বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ

বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ

২৪।১২।১৯৪০

শ্ৰীযুক্ত সুস্থিরকুমার বসু
সাধারণ সম্পাদক, প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন
জামসেদপুর

সবিনয় নিবেদন,
আপনি জানতে চেয়েছেন বাঙ্গালা ভাষার আধুনিক রূপ ও তাহা সর্বজনমান্য করিবার উপায় সম্বন্ধে আমার অভিমত কি। অনুমান করি আমার উত্তর আগামী সম্মেলনে পড়া হবে। সময় অল্প, সেজন্য সংক্ষেপে লিখছি। বহুদিন পূর্বে সাধু ও চলিত ভাষা নামে এক প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তা থেকে কিছু কিছু নিয়েছি।

সভায় আলোচ্য বিষয়–বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ। তার মানে এই বুঝেছি লিখিত বা সাহিত্যিক বাংলা ভাষার চেহারা কিরকম হলে আধুনিক প্রয়োজনের উপযোগী হবে। অর্থাৎ সাহিত্যের বাহনই আলোচ্য, বাহিত বিষয় অপ্রাসঙ্গিক।

ভাষার রূপের তিন অঙ্গ-(১) লিপি বা বর্ণমালার আকৃতি, (২) শব্দাবলীর প্রকার বা form, এবং (৩) বানান। প্রথম অঙ্গটির আলোচনা করব না, কারণ তার এখনও তেমন তাগিদ নেই।

শব্দাবলীর প্রকার নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে, এখনও তা থামে নি। সাধুভাষা ভাল না চলিতভাষা ভাল? তার ভঙ্গী কিরকম হওয়া উচিত– বঙ্কিমীয়, প্রাচীন রবীন্দ্রীয়, আধুনিক রবীন্দ্রীয়, না অত্যাধুনিক তরুণ বিক্ৰীড়িত?

যদি সংজ্ঞার্থ (definitions) ঠিক না থাকে তবে বিতর্কে বৃথা বাক্য ব্যয় হয়, সেজন্য প্রথমেই মৌখিক, লৈখিক, সাধু আর চলিত এই কটি সংজ্ঞার অর্থ বিশদ হওয়া দরকার। আমার একটা অযত্নলব্ধ মৌখিক ভাষা আছে, তা রাঢ়ের বা পূর্ববঙ্গের বা অন্য অঞ্চলের। যদি কথাবার্তায় প্রাদেশিকতা বর্জন করতে চাই তবে এই ভাষাকে অল্পাধিক বদলে কলকাতার মৌখিক ভাষার অনুরূপ করে নিতে পারি, না পারলেও বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমার মুখের ভাষা যেমনই হক, আমাকে একটা লৈখিক বা লেখাপড়ার ভাষা শিখতেই হবে–যা সর্বসম্মত, যার দ্বারা বাঙালীর সঙ্গে আমার সাহিত্য বা সহযোগ হয়, অর্থাৎ যা সাহিত্যের উপযুক্ত।

মুখের ভাষা যে অঞ্চলেরই হক, মুখের ধ্বনিমাত্র, তা শুনে বুঝতে হয়। লৈখিক ভাষা দেখে অর্থাৎ পড়ে বুঝতে হয়। মৌখিক ভাষার উচ্চারণই সর্বস্ব। লৈখিক ভাষার চেহারাটাই আসল, উচ্চারণ সকলে একরকম না করলেও ক্ষতি নেই, মানে বুঝতে পারলেই যথেষ্ট। লৈখিক ভাষা সবর্সধারণের সাহিত্যের ভাষা, সেজন্য বানানে মিল থাকা দরকার, উচ্চারণ যাই হক।

আজকাল বাংলা সাহিত্যে যে ভাষা চলছে তার দুই ধারা–সাধু ও চলিত। প্রথম ধারা অবশ্য প্রবলতর, কিন্তু তার কিছু পরিবর্তন যে দরকার তা অনেকেরই মনে হয়েছে। পৌষ মাসের প্রবাসী পত্রিকায় সম্পাদক মহাশয়ও এইরূপ মত প্রকাশ করেছেন।

