রবীন্দ্র-জন্মদিন

রবীন্দ্র-জন্মদিন (১৮৮১/১৯৫৯)

কোনও মহাপুরুষের উদ্দেশে লোকে যখন সমবেতভাবে শ্রদ্ধার অর্ঘ দেয়। তখন এক বা একাধিক প্রতীক উপলক্ষ্য করেই তা দিয়ে থাকে। এই প্রতীক প্রতিমূর্তি হতে পারে, কৃতির নিদর্শন হতে পারে, জন্মস্থান সাধনাস্থান বা জন্মদিনও হতে পারে। যদি অসংখ্য অনুরাগী জন একই কালে বা একই স্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তবে সেই শ্রদ্ধা বিপুলতা পায়।

পঁচিশে বৈশাখে অনেক লোক জন্মেছে, কিন্তু একাধিক রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয় নি। অতএব এই তারিখের কোনও নিজস্ব নিরপেক্ষ মহত্ত্ব নেই। ফলিত জ্যোতিষে যাঁদের আস্থা আছে তারা হয়তো বলবেন, শুধু দিন ক্ষণ তিথি নক্ষত্র নয়, আরও অনেক রকম জটিল যোগাযোগ চাই, তবেই রবীন্দ্রনাথের তুল্য পুরুষের উদ্ভব হতে পারে। যাঁরা কার্যকারণের অনন্ত শৃঙ্খলা মানেন তারা বলবেন, শুধু জ্যোতিষিক সমাবেশ নয়, অসংখ্য কারণপরম্পরার ফল স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু তার নির্ণয় আমাদের অসাধ্য।

তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য দেবতার অধিষ্ঠানের জন্য নয়, বহু কাল যাবৎ অগণিত ভক্তের সমাগমের ফলে সামান্য স্থানও পুণ্যভূমি হয়ে ওঠে। চৈত্র শুক্ল-নবমী, ভাদ্র-কৃষ্ণ-অষ্টমী, ক্রিসমাস ডে প্রভৃতির পুণ্যতা রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ বা যিশুখ্রীষ্টের জন্মের জন্য নয়, অসংখ্য ভক্ত একই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, সেই কারণেই তা পুণ্যদিন। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্ম একটি আকস্মিক ঘটনা। তিনি যদি সামান্য লোক হতেন তবে এই দিন কেউ গ্রাহ্য করত না। তিনি অসামান্য, তাই এই দিনকে উপলক্ষ্য করে গুণগ্রাহী ভক্তজন সমবেতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, এবং তার ফলেই এই দিনটি পুণ্যময় পর্বদিনে পরিণত হয়েছে।

বুদ্ধ খ্রীষ্ট চৈতন্যদেব প্রভৃতির যে বিবরণ সমকালীন লোকরা রেখে গেছেন তার কতটা ইতিবৃত্ত আর কতটা পৌরাণিক বা mythical তার নির্ণয় সহজ নয়। ধর্মনেতা বা অবতারদের চরিতকথায় কালক্রমে অতিরঞ্জন এসে পড়ে। ভাগ্যক্রমে রবীন্দ্রনাথ ধর্মনেতা ছিলেন না এবং তিনি স্বয়ং স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। যারা তার অন্তরঙ্গ ছিলেন তাঁদের অনেকে কবির কথা লিখেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তারা এখনও লিখছেন। পঞ্চাশ ষাট সত্তর বৎসর পরে এই সাক্ষাৎদর্শীদের কেউ জীবিত থাকবেন না, তখন তাদের লিখিত বিবরণ আর কবির স্বরচিত আত্মকথাই আমাদের ঐতিহাসিক সম্বল হবে।

স্মরণ কীর্তন আর আলোচনাই শ্রদ্ধাপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপায়। তার ভিত্তি বিশ্বস্ত সত্যাশিত বিবরণ। যাঁরা কবির কথা লিখছেন, ভবিষ্যদ্-বংশীয়দের কাছে তাদের গুরুতর দায়িত্ব আছে। লেখক আর সমালোচকদের সতর্ক থাকতে হবে যেন রবীন্দ্রচরিতকথায় কল্পনা আর জল্পনা না আসে, যেন তা কিংবদন্তী বা অবদানকল্পলতায় পরিণত না হয়।