সংকেত

সংকেত

-না, আমরা যাব না, তুমি মালপত্রে হাত দিয়ো না।

–সে কী ঘঁসিয়ে! আপনি লাগেজ নিয়ে এসেছেন, একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে! আপনি বলছেন কী?

–ঠিকই বলছি। আমি মত পরিবর্তন করেছি। আমার ইচ্ছে হয়েছিল এই জাহাজে যাব, এখন আমার ইচ্ছে নেই, তাই যাব না–বুঝেছ?

কুলিটি কিছুক্ষণ আশ্চর্য হয়ে মি. গিলবার্টের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দ্রুতপদে আর একটি যাত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মালপত্র তুলে নিয়ে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

মিসেস গিলবার্ট স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন স্তম্ভিতের মতো, নিজের শ্রবণশক্তিকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না–কী বলছেন তার স্বামী?

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সংকল্প করেছিলেন গিলবার্ট-দম্পতি আর এ নিয়ে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের জল্পনাকল্পনারও অন্ত ছিল না। কিন্তু টিকিট বুক করে জাহাজে ওঠার কয়েক মুহূর্ত আগে হঠাৎ গিলবার্ট তার মত পরিবর্তন করলেন কেন?

যে কুলিটি তাদের মালপত্র বহন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল তাকে উদ্দেশ্য করে মি. গিলবার্ট যা বললেন তার মর্মার্থ হচ্ছে : তারা যাত্রা স্থগিত রাখছেন; অতএব তাদের মালপত্র বহন করার জন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

কুলিকে বিদায় দিয়ে মি. গিলবার্ট এইবার তার মালপত্র গুছিয়ে প্যারিসেই ফিরে যাওয়ার উদযোগ করতে লাগলেন। মিসেস এমিলি গিলবার্ট এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি, এইবার তিনি দারুণ ক্রোধে ফেটে পড়লেন, জেমস! তোমার এই মত পরিবর্তনের কারণ কী? আমাকে কি তুমি মানুষ বলে মনে কর না? জাহাজের টিকিট কেটে জেটিতে এসে যাত্রার পরমুহূর্তে তুমি যাত্রা স্থগিত করলে! অর্থাৎ আমাকে নিয়ে একটা নিষ্ঠুর কৌতুক করে তুমি বুঝিয়ে দিতে চাও যে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে আমাকে তোমার ঘর করতে হবে যেহেতু তুমি অগাধ অর্থের মালিক!

স্ত্রীর কঠিন তিরস্কারের উত্তরে গিলবার্ট কোনো কথা বললেন না, কেবল একটি কুলিকে ডেকে মালপত্র তুলে নিতে অনুরোধ করলেন, তারপর ধীরপদে এগিয়ে চললেন রাজপথের দিকে একটি ভাড়াটে গাড়ির উদ্দেশে।

চলন্ত গাড়ির ভিতর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন মিসেস এমিলি গিলবার্ট। তিনি যে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাত্র তিন মাস হল প্যারিসে তাদের বিবাহ হয়েছে; নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর কাছে এমন বিসদৃশ ব্যবহার আশা করেননি। এতক্ষণ বন্দরের ভিতর আত্মসংবরণ করে থাকলেও গাড়ির ভিতর বসে মিসেস গিলবার্ট আর অবরুদ্ধ ক্রন্দনের বেগ সামলাতে পারলেন না। জেমসের নির্দেশ অনুসারে গাড়ি ছুটতে লাগল প্যারিস শহরের একটা হোটেলের দিকে। স্বামীর মুখোমুখি বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন তার স্ত্রী এবং নববধূর ক্রন্দনে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বসে রইলেন জেমস গিলবার্ট এক অনড় প্রস্তরমূর্তির মতো।

জাহাজ ধরতে যাওয়ার আগে যে হোটেলে গিলবার্ট-দম্পতি বাস করছিলেন, বন্দর থেকে ফিরে এসে তারা আবার সেই হোটেলেই উঠলেন। গাড়ির মধ্যে এমিলি স্বামীর সঙ্গে একটিও কথা বলেননি, হোটেলে এসেও তাঁর মৌনব্রত ভঙ্গ হল না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরাজ করতে লাগল অসহ্য নীরবতার এক অদৃশ্য প্রাচীর।

কয়েকদিন পরের কথা। কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ক্রয় করার জন্য মার্কেটিং-এ বেরিয়েছিলেন। এমিলি, বিষাদের ছায়া তখনো মিলিয়ে যায়নি তাঁর মন থেকে। নববধূর আশাভঙ্গের বেদনাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যে পূর্ব-ইতিহাস জানতে হবে তা হচ্ছে এই

