নিসর্গচর্চা (১৩৬১/১৯৫৪)
কালিদাস যদি বাঙালী হতেন তবে বোধ হয় মেঘদূতের পূর্বমেঘ লিখতেন না কিংবা খুব সংক্ষেপে সারতেন, কিন্তু উত্তরমেঘ সবিস্তারে লিখতেন এবং তাতে বিস্তর মনস্তত্ত্ব জুড়ে দিতেন। প্রাকৃতিক বিষয় সম্বন্ধে বাঙালী অনেকটা উদাসীন, প্রাচীন ভারতীয় এবং পাশ্চাত্ত্য লেখকের মতন নিসর্গপ্রীতি আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশী দেখা যায় না।
কলকাতা ইট কাঠ লোহা কংক্রীটের শহর, কর্জন পার্ক আর ইডেন গার্ডেন ধ্বংস করতে আমাদের কষ্ট হয় নি। কিন্তু জনসাধারণের উপেক্ষা সত্ত্বেও অনেক রাস্তার ধারে আর পার্কে এখনও গাছপালা আছে, তাতে বিভিন্ন ঋতুতে বিচিত্র সমারোহ এখনও দেখা যায়। ইংরেজ সম্পাদিত স্টেটসম্যান কাগজে মাঝে মাঝে তার বর্ণনা থাকে। বর্ষাকালে কলকাতার উপকণ্ঠে যে ভেক-সমাগম আর অষ্টপ্রহরব্যাপী মকমক আলাপ শোনা যায় তার একটি মনোজ্ঞ বিবরণ কয়েক বৎসর আগে উক্ত পত্রে পড়েছিলাম।
দেশী সংবাদপত্রে এসব বিবরণ থাকে না। বাঙালীর মনে সাপ ব্যাং শেয়াল পোকামাকড় প্রভৃতির কথা রসের সঞ্চার করে না, অথচ প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যে এই সব প্রাণী প্রচুর সমাদর পেয়েছে এবং পাশ্চাত্ত্য লেখকরাও এদের উপেক্ষা করেন না। প্রতিদিন বিকালে আমাদের মাথার উপর দিয়ে আকাশপথে এক দিক থেকে আর এক দিকে ঝুঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায়, আমরা তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করি না। বাড়ির কাছে গাছপালা থাকলে চৈত্র বৈশাখ মাসে কাক শালিক তাতে বাসা বাঁধে, বর্ষা আর শীতের শেষে নানারকম প্রজাপতি আসে, আমরা তাদের গ্রাহ্য করি না। সেদিন এক ইংরেজী পত্রিকায় পড়েছি, এক শৌখিন ভদ্রলোক তার বাড়ির সামনে বাগান তৈরি করে একটি সাইন বোর্ডে টাঙিয়েছিলেন–Butterflies are welcome। বাঙালী এমন ছেলেমানুষী রসিকতা করে না।
অনেক বৎসর পূর্বে কোনও এক বাংলা সংবাদপত্রে একজন অনুযোগ করেছিলেন–দেশ এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপন্ন, কিন্তু আমাদের কবি আবৃত্তি করছেন–হৃদয় আমার নাচে রে, ময়ুরের মত নাচে রে! এই কি নাচবার সময়? কবি এর সমুচিত উত্তর দিয়েছিলেন। সংবাদপত্রের অনেক বিজ্ঞ পাঠক বলবেন, জগব্যাপী অশান্তির জন্য আমরা উদবিগ্ন হয়ে আছি, এখন শুধু দেশের আর বিদেশের রাজনীতিক সংবাদ চাই, পুলিসের গুলিতে কজন মরল জানতে চাই, রেশনের চাল কবে বাড়ানো হবে তার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি চাই; এই দুর্দিনে তুচ্ছ বিষয়ে আমাদের আগ্রহ থাকতে পারে না। কিন্তু তবুও দেখতে পাই কুৎসিত মকদ্দমার বিবরণ লোকে নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। সাপের দুই পা, ছাগলীর গর্ভে মর্কটের জন্ম, অমুক স্বামীজীর অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি যজ্ঞে এক শ মন ঘৃতাহুতি, অমুক