দুর্যোধনের গদা

দুর্যোধনের গদা

কমলের পরিচয় পেয়েছিলাম অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে। পরিচয়টা অবশ্য একতরফা; যে-রাতে আমি তার প্রতিভার পরিচয় পেয়েছিলাম, সেই রাতে আমি ছিলাম তার সম্পূর্ণ অপরিচিত, এমনকী সে আমায় তখন দেখতেও পায়নি।

ব্যাপারটা খুলেই বলছি।

যে-সময়ের কথা বলছি, তখন কলকাতার বিভিন্ন স্থানে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতি উপলক্ষে প্রায়ই যাত্রাগানের আসর বসত এবং কোথাও যাত্রার আসর বসার খবর পেলেই আমি যথাস্থানে হাজির হতাম প্রবল উৎসাহের সঙ্গে। এইরকম এক যাত্রার আসরেই কমলের দেখা পেয়েছিলাম।

প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর আগেকার ঘটনা। দক্ষিণ কলকাতার এক যাত্রার আসরে গিয়ে দেখি প্রচুর দর্শকের সমাগমে আসর বেশ জমজমাট। আমার একটু দেরি হয়েছিল, গিয়ে দেখি যাত্রা শুরু হয়েছে। বহুদিন আগেকার কথা, পালার নামটা ঠিক মনে নেই, তবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ বা দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ ধরনের কোনো ব্যাপার হবে।

আগেই বলেছি আমার যথাস্থানে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়েছিল, গিয়ে দেখি যাত্রা শুরু হয়ে গেছে–কুরুরাজ দুর্যোধন গদা হাতে এক ভয়ংকর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন। আশেপাশে তার। স্বপক্ষের এবং বিপক্ষের রথী-মহারথীরা সকলেই উপস্থিত, আচম্বিতে রঙ্গমঞ্চ কম্পিত করে গদাহস্তে ভীমের প্রবেশ!

উক্ত গদার আকৃতি ভীমসেনের চাইতেও বেশি দ্রষ্টব্য ছিল, তাই লক্ষ্যবস্তুর চাইতেও উপলক্ষ্য, লোকের বিশেষ করে ছেলে-ছোকরাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

ভীমসেন আসরে প্রবেশ করেই সগর্জনে এক বক্তৃতা দিলেন। দুর্যোধনের চাইতে তার বক্তৃতা আরও জোরালো হয়েছিল। ভাষাটা ভালো মনে নেই, তবে গম্ভীর গর্জিত কণ্ঠের পামর, নরাধম প্রভৃতি চোখা চোখা বিশেষণগুলি কিছু কিছু মনে পড়ছে–

তারপরই এক অভাবিত ঘটনা!

ভীমসেন গদা আস্ফালন করে এদিক-ওদিক পদচালনা করছেন, সঙ্গেসঙ্গে যাত্রার আসর কাঁপয়ে উচ্চারিত হচ্ছে ভীমকণ্ঠের বাণী।

অকস্মাৎ এক দারুণ চিৎকারে ভীমসেনকে এবং সমগ্র আসরকে চমকে দিয়ে দুর্যোধন এক প্রচণ্ড লাফ মারলেন। মানুষ যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এত উঁচু লাফ মারতে পারে তা জানতাম না! তবে যে সে মানুষ তো নয়, স্বয়ং দুর্যোধন দ্বাপর যুগে মহাভারতের মহাকায় মানুষদের চমকে দিয়েছিলেন, তারই এক প্রতিনিধি কলিযুগের কলিকাতায় মানবদেহের কয়েকটি তুচ্ছ নমুনাকে চমকে দেবেন তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

কিন্তু লম্ফ প্রদান করে ভূতলে অবতীর্ণ হয়ে তিনি যা করলেন তাতে স্বয়ং দুর্যোধনও বোধ হয় কিঞ্চিৎ ভড়কে যেতেন। মহাভারতের দুর্যোধন অস্ত্রচালনা ও বাগযুদ্ধে বিশেষ পটু ছিলেন বটে, কিন্তু নৃত্যকলায় তার পারদর্শিতার কথা বেদব্যাস কোথাও উল্লেখ করেননি কিন্তু যাত্রার দুর্যোধন আচম্বিতে এক পা শূন্যে তুলে এমন এক অদ্ভুত নৃত্য শুরু করে দিলেন যে, পেশাদার নর্তকীও সেই দৃশ্য দেখলে কুরুরাজের ভারসাম্য রক্ষার প্রশংসা না-করে থাকতে পারত না।

এই অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় দৃশ্যে আমরা সকলেই ভড়কে গিয়েছিলাম, এমনকী স্বয়ং ভীমসেনও হয়ে পড়েছিলেন স্তম্ভিত!

হঠাৎ নাচ থামিয়ে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ভীমের দিকে কটাক্ষ করলেন, ইস্টুপিড! পাষণ্ড! বর্বর! নরাধম! তোকে যা বারণ করেছিলাম তাই করলি? তবে এই দেখ

সঙ্গেসঙ্গে দুর্যোধনের হাতের গদা ছুটে এল ভীমের মস্তক লক্ষ করে!

