ভুল নাম ও নকল জিনিস

ভুল নাম ও নকল জিনিস (১৩৬৩/১৯৫৬)

সম্প্রতি দিল্লিতে লোকসভায় একজন সদস্য প্রশ্ন করেছিলেন, বনস্পতিকে ভেজিটেবল ঘি বলা চলবে কিনা। ডক্টর রঘুবীর তার উত্তরে বলেন, ভেজিটেবল ঘি নামে কোনও বস্তু নেই, জিনিসের ভেজালের চাইতে নামের ভেজাল বেশী অনর্থকর।

নামের ভেজাল অর্থাৎ শব্দের অপ্রপ্রয়োগ চিরকালই চলে আসছে। অনেক ভুল নাম কালক্রমে ভাষায় স্থায়িত্ব পায় এবং সাধারণত তাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ভুল নামের সুযোগে নিকৃষ্ট নকল জিনিস বাজারে প্রচলিত হয়।

তৈল শব্দের মূল অর্থ তিল থেকে উৎপন্ন, অর্থাৎ তিল তৈল। ইংরেজী অয়েল শব্দের উৎপত্তি, লাটিন অলিয়ম থেকে, যার মৌলিক অর্থ অলিভজাত, অর্থাৎ অলিভ অয়েল। কিন্তু কালক্রমে অর্থ প্রসারিত হয়েছে, এখন স্নেহদ্রব্য বা তত্ত্বল্য বস্তুমাই তৈল বা অয়েল, সরষের তেল তার্পিন কেরোসিন সবই এই নামে চলে। তালবৃন্তের মূল অর্থ তালগাছের ডাল, তা থেকে হল তালপাতার পাখা; তার পর সংস্কৃত ভাষায় পাখামাত্রই তালবৃন্ত নাম পেল।

অজ্ঞতার জন্য অনেক ভুল নাম চালানো হয়। কয়েকটি ইংরেজী অভিধানে ট্যাবলয়েড শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছিল–ঔষধাদির চাকতি, অর্থাৎ ট্যাবলেট। ট্যাবলয়েড শব্দের যাঁরা প্রবর্তক তাঁরা উকিলের চিঠি দিয়ে জানালেন যে ওই নামে শুধু তাদের তৈরি জিনিস বোঝায়, অভিধানে ব্যাপক অর্থ দিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তখন অভিধান সংশোধিত হল।

একটি বিশেষ কম্পানির প্রস্তুত বীজঘন বস্তুর পেটেন্ট নাম ফিনাইল। কিন্তু সাধারণ লোকে ওই রকম সকল বস্তুকেই ফিনাইল বলে। থার্মস একটি বিশেষ কম্পানির প্রস্তুত জিনিসের নাম, কিন্তু সাধারণ লোকে সব ভ্যাকুয়ম ফ্লাস্ককেই থার্মস বলে। ভ্যাসেলিন নাম একটি আমেরিকান কম্পানির পেটেন্ট, কিন্তু লোকে অনুরূপ সকল বস্তুকেই ওই নাম দিয়েছে। প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে কেড়স নামক এক আমেরিকান কম্পানির ক্যাম্বিসের জুতো এদেশে আসত। এখন আর আসে না, কিন্তু অনেক শিক্ষিত লোকেরও ধারণা, কেডস মানেই ক্যাম্বিসের জুতো।

কাগজে দশ-বারো টাকা দামের নাইলন (বা নিলন) শাড়ির বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। ও দামে একজোড়া নাইলনের মোজাও হয় না। রেয়ন বা নকল রেশমের শাড়িকে নাইলন নাম দিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।

ময়রাকে যদি প্রশ্ন করি, মিষ্টান্নে যে হলদে রং দাও তা কি জিনিস? সে বলে, জাফরান। অনেক ময়রাই মনে করে হলদে রং মাত্রই জাফরান। কুঙ্কুম শব্দের অর্থ জাফরান। যেমন চন্দন ঘষে তিলকচর্চা হয় তেমনি এককালে মেয়েরা কুঙ্কুম অর্থাৎ জাফরান বেটে তার টিপ পরত। বাইশ বৎসর আগে মাদ্রাজের মেয়েদের তা পরতে দেখেছি। আধুনিক বাঙালী মেয়ে যাকে কুঙ্কুম বলে তাতে জাফরানের লেশ নেই, যে-কোনও খয়ের রঙের পিষ্ট বস্তু এই নামে চলে। অজ্ঞতার ফলে কুঙ্কুম শব্দের মানে বদলে গেছে।

খাঁটি সোনা খুব নরম, অল্পাধিক খাদ না মেশালে অলংকার গড়া যায় না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আজকাল যে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেন তা নাইন ক্যারাট গোল্ডের, অর্থাৎ তার ভরিতে দশ আনা খাদ। এই ভেজাল সোনার মেডালকে গোল্ড মেডালই বলা হয়। কিন্তু দোকানদার যদি সের পিছু দশ ছটাক ভেজাল দেওয়া জিনিসকে ঘি নামে চালায় তবে সে আইন অনুসারে দণ্ডনীয় হবে। মেডাল খাবার জিনিস নয়, সেজন্য তাতে ভেজাল থাকলে আইন ভঙ্গ হয় না।

