়ের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কতগুলো ঘটনা শুধু বলেছে। দৃঢ় প্রমাণ হিসেবে কাউকে নিশ্চিত করে মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সবার বিশ্বাস মহিলা একজন জোচ্চোর, জালিয়াত। সাইমন ফিৎজেরাল্ড ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলেন, সেটা প্রমাণ করার জন্য আপনারা কী করতে চান? খুব সহজ উপায় তো আছেই, ডি এন এ পরীক্ষা। সোলানে আঁতকে ওঠার মত করে বলে। তার মানে তো আপনার বাবার দেহকে আবার কবর থেকে তুলতে হবে। টাইলার ফিৎজেরাল্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, কী আর করা যাবে? এরকম পরিস্থিতিতে এটাই একমাত্র পথ। আপনি বাবার মরদেহ কবর থেকে তোলানোর আবেদন করুন। ফিৎজেরাল্ডও সায় দেবার ভঙ্গীতে বলেন, ঠিক আছে। সে ব্যবস্থা আমি না হয় করছি। কিন্তু মেয়েটি ডি এন এ পরীক্ষায় রাজী হবে কেন? এ ব্যাপারে ওর সাথে কোন কথা হয়নি। তবে যদি সে রাজী না হয় তবে বুঝে নিতে হবে যে পরীক্ষার ফলাফলে তার আপত্তি আছে। হয়ত ফলাফল তার বিরুদ্ধে যাবে বলেই। ফিৎজেরাল্ড দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে, সত্যি বলতে কী, এসবে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। তবে এটাও সত্যি যে এরকম একটা বিতর্কিত সমস্যার সমাধান ঘটতে পারে এই পদ্ধতিতেই। এই একটাই পথ আছে। কয়েক মুহূর্ত চিন্তান্বিত ভাঁজময় কপালসহ তিনি দুচোখ বুজে রইলেন। তারপর স্টিভের দিকে তাকালেন, এই ব্যাপারটা সামলানোর দায়িত্ব আমি তোমায় দিলাম।
পরদিন সকাল দশটা, বাড়ীর পড়বার ঘরে ওরা সবাই জমায়েত হয়েছিল। ওরা সবাই মুখোমুখি বসেছিল এক নবাগতর। টাইলার ঘরের অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে। এনার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি পেরি উইঙ্গার, একজন ডি এন এ বিশেষজ্ঞ। বেনডাল প্রশ্ন ও বিস্ময় জড়ানো চোখে টাইলারের দিকে তাকায়। ডি এন এ বিশেষজ্ঞ। এখানে ওনার কী কাজ? টাইলার অন্যদের সবার মুখে ঐ একই প্রশ্নের প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়। আমি ঐ উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটিকে কিছুতেই মেনে নেবো না। শেষ পর্যন্ত দেখব। এবং ইনি তাতে সাহায্য করবেন? বেনডাল বলে, সেটা কি ভাবে? এবার পেরি উইঙ্গার মঞ্চে অবতীর্ন হন। ঘরের সব কজনের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ডি এন এ পরীক্ষা হচ্ছে বংশগতির প্রমাণ সূচক পরীক্ষা। যাতে সন্দেহভাজন দুজনের দেহকোষকে মেলানো হয়। যদি দেখা যায় যে দুটি দেহকোষ ডি এন এ মিলে যাচ্ছে তবে তারা একই বংশগতির বাহক, এখানে আমরা শ্রী স্ট্যানফোর্ডের দেহ থেকে ডি এন এ কোষ সংগ্রহ করব। তারপর ওর মেয়ে হবার দাবী যিনি করেছেন তার শরীরের ডি এন এ, যার পুরো নাম ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড নেবো। এটা রক্ত, চুল, বীর্য ধাতু এরকম যে কোন দেহ পদার্থ থেকে সংগ্রহ করা যায়। এবার দুজনের ডি এন এ জিন কোডকে ম্যাচ করানো হবে রসায়নাগারে। যদি তা মিলে যায় তবে প্রমাণ হবে উনি শ্রী স্ট্যানফোর্ডের সন্তান। আর যদি ম্যাচ না হয় তবে নিশ্চিত ভাবেই প্রমাণ হবে যে উনি জোচ্চোর প্রতারক। কথা শেষ করে পেরি উইঙ্গার কাঁধ ঝাঁকালেন। সে ভঙ্গীটির অর্থ হয়–এই ই সব। উডি প্রশ্ন করে, এই পরীক্ষাটা কতটা নিখুঁত এবং নির্ভরযোগ্য? পেরি হাসেন, দুশো শতাংশ। তার চেয়ে বড় কথা আইনের চোখে এই পরীক্ষার ফলই শেষ কথা।
