আমাদের পরিচ্ছদ (১৮৭৮/১৯৫৬)
সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু এক বক্তৃতায় বলেছেন, ইওরোপীয় পোশাকের উপর এ দেশের লোকের অত্যন্ত ঝোঁক তিনি পছন্দ করেন না। কি রকম সাজ ভারতবাসীর উপযুক্ত তা তিনি খোলসা করে বলেন নি। কয়েক বৎসর পূর্বে যখন তিনি ইংলান্ডে গিয়েছিলেন তখন কাগজে তার হ্যাট কোট টাই ট্রাউজার পরা ছবি বেরিয়েছিল। সম্প্রতি আমেরিকা ভ্রমণের ছবিতে তাঁর পরনে লংকোট টাই আর গান্ধীটুপি দেখা গেছে। ভারতবর্ষে তিনি চুড়িদার পাজামা আচকান আর গান্ধীটুপি পরে থাকেন। অতএব ধরে নিতে পারি সর্বাবস্থায় সাহেব সেজে থাকাই তার অপছন্দ; ক্ষেত্র বিশেষে বিলাতী বা দেশী-বিলাতীর মিশ্র পোশাকে তার সম্মতি আছে।
হিন্দীতে একটা প্রবাদ আছে যার মানে নিজের রুচিতে খাবে আর পরের রুচিতে পরবে। নিজের রুচিতে সাজতে গেলে বাধা পাওয়া যায় তা আমি দেখেছি। একবার দরজীকে ফরমাশ করেছিলাম–আমার যে পঞ্জাবি করবে তার বুকের উপর বাঁ দিকে একটা মামুলী পকেট হবে, আর ভিতরে ডান দিকে আর একটা পকেট হবে; বাঁ দিকের পকেট বাইরে, আর ডান দিকেরটা ভিতরে। বুঝেছ? দরজী বলল, আজ্ঞে ঠিক বুঝেছি। যখন জামা তৈরি হয়ে এল তখন দেখলাম দুটো পকেটই বাঁ দিকে, একটা বাইরে আর একটা ঠিক তার পিছনে ভিতর দিকে। বললাম, এ কি করেছ মিয়া? মিয়া উত্তর দিল, দুটো দু দিকে থাকলে যে বেপ্যাটান হবে বাবু, তা তো দস্তুর নয়। দরজী নিষ্ঠাবান লোক, দস্তুর ভঙ্গের পাতক থেকে আমাকে রক্ষার জন্য নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিল। আর একবার পঞ্জাবির ফরমাশ দিয়েছিলাম যার বুক কোটের মতন সবটা খোলা যায়। দরজী এবারে আমার অনুরোধ রেখেছিল। কিন্তু শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা বলল, এ কি রকম বেয়াড়া জামা! এ যে কোটজাবি, না কোট না পঞ্জাবি, ফেলে দাও এটা। আমি ফেলি নি, দু-তিন জন আমার দেখাদেখি কোটজাবি বানিয়েছিল।
.