প্যারিসের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ করতে এসেছিলেন আমেরিকার প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস গিলবার্ট। ওইখানে অর্থাৎ প্যারিস নগরীতেই এমিলির সঙ্গে জেমসের পরিচয় হয় এবং কিছুদিন পরে তারা পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। এমিলির মাতৃভূমিও আমেরিকা, কিন্তু ঘটনাচক্রে তিনি ফ্রান্সে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিবাহের পর নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর সঙ্গে মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন এবং সত্যি সত্যিই তাঁদের আমেরিকা যাত্রার দিন যখন স্থির হয়ে গেল তখন যে এমিলি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু জাহাজে ওঠার পূর্বমুহূর্তে জেমস যে ভাবে বিনা কারণে যাত্রা স্থগিত করলেন তাতে মনে হয় স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য তাঁর কাছে নেই–নিজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য স্ত্রীকে আঘাত করতে বা অপমান করতে তার বিবেকে বাধে না।

কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়।

স্বামীর বিসদৃশ ব্যবহারের কোনো সংগত কারণ খুঁজে না-পেলেও জেমসকে নিতান্ত স্বার্থপর নিষ্ঠুর মানুষ বলে ভাবতে পারছিলেন না এমিলি। বিবাহের আগে ও পরে তিনি স্বামীর কাছ থেকে কোনোদিনই খারাপ ব্যবহার পাননি। বরং স্ত্রীর প্রতিটি ইচ্ছা-অনিচ্ছার মর্যাদা যে মানুষ স্নেহের সঙ্গে রক্ষা করে এসেছে সেই লোকটি হঠাৎ এমন অসংগত ব্যবহার করল কেন এই প্রশ্নই বার বার জেগে উঠেছে এমিলির মনের মধ্যে।

আচম্বিতে নববধূর চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে তার কর্ণমূলে প্রবেশ করল এক হকারের উচ্চ কণ্ঠস্বর, টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! দারুণ খবর! লিংকন জাহাজ ডুবে গেছে! জোর খবর!

এমিলি চমকে উঠলেন।

লিংকন! ওই লিংকন জাহাজেই তো তাদের আমেরিকা যাত্রা করার কথা ছিল।

দারুণ কৌতূহলী হয়ে এমিলি একটা টেলিগ্রাম কিনে ফেললেন এবং খবরের ওপর চোখ . বুলিয়ে তিনি হয়ে পড়লেন স্তম্ভিত!

অপ্রত্যাশিতভাবে সামুদ্রিক ঝটিকার আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে গেছে লিংকন জাহাজ! একটিমাত্র যাত্রী সাঁতরে বেঁচেছে, আর সকলেরই হয়েছে সলিলসমাধি!

জেমস চুপচাপ বসে ধূমপান করেছিলেন, হঠাৎ ঝড়ের মতো তার সামনে আবির্ভূত হলেন এমিলি! পরক্ষণেই জেমস দেখলেন তার কোলের ওপর এসে পড়েছে একটি কাগজ, সঙ্গেসঙ্গে তিনি শুনতে পেলেন স্ত্রীর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর–জেমস! জেমস! এই দেখ টেলিগ্রাম! লিংকন জাহাজ ডুবে গেছে!… আমি অকারণে রাগ করেছি, দুঃখ পেয়েছি-তুমি নিশ্চয়ই আসন্ন বিপদের কথা জানতে পেরেছিলে! কিন্তু কেমন করে জানলে জেমস! তুমি কি ভবিষ্যতের কথা জানতে পার?

টেলিগ্রামের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে জেমস স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন, ধীরকণ্ঠে বললেন, না, এমিলি, ভবিষ্যতের কথা আমি সবসময় জানতে পারি না। তবে জাহাজে ওঠার পূর্বমুহূর্তে হঠাৎ আমি অনুমান করেছিলাম ওই জাহাজে উঠলে তার পরিণাম আমাদের পক্ষে অশুভ হবে।

এমন অদ্ভুত অনুমানের কারণ? লিংকন খুব মজবুত জাহাজ। ঝড়ের আঘাতে ওই জাহাজ কখনো ডুবে যেতে পারে এমন কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। এমন অভাবিত দুর্ঘটনার কথা তুমি শুধু অনুমান করেই সাবধান হয়েছিলে?

