বাংলা বানানের নিয়ম

বাংলা বানানের নিয়ম

বাংলা বানানের রীতি নির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেন। তদনুসারে নভেম্বর ১৯৩৫এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কার সমিতি গঠিত হয়। এতে ছিলেন–রাজশেখর বসু (সভাপতি), প্রমথনাথ চৌধুরী, মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী, রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অধ্যাপক বিজয়চন্দ্র মজুমদার, দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায়, দুর্গামোহন ভট্টাচার্য, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য (সম্পাদক)।

সমিতি নির্ধারিত বানানের নিয়মাবলী সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র নিম্নোক্ত মত প্রকাশ করেন।—

বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি। —
১লা আশ্বিন ১৩৪৩
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬

বানান যথাসম্ভব সরল ও উচ্চারণসূচক হওয়া বাঞ্ছনীয়, কিন্তু উচ্চারণ বুঝাইবার জন্য অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য এবং প্রচলিত রীতির অত্যধিক পরিবর্তন উচিত নয়। অতিরিক্ত অক্ষর বা চিহ্ন চালাইলে লাভ যত হইবে তাহার অপেক্ষা লেখক, পাঠক ও মুদ্রাকরের অসুবিধা অধিক হইবে। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থে বা শব্দকোষে উচ্চারণ-নির্দেশের জন্য বহু চিহ্নের প্রয়োগ অপরিহার্য, কিন্তু সাধারণ লেখায় তাহা ভারস্বরূপ। প্রচলিত শব্দের উচ্চারণ লোকে অর্থ হইতেই বুঝিয়া লয়। আমাদের ভাষায় বহু শব্দের বানানে ও উচ্চারণে মিল নাই, যথা-গণ, বন, ঘন, জলখাবার, জলযোগ, আষাঢ়, গাঢ়; সহিত, গলিত, অশ্বতর, হ্রস্বতর, একদা, একটা; অচেনা, দেখা। এইপ্রকার শব্দের বানান-সংস্কার করিতে কেহই চান না, প্রদেশভেদে উচ্চারণের কিঞ্চিৎ ভেদ হইলেও ক্ষতি হয় না। সুপ্রচলিত শব্দের বানান সংস্কার যদি করিতে হয় তবে, বানানের জটিলতা না বাড়াইয়া সরলতা সম্পাদনের চেষ্টাই কর্তব্য।

নবাগত বা অল্পপরিচিত বিদেশী শব্দ-সম্বন্ধে বিশেষ বিচার আবশ্যক। এইপ্রকার শব্দের বাংলা বানান এখনও সর্বজনগৃহীতরূপে নির্ধারিত হয় নাই, অতএব সাধারণের যথেচ্ছতার উপর নির্ভর না করিয়া বানানের সরল নিয়ম গঠন করা কর্তব্য।

অসংখ্য সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হইয়া আছে। এবং প্রয়োজনমত এইরূপ আরও শব্দ গৃহীত হইতে পারে। এই সকল শব্দের বানান সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধানাদির শাসনে সুনির্দিষ্ট হইয়াছে, সেজন্য তাহাতে হস্তক্ষেপ অবিধেয়।

সমস্ত বাংলা শব্দের বানান এককালে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভবপর নয়। নিয়ন্ত্রণ ক্রমে ক্রমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই প্রবন্ধে বানানের কয়েকটি মাত্র নিয়ম দেওয়া হইয়াছে। নিয়মগুলি। সাধারণভাবে প্রযোজ্য, কিন্তু শব্দবিশেষে ব্যতিক্রম হইবে। কেবল নিয়ম রচনা দ্বারা সমস্ত বাংলা শব্দের বানান নির্দেশ অসম্ভব। নির্ধারিত বানান অনুসারে একটি শব্দতালিকা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশের ব্যবস্থা হইতেছে।

