প্রণামীর শত

চতুর্থ পরিচ্ছেদ — প্রণামীর শত

রাত বাড়ছে… আকাশে হানা দেয় পাচা… রাতের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জেগে ওঠে জান্তব কোলাহল হুয়া-ক্কা-হুয়া–শেয়ালের পাল!

ঠ্যাঙাড়ের মাঠে বুড়ো বটগাছের তলায় লাঠি হাতে একটি দীর্ঘকায় মানুষ অস্থির চরণে পায়চারি করছে আর থেকে থেকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে পশ্চিমদিকের মেঠো পথটার দিকে। আকাশের পানে তাকিয়ে লোকটি অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করল, চাঁদ মাথার উপর উঠেছে। সময় হয়ে এল তবু কেউ তো টাকা নিয়ে আসছে না। ঠিক আছে, আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি। তারপর না হয় জমিদারবাড়িতে ভিক্ষে চাইতে যাব। সহজে রক্তারক্তি করতে চায় না, কিন্তু আজ বোধ হয় আমার লাঠি অনেকদিন বাদে রক্তের স্বাদ পাবে।

না গো কর্তা, তোমার লাঠি বোধ হয়, আজও উপোসি থাকবে, রক্তের স্বাদ সে আজও পাবে না।

কে রে! সবিস্ময়ে কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল লাঠিধারী ব্যক্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মনুষ্যমূর্তি! অন্ধকারে তার গায়ের সাদা চাদর কিছুটা দৃষ্টিগোচর হয়, চাদরের আড়ালে হাতে কিছু আছে কি না বোঝা যায় না।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে লাঠিধারী বলল, তুই তো কালীচরণের পাইক? ভুবনডাঙার পথ তো পশ্চিম দিকে। সেই দিকে তাকিয়ে চোখ যে ব্যথা হয়ে গেল তা তুই এলি কোন দিক থেকে?

আগন্তুক হাসল, যেদিক থেকেই আসি, আর যেখান দিয়েই আসি, সে-খোঁজে তোমার দরকার কী বাপু? টাকা আনার কথা, টাকা এনেছি। তিনি কোথায়?

কার কথা বলছিস?

দেবী ঠাকরুনের কথা বলছি।

 মায়ের সঙ্গে তোর কী দরকার? টাকা আমার হাতেই দিয়ে যা।

আহাহা! আহ্বাদের কথা শুনে মরে যাই আর কি! চিঠি দিয়েছেন দেবী ঠাকরুন, টাকা দেব তার হাতে। তুমি কোথাকার উটকো লোক তোমার হাতে টাকা দেব কেন?

আগন্তুকের হাতে মস্ত থলিটাকে এইবার দেখতে পেল লাঠিয়াল, মায়ের কথাতেই এখানে এসেছি। রাতবিরেতে এমন জায়গায় কেউ শখ করে দাঁড়িয়ে থাকে? চিঠিতে তো। এই জায়গার কথাই লেখা আছে আর তুইও টাকা দিতেই এসেছিল, তবে আর কথা বাড়াচ্ছিস কেন?

আগন্তুক তরল কণ্ঠে বলল, তুমিই-বা কথা বাড়াচ্ছ কেন? মা-ঠাকরুনকে ডেকে দাও, টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। ঝুটমুট তোমার সঙ্গে মাঝরাত্তিরে গল্প করতে তো আসিনি।

মা সকলের সাথে দেখা করেন না, লাঠিয়ালের কণ্ঠস্বর কর্কশ, টাকা আমার হাতেই দিতে হবে।

লাও কথা! দিতে হবে মানে?আগন্তুকের গলায় হাসির আভাস স্পষ্ট, আমি না-দিলে তুমি কেমন করে নেবে, শুনি? জোর করে?

হ্যাঁ, জোর করেই নেব। তুই বাধা দিতে পারিস?

