শত্রু – দ্বিতীয় খণ্ড

সৈনিকের চতুর্থ অভিজ্ঞতা
শত্রু – দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – নূতন অভিযানের উদ্যোগ

এই কাহিনীর প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি আফ্রিকাবাসী যাবতীয় মহিষকেই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শত্রু বলে মনে করতেন। মহিষ সম্বন্ধে কমান্ডার সাহেবের এমন অদ্ভুত বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠার মূলে যেসব কার্যকারণ বর্তমান ছিল, সেইসব ঘটনার বিবরণ প্রথম খণ্ডের পাঠকদের অজানা নয়। রাইফেলে সিদ্ধহস্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও শৃঙ্গধারী মহাকায় মহিষের মধ্যে স্থাপিত তুলনামূলক শত্রুতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় উভয়পক্ষই আঘাত হানতে বিলক্ষণ পটু, জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল প্রাকৃতিক পরিবেশ আর যোদ্ধাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর–অতএব এই শত্রুতা সমানে-সমানে হয়ে ছিল বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হয় না। কিন্তু পরস্পরবিরোধী যে দুটি শত্রুর সংঘাতের ফলে বর্তমান কাহিনির অবতারণা তাদের মধ্যে এক পক্ষ ছিল দানবের মতো বিপুল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী–অপরপক্ষ খর্বকায় দুর্বল, নগণ্য; মহাবলিষ্ঠ শত্রুর এক চপেটাঘাতেই তার মৃত্যু ছিল অনিবার্য।

অতিকায় দানব ও খর্বকায় মানবের অসম শত্রুতার ফলে ক্ষুদ্রদেহধারী বামনের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে হলেও শেষ পর্যন্ত বামনই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। যে-অস্ত্রের সাহায্যে এমন অসাধ্যসাধন করতে সে সমর্থ হয়েছিল, সেই অস্ত্রটি হচ্ছে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আত্তিলিও সাহেব পূর্বোক্ত দুই শত্রুর মাঝখানে এসে পড়েছিলেন নিতান্ত ঘটনাচক্রের শিকার হয়ে, রাইফেল হাতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবেলাও করেছিলেন তিনি আদর্শ সৈনিকের মতো কিন্তু এই কাহিনির নায়ক নন আত্তিলিও গত্তি। প্রকৃত নায়কের সম্মান কাকে দেওয়া যায় সেই বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে আমি এইবার কাহিনি শুরু করল্লাম সেখান থেকে, যেখানে ঠ্যাং ভেঙে আত্তিলিও তাঁবুর ভিতর শয্যাগ্রহণ করেছেন।

হ্যাঁ, শয্যা না-গিয়ে আর উপায় কী? মহিষের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে তাঁর শ্রীচরণের যে কী দুরবস্থা হয়েছিল সে-কথা নিশ্চয়ই প্রথম খণ্ডের পাঠকদের মনে আছে। মধ্য আফ্রিকার বাকাভা অঞ্চলে অবস্থিত কিভু নামক বৃহত্তম হ্রদের তীরে তাবুর ভিতর শুয়ে আত্তিলিও তাঁর ভাঙা পা সুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর স্বপ্ন দেখছিলেন।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু অবশ্য অন্য লোকের কাছে খুব মনোরম লাগবে না। আত্তিলিওর স্বপ্ন যদি চোখের সামনে নিরেট দেহ নিয়ে দাঁড়ায়, তবে অধিকাংশ মানুষই যে আতঙ্কে চমকে উঠবে । সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আত্তিলিও সাধারণ মানুষ নন, বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার উদ্দেশ্যেই তিনি শ্বাপদসংকুল অরণ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন তাই দূরে দৃশ্যমান অরণ্যসজ্জিত পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে তিনি যে-জীবটির স্বপ্ন দেখতেন, সে হচ্ছে আফ্রিকা তথা সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম বানরজাতীয় জীব–দানব-গরিলা।

কিভু হ্রদের অদূরে বিরাজমান ওই পর্বতশ্রেণির উপর হাজার হাজার বছর ধরে যে মহারণ্য রাজত্ব করছে, সেখানে কোনো মানুষ বাস করে না। অতি দুঃসাহসী পিগমি জাতিও সেখানে কেবলমাত্র দিনের আলোতে প্রবেশ করতে সাহস পায়। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যের নিবিড় অন্তঃপুর থেকে প্রতি প্রভাতে শিশু-সূর্যকে অভিনন্দন জানিয়ে তীব্রস্বরে ডেকে ওঠে দানব-গরিলা। মানুষের যাতনা-কাতর আর্তনাদের মতো অতিকায় কপিকণ্ঠের সেই রবি-বন্দনা কানে গেলে শ্রোতার সর্বাঙ্গে জেগে ওঠে আতঙ্কের শিহরন! ওইভাবে চিৎকার করে প্রভাত-সূর্যকে অভ্যর্থনা জানায় বলেই স্থানীয় মানুষ গরিলার নাম দিয়েছে গাগি অর্থাৎ রাত্রির যে অবসান ঘটায়। গরিলার কণ্ঠস্বরে সাড়া দিতেই যে সূর্যদেব প্রত্যহ পূর্বাচলে আত্মপ্রকাশ করেন এ-বিষয়ে পিগমি জাতির সন্দেহ নেই কিছুমাত্র।

পিগমিরা দু-দুবার খবর পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তারা আত্তিলিওকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক, তাঁর জন্য তারা অপেক্ষা করছে সাগ্রহে। পিগমিদের খবর পেয়ে গরিলার সন্ধানে যাত্রা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে তখনই অভিযান শুরু করতে পারছিলেন না।

তাঁর মানসিক অবস্থা বোধ হয় আহত অঙ্গটিকে আরোগ্য লাভ করতে সাহায্য করেছিল, কারণ অপ্রত্যাশিতভাবে চিকিৎসক তাকে জানালেন গোড়ালির হাড় জোড়া লেগে গেছে, আত্তিলিও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

বেলজিয়ামের উপনিবেশ-মন্ত্রীর হাত থেকে অনেক কষ্টে দানব-গরিলার বাসস্থানে প্রবেশ করার একটা পারমিট বা ছাড়পত্র আদায় করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও।ওই অঞ্চলে প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া খুব কঠিন, তবে কয়েকটা অভিযানে সাফল্য লাভ করেছিলেন বলেই আত্তিলিও

সাহেব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিষিদ্ধ বনভূমিতে বাস করার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। নির্দিষ্ট তিন মাসের মধ্যে একটি  দানব-গরিলা শিকারের অনুমতিও নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। তবে নিছক শিকারের বাসনা চরিতার্থ করতে গেলে সরকারের অনুমতি পাওয়া যেত না–আত্তিলিও সাহেব নিহত গরিলার দেহ নিদর্শন হিসাবে প্রেরণ করতে চেয়েছিলেন এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটির নাম উইটওয়াটারসর‍্যান্ড ইউনিভার্সিটি অর জোহানেসবার্গ।

