সরকারী পরিভাষা

সরকারী পরিভাষা (১৩৫৫/১৯৪৮)

অধ্যাপক শ্রীযুক্ত নির্মলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রবন্ধ সরকারী কার্যে ব্যবহার্য পরিভাষা–পড়িয়া সুখী হইলাম, তিনি সংস্কারমুক্ত হইয়া বিচারের চেষ্টা করিয়াছেন। নূতন পরিভাষা সম্বন্ধে অনেকেরই কৌতূহল আছে। তাঁহাদের প্রতি এই অনুরোধ–বিচারকালে তাঁহারা যেন এই কয়টি বিষয় মনে রাখেন।

(১) বর্তমান ইংরেজী পরিভাষা ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সমগ্র ভারতে প্রবর্তিত হইয়াছে, কোনও বিশেষ প্রদেশের জন্য রচিত হয় নাই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কতকগুলি প্রতিশব্দ চলে বটে (যেমন–আদালত, দারোগা, হিসাব অধিকারি, মাসুল, কোতোয়াল, কানুন, মুখসর, মুসন্না ইত্যাদি), কিন্তু কেবল ইংরেজী পরিভাষাই সর্বভারতে সাধারণভাবে রাজকার্যে চলে।

(২) যদি ইংরেজী শব্দ বর্জন করা হয় তবে তৎস্থানে এমন শব্দ নির্বাচন করিতে হইবে যাহা সর্বভারতে গ্রাহ্য হইতে পারে, কেবল প্রদেশবিশেষের উপযোগী করিলে চলিবে না। এই সর্বভারতীয় পরিভাষা রচনার উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকারেরই করা উচিত ছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাহারা এদিকে মন দেন নাই। পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ ও যুক্তপ্রদেশে পরিভাষা সংকলিত হইতেছে। শুনিতেছি বোম্বাই বিহার ও উড়িষ্যাতেও শীঘ্র আরম্ভ হইবে।

(৩) সর্বভারতীয় পরিভাষা যেমনই হউক, এখন যেমন সংবাদপত্রাদিতে এবং লৌকিক প্রয়োজনে কতকগুলি প্রাদেশিক প্রতিশব্দ চলে (আইন আদালত, দারোগা ইত্যাদি) ভবিষ্যতেও সেরূপ চলিবে। বাজেট, পুলিস প্রভৃতি অনেক ইংরেজী শব্দও চলিবে, অবশ্য কালক্রমে এইরূপ শব্দের অনেকগুলি লুপ্ত হইবে। যেমন পূর্বপ্রচলিত বহু ফারসী শব্দের এখন এই গতি হইয়াছে, অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র তাহা দেখাইয়াছেন। আরও মনে রাখা উচিত–যে শব্দ বাঙালীর বোধ্য তাহা সর্বভারতের উপযোগী না হইতে পারে। বাংলায় সরবরাহ supply, কিন্তু হিন্দীতে এ অর্থ চলে না।

(৪) নূতন পরিভাষা সুবোধ্য হইবে, অর্থাৎ তাহা শুনিলেই উদ্দিষ্ট অর্থের জ্ঞান হইবে এমন আশা করা বৃথা। বর্তমান ইংরেজী পরিভাষা কি শুনিলেই বোধগম্য হয়? Administrator-general & Official Trusteeর অর্থ কয়জন জানে? সকল ক্ষেত্রে শব্দের ব্যুৎপত্তি বা বাচ্যার্থ হইতে উদ্দিষ্ট অর্থ বোঝা যায় না, প্রয়োজনের বশেই আমরা নূতন শব্দের প্রয়োগ শিখি। সিনেমা কাহাকে বলে তাহা সাধারণে স্বচক্ষে দেখিয়া বা পরের মুখে শুনিয়া শিখিয়াছে, শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গতি, তাহা জানিবার প্রয়োজন হয় নাই। ব্ল্যাকআউট, সেলট্যাক্স, বেসামরিক সরবরাহ বিভাগ, কালোবাজার, মুদ্রাস্ফীতি, প্রভৃতির অর্থ দশ বৎসর পূর্বে কয়জন বুঝিতে পারিত? আমরা দায়ে পড়িয়া এগুলির অর্থ শিখিয়াছি। সর্বভারতীয় পরিভাষার সমস্ত (বা অধিকাংশ) শব্দ সর্ব প্রদেশে সুবোধ্য করা অসম্ভব, যাহাতে সর্ব প্রদেশে গ্রহণযোগ্য হয় সেই চেষ্টাই করা উচিত। নূতন শব্দ লোকে কালক্রমে ধীরে ধীরে শিখিবে, যেমন এক কালে ফারসী শব্দ এবং তাহার পর ইংরেজী শব্দ শিখিয়াছে।