অবতারের জন্মোৎসবে বত্রিশটা স্পেশাল ট্রেনে ভক্তসমাগম–এইসব খবরও অনেক পাঠকের চিত্তাকর্ষণ করে। কিন্তু কবে কোথায় অশথগাছ হঠাৎ তামা-রঙের ঝকঝকে পাতায় ছেয়ে গেল, গুলমোর সোঁদাল বা জারুলের ফুল ফুটল, কোথায় ব্যাঙ ডাকল, আকাশে বক না হাঁস কিসের ঝক উড়ে গেল–এসব তুচ্ছ ছেলেমানুষী খবরে লেখক বা পাঠকের আগ্রহ হবে কেন? আমাদের অধিকাংশ গল্পলেখক মিস্টার বাসু মিসেস চ্যাটার্জি বা কলেজের ছেলেমেয়ের প্রেমলীলা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ প্রাচীন বিপ্লবীদের জের এখনও টানছেন, কেউ কেউ নব বিপ্লবীদের আসরে নামাবার চেষ্টা করছেন। এঁদের ছ-সাত শ পাতার গল্পে টমাস হার্ডির মতন নিসর্গবর্ণনার স্থান হয় না।
ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। এ যুগের অনেক কবি, বিশেষত যাঁরা অত্যাধুনিক নন–যেমন কবিশেখর কালিদাস, কুমুদরঞ্জন, যতীন্দ্রনাথ–এখনও নিসর্গচর্চা করেন। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র বিভূতি বন্দ্যো বনফুল তারাশঙ্কর বিভূতি মুখো প্রভৃতি কয়েক জন লেখক তাঁদের গল্পে শুধু মানুষ-মানুষীর কথা লেখেন নি, বৃক্ষ লতা ইতর প্রাণী নদী প্রান্তরকেও সাদরে স্থান দিয়েছেন। বনফুলের ডানা গল্পে পক্ষিচরিত আর নরনারীচরিত সমান তালে চলেছে। তথাপি বলা যায়, ইংরেজ ও প্রাচীন সংস্কৃত লেখকদের তুলনায় আধুনিক বাঙালী লেখক নিসর্গচর্চায় বিমুখ।
উপনিষদের ঋষি সমগ্র নিসর্গে ব্রহ্মোপলব্ধি করে বলেছেন–
নীলঃ পতঙ্গো হরিততা লোহিতাক্ষ
স্তড়িগর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ।
–তুমি নীল পতঙ্গ, হরিদ্র্ণ লোহিতাক্ষ তড়িগর্ভে মেঘ, ঋতুসকল, সমুদ্রসকল।
প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের মধ্যে অকৃত্রিম নিসর্গচিত্রণে বোধ হয় বাল্মীকি শ্রেষ্ঠ। বর্ষাবর্ণনায় তিনি লিখেছেন,
স্বনৈর্ঘনানাং প্লবগাঃ প্রবুদ্ধা
বিহায় নিদ্ৰাং চিরসন্নিরুদ্ধা।
অনেকরূপাকৃতিবর্ণনাদা
নাবাষুধারাভিহতা নদন্তি।
—নানা আকারের নানা বর্ণের ভেক অবরুদ্ধ স্থানে দীর্ঘকাল নিদ্রিত ছিল, এখন তারা মেঘের শব্দে জাগরিত এবং নবজলধারায় সিক্ত হয়ে নানাপ্রকার রব করছে।
কীটস তাঁর The Realm of Fancy কবিতায় লিখেছেন,
Thou shall see the field-mouse peep
Meagre from its celled sleep
And the snake all winter thin
Cast on sunny bank its skin.
কালিদাস বোধ হয় স্বচক্ষে তিমি দেখেছিলেন তাই রঘুবংশে লিখেছেন,
অমী শিরোভিস্তিময়ঃ সরন্ধ্রৈ
রূৰ্ব্বং বিতন্বন্তি জলপ্রবাহান্
–ওই তিমিকুল মস্তকের রন্ধ্র দিয়ে উপর দিকে জলপ্রবাহ ক্ষেপণ করছে।
কিপলিং নেকড়ে বাঘের গান লিখেছেন,
As the dawn was breaking
the Sambhur belled
Once, twice, and again!
And a doe leaped up, and
a doe leaped up
From the pond in the wood
where the wild deer sup.
This I, scouting alone, beheld
Once, twice and again!
