জেহাদ

জেহাদ

বহুদিন আগেকার কথা। ব্রিটিশশাসিত দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত তালাইনভু নামে গ্রামটির নিকটবর্তী অরণ্যে কয়েকটি গ্রামবাসীর অকারণ নিষ্ঠুর আচরণের ফলে সমগ্র বনাঞ্চলে ভয়াবহ সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়েছিল এবং স্বজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রাণ হারিয়েছিল কয়েকটি নিরাপরাধ মানুষ

সেই অদ্ভুত এবং ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ এখানে পরিবেশিত হল :

উক্ত তালাইনভু গ্রামের ছয়-সাতজন লোক কাবেরী নদীর তীরে বাঁশবন থেকে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বাঁশঝাড়ের নীচে তারা তিনটি প্যান্থারের বাচ্চা দেখতে পায়। বাচ্চাগুলো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি, সেখান থেকে সরে এলেই আর কোনো ঝামেলা হত না। কিন্তু লোকগুলোর নিতান্ত দুর্মতি, তাদের মধ্যে একজন হাতের ধারালো কাটারি দিয়ে একটা বাচ্চার গায়ে কোপ বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা প্রায় দু খানা হয়ে রক্তাক্ত শরীরে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ল। হত্যাকারীর দৃষ্টান্ত দেখে তার সঙ্গীরা মহা উৎসাহে অন্য বাচ্চা দুটিকে আক্রমণ করল। কাটারির আঘাতে আঘাতে দুটি শ্বাপদ শিশুই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

আচম্বিতে বনের মধ্যে জাগল ক্রুদ্ধ হুংকার ধ্বনি–পরক্ষণেই হলুদের উপর কালো কালো ছোপ বসানো একটা অতিকায় বিড়ালের মত জানোয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলোর মধ্যে

মা-প্যান্থার!

মানুষ সম্পর্কে বন্য পশুর একটা স্বাভাবিক ভীতি আছে। তাই সকলের অলক্ষ্যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা-প্যান্থার লোকগুলোকে লক্ষ করছিল, কাছে আসতে সাহস পায়নি। কিন্তু চোখের ওপর তার বাচ্চাদের হত্যাকাণ্ড দেখে দারুণ ক্রোধে তার মন থেকে ভয়ের অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল হন্তারকদের ওপর।

প্রথম ব্যক্তি ব্যাপারটা কী হল বুঝতেই পারল না, কারণ মা-প্যান্থারের থাবার আঘাতে তার দুটো চোখই অন্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে! লোকটি ছিটকে পড়ল মাটিতে। সঙ্গেসঙ্গে তার ধরাশায়ী দেহ টপকে একলাফে আরেকটি লোকের বুকের উপর কামড় বসাল ক্ষিপ্তা জননী।

প্রথম ব্যক্তির মতো দ্বিতীয় ব্যক্তিও সশব্দে ধরাশায়ী হয়ে আর্তনাদ করতে লাগল।

আহত লোক দুটির সঙ্গীরা বাচ্চা তিনটির ওপর কাটারির ধার পরখ করতে ইতস্তত করেনি, কিন্তু অস্ত্র হাতে মা-প্যান্থারের নখদন্তের সম্মুখীন হওয়ার সাহস তাদের ছিল না–দারুণ আতঙ্কে আর্তনাদ করতে করতে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পালাতে লাগল তিরবেগে।

মা-প্যান্থার পলাতকদের অনুসরণ করল না, আহত অবস্থায় যে দুটি লোক মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল, তাদের ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নখে দাঁতে তাদের ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে।

তারপর বাচ্চা তিনটির মধ্যে যে-জন্তুটার দেহে কম ক্ষত ছিল সেটাকে মুখে তুলে নিয়ে গভীর বনের ভিতর অদৃশ্য হল।

বাঁশ কাটতে যারা গিয়েছিল, তারা গ্রামে গিয়ে বলল একটা প্রকাণ্ড প্যাস্থার সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাদের আক্রমণ করে দুটি মানুষকে হত্যা করেছে। তারা যে বাচ্চাগুলোকে খুন করে মা-প্যান্থারকে উত্তেজিত করেছিল, এ-কথা তারা বেমালুম চেপে গেল। পরে অবশ্য আসল ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছিল।

কিছুদিন খুব গোলমাল হল। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেই জায়গাটা এড়িয়ে চলল স্থানীয় মানুষ। নিতান্তই ওই জায়গা দিয়ে যাতায়াত করার দরকার হলে সেখানকার মানুষ দলে ভারী হয়ে অস্ত্র নিয়ে পথ চলত।

কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। মা-প্যান্থারকে কেউ আর দেখতে পায়নি। লোকে তার কথা ভুলে গেল।কিন্তু শ্বাপদ জননী তার শাবকদের অপমৃত্যুর কথা ভোলেনি, সে তখন বিদ্বেষ পোষণ করছে। সমগ্র মনুষ্যজাতির ওপর। কিছুদিন পরেই আবার প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ পেল সে।

পূর্বে উল্লিখিত গ্রামটির নিকটবর্তী অরণ্যে এক কুখ্যাত চোর বনরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে বন থেকে চন্দন কাঠ চুরি করত। অনেক চেষ্টা করেও বন বিভাগের লোকজন এবং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

এই চোরটি তার ছেলেকে নিয়ে এক চাঁদনি রাতে জঙ্গলে প্রবেশ করল। কিছু চন্দন কাঠ কেটে নিয়ে ডিঙিতে তুলে নদীর উত্তরদিকের তীরে উঠতে পারলে আর মাদ্রাজের কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারবে না–নদীর ওই দিকটা ছিল মহীশূরাজ্যের অন্তর্গত এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা প্রবেশ করেছিল বনের মধ্যে।

দিনের বেলা এসে একসময় তারা পছন্দমতো গাছগুলো দেখে গিয়েছিল, এখন নির্ধারিত স্থানে এসে তারা কুড়াল দিয়ে গাছ কাটতে শুরু করল। শাবকহারা মা-প্যান্থার ওই শব্দে আকৃষ্ট হয়েছিল সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে সে হানা দিল। নরমাংসের লোভ তার ছিল না, নরহত্যাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।

বাপ বুঝতেই পারেনি ব্যাপারটা কী ঘটল, একবার আর্তনাদ করার সময়ও সে পায়নি। আচম্বিতে পিঠের ওপর একটা গুরুভার দেহের সংঘাতে সে হল ভূমিপৃষ্ঠে লম্ববান, পরক্ষণেই কণ্ঠনালীতে তীক্ষ্ণ দন্তের সাংঘাতিক নিষ্পেষণ। আঠারো বছরের ছেলে তার বাপকে বাঁচানোর চাইতে নিজের প্রাণ বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হাতের কুড়াল ফেলে সে পলায়ন করল দ্রুতবেগে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হতভাগ্য চোর প্রাণত্যাগ করল প্যান্থারের কবলে। ছেলেটি অবশ্য শ্বাপদকে ফাঁকি দিতে পারল, তিরবেগে ছুটে গিয়ে সে নদীর ধারে রক্ষিত ডিঙির ওপর লাফিয়ে উঠল এবং প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে নদী পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে প্রবেশ করল তার কুঁড়েঘরে। চোরের বউ স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যুসংবাদ পেল ছেলের মুখ থেকে।

গ্রামবাসীরা অনেক আগেই শয্যাগ্রহণ করেছিল। মা আর ছেলের আর্তক্ৰন্দন শুনে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালিয়ে তারা চোরের কুটিরে এল, তারপর তার ছেলের মুখ থেকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনল। কিন্তু সেই রাতে কেউ কিছু করতে রাজি হল না। সকলেই জানত বাপ-ছেলে দুজনেই চোর চোরের মৃতদেহ উদ্ধার করার জন্য রাতের অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদের সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছা তাদের ছিল না।

