কায়না

সৈনিকের প্রথম অভিজ্ঞতা
কায়না
প্রথম পরিচ্ছেদ –রহস্যময় মৃত্যু

কায়না!

মৃত্যুগহ্বর!

হ্যাঁ, উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় ভাষা কায়না শব্দটির অর্থ-যাতনাদায়ক মৃত্যুগহ্বর!

কায়না! একবার, মাত্র একবারই ওই ভয়ানক শব্দ উচ্চারণ করেছিল স্থানীয় পুলিশ কর্মচারী, তারপরই তার মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! মি. হুইংক্লির মুখে পূর্বোক্ত ঘটনা শুনে চমকে উঠলেন পর্যটক আত্তিলিও গত্তি, কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে মৃত্যু হল?

হ্যাঁ।–উত্তর রোডেশিয়ার প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি বললেন, স্থানীয় পুলিশ জনৈক নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে তার বক্তব্য পেশ করতে উদ্যত হয়, কিন্তু কায়না শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গেসঙ্গেই তার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। ঘটনাটা হঠাৎ শুনলে খুব অদ্ভুত ও অলৌকিক মনে হয়, তবে একটু ভেবে দেখলে সমস্ত বিষয়টার একটা যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা করা সম্ভব। লোকটির হৃৎপিণ্ডের অবস্থা ভালো ছিল না, আর অনেকটা পথ সে দৌড়ে এসেছিল তাই অত্যধিক পরিশ্রম ও উত্তেজনার ফলে দুর্বল হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটা খুব অসম্ভব নয়। আমি স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে দু-বার কায়নার নাম শুনেছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও কায়না সম্বন্ধে কোনো জ্ঞাতব্য বিষয় আমার কর্ণগোচর হয়নি; কারণ সেবারেও মৃত্যু এসে অতর্কিতে বক্তার কণ্ঠরোধ করেছিল।

আত্তিলিও বললেন, প্রথমবারের ঘটনা তো শুনলাম। দ্বিতীয়বারের ঘটনাটা বলুন।

কমিশনার মি. হুইংক্লি বললেন, একটি স্থানীয় বৃদ্ধার মুখে আমি দ্বিতীয়বার ওই কথাটা শুনেছিলাম। সে আমাকে জানিয়েছিল, কায়নার ভিতর তার চার পুত্র সন্তানকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর কোনো কথা শোনার সুযোগ আমার হয়নি। কারণ ওইটুকু বলেই বৃদ্ধা চুপ করেছিল।

আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, ভয়ে চুপ করেছিল?

উত্তর এল–না। সেই মুহূর্তেই তার মৃত্যু হয়েছিল।

আত্তিলিও বৃদ্ধার মৃত্যুকে বিষপ্রয়োগে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু কমিশনার হুইংক্লি জানালেন আত্তিলিওর সন্দেহ অমূলক।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মি. হুইংক্লি, তারপর বললেন, আমার মনে হয় কায়নার কথা উল্লেখ করেছিল বলেই যে বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল তা নয়, বরং ঠিক উলটো ব্যাপারটা ঘটেছিল।

অর্থাৎ আপনি বলতে চান মৃত্যু আসন্ন বুঝেই বৃদ্ধা কায়নার বিষয়ে উল্লেখ করতে সাহস পেয়েছিল?

হ্যাঁ। স্থানীয় অধিবাসীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত সজাগ। আসন্ন মৃত্যুকে তারা অনুভব করতে পারে। অন্তিম মুহূর্তে বৃদ্ধা কায়নার রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল; দুর্ভাগ্যক্রমে তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যু তার কণ্ঠ রোধ করে।

গল্প করতে করতে পূর্বোক্ত ঘটনা দুটির বিবরণ দিচ্ছিলেন উত্তর রোডেশিয়ার প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি এবং দুই বন্ধুর পাশে বসে সাগ্রহে তার কথা শুনছিলেন আত্তিলিও গত্তি। বন্ধু দুটির নাম প্রফেসর ও বিল। বন্ধুদের সম্পূর্ণ নাম আত্তিলিও তার কাহিনির মধ্যে উল্লেখ করেননি, অতএব আমরাও তাদের প্রফেসর আর বিল নামেই ডাকব।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করেছিলেন কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আফ্রিকার জীবজন্তু ও মানুষ সম্বন্ধে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য উক্ত মহাদেশের কয়েকটি স্থানে তিনি ভ্রমণ করতে উদযোগী হয়েছিলেন। ওই কাজে তার সহায় ছিলেন পূর্বোক্ত দুই বন্ধু, প্রফেসর ও বিল। উত্তর রোডেশিয়ার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত অনেকগুলো জলাভূমি আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও এবং তার দুই বন্ধু। শুধু তাই নয়, বিস্তীর্ণ জলাভূমিগুলোর অবস্থান নির্ণয় করার উপযুক্ত একটি মানচিত্রও তারা তৈরি করে ফেলেছিলেন। স্থানীয় গভর্নর অভিযাত্রীদের সাফল্যে খুশি হয়ে তিন বন্ধুকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আহারাদির পর তারা গভর্নরের লাইব্রেরিতে এলেন কফি পান করার জন্য।

প্রফেসর হঠাৎ উত্তর রোডেশিয়ার বনভূমি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য করলেন। জলাভূমিগুলো পরিদর্শন করে ফিরে আসার সময়ে ওই অঞ্চলের গ্রানাইট পাথর দেখেই তিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন–

এমন অদ্ভুত নিসর্গ দৃশ্য আমি আফ্রিকার কোনো জায়গায় দেখিনি।

অরণ্যের পটভূমিতে অবস্থিত অসংখ্য প্রস্তরসজ্জিত গুহার দৃশ্য বিলকেও অভিভূত করে দিয়েছিল।

নৈশভোজে উপস্থিত রাজপুরুষদের মধ্যে প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি উত্তর রোডেশিয়ার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত–ওই অঞ্চলের কোনো বৈশিষ্ট্যই তার অজানা ছিল না।

মি. হুইংক্লি বললেন, কোনো শ্বেতাঙ্গ এই অঞ্চল পরিদর্শন করেননি। এখানে গাড়ি চলার রাস্তা নেই। যতদূর জানি, খনিজ দ্রব্যও পাওয়া যায় না। মাম্বোয়া নামক যে নিগ্রো জাতি এখানে বাস করে তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারা লাজুক প্রকৃতির এবং শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে আসতে অনিচ্ছুক–সরকারও তাদের ঘাঁটিয়ে অনর্থক বিপত্তির সৃষ্টি করতে চান না।

মি. হুইংক্রির কথা শুনে প্রফেসর ও বিল দুজনেই দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তারা দুজনেই উৎসাহের সঙ্গে জানালেন যে, ওই অঞ্চলের বিচিত্র নিসর্গ-দৃশ্য দেখে তাদের ধারণা হয়েছে প্রকৃতি দেবীর বহু গোপন তথ্য সেখানে লুকানো আছে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে তাদের পক্ষে সেই গোপন রহস্যগুলো আবিষ্কার করা খুব কঠিন হবে না। আত্তিলিও কোনো কথা বলেননি, সঙ্গীদের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি তখন পর্যন্ত–ওই ধরনের অভিযানের সাফল্য সম্বন্ধে তাঁর দ্বিধা ছিল, তাই কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি আত্তিলিও সাহেব।

মি. হুইংক্রি হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনারা যদি মৃত্যুগহ্বর আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে একটা কাজের মতো কাজ হয় বটে!

