বানানের সমতা ও সরলতা

বানানের সমতা ও সরলতা (১৮৭৯/১৯৫৭)

কয়েক বৎসর পূর্বে একজন উত্তরপ্রদেশীয় লেখক আমার কাছে এসেছিলেন। একজন বাঙালী অধ্যাপকও তখন উপস্থিত ছিলেন। দুজনের পরিচয়ের পর অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন, পণ্ডিতজী, আমাদের জাতীয় সংগীত জন-গণ-মন হিন্দীতে অমন উৎকট বানানে লেখা হয় কেন–দ্রাবিড় উৎকল-বঙ্গা, উচ্ছল-জলধিতরঙ্গা? শেষে অনর্থক আ-কার যোগ করেন কেন? পণ্ডিতজী উত্তর দিলেন, বাবুজী, হিন্দী আর বাঙলা জবান এক নয়। আপনাদের অ-কার যেন awe, কিন্তু হিন্দীতে তেমন নয়, upএর আদ্যক্ষর তুল্য হ্রস্ব। জন-গণ-মন গাইবার সময় সেই হ্রস্ব অ-কার আমরা টেনে দীর্ঘ করি, তার ফলে অ-কারান্ত বঙ্গ আমাদের উচ্চারণে বঙ্গা হয়ে যায়। শেষে আ-কার না দিলে লোকে পড়বে–দ্রাবিড় উৎকল্ বঙ্গ উচ্ছল্ জলধিতরঙ্গ। তুলসীদাসজীও তার রামায়ণে ছন্দের প্রয়োজনে অনেক জায়গায় অ স্থানে আ করেছেন, যেমন, সুনি প্রভু বচন হরস হনুমানা, শরণাগত বচ্ছল ভগবানা। আপনাদের বানানেও গলদ আছে। অ-কার হচ্ছে হ্রস্ব স্বর, তার আসল উচ্চারণ ভুলে গিয়ে তাকে awful করেছেন কেন? হ্রস্ব অ-কার বোঝাবার জন্য আপনারা দীর্ঘ আ-কার দেন কোন হিসাবে? bus club Punjab (পঞ্জাব) স্থানে বাস ক্লাব পাঞ্জাব লেখেন কেন?

.

বাঙলা বানান নিয়ে বহু বিতর্ক হয়ে গেছে, এখন আর সেসব পুরনো কথার আলোচনা করব না। কতকগুলি শব্দের বানানে যে বৈষম্য, বাহুল্য বা জটিলতা দেখা দেয় তার সম্বন্ধে কিছু বলছি।

বাঙলা আসামী ওড়িয়া হিন্দী মরাঠী গুজরাটী প্রভৃতি আর্যভাষার মধ্যে অনেক মিল আছে। এই মিল যত বজায় রাখা যায় ততই মঙ্গল। বাঙলা বইএর গুণগ্রাহীঅবাঙালী পাঠকবিঘ্নআছেন। আমরা যদি বাঙলা বানানে অনর্থকবৈষম্য আনি তবে অবাঙালী পাঠকের পক্ষে তা দুর্বোধ হবে, তার ফল বাঙলা সাহিত্যের পক্ষে লাভজনকহবেনা।

