মরণ খেলার খেলোয়ার

মরণ খেলার খেলোয়ার

সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আজ নবজাগ্রত আফ্রিকা। যাঁরা রাজনীতির চর্চা করেন, তাদের কাছে আজ আফ্রিকা তীব্র কৌতূহল ও উদ্দীপনার বিষয়, কিন্তু শুধু আজ নয়

যুগ যুগ ধরে এই অরণ্যাবৃত মহাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে আর এক ধরনের মানুষ, যারা রাইফেল হাতে বারংবার হানা দিয়েছে আফ্রিকার বনভূমির বুকে–

আফ্রিকা!

বলতেই শিকারির মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে এক বিশাল অরণ্যভূমি যেখানে মদগর্বে সর্বত্র পদচারণা করে বেড়ায় বিপুলবপু হস্তিযূথ, গাছের ডালে ডালে এবং ঝোপঝাড়ে শিকারের অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকে মহাকায় অজগর, তৃণ-আচ্ছাদিত প্রান্তরে ছুটোছুটি করে হরিণ-জাতীয় অ্যান্টিলোপ আর জেব্রার দল, লম্বা গলা তুলে গাছের মগডালের পাতা ছিঁড়ে খায় বেঢপ জিরাফ। সর্বাঙ্গ বর্মে ঢেকে নাকের ডগায় দু-দুটো খঙ্গ উঁচিয়ে হঠাৎ ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে প্রান্তরের মাঝখানে আত্মপ্রকাশ করে দ্বি-খড়গী গণ্ডার এবং মাথায় শিঙের সঙিন চড়িয়ে নির্ভয়ে বিচরণ করে যেসব ভয়ংকর কেপ বাফেলো শক্তির দম্ভে তারা দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করে না।

গাছের ওপরে ও নীচে আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় হিংস্র কুকুরমুখো বেবুন-বাঁদরের দল, আর তাদের ওপর হানা দিতে সতর্ক পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে আরও হিংস্র এক অতিকায় মার্জার গাছের ছায়ায় ছায়ায় অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে তার গায়ের গোল গোল দাগগুলো মিশে যায়, শুধু পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘাসের আড়ালে জ্বলতে থাকে একজোড়া ক্ষুধিত চক্ষু–

লেপার্ড!

অকস্মাৎ সমগ্র বনভূমির বুকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে জেগে ওঠে এক ভৈরব-কণ্ঠের হুংকার-সংগীত! পশুরাজ সিংহ তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে সগর্বে!

হ্যাঁ, এই হল আফ্রিকা! শিকারির স্বর্গ!

এখানকার নদী আর জলাভূমিও অতিশয় বিপজ্জনক। জলের মধ্যে এবং জলের ধারে ঝোপের ভিতর স্থির হয়ে পড়ে থাকে যেসব কুমির, নরমাংসে তাদের মোটেই অরুচি নেই; এবং দৈত্যাকৃতি হিপোপটেমস বা জলহস্তীরা যদিও মাংসভোজী নয়, কিন্তু মেজাজ খারাপ হলে মানবদেহের ওপর দাঁতের ধার পরখ করতে তারা আপত্তি করে এমন কথা কেউ কখনো শোনেনি।

এমন চমৎকার জায়গায় যারা বাস করে তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি যে আদর্শ ভদ্র সন্তানের উপযুক্ত হবে না এ-কথা অনুমান করতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না; তবু ভীষণের মধ্যেও আরও-ভীষণ আছে–তাই আফ্রিকার যোদ্ধা অধিবাসীদের মধ্যেও মাসাই জাতির নাম সর্বাপেক্ষা খ্যাতিলাভ করেছে।

আজ এই মাসাইদের কথাই বলব।

পৃথিবীতে বহু ধরনের খেলা আছে, কিন্তু শিকারের মতো উত্তেজনা কোনো খেলাতেই নেই। আর সব শিকারের সেরা শিকার–সিংহ-শিকার!

