দেবীদর্শন

পঞ্চম পরিচ্ছেদ — দেবীদর্শন

স্তব্ধ বিস্ময়ে আগন্তুক তাকিয়ে রইল রমণীর মুখের দিকে সেই মুখ সুন্দর কি অসুন্দর সেই প্রশ্ন মনে আসে না, আয়ত দুই নয়নের দৃষ্টি স্নেহ ও কৌতুকে স্নিগ্ধ, মৃদু হাসিতে বাঁকা ওষ্ঠাধরে অগাধ প্রশ্রয়ের আভাস–দুরন্ত শিশুর কাণ্ড দেখে মায়ের মুখে বুঝি এমন হাসিই ফুটে ওঠে– অনির্বচনীয় সেই মুখের বুঝি তুলনা নেই!

নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল দেবীর কৌতুকজড়িত কণ্ঠ, কী দেখছ?

মনে হয়, মনে হয়

কী মনে হয়?

না, মানে ইয়ে,আগন্তুক মাথা নীচু করে, আপনাকে দেখে ডাকাত বলে মনে হয় না, তাই : ইয়ে অর্থাৎ

দেবী হাসল, ডাকাত তো আমি নই।

আগন্তুক এবার মুখ তুলে দেবীর দিকে চাইল, কিন্তু আপনি তো ডাকাতি করেন। কর্তামশাইয়ের কাছেও

হ্যাঁ, টাকা চেয়েছি। কিন্তু কেন? তোমার কর্তামশাই আর তারই মতো কিছু জমিদার আর সুদখোর মহাজন গরিব মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে, ওই গরিবদের শ্রমের ফলভোগ করে নির্লজ্জের মতো আমি ওই রক্তচোষা জমিদার আর সুদখোরদের যম। গরিবের লুঠ-করা টাকা আমি গরিবদের মধ্যেই বিলিয়ে দিই, বুঝলে? এটাকে যদি ডাকাতি মনে করো তবে আমি ডাকাত।

এসব কথা আমি জানতুম না। কিন্তু মা-ঠাকরুন, আপনি ভুল করছেন। আমাদের কর্তামশাই আর সকলের মতো নন।

দেবী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, ভূষণ এদিকে এসো!

 দস্যুদলের ভিতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল, কী বলছ মা?

বলো, জমিদার কালীচরণ তোমার কী অবস্থা করেছে।

 পাইক দিয়ে আমার জমি থেকে আমায় উঠিয়ে দিয়েছে। যেতে রাজি হইনি বলে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তুমি আশ্রয় না-দিলে বউ-ছেলে নিয়ে আমায় পথে দাঁড়াতে হত।

আগন্তুক ভূষণের চোখে দিকে চাইল, কর্তামশাই তোমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে কেন?

জমিদারের জমিতে বেগার খাটতে রাজি হইনি, তাই। কিছু খাজনাও বাকি ছিল, কিন্তু

কর্তামশাই তোমায় বেগার খাটতে বলেছিল?

না। নায়েবমশাই বলেছিল।

পাইক কে ছিল? বাঘা, করিম, এমতাজ?

না, ওরা নয়। নারদ সর্দারের দল।

তুমি কর্তামশাইয়ের কাছে যাওনি, কেন?

নায়েবমশাই বলেছিল কত্তার হুকুমেই সব হচ্ছে। আরও বলেছিল তাকে বিরক্ত করলে মুণ্ডুটা ধড়ে থাকবে না।

আগন্তুক এবার দেবীর দিকে চাইল, আপনি ঠিক বিচার করেননি মা। নায়েবই এসব করেছে। কর্তামশাই কিছু জানেন না। নায়েব অঘোর বসু খুব খারাপ লোক। ও-ই নারদ সর্দারের দলকে ওই জুটিয়েছে। পুরানো লাঠিয়ালরা কর্তার হুকুম ছাড়া কারো ভিটেয় হাত দেবে না।

হতে পারে কালীচরণ ভালো মানুষ, এসবের কিছু জানেন না, দেবীর জ্ব কুঞ্চিত, কিন্তু তার জমিদারিতে প্রজার উপর হামলা হলে তাকেই সবাই দোষ দেবে।

