গ্রহণীয় শব্দ (১৮৮০/১৯৫৮)
ভাবের বাহন ভাষা, ভাষার উপাদান শব্দ। শব্দের অর্থ যদি সর্বগ্রাহ্য হয় তবেই তা সার্থক, অর্থাৎ প্রয়োগের উপযুক্ত এবং সাহিত্যে গ্রহণীয়।
বাঙলা ভাষা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। তার এক কারণ, বাঙালীর জীবনযাত্রার পরিবর্তন, অর্থাৎ নূতন বস্তু নূতন ভাব নূতন রুচি নূতন আচারের প্রচলন। অন্য কারণ, অজ্ঞাতসারে বা ইচ্ছাপূর্বক ইংরেজী ভাষার অনুকরণ। মৃত ভাষা ব্যাকরণের বন্ধনে মমির মতন অবিকৃত থাকতে পারে, কিন্তু সজীব চলন্ত ভাষায় বিকার বা পরিবর্তন ঘটবেই। আমাদের আহার পরিচ্ছদ আবাস সমাজব্যবস্থা আর শাসনপ্রণালী যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি শব্দ শব্দার্থ আর শব্দবিন্যাসও বদলাচ্ছে।
যাঁরা গোঁড়া প্রাচীনপন্থী তারা কোনও পরিবর্তন প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেন না। আধুনিক ছেলেমেয়েদের চালচলন যেমন অনেক লোকের পক্ষে দৃষ্টিকটু, আধুনিক বাঙলা ভাষার রীতিও সেই রকম। অন্ধ গোঁড়ামি সকল ক্ষেত্রেই অন্যায়, কিন্তু শুধু হুজুক বা ফ্যাশনের বশে কোনও নূতন বস্তু বা রীতি মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। ভাষার রীতির তুলনায় সামাজিক রীতির গুরুত্ব অবশ্য অনেক বেশী, তথাপি কোনও শিক্ষিত লোকই চান না যে মাতৃভাষায় জঞ্জাল আসুক। সহসাগত কোনও শব্দ শব্দার্থ বা প্রয়োগরীতিকে সাহিত্যে স্থান দেবার আগে একটু যাচাই করে দেখা ভাল।
ভাষার সমৃদ্ধি হয় কৃতী লেখকের প্রভাবে, কিন্তু তার ক্রমিক মন্থর পরিবর্তনে জনসাধারণের হাতই বেশী। সাধারণ মানুষ ব্যাকরণ অভিধানের বশে চলে না। কয়েকজন শব্দের উচ্চারণে বা প্রয়োগে ভুল করে, তার পর অনেকে সেই ভুলের অনুসরণ করে, তার ফলে কালক্রমে নূতন শব্দ নূতন অর্থ আর নূতন ভাষার উৎপত্তি হয়। ভাষা মাত্রেই পূর্ববর্তী কোনও ভাষার বিকার বা অপভ্রংশ এবং একাধিক ভাষার মিশ্রণ। শব্দ অর্থ আর ভাষার এই স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বা evolution বারণ করা যায় না। কিন্তু অভিব্যক্তিতেও মানুষের কিছু হাত আছে। মানুষ অন্ধভাবে সবরকম প্রাকৃতিক পরিবর্তন মেনে নেয় না, স্বচ্ছন্দাগত সব কিছুকে সাদরে বরণ করে না। অভিব্যক্তির বহু ক্ষেত্রে মানুষ সজ্ঞানে হস্তক্ষেপ করেছে, যে পরিবর্তন তার পক্ষে অনুকূল তাই ঘটাবার চেষ্টা করেছে। বন্য প্রাণী আর উভিদ থেকে গৃহপালিত পশুপক্ষী আর ভক্ষ্য শস্য ফলাদির উৎপত্তি মানুষেরই যত্নের ফল। ভাষার ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক হস্তক্ষেপ শুভজনক হতে পারে।
