সাহিত্য-সংস্কার

সাহিত্যসংস্কার (১৩৫৬/১৯৪৯)

সব দিকে শুভলক্ষণ দেখা যাইতেছে। হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ মিটিয়াছে, মিস মেয়ো অনুতাপে দগ্ধ হইতেছেন, স্টেটসম্যান বর্জন ও ইংলিশম্যানের অর্জন জোর চলিতেছে, রিফর্ম কমিশনও নিশ্চয় বয়কট হইবে। কিন্তু আসল কাজই বাকী রহিয়াছে–খুড়ার গঙ্গাযাত্রা।

সজ্ঞানে তীরস্থ করার উপযোগী খুড়া পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু বিস্তর লেখক আছেন, ছোট বড় মাঝারি,–তাদের দুরস্ত করাই এখন মস্ত কাজ। লেখকগণের নিজের চরিত্র সংশোধনের কথা বলিতেছি না। কিন্তু তাদের সৃষ্ট নায়ক-নায়িকার চরিত্র, তারা কি বলে কি করে, তাহা উপেক্ষার বিষয় নয়।

গীতায় ভগবান একটি খাঁটী কথা বলিয়া গেছেন-কিং কর্ম কিং অকর্মেতি কবয়োইপাত্র মোহিতাঃ–অর্থাৎ কি কর্ম আর কি অকর্ম সে বিষয়ে কবিদের কাণ্ডজ্ঞান নাই। এই কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে যে সব অনর্থ ঘটিয়াছে বা ঘটিতে পারে তার প্রতিকার আবশ্যক। আমাদের প্রথম কর্তব্য–বড় বড় লেখকগণ যা লিখিয়া ফেলিয়াছেন তার একটা গতি করা। দ্বিতীয় কর্তব্য– ভবিষ্যতে যাঁরা লিখিবেন তাদের জন্য একটি আদর্শ-নির্দেশ।

ছোট-খাটো লেখকগণ ধর্তব্য নন, কারণ তাদের লেখা কালক্রমে আপনিই মুছিয়া যাইবে। কিন্তু যাঁরা সম্রাট, তাদের লেখা আবশ্যক মত সংস্কার করা অবশ্যকর্তব্য। শুনিয়াছি রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা দূরে থাক তার গানের সুরেও কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দিতে চান না। যদি সত্য হয় তবে দুঃখের বিষয়। স্টিভেনশন প্রথমে যে রেলগাড়ির এঞ্জিন সৃষ্টি করেন তার চিমনি ছিল চার হাত, হেলিয়া দুলিয়া কোনও গতিকে গজেন্দ্রগমনে ঘণ্টায় পাঁচ-দশ মাইল চলিত। আর এখনকার পঞ্জাব বম্বে মেলের এঞ্জিন দেখ, কি পরিবর্তন। কিন্তু স্টিভেনশনের মর্যাদা কিছুই কমে নাই। যদি রবীন্দ্রনাথের বাউলের সুর ওস্তাদ-পরম্পরায় সংস্কৃত হইয়া বাগেশ্রী-চৌতালে পরিণত হয়, তবে তার ক্ষুণ্ণ হওয়া অনুচিত, কারণ ক্রমোন্নতিই জগতের নিয়ম। যদি কোন দক্ষ ব্যক্তি গোরার উন্নত সংস্করণে পরেশবাবুর বড় মেয়ে লাবণ্যর সঙ্গে পানুবাবুর বিবাহ দেয়, তবে দেখিতে শুনিতে ভালই হয়। অধিকন্তু, যদি রেললাইনের উপরেই সানাই বাজাইয়া মোটর চালানো যায়, অর্থাৎ নরেশচন্দ্রের কমলের সঙ্গে যদি শরৎচন্দ্রের কিরণময়ীর শুভবিবাহ সংঘটিত হয় এবং তদুপলক্ষে যতীন্দ্র সিংহ মহাশয়ের চাকারভর্তি সাহেব সঙ্গত রচনা করেন, তবে মস্ত একটা সামাজিক সমস্যার সমাধান হইয়া যায়। এই উপায়ে প্রবীণ নবীন সমস্ত বড় বড় লেখকদের রচনা অদল বদল করিয়া ছাঁটিয়া তালি দিয়া নির্দোষ চিরস্থায়ী সাহিত্যে পরিণত করা যাইতে পারে।