এমিলি! লিংকন জাহাজ জলমগ্ন হবে কি না সে-কথা আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না। ওই সমুদ্রযাত্রা যে আমাদের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে না আমি শুধু এই কথাটাই বুঝেছিলাম। যাক, এসব কথা বলতে আর ভাবতে ভালো লাগছে না। তোমার আপত্তি না-থাকলে বরং চলো–একটা নাট্যশালায় গিয়ে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসি।

এমিলির আপত্তি ছিল না। প্যারিস শহরে একটা অপেরা-হাউস-এ তখন জনপ্রিয় প্রদর্শনী। চলছিল, স্বামী-স্ত্রী সেইখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। হোটেলের একটি ভৃত্যকে ডেকে গাড়ি আনতে নির্দেশ করলেন জেমস। একটু পরেই ভৃত্যটি এসে জানাল অশ্বচালিত একটি শকট তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে নির্দিষ্ট গাড়িটির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন জেমস। এমিলি দেখলেন তার স্বামীর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে অশ্বচালকের মুখের দিকে। এমিলি শুনতে পেলেন জেমস অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করছেন, সে কী! এত শীঘ্র!

গাড়ির চালক অসহিষ্ণুস্বরে বলল, সিয়ে, তাড়াতাড়ি উঠুন। শুনলাম আপনারা  নাট্যশালায় যাবেন। অভিনয় শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই, চটপট উঠুন।

জেমস চালকের কথায় কর্ণপাত করলেন না, তিনি হাত নেড়ে বললেন, আমরা যাব না, তুমি অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাও।

বিস্মিত চালক বলল, সে কী মঁসিয়ে! আপনার চাকর যে বললে–

বাধা দিয়ে জেমস বললেন, আমার চাকর নয়, হোটেলের চাকর। সে ভুল করেছে। যাই হোক তোমার সময় নষ্ট হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখপ্রকাশ করছি এবং যতটা সম্ভব তোমার ক্ষতিপূরণ করে দিচ্ছি–

পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে জেমস বিস্মিত চালকের হাতে দিয়ে তাকে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন। চালকের ক্ষোভের কারণ রইল না, সে ঘোড়া ছুটিয়ে অন্য যাত্রীর সন্ধানে যাত্রা করল।

এমিলি এতক্ষণ বোবা হয়ে ছিলেন। এইবার আর তিনি ক্রোধ প্রকাশ করলেন না, লিংকন জাহাজের ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি আজ নাটক দেখতে যাব না?

জেমস বললেন, নিশ্চয়ই যাব। একটু অপেক্ষা করো, আর একটা গাড়ি এখনই পাওয়া যাবে।

গাড়ি পাওয়া গেল, তবে এখনই নয়। প্রায় আধঘণ্টা পরে একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল।

…অপেরা-হাউস-এর কাছাকাছি আসতেই স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল আকাশের দিকে। রাতের আকাশে অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে রক্তিম আলোর বন্যা এবং দূর থেকে ভেসে আসছে বহু মানুষের কোলাহল ধ্বনি!

চালক বলল, আগুন!

বলার অবশ্য দরকার ছিল না। অন্ধকার রাত্রির কালো যবনিকা ভেদ করে আকাশের গায়ে রক্তরাঙা আলোকধারার এমন হঠাৎ আবির্ভাবের কারণ যে এক ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড ছাড়া আর, কিছু হতে পারে না, সে-কথা অনুমান করতে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

একটু এগিয়ে যেতেই জনতার চাপে গাড়ির গতি রুদ্ধ হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রীর বিস্মিত সৃষ্টির সম্মুখে ফুটে উঠল এক ভয়াবহ অগ্নিময় দৃশ্য!

এমিলি প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বললেন, জেমস! ওই নাট্যশালাতেই আমরা সময় কাটাতে এসেছিলাম!

সত্যি কথা! তাঁরা দুজন যে নাট্যাগারের উদ্দেশে এখানে এসেছেন, সেই অপেরা-হাউস বেষ্টন করে জ্বলছে এক ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ড!

সমবেত জনতার কাছে অনুসন্ধান করে জেমস জানলেন প্রায় আধঘণ্টা আগে হঠাৎ কোনো অজ্ঞাত কারণে নাট্যশালায় আগুন ধরে যায়।এমন অতর্কিতে এক প্রচণ্ড অগ্নিবন্যা নাট্যাগারে আত্মপ্রকাশ করে যে, দর্শকরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করা সুযোগও পায় না। অনেক হতভাগ্যেরই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে; অনেকে উদ্ধার পেলেও এমনভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে যে তাদের জীবিত থাকার আশা খুব কম। কোনোরকমে প্রাণরক্ষা হলেও ওইসব নরনারীর মুখ ও দেহের ওপর থেকে আগুনের বীভৎস দংশন-চিহ্ন কোনোদিনই মুছে যাবে না। মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্য থেকে তারা হবে-চিরজীবনের মতো বঞ্চিত…