মৃত্যুগহ্বর! সে আবার কী?

তিন বন্ধুই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

কমিশনার মি. হুইংক্লি তখন যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে–কায়না নামক এক মৃত্যুগহ্বরের কথা স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে শোনা যায় বটে, কিন্তু বাস্তব জগতে উক্ত স্থানের সত্যিই কোনো অস্তিত্ব আছে কি না সে-বিষয়ে তিনি খুব নিঃসন্দেহ নন। হয়তো সবটাই গুজব অথবা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন স্থানীয় মানুষের কল্পনার ব্যাপার। তবে পর পর দু-বার কায়না শব্দটি যে মি. হুইংক্লির শ্রুতিগোচর হয়েছিল সে-কথাও তিনি জানিয়ে দিলেন এবং তারপর পুলিশ কর্মচারী ও বৃদ্ধার মৃত্যু নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল সেই আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ এই কাহিনির শুরুতেই বলা হয়েছে।

সব কথা শুনে বিল আর প্রফেসর ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। সম্ভব হলে সেই মুহূর্তেই তারা মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে যাত্রা করতে প্রস্তুত! আত্তিলিও বন্ধুদের কথায় খুব উৎসাহ প্রকাশ না-করলেও কায়না-অভিযানে তার আপত্তি ছিল না। শেষকালে অবশ্য বিপদের গুরুত্ব বুঝে প্রফেসর ও বিল পিছিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহাযুদ্ধের সৈনিক আত্তিলিও গত্তি একবার কাজ শুরু করে পিছিয়ে আসতে রাজি হলেন না–উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বার বার তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে।

সেসব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

গভর্নরের বাড়ি থেকে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসতেই তিন বন্ধু অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করে ফেললেন। তারা জানতেন স্থানীয় সরকার তাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু সরকারের সাহায্য পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। কাজটা খুবই কঠিন। মাম্বোয়া জাতির প্রধান ব্যক্তিরা অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে বিভিন্ন উপায়ে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে এবং সেই বাধাবিপত্তি জয় করে প্রায় ৩০,০০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে শ্বাপদসংকুল অজানা স্থানে এক গোপন গুহার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যে কতখানি কঠিন, সে-কথা অন্তত আত্তিলিওর অজ্ঞাত ছিল না বিপদের গুরুত্ব বুঝেই তিনি এই অভিযান সম্পর্কে প্রথমে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু অভিযানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আত্তিলিওর মনের ভাব বদলে গেল। বাস্তব জগতে যদি সত্যিই মৃত্যুগুহার অস্তিত্ব থাকে, তবে যেমন করেই হোক ওই জায়গাটা খুঁজে বের করার, প্রতিজ্ঞা করলেন আত্তিলিও।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ত্রয়ী

কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি যে প্রথম মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষের বাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে আফ্রিকা মহাদেশ সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার জন্যই আফ্রিকা ভ্রমণে উদযোগী হয়ে উওর রোডেশিয়াতে পদার্পণ করেছিলেন, সে-কথা এই কাহিনির প্রথম পরিচ্ছেদেই বলা হয়েছে।

কিন্তু সেনাবাহিনীর মানুষটি হঠাৎ সৈনিকের ভূমিকা ত্যাগ করে পর্যটকের ভূমিকা গ্রহণ করতে উৎসুক হয়ে উঠলেন কেন সে-কথা জানতে হলে কমান্ডার সাহেবের পূর্বজীবন নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। প্রফেসর ও বিল নামে আত্তিলিওর যে দুজন বন্ধুর নাম ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সঙ্গেও বর্তমান কাহিনির পাঠকদের বিশেষ পরিচয় হওয়ার প্রয়োজন আছে।

প্রথমেই ধরা যাক আত্তিলিওর কথা, কারণ তিনি হলেন এই কাহিনির নায়ক।

সুদীর্ঘ চার বৎসর ধরে জ্বলতে জ্বলতে প্রথম মহাযুদ্ধের সর্বগ্রাসী অগ্নি যখন নির্বাণলাভের উপক্রম করছে–অর্থাৎ যুদ্ধের শেষ দিকে–হঠাৎ আহত হলেন আত্তিলিও সাহেব। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে মিশরে পাঠানো হল। আত্তিলিওর বুকে গুলি লেগেছিল; তার উপর ফ্লু রোগের আক্রমণ তাকে যক্ষ্মার কবলে ঠেলে দিল। মাত্র তেইশ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে আত্তিলিও খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসক তাকে বললেন, সাহারা মরুভূমিতে সূর্যের তাপে উত্তপ্ত বালির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকলে আত্তিলিওর অসুখ ভালো হয়ে যাবে।

আত্তিলিও ডাক্তারের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। গরম বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে তিনি বসে থাকতেন। মাত্র একমাস পরেই তিনি সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন, তাঁর দেহ রোগমুক্ত হয়েছে এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

ইতিমধ্যে বিস্তর আরব-বেদুইনের সঙ্গে তিনি ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। মরুভূমির মধ্যে একটা সজীব নরমুণ্ড দেখে তারা কৌতূহলী হয়ে ছুটে আসত এবং লুপ্ত বালুকার গর্ভে আত্তিলিওকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে খুবই আশ্চর্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাকে পর্যবেক্ষণ করত। ওই সময়ে আরবি ভাষার সঙ্গে আত্তিলিওর পরিচয় হয়।