তা ঠিক, আগন্তুক সায় দিল, গিন্নিমা মারা যাওয়ার পর কর্তা যেন কেমন হয়ে গেছেন। কোনো কিছুই দেখেন না।

তোমরা তার প্রজা, তোমাদের তো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। একটা ভূষণ তোমায় দেখালুম, কিন্তু এর মতো আরও অনেক মানুষকেই বিনা অপরাধে ভিটে থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তোমরা গাঁয়ের জোয়ান ছেলে–তোমরা থাকতে নায়েব এমন অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে যাবে? তোমরা তবে আছ কী করতে?

আগন্তুক জবাব দেওয়ার আগেই ভূষণ বলল, ওকে ওসব কথা বলে লাভ নেই মা! আজ যদি ওর বাপ বেঁচে থাকত তাহলে কার সাধ্যি আমায় ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে?

আগন্তুকের নতদৃষ্টি ভূষণের মুখের উপর পড়ল, বাপ বেঁচে থাকলে টাকা আদায় করা অত সহজ হত না রে ভূষণ।

ভূষণ বলল, টাকা চাইবার কারণটাও যে ঘটত না, সে-কথা ভুলিস না নীলে।

দেবী একটু অবাক হয়ে বলল, এর নাম বুঝি নীলে? ওর বাবা বুঝি খুব ওস্তাদ লাঠিয়াল ছিল?

এবার শুধু ভূষণ নয়, দলের মধ্যে অনেকগুলো কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠল, ওর নাম নীলে নয়, নীলকণ্ঠ। ওর বাপ বদন সর্দার ছিল দারুণ লেঠেল। লাঠি নিয়ে দাঁড়ালে এক-শো জোয়ানের মহড়া নিতে পারত।

ভূষণ বলল, নীলু কিন্তু বাপের মতো হয়নি মা। নায়েবের অত্যাচার ও রুখবে কেমন করে? বাঁশি বাজিয়ে আর গান গেয়ে তো অঘোর বসুর মতো পাজি নায়েবকে শায়েস্তা করা যায় না মা।

ওর নাম নীলকণ্ঠ?… ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! ও আবার বাঁশি বাজায়, গান গায়?… ভাবা যায় না।

একজন দস্যু প্রশ্ন করল, কেন ভাবা যায় না?

বদন সর্দারের ছেলের নাম নীলকণ্ঠ! দেবী হাসল, তোমার নাম কে রেখেছিল নীলু?

আজ্ঞে গ্রামের ব্রাহ্মণ শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুর। উনি আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমি একেবারে মুখ নই।

তোমার কথা শুনে তা বোঝা যায়। গান, অভিনয় এগুলো খুবই ভালো জিনিস, কিন্তু দরকারে লাঠিও ধরতে হয়। তোমাদের গ্রামে একটা নায়েব প্রজাদের উপর জুলুম করবে আর তোমরা সেটা সহ্য করবে?

আমি কিছুই জানতাম না।

 কথাটা ঠিক, ভূষণ বলল, কিন্তু জানলেই-বা কী করবে ও? নীলেটা বাপের নাম ডোবাল, অমন জোয়ানের বেটা এমন ভেড়া হয় ভাবতে পারি না।

যাই বল ভূষণ, দেবী হাসল, ও যদি ভেড়া হয়, তাহলে ওর শিং-এর গুঁতোটা যে খুবই সাংঘাতিক এ-কথা আমাদের রঙ্গলাল অন্তত স্বীকার করবে। কী বলো রঙ্গলাল?

