বাঘের বাচ্চা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — বাঘের বাচ্চা

জমিদার কালীচরণ পায়চারি করছিলেন ঘরের মধ্যে। জানালাগুলো একেবারে হাট করে খোলা নেই–আবছা আলো-আঁধারির মধ্যেও বোঝা যায় প্রৌঢ় মানুষটি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।

বাইরে থেকে একটা গলা খাকরানির আওয়াজ এল। ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে কালীচরণ হাঁকলেন, কে?

আজ্ঞে আমি।

 কে? নায়েব মশাই?

 আজ্ঞে হ্যাঁ।

আসুন, ভিতরে আসুন।

ঈষৎ শীর্ণ বিরলকেশ নায়েব অঘোর বসু ঘরে ঢুকলেন, কিছু বলতে গেলেন, কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে আর একটা গলা সাড়া দিল, আজ্ঞে কর্তা, আমিও এসেছি।

এসেছেন? তা, বেশ করেছেন, কালীচরণের মুখে হাসির রেখা ফুটল, অনুগ্রহ করে গৃহে পদার্পণ করুন।

হেঁ, হেঁ, একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকল নীলকণ্ঠ, অমন করে বলবেন না কর্তামশাই, আমার অপরাধ হয়। তা, এমন অসময়ে তলব কেন?

হ্যাঁ, হুজুর, নায়েবমশাই বললেন, আমাকেও বাঘা বাড়িতে খবর দিয়েছে। ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার? একটু হাসলেন কালীচরণ, একটা চিঠি এসেছে।

আজ্ঞে, চিঠিপত্তর রাজা লোকের ঘরে তো আসবেই, তাই জন্যে এই আঁ আঁ রোদ্দুরে তলব?… ওঃ, গা যেন জ্বলে গেছে।

কালীচরণ চটে উঠলেন, কথা শুনুন নায়েবমশাই। বদন সর্দারের বেটা তার গায়ে রোদ লাগলে ননীর শরীর গলে যায়। আজ যদি ওর বাপ বেঁচে থাকত, তাহলে কি এমন সর্বনাশ হয়?

কী গেরো! নীলকণ্ঠ বেশ বিব্রত, কথায় কথায় ধান ভানতে শিবের গীত কেন? রাজা-গজার বাড়িতে চিঠি আসতেই পারে, তাতে বাবার কথা ওঠে কী করে? আর এতে সর্বনাশই-বা হবে কেন?

কালীচরণের হাত দুটো বরাবর পিছনদিকেই ছিল–খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন নীলকণ্ঠের দিকে, তারপর হঠাৎ ডান হাতটা ঘুরিয়ে আনলেন সামনে।

একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল নায়েব অঘোর বসুর গলা থেকে, সর্বনাশ!

কালীচরণের ডান হাতে রয়েছে একটা তির, তিরের সঙ্গে কালো সুতোয় বাঁধা একটা পাকানো চিঠি।

হাতটা সামনে বাড়িয়ে কালীচরণ বললেন, নীলে, তুই তো বৃন্দাবন ঠাকুরের কাছে লেখাপড়া শিখেছিস, পড়ে দেখ।

আজ্ঞে ওতে আর পড়ে দেখার কী আছে, খুব ঠান্ডা গলায় বলল নীলকণ্ঠ, তিরের নিশানা দেখেই বুঝেছি দেবী চৌধুরানির পত্র এসেছে। তা কত টাকা চেয়েছেন মা-ঠাকরুন?

