নরখাদক দেবতা

সৈনিকের পঞ্চম অভিজ্ঞতা
নরখাদক দেবতা
প্রথম পরিচ্ছেদ – কাপালালোর পরামর্শ

আত্তিলিও গত্তি তাঁর পূর্বতন অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন যেকোনো নূতন স্থানে পদার্পণ করার সঙ্গেসঙ্গেই স্থানীয় মানুষ তাকে অভ্যর্থনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ওয়াকাঁপাগা নামক নিগ্রোদের গ্রামে পৌঁছে তিনি একটি মানুষকেও দেখতে পেলেন না। তবে হ্যাঁ, কয়েকটা ছাগল গ্রামের ভিতর থেকে ব্যা-ব্যা শব্দে আগন্তুকদের সম্বন্ধে তাদের মতামত জানিয়েছিল বটে!

ব্যাপারটা কী? আত্তিলিও মোটবাহকদের সর্দার কাপালালোকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকগুলো কি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল?

কাপালালো মনিবের সম্মতির জন্য অপেক্ষা না-করে মোটবাহকদের মালপত্র সেখানেই নামিয়ে রাখতে আদেশ করল, তারপর পুবদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, শোনো।

আত্তিলিও কান পেতে শুনলেন নির্দিষ্ট দিক থেকে ভেসে আসছে সংগীত ও বাদ্যের সুমধুর ধ্বনি। তাঁর মনে হল দূরবর্তী নদীতটই পূর্বোক্ত গীতবাদ্যের উৎসস্থল। সম্ভবত ওইখানেই সমবেত হয়েছে গ্রামের সমস্ত মানুষ।

বিয়ের ব্যাপার নাকি? আবার প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও।

উত্তর এল না। কাপালালো হঠাৎ বোবা হয়ে গেছে। আত্তিলিও-বিরক্ত হলেন। চারদিন ধরে কুম্ভীর-সংকুল জলপথে নৌকা চালিয়ে এবং আগুন-ঝরা রোদের ভিতর বারো ঘণ্টা পা চালিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পথের মধ্যে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য কীটপতঙ্গ, তাদের কামড়ের জ্বালায় তাঁর সর্বঅঙ্গ জ্বলছে–বলাই বাহুল্য শরীরের এমন অবস্থায় বিয়ের উৎসব দেখার ইচ্ছে তার ছিল না।

এখন তিনি তাঁবু খাঁটিয়ে ভিতরে ঢুকে বিশ্রাম নিতে চাইছেন। বিশ্রামের আগে পরিষ্কার জল আর সাবান সহযোগে সমস্ত শরীর ধুয়ে পতঙ্গের দংশনে ক্ষতবিক্ষত স্থানগুলোতে আইওডিন লাগানো দরকার এখন কি উৎসব-টুৎসব ভালো লাগে?

অতএব আত্তিলিও গর্জে উঠলেন, বিয়ে-ফিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাতে চাই না। গাঁয়ের সর্দারকে এখনই ডেকে আনে। লোকজন লাগিয়ে সে এখনই পানীয় জল আর স্নানের উপযুক্ত জলের ব্যবস্থা করুক। তারপর জ্বালানি কাঠ, ফল, ডিম, মুরগি সব চাই ঝটপট! জলদি!

কাপালালো এক পা নড়ল না। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে সে আত্তিলিওর দিকে তাকাল। তার চোখের ভাষা অতিশয় স্পষ্ট–আহা! অবোধ বালক! তুমি জানো না তুমি কী বলছ!

খুব বিশ্বাসী মানুষ কাপালালো। তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আত্তিলিওর অগাধ আস্থা। এর আগে সে কখনো মনিবের আদেশ অমান্য করেনি। এমন বিশ্বাসী প্রভুভক্ত অনুচর যদি হঠাৎ অবাধ্য হয়ে পড়ে তাহলে মনিব আর কী করতে পারেন? নিরুপায় আত্তিলিও আসন গ্রহণ করলেন একটা কাঠের বাক্সের ওপর।

বিরক্ত বা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, বেশ শান্তভাবেই এবার প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও, ব্যাপারটা কী বল তো?

কুমির, কাপালালোর উত্তর, কাল দুই যমজ বোনের মধ্যে ছোটো মেয়েটিকে কুমিরে নিয়েছে।

তাহলে এটা কি শোকসভা? শোক প্রকাশের পর্ব শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমরা কি এইখানেই বসে থাকব?

ওয়াকাঁপাগা জাতির প্রতিবেশী অন্য আর একটি নিগ্রোজাতির মানুষ কাপালালো। প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে অনেক তথ্যই তার জানা আছে। আত্তিলিওর প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল–বিদেশিদের উপস্থিতি এই সময়ে ওয়াকাঁপাগা জাতি পছন্দ করবে না, কারণ এখন তারা চফু-মায়া নামক দেবতাকে পূজা নিবেদন করতে ব্যস্ত।

আত্তিলিও কিছু কিছু স্থানীয় ভাষা জানতেন। চফু-মায়া কথাটার অর্থ তিনি বুঝতে পারলেন–মৃত্যুদূত!

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা আবার কী? প্রেতাত্মা?

না, বাওয়ানা। চফু-মায়া হচ্ছে একটা কুমির। নদীতে আর জলাভূমিতে যেসব কুমির বাস করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আর সবচেয়ে ভয়ানক জন্তুটার নাম চফু-মায়া। গতকাল নাইনি। মেয়েটিকে চফু-মায়া নিয়ে গেছে। ঠিক বছর দুই আগে নাইনির বড়ো বোনকেও ওই জন্তুটা খেয়ে ফেলেছিল। দুটি মেয়েই ছিল যমজ বোন।

আত্তিলিও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ওই হতচ্ছাড়া কুমিরটাকে মারার চেষ্টা না-করে লোকগুলো তাকে পুজো করছে? আশ্চর্য ব্যাপার!

হ্যাঁ, বাওয়ানা, কাপালালো বলল, ওয়াকাঁপাগারা তাকে খুশি করার চেষ্টা করছে। ওরা আশা করছে পুজো পেয়ে যদি চফু-মায়া খুশি হয় তাহলে সে আর ওদের উপর হামলা করতে আসবে না।

আফ্রিকায় আসার পর থেকেই কুমির সম্বন্ধে আত্তিলিও যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা থেকে তিনি বুঝেছেন ওই ভয়ংকর সরীসৃপকে শায়েস্তা করতে পারে শুধু শক্তিশালী রাইফেল। স্থানীয় নিগ্রোদের বর্শা আর তির-ধনুক কুমিরের শক্ত চামড়া ভেদ করে মর্মস্থানে আঘাত হানতে পারে না। কিন্তু জলে নামার জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে ওয়াকাঁপাগা জাতি কুমিরের কবল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে না কেন সেই কথাটাই আত্তিলিও সাহেবের জিজ্ঞাস্য।

অনেকবার সেই চেষ্টা হয়েছে, কাপালালো বলল, কিন্তু এখানে খুব বড়ো গাছ পাওয়া যায় না। হালকা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বেড়া লাগিয়ে দেখা গেছে কোনো লাভ নেই। কুমির লেজের আঘাতে ওইসব বেড়া ভেঙে দেয় অনায়াসে। তা ছাড়া জলে নেমে বেড়া লাগানোর সময়ে বহু মানুষ কুমিরের খপ্পরে প্রাণ হারায়।

আত্তিলিও বললেন, ওরা তাহলে ফাঁদ পাতে না কেন? ফদের সাহায্যে ওই শয়তান জানোয়ারগুলোকে নিশ্চয় কাবু করা সম্ভব?

আত্তিলিওর কথা শুনে চমকে উঠল কাপালালো আর মোটবাহকের দল বাওয়ানা বলে কী!

অজ্ঞান অবোধকে জ্ঞান বিতরণ করার চেষ্টা করল কাপালালো, চফু-মায়া হচ্ছে ওয়াকাঁপাগাদের দেবতা। নিজের দেবতাকে কেউ কখনো ফাঁদ পেতে মারার চেষ্টা করতে পারে?

