বাঙালীর হিন্দীচর্চা

বাঙালীর হিন্দীচর্চা (১৩৫৮/১৯৫১)

পনর বৎসর পরে হিন্দী রাষ্ট্রভাষা হবে এই সংকল্প ভারতীয় সংবিধানে গৃহীত হওয়ায় অনেকে রাগ করেছেন, আরও অনেকে ভয় পেয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশ বাঙালী উদাসীন হয়ে আছেন। পনর বৎসর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, অতএব রাগের বশে হিন্দীকে বয়কট করা, ভয় পেয়ে নিরাশ হওয়া, অথবা পরে দেখা যাবে এই ভেবে নিশ্চেষ্ট থাকা–কোনওটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেউ কেউ মনে করেন, পনর বৎসর পরেও সরকারী সকল কার্য হিন্দী ভাষায় নির্বাহ করা যাবে না, তখন ইংরেজীর মেয়াদ আরও বাড়াতে হবে; হয়তো কোনও কালেই ইংরেজী-বর্জন চলবে না। এই রকম ধারণার বশে নিরুদ্যম হয়ে থাকাও হানিকর। অচির ভবিষ্যতে হিন্দী রাষ্ট্রভাষা হবেই–এই সম্ভাবনা মেনে নিয়ে এখন থেকে আমাদের প্রস্তুত হওয়া কর্তব্য।

এ পর্যন্ত আমরা মাতৃভাষা ছাড়া প্রধানত শুধু একটি ভাষা শেখবার চেষ্টা করেছি–ইংরেজী। যাঁরা অধিকন্তু সংস্কৃত ফারসী ফ্রেঞ্চ জার্মন প্রভৃতি শেখেন তাদের সংখ্যা অল্প। ইংরেজী শেখার উদ্দেশ্য তিনটি–জীবিকানির্বাহ, ভিন্নদেশবাসীর সঙ্গে কথাবার্তা, এবং নানা বিদ্যায় প্রবেশ লাভ। হিন্দী যখন রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত হবে তখন কেবল ইংরেজির সাহায্যে জীবিকানির্বাহ চলবে না; সরকারী চাকরি, ওকালতি প্রভৃতি বৃত্তি, এবং সামরিক ও রাজনীতিক কার্যে হিন্দী অপরিহার্য হবে। ভারতের অন্য প্রদেশবাসীর সঙ্গে প্রধানত হিন্দীতেই আলাপ করতে হবে। কিন্তু যাঁরা উচ্চশিক্ষা চান অথবা পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গে যোগ রাখতে চান তাদের অধিকন্তু ইংরেজীও শিখতে হবে। মোট কথা, এখন যেমন ইতর ভদ্র অনেক লোক ইংরেজী না শিখেও কৃষি শিল্প কারবার বা কায়িক শ্রম দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে, ভবিষ্যতে হিন্দী না শিখেও তা পারবে। কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণীর অধিকাংশ লোক যেসব বৃত্তিতে অভ্যস্ত তা বজায় রাখার জন্য হিন্দী শিখতেই হবে। তা ছাড়া অল্পাধিক ইংরেজীও চাই। অর্থাৎ, এক শ্রেণীর শুধু মাতৃভাষা আর এখনকার মতন নামমাত্র বাজারী হিন্দী জানলেই চলবে; আর এক শ্রেণীর মাতৃভাষা ছাড়া ভালরকম হিন্দী এবং একটু ইংরেজী জানলেই চলবে; এবং উচ্চশিক্ষার্থীর অধিকন্তু ইংরেজী উত্তমরূপে আয়ত্ত করতে হবে।