ওরা সবাই এখন খাবার ঘরে। বেলা সাড়ে তিনটে। জুলিয়াকে কিছুটা সন্ত্রস্ত বিভ্রান্ত হতশ ও বিষণ্ণ, দেখাচ্ছিল। ইতিমধ্যে পেরি উইঙ্গার তাকে ডি এন এ টেস্ট-এর ব্যাপারে বিশদভাবে জানিয়েছেন। বিপন্ন মুখে সে বলে, আমি এই ব্যাপরে বাবার মৃতদেহকে কবর খুঁড়ে তুলে আনার ব্যাপারটা একদমই পছন্দ করছি না। ব্যাপারটা ভাবলেই কেমন গা ঘিনঘিন করছে। টাইলার মাথা নাড়ে, হয়ত তা ঠিকই, তবে তোমাকে তো বললামই জুলিয়া, এছাড়া কোন উপায় ছিল না। জুলিয়া বিপন্নতাময় ভঙ্গীতেই বলে, আমাকে কী করতে হবে। উইঙ্গার বলেন, একজন ডাক্তার তোমার চামড়ার নমুনা সংগ্রহ করবেন। তারপর সেখান থেকে তোমার শরীরের ডি এন এ কোষ সংগ্রহ করা যাবে এবং সেটিকে শ্রী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহ থেকে একই পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা ডি এন এ কোষের সঙ্গে মেলানো হবে। আমি…আমি…এক দমই, ভাল লাগছে না ব্যাপারটা আমার। উডি উদ্ধত। প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে প্রশ্ন করেন। কেন? কেন পছন্দ হচ্ছে না? জুলিয়া অসহায় ভঙ্গীতে বলে, জানি না। তবে এত সব…কবর খোঁড়া..মৃতদেহ তোলা.. টাইলার শান্ত গলায় বলে, এবং সে সব…সব কিছু। শুধু তুমি যে সত্যি বলছ তা প্রমাণ করার জন্যে। এবার অন্তর্নিহিত তীব্র সন্দেহের খোঁচাটি জুলিয়া বুঝতে পারে। নিমেষে ওর মুখের রেখা অভিব্যক্তি বদলে যায়। ঘরে উপস্থিত সব কজনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নেয় সে। তারপর টানটান কঠিন মুখে বলে, ঠিক আছে। আমি রাজী।
কবর খুঁড়ে মৃতদেহ বের করার অনুমতি প্রশাসনের এবং কবরখানার দফতর থেকে বের করা সহজ কাজ নয়। পরের দিন কাটল সেই ব্যস্ততায়। অবশেষে অনুমতি পাওয়া গেল।
সোমবার সকাল নটায়, মৃতদেহ কবর থেকে তোলার অনুমতি পাওয়া গেল। নির্দিষ্ট দিনে টাইলার, উডি, বেনডাল, মার্ক, জুলিয়া, সাইমন ফিৎজেরাল্ড, স্টিভ সোলানে, পেরি উইঙ্গার এবং ডাঃ কলিন্স নামের একজন করোনোর দপ্তরের প্রতিনিধির সামনে মৃতদেহ তোলার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং ওঁরা সবাই হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের কবরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কবরখানার চারজন কর্মী কবর খুঁড়ে কফিনসহ হ্যারী স্ট্যানফোর্ডকে বের করে আনার কাজে ব্যস্ত ছিল। এক সময় কফিনটি দেখা দিল। দ্রুত হাতে মাটি সরিয়ে ধরাধরি করে কবর খানার চার কর্মী কফিনটিকে মাটির গর্তের ওপরে তুলে আনল। কর্মীদলের কর্তাটি এবার এই দলটার দিকে ঘুরে তাকায়। এবার কী করতে হবে? পেরি উইঙ্গার এগিয়ে যায়। ডালাটি সরিয়ে দিন। আমি চট করে একটু চামড়ার নমুনা নিয়ে নিই। কর্মীদের একজন ধীরে ধীরে ডালাটাকে ঠেলতে থাকে। ডালা সরে যেতে থাকে। টাইলার, উডি, বেনডাল, জুলিয়া, মার্ক, পেরি টানটান হয়ে ওঠে। ওদের উত্তেজনার আঁচ ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের মধ্যেও। উপস্থিত সব কজন টানটান হয়ে ওঠা সাগ্রহ শরীরে ঝুঁকে পড়ে কফিনের দিকে। কফিনের ডালা পুরো খুলে যায়।
হে ভগবান, বেনডালের ঠোঁট দিয়ে বের হয়ে আসা শব্দগুলো আর্তচিৎকারের মত, তীব্র আতঙ্কতাড়িত শোনায়।
কফিন সম্পূর্ণ খালি।
.