এই সিংহের চামড়ার লোভে দেশ-বিদেশের শিকারিরা এসে ভিড় জমায় আফ্রিকার বনে-জঙ্গলে। ইউরোপ আর আমেরিকায় নিজের সুসজ্জিত বৈঠকখানায় লম্বমান সিংহ-চর্মের স্বপ্ন দেখেন না এমন শিকারি নেই বললেই চলে।

কিন্তু সিংহ-শিকার সহজ নয়, তাই এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে গিয়ে অনেক ভদ্রলোকই আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে প্রাণ হারিয়েছেন, অথবা বিকলাঙ্গ দেহ নিয়ে ফিরে গেছেন স্বদেশে, সর্বাঙ্গে বহন করেছেন শিকারি জীবনের তিক্তস্মৃতি–বীভৎস ক্ষতচিহ্ন!

গর্জনে আকাশ কাঁপিয়ে পশুরাজ সিংহ যখন শিকারির দিকে ছুটে আসে, তখন তার সমস্ত দেহ সংকুচিত হয়ে বৃত্তাকার ধারণ করে দূর থেকে মনে হয় এক দন্ত-ভয়াল ধূসর চর্মগোলক মাটির ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে উড়ে আসছে শূন্যকে বিদীর্ণ করে! সেই ধাবমান বিভীষিকার দেহের ওপর লক্ষ স্থির করে গুলি চালানো অত্যন্ত কঠিন কাজ, আর একেবারে মর্মস্থানে আঘাত হানতে না-পারলে আহত সিংহ ধরাশায়ী হতে চায় না শত্রুর দেহের ওপর পড়ে তাকে দাঁতে-নখে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

কিন্তু এই ভয়ংকর খেলাকে পেশা হিসাবে নিয়েছে এমন পেশাদার শিকারিও আছে। ওদেশে তাদের বলে হোয়াইট হান্টার বা শ্বেত শিকারি।

এই সাদা শিকারিদের সকলেই ক্ষিপ্রহস্তে গুলি চালিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারে, আক্রমণোদ্যত হিংস্র পশুর সামনে তারা কখনো আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে পড়ে না, মাত্র সাত-আট গজ দূর থেকে নির্ভুল নিশানায় গুলি চালিয়ে মারমুখী ধাবমান সিংহকে এরা মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

এহেন সাদা শিকারিরাও মাসাই যোদ্ধাদের নামে মাথার টুপি খুলে শ্রদ্ধা জানাতে লজ্জা পায় না।

নিম্নলিখিত বিবরণী পড়লেই বোঝা যাবে তাদের শ্রদ্ধা নেহাত অপাত্রে ন্যস্ত হয়নি। 

একজন বিখ্যাত শ্বেত শিকারির রোজনামচা থেকে এই কাহিনি তুলে দিচ্ছি–

ভোর হতেই আমরা সিংহের পায়ের চিহ্ন খুঁজে বার করলাম। আগের রাত্রে সিংহ যে ষাঁড়টা মেরেছে, তার মৃতদেহ পাওয়া গেল না। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ও রক্তমাখা পায়ের চিহ্ন ধরে দশজন বর্শাধারী মোরান এগিয়ে চলল (মাসাই যোদ্ধাদের মোরান নামে ডাকা হয়)।

আমি রাইফেল হাতে তাদের অনুসরণ করলাম। আজকের শিকারে আমি দর্শক মাত্র, মোরানরা জানিয়ে দিয়েছে আমার সাহায্য তাদের প্রয়োজন নেই।

কিছুক্ষণ পরে জানোয়ারটার সন্ধান পাওয়া গেল। ফাঁকা জায়গায় বসে সিংহ সারারাত ধরে আকণ্ঠ ভোজন করেছে, তারপর ষণ্ডমাংসে পরিপূর্ণ উদর নিয়ে ঢুকেছে একটা ঘাসঝোপের ভিতর বিশ্রামের উদ্দেশ্যে।

