আফ্রিকার অভিশাপ

আফ্রিকার অভিশাপ

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে সিয়েরা লিওন নামক স্থানে উপস্থিত হলেন: একজন ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার। ভদ্রলোকের নাম হ্যারি উইগিনস।

যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। পূর্বোক্ত অঞ্চলের সৈন্যবাহিনীর জন্য পানীয় জল সরবরাহের বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। ওই পরিকল্পনাগুলিকে কার্যকরী করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার হ্যারি উইগিনস সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকার মাটিতে পদার্পণ করলেন।

বেশ কিছুদিন কাজ করার পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরকারের পক্ষ থেকে হ্যারিকে পাঠানো হল রিজেন্ট নামক একটি নিগ্রো পল্লিতে। জায়গাটার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলেন হ্যারি। কিন্তু জলের রিজার্ভয়ার বসাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, পরিকল্পনা কার্যকরী করার প্রধান বাধা হচ্ছে ঘনসন্নিবিষ্ট লতাগুল্ম ও ঝোপজঙ্গলের নিবিড় সমাবেশ। জলের পাইপ বসাতে গেলে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা দরকার, অতএব একদল স্থানীয় মজুরকে জঙ্গল সাফ করার কার্যে নিযুক্ত করা হল।

কয়েকদিন ভালোভাবেই কাজ চলল। তারপরই হল গোলমালের সূত্রপাত। একদিন সকাল বেলা কার্যস্থলের কাছাকাছি এসে হ্যারি অনুভব করলেন, চারিদিকে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক নীরবতা। মজুরদের কোলাহল অথবা জঙ্গলের ওপর ম্যাচেট নামক ধারালো অস্ত্রের আঘাতজনিত শব্দ একেবারেই শোনা যাচ্ছে না। সব চুপচাপ।

এই অস্বাভাবিক নীরবতার কারণ অনুসন্ধান করতে অকুস্থলের দিকে সবেগে পদচালনা করলেন হ্যারি। যথাস্থানে গিয়ে হ্যারি দেখলেন, মজুরেরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উপরে ঝুলছে এক অদ্ভুত দোলনা।

দোলনাটাকে টাঙানো হয়েছে একটা ময়লা কাপড়ের সাহায্যে। নানারকম আজেবাজে জিনিস রয়েছে দোলনার ভিতরে। ওইসব জিনিসের মধ্যে যে-বস্তুটি হ্যারির দৃষ্টি আকৃষ্ট করল সেটি হচ্ছে সবুজ রং-এর একটি বোতল।

বোতলটা শূন্যগর্ভ নয়, তার মধ্যে রয়েছে খানিকটা তরল পদার্থ। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হ্যারি বুঝলেন, উক্ত তরল পদার্থটি ময়লা জল ছাড়া আর কিছুই নয়।

একটা বিশ্রী দোলনার সামনে এতগুলো কাজের লোক কাজ না-করে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে হ্যারি খেপে গেলেন। মজুরদের সর্দারের কাছে কৈফিয়ত চাইতেই সে জানাল, ওটা ভূতের ওঝার জাদু; ওই বিপজ্জনক জাদুর দোলনাটা সরিয়ে নিলেই তারা মন দিয়ে কাজ করতে পারে।

এই কথা শুনে হ্যারি দৃঢ়পদে দোলনার দিকে অগ্রসর হলেন! সঙ্গেসঙ্গে সমবেত জনতা হাঁ হাঁ করে উঠল–মজুররা সভয়ে জানাল মাসা যেন ওই দোলনা স্পর্শ না-করেন; কারণ যে-ওঝা ওখানে জাদু খাঁটিয়েছে, একমাত্র সেই ব্যক্তি ছাড়া অপর কেউ ওই দোলনা স্পর্শ করলে তার মৃত্যু অবধারিত।

আফ্রিকাতে উইচ-ডক্টর বা ভূতের ওঝার প্রতাপ সাংঘাতিক। স্থানীয় মানুষ ওঝাদের যমের মতো ভয় করে। কিন্তু হ্যারি উইগিনস ইংরেজ; তিনি যখন শুনলেন, যে-ওঝা এই কাণ্ড করেছে তাকে ডেকে আনতে হলে পুরো একটা দিন বসে থাকতে হবে, তখন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

লাথি মেরে দোলনাটাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন ঘন জঙ্গলের গর্ভে!

