টেল মি ইওর ড্রিমস (দুঃস্বপ্নের অঙ্গীকার) — সিডনি সেলডন
ভয়ংকর সব ঘটনাগুলোকে তরুণী অ্যাশলে পরপর সাজাতে থাকে। কোন অচেনা মানুষ ওর তালাবন্ধ ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে ভয় পাওয়ানোর ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, পরের পর খুন হয়ে চলেছে… পুলিশ অ্যাশলেকেই গ্রেপ্তার করে কারণ পুলিশ মনে করে অ্যাশলে চারজন পুরুষ মানুষকে খুন করেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? কে এই খুনী?
এই কাহিনী বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে
০১.
কে ওর পিছু নিয়েছে? এমন হিংস্র অনুসরণকারীদের জগৎ আলাদা। তারা এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। সেই জগতের সঙ্গে অ্যাশলের কোন যোগাযোগই নেই। কে ওর ক্ষতি করতে চায়? এই আতঙ্ক তাড়াতে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল অ্যাশলে। তবুও আজকাল রাতে সে শুধু দুঃস্বপ্ন দেখে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙে আতঙ্কের মধ্যে। অ্যাশলে ভাবে, হয়তো এসবই তার কল্পনা। বোধ হয় খুব বেশি পরিশ্রম করে ফেলছে। যার ভার শরীর নিতে পারছে না। একটা ছুটির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আয়নায় নিজের শরীরের প্রতিফলন দেখে অ্যাশলে। বুদ্ধিদীপ্ত দোহারা চেহারার মধ্যকুড়ির এক যুবতী। কাঁধের ওপর কালো চুলের রাশ। সে তন্বী, আকর্ষণীয়া। কিন্তু বাদামি চোখে উদ্বেগের ছাপ। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। যা ঘটেছে সব ভুলতে চেষ্টা করে। টোস্ট, ওমলেট আর কফি নিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে না। উদ্বেগ তার খাওয়ার আগ্রহও কেড়ে নিয়েছে। রাগান্বিত হয়ে সে ভাবে–এটা চলতে দেওয়া যায় না। যেই হোক, আমার সঙ্গে এরকম করতে দিতে পারি না আমি।
অ্যাশলে ঘড়ি দেখে। এবার কাজে বেরোতে হবে। বেরোবার আগে সে তার সুন্দর করে সাজানো বাসস্থানটার দিকে একবার তাকায়। ভিয়া কামিনো ফোর্ট বহুতলের চারতলায় তার ফ্ল্যাট। ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাপেরটিনোর এই ফ্ল্যাটটা অ্যাশলের খুব পছন্দের। সারা জীবন : সে এখানেই কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে সে অন্য একটা বাসস্থান ঠিক করেছে নিজের জন্য। যাতে কেউ তার খোঁজ না পায়। ক্ষতি করতে না পারে। দরজাটা টেনে বন্ধ করে সে আবার টেনে দেখে নেয় যে সেটি ঠিকমত বন্ধ হয়েছে কিনা। তারপর এলিভেটরে নিচে নেমে আসে। গ্যারাজটা নিস্তব্ধ, জনমানবশূন্য। এলিভেটরের দরজা থেকে ২০ গজ দূরে ওর গাড়িটা দাঁড় করানো রয়েছে। প্রায় ছুটে গিয়ে সে গাড়িতে উঠে যায়। দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে। উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করে। ডাউনটাউনের দিকে গাড়ি ছুটতে থাকে। আকাশে ঘন মেঘ। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস আজ প্রবল বৃষ্টি হবে। অ্যাশলে ভাবে আজ বৃষ্টি হবে না। সূর্য উঠবে। ভগবানের সঙ্গে একটা ডিল করে অ্যাশলে। যদি বৃষ্টি না হয়ে সূর্য ওঠে তবে বোঝা যাবে সব আগের মতই আছে। সব অ্যাশলের কল্পনা।
দশ মিনিট পরে অ্যাশলে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল প্যাটারসন ডাউনটাউন ক্যাপেরটিনোর রাস্তা দিয়ে। কয়েক বছর আগে এই রাস্তাটা ছিল নির্জন। আজ কমপিউটারের জাদুতে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আজ জায়গাটার নামই হয়ে গেছে সিলিকন ভ্যালি। অ্যাশলে এই কম্পিউটার ভ্যালির একটা কোম্পানি গ্লোবাল কম্পিউটার গ্রাফিক্স করপোরেশন-এর একজন কর্মী। দুশো জন কর্মী এই কোম্পানির। সিলভারতে স্ট্রিট দিয়ে যাবার সময় তার মনে হল কেউ তার পিছু নিয়েছে। কেন? রিয়ার উইন্ডোতে চোখ রেখে কাউকে দেখা গেল না। যদিও সব স্বাভাবিক তবুও অ্যাশলের ইন্দ্রিয় যেন অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এবার সে পৌঁছে গেল গ্লোবাল কম্পিউটারের অফিসে। পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে সে অফিসে ঢুকল।
তখনই বৃষ্টি শুরু হল। সকাল নটার মধ্যেই গ্লোবাল কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অফিসের প্রায় সবাই এসে গেছে। তার নাম ধরে কেউ ডাকল। তার ওপরওয়ালা শেন মিলার। মিলার মধ্য তিরিশের সুঠাম পুরুষ। অ্যাশলে যখন নতুন চাকরিতে যোগ দেয় তখন মিলার তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে তোলবার অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। এখন হাল ছেড়ে দিয়ে তারা ভাল বন্ধু। অ্যাশলে ঘরে ঢুকতেই শেন একটা টাইম পত্রিকা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,–একজন অতি বিখ্যাত বাবার সন্তান হতে কেমন লাগে অ্যাশলে?– অ্যাশলে হেসে বলে–দারুণ।– টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদ ছবি ও ক্যাপশন, ডাঃ স্টিভেন প্যাটারসন। মিনি হার্ট সার্জারির জনক, মিলার বলে,–দেখতো, এর জন্য কিছু করতে পারো নাকি?– বলে একটা ছবি এগিয়ে দেয়। ছবিটা একজন চলচ্চিত্র তারকার। গ্লোবালের এক ক্লায়েন্ট একটা বিজ্ঞাপনে একে ব্যবহার করবে। কিন্তু ডেসিয়ের ১০ পাউন্ড ওজন বাড়িয়ে বসে। আছে। চোখের তলা ফোলা। দেখো যদি সামলাতে পারো।–
অ্যাশলে ছবিটার দিকে দেখে। বলে,–দেখে মনে হয় কিছু করা যাবে। নিজের টেবিলে চলে আসে সে। এই সংস্থার একজন গ্রাফিক ডিজাইনার সে। বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করে। তিরিশ মিনিট পরে তার মনে হল কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল সে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, ডেনিস টিব্বলে। টিব্বলে গ্লোবাল কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কম্পিউটার জিনিয়াস। নিখুঁত কাজের জন্য অফিসে সে যাদুকর বলে পরিচিত। তিরিশ ছুঁই ছুঁই টিব্বলে রোগা, টাক মাথার অবদমিত ব্যক্তিত্বের মানুষ। গ্লোবাল-এ রটনা, টিব্বলে আর অ্যাশলের পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ডেনিস টিব্বলে বলল,–সুপ্রভাত, কোন সাহায্যের দরকার আছে?–না, ধন্যবাদ।– অ্যাশলে জবাব দেয়। শনিবার রাতে আমরা কি একসঙ্গে ডিনার করতে পারি?
–না, ঐ দিন আমি ব্যস্ত থাকবো।– ডেনিস তির্যক হেসে বলে,–ব্যস্ত মানে তো বড়সাহেবের সঙ্গে রাতের খাওয়া আর…– অ্যাশলে ধমকে ওঠে। –এটা তোমার দেখার দরকার নেই।– ডেনিস বলে,–ঐ লোকটার মধ্যে তুমি যে কী পাও তা জানি না। আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখ। আমি ওর থেকে অনেক ভাল সঙ্গ দেব। আশা করি বুঝতে পারছ আমি কোন্ সঙ্গের কথা বলছি।–
অ্যাশলে অতি কষ্টে রাগ সংবরণ করে বলে,–আমার এখন অনেক কাজ ডেনিস, তুমি এখন এসো।–
ডেনিস ঝুঁকে পড়ে বলে,–তুমি বোধ হয় জান না, ডেনিস কখনও হাল ছাড়ে না।– বলে দ্রুত পায়ে চলে যায়। অ্যাশলের মনে হয় তবে কি ডেনিস তাকে অনুসরণ করে? সাড়ে বারোটায় ফাইলপত্র গুছিয়ে, কম্পিউটার বন্ধ করে সে উঠে পড়ে।
মার্গারিটা ডি রোমায় এসে পৌঁছে দেখে বাবা তখনও আসেনি। রেস্তোরাঁয় বেশ ভীড়। একটু পরেই তার বাবা ডাঃ স্টিভেন প্যাটারসন ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন। ডাঃ প্যাটারসন বহু বছর আগেই এমন এক হার্ট সার্জারি আবিষ্কার করেছিলেন যাতে কাটা ছেঁড়া, সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় খুব কম। সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল পদ্ধতিটি। জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছেন ডাঃ প্যাটারসন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাক্তারদের। সংস্থা ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে নিজের আবিষ্কারকে ব্যাখ্যা করে বিস্তারিতভাবে জানান, বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের সেই পদ্ধতিটি শেখানোর জন্য প্রায়ই ডাক আসত প্যাটারসনের। অ্যাশলের যখন বারো বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। তারপর থেকে তার জীবনে শুধুই বাবা। উল্টো দিকের চেয়ারে বসলেন প্যাটারসন।
প্যাটারসন হেসে বললেন, টাইম ম্যাগাজিনটা দেখেছ?– অ্যাশলে বলল,–শেন সকালে দেখাল।– ডাঃ প্যাটারসন রেগে গেলেন,–শেন তো তোমার অফিসের বড়সাহেব?–শেন একজন সুপার ভাইজার।–আমি ব্যক্তিগত আর ব্যবসায়িক, পেশাদার আর মানবিক বিষয় এক করে ফেলায় পক্ষপাতী নই। তুমি ওর সঙ্গে সামাজিক ভাবে মেলামেশা করছ তো? এটা ভুল করছ।–
অ্যাশলে বাধা দিয়ে বলে,–আমরা দুজনে শুধুমাত্র ভাল বন্ধু।– তখনই একজন ওয়েটার এগিয়ে আসে …ডাঃ প্যাটারসন তাকে রূঢ়ভাবে ধমক দেন–যতক্ষণ না আপনাকে ডাকা হচ্ছে এদিকে ঘেঁষবেন না– নোকটা লজ্জিত হয়ে দ্রুত সরে যায়। অ্যাশলে তার বাবার ব্যবহারে লজ্জিত বোধ করে। ডাঃ প্যাটারসন এরকমই বদমেজাজি। একবার অপারেশন থিয়েটারে এক সহকারী জুনিয়ার ডাক্তার ভুল করায় ঘুষি মেরে তার ঠোঁট ফাটিয়ে দেন বাবা। ও.টির ভেতরেই। ছোটবেলায় বাবা-মার তীব্র ঝগড়ার চিৎকারগুলো এখনও অ্যাশলের কানে বাজে। ঐ ছোটবেলায় মা-বাবার ঝগড়ার কারণ না বুঝলেও তার মন বিপর্যস্ত হয়ে থাকত। ডাঃ প্যাটারসন আবার কথা শুরু করেন,–শেন মিলারের সঙ্গে মেলামেশা করাটা তোমার ভুল হচ্ছে।–
কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে অ্যাশলের কানে। বহু বছর আগে শোনা কথাগুলো যেন তার কানে ভেসে এল- ওর বাবার কথা, জিম ক্লেয়ারির সঙ্গে মেলামেশা করাটা তোমার ভুল হচ্ছে।– অ্যাশলে তখন পেনসিলভিনিয়া বেডফোর্ড স্কুলে পড়ে। বয়স তখন আঠারো। বেডফোর্ডের জনপ্রিয়তম ও সেরা ছাত্র ছিল জিম ক্লেয়ারি। ফুটবল অধিনায়ক, হ্যান্ডসাম আর নারীঘাতী হাসি ছিল ওর। স্কুলের প্রতিটি মেয়েই তার সঙ্গে বিছানায় যেতে উদগ্রীব ছিল। সেই জিম যে কেন কিভাবে অ্যাশলের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠল। জিমের সঙ্গে ডেট করার সময় অ্যাশলে স্থির করেই রেখেছিল যে ওর সঙ্গে বিছানায় যাবে না। কারণ অ্যাশলে ভাবত শুধু শারীরিক কারণেই জিম তার সঙ্গে মিশছে। কিন্তু ক্রমশ সে বুঝতে পারে জিম ও তার চিন্তাধারা, ধ্যানধারণা, আদর্শ সব একরকম ছিল।
একদিন ডাঃ প্যাটারসন মেয়েকে বললেন,–ঐ ছোরার সঙ্গে তুমি বড্ড বেশি। মেলামেশা করছো আজকাল।–
অ্যাশলে বলল,–হ্যাঁ বাবা, জিম খুব ভাল ছেলে। আমরা দুজন পরস্পরকে ভালবাসি। আলাপ করলে তোমারও ভাল লাগবে।– ডাঃ প্যাটারসন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর ক্রোধ মেশানো গলায় বললেন,–কী করে ঐ ছোকরাটাকে বিয়ে করার কথা ভাবো তুমি। একজন সামান্য ফুটবল খেলোয়াড়। ও কি তোমার উপযুক্ত? তুমি আমার মেয়ে। তোমার উপযুক্ত পাত্র কী ঐ ছোকরা?– এটা অবশ্য নতুন ব্যাপার নয়। জিমের আগে এবং পরে যত জন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটেছে সবার সম্বন্ধেই ঐ একই মত ছিল প্যাটারসনের।
স্কুলের গ্র্যাজুয়েশন পার্টি এগিয়ে আসছিল। জিম ওকে সুখবরটা দিল তখন যখন ওর কাকা শিকাগোতে ওর জন্য একটা ভাল চাকরি জোগাড় করেছে। আমরা শিকাগো চলে যাব। অ্যাশলে নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যায় কারণ তার বাবা যে রাজি হবেন না তা নিশ্চিত। তবে অ্যাশলেও ওর জীবন নিয়ে বাবাকে ছিনিমিনি খেলতে দেবেন না। কিন্তু অ্যাশলে বুঝতে পারেনি তার বাবা কত ধুরন্ধর। স্কুল লিভিং গ্র্যাজুয়েশন পার্টির পরদিন সকালের বিমানে মেয়েকে নিয়ে লন্ডনের পথে রওনা হলেন ডাঃ প্যাটারসন। লন্ডনের কলেজে ভর্তি করে দিলেন। সেই কলেজে পড়ার সময়ই অ্যাশলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে কমপিউটার নিয়ে উন্নত ধরনের পড়াশোনার কোর্স করবে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সম্মানজনক মেই ওয়াং স্কলারশিপ ফর ওম্যান ইন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য আবেদন করল এবং নির্বাচিত হল। তিন বছর সেখানে কম্পিউটার অ্যাডভান্স কোর্স বিষয়ে পড়াশোনা করার পর গ্লোবাল কম্পিউটার গ্রাফিক্স করপোরেশনের চাকরিতে যোগ দিল।
সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরার পথে অ্যাপেল ট্রি বুক হাউসের সামনে গাড়িটাকে দাঁড় করায়। দোকানে ঢোকবার আগে থমকে দাঁড়ায়। কাঁচের দরজায় চোখ রেখে দেখে কেউ তাকে। অনুসরণ করছে কিনা। বইয়ের দোকানে ঢুকতেই এক যুবক কর্মচারী এগিয়ে আসে। অ্যাশলে তাকে বলে অনুসরণকারী বিষয়ে কোন বই আছে কিনা বিক্রেতা বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। অ্যাশলে ভুল বুঝতে পেরে বলে,–আফ্রিকার জন্তু জানোয়ার আর বাগান পরিচর্যা বিষয়ক বইও দেখাবেন।–
অ্যাশলে বাড়ির পথে যাবার সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাড়ির গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলকণা যেন অ্যাশলের কানে হিসহিস করতে থাকে–সে ঠিক ধরবে… তোমায় ধরবে… ধরবে তোমায়। গ্যারাজে গাড়ি দাঁড় করিয়ে এলিভেটর বেয়ে ওপরে উঠে আসে। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে চমকে যায়। সারা ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটি আলো জ্বলছে।
.