সাহারার তপ্ত বালি আত্তিলিওর যক্ষ্মারোগ সারিয়ে দিল। গুলির আঘাতে তার দেহে যে-ক্ষত হয়েছিল, সেই ক্ষতস্থানও শুকিয়ে গেল। কিন্তু এইবার এক নতুন দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে আক্রমণ করল। যক্ষ্মার চেয়েও মারাত্মক এই রোগের নাম আফ্রিকা-জ্বর। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ আফ্রিকাকে ভালোবেসে পাগল হয়–অরণ্য, পর্বত, নদী ও মরুভূমি-সজ্জিত এই বিশাল মহাদেশ তার দ্বিপদ ও চতুষ্পদ সন্তানদের নিয়ে বিদেশি মানুষকে এমন দুর্ভেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে ধরে যে, কিছুতেই তার নিস্তার থাকে না। আফ্রিকা-জ্বরে আক্রান্ত মানুষ পৃথিবীর কোনো স্থানেই স্বস্তি পায় না–বার বার সে ঘুরে ফিরে আসে আফ্রিকার বুকে, বন্য প্রকৃতির সাহচর্য উপভোগ করার জন্য। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন বিদেশি এই আফ্রিকা-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন।

পূর্বোক্ত আফ্রিকা-জ্বর আত্তিলিও সাহেবকে আক্রমণ করেছিল। নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করার আয়োজন শুরু করলেন। উক্ত মহাদেশের বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তিনি একটি অভিযান পরিচালনা করার সংকল্প করেন এবং ওই কাজে তাকে সাহায্য করার উপযুক্ত মানুষের সন্ধান করতে থাকেন। সেই সময়ে প্রফেসরের সঙ্গে আত্তিলিও গত্তির সাক্ষাৎ হয়। আত্তিলিওর অভিযানে বিজ্ঞান-বিষয়ক যেকোনো ব্যাপারেই প্রফেসরের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হত। প্রফেসরের সম্পূর্ণ নাম উল্লেখ করেননি আত্তিলিও; তিনি ভদ্রলোককে প্রফেসর বলেই ডাকতেন, আমরাও তাই ডাকব। আত্তিলিওর লিখিত বিবরণী থেকে শুধু এইটুকু জানা যায় যে, প্রফেসর একজন ফরাসি চিকিৎসক।

এবার বিলের কথা বলছি। সংবাদপত্রে অভিযান-পরিচালনার কাজে সহকারীর জন্য যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন আত্তিলিও, সেই বিজ্ঞাপন দেখেই বিল আকৃষ্ট হয়। বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে বিল একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিল। চিঠি পড়ে আত্তিলিও জানতে পারলেন যে, বিল মোটা মাহিনায় একটি হিসাব-পরীক্ষার প্রতিষ্ঠানে কার্যে নিযুক্ত আছে এবং অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছে। হিসাবপরীক্ষা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে বিল যেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেছে, সেই অভিজ্ঞতা আত্তিলিওর কাজে লাগতে পারে বলেই বিলের বিশ্বাস এবং আত্তিলিও যদি তাকে অভিযানে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে হিসাবপরীক্ষার অফিসে মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে সে যে সাগ্রহে অভিযানে যোগ দিতে রাজি আছে, এই কথাও জানিয়ে দিয়েছে বিল লিখিত আবেদনপত্রে।

এই ধরনের বহু চিঠি আসত প্রতিদিন, কিন্তু বিলের চিঠি হঠাৎ আত্তিলিওর খুব ভালো লেগে গেল। পত্রযোগে তিনি বিলকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। প্রথম দর্শনেই তিনি বিলকে পছন্দ করলেন, কয়েক মিনিট কথা বলেই তিনি বুঝলেন, ঠিক বিলের মতো মানুষকেই তার প্রয়োজন। বিলের পূর্বজীবন সম্বন্ধে আলোচনা করে আত্তিলিও জানলেন, মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই এক দুর্ঘটনার ফলে সে পিতৃমাতৃহীন হয়েছিল। বিলের এক আত্মীয়া তাকে সন্তানস্নেহে পালন করেছিলেন, তাঁর যত্নেই বিল মানুষ হয়েছে। যে-দুর্ঘটনার ফলে বিল তার মা-বাবাকে হারিয়েছিল, সেই ঘটনার কথা সে আত্তিলিওকে বলেনি। পরে অবশ্য বলেছিল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ পরিণাম সম্বন্ধে অবহিত থাকলেও নিয়তির নিষ্ঠুর চক্রান্তকে বাধা দিতে পারেননি আত্তিলিও। যে-দুর্ঘটনার ফলে বিল প্রথমে মা এবং পরে বাবাকে হারিয়েছিল, সেই ঘটনার বিশদ বিবরণ আগে শুনলে হাতিশিকারের জন্য বিলের অস্বাভাবিক আগ্রহের কারণ অনুমান করে আত্তিলিও সাবধান হতেন, কিছুতেই তাকে আফ্রিকায় নিয়ে যেতেন না।

বিলের মা-বাবা যে অভাবিত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, নিউইয়র্কে সংঘটিত সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা হচ্ছে বাস্তব জীবনের এক ভয়াবহ নাটক; এবং সেই নাটকের রক্তরঞ্জিত শেষ দৃশ্যের যবনিকা পড়েছিল অরণ্য-আবৃত আফ্রিকার অন্তঃপুরে।

যথাসময়ে সেই কাহিনি আমরা জানতে পারব।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নাম-মাহাত্ম্য

গভর্নরের বাড়ি থেকে নৈশভোজে আপ্যায়িত হয়ে নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসার পথে তিন বন্ধুর মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল এবং সেই আলোচনার ফলে তারা যে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে অভিযান চালানোর সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, সে-কথা আগেই বলেছি, এখন দেখা যাক পরবর্তী ঘটনার স্রোত তিন বন্ধুকে কোন পথে নিয়ে যায়।

কয়েকদিন পরের কথা। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে বসে আছেন তিন বন্ধু। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে রাতের খানা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল একটি ছোকরা চাকর। তিন বন্ধু লুব্ধ দৃষ্টিতে দেখলেন, ছোকরার হাতের উপর মস্ত বড়ো থালাতে ঝোলের মধ্যে শুয়ে একটা মুরগি, সর্বাঙ্গ থেকে ধূম-উদগিরণ করছে। চিকেনকারি! গরম!

তিন বন্ধুর রসনা সজল হয়ে উঠল।

হঠাৎ কী খেয়াল হল, প্রফেসর বলে উঠলেন, কায়না!

ঝনঝনাৎ! অ্যালুমিনিয়ামের থালাটা ছোকরার হাত থেকে ছিটকে পড়ল মাটির উপর!