(৫) বর্তমান ইংরেজী শব্দগুলির প্রতিশব্দে খাপছাড়া ভাবে নির্বাচন করিলে চলিবে না, এক-একটি নাম হইতে উদ্ভূত অন্যান্য নামেরও প্রতিশব্দ করিতে হইবে। শুধু Inspector নয়, Sub-Inspector, Inspector general, Deputy Inspector-general প্রভৃতির সুসংগত প্রতিশব্দ চাই।

(৬) প্রকৃতি-প্রত্যয়যোগে এবং সন্ধি-সমাসের সাহায্যে সংক্ষেপে পরিভাষা রচনার অসামান্য শক্তি সংস্কৃত ভাষার আছে। ফারসীরও অনেকটা আছে। সংস্কৃত-ফারসী মিশ্রিত খিচুড়ি পরিভাষাও হইতে পারে, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য হইবার সম্ভাবনা অল্প। সংস্কৃত বা ফারসী বর্জন করিয়া পরিভাষা রচনার শক্তি কোনও প্রাদেশিক ভাষার নাই। সংস্কৃত ভাষা ভারতের সকল প্রদেশে মান্য এবং সংস্কৃত শব্দ সকল প্রাদেশিক ভাষাতেই সহজে স্থান পাইতে পারে। তামিল তেলেগু প্রভৃতি ভাষা সংস্কৃতজাত না হইলেও প্রচুর সংস্কৃত শব্দ আত্মসাৎ করিয়াছে। ভারতবর্ষে সংস্কৃতের যে প্রভাব ফারসীর তাহা নাই, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে নগণ্য। শ্রীযুক্ত দুর্গামোহন ভট্টাচার্য মহাশয় তাহার পারিভাষিক শব্দের গঠন প্রবন্ধে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২রা ফাল্গুন ১৩৫৪) সংস্কৃত ভাষার উপযোগিতা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন। বিদেশীর শাসনকালে ভারতীয় প্রজা বিদেশী পরিভাষায় ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত হইয়াছে। নব ভারতে যাঁহাদের সংস্কৃতের সহিত সম্পর্ক নাই তাহারাও কালক্রমে সংস্কৃতজাত পরিভাষা শিখিবেন। ইহার জন্য ভাষাজ্ঞান বা ব্যুৎপত্তিজ্ঞান অনাবশ্যক। ফারসী আরবী না জানিয়াও আমরা বহু ফারসী আরবী শব্দ শিখিয়াছি।

(৭) পশ্চিমবঙ্গে, মধ্যপ্রদেশে ও যুক্তপ্রদেশে সংস্কৃতের ভিত্তিতেই পরিভাষা সংকলিত হইতেছে। নির্বাচিত শব্দগুলি সকল ক্ষেত্রে সমান না হইলেও একই পদ্ধতি অনুসৃত হইতেছে। ইহা সুখের বিষয়, কারণ, উদ্দেশ্য ও আদর্শ যখন সমান, তখন ভবিষ্যৎ মিলিত আলোচনার ফলে একই শব্দাবলী গৃহীত হইবার সম্ভাবনা আছে। (৮) উক্ত প্রদেশগুলিতে যে শব্দাবলী সংকলিত হইতেছে তাহা চূড়ান্ত নহে, মিলিত যুক্ত-আলোচনার ফলে অনেক পরিবর্তন হইবে, অতএব এক-একটি শব্দ সম্বন্ধে আপত্তি তুলিয়া এখন বিশেষ লাভ নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি ভিন্ন সর্বভারতীয় পরিভাষার প্রতিষ্ঠা হইবে না। কেন্দ্রীয় কর্তাদের অভিরুচি কি প্রকার তাহা এখনও অজ্ঞাত। রাষ্ট্রভাষা হিন্দী হইবে কি হিন্দুস্থানী হইবে তাহা লইয়া এখনও বিবাদ চলিতেছে। গণপরিষদে হিন্দীর জয় হইলে সরকারী পরিভাষা সংস্কৃতপ্রধান হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। হিন্দুস্থানীর জয় হইলে ফারসী শব্দের বাহুল্য হইবে এবং সেরূপ পরিভাষা বাঙালী ওড়িয়া মারাঠী গুজরাটী দ্রাবিড়ী প্রভৃতির পক্ষে সংস্কৃত অপেক্ষা সুখবোধ্য সুখোচ্চার্য বা সুশ্রাব্য হইবে না। ইহাও সম্ভবপর যে প্রবল মতভেদের ফলে বর্তমান ইংরেজী পরিভাষাই বজায় থাকিবে। কেরানী, কনস্টেবল, নির্মাণবিৎ ভাল, কিংবা করণিক, আরক্ষিক, বাস্তুকার ভাল এ বিতর্ক এখন তুচ্ছ। ভাবিবার বিষয় এই–ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজভাষার উপর কোন্ ভারতী ভর করিবেন, সংস্কৃত না ফারসী, না ইংরেজী?