দ্বিতীয় খণ্ড
০১.
ওয়াশিংটন প্রেস ক্লাবের বার্ষিক ডিনার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখানে প্রধান অতিথি। ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সিনেটর, ক্যাবিনেট সদস্য অথবা প্রধান বিচারপতি সকলেই এসেছেন। মাস্টার অফ সেরিমোনিজ-এর পদের গুরুত্ব খুব বেশী, জনপ্রিয় এক কমেডিয়ানকে এই পদ দেওয়া হল।
পনেরো বছরের এক মেয়ের সে বাবা। এই মর্মে মামলা রুজু হল। কমেডিয়ান দেশ থেকে পালিয়ে গেল। ডাকা হল এক ফিল্মস্টারকে। যেদিন পার্টি, সেদিন সকালে ফিল্মস্টারকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। অ্যাপেনডিক্সের ব্যথা উঠেছে। অথচ ডিনারের আর দু-ঘন্টা বাকি। ফিল্ম আর টিভির নামজাদা তারকাদের মধ্যে কাছে পিঠে কেউ নেই। শেষ অব্দি উঠতি কমেডিয়ান টবি টেম্পলের নাম উঠল।
ডিনার কমিটির চেয়ারম্যান ডাউনি টবিকে বোঝালেন, তোমার রসিকতাগুলো আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু আজ তোমাকে ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে। মনে রেখো, সাংবাদিকরা তোমার ওপর নজর রেখেছে। তুমি যা বলবে সব কটা কাগজে সেই রিপোর্ট বেরোবে। প্রেসিডেন্ট অথবা কংগ্রেস সদস্যদের সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য করো না।
আমার ওপর আস্থা রাখুন। ধীরে ধীরে বলল টবি।
ডায়াসের কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট বসে আছেন। পেছনের সিক্রেট সার্ভিসের জনা ছয় এজেন্ট। টবিকে কেউ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়নি।
টবি জানে, প্রেসিডেন্ট তাকে মনে রাখবেন। প্রেসিডেন্ট সহজ সরল ঘরোয়া মানুষ। তিনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন।
তিনি বলেছিলেন-কমপিউটারের ওপর আস্থা না রেখে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা উচিত। আমি যখন অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় বসি, তখন আমাকে সাহায্য করে প্যান্টের পেছনটা।
ওর এই কথাটা এখন এক প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
টবি শো-র শুরুতে বলল–মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার গর্ব এবং আনন্দ আমি যে ডায়াসে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানেই বসে আছেন এমন একজন মানুষ, যার পাছার সঙ্গে সারা দুনিয়া তার দিয়ে জোড়া।
এক লহমার জন্য এই কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তারপর এর আসল অর্থ বুঝে প্রেসিডেন্ট হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসি একটা সংক্রামক রোগের মতো, অন্য সকলের মুখে ছড়িয়ে গেল। সিনেটরদের ব্যঙ্গ করছে টবি। সুপ্রীম কোর্টকেও বিদ্রূপ করছে। সাংবাদিকদেরও ব্যঙ্গ করতে ছাড়ছে না। অথচ তার নিষ্পাপ মুখ দেখে কেউ তাকে ঘৃণা করছে না।
শো শেষ হলে প্রেসিডেন্ট বলল–টবি, সোমবার রাতে হোয়াইট হাউসে ডিনারের আসর, তুমি এলে আমি খুশী হব।
হোয়াইট হাউস!
সাংবাদপত্রে শিরোনাম–
লন্ডনের প্যালাডিয়াম।
চ্যারিটি শো
ইংল্যান্ডের রানির সম্মানে বিশেষ শো–
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ডিনার
পুঁজিপতি থেকে রাজনীতিবিদ, গভর্ণর থেকে সাধারণ মানুষ–সবাইকে নিয়ে বিদ্রূপ। সবাই হাসছে।
ক্লিফটন লরেন্স বলল–ফক্স, ইউনিভারসাল, প্যান প্যাসিফিক–সবাই তোমাকে চাইছে। তোমার নিজস্ব টিভি শো হবে।
কত পাব? জানতে চাইল টবি।
–প্রতি সপ্তাহে দশ হাজার ডলার। দু-তিন বছরের কনট্রাক্ট।
টবি খুশী। পৃথিবীর মানুষ কত বোকা, তাই বলে এত আয় হবে? ক্লিফটন লরেন্সও খুশী হয়েছে। অনেক ডলার কমিশন পাবে সে।
কেন পাবে? টবির ঘাম ও প্রতিভার বিনিময়ে। সে কোনো নোংরা ক্লাবে শো দেখায় নি, মাতাল শ্রোতারা তার দিকে বিয়ারের বোতল ছুঁড়ে দেয়নি। আরশোলা ভরতি কোনো নোংরা ঘরে তাকে এক মুহূর্তের জন্য শুতে হয়নি। সাফল্যের মূল্য সে কী করে বুঝবে?
ছটি সপ্তাহ কেটে গেছে।
ক্লিফটন লরেন্স বলল–টিভির সঙ্গে ফিল্ম। ফিল্মের প্রযোজক স্যাম উইনটার্সের প্যান প্যাসিফিক স্টুডিও। ফিল্মের নাম দ্য কিড গোজ ওয়েস্ট।
-আমি আর্মিতে স্যাম উইন্টার্সের সঙ্গে ছিলাম। তুমি বেশী টাকা বলল। কনট্রাক্টের শর্ত, টবি রিহার্সালে আসবে না। চার কোটি লোক দেখবে টবি টেম্পলের শো।
অবশেষে সেই শো শুরু হল। লোকে দেখে আর হাসে। চড়চড় করে টবির দাম বাড়তে থাকে। টবি টেম্পল এখন আর স্টার নয়। সে এই মুহূর্তে এক সুপার স্টার। রাজাদের সঙ্গে রসিকতা করে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গলফ খেলে, উঁচু মানুষদের ঠাট্টা ইয়ার্কি করে। সে প্রতিষ্ঠান বিরোধী কমেডিয়ান। তাই সাধারণ মানুষ তার প্রতি উজাড় করে দেয়। ভালোবাসা।
বেল এয়ারে সুন্দর বাড়ি আছে তার। আটটা বেডরুম আছে সেই প্রাসাদে। আছে মুভি থিয়েটার, মদের সেলার, সুইমিং পুল।
পাম স্প্রিংসে আরও একটা বড়ো বাড়ি বানিয়েছে। রেসের ঘোড়া আছে কালো কুচকুচে। চারজন সেক্রেটারী, একজন সুন্দরী। বয়স একুশ, মাথার চুলে মধু রং। সমস্ত শরীরে টান টান যৌন আবেদন! ওকে খাটো স্কার্টের নীচে কিছু পরতে বারণ করেছে টবি। এতে দুজনেরই সময় বাঁচে।
প্রথম ফিল্মটা দারুণ হিট হয়েছে। চড়া দাম হেঁকে টবি বলেছে–স্যাম, হলিউডে আসার পর তোমায় ফোন করেছিলাম। তুমি ফোনে জবাব দিলে সস্তায় হত।
–আমার দুর্ভাগ্য।
তিনটে নতুন ফিল্মের কনট্র্যাক্ট।
ক্লিফ, তুমি অন্য কোনো স্টারের এজেন্ট হবে না। শুধু আমার। একদল পুরুষ মিলে একটা মেয়ের সাথে ফুর্তি করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, আপ্তবাক্যটা মানো তো?
তাই হল। টবি তবুও একা। টাকার বিনিময়ে শয্যাসঙ্গিনী আর উপহারের বিনিময়ে বন্ধু। এভাবে আর কতদিন চলবে?
একজন সঙ্গীতজ্ঞ বলেছিল–টবি, তোমার ভালোবাসা কেনার দরকার নেই। লোকে এমনিতেই তোমাকে ভালোবাসে।
তবু ঝুঁকি নিই না।
শেষ পর্যন্ত টবির শো-এ জায়গা পেল না ওই মিউজিসিয়ান।
নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের যন্ত্রণা, ভালোবাসার তীব্র তিয়াস, শ্রোতার হাসি আর দর্শকের হাততালি। তখন নিঃসঙ্গতা দূর থেকে, আরও দূরে চলে যায়। সাফল্য, আরও সাফল্য। হাসি, আরও হাসি।
অভিনেতা নিজেকে লুকিয়ে রাখে শেক্সপীয়ারের শব্দের মধ্যে, জর্জ বার্নাড শ তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, মলিয়েলের লেখা কবিতাও তাকে আড়াল করে। গায়ক গারশউইন বা রোজার্স বা কোল পোর্টারের লেখা গানের সাহায্য সে পায়।
কিন্তু একজন কমেডিয়ান একেবারে নিঃসঙ্গ এবং একা। কেউ তাকে সাহায্য করে না। পরিস্থিতির সঙ্গে তাকে মানিয়ে চলতে হয়।
ডিনারের বিখ্যাত ডাক্তার খুব কষ্ট করে রসিকতা শোনাচ্ছে।
টবি বলল–ডক, হাসিও না। আমাদের বাঁচতে দাও।
ফিল্ম শুটিং-এর জন্য সিংহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ট্রাডে।
টবি বলল খ্রিষ্টানরা আর মাত্র দশ মিনিট।
ক্যাথলিক বন্ধু ছোটোখাটো অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। লোকটা প্রায় সেরে উঠেছে। সুন্দরী এক নার্স বিছানা ঠিক করছে। অসাবধানে তার স্তন ছুঁয়ে যায় রোগীটির। পুরুষের পুরুষাঙ্গ কঠিন হয়ে উঠে।
নার্স বলে ওঠে-গুড লর্ড, এটা কী?
