শত্রু – প্রথম খণ্ড

সৈনিকের তৃতীয় অভিজ্ঞতা
শত্রু – প্রথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – আত্তিলিওর সঙ্গী

বর্তমান কাহিনিতে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার আগে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি বলেছেন, এই ঘটনা যদিও বহুদিন আগে ঘটেছে, তবু এখনও মহিষ শব্দটি যদি তিনি শোনেন অথবা উক্ত পশু সম্বন্ধে কোনো আলোচনা যদি তাঁর শ্রুতিগোচর হয়, তাহলে তাঁর সর্বাঙ্গের মাংসপেশি হয়ে যায় আড়ষ্ট–এখনও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে তিনি যেন শুনতে পান শত শত খুরের ভয়াবহ ধ্বনি, এখনও তার মানসপটে ভেসে ওঠে সেই ভয়ংকর দৃশ্য যেখানে প্রান্তরের উপর দণ্ডায়মান তার অসহায় দেহ লক্ষ করে ছুটে আসছে শত শত জীবন্ত বিভীষিকা, সম্মুখে অবস্থিত মনুষ্যমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করে মাটিতে মিশিয়ে দেবার জন্য…

এই ভীতিপ্রদ কাহিনি পরিবেশন করার আগে আফ্রিকার বুকে আত্তিলিওর প্রথম অভিজ্ঞতার বিবরণী পাঠকের দৃষ্টিগোচর হওয়া দরকার–ওই বিবরণ পাঠ করলেও পাঠক বুঝতে পারবেন আফ্রিকাবাসী বিভিন্ন জীবজন্তুর মধ্যে কেবল মহিষ নামক জীবটি সম্বন্ধে আত্তিলিওর বিদ্বেষমূলক মনোভাব নিতান্ত অকারণে সৃষ্ট হয়নি। কমান্ডার সাহেব তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, আফ্রিকাবাসী যাবতীয় মহিষকেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে শত্রু বলে মনে করেন। আফ্রিকার অরণ্যে পদার্পণ করার সঙ্গেসঙ্গেই মহিষ সম্বন্ধে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন আত্তিলিও। যে শোচনীয় ঘটনার ফলে পূর্বোক্ত শৃঙ্গধারী পশুটি সম্পর্কে আত্তিলিওর মনে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হয়েছিল, সেই ঘটনার বিশদ বিবরণীর মধ্যে বর্তমান কাহিনির শুরু।

আত্তিলিও গত্তির বয়স যখন কুড়ির কিছু বেশি, সেই সময়ে শিকার-কাহিনি, অভিযান-কাহিনি ও জীবজন্তু বিষয়ক প্রচুর পুস্তক পাঠ করে তার ধারণা হল ওইসব ব্যাপারে তার জ্ঞান সম্পূর্ণ। হয়েছে–এইবার একটা অভিযানে বেরিয়ে পড়লেই হয়। তিনি মনে করলেন কয়েকটা ঘোড়া, রাইফেল আর গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলেই আফ্রিকার দুর্গম অরণ্যে অভিযান শুরু করা যায়। অ্যাংলো ইজিপশিয়ান সুদানের অজ্ঞাত স্থানগুলোকেই অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছিলেন আত্তিলিও সাহেব। পরে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন পুথিগত বিদ্যা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মূল্য এক নয়।

একে অল্প বয়সের গরম রক্ত, তার উপর বিস্তর বই-টই পড়ে আত্তিলিও হয়ে পড়েছেন সবজান্তা–অতএব সকলের মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি উপস্থিত হলেন সুদানের খার্তুম নামক স্থানে। শুধু গন্তব্যস্থল সম্পর্কে পরিচিত মানুষের মতামত উপেক্ষা করেই ক্ষান্ত হননি আত্তিলিও, সকলের সাবধানবাণী তুচ্ছ করে তিনি মেলামেশা শুরু করলেন মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে। আত্তিলিওর শুভার্থীরা তাঁকে একবাক্যে ওই বিপজ্জনক লোকটির সংশ্রবে আসতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু স্বজান্তা আত্তিলিও কারো কথায় কান দিলেন না। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল মহম্মদ আলি এবং আত্তিলিও গত্তির সম্পর্ক হচ্ছে কায়ার সঙ্গে ছায়ার মতোই অবিচ্ছিন্ন, উপযুক্ত দুটি মানুষকে সর্বত্রই দেখা যায় একসঙ্গে।

খার্তুমের মানুষ মহম্মদ আলিকে ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদী বলেই মনে করত। তাদের ধারণা হচ্ছে উক্ত ব্যক্তি খার্তুম ছেড়ে কোথাও যায়নি, এবং সুদানের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যদি কেউ তার কাছে কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করতে যায় তবে সেই নির্বোধ তিব্বতের লামার বিষয়েও মহম্মদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করতে পারে–কারণ, মহম্মদ আলির কাছে সুদানের বন্যপ্রাণী আর তিব্বতের লামা দুই-ই সমান। দুটি বিষয়েই সে সমান অজ্ঞ।

আত্তিলিও কিন্তু স্থানীয় মানুষের কথা বিশ্বাস করেননি। তাঁর মতে মহম্মদ বাঁচাল বটে, কিন্তু মিথ্যাবাদী নয়। মহম্মদের মুখে যেসব ভয়ানক ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, সেইসব ঘটনা যে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ না হয়ে ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদীর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনাশক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এমন কথা আত্তিলিওর মনে আসেনি–মহম্মদ সম্পর্কে জনসাধারণের অভিমত ঈর্ষাকাতর মানুষের নিন্দা বলেই মনে করেছিলেন আত্তিলিও। সুতরাং আত্তিলিওর বিচারে শিকার-অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হল যে ব্যক্তি, তার নাম মহম্মদ আলি।

সমগ্র খার্তুমের মানুষ একদিন বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে দেখল, আত্তিলিও সাহেব মহম্মদ আলিকে তার পথপ্রদর্শকের কার্যে নিযুক্ত করেছেন। আত্তিলিও পরে জানতে পেরেছিলেন, কথার জাল বুনে চতুর মহম্মদ তাকে যে পারিশ্রমিক অর্থ দিতে রাজি করিয়েছিল, সেই টাকার অঙ্কটা ছিল যথেষ্টর চাইতেও বেশি। অবশ্য মহম্মদের পক্ষে পারিশ্রমিক অর্থ শেষ পর্যন্ত হস্তগত করা সম্ভব হয়নি।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মহম্মদ আলির মৃত্যু

ছয়জন স্থানীয় অধিবাসী নিয়ে গঠিত ছোটো দলটিকে নিয়ে ফাংপ্রভিন্স নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন আত্তিলিও। তিনি এবং মহম্মদ আলি ঘোড়ায় চড়ে দলের আগে আগে চলছিলেন। নির্দিষ্ট স্থানে এসে এক ব্যক্তির মুখে আত্তিলিও শুনলেন ওই অঞ্চলের সবচেয়ে আশ্চর্য দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে আটশো মহিষের একটি বিরাট দল। এমন প্রকাণ্ড দল বড়ো একটা দেখা যায় না। পূর্বোক্ত মহিষযূথকে স্বচক্ষে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করেছে মাত্র কয়েকটি লোক। তারা সকলেই একবাক্যে জানিয়েছে এমন চমকপ্রদ ও ভয়াবহ দৃশ্য কখনো তাদের চোখে পড়েনি। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন আত্তিলিও–শত শত অতিকায় মহিষ প্রায় এক মাইল স্থান ধরে সারিবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করেই তাঁর সর্বাঙ্গ হয়ে উঠল রোমাঞ্চিত! তিনি ঠিক করলেন যেভাবেই হোক ওই মহিষযূথকে তিনি একবার স্বচক্ষে দর্শন করবেন।

