আমিষ নিরামিষ (১৮৭৯/১৯৫৭)
মথুর মুখুজ্যে সকালবেলা পার্কে বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর বাল্যবন্ধু অঘোর দত্তর সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হয়ে গেল। দুজনে একটা বেঞ্চিতে বসলেন। মথুরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর, আছ কেমন? বয়স কত হল?
অঘোর দত্ত বললেন, ভাল মন্দ মিশিয়ে আছি, নালিশ করবার কিছু নেই। বয়স প্রায় আটাত্তর হল।
মথুর। আমার পঁচাত্তর, কিন্তু ভাল নই দাদা। বাত হাঁপানি ডিসপেপসিয়া, নানানখানা। আচ্ছা তুমি তো নিরামিষ খাও। কত দিন খাচ্ছ?
অঘোর। তা ষাট-পঁয়ষট্টি বৎসর, ছেলেবেলা থেকেই।
মথুর। বল কি হে! সেই জন্যই এখন পর্যন্ত বেশ আছ। আমিও ভাবছি মাছ মাংস ছেড়ে দেব। আর কেন, ঢের খেয়েছি, শেষ বয়সে সাত্ত্বিক আহারই ভাল। নিরামিষভোজীরা দীর্ঘজীবী হয়, আনি বেসান্ট, বার্নার্ড শ, গান্ধীজী
অঘোর। ভুল করলে ভাই। আমিষ খেয়েও বিস্তর লোক আশি পেরিয়ে বেঁচে আছেন, যেমন চার্চিল, ফজলুল হক, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। যোগেশ বিদ্যানিধি মশাই তো ছেয়ানব্বই পার হয়ে বার্নার্ড শকেও হারিয়ে দিয়েছেন।
এমন সময় ফণী মল্লিক এসে পড়লেন। এঁর বয়স প্রায় ষাট, বহু কাল আগে একবার বিলাত গিয়েছিলেন, তার লক্ষণ সাজে আর চালচলনে এখনও কিছু দেখা যায়। মথুরবাবু বললেন, আসতে আজ্ঞা হক মল্লিক সায়েব, বসুন এইখানে। এই অঘোর দত্তকে চেনেন তো? অদ্ভুত মানুষ, পঁয়ষট্টি বৎসর নিরামিষ খেয়ে বেঁচে আছেন। আচ্ছা মল্লিক মশাই, আপনি তো বিচক্ষণ জ্ঞানী লোক, আমিষ নিরামিষ আহার সম্বন্ধে আপনার মত কি?
ফণী মল্লিক বললেন, প্রচুর আমিষ খাওয়া উচিত, আমিষের অভাবেই হিন্দু জাতির অধঃপতন হয়েছে।
মথুর। আচ্ছা অঘোর, তোমার তো কোনও কালেই ধর্মে তেমন মতি দেখি নি। তবে মাছ মাংস খাও না কি কারণে?