১৪.
রোজ হিলের বাড়ীর বসবার ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিলেন ওরা সব কজন। ঘটনার তীব্রতর অভিঘাতে হতভম্ব স্তম্ভিত, আতঙ্কজড়িত। উডি ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে বলে উঠল, হঠাৎ এটা সম্ভব হলে কী করে? কুত্তাটা এটা করল কী করে? টাইলার মাথা নাড়ে, এটাই তো লাখ ডলারের প্রশ্ন। নিশ্চিত ভাবেই ঐ মেয়েটা ছাড়া একাজ কেউ করেনি। অন্য কারো এরকম কিছু করার কারণ উদ্দেশ্যও তো কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাজটা সে করল কী ভাবে? প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করল কী করে? এখন আমরা কী করব? কী করার আছে আমাদের? বেনডাল প্রশ্ন তোলে। টাইলার কাঁধ ঝাঁকাল, সত্যি বলতে কী আমি জানি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই একটা কোন উপায়, অন্তত কিছু একটা পথ তো থাকবে? মার্ক উদ্বিগ্নতা ভরা গলায় প্রশ্ন করে। টাইলার তাকায়। ওর কপালে গভীর চিন্তা উদ্বেগের ভাঁজ। চিন্তান্বিত গলায় বলে, একটা, একটাই মাত্র পথ খোলা দেখতে পাচ্ছি আমি, একজন প্রাইভেড ডিটেকটিভকে দিয়ে ঘটনার তদন্ত করানো। যে ঐ মেয়েটার আসল চেহারা, জালিয়াতিকে প্রকাশিত উন্মুক্ত করতে পারবে। উডি আগ্রহের গলায় বলে, এটা চমৎকার পরিকল্পনা, তোমার চেনাজানা এরকম কোন গোয়েন্দা আছেন? টাইলার বলে, না, আমার পরিচিত কাউকে এ ব্যাপারের সঙ্গে জড়াতে চাই না। আমরা শ্রী ফিৎজেরাল্ড-এর সাহায্য চাইতে পারি এ ব্যাপারে। সবাই এ ব্যাপারে রাজী হয়। টাইলার ফোন তুলে নিলো। সাইমন ফিৎজেরাল্ডের নম্বর ঘোরায়। মিনিট তিন দুজনে কথাবার্তা হলো। তারপর ফোন নামিয়ে রেখে ঘরের অন্যদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, টিমমনস, ফ্রাঙ্ক টিমমনস তার নাম। এবং এটা তার ফোন নম্বর। তোমরা যদি রাজী থাকো, তাহলে আমি ভদ্রলোকের সাথে যোগাযোগ করতে পারি। অন্যেরা সবাই এই কথায় রাজী হয়।
পরের দিন বিকেল, বসবার ঘরে ওরা সবাই অপেক্ষায় বসেছিল। এক সময় ক্লার্ক এসে খবর দেয়, ফ্রাঙ্ক টিমস নামের এক ভদ্রলোক এসেছেন, আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। উডি বলে, ওনাকে নিয়ে এসো। কয়েক মুহূর্ত পরই ক্লার্ক পথ দেখিয়ে ফ্যাকাসে রঙের শক্তপোক্ত গড়নের চল্লিশোর্ধ এক পুরুষকে এঘরে নিয়ে এসে হাজির করে। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর, টাইলার সরাসরি কাজের কথায় চলে যায়। পুরো ব্যাপারটা বিস্তারিত ভাবে খুলে বলে টিমমনসকে। সব কথা শোনার পর টিমমনস বলে, ঠিক আছে, কেসটা আমি নিচ্ছি। ঘরের সব কজনের স্বস্তির শ্বাস ফেলার সশব্দ আওয়াজ শোনা যায়। ফ্রাঙ্ক টিমমনস বলে, আশা করি আমার পারিশ্রমিক সম্পর্কে আপনারা অবশ্যই ওয়াকি বহাল। তবুও আমার কর্তব্য সেটা জানিয়ে দেওয়া। আমি দৈনিক একহাজার ডলার হিসাবে পারিশ্রমিক নিই। নিমেষে ঘরের আবহাওয়াটা বদলে যায়। সবাই যেন চমকে থমকে যায়। বেনডাল অবিশ্বাসের চেরা গলায় বলে ওঠে, দিনে..হাজার ডলার? টাইলারও চমকের অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ঘরের বদলে যাওয়া পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে জরিপ করতে থাকেন টিমমনস। উডি মরীয়া ভঙ্গীতে বলে ওঠে, ঠিক আছে। পারিশ্রমিকের ঐ অঙ্কই আপনাকে দেওয়া হবে।
