রবীন্দ্রকাব্যবিচার (২৬.০৪.১৯৬০)
যাঁরা সাহিত্যের চর্চা করেন তাদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়– লেখক, পাঠক, আর সমালোচক। লেখক সাহিত্য রচনা করেন, পাঠক তা উপভোগ করেন, সমালোচক তার উপভোগ্যতা বিচার করেন। এই তিন শ্রেণীর চেষ্টা বিভিন্ন, পটুতাও বিভিন্ন, কিন্তু এঁদের সংস্কার বা মানসিক পরিবেশ যদি মোটামুটি একরকম না হয় তবে লেখক পাঠক আর সমালোচকের সংযোগ হতে পারে না। বন্দে মাতরম্ গান সকল জাতির এবং সকল সম্প্রদায়ের উপভোগ্য হতে পারে নি, কারণ তার রূপক অনেকের সংস্কারের অনুকূল নয়। রুল ব্রিটানিয়া, ইয়াংকি ডুডল প্রভৃতি গান সম্বন্ধেও এই কথা খাটে।
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলতেন, যদিও তিনি সনাতনী ছিলেন না। ভারতীয় পুরাণ তত্ত্বে তার প্রচুর জ্ঞান ছিল, বাল্মীকি কালিদাস প্রভৃতির তিনি অনুরক্ত পাঠক ছিলেন, উপনিষৎ থেকে আরম্ভ করে রূপকথা আর গ্রাম্য ছড়া পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্য ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কোনও অঙ্গই তিনি উপেক্ষা করেন নি। পূর্ববর্তী লেখক ভারতচন্দ্র মধুসূদন বঙ্কিমচন্দ্র হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র প্রভৃতির ন্যায় রবীন্দ্রনাথও ভারতীয় ঐতিহ্যে লালিত হয়েছিলেন। তারই ফলস্বরূপ কর্ণ-কুন্তী, কচ-দেবযানী, ব্রাহ্মণ, অভিসার, মেঘদূত প্রভৃতি অনবদ্য রচনা তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। এই বিশিষ্ট ভারতীয় সংস্কারের চিহ্ন তার সকল রচনাতেই অল্পাধিক পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।
পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য যেমন গ্রীস-রোমের পুরাণ, বাইবেল আর ইউরোপীয় ইতিহাস থেকে সংস্কার পেয়েছে, আমাদের সাহিত্যও তেমনি ভারতীয় দর্শন পুরাণ ইতিহাসাদি থেকে পেয়েছে। পাশ্চাত্ত্য সংস্কার মোটামুটি আয়ত্ত না করলে যেমন পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের রসগ্রহণ করা যায় না, তেমনি ভারতীয় সংস্কারে ভাবিত না হলে এদেশের সাহিত্য উপভোগ করা অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কবিদের মধ্যে যাঁদের প্রাচীনপন্থী বা রবীন্দ্রানুসারী বলা হয় তাদের রচনাও ভারতীয় সংস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু যাঁরা আধুনিক বলে খ্যাত তারা এই সংস্কার প্রায় বর্জন করে চলেন, তাঁদের রচনায় আধুনিক পাশ্চাত্ত্য কবিদের প্রভাবই প্রকট, গ্রীস-রোমের পুরাণকথার উল্লেখও কিছু কিছু দেখা যায়। এই নব্য রীতি প্রবর্তনের কারণ– গতানুগতিকতায় বিতৃষ্ণা এবং আধুনিক পাশ্চাত্ত্য কাব্যরীতির প্রতি অনুরাগ। আর একটি কারণ–এদেশের ঐতিহ্যকে এঁরা প্রগতির পথে বাধা স্বরূপ মনে করেন, সেজন্য তার যথোচিত চর্চা করেননি।
পূর্ববর্তী কবিরা যে সংস্কার অর্জন করেছিলেন, তা থেকে এঁরা প্রায় বঞ্চিত। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মণ, মেঘদূত প্রভৃতির তুল্য রচনা এঁদের আদর্শের অনুরূপ নয়, সাধ্যও নয়। এ নহে কুঞ্জ কুন্দ-কুসুম রঞ্জিত, ফেনহিল্লোল কল কল্লোলে দুলিছে–এইরকম অনুপ্রাসময় ছন্দ তারা অতি সেকেলে মনে করেন। তার লটপট করে বাঘছাল তার বৃষ রহি রহি গরজে, তার বেষ্টন করি জটাজাল, যত ভুজঙ্গদল তরজে–এই ধরণের পৌরাণিক কল্পনাতেও তাদের অরুচি ধরে গেছে। রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব তারা অস্বীকার করেন না, কিন্তু আদর্শও মনে করেন না।
বাঙালী সমাজের একটি শাখা ইঙ্গবঙ্গ নামে খ্যাত। আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে যে নূতন শাখা উদ্গত হয়েছে, তাকে ইওরোবঙ্গ নাম দিলে ভুল হবে না। এই নূতন শাখার প্রসারের ফলে আমাদের সাহিত্যের প্রাচীন শাখার ক্ষতি হবে মনে করি না। সাহিত্যের মার্গ বহু ও বিচিত্র, কালধর্মে নূতন নূতন মার্গ আবিষ্কৃত হবেই। একদল কবি যদি পূর্ব ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বনির্বাচিত পথেই চলেন এবং তাদের গুণগ্রাহী পাঠক আর সমালোচকের সমর্থন পান তাতে সাহিত্যের বৈচিত্র্য বাড়বে ছাড়া কমবে না।
প্রাচীন আর নবীন দুই শাখায়ই নিষ্ঠাবান লেখক পাঠক আর সমালোচক আছেন। এক শাখার সমালোচক যদি অন্য শাখার রচনা বিচার করেন, তবে পক্ষপাতিত্ব অসম্ভব নয়। তথাপি বাঙ্গালী সমালোচকের পক্ষে সমগ্র বাঙলা কাব্য বিচারের চেষ্টা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় বা বিদেশী যে কোনও পণ্ডিতের পক্ষে ভারতীয় আর পাশ্চাত্ত্য রচনার তুলনাত্মক সমালোচনা সহজ নয়।
এককালে রবীন্দ্রকাব্যের যেসব দোষদর্শী সমালোচক ছিলেন তাঁরা সকলেই প্রাচীনপন্থী। নব্যতন্ত্রের পক্ষ থেকে প্রতিকূল সমালোচনা বিশেষ কিছু হয়নি। রবীন্দ্রকাব্য আর পাশ্চাত্ত্যকাব্যের তুলনাত্মক নিরপেক্ষ বিচার করতে পারেন এমন বিদগ্ধ প্রতিভাবান সাহিত্যিক কেউ আছেন কিনা জানি না। মধুসূদন দত্ত যদি একালের লোক হতেন, তবে হয়তো পারতেন, প্রমথ চৌধুরীও হয়তো পারতেন। কোনও বিদেশী পণ্ডিতের এইরূপ সমালোচনার যোগ্যতা আছে কিনা সন্দেহ। ভারতীয় আর পাশ্চাত্ত্য উভয়বিধ সাহিত্যে যাঁর গভীর জ্ঞান নেই, উভয়বিধ সংস্কারে যিনি ভাবিত নন, তাঁর পক্ষে তুলনাত্মক বিচারের চেষ্টা না করাই উচিত।