জনতার প্রতিনিধি

জনতার প্রতিনিধি

একদল হিংস্র নেকড়ের গুহার ভিতর যদি একটা বিড়াল বাচ্চা পথ ভুলে ঢুকে পড়ে তাহলে তার চালচলনটা কেমন হবে?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না-থাকলেও অনুমান করা যায় যে মার্জার শাবক যে মুহূর্তে নেকড়েগুলোর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে সেই মুহূর্তে তার দেহের লোম খাড়া হয়ে উঠবে কাটার মতো এবং দুই চোখের ভীত বিস্ফারিত দৃষ্টি সঞ্চালন করে সে যে চটপট চম্পট দেওয়ার সোজা রাস্তাটা খোঁজার চেষ্টা করবে, এ-বিষয়ে ভুল নেই।

স্নেক ডলস সেলুন নামক পানশালার মেঝের ওপর দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে যে কিশোরটি দোকানির কাছে এক গেলাস ঠান্ডা পানীয় চাইল, তার নির্বিকার মুখ এবং স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গি দেখে মনে হয় না যে এই মুহূর্তে স্থানত্যাগ করার ইচ্ছা তার আছে–

যদিও তার সর্বাঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পানাগারের মধ্যস্থলে দৃষ্টিপাত করলেই নেকড়েবেষ্টিত মার্জার শাবকের কথা মনে পড়বে…

হ্যাঁ, নেকড়ে বই কী

কিংবা নেকড়ের চাইতেও ভয়ংকর মানুষগুলো আড্ডা জমিয়েছে পানাগারের মধ্যে।

পানশালার টেবিলের চারধারে টেবিলে টেবিলে গোল হয়ে বসে যে লোকগুলো তাস খেলছে অথবা পানভোজন করছে তাদের চোখে-মুখে মনুষ্যত্বের চিহ্ন নেই কিছুমাত্র–কঠিন চোয়ালের রেখায় রেখায় জ্বলন্ত চোখের তির্যক চাহনিতে যে বন্য হিংসার ছায়া উঁকি দিচ্ছে সেদিকে তাকালে ক্ষুধার্ত নেকড়ের কথা মনে হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

এতগুলো সাংঘাতিক মানুষের মাঝখানে একটি নিরীহ চেহারার কিশোরকে দেখলে নেকড়েবেষ্টিত মাজার শাবকের কথাই মনে আসে।

স্নেক ডলস সেলুনের মানুষগুলো সেদিন তাই ভেবেছিল, বিড়ালছানার মতো তুচ্ছ করেছিল তারা ওই ছেলেটিকে। একটু পরেই তাদের ভুল ভাঙল ভয়ংকরভাবে–তপ্ত রক্তধারায় হল তাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত।

তাই হয়।

রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু সর্পতে রজ্জ্বভ্রম করলে তার ফল হয় মারাত্মক।

সেই মারাত্মক ভুলের সূচনা জানিয়ে ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল এক বিদ্রূপ জড়িত কণ্ঠস্বর, এই ছোঁড়াটা নিশ্চয়ই এখনও মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খায়। হা! হা! হা! এই দুধের বাচ্চা হল আমেরিকা যুক্তরাজ্যের ডেপুটি মার্শাল! হো! হো! হো!

খোঁচাখাওয়া সাপ যেমন দ্রুতবেগে আততায়ীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি বিদ্যুৎচকিত সঞ্চালনে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর ছেলেটি চেয়ারে উপবিষ্ট লোকগুলির দিকে। সকলে দেখল তার বাঁ-হাতটা সামনের টেবিলের ওপর চেপে বসেছে আর ডান হাতের সরু সরু আঙুলগুলো বাজপাখির ছোঁ মারার ভঙ্গিতে নেমে এসেছে কোমরের খাপে ঢাকা রিভলভারের খুব কাছাকাছি।

হ্যাঁ, আমি যুক্তরাজ্যের ডেপুটি মার্শাল, কিশোরকণ্ঠে শোনা গেল দর্পিত ঘোষণা, আমার নাম ড্যান ম্যাপল। কারো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? কোনো প্রশ্ন?