প্রথম কাজই টিমমনস যেটা করলে বস্টন পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে পুরনো দিনের খবরের কাগজ-এর মাইক্রোচিপ ঘেঁটে ঘেঁটে পঁচিশ বছর আগের স্ট্যানফ্যার্ড পরিবারের কেচ্ছাটির সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ে নিলো। লাইব্রেরী থেকে যখন বের হলো টিমমনসের মনে হলো একটা গোটা উপন্যাস লেখার মত রসদ জোগাড় হয়ে গেছে তার হাতে। এর পর সে এসে হাজির হলো সাইমন ফিৎজেরান্ডের অফিসে। আমার নাম ফ্রাঙ্ক টিমমনস। ফিৎজেরান্ডের সঙ্গে তার প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষ করে সে যখন বের হয়ে আসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার জানা হয়েছে। ৯ই আগষ্ট, ১৯৭৬ আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে জ্বলিয়া স্ট্যানফোর্ড জন্ম নেয়। কোথায়? এটা জানা তার পক্ষে অত্যন্ত জরুরী ছিল। ফিৎজেরান্ডের কাছ থেকে জানা গেল উত্তরটা। সেন্ট জোসেফ হাসপাতাল, মিলাউঁকি। সেই প্রথম এবং শেষবার ওদের মা-মেয়ের সম্পর্কে খোঁজ খবর জানতে পারা যায়। তার পরই ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়। জন সমুদ্রে মিশে যায়। আত্মগোপন করে।
শ্রীমতি ডোহার্টি, মিলাউঁকির সেন্ট জোসেফ হাসপাতালের সুপারিন্টেডেন্ট একজন ষাট বছর বয়সি রুপোলী চুলের বৃদ্ধা মহিলা। স্মৃতির পাতা উলটে পালটে দেখতে দেখতে একসময় তিনি বলে উঠলেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে বটে। আরো আগেই অবশ্য মনে পড়া উচিত ছিল। আহ কি ভয়ঙ্কর কেচ্ছা, কেলেঙ্কারীর ঘটনা। রিপোর্টারগুলো পিছু তাড়া করে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এখানে পর্যন্ত এসে হাজির হয়েছিল। ভাবতে পারেন? এখান থেকে ওরা কোথায় গিয়েছিল আপনি জানেন? না এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই। ও চলে যাবার সময় কোন ঠিকানা রেখে যায়নি? টিমমনস এবার ব্যাপারটাকে অন্যদিক থেকে ধরতে চায়। হাসপাতাল ছেড়ে যাবার সময় উনি কি পুরো পাওনা টাকা মিটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন? শ্রীমতি ডোহার্টি মাথা নাড়েন, না, ওরা মা-মেয়ে যখন হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবার সময় এলো, রোজমেরী আমায় বলল, হাসপাতালের পুরো বিল মেটাতে পারবে না । কিছুটা দেবার মত টাকাই ওর কাছে আছে। এটা নিশ্চয়ই হাসপাতালের নিয়মের পরিপন্থী। কিন্তু কেন জানি না, মেয়েটার ওপর আমার মায়া পড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া মেয়েটি তখন ভীষণ অসুস্থ ছিল। তাই ওকে যেতে দিয়েছিলাম। যদিও রোজমেরী কথা দিয়ে গিয়েছিল যে, আমাদের সমস্ত পাওনা সে অবশ্যই মিটিয়ে দেবে। তিনি কি পরে তা করেছিলেন? অবশ্যই। মাস কয়েক পরই সে ডাক মারফৎ একটা চেক পাঠিয়েছিল। হাসপাতালের