বলা বাহুল্য, পদ্যরচনায় সকল ক্ষেত্রে নিয়ম অনুসারে বানান করা সম্ভবপর নয়।

বানানের নিয়ম যাহাতে বর্তমান বাংলা ভাষার প্রকৃতির অনুকূল হয় সেই চেষ্টা করা হইয়াছে। বিশিষ্ট লেখকগণ অধিকাংশ শব্দ যে রীতিতে বানান করেন তদনুসারে ই ঈ উ ঊ জ ও-কার ং ও শ ষ স প্রভৃতি প্রয়োগের সাধারণ নিয়ম গঠিত হইয়াছে। কতকগুলি শব্দের প্রচলিত বানানে ব্যতিক্রম দেখা যায়। সামঞ্জস্যের জন্য এইগুলিকেও যথাসম্ভব সাধারণ নিয়মের অনুযায়ী করা হইয়াছে। পূর্বে কেবল খুসী, সয়তান, সহর, পালিস, ক্লাশ প্রভৃতি বানান দেখা যাইত, কিন্তু আজকাল অনেকে মূল শব্দ-সম্বন্ধে অবহিত হইয়া খুশী, শয়তান, শহর, পালিশ, ক্লাস লিখিতেছেন। এই রীতিতে সহজেই নিশা, শরবৎ, শরম, শেমিজ, জিনিস, শার্সি প্রভৃতি নিয়মানুযায়ী বানান প্রচলিত হইতে পারিবে। অবশ্য কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম না করিলে চলিবে না, কিন্তু ব্যতিক্রম যত কম হয় ততই ভাল। বিকল্প বাঞ্ছনীয় নয়, তথাপি যেখানে দুই প্রকার বানানের পক্ষেই প্রবল অভিমত পাওয়া গিয়াছে সেখানে বিকল্পের বিধান করিতে হইয়াছে। পূর্বে সস্ক্রান্তি, সঙ্খ্যা প্রভৃতি বানান দেখা যাইত, কিন্তু এখন কেবল সংক্রান্তি, সংখ্যা চলিতেছে। এই রীতিতে ভয়ঙ্কর, সঙ্গম প্রভৃতি স্থানে ভয়ংকর, সংগম লিখিলে বানান সহজ হইবে। কালক্রমে সরলতর বানানই চলিবে এই আশায় এই প্রকার শব্দে বিকল্পের বিধান দেওয়া হইয়াছে। এই প্রকার শব্দের সংখ্যা অধিক নয়, সেজন্য যদি কিছুকাল দুই প্রকার বানানই চলে (যেমন এখন অহংকার চলিতেছে) তবে ক্ষতি হইবে না।

বাংলার কয়েকটি বর্ণে রেফের পর দ্বিত্ব প্রচলিত আছে, সকল বর্ণে নাই, যথা–কৰ্ম্ম, সৰ্ব্ব, কিন্তু কর্ণ, সর্গ। হিন্দী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায় দ্বিত্ব হয় না। এই অনাবশ্যক দ্বিত্ব বর্জন করিলে বাংলায় প্রচলিত অসংখ্য শব্দের বানান অপেক্ষাকৃত সরল হইবে। যে দুই শত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক বানান-বিষয়ক প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়াছেন, তাহাদের দুই জন ব্যতীত সকলেই দ্বিত্ববর্জনের পক্ষে। কয়েকজন প্রবীণ লেখক বহুকাল হইতে তাহাদের লেখায় দ্বিত্ব পরিহার করিয়াছেন। আজকাল বঙ্গদেশে প্রকাশিত অনেক সংস্কৃত পুস্তকে দ্বিত্ব বর্জিত হইয়াছে।

তদ্ভব শব্দে অনেকে মূল অনুসারে ণ প্রয়োগ করেন, যথা-কাণ, সোণা। কিন্তু সকল শব্দে এই রীতি অনুসৃত হয় না, যথা–বামুন, গিন্নী। বাংলা ক্রিয়াপদেও ণত্ব হয় না, যথা–শোনা, করেন, করুন। বহু বিশিষ্ট লেখক কান, সোনা প্রভৃতি লিখিয়া থাকেন এবং এই রীতি ক্রমে ক্রমে বিশেষ প্রচলিত হইতেছে। কোরাণ, গভর্ণর প্রভৃতিতে ণত্ব করিবার কোনও হেতু নাই। যাঁহারা বানান-বিষয়ক প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়াছেন তাহাদের অধিকাংশ ণ বর্জনের পক্ষে। অ-সংস্কৃত শব্দে ণ বর্জন করিলে বানান সরল হইবে। রাণী বানান অনেকেই রাখিতে চান, এজন্য এই শব্দে বিকল্প বিহিত হইয়াছে।

সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ

১। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব

রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা–অর্চনা, মূৰ্ছা, অর্জুন, কর্তা, কার্তিক, বার্তা, কর্দম, অধ, বার্ধক্য, কর্ম, কার্য, সর্ব।

সংস্কৃত ব্যাকরণ-অনুসারে রেফের পর দ্বিত্ব বিকল্পে সিদ্ধ; না করিলে দোষ হয় না, বরং লেখা ও ছাপা সহজ হয়।