তাঁবুতে ফিরে তিনি লোকজনদের জানিয়ে দিলেন উল্লিখিত মহিষযুথের উদ্দেশে তিনি শীঘ্রই যাত্রা করবেন বলে মনস্থ করেছেন এবং ওই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যেকোনো বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে তিনি প্রস্তুত।

আত্তিলিওর ঘোষণা শেষ হতে-না-হতেই মোটবাহক, রাঁধুনি, ছোকরা-চাকর প্রভৃতি যে ছয়জন লোক দলে ছিল তারা সকলেই প্রাণপণে কণ্ঠস্বরের প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল! সেই তুমুল কোলাহলের মধ্যে তাদের বক্তব্য কিছুই বুঝতে পারলেন না আত্তিলিও। তিনি স্বয়ং এইবার চেঁচাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ তারস্বরে চেঁচিয়ে আত্তিলিও দলের মধ্যে স্তব্ধতার সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। তারপর তিনি মহম্মদ আলিকে ডেকে দলের লোকদের এমন অসংগত আচরণের কারণ জানতে চাইলেন।

মহম্মদ আত্তিলিওকে জানাল তার পরিকল্পনা শুনে উৎসাহিত হয়েই দলের মানুষ হঠাৎ কোলাহল করে উঠেছিল, অতএব ওই নিয়ে আত্তিলিওর আর চিন্তা করা উচিত নয়।

না, আত্তিলিও আর চিন্তা করেননি সেদিন এবং পরের দিন যখন তারা রওনা হলেন, তখনও দলের লোকদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর নিয়ে মাথা ঘামাননি আত্তিলিও–কিন্তু তিনদিন পরে এক মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতে উঠেই যখন তিনি আবিষ্কার করলেন মহম্মদ ছাড়া প্রত্যেকটি লোকই হঠাৎ তাবু থেকে অদৃশ্য হয়েছে, তখনই কয়েকদিন আগে কণ্ঠস্বরের তীব্র প্রতিযোগিতার কথা তার মনে হল এবং মহম্মদ আলি যে দলের লোকের উৎকণ্ঠার বিপরীত ব্যাখ্যা করে মনিবকে ধোঁকা দিয়েছে এ-বিষয়ে তার সন্দেহ রইল না একটুও।

মহম্মদকে ডাকলেন আত্তিলিও। দলের যাবতীয় মানুষ তাঁবু ছেড়ে উধাও হয়েছে এই খবর পাওয়ামাত্র যেন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল মহম্মদ আলি। তৎক্ষণাৎ ঘোড়া সাজিয়ে সে জানাল, সবচেয়ে বড়ো মহিষের মাথাটা আত্তিলিওকে যোগাড় করে দেবে বলে যে প্রতিজ্ঞা সে করেছিল, সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে সে দৃঢ়সংকল্প হতচ্ছাড়া পলাতকদের সে বুঝিয়ে দেবে মহম্মদ আলি কোন ধরনের মানুষ, কারো সাহায্য ছাড়াই মহিষযুথের সংবাদ সে সংগ্রহ করতে সক্ষম এবং ওই খবর আনার জন্য এক মুহূর্ত দেরি না-করে এখনই সে যাত্রা করতে প্রস্তুত।

বলতে বলতেই সে তড়াক করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসেছে, আর হতভম্ব আত্তিলিওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে!

হঠাৎ আত্তিলিওর মনে হল মহম্মদ আলিও বোধ হয় অন্যান্য অনুচরদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছে। নিখুঁত আরবীয় পদ্ধতিতে ফাঁকি দেওয়ার এইটাই বোধ হয় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও আধুনিক কায়দা। আত্তিলিও সাহেবের সন্দেহ সত্য, না, অন্যায়ভাবে মহম্মদের বীরত্ব ও সদিচ্ছার প্রতি সন্দিহান হয়ে তিনি উক্ত আরব দেশীয় মানুষটির প্রতি অবিচার করেছিলেন–সে-কথা কোনোদিনই জানা সম্ভব হবে না। কারণ, এতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনার স্রোত একটা প্রহসনমূলক নাটকের সূচনা করছিল–আচম্বিতে ঘটনাচক্রের দ্রুত পরিবর্তন সেই প্রহসনকে রূপান্তরিত করল এক বিয়োগান্ত নাটকের রক্তাক্ত দৃশ্যে।

এই ভয়ংকর পরিবর্তনের জন্য দায়ী হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড বন্য মহিষ। যে-দলটাকে আত্তিলিও অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন, এই জন্তুটা সেই দলভুক্ত নয়–একটা দলছাড়া মহিষের একক উপস্থিতি সমস্ত ঘটনাস্রোতকে বদলে দিয়েছিল।

মহম্মদ তখনও ঘোড়ার পিঠে দৃশ্যমান, আত্তিলিও প্রাণপণে চেঁচিয়ে তাকে ফিরে আসতে বলছেন–হঠাৎ ঝোঁপজঙ্গল ভেদ করে আত্তিলিওর থেকে প্রায় তিনশো ফিট দূরে আবির্ভূত হল এক কৃষ্ণকায় বিপুলবপু বন্য মহিষ! জন্তুটা ঝড়ের বেগে ধেয়ে এল মহম্মদ আলির বাহন আরবি ঘোড়াটার দিকে!

সাবধান! চেয়ে দেখো–সামনে বিপদ! চেঁচিয়ে মহম্মদকে সাবধান করে দিলেন আত্তিলিও, পরক্ষণেই ছুটলেন তাবুর ভিতর থেকে রাইফেল হস্তগত করার জন্য।

মুহূর্তের মধ্যেই রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলেন আত্তিলিও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে প্রচণ্ড সংঘর্ষে মিলিত হল মানুষ ও ঘোটক! আত্তিলিও সচমকে দেখলেন মহিষের একটা শিং ঘোড়ার বুকের ভিতর ঢুকে গেছে! পরক্ষণেই দেখা গেল ঘোড়াটাকে শিং বিধিয়ে শূন্যে তুলে ফেলেছে। মহিষ এবং দারুণ যাতনায় মহিষের মাথার উপর ঘোড়া করছে ছটফট!

মহম্মদ আলি ছিটকে পড়েছিল কয়েক গজ দূরে, ছুটে পালানোর জন্য সে তাড়াতাড়ি ভূমিশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই মহিষ তাকে লক্ষ করে ছুটে এল! ঘোড়াটা তখনও মহিষের মাথার উপর শৃঙ্গাঘাতে বিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছিল, কিন্তু ঘোটকের দেহভার মহিষাসুরের গতিরোধ করতে পারল না–সে এসে পড়ল ভূপতিত মহম্মদ আলির দেহের উপর!

ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন আত্তিলিও; অভ্যস্ত আঙুলের স্পর্শে রাইফেলের বুলেট সশব্দে মহিষের হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। আত্তিলিও দৌড়ে এলেন মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ জন্তু দুটির দিকে। ঘোড়াটা তখনও অসহ্য যাতনায় ছটফট করছিল। আত্তিলিওর রাইফেল তার মৃত্যুকে সহজ করে দিল। মহিষের দেহে প্রাণ ছিল না, গুলি লাগার সঙ্গেসঙ্গেই সে মারা গেছে।

মহম্মদের অবস্থা খুবই শোচনীয় মহিষ আর ঘোড়া জড়াজড়ি করে তার উপরই পড়েছে, দুটি বিশাল দেহের নীচে পিষ্ট হয়ে সে এখন মৃত্যুপথের যাত্রী।শিং দুটো মস্ত বড়ো, প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বলে উঠল মহম্মদ, যেমন… যেমন… আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম. তার কণ্ঠ রুদ্ধ হল, কালো গোঁফ দুটির নীচে রক্তমাখা দাড়ির ভিতর থেকে যে-হাসিটি ফুটে উঠেছিল, সেই হাসির রেখা হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মৃত্যুর স্পর্শে–হাসতে হাসতেই মৃত্যুবরণ করল মহম্মদ আলি।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মহিষ

পূর্বোক্ত ঘটনার পর থেকেই মহিষ সম্বন্ধে তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ পোষণ করতেন আত্তিলিও গত্তি।

একাধিক পুস্তকে মহিষ-বিষয়ক তথ্য পাঠ করে আত্তিলিও জেনেছিলেন ওই জন্তুটি আক্রান্ত না হলে অথবা প্ররোচিত হলে বিনা কারণে কখনো মানুষকে আক্রমণ করে না। কিন্তু মহম্মদ আলি ও তার বাহন আরবি ঘোড়াটার মৃত্যু দেখে আত্তিলিও বুঝেছিলেন কেতাবে লিখিত তথ্য আংশিক সত্য হলেও হতে পারে, সর্বাংশে সত্য কখনোই নয়। এইখানে আফ্রিকার মহিষ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা দরকার। মহিষগোষ্ঠীর কোনো জন্তুকেই নিরীহ বলা চলে না, মহিষ মাত্রেই ভয়ংকর জীব। গৃহপালিত মহিষও উত্তেজিত হয়ে মানুষের প্রাণবিপন্ন করেছে এমন ঘটনা বিরল নয়। মহিষগোষ্ঠীর বিভিন্ন জন্তুর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জীব আফ্রিকার কেপ-বাফেলো। লেপার্ড, হায়না প্রভৃতি মাংসাশী জানোয়ার কখনো কেপ-বাফেলোর ধারেকাছে আসে না। স্বয়ং পশুরাজও পূর্ণবয়স্ক কেপ-বাফেলোর সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় অনিচ্ছুক ক্রোধে আত্মহারা না হলে সিংহ কখনো মহিষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। রুদ্রমূর্তি মহিষকে দেখে সিংহ চম্পট দিয়েছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। মহিষ-পরিবারের সকল পশুরই প্রধান অস্ত্র শিং আর খুর–কেপ-বাফেলো নামক আফ্রিকার অতিকায় মহিষও ওই দুটি মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়; উপরন্তু তাদের মাথার উপর থাকে পুরু হাড়ের দুর্ভেদ্য আবরণ–শিরস্ত্রাণের মত মাথার উপর ওই কঠিন অস্থি-আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখদন্ত কিংবা রাইফেলের বুলেট মহিষের মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে না। ওই অস্থি-আবরণের ইংরেজি নাম বস অব দি হর্নস; সংক্ষেপে বস। বস-এর দু-দিকে অবস্থিত শিং-এর দৈর্ঘ্য সাধারণত ৩৬ ইঞ্চি থেকে ৪৫ ইঞ্চি, তবে ৫৬ ইঞ্চি লম্বা শিংও দেখা গেছে। পূর্বোক্ত মহিষের আয়ু তিরিশ বছর, কিংবা আর একটু বেশি। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত অধিকতর বলশালী তরুণ মহিষদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে অনেক সময় প্রাচীন মহিষরা দল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দলছাড়া মহিষ নিঃসঙ্গ অবস্থায় বিচরণ করে এবং সমগ্র পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী সম্বন্ধে প্রচণ্ড বিদ্বেষ পোষণ করে। নিঃসঙ্গ পুরুষ মহিষই সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার। মহম্মদকে হত্যা করেছিল ওইরকম একটি নিঃসঙ্গ ভয়ংকর গুন্ডা মহিষ।

আফ্রিকাবাসী মহিষদের মধ্যে কেপ-বাফেলো নামক জন্তুটি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে, কিন্তু আরও দুই জাতের মহিষ আফ্রিকাতে দেখা যায়। গ্যামা নামে একরকম মহিষজাতীয় জানোয়ার আরব দেশে চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া আছে বনগোরু বা পিগমি বাফেলো। কেপ-বাফেলোর কাধ মাটি থেকে পাঁচ ফিট কিংবা আর একটু বেশি উঁচু হয়, কিন্তু পিগমি বাফেলোর কাঁধের উচ্চতা মাটি থেকে মাত্র তিন ফিট; তার শিং ধারালো, তবে ছোটো এবং দেহের রং তার অতিকায় জ্ঞাতি ভাইয়ের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়–রক্তাভ-পীত বর্ণে রঞ্জিত ঘন রোমশ দেহ নিয়ে একা অথবা জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে ওই খর্বকায় মহিষ। কেপ-বাফেলোর মতো দলবদ্ধ হয়ে পিগমি বাফেলো বা বনগোর কখনো বাস করে না।

আকারে ছোটো হলেও ওই মহিষগুলো যে কতখানি শক্তি সাহস ও ক্ষিপ্রতার অধিকারী হয়, নিম্নলিখিত ঘটনা থেকেই তা বোঝা যাবে।

বেলজিয়ান কঙ্গোর জঙ্গলে আত্তিলিও সাহেব একবার একটা ওকাপিকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরার চেষ্টা করেন। ওকাপি হচ্ছে নিরামিষভোজী দুষ্প্রাপ্য পশু। একটা ওকাপিকে জীবন্ত অবস্থায় ধরার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছিলেন আত্তিলিও হঠাৎ একদিন সৌভাগ্যক্রমে মাম্বুটি পিগমি জাতির নিগ্রো পথপ্রদর্শকরা একটা ওকাপিকে ঘেরাও করে ফেলল। ওকাপির পদচিহ্নের কাছাকাছি বনগোরু বা খর্বকায় মহিষের টাটকা পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন আত্তিলিও। কিন্তু ওকাপির জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিলেন বলে তাড়াহুড়োর মধ্যে তিনি পিগমিদের কাছে খর্বকায় মহিষ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করেননি।

খুব মনোযোগের সঙ্গে ওকাপিকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলল। একটা বৃহৎ আকার নিয়ে গোল হয়ে অবস্থান করছিল সবাই, মাঝখানে ওকাপিকে লক্ষ করে সেই চলন্ত মনুষ্যবৃত্তের পরিধি ক্রমশ ছোটো হয়ে আসতে লাগল… আচম্বিতে সবুজ উদ্ভিদের জাল ভেদ করে দুটি রক্তাভ বিদ্যুঝলকের প্রচণ্ড আবির্ভাব! কী হচ্ছে-না-হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই দারুণ সংঘাতে ওকাপি-শিকারিরা চতুর্দিকে ছিটকে পড়তে লাগল, আত্তিলিওর মাথা থেকে উড়ে গেল হেলমেট আর হাত থেকে বেরিয়ে গেল রাইফেল এক মুহূর্তের জন্য আত্তিলিও অনুভর করলেন তাঁর পায়ের তলা থেকে সরে গেছে মাটি এবং দেহ হয়েছে শূন্যপথে উড্ডীয়মান–পরক্ষণেই মৃত্তিকার কঠিন স্পর্শ আর চোখের সামনে সর্ষেফুল!