অকাট্য যুক্তি। সত্যিই তো, দেবতা যতই অত্যাচার করুক, সে দেবতা তো বটে! ঠিক আছে, আত্তিলিও বললেন, কয়েকটা কুমিরকে আমি গুলি চালিয়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। এখন চটপট তাঁবু খাঁটিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে ফেলো। ওয়াকাঁপাগাদের সাহায্য তো পাওয়া যাবে না।

একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিল কাপালালো। তারপর সব লোকগুলোকে অন্যান্য কাজে লাগিয়ে দিল। কিন্তু হাজার কাজের মধ্যেও তার দুই চোখের সতর্ক দৃষ্টি ছিল আত্তিলিওর উপর। অতএব আত্তিলিও যখন সংগীতধ্বনি যেদিক থেকে ভেসে আসছে সেইদিকে পদচালনা করার উদ্যোগ করলেন, তৎক্ষণাৎ তার সামনে ছুটে এল কাপালালো-না, বাওয়ানা, ওদিকে যেয়ো না! কাপালালোর কণ্ঠস্বরে উদবেগের আভাস। কোথাও যাব না?

ওখানে? আত্তিলিও নদীর দিকে হাত দেখালেন।

না, কুমিরদের উপর গুলি চালাতে যেয়ো না, দারুণ উদবেগে কাপালালোর কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল, ওখানে গেলে আর একটা সাদা মানুষের যেভাবে মৃত্যু হয়েছে, তোমারও সেইভাবে মৃত্যু হবে।

কী আজেবাজে বকছ?আত্তিলিও ধমকে উঠলেন, এই অঞ্চলে কোনো সাদা মানুষ আসে না।

নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে কাপালালো একটি ঘটনার উল্লেখ করল। ঘটনাটা ঘটেছিল অনেকদিন আগে। কাপালালো তখন বালক মাত্র। সেই সময় জনৈক বেলজিয়ান শিকারির কাছে মোটবাহকের কাজ করেছিল কাপালালো। ওয়াকাঁপাগাদের আস্তানার কাছে এসে উক্ত শিকারি যখন শুনল বহু স্থানীয় মানুষ কুমিরের কবলে প্রাণ হারিয়েছে, তখনই সে জলাভূমিতে গিয়ে রাইফেল চালিয়ে নরখাদক সরীসৃপদের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলার সংকল্প করল।

নিগ্রোরা তাকে নিষেধ করেছিল। শিকারি কারো কথায় কান দিল না। একটা ক্যানো (বিশেষ ধরনের নৌকা) নিয়ে কুমির-শিকারে যাত্রা করল বেলজিয়ান শিকারি। তার সঙ্গে ছিল দুজন স্থানীয় মানুষ। শিকারির কাছ থেকে প্রচুর হাতির মাংস পেয়ে লোক দুটি রাইফেলধারী শ্বেতাঙ্গকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। একদিন খুব ভোরে যাত্রা করল পূর্বোক্ত তিনটি মানুষ এবং জলার ধারে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করতে লাগল মোটবাহকের দল, ওয়াকাঁপাগাদের জনতা এবং কাপালালো স্বয়ং। কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে ভেসে এল রাইফেলের আওয়াজ। তারপরই জাগল মনুষ্যকণ্ঠের অস্ফুট আর্তনাদ। জনতা বুঝল কুমিরের কবলে প্রাণ হারাল তিনটি দুঃসাহসী মানুষ। ক্যানো নৌকাটাও নিখোঁজ হয়ে গেল; সেইসঙ্গে হারিয়ে গেল দাঁড়-বইঠা, নিগ্রোদের দুটি বর্শা, শিকারির রাইফেল।

কাপালালোর গল্প শুনে সমস্ত ব্যাপারটা কী ঘটেছিল সহজেই অনুমান করতে পারলেন আত্তিলিও। জলাভূমির মধ্যে কোনো একটি কুমিরকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল বেলজিয়ান শিকারি, তারপরই আহত জন্তুটার আক্রমণে অথবা অন্য কোনো কুমিরের হামলার মুখে নৌকোটা ভেঙেচুরে ডুবে গিয়েছিল বলেই মনে হয়। কারণ, একবারের বেশি গুলির শব্দ শোনা যায়নি। নৌকো চালিয়ে অকুস্থলে গিয়ে লোকগুলোর সন্ধান নেওয়ার সাহস কারুরই ছিল না। সেধরনের চেষ্টা করেই-বা কী লাভ হত? জলের মধ্যে এক ঝাক মানুষখেকো কুমিরের কবলে পড়লে তিনটি মানুষের পক্ষে কিছুতেই আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়। ওই অঞ্চলের জলাভূমি অসংখ্য নরখাদক কুম্ভীরের বাসস্থান। 

কয়েক বছর আগে আরও একটি সাদা মানুষ এখানে এসেছিল,কাপালালো আবার বলতে শুরু করল, সেই লোকটি ছিল ভারি সাহসী, প্রকাণ্ড জোয়ান। আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেই সাদা মানুষ হাতি, সিংহ আর মোষের সামনে গিয়ে ফটো তুলছে। জন্তুগুলোর সামনে যাওয়ার সময়ে সে একটুও ভয় পেত না। তার সঙ্গে রাইফেল থাকত। সে গুলি চালিয়ে শিকারও করত। তার হাতের টিপ ছিল দারুণ ভালো, কোনো সময়েই গুলি ফসকাত না। ওই লোকটিও চফু-মায়ার কথা শুনে তাকে মারতে গিয়েছিল। চফু-মায়া হল দেবতা–তাকে মারা কি সম্ভব? সেই সাদা মানুষটাকে খেয়ে ফেলেছিল চফু-মায়া।

কাপালালোর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে আত্তিলিও বুঝলেন ওই লোকটি ছিল ইংল্যান্ডের মানুষ। ফটো তোলা এবং শিকার ছিল উক্ত ইংরেজের নেশা। আত্তিলিও কাপালালোর মুখ থেকে ওই ইংরেজ-শিকারি সম্পর্কে আরও সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। দিনের বেলা নাকি ঘুমিয়ে কাটাত ইংরেজ, আর রাইফেল ও ক্যামেরা নিয়ে নদীর ধারে অপেক্ষা করত সারারাত জেগে। খুব সম্ভব নদীতটে বিশ্রামরত কুমিরের ফটো তোলার চেষ্টা করেছিল সে। অথবা এমনও হতে পারে কুম্ভীর ও জলহস্তীর দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিরল দৃশ্য আলোকচিত্রে তুলে নেওয়ার জন্য সে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তার সঠিক উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা আর জানা সম্ভব নয়, কারণ এক রাতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ইংরেজ-শিকারি। অকুস্থলে গিয়ে গ্রামবাসীরা ভিজে মাটির ওপর শিকারির দেহের ছাপ এবং রাইফেল দেখতে পায়। ওইখানেই ছিল কুমিরের গুরুভার দেহের সুগভীর পদচিহ্ন। মাটির উপর দিয়ে মনুষ্য-শরীর টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্নও ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। শিকারি যে হঠাৎ নিদ্রার আবেশে অসাবধান হয়ে পড়েছিল এবং সেই সুযোগে জল থেকে উঠে এসে ধূর্ত চফু-মায়া যে শিকারির নিদ্রাকে চিরনিদ্রায় পরিণত করে দিয়েছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কাপালালোর বিবৃতি শুনে আত্তিলিওর বক্তব্য হল নদীগর্ভে অবস্থিত অসংখ্য কুমিরের মধ্যে যেকোনো একটি জীবের পক্ষেই শিকারিকে গ্রাস করা সম্ভব, কিন্তু স্থানীয় নিগ্রোরা ওই লোকটির মৃত্যুর জন্য চফু-মায়াকে দায়ী করছে কোন প্রমাণের জোরে?