পরের দিন বেশ বেলা হলে গ্রামবাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছেলেটির সঙ্গে রওনা হল এবং অকুস্থলে গিয়ে চোরের মৃতদেহ দেখতে পেল। লোকটির গলা থেকে পেট পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে, সমস্ত শরীর নখদন্তে ছিন্নভিন্ন, জায়গাটা রক্তে ভাসছে। কিন্তু প্যান্থার মৃতদেহের মাংস ভক্ষণ করেনি, হত্যাকাণ্ড সমাধা করে সে চলে গেছে।

আবার কয়েকদিন খুব শোরগোল চলল। লোকজন দল বেঁধে অস্ত্র নিয়ে পথ চলতে শুরু করল। কিন্তু বেশ কিছুদিনের মধ্যেও কোনো হত্যাকাণ্ড যখন অনুষ্ঠিত হল না, তখন স্থানীয় মানুষ আবার স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা শুরু করল। ধীরে ধীরে প্যান্থারের কথা লোকে ভুলে গেল।

কয়েকটা সপ্তাহ কাটল। আবার এল শুক্লপক্ষ। জ্যোৎস্না রাতেই জঙ্গলের মধ্যে দুবৃত্তরা যাবতীয় দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হয়। ওই সময়ে যেখানে হরিণরা নুন চাটতে অথবা জলপান করতে আসে, সেইসব জায়গায় ওত পেতে বসে চোরাই শিকারির দল (poachers) এবং কাঠ চোরের দল। কাঠ চোর চাঁদনি রাতে চন্দন, মাথি, বাঁশ প্রভৃতি কেটে নদীপথে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অথবা গোরুর গাড়িতে বোঝাই করে চোরাই মাল নিয়ে চম্পট দেয়।

এ ছাড়া আছে আর এক ধরনের চোর। তারা চুরি করে মাছ। এরা বঁড়শি বা জাল দিয়ে মাছ ধরে না। ঘরে তৈরি হাতবোমা জলে ফাটিয়ে মাছ ধরে। বিস্ফোরণের ফলে ছোটোবড়ো অসংখ্য মাছ মরে অথবা অজ্ঞান হয়ে জলের উপর ভেসে ওঠে। বাঁশের ডগায় বসানো জলের সাহায্যে বড়ো বড়ো মাছগুলি ধরে চোরের জল নৌকা বোঝাই করে। ছোটো ছোটো মরা মাছগুলো ভেসে যায়, পরে বড়ো মাছ আর কুমিরের খাদ্যে পরিণত হয়।

এই মাছ চুরির জন্য দুটি ডিঙি নৌকা ব্যবহার করা হয়। একটি ডিঙি থেকে বোমা ছোঁড়া হয়, আর একটি শুধু মাছ বোঝাই করার জন্য থাকে। মাছের ভারে ডিঙি যতক্ষণ ডুবে যাওয়ার উপক্রম না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত চোররা মাছ ধরে যায়। জোয়ালের জলে মাইল পাঁচেক ডিঙি ভাসিয়ে একসময়ে তারা ডিঙি থামায়, তারপর মাছগুলোকে থলিতে ভরে রাখে। প্রত্যেক চোর একটা করে থলি বহন করে। ডিঙি দুটোকে উলটো করে ফেলে এক-একটা ডিঙি দুজন করে মানুষ মাথায় তুলে হাঁটতে থাকে সেইদিকে, যেখান থেকে তারা প্রথম ডিঙি ভাসিয়েছিল।

নদীতে জোয়ারের জল ঠেলে ওই গোলাকার চামড়ায় ঢাকা ডিঙি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই এই পরিশ্রম। হালকা দাঁড়গুলো অবশ্য সমস্যা নয়। হাতে হাতে সেগুলো সবাই নিয়ে যায়। অমাপক্ষ হলে চোররা বিশ্রাম নেয়। আবার শুক্লপক্ষের আবির্ভাবে তাদের কাজকর্ম শুরু।

সেই রাতটাও ছিল শুক্লপক্ষের চাঁদনি রাত। একদল চোর চুরি করতে বেরিয়েছিল। ক্রমাগত বোমা মেরে মাছ তুলে তারা ডিঙি বোঝাই করছিল। মাছ বোঝাই করার ডিঙিতে ছিল মাত্র একটি লোক। কারণ, লোক কম হলে সংখ্যায় বেশি মাছ রাখা যায়। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত মাছ ধরার পর যে ডিঙি থেকে বোমা ছোঁড়া হচ্ছিল, সেই ডিঙির লোকরা হাঁক দিয়ে মাছ-বোঝাই ডিঙির মালিককে বলল, অনেক হয়েছে, এবার ডাঙায় ভেড়াও। কিছু খাওয়া দরকার।

মাছ-বোঝাই ডিঙির নিঃসঙ্গ লোকটি খুশি হল, সে সতর্কভাবে খরস্রোতা নদী বেয়ে ধীরে ধীরে ডিঙিটাকে পাড়ে নিয়ে এল। ডিঙির তলায় বাঁশের সঙ্গে যে-দড়ি বাঁধা থাকে, সেইটা নিয়ে লোকটা একলাফে পাড়ে উঠল। একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে দড়িটাকে বেঁধে ডিঙিটাকে সে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হল না। দুই নম্বর ডিঙি থেকে তার বন্ধুরা দেখল একটা দীর্ঘ ধূসর বস্তু নদীর তীরবর্তী ঝোপ থেকে লাফিয়ে পড়ল। তাদের কানে এল একটা চাপা গর্জন, পরক্ষণেই তারা দেখল তাদের সঙ্গীটি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে এবং তার দেহের উপর রয়েছে সেই ধূসর বস্তু!

একটা কান-ফাটানো আর্ত চিৎকার–সঙ্গেসঙ্গে চোরের দল দেখল মাছভরতি ডিঙিটা খরস্রোতা নদীর জলে ছুটে চলেছে এবং তাদের সঙ্গীর হাত থেকে খসে পড়ে মোটা দড়িটাও ছুটছে ডিঙির সঙ্গে!

বোমা ছোঁড়ার ভূমিকায় যে-ডিঙিটা ছিল, সেই ডিঙির মাঝি প্রাণপণে দাঁড় চালিয়ে মাছভরতি ভেসে-যাওয়া ডিঙিটাকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ডিঙিতে অনেক লোক ছিল বলে সেটা ছিল বেজায় ভারী, তাই মাঝির চেষ্টা সফল হল না। ভেসে-যাওয়া ডিঙিটা মাঝনদীতে ছিটকে এসে কয়েকটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে উলটে গেল। সঙ্গেসঙ্গে এত কষ্টে ধরা মাছগুলো অদৃশ্য হল নদীগর্ভে। নিতান্ত দুঃখের সঙ্গে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখল চোরের দল, তারপর তারা তীরের দিকে তাদের ডিঙিটাকে ফেরাল। যে হাঁদা লোকটা হাতের দড়ি ধরে রাখতে পারে না, তাকে এবার আচ্ছা করে ঠেঙানি দিতে হবে এই হল তাদের মনোগত বাসনা। মাছ তো গেলই, ডিঙিটাও গেল ওই ধরনের একটা ডিঙি জোগাড় করতে তাদের অন্তত এক-শো টাকা খরচ হবে, তা ছাড়া মাছের দাম তো আছেই। নির্বোধ সঙ্গীকে বেশ ভালোরকম প্রহার করার সংকল্প নিয়েই তীরে এসে তরী ভেড়াল চোরের দল।

কিন্তু নদীতীরে লোকটার কোনো চিহ্ন নেই তো! তখন হঠাৎ সেই দীর্ঘ ধূসর বর্ণ বস্তুটির কথা তাদের মনে পড়ল। হ্যাঁ, একটা গর্জনও শোনা গিয়েছিল বটে! লোকটাও যেন হঠাৎ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে!

