বিদ্যালয়ের বাংলাভাষা (১৩৫৯/১৯৫২)
এই নাম দিয়ে শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদয়াল বসু একটি প্রবন্ধ সম্প্রতি শিক্ষা ও সাহিত্য পত্রিকায় লিখেছেন। কথাসাহিত্য আষাঢ় সংখ্যায় তার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। তারই জের টেনে আমি কিছু বলছি। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা : আমার মোটেই নেই। কিন্তু বহু কাল আগে যখন স্কুলে পড়তাম তখন বাংলা ভাষা শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল তার দোষ-গুণ আমার মনে আছে। সেজন্য লেখকের যুক্তি বুঝতে আমার বাধা হয় নি।
কৃষ্ণদয়ালবাবুর এই কালোচিত প্রবন্ধটি শিক্ষাধিকারের কর্তাদের অবশ্যপাঠ্য। যাঁরা বাংলা শিক্ষায় গোড়া থেকে সুব্যবস্থা চান তাদের সকলেরই লেখকের মত ও প্রস্তাবগুলি সযত্নে বিচার করে দেখা উচিত। আলোচনার সুবিধার জন্য মূল প্রবন্ধ থেকে কিছু কিছু তুলে দিচ্ছি–
আমি নিজে বাংলা চলিতভাষার অনুরাগী। কিন্তু বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা চলিতভাষার মোহ ত্যাগ করে তাদের প্রত্যেকটি রচনা সাধুভাষায় লেখা অভ্যাস করুক এই আমি চাই।..ছেলেবেলা থেকেই যেসব ছাত্র চলিতভাষা লিখতে শুরু করে তারা স্বভাবতই তদ্ভব দেশজ ও বিদেশী শব্দ আর বড়জোর গোটাকতক অতিপরিচিত সহজ সরল তৎসম শব্দ দিয়ে কাজ চালিয়ে যায় বলে অধিকাংশ তৎসম শব্দ অপ্রয়োজনে ও অব্যবহারে তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এর অনিবার্য পরিণাম…বাংলা সাহিত্যের বহু শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, বহু ক্লাসিক শ্রেণীর রচনা ছাত্রদের অনধিগম্য ও অপঠিত থেকে যায়।..আমার মতে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষে ভাষাশিক্ষার প্রয়োজনটাই মুখ্য, সাহিত্যদীক্ষার প্রয়োজন গৌণ।..বিদ্যালয়ে চলিত ভাষা যদি আদৌ না চালানো হয় তা হলে ছাত্রদের ব্যাকরণ শিক্ষার চাপটা অনেকখানি কমে যায়।…চলিতভাষা এখন কেবল গড়ে উঠছে, তার ব্যাকরণ এখনও সবটা লেখাই হয় নি।…নিম্নতম শ্রেণী থেকে অষ্টম মান পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের গদ্যাংশ সাধুভাষায় লেখা হওয়া চাই–একটি নিবন্ধও চলিত ভাষায় লেখা হলে চলবে না।…নবম ও দশম মানের জন্য একখানি সংকলন-পুস্তক এতকাল যেমন চলে আসছিল তেমনি চলুক।
.