-সরি, সিস্টার।
দুঃখিত হবার কিছু নেই। এটা একটা দারুণ জিনিস।
সিস্টার নগ্ন হয়ে শুয়ে পড়ে তার ওপর।
ছ-মাস পর ক্যাথলিক ভদ্রলোক জানতে পারে, এটা টবি টেম্পলের একটা রসিকতা। হাফগেরস্ত মেয়ে মানুষকে নার্স সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল টবি।
–এলিভেটরে নামছে টবি। সঙ্গে নামকরা এক ভদ্রলোক। টি. ভি. নেটওয়ার্কের কর্তাব্যক্তি। গম্ভীর ধরনের মুখ ভঙ্গি।
টবি বলল–অল্পবয়সী মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক হয়েছিল তোমার। এই কেসটায় তুমি ছাড়া পেয়েছ।
টবি বেরিয়ে গেল। আধডজন লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে।
টবি ঢুকল স্যাম উইন্টার্সের অফিসে।আমার এজেন্ট তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
এজেন্ট নয়। ভেতরে ঢুকল ট্রেনিং পাওয়া একটা চিতাবাঘ। বাইরে থেকে টবি দরজা বন্ধ করে দিল।
তিনজন লোকের তখন হার্ট অ্যাটাক হবার জোগাড়।
ও. হ্যানলন আর রেইনজার-এর অধীনে দশ জন লেখক টবিকে রসিকতা জোগায়। পেশাদার এক বারবনিতাকে ওদের দলে ঢুকিয়ে দিল টবি। দেখা গেল, বেডরুমে সেই লেখকরা বেশী সময় কাটাচ্ছে।
টবির বদান্যতার সীমা পরিসীমা নেই। অকাতরে দান করতে সে ভালোবাসে। অনেক বন্ধুর হাতে সোনার ঘড়ি তুলে দেয়। কাউকে দেয় সোনার সিগারেট লাইটার। দামী পোশাক কিনে দেয়। ইউরোপ বেড়ানোর খরচ দেয়। তাই পকেটে তাকে অনেক টাকা রাখতে হয়।
ফিল্মে অভিনয়ের জন্য যারা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা প্রত্যেক হপ্তায় শুক্রবার টবির বাড়িতে ভিড় জমায়। টবি বলে–ভ্যারাইটি ম্যাগাজিনে দেখলাম, তুমি নাকি অমুক ছবিতে সুযোগ পেয়েছ?
একদিন লেখকদের একজন দেরী করে ওই অধিবেশনে এল। সে বলল–আজ সকালে আমার বাচ্চাটা মোটরগাড়ি চাপা পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
টবি বলল–রসিকতাগুলো লিখে এনেছ?
সকালে অবাক হল। অধিবেশন শেষ হয়ে গেল। একজন লেখক ও. হ্যানলনকে বলল দুনিয়ার সবথেকে ঠান্ডা স্বভাবের ধনী এই টবি। ওকে সন অফ এ বিচ বললেই ঠিক বলা হয়। কারোর ঘরে আগুন লাগলেও তাতে জল সেচতে পারে। এমনই হৃদয়হীন।
এই টবি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ওই লেখকের ছেলের অপারেশনের ব্যবস্থা করেছিল। নামজাদা ব্রেন সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করল। কিন্তু সে লেখককে বলল–একথা আর কেউ জানলে তোমার চাকরী যাবে।
কাজ কাজ আর কাজ–নিঃসঙ্গতার কি আর কোনো ওষুধ নেই। টবি জানতে চায়, কাজ মানেই কি আনন্দ?
লেখকদের সে ঘেন্না করে। আবার লেখক ছাড়া টবির চলবে না। কারো ওপর সে নির্ভর করতে চায় না। প্রতিদ্বন্দ্বীকে সে বরদাস্ত করে না। টবির গ্রুপের এক কমেডিয়ানের কথায় লোকে খুব হেসে উঠেছিল।
টবি বলেছিল–তুমি দারুণ হাসিয়েছ। প্রত্যেক সপ্তাহের শো-এ তুমি থাকবে।
প্রোডিউসারকে টবি বলেছিল–কথাটা শুনলে তো? প্রোডিউসার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে। কমেডিয়ান আর সুযোগ পায় না টবির প্রোগ্রামে।
অথচ এই টবি…পুরোনো দিনের এক কমেডিয়ান ভিনি টারবেলকে পাদপ্রদীপের আলোয় ফিরে আসার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।
পরিচালক বলছে ভিনি সুবিধা করতে পারবেন না।
টবি, ভিনিকে বলেছিল–এই পার্ট তুমি পৃথিবীর অন্য যে কারোর চেয়ে ভালো বলতে পারো।
আমি মুখ খুললেই ওরা হাসে।
–কেননা তুমি কমেডিয়ান। সারা জীবন ধরে তুমি ওদের হাসিয়েছ। এখন তুমি সিরিয়াস রোল করলেও ওরা ভাববে যে, এর আড়ালে কোনো হাসি আছে।
পরিচালককে টবি বলল–ভিনিকে চান্স দাও, যদি না পারে, আমি ওর পার্ট বিনা পয়সায় করব।
-সত্যি? পরিচালকের চোখ কপালে।
–সত্যি ।
–তাই হবে, ভিনিকে কাল সকাল নটার মধ্যে রিহার্সালে আসতে বলে দাও।
বেতার নাটক দারুণ হিট হল। সবাই ভিনির প্রশংসা করল পুরস্কারের পর পুরস্কার।
কয়েক মাস কেটে গেল। নিজের শোতে টবি ভিনিকে সুযোগ দিয়েছিল। সে টবির একটা রসিকতা নিজে বলল। তারপর নিজে চার কোটি দর্শককে হাসাবার চেষ্টা করল। কিন্তু টবি তার ব্যবহারে মোটেই খুশী নয়। তার মুখোশ খুলতেই হবে। শেষ পর্যন্ত ভিনিকে সে প্রচণ্ড অপমান করে।
এই হল টবি টেম্পল। এই হল তার বিচিত্র সুন্দর স্বভাব।
একদিন লেখক ও. হ্যানলন বলল তুমি চার্লি চ্যাপলিনের সেই বইটা দেখেছ? কোটিপতি মানুষ চার্লির বন্ধু মদ খেয়ে মাতাল হল। নেশা কেটে গেলে সে চার্লিকে তাড়িয়ে .দেয়। টবিও ওই কোটিপতির মতো। নেশা না করেও ও রকম হবে।
একবার টিভি নেটওয়ার্কের একটা মিটিং-এ জুনিয়ার এগজিকিউটিভ টবির সঙ্গে কথা বলল না। মিটিং শেষ হল। ক্লিফটন লরেন্সকে আনা হল।
–সে আমাকে পছন্দ করে না? টবি জানতে চাইল।
কে?
–ওই ছেলেটি।
–ও তো ফালতু। ও পছন্দ না করলে কী বা এসে যায়?
শেষ অব্দি ছেলেটিকে ক্লিফটন খুঁজে বের করল। জানতে চাইলটবি টেম্পলকে তুমি । পছন্দ করো না কেন?
–আমি? ছেলেটি অবাক। আমার মতে টবি সারা দুনিয়ার সেরা কমেডিয়ান।
–তাহলে সেই কথাটা ওকে ফোনে জানিয়ে দাও।
তার মানে?
–ওকে ফোন করে জানাও, তুমি টবিকে পছন্দ করো।
–ঠিক আছে, কাল সকালে ফোন করব।
–না, এখনই করো।
–এখন রাত তিনটে বেজে গেছে।
–ও তোমার ফোনের অপেক্ষায় জেগে আছে।
অবশেষে টবিকে ফোনে করল সে।
টবির গলার স্বর ভেসে আসে–হাই
আমি তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম, তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা কত উঁচু।
ফোন রেখে দিল টবি। বন্ধুদের তাস খেলতে ডাকল সে। চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। তবু সে কত নিঃসঙ্গ–কত একা।
.
০২.
রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছিল। হ্রদের জলে নাচছিল আকাশের তারাগুলো।
–ডেভিড, চলো আমরা সাঁতার কাটি।
–জোসেফাইন, আমি সাঁতারের পোশাক আনিনি।
–তাতে কিছু এসে যায় না।
অতি দ্রুত হ্রদের দিকে ছুটে যাচ্ছে জোসেফাইন। সে পোশাক খুলেছে। উষ্ণ জল তার নগ্ন শরীরকে আলিঙ্গন করছে। উদম উলঙ্গ ডেভিড জলে নামল।
-জেসি…
–হ্যাঁ, ডেভিড, এখনই
ডেভিড কেনিয়নের মনে কামনা জেগে উঠেছে। রমণীর শরীরে পুরুষের উত্থিত অঙ্গের ছোঁয়া লাগে। ওরা হ্রদের তীরে ফিরে আসে। জোসেফাইনের রমণী শরীরের ওপর ডেভিড কেনিয়নের পুরুষ শরীর।
জোসেফাইনকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রুগ্ন শয্যাসঙ্গিনী মৃত্যুপথযাত্রিনী মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যায় ডেভিড কেনিয়ন।
–হ্যালো, এতরাতে ঘুমোওনি।
–আমি জোসেফাইনের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি ওকে বিয়ে করব।
–জোসেফাইন সুন্দরী, কিন্তু মনে রেখো, ও এই পরিবারের বউ হবার যোগ্য নয়। তুমি সিসি টপিংকে বিয়ে করো। তা হলে আমিও খুশি হব, তুমিও খুশি হবে।
–মা, আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু আমার পথ কী, আমি তা ঠিক করব।
–তুমি কি আগে ভুল করোনি? ভুল করে কোনো ভয়ংকর কাজ করোনি?
–মা, ঈশ্বরের দোহাই
–তোমার জন্য এই পরিবারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমি চাই না, নতুন করে আর কোনো ক্ষতি হোক। তোমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।
–আমি জোসেফাইনকে ভালবাসি।
মায়ের শরীরে খিচুনি শুরু হয়েছে।
ডাক্তার আসে। বলেডেভিড, মায়ের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে।
সিসি টপিং-এর সঙ্গে দেখা করে ডেভিড।
–সিসি, আমি অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসি। কিন্তু মা চায়, আমি তোমাকে…
–আমিও তাই চাই ডার্লিং।
–তুমি যদি আমাকে এখন বিয়ে করো, মায়ের মৃত্যুর পর ডিভোর্স দাও, তাহলেই ভালো হবে।
–তুমি সত্যি কি তাই চাইছ?
ধন্যবাদ সিসি, আমি কৃতজ্ঞ.…
–পুরোনো বন্ধুরা বন্ধুর কাজ করে।
ডেভিড চলে যেতে সিসি টপিং ডেভিডের মাকে ফোন করে বলল–সব ঠিক হয়ে গেছে।
বিয়ের খবর জোসেফাইন জেনে যাবে, এটা ভাবতে পারেনি ডেভিড। সে জোসেফাইনের বাড়ির পথে এগিয়ে চলল, দরজায় দেখা হল জোসেফাইনের মায়ের সঙ্গে।
–জোসেফাইনের সঙ্গে দেখা করব।
–প্রভু যীশু তার শত্রুদের শাস্তি দেন।
–জোসেফাইনের সঙ্গে কথা বলব।
–সে চলে গেছে।
দুদিনে বাসটা পনেরোশো মাইল এগিয়ে যাবে। সকাল সাতটায় বাস পৌঁছবে হলিউডে।
জোসেফাইনের নতুন নাম জিল ক্যাসল। জোসেফাইন জিনস্কি মারা গেছে। জিল ক্যাসল দীর্ঘজীবী হোক।
.
সঙ্গে ছিল মাত্র দুশো ডলার। কাঠের তৈরী বিশ্রী বাড়ির একটা জঘন্য ছোটো বেড়রুম ভাড়া নিতে বাধ্য হয়েছে জিল ক্যাসল। এখানে যারা থাকে, তারা সবাই একদিন তারকা, হবার স্বপ্ন দেখেছিল। টিভি থেকে ছাঁটাই এক মহিলা জিলকে বলল–হনি, ফিল্মে চান্স পেতে হলে এ. ডি-র সঙ্গে ভাব করো।
–এ. ডি. মানে কী?
–অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর। কাস্টিং ডাইরেক্টদের সঙ্গে শুতে পারলে আরও ভালো।
–এক্সট্রা হিসেবে চান্স পাওয়া যায় না?
–সেন্ট্রাল কাস্টিং স্পেশ্যাল ছাড়া কাউকে নেবে না।
–স্পেশ্যাল মানে?
–ওরা খোঁড়া, নুলো আর ঘোড়সওয়ার। ফুটবল বা বেসবল খেলোয়াড়। এক্সট্রা হতে পারবে না, ছোটোখাটো রোলের চেষ্টা করো।
–এক্সট্রার সঙ্গে তফাত কী?
ছোটো রোলে একটা কথাও বলা যায়। এক্সট্রা কোনো কথা বলে না। ওমনিরা ছাড়া।
–ওমনি মানে?
যারা ব্যাক গ্রাউন্ডে সোরগোল তোলে। প্রথমে এজেন্ট জোগাড় করো।
–এজেন্ট কোথায় পাব?
স্ক্রিন অ্যাক্টর ম্যাগাজিনে পাবে।
এজেন্টরা মুখ খুলতে চাইছে না।
পোর্টফোলিও দেখি।
–তার মানে?
ফটো তোলাও। স্তন আর নিতম্ব যেন সেই ছবিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডেভিড সেলজনিক স্টুডিওয় নানা ভঙ্গিমায় ফটো তোলাল। সবগুলো বাঁধিয়ে দিয়ে ফটোগ্রাফার বলল–সামনে অ্যাকটিং ক্রেডিটর্সের জায়গা রইল।
অভিনয়ের অভিজ্ঞতা? অভিজ্ঞতার আঁড়ার শূন্য।
এজেন্টরা বলছে–তোমরা সবাই সুন্দরী সেক্সি। তোমরা এলিজাবেথ টেলর কিংবা লানা টারনার অথবা আভা গার্ডনারের মতো দেখতে। কিন্তু দেখতে ভালো হলেই হলিউড সুযোগ দেয় না।
লা সিয়ে নেগার ছোট্ট বাংলোয় ড্যানিং এজেন্সির অফিস। মিস ড্যানিং-এর মুখে বসন্তের দাগ। তাকে দেখলেই মনে হয় তিনি কখনও কারো প্রেমে পড়েননি। ভারিক্কি চেহারা।
–আমার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নেই।
–আমি তোমার চান্সের ব্যবস্থা করব। টবি টেম্পল বা টেসি ব্যান্ডের ছবিতে তুমি সুযোগ পাবে।
রোজ ড্যানিং ওকে বেডরুমে নিয়ে গেল। বলল–এই তোমার সুইট। বিছানাতে শোও। কল্পনা করো, তুমি ন্যাটালি নামে এক ধনীর মেয়ে। দুর্বল পুরুষকে বিয়ে করেছে। ডিভোর্স চাও। ও রাজী নয়।
চিত্রনাট্য পড়া হল।
পিটার, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
পিটারের কথা বলছে রোজ। তার হাত জিলের উরু ছুঁয়েছে।
–পরে বললে হয় না?
–আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। আর করব না। আজ বিকেলের প্লেনে আমাকে রেনো যেতে হবে।
–এইভাবে?
–পাঁচ বছর ধরে আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাইনি। তুমি এখনও খেলা করছ। এখন থেকে আমি আর তোমার খেলার সাথী হব না।
রোজের হাত উরুতে ধাক্কা দিচ্ছে। সে মুখে বলছে–বেশ, ভালো বলেছে। বলে যাও
রোজের হাত জিলের উরু থেকে এগিয়ে যাচ্ছে গোপন গভীরের দিকে। জিল শিউরে ওঠে।
রোজের চোখে মুখে উত্তেজনা অথচ রোজ বলছে–পড়ে যাও।
কীভাবে পড়ব? তুমি যদি হাত না সরাও।
সমকামী রোজ ড্যানিং-এর হাত জিলের দুপায়ের ফাঁকে দ্রুত খেলা করছে।
রোজ বলে–সেক্সের সঙ্গে সেক্সের এই লড়াইতে তোমার সুপ্ত সেক্সকে জাগালে অভিনয় ভালো হবে।
-না, লাফিয়ে ওঠে জিল।
রোজের ঠোঁটের কোণ থেকে লালা ঝরছে।
–এসো বেবি, বলে সে জিলের দিকে এগিয়ে আসে।
ওর হাত ছাড়িয়ে জিল ছুটে পালায়। রাস্তায় এসে তার বমি হয় এবং মাথায় যন্ত্রণা।
পরবর্তী পনেরো মাসে জিল ক্যাসল হয়ে উঠল সেই গোষ্ঠীর অন্যতম, যারা বছরের পর বছর ধরে একটা মিথ্যে স্বপ্নের পেছনে ছুটে বেড়ায়। কোন্ ফিল্মে তারকা বদল হতে চলেছে, সে খবর জিল ক্যাসলের নখদর্পণে। কোন প্রোডিউসার কার সঙ্গে শোয়, সব সে জেনে গেছে। চলচ্চিত্র ব্যবসা একটা অরণ্যের দিন আর রাত্রি। এইসব মানুষদের আশা একদিন স্টুডিওর ভেতরে তারা প্রবেশ করতে পারবে। রেশমী পোশাক পরে তারা চিত্র তারকার ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবে। জনতা তাদের ভালোবাসবে। তাদের নামে জয়ধ্বনি দেবে। অমুক অ্যাসিস্ট্যান্টের ডাইরেক্টর, অমুক কাস্টিং ডাইরেক্টর আমাকে বলেছেন।
আপাতত জীবিকার প্রয়োজনে তারা সুপার মার্কেটে, বিউটি পার্লারে চাকরী করছে। তারা নিয়ম নীতি মেনে বিয়ে করছে। আবার ডিভোসও হয়ে যাচ্ছে। প্রতারক তাদের প্রবঞ্চনা করছে। তাদের বয়স বাড়ছে। নায়িকা হবার সম্ভবনা আর নেই। মাথার চুলে পাক ধরেছে। তারা এখন চরিত্রাভিনেতা। তবুও স্টার হবার স্বপ্ন দেখছে।
তাদের মধ্যে যারা যুবতী, তারা দেহব্যবসা করে পয়সা কামাচ্ছে। তবে জিল নয়। গরীবের মেয়ে জোসেফাইন জিনস্কি বড়ো লোকের ছেলে ডেভিড কেনিয়নকে বিয়ে করতে পারে না। ফিল্মস্টার জিল ক্যাসল যা চাইবে, তাই করায়ত্ত করবে।
প্রথম অভিনয়ের সুযোগ এল। এক টিভি মেডিক্যাল সিরিজে নার্সের ভূমিকা। এর জন্য পঞ্চাশ ডলার পাওয়ার কথা আছে জিলের। অবশ্য এর থেকে ট্যাক্স বাবদ কিছু পয়সা কেটে নেওয়া হবে। মোশন পিকচার রিলিফ হোমের চাদা বাবদ কিছু দিতে হবে।
দৃশ্যটা এইরকম হাসপাতালে রোগীর পালস্ দেখছে ডাক্তার।
ডাক্তার জানতে চাইল–নার্স, পেশেন্ট কেমন আছে?