এই প্রকার বর্ণনার অনুরক্ত পাঠক এককালে অনেক ছিল, কিন্তু এখন বড় একটা দেখা যায় না। লোকের রুচি কি বদলে গেছে? বোধ হয় যায় নি, অবহেলায় চাপা পড়ে আছে।
খাবারওয়ালাকে যদি প্রশ্ন করি–মিষ্টান্নে রং দাও কেন, বিকট বিলিতী গন্ধ দাও কেন, সে উত্তর দেয়, খদ্দের এইরকম রং আর গন্ধ চায় যে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তীব্র কৃত্রিম গন্ধযুক্ত সবুজ রঙের গ্রীন ম্যাংগো সন্দেশ পছন্দ করে এমন লোক হয়তো আছে, কিন্তু আসল কথা, খাবারওয়ালা নিজের রুচি আর বুদ্ধি অনুসারে যে রং দেয়, গন্ধ দেয়, অদ্ভুত অদ্ভুত নাম দেয়, ক্রেতা তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, মনে করে, এই হচ্ছে আধুনিক ফ্যাশন। খাদ্যের স্বাভাবিক বর্ণ গন্ধ স্বাদ অনেকেরই ভাল লাগে, কিন্তু মিষ্টান্নকার তা বোঝে না। অনেক গল্পকারও পাঠকসাধারণের স্বাভাবিক সুস্থ রুচির দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক মনে করেন না। লোকে বিকৃত প্রেম আর লালসার চিত্র চায়, রোমাঞ্চ চায়, সেজন্য আমাদের কথাগ্রন্থে তাই থাকে–এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। গল্পকার নিজের রুচি অনুসারেই লেখেন এবং তিনি যদি শক্তিমান হন তবে পাঠকবর্গের মনেও তার রুচি ঞ্চারিত হয়। পাঠক ফরমাশ করে না, লেখকের কাছ থেকে যা পায় তাই হাল ফ্যাশন বলে মেনে নেয়।
রাজনীতিক সামাজিক আর্থিক প্রভৃতি নানা সমস্যা আমাদের আছে।– সাময়িক পত্রে এবং অন্যান্য সাহিত্যে তার বহু আলোচনা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু পাঠকের মন শুধু সমস্যা আর তত্ত্বকথার আলোচনায় তৃপ্ত হয় না, নানাবিধ রসের কামনা করে। বাংলা সাহিত্য উন্নতির পথে চলেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ায় লোকের কর্মক্ষেত্র বেড়ে গেছে, গল্পের পাত্ররা এখন শুধু জমিদারপুত্র কেরানী লেখক চিত্রকর নয়, পাত্রীরা শুধু গৃহপালিতা অল্পশিক্ষিতা কন্যা বা কুলবধূ নয়। বাঙালী অনেক রকম বিজ্ঞান শিখছে, দেশবিদেশে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ নৈসর্গিক তথ্যের সন্ধানে অভিযানও করছে। কিন্তু এখনও আমাদের কথাসাহিত্যের প্রধান অবলম্বন প্রেম। পরিবর্তন এই হয়েছে প্রেমের আর স্বাভাবিক রূপ নেই, আবেদন বৃদ্ধির জন্য তাতে বিলিতী রং আর গন্ধ যোগ করা হয়। অধিকাংশ পাশ্চাত্ত্য গল্পও প্রেমমূলক, কিন্তু প্রেমবর্জিত গল্প আর গল্পতুল্য সুখপাঠ্য লঘু সাহিত্যও প্রচুর আছে এবং পাঠকরা তা আগ্রহের সঙ্গেই পড়ে। বাংলা শিশুপাঠ্য গল্প আর বিলিতীর নকল ডিটেকটিভ কাহিনী অনেক আছে, অল্প স্বল্প ভ্রমণকথাও আছে, কিন্তু আমাদের সাহিত্যে পাশ্চাত্তের মতন বৈচিত্র্য এখনও দেখা যায় ।
শুধু কৌতূহলনিবৃত্তি বা উত্তেজনার জন্য লোকে খবরের কাগজ আর কথাগ্রন্থ পড়ে না, শান্তরসও অসংখ্য পাঠকের প্রিয়। শান্তরস অর্থে শুধু নামে রুচি বা ভক্তিরস নয়। বিস্তর বাঙালী স্ত্রীপুরুষ আজকাল এই রসে ডুবে আছে, তার বৃদ্ধির জন্য সাহিত্যিকদের চেষ্টা অনাবশ্যক। নামে রুচি ছাড়া জীবে দয়াও চর্চার যোগ্য। কিন্তু জীব শুধু দয়ার ভিখারী নয়, প্রীতি বিস্ময় আর কৌতূহলেরও পাত্র।
মানুষ জীবজগতের অংশ, উদভিদ-প্রাণীর সঙ্গে তার আদিম আত্মীয় সম্পর্ক। আমাদের স্বজাতির মধ্যে শত্ৰুমিত্র আছে, উভিদ-প্রাণীর মধ্যেও মানুষের উপকারী অপকারী আছে, কিন্তু তার জন্য সমগ্র জীবজগতের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতার হানি হয় নি।
অরণ্য জনপদ নগর যেখানেই বাস করুক, আবালবৃদ্ধবনিতা সুস্থচিত্ত মানুষ মাত্রেরই সহজাত নিসর্গপ্রীতি আছে। নাগরিক জীবনযাত্রায় তা অবদমিত হতে পারে কিন্তু লুপ্ত হয় না। প্রাকৃতিক প্রতিবেশের সঙ্গে আমাদের এই চিরন্তন সম্বন্ধ এবং প্রতিবেশী বৃক্ষ লতা গুল্ম পশুপক্ষী পতঙ্গাদির প্রতি স্নেহ বিস্ময় আর কৌতূহলের ভাব প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অনাবিল শান্তরসের উপাদান যুগিয়েছে। পাশ্চাত্ত্য লেখক আর পাঠকরাও এই রসের পরম ভক্ত। কালিদাসের শকুন্তলা আর মেঘদূত প্রধানত নিসর্গচিত্রের জন্যই ইওরোপীয় পাঠকের মনোহরণ করেছে। আধুনিক বাঙালী লেখকরা যদি শান্তরসের এই হৃদ্য চিরন্তন উপাদান উপেক্ষা করেন তবে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বঞ্চিত হবে।