ঘন ঘাসঝোপের মধ্যে সিংহের সঙ্গে লড়াই চলে না। মাসাইরা ঝোপের বাইরে থেকে পাথর ছুঁড়তে লাগল। একটু দূরেই শোনা গেল ক্রুদ্ধ কণ্ঠে অস্ফুট গর্জন–পশুরাজ ক্রোধ প্রকাশ করছে! ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, মাসাই যোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহে পাথর ছুঁড়তে শুরু করল। সেই প্রচণ্ড পাথর বৃষ্টির মধ্যে স্থির হয়ে বসে থাকা সিংহের পক্ষেও অসম্ভব; ঝোপজঙ্গল কাঁপিয়ে আমাদের থেকে প্রায় এক-শো গজ দূরে পশুরাজ বেরিয়ে এল ফাঁকা জমির ওপর এবং পরক্ষণেই লাফের পর লাফ মেরে পালাতে শুরু করল।

তৎক্ষণাৎ ভীষণ চিৎকার করে মাসাইরা তার পিছু নিল। লম্বা লম্বা হলুদ রং ঘাসের ভিতর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলল দশটি দীর্ঘাকার মনুষ্যমূর্তি–শিকার হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়।

ছুট, ছুট, ছুট।

সিংহের স্ফীত ও শিথিল উদর সবেগে দুলতে লাগল, একবার এদিক, একবার ওদিক।

কিন্তু ভরপেট খাওয়ার পর এত ছুটোছুটি তার বেশিক্ষণ ভালো লাগল না, হঠাৎ থেমে পশুরাজ রণং দেহি মূর্তিতে ঘুরে দাঁড়াল।

বর্শাধারী যোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তাকে গোল হয়ে ঘিরে ফেলল, আর বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গর্জাতে লাগল পশুরাজ সিংহ।

সেই সচল বৃত্ত ক্রমশ ছোটো হয়ে এল; সিংহের চেহারাও হয়ে উঠল ভয়ংকর। তার দুই চোখ জ্বলতে লাগল, উন্মুক্ত মুখবিবরের ফাঁকে ফাঁকে আত্মপ্রকাশ করল নিষ্ঠুর দাঁতের সারি, আর তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল দারুণ আক্রোশে মাটিতে আছড়ে পড়ল একবার, দু-বার, তিনবার।

পরমুহূর্তে সিংহ আক্রমণ করল।

সঙ্গেসঙ্গে শূন্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল উড়ে এল এক ঝাঁক বর্শা সিংহের দিকে।

একটা বর্শা তার স্কন্ধ ভেদ করে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে এল, কিন্তু সিংহের গতি রুদ্ধ হল না, সামনে যে লোকটিকে পেল তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আক্রান্ত মাসাই একটুও নড়ল না, ঢালের আড়াল থেকে বর্শা বাগিয়ে প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য।

থাবার এক আঘাতে সিংহ ঢালটাকে ফেলে দিল, তারপর পিছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের থাবার সাহায্যে লোকটিকে টেনে আনতে চেষ্টা করল নিজের দিকে।

কিন্তু সেই শরীরী মৃত্যুর আলিঙ্গনে ধরা পড়ার আগেই মাসাই-যোদ্ধা ক্ষিপ্রহস্তে বর্শা চালিয়ে সিংহের বক্ষ ভেদ করে ফেলল, তবু শেষ রক্ষা করতে পারল না–পশুরাজের গুরুভার দেহের সংঘাতে ভূমিপৃষ্ঠে লম্ববান হয়ে পড়ে গেল। আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম ধারালো বর্শার ফলা বুকের পিচ্ছিল মাংসপেশি ভেদ করে অন্তত তিন ফুট ভিতরে ঢুকে গেছে এবং ক্ষতস্থান থেকে গল গল করে বেরিয়ে আসছে গরম রক্তের ফোয়ারা।