না, কারো কিছু জানার নেই।

কেউ কোনো প্রশ্ন করলে না।

যে লোকটি বিদ্রূপ করেছিল সে হাতের গেলাসটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল খুব মন দিয়ে… আশেপাশে অন্য লোকগুলিও হঠাৎ মৌনব্রত অবলম্বন করলে। একটু আগেও যেখানে হইহই হট্টগোলে কান পাতা যাচ্ছিল না, এখন সেখানে ছুঁচ পড়লে শব্দ শোনা যায়…

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত

পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে চেয়ারের উপর যে লোকগুলো বসেছিল তারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল, অভ্যস্ত হাতগুলো ধীরে ধীরে নেমে এল কোমরের খাপে ঢাকা রিভলভারের দিকে।

ড্যান ম্যাপল ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।

সে হেসে উঠল, আমার সঙ্গে রিভলভারের খেলা খেলতে পারে এমন কোনো খেলোয়াড় এখানে নেই। আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি তোমরা যদি আরও কিছুদিন দুনিয়ার আলো দেখতে চাও, তবে তোমাদের হাতগুলো রিভলভারের বাঁট থেকে একটু দূরে দূরে রাখো।

ড্যান ম্যাপলের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার স্পর্শ ছিল না, খুব সহজ আর স্বাভাবিক ছিল তার গলার আওয়াজ। কিন্তু তার চোখ দুটি থেকে হারিয়ে গেল কৈশোরের প্রাণচঞ্চল আলোর দীপ্তি–সর্পিল আক্রোশে চোখের তারায় নেমে এল বিষাক্ত হিংসার ছায়া।

স্নেক ডলস সেলুনের খুনি মানুষগুলো ওই চোখের ভাষা বুঝল খুব সহজেই, তাদের হাতগুলো রিভলভারের বিপজ্জনক সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে গেল।

কোলাহলমুখর পানশালার মধ্যে নেমে এল মৃত্যুপুরীর নীরবতা।

 ড্যান ম্যাপলের আবির্ভাব অতিশয় নাটকীয় বটে কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। আমেরিকা যুক্তরাজ্যের তাহলাকুই নামে যে ছোটো শহরটা পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানকার প্রতিটি বাসিন্দাই খবরটা পেয়েছিল–

খুব শীঘ্রই নাকি ওই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একজন ডেপুটি মার্শাল আসবে।

শহরের বাসিন্দারা খবরটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। না-দেওয়াই স্বাভাবিক। আজকের আমেরিকার কথা নয়–১৮৯২ সালে ওইসব অঞ্চলে আইন-টাইন কেউ বড়ো একটা মানত না। বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত ছোটো ছোটো জায়গায় থানা পুলিশের বিরাট ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল গভর্নমেন্টের পক্ষে, তাই শহরের শৃঙ্খলা রক্ষার ভার থাকত টাউন মার্শালদের ওপর। দুর্ধর্ষ গুন্ডারা যে মার্শালদের খুব ভয় করত তা নয়, তবে পারতপক্ষে মার্শালদের সঙ্গে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চাইত না।

তাহলাকুই শহর কিন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচজন মার্শালকে ওই শহরের গুন্ডারা গুলি করে মেরে ফেলল। শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন জানালেন, একজন ডেপুটি মার্শালকে যেন অবিলম্বে তাহলাকুই শহরে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক এখানে বাস করতে পারছেন না।

আবেদন গৃহীত হল। তাহলাকুই শহরে আবির্ভূত হল ডেপুটি মার্শাল ড্যান ম্যাপল।

শহরের পানাগার স্নেক ডলস সেলুন-এর ভয়াবহ খ্যাতি ম্যাপলের কানেও পৌঁছেছিল। সে জানত রাত্রিবেলা ওই পানাগারের মধ্যে ঢুকলে সে স্থানীয় গুন্ডাশ্রেণির মানুষগুলোকে দেখতে পাবে, অতএব অকুস্থলে হল ড্যান ম্যাপলের আবির্ভাব।

পরবর্তী ঘটনার কথা তো কাহিনির শুরুতেই বলছি। শুধু দেখতে নয়, কিছু দেখাতেও এসেছিল ম্যাপল। সমবেত গুন্ডাদের উদ্দেশ করে সে যখন সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে তখন কেউ সামনে এসে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাল না।

না, চ্যালেঞ্জ নয় কিশোর ড্যান ম্যাপলের চোখের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস ছিল না কারো কিন্তু গুন্ডাদের চোখে চোখে ক্রুর ইঙ্গিতে নির্ধারিত হয়ে গেল নূতন ডেপুটি মার্শালের নিয়তি।