দুটির জায়গায় তিনটি ভাষা শিখতে হবে এতে ভয় পাবার কিছু নেই। গণিত বিজ্ঞান দর্শন প্রভৃতি বিদ্যা আয়ত্ত করতে যে যত্ন নিতে হয় তার চেয়ে অনেক কম যত্নে ভাষা শেখা যায়। হিন্দী আর বাংলার সম্পর্ক অতি নিকট, সে কারণে বাঙালীর পক্ষে হিন্দী শেখা সহজ। ইওরোপ আমেরিকা ও জাপানে বহু লোক তিন-চারটি বা ততোধিক ভাষা শেখে। যারা রাজনীতিক বা বাণিজ্যিক দূত হয়ে অন্য রাষ্ট্রে যান তাদের বিভিন্ন ভাষায় দখল না থাকলে চলে না। যে বাঙালী এইপ্রকার পদের প্রার্থী তাকে বহু ভাষা শিখতেই হবে।

হিন্দীর আধিপত্যে আমাদের মাতৃভাষার ক্ষতি হবে এই ভয় একেবারে ভিত্তিহীন। ইংরেজীর প্রভাবে বাংলা ভাষার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, ভাল মন্দ অনেক বাক্যরীতি বা ইডিয়ম বাংলায় এসে পড়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্য ইংরেজী ভাব ও পদ্ধতি আত্মসাৎ করেই পুষ্ট হয়েছে, কিন্তু নিজের বিশিষ্টতা হারায় নি। হিন্দী দ্বারাও বাংলাভাষা কিঞ্চিৎ প্রভাবিত হবে, কিন্তু অভিভূত হবে না। অনেককাল থেকেই কিছু কিছু হিন্দী শব্দ বাংলায় আসছে, ভবিষ্যতে আরও আসবে, কিন্তু তাতে বাংলার জাত যাবে না। বাংলা থেকেও বিস্তর শব্দ হিন্দীতে যাচ্ছে। বাংলার তুলনায় ইংরেজী ভাষার সমৃদ্ধি খুব বেশী, সেই কারণেই বাংলার উপর তার অসামান্য প্রভাব। হিন্দীর সে সমৃদ্ধি নেই, সেজন্য তার প্রভাব কখনও বেশী হবে না–রাজনীতিক মর্যাদা যতই থাকুক।

পঞ্চাশ-ষাট বৎসর পূর্ব পর্যন্ত এদেশে কেবল পাঠশালায় আর স্কুলের নিম্ন শ্রেণীতে বাংলা পড়ানো হত। তখনকার শিক্ষাবিধাতারা মনে করতেন, বাংলা তো আপনিই শেখা যায়, তার জন্য বেশী কিছু করতে হবে কেন। এই উপেক্ষা সত্ত্বেও সেকালের বাঙালী লেখক মাতৃভাষার উন্নতি করেছেন, উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁদের কীর্তির জন্যই পরবর্তী কালে বাংলা সাহিত্য কলেজেও শিক্ষণীয় হয়েছে। এখন বাংলা চর্চা করেই এম এ, পি-এচ ডি উপাধি পাওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাওয়ায় বাংলা ভাষা জাতে উঠেছে, তার উৎপত্তি সম্বন্ধে অনেক গবেষণা হয়েছে, প্রাচীন বাংলা সাহিত্য পাঠ্যরূপে সমাদর পেয়েছে। কিন্তু কলেজী শিক্ষার গুণে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেষ্টার ফলে প্রত্যক্ষভাবে বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের কোনও উন্নতি হয়েছে এমন বলা যায় না। সেকালের লেখকরা পাঠশালায় বা স্কুলের নিম্নশ্রেণীতেই বাংলা শিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা শীর্ষস্থানীয় তাঁরা ভাষায় শুদ্ধি ও সৌষ্ঠবের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন এবং নূতন লেখকদের নিয়ন্ত্রিত করতেন। এখন অসংখ্য লেখক, তাদের অনেকে কলেজে বাংলা পড়েছেন। এখন রচনার বৈচিত্র্য ও পরিমাণ বেড়ে গেছে, আধুনিক প্রয়োজনে ভাষা নব নব ভাবের ধারক হয়েছে, তার প্রকাশ শক্তিও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু সেকালে যে সতর্কতা ছিল, ইংলান্ড ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে ভাষার উপর যে শাসন আছে, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার একান্ত অভাব দেখা যায়।