বিষয়টি সহজ নয়। ভাষার সৌষ্ঠব রক্ষা আর প্রকাশ-শক্তি বর্ধনের প্রকৃষ্ট উপায় কি সে সম্বন্ধে মতভেদ থাকতে পারে, কোন্ শব্দ গ্রহণীয় বা বর্জনীয় তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সবিস্তার আলোচনা না করে শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। তা থেকে হয়তো সতর্কতার প্রয়োজন বোঝা যাবে।
এমন অনেক বস্তু এদেশে আছে যার সম্বন্ধে আমাদের সাধারণ শিক্ষিত জন এতকাল উদাসীন ছিলেন। সম্প্রতি এই প্রকার কয়েকটি বস্তুর গুরুত্ব বেড়েছে, সংবাদপত্র এবং সাধারণের পাঠ্যগ্রন্থে তাদের উল্লেখ না করলে চলে না। কিন্তু নামকরণে অসাবধানতা দেখা যাচ্ছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর যাবৎ এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে লোহা তৈরি হচ্ছে, নূতন পরিকল্পনায় উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। যে কাঁচা মাল বা খনিজ বস্তু থেকে লোহা তৈরি হয় তার বাঙলা নাম কি? রাশি রাশি এই বস্তু রেলগাড়িতে বোঝাই হয়ে লোহার কারখানায় যায়, কলকাতার বন্দর থেকে জাহাজে জাপান রাশিয়া ইত্যাদি দেশে রপ্তানি হয়। অতি প্রয়োজনীয় এই ভারতীয় সম্পদের একটা সর্বগ্রাহ্য নাম অবশ্যই চাই। ইংরেজী নাম iron ore, বৈজ্ঞানিক নাম hematite। যে অশিক্ষিত জন এই বস্তু পাহাড় কেটে বার করে বা খনি থেকে তোলে তারা বলে লোহা-পাথর। এই অতি সরল উত্তম নামটি কিন্তু বাঙলা কাগজে স্থান পায় না, লেখা হয়–লৌহপিণ্ড বা খনিজ লৌহ বা আকরিক লৌহ। তিনটে নামই ভুল। লৌহপিণ্ড মানে লোহার তাল, lump of iron। খনিজ বা আকরিক লৌহ বলতে বোঝায়, যে লৌহ খনি বা আকরে থাকে। কিন্তু খনি বা আকরে কুত্রাপি লৌহ থাকে না, থাকে একরকম পাথর যাতে লোহা যৌগিক অবস্থায় আছে। মাটিতে আখ হয়, আখে চিনি আছে, কিন্তু আখকে ভমিজ শর্করা বলা চলে না। খনি আর আকর শব্দের মানে একই, কিন্তু পারিভাষিক প্রয়োগে mineralএর বাঙলা খনিজ, oreএর বাঙলা আকরিক। অতএব iron oreএর শুদ্ধ প্রতিশব্দ লৌহ আকরিক। কিন্তু লোহা-পাথর নাম আরও ভাল।
লোহার কথা আর একটু বলছি। লোহা-পাথর থেকে প্রথমে যে লোহা অশুদ্ধ অবস্থায় নিষ্কাশিত হয় তার মোটা মোটা বাটের নাম pig-iron। শূকর-দেহের সঙ্গে সাদৃশ্য কল্পনা করে এই নাম দেওয়া হয়েছে। এই বস্তু ভারতের বাইরে প্রচুর চালান যায়। Iron foundry বা লোহা ঢালাইখানায় এই লোহা গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে রেলিং, রাঁধবার কড়াই, বাটখারা ইত্যাদি নানা জিনিস তৈরি হয়। এই জাতীয় লোহার নাম cast-iron বা ঢালাই লোহা। সংস্কৃতে অনেক রকম লোহার নাম আছে, কিন্তু কোটিতে cast-iron বোঝায় তা স্থির করা যায় না। Pig-iron-এর বাঙলা নাম চাই। শূকর-লৌহ চলবে না, বাজার চলিত নাম পিগ-লোহা বাঙলা ভাষায় মেনে নেওয়া ভাল।