দারুণ ক্রোধে চেঁচিয়ে ওঠার উপক্রম করলেন আত্তিলিও, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরিয়ে আসার আগেই চাকরটা তিরবেগে তাঁবুর বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আত্তিলিও তৎক্ষণাৎ চাকরদের তাঁবুর দিকে পা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছোনোর আগেই তিনি শুনতে পেলেন কয়েকটা উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, পরক্ষণেই দ্রুত ধাবমান পায়ের আওয়াজ।…

তিন বন্ধু হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তারা তিনজন ছাড়া আশেপাশে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই, নিগ্রো চাকররা সবাই অদৃশ্য হয়েছে।

না, সবাই নয়, জামানি নামক জুলু জাতীয় যে রাঁধুনিটি অভিযাত্রীদের একান্ত বিশ্বাসের পাত্র ছিল, সেই লোকটি স্থান ত্যাগ করে পালায়নি। পলাতক পাঁচটি চাকরই ছিল উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় অধিবাসী। প্রফেসরের মুখে কায়না শব্দটি শোনার সঙ্গেসঙ্গেই ছোকরা চাকর সকলের কাছে সেই সংবাদ বিতরণ করেছে এবং তার ফলেই বিহ্বল হয়ে মানুষগুলো যে গা-ঢাকা দিয়েছে, এ-বিষয়ে অভিযাত্রীদের কোনো সন্দেহ ছিল না।

রাতের লোভনীয় খাদ্য মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে, চাকররা উধাও হয়েছে জিনিসপত্র ফেলে, তিন বন্ধুর চোখ-মুখ কিন্তু আনন্দে উজ্জ্বল। একটা স্পষ্ট সত্য তারা বুঝতে পেরেছেন : ভৃত্যদের দারুণ আতঙ্ক প্রমাণ করেছে মৃত্যুগহ্বর অলীক কল্পনা নয়। বাস্তব জগতেই বিরাজ করছে ওই ভয়-দেখানো ভয়ানক কায়না।

শুকনো খাদ্যের টিন খুলতে খুলতে অভিযাত্রীরা প্রতিজ্ঞা করলেন, কায়না নামের ওই বিভীষিকাকে যেমন করেই হোক তারা আবিষ্কার করবেন।

প্রতিজ্ঞা করা সহজ, প্রতিজ্ঞা রাখা সহজ নয়।

উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় মানুষ মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের এড়িয়ে চলতে লাগল। মাম্বোয়া জাতির কোনো লোকের কাছে পথের সন্ধান চাইলে সে ভুল পথের নির্দেশ দিত, কাজ করতে বললে পলায়ন করত ঊধ্বশ্বাসে। চারদিক থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত তিন বন্ধুর কানে, এখানে-ওখানে চোখে পড়ত শূন্যে ভাসমান ধোঁয়ার কুণ্ডলী মাম্বোয়াদের সংকেত।

অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য এখন আর মাম্বোয়াদের অজানা নয়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ভেসে যায় ধোঁয়ার অক্ষরে লেখা কুণ্ডলীপাকানো দুর্বোধ্য সতর্কবাণী–সাবধান! সাদা মানুষ এসেছে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে।

ঢাকের আওয়াজ ও ধোঁয়ার সাংকেতিক অর্থ সঠিকভাবে বোধগম্য না হলেও মাম্বোয়াদের মনোভাব অভিযাত্রীরা বুঝতে পেরেছিলেন।

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেও জনপ্রাণীর সাক্ষাৎ পেলেন না তিনবন্ধু। অভিযাত্রীদের আগমন-সংবাদ আগেই পেয়ে যেত গ্রামবাসীরা এবং সঙ্গেসঙ্গে তারা যে স্থান ত্যাগ করত সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই! অভিযাত্রীরা বুঝলেন, মাম্বোয়া-জাতি তাদের বয়কট করছে!

অবশেষে তারা জেলা-কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বললেন। কমিশনার তাঁদের কথা শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন এবং সক্রিয়ভাবে অভিযাত্রীদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু মাম্বোয়াদের মধ্যে যারা কমিশনারের একান্ত অনুগত ছিল, তারাও তাঁর কথায় অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিতে রাজি হল না। অবশেষে চারজন মাম্বোয়া বন্দি অভিযাত্রীদের দলে কাজ করতে সম্মত হল। তারা বোধ হয় ভেবেছিল, দিনের পর দিন বন্দি অবস্থায় গাধার খাটুনি না-খেটে (ওই সময়ে একটা রাস্তা তৈরির কাজে তারা নিযুক্ত ছিল) যদি পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছু অর্থ উপার্জন করা যায়, তাহলে ক্ষতি কী? তা ছাড়া, ভালোভাবে কাজ করলে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জেলা কমিশনার। অতএব বন্দি চারজন মহা উৎসাহে অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিল।

ইতিমধ্যে কমিশনার সাহেবের সঙ্গে অভিযাত্রীদের দস্তুর মতো বন্ধুত্ব পেয়ে গেছে। কমিশনার বেশ বুদ্ধিমান মানুষ, তিনি রটিয়ে দিলেন গুহাবাসী জন্তুজানোয়ার দেখার জন্যই অভিযাত্রীরা এই অঞ্চলে পদার্পণ করেছেন। ধাপ্পায় কাজ হল; মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের সঙ্গে কিছুটা সহজভাবে মেলামেশা শুরু করল। তিন বন্ধু এবার সাবধান হয়েছেন। কায়নার নাম-মাহাত্ম্য যে বিপত্তির সূচনা করেছিল, তা এত শীঘ্র ভুলে যাওয়ার কথা নয়–কেউ আর কায়নার নাম মুখে আনতেন না।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – গুহাতে মৃত্যুর হানা

কায়না-অভিযান ভালোভাবে চালানোর জন্য একটা মানচিত্রের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উক্ত বস্তুটিকে কোথাও পাওয়া গেল না বলে অভিযাত্রীরা ঠিক করলেন, তারা নিজেরাই এলাকাটা পরিদর্শন করে একটা চলনসই মানচিত্রের খসড়া তৈরি করে নেবেন।

কাজটা দু-চার দিনের মধ্যে হওয়ার নয়, বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই যে কয়দিন ওটা তৈরি না হয়, সেই কয়দিনের জন্য একটা স্থায়ী আস্তানার প্রয়োজন। অতএব স্থায়ীভাবে একটা তাবু খাটানো হল। তবুটা যেখানে পাতা হয়েছিল সেই জায়গাটার চারিদিকে পড়েছিল অজস্র গ্রানাইট পাথর। সমস্ত অঞ্চলটা যেন গ্রানাইট পাথরের রাজত্ব–যেদিকে চোখ যায় খালি পাথর আর পাথর।