সাধুভাষার মানে সৎলোকের বা সভ্যলোকের ভাষা নয়; চলিত ভাষার মানে প্রচলিত ভাষা নয়। বাংলা ভাষার বিশেষণ হিসাবে সাধু ও চলিত দুটিই রূঢ় শব্দ, দুইভাষাই লৈখিক বা সাহিত্যিক। সাধু ও চলিত ভাষার প্রধান প্রভেদ সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের জন্য, যথা–তাহারা বলিলেন, কিংবা তারা বললেন; এবং কতকগুলি অসংস্কৃত ও সংস্কৃতজ শব্দের জন্য, যথা–উঠান, একচেটিয়া, মিছা, সুতা, কিংবা উঠন, একচেটে, মিছে, সুতো। আর যা প্রভেদ দেখা যায়- তা লেখকের ভঙ্গীগত। কেউ বা বেশী সংস্কৃত শব্দ ও সমাস, কেউ বা বেশী আরবী ফারসী শব্দ চালান; কেউ বা পদবিন্যাসে কিঞ্চিৎ নূতনত্বের চেষ্টা করেন। কিন্তু এসকল ভঙ্গী সাধু বা চলিত ভাষার বিশেষ লক্ষণ নয়।

একটা ভ্রান্ত ধারণা অনেকের আছে যে চলিত ভাষা আর পশ্চিম বাংলার মৌখিক ভাষা একই। এর ফলে বিস্তর অনর্থক বিতণ্ডা হয়েছে। সাদৃশ্য এই পর্যন্ত আছে, যে চলিত ভাষার সর্বনাম ক্রিয়াপদাদি উল্লিখিত কতকগুলি শব্দের বানান ভাগীরথীতীরস্থ কয়েকটি জেলার মৌখিক ভাষার শিষ্ট উচ্চারণের সঙ্গে মোটামুটি মেলে। কিন্তু ঐসব জেলাবাসী লেখক যখন চলিত ভাষায় লেখেন তখন তিনি তার মুখের ভাষার যথাযথ অনুসরণ করেন না। তিনি তার বন্ধুকে হয়তো বলেন–গ্যালো রোববারে কোথা গেশলে হ্যাঁ? কিন্তু লেখেন–গেল রবিবারে কোথা গিয়েছিলে হে। লেখবার সময় লোকে যতটা সাবধান হয়, কথাবার্তায় ততটা হতে পারে না।

সাধু বা চলিত যাই হক, সাহিত্যের ভাষা মুখের ভাষার সমান হতে পারে না। তথাপি কোনও এক অঞ্চলের মৌখিক ভাষার ভিত্তিতেই লৈখিক ভাষা গড়ে ওঠে, এবং কালক্রমে একের পরিবর্তনের ফলে অপরের পরিবর্তন আবশ্যক হয়। এই পরিবর্তন বিনা বিতর্কে বিনা পরামর্শে সাধু ভাষায় কিছু কিছু ঘটেছে। রামমোহন রায় লিখতেন তাহারদিগের, তা থেকে ক্রমে তাহাদিগের, তাহাদের হয়েছে। এখন অনেকে সাধুভাষাতেও তাদের লিখছেন। লিখা, শিখা, শুনা, ঘুরা, লতানিয়া, জলুয়া, হয়েন, যায়েন স্থানে এখন সাধুভাষাতেও লেখা, শেখা, শোনা, ঘোরা, লতানে, জলো, হন, যান চলছে। এই পরিবর্তন জীবন্তভাষার লক্ষণ এবং তা সাধারণের অজ্ঞাতসারে হয়েছে। ভাষার গতি বুঝে সজ্ঞানে সবিচারে আরও অগ্রসর হলে ক্ষতি হবে না।

