পরিপূর্ণ সাহিত্য (১৮৮১/১৯৫৯)
রোজগার বললে অধিকাংশ বাঙালী বোঝে চাকরি। ওকালতি ডাক্তারি ঠিকাদারি দালালি ব্যবসা ইত্যাদি রোজগার হলেও অগ্রগণ্য নয়, সাধারণ ভদ্রসন্তানের দৃষ্টিতে চাকরিই সর্বোত্তম জীবিকা। সেই রকম, সাহিত্য বললে অধিকাংশ বাঙালী বোঝে প্রধানত গল্প-উপন্যাস, তার পর কবিতা, তার পর লঘু প্রবন্ধ বা রম্যরচনা। ইংরেজীতে literature অর্থে অনেক রকম রচনা বোঝায়, কিন্তু বাঙলায় সাহিত্য শব্দ অতি সংকীর্ণ অর্থে চলে। অমুক একজন সাহিত্যিক এ কথার মানে, লোকটি গল্প উপন্যাস বা কবিতা লেখেন, অথবা তার সমালোচনা করেন।
অনেকে বলেন, বাঙলা কথাসাহিত্য এখন ইংরেজীর সমকক্ষ এবং বাঙলা ভাষা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার চাইতে অনেক এগিয়ে আছে। কথাটা হয়তো সত্য, কিন্তু সেজন্য আমাদের বেশী আত্মপ্রসাদের কারণ নেই। শুধু গল্প । উপন্যাস নয়, সমগ্র ইংরেজী সাহিত্যের তুলনায় সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অবস্থা কি রকম তা ভাবা দরকার।
স্কুল-কলেজের টেক্সটবুক, শিশুপাঠ্য গল্প-কবিতা, ওকালতি ডাক্তারি ইত্যাদি কর্ম সংক্রান্ত পুস্তক, রাজ্যশাসন সংক্রান্ত নানারকম বিধিগ্রন্থ–এই সব ছাড়া যত গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাই বয়স্থ জনসাধারণ অবসরকালে পড়ে। তা থেকেই আধুনিক বাঙালী লেখক আর পাঠকের সাহিত্যিক রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত রচনা মোটামুটি দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণীতে পড়ে–উদ্ভাবী (বা কাল্পনিক) আর ভাবাত্মক অর্থাৎ creative আর emotional রচনা। গল্প উপন্যাস কবিতা ভক্তিগ্রন্থ ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তর্গত এবং এই সবেরই পাঠক বেশী। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে– জ্ঞানাত্মক আর বাস্তব-বিষয়ক অর্থাৎ informative আর factual রচনা। এই শ্রেণীর উদাহরণ–বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথের কালান্তর, বিশ্বপরিচয়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জিজ্ঞাসা, বিচিত্র জগৎ, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিশ্বের উপাদান, বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, সমরেন্দ্রনাথ সেনের বিজ্ঞানের ইতিহাস। প্রথম শ্রেণীর তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রন্থসংখ্যা অনেক কম, পাঠকও কম। এসব বইএর বারো মাসে তেরো সংস্করণ হবার কোন আশা নেই।
ইংরেজী প্রভৃতি সমৃদ্ধ ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের পত্রিকা আছে, যেমন, গল্প-উপন্যাস, কবিতা, দেশ-ভ্রমণ, সার-সংকলন বা digest, খেলা, বিভিন্ন বিজ্ঞান ও দর্শন ইত্যাদি, বাঙলা পত্রিকার বৈচিত্র্য বেশী নেই, সাধারণ মাসিক আর সাপ্তাহিক পত্রিকায় সব রকম জনপ্রিয় রচনা ছাপা হয়। এইসব পত্রিকায় নানারকম বইএর যে বিজ্ঞাপন থাকে তা থেকেই বাঙলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থার আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। আমার অনুরোধে Statisticsএর একটি ছাত্র * অনেকগুলি বিজ্ঞাপন থেকে একটি মোটামুটি পরিসংখ্যান খাড়া করেছেন। তার হিসাব অনুসারে বিজ্ঞাপিত বিভিন্ন শ্রেণীর বইএর শতকরা হার এই রকম —
গল্প উপন্যাস এবং তার আলোচনা – ৭৫
কবিতা নাটক এবং তার আলোচনা – ৫
ভক্তিগ্রন্থ – ৬
চরিতকথা, স্মৃতিকথা – ৪
ভ্রমণকথা, স্থান-বিবরণ – ২
ইতিহাস – ২
রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব – ২
অর্থনীতি, কৃষি, বাণিজ্য শিল্প – ১ এর কম
দার্শনিক বিষয় – ১
বৈজ্ঞানিক বিষয় – ১ এর কম
ফলিত জ্যোতিষ, অলৌকিক বিষয় – ১
অন্যান্য বিবিধ বিষয় – ১
এই ফর্দ থেকে বোঝা যায় যে বাঙলা সাহিত্যের শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ উদ্ভাবী বা কাল্পনিক এবং ভাবাত্মক রচনা। ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী সাহিত্যেও গল্প-উপন্যাসাদির সংখ্যা বেশী, কিন্তু জ্ঞানাত্মক গ্রন্থের অনুপাত এদেশের মতন অত্যল্প নয়।