যে-ব্যক্তি ডিঙি চালাচ্ছিল, সে নদীর পাড়ে উঠে নিরুদ্দেশ সঙ্গীর খোঁজ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সবাই তাকে নিষেধ করল। প্রথমে তারা ভেবেছিল তাদের সঙ্গী কোনো প্রেতাত্মার কবলে পড়েছে। একটু পরেই হঠাৎ তাদের মনে পড়ল প্যান্থারটির কথা। কিছুক্ষণ আলোচনা করে তারা স্থির করল ওই জন্তুটাই তাদের সঙ্গীকে আক্রমণ করেছিল। এতক্ষণে জন্তুটা নিশ্চয়ই লোকটাকে মেরে ফেলেছে এবং অন্ধকার নিরালা জায়গায় বসে শিকারের মাংস ভক্ষণ করছে। এই সিদ্ধান্তে আসতেই তারা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেইদিকে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীত দিকে ডিঙি বাইতে শুরু করল। কিন্তু প্রায় আধমাইল যাওয়ার পর আর ওইভাবে ডিঙি চালানো সম্ভব হল না। তখন চোরের দল ডিঙিটাকে পাড়ের ওপর তুলে রেখে যথাসম্ভব দ্রুত পদচালনা করল গ্রামের উদ্দেশ্যে। পথ চলার সময় তারা চিৎকার করে কথা বলছিল, যাতে প্যান্থারটা ভয় পেয়ে তাদের সামনে না-আসে।

পরের দিন সূর্য যখন মাথার উপর আগুন ছড়াচ্ছে, সেই সময় সমগ্র গ্রামের লোক দল বেঁধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধানে যাত্রা করল। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, তাকে পাওয়া গেল নদীর ধারে একটা ঝোপের কাছে। জীবিত নয় মৃত–ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। অন্যান্য বারের মতো এবারও দেখা গেল প্যান্থার মানুষটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বটে, কিন্তু তার মাংস খায়নি।

এরপর শুরু হল হত্যার তাণ্ডবলীলা। আরও কয়েকটি মানুষ প্রাণ দিল প্যান্থারের কবলে। প্যান্থার শুধু হত্যা করে, মাংস খায় না। প্রত্যেকটি মৃতদেহকে জন্তুটা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত করে ফেলে যে, লোকগুলোকে চিনতে পারাই কষ্টকর হয়ে ওঠে। মনে হয় দারুণ আক্রোশে জন্তুটা ক্রমাগত আঘাত করে গেছে, হত্যার পরেও মানুষগুলোর ওপর তার রাগ যায়নি।

এই সময়ে নিতান্তই ঘটনাচক্রে একটি জিপগাড়ি চড়ে অকুস্থলে এসে পড়লেন বিখ্যাত শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসন। প্যান্থারের উপদ্রবের বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না, তিনি এসেছিলেন মাছ ধরতে। সঙ্গে ছিল তার ছেলে ডোনাল্ড ওরফে ডন, ডনের বন্ধু মারওয়ান, সেডন টাইনি নামে এক ওস্তাদ মাছ-শিকারি এবং থাংগুভেলু নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি–যে একাধারে শিকার, গাড়ি পরিষ্কার, রন্ধন, পরিবেশন প্রভৃতি সর্ব বিষয়ে সর্ব বিদ্যা বিশারদ।

বাঙ্গালোরে অবস্থিত অ্যান্ডারসন সাহেবের বাড়ি থেকে পাক্কা নিরানব্বই মাইল দূরে কাবেরী নদীর ধারে যেখানে তাদের আস্তানা ফেলা হল, সেই জায়গাটা তালাইনভু গ্রাম থেকে দশ মাইল দূরে। ওইখানেই মাছ ধরা হবে বলে স্থির হল।

রাতের খাওয়া শেষ করে সকলে বনের মধ্যে একটা জায়গা পরিষ্কার করে শুয়ে পড়ল।

ওই অঞ্চলে যে একটি নরঘাতক প্যান্থারের আবির্ভাব হয়েছে সে-কথা আগন্তুকরা জানতেন না, অতএব কারো মনে দুশ্চিন্তা ছিল না। তবে একটা বিপদের সম্ভাবনা ছিল–হাতি। তাই সারা রাত অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা হল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল…

হঠাৎ অ্যান্ডারসন সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘড়ি দেখলেন। তিনটে বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে। আগুন প্রায় নিবে এসেছে, অন্ধকার ভেদ করে জ্বলছে কয়েক টুকরো জ্বলন্ত কাঠ। আগুনটাকে সারারাত জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব যার ছিল, সেই থাংগুভেলু গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সাহেবের বাঁ-দিকে তার ছেলে ডোনাল্ড নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। ডান দিকে মারওয়ান আর টাইনি রাতের শিশির এবং মশার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য মাথা-মুখ চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

অ্যান্ডারসন ভাবতে লাগলেন হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল কেন? জঙ্গলের ভিতর থেকে কোনো সন্দেহজনক শব্দ ভেসে আসছে কি… কিন্তু ছেলে ডোনাল্ডের প্রচণ্ড নাসিকাগৰ্জন ছাড়া আর কিছুই তিনি শুনতে পেলেন না…

হঠাৎ তিনি জানতে পারলেন তার ঘুম ভাঙার কারণ। খুব কাছেই জেগে উঠল করাত চালানোর মতো খসখসে শ্বাপদ কণ্ঠের আওয়াজ হা-আঃ! হা-আঃ! হা-আঃ! ক্ষুধিত প্যান্থারের কণ্ঠস্বর!

সাহেব বুঝলেন নিদ্রিত অবস্থায় তার মগ্নচৈতন্য ওই শব্দে সাড়া দিয়েছে, আর সেইজন্যই তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে।

অ্যান্ডারসন ভয় পেলেন না। শিকারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন প্যান্থার মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক নয়। প্যান্থার মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলে। অবশ্য আহত হলে বা কোনো কারণবশত নরমাংসের প্রতি আকৃষ্ট হলে ভয়ের কথা বটে। তবে নরখাদক প্যান্থার অতিশয় বিরল। মা-প্যান্থারের কাহিনি তখন পর্যন্ত জানতেন না, তাই প্যান্থারের আক্রমণের সম্ভাবনা তাকে উদবিগ্ন করেনি।

আবার জাগল শ্বাপদ কণ্ঠে অবরুদ্ধ গর্জন ধ্বনি। সাহেব শব্দ লক্ষ করে টর্চের আলো ফেললেন। জন্তুটাকে এবার স্পষ্ট দেখা গেল। নিদ্রিত থাংগুভেলুর থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে মাটির ওপর গুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে শ্বাপদ। বসার ভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় সে থাংগুভেলুর উপর লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে।

সাহেব রাইফেলের দিকে হাত বাড়ালেন। অস্ত্রটাতে গুলি ভরে পাশেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাইফেল বাগিয়ে ধরার আগেই হঠাৎ থাংগুভেলু ঘুমের ঘোরে উঠে বসল। তার পায়ের কাছে ছিল জলভরা ডেকচি, পায়ের ধাক্কা লেগে পাত্রটা সশব্দে নড়ে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে জন্তুটা একলাফে অদৃশ্য হল অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে। থাংগুভেলু অবশ্য ততক্ষণে আবার শুয়ে পড়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

অ্যান্ডারসন এইবার হইহই করে সকলকে ডেকে তুললেন এবং প্যান্থারের উপস্থিতির কথা বললেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চাইল না। প্রত্যেকেরই বিশ্বাস তিনি ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন।

অ্যান্ডারসনকে একটু ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে সকলেই আবার নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মন দিল। সাহেবের আর ঘুম এল না। বাকি রাতটা তিনি রাইফেল হাতে জেগে রইলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস একটা মানুষখেকো প্যান্থারকেই তিনি দেখেছেন–জন্তুটা থাংগুভেলুকে আক্রমণের উদ্যোগ করছিল।