দেরির জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন আত্তিলিও। চিকিৎসক যেদিন পায়ের অবস্থা সন্তোষজনক বলে রায় দিলেন, সেইদিন সন্ধ্যার সময়ে আত্তিলিও সাহেবপ্রাদেশিক কমিশনারের সঙ্গে দেখা করলেন। কমিশনারের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া গেলেও যেসব কথা উক্ত ভদ্রলোকের মুখ থেকে শুনেছিলেন আত্তিলিও, সেগুলো তার কানে আদৌ মধুবর্ষণ করেনি।কমিশনার সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন একটির বেশি গরিলাকে কোনো কারণেই হত্যা করা চলবে না। আত্মরক্ষার ছুতো তিনি শুনতে রাজি নন, কারণ এর আগে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ জঙ্গলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেকগুলো গরিলাকে হতাহত করেছে। আহতদের সংখ্যা নিহতের চাইতে বেশি। হত্যাকারীরা অবশ্য বলেছে আত্মরক্ষার জন্যই তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু কমিশনার তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। কমিশনার সাহেব আত্তিলিওকে জানিয়ে দিলেন ওই ধরনের ঘটনা ঘটলে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। কঠোর শাস্তিটা কীরকম হতে পারে জানতে চেয়ে আত্তিলিও শুনলেন অর্থদণ্ডের পরিমাণ খুব কম করে বিশ হাজার ফ্রাঙ্ক এবং কঙ্গো থেকে বহিষ্করণ। অবশ্য বহিষ্করণের আগে একবার জেল খাটতে হবে, তবে জেলের মেয়াদ কতদিন হতে পারে সে-বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছেন না কমিশনার।

জেল! জরিমানা! বহিষ্করণ!–আত্তিলিও হতভম্ব।

কমিশনার বিনীতভাবে জানালেন একটু কড়াকড়ি করতে হয়েছে। গরিলারা দুষ্প্রাপ্য জীব, বিশেষ করে অতিকায় দানব-গরিলা অতিশয় দুর্লভ তাই সরকার তাদের রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ঠিক আছে, আত্তিলিও বললেন, আপনার অমূল্য গরিলাদের মধ্যে একটির বেশি জন্তুকে লক্ষ করে আমি গুলি ছুড়ব না। প্রাণ গেলেও আমার কথার নড়চড় নেই জানবেন।

আত্তিলিও চলে এলেন। কমিশনার তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। স্থানীয় অধিবাসীরা উচ্চভূমিতে অবস্থিত জঙ্গলের কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছিল, ভিতরে যাওয়া তো দূরের কথা। কমিশনারের চেষ্টাতেই কয়েকটি নিগ্রো আত্তিলিওর সঙ্গী হতে রাজি হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে ওই ভদ্রলোকের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করলেন আত্তিলিও।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মাম্বুটি পিগমি

সারাদিন ধরে অত্যন্ত ধীরে ধীরে আর কষ্টকরভাবে পথ চলার পর আত্তিলিও সদলবলে এসে পৌঁছালেন পাহাড়ের উপর একটা সমতলভূমিতে। ওই সমতলভূমির পিছনে বিরাজ করছিল অরণ্যের সবুজ প্রাচীর। খোলা জায়গাটার উপর সকলে এসে দাঁড়াতেই আত্তিলিওর অনুচরদের ভিতর থেকে উঠল প্রবল হাস্যধ্বনি। হঠাৎ লোকগুলোর এমন হাসিখুশি হয়ে ওঠার কারণটা কী হতে পারে ভেবে এদিক-ওদিক দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ পড়ল একদল অতি খর্বকায় মানুষের দিকে। সেই বেঁটে বেঁটে বামনদের দেহে ছিল নামমাত্র আবরণ, তাদের উচ্চতা ছিল চার ফিটের মতো বামনদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা লোকটির দৈর্ঘ্য চার ফিট ছয়-ইঞ্চির বেশি হবে না। লোকগুলোর ছোটো ছোটো কুঞ্চিত মুখের সঙ্গে বাঁদরের মুখের সাদৃশ্য খুব বেশি। ওইরকম কুৎসিত মুখ, খর্বকায় দেহের মধ্যস্থলে সুগোল উদরের স্ফীতি আর সরু সরু পা দেখে মামুটি পিগমি জাতিকে যদি কেউ খুব হাস্যকর বলে মনে করে তাহলে তাকে বোধ হয় দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু মাষুটি পিগমিদের দলে যে ছোটোখাটো বৃদ্ধটি ছিল, সে আত্তিলিওর নিগ্রো অনুচরদের হাস্যস্রোত পছন্দ করল না। বৃদ্ধের মাথা থেকে ঝুলছিল একটা বেবুনের চামড়া, তার নাকের গড়নও ছিল অদ্ভুত হাড়ের উপর-অংশ চেপটা, তলার দিকটা হঠাৎ ঠেলে উঠেছে উপর দিকে। দুই চোখে বন্য উগ্রতার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে পূর্বোক্ত নিগ্রোদের দিকে একবার কটাক্ষপাত করল বৃদ্ধ–এমন ভয়ংকর সেই চোখের প্রভাব যে, তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল হাস্যধ্বনি, সকলের মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্যের নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি।

ইয়াম্বো, বাওয়ানা (সুপ্রভাত, মহাশয়), বৃদ্ধ বলল।

বলার সঙ্গেসঙ্গে হাতের বর্শাতে ভর দিয়ে সে হেলে দাঁড়াল।

তার দুই চোখ এখন আত্তিলিওর দিকে। দৃষ্টিতে বন্ধুত্বপূর্ণ কৌতূহলের আভাস। কেউ বৃদ্ধের পরিচয় না-দিলেও আত্তিলিও বুঝলেন সে হচ্ছে পিগমিদের অধিনায়ক সুলতানি কাসিউলা–কয়েকদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে আত্তিলিওর জন্য।

ইয়াম্বা, বাওয়ানা, বৃদ্ধের সঙ্গীরা সমস্বরে অভ্যর্থনা জানাল। চোখের ভাষা যে পড়তে জানে সে পিগমিদের ঝকঝকে চোখগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝবে বামনরা নির্বোধ নয়। একটু পরেই যে নবাগত সাদা-চামড়ার মানুষটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেই আগন্তুককে দুই চোখ দিয়ে জরিপ করে নিচ্ছে খর্বকায় পিগমিরা বুঝে নিতে চাইছে লোকটি কেমন হবে।

মুহূর্তের মধ্যেই পিগমিদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন আত্তিলিও। ছোটোখাটো লোকগুলোকে তার খুব ভালো লেগে গেল। পিগমিরা আত্তিলিওর মনোভাব বুঝতে পারল। তৎক্ষণাৎ তারা তাবু ফেলার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁবু খাটানোর কাজ শেষ। মোটবাহকরা চটপট শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পারিশ্রমিক নেবার জন্য। প্রাপ্য অর্থ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই লোকগুলো দৌড় দিল–লোভনীয় বকশিশ টম্বাকো (তামাক) নেবার জন্য তারা এক মুহূর্ত দেরি করল না। তাদের অদ্ভুত আচরণের অর্থ খুবই পরিষ্কার আত্তিলিওর কাছে রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই লোকগুলো স্থান ত্যাগ করতে চায়। তাদের বিবেচনায় এই অঞ্চল রাত্রিকালে ঘোরতর বিপজ্জনক।

পিগমিরা এর মধ্যে গাছের ডালপালা দিয়ে একটা সাময়িক আচ্ছাদন নিজেদের জন্য তৈরি করে ফেলেছে এবং অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে আত্তিলিওর রাঁধুনির রান্নার স্বাদ গ্রহণ করছে। নিবিষ্টচিত্তে। রান্না তো ভারি, গাদা গাদা সিদ্ধ আঁটা। কিন্তু সেই খাদ্য পেয়েই তারা খুব খুশি, আর রাঁধুনিও তাদের পরিতুষ্ট করতে ব্যস্ত। একটু আগেই তার অট্টহাস্য যে পিগমিদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল সেই কথা সে ভোলেনি, অপ্রীতিকর ব্যাপারটা মুছে ফেলে সে পিগমিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ন্‌গাগি

খুব ভোরে বীভৎস চিৎকারের শব্দে আত্তিলিওর ঘুম ভেঙে গেল। এমন উৎকট আওয়াজ আগে কখনো শোনেননি তিনি। তবু চিৎকারের কার্যকারণ অনুমান করতে তার ভুল হল না। চটপট তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন আত্তিলিও। পিগমিরা আগেই উঠেছে এবং অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে পড়েছে।

উত্তেজিত স্বরে আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, নগাগি?