নার্স জবাব দিল–আমার ভয় হয়, ও খুব একটা ভালো নেই, ডক্টর।
এখানেই শেষ। অথচ বারবার সে মনে মনে এই সংলাপগুলো বলে যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে, ওর কথা বলার ভঙ্গিতে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কখনও ও ভাবছে ও যেন অভিযোগের সুরে কথা বলছে।
চিত্র গ্রহণের সময় এগিয়ে এল। ডাক্তারের ভূমিকায় বড় হ্যানসন এগিয়ে আসতে প্রথমবার ইতস্তত করছিল জিল। শেষ অব্দি কথাটা বলল সে। জিল ভেবেছিল, এখন থেকে সে নিয়মিত সুযোগ পাবে।
অথচ, তাকে আরও তেরো মাস অপেক্ষা করতে হল। এবার সুযোগ এল এস. জি. এম. স্টুডিওতে।
জীবিকার প্রয়োজনে সোডা ফাউনটেনে সেলস গার্লের কাজ করেছে। এমন কী ট্যাক্সি ড্রাইভারের চাকরিও তাকে করতে হয়েছে।
অতি দ্রুত টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। হ্যারিয়েট মার্কাস নামে একটা হাসিখুশী স্বভাবের রূপসীর সঙ্গে একই ঘরে রয়েছে জিল। হারিয়েটের স্বভাব হল পুরুষের প্রেমে পড়ে যাওয়া।
–জিল, আমার সঙ্গে র্যালফের বিয়ে হবে। শেষ অব্দি বলি-বলি করে কথাটা বলেই ফেলল হ্যারিয়েট। র্যালফ হ্যারিয়েটের গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।
কদিন বাদে মত পাল্টে সে বলল–জিল ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসায়ী টনি আমায় বিয়ে করবে।
ইতিমধ্যে একটি মাস কেটে গেছে। লস এঞ্জেলসের নদীতে টনির লাশ ভাসছে। মুখে একটা আপেল গোঁজা।
–অ্যালেক্সের মতো সুন্দর পুরুষ আমার জীবনে কখনও আসেনি। এটাই হল তার শেষতম উপলব্ধি। অ্যালেক্সকে দেখতে সত্যিই ভালো। সব সময়ে দামী পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। দামী গাড়ি ব্যবহার করে। কিন্তু রোমান্স যখন ফুরোল, তার আগেই অ্যালেক্সের টাকা ফুরিয়ে গেছে।
একটির পর একটি পুরুষ, কখনও নিক–কখনও রবিকখনও জন–অথবা রেমন্ড
-জিন, আমার বাচ্চা হবে। বাচ্চার বাবা বোধহয় লিওনার্ড।
লিওনার্ড এখন কোথায়?
–কোথায় যেন–ওসাহা অথবা ওকিনাওয়া। আমার ভূগোলে জ্ঞান কম।
–এখন কী হবে?
–কেন? আমি মা হব।
সুপার মার্কেটে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে হারিয়েটের চিঠিটা হাতে পেল, জিল।
–জিল, আমি হোপেকেনে আমার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। আলোর দিকে মুখ ফিরিয়েছে জিল ক্যাসল। তীব্র আলোতে সে কিছুই দেখতে পায় না। ওষুধের প্রভাবে তার চেতনাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। সে ডেভিউকে ভালোবাসে। আলো-উজ্জ্বল আলো আর ভালো লাগছে না। গোপন ত্রিকোণের নিরালা গভীরে অবিরল ঝরছে কামনার মধু, মনে হচ্ছে তার, সমস্ত শরীরে সেই মধু ছড়িয়ে পড়ছে। জিল ক্যাসল স্বপ্ন দেখছে, ডেভিড তাকে বিয়ে করেছে আজ তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত।
কামনার অশ্লেষে সে বলে-ডেভিড।
চোখ খুলে দেখে নগ্ন দেহের এক মেক্সিকান পুরুষ তার দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসছে। সে আহত আর্তনাদে জানতে চায়-ডেভিড কোথায়? কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। সে চোখ বন্ধ করে। মেক্সিকান পুরুষ আবার তার শরীরে কামনার, সুর জাগিয়ে দিয়েছে।
তার নগ্ন শীরের দিকে তাকিয়ে আছে দুদুটো পুরুষ।
পর্নোফিল্মের পরিচালক টের্যাগলিও বলছিল–মেয়েটা মরে ঝামেলা বাঁধাবে না তো?
অ্যালেন বলেছেনা। ঠাসা মাল জোগাড় করেছ তুমি। এই মেয়েটা দারুণ। এ পর্যন্ত যতগুলো মেয়েছেলে জোগাড় করা হয়েছে তার মধ্যে এ সবথেকে ভালো দেখতে।
-শুনে সুখী হলাম, অ্যালেন হাত বাড়াল। তার হাতে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক তুলে দিয়ে টের্যাগলিও বলে–এক্সমাসে ডিনারে এসো। আমার বউ স্টেলা খুশী হবে।
সম্ভব হবে না। ক্রিস্টমাসে আমি ফ্লোরিডাতে যাব। বউ-ছেলেমেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
এই পর্ণোফিল্মটা দারুণ হবে। এই মেয়েটার নাম কি দেখানো হবে?
–আসলে নামটাই ব্যবহার করো। নামটা জোসেফাইন জিনস্কি। ওডেসায় যখন পর্ণোফিল্মটা দেখানো হবে, ওরা বন্ধুরা খুবই মজা পাবে।
.
০৩.
সবাই মিথ্যে বলে। সময়ে সমস্ত ক্ষতের উপশম করতে পারে না। সময় বন্ধ নয়। সময় এমন এক শত্রু যে, যৌবনকে ক্রমাগত আঘাত করে। শেষঅব্দি যৌবনকে হত্যা করে। প্রত্যেক বছর হলিউডে কত উজ্জ্বল মুখের তরুণ-তরুণীরা আসে। তাদের মনের গভীর গোপনে এক টুকরো স্বপ্ন, তারা একদিন নামকরা স্টার হবে। এবং জিলের বয়স বাড়ে।
১৯৬৪। দেখতে দেখতে জিল এখন পঁচিশ বছরে পৌঁছে গেছে। পর্নোফিল্মের সেই বিকৃত অভিজ্ঞতার পর ফিল্ম জগত সম্পর্কে তার একটা ভয় জেগেছিল। সে ভেবেছিল, হয়তো আর কোনো দিন তাকে রূপালী পর্দায় মুখ দেখানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই সেই ভয়টা কেটে গেল। সে বুঝতে পারল, এটা এক অদ্ভুত জগত। এখানে সবসময় আলো-আঁধারির খেলা চলতে থাকে।
জীবিকার জন্য কী না করেছে জিল? কখনও হয়েছে কোনো এক চুঁদে আইনবিশারদের সেক্রেটারী, কখনও টুরিস্ট কোম্পানির রিসেপশনিস্ট, কখনও হোটেলের রাঁধুনি, ছোটোখাটো পত্রিকার মডেল থেকে শুরু করে ওয়েট্রেস অথবা টেলিফোন অপারেটর। এমন কী সেলস গার্লের কাজ পর্যন্ত তাকে করতে হয়েছে। এখন এসব কোনো কিছু করতে তার ভালো লাগে না। এখন সে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করে কবে চিত্রতারকা হবার সুযোগ আসবে। কবে ডাক আসবে।
কিন্তু সেই ডাক আর আসে না। মাঝে মধ্যে অবশ্য তাকে ডেকে নেওয়া হয়। দু একটা লাইন সংলাপ বলার মতো ছোট্ট ভূমিকা আর কিছু নয়। বয়স বাড়ছে, যৌবনের উন্মাদনা এবার কি শেষ হবে? সাফল্য আসবে কবে?
টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স-এর তরুণ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর ফ্রেড ক্যাপার যখন প্রস্তাব দিল, জিল তার সঙ্গে সহবাসে রাজী হলে ফিল্মে চান্স পাবে, জিল না বলতে পারেনি।
ফ্রেড ক্যাপার বলল–ডাবিং রুমে চলো।
ছোট্ট ঘর। সাউন্ড প্রুফ। একটা কৌচ পর্যন্ত নেই।
ফ্রেড বলল–কুড়ি মিনিট সময় পাবে। সুইট হার্ট, এরই মধ্যে পোশাক খুলে সবকিছু শেষ করে আবার পোশাক পরতে হবে।
জিলের মনে হল, ওর সঙ্গে একটা বাজারি বেশ্যার মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। মনে মনে ঘেন্না হল, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। ও পোশাক, ব্রা, প্যান্ট–সব কিছু খুলে নগ্ন হল।
ফ্রেড কিছুই খুলল না। শুধু প্যান্টের চেন ঢিলে করে দিল। তখন যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল জিলের। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না।
ফ্রেড ক্যাপার বলল–সুইট হার্ট, তোমার তুলনা হয় না। মেয়েরা যন্ত্রণায় চিৎকার করলে আমার কামনার পারদ মাত্রা চড়চড় করে বাড়তে থাকে। তোমার গোপন অঙ্গ থেকে রক্ত পড়ছে বুঝি? পরিষ্কার করে নাও। তারপর বারো নম্বর স্টেজে এসো। আজ বিকেলেই কাজের সুযোগ পাবে।
ওয়ার্নার ব্রাদার্স, প্যারামাউন্ট, এম. জি. এম., ইউনিভারস্যাল, কলম্বিয়া, ফক্স-সব জায়গাতেই জিল শরীর দিয়েছে আর সুযোগ পেয়েছে।
শুধু ওয়াল্ট ডিজনীর স্টুডিও ছাড়া, কেননা সেখানে সেক্সের কোনো আলাদা চাহিদা নেই।
সবাই কী চায়? চায় জিলের নগ্ন শরীর, কাস্টিং এজেন্ট থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর, ডাইরেক্টর থেকে প্রোডিউসার–সবাই এক ঘরের বাসিন্দা।
তার বিনিময়ে জিল কী পায়? টিভিতে ছোটো ছোটো পার্ট আর-মনের ভেতর ঘৃণা ও তিক্ততা।
একদিন সে এইসব অন্যায় অবিচারের প্রতিশোধ নেবে–মনে মনে একটাই উচ্চারণ করে জিল।
.
১৯৬৯ সালে জিলের মায়ের মৃত্যু হল। শেষ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওডেসাতে গেল সে।
ডেভিড বলল–হ্যালো জোসেফাইন, আজ রাতে হ্রদের ধারে আমাদের দেখা হবে কেমন?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ সিসি পোশাক ছাড়ছে। এই নগ্ন শরীর অনেকে উপভোগ করেছে। গলফের কোর্স থেকে স্কি-টিচার, ফ্লাইট ইনস্ট্রাক্টর–সকলে। কিন্তু ডেভিড আজকাল তার স্ত্রীর সঙ্গে শোয় না।
সিসি, আমি জোসেফাইনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ডেভিড বলতে থাকল– ও রাজী হলে আমি ওকে বিয়ে করব। আমি ডিভোর্স চাইছি।
ম্যাসেরাটি গাড়িতে উঠল সিসি। স্পিড বাড়িয়ে দিল একশো দশ কিলোমিটারে। ডেভিডের রোলস ওকে ধরতে পারে না। সিসির গাড়িটা উল্টে যায়, তার অচেতন শরীরটা ডেভিড গাড়ি থেকে বের করে আনে। রাত দুটোর সময় অপারেটিং রুম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন–সিসি বাঁচবে।
সমস্ত রাত হ্রদের ধারে একা একা অপেক্ষা করেছিল জোসেফাইন। দেখছিল, নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে তারার খেলা। সকালে রোদ ফুটতে সে হলিউডের উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিল। ডেভিড কেন এল না, জানতে চাইল না। সে জানে, জীবনটা এই রকম।
.
টবি টেম্পল শো-এর কাস্টিং ডাইরেক্টর এডি বেরিগান বিবাহিত পুরুষ। তবে বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে সে নিয়মিত যায়। অন্তত সপ্তাহে তিনদিন। অন্য মেয়েদের ভোগ করে।
সেক্সি বলে নাম হয়েছে জিল ক্যাসলের।
এডি বলল–এটা তোমার স্ক্রিপ্ট। কাল সকাল দশটা থেকে রিহার্সাল শুরু হবে।
ধন্যবাদ।
–বিকেলে এসো। দ্যা অ্যালারটন, আমার বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্ট।
–আমি চিনি।
সিক্স ডি, বেলা তিনটেতে এসো।
সেদিন বিকেলে জিলের নগ্ন শরীর ভোগ করল এডি। পরদিন সকালে রিহার্সাল শুরু হবে। টবি টেম্পল রিহার্সালে আসেনি।
শনিবার শো শেষ হল। ক্লিফটন লরেন্স এবং দুজন পুরোনো দিনের কমেডিয়ানের সঙ্গে টবি রাজকীয় মেজাজে স্টুডিওতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শো-এর সব মেয়ের সঙ্গে টবি শুয়েছে। শুধু বাদ আছে জিল।
শো শেষ হবার পর টবি বলেছিল–ক্লিফ, মেয়েটা সুন্দরী। আমার সঙ্গে নৈশভোজ খাবে। ব্যবস্থা করো।
এখন টবি হল আসল রাজা। ক্লিফটন লরেন্স এখন প্রজার ভূমিকাতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছে।
ড্রেসিংরুমে ক্লিফ জিলকে বলল–মিস্টার টেম্পল তোমাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
-ওকে বলুন, আমি ক্লান্ত।
জিল জানে, টবির সঙ্গে শোয়ার চাইতে কোনো কাস্টিং ডাইরেক্টরের সঙ্গে শুলে নিয়মিত অভিনয়ের সুযোগ আসবে।
এডি বেরিগানকে টবি বলল–ওই মেয়েটা, জিল ক্যাসেলকে শোয়ে আবার চান্স দাও।
এডি ওকে ফোন করল। জিল বলল–আমি ইউনিভারসাল স্টুডিওতে ফিল্ম রোল পেয়েছি।
শেষ অব্দি টবি নিজেই জিলকে ফোন করে বলল–হ্যালো জিল, শনিবার আমার সঙ্গে তুমি কি ডিনার খাবে?
-সরি, মিস্টার টেম্পল। আমার অন্য কাজ আছে। জিল নিস্পৃহ কণ্ঠস্বরে উত্তর দিল।
তার এই কথা শুনে টবি খুবই চটে গেছে। ছোটোখাটো রোলে অভিনয় করছে, তার এত অহংকার?
এডিকে ডেকে পাঠাল টবি। –জিল ক্যাসল কার সঙ্গে শোয়?
-না, ওর কোন নির্দিষ্ট বয়ফ্রেন্ড নেই। তাড়াতাড়ি এডি বলল। জিল, এডিকে বেশী পছন্দ করে, টবির কাছে সেই সত্যটা সে জানাতে চায় না।
–ওঃ আই সী। তার মানে মেয়েটা একেবারে অন্য ধরনের তাই তো? টবি নরম গলায় জানতে চাইল।
.
হিলক্রেস্ট কান্ট্রি ক্লাব। ডিনারের আসর, টবি ক্লিফটন লরেন্সকে বলে-জিল ক্যাসল নামে মেয়েটা আমাকে কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছে না। কী করা যায় বলো তো?
–ও অভিনয়ে সুযোগ চাইছে। ওর মনের ভেতর উচ্চ আশা আছে। তোমার বাড়িতে প্রোডিউসার, ডাইরেক্টর, স্টুডিও হেডদের ডাকো। পার্টি দাও। তা হলে ও নিজেই আসবে।
আবার জিলকে ফোন করে টবি হ্যালো জিল, বুধবার রাতে আমার পার্টিতে প্যান প্যাসিফিকের স্যাম উইনটার্স আর অন্যান্য সব স্টুডিওর হেডরা আসবেন। তুমি এদের সঙ্গে দেখা করতে চাও কি? তোমার কি সময় হবে?
ওধারে একটু চুপচাপ। কোনো শব্দ নেই। শেষ অব্দি জিলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল–বুধবার রাতে? না, আমার কোনো কাজ নেই। আমি যাব।
অর্কেস্ট্রার বাজনা, অপারেশন সাকসেসফুল। শ্যাম্পেনের গ্লাস, ফেনিল উচ্ছ্বলতা।
জিল সদা রেশমের পোশাক পরে এসেছে। চুলের স্টাইলের ব্যাপারে ও খুবই যত্ন নিয়েছে। টবি ফিল্ম জগতের নানা মানুষদের সঙ্গে জিলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
সে বারবার বলছে–জিল ক্যাসল, খুব ভালো অভিনেত্রী, ওকে চান্স দিলে তোমার ছবিটা হিট হবে একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
স্যামের কাছে একই অনুরোধ করল সে।
স্যাম বলল–তোমার কথাটা মনে রাখব।
ডিনারে অতিথিদের কথাবার্তা শুনছে জিল
–বড়ো ফিল্ম ফ্লপ হলে স্টুডিওটা একেবারে খতম হয়ে যায়। ক্লিওপেট্রা ফিল্মটা চলতে কিন্তু তার ওপর টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স-এর ভাগ্য নির্ভর করছে।
বিলি ওয়াইল্ডারের নতুন ফিল্মটা দারুণ। তুমি রাশ দেখেছ?