পাওনা টাকা মিটিয়ে দিয়ে। ততদিনে ও একটা চাকরী পেয়েছিল। ঐ ডাক ফেরতের ঠিকানা, ওটা পাওয়া যাবে কি শ্রীমতি ডোহার্টি? আচমকা সোনার খনি আবিষ্কার করার মত উত্তেজনা চক চক করে ওঠে টিমমনসের চোখের তারায়। হে ভগবান! সে তো কোন আদ্যিকালের ঘটনা। দোহাই শ্রীমতি ডোেহার্টি এটা অত্যন্ত জরুরী। শ্রীমতি ডোহার্টি কয়েক পলক টিমমনসের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,–আপনি বসুন, পঁচিশ বছরের পুরনো ফাইল ঘাঁটতে হবে, সময় লাগবে।
প্রায় মিনিট কুড়ি পর তিনি ফিরে এলেন। হাতে একটা লাল কাগজের টুকরো। হাসি মুখে তিনি টিমমনসের দিকে বাড়িয়ে এগিয়ে দিলেন–নিন, পেয়েছি।
এলিট টাইপিং সার্ভিস, ওমাহা, নেব্রসকা।
এলিট টাইপিং সার্ভিসের মালিক ওটাটো ব্রডরিকের বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। টিমমনসের কথার উত্তরে ঝাঁঝালো গলায় তিনি বললেন, আমরা প্রচুর অনিয়মিত অস্থায়ী কর্মীকে নিয়োগ করি। অতদিন আগের কোন একজনের কথা কি করে মনে রাখা সম্ভব? এটা একটা বিশেষ ঘটনা। একজন একাকী মহিলা। সদ্য প্রসব হওয়া অসুস্থ, ভগ্নস্বাস্থ্য। সঙ্গে সঙ্গে সদ্য জন্মান শিশু কন্যা। রোজমেরী? ওটটো ব্রডরিকের মুখ দিয়ে আচমকাই তীরের মত ছিটকে বের হলো নামটা। ঠিক ধরেছেন। ওর কথা কি করে মনে রয়েছে আপনার দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর বাদেও? ওটাটো হাসেন, আপনি Anemonies কাকে বলে জানেন? হ্যাঁ, স্মৃতি সহায় বিদ্যা, মনে রাখতে সাহায্য করে এমন পদ্ধতি। ঠিক বলেছেন। ও যখন এখানে কাজ করতে আসে তখনি একটা সিনেমা ছিল–রোজমেরিজ বেবী। তার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার। এবং… রোজমেরী নেলসন আপনার এখানে কতদিন কাজ করে ছিল? প্রায় এক বছর, তারপর, হঠাৎ কিভাবে যেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে খবর পৌঁছে যায় ওর আসল পরিচয়। আমরাও তখনি জানতে পারি। সংবাদ মাধ্যমের উঁকি ঝুঁকি। যাতায়াত শুরু হতেই একদিন মাঝরাতে সে নিঃশব্দে এ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। উনি কোথায় গিয়েছিলেন সে ব্যাপারে আপনার কোন ধারণা আছে? হ্যাঁ নিশ্চয়ই। রোজমেরী একটু উচ্চতর আবহাওয়ার জলবায়ু পরিবেশে থাকার কথা বলত। আমিই ওকে ফ্লোরিডার গালে এজেন্সীতে যেতে বলেছিলাম।
দশ দিন পর আবার বস্টনে ফিরে এলো ফ্রাঙ্ক টিমমনস। রোজ হিলের বাড়ীর বসবার ঘরে স্ট্যানফোর্ড পরিবারের সদস্যদের মুখোমুখি হলো সে। ওদের সবকজনের তীব্রতর উৎসুক জ্বলজ্বলে দৃষ্টি এখন তার ওপরে নিবদ্ধ। টিমমনস তার ব্রিফকেস খুলে এক তাড়া কাগজ বের করলো। সেগুলোয় নজর বুলোতে বুলোতে সে মুখ খুললো। প্রথমেই আমি… ওর কথা শুরু হওয়া মাত্র টাইলার বাধা দিয়ে বলে ওঠে,–ওসব থাকুক, শ্ৰী টিমমনস, আপনি শুধু আমাদের বলুন মেয়েটা জালিয়াত জোচ্চোর নাকি খাঁটি আসল; টিমমনস ঠান্ডা চোখে ওদের সব কজনের অতি আগ্রহের উত্তেজনায় প্রায় আদিমতর হয়ে ওঠা হিংস্রতার ছায়ামাখা মুখগুলোর দিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে কাটাকাটা