তার কথার জবাব না-দিয়ে কালীচরণ বললেন, নায়েবমশাই চিঠিটা আপনি পড়ুন।

নায়েব অঘোর বসু চিঠিটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় পড়তে লাগলেন—

শ্ৰীশ্ৰীকালীচরণ চৌধুরী সমীপেষু
মহাশয়, দরিদ্র নারায়ণের সেবার জন্য আমি আপনার নিকট সামান্য কিছু অর্থ ভিক্ষা করিতেছি। বর্তমানে মাত্র হাজার দশেক হইলেই চলিবে। এই সামান্য অর্থ আপনার ন্যায় মহাশয় ব্যক্তির নিকট কিছুই নহে। যদি অদ্য নিশীথে রাত্রি বারো ঘটিকায় ঠ্যাঙাড়ের মাঠ নামক স্থানে অবস্থিত প্রাচীন বটবৃক্ষের তলায় পূর্বোক্ত অর্থ আপনি বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে প্রেরণ করেন, তাহা হইলে অতিশয় বাধিত হইব। উক্ত ব্যবস্থায় যদি আপনার বিশেষ অসুবিধা থাকে, তবে আমি স্বয়ং মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎপূর্বক ভিক্ষা লইয়া আসিব। অধিক কী লিখিব? আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করিবেন।
ইতি– দেবী চৌধুরানি

 চিঠি পড়া হলে মাছের মতো বোরাচোখে তাকিয়ে রইলেন নায়েবমশাই। স্তব্ধতা ভঙ্গ করল নীলকণ্ঠ, চিঠিটা আপনার হাতে এল কেমন করে কর্তামশাই?

একটু আগে বাড়ির একটা চাকর চিঠিটা দিয়ে গেল। দাওয়ার উপর সে কাপড় শুকোতে দিচ্ছিল, কোথা থেকে উড়ে এসে তিরটা তার সামনে মাটিতে বিধে গেল। ওই তির দেখেই লোকটার প্রাণ উড়ে গেছে। তিরের মুখে চিঠি যে দেবী চৌধুরানির নিশানা সে-কথা আজ দেশসুদ্ধ লোক সবাই জানে। চাকরটা কাঁপতে কাঁপতে এসে চিঠিটা আমায় দিয়ে গেছে।

যাই হোক, নায়েবমশাই বললেন, টাকাটা তো এখন দিতেই হবে। কি বলেন হুজুর?

কালীচরণ কিছু বলার আগেই নীলকণ্ঠ বলে উঠল, লাও কথা! টাকা কি খোলামকুচি? চাইলেই দিতে হবে?

কুঞ্চিত চক্ষে কালীচরণ বললেন, না-দিয়ে উপায় কী?

এটা আপনি কী কইছেন কর্তা? নীলকণ্ঠ বলল, দেবী আসছেন আপনার গৃহে, তুচ্ছ টাকা দিয়ে কি আমরা তাকে অপমান করতে পারি? আমরা বরং ফুল-চন্দন সাজিয়ে তাকে বরণ করব, বলব–মাগো, তুচ্ছ টাকা দিয়ে তোমায় আমরা অপমান করতে পারি না। আজ ভক্তের পুজো নিয়ে যাও। ভক্তির ধাক্কা যদি সামলাতে পারো, তাহলেই প্রণামীর দশ হাজার টাকা তোমার চরণে সমর্পণ করব।

কালীচরণ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে রইলেন, তারপর হো হো শব্দে হেসে উঠলেন, হতভাগা যাত্রার দলে ঢুকে উচ্ছন্নে গেছিস। সব ব্যাপারেই ঠাট্টা, লঘুগুরু জ্ঞান নেই?… না, না, নীলকণ্ঠ তোর বাপ বেঁচে থাকলেও কথা ছিল–টাকা আমি দেব, গোলমালে কাজ নেই।

নায়েবমশাই আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু হুজুর, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

হুজুর মুখ খোলার আগেই নীলকণ্ঠ বলে উঠল, এত সহজ কথাটা বুঝলেন না নায়েবমশাই? দেবী চৌধুরানিকে আজ সারাদেশের লোক ভক্তি করে। যাকে বলে ভয়ে ভক্তি। আমরা যদি তাঁকে ঠিকমতো আপ্যায়িত করতে না-পারি, তাহলে লোকে বলবে জমিদার কালীচরণ মানীর মান রাখতে জানে না। এখন দেবীকে তো শুধু-মুখে প্রণামীর টাকা ধরে দেওয়া যায় না, কর্তামশাই তাকে পুজো দেবেন লাঠি, তলোয়ার আর সড়কির ফলায় আমরা তবে আছি কী করতে?