একটি দীর্ঘাকার কুৎসিত মানুষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নাম তার নেড ক্রিস্টি।

সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তার সহকারী–আর্চি উলফ।

নেড আর আর্চি ওই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ গুন্ডা। নরহত্যায় তাদের দ্বিধা ছিল না কিছুমাত্র। কত লোক যে তাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে তারা নিজেরাও বোধ হয় তার সঠিক হিসাব দিতে পারত না। এই দুই মানিকজোড় এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

পরবর্তী ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকেই শোনা যাক। ১৮৯২ সালে নভেম্বর মাসের তৃতীয় দিবসে ড্যান ম্যাপল নামে যে কিশোরটি স্নেক ডলস সেলুনে পদার্পণ করেছিল তার কীর্তিকলাপ স্বচক্ষে দেখেছিল এক বালক ভৃত্য নাম তার মাইক ম্যাকফিবেন।

কাহিনির পরবর্তী অংশ মাইকের লিখিত বিবরণী থেকে তুলে দিচ্ছি।

পানাগারের পিছন দিকে দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করলে আর্চি আর নির্বিকারভাবে ড্যান ম্যাপলের সামনে এগিয়ে এল নেড। আমি তখনই বুঝলাম ব্যাপারটা কী ঘটতে যাচ্ছে। সেলুন-রেস্তরাঁয় পিস্তলবাজ গুন্ডারা যখন কোনো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করতে চায় তখন তারা ফঁদ পাতে। ফাঁদের নিয়মটা হচ্ছে, দুজনের মধ্যে একজন সামনে এগিয়ে এসে শিকারকে অন্যমনস্ক করে রাখে এবং সেই সুযোগে পিছন থেকে আর একজন তাকে গুলি করে।

আমি বুঝলাম আর্চি দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে। সুযোগ পেলেই সে গুলি চালাবে। আমার বুক কাঁপতে লাগল। খুব সহজভাবে ম্যাপলকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল নেড, তারপর হঠাৎ একটা টেবিলের ওপর হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল ম্যাপলের দিকে, ওঃ! তুমিই তাহলে নতুন ডেপুটি মার্শাল? রাজ্য সরকার তোমাকেই পাঠিয়েছে?

আমি রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। এখনই পিছনের দরজার কাছে দণ্ডায়মান আর্চির রিভলভার থেকে গুলি ছুটে এসে ম্যাপলকে শুইয়ে দেবে মেঝের ওপর। শুধু আমি নই, অভিজ্ঞ মানুষগুলো সবাই বুঝেছিল ব্যাপারটা, সকলেরই মুখে-চোখে ফুটে উঠেছিল হিংস্র প্রত্যাশা উদগ্র আগ্রহে সকলেই কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল একটা রিভলভারের গর্জন শোনার জন্য…

হ্যাঁ, গর্জে উঠেছিল রিভলভার। কিন্তু সেটা আর্চির অস্ত্র নয়। আমরা দেখলুম দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে আর্চি উলফ, তার হাতের মুঠো থেকে ছিটকে পড়েছে রিভলভার। কখন যে ম্যাপল ডান হাতের দ্রুত সঞ্চালনে কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে আর্চিকে গুলি করেছে আমরা বুঝতেই পারিনি।

আমরা শুধু শুনলাম রিভলভারের গর্জন এবং আহত আর্চির আর্তনাদ, আমরা শুধু দেখলাম ম্যাপলের ডান হাতের রিভলভারের নল থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া আর তার বাঁ-হাতের রিভলভার উদ্যত হয়েছে নেভ ক্রিস্টির দিকে।

কোণঠাসা নেকড়ের মতো হিংস্র দন্তবিকাশ করে পিছিয়ে গেল নেড। সে কোমরে ঝুলানো রিভলভারে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে না–চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল।

এইবার রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হল ওয়াইল্ড হ্যারি। ওই অঞ্চলের আর একটি কুখ্যাত পিস্তলবাজ গুন্ডা সে। কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে হ্যারি গুলি করার উপক্রম করলে, সঙ্গেসঙ্গে ক্ষিপ্রহস্তে গুলি চালিয়ে ম্যাপল তাকে মেঝের ওপর পেড়ে ফেলল।