উত্তরে কাপালালো জানাল পায়ের ছাপ দেখেই স্থানীয় মানুষ বুঝতে পেরেছিল উক্ত শিকারির হন্তারক হচ্ছে চফু-মায়া স্বয়ং। ওই বিরাট কুমিরটার পদচিহ্নের বৈশিষ্ট্য স্থানীয় নিগ্রোদের সুপরিচিত, পায়ের ছাপ শনাক্ত করতে তাদের ভুল হয়নি একটুও।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল কাপালালো। সংগীত ধ্বনি এবার এগিয়ে আসছে। তাদের দিকে। যেদিক থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছিল সেইদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই আত্তিলিওর দিকে ফিরল কাপালালো, বাওয়ানা, কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাও। এমন ভাব করবে যেন তুমি এখানকার কোনো খবরই রাখো না। দুটি কুমারী মেয়ে মারা পড়েছে, আর দুজনই হচ্ছে যমজ। কাজেই এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। কোনো সাদা মানুষের চোখ যা দেখেনি, সেই আশ্চর্য জাদুর খেলা দেখতে পাবে তুমি। শুধু একটু ধৈর্য চাই।

পথের বাঁকে এইবার আত্মপ্রকাশ করল একটি ছোটোখাটো মানুষ। দুটি মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল ওই লোকটি। তার পিছনে হইহই করতে করতে ছুটছিল শত শত লোকের জনতা। আত্তিলিও এবং তাঁর সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল সবাই। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না।

আমাকে বিশ্বাস করো বাওয়ানা, কাপালালো বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাও।

জায়গাটা ছিল খুব গরম আর কটুগন্ধে পরিপূর্ণ। তবু আত্তিলিও স্থান ত্যাগ করলেন না। সেই রাতেই তিনি স্থির করলেন কয়েকটা দিন কাপালালোর কথামতো চলবেন। ভালোই করেছিলেন বলতে হবে, জায়গা ছেড়ে চলে গেলে এক আশ্চর্য দৃশ্য থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন।

দৈর্ঘ্যে পঁয়ত্রিশ ফিট এবং ওজনে চার টন এক মহাশক্তিধর অতিকায় দানবের বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল একটি নগণ্য মানুষ এবং সেই চমকপ্রদ দ্বন্দ্বযুদ্ধের দৃশ্যটিকে স্বচক্ষে দর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন আত্তিলিও গত্তি। যথাসময়ে উক্ত ঘটনার বিবরণ পাঠকের দৃষ্টিগোচর হবে।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ওয়াকাঁপাগাদের গ্রামে আত্তিলিও

ওয়াকাঁপাগাদের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রায় এক সপ্তাহ লাগল। ওয়াকাঁপাগা এক আদিম জাতি, আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে তারা অনিচ্ছুক। তাদের দোষ দেওয়া উচিত নয়। বেলজিয়ানরা কঙ্গোতে উপনিবেশ স্থাপন করার পর ওয়াকাঁপাগাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে এমন কথা বলা যায় না। বেলজিয়ান শাসক ওয়াকাঁপাগাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করার চেষ্টা করেছিল। কোনো লাভ হয়নি। তারা এক পয়সাও রোজগার করে না, ট্যাক্স দেবে কোথা থেকে? তখন তাদের ভিতর থেকে শক্তসমর্থ লোকগুলোকে বেলজিয়ান সরকার ধরে নিয়ে গেল রাস্তা তৈরির কাজের জন্য। অর্থাৎ বেগার খেটে তাদের খাজনা দিতে হবে। এর মধ্যে আবার ওয়াকাঁপাগাদের আস্তানায় হল এক পাদরির আবির্ভাব। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম প্রচার করার সঙ্গেসঙ্গে পাদরিসাহেব ওয়াকাঁপাগা-জাতির রীতিনীতির নিন্দাও শুরু করলেন। স্থানীয় মানুষ খেপে গেল। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়াত বলা মুশকিল, কিন্তু সমস্ত সমস্যার সহজ সমাধান করে দিল চফু-মায়া–ফাঁকা বুঝে সে একদিন পাদরিসাহেবকে টপ করে খেয়ে ফেলল। ওইসঙ্গে বেলজিয়ান অফিসারটিকেও যদি চফু-মায়া ফলার করে ফেলত তাহলে ওয়াকাঁপাগারা অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যেত।

আত্তিলিওর মন্তব্য শুনে ওয়াকাঁপাগাদের জাদুকর বিরস বদনে ঘাড় নেড়েছিল, লোকটার সঙ্গে অনেকগুলো সৈন্য ছিল যে!

যাই হোক, বেলজিয়ান সরকারের আচার আচরণ ওয়াকাঁপাগারা মোটেই পছন্দ করত না। পূর্বে উল্লিখিত বেলজিয়ান ও ইংরেজ শিকারির মৃত্যুর পর তাদের গ্রামে সরকারি তদন্ত হয়েছিল। শিকারিদের অপঘাত মৃত্যুর জন্য ওয়াকাঁপাগা জাতির উপর মোটা টাকার জরিমানা ধার্য করা হল এবং সেই টাকা পাওয়া গেল না বলে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ শাসক ওয়াকাঁপাগাদের ভিতর থেকে অনেকগুলো জোয়ান মানুষ নিয়ে গেলেন বেগার খাটার জন্য। অর্থাৎ বেগার খেটেই জরিমানার টাকা শোধ দিতে হবে!

এমন সব ঘটনার পর আত্তিলিও সাহেবকে দেখে গ্রামের লোক যদি ভাব জমানোর জন্য এগিয়ে না-আসে তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। আত্তিলিও তাদের দোষ দেননি। তবে ওয়াকাঁপাগাদের মনোভাব দেখে তার মনে হয়েছিল সঙ্গে একদল সৈন্য থাকলে নিরাপত্তা সম্বন্ধে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। অবশ্য সৈন্য না-থাকলেও কাপালালো ছিল। ছোটোখাটো একটা সৈন্যদলের চাইতে কাপালালোর একক উপস্থিতি যে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

কয়েকটা দিনের মধ্যে ওয়াকাঁপাগাদের সর্দার, জাদুকর প্রভৃতি মাতব্বর শ্রেণির হোমরা চোমরাদের সঙ্গে মেলামেশা করে কাপালালো তাদের বুঝিয়ে দিল আত্তিলিও গত্তি লোকটা খারাপ নয় এবং সরকারের সঙ্গে ওই সাদা মানুষটার কোনো সম্পর্ক নেই। কাপালালো আরও বলল যে, যদি ওয়াকাঁপাগারা তাদের জাদুর খেলা আত্তিলিওকে দেখাতে রাজি হয় তাহলে তিনি তাদের অনেক টাকা দেবেন। ওই টাকা বেলজিয়ান শাসকের হাতে তুলে দিলে আর বেগার খাটার জন্য তাদের লোকগুলোকে সরকার ধরে নিয়ে যাবে না।

বেলজিয়ান কঙ্গোতে প্রবেশ করার আগে আত্তিলিও একটা পঞ্চাশ ডলারের বিল ভাঙিয়ে বেলজিয়ান মুদ্রায় খুচরো করে নিয়েছিলেন। সেই খুচরো টাকার পরিমাণ কম নয়–তিনটি থলে ভরতি টাকা যখন আত্তিলিও তুলে দিলেন ওয়াকাঁপাগা-সর্দারের হাতে, তখন আর তার সদিচ্ছায় কারো সন্দেহ রইল না। ওয়াকাঁপাগা জাতির মধ্যে যে-মানুষটিকে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বলে মনে করা হয় এবং যার কথা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বেদবাক্যের মতোই অভ্রান্ত, সেই মাতুংগো নামক ব্যক্তিটি বলে উঠল, বাওয়ানা আমার বন্ধু। তাকে সব কিছুই দেখানো হবে।  