পরের দিন মাছ ধরার পালা। টাইনি কয়েকটা মাছ ধরল। অ্যান্ডারসন আর তার ছেলে ডোনাল্ড ওরফে ডন অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের ছিপে একটিও মাছ উঠল না। মারওয়ান বলল সে স্নান করতে যাচ্ছে। স্নানের ফলে যাতে মাছ ধরার বিঘ্ন না হয়, সেইজন্য যেখানে মাছ ধরা হচ্ছিল তার থেকে একটু দূরে, নদীস্রোত যেদিক থেকে আসছে, সেইদিকে চলল মারওয়ান কাঁধে একটি তোয়ালে নিয়ে।

অন্য কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, গতরাত্রে প্যান্থারের উপস্থিতি সম্পর্কে অ্যান্ডারসন সাহেবের কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না এবং সেটা যে নরখাদক এ-বিষয়েও তিনি ছিলেন নিশ্চিত, অতএব তিনি মারওয়ানকে ডেকে বললেন, দাঁড়াও, আমিও আসছি।

হাতে রাইফেল আর কাঁধে রাইফেল নিয়ে মারওয়ানকে অনুসরণ করলেন কেনেথ অ্যান্ডারসন।

সেদিন বিকালের দিকে নদীর জলে বোমা ফাটার আওয়াজ শুনে অ্যান্ডারসন সাহেব ও তার দলবল শব্দ লক্ষ করে ছুটলেন। নদীর বাঁক ঘুরতেই মাছ চোরদের দুটি ডিঙি তারা দেখতে পেলেন। একটা ডিঙিতৈ মাছ বোঝাই, আর একটাতে কয়েকজন লোক অর্থাৎ চোরের দল। সাহেবদের দেখে চোররা ঘাবড়ে গেল, তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে তারা চম্পট দেওয়ার উপক্রম করল। কিন্তু অ্যান্ডারসনের সঙ্গীরা তাদের পালাতে দিল না, বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে তাদের তীরে ডিঙি ভেড়াতে বাধ্য করা হল। তারপর শুরু হল বাগযুদ্ধ। সাহেবের ছেলে ডন তাদের চৌর্যবৃত্তির জন্য তিরস্কার করল। চোরদের বক্তব্য হচ্ছে, মাছগুলো যখন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, তখন মাছ ধরায় দোষ কী? সাহেবরাই-বা তাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কোন অধিকারে? তারা কি সরকারের লোক? থাংগুভেলু এইসব আইনঘটিত প্রসঙ্গে যোগ দিল না, তার বক্তব্য হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মাছ দুটি তাদের দিয়ে চোররা যেখানে খুশি যাক, তাদের গন্তব্য বিষয় নিয়ে শিকারিদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

অ্যান্ডারসন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার বললেন, আচ্ছা, তোমরা বলতে পারো এই এলাকায় কোনো মানুষখেকো প্যান্থার আছে কি না?

বেশ কিছুক্ষণ সকলে স্তব্ধ। তারপর একজন মৃদুস্বরে বলল, হ্যাঁ, ভোরাই, আছে। জন্তুটা অনেক মানুষ মেরেছে। আমাদের দলেই কালু নামে একটি লোক তার কবলে মারা গেছে। কয়েকদিন আগে। আমরা তাই দিনের বেলায় মাছ ধরছি। আমরা চাঁদনি রাতেই মাছ ধরি। কিন্তু এখন সন্ধ্যার পর কেউ ঘরের বাইরে যেতে সাহস পায় না।

লোকটির কথা শুনে সাহেবের ছেলে ডন দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল, চুলোয় যাক মাছ। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। আমাদের কাছে এই প্যান্থার সম্পর্কে সব কিছু খুলে বলো। আমরা শিকারি, জন্তুটাকে গুলি করে মারতে চেষ্টা করব।

লোকগুলো আশ্বস্ত হয়ে তীরে নামল। তারপর তাদের মুখ থেকে সাহেব এবং তার সঙ্গীরা প্যান্থারটির সম্পর্কে সব কিছু শুনলেন। সেসব কথা আগেই সবিস্তারে বলা হয়েছে, তাই এখানে আর পুনরাবৃত্তি করলাম না।

ঘটনার বিবরণ শুনে শিকারিদের সহানুভূতির সঞ্চার হল মা-প্যান্থারের উপর। বন্য শ্বাপদের এমন প্রতিহিংসা গ্রহণের প্রবৃত্তি বড়ো একটা হয় না। ব্যাঘ্র জাতীয় পশুরা অনেক সময় মানুষের অস্ত্রে আহত হলে নরভুক হয়, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র। আহত অবস্থায় দ্রুতগামী বলিষ্ঠ বন্য পশুদের হত্যা করতে অসমর্থ হয়ে বাঘ অথবা প্যান্থার মানুষের মতো দুর্বল শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেখানে প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব থাকে না, অতি সহজে ক্ষুধা নিবারণের জন্যই তারা নরখাদকে পরিণত হয়।

কিন্তু এই মেয়ে-প্যান্থারটি মানুষকে হত্যা করে, মাংস খায় না। শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই সমগ্র মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে সে জেহাদ ঘোষণা করেছে! এমন ঘটনার কথা বড়ো একটা শোনা যায় না।

যাই হোক, মা-প্যান্থারের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও শিকারিরা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জন্তুটা বেঁচে থাকলে বহু নিরপরাধ মানুষ তার কবলে মারা পড়বে। অতএব মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক ওই পশুকে হত্যা করাই শিকারির কর্তব্য বলে সকলে মনে করলেন।

শিকারিরা বড়ো জানোয়ার মারতে আসেননি, এসেছিলেন মাছ ধরতে। তবে মাছ ধরার সাজসরঞ্জাম ছাড়াও তাদের সঙ্গে দুটি রাইফেল আর দুটি শটগান ছিল। পরামর্শের ফলে স্থির হল টাইনি শটগান নিয়ে নদীর স্রোত অনুসরণ করে নদীতীর ধরে হাঁটবে ঘণ্টা দুই, তারপর ফিরে আসবে শিকারিদের আস্তানায়। মারওয়ান আর একটি শটগান নিয়ে নদীস্রোতের বিপরীত দিকে নদীতীরেই অনুসন্ধান করবে। অ্যান্ডারসন ও তার ছেলে ডন প্যান্থারের সন্ধান করবেন ভিন্ন ভিন্ন দিকে জঙ্গলের মধ্যে, তাদের হাতে থাকবে রাইফেল। থাংগুভেলু একটা গাছে উঠে জিপগাড়ি আর ছড়িয়ে-থাকা সরঞ্জামের উপর নজর রাখবে। স্থির হল, প্রত্যেকেই আস্তানায় ফিরবে বিকাল ৫টার মধ্যে।

ব্যাপারটা অবশ্য খুবই বিপজ্জনক। নদীর ধারে ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে প্যান্থার খুব সহজেই শিকারির গতিবিধি লক্ষ করতে পারবে, কিন্তু শিকারির পক্ষে উদ্ভিদের আবরণ ভেদ করে জন্তুটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। জন্তুটা নরহত্যা করতে উগ্রীব, প্রথম আক্রমণের সময়েই তাকে গুলি চালিয়ে বোড়ে ফেলতে না-পারলে শিকারি নিজেই শিকারে পরিণত হবে সন্দেহ নেই। দলের প্রত্যেকেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকবে, অর্থাৎ নিজেরাই টোপ হয়ে শ্বাপদকে আকৃষ্ট করবে–অতর্কিত আক্রমণের ফলে বিপন্ন সঙ্গীকে সাহায্যের সুযোগ অন্য শিকারিরা পাবে না, তাই প্রত্যেক শিকারিকেই নির্ভর করতে হবে নিজের ক্ষমতার উপর। ভুল হলে মৃত্যু নিশ্চিত।

আগের রাতে একটা শম্বর হরিণের চিৎকার শুনেছিলেন অ্যান্ডারসন সাহেব। হরিণজাতীয় পশু অনেক সময় মাংসাশী শ্বাপদের অস্তিত্ব বুঝতে পারলে চিৎকার করে বনের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাবধান করে দেয়। অতএব যেদিক থেকে বিগত রাত্রে শম্বর হরিণের চিৎকার সাহেবের কানে ভেসে এসেছিল, সেইদিকেই তিনি যাত্রা করলেন প্যান্থারের সন্ধানে।