তারপর ঠিক কী হয়েছিল জানি না। ওই রক্তাক্ত নাটকের মধ্যবর্তী অংশে কে কেমন অভিনয় করেছিল বলতে পারব না। কারণ, হ্যারি লুটিয়ে পড়তেই অনেকগুলো রিভলভার একসঙ্গে গর্জে উঠল এবং আমি ঝাঁপ খেলাম একটা টেবিলের নীচে। সেখান থেকে শুয়ে শুয়ে আমি শুনতে পেলাম সগর্জনে ধমকে উঠেছে অনেকগুলো রিভলভার।

প্রায় মিনিট দুই ধরে শুনলাম রিভলভারের গর্জন। তারপর হঠাৎ থেমে গেল সেই শব্দের তরঙ্গ–সব চুপচাপ। খুব সাবধানে টেবিলের তলা থেকে মাথা তুলে দেখলাম স্নেক ডলস সেলুনের মালিক ড্যান ম্যাপলের হাতে তুলে দিচ্ছে একটি পূর্ণ পানপাত্র।

পানশালা শূন্য! গুন্ডার দল সরে পড়েছে!

দোকানের মালিক আর একটা গেলাসে মদ ঢালল, এটাও টেনে নাও। এই গেলাসের দাম দিতে হবে না।

মালিকের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যাপল বললে, হঠাৎ এই অনুগ্রহের কারণ কী?

মালিক বললে, অনুগ্রহ নয়। আমি আইরিশ–আয়ারল্যান্ডের লোক মনে করে মৃত্যুপথযাত্রীকে পানীয় পরিবেশন করলে পুণ্য হয়।

তার মানে? আমি কি মরতে বসেছি নাকি?

–নিশ্চয়। তুমি পাকা খেলোয়াড় তোমার মতো দক্ষ পিস্তলবাজ মানুষ আমি দেখিনি। কিন্তু তোমার আয়ু ফুরিয়েছে। দু-মিনিট কিংবা খুব বেশি হলে মিনিট কুড়ি তুমি বেঁচে থাকতে পারো।

বটে? এক চুমুকে গেলাসের তরল পদার্থ গলায় ঢেলে শূন্য পানপাত্র টেবিলের ওপর রাখল ম্যাপল, আচ্ছা, আজ চলি।

দরজাটা লাথি মেরে খুলে ফেলল ম্যাপল, খাপে ঢাকা রিভলভার দুটির বাঁটের ওপর নেমে এল তার দুই হাত তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে খোলা দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে গেল… শহরের অন্ধকার পথের ওপর মিলিয়ে গেল তার দীর্ঘ দেহ।

মাইকের লিখিত বিবরণীতে আরও অনেক কিছু আছে। সব ঘটনা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করার জায়গা এখানে নেই। খুব অল্প কথায় পরবর্তী ঘটনার বিবৃতি দিচ্ছি।

স্নেক ডলস সেলুনের মালিক যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তা সফল হয়েছিল বর্ণে বর্ণে। ড্যান ম্যাপল পানশালা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চল্লিশ মিনিটের মধ্যে অজ্ঞাত আততায়ী তাকে আড়াল থেকে রাইফেল ছুঁড়ে হত্যা করেছিল।

ম্যাপলের হত্যাকাহিনি শুনে খেপে গেল তাহলাকুই শহরের সমস্ত মানুষ। এতদিন যারা গুন্ডাদের ভয়ে থরথর করে কাঁপত, তারাই আজ রুখে দাঁড়াল গুন্ডারাজ উচ্ছেদ করার জন্য। দলে দলে শান্তিপ্রিয় মানুষ ছুটে এল শহরের পথে।

হাতে তাদের বিভিন্ন অস্ত্র রাইফেল! পিস্তল! শটগান!