২। সন্ধিতে স্থানে অনুস্বার

যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার অথবা বিকল্পে ঙ বিধেয়, যথা–অহংকার, ভয়ংকর, শুভংকর, সংখ্যা, সংগম, হৃদয়ংগম, সংঘটন অথবা অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর ইত্যাদি।

সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুসারে বর্গীয় বর্ণ পরে থাকিলে পদের . অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার বা পরবর্তী বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয়, যথা–সংজাত, স্বয়ংভু অথবা সঞ্জাত, স্বয়ম্ভ। বাংলায় সর্বত্র এই নিয়ম অনুসারেং দিলে উচ্চারণে বাধিতে পারে, কিন্তু কবর্গের পূর্বে অনুস্বার ব্যবহার করিলে বাধিবে না, বরং বানান সহজ হইবে।

অ-সংস্কৃত অর্থাৎ তম্ভব দেশজ ও বিদেশী শব্দ

৩। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব

রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা–কর্জ, শর্ত, সর্দার, চর্বি, ফর্মা, জার্মনি।

৪। হসচিহ্ন

শব্দের শেষে সাধারণত হচিহ্ন দেওয়া হইবে না, যথা–ওস্তাদ, কংগ্রেস, চেক, জজ, টন, টি-পট, ট্রাম, ডিশ, তছনছ, পকেট, মক্তব, হুক, করিলেন, করিস। কিন্তু যদি ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকে তবে হচিহ্ন বিধেয়। হ ও যুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণ সাধারণত স্বরান্ত, যথা–দহ, অহরহ, কাণ্ড, গঞ্জ। যদি হসন্ত উচ্চারণ অভীষ্ট হয় তবে হ ও যুক্ত ব্যঞ্জনের পর হস্-চিহ্ন আবশ্যক, যথা–শাহ্, তখ, জেমস্, বন্ড। কিন্তু সুপ্রচলিত শব্দে না দিলে চলিবে, যথা–আর্ট, কর্ক, গভর্নমেন্ট, স্পঞ্জ। মধ্য বর্ণে প্রয়োজন হইলে হচিহ্ন বিধেয়, যথা–উঁকি, সকা। যদি উপান্ত্য স্বর অত্যন্ত হ্রস্ব হয়, তবে শেষে হচিহ্ন বিধেয়, যথা–কক, খ, সার।

বাংলার কতকগুলি শব্দের শেষে অ-কার উচ্চারিত হয়, যথা–গলিত, ঘন, দৃঢ়, প্রিয়, করিয়াছ, করিত, ছিল, এস। কিন্তু অধিকাংশ শব্দের শেষের অ-কার গ্রস্ত অর্থাৎ শেষ অক্ষর হসন্তবৎ, যথা–অচল, গভীর, পাঠ, করুক, করিস, করিলেন। এই প্রকার সুপরিচিত শব্দের শেষে অ-ধ্বনি হইবে কি হইবে না তাহা বুঝাইবার জন্য কেহই চিহ্ন প্রয়োগ করেন না। অধিকাংশ স্থলে অ-সংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হচিহ্ন অনাবশ্যক, বাংলাভাষার প্রকৃতি অনুসারেই হসন্ত উচ্চারণ হইবে। অল্প কয়েকটি বিদেশী শব্দের শেষে অ উচ্চারণ হয়, যথা–বাই-ল। কিন্তু প্রভেদ রক্ষার জন্য অপর বহু বহু শব্দে হচিহ্নের ভার চাপান অনাবশ্যক। কেবল ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকিলে হসচিহ্ন বিধেয়।

৫৷ ই ঈ উ উ

যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হইবে, যথা–কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীষ, উনিশ, চুন, পূব অথবা কুমির, পাখি, বাড়ি, শিষ, উনিশ, চুন, পুব। কিন্তু কতকগুলি শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই অথবা কেবল উ হইবে, যথা-নীলা (নীলক), হীরা (হীরক), দিয়াশলাই (দীপশলাকা), খিল (কীল), পানি (পানীয়); চুল (চুল), তাড় (তর্দু), জুয়া (দ্যুত)।

স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণ বাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা–কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, বিলাতী, দাগী, রেশমী। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ই হইবে, যথা–ঝি, দিদি, বিবি; কচি, মিহি, মাঝারি, চতি। পিসী, মাসী স্থানে বিকল্পে পিসি, মাসি লেখা চলিবে।