অঘোর। যে কারণে তুমি সাপ ব্যাঙ খাও না।
মথুর। ও একটা বাজে কথা। যদি বলতে অহিংসার জন্য বা স্বাস্থ্যের জন্য খাও না, কিংবা শাস্ত্রমতে প্রশস্ত নয় তাই খাও না তা হলে বুঝতাম।
অঘোর। আমরা যা করি সব কিছুরই কি কারণ বলা যায়? যা বলেছি। তার সোজা অর্থ–তোমার যেমন সাপ ব্যাঙে রুচি হয় না আমার তেমনি মাছ মাংসে হয় না। যদি জেরা কর কেন রুচি হয় না, তবে ঠিক উত্তর দিতে পারব না। হয়তো পাকযন্ত্রের গড়ন এমন যে আমিষ সয় না কিংবা পুষ্টির জন্য দরকার হয় না। হয়তো ছেলেবেলায় এমন পরিবেশে ছিলাম বা এমন কিছু দেখেছিলাম শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম যার প্রভাব স্থায়ী হয়ে আছে। যদি নিরামিষ সহ্য না হত তবে নিশ্চয় আমিষ ধরতাম, যেমন অক্ষয়কুমার দত্ত শেষ বয়সে রোগে পড়ে ধরেছিলেন। আমি কিন্তু পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ন নই। দুধ খাই, যা হচ্ছে খাঁটী গোরস, আর মাঝে মাঝে চিকিৎসার জন্য জান্তব ঔষধও খেতে বা ইনজেকশন নিতে হয়েছে।*
ফণী মল্লিক সহাস্যে বললেন, হ্, এইবার পথে আসুন। এক মার্কিন ভদ্রলোক এচ জি ওয়েল্সকে বলেছিলেন, আপনাদের বার্নার্ড শ একজন ক্ষণজন্মা জ্ঞানী সাধুপুরুষ, নিরামিষ খেয়েই এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্ক চালনা করছেন। ওয়েল্স হেসে বললেন, নিরামিষ না ছাই। দুধ খাচ্ছেন, চীজ খাচ্ছেন, ডিম খাচ্ছেন, আবার প্রতিদিন লিভার এক্সট্রাক্ট ইনজেকশন নিচ্ছেন, যা হল রক্তমাংসের সারাৎসার। শুনুন মথুরবাবু, মাছ মাংস ডিম খেলে যত সহজে পুষ্টি আর শক্তিলাভ হয়, তেমন আর কিছুতে হয় না। জনকতক ভাত ডাল শাগ তরকারি খেয়ে দীর্ঘজীবী হতে পারে, কিন্তু অ্যাভারেজ লোকের পক্ষে আমিষ বর্জন অনিষ্টকর। যার প্রচুর দুধ ক্ষীর ছানা খাবার সামর্থ্য আছে তার হয়তো চলে যেতে পারে, কিন্তু সকলের পক্ষে আর সকল জায়গায় তা সুলভ নয়।
মথুর। কিন্তু শুনেছি মাংস খেলে হিংসাবৃত্তি প্রবল হয়। এই দেখুন না, এদেশে যারা মাংসখোর তারাই দাঙ্গাবাজ আর একটুতে ছোরা মারে।
ফণী। মারবেই তো, অন্য পক্ষ যে নিস্তেজ ভীরু। মুখুজ্যে মশাই, আমাদের যে মাইল্ড হিন্দু বলে খ্যাতি আছে তা মোটেই গৌরবের নয়। আমাদের একটু উগ্র হওয়া দরকার। ভারতীয় আর্যজাতির ইতিহাস দেখুন। রাম লক্ষ্মণ সীতা বনে গিয়ে মাংস খেয়েই জীবনধারণ করতেন। চিত্রকূট আর দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে চাল ডাল আটা পাবেন কোথা? পেলে অবশ্য ফলমূলও খেতেন, কিন্তু সেটা তাদের প্রধান খাদ্য ছিল না, শুধু ভাইটামিন-সিএর জন্য খেতেন। বনবাসী পাণ্ডবরাও তাই করতেন। তারা এত হরিণ মারতেন যে সেখানকার ঋষিরা তাদের অন্যত্র চলে যেতে বলেছিলেন। আমাদের মাংসাশী পূর্বপুরুষরা তেজস্বী মহাবীর যুদ্ধবিশারদ ছিলেন, আবার বেদ-বেদান্তও রচনা করেছেন। তাদের বংশধররা বৌদ্ধ আর জৈনদের নকলে নিরামিষভোজী হয়েই অধঃপাতে গেছে।
মথুর। অঘোর, তুমি কি বল? মাংসাহার আসুরিক নয় কি? তাতে কাম ক্রোধ লোভাদি রিপু আর হিংস্রতা প্রবল হয় না কি?