লৈখিক ভাষার অবলম্বন হিসাবে পশ্চিম বাংলার মৌখিক ভাষারই যোগ্যতা বেশী, কারণ, এ ভাষার পীঠস্থান কলকাতা সকল সাহিত্যিকের মিলনক্ষেত্র, রাজধানীও বটে। কিন্তু যদি পশ্চিম বাংলার মৌখিক ভাষার উচ্চারণের উপর অতিমাত্র পক্ষপাত করা হয় তবে প্রগতি না হয়ে বিপ্লব হবে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও উচ্চারণ আর বানানের সংগতি সর্বত্র বজায় রাখা সম্ভবপর নয়। ও-কার আর হচিহ্নের বাহুল্যে লেখা কণ্টকিত করায় কিছুমাত্র লাভ নেই, অর্থবোধ থেকেই উচ্চারণ আসে। লৈখিক বা সাহিত্যের ভাষার রূপ ও পদ্ধতি নিরূপিত ও সহজে অধিগম্য হওয়া আবশ্যক, নতুবা তা সর্বমান্য হয় না, শিক্ষারও বাধা হয়। সুতরাং একটু রফা ও কৃত্রিমতা– অর্থাৎ সকল মৌখিক ভাষা হতে অম্লাধিক প্রভেদ–অপরিহার্য।

সাধু আর চলিত দুরকম ভাষার পৃথক অস্তিত্বের আর প্রয়োজন আছে। মনে হয় না। দুইএর সমন্বয় অসাধ্য নয়। এমন লৈখিক ভাষা চাই যাতে বর্তমান সাধুভাষার আর মার্জিতজনের মৌখিকভাষা দুইএরই সদ্গুণ বজায় থাকে। সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদের দ্বারা যে বার্সংকোচ লাভ হয় তা আমরা চাই, আবার মৌখিক ভাষার সহজ প্রকাশশক্তিও ছাড়তে চাই না। আমার প্রস্তাব সংক্ষেপে নিবেদন করছি।

(১) ক্রিয়াপদ আর সর্বনামের সাধুরূপের বদলে চলিত রূপ গৃহীত হক।

(২) অন্যান্য অসংস্কৃত ও সংস্কৃতজ শব্দের কতকগুলির সাধুরূপ আর কতকগুলির চলিত রূপ গৃহীত হক। যে শব্দের সাধু ও মৌখিক রূপের ভেদ আদ্য অক্ষরে, তার সাধু রূপই বজায় থাকুক, যথা–ওপর, পেছন, পেতল, ভেতর না লিখে উপর, পিছল, পিতল, ভিতর। যার ভেদ মধ্য বা অন্ত্য অক্ষরে, তার মৌখিক রূপই নেওয়া হক, যথা–কুয়া, মিছা, উঠান, একচেটিয়া স্থানে কুয়ো, মিছে, উঠন, একচেটে।

(৩) যে সংস্কৃত শব্দ বর্তমান চলিতভাষায় অচল নয়, অর্থাৎ বিখ্যাত লেখকগণ যা চলিতভাষায় লিখতে দ্বিধা করেন না, তা যেন বিকৃত করা না হয়। সত্য, মিথ্যা, নূতন, অবশ্য স্থানে যেন সত্যি, মিথ্যে, নোতুন, অবিশ্যি লেখা না হয়।

(৪) বর্তমান সাধুভাষার কাঠামো বা অন্বয়পদ্ধতি বা syntax বজায় থাকুক। ইংরেজী ভগীর অন্ধ অনুকরণ অথবা অকারণে বিশেষ্য সর্বনাম ক্রিয়াপদের বিপর্যয় বর্জনীয়।

এ ভাষায় অনুবাদ করলে সংস্কৃত রচনার ওজোগুণ নষ্ট হবে, অথবা এতে দর্শন বিজ্ঞান লেখা যাবে না এমন আশঙ্কা অমূলক। দুরূহ সংস্কৃত শব্দ এবং সমাসের সঙ্গে মৌখিক ক্রিয়াপদ আর সর্বনাম চালালেই গুরুচণ্ডাল দোষ হবে না।