–আমি গ্রেগরি পেককে একটা রহস্য ফিল্মের চিত্রনাট্য দিয়েছি। ও রোল নেবে কিনা দু-একদিনের মধ্যে জানতে পারব।
এবং এখানেই…টেবিলের এক প্রান্তে সেই বিখ্যাত প্রয়োজক, যে জিলের সঙ্গে দেখা করতে রাজী হয়নি। বিখ্যাত কমেডি ডাইরেক্টর যে জিলকে ইন্টারভিউ দেয়নি। এবং স্যাম উইনটার্স, যে জিলের টেলিগ্রাম পেয়েও তার টিভি শো দেখেনি।
একদিন-একদিন আমারও দিন আসবে। আমি এসব অপমানের বদলা নেব।
–জিল, আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি? টবি জানতে চাইল।
-না, ধন্যবাদ, আমার গাড়ি আছে। আজকের পার্টির জন্য তোমাকে আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি, টবি।
টবি তার এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্সকে বলল–আমি ভেবেছিলাম, ওকে ডিনার খাইয়ে একশো ডলার খরচ করব। চ্যাশেন কিংবা পেরিনোতে খাওয়াব। অথবা ডারবীতে। ও আমাকে নিয়ে গেল লস এঞ্জেলস-এর ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁতে। কত খরচ হল জানো? দু-ডলার চল্লিশ সেন্ট। ডিনারের পর আমরা সমুদ্রের ধারে হাঁটছিলাম। ওকে আমি বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ও আমায় চুমু খেয়ে বিদায় জানাল। এমন অদ্ভুত স্বভাবের মেয়ে আমি কখনও দেখিনি।
আর একদিন
ক্লিফ, ওকে আমি তিন হাজার ডলার দামের হীরের ব্রেসলেট উপহার পাঠিয়ে ছিলাম। ও ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। সত্যি, এমন মেয়ে সহজে চোখে পড়ে না।
স্যাম উইনটার্সকে টবি বলল–তোমার নতুন ফিল্মে জিলকে চান্স দাও।
খুব যত্ন করে স্যাম টেস্ট নিল। সেরা ক্যামেরাম্যানকে ডেকে পাঠাল। নামকরা পরিচালকেরও ডাক পড়ল।
পরের দিন শটগুলো জেনে স্যাম টবিকে বলল–দেখতে ভালো, ডায়লগ বলতে পারে। ছোটাখাটো চরিত্রে চান্স দিতে পারি। কিন্তু জিল কোনোদিন নায়িকা হতে পারবে না।
সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারে এই খবরটা শোনাল টবি। খবর শুনে জিল একেবারে ভেঙে পড়েছে। তার অনেক দিনের স্বপ্ন সে নায়িকা হবে। প্রেক্ষাপটের সমস্ত আলো তার ওপর পড়বে।
টবি বললহনি মন খারাপ করো না। স্যাম কিছু জানে না।
কিন্তু জিল জানে। স্যাম ঠিকই বলেছে। জিল কোনোদিন নায়িকা হবে না। জিল ফুঁপিয়ে কাঁদে। ব্যর্থতার ইতিহাস বলে যায় জিল। শুধু দেশঘটিত নোংরামির কথা বলে না।
রুমাল দিয়ে তার কান্না মুছিয়ে টবি বলে–শোনো আমার বাবা ছিল কসাই। আমি কী ভাবে বড়ো হয়েছি বলে তো?
সেই রাতে টবির অনেকদিনের স্বপ্ন সফল হল। জিলের শরীরে শরীর মেলাল সে।
রাত শেষ হলে টবি বলেছিল–তোমাকে আমি বিয়ে করব, জিল!
.
০৪.
এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স জিলের সঙ্গে দেখা করল।
সে বলল টবি যদি জানতে পারে হলিউডের সবাই তোমার শরীরের স্বাদ গ্রহণ করেছে, তা হলে কী হবে বলো তো? এই নাও পাঁচ হাজার ডলার, তুমি এখনই হলিউড থেকে বেরিয়ে যাও।
চুপচাপ কোনো কথা না বলে অফিস থেকে জিল বেরিয়ে গেল।
অটোমোবাইল অ্যাকসিডেন্টে সিসির মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ডেভিড তাকে পৃথিবীর সেরা প্লাস্টিক সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিল। উনি ব্রাজিলে থাকেন।
একটু আগে সিসির ফোন এসেছে–ডেভিড, আমি আর ফিরব না। এখানকার এক ছোট্ট বাগিচার মালিকের সঙ্গে আমরা আলাপ হয়েছে। তাকে দেখতে ঠিক তোমার মতো। কিন্তু তোমার সঙ্গে অনেক তফাত আছে। সে আমাকে ভালোবাসে আর তুমি আমায় ঘৃণা করো।
ডেভিডের লিয়র জেটবিমান লস এঞ্জেলসের দিকে চলেছে। সেখানে জিল আছে। তার ভালোবাসার মেয়ে। এয়ারপোর্টে খবরের কাগজের হেড লাইনটা দেখতে পেল ডেভিড। সেখানে লেখা আছে–টবি টেম্পল জিল ক্যাসলকে বিয়ে করেছে।
এয়ারপোর্টের বারে ঢুকল ডেভিড। তিনদিন পরে তার প্লেন টেক্সাসে ফিরে গেল।
টবি টেম্পল আর জিল ক্যাসলের হানিমুন। মেক্সিকোর ভিলা। চারপাশে ক্যাকটাস। রঙিন বুগেনভেলিয়া। পাখিদের কলকাকলি। সমুদ্রের বুকে প্রমোদ তরণী ভাসিয়ে দেওয়া।
মেক্সিকো থেকে বিয়ারিজবুল ফাইট দেখা, জুয়া খেলা আর অলস দুপুরে মাছ ধরা, শরীর মেলানো।
তারপর মঁ ব্লাঁক।
তুষারে ঢাকা পাহাড়ের বুকে স্কি করা, কুকুরটানা স্লেজ গাড়িতে চড়া। আজ আর টবি নিঃসঙ্গ নয়। আজ সে সুখী।
তারপর হলিউডের দিনগুলো
আজ জিলের সময় এসেছে, প্রতিশোধের পালা এবার শুরু হবে। যারা তাকে সুয়োগ দেয়নি, দিনের পর দিন তাকে অবহেলা আর অসম্মান করেছে, তার শরীর নিয়ে রাঘবন্দী খেলা খেলেছে, তাদের ওপর শোধ নিতে হবে।
এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স চায়নি, টবিকে জিল বিয়ে করুক। তাই রেজিস্টার্ড চিঠিতে তাকে জানান হল, সে আর টবির এজেন্ট নয়।
.
রোজ, ড্যানিং
–ডার্লিং, আমি তখন এজেন্ট খুঁজছি। রোজ ড্যানিং-এর কাছে গেলাম। সে আমার উরুতে হাত দিয়ে খারাপ প্রস্তাব করল। আমি ছুটে পালিয়ে গেছি। মেয়েটা হোমো সেক্সচুয়াল।
দশদিন বাদে রোজ ড্যানিং-এর লাইসেন্স বাতিল হল।
–ডার্লিং টবি, তোমার প্রতিভা স্যাম উইনটার্স কিছুই বোঝে না।
অন্য সব স্টুডিওর সঙ্গে কনট্র্যাক্ট সই করল টবি।
পার্টি, প্রিমিয়র, চ্যারিটি আর ডিনার। জিল টবিকে সারাদিন ব্যস্ত রাখে। টবির মনে হয়ে, সে বড়ো ক্লান্ত।
ক্যানের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। টবি টেম্পলকে স্পেশ্যাল অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হচ্ছে। ঘোষণা শেষ হয়ে গেছে। তখনও টবি সিটে বসে আছে।
জিল বলে–ওঠো।
টবি ওঠে। সামনের দিকে এগোতে চায়। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
এবং ডাক্তার দুকলস্ বলেন–মিসেস টেম্পল, আপনার স্বামীর স্ট্রোক হয়েছে। উনি আর কোনোদিন চলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। কথা বলার ক্ষমতা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে।
.
০৫.