অঘোর। ঠিক বলতে পারি না। নিরামিষাশী গণ্ডার মোষ আর ষাঁড়ের ক্রোধ নেহাত কম নয়। বাঁদর আর ছাগলের প্রথম রিপু বাঘ সিংগির চাইতে প্রবল। শুনেছি হিটলার নিরামিষ খেতেন, কিন্তু অহিংস হতে পারেন নি। আমিষাশী লোকের তুলনায় নিরামিষাশীর সংযম হয়তো মোটের উপর কিছু বেশী, কিন্তু তার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। চুরি জুয়াচুরি ভেজাল কালোবাজার লাম্পট্য ইত্যাদি নানারকম দুষ্কর্ম আমাদের দেশের নিরামিষ খোরদের মধ্যে কিছুমাত্র কম নয়। এদেশের অনেক লোক গরুকে মাতৃজ্ঞান করে, বাঁদরকে ভ্রাতৃজ্ঞান করে, কিন্তু গোখাদক শিকারপ্রিয় পাশ্চাত্ত্য জাতিদের তুলনায় আমাদের জন্তুপ্রীতি মোটের উপর কম। নিরামিষ ভোজন বেশী হিতকর কি না তার পরীক্ষা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত হয় নি। যদি শ-খানিক শিশুকে একই পরিবেশে প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত রাখা হয় এবং তাদের পঞ্চাশ জনকে আমিষ আর পঞ্চাশ জনকে নিরামিষ খাওয়ানো হয় তবে তাদের স্বাস্থ্য আর চরিত্রের গড়পড়তা প্রভেদ দেখে খাদ্যের গুণাগুণ বিচার করা যেতে পারে। তবে এ কথা ঠিক যে আধুনিক খাদ্য-বিজ্ঞানীরা বেশী মাংস খাওয়ার নিন্দা করেন, আমিষ-নিরামিষ মিশ্রিত খাদ্যই ভাল মনে করেন।
ফণী। আমিও মানি যে মিশ্রিত আহারই ভাল। কিন্তু খাদ্যবিজ্ঞানীরা শুধু বেশী মাংস খাওয়ার নিন্দা করেন না, অতিরিক্ত স্টার্চ মিষ্টান্ন আর তেল ঘিও অনিষ্টকর বলেন। আমরা বাঙালীরা যা খাই তাতে মাছ মাংসের মাত্রা নিতান্তই কম। এদেশে নদীবহুল অঞ্চল আর সমুদ্রের উপকূলে বিস্তর মাছ পাওয়া যায়, সেই বিধিদত্ত খাদ্য না খাওয়া ঘোরতর বোকামি। মাছ পাঠা মটন ডিম আমাদের নিষিদ্ধ খাদ্য নয়, মুরগিও জাতে উঠেছে, আজকাল পোর্ক আর বীফেও অনেকের আপত্তি নেই। এখন দরকার যেমন করে হক আহারে আমিষের মাত্রা বাড়ানো। আমরা যদি আহার বিষয়ে পাশ্চাত্ত্য জাতিদের সমান না হই তবে জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে যাব। কূপমণ্ডুক হয়ে সনাতন বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ থাকার দিন চলে গেছে। আমাদের এখন নানা উপলক্ষে দেশবিদেশে যেতে হয়, এ খাব না ও খাব না বলে আবদার করলে চলবে না। সভ্য মানুষের পোশাক যেমন প্রায় এক ধরনের হয়ে পড়ছে, সভ্য মানুষের খাদ্যও তেমনি ইউনিভর্সাল হওয়া দরকার। অঘোরবাবু যে সাপ ব্যাঙের সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন তা অত্যন্ত কুযুক্তি। সাপ ব্যাঙে রুচি না হবারই কথা, কিন্তু সভ্য লোকে সর্ব দেশে যা খায় তার উপর ঘৃণা থাকা সুরুচির পরিচয় নয়।