লাঠি হাতে যে-লোকটি প্রথমেই ঘাড়ের উপর আগন্তুকের রদ্দা খেয়ে মাটি নিয়েছিল, তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল। মনের ভাব গোপন করার জন্য সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

দলের ভিতর থেকে একটি লম্বা-চওড়া জোয়ান সামনে এগিয়ে এল, মাঠান যদি অনুমতি করেন তো একটা কথা বলি।

দেবীর ভ্রু কুঞ্চিত হল, তুমি তো নতুন এসেছ কৈলাস? বোধ হয় মাস দুই হবে, তাই না? তোমার সম্পর্কে কিছু কিছু নালিশ আমার কানে এসেছে। শুনেছি তুমি ভারি ওস্তাদ লাঠিয়াল, কিন্তু এখানকার ব্যাপার আলাদা। নালিশগুলো সম্পর্কে আমি খোঁজখবর করছি। যা শুনেছি তার সবটুকু না হোক, যদি কিছুটাও সত্যি হয়, তাহলে তোমার কাঁধের উপর মাথাটা নাও থাকতে পারে বুঝেছ?

কৈলাসের মুখ-চোখ বিবর্ণ হয়ে গেল, আমার নামে যদি কেউ মিথ্যে করে লাগায়, তাহলেও আমায় শাস্তি পেতে হবে? এই কি আপনার বিচার?

মিথ্যে হলে শাস্তি পাবে না। সত্যমিথ্যা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। তোমায় দেখে কথাটা মনে পড়ে গেল, তাই সাবধান করে দিলাম। যাই হোক–কী যেন বলছিলে তুমি?

সর্দার ওই ছোঁড়াটার হাতের মারে মাটি নিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন তেমন জোয়ানের পাল্লায় পড়লে ওই দুধের বাচ্চাটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না, অনেক আগেই মাটিতে শুয়ে পড়ত।

তেমন তেমন জোয়ানটা কি তুমি নাকি? দেবী কঠিন স্বরে বলল, রঙ্গলালকে আমি তোমার চেয়ে ভালো করে চিনি। আমি যখন থাকব না, সেই সময় একবার রঙ্গলালকে ঘাঁটিয়ে দেখ।

মা এই লোকটা নতুন এসেছে, কিন্তু ওর চালচলন দেখলে মনে হয় ও-ই যেন দলের সর্দার।

রঙ্গলাল বলল, কী বলব মা, তোমার সামনে তো গরম দেখাতে পারি না, যদি অনুমতি দাও তাহলে এই বেআদব লোকটাকে কিছু আদব শেখাতে পারি।

দেবী উত্তর দেওয়ার আগেই নীলকণ্ঠ কৈলাস নামে লোকটার সামনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, দেখি! দেখি! ওটা একবার দেখি!

পরক্ষণেই তার ডান হাত কৈলাসের গলায় আছড়ে পড়েই ফিরে এল একটা শব্দ হল : ফট! ছিন্নহারের সঙ্গে সংলগ্ন তাবিজটাকে চোখের সামনে তুলে ধরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, এই তাবিজ তুমি কোথায় পেলে?

উত্তর এল লাঠির মুখে। সজোরে নীলকণ্ঠের মাথায় আঘাত হানল কৈলাস। সেই লাঠি মাথায় পড়লে নীলকণ্ঠ তখনই মারা পড়ত, কিন্তু চকিতে বর্শা তুলে আঘাত রুখে দিল দেবী চোখের পলক ফেলার আগেই আবার ঘুরল বর্শা, মুহূর্তের মধ্যে ধারালো ফলা কৈলাসের কণ্ঠনালি স্পর্শ। করল, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র কণ্ঠের আদেশ, কৈলাস। লাঠি ফেলে দাও, নইলে

নইলে কী ঘটবে সেটা আর বলতে হল না, কৈলাসের হাতের লাঠি খসে পড়ল মাটির উপর। শুধু কৈলাস নয়, নীলকণ্ঠের বুকের ভিতরেও আতঙ্কের বিদ্যুৎ-শিহরন তুলে দিল সেই আদেশবাণী। জীবনে সর্বপ্রথম নীলকণ্ঠ বুঝল রমণীর কণ্ঠস্বর সবসময় খুব রমণীয় হয় না!

কঠিন স্বরে দেবী বলল, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। আমার সামনে তুমি একটা মানুষের মাথায় লাঠি চালিয়ে দিলে!

সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। দেবী আবার বলল, তুমি কি জানো না অনর্থক রক্তপাত আমি পছন্দ করি না? আমার দলে বিনা প্রয়োজনে কেউ খুনোখুনি করলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।

কিন্তু মা-ঠাকরুন, নীলকণ্ঠ হঠাৎ বলে উঠল, আত্মরক্ষার অধিকার তো সকলেরই আছে।

অবাক হয়ে দেবী বলল, তা আছে। কিন্তু তুমি তো কৈলাসকে আক্রমণ করনি, আত্মরক্ষার প্রশ্ন আসে কী করে?

আসে মা ঠাকরুন, আসে, নীলকণ্ঠের মুখে অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটল, এই তাবিজটা ও কোথায় পেল সে-কথা বলতে হলেই আরও অনেক পুরোনো কথা উঠবে। আমি আপনাকে প্রথম দেখলাম–তবু এইটুকু সময়ের মধ্যে আপনাকে যতটুকু বুঝেছি, তাতে মনে হয় এই তাবিজের ঘটনা জানার পর আপনার দলে ওর স্থান তো হবেই না, উপরন্তু কিছু বাড়তি দুর্ভোগও ওর বরাতে জুটতে পারে। তাই আমার মুখ চটপট বন্ধ করার জন্যই কৈলাস ফট করে লাঠি চালিয়ে দিয়েছে, দারুণ ভয়ে আগুপিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ওর ছিল না।

বটে? বর্শার ফলা সরে গেল কৈলাসের গলা থেকে, তাহলে তো এই তাবিজের ব্যাপারটা আমাকে জানতেই হয়। এটা যদি কৈলাসের সম্পত্তি না হয়, তাহলে এর আসল মালিক কে?

তাবিজের আসল মালিক বেঁচে নেই, মা-ঠাকরুন।

তুমি তাকে জানতে?

জানতুম।

কে সে?

 বদন সর্দার। আমার বাবা।

মাঠের মধ্যে তখন বোধ হয় ছুঁচ পড়লেও শব্দ শোনা যায়… হঠাৎ নীরবতা ভেঙে দেবী বলল, তাবিজটা আমার হাতে দাও।

কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে দেবী বলল, তাবিজটা যদি তোমার বাবার হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি ওটা পাবে। কিন্তু এটা তো পিতলের তৈরি খুব সাধারণ জিনিস, কৈলাস এটা চুরি করবে কেন?

কৈলাস কিছু বলতে যেতেই দেবী উগ্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, চুপ করো। সময় যখন আসবে তখন তোমার কথাও আমি শুনব। এখন কোনো কথা কইবে না।

ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল কৈলাস। নীলকণ্ঠ বলল, জিনিসটা খুব সাধারণ নয়। কৈলাস ওটা চুরি করেনি, বাবাকে খুন করে গলা থেকে খুলে নিয়েছিল।

এই সামান্য জিনিসের জন্য মানুষ খুন করেছে কৈলাস?–না, না, এ-কথা বিশ্বাস করা যায় না।

মা ঠাকরুন, এটা সামান্য জিনিস নয়, নীলকণ্ঠ বলল, সব কথা শুনলেই আপনি বুঝবেন। এই তাবিজটা কর্তামশাইয়ের ঠাকুরদার ঠাকুরদা পেয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী নাকি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন, তিনি বলেছিলেন এই তাবিজ যার কাছে থাকবে সে কখনো কোনো লড়াইতে হারবে না।

জনতার ভিতর থেকে একাধিক কণ্ঠ সাড়া দিল, হ্যাঁ, হা এ-কথা আমরাও শুনেছি। কালীচরণ চৌধুরির ওই তাবিজের কথা অনেকেই জানে। চৌধুরি কত্তাদের সকলেই খুব বেপরোয়া মানুষ ছিলেন, জমির দখল নিয়ে তারা অনেক লাঠালাঠি খুনোখুনি করেছেন কিন্তু কখনো কোনো দাঙ্গা-কাজিয়ায় তারা হারেননি, সবসময়ই জিতেছেন। লোকে বলে ওই তাবিজ যতদিন কাছে থাকবে, ততদিন চৌধুরি বংশের কেউ লড়াইতে হারবে না। তবে তাবিজটা যে বদন সর্দারের কাছে গেছে এমন খবর আমাদের জানা নেই।