একটা তাবু খাঁটিয়েই কাজ শেষ হল না। জিনিসপত্র সাজসরঞ্জাম মজুত করার জন্য কয়েকটা কুঁড়েঘর তোলা দরকার। কিন্তু শক্ত পাথুরে-মাটির ওপর খুঁটি পুঁতে ঘর তোলা কি দু-চারজনের কাজ? তা ছাড়া বাক্স-বন্দি অজস্র সাজসরঞ্জাম বহন করার জন্যও তো কিছু লোকের দরকার। খুঁটিনাটি আরও যেসব কাজ ছিল তার জন্যও লোক চাই, অর্থাৎ বেশ কিছু জনমজুর না হলে অভিযাত্রীদের আর চলছে না।

তিন বন্ধুর সঙ্গে যে চারজন মাদোয়া-বন্দি কাজ করার জন্য এসেছিল, তাদের, এবার পদোন্নতি ঘটল। খাটুনির কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে আত্তিলিও তাদের জনমজুর সংগ্রহ করার কাজে নিযুক্ত করলেন তারা হয়ে গেল রিক্রুটিং অফিসার!

কাজটা তাদের খুব পছন্দ হয়েছিল; ওই কাজে তারা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিল। মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক এবং নানারকম উপহার পেয়ে মাম্বোয়ারা ভারি খুশি; সেই সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই লুব্ধ জনতার স্রোত এমনভাবে বাড়তে লাগল যে মাসখানেক পরেই অভিযাত্রীরা দেখলেন লোকের অভাবে বিপন্ন হওয়ার কোনো কারণ আর নেই।

মাম্বোয়ারা খুব মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। মাম্বায়া সর্দার অভিযাত্রীদের জানাল, তার প্রজাদের মধ্যে চারজনকে তারা বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছেন বলে সে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং সবরকমে তাদের সাহায্য করতে সে প্রস্তুত। বন্দি চারজন স্থানীয় মানুষ, অন্তত শতাধিক গুহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল, তবু যদি প্রয়োজন হয় সর্দার নিজে তাদের সাহায্য করবে–অবশ্য যদি তারা সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করেন।

খুব ভালো কথা। খুব আনন্দের কথা। বিল ও প্রফেসর মাম্বোয়া-সর্দারের কথায় ও ব্যবহারে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কিন্তু আত্তিলিওর মনে খটকা লাগল–হঠাৎ মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের সাহায্য করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠল কেন? এটা অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ নয় তো? আত্তিলিও বন্ধুদের কাছে তার সন্দেহ প্রকাশ করলেন না, মনের কথা মনেই চেপে রাখলেন।

অভিযানের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে চালানোর জন্য অভিযাত্রীরা পরামর্শ করতে বসলেন। পরামর্শের ফলে স্থির হল, প্রত্যেক দিন তিন বন্ধু তিন দিকে যাবেন। বন্দি মাম্বোয়া চারজনের মধ্যে দুজন যাবে প্রফেসরের সঙ্গে, দুজন যাবে বিলের সঙ্গে এবং জামানি নামক জুলু-অনুচরটি থাকবে আত্তিলিওর সঙ্গে। পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি দল হবে তিনটি ভিন্ন পথের পথিক।

অল্প সময়ের মধ্যে একটা বৃহৎ এলাকা পরিদর্শন করার পক্ষে ওই পরিকল্পনা খুবই উপযোগী ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভাবতে গেলে বলতে হয় পরিকল্পনাটা ছিল অতিশয় মারাত্মক। কারণ, গুহার মধ্যে প্রবেশ করে অভিযাত্রীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো হিংস্র জন্তুর সম্মুখীন হন, তবে সম্পূর্ণ এককভাবেই তাকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হবে। নিগ্রোদের মধ্যে কেউ গুহার ভিতর প্রবেশ করতে চাইবে না–তারা অপেক্ষা করবে গুহার বাইরে এবং গুহার ভিতর থেকে আচম্বিতে শ্বাপদকণ্ঠের হিংস্র গর্জন কানে এলে তারা যে পদযুগলের দ্রুত ব্যবহার না-করে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা আছে কি? নিগ্রোরা স্থানীয় মানুষ, খুব সহজেই পথ চিনে তারা তাবুতে ফিরে আসতে পারবে, কিন্তু বিদেশি অভিযাত্রী শ্বাপদের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলেও গুহার বাইরে এসে নিগ্রোদের দেখা না-পেলে আবার বিপদে পড়বেন–ছোটো বড়ো অসংখ্য গ্রানাইট পাথরের দুর্গ, সুড়ঙ্গ আর গোলকধাঁধা ভেদ করে তার পক্ষে সঠিক পথের নিশানা ধরে তাবুতে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব।

এইসব বিপদের সম্ভাবনা তুচ্ছ করেই অভিযাত্রীরা অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিপদ যে হয়নি তা নয়, হয়েছিল। জামানি এবং মাম্বোয়া পথপ্রদর্শকেরা সকলেই গুহার সান্নিধ্য অপছন্দ করত। পথ দেখিয়ে গুহার সামনে নিয়ে যেতে তাদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু গুহার প্রবেশপথ থেকে প্রায় ফুট পঞ্চাশ দূরে এসেই তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত, কিছুতেই আর অগ্রসর হতে চাইত না। তাদের দোষ নেই; কয়েকদিনের ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে তাদের ভয় পাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ ছিল।

একটা অজানা গুহার মধ্যে একদিন হঠাৎ বিলের সঙ্গে একটা হায়নার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। বিল গুলি ছুড়ল–গুহার অস্পষ্ট অন্ধকারে তার নিশানা ভালো হয়নি–ফলে জটা মরল না। আহত হল। দ্বিতীয়বার গুলি চালিয়ে হায়নাটাকে হত্যা করার আগে জটা বিলের হাঁটুতে একবার নখের আঁচড় বসিয়েছিল। বিল ক্ষতটার দিকে নজর দেয়নি। হায়না মেরে সে গুহার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল এবং তারপরেও ক্ষতচিহ্নটাকে সামান্য আঘাত বলে তুচ্ছ করেছিল। তাচ্ছিল্যের পরিণাম বিলের পক্ষে ভালো হয়নি। সেইদিনই সন্ধ্যার সময়ে তার ক্ষতটা এমন ভীষণভাবে বিষিয়ে উঠল যে আত্তিলিও ভাবলেন বিলকে বাঁচানোর জন্য ওই পা-টিকে হয়তো কেটে ফেলতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই বিল সেযাত্রা আরোগ্য লাভ করতে সমর্থ হয়।