০২.
All around the mulberry lush
the monkey chosed the weasel
the monkey though it was all in fun
pop goes the weasel–
গানটা টোনি প্রেসকট-এর খুবই পছন্দ। তার মা এই গানটা খুব অপছন্দ করে। –ঐ বস্তাপচা গানটা তোমার বেসুরো গলায় আর গেয়ো না। বন্ধ করো।–ঠিক আছে মা,– টোনি অবশ্য গানটা না থামিয়ে স্বগতোক্তির মত গেয়ে চলে। মায়ের বিরক্তিতে সে খুশি হয়। বাইশ বছরের টোনি প্রেসকট একজন আধুনিক আমেরিকান যুবতী। প্রাণবন্ত, দুষ্টুমিতে ভরপুর। বোমার মত বিস্ফোরক ওর চরিত্র। হৃদয়াকৃতির মুখ ওর। চঞ্চল বাদামি দুই চোখ। শারীরিক গঠন উত্তেজক। লন্ডনে জন্ম হওয়ায় ওর ইংরেজিতে মনোরম এক বৃটিশ উচ্চারণ ভঙ্গি মিশে থাকে। বরফের পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়া, স্কি এবং আইস স্কেটিং ওর প্রিয় খেলা। টোনি গ্লোবাল কম্পিউটার গ্রাফিক্সের চাকরিটাকে খুব অপছন্দ করে। কিন্তু তবুও চাকরি তো করে যেতে হয়। বিশেষ করে মাইনেটা যখন ভাল। টোনি রাতের জীবন খুব পছন্দ করে। দিনের বেলা রক্ষণশীল পোশাক পরলেও রাতে সে মিনি স্কার্ট, হট প্যান্ট, কাধবিহীন ব্লাউজ বা স্ট্র্যাপ গেঞ্জি ব্যবহার করে। ক্যামডেন হাই স্ট্রিটে ইলেকট্রিক বলরুম আর সাবটেরিনিয়াতে লিওপার্ক লাউঞ্জ এই দুটো নাইটক্লাবে যেতে ও পছন্দ করে। সে রাতেও এক উদ্দাম নাচের পর একটা চেয়ারে বসেছে টোনি। এমন সময় এক যুবক এসে বলে,–আপনি তো দারুণ নাচেন।– টোনি ফিরে তাকায়। এ সব ক্লাবে এই ধরনের ব্যাপার ঘটেই থাকে। এভাবেই ডেট খুঁজে নেয় যুবক যুবতীরা। টোনি বলে,–ধন্যবাদ।–
–আপনার জন্য কোন পানীয় বলতে পারি।
–নিশ্চয়ই–। পানীয়ে চুমুক দিয়ে যুবকটি বলে,–আমার একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট আছে। আমরা রাতটা তো সেখানে কাটাতে পারি।– টোনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়–আমি রাতটা নিজের বিছানায় কাটাতে বেশি ভালবাসি।–
তারপর লন্ডন ছেড়ে ওরা চলে এল ক্যাপেরটিনোয়। তবে লন্ডনের মত আবেগ, উচ্ছলতা নেই এখানে। বড় কৃত্রিম এখানকার সব কিছু। এখানকার নাইটক্লাবগুলোয় টোনির যাতায়াত থাকলেও লন্ডনের মত স্বতঃস্ফূর্ততা সে খুঁজে পায়নি। তার ওপরে এই অপছন্দের চাকরি। প্লাগ ইন, ডিপিআই, হাফটোন, গ্রিডস শুনতে শুনতে দিন কাটিয়ে সন্ধে থেকে সারারাত তার কাছে যেন আরও অসহ্যের হয়ে ওঠে। লন্ডনের উত্তেজক নৈশজীবন কি ভীষণ মিস করছে সে। নিজের একঘেয়েমি কাটাতে নাইটক্লাবের পিয়ানোতে গিয়ে বসে। গান গায়। ডিসকো বা নাইট ক্লাবে হাজির যুবকযুবতীরা ওর গান পছন্দই করে। কিন্তু মা বলে টোনি বেসুরো গান গায়।
এক রাতে পিত্ৰজৎস-তে মালিক ওর খাওয়া ও মদ্যপানের দাম নিল না। বলল তার অসাধারণ গানের জন্য এটা সম্মান দক্ষিণা। আবার আসতে অনুরোধ করল। মা যদি শুনতে পেত কথাগুলো।
এক শনিবারের রাতে স্নিফ হোটেলের ডিনার রুমে রাতের খাওয়া সারার পর টোনির মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছিল। টোনি ডায়াসে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে কোল পোর্টার এর একটা গান গায়। প্রবল হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করা হয় তাকে। টোনি চেয়ারে ফিরে আসতে যাচ্ছিল। কিন্তু চারদিকের ভোজন ও পানরতদের অনুরোধে ওকে আরও দুটো গান গাইতে হল। টেবিলে ফিরে আসতেই এক টাক মাথা মধ্য চল্লিশের পুরুষ এসে বসার অনুমতি চায়। বসে বলে,–আমার নাম নরম্যান জিমারম্যান। আমি নাটকের প্রযোজক। আমি একটা সঙ্গীত নাটক মঞ্চে নামাতে চলেছি। সেই বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।–
টোনি ওনার সম্বন্ধে কাগজ, পত্রপত্রিকায় প্রচুর পড়েছে। আপনার গলা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার নতুন সঙ্গীত নাটক কিং অ্যান্ড আইতে অভিনয় করবেন? ব্রডওয়ে।– । মা কি শুনতে পাচ্ছ? জিমারম্যান জানতে চায় কবে অডিশন দিতে পারবে সে? –দুঃখিত, সম্ভব হবে না।–
জিমারম্যান বিস্মিত হয়ে গেলেন। নামি দামি অভিনেতা অভিনেত্রীরাও তার নাটকে অভিনয় করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, আর এ প্রস্তাব পেয়ে ও প্রত্যাখ্যান করছে? জিমারম্যান বললেন,–আপনার সামনে হাজারটা সুযোগ এনে দিতে পারে এই নাটকের অভিনয়।–আমি একটা চাকরি করি।–কী চাকরি?–একটা কম্পিউটার সংস্থায়।– আমি জোর দিয়ে বলছি ঐ সংস্থায় আপনি যা মাইনে পান তার তিনগুণ রোজগার করতে পারবেন এখানে।– টোনি বলে,–জানি–। –তবে আপনি কী শো বিজনেসে আগ্রহী নন?– টোনি বলে,–আমি আগ্রহী। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমায় মাঝপথে সরে দাঁড়াতে হবে।–কেন? আপনার স্বামী কি বাধা দেবেন?—
আমি অবিবাহিতা।– এবার জিমারম্যানকে বিরক্ত দেখায়–আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, আপনার আপত্তিটা কোথায়?–আমি আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলতে পারছি। । বলতে পারেন এক অভিশাপ যা আমাকে সারাজীবন বহন করে বেড়াতে হবে।–
টোনি ইন্টারনেট বিষয়ে জানল গ্লোবালে চাকরি করতে করতেই। সারা পৃথিবীর পুরুষদের খোঁজ পাওয়া ও আলাপ করার এক সুযোগ। একদিন সহকর্মী ক্যাথি হিলিং এর সঙ্গে ডিউক রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়েছিল। তাকে বলল,–আমাকে ইন্টারনেট ব্যবহারটা শিখিয়ে দেবে?– পরদিন দুপুরের খাবারের ছুটির ফাঁকে ক্যাথির কেবিনে গিয়ে হাজির হল। সবাই লাঞ্চ খেতে গেছে। ইন্টারনেট আইকন ক্লিক করার পর ক্যাথি তার পাসওয়ার্ক এন্টার করে সংযোগের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর আরেকটি আইকনে ডাবল ক্লিক করে চ্যাটরুমে ঢুকল। টোনি দেখল টাইপ হওয়া অক্ষরের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে বসে থাকা দুটি মানুষের আলাপচারিতা, টোনির চোখের সামনে অন্য একটা পৃথিবীর দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।
কয়েকদিনের মধ্যে টোনি তার ফ্ল্যাটে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটা কম্পিউটার বসালো।
এরপর অফিস থেকে ফিরে ইন্টারনেটে বসতে শুরু করল। জীবন এক অন্য খাতে বইতে শুরু করল। পাল্টে গেল চেনা জীবন। আর ক্লান্তিকর একঘেয়েমিতে ভরা জীবন নয় তার। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেন সারা পৃথিবী ভ্রমণ করে বেড়াতে পারে সে। সে রাতেও টাইপ করলে পর্দার নীল চৌকো ফ্রেম জুড়ে বেগুণী অক্ষর ভেসে ওঠে। –হ্যালো আমি টোনি। কেউ কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?– কয়েক মুহূর্ত বাদেই পর্দায় ভেসে ওঠে,–হাই আমি বব। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।– পুরো পৃথিবীর সাথে সাক্ষাতের জন্য টোনি এখন প্রস্তুত।
–হল্যান্ডের হানস নিস্টেলরয়। আমি একজন ডিজে। থাকি আমস্টারডামে। আমার রাত জাগা জীবনটা উন্মুক্ত জঙ্গলের মত। অনিশ্চিত জীবন আমার।– টোনি এবার টাইপ করে–কী উত্তেজক জীবন। আমি নিজেও গাইতে, নাচতে ভালবাসি, কিন্তু আমার শহরে অল্প কটা নাইটক্লাব আর ডিস্কো। খুবই অসহ্য জীবন আমার।–
–আমি তোমার এক ঘেয়েমি কাটাতে পারি কী?
–নিশ্চয়ই। এবার ঘন ঘন আমাদের চ্যাট হবে।
–বাই। শুভরাত্রি।
— দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল অ্যালকট।
পশ্চিম জার্মানির গ্রেফি ফ্রিগ্রাউজ।
আর্জেন্টিনার মালদানো ভাসকুয়েজ আলমাও।
ডাবলিন-এর ঘন গারবল্ডি।
প্রতিটা রাতই আলাদা রকমের উত্তেজক। একরাতে সে ফ্রান্সের জঁ ক্লদ পেরেত ফ্রান্স থেকে পেয়ে গেল। দ্রুত তাদের বন্ধুত্ব জমে উঠল। পারী শহরের উত্তেজক নৈশ জীবনের কাহিনী শোনোতোজ। অফিস থেকে ফিরে সে জঁ-এর সঙ্গে চ্যাট করতে বসে যেত। জঁ একটা জুয়েলারি শপের মালিক। বেড়াতে ভালবাসে। একবার কমপিউটারে স্ক্যান করে নিজের একটা ছবি পাঠায় টোনিকে। এক আকর্ষণীয় চেহারার মধ্যে কুড়ির যুবক। টোনিও তার ছবি পাঠায়। জ জানায় সে একজন সুন্দরী, আকর্ষণীয়া যুবতী। পারী চলে এস। টোনি জানায় যাবে।
পরদিন অফিসে ঢুকেই দেখল শেন মিলার অ্যাশলে প্যাটারসনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করছে। বিরক্ত হয় টোনি। মিলারের মত সুপুরুষ ঐ মানসিক রোগী অ্যাশলের মধ্যে কী পায় কে জানে। হতাশাগ্রস্ত, প্রাণহীন মেয়ে। কোন যুবতী মেয়ে রাতে বাড়ি ফিরে একা বসে বই পড়ে, হিস্ট্রি চ্যানেল অথবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল দেখে ভাবা যায়? নৈশজীবন বলে কিছু নেই। পুরুষদের সঙ্গে মেশে না। এরকম একজন মেয়ের পেছনে মিলারের মত প্রাণবন্ত সুপুরুষ কেন যে লেগে আছে কে জানে। অ্যাশলে নিশ্চয়ই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করেনি কখনও। কি যে হারাচ্ছে নিজেই। জানে না। টোনির হঠাৎ মনে হল তার মা নিশ্চয়ই ইন্টারনেটকে ঘৃণা করত। কারণ মা সবকিছুকেই ঘৃণা করত, মা শুধু চিৎকার আর ঘ্যানঘ্যান করতেই জানত।
টোনিকে কখনই মা সহ্য করতে পারেন নি। –তুমি একটা অপদার্থ, বোকা–, এই ছিল মায়ের কথা। টোনির মনে পড়ে যায় সেই দুর্ঘটনার কথা যাতে মা মারা গিয়েছিল। টোনির কানে বাজে মায়ের সাহায্য চেয়ে কাতর আর্তনাদ।
–A penny for a spool of thread
A penny for a needly
That the way money goes,
Pop! goes the weasel–.
.
০৩.