অঘোর। সাপ ব্যাঙ শুওর গরু ছাগল ভেড়া কোনওটার উপর আমার ঘৃণা নেই, সবাই কৃষ্ণের জীব। সায়েবদের যেমন কাঁঠাল কয়েতবেল আর টোপাকুলের গন্ধ সয় না, আমারও তেমনি আমিষের গন্ধ সয় না। নিজে খাই না, কিন্তু যারা খায় তাদের রুচির নিন্দা করি না। মল্লিক মশাই, আপনি রামায়ণ মহাভারত থেকে উদাহরণ দিয়েছেন। দয়া করে আর একটু পশ্চাতে দৃষ্টিনিক্ষেপ করুন। আমাদের পূর্বপুরুষ অতি প্রাচীন মানবজাতি কি খেয়ে জীবনধারণ করত? যখন পশুপালন আর কৃষিকর্ম জানা ছিল না তখন মানুষ শুধু শিকার করা জন্তু নয়, সাপ ব্যাঙ ইঁদুর টিকটিকি শামুক গুগলি ফড়িং পোকা, মায় নরমাংস, যা জুটত তাই খেত। পাওয়া গেলে ফলমূলও খেত, কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক সত্য মানতে হবে যে প্রায় সকল প্রাণীই মানুষের ভক্ষ্য হতে পারে, কিন্তু সকল উদ্ভিদ নয়। পশুপক্ষিপালন শেখার পর মানুষ পালিত জন্তুর মাংস দুধ ডিম খেতে শুরু করল। তার পর কৃষির প্রচলন হলে নানারকম শস্য উৎপন্ন হতে লাগল, খাদ্যের বৈচিত্র্য বেড়ে গেল। মানুষের রুচি কালে কালে বদলায়, এক শ বছর আগে আমরা যা খেতাম এখন ঠিক তা খাই না। মোট কথা, আমাদের অতি প্রাচীন পূর্বপুরুষদের সাপ ব্যাঙ পোকামাকড়ে বিলক্ষণ রুচি ছিল, তার পর ক্রমশ রুচি বদলেছে, আধুনিক সভ্য মানুষ নানা রকম আমিষ নিরামিষ খেতে শিখেছে, সেকালের অনেক খাদ্যের উপর বিতৃষ্ণাও জন্মেছে। কিন্তু এখনও অসভ্য আর অর্ধসভ্য জাতি আছে যাদের সাপ ব্যাঙ ইঁদুর পোকায় আপত্তি নেই।
ফণী। আদিম মানুষ কি খেত আর একালের অসভ্য মানুষ কি খায় তা আমাদের দেখবার দরকার নেই। আমার বক্তব্য আধুনিক সভ্য সমাজে যা খুব চলে তাই আমাদের খেতে হবে।
অঘোর। অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ কতকগুলি প্রাণীর মাংস ডিম দুধ আর বাছা বাছা শস্য তরকারি ফল মূল। হিন্দুর লোকাঁচার অনুসারে মাছ ছাগল ভেড়া হরিণ হাঁস ইত্যাদি কয়েকটি প্রাণীর মাংস শুদ্ধ। শাস্ত্রে পাঁচটি পঞ্চনখ জন্তু খাবার বিধানও আছে–খরগোশ শজারু গোসাপ গণ্ডার আর কচ্ছপ। এখন নতুন ফর্দ করতে হবে, সায়েবরা যা খায় অর্থাৎ গরু শুওর ইত্যাদিও খেতে হবে। পোর্ক আর বীফ দুর্মূল্য হওয়ায় পাশ্চাত্ত্য দেশে আজকাল ঘোড়া আর তিমি অর্থাৎ হোয়েলের মাংসও চলছে। সায়েবরা ব্যাঙের ঠ্যাং আর ঝিনুকের কাঁচা শাঁসও অতি সুস্বাদু মনে করে। অতএব এসবেও আপত্তি করা চলবে না। মল্লিক মশাই, এই তো আপনার মত?