আমার বিশ্বাস, সাধুভাষা ক্রমশ অচল হয়ে আসছে, ভবিষ্যতে কেবল চলিতভাষাতেই বাংলা সাহিত্যের সকল প্রয়োজন মিটবে। এই বিশ্বাস সত্ত্বেও কৃষ্ণদয়ালবাবুর সমস্ত প্রস্তাব আমি গ্রহণীয় মনে করি। সাধুভাষায় সাহিত্য রচনা একদিন বন্ধ হবে। খবরের কাগজও চলিত ভাষায় লেখা হবে, কিন্তু গত দেড় শ বৎসরে সাধুভাষায় যে বিশাল বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে তার একটা বড় অংশ চিরায়ত বা ক্লাসিক হয়ে থাকবে। এই কারণে সাধুভাষা প্রত্ন হয়ে গেলেও তার চর্চা লোপ পাবে না।
এখন সাধু আর চলিত দুই রীতিতেই বাংলা ভাষা লেখা হচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে চলিতভাষাই একমাত্র সাহিত্যিক ভাষা হয় তবে অষ্টম মান পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে তা বর্জিত হবে কেন? কৃষ্ণদয়ালবাবু তার কারণ দেখিয়েছেন। তার যুক্তির পরিপূরকরূপে কিছু বলছি।
বাংলা সাধুভাষা বহুজনের চেষ্টায় বহু কালে তার সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। চট্টগ্রামের নবীনচন্দ্র সেন, ঢাকার কালীপ্রসন্ন ঘোষ, কলকাতার রমেশচন্দ্র দত্ত, মহারাষ্ট্রের সখারাম গণেশ দেউস্কর একই ভাষায় লিখেছেন। বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি যে রীতির প্রবর্তন করেছেন পরবর্তী লেখকরা তারই অনুসরণ করেছেন। ভঙ্গীর বা স্টাইলের ভেদ থাকলেও তাদের রীতি একই। চলিতভাষার প্রভাবে, নূতনত্বের প্রয়াসে এবং গ্রাম্যতার সংক্রমণে আজকাল সাধুভাষাতেও কিছু বিকার এসেছে, তথাপি চলিতভাষার তুলনায় তা অধিকতর শৃঙ্খলিত। এই শৃঙ্খলা থাকায় সকল জেলার বাঙালীর পক্ষেই সাধুভাষা আয়ত্ত করা সহজ। এ ভাষার ব্যবহার ক্রমশ কমে গেলেও বহুকাল চলবে, সুতরাং বিদ্যালয়ের শিক্ষায় এই ভাষাই প্রশস্ত। আর সঙ্গে যদি চলিত ভাষাও শেখানো হয় তা হলে অল্পবয়স্ক ছাত্ররা দোটানায় পড়বে।
সাধুভাষার তুল্য সুশৃঙ্খল আর সর্বসম্মত হলে চলিতভাষাই বাংলা শিক্ষার একমাত্র বাহন হবে। তখন উচ্চতর শ্রেণীতে সাধুভাষা শেখালেই চলবে। কিন্তু বাংলাভাষার এই পরিবর্তন শীঘ্র হবে এমন সম্ভাবনা দেখি না। চলিতভাষার যতই প্রসার হক, এখনও তা নিয়ন্ত্রিত হয় নি। এই ভাষার যাঁরা প্রধান সংস্থাপক–রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী, তাঁদেরও শব্দাবলীতে সর্বত্র ঐক্য দেখা যায় না (করলাম, করলেম, করলুম, তাঁদের, তাদেরকে, কাকে, কাউকে ইত্যাদি)।
চলিত ভাষার লক্ষণ সম্বন্ধে অনেকের ধারণা স্পষ্ট নয়। সর্বনাম, ক্রিয়াপদ, এবং কয়েকটি অসংস্কৃত বিশেষ্য বিশেষণ আর অব্যয় ছাড়া সাধুভাষার সঙ্গে তার কোনও প্রভেদ নেই। তৎসম শব্দ বেশী থাকলেই সাধুভাষা, আর তদ্ভব দেশজ বা বিদেশজ শব্দ বেশী থাকলেই চলিতভাষা হয় না। অনেকে মনে করেন, কলকাতা অঞ্চলের মৌখিক ভাষাই চলিতভাষা। এই ধারণা একবারেই ভুল। যেমন সাধুভাষা, তেমনি চলিতভাষাও সাহিত্যিক প্রয়োজনে উদ্ভূত ব্যবহারসিদ্ধ বা conventional লৈখিক ভাষা, ভাগীরথীতটবর্তী স্থানের মৌখিক ভাষার সঙ্গে তার কিছু সাদৃশ্য থাকলেও ঐক্য নেই। খাস কলকাতাবাসীর মুখের বুলি–গ্যালো রোববারে কোথায় ছেলে হ্যাঁ? ভের বেতে বরযাত্তর গেশলে বুঝি? এই কথাই সাহিত্যোচিত চলিতভাষায় লেখা হবে–গেল (বা গত) রবিবারে কোথায় ছিলে হে? ভাইএর বিয়েতে বরযাত্র গিয়েছিলে বুঝি?