অনেক ভুল নাম প্রয়োগসিদ্ধ বা আইনসম্মত। অনেক নামে অজ্ঞতা প্রকাশ পেলেও ক্ষতি বিশেষ কিছু হয় না। কিন্তু সাগুদানা বা এরারুট নামের অপপ্রয়োগ অনর্থকর। স্টার্চ (শ্বেতসার বা পালো) অনেক রকম উদ্‌ভিজ্জ বস্তু থেকে প্রস্তুত হয়, যেমন আলু চাল গম ভুট্টা টাপিওকা (কাসাভা বা শিমুল-আলু), শটি ইত্যাদি। যদি সুশোধিত হয় তবে গুণের বেশী তারতম্য দেখা যায় না। তাল-বর্গীয় সাগু গাছের মজ্জা থেকে যে স্টার্চের দানা প্রস্তুত হয় তাই সাগুদানা। ক্যানা বা সর্বজয়া শ্রেণীর এক রকম গাছের মূল থেকে তৈরি স্টার্চের নাম এরারুট (অ্যারারুট)। আসল সাগু আর এরারুট অন্যান্য শোধিত স্টার্চের তুলনায় বেশী লঘুপাক কিনা তার বোধ হয় কোনও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয় নি। সাধারণে গতানুগতিক ভাবে বিশ্বাস করে যে চিনির চাইতে মিছরি বেশী উপকারী, তাল-মিছরি আরও উপকারী; তেমনি। মনে করে, সুপাচ্যতায় সাগু আর এরারুট শ্রেষ্ঠ। সম্ভবত এই শ্রেষ্ঠতা কাল্পনিক, সকল বিশুদ্ধ স্টার্চই প্রায় সমান পাচ্য।

কিন্তু গুণের তারতম্য থাকুক বা না থাকুক, সাগু আর এরারুট নামে অন্য স্টার্চ বিক্রয় করা প্রতারণা। অনেক বৎসর পূর্বে কোনও অসাধু ব্যবসায়ীর মাথায় এল–আসল সাগুর দরকার কি, টাপিওকার পালো থেকে দানা তৈরি করলেই চলবে, দেখতে আর খেতে একই রকম হবে। এককালে এই নকল জিনিস কোনও কোনও দোকানে কেচুয়া দানা নামে বিক্রি হত, কিন্তু পরে তা সাগুদানা নামেই চলে গেল। এখনকার অনেক দোকানদারও জানে না যে সে নকল জিনিস বেচছে। সাগুদানা নামে লোকে যা কেনে তা টাপিওকার দানা আর এরারুট নামে যা কেনে, তা ভুট্টার স্টার্চ (কর্ন ফ্লাওআর) অথবা টাপিওকার স্টার্চ।

দোকানদার আর জনসাধারণ যাতে সাগুদানা আর এরারুট নামের অপপ্রয়োগ না করে তার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। টাপিওকার দানা আর ভুট্টা প্রভৃতি থেকে তৈরি স্টার্চ নিষিদ্ধ করার দরকার নেই, কারণ কোনওটি অখাদ্য নয়। কিন্তু এমন আইন হওয়া উচিত যাতে খাদ্যবস্তু মাত্রই যথার্থ নামে বাজারে চলে। টাপিওকা-দানা, কাসাভা-দানা, শিমুল-দানা বা পালো দানা নাম চলতে পারে। সবরকম স্টার্চের সাধারণ নাম শ্বেতসার বা পালো দিলে দোষ হবে না।

ভারত সরকার সিন্থেটিক রাইস নাম দিয়ে চালের অনুকল্প তৈরির চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি বিলাতী নেচার পত্রে তার গবেষণার বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। এর প্রধান উপাদান টাপিওকার পালো আর চীনাবাদামের খোেল। এই নকল চালের রূপ আর পুষ্টিগুণ নাকি চালের মতই হবে। তথাপি এ জিনিসকে সিন্থেটিক রাইস নাম দেওয়া অন্যায়। আজকাল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে নীল (ইন্ডিগো), কর্পূর, মেন্থল প্রভৃতি প্রস্তুত হচ্ছে তার আণবিক গঠন আর গুণ স্বভাবজাত বস্তুর সমান বা প্রায় সমান, সেজন্য সিন্থেটিক (সংশ্লেষিত) বিশেষণ সার্থক। কিন্তু সিন্থেটিক চাল ডাল মাছ মাংস ডিম প্রস্তুত করা মানুষের অসাধ্য। নকল চাল যতই সুখাদ্য হক, তা সিন্থেটিক হতে পারে না, তাকে ইমিটেশন রাইস বা নকল চালই বলা উচিত।