এমন দারুণ মার খেয়েও সিংহ পরাজয় স্বীকার করল না।

বজ্ৰদংশনে শত্রুর কাঁধ চেপে ধরে সিংহ পিছনের দুই থাবার সবগুলো নখ বিধিয়ে দিল শত্রুর পেটে পরক্ষণেই সনখ থাবার প্রচণ্ড আকর্ষণে বিদীর্ণ হয়ে গেল ভূপতিত যোদ্ধার উদর, রক্তাক্ত পাকস্থলীটা কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ল মাটির উপর।

বীভৎস দৃশ্য!

এবার আর বর্শা নয়–কোমরে ঝোলানো খাপ থেকে দ্বি-ধার ছুরিকা খুলে যোদ্ধারা ছুটে এল এবং বারংবার আঘাত করতে লাগল সিংহের মাথায় উন্মাদের মতো।

মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে নাকের ডগা থেকে করোটি পর্যন্ত বিরাট কেশরযুক্ত মাথাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

মাসাইদের বিশ্বাস সিংহের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় যে-ব্যক্তি সিংহের লেজ ধরে টেনে রাখতে পারবে, সে-ই সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা। ব্যাপারটা বড়ো সহজ নয় অন্যান্য যোদ্ধারা যখন সিংহের দেহের ওপর বর্শা ও ছোরার সদ্ব্যবহার করবে, তখন একজন মাসাই সেই ক্রোধোন্মত্ত সিংহের লাঙ্গুল সজোরে টেনে রাখবে। যে-যোদ্ধা পর পর চারবার এইভাবে সিংহের লেজ ধরতে পারে, মাসাইরা তাকে মেমবুকি উপাধি দেয়। মেলমবুকি উপাধি মাসাইদের কাছে বিরাট সম্মানজনক ব্যাপার এবং এই সম্মানের লোভে বহু মোরান যুবক অকালে প্রাণ হারায়।

আমার জীবনে এমন ভয়ংকর নাটকের দর্শক হওয়ার সৌভাগ্য একবার হয়েছিল, সে-কথাই বলছি।

যোদ্ধাদের দলটা বেশ বড়ো ছিল এবং এবারও আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হল কোনো কারণেই গুলি চালাতে পারব না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোটো ঝোপের ভিতর সিংহের সাড়া পাওয়া গেল। মাসাই যোদ্ধারা সঙ্গেসঙ্গে ঝোপটাকে ঘিরে ফেলল।

ঝোপটা খুব ঘন ছিল না। মাসাইরা বৃত্তাকারে এগিয়ে চলল চিৎকার করতে করতে। হঠাৎ ঝোপের মাঝখান থেকে একাধিক সিংহের গর্জন শুনতে পেলাম। তারপরই দেখলাম একটা সিংহ তিরবেগে ছুটে এসে একজন মাসাইয়ের ঢালের উপর সজোরে চপেটাঘাত করে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিল এবং অন্যান্য যোদ্ধারা কিছু করার আগেই সকলের মাথার উপর দিয়ে লম্বা লাফ মেরে অদৃশ্য হয়ে গেল পাশের জঙ্গলের মধ্যে। সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, কেউ হাতের বর্শা তোলার সময় পেল না।

যাই হোক, যে-লোকটি পড়ে গিয়েছিল সে আহত হয়নি, এটাই সান্ত্বনা।

ঝোপের ভিতর সিংহের চাপা গর্জন ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠল।

এগিয়ে গিয়ে দেখলাম মাসাইরা আর একটা সিংহকে ঘিরে ফেলেছে। কোণঠাসা পশুরাজ এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর থেকে থেকে গর্জে উঠছে, যেন বলতে চাইছে–সাবধান, আর এগিয়ো না।