আর একবার ভারসাম্য হারিয়ে প্রফেসর হঠাৎ পড়ে গেলেন একটা শুকনো গাছের ডালপালার মধ্যে। ডালগুলোতে পাতা ছিল না একটিও। কিন্তু কাটা ছিল প্রচুর পরিমাণে। কাটার আঘাতে প্রফেসরের জামাকাপড় হল ছিন্নভিন্ন, দেহের চামড়ায় হল একাধিক ছিদ্রের সৃষ্টি এবং ওই ছিদ্রপথে কাটার বিষ প্রফেসরের রক্তে ঢুকে তাকে শয্যাশায়ী করে দিল। কাটার মধ্যে কী ধরনের বিষ ছিল ভগবানই জানেন–ঝাড়া দশদিন ধরে প্রফেসর ভুগলেন প্রচণ্ড জ্বরের আক্রমণে।

জ্বরের কবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে একটু সুস্থ হয়েই প্রফেসর আবার মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। এবার আর কাটা নয়, দু-দুটো সিংহের সঙ্গে প্রফেসরের দেখা হল একটা অজানা গুহার মধ্যে। প্রফেসর গুলি ছুড়লেন, গুলি লাগল না। সিংহরা আক্রমণের চেষ্টা না-করে বিদ্যুদবেগে গুহার বাইরে অদৃশ্য হলরাইফেলের গর্জিত অগ্নিশিখা তাদের মোটেই পছন্দ হয়নি। প্রায় অন্ধকার গুহার ভিতর দু-দুটো সিংহের মারাত্মক সান্নিধ্য থেকে অক্ষত অবস্থায় পরিত্রাণ পেয়ে খুশি হয়ে প্রফেসর বাইরে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু তার মাম্বোয়া সঙ্গীদের তিনি দেখতে পেলেন না। প্রফেসর বুঝলেন হয় তারা সিংহের কবলে পড়েছে, আর না হয় সিংহদের দেখে গা ঢাকা দিয়েছে। শেষোক্ত সন্দেহই সত্যি, সিংহদের দেখে তারা দৌড়ে পালিয়েছিল। প্রফেসর যদি বুদ্ধিমানের মতো গুহার সামনে অপেক্ষা করতেন তাহলে তিনি অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতেন। কারণ, মাধোয়ারা তাবু থেকে আত্তিলিওকে নিয়ে অকুস্থলে ফিরে এসেছিল। প্রফেসরকে অবশ্য সেখানে পাওয়া যায়নি। মাম্বোয়াদের না দেখতে পেয়ে প্রফেসর নিজেই তাবুতে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলেন এবং দিশাহারা হয়ে গন্তব্যস্থলের বিপরীত দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে মাম্বোয়াদের সাহায্যে আত্তিলিও যখন আড়াই দিন পরে প্রফেসরকে আবিষ্কার করলেন, তখন ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং জ্বরের আক্রমণে ভদ্রলোকের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়।

আমাদের কাহিনির নায়ক স্বয়ং আত্তিলিও সাহেবও সঙ্গীদের মতোই গুহার ভিতর বিপন্ন হয়েছিলেন।

সিংহ নয়, হায়না নয়, একটি ছোটো গোলাকার মাংসপিণ্ডের রোমশ শরীরের উপর হোঁচট খেয়ে আত্তিলিও প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। একদিন বিকেল বেলা আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর জামানি তাকে একটা সুড়ঙ্গের সামনে এনে জানাল ওটা একটা গুহার প্রবেশপথ। পথটা ছিল নীচু, খুবই সংকীর্ণ। অতি কষ্টে ভিতরে প্রবেশ করলেন আত্তিলিও, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। অনেকক্ষণ ওইভাবে চলার পর তার মনে হল এতক্ষণে বোধ হয় তিনি সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে গুহার ভিতর পৌঁছেছেন। হাতের টর্চ জ্বেলে তিনি দেখলেন তার অনুমান সত্য–বিজলিবাতির ক্ষীণ আলোকধারা হারিয়ে গেছে এক অন্ধকার-আচ্ছন্ন গুহার বিপুল বিস্তৃতির মধ্যে। ওই বিশাল গুহার অভ্যন্তরে পদার্পণ করলে প্রস্তরবেষ্টিত গলিপথগুলোর ভিতর পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে, অতএব ভিতর দিকে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ হবে কি না ভাবতে লাগলেন আত্তিলিও এবং ভাবতে ভাবতেই হামাগুড়ি-দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পায়ের উপর সেই বস্তুটির অস্তিত্ব অনুভব করলেন! সঙ্গেসঙ্গে গুহার শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল একটা শব্দ ফাসস! পরক্ষণেই জুতোর চামড়ার উপর ধারালো বস্তুর সংঘাতের শব্দ!

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – জ্ঞান হারালেন আত্তিলিও

টর্চের আলোটা তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে পায়ের উপর ফেলে আত্তিলিও দেখলেন, তার জুতোর সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে হলুদের উপর কালো কালো ছাপ-বসানো একটা রোমশ ফুটবল! সেই অতিজীবন্ত ও অতি ক্রুদ্ধ ফুটবলের মতো গোলাকার বস্তুটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে মার্জারকণ্ঠের গর্জনধ্বনি, সঙ্গেসঙ্গে জুতোর উপর ধারালো নখের আঁচড় কাটার শব্দ।

লেপার্ডের বাচ্চা! বিড়াল জাতীয় জীবের স্বভাব অনুযায়ী বাচ্চাটা সমস্ত দেহটাকে গোল করে পাকিয়ে আত্তিলিওর জুতোটাকে চেপে ধরেছে এবং তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে মোটা হান্টিং বুট-এর চামড়া!

বাচ্চাটার চেষ্টা সফল হত কি না বলা মুশকিল, কিন্তু আত্তিলিও তাকে সেই সুযোগ দিলেন না। সজোরে লাথি মেরে বাচ্চাটাকে তিনি দূরে সরিয়ে দিলেন। জন্তুটার ছিটকে পড়ার আওয়াজ, শোনা গেল। অন্ধকার গুহার গর্ভে শ্বাপদ-শিশুর ছোটো শরীরটা আত্তিলিওর দৃষ্টিগোচর হল না, কিন্তু রুষ্ট প্রতিবাদ ভেসে এল তার কানে–ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে বাচ্চাটা তার বিরক্তি ও ক্রোধ জানিয়ে দিচ্ছে!