আগামীকাল, মাতুংগোর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো সর্দার, আবার নদীর ধারে কুমারী মেয়েরা নাচবে। ওরা নাচবে চফু-মায়ার জন্য। এবং বাওয়ানার জন্য।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি

আধুনিক সভ্যতা যাদের স্পর্শ করেনি, সেইসব আদিম জাতি খুব সরল ও বিশ্বাসী হয়। ওয়াকাঁপাগা জাতিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। একবার বন্ধুভাবে গ্রহণ করার পর তারা আত্তিলিওর কাছে কিছুই গোপন করার চেষ্টা করল না। কাপালালো যে জাদুর খেলার উল্লেখ করেছিল এইবার সেই জাদু-রহস্য খোলাখুলিভাবে জানতে পারলেন আত্তিলিও।

পর পর দুটি যমজ ভগ্নীকে অবিবাহিত অবস্থায় ভক্ষণ করেছে চফু-মায়া, এখন ওয়াকাঁপাগা জাতির সামাজিক নিয়ম অনুসারে ওই কন্যা দুটির পিতাকে হন্তারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।

কারণটাও বুঝিয়ে বলা হল। যদি যুদ্ধে কন্যাদের পিতা নিহত হয় তাহলে তার আত্মা কুম্ভীরের উদরে আবদ্ধ কন্যা দুটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে আর এক পৃথিবীতে সেখানে শোক-দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ। আর যদি কন্যাদের পিতা যুদ্ধে জয়ী হয়, তবে কুমিরের পেট চিরে সে কন্যাদুটিকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করবে এবং মুক্ত আত্মা দুটি সর্বদাই পিতার সঙ্গে থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে সুখে-আনন্দে পরিপূর্ণ করে রাখবে, তাদের চেষ্টায় পিতৃদেবের ধনসম্পদও বৃদ্ধি পাবে।

চফু-মায়ার কবলে নিহত যমজ ভগ্নীদের পিতার নাম নগুরা-গুরা। লোকটির দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন–ক্ষীণকায়, শান্তশিষ্ট এই বয়স্ক মানুষটি লড়াই করবে নরভুক অতিকায় কুম্ভীরের সঙ্গে? অসম্ভব, নিশ্চয়ই তিনি কোথাও ভুল করছেন!

তুমি কী বলতে চাও, নগুরা-গুরার দিকে আঙুল দেখিয়ে জাদুকর মাতুংগোকে জিজ্ঞাসা করলেন আত্তিলিও, ওই লোকটি চফু-মায়ার সঙ্গে লড়াই করবে?

হ্যাঁ, বাওয়ানা।

একা? ওর হাতে রাইফেল থাকবে তো?

ও একাই লড়বে। ওর হাতে রাইফেল থাকবে না।

জাদুকরের কুটিরের মধ্যে চুপ করে বসে ছিল নগুরা-গুরা। মাথা নেড়ে সে মাতুংগোর কথায় সায় দিল।

আবার আত্তিলিওর প্রশ্ন, তবে বোধ হয় বিশেষ ধরনের কোনো ফাঁদ নিয়ে ও লড়াই করবে?

না, বাওয়ানা। ফাঁদের সাহায্য ছাড়াই ও লড়বে। ওর হাতে একটা ছুরি আর একটা দড়ি। একমাত্র ওর নিজস্ব ডান হাতটা ছাড়া আর কেউ ওকে সাহায্য করতে আসবে না।

নগুরা-গুরা নামক ছোটোখাটো মানুষটি আবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

জাদুকর মাতুংগো বলল, চফু-মায়া যখন বোঝে বিপদের ভয় বিশেষ নেই তখনই সে দেখা দেয়। আর ওয়াকাঁপাগাদের পক্ষে চফু-মায়ার মোকাবিলা করার ওই একটি সুযোগই আছে। দড়ি আর ছুরি হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র যা দিয়ে চফু-মায়ার সঙ্গে লড়াই করা যায়।

মাতুংগোর কণ্ঠ শান্ত, নিরুবেগ। আত্তিলিও সবিস্ময়ে দেখলেন নগুরা-গুরার ভাবভঙ্গিতেও কিছুমাত্র উত্তেজনার চিহ্ন নেই। অসম্ভব আত্মবিশ্বাস আর সাহসের অধিকারী না হলে কোনো মানুষই নরখাদক কুম্ভীরের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধের নামার আগে এমন নিশ্চিন্তভাবে বসে থাকতে পারে না।

মাতুংগোর গলার স্বর আত্তিলিওর কানে এল, তুমি নিজের চোখেই সব দেখবে।

নগুরা-গুরা সায় দিল, হ্যাঁ, সময় এলেই দেখতে পাবে।

…সময় এল কয়েক সপ্তাহ পরে।

অন্তর্বর্তী দিনগুলো অবশ্য একঘেয়ে লাগেনি আত্তিলিওর কাছে। প্রত্যেক দিন বাদ্য সহযোগে নৃত্যগীত চলত নদীর ধারে। রোদের তাপ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটা ছায়াঘেরা জায়গা বেছে নিতেন আত্তিলিও। তারপর সেখানে বসে উপভোগ করতেন ওয়াকাঁপাগা জাতির নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। ঢালের উপর বর্শাদণ্ডের আঘাতে বাজনা বাজিয়ে গান গাইত যুবকের দল, নাচতে নাচতে নদীর জলে নামত কয়েকটি কুমারী মেয়ে, গায়ের জামা আর মাথার টুপি খুলে ভাসিয়ে দিত জলে পরক্ষণেই নদীর বুক ছেড়ে উধ্বশ্বাসে উঠে আসত সেইখানে, যেখানে বসে আছে নগুরা-গুরা। মুহূর্তের মধ্যে কাছাকাছি দুটি মেয়ের হাত চেপে ধরত নগুরা-গুরা, তারপর চারদিকে দণ্ডায়মান জনতার ব্যুহভেদ করে ছুটত মেয়ে দুটির হাত ধরে। সমবেত জনতাও চিৎকার করতে করতে ছুটত তাদের পিছনে।

কোলাহল থেমে যেত ধীরে ধীরে। পরিশ্রান্ত লোকগুলো কুটিরে প্রবেশ করত আহারাদি সাঙ্গ করে বিশ্রাম নেবার জন্য।

বহুদিন আফ্রিকাতে কাটিয়ে কয়েকটি বিষয়ে আত্তিলিও খুব সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অধিকাংশ মানুষই নিগ্রোদের জাদুবিদ্যার অনুষ্ঠান প্রভৃতিকে বুজরুকি বলে উড়িয়ে দেয় কিন্তু আত্তিলিও জানতেন এই অনুষ্ঠানগুলো মোটেই বুজরুকি নয়, ওইসব ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনস্তত্ত্বের জটিল বিজ্ঞান।

জাদুকররা মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে বিশেষত তার নিজের জাতির মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে, দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল। তারা খুব ভালোভাবেই জানে মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যকে কেমন করে কাজে লাগাতে হয়। উদাহরণস্বরূপ নদীর ধারে নাচগান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যাপারগুলোকে ধরা যাক–

রোজ সকালে তুমুল কোলাহল তুলে একই দৃশ্যের বার বার অভিনয় করার ফলে স্থানীয় মানুষের মনে দুর্ঘটনার স্মৃতি খুব দাগ কেটে দেবে, তারা ভবিষ্যতে অসাবধান হবে না, সুতরাং দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমবে।