আমাদের দ্বিতীয় কর্তব্য–ভবিষ্যতের জন্য আদর্শ-নির্দেশ। এই আদর্শ এমন হওয়া চাই যাতে আর্ট ও সমাজ দুই বজায় থাকে।

আর্ট কি? এক কথায় বলা যাইতে পারে–যা ভাল লাগে তাই আর্টের অঙ্গ বা রসবস্তু, এবং তা ভদ্রজনের মুখরোচক করিয়া পরিবেশন করাই আর্ট। অবশ্য একই বস্তু সকলের ভাল না লাগিতে পারে, অতএব আর্টের সৃষ্টি ও উপভোগ কতকটা ব্যক্তিগত। কিন্তু এমন জিনিস অনেক আছে যা অনেকেরই ভাল লাগে কেবল মাত্রার তারতম্য লইয়াই বিবাদ। সকলেই বলে–দুধ অতি উপাদেয় বস্তু, কিন্তু কেউ ঢকঢক করিয়া খায়, কেউ একটু আধটু খায়। পেঁয়াজের দুর্গন্ধ প্রসিদ্ধ, মাত্রা-ভেদে ভদ্র-অভদ্র অনেকেরই রুচিকর। অতএব দুধ ও পেঁয়াজ দুই অপরিহার্য রসবস্তু! তথাপি, সমাজ মনে করে–দুধ যত খাওয়া যায় ততই বলবৃদ্ধি হয়, কিন্তু পেঁয়াজ বেশী মাত্রায় বিকট। তাই আমরা গতানুগতিক ভাবে দুধ-খোরকে বলি সাত্ত্বিক, পেঁয়াজ খোরকে বলি নেড়ে। ইহা অন্ধ সমাজের কথা, আমাদের অন্তরের কথা নয়। দয়া দাক্ষিণ্য ভক্তি প্রীতির কথা শুনিতে আমাদের বেশ ভাল লাগে তা অবশ্য মানি, কিন্তু কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, খুনোখুনি-ব্যভিচার, নরমাংস, নারীমাংস –এ সকলও উপযুক্ত অনুপানের সহিত কম উপভোগ্য নয়।

সর্বভুক পাঠক হাঁ করিয়া আছে, ওস্তাদ রসস্রষ্টা কাহাকেও বঞ্চিত করিতে, কিছুই বাদ দিতে পারেন না। তিনি শান্ত করুণ রসের স্রোত বহাইবেন, আবার ষড়রিপুর বিচিত্র খেলা দেখাইয়াও তাক্ লাগাইয়া দিবেন। কিন্তু নিন্দকের মুখ বন্ধ করিবেন কোন্ উপায়ে? পূর্বাচার্যগণ তাহা দেখাইয়া গেছেন। ভারতচন্দ্র পায়সান্ন পরিবেশনের সঙ্গে কালীনামের গরম মসলা দিয়া শুটকী মাছ চালাইয়াছিলেন। কিন্তু এ যুগে তাহা চলিবে না, কারণ উক্ত মাছের নূতনত্ব নাই, কালীনামেরও আর তেমন হজম করাইবার ক্ষমতা নাই। মনীষী রেনল্ডস ও তাঁর ভারতীয় শিষ্যগণ উৎকৃষ্টতর উপায় অবলম্বন করিয়াছেন, তাঁরা যথাসাধ্য আর্টের কেরামতি করিয়া অবশেষে দেখাইয়াছেন ধর্মের জয়, অধর্মের ক্ষয়। ইহাই নিন্দকের প্রকৃষ্ট প্রত্যুত্তর। এখন আর্টের সীমা আরও বর্ধিত হইয়াছে, প্রাচীন লেখকগণ যা স্বপ্নেও ভাবেন নাই এমন নব নব রসবস্তু আবিষ্কৃত হইয়াছে, আলকাতরা হইতে স্যাকারিন, বানরের অঙ্গে নব যৌবনের গ্রন্থি, ছাগলের মনের গোপন কোণে উদ্দাম প্রেমের আদিধারা। কিছুই বাদ দিবার দরকার নাই, যা কিছু ব্যাপার হইয়া থাকে বা ঘটিতে পারে তা-ই আর্টের গণ্ডিতে পড়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা চাই। যত ইচ্ছা নরক মন্থন করিয়া রত্ন উদ্ধার কর, কিন্তু উপসংহারে সমস্ত পাপাত্মার নাক কাটিয়া দাও।