এমন অতর্কিতে আক্রান্ত হলে অনেক বীরপুরুষই ধরাশায়ী হত, কিন্তু দুর্যোধনের প্রতিপক্ষও নিতান্ত সাধারণ মানুষ নন–স্বয়ং ভীমসেন।

বিদ্যুদবেগে মাথা সরিয়ে আত্মরক্ষা করে ভীম তাঁর গদা চালালেন দুর্যোধনের দিকে এবং আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে নিজের গদা দিয়ে সেই গদাকে প্রতিহত করে দুর্যোধন করলেন প্রতি-আক্রমণ!

ঠক, ঠক, ঠকাস, ঠাই প্রভৃতি ভীষণ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল যাত্রার আসর। এতক্ষণ বাদে দর্শকরাও আত্মস্থ হয়ে তাঁদের নিজস্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, অর্থাৎ ঘন ঘন হাততালি ও প্রশংসাসূচক ধ্বনিতে দুই যোদ্ধাকেই উৎসাহ দিতে শুরু করেছেন। আসরের অন্যান্য অভিনেতারা। কিন্তু ভীম ও দুর্যোধনের দ্বন্দ্বযুদ্ধে বিশেষ উৎসাহিত হতে পারেননি, বরং তারা লড়াই থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দুই মহাবীরের ঘূর্ণিত গদার ঘন ঘন আস্ফালন তুচ্ছ করে কেউ এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ একজন (খুব সম্ভব শ্রীকৃষ্ণ, ঠিক মনে নেই) এগিয়ে এসে দুর্যোধনকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন এবং তৎক্ষণাৎ কুরুরাজের গদাঘাতে ঠিকরে ধরাশয্যা অবলম্বন করলেন।

নারায়ণের সাক্ষাৎ অবতার শ্রীকৃষ্ণকে ধরাশায়ী করে দুর্যোধন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, পরক্ষণেই তার হাতের গদা প্রচণ্ড বেগে এসে পড়ল ভীমসেনের দক্ষিণ ঊরুদেশের উপর বাপরে, বলে ভীম বসে পড়লেন দুই হাতে উরু চেপে ধরে!

ঘন ঘন হাততালিতে যাত্রার আসর সরগরম! যদিও মূল মহাভারতে কোথাও দুর্যোধনের গদাঘাতে শ্রীকৃষ্ণের পতন বা ভীমসেনের ঊরুভঙ্গ প্রভৃতি বিপর্যয়ের কথা লেখা নেই, কিন্তু সমবেত দর্শকমণ্ডলী মহাভারতের এই নতুন পালা উপভোগ করছিল অতিশয় উৎসাহের সঙ্গে। দুর্যোধন তখনও আস্ফালন করছিলেন, হতভাগা, পাজি, ইস্টুপিড! তোকে এক-শোবার সাবধান করে দিয়েছি, তবু কথা শুনলি না? এখন বোঝ ঠেলা–কেমন লাগে?

হঠাৎ কুরুপক্ষের এক যোদ্ধা বিশ্বাসঘাতকতা করল। বিকর্ণের ভূমিকায় যে লোকটি অভিনয় করছিল সে হঠাৎ দুর্যোধনের কোমর জড়িয়ে ধরল এবং সচকিত দুর্যোধন নিজেকে মুক্ত করে নেওয়ার আগেই নিতান্ত কাপুরুষের মতো পাণ্ডবপক্ষের চার মহাবীর অর্থাৎ যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দুর্যোধনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে কাবু করে গদাটি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল! ভীমসেন অবশ্য এই অসম যুদ্ধে যোগদান করেননি; তার কারণ অবশ্য নীতিবোধ নয়, তিনি তখনও ঊরু চেপে ধরে কাতরোক্তি করছিলেন, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার ছিল না!

সহোদর ভ্রাতার বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিপক্ষের যোদ্ধাদের কাপুরুষের মতো হীন ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ হয়ে দুর্যোধন যেসব বাক্যবাণ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন সেগুলো কুরু অথবা পাণ্ডবপক্ষের কোনো মানুষের পক্ষেই আদৌ সম্মানজনক নয়! দর্শকরা কিন্তু ততক্ষণে দুর্যোধনের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে গেছে, ঘন ঘন হাততালি দিয়ে তারা কুরুরাজের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও আনুগত্য প্রকাশ করছে বারংবার!

এইবার আসরে প্রবেশ করলেন যাত্রাদলের অধিকারী, দুর্যোধনের মুখের ওপর তর্জনী আস্ফালন করে তিনি বললেন, ওরে রাসকেল! তুই কোন আক্কেলে ভীমকে গদার বাড়ি মারলি? গদাযুদ্ধ তো এখন হওয়ার কথা নয়, গদাযুদ্ধ হবে শেষ দৃশ্যে–সব ভুলে গেলি? তা ছাড়া দুর্যোধনের গদাঘাতে ভীমের ঊরুভঙ্গ কে কবে শুনেছে রে ছুঁচো?