নদীর ধারে চিৎকার-চেঁচামেচির ফলে কুমিরের দল হবে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত, সুযোগ পাওয়ামাত্র তারা মানুষকে আক্রমণ করবে। অর্থাৎ নাগুবা-গুরাকে যাতে চফু-মায়া এগিয়ে এসে আক্রমণ করে সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে। প্রতিদিন মেয়েদের গায়ের জামা আর মাথার টুপি ভেসে যাচ্ছে চফু-মায়ার আস্তানার দিকে, ওইসব জিনিসগুলো থেকে ক্রমাগত প্রিয় খাদ্যের গন্ধ পেতে পেতে নরমাংসের লালসায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নগুরা-গুরার দিকে চফু-মায়াকে আকৃষ্ট করার এটাও এক অভিনব কৌশল! রণক্ষেত্র সাজানোর সঙ্গেসঙ্গে চফু-মায়ার প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধাটিকেও প্রস্তুত করা হচ্ছিল ধীরে ধীরে কুটিরের মধ্যে প্রতিদিন সঙ্গোপনে মাতুংগো যে কী মন্ত্র দিত নগুরা-গুরার কানে সে-কথা জানা সম্ভব নয় আত্তিলিওর পক্ষে, কিন্তু ছোটোখাটো মানুষটির মধ্যে মাতুংগোর প্রভাব যে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। নিপুণ কর্মকার যেমন ভোতা লোহাকে শান দিতে দিতে ধারালো অস্ত্রে পরিণত করে, ঠিক তেমনিভাবেই জাদুকর মাতুংগোর হাতে শান খেতে খেতে ঝরে পড়ছিল নগুরা-গুরার আলস্য-অবসাদ আর আতঙ্কের অনুভূতি তুচ্ছ মানবের ক্ষুদ্র দেহের অন্তস্থল ভেদ করে জন্মগ্রহণ করছিল এক প্রতিহিংসাপরায়ণ দৈত্য!

নগুরা-গুরার মুখের দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও বুঝতে পারতেন সে বদলে যাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি, চোয়ালের কাঠিন্য আর দৃঢ় পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায় নগুরা-গুরার ভিতর জেগে উঠেছে অদম্য আত্মবিশ্বাস নরখাদক অতিকায় কুম্ভীরের সঙ্গে দ্বৈরথরণে অবতীর্ণ হতে সে একটুও ভীত নয়! এমনকী আত্তিলিও সাহেবেরও একসময় মনে হল একটা কুমিরকে হাতাহাতি লড়াইতে মেরে ফেলা এমন কী কঠিন কাজ?

দুর্ভেদ্য বর্মের মতো কঠিন চর্মে আবৃত ৩৫ ফিট লম্বা ধূর্ত ও হিংস্র নরভুকের বিরুদ্ধে ছুরিকাসম্বল একটি মানুষের জয়লাভ করার সম্ভাবনা খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল আত্তিলিওর কাছে–এও কি মন্ত্রের প্রভাব? না, মনস্তত্ত্বের মহিমা?…

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দ্বৈরথ

সোম, মঙ্গল, বুধ–

তিনদিন হল নাচগান প্রভৃতি সব অনুষ্ঠান বন্ধ। নদীতট নির্জন। মেয়েরাও নদী থেকে জল আনতে যায় না। জাদুকর মাতুংগোর নির্দেশ–কেউ যেন নদীর ধারে না-আসে; আবার নতুন আদেশ না-পাওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বজায় রাখতে হবে।

বৃহস্পতিবার সকালে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে কাপালালো প্রবেশ করল আত্তিলিওর তাবুতে, তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

কাপালালোর কথামতো তাকে অনুসরণ করলেন আত্তিলিও। কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার। এমনকী ছাগলদেরও দেখা যাচ্ছে না। ফিসফিস করে কাপালালো জানাল যতক্ষণ পর্যন্ত মাতুংগো আদেশ না-দিচ্ছে ততক্ষণ একটি প্রাণীও কুটিরের বাইরে আত্মপ্রকাশ করবে না। মাতুংগো জানিয়েছে বাওয়ানার রাইফেলের শব্দই হচ্ছে গ্রামবাসীদের বেরিয়ে আসার সংকেত। লোকজনের উপস্থিতি বা কথাবার্তার শব্দে জাদুবিদ্যা প্রয়োগের ব্যাঘাত হতে পারে বলেই নাকি এই ব্যবস্থা! সমগ্র এলাকার মধ্যে শুধু একটা ছাগকণ্ঠের ব্যা ব্যা ধ্বনি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ছাগলের গলার আওয়াজটা ভেসে আসছিল কুয়াশায় ঢাকা নদীতট থেকে।

নদীর ধারে পৌঁছে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ছাগশিশুটিকে দেখতে পেলেন আত্তিলিও। নিতান্তই কচি বাচ্চা, কুমিরের প্রিয় খাদ্য।

কথা না-বলে প্রায় তিরিশ ফুট দূরে অবস্থিত আর একটা গাছের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল কাপালালো। গাছটা খুব শক্ত, কিন্তু নমনীয়। ওয়াকাঁপাগারা ওই জাতের গাছ থেকেই তাদের ধনুক তৈরি করে। আত্তিলিও দেখলেন, নির্দিষ্ট গাছটির ডগার দিকে একটা দড়ি বাঁধা আছে। দড়ির পাক খুব আলগা অবস্থায় ঝুলতে ঝুলতে ছাগশিশুর কাছাকাছি গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।

ঘন সন্নিবিষ্ট একটা ঝোঁপের কাছে আত্তিলিওকে টেনে নিয়ে গেল কাপালালো। তারপর তার পাশেই সে গুঁড়ি মেরে বসল। সঙ্গেসঙ্গে একটু দূরে আর একটা ঝোঁপের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল আরও দুটি মনুষ্য-মূর্তি।

একজন হচ্ছে নগুরা-গুরা। তার ডান হাতের পুরোবাহু থেকে কবজি পর্যন্ত জড়িয়ে অবস্থান করছে গাছের ছালের পুরু আবরণ বা ব্যান্ডেজ।

অপর লোকটি মাতুংগো। তার হাতে একটা অদ্ভুত অস্ত্র। সে যখন নীচু হয়ে মাটি থেকে দড়ির ঝুলে-পড়া অংশটা তুলে হাতের অস্ত্রটার মাঝামাঝি জায়গায় জড়িয়ে নিচ্ছে, ঠিক তখনই বস্তুটির স্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেন আত্তিলিও।

জিনিসটা হচ্ছে দোলা ছুরি; দুটো ধারালো ফলার মাঝখানে বসানো আছে শক্ত কাঠের বাঁট। ওই বাঁটের মাঝখানে শক্ত করে দড়িটা বেঁধে মাতুংগো হঠাৎ নগুরা-গুরার কাধ চেপে ধরল। জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে দড়ি বাঁধা দোলা ছুরিটা তুলে নিল নগুরা-গুরার হাতে। একবার তীব্র দৃষ্টিতে নগুরা-গুরার চোখের দিকে তাকাল মাতুংগো–আবার ঝাঁকুনি! খুব জোরে মাথা নাড়ল নগুরা-গুরা, তারপর ঘুরে গিয়ে ছাগশিশুর নিকটবর্তী গাছটার পিছনে বসে পড়ল। আত্তিলিওর মনে হল জাদুকর মাতুংগোর চোখের দৃষ্টি থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি ধাক্কা মেরে নগুরা-গুরার দেহটাকে যথাস্থানে বসিয়ে দিল!