বামাচরণ! শিবু কাকা!… তোমাদের তো আমি চিনি, নীলকণ্ঠ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তোমরাও মা-ঠাকরুনের দলে যোগ দিয়েছ!… যাক গে, যে-কথা বলছিলাম–হ্যাঁ, তাবিজটা যে বাবাকে কর্তামশাই দিয়েছিলেন সে-কথা অনেকেই জানে না। জানার কথাও নয়। তাবিজটা কী করে কর্তামশাইয়ের গলা থেকে বাবার গলায় এল সেই ঘটনা এখন বলছি, শোনো। একদিন শিকারে গিয়ে কর্তামশাই একটা বুনো শুয়োরকে গুলি করেন। শুয়োর মরল না, জখম হল। চোট খেয়ে পালানোর চেষ্টা না-করে সে তেড়ে এল কর্তামশাইয়ের দিকে। কর্তামশাই আবার গুলি করলেন। গুলি গেল ফসকে। শুয়োর সেদিন কর্তামশাইকে মেরেই ফেলত, কিন্তু আমার বাবা লাঠি চালিয়ে শুয়োরের দুটো ঠ্যাং ভেঙে দেয় বলে কর্তামশাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তারপর নতুন করে বন্দুকে গুলি ভরে শুয়োরটাকে মারলেন কর্তামশাই আর তাবিজটা নিজের হাতে খুলে বাবার গলায় পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে ওই তাবিজটা সর্বদা বাবার গলায় থাকত, কিন্তু বাবাকে যখন খুন করা হয়

বাধা দিয়ে দেবী বলল, তোমার বাবাকে কে খুন করেছিল? কৈলাস?

খুনিকে কেউ দেখতে পায়নি, নীলকণ্ঠ বলল, আমি সেদিন গোঁসাইজির ঘরে বসে বাঁশি বাজাচ্ছি, হঠাৎ খবর পেলাম ভিনগাঁয়ের পথে আমার বাবা জখম হয়ে পড়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম বাবার চোট সাংঘাতিক, বাঁচার আশা নেই। বাবার কাছে শুনলাম ঝোপের আড়াল থেকে কেউ সড়কি ছুঁড়ে মেরেছে। বাবা যখন ডুয়ে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, তখন একটা লোক ঝোপ থেকে বেরিয়ে তাবিজটা বাবার গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাবা মরার আগে আমায় গান-বাজনা নিয়েই থাকতে বলেছিল–বলেছিল খুনোখুনি রক্তারক্তির পথ ছেড়ে দিতে। বাবার আদেশ মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু আজ এই তাবিজটা দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেছে। মা ঠাকরুন, আপনি বিচার করুন–যে-লোক আড়াল থেকে সড়কি ছুঁড়ে মানুষ মারে তার কেমন সাজা হওয়া উচিত?

কৈলাসকে জিজ্ঞাসা করলে সত্যি কথা জানা যাবে না, দেবীর ললাটে জাগল কয়েকটা রেখা, কিন্তু শুধু তাবিজটা হাতানোর জন্য তোমার বাবাকে খুন করবে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

বাবার অনেক শত্রু ছিল। হয়ত কখনো কৈলাস বাপের হাতে মার খেয়েছে, অথবা অপমান হয়েছে। হয়তো কোনো শত্রু বাপকে খুন করার জন্য কৈলাসকে টাকা খাইয়েছে–আসল ব্যাপার তো জানার কোনো উপায় নেই। আরও অনেকের মতো কৈলাসও নিশ্চয় তাবিজের ক্ষমতার কথা শুনেছে। বাপকে ঘায়েল করার পর তাবিজ হাতানোর সুযোগটা সে ছেড়ে দেয়নি।

তোমার যুক্তি উড়িয়ে দেওয়া যায় না, দেবী এবার কৈলাসের মুখের উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, কৈলাস, এই তাবিজ তোমার হাতে এল কেমন করে?