দুর্যোধন বললেন, ও আমার পা মাড়িয়ে দিল কেন? আমি বার বার সাবধান করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম আমার পায়ে কড়া আছে; কড়াতে যেন না লাগে। হতভাগা ভোদা বক্তিমে করতে করতে আমার পায়ের কড়ার উপরই পা চাপিয়ে দিল!

অধিকারী বললেন, তাই বলে তুই মারবি? মহাভারতের কোন অধ্যায়ে দুর্যোধনের পায়ে কড়ার কথা আছে শুনি? তুই পায়ের কড়া গজাতে দিলি কেন? কড়া কেটে ফেললি না কেন? উল্লুক! বোম্বেটে! শয়তান!

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে অধিকারী দুর্যোধনের গণ্ডদেশে করলেন প্রচণ্ড চপেটাঘাত!

দুর্যোধন তখন চার পাণ্ডবের বাহুপাশে বন্দি, তবু নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন এবং তার যে গদাটি বিশ্বাসঘাতক বিকর্ণ সম্প্রতি হস্তগত করেছিল সেই গদাটির দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন সতৃষ্ণ নয়নে!

দর্শকরা তখন প্রবল উৎসাহে দুর্যোধনকে সমর্থন জানাচ্ছে। একটি অল্পবয়সি ছেলে তারস্বরে ঘোষণা করল যে, একটিবার গদা হাতে পেলে মহাবীর দুর্যোধন যে কুরুপাণ্ডবের সম্মিলিত বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দেবেন এ-বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

কিন্তু অধিকারী ও অভিনেতারা সপ্তরথীবেষ্টিত দুর্যোধনের লড়াই দেখতে রাজি ছিলেন না, দর্শকদের একান্ত অনুরোধ সত্ত্বেও কুরুরাজকে তাঁর গদা ফেরত দেওয়া হল না, যাত্রাও গেল ভেঙে।

পূর্বোক্ত ঘটনার বৎসর কেটে গেছে। আমি তখন কলকাতার এক চিত্র-পরিবেশক অর্থাৎ ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার অফিসে কাজ করি। অফিসের মালিক একদিন জানালেন যে উক্ত অফিসে তিনি একটি লোককে নিয়োগ করতে চান। লোকটি তার পরিচিত এক ভদ্রলোকের সুপারিশ নিয়ে এসেছিল, তাই ইচ্ছে না-থাকলেও লোকটিকে চাকরি দিতেই হবে। তবে কাজের অনুপযুক্ত বলে প্রমাণিত হলে কয়েক মাস পরে তাকে ছাঁটাই করে দেওয়া যেতে পারে। ওই লোকটিকে আমার সঙ্গেই দেখা করার নির্দেশ দিয়েছেন মালিক, আমি যেন তাকে কাজ বুঝিয়ে দিই।

যথা আজ্ঞা। মালিক যেদিন আমাকে সব কথা জানালেন তার পরের দিনই লোকটির আসার কথা। আমার অফিসে দশটার মধ্যে হাজিরা না-দিলেও চলে, অতএব নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়লাম বারোটার পর।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ব্রিটিশ-অধিকৃত কলকাতা শহরে এত লোক সমাগম হয়নি। দুপুর বেলা ট্রামে-বাসে বিশেষ ভিড় হত না, তাই যাত্রীদের আকর্ষণ করার জন্য ট্রাম কোম্পানি মিড ডে ফেয়ার নামক অল্প মূল্যে টিকিট দেবার একটি রীতি প্রচলিত করেছিল। দুপুর বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত ট্রামের প্রথম শ্রেণিতে ছ-পয়সার বদলে তিন পয়সা এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে চার পয়সার বদলে দু-পয়সার টিকিট কিনে যাত্রীরা ভ্রমণের অধিকার অর্জন করতে পারত।

আগেই বলেছি আমার অফিসে হাজিরা দেওয়ার সময় সম্বন্ধে বিশেষ কড়াকড়ি ছিল না, খুব কাজ না-পড়লে অধিকাংশ সময়েই অফিস যাওয়ার সময়ে আমরা মিড ডে ফেয়ার নামক প্রচলিত রীতির সুযোগ গ্রহণ করতাম।

নির্দিষ্ট দিনে বারোটার ট্রামে উঠে আমি একটি তিন পয়সার টিকিট কিনে ফেললাম। যাত্রীর সংখ্যা ছিল খুবই কম, কাজেই কনডাক্টর যখন একটি যাত্রীর সামনে গিয়ে বার বার টিকিট চাইতে লাগল তখন নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল তার দিকে।

যাত্রীটি কিন্তু কনডাক্টরের কথায় প্রথমে কর্ণপাত করলেন না। একটি খবরের কাগজ খুলে ধরে এমনভাবে তিনি মগ্ন হয়ে গেছেন যে মনে হয় কাগজের ছাপার অক্ষরের বাইরে কোনো কিছুই তিনি দেখতে বা শুনতে চান না।

খবরের কাগজের প্রতি যাত্রীটির গভীর অনুরাগ ট্রাম-কনডাক্টরের মনে বিরক্তিকর সঞ্চার করল–

ও মশাই, টিকিট নিয়ে তারপর কাগজ পড়ুন।

ভদ্রলোক খবরের কাগজ থেকে চোখ না-তুলেই বললেন, টিকিট হয়ে গেছে।

কনডাক্টর বলল, কোথায়? দেখি?