সমস্ত ভারতের স্ত্রীপুরুষের পরিচ্ছদের আলোচনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য চলচ্চিন্তা নয়, কেবল বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথাই বলব, প্রথমে পুরুষের, শেষে মেয়ের। পরিচ্ছদ সম্বন্ধে আমাদের রুচি তিন কারণে প্রভাবিত হয়– (১) গতানুগতিক রীতি, (২) সাময়িক ফ্যাশন হুজুক বা বিখ্যাত লোকের আদর্শ এবং (৩) স্বাস্থ্য স্বাচ্ছন্দ্য বা সুবিধার জ্ঞান। তা ছাড়া আর্থিক কারণ বা সুলভতা দুর্লভতা তো আছেই।
গতানুগতিক রীতি কালক্রমে বদলায়। আমার শৈশবে অর্থাৎ প্রায় সত্তর বৎসর আগে সাধারণ ভদ্র বাঙালীর পরিচ্ছদ ছিল ধুতি পিরান চাদর আর বিলাতী গড়নের জুতো (শু বা পম্প)। পিরানের আকার আধুনিক পঞ্জাবির মতন, কিন্তু ঝুল কম। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতরা পরতেন ধুতি, কোরতা বা খাটো আঙরাখা, চাদর আর চটি, অনেক সময় শুধু ধুতি চাদর চটি। কোরতায় বোতামের বদলে ফিতা থাকত, ঝুল কোমর পর্যন্ত। খাটো আঙরাখার গড়ন চাপকানের মতন কিন্তু ঝুল নিতম্ব পর্যন্ত। কীর্তন-গায়করা এখনও কোরতা পরে থাকেন। গেঞ্জির চলন ৬০৭০ বৎসর আগে হয়। সেকালে নাম ছিল। গেঞ্জিফ্রক। ইংলান্ড আর ফ্রান্সের মাঝে যেসব দ্বীপ আছে তার একটার নাম। Guernsey আর একটার Jersey। তা থেকেই জামার নাম গেঞ্জি আর জার্সি হয়েছে।
বিলাতফেরতরা তখন সর্বদা সাহেবী পোশাক পরতেন, সুরেন বাড়জ্যে এবং আরও দু-চার জন ছাড়া। উকিল ডেপুটি সবজজ আর বড় কর্মচারীরা ইজার চাপকানের উপর চোগা বা পাকানো চাদর পরতেন, মাথায় শামলা বা পিরালী পাগড়ি দিতেন। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিতে আছে, মহেন্দ্র চাপকান পরে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে যেত। শীতকালে অবশ্য সকলেরই পোশাকের পরিবর্তন হত, মধ্যবিত্তরা ধুতির উপর গরম কোট এবং র্যাপার বা শাল পরতেন। অল্প কয়েক জন অতি সেকেলে লোক পারসী কোট (ঝুল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত) আর চায়না কোট (গলায় কলার নেই, ঢিলা গড়ন) পরতেন।
প্রায় ষাট বৎসর আগে অল্পবয়স্কদের মধ্যে পিরানের বদলে শার্টের প্রচলন হল। শার্টের উপর চাদর বা উড়নি ইচ্ছাধীন, কিন্তু কলকাতার যুবসমাজে কোটের উপর চাদর পরা বাঙাল বা খোট্টা-বাঙালীর লক্ষণ গণ্য হত। ক্রমশ শিক্ষিত লোকের অনেকের হুঁশ হল, শার্ট হচ্ছে সাহেবদের অন্তরীয়, কোটের নীচে পরবার। তখন তার বদলে এল পঞ্জাবি, অর্থাৎ বেশী ঝুলওয়ালা পিরান। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর সাজ নিরূপিত হয়ে গেল– ধুতি আর পঞ্জাবি, তার উপর চাদর ইচ্ছাধীন। ধুতি-চাদর আমাদের বহু প্রাচীন পরিধেয়, কিন্তু পঞ্জাবি নামেই বোঝা যায় এটি খাঁটি বাঙলা দেশের জিনিস নয়। পিরান শার্ট আর পঞ্জাব অঞ্চলের আজানুলম্বিত কমীজ-এর মিশ্রণে পঞ্জাবি নামক জামার উৎপত্তি হয়েছে। ১৯২০-৩০ নাগাদ চাপকান চোগা শামলা পাগড়ি লোপ পেতে লাগল এবং সাহেবী সাজই সম্ভ্রান্ত পোশাক গণ্য হল, কিন্তু হ্যাট বহুপ্রচলিত হয় নি।
কাপড়ের দাম ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার ফলে বালক আর কিশোরদের মধ্যে হাফপ্যান্টের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। ধুতি পরা ছোট ছেলে এখন আর প্রায় দেখা যায় না, মেয়েরাও কিশোর বয়স পর্যন্ত ফ্রক পরে। যুবা আর প্রৌঢ়দের মধ্যে ধুতির বদলে পাজামা ইজার বা প্যান্টের প্রচলন ক্রমশ বাড়ছে। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বদেশী রুচি লুপ্তপ্রায় হয়েছে, এখন হরেক রকম ইজার প্যান্ট শার্ট আর শার্ট-কোটের খিচুড়ি চলছে, অদূর ভবিষ্যতে বাঙালীর জাতীয় পরিচ্ছদ কি দাঁড়াবে বলা অসম্ভব।
.