অলিটটে পিটার্স একজন সফল চিত্রশিল্পী হতে পারত। রং সম্বন্ধে ওর একটা সূক্ষ্ম বোধ ছিল। রঙের গন্ধ পেত সে। শুনতে পেত। ওর বাবার কণ্ঠস্বর কখনও গভীর লাল, কখনও গভীর নীল। মায়ের কণ্ঠস্বর গাঢ় বাদামি। শিক্ষিকার কণ্ঠস্বর সর্বদাই হলুদ। বাতাসের শব্দের রং সবুজ। প্রবাহমান জলের স্রোতের রং ধূসর।
কুড়ি বছরের অলিটটে পিটার্স এমন এক নারী যার সৌন্দর্য কখনও অতি সাধারণ, কখনও চোখ ধাঁধানো, কখনও নরম, কখনও শিহরণ জাগানো হতে পারে। তার মনমেজাজ মর্জির ওপর নির্ভর করে তার সৌন্দর্য। ও নিজের সম্পর্কে অতিসচেতন নয়। নম্র, লাজুক, মৃদু ভাষী এক যুবতী। রোমে জন্ম হওয়ার কারণে তার কথার ঢঙে ইতালিয় ছন্দ। ইতালি যেন ওর ব্যক্তিগত। প্রাচীণ মন্দির আর কলোসিয়ামগুলোতে একা যখন ঘুরে বেড়ায় অলিটটে বুঝতে পারে সে ওইগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সে যখন পিয়াজা নভোনা, সেন্ট পিটার্স, বাসিলকা অথবা ভ্যাটিকান মিউজিয়াম বা বার্থেজ গ্যালারিতে ঘুরে বেড়ায় তখন চারপাশের মানুষজনের ভীড়, কথাবার্তার থেকে অনেক আপন মনে হয় ঐ প্রাচীনত্ব। রাফেল বা ফ্ৰা বার্টোলো মোমেনের আঁকা প্রাচীন যুগের ছবিগুলি মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ওর শরীরে শিহরণ জাগে। ওর মনে হয় ঐ যোড়শ শতকে ও ছিল, আর চিত্রকর হয়ে ওঠার অদম্য বাসনাটা ওর মধ্যে জেগে ওঠে। মায়ের বাদামি কণ্ঠস্বর কানে আসে–কেন কাগজ আর রং নষ্ট করছ। চিত্রকর হতে তুমি পারবে না।–
ক্যালিফোর্নিয়া এসে প্রথম দিকে মানিয়ে নেবার একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু ক্যাপেরটিনো শহরটার নির্জনতায় সে মুগ্ধ হল। গ্লোবাল কম্পিউটারের চাকরিটা ওকে প্রয়োজনীয় আর্থিক নিরাপত্তা দিল। শহরটায় কোন বড় শিল্পকলা ছিল না। তাই সপ্তাহ শেষে অলিটটে বেরিয়ে পড়ত। ওর সহকর্মী টোনি তাই নিয়ে ওকে তাচ্ছিল্য করত। নাইট ক্লাবে যেতে বলত। অবশ্যই অলিটটে সে কথায় কান দেয়নি।
অলিটটে ছিল ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ। চরম একাকীত্ব ও বিপন্নতাবোধে ভুগত সে। অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবত নিজেকে। ওর মন যে কখন পাল্টাতে শুরু করবে তা সে নিজেও জানত না। খুব উচ্ছল মেজাজ থেকে নিমেষে তীব্র হতাশা আচ্ছন্নতায় তলিয়ে যেত সে। নিজের আবেগের ওপর ওর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। টোনিকে সে ব্যাপারটা জানিয়েছিল। টোনি বলেছিল, আমার সঙ্গে নাইটক্লাবে চলো। জীবনকে উপভোগ করো। অ্যাশলে প্যাটারসনের দিকে চোখ পড়তেই টোনি বলেছিল,–ঐ কুত্তীটা হল হিম বরফের রানি।– ঘেন্না আর রাগ মেশানো টকটকে লাল (অলিটটে রংটা দেখতে পায়) কণ্ঠস্বরে বলে সে। অলিটটে বলে,–ও খুব সিরিয়াস। কী করে হাসতে হয় কারো ওকে শেখানো উচিত।– টোনি বলে,–কী করে কাঁদতে হয়, তাও ওকে শিখিয়ে দেওয়া উচিত।–
এক শনিবার রাতে সানফ্রান্সিসকোর গৃহহীনদের সাহায্যার্থে আয়োজিত রাতের ভোজসভায় অলিটটে হাজির ছিল। সেখানে এক বৃদ্ধা হুইল চেয়ারে বসেছিলেন। অলিটটে এগিয়ে এসে তাকে ভোজটেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে প্লেটে খাবার তুলে দেয়। বৃদ্ধা স্নেহের হলুদ রংয়ের (অলিটটে দেখতে পায়) স্বরে বলেন,–ধন্যবাদ। আমার মেয়ে থাকলে আমি চাইতাম সে যেন তোমার মত হয়। এই প্রশংসা শুনে অলিটটে বলে,–তোমার মেয়ে তোমারই মতো সুন্দরী হত।– অলিটটের সারা শরীরে তীব্র কাঁপুনি জাগে। হিংস্র লাল এই স্বর কখনো তো জেগে ওঠেনি তার মধ্যে? সে রাতে বারবার ব্যাপারটা ঘটতে থাকায় ভীত হয়ে পড়ে সে। তার পরেও ঐ ধরনের হিংস্র চেতনার প্রতিফলন ঘটতে থাকে ওর মনের ভেতর। যেন অচেনা কেউ মনের ভেতর থেকে কথাগুলো বলছে।
কেটি হার্ডির সঙ্গে কেনাকাটা করতে গিয়েছিল সে। একটা দোকানের শো-কেসের ঝোলানো পোশাক দেখে কেটি বলে,–কি সুন্দর!– অলিটটে দারুণ– বলে। কিন্তু শুনতে পায় ওর মন থেকে কেউ বলছে,–এই কুৎসিত পোশাকটা তোমার পরার পক্ষে আদর্শ।– এক সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরে প্রতিবেশী রোনাল্ড-এর সঙ্গে রাতের খাওয়া সারতে বের হয়েছিল। সুস্বাদু, দামি খাবার খাওয়ার সময় রোনাল্ড বলেছিল–আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি আসাতে। আমরা এবার থেকে এরকম মাঝে মাঝে আসব।– অলিটটে বলে,–নিশ্চয় আসব।– কিন্তু শুনতে পায় ওর মন বলছে–বোকা, জঘন্য, নোংরা কুত্তা। তোর পাশে বসে খেতেও ঘেন্না করে।– আতঙ্কে অলিটটের সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। তখন প্রতিপদে সামান্য কারণেই বন্য রাগে ফেটে পড়ে সে। একদিন সকালে অফিস যাবার পথে একটা গাড়ি সামান্য স্পর্শ করে ওকে। শরীরে তীব্র রাগের দাপাদাপি টের পায় সে। –বেজন্মার বাচ্চা, খুন করব তোকে।–
উদ্ভট নানা চিন্তায় ওর মন ভরে ওঠে। যারা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে তারা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। পরিচিত কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কেউ খুন হচ্ছে। দৃশ্যগুলি সে বিস্তারিতভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারে। আর তখন আনন্দে ওর মন ভরে ওঠে। তারপর স্বাভাবিকতায় ফিরে এসে লজ্জিত বোধ করে নিজের ঐ প্রবৃত্তির জন্য। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে সে নম্র, ভদ্র, সহানুভূতিশীল, বিনয়ী, সর্বদা আতঙ্কিত হয়ে থাকে সে। কখন আবার ঐ হিংস্র মানসিক রোগে আক্রান্ত হবে। দ্বিতীয় কোন এক অবচেতনে হারিয়ে যাবে। বাধা দিতে পারবে না।
প্রত্যেক রবিবার সকালে গির্জায় যায় অলিটটে। নানা সমাজ কল্যাণমূলক কাজে অংশ নেয়। যেমন অনাথ শিশুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ। সেদিন অলিটটে নিজের কয়েকটা ছবি নিয়ে এসেছিল। সেগুলো কেউ কিনবে সে ভাবেনি। পাত্রী সেলভাজ্জিও ছবিগুলো দেখে আপ্লুত হয়ে গেলেন। ঐদিন গির্জায় হাজির সকলেই খুব প্রশংসা করলেন ছবিগুলোর। আর্ট গ্যালারিতে দেওয়া উচিত ছিল বললেন সকলে। সেদিন বিকেলের মধ্যেই ছবিগুলো বিক্রি হয়ে গেল। অলিটটে বলে,–মা তুমি কী শুনতে পাচ্ছ?– শনিবারে অফিস থেকে ফিরে অলিটটে সানফ্রানসিসকো বা অন্য কোন বড় শহরে বের হয়ে পড়ত। রবিবার সারাটা দিন শহরের আর্ট গ্যালারিতে ঘুরে বেড়াত। অনেক তরুণ শিল্পী গ্যালারিতে দর্শকদের সামনেই ছবি আঁকত। এরকমই একজনের দিকে নজর পড়ল অলিটটের। রংয়ের জ্ঞান প্রচুর। বেশ ভাল হাত। মন দিয়ে তার কাজ দেখতে থাকে অলিটটে। লোকটার ওর দিকে তাকায়। হাসে। জর্জিয়া ওকিফির পিটুনিয়া ছবির নকলটা আঁকছিল সে। প্রশ্ন করে,–কেমন হচ্ছে?– অলিটটে জবাব দেয়,–দারুণ।– উত্তরটা দিয়েই ভাবে কখন মনের ভেতর থেকে ভেসে আসবে মূর্খ, জঘন্য, অপেশাদার, কাঁচা হাতের কাজ। সেরকম কিছু কিন্তু ঘটল না। ধন্যবাদ, আমার নাম রিচার্ড মেলটন।–আমি অলিটটে পিটার্স। আপনি কি প্রায়ই আসেন এখানে?–যা, আপনি কোথায় থাকেন?–কাপেরটিনো।– যম, সেটা তোর জানার দরকার কী? –এরকম কোন উত্তর এল না মনের ভেতর থেকে। কিন্তু কেন?
রিচার্ড মনোযোগ দিয়ে আঁকতে থাকে। অলিটটে দেখতে থাকে লম্বা চেহারার, নীল চোখ, কোঁকড়া চুলের মধ্য কুড়ির যুবকটিকে। রিচার্ড একসময় বলে,–আমার খিদে পেয়েছে। চলো কিছু খাই।–ধন্যবাদ, চলুন।– অলিটটে এবার ভাবে মনের ভেতর থেকে ভেসে আসবে–অচেনা, জঘন্য, নোংরা পুরুষদের সঙ্গে আমি খেতে চাই না। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। ব্যাপারটা কী? কাছের একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে খেতে মহান চিত্রকরদের ছবির বিষয়ে আলোচনা করতে থাকে। গোটা সময়ে একবারও অলিটটে মনের গহন থেকে নর্থক স্বরটা শুনতে পায় না। একটি নীল চোখের লম্বা চুলের, লম্বা যুবক এগিয়ে আসে ওদের দিকে। রিচার্ড আলাপ করায়,–এ হচ্ছে গ্যারি। আমার ছোটবেলার বন্ধু। আর ইনি অলিটটে পিটার্স।– পরিচয় শেষ করেই গ্যারি অন্য কাজে চলে যায়। আরো ঘণ্টা দুয়েক রিচার্ডের সঙ্গে কাটিয়ে অলিটটে ফিরে আসে। রিচার্ড বলে,–আবার কি আমাদের দেখা হবে?–
নিশ্চয়ই,– সেই রাতেই টোনিকে রিচার্ডের কথা বলে সে। টোনি বলে,–কোন শিল্পীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তার আঁকা ফলের ছবি খেয়েই কাটাতে হবে।–
অলিটটে বলে,–আমার রিচার্ডকে ভাল লেগেছে।–
দীর্ঘ চল্লিশ বছর চাকরি করার পর পাস্তুর ফ্রাঙ্ক-এর অবসরের দিন এসে পড়ল। ওর সহকর্মীদের মন খারাপ। গোপনে তারা আলোচনায় বসল। কী উপহার দেওয়া যায় পাস্তুর কে? ঘড়ি, ফুলদানি, বাঁধানো ছবি, ছুটি কাটানোর বিমান টিকিট? কেউ বলল ফ্রাঙ্ক ছবি খুব পছন্দ করে। ওকে একটা প্রতিকৃতি আঁকিয়ে উপহার দিলে ভাল হয়। অলিটটে কি এঁকে দেবে? অলিটটে আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়। ওয়াল্টার ম্যানিং হলেন দফতরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মী। তিনি কারো প্রশংসা সহ্য করতে পারেন না।
তিনি বললেন,–আমার মেয়েও খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে। কাজটা ও-ই করুক।– সহকর্মীদের একজন বলে,–দুজনেই আঁকুক। যারটা ভাল হবে তারটাই পাস্তুরকে দেওয়া হবে।–
পাঁচ দিনে অলিটটে ফ্রাঙ্ক পাস্তুরের প্রতিকৃতি এঁকে ফেলল। সহকর্মীরা এই দুর্দান্ত ছবিটাই পাস্তুরকে দিতে মনস্থ করল। ওয়াল্টার ম্যানিং বললেন,–আমি প্রতিবাদ করছি। আমার মেয়ে উদারতা বশত ছবিটা এঁকে দিয়েছে। তাই তার ছবিটাই দেওয়া হোক। সে একজন পেশাদার শিল্পী। হয় তার আঁকা ছবিটাই দেওয়া হোক পাস্তুরকে নয়ত কোন ছবিই দেওয়া হবে না।– ঘরের পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠল। প্রবল তর্কাতর্কি শুরু হল। অলিটটে বলল,–আমার মতে ওয়াল্টার সাহেবের মেয়ের আঁকা ছবিটাই পাস্তুরকে দেওয়া হোক।– ম্যানিং বিজয়ীর হাসি হেসে বলেন,–এতে আমার মেয়েকে প্রাপ্য সম্মান দেখানো হবে।–
সেদিনই অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে চলন্ত গাড়ির তলায় চাপা পড়ে ওয়াল্টার ম্যানিং মারা যান। পরের দিন অফিসে গিয়ে খবরটা শুনে অলিটটে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
.
০৪.