আছি কী করতে! ভেংচে উঠলেন নায়েবমশাই, এমতাজ, করিম আর বাঘা ছাড়া লাঠি ধরতে কে জানে এখানে? এ কি প্রজা ঠেঙানো? এর নাম দেবী চৌধুরানি। তার সঙ্গে আসবে খুনে ডাকাতের দল–বুঝলি? গান গেয়ে আর বাঁশি বাজিয়ে তাদের ঠেকানো যাবে না।

ওই তো ভুল করলেন নায়েবমশাই। নীলকণ্ঠ কি খালি বাঁশি বাজাতে জানে? হাত দুটো চিতিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, দরকার হলে সে কেমন বাঁশও হাঁকরাতে পারে একবার দেখুন।

কালীচরণ এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, চুপ করে ছিলেন। এখনও তিনি কিছু বললেন না। শুধু তার দুই চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠল।

নায়েবমশাই কী বলতে গেলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে নীলকণ্ঠ কর্কশ স্বরে বলল, আপনি থামুন নায়েবমশাই। যা বলার কর্তামশাই বলুন।

নায়েবমশাই ভীষণ চটে কী যেন বলতে গেলেন, কিন্তু আবার বাধা পড়ল–কালীচরণ এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে, নীলে, তোর সাহস আছে বুঝলাম। কিন্তু কাজিয়া-দাঙ্গায় কাজ নেই বাবা

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, তোর বাপের আর ছেলেপুলে নেই, তোর কিছু হলে আমার বুকে শেল বাজবে।

নীলকণ্ঠ ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, তবে আর আমায় ডাকলেন কেন?

টাকাটা তোকেই দিয়ে আসতে হবে। বাঘা, করিম ওদের বিশ্বাস নেই। বেটাদের খুন তো গরম হয়েই আছে, হয়তো দাঙ্গা বাধিয়ে দেবে।

কর্তামশাই, নিজের হাতে ডাকাতের হাতে টাকা তুলে দেবে?রুদ্ধ আক্রোশে নীলকণ্ঠের গলার স্বর আটকে যায়, আপনি কী বলছেন কর্তা?

আরে সেইজন্যই তো তোকে ডাকা হল, নায়েব অঘোর বসুর বিদ্রূপ অতিশয় স্পষ্ট, যার যা কাজ।

নায়েবমশাই, ঘুরে দাঁড়াল নীলকণ্ঠ, আপনি মরদের মন বোঝেন না। কর্তামশায়ের হুকুম নিজের হাতে লুঠেরার হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। তাই দেব। আমরা তো হুকুমের চাকর তাই দেব। কিন্তু আপনি আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে এস না নায়েবমশাই। মন-মেজাজ ভালো নেই, কী হতে কী হয়ে যাবে।

নীলকণ্ঠের মুখের দিকে তাকিয়ে নায়েবের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল–এই নীলকণ্ঠ পরিচিত নীলে নয়, এই মানুষ অন্য মানুষ, একে চোখ রাঙানো চলে না, ধমক দেওয়া চলে না–নায়েব মশাই-এর মনে হল তার চোখের সামনে ফণা তুলে একটা গোখরো সাপ হিংস্র আক্রোশে দুলছে আর দুলছে!

সত্যিই নীলকণ্ঠ টলছিল। কালীচরণের দিকে না-তাকিয়েই সে রুদ্ধস্বরে বলল, কর্তামশাই, আমি রাত্রে আসব। টাকা তৈরি রাখবেন।

তারপরই সে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে। কালীচরণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, নায়েবমশাই, নীলেকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম.. বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়, ছাগল হয় না।