ইয়ে-এই-মানে, হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল কৈলাস, এই তাবিজটা তো আমার। অনেকদিন হল পরছি। ছোঁড়াটা যদি এটা ওর বাবার জিনিস বলে দাবি করে, অমনি ওর কথাটা সত্যি হয়ে যাবে? মা, আপনি তো কখনো অবিচার করেন না–বলুন, এটা যে ওর বাবার জিনিস তেমন কোনো প্রমাণ আছে? একরকম দেখতে দুটো তাবিজ কি হয় না?

দেবীর ললাটে অনেকগুলো রেখার সৃষ্টি হল, কৈলাস, তুমি ভালো ফন্দি এঁটেছ। হ্যাঁ, একরকম দেখতে দুটো জিনিস হতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস জিনিসটার আসল মালিক বদন সর্দার।

শুধু আপনার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমায় সাজা দিলে কি সুবিচার হবে?

জনতা স্তব্ধ। দেবীর মুখে রুদ্ধ রোষের আভাস। শয়তান কৈলাস ভালো যুক্তি দেখিয়েছে সত্যিই তো, ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কারো দণ্ডবিধান করলে তাকে কিছুতেই সুবিচার বলা চলে না।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল নীলকণ্ঠ, এটা যে বাবার তাবিজ এই মুহূর্তে সেটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কর্তামশাইয়ের কাছে গেলে হয়তো প্রমাণ হয়ে যেত তাবিজটার আসল মালিক কে ছিল। কিন্তু সেটাও তো অসম্ভব। তবে কৈলাস, তুমি যে একটু আগে হঠাৎ লাঠি চালিয়ে আমার মাথাটা ফাঁক করে দিচ্ছিলে, সেটা সবাই দেখেছে। মা-ঠাকরুন বল্লম তুলে রুখে না-দিলে আমি এতক্ষণে যমরাজার কাছে পৌঁছে যেতাম। কাউকে সতর্ক না-করে তার মাথায় হঠাৎ লাঠি চালানো কি অপরাধ নয়? মা-ঠাকরুন, অন্তত এই অপরাধের বিচার তো আপনি করতে পারেন?

দেবী কঠিন দৃষ্টিতে কৈলাসের দিকে চাইল, হ্যাঁ, এই অপরাধের শাস্তি তো হতেই পারে।

আমি তৈরি ছিলাম না, ও আমায় লাঠি চালিয়ে খুন করতে গিয়েছিল, নীলকণ্ঠ বলল, একবার বলে-কয়ে আমার মাথায় লাঠি মারতে বলুন, দেখি ও কেমন মরদ!

রঙ্গলাল হঠাৎ বলে উঠল, এই কথাটা আমার মনে ধরছে। কৈলাস তো একটু আগেই বলছিল আমার মতো দুবলা মানুষ বলেই দুধের বাচ্চার হাতের মারে মাটি নিয়েছে, তেমন তেমন জোয়ান হলে নাকি ওই বাচ্চাটাকে মাটিতে শুইয়ে দিত। আমি একবার দেখতে চাই আমাদের কৈলাস কেমন জোয়ান। যার হাতের এক ঘায়ে রঙ্গলাল সর্দার মাটিতে ঠিকরে পড়ে, তার পাল্লায় পড়লে কৈলাসের কী হাল হয় সেটাই একবার দেখতে চাই আমি। অবশ্য মায়ের কথাই শেষ কথা। আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা জানিয়ে দিলাম।

সমবেত জনতা সাগ্রহে চিৎকার করে রঙ্গলালের প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। এখন শুধু দেবীর অনুমতির অপেক্ষা।

হাত তুলে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল দেবী, লাঠির মুখে বিচার আমি কখনো করিনি, তবে সবাই যখন চাইছে

হাতজোড় করে নীলকণ্ঠ বলল, মা ঠাকরুন, এই অনুমতিটা যদি দেন তাহলে আমি আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।

তাই নাকি? দেবীর মুখে কৌতুকের হাসি দেখা দিল, এত সহজে একটা মানুষকে যদি কেনা যায়, তাহলে তো অনুমতি দিতেই হয়। বেশ, সকলের মতের বিরুদ্ধে আমি যাব না–শুরু হোক লড়াই।