অন্যত্র মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্মবাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের অন্তে কেবল ই হইবে, যথা–বেঙাচি, বেঁজি, কাঠি, সুজি, কেরামতি, চুরি, পাগলামি, বাবুগিরি, তাড়াতাড়ি, সরাসরি, সোজাসুজি।

নবাগত বিদেশী শব্দে ঈ উ প্রয়োগ সম্বন্ধে পরে দ্রষ্টব্য।

৬। জ য

এই সকল শব্দে য না লিখিয়া জ লেখা বিধেয়–কাজ, জাউ, জাঁতা, জাঁতি, জুই, জুত, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল।

৭। ণ ন

অ-সংস্কৃত শব্দে কেবল ন হইবে, যথা–কান, সোনা, বামুন, কোরান, করোনার। কিন্তু যুক্তাক্ষর ন্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ট চলিবে, যথা–ঘুণ্টি, লণ্ঠন, ঠাণ্ডা।

রানী স্থানে বিকল্পে রাণী চলিতে পারিবে।

৮। ও-কার ও ঊর্ধ্ব-কমা প্রভৃতি

সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বুঝাইবার জন্য অতিরিক্ত ও-কার, ঊর্ধ্ব-কমা বা অন্য চিহ্ন যোগ যথাসম্ভব বর্জনীয়। যদি অর্থগ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত্য অক্ষরে ও-কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে ঊর্ধ্ব-কমা বিকল্পে দেওয়া যাইতে পারে, যথা–কাল, কালো; ভাল, ভালো; মত, মতো; পড়ো প’ড়ো (পড়ুয়া বা পতিত)।

এই সকল বানান বিধেয়–এত, কত, যত, তত; তো, হয়তো; কাল (সময়, কল্য), চাল (চাউল, ছাত, গতি), ডাল (দাইল, শাখা)।

৯। ং ঙ

বাঙ্গলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী, ভাঙ্গন প্রভৃতি এবং বাংলা, বাঙলা, বাঙালী, ভাঙন প্রভৃতি উভয়প্রকার বানানই চলিবে। হসন্ত ধ্বনি হইলে বিকল্পে ং বা ঙ বিধেয়, যথা–রং, রঙ; সং, সঙ; বাংলা, বাঙলা। স্বরাশ্রিত হইলে ঙ বিধেয়, যথা–রঙের, বাঙালী, ভাঙন।

ং ও ঙ-এর প্রাচীন উচ্চারণ যাহাই হউক, আধুনিক বাংলা উচ্চারণ সমান, সেজন্য অনুস্বার স্থানে বিকল্প ঙ লিখিলে আপত্তির কারণ নাই।রং-এর অপেক্ষা রঙের লেখা সহজ। রঙ্গের লিখিলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, কারণ রঙ্গ ও রং-এর উচ্চারণ সমান নয়, কিন্তু রং ও রঙ সমান।

১০। শ ষ স

মূল সংস্কৃত শব্দ-অনুসারে তদ্ভব শব্দে শ, ষ বা স হইবে, যথা–আঁশ (অংশু), আঁষ (আমিষ), শাঁস (শস্য), মশা (মশক), পিসী (পিতৃঃস্বসা)। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা–মিসে (মনুষ্য), সাধ (শ্রদ্ধা)।

বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ-অনুসারে s স্থানে স, sh স্থানে শ হইবে, যথা–আসল, ক্লাস, খাস, জিনিস, পুলিস, পেনসিল, মসলা, মাসুল, সবুজ, সাদা, সিমেন্ট, খুশি, চশমা, তক্তাপোশ, পশম, পোশাক, পালিশ, পেনশন, শখ, শৌখিন, শয়তান, শরবৎ, শরম, শহর, শার্ট, শেম্পিয়র। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা–ইস্তাহার (ইশতিহার), গোমস্তা (গুমান্তাহ), ভিস্তি (বিহিস্তী), খ্রীষ্ট (christ)।

শ ষ স এই তিন বর্ণের একটি বা দুইটি বর্জন করিলে বাংলা উচ্চারণে বাধা হয় না, বরং বানান সরল হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদ্ভব শব্দে মূল অনুসারে শ ষ স প্রয়োগ বহুপ্রচলিত এবং একই শব্দের বিভিন্ন বানান প্রায় দেখা যায় না। এই রীতির সহসা পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। বহু বিদেশী শব্দের প্রচলিত বাংলা বানানে মূল-অনুসারে শ বা স লেখা হয়, কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম বা বিভিন্ন বানান দেখা যায়, যথা-সরবৎ, শরবৎ; শরম, সরম; শহর, সহর; শয়তান, সয়তান; পুলিস, পুলিশ। সামঞ্জস্যের জন্য যথাসম্ভব একই নিয়ম গ্রহণীয়।