অফিসের যদিও দেরি আছে তাও অ্যাশলে দ্রুত স্নান সারছিল। ঠিক তখনই দরজাটা খোলার বা বন্ধ হবার শব্দ হল। ওর বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে ভয়ে। শরীর বেয়ে জলের ফোঁটাগুলো নামতে থাকে। নিজেকে মুছে নিয়ে সে বেরিয়ে আসে। শোবার ঘরে ঢোকে। সব কিছুই ঠিকঠাক আছে। যত সব অর্থহীন কঙ্গনা। অফিস যাবার জন্য দ্রুত তৈরি হতে গিয়ে আলমারি খুলে দেখে ওর সমস্ত অন্তর্বাসগুলোকে কেউ ওলোটপালট করে দেখেছে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে ওঠে সে। লোকটা ওর ব্রা আর প্যান্টিগুলো কি নিজের শরীরে ঘষেছে? ফ্যানটাসিতে অ্যাশলেকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে? পুলিশকেও তো জানানো যাবে না। পুলিশ হাসবে– আপনার ব্রা প্যান্টি কেউ ঘাঁটাঘাটি করেছে তার তদন্ত করতে হবে? আপনি তাকে দেখেছেন? কে আপনাকে অনুসরণ করে আপনি তাকে দেখেছেন?–
অ্যাশলে পোশাক পরতে পরতে ভাবে দ্রুত তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু পরেই মনে পড়ল–আমি কোথায় থাকি সে জানে। কখন কোথায় যাই, কি করি সবই তার জানা। কিন্তু আমি তার সম্বন্ধে কিছু জানি না। একবার একটা বন্দুক রাখার কথা ভেবেছিল। হিংসা পছন্দ করে না বলে রাখেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
নিচে এসে দেখে চিঠির বাক্সে একটা খাম রয়েছে। বেডফোর্ড এরিয়া হাইস্কুলের পাঠানো। খাম ছিঁড়ে দেখে একটা নিমন্ত্রণ পত্র।
দশ বছরের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। দশটা বছর কেটে গেল। তোমার কি জানতে ইচ্ছে করে না, তোমার একসময়ের পুরনো বন্ধুরা, সহপাঠীরা, সবাই এখন কেমন কিভাবে আছে? গত দশ বছর তারা কীভাবে কাটিয়েছে? তাই এক পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। মজা, হাসি, গান, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া। তোমার দেখা পাবার জন্য পুরনো বন্ধুরা উদগ্রীব হয়ে, আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।–
অফিসের পথে যেতে যেতে অ্যাশলের মনে পড়ল চিঠিটার কথা। জিম ক্লেয়ারি যে তার দেখা পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে নেই একথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে। সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মত তার চোখে ভেসে ওঠে,–আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই, আমার কাকা শিকাগোয় একটা ভাল চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে…ভোরবেলার ট্রেনে যাব…তুমি কি যাবে? আমি তোমার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করব।–
অ্যাশলে বুঝতে চেষ্টা করে একা একা স্টেশনে অপেক্ষা করা…কেউ আসে না। সেই হতশা ও তীব্র অপমান, প্রতারিত হওয়া। জিম মত বদল করেছিল কিন্তু জানায়নি এবং শেষ রাতের ফাঁকা স্টেশনে অ্যাশলেকে ছেড়ে দিয়েছিল। অ্যাশলে ভাবে পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে যাবে না সে।
কাছের একটা রেস্তোরাঁয় শেন মিলারের সঙ্গে দুপুরের খাওয়া সারতে গিয়েছিল অ্যাশলে। নিঃশব্দে দুজনে খাচ্ছিল। মিলার জিজ্ঞেস করে,–কি এত ভাবছ?– মিলারকে অন্তর্বাসের ব্যাপারটা বলতে গিয়েও বলে না কারণ কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া বন্ধ ঘরে কেউ ঢুকবেই বা কীভাবে?স্কুলের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের কথা বলে। যাচ্ছে না তাও বলে।মিলার বলে,–গেলে ভাল করতে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে বেশ মজা আনন্দ হয়। পুরনো বন্ধুরা আসে তো।– পুরনো বন্ধুদের মধ্যে জিম ক্লেয়ারি কি আসবে? স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে অ্যাশলেকে কি বলবে আমি দুঃখিত স্টেশনে আসতে পারিনি বলে! না–অ্যাশলে পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে যাবে না।
তবুও অ্যাশলের মনে হয়, অনেক পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে ভালই লাগবে। যেমন ফ্লোরেন্স শিয়েফার। হঠাৎ স্কুল এমন কি শহর ছেড়ে চলেই বা গিয়েছিল কেন? মিলারকে জানায় সে পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে যাবে। ১৫ই জুন শনিবার অনুষ্ঠান। সে শুক্রবার যাবে। রবিবার সন্ধ্যেয় ফিরে এসে সোমবার অফিসে আসবে। মিলার সম্মতি দেয়।
অফিসে এসে নিজের কমপিউটার চালু করে আঁতকে ওঠে অ্যাশলে। পর্দায় ওর একটা নগ্ন প্রতিমূর্তি ফুটে ওঠে। তারপর কিছু কিছু বিন্দু একটা হাত তৈরি করে। হাতে একটা ছুরি। ছুরিসহ হাতটা অ্যাশলের বুকে বিধে যায়। সারা পর্দা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে রক্ত। অ্যাশলে তীব্র চিৎকার করে ওঠে। কমপিউটারটা বন্ধ করে দেয় সে। ওর চিৎকারে সবাই ছুটে আসে। শেন মিলার উদ্বিগ্নভাবে জানতে চায়কী হয়েছে? অ্যাশলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কমপিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু সামলে কমপিউটারটা চালু করে। দেখে পর্দায় সবুজ বাগানে সাদা খরগোেস ছুটে বেড়াচ্ছে। সবার চোখে তীব্র সন্দেহ। ওকে দেখতে থাকে অবাক হয়ে। অ্যাশলে চেয়ারে বসে পড়ে।
শেন মিলার ওর পিঠে হাত রাখে। অ্যাশলে অসহায়, মুখ তুলে তাকায়। মিলারও সহকর্মীদের মুখের দিকে তাকিয়ে হতাশ বিষণ্ণ গলায় বলে,–ওটা ছিল–এখন চলে গেছে।– সবাই কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে ফিরে গেল। মিলার বলে,–তুমি ডাঃ স্পিকম্যানকে দেখাচ্ছ। না কেন?– অ্যাশলে ভাবে তার কি সত্যিই মনোরোগ বিশেষজ্ঞর দরকার?
ডাঃ বেন স্পিকম্যান। প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স। অ্যাশলে তাকে বলে,–গতরাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি একটা বাগানের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি। বিশ্রী রঙের কতকগুলো ফুল আমায় কি যেন বলছিল–আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি দৌড়ে পালাচ্ছিলাম…কেন-তা জানি না।–
ডাঃ স্পিকম্যান ওকে নিরীক্ষণ করেন। তারপর বলেন–আপনি কি কোন কিছুর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন?–
–জানি না, তবে কেউ আমায় অনুসরণ করে সবসময়। সে আমাকে খুন করতে যায়।
–আপনি তো একা থাকেন?
–হ্যাঁ।
–আপনি কি কাউকে ভালবাসেন?
–না।–
ডাঃ স্পিকম্যান একটু ভেবে বলেন,–এ তো একটা গভীর মানসিক সমস্যা। এই বয়সের একক মহিলারা মনের চাহিদা থেকে একজন পুরুষের প্রয়োজন অনুভব করেন। তাই থেকে ফিজিক্যাল টেনশন গড়ে ওঠে।–
অ্যাশলের প্রয়োজন তবে গুড ফাঁক? কথাটা মনে হতেই হাসি পায় তার। তার বাবা বলেন,–এই শব্দটা কখনও উচ্চারণ কোর না। এসব নোংরা খারাপ মেয়েদের কথা। এসব ভাষা শিখলে কোথায়?– ডাঃ স্পিকম্যান বলেন, আপনার কোন গুরুতর মানসিক সমস্যা নেই। খুব বেশি পরিশ্রম ও উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা থেকেই এমন হচ্ছে। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।–
পরের সপ্তাহটা পুনর্মিলন উৎসবে যাবে কি যাবে না, এই টানা পোড়েনে কাটল। শেষ অবধি মনকে শান্ত করে ঠিক করে যাবে। অতীত হল মূল্যহীন। অতীতে যাই ঘটে থাক, ভুলে যাবে।
পরদিন বিমান বন্দরের কাউন্টার থেকে নিজের বিমান টিকিটটা সংগ্রহ করে দেখে, সেটি প্রথম শ্রেণীর। কিন্তু সে সাধারণ টিকিট বুক করেছিল। কর্মীকে সে বলে, একটা ভুল হয়েছে আমর টিকিট ছিল সাধারণ শ্ৰেণীর। কিন্তু এটা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাউন্টারের কর্মীটি কমপিউটারের বোতাম টিপে পর্দায় চোখ রেখে বলে,–এখানে সাধারণ শ্রেণীর টিকিট কাটলেও পরে ফোনে আপনি তা প্রথম শ্রেণীর টিকিটে পরিবর্তন করেন।– লোকটা একটা রসিদে অ্যাশলের ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেখায়। অ্যাশলে কোনও মতে হ্যাঁ বলে। টিকিট হাতে নিয়ে ও অনুভব করে ওর সারা শরীরে ঠান্ডা স্রোত বইছে। ও কখনই ফোন করে টিকিটের শ্রেণী পরিবর্তন করেনি।
বেডফোর্ড পৌঁছে এয়াপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া নিল। বহুবছর আগে রাগে দুঃখে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া শহরটাকে ঘুরে দেখতে থাকে। যদিও তত ছোট নেই। টেলিভিশন চ্যানেল, আর্ট গ্যালারি, দৈনিক খবরের কাগজের অফিস হয়েছে। প্রচুর রেস্তোরাঁও হয়েছে। পুরনো শহরটাকে দেখতে দেখতে ছোট বেলার মা-বাবার ঝগড়াগুলো ওর কানে বাজতে থাকে। ঝগড়ার কারণগুলো অবশ্য ওর মনে নেই।
পাঁচটা নাগাদ হোটেলে ফিরে স্নান সেরে পুনর্মিলন উৎসবে যাবার জন্য তৈরি হতে থাকে। সন্ধ্যে সাতটায় সে সুন্দরভাবে সাজানো স্কুল বাড়ির জিমন্যাসিয়াম ঘরে ঢোকে। তার পুরনো সহপাঠীদের অনেককেই চেনার উপায় নেই। শদুয়েক ছাত্রছাত্রী হাজির হয়েছে। অ্যাশলে জিম ক্রিয়েরিকে খুঁজছিল। ওর কতখানি পরিবর্তন হয়েছে কে জানে। ওর সঙ্গে ওর স্ত্রী আর বাচ্চারাও কিন্তু থাকবে। অনেকেই ওর দিকে এগিয়ে আসছে। –হালো, আমি ট্রেন্ট ওয়াটারগন, তোমায় দুর্দান্ত দেখাচ্ছে। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।– আর একজন এগিয়ে আসে,–হ্যালো, অ্যাশলে, আমি আরট ডেভিডস।– আর একজন এগিয়ে এল আমি লেমি হল্যান্ড। অ্যাশলে ক্রমশ বিস্ময়াবদ্ধ হয়ে পড়ছিল। দশ বারো বছরে সবাই এত বদলে গেছে? কিন্তু জিম ক্লেয়ারি কোথায়? হয়ত অ্যাশলের সঙ্গে দেখা হবার ভয়ে আসেনি।
একজন সুন্দরী অ্যাশলের সামনে এসে বলে–হাই অ্যাশলে, ফ্লোরেন্স শিয়েফারকে মনে পড়ে? অ্যাশলে উচ্ছ্বসিত হয়। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট ও প্রিয় বান্ধবী ছিল ফ্লোরেন্স। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে। ফ্লোরেন্স জানতে চায়,–হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলে অ্যাশলে?—
আমার বাবা আমায় লন্ডনের কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিল।– ফ্লোরেন্স বলে,–পুলিশের গোয়েন্দারা আমার কাছে তোমার খোঁজ জানবার চেষ্টা করেছিল। ওরা জানত জিম তোমার সঙ্গেই গিয়েছিল।– অ্যাশলে জানতে চায়, কেন খোঁজ করছিল পুলিশ ফ্লোরেন্স বলে,–খুনের তদন্তটার জন্য।–
অ্যাশলে ফ্যাকাসে মুখে বলে–কে খুন হয়েছিল?– ফ্লোরেন্স বিস্মিত হয়,–তুমি জান না? জিম গ্র্যাজুয়েশন পার্টির পরের দিনই নৃশংসভাবে ছুরির আঘাতে খুন হয়।– অ্যাশলের মাথা ঘুরতে থাকে। কোন রকমে টেবিলের একটা কোণ ধরে নিজেকে সামলায়। ফ্লোরেন্স বলে,–দুঃখিত অ্যাশলে। আমার খেয়াল ছিল না তুমি লন্ডন চলে গিয়েছিলে। আমি ভাবছিলাম খবরের কাগজে তুমি ঘটনাটা পড়েছ।–
অ্যাশলে ভাবে এতগুলো বছর সে জিমকে অপরাধী ভেবে এসেছে। ঘৃণা করেছে। কিন্তু জিমকে কে খুন করল? অ্যাশলে জানে তার বাবাই এ কাজ করেছে। ফ্লোরেন্সকে বলে,–আমার শরীর ভাল লাগছে না। আমায় একটু একা থাকতে দেবে?– ফ্লোরেন্স বলে,–নিশ্চয়ই।– বলে সরে যায়।
পরদিন সকলেই ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে এল সে। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্ন দেখল সে চিৎকার করে গলাগালি দিয়ে চলেছে। ক্ষতবিক্ষত জিম আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এবার আততায়ীর মুখটা স্পষ্ট হয়। হাতের ছুরি থেকে রক্ত পড়ছে। তার বাবা। তার বাবাই আততায়ী।
.
০৫.