দারুণ আতঙ্কে নিগ্রো মজুরের দল মাটিতে শুয়ে পড়ল। একটু পরে মুখ তুলে তারা দেখল তাদের মাসা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং তার দেহের উপর মৃত্যুর কোনো লক্ষণ নেই।

নিগ্রো মজুররা আশ্চর্য হয়ে গেল।

তারা ভেবেছিল দোলনাতে লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে মাসার মৃত্যু হবে, কিন্তু হ্যারিকে জীবিত দেখে তাদের ধারণা হল ভূতের ওঝার চাইতে মাসা অনেক বড়ো জাদুকর।

এমন ক্ষমতাশালী জাদুকর সহায় থাকলে আর ভয় কীসের? অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়ে মজুরের দল কাজে লেগে গেল।

তারপরেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা।

দোলনাতে লাথি মারার এক সপ্তাহের মধ্যেই হ্যারি দেখলেন, তার ডান হাতের মধ্যম আঙুলটি ভীষণ ফুলে উঠেছে, সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে দারুণ যন্ত্রণা।

হ্যারি নিকটবর্তী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। ওই চিকিৎসকটি শ্বেতাঙ্গ নন, চিকিৎসাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এক স্থানীয় অধিবাসী। দোলনাঘটিত ব্যাপারটি ইতিমধ্যেই উক্ত নিগ্রো চিকিৎসকের কানে এসেছিল, আঙুলের চিকিৎসা না-করে তিনি হ্যারিকে ওঝার সঙ্গে মিটমাট করার পরামর্শ দিলেন।

বিজ্ঞানসম্মত ইউরোপীয় পদ্ধতিতে সুপণ্ডিত এক নিগ্রো চিকিৎসকের কাছে হ্যারি এমন ব্যবহার আশা করেননি। হ্যারি চিকিৎসা করার জন্যই চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন, উপদেশ চাইতে আসেননি। চটে-মটে তিনি স্থানত্যাগ করলেন। স্থানীয় নিগ্রো বন্ধুরাও হ্যারিকে বার বার ওঝার সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু হ্যারি কারুর কথায় কান দিলেন না। তার আঙুলের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হতে লাগল।

ওই সময়ে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে আবির্ভূত হল এক দারুণ সংক্রামক জ্বরব্যাধি। সংক্রামক জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নিগ্রো পল্লি ছেড়ে হ্যারি ফ্রি-টাউন শহরে উপস্থিত হলেন এবং সেখানকার মিলিটারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হলেন।

হ্যারিরও জ্বর হয়েছিল। প্রায় চার মাস পরে সুস্থ হয়ে তিনি কার্যস্থলে ফিরে গেলেন। তার আঙুলটা কিন্তু মিলিটারি হাসপাতালের নিপুণ চিকিৎসাকেও পরাজিত করল, আঙুলের ক্ষত কিছুতেই আরোগ্য লাভ করল না। হ্যারি ডান হাতটাকে একটা কাপড়ে বেঁধে গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতেন।

হ্যারির বন্ধুবান্ধব এবং তার অধীন নিগ্রো মজুররা বার বার তাকে ওঝার সঙ্গে দেখা করে মিটমাট করতে উপদেশ দিল। কিন্তু হ্যারি তার সংকল্পে অটল, কিছুতেই তিনি ওঝার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন না।

হঠাৎ একদিন সকালে ওঝা নিজেই এল হ্যারির সঙ্গে দেখা করতে। ওঝার পোশাক পরিচ্ছদে অবশ্য যদি সেটাকে পরিচ্ছদ বলা যায় সত্যিই কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তার অধমাঙ্গের কিছু অংশ আবৃত করে ঝুলছে বাঁদরের চামড়া এবং উক্ত বানরচর্মের সঙ্গে সংলগ্ন হয়েছে মানুষের হাতের হাড়, কঙ্কাল-করোটি, শুষ্ক গিরগিটি প্রভৃতি বিচিত্র ও বীভৎস জন্তু।

পরস্পরের ভাষা বুঝতে যদি অসুবিধা হয়, সেজন্য হ্যারি তার নিগ্রো ভৃত্যকে ওঝার সামনে হাজির করলেন। ভৃত্যটি ওঝার সান্নিধ্য পছন্দ করেনি, কিন্তু প্রভুর আদেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হল।

অবশ্য কথাবার্তা বলতে বা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হল না। আফ্রিকায় প্রচলিত পিজিন ইংলিশ নামে অশুদ্ধ ইংরেজিতে কথোপকথন চলছিল।

হ্যারির জিজ্ঞাস্য হল, ওঝার জাদুবিদ্যা তাকে আফ্রিকার মাটি থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি কেন?