ফণী। হাঁ, তবে সায়েব বললে ঠিক হবে না, বলুন আধুনিক সুসভ্য জাতিরা।
অঘোর। সুসভ্য জাতিদের মধ্যে যাঁরা বিজ্ঞতম আর দূরদর্শী তারা বুঝেছেন যে অভ্যস্ত বাছাবাছা খাদ্যের উপর একান্ত নির্ভর ভাল নয়। দরকার হলে অনভ্যস্ত খাদ্যও খেতে হবে, যাতে পুষ্টি হয় আর স্বাস্থ্যহানি হয় না। পুরাণে আছে, দুর্ভিক্ষের সময় বিশ্বামিত্র সপরিবারে কুকুরের মাংস খেতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে যুদ্ধ বা আবিষ্কার ইত্যাদির অভিযানে অবস্থা বিশেষে অনভ্যস্ত খাদ্যও খাবার দরকার হতে পারে। সম্প্রতি বিলাতে আর ফ্রান্সে জনকতক ভলনটিয়ারকে কিছুদিনের জন্য এমন জায়গায় নির্বাসিত করা হয়েছিল যেখানে মামুলী খাদ্য মোটেই মেলে না। তাদের প্রতি। নির্দেশ ছিল, ফল মূল পাতা পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ মাছ ব্যাঙ শামুক গুগলি যা জোটে তাই কাঁচা খেয়ে জীবনধারণ করতে হবে। তারা ফিরে এলে দেখা গেল যে তাদের কিছুমাত্র স্বাস্থ্যহানি হয় নি। আমাদের দেশেও ওই রকম আপৎকালীন আহারের অভ্যাস হওয়া দরকার।
মথুর। দেখ অঘোর, তুমি একটি ভণ্ড। নিজে নিরামিষ খাও অথচ মল্লিক মশাইকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি কি বলতে চাও, সাপ ব্যাঙ পোকা মাকড় খেতে না শিখলে আমাদের নিস্তার নেই?
ফণী। অঘোরবাবু আমার লেগ পুল করছেন।
অঘোর। আজ্ঞে না। আপনি অনেক সারগর্ভ কথা বলেছেন, আমি শুধু আপনার যুক্তি আর একটু ফালাও করবার চেষ্টা করছি।
মথুর। আচ্ছা মল্লিক মশাই, আমিষ খাদ্য খুব পুষ্টিকর তা তো বুঝলাম। কিন্তু অহিংসা হচ্ছে পরম ধর্ম, অতএব কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্যহানি মেনে নিয়েও নিরামিষাশী হওয়া উচিত নয় কি? প্রাচীন যুগের অবস্থা যাই হক, ঈশ্বরকৃপায় এখন যখন চাল ডাল গম তরকারি আর কিছু কিছু দুধও জুটছে, আর মাছ মাংসের বাজারও আগুন, তখন নিরামিষ খাওয়াই আমাদের উচিত, এই কি ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয়?
ফণী। ঈশ্বরের অভিপ্রায় কি তা জানবেন কি করে? সকলেই অহিংস হবে আর নিরামিষ খাবে এই যদি সৃষ্টিকর্তার মতলব হত, তবে তিনি বাঘ সিংগি বেরাল প্রভৃতি জানোয়ার সৃষ্টি করতেন না, সব জন্তুকেই গরু ছাগলের মতন নিরামিষাশী করতেন। পৃথিবীতে বিস্তর প্রাণী আছে যারা বিধাতার বিধানেই আমিষাশী হয়েছে, হিংসার পাপ তাদের স্পর্শ করে না। মানুষকেও সেই দলে ফেলবেন না কেন?