Atom bomb অর্থে অনেকে আণবিক বোমা লেখেন। এই অনুবাদ ভুল। Atomicএর বাঙলা পারমাণবিক। পরমাণু বোমা লিখলে ঠিক হয়। এ সম্বন্ধে পরিমল গোস্বামী মহাশয় অনেকবার আলোচনা করেছেন।
যুদ্ধের সময় blackout অর্থে নিষ্প্রদীপ খুব শোনা যেত, এখনও বিজলীর অভাবে শহর অন্ধকার হলে বলা হয় নিষ্প্রদীপ। কিন্তু blackoutএর উদ্দিষ্ট অর্থ আলোকহীনতা। নিষ্প্রদীপ মানে আলোকহীন। ভারতচন্দ্র বহুকাল আগে শুদ্ধ নাম রচনা করে গেছেন–অপ্রদীপ, অর্থাৎ আলোকের অভাব। শব্দটি বিশেষ্য বিশেষণ দুই রূপেই চলতে পারে। Blackoutএর প্রতিশব্দ রূপে অপ্রদীপই গ্রহণীয়।
সাত-আট বৎসর আগে civil supply অর্থে লেখা হত অসামরিক সরবরাহ। Civil শব্দের বাঙলা ছিল না, তাই নঞর্থক অসামরিক শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। যেন সামরিক প্রয়োজনই মুখ্য, জনসাধারণের প্রয়োজন নিতান্তই গৌণ। এই রকম মনোভাবের ফলে এককালে non-Mohamedan নামটির সৃষ্টি হয়েছিল। আজকাল সরকারী নাম জনসংভরণ চলছে, কিন্তু প্রথম প্রথম খুব আপত্তি শোনা গিয়েছিল।
Subcontinentএর বাঙলা উপমহাদেশ। ইংরেজী কাগজে অবিভক্ত সমগ্র ভারত সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য থাকলে লেখা হয়–in this Subconti nent। এর উদ্দেশ্য বোধ হয় পাকিস্তানকে কোনও রকমে ক্ষুণ্ণ না করা। বাঙলায় এই উপমহাদেশে যেমন শ্ৰতিকটু তেমনি অনর্থক। বিষ্ণুপুরাণে পরাশরের বচন আছে–
উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষং তদ্ ভারতং নাম ভারতী যস্য সন্ততিঃ।
এই বর্ণনা অনুসারে ভারতবর্ষ মানেই this Subcontinent, যেমন স্কান্ডিনেভিয়া মানে নরওয়ে সুইডেন ডেনমার্ক আর আইসলান্ড। প্রাচীনকালে এই দেশে বহু স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল, ব্রিটিশ আমলেও ফ্রেঞ্চ পোর্তুগীজ অঞ্চল আর নেপাল ছিল, তথাপি সমগ্র দেশকে বলা হত India বা ভারতবর্ষ। পাকিস্তান হয়েছে বলেই ভারতবর্ষ নামের ভৌগোলিক অর্থ বদলাতে পারে না। আমাদের খণ্ডিত দেশকে শুধু ভারত বা ভারত রাষ্ট্র বলা যেতে পারে।
Chancellor ও Vice-chancellor অর্থে আচার্য ও উপাচার্য চলছে। এই দুই প্রতিশব্দ অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে করি। উপাচার্যের মানে assistant professor/ Vice-chancellorকে এই নাম দিলে তার মর্যাদার হানি হয়। এ সম্বন্ধে পূর্বে কিছু আলোচনা করেছি।*