 হত্যাকাণ্ডের পরদিনই আমেরিকা যুক্তরাজ্যের একজন ডেপুটি মার্শাল অকুস্থলে এসে পড়ল, নাম তার হেক ব্রুনার। তার সঙ্গে এল দুজন যোগ্য সহকারী। হত্যাকাণ্ড যেখানে ঘটেছিল সেখানে খোঁজাখুঁজি করে তারা আবিষ্কার করলে একটা ব্যবহৃত বুলেটের খোল এবং সেই খোলটার একটু দুরেই পাওয়া গেল একটা লাকি চার্ম বা কবচ জাতীয় বস্তু। স্পষ্টই বোঝা গেল যে রাইফেল। থেকে গুলি চালিয়ে ম্যাপলকে হত্যা করা হয়েছে, ওই বুলেটের খোলটা হচ্ছে উক্ত রাইফেলে ব্যবহৃত অকেজো টোটা।

ওই ধরনের বুলেট অনেকেই ব্যবহার করে, কাজেই সেটা তাকে খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

কিন্তু কবৃচটা গোয়েন্দার কাছে মূল্যবান সূত্র।

ব্রুনার তার দুই সহকারীকে বললে, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসছি। এই কবচের মালিকটিকে যদি আবিষ্কার করতে পারি তাহলেই হত্যাকাণ্ডের সমাধান হয়ে যাবে। আমার মনে হয় খুনি আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না।

ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল হেক ব্রুনার। দু-দিন তার পাত্তা পাওয়া গেল না। আর এই দুটো দিন শহরের কোনো জায়গায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হল না। তাহলাকুই শহরের ইতিহাসে পরপর দু-দিন কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না, এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা।

শহরের আশেপাশে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে যেসব গুন্ডা নগরবাসীর ওপর হামলা করত তারা পরপর দু-দিন তাদের আস্তানায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে রইল।

ক্ষিপ্ত জনতার সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাদের ছিল না, হাওয়া ঘুরে গেছে!

দু-দিন পরেই সকাল বেলা শহরের রাজপথে ঘোড়ার পিঠে আবির্ভূত হল ব্রুনার। এক বিরাট জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়াল, খবর কী?

ব্রুনার বললে, কবচের মালিক হচ্ছে নেড ক্রিস্টি। যে বুড়ো রেড-ইন্ডিয়ান এই ধরনের কবচ তৈরি করে তাকে আমি ভালোভাবেই জানি। আমি ওই বুড়োর কাছে গিয়েছিলাম। কবচটা দেখেই সে জিনিসটা শনাক্ত করল–নেড ক্রিস্টি ওই কবচ নিয়েছিল বুড়োর কাছ থেকে। এই তল্লাটে ওই ধরনের কবচ বুড়ো ছাড়া আর কেউ তৈরি করতে পারে না, তাই ওর কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য। বুড়ো আমাকে বলেছিল যে যতগুলো কবচ সে তৈরি করেছিল সবগুলোতেই সে খোদাই করেছিল একটি একটি সাপের ছবি কিন্তু ক্রিস্টির কবচে সে এঁকে দিয়েছিল দু-দুটো সাপ। আমরা যে কবচটা কুড়িয়ে পেয়েছি তাতেও দুটি সাপের ছবি খোদাই করে আঁকা হয়েছে!

জনতার ভিতর থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন? চলো–ওই শয়তান নেড ক্রিস্টিকে ধরে তার গলায় একটা দড়ি লাগিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া যাক।

সমবেত জনমণ্ডলী বক্তার প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে গর্জে উঠল, ঠিক! ঠিক! নেড ক্রিস্টিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেব! চলো, দেখি কোথায় লুকিয়ে আছে সেই শয়তান।

ব্রুনার কঠোর স্বরে বললে, না। আইন তোমরা নিজেদের হাতে নিতে পারো না। আমরা সরকারের প্রতিনিধি, যা করা কর্তব্য আমরা তাই করব। নেড ক্রিস্টির আস্তানা কোথায় তোমরা জানো?

একাধিক কণ্ঠে উত্তর এল, জানি। র‍্যাবিট ট্র্যাপ।

 সেটা আবার কোথায়?

 মাইক নামে যে ছোকরা চাকরটি সেলুনের ভিতর ম্যাপলের কীর্তি প্রত্যক্ষ করেছিল সে এগিয়ে এসে জানাল যে র‍্যাবিট ট্র্যাপ জায়গাটা সে চেনে এবং ব্রুনার যদি অনুমতি দেয় তবে সে তার সঙ্গে গিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিতে পারে।

ছেলেটিকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পুলিশ দলের সঙ্গে ব্রুনার ছুটল র‍্যাবিট ট্র্যাপ-এর দিকে।