পিগমিদের নেতা কাসিউলা গম্ভীরভাবে বলল, নদিও, নগাগি (হ্যাঁ, গরিলা)।

সমবেত পিগমিরা মাথা নেড়ে সর্দারের কথায় সায় দিল। তার পর সদ্য জাগ্রত শিশু সূর্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। আত্তিলিওর পায়ের তলায় অবস্থিত উঁচু জমিটার অনেক নীচে কিভু হ্রদের জল যেখানে আয়নার মতো ঝকঝক করছে, মনে হল সেই তরল আয়নার উপর থেকেই উঠে আসছে প্রভাত সূর্য।

কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন আত্তিলিও। সঙ্গে রইল খর্বকায় পিগমি পথপ্রদর্শকের দল। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে আত্তিলিও ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু এমন কষ্টকর পথ চলার অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি। পথ বলতে কিছু নেই–ঘন সন্নিবিষ্ট বৃক্ষ, ঝোঁপ, লতা, ঘাসজঙ্গল প্রভৃতি নিয়ে গঠিত উদ্ভিদের প্রাচীর ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতি মুহূর্তে মনের মধ্যে জেগে ওঠে সর্পাঘাতের সম্ভাবনা। মাথার উপর ডালপালা আর লায়ানা লতার মধ্যে সাপ লুকিয়ে থাকলে তাকে ছোবল মারার আগে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়; পায়ের কাছে যেখানে শুকনো ঝরা পাতা আর শ্যাওলার মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় সেখান থেকেও লুকিয়ে-থাকা সাপ যেকোনো মুহূর্তে ছোবল বসাতে পারে শুধু তাই নয়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে যদিও ঘন জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না, তবু প্রতি মুহূর্তে ঝোঁপঝাড়ের ভিতর থেকে আত্মগোপনকারী হিংস্র পশুর আক্রমণের আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা চমকে চমকে উঠতে থাকে, সেইসঙ্গে চোখে পড়ে বিষাক্ত কীটপতঙ্গের আনাগোনা। কয়েকটা বিচিত্র ধরনের কীট আত্তিলিওর পরিচিত নয়, সেগুলোকে তার আরও বেশি ভয়ানক বলে মনে হল। কাটাগাছের ডালগুলো তাদের ধারালো আলিঙ্গনের চিহ্ন বসিয়ে দিতে লাগল আত্তিলিওর পরিচ্ছদ আর চামড়ার উপর, অসংখ্য নাম-না-জানা গাছের বিষাক্ত স্পর্শে ফুলে ফুলে উঠল তার মুখ আর হাত, সঙ্গেসঙ্গে আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বালা-যন্ত্রণা। এর ওপর আবার শ্বাসকষ্টও ছিল–উচ্চভূমির ভারী বাতাস টানতে তার বিলক্ষণ কষ্ট হচ্ছিল, কয়েক ঘণ্টা পথ চলার পরই তার দৃষ্টি হয়ে এল ঝাপসা, কান করতে লাগল ভো ভো! দাঁতে দাঁত চেপে রাইফেল আঁকড়ে ধরে অতিকষ্টে এগিয়ে যেতে। লাগলেন আত্তিলিও সাহেব।

আত্তিলিওর সঙ্গী কাসিউলা নামক পিগমিদের নেতা এবং তার বারোজন অনুচর খুব সহজেই পথ চলছিল। উদ্ভিদের জটিল জালের ভিতর দিয়ে তাদের ছোটোখাটো শরীর চটপট পথ করে নিচ্ছিল, কিন্তু মস্ত গুরুভার দেহ নিয়ে আত্তিলিও যাচ্ছিলেন আটকে আর আটকে তিনি যখন গাছপালার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে পথ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন এবং পায়ের তলায় গর্তগুলো দেখতে না-পেয়ে ধপাধপ আছাড় খাচ্ছেন, পিগমিরা তখন হালকা শরীর নিয়ে গর্তের উপরের। ঘাসপাতা মাড়িয়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে! তাদের জুতো ছাড়া খালি পা খুব সহজেই নরম মাটি, শ্যাওলা ও শিকড়বাকড়ের উপর চেপে পড়ছে কিন্তু আত্তিলিও সাহেবের জুতো-পরা পা যাচ্ছে পিছলে আর পিছলে, তিনি খাচ্ছেন হোঁচটের পর হোঁচট! জঙ্গলের ছায়ার মতোই নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে পিগমিরা, আবার ফিরে এসে সর্দারকে সামনের পথের খবরাখবর দিচ্ছে ফিসফিস করে, তারপরই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে ভূতুড়ে ছায়ার মতো!…

আচম্বিতে আত্তিলিওর খুব কাছেই জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল এক তীব্র চিৎকার! ক্রুদ্ধ সিংহের গর্জনের চাইতেও ভয়ংকর, যাতনাকাতর কুকুরের কান্নার চাইতেও করুণ, মরণাহত মানুষের আর্তনাদের চাইতেও ভয়াবহ সেই চিৎকারের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সকাল বেলা যে চিৎকার শুনেছিলেন আত্তিলিও, এই শব্দটা মোটেই সে-রকম নয়। প্রথম চিৎকারের পরেই খুব কাছ থেকে আরও অনেকগুলো কণ্ঠের সাড়া পাওয়া গেল–কণ্ঠস্বরগুলো একইরকম তীব্র, একইরকম উগ্র, একইরকম ভয়ংকর! তারপর আবার সব চুপচাপ!

চিৎকারগুলো যে গরিলাদের কণ্ঠ থেকেই এসেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু জন্তুগুলো কোথায় অবস্থান করছে বুঝতে পারলেন না আত্তিলিও। গাছের পাতার কম্পনও তাঁর চোখে পড়ল না, তাই তাদের গতিবিধিও ধরতে পারলেন না তিনি–তবে একটা উগ্র গন্ধ তার নাকে এসেছিল বটে। আত্তিলিও ভাবতে লাগলেন এই বুঝি একজোড়া রোমশ বাহু জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরে!

