স্বাধীনতার স্বরূপ

স্বাধীনতার স্বরূপ (১৮৭৯/১৯৫৭)

স্বাধীন আর পরাধীন দেশের প্রভেদ কি? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলবেন, দেশের লোকেই যেখানে শাসন করে সে দেশ স্বাধীন, বিদেশী যেখানে শাসন করে তা পরাধীন। কিন্তু এত সহজে প্রশ্নটির মীমাংসা হয় না। দেশের কত জন স্বাধীন, কতটা স্বাধীন, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে স্বাধীন, ইত্যাদি নানা বিষয় বিচার করা দরকার।

স্বাধীনতার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ–নিজের ইচ্ছায় চলবার অর্থাৎ যা ইচ্ছা তাই করবার ক্ষমতা। এ রকম নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কোনও দেশের কোনও লোকের নেই, সর্বশক্তিমান ডিকটেটরেরও নেই। সকল রাষ্ট্রেই নাবালক, পাগল, জেলখানার কয়েদী ইত্যাদির স্বাধীনতা অল্প। প্রাচীন স্বাধীন ভারতে স্ত্রী আর শূদ্রের অনেক অধিকার ছিল না, ব্রাহ্মণ গুরু পাপে লঘু দণ্ড পেত, কিন্তু অব্রাহ্মণ নিষ্কৃতি পেত না। কমিউনিস্ট দেশের প্রজার স্বাধীনতা অতি সীমাবদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যাগুরু অশ্বেতজাতির অনেক অধিকার নেই। বিলাতে ১৯২০ সালের আগে রোমান ক্যাথলিক প্রজার পূর্ণ অধিকার ছিল না, ১৯১৮ সালের আগে মেয়েদের ভোট ছিল না। ব্রিটিশ আমলে ভারতের প্রজা বিনা বাধায় প্রচুর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হতে পারত, কিন্তু সমাজতন্ত্রী স্বাধীন ভারতে সেই অধিকার সংকুচিত হয়েছে। বর্তমান ব্রিটিশ এবং আরও অনেক ইওরোপীয় রাষ্ট্রের অবস্থাও এই রকম। মোট কথা, প্রজার পক্ষে স্বাধীন আর পরাধীন দুই দশাই আপেক্ষিক বা relative

আমরা বলে থাকি, তুর্ক জাতি অর্থাৎ পাঠান-মোগল কর্তৃক ভারত বিজয়ের পর থেকে ১৯৪৭ সালের অগস্ট পর্যন্ত মোটামুটি ৭০০ বৎসর ভারত পরাধীন ছিল। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, মুসলমান বিজেতারা ভারতে স্থায়ী ভাবে বসতি করেছিল এবং এদেশের বিস্তর লোক মুসলমান হয়ে বিজেতাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, এই কারণে বাদশা-নবাবদের বিদেশী বলা ঠিক নয়, তাদের রাজত্বকালে ভারত পরাধীন ছিল এ কথাও বলা চলে না। এঁদের যুক্তি অনুসারে কেবল ব্রিটিশ অধিকারেই ভারত পরাধীন ছিল। এ দেশের মুসলমানরাও মনে করে, বাদশাহী আর নবাবী আমলে তাদের স্বাধীনতার হানি হয় নি।

আলোচ্য বিষয়টি কি রকম জটিল তা আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাস থেকে জানা যাবে। ১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দে নরমান্ডির ডিউক উইলিয়ম যখন ইংলান্ড আক্রমণ করে জয়ী হন তখন ইংরেজ জাতি নিশ্চয় পরাধীন হয়েছিল। তার পর শতাধিক বৎসর নরমান অভিজাত বর্গের সর্বময় কর্তৃত্বের সময় দেশের অধিবাসী অ্যাংলোস্যাকসনরা অধীনতার দুঃখ ভাল করেই ভোগ করেছিল। কিন্তু সেই পরাধীন দশা ক্রমে ক্রমে আপনিই বিলীন হয়ে গেল। বিজেতা আর বিজিতদের মধ্যে ভাষাগত ভেদ ছিল, কিন্তু বর্ণগত ধর্মগত আর আচারগত ভেদ ছিল না, সেজন্য নরমান আর অ্যাংলোস্যাকসন শীঘ্রই সম্পূর্ণভাবে মিশে গেল। সুতরাং এ কথা বলা চলে যে নরমান বিজয়ের পর ইংলান্ড দু-এক শ বৎসর মাত্র পরাধীন ছিল।

সপ্তম শতাব্দে ইসলামের উৎপত্তির সময় মিসর পারস্য তাতার প্রভৃতি স্বাধীন ছিল, কিন্তু কয়েক শ বৎসরের মধ্যেই মুসলমান খলিফা এবং আরব যোদ্ধারা এই সব দেশ জয় করে করে নিজের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করেন। দেশের লোক বিজিত হল, কিন্তু ধর্মান্তরিত হয়ে বিজেতাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সাযুজ্য লাভ করল, তাদের পরাধীনতার কলঙ্ক আর রইল না।