এতক্ষণে সমস্ত পরিকল্পনাটা আত্তিলিওর কাছে পরিষ্কার হল। নগুরা-গুরার সর্বাঙ্গে যে তৈলাক্ত বস্তুটি মাখানো আছে, সেই পদার্থটির গন্ধ মানুষের গায়ের গন্ধ ঢেকে রাখবে–ছাগশিশুর ক্রন্দনে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এলেও চফু-মায়া তার ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে মানুষের উপস্থিতি বুঝে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে না।

তারপর কী ঘটবে সহজেই অনুমান করা যায়। আচম্বিতে একটা মানুষকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখলেই কুমির তেড়ে যাবে, মুহূর্তের জন্য খুলে যাবে দুই চেয়ালের প্রকাণ্ড হাঁ, পরক্ষণেই শত্রুকে মুখগহ্বরে বন্দি করার চেষ্টায় সশব্দে বন্ধ হয়ে যাবে দন্তসজ্জিত দুই চোয়ালের মরণফাঁদ।

সেই হাঁ-করা মুখের সুযোগ নেবে নগুরা-গুরা–পলকের মধ্যে কুমিরের মুখগহ্বরে হাত ঢুকিয়ে এমন কায়দায় সে ছুরিটা ধরবে যে, কুমিরের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে দংশনের চাপে ছুরির দুটো ফলাই সরীসৃপের মুখের ভিতর নরম মাংস ভেদ করে এফেঁড়-ওফেঁড় হয়ে বসে যাবে; কিন্তু দুটো ধারালো ফলা মাঝখানে অবস্থিত শক্ত কাঠের টুকরোটার জন্য কুমির মুখের হাঁ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারবে না এবং সেই একটুখানি ফাঁকের ভিতর থেকেই চট করে হাত টেনে নিয়ে নিরাপদ ব্যবধানে সরে যাবে নগুরা-গুরা।

অসম্ভব, আত্তিলিও ভাবলেন, এ হচ্ছে উন্মাদের চিন্তা। ওইটুকু কাঠের টুকরো কখনোই কুমিরের প্রচণ্ড দুই চোয়ালের চাপ উপেক্ষা করে টিকে থাকতে পারবে না। নগুরা-গুরার ডান হাত ধরা পড়বে কুমিরের মুখের মধ্যে; জন্তুটা যদি তাকে জলের ভিতর না-নিয়ে যায় তাহলেও লোকটার বাঁচার আশা নেই কারণ কামড়ের চাপে তার হাতখানা নিশ্চয়ই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ক্ষতস্থানে গ্যাংগ্রিন-এর যে পচনক্রিয়া শুরু হবে তাতেই লোকটির মৃত্যু অবধারিত।

নগুরা-গুরার অবস্থা বুঝে উদবিগ্ন হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। উদ্ভিদের বন্ধন জাল থেকে রাইফেলটাকে তিনি মুক্ত করে নিলেন, তারপর যথাসম্ভব নিঃশব্দে সেফটি-ক্যাচ সরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের সাইট কুড়ি গজের মধ্যে নির্দিষ্ট করতে সচেষ্ট হলেন।

হঠাৎ রাইফেলের উপর এসে পড়ল একটা হাত।

আত্তিলিও চমকে উঠলেন–হাতের অধিকারী জাদুকর মাতুংগো! জাদুকরের দুই চোখের গভীর দৃষ্টি আত্তিলিওকে তার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিল–তিনি বলেছিলেন কোনো কারণেই মানুষ ও সরীসৃপের দ্বন্দ্বযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবেন না।

মাতুংগোর ঠোঁট নড়ে উঠল, কোনো শব্দ হল না, কিন্তু ওষ্ঠাধরের কম্পন দেখে তার বক্তব্য বুঝতে পারলেন আত্তিলিও–

চফু-মায়া আসছে। তুমি একটুও নড়বে না।

ছাগশিশুর কান্না তখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। চুপ করে অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার জন্য আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট। মনে হচ্ছে কিছুই ঘটবে না। কুয়াশা সরে যাচ্ছে। আত্তিলিও ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন–ঘড়ির কাঁটা বলছে এখানে আসার পর কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেছে।

হঠাৎ মাতুংগোর কনুইয়ের চাপ পাঁজরের উপর অনুভব করলেন আত্তিলিও। দুই চোখের দৃষ্টি এদিক-ওদিক চালিত করলেন তিনি, কিছুই নজরে পড়ল না। কোনো অস্বাভাবিক শব্দও তার কানে এল না। নগুরা-গুরা বসে আছে পাথরের মূর্তির মতো, তার পিঠের মাংসপেশিতে এতটুকু কম্পনের সাড়া নেই। একইভাবে কাঁদছে আর কাঁদছে ছাগলের বাচ্চা। আত্তিলিওর চোখে-কানে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ল না।

হঠাৎ আত্তিলিও সাহেবের পাঁজরের উপর থেকে কনুইয়ের চাপ সরে গেল। মাতুংগো কী করে ভয়ংকরের আগমনবার্তা পেয়েছিল বলা যায় না, কিন্তু নদীর জলে একটা হলদে-সবুজ বস্তুর চলমান অস্তিত্ব এইবার আত্তিলিওর চোখে পড়ল। ছাগশিশুর ভয়ার্ত দৃষ্টি এখন নদীর দিকে, আর্তস্বর তীব্র থেকে তীব্রতর!

ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে নদীর জলে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা প্রকাণ্ড মাথা! আত্তিলিওর মনে হল তিনি স্বপ্ন দেখছেন–এমন প্রকাণ্ড কুৎসিত মস্তকের অস্তিত্ব বাস্তবে কল্পনা করা যায় না। জল ছেড়ে উঠে এল ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতা অতিকায় কুম্ভীর চফু-মায়া!

দড়িতে বাঁধা ছাগল-বাচ্চার কয়েক ফিট দূরে এসে থমকে দাঁড়াল কুমির। আত্তিলিও বুঝলেন এইবার সে শিকারকে কামড়ে ধরবে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মাতুংগো। চিৎকারটা বোধ হয় যুদ্ধের সংকেত-মুহূর্তের মধ্যে গাছের আড়াল থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে এল নগুরা-গুরা, ছাগশিশুর মাথার ওপর দিয়ে মেলে দিল প্রসারিত দক্ষিণ হস্ত।

বিদ্যুদ্‌বেগে এগিয়ে এসে শত্রুকে আক্রমণ করল চফু-মায়া। সশব্দে খুলে গেল দুই ভয়ংকর চোয়াল। একটা তুচ্ছ মানুষের দুর্বল হাত লক্ষ করে এগিয়ে এল চফু-মায়ার দন্ত-কণ্টকিত করাল মুখগহ্বর। পরক্ষণেই আবার ভীষণ শব্দে চোয়াল দুটি বন্ধ হয়ে গেল কুমির বুঝি বজ্রকঠিন দংশনে চেপে ধরেছে শত্রুর হাত!

আত্তিলিও চমকে উঠলেন… না! নগুরা-গুরা সরে এসেছে! তার ডান হাত এখনও অক্ষত অবস্থায় দেহের সঙ্গে সংলগ্ন, কিন্তু যে-অস্ত্রটা একটু আগেও তার ডান হাতের মুঠির মধ্যে ছিল সেই দোলা ছুরিটাকে আর যথাস্থানে দেখা যাচ্ছে না!

চফু-মায়া পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল–পরক্ষণেই এক প্রকাণ্ড ডিগবাজি খেয়ে শূন্য পথে প্রায় পনেরো ফিট উচ্চতা অতিক্রম করে তার বিশাল দেহ এসে পড়ল নদীগর্ভে! ফোয়ারার মতো ছিটকে উঠল জল, চফু-মায়া হল অদৃশ্য!

তারপর নদীর জল তোলপাড় করে জাগল ঢেউয়ের পর ঢেউ! থর থর করে কাঁপতে লাগল গাছে বাঁধা দড়ি! জলের তলায় আত্মগোপন করে চফু-মায়া প্রাণপণে ছুরি আর দড়ির মারাত্মক আলিঙ্গন থেকে মুখগহ্বরকে মুক্ত করতে চাইছে!..

আত্তিলিও বুঝলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধের পালা শেষ; জয়ী হয়েছে নগুরা-গুরা। সঠিক সময়জ্ঞান, ক্ষিপ্রতা এবং সংযত স্নায়ুর সাহায্যে ওই মানুষটি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে।

কিন্তু চরম মুহূর্তে অসীম সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দিলেও বিপদ কেটে যেতেই নগুরা-গুরার অবস্থা হয়েছে নির্জীব জড়পদার্থের মতো। নদীর বুক থেকে ছিটকে এসে জলের ধারা তার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিচ্ছে তবু তার খেয়াল নেই। চোখ পাকিয়ে সে তাকিয়ে আছে আলোড়িত জলরাশির দিকে; মনে হচ্ছে এত বড়ো জীবটাকে সে যে স্বহস্তে মর্মঘাতী আঘাতে পর্যুদস্ত করেছে, ঘটনার এই সত্যতা তার নিজের কাছেই এখন অবিশ্বাস্য!