পরের মাসগুলো দুঃস্বপ্নের মত কাটল অ্যাশলের। সব চোখের সামনে ভাসতে লাগল। জিমের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। একবার ভাবল ডাঃ স্পিকম্যানের কাছে যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে কী করে তার সঙ্গে আলোচনা করবে? বাবা এ কাজ করেছে এটা ভাবতেই সে অপরাধবোধে ভুগছিল। অথচ সে নিশ্চিত জানে তার বাবাই এ কাজ করেছে। চিন্তাটা মন থেকে সরাবার জন্য কমপিউটারের মধ্যে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। শেন মিলার এগিয়ে আসে–অ্যাশলে, তুমি ঠিক আছ তো? আজ রাতে বাইরে কোথাও খেতে যাবে?–না, আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত আমি একটু ব্যস্ত থাকব। অন্য কোন দিন যাব, কেমন?–ও. কে, কোন দরকার থাকলে বোল।–হা।– মিলার চলে যায়।
শুক্রবার বিকেলে অফিস ছুটির পর ডেনিস টিব্বলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে,–আমি তোমার সাহায্য চাই।–দুঃখিত ডেনিস।–আরে, একটা ব্যাপারে তোমার পরামর্শ চাই। আমি একজনের প্রেমে পড়েছি। তাকে বিয়ে করতে চাই। এ ব্যাপারে একজন মহিলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তোমার পরামর্শ চাই।–
অ্যাশলে ভাবে যদি তাই হয় তবে অ্যাশলের পক্ষে তা ভালই হবে। ডেনিস আর ফেউয়ের মতে তার পেছনে লেগে থাকবে না। তবে তার ফ্ল্যাটে ডেনিসকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কোন অভদ্রতা করলে ওকে তো আর ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিতে পারবে না। বরং ডেনিসের ফ্ল্যাটে নিজে গেলে ইচ্ছেমত বার হয়ে আসতে পারবে।
ডেনিসের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে অ্যাশলে চমকে যায়। যেন কোন ভয়ের সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছে সে। দেওয়াল ভর্তি করে হরর মুভির গা ছমছমে পোস্টার। অন্যদিকে নগ্ন নারীদেহের পোস্টারও রয়েছে। টিভির ওপর, টেবিলে, বুক শেলফে, কাঠের তৈরি মূর্তি। যেন কোন দেহপসারিণীর ঘর। এখান থেকে কতক্ষণে বের হতে পারবে ভাবতে থাকে অ্যাশলে। ডেনিসকে বলে,–সেই মেয়েটির কথা তাড়াতাড়ি বল। আমি বেশীক্ষণ থাকতে পারব না।– ডেনিস সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে সে সিগারেট নেবে কিনা। অ্যাশলে বলে সে সিগরেট, মদ খায় না।
ডেনিস বলে,–তুমি তো আশ্চর্য মেয়ে।– গ্লাসে একপাত্র রেড ওয়াইন ঢেলে অ্যাশলেকে দেয়। বলে–এতে তোমার জাত যাবে না।– অ্যাশলে হালকা চুমুক দিয়ে বলে,–এবার তোমার প্রিয়তমার বিষয়ে বলো।– ডেনিস বলে,–এমন মেয়ের দেখা আর পাব কিনা জানি না। তোমারই মত যৌন আবেদনময়ী।– অ্যাশলে রেগে যায়। ডেনিস বলে,–রাগ করছ কেন? প্রশংসা করেই আমি কথাটা বললাম।– অ্যাশলে আবার পানীয়তে চুমুক দেয়, আর একটা অস্বস্তি বোধ করে শরীরে। এক আচ্ছন্নতা গ্রাস করে তাকে। ডেনিস বলে চলেছে,–মেয়েটি আমাকে চাইলেও তার মা, বাবার মত নেই। তাই আমাকে বিয়ে করতে হলে…– অ্যাশলে এক গভীর ক্লান্তিতে তলিয়ে যেতে থাকে।
ধীরে ধীরে জেগে উঠে। অ্যাশলের যেটা প্রথম মনে হল সেটা হল কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটে গেছে। মাদক জাতীয় কিছু তার পানীয়ে মেশানো হয়েছিল। তার প্রভাব এখনও পুরোপুরি কাটেনি। চোখ খুলে রাখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। তবুও ধীরে ধীরে চোখ খুলে ঘরের চারপাশে তাকাতেই এক তীব্র আতঙ্কে ডুবে যায় সে। কোন এক হোটেলের ঘরে সে শুয়ে আছে। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। বিছানার পাশে রাখা হোটেলের রুম সার্ভিস মেনুতে চোখ পড়ে-দ্য শিকাগো শপ হোটেল। শিকাগোতে সে কীভাবে পৌঁছল? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। বিছানার পাশে রাখা টেলিফোন তুলে সে জিজ্ঞেস করে,–আজ কী বার?– বিস্ময় মাখানো গলায় উত্তর আসে,–আজ সোমবার।– অ্যাশলে ফোন রেখে দেয়। তার মানে মাঝখানে দুটো গোটা রাত এবং দিন কেটে গেছে। ডেনিসের ফ্ল্যাটে মাদক মেশানো রেড ওয়াইনে চুমুক দেওয়ার পর থেকে তার মন সম্পূর্ণ ফাঁকা। মাদকের নাম ডেট রেপ ড্রাগ। সে বোকার মত ডেনিসের কথা বিশ্বাস করে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে পানীয়তে চুমুক দিয়েছিল। ঐ ড্রাগ মেশানো পানীয় তার স্মৃতি থেকে দুদিনের সব ঘটনা মুছে দিয়েছে। এখান থেকে দ্রুত বের হতে হবে। নিজেকে খুব অপরিচ্ছন্ন মনে হল। শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ভাল করে স্নান করে। তবে যদি সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই চিন্তাটাই ওকে ভাবিয়ে তোলে। শাওয়ার বন্ধ করে বাইরের আসে। ঘরে এসে নিজের পোশাকগুলো কোথাও খুঁজে পায় না। এখান থেকে বেরোতে তো হবে। তাই হোটেলের আলমারি থেকে একটা কালো চামড়ার মিনিস্কার্ট আর ভোলা টিউব টপ পরে। ঐ একটাই পোশাক ছিল আলমারিতে। সে আয়নায় নিজেকে দেখে। কলগার্লের মত দেখাচ্ছে তাকে। হাতব্যাগে চল্লিশ ডলারের মত পড়ে আছে। চেকবই আর ক্রেডিট কার্ড দুটো রয়েছে। একতলায় রিসেপশনে আসে।
রিসেপশনের কর্মীটি হেসে বলে,–এরই মধ্যে চলে যাবে? সময়টা নিশ্চয়ই ভালই কেটেছে?– অ্যাশলে বুঝতে চেষ্টা করে কী উদ্দেশ্যে লোকটা কথাগুলো বলছে। পাঞ্চ মেশিনে বার কতক ক্রেডিট কার্ডটা ঘষে নিয়ে কর্মীটি বলে,–দুঃখিত। এটা কাজ করছে না। আপনার অ্যাকাউন্টে টাকা নেই।–মানে,– অ্যাশলে আকাশ থেকে পড়ে।
–আপনারা চেক নেন?–না।– খুব অসহায় লাগে নিজেকে। সে একটা ফোন করতে চায়। লোকটা ঘরের কোণে ফোনটা দেখিয়ে দেয়। সানফ্রানসিকো মেমোরিয়াল হাসপাতালে তার বাবার অফিসে ফোন করে সে। কিন্তু তার বাবা উটিতে। অ্যাশলে জানতে চায়, কতক্ষণ লাগবে অপারেশন শেষ হতে? কর্মীটি বলে সে বলতে পারবে না। অ্যাশলে বলে বাবাকে বলতে একটু ফাঁক পেলেই যেন অ্যাশলেকে ফোন করে। ফোনের দিকে তাকিয়ে নম্বরটা বাবার রিসেপশনিস্টকে দিয়ে দেয়। আবার বলে খুব জরুরি দরকার। বাবা যেন অবশ্যই ফোন করেন।
সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে সে লক্ষ্য করে যারা যাতায়াত করছে তারা তির্যক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে কুপ্রস্তাবও দিচ্ছিল। এই পোশাকে বসে থাকতে ওরও অস্বস্তি হচ্ছিল। আধঘন্টা পার ফোনটা বেজে ওঠে। অ্যাশলে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরে। বলে,–বাবা, আমি শিকাগোতে রয়েছি। আমার একটা বিমান টিকিট আর ক্যাশ টাকা দরকার।–
বাবা বিস্মিত হন–শিকাগোতে কেন গেছ?–ফোনে এক্ষুনি সব বলতে পারছি না।–
ডাঃ প্যাটারসন বলেন–১০.৪০ মিনিটে একটা বিমান আছে সান জোসে ফেরত আসবার। তোমার নামে ঐ বিমানে টিকিট সংরক্ষণ করে দিচ্ছি। ইউনিয়ান ব্যাঙ্কের মানি ট্রান্সফার বিভাগে ফোন করে বলে দিচ্ছি, তোমার ঠিকানায় ওদের এজেন্ট আধঘন্টার মধ্যে ডলার পৌঁছে দেবে। তোমার ঠিকানা দাও। ফিরে আমার অফিসে চলে এসো।–.
–না, বাবা, আমার একটু নিজের অ্যাপার্টমেন্টে দরকার আছে।– অ্যাশলে এই কথা বলল কারণ এই পোশাকে বাবার সামনে কী করে যাবে?
বিমানে বসে অ্যাশলে ভাবতে থাকে ডেনিস টিব্বলে ওর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তার শাস্তি ওকে পেতেই হবে। এ অপরাধ ক্ষমা করা যায় না। পুলিশে খবর দিতে হবে। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে সে অন্য পোশাক পরতে আলমারির দিকে যায়। তখনই দেখতে পায় ড্রেসিং টেবিলে একটা আধপোড়া সিগারেট পড়ে রয়েছে। আতঙ্কে শিহরিত হয়ে পড়ে সে।
দ্য ওক রেস্তোরাঁয় কোণের টেবিলে ডাঃ প্যাটারসন আর অ্যাশলে মুখোমুখি বসেছিল। তিনি অ্যাশলেকে নিরীক্ষণ করছিলেন,–তোমার চেহারাটা এরকম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন? শিকাগোতে কেন গিয়েছিলে?—
আমি জানি না।–মানে?– বাবাকে সব কথা বলা উচিত হবে কি না বুঝতে পারে অ্যাশলে–শেষে ঠিক করে বাবাকে সব বলাই ভালো। কারণ কি করা উচিত তার সঠিক পরামর্শ বাবাই দিতে পারবে। সে বলে,–ডেনিস টিব্বলে একটা সমস্যায় পড়ে তার সমাধানের জন্য আমাকে ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল।–
ডেনিস টিব্বলে–মানে সেই সাপের মত লোকটা?– কয়েক মাসে আগে তার সহকর্মীদের সঙ্গে বাবার পরিচয় হয়েছিল। তাই বাবা ওদের চেনে।
–ওর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?– অ্যাশলে বোঝে বাবাকে বলা তার উচিত হয়নি। বাবা তার সব ব্যাপারেই বড় বাড়াবাড়ি করে। বিশেষ করে পুরুষ কেউ হলে। অ্যাশলে বলে,–না ওর সঙ্গে সহকর্মীর বাইরে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। ও আমাকে একপাত্র রেড ওয়াইন খেতে দেয়। এরপর অ্যাশলে ইতস্তত করতে থাকে, কীভাবে এর পরের ঘটনা বলবে? বাবার মুখ কঠোর হয়ে উঠেছে। হঠাই ওর মনে ভেসে ওঠে বাবার কথা আবার যদি আমি আমার মেয়ের আশেপাশে তোমায় দেখি আস্ত রাখব না। এরপর জিম ক্লেয়ারির কী পরিণতি হয়েছিল তা অ্যাশলের মনে পড়ে। তাই পুরো ঘটনাটা না বলে রেখে ঢেকে ছোট করে বলবে ভাবে। কিন্তু অ্যাশলের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় প্যাটারসন বলেন,–আমি পুরো ঘটনাটা হুবহু শুনতে চাই।–
বিছানায় শুয়ে সেই রাতে অ্যাশলে ছটফট করছিল। ডেনিস যা করেছে তা সবাই জানতে পারলে তার পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাজনক হবে। ডেনিস যে ওর সম্পর্কে আগ্রহী তা অ্যাশলেকে আগেই অনেকে বলেছে। তাও ওর ফ্ল্যাটে যাওয়াটা অ্যাশলের উচিত হয়নি। প্রায় রোজই তার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে অ্যাশলে। এখন অ্যাশলে নিশ্চিতভাবেই জানে ওর অনুসরণকারী ছিল ডেনিস টিব্বলেই।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় অ্যাশলে অফিস যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তখন ফোন বেজে উঠল। শেন মিলার বলল,–অ্যাশলে খবরটা শুনেছ–ডেনস টিব্বলে মারা গেছে। টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। আততায়ী কাল রাতে ওর ফ্ল্যাটে ঢুকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ওকে খুন করেছে।–
খবরটা শুনে হাত পা অবশ হয়ে আসে অ্যাশলের।
.
০৬.
ডেপুটি শেরিফ স্যাম ব্লেক সানেভিলে অ্যাভিনিউতে ডেনিস টিব্বলের ফ্ল্যাটে ঢুকে জানতে চাইলেন,–লাশ কোথায়?– একজন পুলিশকর্মী বলে,–শোবার ঘরে স্যার।– শোবার ঘরের দরজায় থমকে দাঁড়ালেন তিনি। সারা শরীরটা কাঁচের বোতল দিয়ে কোপানো হয়েছে। পুরুষাঙ্গটিকেও থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। নগ্ন লাশটার সারা দেহে কাঁচের টুকরো গেঁথে রয়েছে। খুব নৃশংসভাবে খুন করেছে খুনি।
ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার এসে হাজির হয়েছে। ডেপুটি শেরিফ তাকে জিজ্ঞেস করলেন–মৃত ব্যক্তির নাম কী?–
–ডেনিস টিব্বলে স্যার। তিন বছর এই বাড়িতে আছেন।–,–ওনার সম্বন্ধে কিছু জানেন আপনি?–ভদ্রলোক অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বিশেষ মিশতেন না। পেশাদার বারাঙ্গ না মেয়েদের মাঝে মধ্যেই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসতেন। চাকরি করতেন গ্লোবাল কমপিউটার গ্রাফিক্স করপোরেশনে।– ব্লেক জিজ্ঞেস করল,–লাশটা কে প্রথম দেখে?–মারিয়া এই ফ্ল্যাটে কাজ করে। কাল ওর ছুটি থাকায় কাজে আসেনি। আজ এসে ওই প্রথম লাশটিকে দেখতে পায়।–
ডেপুটি শেরিফ মারিয়াকে পাঠিয়ে দিতে বললেন। মধ্য চল্লিশের ফর্সা কালো চুলের ব্রাজিলিয় মহিলা মারিয়া। উদ্বেগ এবং আতঙ্কে কাতর। নার্ভাস ভঙ্গিতে ডেপুটি শেরিফের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে,–আমি সকাল সতাটায় এসে দেখি সদর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা নয়। আমি অবাক হই। ভেতরে ঢুকে দেখি সব আলোগুলো জ্বলছে। শোবার ঘরে ঢুকে দেখি এই দৃশ্য।–
–মারিয়া তুমি কি এই ঘর থেকে কিছু সরিয়েছ?–মানে?–ভয় পেওনা-সাহেবের লাশ দেখার পরে এঘরের কোন কিছুতে তুমি হাত দিয়েছিলে?–
মারিয়া বলে,–মেঝেতে দুটো ভাঙা মদের বোতল পড়েছিল, আমি সেগুলো পরিষ্কার করে দিই। না হলে কারও পায়ে ফুটবে।– হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করেন,–সেগুলো তুমি কী করেছ?—
রান্নাঘরের জঞ্জাল ফেলার ব্যাগে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু রান্নাঘরের সেই ব্যাগে পাওয়া গেল না মদের বোতলের ভাঙা অংশ। জঞ্জাল ফেলার পাত্রে বোধহয় কেউ ফেলে দিয়েছে। তবে একটা পোড়া সিগারেটের অংশ চোখে পড়ল। সেটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিলেন। মারিয়ার কাছে জানতে চাইলেন কিছু খোয়া গেছে কিনা। মারিয়া পর্যবেক্ষণ করে বলল,–না, বোধহয়।– তার মানে ডাকাতি করা এই খুনের উদ্দেশ্য নয়।
ডেপুটি শেরিফ ও শেরিফ ম্যাট ডাও লিং তার অফিসে বসেছিলেন। তদন্তের অগ্রগতি সম্বন্ধে জানতে চাইলেন শেরিফ।
ডেপুটি শেরিফ বললেন–ভাঙা মদের বোতলগুলো পাইনি।– পোড়া সিগারেটের টুকরো পেয়েছি। সিগারেটে লিপস্টিকের দাগ পেয়েছি। অর্থাৎ কোন মহিলা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কিছু জানতে পারিনি। খুনের আগে ডেনিস যৌনমিলন করেছিল। বিছানায় চাদরে দাগ। নারীর যৌনকেশ একথাই প্রমাণ করে। আমি সেগুলোর ডি. এন. এ. টেস্ট-এর ব্যবস্থা করেছি।–
শেরিফ বলেন–তাড়াতাড়ি কেসটার সমাধান করো। মিডিয়া যাতে মাতামাতি করতে না পারে। খবরের কাগজ যেন শিরোনাম লিখতে না পারে–সিলিকন ভ্যালিতে সেক্স ম্যানিয়াকের আক্রমণ।– ব্লেক বলে,–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।–