নীলকণ্ঠের হাতে তখনও রঙ্গলালের লাঠিটা ছিল, সেটা তুলে ধরে সে বলল, রঙ্গ সর্দার, তোমার লাঠিটা আমি কিছুক্ষণের জন্য ধার নিলাম। ওহে কৈলাস, মা যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন তোমার লাঠিটা মাটি থেকে তুলে নাও, দেখি তুমি কেমন মরদ।

একবার ডান দিকে পাঁয়তারা করল তারপর লাঠিটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁক দিল, তৈরি হয়ে নে নীলু। আবার বলিস না তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎ মেরেছে। এবার তোকে বলে-কয়েই মারছি–দেখ যদি সামলাতে পারিস।

এক ঝটকায় গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে প্রতিদ্বন্দীর দিকে ফিরে দাঁড়াল নীলকণ্ঠ, মশালের আলো ঝলমল করে উঠল পেশিবদ্ধ দেহের উপর চাদরের তলায় যে এমন একটি বর্ণচোরা আম লুকিয়ে ছিল সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি, হঠাৎ যেন খাপ থেকে বেরিয়ে এল একটা ধারালো তলোয়ার!

জনতার ভিতর থেকে ভেসে এল অস্ফুট প্রশংসার ধ্বনি। রঙ্গলাল সোৎসাহে বলে উঠল, এ যে রেয়াজি জোয়ান!… দুধের বাচ্চার চেহারাটা ভালো করে দেখে নে কৈলাস। তোর বরাত আজ খুবই খারাপ রে কৈলাস, খুবই খারাপ।

অল্পবয়সি ছেলেটাকে দেখে কৈলাস ভেবেছিল লাঠির এক ঘায়েই লড়াই ফতে করবে। ছেলেটার হাতের মারে রঙ্গলালকে পড়ে যেতে দেখে সে বিশেষ ঘাবড়ায়নি–দলের পুরোনো লোকদের মতো রঙ্গলালের ক্ষমতা সম্বন্ধে সে সচেতন ছিল না, ভেবেছিল যোগ্যতার জন্য নয়, দেবীর অনুগত পুরানো লোক বলেই বুঝি সর্দারি করছে রঙ্গলাল। কিন্তু নীলকণ্ঠের আবরণ-মুক্ত শরীরটা দেখেই সে বুঝতে পারল নিয়মিত রেওয়াজ বা চর্চা না-করলে এমন শরীর হয় না ছেলেটাকে দুধের বাচ্চা বলে অবজ্ঞা করা উচিত হয়নি।

তবে শরীরে যতই শক্তি থাক, এত অল্প বয়সে পাকা লাঠিয়ালের সঙ্গে লড়াই দেওয়ার ক্ষমতা বড়ো একটা হয় না। বেশিক্ষণ লড়াই চললে দমের লড়াইতেই ছেলেটা জিতে যেতে পারে, সেই সুযোগ দিতে রাজি নয় কৈলাস–

বাঁ-দিকে পাঁয়তারা করে এগিয়ে গেল সে, পলকে দিক পরিবর্তন করে বিকট হাঁক দিয়ে সে ডান দিকে ঘুরে গিয়ে সজোরে লাঠি হাঁকাল।

আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজের লাঠি তুলে সেই আঘাত রুখে দিল নীলকণ্ঠ, পরক্ষণেই প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে–

ঠক, ঠক, ঠকাস…সংঘাতে সংঘাতে কর্কশ শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল দুটি লাঠি। লাঠিয়ালদের স্পষ্ট করে দেখা যায় না, শুধু দুটি ঘূর্ণিত চক্র যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেষ্টন করে ঘুরতে থাকে নিষ্ঠুর আক্রোশে…

হঠাৎ আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল কৈলাস। নীলকণ্ঠের লাঠি আবার উঠল, আবার নামল… আবার আর্ত চিৎকার… মাটির উপর পড়ে ছটফট করতে লাগল কৈলাস! জনতা নিরাশ হল, যে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে কে জানত!

লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে নীলকণ্ঠ বলল, কৈলাস, আড়াল থেকে সড়কি ছুঁড়ে তুমি মানুষ মারতে পারো, আচমকা লোকের মাথায় লাঠি মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিতে পারো কিন্তু জোয়ান মরদের সঙ্গে সামনাসামনি লড়ার ক্ষমতা তোমার নেই। ইচ্ছে করলে এখনই তোমায় সাবাড় করতে পারতাম, করলাম না দয়া করে ছেড়ে দিলাম। তবে তোমার মতো লোক বহু মানুষের দুঃখের কারণ হতে পারে, তাই তোমার ডান হাত আর বাঁ-দিকের ঠ্যাংটাকে আমি বরবাদ করে দিলাম–বুঝেছ?

কৈলাসের কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না, দারুণ যন্ত্রণায় তার চৈতন্য তখন প্রায় অবলুপ্ত…

হাতের লাঠি নীরবে রঙ্গলালের হাতে তুলে দিল নীলকণ্ঠ, তারপর ফিরে দাঁড়াল দেবীর দিকে, মা, এবার আমি যাই?

যাবে? দেবী যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল, নীলকণ্ঠের গলার আওয়াজে তার সংবিৎ ফিরে এল, হ্যাঁ, এবার তোমার যাওয়ার সময় হয়েছে। তবে যাওয়ার আগে টাকার থলিটা তুলে নাও।

হ্যাঁ, মা, নীচু হয়ে নীলকণ্ঠ থলিটা তুলে নিল, এটা আপনার হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই, কিন্তু খুনিটার গলায় বাবার তাবিজ দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল, সব ভুলে গেলাম।

নীলকণ্ঠ থলিসমেত হাত বাড়িয়ে দিল দেবীর দিকে। দেবীর দুই চোখের দৃষ্টি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল তার মুখের উপর, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, থলিটা তুমি নিয়ে যাও, নীলকণ্ঠ। জমিদার কালীচরণ চৌধুরিকে বলবে টাকা আমি ফেরত দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে তার জমিদারিতে কোনো প্রজার উপর যদি অত্যাচার হয়, তাহলে তাকেই আমি দায়ী করব, আর সেদিন আমার রোষ থেকে তোমার লাঠিও তাঁকে বাঁচাতে পারবে না।

কী বলছেন মা! নীলকণ্ঠ চমকে উঠল, আপনার বিরুদ্ধে আমি লাঠি ধরব এমন কথা ভাবতে পারলেন? আপনি বল্লম তুলে বাধা না-দিলে কৈলাসের লাঠি আমার মাথাটা চুরমার করে দিত, সে-কথা আমি কোনোদিন ভুলব?

একটু থেমে সে আবার বলল, কিন্তু আপনার কাছে আমি অপরাধী। না-জেনে আপনাকে অসম্মান করেছি মা, আমায় ক্ষমা করুন।

দেবী বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠল, সে কী নীলকণ্ঠ, তুমি কখন আমায় অসম্মান করলে?

করেছি বই কী, নীলকণ্ঠের গলার স্বর দারুণ আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে এল, ঠাট্টা করে বলেছিলাম–দেবীদর্শন না হলে প্রণামী দেব না। তবু আমার কী ভাগ্য–ঠ্যাঙাড়ের মাঠে সত্যিই দেবীদর্শন করলাম। মা, প্রণামী তো নিলে না, সন্তানের প্রণামটা তো নেবে?

দেবী কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু তার মুখের মৃদু হাসিতেই মৌন সম্মতি বুঝে নিল নীলকণ্ঠ। নতজানু হয়ে সে হাত বাড়াল দেবীর পায়ের দিকে…

আকাশের দিকে তাকিয়ে রঙ্গলাল বলল, মা, চাঁদ যে ঢলে পড়ল। এবার বোধ হয় যাওয়ার সময় হয়েছে।

মাঠের উপর আবছা অন্ধকারে ভুবনডাঙা গ্রামের দিকে একটা চলমান ছায়ামূর্তি তখনও দেখা যাচ্ছে–সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দেবী বলল, হ্যাঁ, রঙ্গলাল, এবার আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। ভোরের আগেই বজরা ধরতে হবে।