ভদ্রলোক এইবার কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পায়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন, ওই যে!

সবিস্ময়ে দেখলাম ভদ্রলোকের চটিপরা পায়ের দুই আঙুলের ফাঁকে ধরা রয়েছে একটি ট্রামের টিকিট!

কনডাক্টর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জানাল, টিকিটটা হাতে নিয়ে দেখাতে হবে।

ভদ্রলোক শান্তভাবে জানালেন, ট্রাম কোম্পানির আইন অনুসারে টিকিট কিনতে এবং কনডাক্টর দেখতে চাইলে সেই টিকিট তাকে দেখাতে তিনি বাধ্য; কিন্তু উক্ত টিকিট হাতে করে দেখাতে হবে কি পায়ে করে দেখাতে হবে সে-বিষয়ে ট্রাম কোম্পানির কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই!

কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর কনডাক্টর ভদ্রলোকের সামনে থেকে সরে গেল। ভদ্রলোকও সেই টিকিটটা পায়ের আঙুলে ধরে রেখেই আবার খবরের কাগজে মনোনিবেশ করলেন।

অফিসে যাওয়ার পথে একটা দোকানে আমার একটু কাজ ছিল। ওই দোকানে নেমে কাজটা সেরে নিলাম, তারপর অফিসে ঢুকলাম। বেশি দেরি হয়নি, দোকানের থেকে আমার অফিস মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। অফিসে গিয়ে নিজের আসন গ্রহণ করতেই বেয়ারা এসে জানাল এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, তিনি নাকি মিনিট পাঁচেক ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কার্ডের উপর লেখা নামটা পড়লাম কমল বিশ্বাস। মালিক যে লোকটিকে সাময়িকভাবে নিয়োগ করার কথা বলেছিলেন তার নামও কমল বিশ্বাস–অতএব বেয়ারাকে ডেকে ভদ্রলোককে নিয়ে আসতে বললাম।

যে-মানুষটি আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন তাঁকে দেখে চমকে উঠলাম! আরে! এই ভদ্রলোকই তো ট্রামের ভিতর একটু আগে এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন! একটু তাকিয়ে থাকতেই ভদ্রলোককে বেশ পরিচিত মনে হল, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না তাকে কোথায় দেখেছি।

ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখ করে বললেন, আমার নাম স্যার কমল বিশ্বাস। আমাকে বাবু বলেছিলেন যে–

বাধা দিয়ে বললাম, ঠিক আছে। আমার নাম মহীতোষ রায়। আমাকে স্যার বলার দরকার নেই। মালিক আপনার কথা বলে গেছেন, আসুন আপনাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি।

ভদ্রলোককে তার টেবিলে বসিয়ে আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, আচ্ছা কমলবাবু, আপনি পা দিয়ে টিকিট দেখাচ্ছিলেন কেন? হাতে করে দেখালেই পারতেন। কনডাক্টরও মানুষ, তাকে ওভাবে অপমান করা আপনার উচিত হয়নি।

কমলবাবু চমকে উঠলেন, ও! আপনি ওই ট্রামেই ছিলেন!

একটু থেমে মুখ নীচু করে তিনি বললেন, বিশ্বাস করুন, অপমান করার ইচ্ছে আমার ছিল না। হাতে নিয়ে টিকিট দেখাতে গেলেই তিন পয়সা গচ্চা দিতে হত, তাই

তার মানে?

আজ্ঞে গড়িয়াহাটা থেকে উঠেছিলাম। হঠাৎ এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে রাসবিহারীর মোড়ে নামতে হল। সেই ট্রামের টিকিটটা সঙ্গে ছিল। অন্য একটা ট্রামে উঠে ওই টিকিটটা পায়ের আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে কাগজ পড়তে শুরু করলাম। জানতাম, কনডাক্টর পায়ে হাত দিয়ে টিকিট দেখবে না, তাই

অবাক হয়ে গেলাম! লোকটা তো দারুণ ধূর্ত! আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎচমকের মতো আর একটি দৃশ্য ভেসে উঠল আমার মানসপটে এতক্ষণে মনে পড়েছে ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছি!

হেসে বললাম, চাকরি করতে এলেন কেন? যাত্রাদলে অভিনয় করতে ভালো লাগল না?

কমলবাবু সবিস্ময়ে বললেন, আপনি আমার অভিনয় দেখেছেন বুঝি?