গরিলা সম্বন্ধে যেসব গল্প শুনেছিলেন আত্তিলিও সেই গল্পগুলো এখন তার মনে পড়তে লাগল। নিগ্রোদের মধ্যে অনেকেই নাকি গরিলার কবলে পুড়ে অদৃশ্য হয়েছে, শ্বেতাঙ্গ শিকারিদের মধ্যে যারা গুলি চালিয়েছে কিন্তু গরিলাকে হত্যা করতে পারেনি এবং তার ফলে গরিলার প্রচণ্ড মুষ্টি যাদের সর্বাঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে তাদের কথা মনে পড়ল আত্তিলিও সাহেবের, গরিলার নখাঘাতে ছিন্নভিন্ন পিগমিদের কাহিনিও তাঁর স্মরণপথে উঁকি দিল, আর

আর ঠিক সেই সময় মটাৎ করে একটা গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ এল আত্তিলিওর বাঁ-দিক থেকে!

বিদ্যুদবেগে শব্দ লক্ষ করে ঘুরলেন তিনি, কিন্তু কিছুই তার নজরে পড়ল না।

আবার একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ এল সামনের দিক থেকে। পরের শব্দটা উঠল ডান দিকে। তারপর এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল সেই শব্দ–কাদের ভারী পায়ের চাপে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে শুকনো গাছের ডাল। সেইসঙ্গে বড়ো বড়ো গাছের পাতার আলোড়ন-ধ্বনি। অরণ্যের বুকে শব্দের তরঙ্গ তুলে সরে যাচ্ছে অনেকগুলো অতিকায় জীব। যদি তাদের মধ্যে কারো হঠাৎ আত্তিলিওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার শখ হয়, তাহলে কী হবে? ঘন উদ্ভিদের জাল ভেদ করে আক্রমণকারীকে আবিষ্কার করার আগেই তো আত্তিলিও পড়ে যাবেন দানবের খপ্পরে! রাইফেল চালানোর সময় পাওয়া যাবে কি?

না, সেসব কিছু হল না। অন্তত এবারের মতো গরিলারা আত্তিলিও আর তার দলবলকে রেহাই দিল। জন্তুগুলো সরে যাচ্ছে।

যে-পাহাড়টার উপর আত্তিলিও তাঁর পিগমি সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই পাহাড়ের নীচের দিকেই সশব্দে নেমে যাচ্ছে গরিলার দল। যাওয়ার আগে তারা বুঝি জানিয়ে দিয়ে গেল, সাবধান! চলে যাও এখান থেকে! কথা না-শুনলে বিপদ হবে!

হ্যাঁ, চলে যেতেই চাইলেন আত্তিলিও। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাতে তার একটু সময় লাগবে। সেদিন অন্তত দানব-গরিলার সান্নিধ্যে আসার জন্য একটুও উৎসুক ছিলেন না আত্তিলিও, বরং ওই ভয়ংকর জীবের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্যই তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। কম্পাসের দিকে তাকিয়ে তিনি পিছন ফিরে তাঁবুর দিকে যাত্রা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন পিগমি-সর্দারের কাছে। সর্দার কাসিউলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, তারপর সোজা এগিয়ে চলল নিজের খুশিমতো। পিছন ফিরে তাবুর রাস্তায় পা বাড়াল । আত্তিলিওর মেজাজ খারাপ হল; লোকটা আবার কিশোয়াহিলি ভাষা ভালো বুঝতে পারে না, কিন্তু ওই ভাষা ছাড়া আর কীভাবে আত্তিলিও ভাব প্রকাশ করবেন? এত তাড়াতাড়ি তো আর পিগমিদের ভাষা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। অতএব বার বার হাত নেড়ে পূর্বোক্ত ভাষাতেই তিনি বলতে লাগলেন, তোমাকে পিছন ফিরতে বলছি না? আমি তাঁবুতে ফিরতে চাই।

সর্দার কাসিউলা খুব অমায়িকভাবে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ আত্তিলিওর কথা সে বুঝেছে। কিন্তু যে-পথ ধরে এগিয়ে গেলে তাবুতে পৌঁছানো যাবে বলে ভাবছিলেন আত্তিলিও, ঠিক তার উলটো দিকের পথ ধরেই হাঁটতে লাগল কাসিউলা! এমন নির্বিকার মানুষকে নিয়ে কী করা যায়? উপায়ান্তর না-দেখে আত্তিলিও শেষ পর্যন্ত কাসিউলাকেই অনুসরণ করলেন। ফলে দেখা গেল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি এসে পড়েছেন তাবুর সামনে! আত্তিলিও বুঝলেন কম্পাস প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্য না-নিয়েও পিগমিরা নিখুঁতভাবে পৃথ চলতে পারে। শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও পিগমিরা কখনো পথ ভুল করে না। সত্যি, তাদের দিকনির্ণয় করার ক্ষমতা অদ্ভুত।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বামন ও দানবের দেশ

কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। আত্তিলিও দানব-গরিলার স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারলেন। কিন্তু দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পিগমিদের মতো সহজভাবে পথ চলার কায়দাটা রপ্ত করতে পারলেন না। প্রত্যেকদিন অরণ্য ভ্রমণ সাঙ্গ করে আত্তিলিও ভাবতেন, আর নয়, এবার অন্তত কয়েকটা দিন বিশ্রাম নেব।

পরের দিন কাসিউলা এসে ডাকামাত্র তিনি আবার বেরিয়ে পড়তেন, রহস্যময় অরণ্য যেন দুর্বার আকর্ষণে তাকে টেনে আনত তাবুর বাইরে।

প্রত্যেকদিন কাসিউলা তার শ্বেতাঙ্গ অতিথিকে নিয়ে যেত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। ওই জায়গাগুলো ছিল গরিলাদের রাতের আস্তানা। তারা চলে যাওয়ার পর তাদের পরিত্যক্ত আস্তানা পর্যবেক্ষণ করে আত্তিলিও দুটি গরিলা-পরিবারের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন। পরিবার দুটি দিনের বেলা একসঙ্গে ভ্রমণ করত, কিন্তু রাত হলে তারা আশ্রয় নিত পৃথক আস্তানায়।

ওই আস্তানাগুলো তৈরি করতে গরিলারা যথেষ্ট পরিশ্রম করত। দুটি বড়ো গাছের নীচে রাত্রিবাসের জন্য আস্তানা তৈরি করা হত। প্রথমে গাছের তলায় মাটির উপর থেকে ঝোঁপঝাড়, শিকড়বাকড় তুলে জায়গাটা পরিষ্কার করত গরিলারা, তারপর সেই জায়গাটার উপর প্রচুর পরিমাণে শ্যাওলা, গাছের পাতা প্রভৃতি বিছিয়ে প্রস্তুত করত একটি আরামদায়ক বিছানা। অন্তঃপুরের গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টাও ছিল–মোটা মোটা লায়ানা লতা টেনে এনে পর্দা দেওয়ার চেষ্টা দেখা যেত ওই আস্তানায়।

গরিলাদের সঙ্গে যখন ছোটো বাচ্চা থাকে তখন মেয়ে-গরিলা আর বাচ্চারা গাছের উপর আশ্রয় গ্রহণ করে। দৈত্যাকৃতি পুরুষ গরিলা গাছের নীচে পূর্বে উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসারে তার নিজের আস্তানা ও শয্যা তৈরি করে, তারপর সেখানে নিদ্রা দেয়। তবে একবারে চিতপাত হয়ে তারা শুয়ে পড়ে না, গাছের গুঁড়িতে পিঠ লাগিয়ে তারা নিদ্রাসুখ উপভোগ করে। ঘুমের সময়েও বিপদের আশঙ্কায় তাদের ইন্দ্রিয় থাকে অতিশয় জাগ্রত, একেবারে অচৈতন্য হয়ে তারা কখনোই নিদ্রার ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করে না।