স্বামীর হাত ধরে হোটেলে ফিরে এলেন মিসেস এমিলি গিলবার্ট। কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হল না। আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ রূপ এমিলিকে প্রায় স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। জেমস তাঁর স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন।

অবশেষে প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন এমিলি : জেমস! আজও আমরা অদ্ভুতভাবে রক্ষা পেয়েছি। প্রথম গাড়িটাতে যদি আমরা উঠে পড়তাম তাহলে যথাসময়েই আমরা পৌঁছে যেতাম নাট্যাগারে; এবং ওই ভয়াবহ আগুনের বেড়াজালে পুড়ে আমাদের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। কিংবা প্রাণে বাঁচলেও সারাজীবন হয়ে থাকতাম মূর্তিমান বীভৎসতার এক কুশ্রী প্রতিচ্ছবি। বলো জেমস, এই অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারটা তুমি নিশ্চয় আগেই জানতে পেরেছিলে?… আমার বিশ্বাস তুমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তুমি নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!… চুপ করে রইলে কেন? আমি তোমার স্ত্রী, আমার কাছে কিছুই তোমার গোপন করা উচিত নয়।

জেমস মুখ তুললেন, না, এমিলি, কিছুই গোপন করব না। তোমাকে আগে বলিনি, কারণ বললেও তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে না। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই তোমার এই ধারণা সত্য নয়, কিন্তু মূর্তিমান অমঙ্গল যখন মৃত্যুদূত হয়ে আমার সামনে আসে তখন আমি তাকে চিনতে পারি। না, কথাটা ঠিক হল না বরং বলতে হবে তখন তাকে চেনার ক্ষমতা আমার ছিল, কিন্তু আজ থেকে সে-ক্ষমতা আর আমার রইল না।

উৎকণ্ঠিত স্বরে এমিলি প্রশ্ন করলেন, কেন? ভবিষ্যতে আবার যদি বিপদ আসে তাহলে কি তুমি জানতে পারবে না?

না, পারব না। কিন্তু জানার প্রয়োজনও আর হবে না। মৃত্যু আরও একবার আমার কাছে আসবে, কিন্তু তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ সেই মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। অবশ্যম্ভাবী স্বাভাবিক পরিণতি। তোমার উদবিগ্ন হওয়ার হেতু নেই এমিলি, আমি আরও অনেক দিন বাঁচব।

তাহলে আমার সন্দেহ সত্য? তুমি ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা রাখো?

না, আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নই, ভবিষ্যদ্রষ্টাও নই। শোনো, সব কথা তোমায় খুলে বলছি। আজ থেকে কয়েক বৎসর আগে আমি মিশরে গিয়েছিলাম। তুমি জানো আমি প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রাচীন মিশরের একটি কবর খুঁড়ে আমি একটি কফিন হস্তগত করি। কফিনের ভিতর ছিল একটি মমি। এমিলি, তুমি নিশ্চয় জানোমমিকাকে বলে?

জানি। প্রাচীন মিশরীয়রা কোনো অজ্ঞাত উপায়ে মৃতদেহকে সংরক্ষণ করত। বিশেষ ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করে তারা মৃতদেহকে কবর দিত।

ওই ওষুধের প্রভাবে মড়ার চামড়া ও মাংস জীর্ণ হয়ে খসে পড়ত না, দেহে প্রাণ না-থাকলেও সেই মৃতদেহ তার জীবন্ত চেহারার প্রতিচ্ছবি হয়ে কবরের মধ্যে বিরাজ করত যুগযুগান্তর ধরে। অবিকৃত সেই মৃতদেহকে মমি বলা হয়।

ঠিক, ওই ধরনের একটা মমি হস্তগত করে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। শবাধার অর্থাৎ কফিনসুদ্ধ মমির দেহটা আমি নিউইয়র্কে নিয়ে যেতে মনস্থ করি। মমিটা যেদিন আমার হাতে এল সেই রাতেই আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের ভিতর আমার সামনে আবির্ভূত হল এক আশ্চর্য মূর্তি। সেই মূর্তির সর্বাঙ্গ বেষ্টন করে ঝুলছে প্রাচীন মিশরীয় পরিচ্ছদ। তার মুখটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি; কারণ গোলাকার বলয়ের মতো এক তীব্র আলোকপুঞ্জ অবস্থান করছিল সেই মূর্তির কাঁধের উপর এবং সেই অপার্থিব আলোকপ্রবাহের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল মূর্তির মুখমণ্ডল। সেই অদ্ভুত মূর্তির কাঁধের ওপর থেকে জ্বলন্ত আলোর বলয় ভেদ করে ভেসে এল এক অমানুষিক কণ্ঠস্বর