একটি উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দিব, কিন্তু প্লট মনে আসিতেছে না। অপরের প্লট যে আত্মসাৎ করিব তার জো নাই,–আজকালকার ছোকরারা অতি চালাক, রুশিয়া হইতে চুরি করিলেও ধরিয়া ফেলিবে। অতএব ঋণ স্বীকার করিয়াই চন্দ্রশেখর হইতে দু-একটি চরিত্র লইব। বঙ্কিমচন্দ্র শৈবলিনীকে মন্দ আঁকেন নাই, তবে প্রায়শ্চিত্তটা বেশী হইয়াছে,–আজকাল অত না হইলেও চলে। কিন্তু আধুনিক আর্টের ব্যাপ্তি না জানায় প্রতাপকে তিনি একেবারে পঙ্গু করিয়া ফেলিয়াছেন। এই প্রতাপের চরিত্র আমূল সংশোধিত করিয়া কিঞ্চিৎ নমুনা দেখাইতেছি।–

প্রতাপ রায় মরে নাই। ঘা সারিবামাত্র সে চন্দ্রশেখরের বাড়ি আসিয়া হাঁকিল ভটচায, ও ভটচার্য।

চন্দ্রশেখর নামাবলী গায়ে খড়ম পায়ে আসিয়া বলিলেন,-কে ও, প্রতাপ যে। বেশ সেরেচ বাবা?

প্রতাপ একটি তাড়ি-রঙের ধুতির উপর তাড়ির ভাঁড়ের রঙের মেরজাই পরিয়া আসিয়াছে। তার চোখ লাল, দৃষ্টি উদভ্রান্ত। টলিতে টলিতে বলিল– শৈবলিনীকে ডেকে দিন।

চন্দ্রশেখর মাথা নীচু করিয়া একটু ভাবিয়া বলিলেন–নাই বা দেখা করলে।

–দেখা করতে আমি আসি নি, একেবারে নিয়ে যেতে এসেছি। ডাকুন শীগগির।

–সে কি প্রতাপ? তিনি যে কুল-বধূ।

-হলেনই বা, এক কুল ছেড়ে অন্য কুলে যাবেন, আমি তো আর লরেন্স ফস্টর নই। সব ঠিক করেছি, তোকি খ প্রস্তুত, তাজই শৈবলিনীকে মোছলমান বানিয়ে দেবে, তার পর আপনাকে তাল্লাক, আমার সঙ্গে নিকে। আমার নাম এখন আফতাব খাঁ। ভয় নেই ঠাকুর, জাত যাবে না, কালই আবার রামানন্দ স্বামীকে ধরে দুজনে শুদ্ধি নিয়ে নেব।

চন্দ্রশেখর বসিয়া পড়িয়া বলিলেন–তুমি কি জাল-প্রতাপ?

প্রতাপ বজ্রনিনাদে বলিল–আমি জাল! মূর্খ ব্রাহ্মণ, কাহার সম্পত্তি তুমি ভোগ করিতে চাও? একই বৃন্তে দুটি ফুল কে ছিঁড়িয়াছিল? (মূল গ্রন্থ দেখ) ভণ্ড জ্যোতিষী, শৈবলিনীর অন্তরের কথা বিবাহের পূর্বে গণিয়া দেখ নাই?