হইচই, চিৎকার, ধুন্ধুমার–যাচ্ছেতাই ব্যাপার!

দুটো বেঁটে বেঁটে মহিষ ধাঁ করে মানুষের ব্যুহ ভেদ করে বিদ্যুৎঝলকের মতো অন্তর্ধান করল। সেইসঙ্গে পালিয়ে গেল আত্তিলিও সাহেবের এত সাধের ওকাপি!

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মূল্যবান উপদেশ

খর্বকায় বামন মহিষের ধাক্কা খেয়ে নাস্তানুবুদ হওয়ার কয়েকদিন পরেই এক ইংরেজ-শিকারির সঙ্গে হঠাৎ আত্তিলিওর আলাপ হয়ে গেল। ওই ইংরেজ শিকারিটি সারাজীবন ধরে আফ্রিকাতে বন্য মহিষের গতিবিধি লক্ষ করেছে, বহু মহিষ শিকার করেছে এবং তার ফলে মহিষ-চরিত্র সম্বন্ধে সে হয়ে উঠেছে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ। ইরামা নামক স্থানে একটি দোকান থেকে শ্বেতাঙ্গরা জিনিসপত্র কিনতেন–আমাদের আত্তিলিও সাহেবও একদিন ওই দোকানে উপস্থিত হলেন কয়েকটা প্রয়োজনীয় বস্তু ক্রয় করার জন্য। পূর্বে উল্লেখিত ইংরেজ-শিকারিও একই উদ্দেশ্যে সেই সময়ে দোকানে উপস্থিত হয়েছিল।

তছোটো বুশ ব্লাউজ ও শর্ট পরিহিত আত্তিলিওর অনাবৃত বাহু ও পায়ের বিভিন্ন স্থানে আঘাতজনিত কালশিরার চিহ্ন দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠল দোকানদার। তাকে সংক্ষেপে ওকাপি ও খর্বকায় মহিষ-ঘটিত দুর্ঘটনার কথা বলে প্রসঙ্গ শেষ করে দিলেন আত্তিলিও, তারপর টিনে বন্ধ শুষ্ক আনাজ ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু মহিষ শব্দটি কানে যাওয়ামাত্র আগন্তুক ইংরেজ আত্তিলিওর দিকে ছুটে এল।

লোকটির কথাবার্তায় তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চিহ্ন দেখে আত্তিলিও বুঝলেন সে তাঁকে নিতান্তই তৃতীয় শ্রেণির শিকারি মনে করছে। তিনি গরম হয়ে উঠলেন এবং শিকারি-জীবনের কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, আত্তিলিও গত্তি নিতান্ত সাধারণ মানুষ নয়। লোকটি তখন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং আবিষ্কৃত তথ্য নিয়ে কথা কইতে শুরু করল। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আত্তিলিও যখন তার সান্নিধ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হলেন, তখন মূল্যবান সময়ের অপচয় হওয়ার জন্য তিনি মনে মনে বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কয়েক বছর পরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্তিলিও উপলব্ধি করেছিলেন ইরামার এক অখ্যাত দোকানে দাঁড়িয়ে অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ-শিকারির কাছ থেকে মহিষ-চরিত্র সম্পর্কে কিছু জ্ঞানলাভ করেছিলেন বলেই তিনি সময়কালে কর্তব্য স্থির করে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

মহিষ-প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলেছিল ওই ইংরেজ-শিকারি। সুদীর্ঘ শিকারি-জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে সে জানতে পেরেছিল আক্রমণ-উদ্যত ক্ষিপ্ত মহিষকে বাধা দিতে পারে প্রশস্ত নদী, আগুনের জ্বলন্ত প্রতিবন্ধক এবং–

এবং মানুষের মৃতদেহ!

কথাটা শুনতে খুবই অদ্ভুত বটে, কিন্তু ইংরেজ-শিকারি দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল, মৃতদেহের উপর মহিষ কখনো আক্রমণ চালায় না–সে মৃতদেহ লক্ষ করে ছুটে আসবে, কিন্তু সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়বে কিছুতেই মরা মানুষকে স্পর্শ করবে না। দূরে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার তেড়ে এসে থমকে দাঁড়াবে–এমনি করে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর এক সময়ে প্রস্থান করবে মহিষ। আত্তিলিওর হঠাৎ-পাওয়া নতুন বন্ধু বলেছিল, যে মুহূর্তে মহিষ দেখবে মানুষটা নড়াচড়া না-করে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে, সেই মুহূর্তেই সে ধরে নেবে ওটা মৃতদেহ আর তৎক্ষণাৎ সে থেমে যাবে।

কিন্তু, আত্তিলিও প্রতিবাদ করেছিলেন, মহিষ দেখবে কেমন করে? অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি যেসব জানোয়ার শিং দিয়ে আঘাত করে, তারা তো চোখ বন্ধ করে আঘাত হানতে অভ্যস্ত।

বাঃ! বেশ বলেছ! বিজয়গর্বে হুংকার দিয়ে উঠল ইংরেজ-শিকারি, এতদিন আফ্রিকাতে থেকে তুমি এই কথা বললে? তাহলে কী জানলে ঘোড়ার ডিম! মহিষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাথা উঁচু রেখে শত্রুকে লক্ষ করে এই বৈশিষ্ট্যের কথা কি তোমার জানা নেই?

তাই তো! ঠিক কথা! এইবার আত্তিলিওর মনে পড়ল মহম্মদের মৃত্যুকালীন ঘটনা ঘোড়াটাকে শিং দিয়ে আঘাত করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মহিষ মাথা উঁচু করে রেখেছিল, একেবারে সামনে এসে একবারই সে মাথা নামিয়েছিল চরম আঘাত করার জন্য।

বাঃ! বেশ বলেছ! সুযোগ পেয়ে আবার বিদ্রূপ করল ইংরেজ-শিকারি, আঘাত করার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত মহিষ তার মাথা উঁচু করে রাখে, কারণ ওই জন্তুটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের শয়তান। সে জানে মাথা নীচু করলে খুলির উপর বসানো পাথরের মতো শক্ত হাড়ের বস তার মস্তিষ্ক ও কপালকে শত্রুর আক্রমণ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে পারে, তবু সে মাথা উঁচু করে রাখে। কেন জান? কারণ, শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত মহিষ তার শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করে অধ্যর্থ সন্ধানে আঘাত হানতে চায়। আর সেইজন্যই সে মাথা তুলে শত্রুকে দেখতে থাকে, অন্যান্য শিংওয়ালা জন্তুর মতো চোখ মুদে আক্রমণ করে না। মহিষের সামনে যদি কখনো যাও, তবে এই কথাগুলো মনে রাখবে, কখনো ভুলবে না।