ভোর হলেই আবার গরিলারা বেরিয়ে পড়ে আহারের সন্ধানে। আত্তিলিও তাঁর পিগমি-বাহিনী নিয়ে গরিলাদের পরিত্যক্ত আস্তানা থেকে পদচিহ্ন ধরে জন্তুগুলোকে অনুসরণ করতেন। এই ব্যাপারে কাসিউলার দক্ষতা অসাধারণ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্তিলিও সাহেব গরিলাদের পথ-চলার চিহ্ন আবিষ্কার করতে না-পারলেও কাসিউলা নির্ভুলভাবে জন্তুগুলোর গন্তব্য পথ নির্ণয় করতে পারত। কী করে পারত সেটা অবশ্য আত্তিলিও বুঝতে পারেননি। কয়েক জায়গায় গরিলাদের পায়ের ছাপ তুলেছিলেন আত্তিলিও প্লাস্টার অব প্যারিস নামক পদার্থের সাহায্যে। সবচেয়ে বড় পায়ের ছাপ ছিল ১৪ ইঞ্চি লম্বা, ৬ ইঞ্চি চওড়া এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে কনিষ্ঠ অঙ্গুলি পর্যন্ত পদচিহ্নের বিস্তার ৭ ইঞ্চি। জন্তুটার দেহের ওজন সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা দেবার জন্য আত্তিলিও বলেছেন পিগমিদের পায়ের ছাপ যতই গম্ভীর হয়, তার চারগুণ গম্ভীর হয়ে মাটির উপর পড়ে গরিলার পদচিহ্ন।

ওই পায়ের চিহ্ন দেখে গরিলাদের চিনতে পারত কাসিউলা। পিগমিরা তাদের এলাকার প্রত্যেকটি গরিলার নামকরণ করেছিল। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু শুধু পায়ের ছাপ দেখেই কাসিউলা বলে দিত কোন কোন জন্তুর পদচিহ্ন! এ-বিষয়ে তার একবারও ভুল হয়নি।

খুব ধীরে ধীরে পা চালিয়ে গরিলাদের অনুসরণ করতেন আত্তিলিও। অতিকায় বানরগুলোর গতিবিধি তিনি লক্ষ করতেন জঙ্গলের আড়াল থেকে অথবা গাছের উপর থেকে।

গরিলারা প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উদরস্থ করে। কারণ, তাদের দেহের পরিধি যেমন বিরাট, তাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত জিনিসগুলোর আকার তেমনই অতিশয় ক্ষুদ্র। মিয়ান্দো নামক এক ধরনের শাক তাদের প্রিয় খাদ্য। মিয়ান্দো ভক্ষণে ব্যস্ত একদল গরিলাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আত্তিলিও সাহেবের। একটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে অবস্থান করেছিল মিয়ান্দো শাকের খেত, কয়েক মিনিটের মধ্যেই গরিলারা জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলল! খেতের সমস্ত শাক উদরস্থ করেই দলটা আবার খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যাত্রা করল দলপতির নির্দেশে।

আহার্য বস্তু সংগ্রহ করার জন্যই গরিলারা সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে বাধ্য হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটা বিস্তীর্ণ এলাকার ফলমূল, শাকসবজি তারা উদরস্থ করে ফেলে, অতএব খুব বেশি ঘোরাঘুরি না-করলে তাদের রাক্ষুসে খিদে মিটবে কেন? গরিলাদের প্রিয় খাদ্য হচ্ছে মিয়ান্দো শাক, বুনো কলা, বুনো পেঁয়াজ আর কচি বাঁশের গোড়া। ভোরবেলা থেকে শুরু করে বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত চলে তাদের ভ্রমণ আর আহার পর্ব–তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের খাদ্যসংগ্রহের বিরাম নেই। খুব সম্ভব সেইজন্যই তারা প্রতিরাত্রে নূতন নূতন রাতের আস্তানা তৈরি করতে বাধ্য হয়। আহারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তারা বিকালের দিকে আগের আস্তানা থেকে এত দূরে এসে পড়ে যে, সেখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না–অতএব রাত্রিবাসের জন্য নূতন ঘর না-বেঁধে আর উপায় কী?

দুপুর বেলা গরিলারা যখন বিশ্রাম করে সেইসময় কয়েকদিন তাদের লক্ষ করেছিলেন আত্তিলিও। কয়েকটি পূর্ণবয়স্ক গরিলাকে সটান ঘাসের উপর লম্বা হয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে দেখা গেল, কয়েকটা জন্তু আবার গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে ঘুম লাগাচ্ছে। একদিন একটা গরিলা-বাচ্চার কাণ্ড দেখে খুব মজা পেয়েছিলেন আত্তিলিও। একটা কিশোরবয়স্ক গরিলার সঙ্গে বাচ্চাটা খেলা করছিল। গাছের উপর-নীচে ছুটোছুটি করে তারা পরস্পরকে তাড়া করছিল খেলার ছলে, কখনো-বা লায়ানা লতা ধরে ঝুলছিল প্রবল উৎসাহে, আবার কখনো-বা লুকোচুরি খেলার আনন্দে তারা মশগুল। হঠাৎ বাচ্চাটা খেলা ছেড়ে তার মায়ের কাছে এসে পড়ল। মা বসে বসে ঢুলছিল, বাচ্চার বোধ হয় সেটা পছন্দ হল না। সে প্রথমে মায়ের চারপাশে লাফালাফি করল, তারপর বুকের উপর লাফিয়ে উঠে চুল ধরে টানতে লাগল; অর্থাৎ যতরকমে সম্ভব মাকে বিরক্ত করতে শুরু করল। গরিলা-মা প্রথমে কিছু বলেনি, কিন্তু অত্যাচার যখন অসহ্য হয়ে উঠল তখন চোখ বন্ধ রেখেই বাচ্চাকে একটি মৃদু চপেটাঘাত করল সে। থাপ্পড় খেয়ে বাচ্চাটা ফুটবলের মতো গোল হয়ে গড়াতে গড়াতে ছিটকে পড়ল অনেক দূরে! অবশ্য পরিত্রাহি চিৎকার করে সে জানিয়ে দিয়েছিল মায়ের ব্যবহারটা তার মোটেই ভালো লাগেনি।

গরিলা দলপতির গতিবিধি লক্ষ করা কিন্তু এত সহজ নয়। পথ চলার সময়ে সে থাকে দলের আগে। দল যখন পিছিয়ে আসে, সে তখন সকলের পিছনে। দলের গরিলারা যখন আহারে ব্যস্ত, দলপতি সেইসময় চারধারে ঘুরে ঘুরে টহল দেয়, নজর রাখে চারদিকে শত্রুর আবির্ভাব হলে তার প্রথম মোকাবেলা করে দলপতি। দৈর্ঘ্যে ছয় ফিট ছয় ইঞ্চি, রোমশ কৃষ্ণ দেহের পৃষ্ঠদেশে কালোর বদলে রুপালি রঙের ছোঁয়া-মাখানো বিরাট শরীর নিয়ে গরিলা দলপতি যখন ধীর পদক্ষেপে বনের পথে বিচরণ করে, তখন মনে হয় অরণ্য-সম্রাট তার রাজত্ব পরিদর্শন করে ফিরছে!