গত সত্তর বৎসরে আমাদের পরিচ্ছদের যে ক্রমিক পরিবর্তন হয়েছে তার একটি কারণ নকল, ফ্যাশন বা হুজুক, অন্য কারণ ধুতির মূল্যবৃদ্ধি। কি রকম পরিচ্ছদ আমাদের উপযুক্ত তা নূতন করে বিচারের পূর্বে কতকগুলি বিষয় মেনে নেওয়া যেতে পারে। যথা
(১) সর্বাবস্থায় একই রকম পরিচ্ছদ চলতে পারে না, কর্মভেদে এবং ঋতুভেদে বেশের পরিবর্তন হবেই।
(২) ভারতের সকল প্রদেশের আবহাওয়া সমান নয়, সে কারণে পরিচ্ছদও সমান হতে পারে না। তথাপি সর্বভারতীয় মিলনের ক্ষেত্রে কিছু সাম্য থাকা বাঞ্ছনীয়।
(৩) ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন জাতির পরিচ্ছদে খুব মিল আছে। ইংরেজী যেমন বিশ্বরাজনীতির ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইওরোপীয় পোশাকও তেমনি সর্বজাতির ভব্য পরিচ্ছদ হয়ে পড়েছে। ভারতবাসী যদি ইওরোপীয় পোশাক অল্পাধিক গ্রহণ করে তবে আপত্তির কারণ নেই। অবশ্য ইওরোপীয় পোশাকের সবটাই স্বাস্থ্যের অনুকূল আর সুবিধাজনক নয়, অনাবশ্যক উপকরণও তাতে আছে (যেমন নেকটাই), সে কারণে কিছু কিছু সংস্কার হওয়া উচিত।
ফ্যাশন অগ্রাহ্য করে শুধু স্বাস্থ্য আর সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রেখে যদি বাঙালীর পরিধেয় নির্ধারণ করা যায় তবে তা কি রকম হবে? অনেক কাল আগে একজন মান্যগণ্য ইংরেজ (নাম মনে নেই) কয়েক বৎসর বাঙলা দেশে বাস করে বিলাতে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন–We are baked for four months, boiled for four months and allowed to cool for four months। এই বিবরণে অত্যুক্তি আছে, কিন্তু এ কথা ঠিক যে আমাদের মাতৃভূমি গ্রীষ্মকালে সর্বদা মলয়জশীতলা থাকে না, গুমট আর ভেপসা গরম দুইই আমাদের ভোগ করতে হয়। এ দেশের বাতাস পশ্চিম ভারতের মতন শুখনো নয়, সেজন্য তাপ প্রবল না হলেও ঘাম বেশী হয়। এখানে বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত প্রায় সাত মাস অল্পাধিক গরম, শীত ঋতুও মৃদু ও অল্পস্থায়ী। অতএব আমাদের পরিধেয় প্রধানত আর্দোষ্ণ (humid and hot) বায়ুর উপযুক্ত হওয়া উচিত। অবশ্য শীতকালে পরিবর্তন করতে হবে।