অনেক লেখক মনে করেন, তৎসম শব্দ যত বাদ দেওয়া যায় ততই ভাল। ভারতের বিভিন্ন ভাষাগুলির একমাত্র যোগসূত্র সংস্কৃত বা তৎসম শব্দাবলী। বহু অবাঙালী বাংলা সাহিত্য পড়ে থাকেন। তাদের অনেকের কাছে শুনেছি–বাংলা লেখায় সংস্কৃত শব্দ বেশী থাকলে তাদের বোঝবার সুবিধা হয়, বাংলায় বিকৃতরূপে আর বিকৃত অর্থে যে উর্দু বা আরবী-ফারসী শব্দ চলে তাতে তাদের সাহায্য হয় না। তৎসম শব্দ কমালে বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে যে যোগসূত্র আছে তা ছিন্ন হবে, বাংলা ভাষার প্রসার কমে যাবে।
চলিতভাষা একটা স্বতন্ত্র ভাষা নয়, সাধুভাষারই কালক্ৰমিক সংস্করণ। সাধুভাষার পদ্ধতির সঙ্গে অনেক রফা করতে হবে, গ্রাম্যতা একবারে বাদ দিতে হবে, তবেই চলিতভাষা সর্বসম্মত প্রামাণিক সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হবে। অবশ্য সাহিত্যে সকল ভঙ্গীরই স্থান আছে। হুতোম পেঁচার সেকেলে বৈঠকী ভাষা, সম্বুদ্ধ লিখিত কয়েকটি গল্পের বরিশালী ভাষা, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের সিলেটী-আরবী-ফারসী-জার্মন-ফ্রেঞ্চের বুকনি দেওয়া বিচিত্র আলাপের ভাষা, রূপদর্শীর স্ল্যাং-বহুল আড্ডার ভাষা–সবই উপভোগ্য এবং সাহিত্যে স্থায়িত্ব পাবার যোগ্য। কিন্তু এ ধরণের লঘু ভাষা রসাত্মক হলেও সর্বার্থসাধক নয়, পাঠ্যপুস্তকের যোগ্যও নয়। যাঁরা খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং গম্ভীর চলিত ভাষাতে লিখে থাকেন, তাদের মধ্যেও এমন লেখক বেশী নেই যাঁদের রচনায় সংস্কৃতেতর শব্দাবলীর ঐক্য আছে–যেমন ঐক্য সাধুভাষার অধিকাংশ লেখকদের রচনায় পাওয়া যায়। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পাঠ্যপুস্তকে সাধুভাষা আর চলিত ভাষা দুইই দিলে তারা দিশেহারা হয়ে একটা খিচুড়ি ভাষায় অভ্যস্ত হবে। রাজনীতি আর চলিত ভাষা দুটোই অপরিহার্য, কিন্তু একটু বেশী বয়সে চর্চা করাই নিরাপদ।
কৃষ্ণদয়ালবাবু নিম্ন শ্রেণীতে ব্যাকরণের চাপ কমাতে বলেছেন। এই প্রস্তাব সমীচীন মনে করি। শিশু যেমন শুনে শুনে মৌখিক ভাষা শেখে, অল্পবয়স্ক ছাত্র তেমনি বই পড়ে সাহিত্যিক বা লৈখিক ভাষা শিখবে। ব্যাকরণ একটি analytical শাস্ত্র, ব্যাকরণ-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থই বিশ্লেষণ। আগে সংঘটন অর্থাৎ বাক্যরচনা, তার পর বিশ্লেষণ বা ব্যাকরণ শেখাই যুক্তিসংগত। ছাত্র যা পড়বে তা থেকেই বানান, শব্দরূপ, ধাতুরূপ, সন্ধিসমাসবদ্ধ পদ, বাক্যরীতি ইত্যাদি শিখবে। প্রাথমিক ব্যাকরণে কৃৎ তদ্ধিত আর সমাস প্রকরণের দরকার দেখি না। ইংরেজী ভাষাতেও নানারকম সমাস আছে (ষষ্ঠীতৎপুরুষ-sunlight, কর্মধারয়-hot bag, বহুব্রীহি–blockhead, অলুক্s on-in-law ইত্যাদি। কিন্তু ইংরেজী প্রাথমিক ব্যাকরণে সমাস-প্রকরণ থাকে না অথবা সংক্ষেপে থাকে। ছাত্র যদি ভবিষ্যতে সাহিত্যিক হয় এবং নূতন নূতন শব্দ আর সমাসবদ্ধ পদ রচনা করতে চায়, তবে তাকে ভাল করে ব্যাকরণ শিখতেই হবে। কিন্তু এই শিক্ষা উচ্চতর শ্রেণীতে হওয়াই ভাল।
[বনফুলকে লিখিত চিঠি। এই সময়ে প্রকাশিত বনফুলের গল্পসংগ্রহ গ্রন্থের ভূমিকারূপে মুদ্রিত।–স:]