অঘোর। কিন্তু মানুষ শুধু আমিষ খায় না, লাউ কুমড়ো আম কাঁঠালও খায়। বিধাতা আমাদের বাঘ সিংগির দলে ফেলেন নি, বরং বলতে পারেন, ভালুক শেয়াল ইঁদুর কাগ প্রভৃতি সর্বভুক জানোয়ারের দলে ফেলেছেন।
ফণী। এ কথায় আমার আপত্তি নেই।
অঘোর। আরও একটা কথা। বিধাতা আমাদের এমন বুদ্ধি দিয়েছেন, যাতে চিরাভ্যস্ত খাদ্য বদলাতে পারি।
মথুর। তাইতো, বিষয়টা বড়ই গোলমেলে ঠেকছে। তোমরা দুই তার্কিকে মিলে আমার মাথা গুলিয়ে দিলে।
অঘোর। শোন মথুর, এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামিও না, কূল কিনারা পাবে না। শাস্ত্রে আছে, যাতে জীবের অত্যন্ত হিত হয়, তাই ধর্ম। কিন্তু মুশকিল এই, বেরালের যা হিত ইঁদুরের তা নয়, মশা মাছি ছারপোকার যা হিত মানুষের তা নয়। অহিংসা পরম ধর্ম, কিন্তু তা পুরোপুরি মেনে চলা আমাদের অসাধ্য। আমিষাহার না হয় বর্জন করা গেল, কিন্তু আরও অনেক নিষ্ঠুর কর্ম আমরা চোখ বুজে করে থাকি। ষাঁড়কে নপুংসক করে বলদ বানিয়ে নাকে দড়ি দিয়ে খাটাই। কোটি কোটি পোকা মেরে পবিত্র আর শৌখিন এণ্ডি গরদ তসর তৈরি করি, তুচ্ছ শখের জন্য পাখিকে খাঁচায় পুরি, নানা জন্তুর স্বাধীনতা হরণ করে জুএ বন্দী করি, পোলিও-ভ্যাকসিন তৈরির জন্য হাজার হাজার বাঁদর চালান দিই, তাদের বধ করা হবে জেনেও। এসব কি জীবহিংসা নয়? আমাদের স্বভাব হঠাৎ বদলানো যাবে না। আমিহার অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে, শাস্ত্রে তার নিন্দা থাকলেও বারণ নেই। মনুর সেই বচনটি জান তো? ন মাংস ভক্ষণে দোষো ইত্যাদি। প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং–লোকের প্রবৃত্তিই এই রকম, নিবৃত্তিস্তু মহাফলা–তবে ছাড়তে পারলে মহা ফললাভ। আমাদের দেশের অনেক মহাপুরুষ মাংসাহার সমর্থন করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার গৌরদাস বাবাজীকে দিয়ে বলিয়েছেন, বাপু, ভগবান কোথায় বলেছেন যে পাঁঠা খাইও না?…পদ্মপুরাণ খোল, দেখাইব যে মাংস দিয়া বিষ্ণুর ভোগ দিবার ব্যবস্থা আছে। বিবেকানন্দ মাংসভোজন আবশ্যক বলেছেন। এ দেশের যেসব সম্প্রদায় বংশানুক্রমে নিরামিষাশী ছিল, তাদেরও অনেকে আজকাল আমিষ খাচ্ছে, আধুনিক ভারতে নিরামিষভোজী কমছে, আমিষভোজী বাড়ছে।
মথুর। তবে কি তোমরা বলতে চাও আমিষ না খাওয়াই দোষের?
ফণী। তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
অঘোর। আমি তা বলি না। এ যুগের ঋষি হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। খাদ্য বিজ্ঞানী যে ব্যবস্থা দেবেন, তাই মেনে নেওয়া ভাল। অবশ্য সেকালের ঋষিদের মতন আধুনিক ঋষিদেরও মতভেদ আছে। যার ব্যবস্থা আমাদের মনের মতন হয়, তাই মেনে নেওয়া যেতে পারে।
ফণী। অঘোরবাবু, আপনাদের শাস্ত্রে আছে না–মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ? মহাজন অর্থাৎ বেশীর ভাগ লোকে যা করে, তাই হচ্ছে ধর্মের পথ। অতএব আমিষাহারই ধর্ম। আপনি ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন।
অঘোর। মহাজনের পথ ছেড়ে অন্য পথে চললেই লোকে ধর্মভ্রষ্ট হয় না। গৈরিকধারী সন্ন্যাসী, আজীবন ব্রহ্মচারী, ছাতু-মা-ভোজী নির্বাক মৌনী বাবা, বিবস্ত্র নেংটা বাবা–এরা খাপছাড়া, কিন্তু অধার্মিক নয়। নিরামিষ ভোজীকেও যদি এইসব ক্ল্যাংকের দলে ফেলেন, তবে আপত্তি করব না। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না। কালক্রমে নিরামিষ ভোজনই সভ্যজনের প্রিয় হওয়া অসম্ভব নয়। অহিংসা প্রবৃত্তির প্রসারের ফলে আমাদের রুচি বদলাতে পারে। নিরামিষের তুলনায় আমিষ খাদ্যে টোমেইন আর নানা রকম ক্রিমি কীট (যেমন trichina, fluke ইত্যাদি) জন্মাবার সম্ভাবনা বেশী, এই কারণেও আমিষের আকর্ষণ কমতে পারে। হয়তো ভবিষ্যতে সভ্য মানবের বিচারে আমিষ খাদ্য অসুন্দর অহূদ্য অনাবশ্যক গণ্য হবে। অনেক পাশ্চাত্ত্য শিকারী লিখেছেন, মানুষের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বলে বাঁদরের মাংস তারা খেতে পারেন না। সর্বজীবে সমজ্ঞান বৃদ্ধি পেলে হয়তো কোনও মাংসেই রুচি হবে না।
মথুর। বাঁদর তো আমাদের পূর্বপুরুষ?