পার্বত্য পথ বেয়ে এগিয়ে চললেন সাহেব। চারদিকে ছড়ানো বড়ো বড়ো পাথর, ঘন ঝোপঝাড়। ওই পাথর বা ঝোপের আড়ালে প্যান্থার লুকিয়ে থাকতে পারে অনায়াসে। কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলে ডন এবং তার সঙ্গীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়লেন অ্যান্ডারসন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, তিনি আশা করলেন তারাও তাঁর মতোই সতর্কতা অবলম্বন করবে।

চারদিক নিস্তব্ধ। অসহ্য গরম। পাখিদের কলকণ্ঠ সম্পূর্ণ নীরব। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হলেন সাহেব। সামনে বড়ো পাথর বা ঝোপঝাড় দেখলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে কাছে আসছিলেন সাহেব, তবে তিনি জানতেন পিছন থেকেই বিপদের ভয় বেশি–কারণ, বাঘ অথবা প্যান্থার মানুষ মারতে অভ্যস্ত হলেও মানুষকে ভয় পায় এবং সেইজন্যই অধিকাংশ সময়ে তারা মানুষকে পিছন থেকে আক্রমণ করে। অতএব সাহেবকে ক্রমাগত থামতে হচ্ছিল, কখনো সামনে কখনো পিছনে তাকাতে তাকাতে খুব ধীরে ধীরে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। বাতাসের ধাক্কায় আন্দোলিত উদ্ভিদ এবং বৃক্ষশাখার মর্মরধ্বনি শুনে মাঝে মাঝে প্যান্থারের অস্তিত্ব কল্পনা করে রাইফেল তুলে ধরেন তিনি, একটু পরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার অস্ত্র নামিয়ে পদচারণা করেন–এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর অ্যান্ডারসন বুঝলেন তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ছে, একেবারে অনভিজ্ঞ নতুন শিকারির মতো আচরণ করছেন তিনি।

এইবার তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠলেন, নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চললেন সামনে। আরও কিছুক্ষণ কাটল। কিছু ঘটল না। সাহেব মনে করলেন মাছ চোর প্যান্থারের ব্যাপারটা বাড়িয়ে বলেছে। নরঘাতিনী মেয়ে-প্যান্থারের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সন্দিহান হয়ে উঠলেন।

একটা পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠছিলেন অ্যান্ডারসন। একটু পরেই পাহাড়ের উপর উঠে তিনি নামতে শুরু করলেন ঘন বাঁশবনে ঘেরা একটি উপত্যকার দিকে…

কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর গাছের পাতা ঘর্ষণের শব্দ সাহেবের কানে এল, পরক্ষণেই গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ! শব্দের কারণ বুঝতে শিকারির কান ভুল করল না–গাছের পাতা আর ডালপালা দিয়ে উদর পূরণ করছে হাতি!

অ্যান্ডারসন থেমে গেলেন, যেদিক থেকে শব্দ আসছে সেইদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতি যদি একক হয়, তাহলে কাছাকাছি মানুষ দেখলে আক্রমণ করতে পারে। একক হস্তী অধিকাংশ সময়ে দলছাড়া গুন্ডা হয়, মানুষ বা অন্য জন্তু দেখলে সে হত্যা করতে চায়। হাতির দল থাকলে বিশেষ ভয় নেই, মানুষ দেখলে তাদের সরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শব্দ যেদিক থেকে আসছে, সাহেবের চলার পথটা গেছে সেইদিকেই। হাতিকে এড়াতে হলে ঘন বাঁশঝোপ আর কাটাবনে ঢুকতে হয়, আর সে-রকম জায়গায় ক্রুদ্ধ পান্থার বা হাতির সম্মুখীন হলে শিকারির সমূহ বিপদ–তাই সোজা রাস্তা ধরেই এগিয়ে চললেন সাহেব।

সাহেবের পিছন দিক থেকে জোর হাওয়া আসছিল। সামনে গাছের ডালপালা ভাঙার আওয়াজ হঠাৎ থেমে গেল। সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। চারদিক স্তব্ধ। অর্থাৎ হাতিও বাতাসে গন্ধ পেয়ে আহারে ক্ষান্ত হয়েছে। এখন হয় সে নিঃশব্দে সরে গেছে, অথবা মানুষটাকে চাক্ষুষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

এই প্রকাণ্ড জন্তুগুলো নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে, কিন্তু জঙ্গল সেখানে এমন ঘন যে, সেই নিবিড় উদ্ভিদের আবরণের ভিতর দিয়ে চলতে গেলে সামান্য একটু শব্দ হবেই হবে–সাধারণ মানুষের কান সেই তুচ্ছ শব্দের কারণ ধরতে না-পারলেও অভিজ্ঞ শিকারি সেই শব্দ থেকেই গজরাজের চলাচেলের সংবাদ জানতে পারবেন। কোনো শব্দ কানে না-আসায় সাহেব বুঝলেন হাতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বাতাস নিশ্চয়ই তার কাছে নিকটবর্তী মানুষের সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে হাতির ঘ্রাণশক্তি অতিশয় প্রবল।

আরও দশ মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সাহেব। হাতি নড়ল না। বোধ হয় ভাবছিল দু-পেয়ে আপদটা বিদায় না-হওয়া পর্যন্ত নিঃশব্দে অপেক্ষা করাই ভালো।

অবশেষে সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতিটাকে ভয় দেখানোর জন্য জোরে শিস দিতে দিতে তিনি সামনে এগিয়ে চললেন সামনের পথ ধরে। ফল হল তৎক্ষণাৎ। অবশ্য সাহেব যা আশা করেছিলেন তা হল না–হাতি স্থানত্যাগ করল বটে, কিন্তু পিছন ফিরে পালাল না, ক্রোধে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল সাহেবের দিকে! ঘন জঙ্গল ভেদ করে মুহূর্তের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল একটা প্রকাণ্ড মাথা আর হত্যার আগ্রহে উদ্যত একজোড়া সুদীর্ঘ গজদন্ত!

মহা মুশকিল! ওই এলাকায় কোনো গুন্ডা হাতির অস্তিত্ব সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়নি। জন্তুটাকে গুলি করে মারলে বন বিভাগ অ্যান্ডারসনকে নিয়ে টানাটানি করবে আর তার ফলে সাহেবের দুর্গতির সীমা থাকবে না। দৌড়ে পালাতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য, কারণ ক্রুদ্ধ হস্তী তাহলে নির্ঘাত সাহেবকে অনুসরণ করে ধরে ফেলবে এবং হত্যা করবে–দৌড়ের প্রতিযোগিতায় মানুষের পক্ষে হাতিকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য গুলি চালিয়ে হাতির হাঁটু ভেঙে দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাহলে জন্তুটা দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করবে–অনর্থক জানোয়ারকে কষ্ট দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না অ্যান্ডারসন সাহেব।

হ্যাঁ, আর একটা উপায় আছে, আর সেই উপায়ই অবলম্বন করলেন সাহেব। শূন্যে রাইফেল তুলে আওয়াজ করতেই হাতি চমকে থেমে গেল। তার পায়ের ধাক্কায় রাশি রাশি ঝরাপাতা আর ধুলোর ঝড় উড়ল চারদিকে। সাহেব সামনে এগিয়ে এসে আবার রাইফেলের আওয়াজ করলেন।

এইবার গজরাজ ভয় পেল। ক্রুদ্ধ বৃংহন-ধ্বনির পরিবর্তে তার কণ্ঠে জাগল ভয়ার্ত চিৎকার। ছোট্ট বেঁটে লেজটা পিছনের দুই পায়ের ফাঁকে গুটিয়ে সে দ্রুতবেগে পলায়ন করল।