ঘন জঙ্গল আর কাঁটা ঝোপের ভিতর দিয়ে যথাস্থানে এসে পৌঁছে গেল ব্রুনার এবং তার দল। একটা ছোটো পাহাড়ের ওপর চারদিকে ছড়িয়ে আছে ঘন ঝোপঝাড় এবং তারই মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি কাষ্ঠনির্মিত ঘর বা কেবিন–ওই হচ্ছে নেড ক্রিস্টির আস্তানা।

ব্রুনারের দল ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। পুলিশ বাহিনীর একজন লোক আহত হয়ে ছিটকে পড়ল মাটির ওপর। অন্যান্য পুলিশরা চটপট ভূমিশয্যায় লম্বমান হয়ে আত্মরক্ষা করলে, কেউ কেউ আশ্রয় নিলে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ছোটো-বড়ো পাথরের আড়ালে।

ঘরের ভিতর থেকে দু-দুটো রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রুনারের দলের আরও দুজন লোক আহত হল। ব্রুনার বুঝল, ওই ঘরটি হচ্ছে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো শক্ত কাঠের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে নেড এবং তার সঙ্গী (খুব সম্ভব আর্চি উলফ) পুলিশদলের নিক্ষিপ্ত বুলেট থেকে সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারবে, কিন্তু ফাঁকা জায়গার ওপর দিয়ে গুন্ডাদের রাইফেলের সামনে এগিয়ে যাওয়া পুলিশদের পক্ষে অসম্ভব।

সে দলের মধ্যে দুজনকে ডেকে বললে, এখনই শহর থেকে জনদশেক বন্দুকবাজ মানুষ নিয়ে এসো। তারাই হবে আজ সরকারের অস্থায়ী প্রতিনিধি। এই কয়জন পুলিশ নিয়ে গুন্ডা দুটোকে শায়েস্তা করা যাবে না।

ব্রুনারের দুই সহকারী তাহলাকুই শহরের দিকে তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে। বিকাল বেলার দিকে তাদের সঙ্গে এল দশজন রাইফেলধারী নাগরিক–তাহলাকুই শহরের দশটি লড়িয়ে মানুষ।

পুলিশ ও নাগরিকদের মিলিত বাহিনী এইবার একযোগে গুন্ডাদের আক্রমণ করলে। তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে কাঠের ঘরটার ওপর তারা গুলি চালাতে শুরু করলে এবং গুলিবর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

অসম্ভব। গুন্ডাদের নিশানা অব্যর্থ।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকজন গুলি খেয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হল। কাঠের ঘরটা যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী–জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ন্ত মৃত্যুদূতের মতো ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি কার সাধ্য সেদিকে যায়?

নাঃ, এভাবে হবে না। ব্রুনার হতাশ হয়ে পড়ল।

 টলবার্ট নামক একজন নাগরিক এইবার সামনে এগিয়ে এল, ব্রুনার! ওই কাঠের ঘরটাকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

ব্রুনার বললে, কিন্তু এত দূর থেকে ঘরের ওপর ডিনামাইট ছুঁড়ে মারা সম্ভব নয়। ডিনামাইট ছুঁড়তে হলে ঘরের কাছাকাছি যেতে হবে আর ঘরের কাছে এগিয়ে গেলেই আমরা গুন্ডা দুটোর রাইফেলের সামনে পড়ব। গুলি যদি ডিনামাইটের ওপর লাগে তাহলে আর দেখতে হবে না–আমাদের পুরো দলটাই দড়াম করে উড়ে যাবে স্বর্গের দিকে! আত্মহত্যা করার অনেক ভালো ভালো উপায় আছে টলবার্ট, ডিনামাইটের মুখে প্রাণ দিতে আমি রাজি নই।

টলবার্ট বললে, আমি আর কোপল্যন্ড একটা পরিকল্পনা করেছি। আমার মনে হয় গুন্ডাদের আমরা কাবু করতে পারব।

সারারাত ধরে সবাই মিলে ঘরটাকে পাহারা দিলে কিন্তু ঘরের সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেউ করলে না। অনর্থক প্রাণ বিপন্ন করার পক্ষপাতী নয় ব্রুনার; টলবার্ট এবং কোপল্যন্ডের উপর ভরসা করে সে রাতটা নিষ্ক্রিয়ভাবে হাত গুটিয়ে বসে রইল–দেখা যাক ওদের পরিকল্পনা কতদূর ফলপ্রসূ হয়।