মাথা নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ।

তারপর সেই ভীম ও দুর্যোধনের দ্বৈরথঘটিত যাত্রাগানের উল্লেখ করতেও ভুললাম না। হেঁ, হেঁ, হেঁ, কমলবাবু লজ্জিত হলেন, পায়ে একটা কড়া ছিল স্যার। ওটাতে লাগলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যেত। ভোদা–মানে, যে ভীম সেজেছিল–তাকে বার বার সাবধান করে দিয়েছিলাম, তবু হতভাগা ওই কড়ার ওপর এমনভাবে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল যে রাগে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম…

একটু থেমে, একটু চুপ করে থেকে কমলবাবু বললেন, তারপর থেকেই আমি যাত্রার দল ছেড়ে দিয়েছি।

প্রায় একটা বছর কেটে গেল। কমল বিশ্বাস কাজকর্ম ভালোই করে, ফকিও দেয় না। আমাদের মধ্যে তখন অপরিচিতের ব্যবধান ঘুচে গেছে, কমলের সাহচর্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে দস্তুরমতো লোভনীয়।

একদিন কমল হঠাৎ বলল, ওহে মহীতোষ, চলো দিনকয়েক বাইরে থেকে ঘুরে আসি।

-কোথায়?

–মধুপুর। আমার এক বন্ধুর পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়ি আছে ওখানে। বন্ধুটির নাম সুশীল, সে দিনকয়েকের জন্য হাওয়াবদল করে আসতে চায়। চলো, আমরাও ওইসঙ্গে ঘুরে আসি। বাড়িভাড়া তো লাগবে না, আর তুমি বললে মালিক ছুটি দিতে রাজি হবেন! কাজকর্ম বিশেষ নেই এখন, আর তোমার অনুরোধ মালিক ফেলতেও পারবেন না।

সত্যি কথা। আমার কাজকর্মে অফিসের মালিক আমার উপর খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। আমি ছিলাম তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র।

পনেরো দিনের ছুটি মঞ্জুর করে নিয়ে কমল এবং তস্য বন্ধু সুশীলের সঙ্গে মধুপুর চলে গেলাম। সুশীলের পুরো নাম হচ্ছে সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়। ট্রেনের মধ্যেই বেশ আলাপ জমে গেল এবং আপনি ও বাবু প্রভৃতি অধিকন্তু বিসর্জন দিয়ে আমরা বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম অতি অল্প সময়ের মধ্যেই।

মধুপুর গিয়ে নির্দিষ্ট বাড়িটা খুঁজে নিতে খুব বেগ পেতে হল না। পুরানো দোতলা বাড়ি, দেখাশুনা করে একটা মালি। সে আমাদের ঘরদোর খুলে সব ব্যবস্থা করে দিল। বাড়িটা বেশ বড়ো, পরিচর্যার অভাবে তার অবস্থা বেশ জীর্ণ। নীচের একটা ঘর পরিষ্কার করে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

স্টেশনের কাছাকাছি একটা হোটেলে আমরা সেদিন খেয়ে নিলাম। ঠিক করলাম, যে-কয়দিন আছি ওই হোটেলেই খাব, রান্নার হাঙ্গামা করব না। আমরা যে বাড়িটায় ছিলাম তার আশেপাশে সমস্ত জায়গাটার একটা বর্ণনা দেওয়া দরকার। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর আগেকার কথা, তখনকার ভৌগোলিক অবস্থার সঙ্গে বর্তমান মধুপুরের বিশেষ মিল থাকার কথা নয়। কারণ এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান মধুপুরের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এনেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

স্টেশনের নিকটবর্তী এলাকা অর্থাৎ শহর অঞ্চলে ছাড়িয়ে চলে গেছে একটা সুদীর্ঘ পথ। ওই পথের দু-পাশে দাঁড়িয়ে আছে বহু অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। বিরাট বিরাট সেই প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলির অবস্থা নিতান্তই জীর্ণ-শীর্ণ এবং সেই অতিবৃহৎ অট্টালিকাগুলির সম্মুখবর্তী উদ্যানের স্থান অধিকার করে আত্মপ্রকাশ করেছে ঘন ঝোপজঙ্গল, এমনকী কোনো কোনো বাড়ির ভিতর থেকে ইষ্টক-অবরোধ ভেদ করে মাথা তুলেছে বট ও অশ্বথ বৃক্ষ। ওই বৃহৎ অট্টালিকা-অরণ্য ছড়িয়ে রয়েছে বড়ো পথের দু-পাশে এবং তাদের মধ্যবর্তী গলিপথগুলি বিলুপ্ত হয়েছে সবুজ প্রান্তরের উপর। আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেটা ছিল একটা মাঠের উপর এবং সেখানে যেতে হলে দুটি অট্টালিকার মধ্যবর্তী একটা গলিপথ অতিক্রম করতে হত।