সংস্কৃতে অ কণ্ঠ্য বর্ণ, তার মূল উচ্চারণ upএর আদ্যক্ষর তুল্য। এই হ্রস্ব অ টেনে উচ্চারণ করলেই আ হয়। ই ঈ যেমন মূলত একই ধ্বনি, শুধু প্রথমটি হ্রস্ব আর দ্বিতীয়টি দীর্ঘ তেমনি অ আ মূলত একই, শুধু প্রথমটি হ্রস্ব আর দ্বিতীয়টি দীর্ঘ। ইংরেজী fur যদি টেনে দীর্ঘ করা হয় তবে far হয়ে যায়। পঞ্চাশ-ষাট বৎসর আগে কলেক্টর পায়োনিয়র সর (Sir) ক্লব ইত্যাদি বানান প্রচলিত ছিল। তখন অ-কারের মৌলিক অর্থাৎ upএর আদ্যক্ষর তুল্য উচ্চারণ আমাদের অভ্যস্ত ছিল, তার ফলে বাঙলা হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় বহু শব্দে একই বানান চলত। বাঙালী তখন স্থানভেদে অ-কারের চার রকম উচ্চারণ করত, যেমন কটা, কটু, একটু, টি-কপ। কটা শব্দে অ-কারের উচ্চারণ সংবৃত, অর্থাৎ ইংরেজী awe শব্দের তুল্য। এই উচ্চারণ হিন্দীতে নেই। কটু শব্দের অ-কার ও-কারের তুল্য। এও হিন্দীতে নেই। একটু শব্দে অ-কার গ্রস্ত, অর্থাৎ ক-অক্ষর হসন্ত তুল্য। টি-কপ শব্দে ক-এর উচ্চারণ বিবৃত, অর্থাৎ ইংরেজী cupএর তুল্য, কিন্তু আধুনিক বাঙালী অ-কারের শেষোক্ত হ্রস্ব উচ্চারণ ভুলে গেছে, তার ফলে অ-কার স্থানে আ-কার চলছে, যেমন ক্লাব, বাস, সার্কাস, কাটলেট। মাঝে মাঝে নাম্বারও দেখতে পাই, কিন্তু জজ এখনও জাজ হন নি।

হিন্দী মরাঠী গুজরাটীতে অ-কারের শুধু বিবৃত বা হ্রস্ব, এবং গ্রস্ত বা হসন্তবৎ উচ্চারণ আছে। কল বন বট-এর হিন্দী উচ্চারণ cull, bun, butএর তুল্য। গ্রস্ত অ-কার হিন্দীতে খুব বেশী, আমাদের জনতা বিমলা কামনা হিন্দী উচ্চারণে জন্তা, বিম্লা, কান্না। কিন্তু হিন্দীতে সংবৃত অর্থাৎ awe-তুল্য অ-কার নেই, তা বোঝাবার জন্য আ-কার লেখা হয়, যেমন royal-রায়ল, talky-টাকি। সেকালে বাঙালীও এই রকম বানান করত, তার কয়েকটি নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে, যেমন কালেজ, আগস্ট, লাট (lord বা lot)। ষাট-সত্তর বৎসর আগে law স্থানে লা লেখা হত।

এককালে আমাদের অ-কারের যে শক্তি ছিল তা ফিরিয়ে আনা উচিত মনে করি। হ্রস্ব অ-কার স্থানে আ-কারের প্রয়োগ খুব বেশীদিনের নয়। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত দুর্গেশনন্দিনীর আখ্যাপত্রে আছে–অপর সরকিউলর রোড। রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থের পুরনো মুদ্রণে কটলেট, থর্ড ইত্যাদি বানান দেখা যায়। আমাদের লেখকরা একটু চেষ্টা করলেই আকারের অপপ্রয়োগ বন্ধ করে অ-কারের মৌলিক বিবৃত হ্রস্ব উচ্চারণ ফিরিয়ে আনতে পারেন। Bus স্থানে বাস না লিখে বস লিখলে কোনও ক্ষতি হবে না, সাধারণ লোকে এখন যতটা বিকৃত উচ্চারণ করে তার চাইতে বেশী বিকৃত করবে না। স্থানভেদে অ-কারের চার রকম উচ্চারণই বাঙলায় চলতে পারে, তাতে অবাঙালী পাঠকের উচ্চারণ ভুল হলেও অর্থবোধে বাধা হবে না। জন-গণ-মন গানে সংবৃত অ-কার বোঝাবার জন্য যদি বঙ্গা-তরঙ্গা লেখা হয় তাতে আমাদের আপত্তির কারণ নেই। আমরাও তো হিন্দী হৈ স্থানে হ্যায় লিখি।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নিযুক্ত বানান-সমিতির নিয়মে অসংস্কৃত শব্দে ণ বাদ দিয়ে শুধু ন লেখার বিধান আছে। হিন্দী প্রভৃতিতেও অসংস্কৃত শব্দে ণ নেই, রানী, বরন (বর্ণ), মন (চল্লিশ সের) লেখা হয়। বাঙলায় গিণি সোণা মূর্ধন্য ণ দিয়ে কেন লেখা হয় জানি না, হয়তো সোনার গৌরব-বৃদ্ধির জন্য।