মাতুংগো তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে একটা হাত রাখল নগুরা-গুরার কাঁধের উপর। আত্তিলিও জানতেন তার অনুচর কাপালালো ওই অঞ্চলের এক সাহসী শিকারি–কিন্তু তিনি দেখলেন ঘটনার ভীষণতা তাকেও স্তম্ভিত করে দিয়েছে! সম্মোহিত মানুষের মতোই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাপালালো!…

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – আত্তিলিওর বিপদ

নদীর বুক থেকে প্রবল বেগে উঠে আসছে উচ্ছ্বসিত জলধারা, সবেগে দুলছে আর দুলছে বৃক্ষে আবদ্ধ লম্ববান রঞ্জু চফু-মায়ার বিশাল দেহ জলের তলায় অদৃশ্য থাকলেও তার মৃত্যুকালীন আক্ষেপ নদীতটে দণ্ডায়মান দর্শকের কাছে অতিশয় স্পষ্ট।

কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও চফু-মায়া ছুরির মারাত্মক দংশন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। দোলা ছুরির ফলা দুটো এমন গভীরভাবে মুখের ভিতর বিধে আটকে আছে যে, বেচারা কুমির না-পারছে মুখ বন্ধ করতে, না-পারছে মুখ খুলতে! সে প্রাণপণে টানাটানি করছে, সঙ্গেসঙ্গে ছুরির মাঝখানে বাঁটে-বাঁধা দড়িতে পড়ছে টান টানাটানির ফলে যন্ত্রণা বাড়ছে; জন্তুটার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘাসে-পাকানো দড়িটা ভীষণ শক্ত। সেটা ছিঁড়ে ফেলা চফু-মায়ার মতো শক্তিশালী জীবের পক্ষেও সম্ভব নয়। ছুরির সঙ্গে আবদ্ধ দড়িটাকে যে গাছের ডালে বাঁধা হয়েছে, সেই ডালটা যদি টানাটানিতে ভেঙে পড়ে তাহলে যন্ত্রণা থেকে রেহাই না-পেলেও কুমির অন্তত সীমাবদ্ধ গণ্ডির বন্ধন দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে কিন্তু তা হওয়ার নয়। আগেই বলেছি ওই জাতের গাছ যেমন নমনীয়, তেমনই কঠিন। গাছটি যে চফু-মায়ার টানাটানি অগ্রাহ্য করে তার অখণ্ডতা বজায় রাখতে সমর্থ সে-কথা জেনেই পূর্বোক্ত বৃক্ষশাখায় দড়ি বেঁধে নরখাদকের মৃত্যুফঁদ সাজিয়েছে জাদুকর মাতুংগো।

চফু-মায়া সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা পোষণ করলেও তার যন্ত্রণা দেখে ব্যথিত হলেন আত্তিলিও। তিনি স্থির করলেন জলের উপর আহত কুমিরটা একবার মাথা তুললেই তিনি গুলি চালিয়ে তাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দেবেন।

আচম্বিতে নদীর বুক থেকে ছিটকে এল রক্তাক্ত জলের ধারা আত্তিলিওর দিকে, সচমকে এক লাফ মেরে সরে গেলেন তিনি। ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত জলের ধারাটা নদীতটে নিঃশেষ হয়ে যেতেই আবার এগিয়ে গেলেন আত্তিলিও। কিন্তু রাইফেল তুলে ধরার আগেই তার চোখে পড়ল নদীর জলে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি! সেই জীবন্ত ও চলন্ত কাষ্ঠখণ্ডগুলোর স্বরূপ-নির্ণয় করতে আত্তিলিওর ভুল হল না–আহত চফু-মায়ার দিকে ধেয়ে আসছে কুমিরের দল! দীর্ঘকাল ধরে নদী ও জলের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছে যে শয়তান, ছিনিয়ে নিয়েছে জাতভাইদের মুখের গ্রাস বারংবার সে আজ অসহায় বুঝে প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসছে কুমিরের ঝক; চফু-মায়ার মৃত্যুযাতনা তারা উপভোগ করতে চায়, তার দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে তারা আজ বসাতে চায় ভোজের আসর!

দ্রুত, অতি দ্রুতবেগে এগিয়ে আসতে লাগল হিংস্র সরীসৃপের দল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আত্তিলিও তাকিয়ে রইলেন সেই মাংসলোলুপ মিছিলের দিকে। চফু-মায়া তখনও কাবু হয়নি, প্রবল বিক্রমে সে তখনও ছুরি আর দড়ির মারাত্মক বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে হঠাৎ দলের ভিতর থেকে একটা দুঃসাহসী কুমির এগিয়ে এসে কামড়ে ধরল চফু-মায়ার লেজ!

ওই ঝটাপটির মধ্যে লক্ষ স্থির করা খুবই কঠিন, তবু আত্তিলিও রাইফেল তুলে নিশানা করতে সচেষ্ট হলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে লাঙ্গুলের উপর দন্তাঘাতের যাতনা অনুভব করে চফু-মায়া এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে জল থেকে ছিটকে উঠল শূন্যে!

বাওয়ানা!

আত্তিলিওর কানে এল উদবিগ্ন কণ্ঠের আহ্বান। মুহূর্তের জন্য তার পার্শ্বদেশে কী-যেন-একটা বস্তুর আঘাত অনুভব করলেন তিনি। অজ্ঞাতসারে তার মাংসপেশি সংকুচিত হল, আঙুলের চাপ পড়ল রাইফেলের ট্রিগারের উপর সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে অগ্নিউদগার করে হাত থেকে ঠিকরে বেরিয়ে গেল রাইফেল। দোদুল্যমান রঞ্জু এবার তার পাঁজরের উপর থেকে সরে এসে আঘাত করল পায়ের উপর পরক্ষণেই ধনুক-ছাড়া তিরের মতো আত্তিলিওর দেহ এসে পড়ল কুম্ভীরসংকুল নদীগর্ভে!

পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি ডুবে গেলেন। কয়েক মহূর্তের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন নদীর তলদেশে। চটচটে কাদার মারাত্মক বন্ধন থেকে নিজেকে কোনোরকমে মুক্ত করে আত্তিলিও ভেসে উঠলেন, তারপর তীরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।

জল এখন চিবুক পর্যন্ত। কিন্তু আত্তিলিও আর অগ্রসর হওয়ার সাহস পেলেন না। তার চারদিকে ঘুরছে কুমিরের দল, এখন পর্যন্ত তারা যে আত্তিলিওকে আক্রমণ করেনি এটাই আশ্চর্য। আত্তিলিওর মনে হল দারুণ আতঙ্কে তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। সেটা বরং ভালো, আত্তিলিও ভাবলেন, মৃত্যুর আতঙ্কের চাইতে মৃত্যু অনেক ভালো। এখন ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ততই মঙ্গল…

জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে প্রায় নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়েছিলেন আত্তিলিও, হঠাৎ তার মনে পড়ল নগুরা-গুরার কথা। আফ্রিকার এক আদিম মানুষ যদি ভয়কে জয় করে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে পারে, তবে মহাযুদ্ধের সৈনিক হয়ে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি কি ক্লীবের মতো মৃত্যুর মুখে আত্মসমর্পণ করবেন? কখনোই নয়।