গলায় বললো, যদি আপনারা কিছু মনে না করেন শ্রী স্ট্যানফোর্ড, আমার নিজের একটা পদ্ধতি আছে। আমি সেভাবেই কাজ করতে চাই। টাইলার উডির দিকে তাকালো। দুজনের মধ্যে সতর্কতার ইঙ্গিতবাহী দৃষ্টি বিনিময়ের পর টাইলারই বলে,–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আপনি বলুন। সুতরাং টিমমনস বলে চলে, হাসপাতাল থেকে রোজমেরী নেলসন যায় ওমাহা, নেব্রাস্কাতে। চাকরী নেন–উষ্ণতর আবহাওয়া তার স্বাস্থ্য শরীরের পক্ষে উপযোগী হবে তাই। এর পর তিনি ফ্লোরিডায় বাস করতে থাকে। চাকরী নেন…এর পর। শেষ খোঁজ পাওয়া যায় দশবছর আগে। তখন তিনি সানফ্রান্সসিসকোতে বাস করছিলেন। এটা কি? টাইলার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দশবছর আগে? গত দশ বছরের খোঁজ আপনি জোগাড় করতে পারেননি? তাহলে তো কাজের কাজ কিছুই হলো না। পণ্ডশ্রম। ওর কথায় কান বা মনোযোগ না দিয়ে ফ্রাঙ্ক টিমমনস এক মনে নিজের হাতের কাগজগুলো দেখতে দেখতে এক সময় মুখ তুলল। মেয়েটি, জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল। তখন তার বয়স সতের বছর। উডি তীক্ষ্ণ রাগ মেশানো গলায় বলে, তাতে কি সোনার খনি আবিষ্কার হলো আমাদের? ফ্রাঙ্ক টিমমনস এক টুকরো কাগজে চোখ রেখে বলে, ক্যার্লিফোনিয়া রাজ্যের নিয়ম, প্রতিটি চালকের অনুমতিপত্র প্রাপ্তর আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে রাখা। আমি সেখান থেকে একটা কপি করে এনেছি। কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দিয়ে সে বলে, এই হচ্ছে আসল জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের আঙ্গুলের ছাপের নমুনা?
টাইলার সপ্রশংস চোখে টিমমনসের দিকে তাকিয়ে বলে, চমৎকার, তার মানে, যদি মেয়েটির ফিঙ্গার প্রিন্ট ঐ নমুনার সঙ্গে মিলে যায় তাহলে সে আমাদের সৎ বোন, খাঁটি। আর যদি না মেলে তাহলে… টিমমনস বলে, আমি সঙ্গে করে একটি পরিবহনযোগ্য আঙ্গুল ছাপ মেলানোর যন্ত্র নিয়েই এসেছি। উনি কি এখানে আছেন? তাহলে এখুনি পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যায় ফলাফল। টাইলার উত্তেজিত গলায় বলে, না, স্থানীয় একটি হোটেলে থাকছে সে। আমি এখুনি ফোনে ওকে বলছি এখানে চলে আসতে।
আধঘণ্টা বাদে, ওরা সদল বলে হোটেল ট্রিমন্ট হাউসে জুলিয়ার ঘরে হাজির হয়। কারণ ফোনে টাইলারের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখান করেছিল জুলিয়া। ওরা ঘরে ঢুকে দেখে জুলিয়া তার সুটকেস গোছাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছো তুমি? বেনডাল বলে। সে ওদের দিকে ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। তারপর দৃঢ় গলায় বলে, আমি বাড়ী ফিরে যাচ্ছি। আমারই ভুল। আমার এই দেখা করতে আসাটা। টাইলার অগোছালো ভঙ্গীতে বলে, তুমি তার জন্য আমাদের দায়ী করতে পারো না। ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত ভঙ্গীতে জুলিয়া বলে, আমার ওপর, প্রথম মুহূর্তটা থেকেই তোমরা আমায় সন্দেহের চোখে দেখছ, অথচ বারবার আমি তোমাদের বলেছি, বাবার সম্পত্তিতে আমার কোনরকম লোভ বা দাবী নেই। আমি এসেছিলাম, বাবার মৃত্যুর খবর জানতে পেরে, তোমাদের সঙ্গে, আমার সৎ ভাই বোনদের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু বিনিময়ে কী পেলাম, শুধুই সন্দেহ আর অবিশ্বাস। দুচোখ জলে ভরে ওঠে ওর। টপটপ করে এক সময় চোখ ভাসিয়ে দুগাল বেয়ে নেমে আসে। টাইলার থমকে যাওয়া পরিবেশের ভারী আবহাওয়ার নৈঃশব্দ্য ভাঙ্গে, জুলিয়া পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ফ্রাঙ্ক টিমমনস, একজন গোয়েন্দা। জুলিয়া জলভরা অথচ খর চোখে তাকায়। এবার কি? আমায় গ্রেপ্তার করা হবে? ভদ্রমহোদয়া জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড সানফ্রান্সিসকোতে গাড়ীর চালকের সরকারী অনুমতি অর্থাৎ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিলেন। জুলিয়া দুই ভুরু কুঁচকে এক ঝলক ভাবে। তারপর উত্তর দেয়, হ্যাঁ, অবশ্যই মনে পড়েছে। তাতে কী, সেটা কি আইন বিরুদ্ধ কোন কাজ নাকি আপনার মতে।
টিমমনস মাথা নাড়ে, না, মহোদয়া নিশ্চয়ই নয়, আসলে কথা হচ্ছে… টাইলার হঠাৎ বাধা দেয়। কথাটা হচ্ছে, সেই জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের আঙ্গুলের ছাপ লাইসেন্সে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে জুলিয়া কিছুটা বিভ্রান্তের মত বলে, আমি বুঝতে পারছি না…। এত সব কথা…। উডি বলে ওঠে, আমরা চাই সেই লাইসেন্সে দেওয়া জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের নমুনার সঙ্গে তোমার আঙ্গুল ছাপ মিলিয়ে যাচাই করতে। জুলিয়া শক্ত মুখে বলে, না, আমি তা করব না। মার্ক প্রশ্ন করে, কিন্তু বোন, দেবে না কেন? ওর শরীর কাঁপতে থাকে। জুলিয়া ফেটে পড়া রাগের অভিব্যক্তিতে বলে, কারণ প্রথম থেকেই তোমরা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছ যেন আমি অপরাধী। যথেষ্ট হয়েছে, তোমাদের ওসব খেলায় আর আমি নেই। আমি চলে যাচ্ছি। বেনডাল নরম গলায় বলে, দেখো জুলিয়া, যা ঘটছে। যা করতে হচ্ছে তা আমাদেরও ভাল লাগছে না। কিন্তু আইন এবং নিজেদের মনের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্য, এসব কিছু করতে বাধ্য যাচ্ছি আমরা। কিন্তু এবার এসবের শেষ হওয়া একটা সমাধান সূত্রে পৌঁছান দরকার। এই ব্যবস্থাটা তোমায় সুযোগ করে দিচ্ছে প্রমাণ দেবার। তুমি আসলে কে প্রমাণ করে দিয়ে গোটা অধ্যায়টাতে পর্দা টানাও। তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো কেন? জুলিয়া কথাগুলো শুনে বেনডালের মুখটাকে সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ওর দৃষ্টি ফেরে অন্যদের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্যদের মুখগুলো দেখে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ওর শক্ত মুখ আরো কঠিন হয়ে ওঠে। তারপর দৃঢ় গলায় ও বলে, বেশ, আমি রাজী।