স্টেশনের কাছে পূর্বোক্ত হোটেলে আমরা সকালে চা ও দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিতাম। দুপুর বেলা হোটেল থেকে ফিরে এসে আমরা দাবা খেলতাম। দুপুর পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে থাকতাম বটে কিন্তু বিকাল হতেই আমি সঙ্গীদের সাহচর্য ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তাম। কমল ও সুশীল স্টেশনে গিয়ে পরিচিত মানুষের সন্ধান করত, আর আমি যেতাম ফাঁকা মাঠের দিকে মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্য গ্রহণ করতে। কলকাতা শহর থেকে এখানে এসে স্টেশনের জনাকীর্ণ স্থানে আবার কলকাতার মতোই শহরের পরিবেশ উপভোগ করতে আমার ভালো লাগত না। অতএব বিকাল হলেই আমি হয়ে পড়তাম নিঃসঙ্গ, একক।

অনেক সময় কবরখানায় বেড়াতে গেছি। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে সেই জনহীন স্থানে দাঁড়িয়ে আমি যেন এক অন্য জগতের সাড়া পেতাম। ভাষার সাহায্যে সেই অদ্ভুত অনুভূতিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করব না। সে ক্ষমতাও আমার নেই। তবে এইটুকু বলতে পারি গোরস্থানে আমি কোনোদিন ভয় পাইনি, তবে রোমাঞ্চ অনুভব করেছি বটে।

হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলাম

কিন্তু কবরখানায় নয়, কবরখানা থেকে ফেরার পথে।

তখন অন্ধকার হয়ে গেছে।

হাতে ঘড়ি ছিল না, মনে হয় রাত সাড়ে সাতটা কি আটটা হবে। শহরের বাইরে ওইসব জায়গায় একটু রাত হলেই মনে হয় গভীর রাত্রি। তবে রাত বাড়লেও আমার অস্বস্তির কারণ ছিল না, জ্যোৎস্নার কল্যাণে রাতের অন্ধকার আমার দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিতে পারেনি, চাঁদের আলোতে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম… দুটি বৃহৎ অট্টালিকার মধ্যবর্তী সরু পথ অবলম্বন করে এগিয়ে গেলাম, এখানেই সামনে পড়বে পরিচিত প্রান্তর এবং সেই প্রান্তর পথ অতিক্রম করলেই বাড়ি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর হোটেলের দিকে যাত্রা করব উদরের ক্ষুধা শান্ত করার জন্য।

হঠাৎ চমকে থেমে গেলাম—

কোথায় এসেছি? ভুল হয়েছে, এ তো আমার পরিচিত পথ নয়!

বেশ কিছু দূরে মুক্ত প্রান্তরের ওপর অবস্থিত একটি জলাশয়ের অপর প্রান্তে যে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে সেটিও দ্বিতল বটে কিন্তু আমাদের পরিচিত গৃহ নয়!

একটু নজর দিয়ে দেখলাম দোতলা বাড়ি হলেও সেই বাড়ির ছাদের উপর এককোণে একটা ছোটো ঘর দেখা যাচ্ছে চিলেকোঠা।

বাড়িটি অন্ধকার, কিন্তু চিলেকোঠার একটিমাত্র জানলায় আলোর আভাস!

জ্যোৎস্না-আলোকিত উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর সেই জলাশয় এবং নীলাভ-কৃষ্ণ রাত্রির আকাশের পটভূমিতে দ্বিতল গৃহের একটিমাত্র ঘরের আলোক-উজ্জ্বল বাতায়ন আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেইদিকে এগিয়ে গেলাম নিজেরই অজ্ঞাতসারে!

আর তৎক্ষণাৎ আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এক তীব্র অনুভূতি আমাকে সাবধান করে দিল। আমি বুঝলাম ওই বাড়িতে গেলে আর ফিরে আসতে পারব না!

একেই কি বলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়?

জানি না। তবে এক অদম্য আকর্ষণে আমার পা দুটো যেন আমাকে বার বার ঠেলে দিতে। চাইছিল সেই বাড়ির দিকে। তবু জোর করে আত্মসংবরণ করলাম। কিন্তু স্থানত্যাগ করতে পারলাম না। পিছন ফিরতে গেলেই মনে হচ্ছিল আমি যেন এক পরম কামনার ধন ফেলে রেখে চলে যাচ্ছি, অদ্ভুত এক মানসিক যাতনাবোধ করছিলাম–মনে হচ্ছিল নিতান্ত প্রিয়জনকে যেন বিদায় দিচ্ছি আমার জীবন থেকে।

হঠাৎ মনে হল, এইখানে দাঁড়িয়ে না-থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে যদি বন্ধুদের নিয়ে আসি তাহলে তো নির্ভয়ে ওই বাড়িটার কাছে যেতে পারি আর তিনজন একসঙ্গে থাকলে ভয়ের কোনো কারণ থাকবে না, অতএব পিছন ফিরে যে পথে এসেছি সেই পথেই আবার পদচালনা করতে উদ্যত হলাম।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভয় পেলাম।

দারুণ আতঙ্কে আমার পা দুটি নিশ্চল হয়ে গেল!