দুটো হাত, দুটো পা নাড়তে পারছে না টবি।
কথা বলতে পারছে না। বেশ বোঝা যাচ্ছে, কিছু বলতে চাইছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে অসহায় আকুতিতে।
প্রেস ফটোগ্রাফার থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত ফোন করেছেন। সিনেটররা বারবার ফোন করে টবির শরীরের অবস্থা জানতে চাইছেন। ফ্যানরা চিঠি লিখছে।
দুজন নিওরোলোজিস্ট নিয়ম করে তাকে দেখছে। তিনজন নার্স রাখা হয়েছে। ফিজিও থেরাপিস্টদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
জিল টবিকে আশ্বাস দিয়ে বলল–তুমি বাঁচবে, তুমি হাঁটবে। তুমি আবার কথা বলবে।
টবি, আমি তোমার। আমরা আবার শরীরে শরীর মেলাব।
টবি, ঠোঁট নাড়াও। কথা বলার চেষ্টা করো।
টবি, তোমার ফ্যানরা তোমাকে দেখতে চায়।
টবি, তুমি টবি টেম্পল, সবাই তোমায় ভালোবাসে। তোমায় ভালো হতেই হবে। স্পিচ থেরাপি। সুইমিং পুলে ফিজিওথেরাপি।
একদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেল জিলের। জিল দেখল, টবি লাঠি হাত উঠে দাঁড়িয়েছে। কোনো রকমে বলছে–জি-ই-ই
হয়তো জিল কথাটা বলতে চাইছে সে। তার এই আপ্রাণ প্রয়াস দেখে জিল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
ডক্টর কাপলান বললেন–অবিশ্বাস্য! অলৌকিক!
জিল বলল–অলৌকিক।
ঈশ্বরবিহীন এই পৃথিবীতে অলৌকিক যা কিছু ঘটে, তা নিজের চেষ্টাতে হয়–জিল এই সরল সত্যটা জেনে গেছে।
স্যাম উইনটার্সকে ফোন করল জিল। স্যাম এল।
টবি টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল–হাই, স্যাম।
–জেসাস। তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
জিল বলল–স্যাম, টবি আবার কাজ শুরু করতে চায়।
–এখন কোন কাজ নেই। তবে কথাটা মনে রাখব।
টবির লাইফ ইনসিওর করতে কোনো সংস্থা রাজী হবে না। হলিউড তাকে আর সুযোগ দিতে পারবে না।
হানটিংটন হার্টফোর্ড থিয়েটারে টবির ওয়ান-ম্যান শো। সব ব্যবস্থা জিল করেছে। ও, হ্যানলন আর রেইনজার অনেক দিন বাদে স্ক্রিপ্ট লিখেছে। পরিচালক ডিক ল্যানড্রি। গান লিখেছে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী তিনজনের টিম।
আবার পাদপ্রদীপের তলায় দাঁড়াল সুপারস্টার টবি টেম্পল।
সে মজার মজার গল্প বলল, নাচ দেখাল, গান গাইল। সে মানুষকে হাসাল।
সুপারস্টার ফিরে এসেছে। প্রেসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। দর্শকের চিৎকার।
ওয়ান ম্যান শো। চিকাগো থেকে ওয়াশিংটন হয়ে নিউইয়র্ক।
আর্ট থিয়েটারে তার পুরোনো ফিল্ম দেখানো হচ্ছে।
টবির নামে পুতুল বেরিয়েছে। তার ছবি আঁকা টি-শার্ট বিক্রি হচ্ছে।
কফি, সিগারেট, টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে তার ছবি।
টিভিতে টবি টেম্পল উইক।
একটির পর একটি পার্টি, রিসেপশনের আসর। হোয়াইট হাউসে ডিনার। ওয়ান ম্যান শো।
লন্ডন থেকে প্যারিস এবং মস্কো।
প্রমোদ স্রোত ভাসছে, জলের দিকে তাকিয়ে আছে টবি।
–জিল, জলে ডুবে মরতে আমার ভীষণ ভয় করে।
–তুমি দুশ্চিন্তা করছ কেন?
–আমি মরতে চাই না। মৃত্যুকে আমার বড়ো ভয়। এখানে আমি টবি টেম্পল সবাই আমাকে চেনে। কিন্তু মরে গেলে? নরক কোথায় আছে আমি জানি না। সেখানে দর্শক নেই, শ্রোতা নেই। শুধু নিঃসঙ্গ জীবন।
টবির এজেন্ট ক্লিফটন লরেন্স আজ সর্বস্বান্ত। একজন লোকের মুখে জিল সম্বন্ধে কিছু গুজব শুনে সান্টা মনিকা বুলেভার্দে পর্ণো-ফিল্ম দেখতে গেছে ক্লিফটন।
পর্দায় ভেসে উঠল উলঙ্গ জিল ক্যাসলের যৌন সঙ্গমের ছবি। ক্রেডিট টাইটেলে তার নাম জোসেফাইন জিনস্কি। তিনশো ডলার দিয়ে একটা প্রিন্ট কিনল ক্লিফটন। সে জিলের ওপর প্রতিশোধ নেবে।
পরের দিন সকাল দশটা। টবি টেম্পলের বাড়িতে গিয়ে ক্লিফটন শুনল মিস্টার আর মিসেস টেম্পল এখন ইওরোপ পরিভ্রমণে চলে গেছেন।
.
০৬.
লন্ডন।
আরজিল স্ট্রিটে পুলিশ কর্ডন, শো দেখাচ্ছে টবি টেম্পল।
ব্রিটিশ সরকারকে ঠাট্টা করছে সে। ইংরাজদের মুখ গোমড়া। ভাবও বাদ দিচ্ছে না।
সবাই হাসল। এসব ঠাট্টা। টবিকে তারা সত্যি সত্যি ভালোবাসে।
প্যারিস।
শো শেষ হয়েছে এইমাত্র। হাজার মানুষের উন্মত্ত চিৎকার। টবি–টবি।
মস্কো।
বলশয় থিয়েটারে টবি মুকাভিনয় দেখাচ্ছে–হাসিতে ফেটে পড়ছে রাশিয়ান দর্শক।
জেনারেল ইউরি রোম্যানোভিচ বললেন–আমেরিকান ফিল্ম রাশিয়াতে খুব বেশী দেখানো হয় না। কিন্তু আপনার অভিনীত ফিল্মগুলো আমরা প্রায়ই দেখি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি। কমেডি এবং প্রতিভা কোনো দেশের সীমা মানে না।
জেনারেলের সঙ্গে টবি এবং জিল বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গোর্কি পার্ক থেকে সেন্ট বেসিলের গির্জা, মস্কো স্টেট সার্কাস। তারপর ভোজের আসরে জাকুশিবা, দুষ্প্রাপ্য ক্যাভিয়ের প্যাস্ট্রি আর আপেলের প্যাস্ট্রির সঙ্গে অ্যাপ্ৰিকটের সস। এই সুন্দর খাদ্যটির নাম ইয়বচনায়।
আরও বেড়ানো আরও খ্যাতি প্রতিপত্তি। আরও টাকা।
পুশকিন আর্ট মিউজিয়াম থেকে লেনিনের সমাধি। ছোটোদের খেলনার দোকান ডেটস্কিমির। এ্যামভস্কো স্ট্রিটের দোকান। যেখানে সাধারণ লোক প্রবেশের ছাড়পত্র পায় না। সারা পৃথিবী ঘুরে আসা দুর্মূল্য খাদ্যসম্ভার এখানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। স্পেশ্যাল পাশধারী রাশিয়ান আমলারা এখানে ঢুকতে পারে।
এইসব মানুষেরা এমন সব বিদেশী ফিল্ম দেখে, যা সাধারণ মানুষদের দেখতে দেওয়া হয় না।
অর্থাৎ জনগণের রাষ্ট্র রাশিয়াতে সব কিছু জনগণের জন্য নয়।
টবির মুখটা ফ্যাকাশে। সে বিশ্রাম নিতে চায়।
সন্ধ্যাবেলা একা একা বের হয় সে।
লবির প্রবেশ পথের মুখে…চেনা মানুষ জোসেফাইন বলে ডাকে।
কে ডাকে?
ডেভিড কেনিয়ন।
যাকে একদিন জিল ভালোবেসেছিল।
অথবা বলা যেতে পারে, যে একদিন ডেভিডের ভালোবাসা পেয়েছিল।
-তুমি মস্কোয়?
সরকারের তরফে খনিজ তেলের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি।
–সিসি কোথায়?
–ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি টবি টেম্পলের ফ্যান। ও সেরে উঠেছে বলে আমি দারুণ খুশী। হলিউডে ও লন্ডনে ওর প্রোগ্রাম দারুণ হয়েছে। আমি দেখেছি।
–আমার সঙ্গে দেখা করলে না কেন?
–তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি।
তারপর সবকথা বলে দেয় ডেভিড। কীভাবে চালাকি করে সিসি তাকে বিয়ে করেছিল। কীভাবে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
–আমি তোমায় এখনও ভালোবাসি জোসেফইন।
বলশয় থিয়েটারে টবির শো শেষ হয়ে গেছে। দর্শকরা শো শেষ হবার পর হাসছে।
টবি আজ বড়ো ক্লান্ত। পার্টিতে একাই গেল জিল।
রাত দুটোর সময় হোটেলে ফিরে সে দেখল, টবি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে, ডক্টর দুকলস বললেন
–আপনার স্বামীর সেরিব্রাল ভেনাস থ্রম্বসিস হয়েছে। উনি আর কোনদিন কথা বলতে পারবেন না। হাঁটতে পারবেন না। তবে মনটা সম্পূর্ণ সুস্থ।
কয়েক সপ্তাহ বাদে অসুস্থ অনড় স্বামীকে নিয়ে জিল বাড়ি ফিরল।
টবির চামড়া হলুদ। মাথার চুল দ্রুত উঠে যাচ্ছে। হাত-পা শুকিয়ে কাঠির মতো। তার মুখে অদ্ভুত একটা বিদ্রূপ মেশানো হাসি।
ডেভিড কেনিয়ন ফোন করে সহানুভূতি জানাল।
ডক্টর কাপলান বললেন–পক্ষাঘাত সারবে না। ঠিক মতো যত্ন নিলে উনি আরও কুড়ি বছর বাঁচবেন।
কুড়ি বছর? ততো দিন জিল কি টবির সঙ্গে বাঁধা থাকবে?
সে টবিকে ছেড়ে গেলে ডেভিড তাকে ঘেন্না করবে। আর যদি–আর যদি টবির মৃত্যু হয়?
.
০৭.
টবির চোখ দুটো বলছে, আমি মরতে চাই না।
জিল ভাবে, মারসিকিলিং? ইউথ্যানাসিয়া? যেসব রোগী আর কোনো দিন ভালো হবে না, তাদের এইভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেওয়াই তো ভালো। অনেক ডাক্তারও এই মত বিশ্বাস করেন। কিন্তু আইন এটাকে এখনও পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়নি। আইনের চোখে এটা মার্ডার বা হত্যা।
মস্ত বড়ো বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে টবি। তার চোখ দুটো আবার বলে–আমাকে বাঁচতে দাও।
জিল বলে ওঠে–তুমি আর কোনো দিন ভালো হবে না টবি। তোমার এখন মরে যাওয়াই ভালো।
টবি বুঝতে পারে সব কিছু। কিন্তু কথা বলতে পারে না। তার চোখে ফুটে ওঠে সন্ত্রস্ত বিপন্নতা।
ওয়াশিংটন থেকে ডেভিডের ফোন।
-কেমন আছো?
–আমি তোমায় ভালোবাসি ডেভিড।
হুইলচেয়ারে টবি টেম্পল। তার চোখ থেকে ঘৃণা ঝরে পড়ছে।
রাতে বিছানায় শুয়ে জিল হুইলচেয়ারে কাঁচ ক্যাচ শব্দ শোনে। অসম্ভব, লোকটা বিছানাতে শুয়ে আছে। পক্ষাঘাত হয়েছে তার। অনড়, অচল এক পুরুষ। নাঃ তার সঙ্গে আর কোনো দিন শরীরের খেলা খেলতে পারবে না জিল।
সকালে ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিল–টবি কি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে?
না, অসম্ভব।
যদি ওর মন চায়?
–সাইকোকাইনেসিস? অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, প্রশ্ন পাওয়া যায়নি।
জিলের মাথায় এখন আবার সেই অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
টবির চোখ চাইছে, আরও কিছুদিন জীবনকে ভোগ করতে। এখনও সেখানে উত্তেজনার ছোঁয়া।
জিল চাইছে, টবি যেন এখনই মরে যায়। টবিও হয়তো মনে মনে জিলের মৃত্যু কামনা করছে।
শেষ অব্দি নার্সকে বিদায় দিল জিল।
ওর গাড়ির শব্দ দূরে যেতেই সে টবির অনড় রোগা শরীরটা হুইল চেয়ারে তুলল। স্ট্র্যাপ বাঁধল। সুইমিং পুলের ধারে গেল। সমস্ত শক্তিকে এক করে হুইল চেয়ারটা জলের ভেতর ঠেলে দিল।
টবির চোখে মুখে আতঙ্ক।
হায় ঈশ্বর, সিমেন্টের কিনারায় আটকে গেল চাকা।
যেন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে টবি চেয়ারটা ঠেকিয়ে রেখেছে।
–আমি মরতে চাই না। দোহাই, আমাকে বাঁচতে দাও। টবির চোখ দুটো বলছিল।
এবার জিলকে আরও নির্মম আর হৃদয়হীন হতে হয়। সে জোরে ধাক্কা দিল। হুইলচেয়ার জলের ভেতর ডুবে গেল।
.
ইনকোয়েস্ট।
ডাক্তার কাপলান বলছিলেন স্বামীর প্রতি মিসেস টেম্পলের ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। পক্ষঘাতগ্রস্ত স্বামীকে গতবার একবার নিজের চেষ্টায় উনি সারিয়ে তুলেছিলেন।
জিল বলল–আমি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। ব্রেক খুলে হাত ফসকে…আমি টবিকে সারিয়ে তুলতেই চেয়েছিলাম। আমি তার মৃত্যুর কারণ।
জুরিরা রায় দিলেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
শুধু ক্লিফটন লরেন্স বুঝতে পারল–জিল টবিকে খুন করেছে।
.
০৮.
হলিউড রিপোর্টার এবং ডেইলি ভ্যারাইটি জানাচ্ছে–জিল টেম্পলের সঙ্গে ডেভিড কেনিয়নের বিয়ে হবে।
জাহাজের ডেকে ওদের বিয়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। জিল পৌঁছে গেছে সাজানো গোছানো কেবিনে।
জাহাজের অফিসার বললেন মিস্টার কেনিয়ন একটু পরেই আসবেন।
ধন্যবাদ।
আর কুড়ি মিনিট পর জাহাজ ছাড়বে।
সিলভার শ্যাডো গাড়িটা জেটির মুখে থামল।
ডেভিড জাহাজে উঠল।
হঠাৎ কে যেন বলল মিস্টার কেনিয়ন?
–আপনি?
–জিলের পুরোনো বন্ধু। আমার নাম ক্লিফটন লরেন্স। আপনি কি একটু এদিকে আসবেন?
প্রোজেকশনিস্ট অনুপস্থিত। তাকে দশ ডলার ঘুষ দেওয়া হয়েছে। ক্লিফটন ফিল্ম চালু । করেছে। ডেভিড দেখছে।
তরুণী জিলের নগ্ন শরীর, পুরুষের পর পুরুষের সঙ্গে দেহমিলন, মেক্সিকান পুরুষ জিলের শরীরে শরীর মেলাচ্ছে। ডেভিড যেন উন্মাদ হয়ে যায়।
মনে পড়ে গেল তার, মেস্কিকান মালীকে বোন বেথের সঙ্গে যৌনসঙ্গমরত অবস্থায় দেখে লোকটাকে সে খুন করেছিল। পরে তার বোন পাগল হয়ে যায়।
ক্লিফটনের মুখে দুম করে একটা ঘুষি মারল ডেভিড। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। রক্তাক্ত, মুখে বরফ লাগাল ক্লিফ। আঃ, ঠোঁটের কোণে টুকরো হাসির ছবি। এতদিন পর ষড়যন্ত্রটা সফল হয়েছে। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বিয়ের কেকটা দেখল। কেকের ওপর বর কনের মূর্তি দুটো অসহ্য বলে মনে হল তার। কনের মাথাটা সে মুচড়ে ভেঙে দিল।
কেবিনের দরজায় কার হাতের শব্দ?
দরজা খুলল জিল।
–হ্যালো জিল, ডেভিড চলে গেছে, ও আর ফিরবে না। তোমার পর্নো ফিল্ম আমি ওকে দেখিয়েছি। এই আমার প্রতিশোধ। বিদায় জোসেফাইন জিনস্কি। এ জীবনে আর কখনও তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।
রক্তাক্ত মুখটা রুমালে ঢেকে ক্লিফটন বোট ডেকে নেমে গেল। জাহাজের ক্যাপ্টেন দেসাদকে বললেন–ফিটার কেনিয়ন জাহাজ থেকে নৌকোয় নেমে গেলেন। মিসেস টেম্পল এখনো তার কেবিনে। বিয়ের সব ব্যবস্থা হয়ে শেষে এই হল?
জানি না, আমেরিকানরা হয়তো এইরকমই হয়ে থাকে।
.
রাত দুটো। জাহাজে কেউ কোথাও নেই। জিল একা। মাথায় যন্ত্রণা। সে এক দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। টবির অশরীরী মুখ হাসছে। টবির কণ্ঠস্বর বলছে–আমি একটু বাঁচতে চাই, জিল। তুমি আমাকে এভাবে মেরো না। আরও বলছে সে, এখানে এসো, আমার কাছে এসো। এখানে আরাম করো।
চোখ বুজে ঝাঁপ দিল জিল। রাতের হাওয়া বরফের মতো হিম। হওয়ায় ভেসে যায় তার শরীর। টবির মুখ কাছাকাছি আসতে চায়। পক্ষাঘাত গ্রস্ত দুটি হাত বাড়িয়ে সে জিলকে ধরতে চায়। এবার থেকে তারা একসঙ্গে থাকবে। কোনো লোভ বা প্রতিহিংসা এসে তাদের আলাদা করতে পারবে না।
রাতের হাওয়া বইছিল।
চারপাশে অসীম অনন্ত সমুদ্র। আকাশের তারারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
আকাশ-যেখানে একদিন এইসব ভালোবাসা আর ঘৃণার গল্প-কথা লেখা হয়েছিল।