অঘোর। ঠিক পূর্বপুরুষ নয়, নিকট জ্ঞাতি বলা যেতে পারে। সম্প্রতি প্রফেসর হলডেন দিল্লিতে বক্তৃতায় বলেছেন, মাছই আমাদের অতি প্রাচীন আদিম পূর্বপুরুষ।
মথুর। কি ভয়ানক কথা! তাহলে মাছ খাওয়া মানে পিতৃমাংস ভক্ষণ? আচ্ছা দেড় টাকা সেরের চুনো পুঁটিও কি আমাদের পূর্বপুরুষ?
অঘোর। চুনো পুঁটি কই মাগুর ইলিশ রুই কাতলা সবাই। তবে চিংড়ির কথা আলাদা, ওরা হল মাকড়সা আর কাকড়াবিছার সগোত্র।
মথুর। মহাভারত! তা হলে খাব কি?
অঘোর। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি বলছে, হাতি ঘোড়া থেকে পোকা মাকড় পর্যন্ত সব প্রাণীই মানুষের ভক্ষ্য। প্রবৃত্তি বলছে, বাছা বাছা গুটিকতক প্রাণীই খেতে ইচ্ছা করে। অন্তরাত্মা বলছে, নিরামিষেই যখন কাজ চলে তখন জীব-হিংসার দরকার কি।
ফণী। সব গাঁজা। আমিষ ত্যাগ করলে মানুষের অধঃপতন হবে, নিরামিষ খাদ্যে এসেনশ্যাল আমিনো-অ্যাসিডের অভাব আছে।
অঘোর। খাদ্যবিজ্ঞানী আর রসায়নী হয়তো সে অভাব পূরণ করতে পারবেন। সয়াবীন, চীনাবাদাম, তিল, ঈস্ট, খুদে পানা ইত্যাদি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে।
মথুর। তা হলে এখন করা যায় কি?
অঘোর। দেখ মথুর, প্রবৃত্তিই বলবতী। যাতে তোমার রুচি হয়, যা তোমার পেটে সয়, তাই খাবে। ভবিষ্যতে হয়তো মাছ মাংসের অনুকল্প উপাদেয় সুষম নিরামিষ খাদ্য আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু তা তোমার আমার ভোগে লাগবে না। মল্লিক মশায়ের বয়স কম, উনি হয়তো চেখে দেখবার সুযোগ পাবেন। এখন ওঠা যাক, অনেক বেলা হয়েছে।
[* প্রায় কোনও প্রচ্ছন্নতা না রেখে নিজেকে এতটা project বোধহয় আর কখনও করেন নি। বয়স আটাত্তর, ৬০/৬৫ বৎসর অর্থাৎ ১২/১৩ বৎসর বয়স থেকে নিরামিষাশী ও সব বিষয় চরম বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর rational মতবাদ। ফোটোগ্রাফ না হলেও অঘোর দত্ত নিখুঁত আত্মপ্রতিকৃতি। আর হয়তো ছেলেবেলায় এমন কিছু পড়েছিলাম…–আমার শৈশবে একবার বলেছিলেন–রাজর্ষি; ওটাও আমার নিরামিষ খাওয়ার একটা কারণ। আবার–মোটেই ভেজিটেরিয়ন নই, রোজ খাঁটী গোরস খাচ্ছি–এও বলেছেন। স:।]