সেকালের উপেক্ষা, একালের অসতর্কতা, এবং ইংরেজীর প্রবল প্রভাব –এই তিন বাধা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এতে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্ব নেই, বাঙালী লেখকের সহজাত সাহিত্যপ্রীতি ও নৈপুণ্যের জন্যই বাংলা ভাষা জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা রূপে গণ্য হয়েছে। হিন্দীর প্রতিপত্তি যতই হক তাতে বাংলা ভাষার অনিষ্ট হবে না।

.

যেসব সরকারী কর্মচারীর কর্মকাল শেষ হয়েছে বা শীঘ্র হবে, তাদের হিন্দী না শিখলেও চলবে। যাঁরা যুবক, এখনও বহুকাল কর্মরত থাকবেন, তাদের অনেককেই হিন্দী শিখতে হবে, নতুবা তাদের উন্নতি ব্যাহত হবে। আর, যারা অল্পবয়স্ক তাদের সযত্নে হিন্দী শেখাতেই হবে, যাতে তারা ভবিষ্যৎ প্রতিযোগে পরাস্ত না হয়। ব্রিটিশ রাজত্বের আরম্ভকালে মুসলমানরা বাদশাহী জমানা আর ফারসী ভাষার অভিমানে ইংরেজীকে উপেক্ষা করেছিল। তার জটিল পরিণাম কি হয়েছে তা সকলেই জানেন। অন্ধ বিদ্বেষ বা অদূরদর্শিতার বশে হিন্দীকে উপেক্ষা করলে বাঙালীর অশেষ দুর্গতি হবে।

ভাগ্যক্রমে হিন্দুস্থানী অর্থাৎ উর্দু রাষ্ট্রভাষা রূপে নির্বাচিত হয় নি। সংবিধান সভায় যাঁরা হিন্দীর পক্ষে লড়েছিলেন তাঁরা এখন শুদ্ধ হিন্দী অর্থাৎ সংস্কৃতশব্দবহুল হিন্দীর প্রতিষ্ঠার জন্য সোৎসাহে চেষ্টা করছেন। ভারতের প্রধান ভাষাগুলির যোগসূত্র সংস্কৃত শব্দাবলী। হিন্দী ভাষায় যদি আরবী ফারসী শব্দ কমানো হয় এবং সংস্কৃত শব্দ বাড়ানো হয় তবে দু-তিন কোটি উর্দুভাষীর অসুবিধা হলেও অবশিষ্ট বহু কোটি ভারতবাসীর সুবিধা হবে। হিন্দী ভাষায় যদি ইহান, দর, পৈদাইশ, বনিত, মুহব্বত, স্যাহী ইত্যাদির পরিবর্তে পরীক্ষা, বৃক্ষ, উৎপত্তি, অপেক্ষা, প্রীতি, মসি ইত্যাদি লেখা হয় তবে বাঙালী আসামী ওড়িয়া গুজরাটী মরাঠী ও দক্ষিণ-ভারতবাসী সকলেরই বুঝতে সুবিধা হবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫১ অনুচ্ছেদে আছে–হিন্দী ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য মুখ্যত সংস্কৃত থেকে এবং গৌণত অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করা হবে।

.

হিন্দী ভাষা একটা বোঝা হয়ে হঠাৎ আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে এই ভেবে উদবিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর একটা লাভের দিকও আছে, তা বাঙালী লেখকদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। ব্যবসায় বুদ্ধির যতই অভাব থাকুক একটি বিষয়ে বাঙালী এখনও এগিয়ে আছে। বাংলা সাহিত্য হিন্দী প্রভৃতির চেয়ে সমৃদ্ধ, পরিমাণে না হলেও গুণে শ্রেষ্ঠ। বাংলা কাব্য ইতিহাস দর্শন ইত্যাদির মর্যাদা যতই থাকুক, পাঠক বেশী নয়। কিন্তু পণ্য হিসাবে বাংলা গল্পগ্রন্থের আদর আছে। অনেক বাংলা গল্পের হিন্দী গুজরাটী তামিল প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, অনেক অবাঙালী সাগ্রহে মূল বাংলা গ্রন্থ পড়ে থাকেন। উদারস্বভাব অবাঙালী পাঠক বাংলা গল্পের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না।