না, কোনো ভয়ংকর দৃশ্য দেখিনি।

যে পথের উপর দিয়ে আমি মাঠে এসে পৌঁছেছিলাম, সেই পথের দু-ধারে অবস্থিত দুটি বিশাল অট্টালিকার জীর্ণ প্রাচীরের উপর দিয়ে দুই বাড়ির গাছপালা অজস্র ডালপালা হাত বাড়িয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে, তার ফলে ঘন পত্রপল্লবশোভিত বৃক্ষশাখার নীচে পথটার উপর বিরাজ করছে এমন এক ঘনীভূত অন্ধকার যে চাঁদের আলো পর্যন্ত সেই উদ্ভিদের নিবিড় আবরণ ভেদ করে পথের উপর প্রবেশ-অধিকার পায়নি।

অন্ধকার-আবৃত সেই পথ এবং মাথার ওপর ঝাকড়া গাছপালার নিবিড় সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এক দারুণ আতঙ্ক অনুভব করলাম। আমি বুঝলাম ওই পথের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, আমার অনুভূতি আমাকে বলে দিচ্ছে ওই পথের উপর অবস্থান করছে এমন এক ভয়ংকর যার অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু তাকে চোখে দেখতে পাচ্ছি না! পিছন ফিরে বাড়িটার দিকে চাইলাম। যাব নাকি? এগিয়ে যাব ওই বাড়ির দিকে? ওখানে আশ্রয় চাইব?

একটু এগিয়ে গেলাম। দারুণ আকর্ষণ বোধ করছি, মনে হচ্ছে ছুটে যাই ওই বাড়ির দিকে। কিন্তু তবু অবচেতন মনে অনুভব করলাম ওখানেই রয়েছে আমার মৃত্যু, যত মোহ যত আকর্ষণই বোধ করি না কেন, ওই বাড়ি হচ্ছে আমার মরণফাঁদ! কোনো যুক্তি নেই এমন চিন্তার, তবু বার বার মনে হতে লাগল মোহময় ওই মরণ-ভবনকে পিছনে ফেলে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে ওই পথের দিকে ভয় দেখানো ভয়ংকরকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে পারলে ওই পথই হবে আমার প্রাণরক্ষার একমাত্র উপায়।

তবু সেদিকে পা বাড়াতে পারলাম না। যতবার পা বাড়াই ততবারই দারুণ আতঙ্কে পিছিয়ে আসি। হঠাৎ ভীষণ ক্রোধে আমার চৈতন্য যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল কেন? কেন যেতে পারব না ওই পথে? কোন অমঙ্গলের অদৃশ্য ছায়া প্রাণরক্ষার একমাত্র পথ থেকে সরিয়ে আমাকে ঠেলে দিতে চায় ওই মরণ-ভবনের দিকে?

দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আমি এগিয়ে যাই গলিপথ ধরে। একটু এগিয়ে যেতেই আবার ভয় পেলাম, দারুণ ভয়!

অপার্থিব সেই আতঙ্কের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মনে হল আমার ঠিক পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে এক অশুভ জীব, যার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, কিন্তু যাকে চোখে দেখা যায় না! প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল এক দৌড়ে ওই পথটা পার হয়ে চলে যাই, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে লাগলাম। জানতাম ছুটতে গিয়ে যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই তাহলে আর আমার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকবে না এবং চলৎশক্তি রহিত হয়ে যদি ওইখানে পড়ে থাকি তাহলে যে জীবটির অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পাচ্ছি তার কবলেই যে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই.. আমি বলছি আর অনুভব করছি আমার ঠিক পিছনেই সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে অমঙ্গলের অদৃশ্য ছায়া… অবশেষে আর আত্মসংবরণ করতে না-পেরে ঘুরে দাঁড়ালাম–নাঃ! কেউ নেই!

আচম্বিতে দারুণ আতঙ্ক আমার চেতনাকে গ্রাস করল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি তিরবেগে ছুটলাম গলিপথ ধরে বড়োরাস্তার দিকে।

না, পড়ে যাইনি; কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এসে পড়লাম বড়োরাস্তার ওপর আর ঠিক সেই মুহূর্তে নারীকণ্ঠের ঐকতান সংগীত প্রবেশ করল আমার শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে।

সাঁওতাল মেয়েরা দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে বড়ো রাস্তা ধরে!

আঃ! গান যে কত মধুর সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম। জীবনে অনেক ভালো ভালো গায়কের গান শুনেছি, কিন্তু কয়েকটি অশিক্ষিত সাঁওতাল রমণীর কণ্ঠসংগীত সেই রাতে আমাকে যেমন আনন্দ দিয়েছিল তেমন আনন্দ কখনো গান শুনে পাইনি। নীরব মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে সেই সংগীত যেন জীবনের অস্তিত্ব ঘোষণা করল আমার সম্মুখে!