পারি বই কী। আমি নিজে হাতে টাকা তুলে না-দিলে আমার হাত থেকে টাকা কেড়ে নিতে পারে এমন জোয়ান এখনও জন্মায়নি। বুঝলে কত্তা?

ওরে হতভাগা, তুই কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিস জানিস না। আমাদের মা সহজে কারুকে মারধর করতে চান না, তাই তুই এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা কইতে পারছিস। ভালো কথায় বলছি টাকা আমার হাতে দিয়ে চলে যা–নইলে, এই লাঠি দেখছিস?

অমন লাঠি অনেক দেখেছি। আমার হাতে লাঠি নেই, তাই লাঠি দেখাচ্ছ?

তোকে মারতে লাঠি লাগে না, লাঠিয়াল সামনে এগিয়ে এসে আগন্তুকের থলিসমেত হাত সজোরে চেপে ধরল, দে, টাকা।

আগন্তুকের হাত থেকে টাকার থলিটা সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল। হো হো শব্দে হেসে উঠে লাঠিয়াল বলল, তুই কেমন মরদ? একটা হাতের চাপ সহ্য করতে পারিস না, আবার মুখে লম্বা লম্বা কথা?

নীচু হয়ে টাকার থলিটা তুলে নেওয়ার উদযোগ করল সে। সঙ্গেসঙ্গে আগন্তুকের একটা হাত লোহার ডান্ডার মতো এসে পড়ল লাঠিয়ালের ঘাড়ে… কয়েক মুহূর্তের জন্য মানুষটার চৈতন্য লোপ পেয়েছিল… সম্বিৎ ফিরে আসতে সে দেখল টাকার থলি যেখানে পড়ে ছিল সেখানেই আছে, কিন্তু তার হাতের লাঠিটা এখন বিরাজ করছে নবাগত মানুষটির হাতে!

লাঠি হাতে আগন্তুক হেসে উঠল, তুমি তো তুমি, ওধারে মাটির উপর যে জোয়ানগুলো শুয়ে আছে, ওরা সবাই মিলে চেষ্টা করলেও এই থলিটাকে নিতে পারবে না। আমার কথা বিশ্বাস না হয়, ওদের ডেকে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে লাঠিয়াল বলল, মাঠের উপর লোক আছে তুই জানিস?

জানি বই কী।

 আশ্চর্য ব্যাপার! কী করে জানলি?

ভুবনডাঙার দিক থেকে যে-পথটা এসেছে, সেটার উপর দিয়ে অর্থাৎ পশ্চিমদিক থেকেই আমি আসছিলাম। ওখানে কত লোক আছে আঁধারে মালুম হবে না জানতাম। তাই মাঠের উপর শুয়ে বুকে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। তুমি নিশ্চয়ই জান অন্ধকারে মাঠের উপর কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে দাঁড়ানো-মানুষ দেখতে পায় না, কিন্তু মাটিতে শুয়ে পড়লে আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ শুয়ে-থাকা মানুষের চোখে পড়বে। তাই মাটিতে শুয়ে পড়েও আমি যখন কারুকে দেখতে পেলাম না, তখন বুঝলাম স্যাঙাতরা সব মাটিতে শুয়ে আছে। মানে, জমিদার মশাই টাকা না-পাঠিয়ে একদল পাইকও তো পাঠাতে পারেন–তাই বোধ হয় মা-ঠাকরুনের এই সতর্কতা। আমিও তখন তোমাদের ওষুধ তোমাদেরই খাওয়ালাম–অর্থাৎ মাঠের পথ ছেড়ে উলটোদিকে বনের পথ ধরলাম, তারপর ওই পথ দিয়ে মাঠ ধরে বুকে হেঁটে এই গাছের তলায় আসতেই তোমার সাথে মোলাকাত হয়ে গেল। সোজা পথে বুকে হেঁটে এগোলে হয়তো তোমাদের দলের মধ্যে গিয়ে পড়তাম। সেই বখেড়াটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই এতটা পরিশ্রম করতে হল।

লাঠিয়াল গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তুই তো দেখছি বহুত পোড়-খাওয়া লোক। তবে এখানে কত লোক আছে তা তো তুই জানিস না। একা তুই কয়জনকে সামলাতে পারবি?