ইংরেজ-শিকারির উপদেশ আত্তিলিওর মনে গেঁথে বসে গিয়েছিল। অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় অকস্মাৎ অবচেতন মনের গহন অন্তস্থল থেকে ওই কথাগুলো ভেসে এসেছিল তাঁর স্মৃতির দরজায় এবং সেইজন্যই নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন আত্তিলিও সাহেব।

কিন্তু যে আধ-পাগলা ইংরেজ সারাজীবন ধরে মহিষ-চরিত্র নিয়ে গবেষণা করে ওই জন্তু সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ হয়েছিল, সেই মানুষটা তার নিজের কথাগুলোই একদিন ভুলে গেল। একবারই ভুল করেছিল ইংরেজ-শিকারি, কিন্তু ভ্ৰম-সংশোধনের সুযোগ সে আর পায়নি। আত্তিলিওর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই একটি আহত মহিষের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ইংরেজ-শিকারি প্রাণ হারিয়েছিল।

উক্ত ইংরেজ যেখানে মারা যায়, সেই জায়গাটা হচ্ছে অ্যাংকোলে নামক নিগ্রো জাতির বাসস্থান। ইংরেজ-শিকারির আরও একটি কথার সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়েছিলেন আত্তিলিও ওই অঞ্চলেই এবং সেই প্রমাণটা যে উপস্থিত করেছিল সে শ্বেতাঙ্গ নয়–জনৈক কৃষ্ণকায় অ্যাংকোলে-শিকারি।

মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর উপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন আত্তিলিও–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভয়াবহ পরিস্থিতি

অ্যাংকোলে-শিকারির অদ্ভুত কৌশল ও স্নায়ুর উপর তার আশ্চর্য সংযম দেখে ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু কতখানি মানসিক শক্তি থাকলে মানুষ নির্বিকারভাবে ওই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে সে-বিষয়ে তাঁর ধারণা সেদিন খুব স্পষ্ট ছিল না।

দু-বছর পরে তিনি নিজে যখন ওই অবস্থায় পড়লেন, তখনই বুঝতে পারলেন কী অসাধারণ মানসিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল পূর্বোক্ত ক্ষুদ্রকায় নিগ্রো শিকারি।

খুব ভেবে দেখলে অবশ্য বলতে হয় আত্তিলিওর অবস্থা ওই নিগ্রো শিকারির চাইতেও খারাপ ছিল–অ্যাংকোল-শিকারি স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল এবং ওইরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তার পেশাগত শিক্ষা আর সুদীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির ইতিহাসও ধর্তব্য কিন্তু আত্তিলিও সাহেব কোনোদিনই বন্য মহিষের মতো বদখত জানোয়ারের সম্মুখীন হওয়ার অভিলাষ পোষণ করেননি, ঘটনাচক্রের শিকার হয়েই এক অভাবনীয় বিপদের সামনে রুখে দাঁড়াতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।

যখনকার কথা বলছি সেই সময়ে আত্তিলিও গত্তি আফ্রিকার কিভু হ্রদের তীরবর্তী সাময়িক আস্তানা থেকে চিবিন্দা নামক স্থানের অরণ্যে অভিযান চালানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তাঁর অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল দানব-গরিলা। ওই জীবটির সম্বন্ধে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

দৈবক্রমে একদিন আত্তিলিওর সঙ্গে একজন বেলজিয়ামের অধিবাসীর পরিচয় হয়ে গেল। ওই লোকটি জানাল কিভু হ্রদ আর টাঙ্গানিকা হ্রদের মধ্যবর্তী প্রান্তরে তার সঙ্গে গেলে একদল মহিষের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবেন আত্তিলিও সাহেব। গরিলা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে সেই সময় মাথা ঘামাচ্ছিলেন না আত্তিলিও, কিন্তু লোকটি বলল আড়াইশো মহিষ নিয়ে গঠিত ওই প্রকাণ্ড দলটার ফটো তোলার কাজ চিড়িয়াখানাতে ফটো নেওয়ার মতোই সহজ হবে। এত সহজে আড়াইশো মহিষের একটা প্রকাণ্ড দলকে তার ক্যামেরাতে বন্দি করা যাবে শুনে রাজি হয়ে গেলেন আত্তিলিও।

তুমি একটা উইয়ের ঢিপি বেছে নেবে, লোকটি বলল, ওই ঢিপির পিছন থেকে ফটো তুলবে যত খুশি। এমন সুযোগ আর কখনো পাবে না।

বেলজিয়ানের কথায় খুব নিশ্চিন্ত হয়ে আত্তিলিও গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হলেন। ব্যাপারটা মোটেই বিপজ্জনক নয়, চিড়িয়াখানাতে যাওয়ার মতোই সোজা–অতএব শিকারে যাওয়ার উপযুক্ত বুট পরার প্রয়োজন মনে করেননি আত্তিলিও; শহর-অঞ্চলে যে সাধারণ জুতো পরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন সেই জুতো জোড়া পায়ে চড়িয়ে তিনি চললেন মহিষযুথের আলোকচিত্র সংগ্রহ করতে রাইফেলটা তিনি নিয়েছিলেন নিতান্ত অভ্যাস বশে। তাঁবুর লোকজন দরকারি কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই বাছাবাছি না-করে যে-নিগ্রোটিকে সামনে পেলেন তাকেই তিনি ডেকে নিলেন রাইফেলটা বহন করার জন্য। আত্তিলিও দুটো হাতই খালি রাখতে চেয়েছিলেন–লম্বা লেন্স আর ক্যামেরা ভালোভাবে ব্যবহার করতে হলে দুই হাতই খালি রাখা দরকার। সবচেয়ে ভালো ক্যামেরাটাকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন আত্তিলিও…

প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বেলজিয়ান বন্ধুর নির্দেশে পথের উপর এক জায়গায় মোটরগাড়িটা থামানো হল। ঘন উদ্ভিদের জালে আচ্ছন্ন একটা সরু পথের উপর দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল আত্তিলিওর নতুন বন্ধু তাকে অনুসরণ করলেন আত্তিলিও। লোকটি জানাল নদীর যেখানে মহিষের দল সন্ধ্যার সময়ে জলপান করতে আসে সেই জায়গাটা সে ভালোভাবেই জানে–খুব তাড়াতাড়ি চলার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে সে বলল মহিষদের আসার সময় হয়েছে, এখনই তারা এসে পড়বে।

মিনিট দশেক হাঁটার পরে সকলে এসে থামল একটা খোলা জায়গার উপর। আত্তিলিও দেখলেন প্রচণ্ড সূর্যের তাপে শুষ্ক প্রান্তরের এখানে ওখানে বর্ষার কাদা শুকিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে এবং সেই শুষ্ক কর্দমপিণ্ডগুলোর মধ্যবর্তী স্থানের মাটি ফেটে দেখা দিয়েছে অজস্র ফাটল। হাঁটার সময়ে ওই ফাটলে পা পড়লেই চিতপটাং হওয়ার সম্ভাবনা। আত্তিলিও চারপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন–ডান দিকে প্রায় সিকি মাইল দূরে রুজিজি নদী, সামনে নাতিদীর্ঘ নলখাগড়ার নিবিড় সমাবেশ আর বাঁ-দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল চোখে পড়ে উইঢিপির পর উইটিপি। ওইখানে, অসংখ্য উইঢিপির মধ্যে একটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল বেলজিয়ান, ওই জায়গাটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো। চটপট চলে যাও ওইখানে, দেরি কোরো না।

খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে কথা বলছিল বেলজিয়ান বন্ধু; তার মতোই স্বরে আত্তিলিও জানতে চাইলেন উক্ত ব্যক্তি কোথায় অবস্থান করতে চায়।

আমাকে নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না, লোকটি উত্তর দিল, কাছাকাছি থাকব। আত্তিলিও দেখলেন বেলজিয়ান তার নিজস্ব ভৃত্যকে নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা তার মোটেই ভালো লাগল না। সমস্ত জায়গাটা খুব নির্জন, অস্বস্তিকর। ফটো তোলার পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে সেই মুহূর্তে ফিরে যেতে পারলে খুশি হতেন আত্তিলিও। তাঁর সঙ্গী বন্দুকবাহক নিগ্রোটির মনোভাবও বোধ হয় সেইরকম অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে লোকটি হঠাৎ কথা কইতে শুরু করল। আত্তিলিও তার একটা কথাও বুঝতে পারলেন না। আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন ছয়টি ভাষায় তিনি লোকটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার ভাষাও লোকটির কাছে সমান দুর্বোধ্য! পর পর ছয়বার ভাষা থেকে ভাষান্তরে প্রবেশ করলেও আত্তিলিওর বক্তব্য ছিল একটি–ওহে বাপু! দয়া করে একটু চুপ করো তো! মুখের ভাষা না-বুঝলেও তার কণ্ঠস্বর আর ভাবভঙ্গি থেকে লোকটি শেষপর্যন্ত বক্তার বক্তব্য অনুধাবন করতে সমর্থ হল। সে চুপ করল।

পরে অবশ্য আত্তিলিও জানতে পেরেছিলেন ওই লোকটি তাকে একটা জরুরি সংবাদ পরিবেশন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল–দুর্ভাগ্যক্রমে তার কথা আত্তিলিও বুঝতে পারেননি, আর সেইজন্যই যথাসময়ে খবরটা শুনে সতর্ক হওয়ার সুযোগ তার হল না।

খবরটা হচ্ছে এই : বেলজিয়ানের চাকরের কাছে আত্তিলিওর বন্দুক-বাহক জানতে পেরেছিল যে, তারা নদী পার হয়ে বিপরীত তীর থেকে মহিষদের উপর গুলি চালিয়ে কয়েকটা জন্তুকে হত্যা করবে বলে ঠিক করেছে। বেলজিয়ানটির কফির আবাদ আছে; সেই আবাদে নিযুক্ত মজুরদের মাংস সরবরাহ করার জন্যই মহিষ শিকারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। মাঝখানে নদী থাকায় অপর পার্শ্বে অবস্থিত বেলজিয়ান-শিকারি ও তার ভৃত্যের অবস্থা দস্তুর মতো নিরাপদ। কিন্তু এপারে আর দুজন মানুষের পক্ষে ব্যাপারটা যে কতখানি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিওকে সাবধান করে দেবার চেষ্টা করেছিল তাঁর বন্দুকবাহক।

আত্তিলিওর পক্ষে অবশ্য নবপরিচিত বন্ধুর সদিচ্ছায় সন্দিহান হওয়া স্বাভাবিক নয়–প্রায় আড়াইশো মহিষের মাঝখানে গুলি চালিয়ে দিলে তাদের কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটা যে কারো কাছে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতো সহজ মনে হতে পারে এমন কথা আত্তিলিও সাহেবই-বা ভাববেন কেমন করে? তিনি শুধু জানতেন মহিষের দল এখনই এসে পড়বে, অতএব চটপট একটা উইঢিপির পিছনে আশ্রয় নেওয়া উচিত এই মুহূর্তে। দলটা এসে পড়লে আর নড়াচড়া করা সম্ভব হবে না, কয়েকশো বন্য মহিষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ছিলেন আত্তিলিও। নির্দিষ্ট উইঢিপির পিছনে গিয়ে স্থান গ্রহণ করতে প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেল। আত্তিলিও তাঁর টেলিফটোর অ্যাপারেচার ঠিক করছেন নিবিষ্টচিত্তে আচম্বিতে তাঁর পায়ের তলায় গুরুগম্ভীর শব্দ তুলে মাটি কাঁপতে শুরু করল। পিছন থেকে বন্দুকবাহক নিগ্রোর অস্ফুট ভয়ার্ত স্বর আত্তিলিওর কানে এল, কিন্তু তিনি পিছনে চাইলেন না, তার দুই চোখের স্তম্ভিত দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ হয়েছে সেইদিকে যেখানে নলখাগড়ার ঝোঁপ ভেদ করে খোলা মাঠের উপর আত্মপ্রকাশ করছে মহিষের দল! আত্তিলিওর মনে হল সেই চলন্ত জান্তব স্রোতের যেন বিরাম নেই–কতগুলো মহিষ আছে ওখানে?…

ভয়ংকর এবং চমকপ্রদ দৃশ্যটাকে আরও জমকালো করে তুলেছে অস্তায়মান সূর্যের আলোকধারা–

মাথার উপর জ্বলছে রক্তরাঙা আকাশের পট, তলায় এগিয়ে চলেছে মেঘের মতো কালো এক শরীরী অরণ্য; সেই জীবন্ত ও চলন্ত অরণ্যের মাথায় মাথায় বাঁকা তলোয়ারের মতো শিংগুলোতে জ্বলে জ্বলে উঠছে রক্তলাল রবিরশ্মি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো–সঙ্গেসঙ্গে সহস্র খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন কম্পিত পৃথিবী করছে ধূলি-উদগিরণ। অপূর্ব দৃশ্য!

আত্তিলিও মনে মনে তার নবপরিচিত বন্ধুকে ধন্যবাদ দিলেন। সে ঠিক জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে। এখান থেকে ফটো তোলা সবচেয়ে সুবিধাজনক। হাওয়ার গতি অবশ্য ভালো নয়, তবে মহিষরা যে তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে না সে-বিষয়ে আত্তিলিও গত্তির মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।

চব্বিশটা আলোকচিত্র গ্রহণ করার পর আত্তিলিও ক্যামেরার স্বয়ংক্রিয় ম্যাগাজিন থেকে ব্যবহৃত ফিল্ম সরিয়ে নূতন ফিল্ম সংযোগ করতে সচেষ্ট হলেন। নীচু হয়ে ওই কাজ করছিলেন তিনি। পুরানো ফিল্ম সরিয়ে নতুন ফিল্ম লাগাতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগে। তবে আত্তিলিওর বোধ হয় মিনিট খানেকের উপর আরও ত্রিশ সেকেন্ড লেগেছিল; কারণ, তার পায়ের তলায় তখন জেগে উঠেছে প্রচণ্ড কম্পন–শত শত চলন্ত চতুম্পদের পদাঘাতে মাটি কাঁপছে ভূমিকম্পের মতো!