গরিলারা যখন স্থানত্যাগ করে অপরস্থানের উদ্দেশে রওনা হত, ঠিক সেইসময় তাদের অনুসরণ করতেন না আত্তিলিও। কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি বুঝেছিলেন পিগমিদের মতো নিঃশব্দে ঘন জঙ্গলের ভিতর চলাফেরা করার ক্ষমতা তার নেই। ভারী জুতো আর ভারী শরীর নিয়ে ধুপধাপ করে বনের মধ্যে যাতায়াত করতে গিয়ে গরিলাদের চমকে দেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাদের মেজাজ খারাপ থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, সে-রকম বিপজ্জনক কিছু না-ঘটলেও অতি দ্রুতবেগে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে তারা যে অনুসরণকারীদের ফাঁকি দেবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ধাবমান গরিলাদের নাগাল পেতে হলে আবার কয়েক ঘণ্টা ঊর্ধ্বশ্বাসে তাদের পিছু পিছু ছোটা দরকার। সেইখানেই আত্তিলিওর প্রবল আপত্তি, ঘন জঙ্গলের মধ্যে অনর্থক ছোটাছুটি করে কষ্ট পেতে তিনি মোটেই রাজি ছিলেন না। অতএব গরিলারা কিছুদূর এগিয়ে গেলে পিগমি-সর্দার কাসিউলার নির্দেশ অনুসারে তাদের পিছু নিয়ে এগিয়ে যেতেন আত্তিলিও এবং ওইভাবে চলাফেরা করার ফলে অনুসরণকারী মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হতে পারেনি গরিলার দল। একটা জায়গা ছেড়ে আর একটা জায়গার উদ্দেশে গরিলাদের পদচালনা করতে দেখলেই আত্তিলিও বসে পড়তেন একটা গাছের গুঁড়ির উপর। তারপর বেশ খানিকটা সময় কেটে গেলে তিনি আবার তাদের পিছু নিতেন। ওই সময়টা চুপচাপ বসে–থেকে আত্তিলিও পিগমিদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চেষ্টা করতেন।

আগেই বলেছি ওই অঞ্চলের গরিলাদের প্রত্যেকটি পশুরই নামকরণ করেছিল পিগমিরা। কিটাম্বো নামে একটা মস্ত পুরুষ-গরিলাকে পিগমিরা ভীষণ ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কের সঙ্গে একটা শ্রদ্ধার ভাবও দেখেছিলেন আত্তিলিও। একদিন কাসিউলাকে ডেকে আত্তিলিও জিজ্ঞাসা করলেন এমন ভয়ানক জন্তুটাকে তারা হত্যা করেনি কেন? উত্তরে কাসিউলা জানাল শ্বেতাঙ্গদের আইনে গরিলা মারলে শাস্তি পেতে হয় বলেই তারা উক্ত কিটাম্বোর অস্তিত্ব সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। আত্তিলিও বুঝলেন কাসিউলা মিথ্যা কথা বলছে। গরিলার মাংস যে পিগমিদের প্রিয় খাদ্য এবং শ্বেতাঙ্গ শাসকের আইন অমান্য করে তারা যে সুযোগ পেলেই গরিলা শিকার করে সেই তথ্য আত্তিলিওর অজ্ঞাত ছিল না। সাদা মানুষের আইনের কথা নিতান্তই বাজে কথা, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মহাশক্তিধর কিটাম্বোর হিংস্র আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার সাহস ছিল না বলেই পিগমিরা তাকে কখনো হত্যার চেষ্টা করেনি।

স্বয়ং কমিশনার সাহেব আত্তিলিওকে জানিয়েছিলেন পিগমিদের গরিলা শিকার থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও বেলজিয়ামের শ্বেতাঙ্গ-সরকার সুবিধা করতে পারেননি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে সুবিধা পেলেই পিগমিরা গরিলা মেরেছে। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যের ভিতর ঢুকে দোষীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। কিন্তু সরকারের আইনের সাহায্য ছাড়াই গরিলারা যে খর্বকায় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে তার কারণ হচ্ছে তাদের নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য। মাঝে মাঝে গরিলা শিকার করলেও কয়েকটা অতি-বৃহৎ অতিহিংস্র গরিলার সামনে যেতে ভয় পেত পিগমিরা, তাদের বর্শা আর তিরধনুক নিয়ে ওইসব অরণ্যচারী দানবের মোকাবেলা করা অসম্ভব। কিটাম্বোর মতোই ভয়ানক আর একটি পুরুষ-গরিলা পিগমিদের এলাকার মধ্যে বাস করত। কিটাম্বোকে নিয়ে পিগমিরা বিশেষ মাথা ঘামাত না, কিন্তু মোয়ামি ন্‌গাগি নামক অপর গরিলাটি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যথেষ্ট। মোয়ামি ন্‌গাগিকে পারলে নিশ্চয়ই হত্যা করত কাসিউলা, সেই চেষ্টাও যে হয়নি তা নয়–তবে পূর্বতন অভিজ্ঞতার ফলে কাসিউলা জেনেছিল ওই ভয়ংকর দানবের সামনে গেলে পিগমিদের মৃত্যু অবধারিত, তাই অনর্থক দলের লোকের প্রাণ বিপন্ন না-করে অন্য উপায়ে তাকে বধ করতে চেয়েছিল পিগমি-সর্দার সুলতানি কাসিউলা।

মোয়ামি ন্‌গাগি নামের ভয়ংকর গরিলাটি সম্পর্কে সব কথা খুলে বলেছিল কাসিউলা আত্তিলিওর কাছে। নিজেদের জীবন বিপন্ন না-করে জন্তুটাকে হত্যা করার অন্য উপায় থাকলে সে তাই করবে এ-কথাও বলেছিল কাসিউলা–কিন্তু সেই অন্য উপায় যে কী হতে পারে সে-বিষয়ে সে কোনো আলোচনা করেনি এবং আত্তিলিও সাহেবও ওই ব্যাপারে পিগমি-সর্দারের নীরবতা নিয়ে মাথা ঘামাননি। মাথা ঘামালে ভালো করতেন, অন্তত কয়েকটা ভয়ংকর মুহূর্তের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। পরে যখন কাসিউলার পরিকল্পনা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তখন আর বিপদকে এড়িয়ে যাওয়ার সময় ছিল না তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত! অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাইফেল হাতে সেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়েছিলেন আত্তিলিও নিতান্তই আত্মরক্ষার জন্য।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – গরিলারাজ মোয়ামি ন্‌গাগি

পিগমিদের ভাষায় মোয়ামি ন্‌গাগি কথাটার অর্থ হচ্ছে গরিলার রাজা। পিগমিদের এলাকার গরিলাদের মধ্যে পূর্বোক্ত গরিলাটি ছিল সবচেয়ে বড়ে, সবচেয়ে ভয়ংকর। গরিলারা খুব শান্তশিষ্ট নয়, কিন্তু গরিলারাজ মোয়ামি ন্‌গাগির মতো হিংস্র ও উগ্র চরিত্র গরিলাদের মধ্যেও দেখা যায় না।