সব দিক রক্ষা পাওয়ায় খুশি হলেন সাহেব। হাতি বাঁচল, তিনিও বাঁচলেন। কিন্তু নিজের উপর তিনি বিরক্ত। চুপচাপ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে হাতিটা নিশ্চয়ই চলে যেত। রাইফেলের আওয়াজ শুনে খুনি প্যান্থার আর এদিকে আসবে না। মাত্র আধঘণ্টা হল তিনি আস্তানা ছেড়ে বনের মধ্যে এসেছেন, এখন আর এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি? প্যান্থারের সাক্ষাৎ আজ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর সাহেব আবার অগ্রসর হলেন। অন্তত মিনিট দশের মধ্যে প্যান্থার, হাতি বা অন্য কোনো হিংস্র জানোয়ারের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই; রাইফেলের শব্দে কাছাকাছি যেসব পশু ছিল, তারা নির্ঘাত দূরে সরে পড়েছে। পদে পদে চারদিকে নজর রাখার দরকার আর ছিল না, তাই খুব কম সময়ের মধ্যেই ঘন বাঁশবন পেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় তিনি পৌঁছে গেলেন। এখানে রয়েছে বাবুল, বোরাম, ছোটো ছোটো তেঁতুল গাছ এবং মাটির ওপর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লম্বা লম্বা ঘাস আর ঘাস। পায়ে চলা যে-পথ ধরে সাহেব এগিয়ে চলছিলেন, সেই পথটা বিস্তীর্ণ ঘাসের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, তার পরিবর্তে এখানে-ওখানে তৃণাবৃত প্রান্তর ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছে আরও অনেকগুলো ছোটো ছোটো পায়ে-চলা পথ। হরিণদের পায়ে পায়ে ওই পথগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। জায়গাটা পরীক্ষা করে অ্যান্ডারসন বুঝলেন তিনি হরিণদের প্রিয় বাসভূমিতে এসে পড়েছেন। মাংসাশী পশুর প্রিয় খাদ্য হচ্ছে হরিণ–সুতরাং সাহেবের আশা হল এইখানে খুনি প্যান্থার হয়তো হানা দিতে পারে।

সাহেব আরও একটু এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তার কানে এল পাখির ডাকের মতো এক বিচিত্র শব্দ! শব্দের তরঙ্গ আসছে তারই দিকে! না, ওগুলো পাখির ডাক নয়–বুনো কুকুর! একপাল বুনো কুকুর কোনো হতভাগ্য শিকারকে তাড়া করে সাহেবের দিকেই ছুটে আসছে।

সাহেব তাড়াতাড়ি একটা ছোটো তেঁতুল গাছের আড়ালে সরে দাঁড়ালেন।

ভারতীয় বুনো কুকুর অতি ভয়ংকর জীব। বনের সব জানোয়ারই তাকে ভয় পায়। এই কুকুরগুলো দল বেঁধে শিকার করে। কোনো হরিণের পিছনে যদি বুনো কুকুরের দল তাড়া করে, তবে আর রক্ষা নেই। যতই দ্রুতগামী হোক পলাতক হরিণ একসময়ে ধরা পড়বেই, আর কুকুরগুলো তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খাবে।

গাছের ডালপালার ওপর শিং-এর ঘষা লাগার আওয়াজ শুনতে পেলেন সাহেব, সঙ্গেসঙ্গে জঙ্গল ভেদ করে তার সামনে আত্মপ্রকাশ করল একটি সুন্দর শম্বর হরিণ। তার মুখ থেকে ফেনা ঝরে পড়ছে, কাঁধের ওপরও জড়িয়ে রয়েছে মুখের ফেনা, আর তার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে দারুণ আতঙ্কে! হরিণটা থামল না, তিরবেগে ছুটে পালাতে লাগল।

আচম্বিতে জাগল বজ্রপাতের মতো ভীষণ গর্জনধ্বনি, পরক্ষণেই ডোরাকাটা একটা শরীর শূন্যপথে উড়ে এসে পড়ল ধাবমান শম্বরের পিঠের উপর!

একটা বাঘ শিকারের খোঁজে হরিণদের বিচরণ ভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে কুকুরের চিৎকার নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিল এবং তারা যে শিকার তাড়িয়ে নিয়ে আসছে সেটাও বুঝতে পেরেছিল। সাধারণত বাঘ বুনো কুকুরদের এড়িয়ে চলে, এই বাঘটাও হয়তো তাই করত কিন্তু হরিণটা তার কাছে এসে পড়ায় সে লোভ সামলাতে পারেনি, শিকারের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

বাঘের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সে নিশ্চয়ই সাহেবের অনেক আগেই কুকুরগুলোর চিৎকার শুনতে পেয়েছিল এবং উৎকর্ণ হয়ে শব্দের গতি নির্ণয় করছিল, সেইজন্য সাহেবের মৃদু পদধ্বনি তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেনি।

বাঘের গুরুভার দেহ হঠাৎ পিঠের ওপর পড়তেই শম্বরের পিঠ বেঁকে গেল, তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত চিৎকার, তারপরই দুটি জানোয়ার জড়াজড়ি করে পড়ে গেল মাটির উপর। লম্বা লম্বা ঘাসের আঁড়ালে ভূপতিত পশু দুটিকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না সাহেব কিন্তু মেরুদণ্ড ভাঙার আওয়াজ এবং শক্ত মাটিতে খুরের সংঘাতজনিত শব্দ শুনে বুঝলেন বাঘ তার শিকারকে হত্যা করছে, মাটির ওপর মৃত্যুকালীন আক্ষেপে পা ঠুকছে মরণাহত হরিণ।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে অকুস্থলে উপস্থিত হল একপাল বুনো কুকুর!

সাহেব যেখানে আত্মগোপন করেছিলেন, সেখান থেকে ঘাসের আড়ালে উপবিষ্ট বাঘকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। সে মৃত শিকার আগলে রেখে কুকুরগুলোকে তাড়াবার জন্য ভীষণ গর্জনে বন কাঁপাতে লাগল। সেইসঙ্গে কাঁপতে লাগল সাহেবের বুক। কিন্তু কুকুরের দল নির্বিকার!

অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের চমক সামলে নিয়ে কুকুরগুলো মৃত হরিণ আর বাঘকে ঘিরে ফেলল। সাহেব গুনে দেখলেন দলে রয়েছে নয়টি কুকুর।

হঠাৎ কুকুরগুলোর কণ্ঠস্বর বদলে গেল, পাখির ডাকের মতো তীক্ষ্ণ কলধ্বনির পবির্তে তাদের কণ্ঠে জাগল এক করুণ ও বিলম্বিত শব্দের তরঙ্গ! শিকারি অ্যান্ডারসনের কাছে ওই পরিবর্তিত কণ্ঠস্বরের অর্থ অজানা ছিল না–কুকুরগুলো এখন তারস্বরে সাহায্য চাইছে। জাতভাইদের কাছে।

প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে ওই সাহায্য প্রার্থনা কখনো বিফল হয় না। আশেপাশে অবস্থিত প্রত্যেকটি বুনো কুকুর ওই করুণ কণ্ঠের আহ্বান শুনলেই ছুটে আসবে। অরণ্যের সারমেয় সমাজে এটাই। হল অলিখিত আইন। এই আইন মেনে চলে প্রত্যেকটি বনবাসী কুকুর।

বাঘ এতক্ষণ লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে গুঁড়ি মেরে পড়ে ছিল, এবার সে উঠে দাঁড়াতেই তার সমগ্র শরীর সাহেবের দৃষ্টিগোচর হল। ধীরে ধীরে দেহ ঘুরিয়ে সে শত্রুপক্ষের সংখ্যা নির্ণয় করল। তার মুখ তখন ক্রোধে বিকৃত হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, হিংস্র দন্ত বিস্তার করে সে ভীষণ শব্দে গর্জন করছে এবং তার দীর্ঘ লাঙ্গুল পাক খাচ্ছে দেহের দু-পাশে বারংবার! অভিজ্ঞ শিকারি অ্যান্ডারসন লেজ নাড়ানোর ভঙ্গি দেখে বুঝলেন বাঘ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, কিন্তু সে ভয় পেয়েছে এ-কথাও সত্যি।

কুকুরগুলো বাঘের ভীতি প্রদর্শনে বিচলিত হল না, তারা একটানা বিষণ্ণ স্বরে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে লাগল। অরণ্যের বুকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে বাজতে লাগল ব্যাঘ্রের ভৈরব গর্জন আর সারমেয় বাহিনীর উৎকট ঐকতান!