বানান-সমিতির আর একটি নিয়ম–কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ অনুসারে s স্থানে স এবং sh স্থানে শ হবে, যেমন, ইশারা তামাশা শয়তান শেমিজ-এ তালব্য শ, কিন্তু আসমান জিনিস সাদা নোটিস পুলিস-এ দন্ত্য স। হিন্দী প্রভৃতিতে এই রীতি মানা হয়, বাঙালী মুসলমান লেখকরাও তা মানেন। সকলেই এই নিয়মে বানান করলে সামঞ্জস্য আসবে।

আর একটি বিষয় বিচারের যোগ্য। অনেক শব্দে অনর্থক apostrophe বা ঊর্ধ্ব কমা দেখতে পাই। বার্নার্ড শ, পাঁচ শ ইত্যাদিতে ঊর্ধ্ব কমার সার্থকতা কি? না দিলেও লোকে শএর ঠিক উচ্চারণ করবে, কেউ শ বলবে না। দুদিন, নটাকা ইত্যাদি বানানে ঊর্ধ্ব কমার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। দুই থেকে দু, নয় থেকে ন হয়েছে তা জানাবার কি দরকার? দু ছ ন শ ইত্যাদি স্বপ্রতিষ্ঠ শব্দ, এদের ব্যুৎপত্তি না জানালে কোনও ক্ষতি হয় না। সাধু রূপ তাহা তাহাকে তাহাতে তাহার থেকে চলিত রূপ তা তাকে তাতে তার হয়েছে, কিন্তু ঊধ্ব কমা দেওয়া হয় না।

লখনউএর যারা বাসিন্দা তারা সরল বানান লেখে ল খ ন উ, কিন্তু বাঙালী অনর্থক লক্ষ্ণৌ লেখে কেন? দরভঙ্গায় দ্বার নেই, বঙ্গের সঙ্গেও সম্পর্ক নেই, তবু দ্বারবঙ্গ লেখা হয় কেন? আর একটা উৎকট বানান sir স্থানে স্যার। যেমন ক্যাট হ্যাট ব্যাট, তেমনি স্যার। শুধু সার লিখলেই চলে, সেকেলে বানান সর আরও ভাল মনে করি।

অনেকে মনে করেন বিদেশী শব্দের হসন্ত উচ্চারণ বোঝাবার জন্য শেষে হচিহ্ন দিতেই হবে। এঁরা লেখেন–কাটলেট, টি-পট, প্লেট, ডিশ। হসচিহ্ন না দিয়ে যদি শুধু ডিশ লেখা হয় তবে লোকে ডিশঅ পড়বে এমন ভয় আছে কি? অনর্থক হসচিহ্ন দিয়ে লেখা কণ্টকিত করায় লাভ নেই। অনেকে মেইন, চেইন, টেইল লেখেন। এঁদের যুক্তি ইংরেজী শব্দে । অক্ষর আছে, উচ্চারণেও তার প্রভাব পড়ে। এই যুক্তি মিথ্যা। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করা যায় না, কাছাকাছি বানানে হলেই যথেষ্ট। মেইন, চেইন ইত্যাদি লিখলে লোকে ই-কারের উপর অতিরিক্ত জোর দেয়। আর একটি ভয়ংকর বানান মাঝে মাঝে দেখি–কেইক অর্থাৎ কেক। ই-কার না দিলে কি ক্যাক পড়বার ভয় আছে?