আত্তিলিও আবার অগ্রসর হলেন তীরভূমির দিকে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই একটা পাথরের উপর তার পা পড়ল। জল এখন কাঁধের নীচে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন আত্তিলিও। সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারলেন কেন কুমিরগুলো তাকে আক্রমণ করেনি। চফু-মায়া এখনও লড়াই করছে। দোলা ছুরির নিষ্ঠুর দংশন চফু-মায়ার শক্তিশালী চোয়াল দুটিকে অকেজো করে দিয়েছে বটে, কিন্তু কাটা-বসানো লেজের চাবুক হাঁকড়ে সে আক্রমণকারী শত্রুকুলকে বাধা দিচ্ছে বিপুল বিক্রমে। কুমিরের দল এখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত, তুচ্ছ একটা মানুষকে নিয়ে তারা মাথা ঘামাচ্ছে না–আগে চফু-মায়া, তারপর…।

স্টেডি, বাওয়ানা, মাথার উপর থেকে ভেসে এল কাপালালোর কণ্ঠস্বর, স্টেডি।

সচমকে মুখ তুলে আত্তিলিও দেখলেন তার মাথার উপর একটা গাছের ডালে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে কাপালালো–ডালটাকে নীচু করে আত্তিলিওর নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে সে প্রাণপণে। তার পিছনে ঘন পাতার আড়ালে বসে রয়েছে আরও দুটি মানুষ। তাদের মধ্যে একজন শক্ত মুঠিতে কাপালালোর দুই পায়ের গোড়ালি ধরে রেখেছে এবং তার পশ্চাত্বর্তীর হাতের মুঠিতে রয়েছে পূর্ববর্তী মানুষটির পা। আত্তিলিওর সঙ্গে সেই জীবন্ত শিকলের প্রথম সংযোগস্থল হচ্ছে কাপালালো। খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তিনটি মানুষের আলিঙ্গনে-আবদ্ধ জীবন্ত শৃঙ্খল, আরও ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগল বৃক্ষশাখা জলের দিকে…

এইবার, কাপালালো বলল, যতটা সম্ভব উঁচু হয়ে গাছের ডালটা ধরো বাওয়ানা। তারপর অপেক্ষা করো।

শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আত্তিলিও লাফালেন। ডালটা ধরে ফেললেন তিনি। ডাল ধরলেও শরীরটাকে উপরে তোলা সম্ভব হল না, তাঁর অবশ দেহ আবার ঝুলে পড়ল নীচের দিকে। কিন্তু হাতের আঙুলগুলো লোহার সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল ডালটাকে। আত্তিলিওর দেহের ওজন সেই আঙুলের বাঁধনকে শিথিল করতে পারল না।

রেডি!

কাঁধের সন্ধিস্থলে একটা তীব্র যাতনা অনুভব করলেন আত্তিলিও। পরক্ষণেই অভিশপ্ত নক্ৰসংকুল নদীগর্ভ থেকে তার দেহটা প্রবল আকর্ষণে শূন্যে উঠে এল! কাপালালো আর তার দুই সঙ্গী তাকে কী করে উদ্ধার করেছিল এবং জলের উপর দোদুল্যমান সেই বৃক্ষশাখায় ভারসাম্য বজায় রেখে কোন প্রক্রিয়ায় আত্তিলিওর অচেতন শরীরটাকে তারা শক্ত মাটির নিরাপদ আশ্রয়ে নামিয়ে এনেছিল সেই রহস্য আত্তিলিওর কাছে আজও অজ্ঞাত কারণ, নিগ্রোরা যখন তার উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত, তিনি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সব ভালো যার শেষ ভালো

এটা নাইনির গয়না, হাতির দাঁতের তৈরি, একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন আত্তিলিও, আর এই তামার ব্রেসলেট হল নাইনির বোনের সম্পত্তি। ওই ক্রস হচ্ছে পাদ্রী সাহেবের জিনিস। ।

আচ্ছন্নের মতো শুয়ে শুয়ে কথাগুলো শুনতে পেলেন আত্তিলিও। তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? স্বপ্ন কি কথা কয়? অতি কষ্টে চোখের পাতা মেলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলেন তিনি। একটা চোখ খুলল। আরেকটা খুলল না, কারণ সেই চোখটার উপর লাগানো ছিল ব্যান্ডেজ গোছের একটা আবরণ। যে-কণ্ঠস্বর মগ্নচৈতন্যের দ্বারে আঘাত করে আত্তিলিওর চেতনা ফিরিয়ে এনেছিল, সেই কণ্ঠস্বরের মালিককে সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মধ্যেও চিনতে পারলেন আত্তিলিও –মাতুংগো!

কাপালালোকেও সেখানে দেখতে পেলেন আত্তিলিও। তার তাঁবুর মধ্যে তারই বিছানার কাছে মাটির উপর দুজনে বসে ছিল। একটা ক্যানভাসের উপর পড়ে ছিল কয়েকটা জলে-ভেজা জিনিস। মেয়েদের দুটি অলংকার। একটা ক্রস। একটা পুরানো ধরনের ক্যামেরার লেন্স। একটা মস্ত সোনার ঘড়ি এবং ঘড়ির সঙ্গে আটকানো একটা ভারী সোনার চেন ইত্যাদি…

বাওয়ানা এইবার আমাদের কথা বিশ্বাস করবে। মাতুংগো বলল, সে যখন দেখবে নগুরা-গুরা চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে এই জিনিসগুলো উদ্ধার করেছে তখন আর আমাদের কথা সে অবিশ্বাস করতে পারবে না।

সে এই জিনিসগুলিকেও স্বচক্ষে দেখবে। কাপালালো বলে উঠল এবং তার হাত থেকে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি দ্রব্য এসে পড়ল মাটিতে রাখা ক্যানভাসের উপর। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা জিনিস হাতির দাঁতে তৈরি, কতকগুলো আবার ধাতব বস্তু। ওই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে নরভুক কুম্ভীরের অপরাধের অকাট্য প্রমাণ। বছরের পর বছর ধরে ওই জিনিসগুলো জমেছে ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতার উদর-গহ্বরে।

কিন্তু–আত্তিলিও জানতে চাইলেন, কুমিরগুলো কি চফু-মায়াকে খেয়ে ফেলেনি? জিনিসগুলো পাওয়া গেল কী করে?

কাপালালো আর মাতুংগো চমকে উঠল। তারা বুঝতেই পারেনি কখন আত্তিলিওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। এবার দুজনেই হেসে ফেলল।

তোমার বন্দুকের আওয়াজ শুনে গ্রামের সব লোক দৌড়ে এসেছিল, কাপালালো বলল, তারাই তোমাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। আর দড়ি ধরে টেনে চফু-মায়ার ছিন্নভিন্ন দেহটাকে তারাই তুলে এনেছে ডাঙার উপর। চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে যে জিনিসগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো এখন নগুরা-গুরার সম্পত্তি। কাল সে জিনিসগুলো গ্রিক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করবে। ওগুলোর বদলে সে পাবে অনেকগুলো ছাগল।

কিছুদিন আগে মাতুংগো একটা কথা বলেছিল। সেই কথাটা হঠাৎ এখন আত্তিলিওর মনে পড়ল, যমজ বোনদের আত্মা ওদের পিতাকে খুশি করবে। ওই আত্মা দুটির কল্যাণে পিতার ধনসম্পদ বাড়বে, বৃদ্ধ বয়সে সে খুশি হবে।

মাতুংগো বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না। কাপালালোকে ঠেলে সরিয়ে দিল সে। এটা পান করো, সযত্নে আত্তিলিওর মাথাটা তুলে ধরে একটা কাঠের পাত্র তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল মাতুংগো।

কৃতজ্ঞচিত্তে তরল ওষুধটা পান করে ফেললেন আত্তিলিও। পানীয়টা বলকারক এবং মশলার গন্ধে পরিপূর্ণ।

ঘুমাও,মাতুংগো বলল। আত্তিলিওর মাথাটা সে আবার ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল বালিশের উপর।

ঘুমাও, বাওয়ানা, কাপালালো বলল, আর ভয় নেই। সব ভালো যার শেষ ভালো।

বৈশাখ ১৩৮০