বাঘ বুঝল যত দেরি হচ্ছে, ততই তার বিপদ বাড়ছে। হঠাৎ দুই লাফে এগিয়ে গিয়ে বাঘ তার সামনে দাঁড়ানো কুকুরটাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। আক্রান্ত কুকুর চটপট সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করল। বাঘের পিছনে যে কুকুরগুলো ছিল তারা এগিয়ে এল বাঘকে আক্রমণ করতে। বাঘ এইরকমই অনুমান করেছিল, চকিতে পিছন ফিরে সে ডাইনে-বাঁয়ে থাবা চালাল বিদ্যুদবেগে। কুকুরগুলো তাড়াতাড়ি আর থাবার নাগাল থেকে সরে গেল, শুধু একটি কুকুর একটু দেরি করে ফেলল–

সনখ থাবার প্রচণ্ড আঘাতে কুকুরটা ঠিকরে শূন্যে উঠে গেল এবং তার দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পিছনের একটি পা!

কুকুরগুলো আবার পিছন থেকে বাঘকে আক্রমণ করল। আবার ঘুরে দাঁড়াল বাঘ, আবার তার সামনে থেকে সরে গেল কুকুরের দল আর বাঘ যখন আক্রমণকারী কুকুরদের সামলাতে ব্যস্ত, সেই সময়ে পিছন থেকে আর দু-পাশ থেকে অন্য কুকুরগুলো ছুটে এল কামড় বসাতে।

বাঘ একপাশে ঘুরল, তারপর আশ্চর্য কৌশলে দিক পরিবর্তন করে পিছন থেকে তেড়ে আসা কুকুরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত্রুর এমন অভাবনীয় আচরণের সম্ভাবনা কুকুররা কল্পনা করতে পারেনি। সরে যাওয়ার আগেই বাঘের প্রচণ্ড দুই থাবা দুটো কুকুরকে মাটির উপর পেড়ে ফেলল। একটা আহত কুকুর তার বিদীর্ণ উদর নিয়ে অতিকষ্টে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাঘ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল।

শত্রুপক্ষকে বাঘ প্রায় বিধ্বস্ত করে এনেছিল, কিন্তু আহত কুকুরটাকে কামড়াতে গিয়েই সে ভুল করল। মুহূর্তের মধ্যে অন্যান্য কুকুরগুলো তাকে পিছন থেকে ও দু-পাশ থেকে ছেকে ধরল এবং কামড়ের পর কামড় বসিয়ে শরীর থেকে মাংস তুলে নিতে লাগল।

বাঘের ঘন ঘন গর্জনে বন কাঁপতে লাগল, কিন্তু এখন তার গর্জনে ভয়ের আভাস ফুটে উঠল

বাঘ হাঁপাচ্ছে। তার নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। কুকুরের দল বিশ্রামে রাজি নয়। তারা নতুন উদ্যমে আক্রমণ শুরু করল চিৎকার করতে করতে। বাঘ আবার গর্জে উঠল কিন্তু তার গর্জনে তেমন জোর নেই। যুদ্ধের আগ্রহ তার কমে এসেছে। সে এখন দস্তুরমতো শঙ্কিত!

আচম্বিতে ব্যাঘ্র গর্জন আর সারমেয় কণ্ঠের ঐকতান ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে এল এক নতুন শব্দের তরঙ্গ! দূর থেকে ভেসে আসছে বহু কুকুরের কণ্ঠস্বর–একদিক থেকে নয়, বিভিন্ন দিক থেকে এবং একইসঙ্গে!

সাহায্যের আশ্বাস! দলে দলে বুনো কুকুর ছুটে আসছে যুদ্ধে যোগদান করতে।

নাজেহাল বাঘ আর দাঁড়াল না। সভয়ে লেজ গুটিয়ে সে দৌড় দিল রণক্ষেত্র ত্যাগ করে। কুকুরগুলো নাছোড়বান্দা ক্লান্ত ও আহত দেহ নিয়েই তারা বাঘের অনুসরণ করল। দেখতে দেখতে সাহেবের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল পলাতক বাঘ আর অনুসরণকারী ছয়টি কুকুরের দল…

কিছুক্ষণ পরেই সাহায্যকারী কুকুরগুলো অকুস্থলে এসে পড়ল। প্রথমে পাঁচ, পরে আরও বারোটি কুকুর সেইখানে উপস্থিত হল। নিহত তিনটি কুকুরের দেহ থেকে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে করতে নবাগত কুকুরের দল হঠাৎ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তারপর ছুটে চলল সেই পথে, যে-পথ দিয়ে পালিয়েছে বাঘ এবং তার অনুসরণকারী ছয়টি কুকুর।

সব মিলিয়ে এখন প্রায় চব্বিশটি কুকুর বাঘের পিছু নিয়েছে। সাহেব বুঝলেন বাঘের আর নিস্তার নেই। কুকুরের দল একসময় বাঘকে ধরে ফেলবেই ফেলবে, তারপর সকলে মিলে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। বাঘকে শেষ করে ফিরে এসে কুকুরগুলো হরিণটাকেও যে খেয়ে ফেলবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অ্যান্ডারসন তার আস্তানায় ফিরে এসে দেখলেন টাইনি ফিরে এসেছে। একটু পরে এসে পড়ল মারওয়ান। তারা কেউ কিছু দেখেনি বা শোনেনি। বেশ দেরি করে এল সাহেবের ছেলে ডন। সে একটা প্যান্থারের পায়ের ছাপ দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ বনের পথে চলতে চলতে একটা গুহা তার চোখে পড়ে। গুহার মধ্যে প্যান্থর থাকতে পারে ভেবে সে কয়েকটা ঢিল ছুঁড়ে মারে। তার আশা ছিল ঢিল খেয়ে গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে প্যান্থার। হ্যাঁ, বেরিয়ে এসেছিল বটে কিন্তু প্যান্থার নয়, এক ভল্লুকী! তার পিঠে ছিল দু-দুটো বাচ্চা! ভল্লুকী বাচ্চা নিয়ে অন্ধের মতো ছুটতে ছুটতে অরণ্যগর্ভে অদৃশ্য হল, ডনকে সে দেখতে পায়নি। ভাগ্যিস দেখেনি, মানুষ দেখলে হয়তো সে আক্রমণ করত আর আত্মরক্ষার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে গুলি করতে বাধ্য হত ডন।

ভল্লুক পরিবারের সঙ্গে প্যান্থারের সহাবস্থান অসম্ভব, অতএব অনুসন্ধানপর্বে ইস্তফা দিয়ে আস্তানায় ফিরে এসেছিল ডোনাল্ড ওরফে ডন।

বনের মধ্যে অ্যান্ডারসন সাহেবের অভিজ্ঞতার কাহিনি শুনে সবাই তো অবাক। বাঘ আর কুকুরের লড়াইয়ের ঘটনা সকলকেই আকৃষ্ট করল। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, হাতিকে ভয় দেখানোর জন্যে সাহেবের গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা হল। ঠিক হল দু-ঘণ্টা পর পর পালা কবে সবাই পাহারা দেবে। চটপট রাতের খানা শেষ করে সকলে গল্পগুজব আরম্ভ করল। একসময় কথাবার্তা থেমে গেল, সকলের চোখে নামল তন্দ্রার আবেশ। পালা অনুসারে প্রথম দু-ঘণ্টা পাহারা দেবে থাংগুভেলু, তারপর মারওয়ান, তারপর অ্যান্ডারসন সাহেব স্বয়ং অ্যান্ডারসনের পরে যথাক্রমে ডোনাল্ড আর টাইনি।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে অ্যান্ডারসন শুনতে পেলেন পাহাড়ের উপর থেকে ভেসে আসছে। বাঘের গর্জন। তার মনে হল যে-বাঘটিকে কুকুরের দল তাড়া করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই হত্যা করেছিল, সেই নিহত বাঘের সঙ্গিনীই পাহাড়ের উপর গর্জন করে ফিরছে…