ক্যামেরাতে নতুন ফিল্ম লাগিয়ে আত্তিলিও আবার উইটিপির আড়াল থেকে মুখ বাড়ালেন। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কের চমক। মহিষযূথ খুব কাছে চলে এসেছে। এমন অপ্রত্যাশিত সান্নিধ্য আত্তিলিওর ভালো লাগল না। জন্তুগুলো তার ডান দিক দিয়ে নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, এখন মনে হচ্ছে তাদের গতিপথ একটু বদলে যাওয়ার ফলেই মহিষয়ূথ তার কাছাকাছি এসে পড়েছে।

অবশ্য জন্তুগুলোর মধ্যে কোনো উত্তেজনা বা উগ্রতার চিহ্ন দেখা দেয়নি। তবু আত্তিলিও ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবে নিতে পারলেন না। মুহূর্তের মধ্যে তিনি কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। মহিষের দল সোজাসুজি নদীর দিকে এগিয়ে গেলেই তিনি আবার ক্যামেরা হাতে নেবেন, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে ততক্ষণ ক্যামেরার চাইতে রাইফেলের সান্নিধ্য বেশি বাঞ্ছনীয়।

দৃষ্টি সামনে রেখে তিনি পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শিকারির প্রসারিত হস্তের এই ইঙ্গিত প্রত্যেক বন্দুকবাহকের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও রাইফেলের স্পর্শ পেলেন না আত্তিলিও সাহেব। সম্মুখে চলমান ভয়ংকর মিছিল থেকে চোখ ফেরানো নিরাপদ নয়, তাই চোখের দৃষ্টি যথাস্থানে রেখেই তিনি চাপা গলায় ডাকলেন–এই!

ফল হল একইরকম, প্রসারিত হস্তের মতো অবরুদ্ধ কণ্ঠের ইঙ্গিতও হল ব্যর্থ–হাতে এসে পৌঁছাল না রাইফেল।

লোকটা কি গাধা নাকি? সক্রোধে দুই চোখে আগুন ছড়িয়ে পিছন ফিরলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল বিদ্যুৎ তরঙ্গ–

কেউ নেই পিছনে!

লোকটা যে কখন পালিয়েছে বুঝতেই পারেননি আত্তিলিও। এখন তার দ্রুত ধাবমান দেহটা তার চোখে পড়ল। এর মধ্যেই সে অনেক দূর চলে গেছে, তার শরীরটা দেখাচ্ছে ছোট্ট, নদী থেকে লোকটির দূরত্ব এখন এক-শো গজও হবে না।

আত্তিলিও মনে মনে ভাবলেন, মহিষগুলো নিশ্চয়ই ওকে দেখতে পেয়েছে। সেইজন্যই তাদের গতিপথের পরিবর্তন ঘটেছে।

কিন্তু তার ধারণা যদি সত্য হয় তাহলে তো সমূহ বিপদ। মহিষরা যে-পথ ধরে এগিয়ে আসছে, সেই পথের মাঝখানেই তো রয়েছেন তিনি একটু পরেই তো আড়াইশো মহিষের দল এসে পড়বে তার উপর! এখন উপায়!

বন্দুকবাহক নদীর ধার থেকে একবার আত্তিলিওর দিকে তাকাল, হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল রাইফেলটা সে ওইখানেই রেখে দিয়েছে–তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর মধ্যে। জল ছিটকে উঠল, আর তাকে দেখা গেল না।

আত্তিলিও এইবার মহিষযুথের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারা এগিয়ে আসছে একইভাবে, তবে তাদের গতিবেগ বর্ধিত হয়নি, বেশ হেলেদুলে সহজভাবেই এগিয়ে আসছে তারা।

একটি লোককে ছুটতে দেখেও যখন তারা উত্তেজিত হয়নি, তখন আর একটি লোকের ধাবমান শরীরও বোধ হয় তাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে না–ভাবলেন আত্তিলিও।

দূরত্বটা চোখ দিয়ে মেপে নিলেন তিনি–নিতান্তই যদি তেড়ে আসে, তাহলেও আমাকে ওরা ধরে ফেলার আগেই আমি রাইফেলটার কাছে গিয়ে পড়ব।

সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি ছুটতে শুরু করলেন। সঙ্গেসঙ্গে বন্দুকের আওয়াজ পর পর তিনবার। আত্তিলিও ভাবলেন তার বেলজিয়ান বন্ধু বন্দুকের শব্দে মহিষগুলোর দৃষ্টি অন্যত্র আকৃষ্ট করে তাকে সাহায্য করতে চাইছে। কথাটা ভাবতেই তার মনের জোর বাড়ল, আরও জোরে পা চালিয়ে ছুটতে লাগলেন তিনি।

আবার বন্দুকের শব্দ। ডান পায়ের গোড়ালিতে অসহ্য যন্ত্রণা। ছিটকে পড়লেন আত্তিলিও। ক্যামেরাটা দারুণ জোরে তার বুকে আঘাত করল। মাটিতে আছাড় খেয়ে জ্ব থেকে ঝরতে লাগল রক্তের ধারা। একবার উঠতে চেষ্টা করলেন আত্তিলিও। আর সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কী হয়েছে। আত্তিলিও ভেবেছিলেন তাঁর পায়ে গুলি লেগেছে, কিন্তু না, তা নয়–পাথরের মতো শক্ত মাটির ফাটলে তার পা আটকে গেছে। ফাটলের গ্রাস থেকে পা টেনে বার করলেন আত্তিলিও। পা মচকে গেছে ভীষণভাবে, গোড়ালির হাড় ভেঙে যাওয়াও আশ্চর্য নয়। মহিষের দল এদিকে ভীষণ উত্তেজিত। গুলি খেয়ে কয়েকটা জন্তু মারা পড়েছে। সমস্ত দলটা এখন আত্তিলিওর দিকেই ছুটে আসছে।

একবার পা ফেলার চেষ্টা করেই থেমে গেলেন আত্তিলিও। নদী সামনে, একটি দৌড় দিলেই তিনি নিরাপদ।

কিন্তু দৌড়ানো তো দূরের কথা, সহজভাবে হেঁটে চলার ক্ষমতাও তার নেই।

সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল অ্যাংকোলে-শিকারির কথা। মড়ার ভান করে পড়ে থেকে সেই লোকটি মহিষকে ফাঁকি দিয়েছিল। অতি দুঃখে আত্তিলিওর হাসি এল। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। তাঁর, সর্বশরীর কাঁপছে থর থর করে মৃতদেহের অভিনয় করার এইটাই তো উপযুক্ত সময়!

অ্যাংকোলেকে পরীক্ষা করেছিল একটি মহিষ, তাকে পরীক্ষা করতে আসবে আড়াইশো মহিষের বিপুল বাহিনী।

নাঃ, অসম্ভব, আত্তিলিওর পক্ষে মড়ার ভান করে এই চতুষ্পদ মৃত্যুদূতদের ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার সুপ্তচেতনা ভেদ করে জাগ্রত চৈতন্যের দ্বারে আঘাত করল এক আধপাগলা ইংরেজ শিকারির কণ্ঠস্বর–মনে রেখো, ওরা মাথা তুলে রাখে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওরা মাথা তুলে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করে..