আচম্বিতে সেই শব্দে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠল আরও অনেকগুলো বাচ্চা লেপার্ড : ফ্যাঁস, ফ্যাঁস, ফ্যাঁসস…।

অন্ধকারের ভিতর শ্বাপদ শিশুদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না আত্তিলিও, কেবল তাদের ক্রুদ্ধ বিড়ালের মতো গর্জনধ্বনি তার কানে ভেসে আসতে লাগল।

আত্তিলিও ভয় পেলেন।

অনেকটা লেপার্ডের মতো দেখতে চিতা নামক যে-জন্তুটি আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করে, সেই চিতার বাচ্চা দেখলে তিনি ভয় পেতেন না; কিন্তু আত্তিলিওর অভিজ্ঞ চক্ষু ভুল করেনি, জন্তুটা চিতার বাচ্চা নয়, লেপার্ড-শিশুই বটে। চিতা ভীরু জানোয়ার, লেপার্ড হিংস্র ও ভয়ংকর। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো লেপার্ড মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক, বিশেষ করে বাচ্চার বিপদের আশঙ্কায় অন্ধকার গুহার ভিতর ক্ষিপ্ত লেপার্ড-জননীর আক্রমণ যে কতখানি মারাত্মক হতে পারে, সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিওর মতো দুঃসাহসী মানুষও ভয় পেয়েছিলেন।

তিনি বুঝেছিলেন, দিনের বেলা অন্ধকার গুহার আশ্রয় ছেড়ে বাচ্চাদের মা বড়ো লেপার্ডটা বাইরে বেড়াতে যাবে না–সে নিশ্চয়ই গুহার ভিতরে কোথাও অবস্থান করছে এবং বাচ্চাদের নিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্যে যে দ্বিপদ জন্তুটি তার আস্তানায় অনধিকার প্রবেশ করেছে, তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আত্তিলিও বাচ্চাদের মা বড়ো লেপার্ডটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু অন্ধকারে অভ্যস্ত একজোড়া শ্বাপদচক্ষু যে তার গতিবিধি লক্ষ করছে, সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিও অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিলেন।

বাচ্চাগুলো ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে এতক্ষণ ক্রোধ প্রকাশ করছিল, হঠাৎ তারা একসঙ্গে চুপ করে গেল। আত্তিলিওর অনুমান এইবার নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হল : বাচ্চাদের আকস্মিক নীরবতা বড়ো লেপার্ডটার সান্নিধ্য প্রমাণ করে দিয়েছে।

পালাতে পারলে আত্তিলিও পালিয়েই যেতেন। কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময়ে আক্রান্ত হলে অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ করতে হবে, আত্মরক্ষার চেষ্টা করাও সম্ভব হবে না। অতএব পলায়নের চিন্তা ছেড়ে গুহার ভিতর দাঁড়িয়ে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তিনি প্রস্তুত হলেন। গুহার দেয়ালে পিঠ রেখে আত্তিলিও টর্চের আলো ঘুরিয়ে বড়ো লেপার্ডটাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

হঠাৎ তার মাংসপেশিগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেল–দুটো বিরাট পাথরের মাঝখানে টর্চের আলোকধারার মধ্যে ভেসে উঠেছে একজোড়া বৃহৎ নিস্পলক চক্ষু!

চোখ দুটো গোল, সবুজ এবং জ্বলন্ত!

মা-লেপার্ড!

বিপদের মুখোমুখি হতেই বিপদের ভয় কেটে গেল। আত্তিলিওর কম্পিত হাত দুটো হঠাৎ সৈনিকের অভ্যস্ত দৃঢ়তায় রাইফেল ও টর্চ আঁকড়ে ধরল, টর্চের আলোতে জ্বলন্ত চোখ দুটির উপর নিশানা স্থির করতে লাগলেন আত্তিলিও।

লেপার্ড লাফ দিল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটল রাইফেলের গুলি। গুলি লাগল, কিন্তু শ্বাপদের গতি রুদ্ধ হল না। সশব্দে লেপার্ড এসে আছড়ে পড়ল গুহার প্রস্তর-প্রাচীরের উপর। শ্বাপদের নিশানা ভুল হয়নি, কিন্তু আত্তিলিও স্থান পরিবর্তন করেছেন বিদ্যুদ্‌বেগে। লেপার্ড দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার আগেই আবার গর্জে উঠল রাইফেল, গুলি জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল।

তীব্র উত্তেজনা কেটে যেতেই আত্তিলিও ক্লান্তি বোধ করলেন। কিন্তু ওই বিপজ্জনক গুহার মধ্যে বিশ্রাম করার ইচ্ছা তার ছিল না। সুড়ঙ্গের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি দ্রুতবেগে হামাগুড়ি দিতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই গুহার বাইরে এসে প্রখর সূর্যালোকের নীচে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

জীবনে সর্বপ্রথম জামানি তার প্রভুর আদেশ অমান্য করল। সে কিছুতেই মৃত লেপার্ডের দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে রাজি হল না।

না, মাসাংগা, না,–জামানি বলল, এই জন্তুটার চামড়া আমি ছাড়াতে পারব না। এটা লেপার্ড নয়, এটা হচ্ছে লেপার্ডের দেহধারী প্রেতাত্মা! ওটার চামড়া ছাড়িয়ে নিলেই প্রেত ওই দেহ থেকে বেরিয়ে আমাকে আক্রমণ করবে। মাসাংগা! এই দেশটা ভালো নয়, আমাদের এখনই এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।

আত্তিলিও অবশ্য জামানির উপদেশে কর্ণপাত করেননি। মাঙ্গেয়াদের সন্দেহ চলে গেছে, অভিযাত্রীরা এখন তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। এই হচ্ছে অনুসন্ধান-কার্য চালানোর উপযুক্ত সময়, এখন কি ফিরে যাওয়া যায়? মাম্বোয়াদের এখন ধারণা হয়েছে, অভিযাত্রীরা কেবল গুহার ভিতর জন্তুজানোয়ার দেখার জন্যই এখানে এসেছেন। এটা অবশ্য তাদের কাছে পাগলামি, তবে এই ধরনের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতে তাদের আপত্তি নেই। সাদা মানুষরা যদি গুহার মধ্যে ঢুকে জন্তুজানোয়ারের আঁচড়-কামড় খেতে চায় এবং সেই কাজে সাহায্য করলে যদি টাকাপয়সা, সিগারেট আর নানারকম উপহার পাওয়া যায়, তাহলে তাদের সাহায্য করতে আপত্তি কী? তবে হ্যাঁ, কায়নার কথা না-বললেই হয়।

অবশ্য অভিযাত্রীরা কায়নার নাম আর ভুলেও উচ্চারণ করতেন না।

একদিন হঠাৎ দুটি মাম্বোয়ার কথা আত্তিলিওর কানে এল। আত্তিলিও ছিলেন তাঁবুর ভিতরে, মাম্বোয়ারা তাকে দেখতে পায়নি। তিনি শুনলেন একজন মাম্বোয়া বলছে, খুব সম্ভব যে পাঁচটা ছেলে আগে সাদা মানুষের কাজ করত, তারা ভুল করেছে। বোধ হয় ওরা সাদা মানুষের কথা বুঝতে পারেনি।