কথায় কথায় thanks, please, kindly ইত্যাদি বলা ইংরেজী শিষ্টাচার। আমরা তা মেনে নিয়েছি। একবার একটি মেয়ের অটোগ্রাফ খাতায় আমি নাম সহি করলে সে বলেছিল, ধন্যবাদ। আমি প্রশ্ন করলাম, কে ধন্য, তুমি না আমি? মেয়েটি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, তার পর উত্তর দিল আমি, আমি ধন্য শব্দের এক অর্থ কৃতার্থ, আর এক অর্থ খুব বাহাদুর, যেমন ধন্য তোমারে হে রাজমন্ত্রী। মেয়েটি প্রথম অর্থে নিজেকেই ধন্যবাদ দিয়েছিল, দ্বিতীয় অর্থে আমাকে দেয় নি। Thanksএর বাঙলা চাই, ঠিক সমার্থক না হলেও ধন্যবাদ মেনে নেওয়া যেতে পারে। Please, kindly স্থানে অনুগ্রহপূর্বক, দয়া করে ইত্যাদি বলা হয়। হিন্দীতে কৃপয়া এই ছোট সংস্কৃত পদটি চলছে, বাঙলাতেও মেনে নেওয়া যেতে পারে।
ইংরেজীতে অনেক লোকের নাম একত্র লিখতে হলে আগে Messrs বসানো হয়, অর্থাৎ এঁরা সকলেই Mister। হিন্দীতে তার নকল চলছে সর্বশ্রী, বাঙলাতেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই। সর্বশ্রী শুনলেই মানে আসে হাওড়াশ্রী বাঁটরাশ্রী। লোকে যদি এতই শ্রীর কাঙাল হয় তবে উৎকট সর্বশ্রী না লিখে শ্রীর পর কোলন বা ড্যাশ দিয়ে সমস্ত নাম লেখা যেতে পারে।
স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের প্রতি আমাদের কিছু পক্ষপাত দেখা যায়। জীবনচরিত বা চরিত স্থানে জীবনী, জন্মবার্ষিক বা জন্মদিন স্থানে জন্মবার্ষিকী, পরিক্রম বা পরিক্রমণ স্থানে পরিক্রমা, শতাব্দ স্থানে শতাব্দী, প্রকাশ স্থানে প্রকাশনা ইত্যাদি চলছে। এতে আপত্তির কারণ নেই, কিন্তু স্থানে অস্থানে কার্যকরী শব্দটির এত চলন হল কেন? শুধু খবরের কাগজে নয়, অনেক জনপ্রিয় লেখক আর অধ্যাপকের লেখাতেও দেখতে পাই–কার্যকরী উপায়, কার্যকরী সমাধান, প্রস্তাব কার্যকরী করা ইত্যাদি। কার্যকর বা কার্যকারী লিখতে বাধে কেন?
আর একটি অদ্ভুত ফ্যাশন সম্প্রতি দেখা দিয়েছে ক্লীবলিঙ্গ প্রীতি। পত্রিকা বা পুস্তকের নাম রূপ, সুন্দর, অবনীন্দ্রচরিতম্ ইত্যাদি রাখলে আপত্তি করা যায় না। বোধ হয় গৌরব বৃদ্ধির জন্যই সংস্কৃত বিভক্তিযুক্ত নাম দেওয়া হয়। ভরতনাট্যও এই রকম হতে পারে। অনেক দ্রাবিড়ী নামের শেষে ম্ আছে, যেমন–পায়সম্ রসম্ পপডম্ শ্রীরঙ্গম্ চিদম্বরম্। ভরতনাট্যও হয়তো সেই রকম। সেদিন রাস্তায় একটি কবিরাজী দোকানে সাইন বোর্ড দেখেছি–শ্রীআয়ুর্বেদম্। সংস্কৃত ভাল করে না শিখলে কবিরাজ হওয়া যায় না। আয়ুর্বেদ পুংলিঙ্গ শব্দ। দোকানের মালিক শেষে ম্যােগ করে আয়ুর্বেদকে নপুংসক করলেন কেন? আর একটি শোচনীয় নাম মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। একজন লেখক তাঁর রচনার শেষে নাম লেখেন– ভারতপুত্র। এই ভারতসন্তান ক্লীবত্ব বরণ করলেন কোন্ দুঃখে?
[* আচার্য উপাচার্য দ্রষ্টব্য।–স:।
শতাব্দ স্থানে সর্বদা অকারণ স্ত্রীলিঙ্গ শতাব্দী চলছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর আরম্ভে পাশাপাশি লেখা হতে লাগল–নতুন সহস্রাব্দ। অব্দ–শত হলে স্ত্রী, আর সহস্র হলে পুং (লালিমা পাল)-কোন্ যুক্তিতে লিঙ্গভেদ?–স:।]