মুসলমান বিজয়ের এইপ্রকার পরিণাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটলেও কয়েকটি দেশে ব্যতিক্রম দেখা গেছে। স্পেন, সিসিলি, বলকান প্রদেশের কতক অংশ আর ভারতবর্ষ বিজিত হয়েও পুরোপুরি ধর্মান্তরিত হয় নি। স্পেন সিসিলি ইত্যাদি কয়েক শ বৎসরের মধ্যেই বিজেতার কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল, কিন্তু ভারতবর্ষ তা পারে নি। কুবলাই খাঁ আর তার উত্তরাধিকারীরা অনেক বৎসর চীন দেশে রাজত্ব করেছিলেন এবং নিজেরাই বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

এ কালে ভারতে যে দেশাত্মবোধ আর সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে সেকালে তা ছিল না। ভারতবাসী বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত, আপকালেও তাদের ঐক্য ঘটে নি, আক্রামক জাতিদের মতন তারা যুদ্ধনিপুণ ছিল না, তাদের নীতি যভবিষ্য তদৃভবিষ্য। এই সব কারণে ভারত পরাধীন হয়েছিল। ভারতীয় প্রজা চিরকাল ঝাট পরিহার করেছে, ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে থেকে চিরাগত ধর্ম আর সমাজবিধি পালন করতে পারলেই কৃতার্থ হয়েছে, রাজা যেই হক তাতে তার বিশেষ আপত্তি ছিল না।

নরমান বিজয়ের পর ইংলান্ডের এবং মুসলমান বিজয়ের পর মিসর। পারস্য প্রভৃতির সর্বাঙ্গীণ পরাধীনতা ঘটেছিল এবং মিশ্রণের ফলে কয়েক শ বৎসরের মধ্যে তা তিরোহিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের পরাধীনতা আংশিক, অর্থাৎ শুধু রাজনীতিক, অত্যাচারিত হয়েও দেশের অধিকাংশ লোক তাদের ধর্মগত আর সমাজগত স্বাতন্ত্র রক্ষা করেছিল। বহুবর্ষব্যাপী নিশ্চেষ্টতার মধ্যেও ভারতবাসীর একটি বিষয়ে দৃঢ়তা ছিল, সে তার সহজং কর্ম (বা ধর্ম) সদোষমপি ত্যাগ করে নি। সমগ্র ভারত যদি পরধর্ম গ্রহণ করত তবে আমাদের পরাধীন দশার স্থিতি সাত শ বৎসর না হয়ে দু শ বৎসর গণ্য হত, অর্থাৎ শুধু ব্রিটিশ অধিকার কাল। সে ক্ষেত্রে সমস্ত মুসলমানের সঙ্গে সাজাত্য অনুভব করে কবি ইকবালের মতন আমরাও হৃত রাজ্যের জন্য বিলাপ করতাম–চীন হমারা, স্পেন হমারা।

অন্য বিষয়ে উদ্যমহীন হয়েও ভারতবাসী তার দৃঢ় স্বধর্মনিষ্ঠা কোথা থেকে পেয়েছে? কেউ কেউ বলবেন, এর মূলে আছে বর্ণাশ্রম ধর্ম। কিন্তু যথার্থ বর্ণাশ্রম আর চাতুর্বর্ণ বহুকাল আগেই লোপ পেয়েছে, তার স্থানে যা এসেছে তা জাতিভেদ বা casteism। এই শতমুখী ভেদবুদ্ধির এমন শক্তি থাকতে পারে না যার দ্বারা বিজেতার ধর্মকে বাধা দেওয়া যায়। ভারতবাসীর প্রকৃতিতে এক প্রকার প্রবল জাড্য বা inertia আছে, সে অজ্ঞাতসারে অনেক পরিবর্তন মেনে নেয় কিন্তু সজ্ঞানে তার নিষ্ঠা ত্যাগ করতে চায় না। হয়তো এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই বহিরাগত আঘাত প্রতিহত হয়েছিল। পেগান গ্রীস আর রোমের সংস্কৃতি প্রচুর ছিল, তথাপি সেখানকার লোকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছিল। ভারতের অসংখ্য ধর্মমত আর লোকাঁচারের মধ্যে এমন কিছু বলিষ্ঠ অবলম্বন আছে যার কাছে বিদেশীর প্রভাব হার মেনেছিল। ইতিহাসজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো তার সন্ধান পেয়েছেন।

আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। পাঁচ শ বৎসরের মুসলমান শাসনের ফলে ভারতবাসীর সংস্কৃতি অবশ্যই কিছু বদলেছে। কিন্তু তার চাইতে বহুগুণ বদলেছে দুশ বৎসরের ব্রিটিশ শাসনে। মুসলমান সংস্কৃতি থেকে গ্রহণযোগ্য বেশী কিছু আমরা পাই নি, কিন্তু ব্রিটিশ বা ইওরোপীয় সংস্কৃতি থেকে প্রচুর পেয়েছি। আমরা খ্রীষ্টীয় ধর্ম নেবার প্রয়োজন বোধ করি নি, কিন্তু ইওরোপীয় আচার কিছু কিছু আত্মসাৎ করেছি এবং সাগ্রহে পাশ্চাত্ত্য বিদ্যা বুদ্ধি ও ভাবধারা অজস্র পরিমাণে বরণ করে নিয়েছি।