সমালোচনা
০১. জীবনস্মৃতি–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ২, বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট, কলিকাতা। আকার ৯২ x ৬৪ ইঞ্চ, ২২৩ পৃষ্ঠা। মূল্য সাড়ে তিন টাকা।
এই রচনা পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩১৯ সালে, তার পর এ পর্যন্ত আরও ছ বার ছাপা হয়েছে। বর্তমান সংস্করণের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, গ্রন্থে উল্লিখিত অনেক ব্যক্তি, বিষয় এবং ঘটনা সম্বন্ধে পাদটীকা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় এবং প্রধান বৈশিষ্ট্যগ্রন্থের শেষে যোজিত একান্ন পৃষ্ঠা ব্যাপী গ্রন্থপরিচয়, কবির বংশলতা, এবং বর্ণমিক উল্লেখপঞ্জী।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির সূচনায় লিখেছেন–এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছু নাই যাহা চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যোগ্য।…নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য।…এই স্মৃতিগুলি সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্রী। ইহাকে জীবন-বৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক।
রবীন্দ্রনাথ যাই বলুন, পাঠকবর্গের কাছে এই রচনা শুধুই সাহিত্য নয়। জীবনবৃত্তান্ত হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ হতে পারে; কিন্তু অনাবশ্যক মোটেই নয়। কেউ যদি নিজের সম্বন্ধে কোনও কথা নাও বলেন তথাপি নানা উপায়ে তার জীবনের একটা ইতিহাস সংকলন করা যেতে পারে। অধিকাংশ জীবনবৃত্তান্ত এই রকম। কিন্তু এসব বৃত্তান্ত যতই উত্তম হক, তা মূলত বাহ্যদৃষ্ট জীবনচরিত, অর্থাৎ কীর্তি বা আচরণের ইতিহাস। মানসিক ইতিহাস বা স্বভাবের প্রকৃত পরিচয় জানবার শ্রেষ্ঠ উপায় আত্মচরিত, তা যতই অসম্পূর্ণ হক। জীবনস্মৃতির একটি পরিত্যক্ত পাণ্ডুলিপির সূচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–সম্প্রতি নিজের জীবনটা এমন এক জায়গায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যখন পিছন ফিরিয়া তাকাইবার অবকাশ পাওয়া গেছে–দর্শকভাবে নিজেকে আগাগোড়া দেখিবার যেন সুযোগ পাইয়াছি। ইহাতে এইটে চোখে পড়িয়াছে যে, কাব্যরচনা ও জীবনরচনা ও-দুটো একই বৃহৎ রচনার অঙ্গ। এই পশ্চাদর্শন বা restrospectionএর জন্যই জীবনস্মৃতি অমূল্য গ্রন্থ।
বর্তমান সংস্করণের শেষে যে গ্রন্থপরিচয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে তা মূল গ্রন্থের পরিপূরক এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। যাঁদের চেষ্টায় এই সুদৃশ্য সুমুদ্রিত তথ্যবহুল সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে তারা অশেষ প্রশংসার যোগ্য।
৫/৪/৪৪
০২. শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী–শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংকলিত। প্রকাশক-বুকল্যান্ড লিমিটেড। ৭ X ৫ ইঞ্চ। ৩৯০ পৃষ্ঠা। মূল্য তিন টাকা।
কীর্তিমানের শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাঁর কীর্তি। আর কিছু না জানলেও আমাদের বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু কীর্তিই সমগ্র পরিচয় নয়। তার আকৃতি প্রকৃতি পছন্দ অপছন্দ প্রভৃতিও লোকে জানতে চায়। বিশেষত যিনি জনপ্রিয় গল্পলেখক এবং বিচিত্র চরিতাবলীর স্রষ্টা, তিনি স্বয়ং কি রকম সে সম্বন্ধে লোকের কৌতূহলের অন্ত থাকে না।
মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাবার শ্রেষ্ঠ উপায় তার চিঠিপত্র। শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী তাঁর গল্পের মতই চিত্তাকর্ষক। এই চিঠিগুলির বেশীর ভাগ তিনি স্বচ্ছন্দে বিশ্বস্ত জনকে লিখেছিলেন। ভবিষ্যতে ছাপা হবে এমন চিন্তা তার মনে ছিল না। সতর্কভাবে লেখা না হলেও এগুলি তাঁর বিশিষ্ট প্রতিভায় মণ্ডিত। এই সংকলনে আমরা যে ব্যক্তির পরিচয় পাই তিনি সরল, বন্ধুবৎসল, স্নেহাকাঙ্ক্ষী, একটু অভিমানী, বিনয়ী ও পরিহাসপ্রিয়। তিনি খোলাখুলি মতামত প্রকাশ করেন, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ করেন। পরের দুঃখে কাতর হন, বাড়ির পশুপক্ষীর মৃত্যুও সইতে পারেন না। প্রায়ই অসুখে ভোগেন, ছবি আঁকেন, বিস্তর বই পড়েন, হার্বার্ট স্পেনসারের দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করতে ইচ্ছা করেন, আবগারী ব্যাটাদের হার মানিয়েছিলাম বলে গর্ব করেন, কারও কাছে অপরাধ করেছেন মনে করলে অসংকোচে মার্জনা চান। তিনি জানিয়েছেন যে তিনি ethics বোঝেন, কারও চেয়ে কম বোঝেন বলে মনে করেন না। শুধু গল্প নয়, সকল বিষয়েই তিনি প্রবন্ধ লিখতে পারেন, কেবল পদ্য পারেন না। আরও লিখেছেন-আমার বাংলা ভাষার উপর দখল নেই বললেই চলে, শব্দসঞ্চয় খুব কম। কাজেই আমার লেখা সরল হয়; আমার পক্ষে শক্ত করে লেখাই অসম্ভব।
৬/৩/৪৮