হ্যাঁ, উপায় আছে! একটিমাত্র পন্থা অবলম্বন করলে হয়তো যমদূতদের কবল থেকে উদ্ধার লাভ করা সম্ভব নতুন আশায় বুক বাঁধলেন আত্তিলিও। মহিষ চরম আঘাত হানবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মাথা তুলে শত্রুকে লক্ষ করে; অতএব ধাবমান মহিষযূথকে যদি তিনি হঠাৎ চমকে দিতে পারেন, তবে হয়তো জন্তুগুলো তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারে।

আত্তিলিও জানতেন মহিষের চক্ষু বিবর্ধক শক্তিসম্পন্ন। তার সামান্য গতিবিধি তাদের চোখে ধরা পড়বে অসামান্য দ্রুতবেগে বর্ধিত আকারে–অতএব দুই হাত নেড়ে যদি তিনি তাদের ভড়কে দিতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো এযাত্রা বেঁচে যাবেন। আড়াইশো ধাবমান মহিষের সামনে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবশ্য খুবই কঠিন, কিন্তু হাত নেড়ে চিৎকার করা ছাড়া বর্তমান অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার যখন অন্য উপায় নেই, তখন উপযুক্ত বিপজ্জনক পদ্ধতির আশ্রয়গ্রহণ করার সংকল্প করলেন আত্তিলিও–

এক টান মেরে মাথা থেকে তিনি খুলে ফেললেন হেলমেট, প্রস্তুত হলেন চরম মুহূর্তের জন্য…

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – শরীরী ঝটিকার গতিপথে

পায়ে পায়ে জাগছে ভূমিকম্প, শৃঙ্গে শৃঙ্গে জ্বলছে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ, ধেয়ে আসছে মূর্তিমান মৃত্যুর শরীরী ঝটিকা–

আড়াইশো মহিষের উন্মত্ত বাহিনী!

কখন যে তারা এসে পড়েছে বুঝতে পারেননি আত্তিলিও, তিনি শুধু চিৎকার করছেন গলা ফাটিয়ে আর মাথার হেলমেট খুলে সজোরে নাড়ছেন সেটাকে–ডাইনে, বাঁয়ে, মাথার উপর সর্বত্র! জন্তুগুলো তাঁর এত কাছে এসে পড়েছিল যে, মহিষ দলপতির খোলা চোখ দুটোকেও তিনি দেখতে পেলেন। ভাবলেশহীন নির্বিকার দৃষ্টি মেলে জন্তুটা তার দিকে তাকিয়েছিল নির্নিমেষ নেত্রে। দারুণ আতঙ্কে আত্তিলিও চোখ মুদে ফেললেন, কিন্তু তার হাত দুটো যন্ত্রের মতো ঘুরতে লাগল–ওই অঙ্গ দুটি যেন তাঁর নিজস্ব নয়, হঠাৎ যেন হাতের উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছেন তিনি–অদৃশ্য এক শক্তি যেন হাত দুটিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার!

মুদিত নেত্রে সজোরে হাত নাড়তে লাগলেন তিনি, সেইসঙ্গে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার চোখে না দেখতে পেলেও তাঁর শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতে লাগল অনেকগুলো গুরুভার দেহের প্রচণ্ড পদধ্বনি। দ্রুত ধাবমান সেই ধ্বনিতরঙ্গ তার দু-পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ডাইনে আর বাঁয়ে… অবশেষে একসময়ে আত্তিলিওর পিছনে বহু দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল বিলীয়মান শব্দের ঢেউ দূরে অপসৃত মৃত্যুর পদধ্বনির মতো…।

যাক! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আত্তিলিও! এই যাত্রা বেঁচে গেছেন তিনি! হাতে রাইফেল না থাকায় তিনি ভেবেছিলেন এইবার মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পরে বুঝলেন নিরস্ত্র ছিলেন বলেই তিনি অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে অব্যাহতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। রাইফেল হাতে থাকলেই গুলি চালাতেন তিনি, কিন্তু লাভ কী হত? কয়েকটা জন্তু গুলি খেয়ে মারা পড়ত, তারপরই তার দেহের উপর দিয়ে ছুটে যেত চতুষ্পদ জনতার জান্তব ঝটিকা–শত শত খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতেন তিনি, প্রান্তরের বুকে একদা-জীবিত মনুষ্যদেহের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পড়ে থাকত দলিত, বিকৃত, রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ড।

মহিষ-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যার অমূল্য উপদেশ যথাসময়ে স্মরণে আনতে পেরে বেঁচে গেলেন আত্তিলিও, সেই ইংরেজ-শিকারি কিন্তু সময়কালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গিয়ে গুলি চালিয়েছিল এবং তার ফলেই মৃত্যুবরণ করেছিল সে। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস।

আত্তিলিও জানতেন বর্তমানে তিনি নিরাপদ। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী নয় সেই নিরাপত্তা। মহিষয়ূথ এখনই আবার ফিরে আসবে। যেভাবে অ্যাংকোলে-শিকারির কাছে ছয়-ছয়বার ঘুরে এসেছিল একক মহিষ জোবি, ঠিক সেইভাবেই তার কাছে ঘুরে আসবে মহিষের দল–পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন আত্তিলিও গত্তি।

অনুমান নির্ভুল। ঘুরে এসেছিল মহিষযূথ। তবে আত্তিলিওকে তারা দেখতে পায়নি। পা ভেঙেছে কি অস্ত আছে সে-বিষয়ে একটুও মাথা না-ঘামিয়ে জ্বালাযন্ত্রণা তুচ্ছ করে তিনি ছুটেছিলেন নদীর দিকে। মহিষগুলো যখন অকুস্থলে ফিরে এসেছিল, আত্তিলিও তখন নদীতীর থেকে বন্দুকবাহকের পরিত্যক্ত রাইফেলটা তুলে নিয়ে ঝাঁপ খেয়েছেন নদীর জলে! প্রায় পাঁচ ফিট গভীর কর্দমাক্ত জলের ভিতর দিয়ে রাইফেলে ভর দিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন এবং অতি কষ্টে নদী পার হয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে শক্ত জমির উপর একসময়ে এসে পড়লেন আত্তিলিও। সঙ্গে সঙ্গে একগাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বেলজিয়ান বন্ধু!

আত্তিলিওর শোচনীয় অবস্থা তার নজরেই পড়ল না। মহানন্দে চিৎকার করে সে বলে উঠল, কী? কেমন দেখলে? আমি তোমায় বলেছিলাম কি না..

আত্তিলিও সাহেবেরও অনেক কিছু বলার ছিল। বলেননি। কারণ কথা বলতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন তাঁর স্বরযন্ত্র কিছুক্ষণ পর্যন্ত মৌনব্রত পালন করতে চায়–অতএব বন্ধু সম্বন্ধে তাঁর যে ব্যক্তিগত অভিমত জানানোর জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, সেই বক্তব্যকে তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেন।

আমি তোমায় বলেছিলাম কি না? প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে বন্ধুবর বলল, ঠিক চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতোই সহজ হবে সমস্ত ব্যাপারটা এখন দেখলে তো?

হ্যাঁ, সবই দেখলেন আত্তিলিও, সবই শুনলেন। পরে তিনি বন্ধুকে কী বলেছিলেন জানি না। কারণ আত্তিলিও গত্তি তার আত্মজীবনীতে সেসব কথা লিপিবদ্ধ করেননি। তবে বাকশক্তি ফিরে পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তিনি যে বন্ধুকে বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত করে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন এ-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ এবং সেই ভাষণের ফলে উভয়ের বন্ধুত্ব খুব গাঢ় হয়েছিল বলেও মনে হয় না।