ভাষা ভাবের বাহন মাত্র। বাংলা সাহিত্যের বা বাংলা গল্পের উৎকর্ষ বাংলা ভাষার জন্য নয়, বাঙালী লেখকের স্বাভাবিক পটুতার জন্য। বাঙালী সাহিত্যিক যদি হিন্দী ভাষা আয়ত্ত করে হিন্দীতে লেখেন তবে তার পুস্তক সর্বভারতে প্রচারিত হবে, ক্রেতা বহু গুণ বেড়ে যাবে। যাঁরা অল্প বয়স থেকে হিন্দী শিখছেন তাদের যদি ভবিষ্যতে শখ হয় তবে অনায়াসে হিন্দীতে গল্প লিখতে পারবেন। এর জন্য অপর প্রদেশের সমাজে মিশতে হবে, তাদের আচারব্যবহার জানতে হবে। প্রবাসী বাঙালীর পক্ষে তা সুসাধ্য। যদি কেবল বাঙালী সমাজ নিয়ে হিন্দীতে গল্প লেখা হয় তা হলেও তার ভারতব্যাপী কাটতি হবে। লেখকের ক্ষমতা আর পাঠকের রুচির সামঞ্জস্য করে বলা যেতে পারে যে, গল্পের পাত্র-পাত্রী যদি কতক বাঙালী আর কতক অন্যপ্রদেশবাসী হয় তবেই সব চেয়ে ভাল ফল হবে। যারা বাংলা গল্প লিখে খ্যাতি লাভ করেছেন এবং বিহারী উত্তরপ্রদেশী প্রভৃতি সমাজের সঙ্গে পরিচিত, স্থবির না হলে তাঁরা হিন্দী ভাষা আয়ত্ত করে এই কাজে নামতে পারেন। ফরাসী জাৰ্মন চেক হাঙ্গেরীয় পোল প্রভৃতি অনেক বিদেশী ইংরেজীতে লিখে যশস্বী হয়েছেন। তাঁদের ভাষায় সময়ে সময়ে ভুল হয়, তার জন্য একটু আধটু উপহাসও সইতে হয়। কিন্তু রচনার গুণাধিক্যে তাঁদের ছোট ছোট ভুটি চাপা পড়ে যায়।

বাঙালী সাহিত্যিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এঁদের জনকতক যদি হিন্দী লেখায় মন দেন তা হলে বাংলা সাহিত্য নিঃস্ব হবে না। এঁদের প্রভাবে হিন্দী ভাষাও ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষার নিকটতর হবে। নগেন্দ্র গুপ্ত, প্রভাত মুখো এবং চারু বন্দ্যো তাদের অনেক গল্পে বিহারী ও উত্তর প্রদেশী পাত্র-পাত্রীর অবতারণা করেছেন। এইসকল গল্প হিন্দীতে লেখা হলে ভারতব্যাপী সমাদর পেত। উপেন্দ্র গঙ্গো, শরদিন্দু বন্দ্যো, বিভূতি মুখো এবং বনফুলের অনেক গল্পে অবাঙালী নরনারীর মনোজ্ঞ চিত্র আছে। এঁরা বহুকাল বাংলা দেশের বাইরে বাস করেছেন, সেখানকার সমাজের খবর রাখেন, অম্লাধিক হিন্দী জানেন, এবং সকলেই ভূরিলেখক। মাতৃভাষা চর্চায় ক্ষান্ত না হয়েও এঁরা মাঝে মাঝে মাতৃম্বসার ভাষা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।