অ্যাশলে মানসিকভাবে নিজেকে এতটাই বিধ্বস্ত ভাবছিল যে অফিসে যাবে কি যাবে না স্থির করতেই কিছুটা সময় চলে গেল। যে কেউ তার দিকে তাকালেই বুঝবে কিছু একটা ঘটেছে তা সে বুঝতে পারছে। পুলিশ অফিসে এলে তো তাকেও জেরা করবে। সত্যি কথাটা বললে তো খুনি হিসেবে তাকে সন্দেহ করবে। নয়তো তার বাবাকে। জিম ক্লেয়ারির খুনের ঘটনাটা মনে পড়ে তার।
স্যাম ব্লেক মানে ডেপুটি শেরিফ গ্লোবালের অফিসে যখন এলেন কর্মচারীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চাপা গলায় আলোচনা চালাচ্ছে। শেন মিলার এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানায়। ডেপুটি শেরিফ জানতে চান,–কেমন কর্মী ছিলেন টিব্বলে?–
–সৎ কর্মী। কমপিউটার জিনিয়াস ছিল সে।–
ওর সামাজিক জীবন সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?–না—জুয়া খেলত কি?–জানি না?–মহিলা বান্ধবী ছিল কি?–মহিলারা ওর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করত বলে শুনিনি। ডেনিস চাষা স্বভাবের মানুষ ছিল। তবে শুনছিলাম একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছে।–
–আপনার অন্য কর্মীদের সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই।–নিশ্চয়ই।– শেন মিলার ওকে বড় হলঘরে নিয়ে আসে। ডেপুটি শেরিফ বলতে থাকেন–আপনাদের সহকর্মী ডেনিস টিব্বলের খুনের ব্যাপার আপনারা নিশ্চয় জানেন। ঐ বিষয়ে কিছু জানা থাকলে আমাকে জানিয়ে তদন্তের কাজে সাহায্য করতে পারেন। তার কি কোন শত্রু ছিল?–
সারা ঘরে নৈঃশব্দ্য ছড়িয়ে পড়ে। তিনি কোন এক মহিলাকে বিয়ে করতে চলেছিলেন। কেউ তাকে চেনেন?– এই প্রশ্নে অ্যাশলের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। এখন পুলিশ কর্তা তাকে দেখলে সন্দেহ করবেনই। ওর মনে ভেসে ওঠে ডেনিসের কৃত কুকর্মের কথা শুনে ওর বাবার মুখটা কেমন জ্বর, অমানবিক, নিষ্ঠুর হয়ে উঠছিল। নিজেই নিজের মনকে প্রবোধ দিতে শুরু করে, ওর বাবা কাউকে খুন করতে পারেন না। তিনি একজন শল্য চিকিৎসক। জিম ক্লেয়ারি, ডেনিস টিব্বলেকে যেভাবে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে তা শল্য চিকিৎসার ভঙ্গিতেই। –তা হলে ধরে নেব শুক্রবার অফিস ছুটির পর থেকে ডেনিস টিব্বলে সম্পর্কে আপনারা আর কিছু জানেন না?– টোনি প্রেসকট এক কোণ থেকে অ্যাশলেকে লক্ষ্য করতে থাকে। মনে মনে বলে শুক্রবার সন্ধ্যেয় যে ডেনিসের সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে তা বলছ না কেন? স্যাম ব্লেক কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলেন,–মিলারের কাছে আমার ফোন নম্বর রয়েছে। আপনাদের কিছু মনে পড়লে আমায় ফোন করে জানাতে পারেন।– বেরিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল–এই অফিসে কারও সঙ্গে কি ডেনিসের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল?– মিলার বলে,–শুধু আমাদের একজন কমপিউটার কর্মীর সঙ্গে কিছুটা বন্ধুত্ব ছিল।–
আমি কি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি?–অবশ্যই।– মিলার এবং ব্লেককে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অ্যাশলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মিলার পরিচয় করিয়ে দেয়। অ্যাশলে জোর করে হাসার চেষ্টা করে। ওর মন বলে সাবধান বেস কিছু বলে ফেলো না।
–ডেনিস টিব্বলে আপনাকে বিশেষ পছন্দ করতেন?–আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতাম ।–আপনারা একসাথে বেরিয়েছেন? ডেটিং করেছন?–না, আমি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিতাম না।–
ডেনিস কি আপনাকে ওঁর বিয়ের কথা কিছু বলেছিলেন?– অ্যাশলে সতর্ক হয়। এমনও তো হতে পারে, অ্যাশলের ডেনিসের ফ্ল্যাটে যাওয়া প্রমাণ হয়ে গেছে আঙ্গুলের ছাপ বা জুতোর দাগ থেকে। তাকে এখন বাজিয়ে দেখছেন পুলিশ কর্তা। –মিস প্যাটারসন,– ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরে আসে অ্যাশলের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,–এত গভীরভাবে মনকে নাড়া দিয়ে গেছে ঘটনাটা যে আমি…–ঠিক আছে, ঠিক আছে–ব্লেক আবার দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করে। যদি ওর আঙুলের ছাপ পেয়ে থাকে এরা? তাই বলে,–হ্যাঁ। একবার ডেনিসের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম একটা দরকারি কাগজ আনতে।–কতদিন আগে?–সপ্তাহ খানেক হবে হয়তো?—
পুলিশ কর্তা ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন অ্যাশলের কথায় কোন ফাঁক রয়েছে। নাকি–কতটা মিথ্যে বলছে সে। অ্যাশলে ভাবে সত্যি কথাটা বলে দেওয়াই উচিত ছিল। বাবা হয়তো অপরাধী নন। হয়তো কোন চোর ঢুকেছিল। দশ বছর আগেও যেমন জিম ক্লেয়ারিকে খুন হতে হয়েছিল। তাও কাকতালীয় বলে ধরে নিলেও বড় বেশি অবিশ্বাস্য। বাবা কেন এ কাজ করল?
ডেপুটি শেরিফ বলছেন,–এটা একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। কিন্তু কোনো মোটিভ নেই। মাদক, ডাকাতি, নারীঘটিত কোন ব্যাপার নেই। কী কারণে খুন হল ডেনিস?– শেন মিলার বলে,–আমিও তাই ভাবছি। খুনের মত অপরাধ মোটিভ ছাড়া কেন ঘটবে?– ডেপুটি শেরিফ অ্যাশলের দিকে তাকান। অ্যাশলে ঐ চোখের ভাষা পড়তে পারে–আমি আপনার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি।– পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে অ্যাশলেকে দেন। –যদি কোন কথা আমায় জানাতে চান ফোন করে জানাতে পারেন।–নিশ্চয়ই।– ডেপুটি শেরিফ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিশ্চিন্ত হয় অ্যাশলে।
সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে ফোনে অ্যানসারিং মেশিনে রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–গত রাতে তুমি আমায় যে গরম করা স্বাদ দিয়েছিলে আজ রাতেও ঐ স্বর্গের স্বাদ আমি পেতে চাই। একই সময়, একই জায়গায় দেখা হবে।– ওর সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। ও পাগল হয়ে যাবে। বাবা নয়। কোন পাগল কি এর সঙ্গে যুক্ত?
ঐ ঘটনার পাঁচ দিন পরে অ্যাশলে তার ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির থেকে একটা স্টেটমেন্ট পেল। বিল নম্বর ৪৪–আধুনিক পোশাকের বিল ৪৫০ ডলার। বিল নম্বর ১০৩–সার্কাস ক্লাবের ডিনার ৩০০ ডলার, বিল নম্বর ১৭৯-লুইস রেস্তোরাঁ ২৫০ ডলার। অ্যাশলে কোনদিন ঐ পোশাকের দোকানের নাম শোনেনি। ঐ ক্লাব বা রেস্তোরাঁয়ও যায়নি।
.
০৭.
ডেনিস টিব্বলের হত্যা রহস্যের তদন্তের বিবরণ অ্যাশলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল । এবং টেলিভিশনে দেখছিল। পুলিশ কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। ব্যাপারটা শেষ ভেবে অ্যাশলে নিশ্চিন্ত হল। হঠাই তখন এক সন্ধ্যেয় ডেপুটি শেরিফ অ্যান ব্লেক তার বাড়িতে এসে হাজির। বলল,–এদিক দিয়েই একটা কাজ সেরে যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম একটু দেখা করে যাই।– অ্যাশলে সৌজন্যবশত তাকে আপ্যায়ন করে। ভেতরে ঢুকে ব্লেক বলে,–আপনার ফ্ল্যাটটা তো সুন্দর করে সাজানো, তবে ডেনিসের পছন্দ হত না?–
বলতে পারি না। কারণ সে আমার ফ্ল্যাটে আসেনি কখনও।– ব্লেক বলে,–ডেনিসের খুনটা খুব অদ্ভুত। কোন মোটিভ ছাড়া খুন তো। তবে গ্লোবালের অফিসের সবাই বলছে আপনার সঙ্গেই যেটুকু মেশার মিশতেন ডেনিস। তাই আপনি যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন এই খুনের ব্যাপারে অবশ্যই করবেন। আসলে খুন হওয়া কেসের সামাধান না করতে পারলে আমার বড় হতাশা লাগে। মনে হয় একজন অপরাধী আমার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান। যাক আজ চলি।– অ্যাশলে শীতল চোখে তার চলে যাওয়া দেখতে থাকে। ওর এই আসার কারণ কী? আমার জন্য কোন সতর্ক বার্তা?
টোনি তার কমপিউটারে ডুবে থাকে। ইন্টারনেটে ঝুঁদ হয়ে ই-মেল পর্দায় অক্ষর ফুটে ওঠে। তারপর সেন্ড বোতামে আঙুল ছোঁয়ায়। পর্দায় তার পাঠানো মেল-এর উত্তর–টোনি এ কদিন কোথায় ছিলে? আমার চ্যাটরুম তোমার অপেক্ষায় ছিল এতদিন।–আমি মার্ক ওয়েভ রিজার। একজন ফার্মাসিস্ট।–ড্রাগ নাও তুমি?–কখনও কখনও।–হাই টোনি। আমি ওয়েস্তি। একজন লাইব্রেরিয়ান।–মোটেই উত্তেজক, কাজ নয়।– অবশেষে, জঁ ক্লদ পেরেত। –Bonnenuit Comment CA VA, কেমন আছ টোনি?–আমি ভালই আছি। তুমি কেমন আছ?–তোমায় মিস্ করছি। দেখা করতে চাই তোমার সঙ্গে।–আমিও তাই চাই। তোমার ছবি পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ।– এইভাবেই টোনির প্রতিরাত কাটে।
পরদিন সকালে অ্যাশলের ডাক পড়ে শেন মিলারের কেবিনে। মিলার বলে,–কুইবেক এ একটা কমপিউটার সম্মেলন হচ্ছে। সারা পৃথিবী থেকে বিখ্যাত কমপিউটার বিশেষজ্ঞরা আসবে। তুমি কি আগামী বড়দিনটা কুইবেক শহরে কাটাতে চাও?– হাসে অ্যাশলে,–তার মানে আমাদের কোম্পানি ঐ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে?–হ্যাঁ, আমরা এক সপ্তাহ থাকব।–
টোনির সঙ্গে জঁ ক্লদ-এর চ্যাটরুমের মাধ্যমে কথাবার্তা চলছিল। টোনি জানায় ঐ সম্মেলনের কথা। কবে যাচ্ছে তারা জানতে চায় ক্লদ। সপ্তাহ দুই পরে জানায় টোনি। তাদের দুজনেরই মনে হল খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
প্রতি রাতে অ্যাশলে টেলিভিশনের খবরে টিব্বলের হত্যা রহস্যের সাম্প্রতিক অবস্থা জেনে নিত। কোন নতুন অগ্রগতির খবর না পেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করত সে। অ্যাশলের কোন সম্পর্ক এই খুনের সঙ্গে পুলিশ যদি বার করতে না পারে তবে তার বাবাকেও ছুঁতে পারবে না। তবে অ্যাশলের সুরক্ষার জন্যেই তো বাবার খুনি হয়ে ওঠা। পরদিন সে বাবাকে ফোন করে বলে,–বাবা, আমাকে আমার কোম্পানির থেকে একটা কমপিউটার সম্মেলনে পাঠাচ্ছে। বড়দিনের সময়। কুইবেক শহরে।– বাবা বললেন,–আমিও ঐ সময়ে যাব তোমার সঙ্গে। তখন আমারও কাজের চাপ কম থাকে। তোমার হোটেলে আমার, জন্যও একটা ঘর নিয়ে রাখবে।– অ্যাশলে অনিচ্ছার সঙ্গে সম্মতি জানায়।
২১শে ডিসেম্বর গ্লোবাল কমপিউটারের দলটা জ লিসেজ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে নামল। রাস্তায় ঘন বরফ। শূন্যেরও কয়েক ডিগ্রি নিচে তাপমাত্রা। শাটে ফ্রন্টেসকা হোটেলে এল দলটা। ঘরে এসে টোনি জঁ ক্লদকে ফোন করে। জঁ ক্লদ বলে,–Mais mon, তুমি এত কাছে এসেছ ভাবতেই পারছি না। কখন দেখা হবে?– টোনি বলে,–কাল সকাল নটায় আমরা কনভেনশনে যাব। তার মধ্যে সময় করে ঠিক দেখা করব। দুপুরে একসঙ্গে খেতে পারি।–গ্র্যান্ডে আলি ইজ্জত-এ ভাল রেস্তোরাঁ আছে, নাম লা-প্যারিস বেট। ওখানে দুপুর একটায় পৌঁছে যাব।–ঠিক আছে আমি আসব।–
রেনে লাভসলিয়ে বুলেভার্ড রাস্তার ওপর দ্যা সেন্টার দেস কংগ্রেস দা কুইবেক-এর কাঁচ আর ইস্পাতের তৈরি বহুতল বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। চার তলার হলঘরটায় এক হাজার লোক ধরে। পুরো ঘরটা পৃথিবীর নানা দেশের কমপিউটার-এর সঙ্গে জড়িত মানুষজনে ঠাসা। আধডজন সেমিনার চলছে একই সঙ্গে। মাল্টিমিডিয়া রুম ও ভিডিও কনফারেন্স সেন্টার ভিড়ে ঠাসা। পৌনে একটায় টোনি কনভেনশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসে। ট্যাক্সি নিয়ে লা প্যারিস বেক্সট রেস্তোরাঁয় পৌঁছে যায়। জ ক্লদ চিনে নেয় সহজেই কারণ আগে ছবি দেখেছে। টোনি টেবিলের কাছে পৌঁছতেই সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,–এই শহরে তোমার দিনগুলো খুব ভাল কাটবে। ঘুরে বেড়ানোর দুর্দান্ত সুন্দর জায়গা আছে।– ওয়েটার মেনু নিয়ে আসে। Nons Voudrions ie brome lake ducklings-এর অর্ডার দেয় সে। টোনিকে বলে,–এটা চুছো করা হাঁসের সঙ্গে প্রচুর মশলা, সস দেওয়া আপেলের রসে ডোবানো৷–খুব সুস্বাদ নিশ্চয়ই।–
খেতে খেতে ওরা নিজেদের অতীত সম্পর্কে খুলে বলে। তারা দুজনেই অবিবাহিত। স্কি করতে দুজনেই ভালবাসে। টোনি ভাবে জঁ ক্লদ-এর মধ্যে একটা উৎসাহ রয়েছে যেটা বালকোচিত। টোনি এর আগে কোন পুরুষের সঙ্গে এত সহজে মিশতে পারেনি। এরপর থেকে প্রতিদিনই তারা একসঙ্গে দুপুরের খাওয়া সারতে আর শহর ঘুরতে যেত।
বড়দিন যত এগিয়ে আসছিল অ্যাশলে ততই ভাবছিল, বড় দিনটা বিশ্রীভাবে কাটবে কারণ বাবা আসবে।
একদিন জঁ ক্লদ টোনিকে নিয়ে গয়নার দোকানে যায়। গাঁবেত জুয়েলারি সুসজ্জিত বিশাল দোকান। আধডজন কর্মচারী। জঁ ক্লদ একটা হীরে বসানো আংটি যেটা পান্না দিয়ে ঘেরা টোনিকে উপহার দিতে চাইল। টোনি বলল,–না, না এটা খুব দামি। তোমার থেকে এই কদিনে যা পেলাম তাই যথেষ্ট।– জঁ ক্লদ জোর করে আংটিটা টোনির আঙুলে পরিয়ে দেয়। টোনি কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা অ্যাশলের কাছে তার বাবার ফোন এল–এবার বড়দিন আমরা একসঙ্গে কাটাতে পারছি না। আমার এক গুরুত্বপূর্ণ ধনী রোগীর স্ট্রোক হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা। আমি কাল সেখানে চলে যাচ্ছি।–
–বাবা, খুব খারাপ লাগছে।– অ্যাশলে গলার স্বর দুঃখিত করে বলে। –পরে আমরা এটা পুষিয়ে নেব।–নিশ্চয়, বাবা সাবধানে থেকো।– ফোনটা রেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে অ্যাশলে।
ধনী, অভিজাত পাড়ায়, রাস্তার ধারে জঁ প্যালাস-এর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রেস্তোরাঁ প্যাভিলিয়ান। রাত সাড়ে দশটায় টোনি ও জঁ ক্লদ সেখানে ঢুকল। ওদের দেখে ওয়েটার এগিয়ে এল। জঁ ক্লদ এর পরিচিত। জঁ ক্লদ টোনির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। হিমশীতল শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। জঁ ক্লদ বলে,–আমি ভাবতে পারছি না আমাদের দেখা হল।–আমিও,– টোনি বলল। তখনই বাজনার সঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় নানা বয়সী নারী পুরুষ ড্যান্স ফ্লোরে গিয়ে হাজির হল। ওরাও নাচের জায়গায় গিয়ে উদ্দামভাবে নাচতে শুরু করে। নাচ টোনির এক তীব্র প্যাশন। ছোটবেলায় সে যখন নাচত তখন মা বলত,–এটা কি নাচ হচ্ছে না তান্ডব? তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।–