ওঝা জানাল, সে আশ্চর্য হয়েছে এবং সেইজন্যই সে মাসার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ওঝা আরও জানাল যে হ্যারির আঙুলের ক্ষত সে ভালো করে দিতে পারে, অবশ্য মাসা যদি তার সঙ্গে মিটমাট করতে সম্মত হয়।

 হ্যারি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, তুমি জাদুবিদ্যার সাহায্যে আমাকে মারতে পারবে না। এমনকী অস্ত্রের সাহায্যেও তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না।

নিজের গুলিভরা রিভলভার তিনি ওঝার হাতে দিয়ে বললেন, যদি সাহস থাকে আমাকে গুলি করে মারো।

ওঝা রিভলভারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, তারপর অস্ত্রটাকে হ্যারির হাতে ফেরত দিয়ে জানাল, এত ছোটো বন্দুক ছুঁড়তে সে অভ্যস্ত নয়।

হ্যারি তৎক্ষণাৎ ভৃত্যকে তার রাইফেল নিয়ে আসতে আদেশ করলেন।

 রাইফেল এল। ওঝা বলল, বন্দুক ছুঁড়তে তার ভালো লাগে না, সে তরবারি চালনা করতেই অভ্যস্ত।

নাছোড়বান্দা হ্যারি ভৃত্য পাঠিয়ে নিকটবর্তী এক সৈনিক বন্ধুর কাছ থেকে একটা আর্মি সোর্ড আনালেন এবং সেই তলোয়ারটা তুলে দিলেন ওঝার হাতে।

ওঝা অস্ত্রটার ধার পরীক্ষা করে শূন্যে দুই একবার তরবারি আস্ফালন করল, তারপর বলল, শ্বেতাঙ্গদের অস্ত্র সে ব্যবহার করতে পারবে না–অতএব এই তলোয়ার দিয়ে কোনো মানুষকে হত্যা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

আফ্রিকার স্মারক-চিহ্ন হিসাবে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা তরবারি ক্রয় করেছিলেন হ্যারি, এইবার সেই অস্ত্রটাকে তিনি ওঝার হাতে তুলে দিলেন।

তলোয়ারটা সে হ্যারির হাতে ফিরিয়ে দিল।

হ্যারি কিন্তু তাকে ছাড়লেন না। এক ধাক্কায় ওঝাকে মাটিতে ফেলে তিনি তলোয়ারের ফলা তার কণ্ঠদেশে স্থাপন করলেন, তারপর বললেন, তুমি আমাকে মারতে পারবে না। কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করব। এখনই হত্যা করব।

বলাই বাহুল্য, লোকটিকে হত্যা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হ্যারির ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তাকে বে-ইজ্জত করার জন্যই হ্যারি এত কাণ্ড করছিলেন। দারুণ হাসির আবেগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, অবরুদ্ধ হাস্যকে দমন করার চেষ্টায় তিনি প্রাণপণে ক্রোধের অভিনয় করছিলেন।

নিগ্রো ভৃত্যটি তার কম্পিত কণ্ঠস্বরে অবরুদ্ধ হাস্যের পরিবর্তে নিদারুণ ক্রোধের আভাস অনুমান করে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।

ওঝা কিন্তু বিশেষ ভয় পায়নি। হ্যারির হাতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে বলল, মাসা! ওই ওষুধটাই তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

হ্যারি সচমকে নিজের হাতের দিকে তাকালেন। দুই হাতের কবজির ওপর একসময় তিনি শখ করে উলকি আঁকিয়েছিলেন। ওঝা জানাল ওই উলকির চিহ্নই নাকি তাঁকে রক্ষা করেছে।

ওঝা অসন্তুষ্ট হয়নি। সে হ্যারিকে আফ্রিকা ত্যাগ করতে বলল। সে আরও বলল, মাসা যদি আফ্রিকা না-ছাড়েন তবে তার আঙুলের ঘা কিছুতেই সারবে না।

ওঝার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। হ্যারি যতদিন আফ্রিকাতে ছিলেন ততদিন তার আঙুলের ক্ষত তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছে। আফ্রিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হওয়ার পর তার আঙুলের ঘা শুকিয়ে যায় এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করেন।

উপরে বর্নিত কাহিনিটি মনগড়া গল্প নয়, বাস্তব সত্য। কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের নামও যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, কোনো কিছুর পরিবর্তন করা হয়নি।