ব্রজেন্দ্রনাথের সাধনা

ব্রজেন্দ্রনাথের সাধনা (১৩৫৯/১৯৫২)

যিনি কৃতকর্মা এবং যাঁর কাছ থেকে আরও অনেক কৃতি লোকে আশা করে, তিনি যদি কর্মে রত থেকেই সহসা মারা যান তবে লোকে বলে, ইন্দ্ৰপাত হল। ব্রজেন্দ্রনাথ খ্যাতনামা দেশনেতা শিল্পপতি বা আচার্য ছিলেন না, বিদ্যাবত্তাসূচক উপাধিও তার ছিল না, দেশের অল্প লোকই তার কাজের খবর রাখত। তথাপি বললে অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর মৃত্যুতে ইন্দ্রপাত হয়েছে।

ব্রজেন্দ্রনাথ জীবদ্দশাতেই প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তু তার সাহিত্যকর্মের মান সর্বসম্মতভাবে নির্ধারিত হয়েছে এমন বলা যায় না। সাহিত্য শব্দের প্রাচীন অর্থ আজকাল প্রসারিত হয়েছে, শুধু কাব্য আর কথাগ্রন্থ নয়; দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক রচনাও সাহিত্য। কিন্তু অনেকে মনে করেন, creative art ভিন্ন প্রকৃত সাহিত্য হয় না। কাব্য গল্প বা সুখপাঠ্য প্রবন্ধ সাহিত্যের শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু প্রাচীন রচনার উদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যা লেখা হয় তা সাহিত্য নয়, সংকলন-জাতীয় কর্ম। এঁদের মতে ব্রজেন্দ্রনাথ সাহিত্যস্রষ্টা নন, সাহিত্যের উদ্ধারক ও সংরক্ষক।

ব্রজেন্দ্রনাথ যা করেছেন তা সৃষ্টিকর্ম কি স্থিতিকর্ম, সাহিত্যিকগণের কোন্ শ্রেণীতে তার স্থান, তার মর্যাদা কবি বা কথাকারের চাইতে বেশী কি কম, ইত্যাদি আলোচনায় লাভ নেই। তিনি যদি শুধু সাহিত্য-পরিষদের কর্ণধার ও উন্নতিসাধক হতেন, অথবা শুধু পত্রিকাসম্পাদক বা পুস্তক প্রকাশক হতেন, তবে বলা চলত যে তিনি ঠিক সাহিত্যিক নন, সাহিত্যসহায়ক মাত্র। কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ আজীবন গ্রন্থ প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর এই কর্ম কি সাহিত্যরচনা নয়, শুধুই মোহিতলাল-কথিত খনিত্ৰ-কর্ম?

মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানস্পৃহা আছে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সম্বন্ধে কৌতূহল আছে, সর্বপ্রকার সৌন্দর্য ও আনন্দ উপভোগের অর্থাৎ প্রেয় ও শ্রেয় লাভের আগ্রহ আছে। এই স্পৃহা কৌতূহল ও আগ্রহই মনুষ্যত্বের বিশিষ্ট লক্ষণ, এবং ভাষা দ্বারা তা প্রকাশ বা চরিতার্থ করবার চেষ্টার নামই সাহিত্য। তথ্যমূলক রচনা অপেক্ষা রস- বা কল্পনা-মূলক রচনা শ্রেষ্ঠ–এই ধারণা সংকীর্ণ বুদ্ধির লক্ষণ।

 ব্রজেন্দ্রনাথ যে সাহিত্য রচনা করেছেন তার অবলম্বন ইতিহাস। প্রথম জীবনে তিনি মোগল যুগ সম্বন্ধে অনেক লিখেছেন, কিন্তু পরে তিনি তাঁর মাতৃভূমি বাংলা দেশেই ইতিহাসের প্রচুর উপকরণ খুঁজে পেয়েছেন। গত দেড় শ বৎসরে এদেশে যে সাহিত্যিক অভ্যুদয় হয়েছে এবং বাঙালী সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে, ব্রজেন্দ্রনাথ তারই ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনা করেছেন। সাহিত্য-সেবকগণের সংক্ষিপ্ত জীবন-চরিত লিখে তিনি তাদের বিস্মৃতি থেকে উদ্ধার করেছেন। বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস, বাংলা সাময়িক পত্র এবং আরও অনেক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কৃতি সংবাদপত্রে সেকালের কথা।