আজ নাচের শেষে জঁ ক্লদ বলল,–অসাধারণ নেচেছে তুমি।–ধন্যবাদ।– মা, তুমি কি শুনতে পাচ্ছে? অ্যাসপারাগাস সুপ, লাল মদে ডোবানো গলদা চিংড়ি, ঝিনুকের রায়তা আর Valpolicella মদ দিয়ে খাওয়াদাওয়া করে টোনির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে জঁ ক্লদ বলে,–আজ রাতটা আমার বাড়িতে কাটাবে?– টোনি দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল,–কাল কাটাব।–
পুলিশ অফিসার রেনে পিকার্ড রাত তিনটেয় প্রতি রাতের মত গ্র্যান্ড অ্যালির রাস্তায় টহল দিচ্ছিলেন। লাল ইটের একটা দোতলা বাড়ির সদর দরজাটা হাট করে খোলা। তিনি এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটার কারণ জানতে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। –বাড়িতে কেউ আছেন। তার স্বর প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা ঘটেছে। আগ্নেয়াস্ত্রটাকে হাতের মুঠোয় ধরে এগোতে থাকেন তিনি। সারা বাড়ি জুড়ে এল নৈঃশব্দ। এ ছাড়া কিছুই নজরে আসে না। দোতলায় উঠে বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা শোবার ঘর তার নজরে পড়ল। দরজাটা টেনে ধরে ঘরে ঢুকেই চমকে গেলেন। একটি ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। ভোর পাঁচটায় ধূসর আর হলুদ রঙের স্ট্রম বুলেভার্ডের তিনতলা বাড়িটা যেটা পুলিশের সদর দফতর, তার একটি ঘরে ইনসপেক্টর পল কাইয়ের অন্য অফিসারের কাছে জানতে চান ঘটনাটা। অফিসার গাই ফনটাইন উত্তর দেন–মৃতের নাম জঁ ক্লদ পেরেত। খুনটা হয়েছে রাত একটা থেকে আড়াইটের মধ্যে। ২৩টি ছুরির আঘাত রয়েছে। জঁ ক্লদ পেরেতের জ্যাকেটের পকেটে প্যাভিলিয়ান রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়ার একটা রসিদ পাওয়া গেছে। জঁ ক্লদ টোনি প্রেসকট নামে একট মহিলাকে নিয়ে ঐ রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। প্রধান ওয়েটার নিকোলাস-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার। মৃত্যুর আগে পেরেত কোন মহিলার সঙ্গে যৌন মিলন করেছিল। একটা লেটার ওপেনার দিয়ে খুন করা হয়েছে। আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে। ল্যাবরেটরিতে সেগুলো পাঠানো হয়েছে।
–টোনি প্রেসকটকে গ্রেফতার করা হয়েছে?– ফনটাইন বলে,–ঐ মহিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ক্রিমিনাল রেকর্ডে তার নাম নেই। কিন্তু শহরের জন্ম দফতরে কোন জন্ম সার্টিফিকেট নেই, সোশাল সিকিউরিটি নম্বর নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। শহরের কোন হোটেলেও ঐ নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। বিমানবন্দর তো রাত বারোটায় বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ট্রেন গতকাল বিকেলে ছেড়ে গেছে। ভোরের প্রথম ট্রেন ছটায়। ঐ মহিলার বর্ণনা আমরা বাস স্ট্যান্ড, ট্যাক্সি দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছি। স্থল পথে শহর ছেড়ে সে পালাতে পারবেন না।
ল্যাবরেটরি থেকে আঙুলের ছাপের রিপোর্ট আসে। অকুস্থলে পাওয়া আঙুলের ছাপ কমপিউটারে ম্যাচ করানো যায়নি। টোনির কোন ছাপ কমপিউটারের সংরক্ষিত নেই।
.
০৮.
অ্যাশলে কুইবেক থেকে ফেরার পাঁচদিন পর বাবার ফোন এল–আমি আজ সকালে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরেছি।–তোমার রোগী কেমন আছে?–ভাল–তুমি কাল সানফ্রান্সিসকোয় আসতে পারবে? রাতে তা হলে একসঙ্গে খেতাম।–ঠিক আছ।–তা হলে রাত আটটায় লুলু রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করব।–
পরদিন আটটা পনেরো নাগাদ লুলুতে তার বাবা এল। চারপাশের মানুষদের মধ্যে সমীহ ফুটে উঠল। বাবা বলল,–বড়দিনটা একসঙ্গে কাটাতে না পারায় দুঃখিত।–আমিও খুব দুঃখ পেয়েছি বাবা।– অ্যাশলে জোর করে বলে। মুরগির মাংসের পদের অর্ডার দিয়ে বাবা ওর মুখোমুখি বসে। বলে,–কুইবেক শহরের দিনগুলো কেমন কাটল?–দারুণ,– অ্যাশলে শান্তভাবে বলে,–গত মাসে আমি বেডফোর্ড গিয়েছিলাম। পুরনো স্কুলের রি ইউনিয়নে। জানলাম আমরা যেদিন লন্ডনে চলে আসি সেদিনই জিম ক্লেয়ারি খুন হয়।– ঠান্ডা চোখে সে বাবার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। ডাঃ প্যাটারসন বলেন,–যে তোমার পেছনে লেগে থাকত? তোমায় আমি বাঁচিয়ে ছিলাম ওর হতে থেকে।– অ্যাশলে ভাবে এটা কি বাবার স্বীকারোক্তি?
অ্যাশলে এবার বলে,–ডেনিস টিব্বলেও খুন হয়েছে। জিমের মতই ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ও খুন হয়েছে। ডাঃ প্যাটারসন ধীরে ধীরে রুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে বললেন,–ওর মত নোংরা মানুষরা এইভাবেই মারা যায়। অ্যাশলের মনে হয় ওর বাবা চিকিংসার মত মহৎ পেশায় নিযুক্ত হয়েও কি নিষ্ঠুর! বাবাকে বোঝা সত্যিই দুঃসাধ্য।
.
অলিটটে আর রিচার্ড মেলটন ডি ইয়ং মিউজিয়ামে দেখা করে। রিচার্ড জানতে চায়–কেমন লাগল কুইবেক শহর?– অলিটটে বলে,–খুব ভাল। এত সুন্দর সব মিউজিয়াম।– মেলটন জানায় তার একটা ছবি একজন শিল্প সংগ্রাহক কিনে নিয়েছেন। অলিটটে খুশি হয়। ওর মনে হয়, মেলটনের সঙ্গ তাকে এক অদ্ভুত আনন্দ দেয়। অন্য কেউ যদি ছবি বিক্রির কথা বলত তার মনে হত এমন রুচিহীন মানুষ কে আছে যে ওর মত শিল্পীর ছবি পয়সা খরচ করে কিনবে? কিন্তু রিচার্ডের ক্ষেত্রে এরকম কোন চিন্তা ওর মাথায় আসে না। এই অনুভূতিটা ওর ভাল লাগে।
ওরা কাছাকাছি একটা এর রেস্তোরাঁয় দুপুরে খাওয়া সারতে গেল। অলিটটে নিরামিষাশী তাই তার জন্য স্যালাড আর রিচার্ড নিজের জন্য কিমার রোস্ট আনতে চায়। একজন আকর্ষণীয় চেহারার যুবতী খাদ্য পরিবেশনকারিণী এগিয়ে এসে বলে,–হ্যালো রিচার্ড।– রিচার্ড বলে,–হাই বানি।– ওদের কথা বলতে দেখে তীব্র ঈর্ষায় জ্বলতে থাকে অলিটটে। সে নিজেও অবাক হয়। বার্নির্স চলে গেলে সে বলে,–মেয়েটি কি তোমার পরিচিত?– রিচার্ড হাসে–া অনেকবার এখানে এসেছি তো। প্রথম যখন আসতাম আমার হাতে বেশি পয়সা থাকত না কিন্তু বার্নির্স আমার জন্য একটু বেশি করে খাবার এনে দিত।–হ্যাঁ ওকে আমারও বেশ ভাল মনে হল।– মুখে এ কথা বললেও মনে মনে অলিটটে ভাবে কদর্য একটা মেয়ে।
খেতে খেতে ওরা শিল্প ও শিল্পী বিষয়ে নানা আলোচনা করতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে ওরা গ্যালারি মিউজিয়ামে ফিরে আসে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওরা মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আসে।
রিচার্ড হঠাৎ বলে,–আমার রুমমেট আজ ফিরবে না। তুমি কি আজ রাতে আমার ফ্ল্যাটে যাবে। অনেক ছবি দেখাব?– অলিটটে রিচার্ডের হাতটাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,–আজ নয়।– রিচার্ড বলে,–আজ নয় কেন? ঠিক আছে তোমার যেদিন ইচ্ছে হয় সেদিনই যেও।– সে রাতে বিছানায় শুয়ে অলিটটের মনে হল,–অবিশ্বাস্য ব্যাপার। রিচার্ড আমাকে। মুক্তি দিয়েছে। তারপর রিচার্ডের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমে তলিয়ে গেল।–
রাত দুটোয় রিচার্ডের রুমমেট গ্যারী তার রাতের পার্টি সেরে ফিরে দেখে অন্ধকারে ডুবে আছে গোটা অ্যাপার্টমেন্ট। শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ঠেলতেই খুলে যায়। আলো জ্বালিয়ে সে যে দৃশ্য দেখে তাতে সে আর্ত চিৎকার করে বেরিয়ে আসে।
ডিটেকটিভ হোয়াইটটেকার তার সামনের চেয়ারে বসা আতঙ্কগ্রস্ত গ্যারিকে বলে শান্ত হতে। বলেন,–পুরো ঘটনাটা ভাল করে দেখা যাক, তোমার বন্ধুর কোন শত্রু ছিল না বলছ?–হ্যাঁ।–তোমরা কি প্রেমিক প্রেমিকা?–না, না। আর্থিক সুবিধার কারণে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতাম।– ডিটেকটিভ হোয়াইটটেকার চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন,–ডাকাতির জন্য খুন করা হয়নি। ডাকাতির জন্য খুন করলে অন্ডকোষসহ লিঙ্গটাকে কেটে দেবে না। তীব্র প্রতিহিংসা বশতই খুন করা হয়েছে। তোমার বন্ধুর কোন প্রেমিক ছিল বলে জান?– গ্যারী বলে,–হ্যাঁ রিচার্ড অলিটটে বলে এচটা মেয়ের কথা খুব বলত। ক্যাপেরটিনোতে থাকে।– দুই ডিটেকটিভ হোয়াইটটেকার আর রেনল্ডস মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
আধঘন্টা বাদে ডিটেকটিভ হোয়াইটটেকার ফোনে শেরিফ ডাওলিংয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। বলছিলেন যে ওদের ওখানেও একটা খুন হয়েছে যার মোডাস অপারেন্ডি হুবহু ক্যাপেরটিনোর ডেনিস টিব্বলের খুনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। হোয়াইটটেকার বলেন–আমি এফ. বি. আই-এর সঙ্গে কথা বলেছি। ওদের কমপিউটারে এই ধরনের খুনের তিনটি নজির আছে। একটা দশ বছর আগের। বাকি দুটো সাম্প্রতিক কালে। দশ বছর আগেরটা পেনিসিলভিনিয়ায় তারপরে ক্যাপেরটিনোকুইবেকসিটি-সানফ্রান্সিসকো–ঘটনাগুলোর মধ্য যেন যোগসূত্র রয়েছে কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলছি। FB.-কে খোঁজ নিতে বলেছি কুইবেকে হাজির ছিল এমন কেউ ঐ অন্য দুই শহরে খুনের সময়ে হাজির ছিল কিনা।
সাংবাদ মাধ্যমে খবরটা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে রোমহর্ষক শিরোনাম দিয়ে এই খুন প্রসঙ্গে খবর বের হতে লাগল
Serial Killer loose…
Quaters Hommes Brutalement Tues Et Casterswir suchen Ein Mann Der Castreșt siene Hopper Maniac De Hommecidal Sullo Spree Cerspoder…
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর মনোবিজ্ঞানীরা তাদের মতামত জানাতে লাগলেন–.. শিকাররা যেহেতু পুরুষ এবং তাদের পুরুষাঙ্গ কর্তন করা হয়েছে, নিশ্চিত বলা যায় এটা কোন সমকামীর কাজ…
–…হয়ত বারবার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পুরুষ বিদ্বেষী কোন মহিলা এ কাজ করেছে…
–…একজন স্বেচ্ছাচারী মা আছেন এমন কোন পুরুষ এ কাজ করেছে…–
ডিটেকটিভ হোয়াইটটেকার শনিবার সকালে শেরিফ ডাওলিংকে ফোন করে,–একটা খবর আছে। FB.I ক্রশ চেকিং করে আমায় একজন আমেরিকানের নাম জানিয়েছে যে পেরেত খুনের সময়, কুইবেক-এ ছিল। তার নাম অ্যাশলে প্যাটারসন।–
শনিবার সন্ধ্যে বেলায় অ্যাশলের ফ্ল্যাটের বেল বেজে উঠল। –কে?–ডেপুটি শেরিফ স্যাম ব্লেক।– দীর্ঘক্ষণ পরে উদ্বিগ্ন মুখে অ্যাশলে দরজা খুলে দাঁড়ায়। –আমার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল।–আসুন, ভেতরে আসুন।– অ্যাশলে ভাবে সর্তক থাকতে হবে। প্রশ্নটা করেই ফেল–আপনারা কি আমায় সন্দেহ করছেন?–না, ঘাবড়ে যাবেন না। নিয়ম মাফিক কিছু প্রশ্ন করব। গত কয়েকদিনের মধ্যে আপনি কানাডার কুইবেক শহরে গিয়েছিলেন?–া, বড়দিনের সময়।–সেখানে জঁ ক্লদ পেরেত-এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল?—পরিচয় দূরের কথা। ঐ নামের কাউকে চিনি বলে মনে করতে পারছি না। তিনি কে?–কুইবেক শহরে একটি রত্নগয়নার দোকানের মালিক ভদ্রলোক?–তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?– ডেপুটি শেরিফ বলে,–ডেনিস টিব্বলে কিন্তু আপনার সহকর্মী ছিল।–মোটেই না বড়জোর বলা যায় আমরা এক জায়গায় চাকরি করতাম।–বেশ–মাঝে মাঝেই তো আপনি সানফ্রানসিসকো যান, তাই না?–হ্যাঁ, যাই।–সেখানে রিচার্ড মেলটন নামের একজন যুবক শিল্পীর সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়?–না। ঐ নামের কারো সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তাছাড়া শিল্প ও শিল্পী সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ নেই।–তাহলে মিস প্যাটারসন আপনাকে পলিগ্রাফ পরীক্ষায় বসতে হবে। আপনি পুলিশের সদর দফতরে আসবেন।–
পলিগ্রাফ বিশেষজ্ঞের নাম কিথ রসন। পরদিন সকাল এগারোটায় তার মুখোমুখি হল অ্যাশলে। অ্যাশলের হাতে, কপালে, বুকে, মাথায় সরু তার আটকে দেওয়া হয়েছিল। ডাঃ রসনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল অ্যাশলে। উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা রেখাচিত্র ভেসে উঠে কাগজে ছাপা হতে থাকে। যেটা অ্যাশলের মানসিক স্থিতি ও ভারসাম্যের রেখাচিত্র।
ডঃ কিথ জিজ্ঞেস করলেন–আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনার বয়স কত?–আঠাশ।–আপনার থাকা হয় কোথায়?–১০৬৯৪ ভায়া কামিনে কোর্ট, ক্যাপেরটিনো। –আপনি চাকরি করেন?–হা।–রাগপ্রধান সঙ্গীত পছন্দ করেন?–হ্যাঁ।–আপনি রিচার্ড মেলটনকে চিনতেন?–না।–
ডঃ রসন দেখেন-রেখাচিত্রে এখনও পর্যন্ত কোন পরিবর্তন নেই। যার অর্থ অ্যাশলের প্রতিটি উত্তরই সঠিক।
আবার প্রশ্ন শুরু হয়। আপনি কোথায় চাকরি করেন?–গ্লোবাল কমপিউটার গ্রাফিক্স করপোরেশনে।–চাকরিটা আপনার মনের মত?–হ্যাঁ।–সপ্তাহে কদিন কাজ করেন?–পাঁচদিন।–জঁ ক্লদ পেরেত আপনার কেমন বন্ধু ছিলেন?–ঐ নামের কাউকে চিনি না।– রেখাচিত্রে কোন পরিবর্তন নেই। –সকালে কী খেয়েছেন?–টোস্ট, ডিমের পোচ, কালো কফি।– রেখাচিত্রে পরিবর্তন নেই। অ্যাশলেকে ছেড়ে দিয়ে ডঃ রসন শেরিফের ঘরে গিয়ে বললেন,–অ্যাশলে প্যাটারসন ১০০ শতাংশ সত্যি উত্তর দিয়েছে। ও নির্দোষ।–
পুলিশ দফতর থেকে স্বস্তির সঙ্গে বের হয়ে আসে অ্যাশলে। ভগবানকে ধন্যবাদ জানায়। বাবাকে জড়িয়ে কোন প্রশ্ন না করায় ও নিশ্চিন্ত। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গাড়ি রেখে এলিভেটরে করে উঠে গরম জলে স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢুকে চমকে যায়। বাথরুমের আয়নায় দেখে লাল লিপস্টিক দিয়ে কেউ লিখে রেখেছে–তুমি মরবে।
আতঙ্কে চেঁচিয়ে ওঠে সে।
.