সংস্কৃত শাস্ত্রে চৌষট্টি কলার উল্লেখ আছে, তার কতকগুলি ইংরেজী art সংজ্ঞার অন্তর্গত। যেমন গীত বাদ্য নৃত্য নাট্য আলেখ্য তক্ষণ। ইংরেজীতে গল্প আর কাব্য-রচয়িতাও আর্টিস্টরূপে গণ্য হন, বাঙলাতেও তাঁদের কলাবিৎ বলা চলে। যাঁরা ছবি আঁকেন, মূর্তি গড়েন, গীতবাদ্য-নৃত্য বা অভিনয় করেন তারা যেমন আর্টিস্ট, গল্প-উপন্যাস আর কবিতার লেখকও তেমনি আর্টিস্ট বা কলাবিৎ। এঁদের সকলেরই রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য চিত্তবিনোদন। যাতে বিনোদনের সঙ্গে মনের উৎকর্ষ আর অনুভূতির প্রসার হয় সেই রচনা অবশ্যই প্রকৃষ্ট। সকল দেশেই সংস্কৃতির একটি প্রধান অঙ্গ আর্ট বা কলাচর্চা।
সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে কথাসাহিত্য কাব্য সংগীত নাট্য চিত্রকলা প্রভৃতি অপরিহার্য তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কলাচর্চাই সংস্কৃতির সবটা নয়। উভাবী বা কাল্পনিক, এবং ভাবাত্মক, creative আর emotional সাহিত্যে সব প্রয়োজন মেটে না, জ্ঞানাত্মক আর বাস্তব বিষয়ক সাহিত্যও অপরিহার্য। এই জাতীয় সাহিত্য বাঙলায় যথেষ্ট নেই।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, জ্ঞানাত্মক বাস্তব বিষয়ের চর্চা তো স্কুল কলেজেই চুকে গেছে, প্রৌঢ় আর বৃদ্ধ বয়সেও যদি তার জের টানতে হয় তবে জীবন দুর্বহ হবে। এ রকম মনোভাব ঠিক নয়। শিক্ষার শেষ নেই, আজীবন তা চলে। ঠেকে শেখা শুনে শেখা আর দেখে শেখার সুযোগ সকল ক্ষেত্রে মেলে না, তাই যত কাল সামর্থ্য তত কালই পড়ে শিখতে হয়। মানুষের যে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা পুরাকাল থেকে সংগৃহীত হয়ে আসছে তা শুধু বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের সংরক্ষিত গুহ্য বিদ্যা নয়, জনসাধারণের সাহিত্যেও যথাসম্ভব মনোজ্ঞ ভাষায় তাকে স্থান দিতে হবে।
টেক্সটবুক প্রায় নীরস রচনা, পরীক্ষা পাসের জন্যেই ছেলেমেয়েরা তা পড়ে। সে রকম লেখা বয়স্থ লোকের উপযুক্ত নয়। শুধু তথ্য থাকলেই চলবে না, রচনা চিত্তাকর্ষক হওয়া চাই, তবেই সাধারণ পাঠকের পড়বার আগ্রহ। হবে। ইংরেজীতে এই জাতীয় গ্রন্থ বিস্তর আছে, পাঠকও অসংখ্য। উদাহরণ আর আদর্শস্বরূপ কয়েকটি গ্রন্থের নাম করছি।–
H G Walesএর Short History of the World, সদ্য প্রকাশিত Julian Huxley Story of Evolution, M Davidson4g Easy Outline of Astronomy, Gilbert Murry Myths and Ethics, AN Whiteheadএর Science and the Modern World, নির্মলকুমার বসুর Cultural Anthropology।
বাঙলায় এই জাতীয় গ্রন্থ নেই এমন নয়, কিন্তু যথেষ্ট নেই। বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ নামে বিশ্বভারতী অনেকগুলি জ্ঞানগর্ভ ঘোট বই প্রকাশ করেছেন। শুনেছি এই গ্রন্থমালার ক্রেতা অনেক কিন্তু পাঠকও অনেক কিনা জানি না।
বাঙলা গল্প কাব্য আর ভক্তিগ্রন্থ সংখ্যায় এবং উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য রচনায় হিন্দী এগিয়ে যাচ্ছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বাঙলা অনুবাদ প্রকাশের অনেক বৎসর আগেই হিন্দী অনুবাদ ছাপা হয়েছে। ভারতের প্রাকৃতিক আর শিল্পজাত দ্রব্যের বিবরণেও হিন্দী অগ্রণী। বাঙলার তুলনায় হিন্দীভাষীর সংখ্যা অনেক বেশী, হিন্দী বইএর পাঠকও বেশী। বিহার উত্তরপ্রদেশ পঞ্জাব রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ–এই সকল রাজ্যে হিন্দী সাহিত্যের উন্নতির জন্য প্রচুর সরকারী সাহায্য আর উৎসাহ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পোষকতা তো আছেই। এ সবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সরকারী সাহায্য অতি অল্প। আমাদের অপূর্ণ সাহিত্যকে পূর্ণতা দেবার জন্য লেখক প্রকাশক পাঠক আর সরকার সকলকেই অবহিত হতে হবে। বাঙলা সাহিত্য চিরকালই ভারতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হয়ে থাকুক এমন স্পর্ধা করতে বলি না, কিন্তু বাঙলা সাহিত্য সকল বিভাগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক এই কামনা বাঙালী মাত্রেরই করা উচিত।
[* আমি। –স:।]