নির্দিষ্ট সময়ে সাহেবকে ঘুম থেকে তুলে মারওয়ান বলল, একটা প্যান্থারকে সে শিকারিদের আস্তানার পিছনে পাহাড়টার উপর থেকে ডাকতে শুনেছে। আওয়াজ আসছিল অনেক দূর থেকে। হ্যাঁ, আরও একটা কথা তার মনে পড়ছে–একটা পাখি, সম্ভবত বনমোরগ, শিকারিদের শয্যার খুব কাছ থেকে হঠাৎ চিৎকার করতে করতে পাখা ঝটপটিয়ে উড়ে গেছে। ব্যাপাটা এত তুচ্ছ যে, সে ঘটনাটার কথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিল।

মারওয়ান শুয়ে পড়ল। অ্যান্ডারসন তাকে কিছু বললেন না, কিন্তু বনমোরগের ব্যাপারটা তার কাছে আদৌ তুচ্ছ মনে হয়নি। পাখিটা হঠাৎ চিৎকার করে অন্ধকারের মধ্যে উড়ে গেল কেন? সে নিশ্চয়ই দিনের আলো থাকতে থাকতে রাতের নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে ওই জায়গাটাকে বেছে। নিয়েছিল। কোনো বিপদের সম্ভাবনা না-থাকলে পাখিটা রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত আশ্রয়ের জন্য অন্ধের মতো স্থানত্যাগ করে ছোটাছুটি করবে না। এই বিপদটা হয়তো শিকার-সন্ধানী পাইথন, বনবিড়াল বা ভাম হতে পারে এমনকী ক্ষুধার্ত কোনো প্যান্থারের উপস্থিতি অসম্ভব নয়। হরিণ, শুয়োর প্রভৃতি জানোয়ার প্যান্থারের প্রিয় খাদ্য হলেও পক্ষিমাংসে তার অরুচি নেই।

ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সাহেবের মনে হল নরঘাতিনী মেয়ে-প্যান্থারটাকে দেখেও পাখিটা ভয় পেয়ে থাকতে পারে। আগের রাতে ওই প্যান্থারটাই যে নিদ্রিত শিকারিদের আস্তানায় হানা দিতে এসেছিল সে-বিষয়ে সাহেবের সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। জন্তুটার মনুষ্যজাতির ওপর যেরকম বিদ্বেষ, আজ রাতেও নিদ্রিত শিকারিদের উপর তার হামলার সম্ভাবনা আছে বলেই সাহেবের মনে হল। অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে আরও একটা কাঠ তিনি ফেলে দিলেন, আলোটা জোর হলে নজর রাখার সুবিধা হবে। তারপর নদীর ধারে একটা মস্ত গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে বসলেন।

পিছনে নদী, পৃষ্ঠরক্ষা করছে গাছের গুঁড়ি–অতএব পিছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে পাহারা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন অ্যান্ডারসন…

রাত দুটো বাজল। তখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। পিছন থেকে ভেসে আসছে নদীর কল্লোলধ্বনি। মাঝে মাঝে জলচর জীবের সশব্দ আলোড়ন… মাছ, অথবা কুমির হওয়াটাও বিচিত্র নয়। বিপরীত দিকে নদীকূল থেকে ভেসে এল রাতচরা সারসের বিষণ্ণ চিৎকার। তারার মালায় সাজানো অন্ধকার আকাশের পটে আরও অন্ধকার এক উড়ন্ত ছায়া কয়েক মুহূর্তের জন্য সাহেবের দৃষ্টিপথে ধরা দিয়ে অদৃশ্য হল। অন্ধকারেও ওই উড়ন্ত ছায়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে ভুল করেননি শিকারি, ওটা হর্নড় আটল নামক অতিকায় পেঁচা। ওই পাখি রাতের শিকারি, অন্ধকারে খরগোশ ও অন্যান্য ছোটোখাটো জীবজন্তু মেরে খায়।

পেচক অন্তর্ধান করার পরেই কাঠের ওপর করাত চালানোর মতো একটা কর্কশ চাপা আওয়াজ সাহেবের কানে এল। জলকল্লোল ভেদ করে ওই অস্পষ্ট আওয়াজ আলাদা করে ধরার মতো শ্রবণশক্তি এবং ওই শব্দের তাৎপর্য উপলব্ধি করার মতো শিক্ষা সকলের নেই কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারসন বুঝলেন শব্দটা এসেছে প্যান্থারের গলা থেকে! অর্থাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ঘাতিনী!

আবার, আবার সেই মৃদু অথচ ভীতিপ্রদ শব্দ। এবারে খুব কাছে। নিদ্রিত মানুষগুলোর পিছনেই একটা ঘন ঝোপ থেকে শব্দ এসেছে। আক্রমণের মুখে সাহস সঞ্চয় করার জন্যই জন্তুটা চাপা গলায় গর্জন করছে। এখনই সে আক্রমণ করবে সন্দেহ নেই। শ্বাপদের উদ্দেশ্য বুঝলেও সাহেব টর্চের বোম টিপলেন না। কারণ সামনের ঝোপটাকে একটা নিরেট অন্ধকারের ভ্রুপের মতো লাগছিল, প্যান্থারকে সাহেব তখনও দেখতে পাচ্ছিলেন না। যদি এই মুহূর্তে সে ঝোপের আড়ালে থাকে, তাহলে আলো জ্বাললেও সাহেব তাকে দেখতে পাবেন না কিন্তু জন্তুটা তাকে দেখেই চম্পট দেবে, তাকে গুলি করার আর সম্ভাবনা থাকবে না। সুতরাং সাহেব আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চাইলেন।

কিন্তু প্যান্থার অপেক্ষা করতে রাজি হল না। আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে প্যান্থার যেরকম তীব্র ও ছোটো গর্জনে তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, ঠিক সেইভাবে গর্জন করে জন্তুটা একলাফে ঝোপ থেকে বেরিয়ে নিদ্রিত শিকারিদের কাছাকাছি এসে পড়ল। আর একটি লাফ দিলেই সে এসে পড়বে মানুষগুলোর ওপর।

ঠিক এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সাহেব। টর্চের আলোকরেখা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে নির্দিষ্ট নিশানাকে সাহেবের দৃষ্টিগোচর করে দিল–নিক্ষিপ্ত আলোকে জ্বলে উঠল প্যান্থারের দুই চক্ষু!

হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে জন্তুটা থমকে গেল, সাহেব রাইফেলের নিশানা স্থির করে ট্রিগার টিপতে উদ্যত হলেন

আচম্বিতে একটা প্রচণ্ড শব্দ! তারপরই আর একটা!

সঙ্গেসঙ্গে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল সাহেবের ছেলে ডন, জানিয়ে দিল বাবা গুলি ছোঁড়ার আগেই তার রাইফেল ঘাতিনীকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছে।

জন্তুটা তখনও মরেনি। খুব ধীরে ধীরে সে শ্বাস টানছিল, তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে প্রকাশ করছিল প্রাণশক্তির শেষ স্পন্দন।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই স্পন্দনও স্তব্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুবরণ করল ঘাতিনী।

মা-প্যান্থারের মৃত্যুতে খুশি হননি সাহেব। তবে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে ছেলের কৃতিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছিল।

বাস্তবিক, ঘুম-জড়ানো চোখে অন্ধকারের মধ্যে অব্যর্থ সন্ধানে লক্ষ্য ভেদ করার ক্ষমতা কয়জনের থাকে?

[১৩৮৭]