চন্দ্রশেখর কাতর কণ্ঠে কহিলেন–খুবই অন্যায় হয়ে গেছে বাবা। স্ত্রী চরিত্র তো জ্যোতিষে গণা যায় না। এই কলিকালে যে বিবাহের পূর্বে প্রেম হতে পারে তা জানতুমই না। যেতে দাও বাবা, যেতে দাও–যা হবার হয়ে গেছে। বেচারী এখন শান্তিতে আছে, সংসারধর্ম করচে, পুরনো কথা সব ভুলেচে। আহা, আর তাকে উদ্ব্যস্ত করো না।

প্রতাপ উন্মত্তের ন্যায় হাসিয়া বলিল–এই বিদ্যে নিয়ে তুমি পণ্ডিতি কর? যে অন্তরে অন্তরে আমারই, তাকে তুমি কোন্ অধিকারে আটকে রাখবে? বল ব্রাহ্মণ, বল বল। যে আমার শৈশব-সঙ্গিনী, সে আজু কঁহা মেরী হৃদয়কী-ঈ-ঈ-(স্টার থিয়েটার দেখ)।

চন্দ্রশেখর ভীত হইয়া বলিলেন–একটু ঠাণ্ডা হও বাবা। আমি বুঝিয়ে দিচ্চি।–পাপের স্পর্শ হতে কেউ রক্ষা পায় না, শৈবলিনীও ছেলেবেলায় পাপে পড়েছিলেন।

–অ্যাঁ! পূর্বরাগ পাপ?

–সর্বত্র পাপ নয় বাবা। কিন্তু যেখানে স্বাধীন বিবাহ চলিত নেই, সেখানে পূর্বরাগের ফলে পরে শান্তিভঙ্গ হতে পারে, সেজন্যই পাপ।

–তবে পাপীয়সীকে ছেড়ে দাও না ঠাকুর।

–খাপ্পা হয়ো না বাবা। পাপ হলই বা–ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথিনি,–অমন একটু-আধটু পাপ আমরা সবাই করে থাকি। কিন্তু সেটা নির্মূল করাও যায়। শৈবলিনী মন্ত্রলাভ করেছেন, যে মন্ত্রবলে চিরপ্রবাহিত নদী অন্য খাতে চালানো যায়। (মূল গ্রন্থ দেখ)

-বুঝেচি বুঝেচি, বুজরুকি করে তাকে আটকে রাখতে চাও! ও চলবে না ঠাকুর, তুমি তাকে আটকাবার কে? আমার শৈবলিনীকে চাই, এক্ষুনি এক্ষুনি। উচাটন মন যারে ধরিবারে ধায়, তারে কেন-ক্যানও-কেন নাহি পায়! (স্টার থিয়েটার দেখ)

চন্দ্রশেখর খাড়া হইয়া উঠিয়া বলিলেন–ক্যানও নাহি পায় তা আমি বুঝিয়ে দিচ্চি। রামচরণ, অ রামচরণ–

রামচরণ এখন ভটচা-বাড়িতেই কাজ করে। সাড়া দিল–আজ্ঞে।

–ওরে নিয়ে আয় তো আমার ছড়িটা, সেই বেতের লিলিকে ছড়ি। বাঁশের লাঠিটা নয়, বুঝেচিস্?

প্রতাপ বলিল–ছড়ি কি হবে, ভটচায?

–তোমায় লাগাব। দু-এক ঘা খেলেই বুদ্ধি সাফ হয়ে যাবে। রামচরণ, জদি

প্রতাপ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল–আঁ, মারবে? প্রতাপ রায়ের গায়ে হাত? তবে রে পাজী, শুয়ার–

–অ রামচরণ, বেতের ছড়িতে হবে না রে, বাঁশের লাঠিটাই আ—

প্রতাপ সদর্পে পলায়ন করিল। আর্ট ও সমাজধর্ম দুই বজায় রহিল, অথচ লাঠি ভাঙিল না।

[চিরকুমার সভা সম্বন্ধে দুটো আপত্তি জানিয়েছিলেন। এমন মজার একটা ঘটনায় কবি কেন এক বালবিধবা চরিত্র রাখলেন–শৈলবালা-অবলাকান্তবাবু। দ্বিতীয় ব্যাপারটি ভয়ানক–কবি ভাবলেন না ফেণী পূর্ণকে বিয়ে করে চলে গেলে একা বৃদ্ধ চন্দ্রবাবুকে কে দেখবে; উচিত ছিল ওঁরও একটা বিয়ে দেওয়া। জগত্তারিণী হলেও চলত। এটি বলেছিলেন ওঁর দৌহিত্রী, আমার মাকে। –স:।]