আরব দেশের লোক গ্রীষ্মের তাপ রোধের জন্য সাদা কাপড়ের চোগা পরে, পুরুষরাও সাদা ঘোমটা দিয়ে মাথা আর মুখের দু পাশ ঢাকে। আমাদের দেশে গ্রীষ্মের দু-এক মাস খালি গায়ে আর খালি মাথায় বাইরে গেলে তাতের জন্য কষ্ট হয়, ছাতা বা আর কিছু দিয়ে মাথা ঢাকতে হয়। কিন্তু পূর্বোক্ত সাত মাসের বাকী সময় বাতাস আদ্রোষ্ণ থাকে, তখন অল্প পরিচ্ছদই স্বাস্থ্যকর। ইওরোপীয় পুরুষ খালি গায়ে মোটরে চলেছে এই দৃশ্য এখন কলকাতায় বিরল নয়। আমাদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অনেকে সেকালে যা পরতেন এবং এখনও যা পরেন–ধুতি চাদর আর চটি–এই হলেই যথেষ্ট। তাত অথবা অল্প ঠাণ্ডার সময় চাদর দিয়ে গা ঢাকা যেতে পারে, ভেপসা গরমে চাদর কাঁধে রেখে গায়ে হাওয়া লাগানো যেতে পারে। কিন্তু মানুষের রুচি সকল ক্ষেত্রে যুক্তির বশে চলে না। ভারত সরকার আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, আমাদের ভব্যতার ধারণাও বদলাচ্ছে, আগে যা বিলাস গণ্য হত এখন তা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। শুধু ধুতি চাদর চটি এখন অচল, আমাদের গলা থেকে পা পর্যন্ত সবই ঢাকতে হবে।
ধুতির অনেক গুণ। সেলাই করতে হয় না, সহজে পরা যায়, সহজে খোলা যায়, গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে না, হাওয়া লাগতে দেয়, নিত্য কাঁচা যায়, ইস্তিরি না করলেও চলে। ধুতি শব্দের মূল রূপ ধৌতি, অর্থাৎ যা নিত্য ধৌত করতে হয়। আধুনিক ভদ্র বাঙালী যেভাবে ধুতি পরে তা নির্দোষ নয়। সামনে এক গোছা কোঁচা নিরর্থক, তাতে শুধু বোঝা বাড়ায় আর হাওয়া আটকায়। প্রমাণ ধুতি যদি দশ হাতের বদলে আট হাত করা হয় তবে লজ্জা নিবারণে কিছুমাত্র বাধা হয় না, শরীরে বেশী হাওয়া লাগে, কাপড়ের ওজন ১/৫ ভাগ কমে, দামও কমে।
বাঙালীর কোঁচা একটা সমস্যা, পথে চলবার সময় অনেকেই বাঁ হাতে কোঁচার নিম্নভাগ ধরে থাকে। সেকালের ভারতীয় সুন্দরীদের হাতে লীলাকমল থাকত, মধ্যযুগের রাজাবাদশাদের হাতে গোলাপ ফুল বা শিকারী বাজপাখী থাকত, ভিকটোরীয় যুগের বিলাসিনীদের হাতে flirting fan থাকত। মানবজাতির কাণ্ডজ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়ায় ওসব অনাবশ্যক প্রথা লোপ পেয়েছে। বর্তমান কর্মময় যুগে পথচারী বাঙালী কোঁচার দায়ে এক হাত পঙ্গু করেছে এই দৃশ্য অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। কেঁচার নীচের অংশটা কোমরে খুঁজলে ক্ষতি কি?