টিমমনস এগিয়ে আসে। জুলিয়ার দিকে একটা কালি প্যাড এগিয়ে দেয়। জুলিয়া সযত্নে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কালি প্যাডে চেপে কালি লাগায়। টিমমনস ম্যাচিং মেশিনটা খোলে। সেই যন্ত্রের পর্দার বাঁ দিকে ড্রাইভিং লাইসেন্সে দেওয়া আঙ্গুলের ছাপের নমুনা ফুটে রয়েছে। জুলিয়া এগিয়ে যায়। যন্ত্রের সেনসার লেন্সে নিজের বুড়ো আঙুল চেপে ধরে, পর্দায় নতুন দেওয়া ছাপের আকার ফুটে ওঠে। টিমমনস ফলাফল লেখা বোতামে চাপ দেয়। দুদিক থেকে দুটো ছাপ ক্রমে পর্দায় মাঝ বরাবর সরে আসতে থাকে। পুরনো ছাপটার ওপরে নতুন ছাপটা এসে চেপে গায়ে গায়ে লেগে বসে। দুটো ছাপই একটার সঙ্গে অন্যটা হুবহু মিশে যায়। নিমেষে পর্দা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লাল আলো। ছাপ দুটোর মিশে যাওয়া প্রতিচ্ছবির ওপর বড়বড় অক্ষরে লেখা ফুটে ওঠেনমুনা যাচাই সঠিক মিল চিহ্নিত।
সারা ঘর জুড়ে কয়েক মুহূর্তের চূড়ান্ত নৈঃশব্দ। তারপর, হিরন্ময় নীরবতার সেই মুহূর্তগুলো পার হয়ে বেনডালই প্রথম কথা বলে-স্ট্যানফোর্ড পরিবারে স্বাগত আমাদের সৎ বোন। দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বেনডাল। অন্যেরাও ততক্ষণে স্বতস্ফুর্ত হাততালিতে ঘর ভরিয়ে তুলেছে। জুলিয়ার দুচোখ বেয়ে তখন আনন্দার ঝরঝর ধারা।
.
রাত, রোজ হিলের বাড়ীটা স্তব্ধতায় ঢেকে রয়েছে। বিকেলেই মালপত্র সমেত জুলিয়াকে এ বাড়ীতে নিয়ে এসেছে ওরা। হোটেলের পাট চুকিয়ে দোতলায় সুন্দর করে সাজানোনা একটা ঘর দেওয়া হয়েছে ওকে থাকার জন্য। রাতের খাওয়ার পর ওরা যে যার ঘরে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের সবার চিন্তাতেই ঘুরছিল একটাই বিষয়, ওদের নতুন সৎ বোন জুলিয়া।
ওর নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে ও একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছে। যা ঘটছে তা বাস্তব নয়। সত্যি ঘটছে না–টাইলার।
ও ব্যাপারটা কিভাবে সইয়ে নিচ্ছে? বাকী জীবনটাকে এখন এরপর কিভাবে অ্যাডজাস্ট করবে, ভারসাম্য বজায় রাখবে? –বেনডাল।
যেভাবে আমরা সবাই সব কজন হঠাৎ নবাব হওয়া ভাইবোন নিজেদের জীবনকে অ্যাডজাস্ট করব, ও নিশ্চয়ই একইভাবে জীবনের ভারসাম্য ধরে রাখবে–উডি।
অ্যাডজাস্ট ভারসাম্য, এসব কচকচানি নিয়ে কে মাথা ঘামায়? আমার তত্ত্ব হচ্ছে জীবনকে প্রাণ খুলে উপভোগ করে নাও। শ্যাম্পেন, ক্যাভিয়ের, ও নিশ্চয়ই তাই ভাবছে? –মার্ক।
রাত পা বাড়াচ্ছে গভীরতার দিকে, টাইলার দরজা খুলে বের হয়ে আসে। চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়। জুলিয়ার ঘরের সামনে এসে দরজায় করাঘাত করে হালকাভাবে। দরজা খোলা আছে, চলে এসো। ঘরের ভেতর থেকে শোনা যায়। টাইলার দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বিছানায় উঠে বসেছে জুলিয়া, দুজনে কয়েক মুহূর্ত দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর টাইলার দুহাত বাড়িয়ে দেয়, এগিয়ে যায়, জুলিয়াও এগিয়ে আসে। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে এবং ধীর নিঃশব্দ হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে। টাইলার যখন কথা বলে, শোনা যায় সে বলছে, আমরা পেরেছি মার্গো, আমরা করতে পেরেছি, সফল হয়েছি।