সিংহের থেকে প্রায় দশগজ দূরে মাসাইরা দাঁড়িয়ে পড়ল। পরক্ষণেই বর্শা ছুটতে লাগল ঝাঁকে ঝাকে। কয়েকটা বর্শা সিংহের দেহ বিদ্ধ করে মাটিতে পড়ে গেল, কেবল একটা বর্শা দেখলাম সিংহের পেটে গম্ভীর হয়ে বসে গেছে। ভীষণ গর্জন করে জানোয়ারটা লাফিয়ে উঠল আর সঙ্গেসঙ্গে একজন মাসাই হাতের বর্শা মাটিতে ফেলে ছুটে এসে সিংহের লম্বা লেজটা দুই হাতের বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরল। (মাসাইরা কখনো সিংহের লেজের আগায় রোমশ অংশে হাত দেয় না, তারা গোড়ার দিকটা চেপে ধরে। কারণ, সিংহ তার লেজটাকে লোহার ডান্ডার মতো শক্ত করতে পারে এবং সেই আড়ষ্ট ও কঠিন লাঙ্গুলের একটি আঘাতে ঠিকরে মাতা ধরিত্রীকে আলিঙ্গন না-করে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এমন বলিষ্ঠ মানুষ দুনিয়ায় আছে কি না সন্দেহ।)

লেজ ধরামাত্র অন্যান্য যোদ্ধারা ছোরা হাতে ছুটে এসে সিংহকে আক্রমণ করল। এই চরম মুহূর্তে মাসাই যোদ্ধাদের দেহে কোনো অনুভূতি থাকে না, তারা যন্ত্রের মতো আঘাত করতে থাকে এবং যন্ত্রের মতোই নখ ও দাঁতের আঘাত গ্রহণ করে নিজেদের শরীরের ওপর ভীষণ উত্তেজনায় কিছুক্ষণের জন্য তাদের শারীরিক অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়।

আমি স্বচক্ষে দেখলাম সিংহ যখন নিজেকে মুক্ত করতে পারল না, তখন পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে দক্ষ মুষ্টিযোদ্ধার মতো ডাইনে-বামে থাবা চালাতে শুরু করল। প্রায় প্রতিটি আঘাতেই তার থাবার নখগুলো একাধিক শত্রুর দেহে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করল বটে, কিন্তু আমি কোনো যোদ্ধার মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি দেখতে পেলাম না। পরে শুনেছিলাম এই সময় তারা বেদনা বোধ করে না।

লড়াই চলল অনেকক্ষণ ধরে–তারপর অত্যধিক রক্তপাতে অবসন্ন পশুরাজ ধীরে ধীরে ধরাশয্যা গ্রহণ করল।

সূর্যের আলোয় আবার ঝলসে উঠল অনেকগুলো শানিত ছুরিকা–নিষ্ঠুর আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সিংহের বিশাল মস্তক! সব শেষ!

আহত মাসাইদের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চোখে পড়ল বীভৎস ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে গল গল করে, কিন্তু তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই! আমি দুজন যোদ্ধার ক্ষতস্থান উঁচসুতো দিয়ে সেলাই করে দিলাম; একজন তো কথাই বলল না, আর একজন তালুতে জিভ লাগিয়ে শব্দ করল স! অর্থাৎ কী আপদ! সামান্য ব্যাপারে এত কেন?