হে বিদেশি! প্রাচীন মিশরের অমর্যাদা কোরো না। জীবিত মানুষের কাছ থেকে যে বিদায় নিয়েছে, তাকে শান্তিতে বিশ্রাম নিতে দাও। যে কবর খনন করে তুমি কফিনটা নিয়ে এসেছ, সেই কবরের ভিতর আবার তুমি ওটাকে রেখে এসো। আমার কথা শুনলে তোমার মঙ্গল হবে।

পরক্ষণেই মূর্তি অদৃশ্য হল আমার ঘুমও গেল ভেঙে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আমি স্বপ্নের কথা চিন্তা করলাম। স্বপ্ন বটে, কিন্তু এমন জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ স্বপ্নের অনুভূতি আমার জীবনে কখনো হয়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরের দিন স্বপ্নে দৃষ্ট মূর্তির কথা মতো কফিনটা পূর্বোক্ত কবরের মধ্যে রেখে এলাম। সেই রাতে আবার স্বপ্নের মধ্যে সেই মূর্তি আমার সামনে আবির্ভূত হল। স্বপ্নের মধ্যেই শুনলাম সেই গভীর অপার্থিব কণ্ঠস্বর–বিদেশি! আমি খুশি হয়েছি! তোমার অন্যান্য দেশবাসীর মতো তুমি নির্বোধ নও! শোনো, তোমার ভাগ্যে অকালে মৃত্যুযোগ আছে। বার বার তিনবার মৃত্যু তোমাকে আক্রমণ করবে। কিন্তু সাবধান থাকলে অকালমৃত্যু তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। যে-মানুষের মুখের উপর তুমি শুষ্ক রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাবে তার থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। জানবে, ওই রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্নের মানুষ হচ্ছে অশরীরী মৃত্যুর শরীরী প্রতিনিধি। আচ্ছা, আজ বিদায় গ্রহণ করছি, তোমার মঙ্গল হোক…।

আমাকে মঙ্গল কামনা জানিয়ে মূর্তি হল অদৃশ্য এবং তার অন্তর্ধানের পর আমার ঘুমও ভেঙে গেল। ওই ঘটনার কয়েক মাস পরে আমি মিশর ত্যাগ করেছিলাম। কিন্তু মূর্তির সাবধানবাণী কখনো অগ্রাহ্য করিনি। প্রথমে জেটির উপর কুলির মুখে এবং তারপর ঘোড়ার গাড়ির চালকের কপালের ওপর আমি দেখেছিলাম লাল ও শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন, সঙ্গেসঙ্গে সাবধান হয়ে কী করেছি তা তো তুমি জান।

এমিলির দুর্ভাবনা গেল না, উদবিগ্ন কণ্ঠে তিনি বলেন, কিন্তু মাত্র তো দু-বার গেছে। এখনও একটা ফাড়াআছে।

জেমস হাসলেন, না ভয় নেই। বিপদ কেটে গেছে। মিশর ছেড়ে আসার আগে কায়রো শহরেই একদিন লিফট দিয়ে নামতে গিয়ে লিফটম্যানের মুখের ওপর দেখলাম মৃত্যুর স্বাক্ষর রক্তবর্ণ ক্ষতচিহ্ন! আমি তৎক্ষণাৎ থেমে গেলাম এবং আমার সঙ্গে যে বন্ধুটি ছিলেন তাঁকে ধরে রেখে জানালাম আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামব, অতএব তাঁকেও আমার সঙ্গী হতে হবে। তোমার মতো বন্ধুটিও আমার ওপর রেগে আগুন হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই এক ভীষণ শব্দ! জানা গেল লিফটের কল বিগড়ে যান্ত্রিক খাঁচাটা হঠাৎ আছড়ে পড়েছে নীচে, লিফটের মধ্যে যারা ছিল তাদের মধ্যে একটি প্রাণীও রক্ষা পায়নি! বন্ধুটি খুব আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমি কি সত্যিই দুর্ঘটনার কথা অনুমান করতে পেরেছিলাম? আমি অবশ্য তাঁর কৌতূহল নিবারণ করিনি। যাই হোক, বার বার তিনবারই আমি অকালমৃত্যুর আক্রমণ এড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি এবং আশা করছি এইবার বেশ কিছুকাল নিশ্চিন্ত হয়ে এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে পারব।

উপরে বর্ণিত কাহিনিটি নিছক গল্প নয়, ঘটনাগুলি বাস্তব জীবনেই ঘটেছিল। তবে স্থান, কাল ও পাত্রপাত্রীদের নাম গোপন করা হয়েছে।

[১৩৮৭]