বিদেশী শব্দের s-ধ্বনির জন্য বাংলায় ছ অক্ষর বর্জনীয়। কিন্তু যেখানে প্রচলিত বাংলা বানানে ছ আছে এবং উচ্চারণেও ছ হয়, সেখানে প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা-কেচ্ছা, ছয়লাপ, তছনছ, পছন্দ।

দেশজ বা অজ্ঞাতমূল শব্দের প্রচলিত বানান হইবে, যথা–করিস, ফরসা (ফরশা), সরেস (সরেশ), উসখুস (উশখুশ)।

১১। ক্রিয়াপদ

 সাধু ও চলিত প্রয়োগে কৃদন্ত রূপে করান, পাঠান প্রভৃতি অথবা বিকল্পে করানো, পাঠানো প্রভৃতি বিধেয়।

চলিত ভাষার ক্রিয়াপদের বিহিত বানানের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হইল। বিকল্পে ঊর্ধ্ব কমা বর্জন করা যাইতে পারে এবং লাম বিভক্তি স্থানে লুম বা–লেম লেখা যাইতে পারে।

হ-ধাতু– হয়, হন, হও, হস, হই। হচ্ছে। হয়েছে। হক, হন, হও, হ। হল হলাম। হত। হচ্ছিল। হয়েছিল। হব (হবো, হবে। হয়ো, হস। হতে, হয়ে হলে, হবার, হওয়া।

খা-ধাতু– খায়, খান, খাও, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, খাও, খা। খেলে, খেলাম। খেত। খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব (খাবো), খাবে। খেয়ো, খাস। খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার, খাওয়া।

দি-ধাতু।– দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিলে, দিলাম। দিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেব (দেববা), দেবে। দিও, দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার, দেওয়া।

শু-ধাতু– শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই, শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শুন, শোও, শশা। শুল, শুলাম। শুত। শুচ্ছিল। শুয়েছিল। শোব (শোব), শোবে। শুয়ো, শুস। শুতে, শুয়ে, শুলে, শোবার, শোয়া।

কর-ধাতু– করে, করেন, কর, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, কর, কর। করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল? করব (করবো), করবে। করো, করিস। করতে, করে, করলে, করবার, করা।

কাট-ধাতু– কাটে, কাটেন, কাট, কাটিস, কাটি। কাটছে। কেটেছে। কাটুক, কাটুন, কাট, কাটু। কাটলে, কাটলাম। কাটত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব (কাটবো), কাটবে। কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার, কাটা।

লিখ-ধাতু– লেখে, লেখেন, লেখ, লিখিস, লিখি। লিখছে। লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখ, লেখ। লিখলে, লিখলাম। লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব (লিখবো), লিখবে, লিখো, লিখিস। লিখতে, লিখে, লিখলে, লেখবার, লেখা।

উঠ ধাতু– ওঠে, ওঠেন, ওঠ, উঠিস, উঠি। উঠছে। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠ, ওঠ। উঠল, উঠলাম। উঠত। উঠছিল। উঠেছিল। উঠব (উঠবো), উঠবে। উঠো, উঠিস। উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার, ওঠা।

করা-ধাতু– করায়, করান, করাও, করাস, করাই। করাচ্ছে। করিয়েছে। করাক, করান, করাও, করা। করালে, করালাম। করাত। করাচ্ছিল। করিয়েছিল। করাব (করাবো), করাবে। করিও, করাস। করাতে, করিয়ে, করালে, করাবার, করান (করানো)।

১২। কতকগুলি সাধু শব্দের চলিত রূপ

কুয়া, সুতা, মিছা, উঠান, উনান, পুরান, পিছন, পিতল, ভিতর, উপর প্রভৃতি কতকগুলি সাধুশব্দের মৌখিকরূপ কলিকাতা অঞ্চলে অন্যপ্রকার। যে শব্দের মৌখিক বিকৃতি আদ্য অক্ষরে তাহার সাধুর রূপই চলিত ভাষায় গ্রহণীয়, যথা–পিছন, পিতল, ভিতর, উপর। যাহার বিকৃতি মধ্য বা শেষ অক্ষরে তাহার চলিত রূপ মৌখিক রূপের অনুযায়ী করা বিধেয়, যথা–কুয়ো, সুতো, মিছে, উঠন, উনন, পুরনো।