০৯.
আঙুলগুলো এমন থরথর করে কাঁপছিল যে অ্যাশলে তিনবার চেষ্টা করেও নম্বর ডায়াল করতে পারছিল না। শেষে দমবন্ধ করে চেষ্টা করে ডায়াল করে। ও প্রান্ত থেকে আওয়াজ আসে–হ্যালো, শেরিফের অফিস।–স্যাম ব্লেককে দেবেন?–উনি বেরিয়েছেন।–উনি ফিরলেই বলবেন অ্যাশলে প্যাটারসন ফোন করেছিল।–ঠিক আছে।–
ঘণ্টা খানেক পরে সহশেরিফ এলেন। তার আগে আশলেকে ফোন করেছিলেন। তিনি আসা মাত্রই অ্যাশলে তাকে স্নান ঘরে আয়নার লেখাটা দেখায়। –কে এটা করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?–জানি না–এই ফ্ল্যাটের চাবি থাকে আমার কাছে।– বলতে বলতে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। শেরিফ তার পিঠে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে হাত রাখেন। বলেন,–আপনাকে পাহারা দেওয়া এখন আমার দায়িত্ব।–
অ্যাশলে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,–আসলে ওই আতঙ্কে আমি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি।– ডেপুটি শেরিফ বলেন,–খুবই স্বাভাবিক।– অ্যাশলে গরম কফি আর বিস্কুট নিয়ে আসে। সোফায় বসে খেতে খেতে শেরিফ বলেন,–কতদিন হল এসব শুরু হয়েছে।– তা প্রায় মাস ছয়েক। আমার ফ্ল্যাটে বারবার কেউ ঢুকে পড়ছে। আমায় অনুসরণ করছে। ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখতাম সব আলো জ্বলছে। ফ্ল্যাটে সিগারেটের টুকরো পড়ে থাকতে দেখতাম।– ব্লেক বললেন,–আপনার কোন প্রেমিক ছিল যাকে আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন?–না।– ব্লেক উঠে দাঁড়ায়। অ্যাশলে বলে,–এই ফ্ল্যাটে আজ রাতে আমি একা কিছুতেই থাকতে পারব না।–থানা থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি কাউকে।–আ, আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। আপনি থেকে যান।–আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আপনার কোন বন্ধু-বান্ধবীকে আসতে বলুন।–যদি তাদের মধ্যেই কেউ এ কাজ করে থাকে।–তাও বটে। ঠিক আছে। আমি থেকে যাচ্ছি। তবে আমাকে দুটো ফোন করতে হবে। একটা বড় কর্তা ডাওলিংকে। অন্যটা আমার স্ত্রীকে।–
ফোন দুটো সেরে আসার পর অ্যাশলে বলে,–আপনি শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি সোফায় শুয়ে পড়ছি।– স্যাম ব্লেক বলেন,–আমি আরাম করে ঘুমোবার জন্য তো ওখানে থাকছি না। আপনি শোবার ঘরে যান। আমি এই সোফায় শুয়ে পড়ছি।– ধন্যবাদ জানিয়ে অ্যাশলে শুতে চলে যায়। স্যাম ব্লেক জানলাগুলো ভাল করে বন্ধ করে সোফায় এসে শুয়ে পড়েন।
ওয়াশিংটনের এফ বি আই সদর দফতরে বড়কর্তা রেনল্ড কিংসলের সঙ্গে ডিটেকটিভ রামিরেজের কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন,–বেডফোর্ড, ক্যাপেরটিনো, কুইবেক, সানফ্রানসিসকোর খুনের জায়গাগুলোর হাতের ছাপ, আঙুলের ছাপ এবং ভিশন-এ টেস্টের রিপোর্ট এসে গেছে। সব ম্যাচ করে গেছে।– কিংসলে বলেন,–তার মানে এগুলো একজন সিরিয়াল কিলারের কাজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে গ্রেফতার কর।–
পরদিন ভোরে ডেপুটি শেরিফ স্যাম ব্লেকের মৃতদেহটা অ্যাশলের ফ্ল্যাটের পিছন দিকের সরু গলিতে দেখতে পান বাড়ির সুপারিনটেন্ডেন্ট-এর স্ত্রী। নগ্ন মৃতদেহটি ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।
.
১০.
পুলিশের বড় কর্তা ডাওলিং, দুজন সাদা পোশাকের গোয়েন্দা এবং দুজন উর্দিধারী পুলিশ কর্মী অ্যাশলেকে ঘিরে ছিল। অ্যাশলে কেঁদে চলেছিল কাঁপতে কাঁপতে। –একমাত্র আপনিই আমাদের সাহায্য করতে পারেন মিস প্যাটারসন।– শেরিফ বলেন। অ্যাশলে প্রাণহীন চোখে বলে,–আমি চেষ্টা করছি।– শেরিফ বলেন,–গোড়া থেকে শুরু করুন।–গতরাতে স্নান ঘরের আয়নার ঐ লেখাটার কারণে আতঙ্কিত হয়ে আমিই ওঁকে থাকতে বলি। এই সোফায় উনি শুয়েছিলেন। ওঁকে বালিশ, কম্বল দিয়ে আমি শোবার ঘরে চলে যাই। ঘুম আসছে না বলে ঘুমের ওষুধ খাই। তারপর সকালে ঘুম ভাঙে পেছনের গলি থেকে চিৎকারে।– শেরিফ তার সহকর্মীদের বলেন,–গোটা বাড়িটা ভাল করে খুঁজে দেখুন। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আমাকে জানাবেন।– শেরিফ এবার অ্যাশলেকে বলেন,–আপনার কি মনে হয় গতরাতে সেই আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকে স্যামকে খুন করেছে।– অ্যাশলে কেঁদে ওঠে,–আমি কিছু জানি না।–
গোয়েন্দা এলটন তখনই বলে,–স্যার, এদিকে একটু আসবেন?– রান্নাঘরের সিঙ্কের মধ্যে মাংস কাটা ধারালো রক্তমাখা ছুরি। এলটন বলে,–ভালই হল। আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে।– দস্তানা পরে ছুরিটা এলটন প্লাস্টিকের খাপে ঢুপিয়ে দিল। কিন্তু শেরফি ভাবছেন খুনি এভাবে খুনের অস্ত্র ফেলে গেল কেন?
গোয়েন্দা কোস্তফ এসে বলে,–স্যার আমি এই অত্যন্ত দামী গয়নাটা আলমারিতে পেলাম। আংটিটার বাক্সে কানাডার কুইবেক শহরের এক গয়নার দোকানের ঠিকানা লেখা।– শেরিফ দেখেন হিরে বসানো আংটিটার চারপাশে ছোট ছোট পান্না বানো। আংটিটা দেখতে দেখতে শেয়ালের মত হাসি ফুটে উঠল শেরিফের মুখে। তিনজনই অ্যাশলের কাছে এলেন। জানতে চাইলেন ছুরিটা তার কিনা। অ্যাশলে শূন্য চোখে বলে,–হতে পারে।–আংটিটাও কি আপনারই?– অ্যাশলে আংটিটা দেখে বলে,–না, এত দামি গয়না আমার নয়।– শেরিফ বলেন,–কুইবেক শহরে খুন হওয়া এক গহনার দোকানের মালিক জঁ ক্লদ পেরেত টোনি প্রেসকটকে এই আংটিটা উপহার দিয়েছিল।– অ্যাশলে বিস্মিত বিবর্ণ হয়ে বলে,–এটা কি করে আমার ঘরে এল?–
তখনই পুলিশ কর্মীদের একজন এসে বলে, স্যার, করিডর ঘরে রক্তের দাগ।– স্যাম বলেন,–তার মানে স্যামকে এই ফ্ল্যাটে খুন করে টেনে নিয়ে গিয়ে এলিভেটরে করে নীচে নেমে ফেলে দেওয়া হয়েছে।– শেরিফ বললেন,–মিস প্যাটারসন, আপনাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হচ্ছি।– অ্যাশলে চমকে ওঠে। যন্ত্রচালিতের মত উঠে দাঁড়ায়। শেরিফ বলে,–আপনি আইনজীবিকে ফোন করতে পারনে।– অ্যাশলে বলে,–তার দরকার নেই। বাবাকেও এসব জানাতে চাই না।–
শেরিফ ভাবছিলেন পলিগ্রাফ টেস্টেই তো অ্যাশলে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রমাণ তো ইঙ্গিত করছে সিরিয়াল কিলার হল ঐ অ্যাশলে প্যাটারসন। এমন সময় গোয়েন্দা কোস্তভ এসে বললেন,–স্যার, ডেপুটি শেরিফের সঙ্গে তার মৃত্যুর আগে কারও যৌনমিলন হয়েছিল। অতি বেগুনী রশ্মির সাহায্যে প্রমাণ করে দেখা গেছে, স্যার-এর শরীরে বীর্য ও নারী-যোনিরসের চিহ্ন রয়েছে। তীব্র ভাবে বিস্মিত হল প্যাটারসন। ঐ অ্যাশলের সঙ্গে স্যাম-এর যৌনমিলন হয়েছিল? ব্যাপারটা আরও জট পাকিয়ে গেল।
সেদিন সন্ধ্যে বেলায় শেরিফ ডাওলিং তার অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে কেসটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় ফোন বাজল। ডাওলিং বললেন,–হ্যালো,–FBI-এর সদর দফতর থেকে স্পেশাল এজেন্ট রামিরেজ বলছি। আমরা অ্যাশলে প্যাটারসনের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড পাইনি। যেহেতু ১৯৯৮-এর আগে গাড়ি চালানোর লাইসেন্সের জন্য আঙুলের ছাপ নেবার কোন প্রয়োজন হত না…।– এর পর প্রায় মিনিট দশেক শেরিফ আর রামিরেজ-এর কথা চলল ফোনে। শেরিফের মুখের অভিব্যক্তি বদলে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে–অবিশ্বাস্য,–কি আশ্চর্য, হে ভগবান– ইত্যাদি মন্তব্য করছিলেন। ফোন নামিয়ে রেখে দীর্ঘসময় গুম হয়ে বসে রইলেন। পরে বললেন–এফ বি আই সদর দপ্তরের ফোন ছিল। ওরা সব কটি মৃতদেহের ফিঙ্গার প্রিন্ট যাচাই করে দেখেছে একজনই খুনগুলো করেছে।– একটু থেমে আবার বললেন শেরিফ,–কুইবেক শহরে জঁ ক্লদ পেরেত মৃত্যুর আগে এক ইংরেজ মহিলা যার নাম টোনি প্রেসকট তার সঙ্গে মেলামেশা করেছিলেন। সানফ্রান্সিসকোতেও একজন ইতালিয় মহিলা অলিটটে পিটার্সকে, রিচার্ড মেলটন খুন হওয়ার আগে তার সঙ্গে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। আর স্যাম ব্রেক ছিলেন অ্যাশলে প্যাটারসনের সঙ্গে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন শেরিফটোনি প্রেসকট, অলিটটে পিটার্স, অ্যাশলে প্যাটারসন ওরা একই ব্যক্তি।