শৌখিন ধনী বাঙালী যাঁরা সাধারণত ইওরোপীয় পরিচ্ছদ ধারণ করেন তাঁরাও বিবাহ শ্ৰাদ্ধ ইত্যাদির সভায় ধুতি পরে আসেন। অনেকের পরনে আভিজাত্যসূচক ৫২ ইঞ্চি বা আরও বেশী বহরের সূক্ষ্ম ধুতি থাকে, হাঁটবার সময় কেঁচার স্তবকতুল্য নিম্নভাগ মাটিতে লুটয়। চণ্ডীদাসের নায়িকা যেমন নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলত, শৌখিন বাঙালী নাগরিক তেমনি কেঁচাটি লুটিয়ে ঝেটিয়ে ঝেটিয়ে চলে। একজন সুপরিচিত ভদ্রলোককে বলেছিলাম –মাটিতে যত ময়লা আছে সবই যে কেঁচায় লাগছে! উত্তর দিলেন, লাগুক গে, কালই তো লনড্রিতে যাবে।
আজকাল অনেকের পরনে যে পাতলা কাপড়ের পায়জামা বা ইজার দেখা যায় তা নানা বিষয়ে ধুতির চাইতে শ্রেষ্ঠ। ওজন কম, দামও ধুতির কাছাকাছি, কোঁচার বালাই নেই। যাদের দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়–যেমন ডাক্তার বিজ্ঞানী যন্ত্রী ইত্যাদি–তাদের পক্ষে ধুতির চাইতে পাজামা বা ইজার সুবিধাজনক।
সম্প্রতি মোটা কাপড়ের প্যান্ট বা ট্রাউজারের খুব চলন হয়েছে। শুনতে পাই, স্মার্টনেসের লক্ষণ হচ্ছে ঘোর রঙের প্যান্টের উপর সাদা বা ফিকা রঙের শার্ট। শার্ট পুরো হাতা হওয়া চাই, কিন্তু কনুই পর্যন্ত আস্তিন গোটানো থাকবে। গরিব গৃহস্থকেও ছেলের শখ মেটাবার জন্য দামী কাপড়ের প্যান্ট শার্ট যোগাতে হয়।
অনেককে বলতে শুনেছি–ড্রিল কর্ডরয় প্রভৃতি মোটা রঙিন কাপড়ের প্যান্ট মোটের উপর ধুতির চাইতে সস্তা। কারণ, ময়লা হলে সহজে ধরা যায় না, কাচতে হয় না, বার বার ধোবার বাড়ি দিতে হয় না, সহজে ছেড়ে না, বহু কাল পরা চলে। এই যুক্তিতে ফাঁকি আছে। ধুতি যদি সাদা না হয়ে বাদামী খাকী বা ছাই রঙের হত, এবং রোজ কাঁচা না হত, তবে তাও দীর্ঘস্থায়ী হত। দোষ আমাদের প্রথার বা ফ্যাশনের, ধুতির নয়। ধুতি সাদা হওয়া চাই, রোজ কেচে শুদ্ধ করা চাই, কিন্তু মোটা রঙিন প্যান্ট কাঁচা হয় না, যত দিন তার মলিনতা চোখে দেখা না যায় তত দিন তার বাহ্যাভ্যন্তর শুচি।