অন্ধকারেও আগন্তুকের দাঁতগুলো একবার চকচক করে উঠল, অন্তত শ-খানেক জোয়ানকে তো সামলাতে পারব। তার বেশি হলে কী হবে বলা যায় না।

উরিব্বাস, লাঠিয়াল বলে উঠল, তুই তো খুব ভারি মরদ। তোর মুখটা তো একবার দেখতে হয়।

দু-হাতের আঙুল মুখে ঢুকিয়ে সে কুঈ দিল–পরক্ষণেই মাঠের উপর থেকে ভেসে আসতে লাগল তীব্র সংকেত ধ্বনি–রিক-রিক-চুঁ-ঈঈঈ!

একটু পরেই জ্বলে উঠল মশাল; প্রথমে একটা দুটো, তারপর অনেকগুলো…

জ্বলন্ত মশাল নিয়ে লোকগুলো এগিয়ে এল কাছে। একজন হাঁক দিয়ে বলল, সর্দার! কী খবর? টাকা এসেছে?

এসেছে, সর্দার অর্থাৎ আমাদের পূর্ব-পরিচিত লাঠিয়াল বলল, কিন্তু এ বলছে মায়ের হাতে টাকা দেবে, আর কারো হাতে দেবে না।

একটা অস্ফুট গুঞ্জন উঠল। একজন চড়া গলায় বলল, তোর মতো লোক মায়ের সাক্ষাৎ পায় না। ভালো কথায় টাকা দিয়ে দে।

সর্দার এবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে হাসল, কী মনে হয়? এতগুলো জোয়ানকে সামলাতে পারবি?

আগন্তুকও হাসল, ওসব চেষ্টা না-করাই ভালো! জোর করে টাকা নিতে গেলে কয়েকটা ভালো মানুষের লাশ পড়বে এখানে–সেটা কি ভালো হবে সর্দার?

সর্দারের চোয়াল শক্ত হল, এই তোর শেষ কথা?

হ্যাঁ, এই আমার শেষ কথা, আগন্তুকের কণ্ঠে আর হাসির রেশ নেই, দেবীদর্শন না হলে প্রণামী দেব না।

কথাটা সকলেই শুনতে পেল। কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এল, সর্দার, হুকুম দাও বেটাকে এখানেই শুইয়ে দি।

সর্দার কিছু বলার আগেই আগন্তুকের পিছন থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠের ধ্বনি, আমাকে দেখলেই যদি টাকা দিতে রাজি থাকে, তবে খুনোখুনির দরকার কী? আমি তো পর্দানশিন নই।

সচমকে পিছন ফিরে আগন্তুক দেখল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী! একটু দূরে হাতে হাতে যে-মশালগুলো জ্বলছিল তার অস্পষ্ট আভায় রমণীর মুখ ভালোভাবে দেখা না-গেলেও তার হাতের বল্লম ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি আগন্তুকের মনে বিস্ময় ও সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তুলল। সে কিছু বলার আগেই রমণী আবার বলল, ওরে, তোদের মধ্যে একজন একটা মশাল এদিকে নিয়ে আয়। আমাকে দর্শন না-করলে প্রণামী দিতে চায় না আমার এমন ভক্তের মুখটা তো একবার ভালো করে দেখতে হয়।

মশাল হাতে দু-তিনজন সামনে এগিয়ে এল। রমণীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠল আগন্তুক–এই কি দস্যুনেত্রী দেবী চৌধুরানি! এরই জন্য ঘুম নেই কুঠিয়ালদের চোখে? এরই জন্য সন্ত্রস্ত পরাক্রান্ত ইংরেজ সরকার! একেই গ্রেপ্তার করার জন্য হন্যে হয়ে ফিরছে ইংরেজের সেনাবাহিনী!…