নবাগত ইংরাজী ও অন্যান্য বিদেশী শব্দ

Cut-এর u, cat-এর a, f, v, w, z প্রভৃতির প্রতিবর্ণ বাংলায় নাই। অল্প কয়েকটি নূতন অক্ষর বা চিহ্ন বাংলা লিপিতে প্রবর্তিত করিলে মোটামুটি কাজ চলিতে পারে। বিদেশী শব্দের বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত, কিন্তু নূতন অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য বর্জনীয়। এক ভাষার উচ্চারণ অন্য ভাষার লিপিতে যথাযথ প্রকাশ করা অসম্ভব। নবাগত বিদেশী শব্দের শুদ্ধিরক্ষার জন্য অধিক আয়াসের প্রয়োজন নাই, কাছাকাছি বাংলা রূপ হইলেই লেখার কাজ চলিবে। যে সকল বিদেশী শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও তদনুযায়ী বানান বাংলায় চলিয়া গিয়াছে, সে সকল শব্দের প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা–কলেজ, টেবিল, বাইসিকেল, সেকেন্ড।

১৩। বিবৃত অ (cut-এর u)

মূল শব্দে যদি বিবৃত অ থাকে, তবে বাংলা বানানে আদ্য অক্ষরে আ-কার এবং মধ্য অক্ষরে অ-কার বিধেয়, যথা–ক্লাব (club), বাস (bus), বাল্ব (bulb), সার (sir), থার্ড (third), বাজেট (budget), জার্মন (German), কাটলেট (cutlet), সার্কস (circus), ফোকস (focus), রেডিয়ম (radium), ফসফরস (Phosphorus), হিরোডোটস (Herodotus)।

১৪। বক্র আ (বা বিকৃত এ। cat-এর a)

মূল শব্দে বক্র আ থাকিলে বাংলায় আদিতে অ্যা এবং মধ্যে া বিধেয়, যথা–অ্যাসিড (acid), হ্যাট (hat)।

এইরূপ বানানো ‘্যা’কে য-ফলা+আ-কার মনে না করিয়া একটি বিশেষ স্বরবর্ণের চিহ্ন জ্ঞান করা যাইতে পারে, যেমন হিন্দীতে এই উদ্দেশ্যে ঐ-কার চলিতেছে hat = ।ৈ নাগরী লিপিতে যেমন অ-অক্ষরে ও-কার যোগ করিয়া ও সী হয়, সেরূপ বাংলায় অ্যা হইতে পারে।

১৫। ঈ উ

মূল শব্দের উচ্চারণে যদি ঈ ঊ থাকে, তবে বাংলা বানানে ঈ ঊ বিধেয়, যথা–সীল (seal), ঈস্ট (east), উস্টার (worcester), শূল (spool)।

১৬। f v

f ও v স্থানে যথাক্রমে ফ ভ বিধেয়, যথা–ফুট (foot), ভোট (vote)। যদি মূল শব্দে v-এর উচ্চারণ তুল্য হয়, তবে বাংলা বানানে ফ হইবে, যথা–ফন (Von)।

১৭। w

w স্থানে প্রচলিত রীতি অনুসারে উ বা ও বিধেয়, যথা–উইলসন (wilson), উড (wood), ওয়ে (way)।

১৮। য়

নবাগত বিদেশী শব্দে অনর্থক য় প্রয়োগ বর্জনীয়। মেয়র, চেয়ার, রেডিয়ম, সোয়েটার প্রভৃতি বানান চলিতে পারে, কারণ য় লিখিলেও উচ্চারণ বিকৃত হয় না। কিন্তু উ-কার বা ও-কারের পর অকারণে য়, য়া, গো লেখা অনুচিত। এডোয়ার্ড, ওয়ারবন্ড না লিখিয়া এড়ওয়ার্ড, ওঅর-বন্ড লেখা উচিত। হার্ডওয়ার (hardware) বানানে দোষ নাই।

১৯। s, sh

১০ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।

 ২০। st

নবাগত বিদেশী শব্দে st স্থানে নূতন সংযুক্ত বর্ণ স্ট বিধেয়, যথা স্টোভ (stove)।

২১। z

z স্থানে জ বা জ বিধেয়।

২২। হসচিহ্ন।

 ৪ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।