এই গ্রন্থ রচনায় তিনি যে পরিশ্রম করেছেন তাকে তপস্যা বলা চলে। ইংরেজ প্রভৃতি জাতি নরম্যান টিউডর ইত্যাদি আমলের জীর্ণ ঘর-বাড়ি সযত্নে রক্ষা করে। শুধু মন্দির মূর্তি ও চিত্র নয়, প্রাচীন গ্রন্থ, চিঠিপত্র, অস্ত্র, গৃহসজ্জার আসবাব, তৈজস দ্রব্য, পরিধেয়, অলঙ্কার ইত্যাদি অতীত যুগের বিবিধ নিদর্শন মহামূল্য জ্ঞানে সঞ্চয় করে। প্রাচীনের প্রতি আমাদের এই । মমতা নেই। দেবমন্দির ও তৎসংক্রান্ত বস্তু রক্ষায় কতকটা আগ্রহ আছে বটে, রাজাদের হতাশাখানাতেও অনেক সেকেলে জিনিস রাখা হয়, কিন্তু সাধারণ লোকের বাড়িতে দু-এক শ বছর আগেকার আসবাব অলংকার বাসন ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া শক্ত।

ইংরেজী বিদ্যা শিখে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে ইতিহাস মানে শুধু রাজা-রাজড়ার কীর্তি বা অকীর্তি, যুদ্ধ, আর অসংখ্য সন-তারিখ। ব্রজেন্দ্রনাথ এই মোহ কাটিয়ে উঠে স্বজাতির সাহিত্যচেষ্টা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে মন দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন–পূর্বপুরুষের কার্যকলাপের নিদর্শনগুলি সযত্নে রক্ষা করিবার আগ্রহ আমাদের নাই।..সরকারী দলিলপত্রে ও গ্রন্থাগারগুলিতে ইংরেজ-শাসিত বাংলা দেশে বাঙালী কি ভাবে জীবন কাটাইতেছিল, কি চিন্তা করিতেছিল, তাহার বড় একটা প্রমাণ নাই। এই উদাসীনতার প্রতিকার ব্রজেন্দ্রনাথ করেছেন। বলা যেতে পারে সংবাদপত্রে সেকালের কথা গ্রন্থে ভূমিকা ছাড়া তার নিজের লেখা তো কিছুই নেই, শুধু খবরের কাগজ থেকে সংকলন। এর জন্যই তাঁকে ইতিহাসকার আর সাহিত্যকার বলতে হবে?

অবশ্যই বলতে হবে। ব্রজেন্দ্রনাথ যে উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন তা থেকে একটা মৌলিক গ্রন্থ তিনি অল্পায়াসেই লিখতে পারতেন। তা হয়তো ধারাবাহিক ইতিহাস হত কিন্তু নিচ্ছিদ্র হত না। সেরকম গ্রন্থ রচনার লোভ সংবরণ করে তিনি সকল ত্রুটি আর বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠেছেন! তাঁর গ্রন্থ স্বতঃপ্রমাণ ঐতিহাসিক প্রদর্শভাণ্ডার। সেকালের বাঙালী কিভাবে জীবন যাপন করত, কি চিন্তা করত তা ব্রজেন্দ্রনাথ নিজে বলেন নি, তাঁর সংগ্রহই বলেছে। অতীতকে তিনি কথা কইয়েছেন। তাঁর উদ্যম ও পদ্ধতি অভিনব, কিন্তু তাঁর সাধিত কর্ম ইতিহাসও বটে সাহিত্যও বটে।

ব্রজেন্দ্রনাথ তার ভূমিকায় বলেছেন, সংবাদপত্রের মধ্যেও সত্য মিথ্যা দুইই আছে। দেশকাল পাত্র বিবেচনা করিয়া, সত্য মিথ্যা যাচাই করিয়া লইবার দায়িত্ব ইতিহাসলেখকের। তিনি আরও বলেছেন, এ যুগের– সংবাদপত্র বিগত শতাব্দীর সংবাদপত্র অপেক্ষা অনেক বেশী মিথ্যাচারী। তার মুখে শুনেছিলাম, আরও এই উপাদান সংগ্রহ হলে একটি ধারাবাহিক ইতিহাস লেখবার ইচ্ছা তার আছে।

আশা করি ব্রজেন্দ্রনাথের অনুবর্তীগণ আরও উপাদান সংগ্রহ করবেন এবং অচির ভবিষ্যতে কোনও যোগ্য লেখক সমস্ত উপকরণ যাচাই আর অবলম্বন করে সেকালের বাঙালী সমাজের একটি প্রামাণিক ইতিহাস লিখবেন।