পরিধেয় বস্ত্রে দুরকম ময়লা লাগে–দেহের ক্লেদ (ঘাম, তেল ইত্যাদি), এবং বাইরের বিশেষত বাতাসের ধুলো আর ধোঁয়া। শুকনো কাপড়ের চাইতে ভিজে কাপড়ে বাতাসের ময়লা বেশী লাগে। কাচা কাপড় যখন ভিজে অবস্থায় শুখখাতে দেওয়া হয় তখন বাতাসের ধুলো আর ধোঁয়া তাতে আটকে যায়। এই কারণে প্রতিবার কাচার পর কাপড়ের মলিনতা বাড়ে, গাত্রজ মল দূর হলেও বায়ুস্থিত মল ক্রমশ জমা হতে থাকে। শহরের বাইরে কাপড় শীঘ্র ময়লা হয় না, কারণ সেখানে ধুলো ধোঁয়া কম। আমাদের চিরাগত প্রথা–ধুতি শাড়ি প্রত্যহ কেচে শুদ্ধ করে নিতে হবে। বার বার কাচার ফলে কাপড় জীর্ণ হয়, ধুলো-ধোঁয়ায় ময়লা হয়–এই অসুবিধা আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু মোটা প্যান্টের বেলায় আমাদের ধারণা অন্য রকম। দেহের ময়লা প্যান্টেও লাগে, প্রতিবার প্রস্রাবের সময় তাও দু-চার ফোঁটা লাগে, কিন্তু এ সব গ্রাহ্য করা হয় না।
অতএব দেহজ মল আর বায়ুজ মল দুয়ের মধ্যে একটাকে আমাদের মেনে নিতে হবে কিংবা রফা করতে হবে। মোটা প্যান্ট নিত্য কাচা অসম্ভব, কিন্তু পাতলা পাজামা বা ইজার যদি মাঝে মাঝে কাচা হয় তবে কতকটা ধুতির তুল্য শুদ্ধ হতে পারে। মোটা প্যান্ট পরা ফ্যাশন-সম্মত হলেও যুক্তিসংগত নয়, অন্তত গরমের সময় নয়। সব দিক দিয়ে বিচার করলে আমাদের নিত্য পরিধানের জন্য পাতলা কাপড়ের পাজামা বা ইজার বা আট-হাতি ধুতি প্রশস্ত।
ধুতি আর পাজামার যে গুণ, পঞ্জাবিরও তা আছে, গায়ে লেপটে থাকে না, হাওয়া লাগতে দেয়। ভিতরে গেঞ্জি বা ফতুয়া পরলে পঞ্জাবি নিত্য কাচতে হয় না, ভিতরের জামা কাচলেই চলে। পঞ্জাবির ঝুল নিতম্ব পর্যন্ত হওয়াই ভাল, বেশী হলে অনর্থক বায়ুরোধ আর তাপবৃদ্ধি করে। পাতলা কাপড়ের কোট (বা কোট তুল্য পঞ্জাবি) আরও ভাল, কারণ সহজেই পরা আর খোলা যায়, বেশী ঢিলা করবার দরকার হয় না।
ব্রিটিশ রাজত্বে আমাদের দরবারী পোশাক ছিল ইজার চাপকান চোগা আর শামলা বা পাগড়ি, সাহেব আর ইঙ্গ-বঙ্গের পক্ষে ড্রেস সুট। বর্তমান ভারত সরকার কর্তৃক বিহিত দরবারী পোশাক সাদা চুড়িদার পাজামা আর আচকান। দুটোই আপত্তিজনক। চুড়িদার পাজামা পায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে, পরতে আর খুলতে মেহনত হয়। আজানুলম্বিত আচকান পরলে অনর্থক কাপড়ের বোঝা বইতে হয়। ঠাণ্ডায় অসুবিধা না হতে পারে, কিন্তু গরমের সময় বায়ুরোধ করে। শ্রীরাজাগোপালাচারীর মতন ধুতি পঞ্জাবি অথবা বিভিন্ন প্রদেশে যে ভব্য পরিচ্ছদ প্রচলিত আছে তাই দরবারী পোশাক গণ্য হবে না কেন?