পরদিন সকালে পরিকল্পনার চেহারা দেখে দলসুদ্ধ মানুষের চক্ষুস্থির! একটা ঘোড়ায়-টানা গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে নিয়ে গাদা গাদা কাঠের টুকরো সাজাল টলবার্ট আর কোপল্যন্ড, তারপর দুই স্যাঙাতে মিলে সেই কাঠবোঝাই গাড়িটাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল গুন্ডাদের আস্তানার দিকে।

এককুড়ি ডিনামাইটের স্টিক! ঘরের ভিতর থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে এল গুলির পর গুলি একটা গুলি যদি কোনোরকমে ডিনামাইটের ওপর পড়ে তাহলে গাড়িসুদ্ধ মানুষ দুটো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে! দলসুদ্ধ লোকের বুক কাঁপতে লাগল, কিন্তু দুই বন্ধু সম্পূর্ণ নির্বিকার তারা গাড়ি ঠেলছে তো ঠেলছেই।

ফটফট করে উড়ে যেতে লাগল কাঠের টুকরোগুলো গুলির আঘাতে, গাড়ির একটা চাকা থেকে দুটো কাঠের ডান্ডা উড়িয়ে নিলে রাইফেলের বুলেট, কোপল্যন্ডের মাথায় আঁচড় বসিয়ে একটা গুলি তার সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিয়ে দিলে, আর একটা গুলি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল টলবার্টের টুপি–তবু তারা নির্বিকারভাবে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলল!

দুই বন্ধু যেন আত্মহত্যার সংকল্প নিয়েছে।

আচম্বিতে পাহাড়ের বুক কাঁপিয়ে জেগে উঠল এক ভয়াবহ শব্দের তরঙ্গ, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে কেঁপে উঠল মাটি ধোঁয়া আর ধুলোর ঝড়ে চারদিক আচ্ছন্ন করে পুলিশদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল বড়ো বড়ো কাঠের টুকরো!

ধোঁয়া কেটে গেলে সবাই দেখল, কাঠের ঘরটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছে। একটু দূরেই গাড়ির আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে টলবার্ট আর কোপল্যন্ড এবং ভাঙা ঘরের ভগ্নস্তূপের ভিতর রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে নেড ক্রিস্টি!

একটা রাইফেল সগর্জনে অগ্নি-উদগার করলে।

নেড ক্রিস্টির প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

ব্রুনার এসে দাঁড়াল কোপল্যন্ড আর টলবার্টের সামনে। গুলির আঘাতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে কোপল্যন্ড। টলবার্টও আহত হয়েছে, কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি। মুখ তুলে দুর্বলভাবে সে একবার হাসল, তারপর ব্রুনারকে উদ্দেশ করে বললে–

আমার মাথায় একটা গুলি আঁচড় কেটে চলে গেছে। খুব রক্তপাত হচ্ছে বটে, কিন্তু আমি বিশেষ ভয় পাইনি। তবে ডিনামাইট যখন ফাটছিল তখন সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি উড়ে গেলাম।

সমস্ত ঘটনাটা পরে জানা গেল। সব কিছু এত দ্রুত ঘটেছিল যে প্রত্যক্ষদর্শীরাও প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। টলবার্ট আর কোপল্যন্ড গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গুন্ডাদের আস্তানার পনেরো গজের মধ্যে এসে পড়েছিল এবং সেইখান থেকেই ঘরের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল ডিনামাইট স্টিকগুলো। বিস্ফোরণের আগে বুকে হেঁটে খানিকটা পিছিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই তারা বেঁচে গেছে–কী অসীম সাহস!

হত ও আহত মানুষগুলোকে নিয়ে ব্রুনার শহরে ফিরে এল।

নেড ক্রিস্টি মারা পড়েছিল, কিন্তু আর্চি উলফকে ওখানে পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভব কোনো গোপন পথে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে সে সরে পড়েছিল।

তাহলাকুই শহরে আর কখনো গুন্ডার উপদ্রব হয়নি। পুলিশ ও জনতার সম্মিলিত আক্রমণের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সমাজবিরোধী গুন্ডার দল।

ভদ্রলোকের বাসযোগ্য হয়ে উঠল তাহলাকুই শহর।

 জনতার প্রতিনিধিকে যারা হত্যা করেছিল, ক্ষিপ্ত জনতা তাদের ক্ষমা করেনি।

[পৌষ ১৩৭৬]