পিগমি-দলপতি কাসিউলা ওই গরিলাটিকে ঘৃণা করত। ঘৃণাটা অহেতুক নয়। কয়েক বছর আগে কাসিউলার দলভুক্ত ছয়টি পিগমি-শিকারির সঙ্গে তার ছেলেরাও গিয়েছিল খাবারের জন্য সাদা পিঁপড়ে ধরতে। হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে গরিলারাজ মোয়ামি গ্লাগি পিগমিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাসিউলার এক ছেলে এবং তার এক সঙ্গী গরিলার ভয়ংকর আলিঙ্গনে ধরা পড়ল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের সর্বাঙ্গ হয়ে গেল চূর্ণবিচূর্ণ। দলের অন্য সবাই পালাল। দুটি মানুষকে হত্যা করেও দানব ক্ষান্ত হতে চাইল না, মৃতদেহ দুটি মাটিতে ফেলে সে পলাতক পিগমিদের তাড়া করল।

আত্মরক্ষার জন্য পিগমিরা এইবার তাদের প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করল। গরিলা তেড়ে এলে পিগমিরা পালাতে পালাতে বর্শাদণ্ড উলটো করে মাটিতে বসিয়ে দেয়–বর্শাদণ্ড এমনভাবে মাটিতে গেঁথে যায় যে, ধারালো ফলার মুখটা ঘোরানো থাকে অনুসরণকারী গরিলার দিকে এবং ওইভাবে বর্শাদণ্ড মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার সময়ে পলাতকরা এক মুহূর্তের জন্যও থামে না, তাদের গতিবেগ থাকে অব্যাহত। ফলে যে-পথ দিয়ে পিগমিরা পালাতে থাকে সেই পথের জায়গায় জায়গায় ঘন পত্রপল্লবের অন্তরাল থেকে মাটির উপর কোনাকুনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকগুলো বর্শার উদ্যত ফলা গরিলাকে অভ্যর্থনা করার জন্য! ক্ষিপ্ত গরিলা নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করে না, দারুণ ক্রোধে সাময়িকভাবে সাবধান হওয়ার কথাও সে ভুলে যায় তার ফলে পিগমিদের পিছু নিয়ে ছুটতে ছুটতে সে এসে পড়ে বল্লমে কণ্টকিত পথের উপর, আর অনিবার্যভাবেই দানবের ধাবমান বিপুল দেহের গতিবেগে একটা-না-একটা বর্শা সবেগে ঢুকে যায় তার বুকে কিংবা পেটে!

সেদিনও পূর্বোক্ত কৌশল প্রয়োগ করল পলাতক বামনের দল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ভীষণ গর্জন করে থমকে দাঁড়াল গরিলারাজ–তার বিপুল উদরদেশে গভীরভাবে বিদ্ধ হয়েছে একটি বর্শা!

পিগমিরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে আহত জন্তুটাকে লক্ষ করতে লাগল। গরিলা বর্শাটাকে পেট থেকে বাইরে আনার জন্য প্রাণপণে টানাটানি শুরু করল। সেজন্য জন্তুটার খুবই কষ্ট হচ্ছিল সন্দেহ নেই, কারণ বর্শাফলকের দুই প্রান্ত বাঁকা হুক-এর মতো তৈরি করে পিগমিরা একবার শরীরের ভিতর ঢুকলে ওই বাঁকানো ফলা দুটো আর সহজে বাইরে আসতে চায় না।

কয়েকবার টানাটানি করেও যখন গরিলা বর্শাটাকে পেট থেকে বাইরে আনতে পারল না, তখন সে ঝোঁপঝাড় ভেঙে বনের ভিতর অদৃশ্য হল। পিগমিরা ভাবল জন্তুটা জঙ্গলের মধ্যে কোথাও মরে থাকবে। কয়েক মাস পরে আহত গরিলা আবার পিগমিদের এলাকাতে দর্শন দিল। এবার সে একা নয়, এক সুবৃহৎ গরিলা-পরিবারের দলপতি হয়ে ফিরে এসেছিল মোয়ামি গাগি তার দেহ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বভাব আগের চেয়েও উগ্র, আগের চেয়েও ভয়ংকর!

কাসিউলার গল্প শুনে খুব মজা পেয়েছিলেন আত্তিলিও। পিগমিদের হাত পা নেড়ে বলার ভঙ্গিটা সত্যি উপভোগ্য। গল্প হিসাবে তাদের বক্তব্য ভালোভাবেই উপভোগ করেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু কথাগুলো তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। পরে অবশ্য তিনি জানতে পেরেছিলেন কাসিউলার কথা নিতান্ত রটনা নয়, প্রকৃত ঘটনা। তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দিয়েছিল পিগমি সর্দার কাসিউলা এবং সেই প্রমাণের ধাক্কায় আত্তিলিও সাহেবের প্রাণপাখি দেহের খাঁচা ছাড়ার উপক্রম করছিল!

ঘটনাটা এবার বলছি।

একদিন দুপুর বেলা আত্তিলিও যখন কিটাম্বোর দলের পিছু নিয়েছেন, সেই সময় হঠাৎ কাসিউলা থমকে দাঁড়াল। সে উগ্রীব হয়ে কিছু শুনল, বাতাসে কয়েকবার ঘ্রাণ গ্রহণ করল, তারপর পার্শ্ববর্তী ঝোঁপঝাড় পরীক্ষা করতে লাগল।

ব্যাপারটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। অধিকাংশ সময়েই ওইভাবে গরিলাদের গন্তব্যপথ নির্ণয় করে থাকে কাসিউলা, কাজেই আত্তিলিওর মনে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়নি। কিন্তু সে যখন ফিসফিস করে বলল, ওই যে, ওদিকে গেছে ন্‌গাগি, এবং সামনের পর্বতচূড়ার দিকে অগ্রবর্তী অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আত্তিলিওকে এগিয়ে যেতে বলল, তখনই তার সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। আত্তিলিও সাহেব দারুণ উত্তেজনায় অসতর্ক হয়ে পড়েছিলেন, তার উপর দুর্গম অরণ্যে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করার ফলে তিনি এত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, কাসিউলার আচরণের অসংগতি তার নজর এড়িয়ে গেল। তিনি যদি সতর্ক থাকতেন তবে নিশ্চয়ই জানতে চাইতেন অন্যান্যবারের মতো সামনে এগিয়ে পথপ্রদর্শক হওয়ার পরিবর্তে হঠাৎ কাসিউলা এখন নিজে পিছনে থেকে তাকে এগিয়ে যেতে বলছে কেন? আত্তিলিওর বরাত খারাপ, কাসিউলাকে কোনো প্রশ্ন না-করে তিনি বোকার মতো পায়ের ছাপগুলোকে অনুসরণ করলেন।