কনভোকেশনের সময় গ্রাজুয়েটদের যে পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়–কালো বা রঙিন কাপড়ের জোব্বা আর মাথায় থোপনা দেওয়া স্লেট–তা সার্বজাতিক হতে পারে, কিন্তু যেমন বিশ্রী তেমনি জবড়জঙ্গ। কয়েক বৎসর আগে শান্তিনিকেতনে উৎসবাদি উপলক্ষে অধ্যাপকদের বিহিত পরিচ্ছদ ছিল ধুতি-পঞ্জাবির উপর বাসন্তী রঙের উত্তরীয়। এখনও সেই প্রথা আছে কিনা জানি না। সেই রকম সুলভ শোভন পরিচ্ছদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তন করতে পারে।
সাধারণত বাঙালী মাথা ঢাকে না। প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে কলকাতার একটি বিলাতী কম্পানি বাঙালীর জন্য বিশেষ এক রকম টুপি চালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একটাও বেচতে পারে নি। মহাত্মা গান্ধী যেসব বস্তু উদ্ভাবন করেছেন তার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ বস্তু গান্ধীটুপি। সস্তা, হালকা, সহজে কাঁচা যায়, ঠাণ্ডা আর রোদ থেকে কতকটা মাথা বাঁচায়, টাক ঢাকে। গৈরিকধারীকে দেখলে যেমন মনে হয় লোকটি সাধু ধর্মাত্মা তেমনি গান্ধীটুপিধারীকে মনে হয় কংগ্রেসকর্মী বা দেশসেবক। যেসব রাজনীতিক সভায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক একত্র হয় সেখানে বাঙালী গান্ধীটুপির প্রভাবে সহজেই দলে মিশে যেতে পারে, তাকে হংস মধ্যে বক মনে হয় না। কিন্তু যেখানে রোদ থেকে মাথা বাঁচানোই উদ্দেশ্য সেখানে হ্যাটই শ্রেষ্ঠ শিরস্ত্রাণ। বহুকাল পূর্বে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় প্রবাসীতে লিখেছিলেন, রোদের সময় ধুতির সঙ্গে হ্যাট পরা যেতে পারে। পুলিসের শিরস্ত্রাণ যদি লাল পাগড়ির বদলে সোলা-হ্যাট করা হয় তবে ওজন কমবে, দামও বাড়বে না, মাথা গরম হবে না, অন্তত বাঙালী কনস্টেবলরা খুশী হবে। এ দেশের সোলা-হ্যাট-শিল্প লোপ পেতে বসেছে, কারণ বিলাতে এখন তার আদর নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি পুলিসের জন্য সোলা-হ্যাটের প্রবর্তন করেন তবে অনেকের উপকার হবে।
.
কালিদাস নারীর অশিক্ষিতপটুত্বের উল্লেখ করেছেন। তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বঙ্গনারীর পরিচ্ছদ। বাঙালী পুরুষ অনুকরণে পটু, এককালে মোগলাই সাজের নকল করেছিল, তার পর ইওরোপীয় পোশাকও নিয়েছে। কিন্তু বাঙালী মেয়ে তার স্বাতন্ত্র্য হারায় নি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর যুগে সে কাছা দিয়ে শাড়ি পরত, কবি হেমচন্দ্রের আমলে লাজে অবনতমুখী তনুখানি আবরি জুজুবুড়ী সেজে থাকত। কিন্তু আধুনিকা বাঙালিনী সুপর্ণা বিহঙ্গীর ন্যায় শোভনচ্ছদা হয়েছে, চিরন্তন পরিচ্ছদ বজায় রেখেও স্বাস্থ্যের অনুকূল সুরুচিসম্মত সুদৃশ্য সজ্জা উদ্ভাবন করেছে। দেশে বিদেশে শাড়ি অজস্র প্রশংসা পেয়েছে। যেসব ভারত-ললনা আঠারো-হাতি শাড়ি কাছা দিয়ে পরে এবং যারা সালোআর-কমীজ-দোপাট্টায় অভ্যস্ত তারাও ক্রমশ বাঙালিনীর অনুসরণ করছে।
কিন্তু একটা কথা ভাববার আছে। শাড়ি-ব্লাউজ ঘরে বাইরে সুশোভন পরিচ্ছদ, কিন্তু আজকাল অনেক মেয়ে শিক্ষা বা জীবিকার জন্য যে ধরনের কাজ করে তার পক্ষে শাড়ি সকল ক্ষেত্রে উপযুক্ত নাও হতে পারে। যান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক আর চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে শাড়ির আঁচল একটা বাধা, বিপদের কারণও হতে পারে। সুবিধা আর নিরাপত্তার জন্য বোধ হয় ক্ষেত্র বিশেষে শাড়ির বদলে স্কার্ট বা স্ন্যাস জাতীয় পরিধেয়ই বেশী উপযুক্ত।