আমি বাজি ফেলতে পারি যেকোনো শ্বেতাঙ্গ এই অবস্থায় পড়লে যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যেত।

মাসাই যোদ্ধাদের বর্শা খুব শক্ত হয় না। স্রোতস্বতী নদীর ধার থেকে মাটি-মেশানো-লোহা দিয়ে স্থানীয় কামাররা বর্শা তৈরি করে, কিন্তু সেই লোহাকে টেম্পার দিয়ে কঠিন করার বিদ্যা তারা আয়ত্ত করতে পারেনি। জোরে আঘাত পেলে বর্শার ফলা বেঁকে যায়। হাঁটুর ওপর রেখে অনায়াসেই ওই বর্শাফলক বাঁকিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মাসাই যোদ্ধা ওই বর্শা চালিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। সেই আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা চোখে না-দেখলে বিশ্বাস হয় না। মাসাইদের দক্ষতার নমুনাস্বরূপ আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এই ঘটনাটি বলার আগে আফ্রিকার লেপার্ড সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার।

আফ্রিকার মতো ভারতের অরণ্যেও লেপার্ড আছে, বাংলায় তাকে চিতাবাঘ বলে ডাকা হয়। কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে চিতা নামে যে জানোয়ার বাস করে, তার দেহ-চর্মের সঙ্গে লেপার্ডের কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও দেহের গঠনে আর স্বভাব-চরিত্রে চিতার সঙ্গে লেপার্ডের বিশেষ মিল নেই–চিতা এবং লেপার্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন জানোয়ার। চিতা ভীরু প্রকৃতির জীব। লেপার্ড হিংস্র, দুর্দান্ত।

 জে. হান্টার, জন মাইকেল প্রভৃতি খ্যাতনামা শিকারি লেপার্ডকে আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার বলেছেন। সিংহের মতো বিপুল দেহ এবং প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী না হলেও ধূর্ত লেপার্ডের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণকে অধিকাংশ শিকারিই সমীহ করে থাকেন।

লেপার্ডের আক্রমণের কৌশল অতি ভয়ংকর। লতাপাতা ও ঘাসঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে সে যখন বিদ্যুৎবেগে শিকারির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, তখন আক্রান্ত ব্যক্তি অধিকাংশ সময়েই হাতের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় না। প্রথম আক্রমণেই লেপার্ড তার সামনের দুই থাবার ধারালো নখ দিয়ে শিকারির চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, সঙ্গে সঙ্গে একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের মারাত্মক দংশন চেপে বসে শিকারির কাঁধে, আর পিছনের দুই থাবার নখগুলোর ক্ষিপ্র সঞ্চালনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হতভাগ্যের উদর।

বিখ্যাত শিকারি জে. হান্টার একবার তিনজন বর্শাধারী মাসাই-যোদ্ধার সঙ্গে একটা লেপার্ডকে অনুসরণ করেছিলেন। জন্তুটা কয়েকদিন ধরে মাসাই পল্লিতে ছাগল মারছিল। সিংহ ক্ষুধার্ত হলেই শিকার ধরে, অকারণে সে প্রাণীহত্যা করে না। লেপার্ড শুধু হত্যার আনন্দেই হত্যা করে। মাসাই পল্লির হানাদার লেপার্ড অনেকগুলো ছাগল মেরেছিল, কিন্তু একটিরও মাংস খায়নি।

বেশ কিছুক্ষণ পলাতক লেপার্ডের পদচিহ্ন ধরে খোঁজাখুঁজি করার পর একটা ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে তার সন্ধান পাওয়া গেল। পায়ের দাগ দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, জন্তুটা ওই ঘাসের জঙ্গলেই ঢুকেছে, তবে ঠিক কোথায় সে অবস্থান করছে সেটা অনুমান করা সহজ ছিল না। লেপার্ডের পরিবর্তে সিংহ হলে আন্দাজে কয়েকটা পাথর ঘাসঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে দিলেই কাজ হত–পশুরাজ ছুটে এসে আক্রমণ করত অথবা তার অস্তিত্ব ঘোষণা করত সগর্জনে। কিন্তু লেপার্ড অতিশয় ধূর্ত, গায়ে ঢিল পড়লেও সে চুপ করে থাকে, শিকারিকে তার অবস্থান নির্ণয় করতে দেয় না। ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে অনেকগুলো পাথর ছোঁড়া হল। বৃথা চেষ্টা। লেপার্ডের সাড়া নেই।