পাহাড়ের গা ছিল ভীষণ খাড়া। হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন আত্তিলিও।মসার রাইফেলটা যাতে লতা আর উদ্ভিদের জালে জড়িয়ে না যায় সেদিকেও তাকে লক্ষ রাখতে হয়েছিল, তাই আশেপাশে দৃষ্টি দেবার অবসর তার হয়নি। আত্তিলিও বরাবরই লক্ষ করেছেন জঙ্গলের পথে পিগমিরা ছায়ার মতো নিঃশব্দে তার সঙ্গে এগিয়ে যায়। তাই তাদের সাড়া শব্দ না-পেলেও বামনরা যে তার পিছন পিছন আসছে সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন নিঃসন্দেহ। ঝোঁপঝাড় আর লতাপাতার ব্যুহ ভেদ করে খাড়াই বেয়ে উঠছিলেন আত্তিলিও, মনে মনে ভাবছিলেন এই সময় যদি পাহাড়ের উপর থেকে কোনো গরিলা হঠাৎ তাদের উপর লাফিয়ে পড়ে তাহলে তিনি তো রাইফেল ব্যবহার করার সুযোগই পাবেন না–তলা থেকে বর্শা চালিয়ে পিগমিদের পক্ষেও ওইরকম আক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। গরিলা যদি ওইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে তার প্রকাণ্ড দেহের ভারে পিষ্ট হয়ে সকলের মৃত্যু হবে, জন্তুটাকে আর কষ্ট করে হাত পা চালাতে হবে না–

অতএব চটপট পাহাড়ের উপর সমতল ভূমিতে পা রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আত্তিলিও।

হাঁপাতে হাঁপাতে আর দুড়দাড় শব্দে ঝোঁপঝাড় ভাঙতে ভাঙতে আত্তিলিও পাহাড়ের উপর একটা ডিম্বাকৃতি সমতলভূমির উপর এসে পৌঁছালেন। ওইরকম শব্দ করে গরিলার পিছু নেওয়া নির্বোধের কাজ, কিন্তু আত্তিলিও ঘন জঙ্গলের মধ্যে পিগমিদের মতো নিঃশব্দে দ্রুত চলাফেরা করতে পারতেন না। উপরে পৌঁছে ঝোঁপঝাড়, ঘাসপাতা আর বৃক্ষশাখার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে আর রাইফেলটাকে মুক্ত করলেন আত্তিলিও, তারপর যে লায়ানা লতাটা এর মধ্যে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল সেটাকে টানাটানি করে সরিয়ে দিলেন তিনি। যাই হোক, এতক্ষণ বাদে একটা সমতল স্থানে পা রাখতে পেরে আত্তিলিও একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মৃদুস্বরে কাসিউলাকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি–আচম্বিত তার কানের পর্দা ফাটিয়ে জেগে উঠেছে তিন-তিনটি কণ্ঠের বীভৎস চিৎকার।

পরক্ষণেই সামনের ফাঁকা জায়গার বিপরীত দিকে অবস্থিত জঙ্গল ভেদ করে আবির্ভূত হল তিনটি বিপুলাকৃতি গরিলা!

এতক্ষণ পরে আত্তিলিওর বুদ্ধি খুলল–

কাসিউলা পরিচয় করিয়ে না-দিলেও মুহূর্তের মধ্যেই তিনি বুঝে ফেললেন আক্রমণকারী গরিলাদের সামনে এগিয়ে এসে যে দানবটা দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে কিটাম্বো নয়–স্বয়ং মোয়ামি

গাগি! উক্ত গরিলার মেজাজ খুব ভালো নয় বলেই শুনেছিলেন আত্তিলিও, অন্তত সেই মুহূর্তে তার খারাপ মেজাজ যে আরও খারাপ হয়েছে সে-বিষয়ে আত্তিলিওর একটুও সন্দেহ ছিল না।

আরও একটি বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলেন। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল পিগমিরা ধারেকাছেই আছে। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ নেই, সম্পূর্ণ একক অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আর তাকে লক্ষ করে ধেয়ে আসছে তিন-তিনটি মারমুখো গরিলা!

আত্তিলিও দেরি করলেন না, রাইফেল তুললেন। সবার আগে ধেয়ে আসছে গরিলারাজ মোয়ামি গ্লাগি, তার জ্বলন্ত কয়লার মতো দুই প্রদীপ্ত চক্ষু আর হাঁ করা মুখের দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি।

জন্তুটার বুক লক্ষ করে তিনি গুলি ছুড়লেন। গরিলা মাটিতে পড়ল না! সে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল! তার গতিবেগ হয়ে উঠল দ্রুত থেকে দ্রুততর–ঝড়ের বেগে সে এগিয়ে

আসতে লাগল আত্তিলিওর দিকে।

আত্তিলিও হতভম্ব! এত কাছ থেকে তিনি কি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন? গরিলা তখন তার কাছ থেকে প্রায় বিশ ফিট দূরে আছে। রাইফেলে গুলি ছিল না, চটপট গুলি ভরে আত্তিলিও আবার রাইফেলের ঘোড়া টিপলেন।

দ্বিতীয় বারের উদ্যম ব্যর্থ হল না। গরিলা থেমে গেল, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। জন্তুটা এত কাছে এসে পড়েছিল যে, তার দেহের ধাক্কায় একটা গাছের ডাল ভেঙে ছিটকে এসে লাগল আত্তিলিওর হাঁটুতে।

গরিলারাজ মোয়ামি ন্‌গাগি সেখানেই মৃত্যুবরণ করল। কিন্তু তখনও আত্তিলিওর বিপদ কাটেনি। দানবের দুই সহচারী ধেয়ে আসছে তাকে লক্ষ করে। রাইফেল তুললেন আত্তিলিও, আর সঙ্গেসঙ্গে তার মনে পড়ল কমিশনার সাহেবের সাবধানবাণী–

জেল! জরিমানা! বহিষ্করণ!

ওরে বাবা! গরিলার চাইতে কমিশনারের আইন কিছু কম বিপজ্জনক নয়! আত্তিলিও শূন্যে রাইফেল তুলে তিনবার আওয়াজ করলেন। বরাত ভালো, তাতেই কাজ হল। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে মেয়ে-গরিলা দুটো পালিয়ে গেল বনের মধ্যে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্তিলিও মাটিতে বসে পড়লেন। তার আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ছিল না। একটু দূরেই ধরাশায়ী গরিলারাজের প্রকাণ্ড মৃতদেহটা তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। আর হঠাৎ যেন জাদুমন্ত্রের গুণে জনশূন্য অরণ্য দলে দলে মানবসন্তান প্রসব করতে শুরু করল! একটু আগেই যেখানে জনমানুষের চিহ্ন ছিল না, সেখানেই কোথা থেকে কে জানে এসে দাঁড়াল একদল বেঁটে বেঁটে মানুষ। মামুটি পিগমি!

সুলতানি কাসিউলা বীর বিক্রমে এগিয়ে এসে মৃত গরিলার মস্ত বড়ো উদরের উপর পা তুলে দিল, তারপর পেটের উপর একটা শুষ্ক ক্ষতচিহ্নের দিকে আত্তিলিওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাল কয়েক বছর আগে ওই জায়গাতেই পিগমিদের বর্শা বিঁধেছিল।

যাক এতদিনে প্রতিশোধ নেওয়া হল, সগর্বে বলে উঠল কাসিউলা, মোয়ামি ন্‌গাগি মারা গেছে।

আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ তখন রাগে জ্বলছে। কাসিউলা যে কিটাম্বোর নাম করে মোয়ামি ন্‌গাগির ডেরার দিকে তাকে চালিত করেছিল সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই–পিগমিদের বর্শা, আর তিরধনুক ওই দানবের বিরুদ্ধে অচল বলে স্বয়ং আত্তিলিওকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে কাসিউলা!

খুব রেগে গেলেন আত্তিলিও, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। কাসিউলার ভুলটা যে নিতান্তই ইচ্ছাকৃত সে-কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

মাঘ-ফাল্গুন ১৩৭৯