দুই বাড়ির মাঝখানে গাছপালার আচ্ছাদনের নীচে যে অন্ধকার-আচ্ছন্ন পথটা পার হয়ে এলাম সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে আবার সেই অশুভ ও অদৃশ্য অমঙ্গলের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। ওইসঙ্গে আমার অনুভূতিতে ধরা পড়ল আর এক সত্য :

অদৃশ্য অমঙ্গলের কায়াহীন আত্মা এই বড়োরাস্তার উপর আসতে পারে না, ওই গলিপথই হচ্ছে তার অধিকারভুক্ত এলাকা!

পিছন ফিরে সবেগে পা চালিয়ে দিলাম নিজের আস্তানার দিকে। এবার আর ভুল হল না। বাড়ি এসে দেখলাম কমল ও সুশীল দাবা খেলছে। সব কথা খুলে বলে আমি তাদের আমার সঙ্গে ওই বাড়িতে যেতে অনুরোধ করলাম। ভেবেছিলাম অ্যাডভেঞ্চার-এর আশায় দুজনেই আমার সঙ্গে ওই বাড়ির দিকে যেতে রাজি হবে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তারা কেউ সেই, বাড়ির দিকে পা বাড়াতে রাজি নয়!

দুজনেরই অভিমত হচ্ছে, বিদেশে বেড়াতে এসে ভূতের কবলে পড়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি জানালাম ওখানে কোনো ভূত আমার দৃষ্টিগোচর হয় নি এবং আমার সম্মুখে উপবিষ্ট দুই মূর্তিমান অদ্ভুতের চাইতে বড় কোনো ভূত সেখানে থাকতে পারে বলে মনে হয় না। ওরা কোনো কথা বলল না, চুপ করে দাবা খেলতে লাগল। আমি তখন ভীরু, কাপুরুষ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করে দুই বন্ধুর আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করলাম। আশা ছিল, সুশীল রাজি না হলেও কুরুরাজ দুর্যোধনের আধুনিক প্রতিনিধির স্থান যে-মানুষটি অধিকার করেছিল অন্তত সেই কমল বিশ্বাস আমার ধিক্কার শুনে অপমান বোধ করে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হবে। কিন্তু আশা সফল হল না, আমার দুর্বাক্যগুলি দুর্যোধনের একদা-প্রতিনিধি অবলীলাক্রমে হজম করলেন এবং দাবার চাল দিতে দিতে আমাকে লক্ষ করে যেসব উপদেশ বর্ষণ করলেন তার সারমর্ম হচ্ছে : কোনো বুদ্ধিমান মানুষই বিদেশে বেড়াতে এসে ভূতের সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ প্রকাশ করে না, অতএব আমার মতো নির্বোধের দুর্বাক্যে বিচলিত হয়ে সংকল্প ত্যাগ করার পাত্র যে কমল বিশ্বাস নন এই পরম সত্যটি উদঘাটন করে উক্ত নামধারী মানুষটি আবার দাবার চালে মনোনিবেশ করলেন।

আমি খুবই হতাশ হলাম। কিন্তু একা ওখানে যাওয়ার আমার সাহস ছিল না, তাই সেরাতে কৌতূহল দমন করে সুবোধ বালকের মতোই নৈশভোজন শেষ করে শয্যার বুকে আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

পরের দিন খুব সকাল উঠে সেই বাড়িটার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোথাও সেই বাড়ি অথবা পূর্বদৃষ্ট জলাশয়টির অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলাম না।

এই ঘটনার পর আরও সাত দিন আমরা মধুপুরে ছিলাম। ওই সাত দিনের মধ্যে প্রত্যেক দিনই আমি অনুসন্ধান করেছি, কিন্তু ওই বাড়ি আর জলাশয় আমার দৃষ্টিপথে একদিনও ধরা দিল না! খুবই আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নেই।

এলাকাটা ছিল খুব ছোটো, আর অট্টালিকাগুলির মধ্যবর্তী পথগুলি কিছু অগুনতি নয়, কিন্তু সবগুলি গলিপথ ও পথের শেষে অবস্থিত প্রান্তরগুলির উপর তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়েও আমি ঈপ্সিত বস্তুর দর্শন পেলাম না।

যাদের কাছে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি তাদের মধ্যে অনেকেই বলে ওটা হচ্ছে ইলিউশন বা চোখের ভুল। আমার ধারণা অন্যরকম। আমার বিশ্বাস ওই বাড়ি আর জলাশয় দিনের আলোতে আমি খুঁজে পাইনি বটে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে যদি অনুসন্ধান করতাম, তাহলে নিশ্চয়ই ওই বাড়ির সাক্ষাৎ লাভ করতাম। নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাত্রিকালে ওই বাড়ির খোঁজ করার সাহস আমার হয়নি, তাই রহস্য আমার কাছে রহস্যই রয়ে গেল।

ইলিউশন বা চোখের ভুল প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আমার মনঃপূত নয়। আমি নেশাগ্রস্ত হইনি, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে সুস্থ দেহে চাঁদের আলোতে অন্তত দশ মিনিট ধরে মরীচিকা দেখার মতো অসুস্থ মন বা চোখ আমার তখনও ছিল না, এখনও নেই।

[১৩৮৭]