হান্টার জানতেন জন্তুটা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। তিনি ভেবেছিলেন ক্রুদ্ধ লেপার্ডের বিদ্যুৎচকিত আক্রমণ মাসাইদের বিভ্রান্ত করে দেবে, তার বর্শা চালানোর সুযোগই পাবে না কিন্তু সাহেব ভুল করেছিলেন, বর্শাধারী মাসাই-যোদ্ধার ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল খুবই অস্পষ্ট।

সাহেবের নির্দেশ অনুসারে তার পিছনে দু-পাশে ছড়িয়ে পড়ে তিনটি মাসাই কোমরসমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল পলাতক শ্বাপদের সন্ধানে। প্রতি পদক্ষেপেই শিকারিরা একবার থমকে দাঁড়াচ্ছিল, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে আবার পা ফেলছিল অতি সন্তর্পণে। ঘাস-জঙ্গলটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু এইভাবে চলা বড়ো কষ্টকর দারুণ উত্তেজনায় স্নায়ু যেন ছিঁড়ে পড়তে চায়।

আচম্বিত হান্টার সাহেবের ডান দিকে সম্মুখভাগে ঘাসের আবরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল এবং লাফ দিল তাকে লক্ষ করে। সাহেব রাইফেল তোলার আগেই তার ডান দিকে দণ্ডায়মান মাসাই-যোদ্ধার বর্শা শ্বাপদের দেহ বিদ্ধ করল। ঘাড় এবং কাঁধের মাঝামাঝি জায়গায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে বর্শাটা লেপার্ডকে মাটিতে গেঁথে ফেলেছিল।

 মুক্তিলাভের চেষ্টায় জন্তুটার কী আস্ফালন আর গর্জন কিন্তু নিষ্ফল প্রয়াস! এমন শক্ত আলিঙ্গনে বর্শাটা তাকে মাটির সঙ্গে গেঁথে ফেলেছিল যে, প্রাণপণ চেষ্টাতেও সে অস্ত্রটাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে আসতে পারছিল না।

মাসাই-যোদ্ধা কোমর থেকে সিমি (বড়ো ছোরা) খুলে লাফ মেরে এগিয়ে গেল চরম আঘাত করার জন্য তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিলেন হান্টার, কী সর্বনাশ! ছোরার কোপ মারলে অমন সুন্দর চামড়াটা নষ্ট হয়ে যাবে যে!

ক্ষিপ্রহস্তে রাইফেল তুলে গুলি চালাতেই বর্শাবিদ্ধ, লেপার্ডের ভবযন্ত্রণা শেষ হয়ে গেল।

মাসাইদের সাহস ও বীরত্বের কথা তো বললাম, এবার তাদের চেহারা ও অস্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দু-একটা কথা বলছি।

মাসাইদের নাক, চোখ ও মুখের । গড়ন সুন্দর। কেউ কেউ মনে করেন । মাসাইদের দেহে রয়েছে প্রাচীন, মিশরবাসীর রক্ত।

চেহারার মতো মাসাইদের বর্শাও কিছু বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। মাসাইদের বর্শার দু-দিকেই ধারালো লোহার ফলা বসানো, মাঝখানের অংশটিতে অর্থাৎ ধরার জায়গায় কাষ্ঠদণ্ড লাগানো থাকে। ওই ধরনের বর্শা অন্যান্য জাতির নিগ্রোরা ব্যবহার করে না। যুদ্ধ বা শিকার অভিযানে যাত্রা করার সময়ে মাসাই যোদ্ধা মাথায় উটপাখির পালক গুঁজে দেয়।

মাসাই জাতি যে কেবল হানাহানি আর মারামারি করতেই দক্ষ তা নয়, তারা অতিশয় অতিথিবৎসল এবং ভদ্র। অকারণে তারা বিদেশিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে না।

[চৈত্র ১৩৬৮]