ভাষার তৃতীয় অঙ্গ বানান। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানানের কতকগুলি নিয়ম সংকলন করে যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন তা সকল সাহিত্যসেবীকেই পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ও তার লিখিত দৃষ্টান্তের প্রভাবে নূতন বানানগুলি ধীরে ধীরে প্রচলিত হচ্ছে। সবিস্তার আলোচনা না করে নূতন বানানের কয়েকটি প্রধান বিধি জানাচ্ছি।

(১) হিন্দী মরাঠী গুজরাটী প্রভৃতি সংস্কৃতজাত ভাষায় রেফাক্রান্ত ব্যঞ্জন বর্ণের দ্বিত্ব হয় না। ব্যাকরণ অনুসারেও দ্বিত্ব আবশ্যক নয়। বাংলাতেও দ্বিত্ব বর্জনীয়। কার্য লিখতে একটা য যথেষ্ট।

(২) কতকগুলি বাংলা শব্দের শেষে অ-কার উচ্চারিত হয়, যেমন–ছিল, বড়, কত; কিন্তু অধিকাংশ শব্দে হয় না, যেমন–ছিলেন, তোমার, কেমন। শেষোক্ত শব্দগুলিতে হস্ চিহ্ন দেওয়া হয় না, যদিও উচ্চারণ হসন্ত। যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা না থাকে তবে অসংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হস্ চিহ্ন বর্জনীয়। ওস্তাদ, পকেট, হক, ডিশ প্রভৃতি শব্দে হস্ চিহ্নের কোনও দরকার নেই।

(৩) অসংস্কৃত শব্দে ণ থাকবে না, কেবল ন। কান, বামুন, কোরান, করোনার প্রভৃতিতে ন। এই প্রথা নূতন নয়, অনেক খ্যাতনামা লেখক বহুকাল থেকে এইরকম লিখছেন।

(৪) ফারসী আরবী ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী শব্দের মূল উচ্চারণ অনুসারে বাংলা বানানে s স্থানে স এবং sh স্থানে শ হবে। যথা–জিনিস, সরকার, ক্লাস, নোটিস দন্ত্য স; শরম, শুরু, শাগরেদ, পালিশ তালব্য শ। হিন্দী প্রভৃতি ভাষাতেও এই রীতি চলে। অনেক বাঙালী মুসলমানও এইরকম। বানান করেন।

(৫) নবাগত বিদেশী শব্দে অনর্থক য় বর্জনীয়। war ওয়ার নয়, ওআর। কিন্তু wire ওয়ার।

(৬) বক্র আ বা বিকৃত এ বোঝাবার জন্য আদিতে অ্যা এবং মধ্যে বা অন্তে া বিধেয়, যথা–অ্যাসিড, হ্যাট, নিউম্যান।

(৭) পৌষমাসের প্রবাসী পত্রিকায় সম্পাদক মহাশয় চলিত ক্রিয়াপদের খামখেয়ালী বানানের নিরূপণ চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কৃত নিয়মে তা আছে; বল্লেন, কছিল নয়, বললেন, করছিল।

কেউ কেউ বলেন–এই নিয়মের কতকগুলি পালন করতে গেলে নানা ভাষায় জ্ঞান দরকার। জিনিস-এর মূল জি, সাগরেদ-এর মূল শার্গি তা কত লোক জানে? আমি বলি, জানবার বিশেষ দরকার নেই। ব্যুৎপত্তি না জেনেও আমরা শিখি যে উজ্জ্বলএ ব-ফলা আছে কিন্তু কজ্জলএ নেই। যারা জানেন এবং যাঁদের উৎসাহ আছে তারা নির্দেশ দেবেন এবং সাধারণে ক্রমে ক্রমে শিখবে।

বিনীত
রাজশেখর বসু