তার সঙ্গী বলল, হতে পারে। কিংবা হয়তো ওটা ছিল সাদা মানুষের ক্ষণিকের খেয়ালমাত্র। তবে সেই খেয়াল কেটে গেছে, আমরা এখন যেদিকে যেতে বলি ওরা সেইদিকেই যায়। ওরা যেদিকে গেলে আমাদের মাতব্বররা বিপদ হবে বলে মনে করে, সেদিকে ওরা কখনোই পা বাড়ায় না।

আত্তিলিওর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। মাম্বোয়াদের বিশ্বাস অভিযাত্রীরা মৃত্যুগহ্বর নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। মানচিত্রটা নিয়ে আত্তিলিও দাগ দিতে লাগলেন। তার পরিকল্পনা ছিল খুবই সহজ।

মাম্বোয়ারা নিশ্চয়ই কায়নার ধারেকাছে অভিযাত্রীদের উপস্থিতি চাইবে না, অতএব মৃত্যুগহ্বর যেখানে অবস্থান করছে তার থেকে দূরে দূরেই মাথোয়ারা তাদের পরিচিত করার চেষ্টা করবে। যে জায়গাগুলো একবার দেখা হয়ে যায়, ম্যাপের গায়ে সেই জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে রাখতেন অভিযাত্রীরা। ম্যাপটাতে দাগ দিতে দিতে এক সময় তারা নিশ্চয় দেখতে পাবেন, কোন এলাকাটা বাদ দেওয়া হচ্ছে। একবার যদি তাদের চোখে ধরা পড়ে, একটা নির্দিষ্ট এলাকা মাম্বোয়ারা এড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে সেই অঞ্চলটায় অভিযান চালালেই মৃত্যুগহ্বরের সন্ধান পাওয়া যাবে।

কিন্তু হা, এখানে একটা কিন্তু আছে।

যেসব এলাকায় যাওয়া হয়েছে, ম্যাপের গায়ে সেই এলাকাগুলিকে ফুটকির দাগ বসিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে; এখন পেনসিলের লাইন টেনে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন জায়গা ম্যাপের উপর চক্রাকারে ছড়িয়ে আছে, অর্থাৎ সেইসব স্থানে এখন পর্যন্ত অভিযাত্রীদের পায়ের ধুলো পড়েনি। কিন্তু সেই ছোটো ছোটো টুকরো টুকরো অনাবিষ্কৃত এলাকার পরিধি বড়ো কম নয়। এইভাবে আর কতদিন অভিযান চালানো সম্ভব? ইতিমধ্যেই অভিযাত্রীরা বেশ কয়েকবার বিপদে পড়েছেন। অজানা গুহার অন্ধকারে অনিশ্চিত প্রত্যাশায় দিনের পর দিন জীবন বিপন্ন করা কি বুদ্ধিমানের কাজ? তিন মাস তো হয়ে গেল, আর কত দিন?

অতএব পরামর্শ সভা বসল।

প্রফেসর এবং বিল অভিযান চালানোর বিপক্ষে রায় দিলেন। প্রফেসরের বক্তব্য হচ্ছে : তিন মাস অনুসন্ধান চালিয়ে এক-শো উনত্রিশটা গুহার ভিতর তারা পদার্পণ করেছেন, কিন্তু মৃত্যুগহ্বর এখন পর্যন্ত তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। কায়নার অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রফেসর মোটেই নিঃসন্দেহ নন। তিনি আরও জানালেন এই অঞ্চলের বিভিন্ন গুহার মধ্যে প্রাচীন গুহামানবের বসবাসের নিদর্শন এবং বিবিধ প্রকার খনিজবস্তুর অস্তিত্ব তাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিয়েছে। অথচ এইসব দিকে চোখ না-দিয়ে অর্থ আর সময়ের অপব্যয় করা হচ্ছে এক অলীক বস্তুর পিছনে! অতএব এই অভিযান এখনই বন্ধ করা উচিত।

বিলও প্রফেসরকে সমর্থন জানাল, দুজনেরই মত হচ্ছে : চুলোয় যাক কায়না। মরীচিৎকার পিছনে ছুটে এসে অনেক বস্তুর সান্নিধ্য আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি, যেগুলো প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাণীবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিরাট আবিষ্কার বলে গণ্য হতে পারে।

অকাট্য যুক্তি। তবু আত্তিলিও বন্ধুদের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। আত্তিলিও শেষ চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমি স্বকর্ণে শুনেছি একজন মাম্বোয়ার কথা। লোকটা তার সঙ্গীকে বলছিল আমরা নাকি কখনোই সেদিকে যাইনি যেদিকে আমাদের গতিবিধি মাম্বোয়া-প্রধানরা পছন্দ করে না।

বিল বলল, খুব সম্ভব আমাদের অজ্ঞাতে কায়নার সামনে দিয়ে আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আসল জায়গাটা ছাড়িয়ে মাম্বোয়াদের সঙ্গে আমরা অন্যদিকের গুহায় গুহায় ঘুরেছি। এই দশ বছর ধরে ঘোরাঘুরি করলেও আমরা মৃত্যুগহ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারব না।

ঠিক আছে–আত্তিলিও বললেন, যেসব গুহাতে খনিজদ্রব্য বা ঐতিহাসিক বস্তুর নিদর্শন আছে বলে মনে হয়, তোমরা সেইসব গুহাতে সন্ধান চালিয়ে আবিষ্কারের সম্মান লাভ কর তোমাদের আমি কায়নার পিছনে সময় নষ্ট করতে বলব না। সঙ্গে যত খুশি লোক নাও, তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এতদিন ধরে এত কষ্ট সহ্য করার পর এত তাড়াতাড়ি আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। অন্তত আরও একমাস আমি দেখব। নির্দিষ্ট একমাসের মধ্যে যদি কোনো ফল না-পাই, তাহলে কথা দিচ্ছি আমি কায়না অভিযানে ইস্তফা দেব।

আত্তিলিওর প্রস্তাবে কারো আপত্তি হল না। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।

পরের দিন ১৫ সেপ্টেম্বর স্বয়ং মাম্বোয়া-সর্দার আত্তিলিও সাহেবের সঙ্গী হল। ইতিপূর্বে সর্দার তাদের উপদেশ, নির্দেশ দিয়েছে, কোথায় কোন পথে গেলে নূতন নূতন গুহার সন্ধান পাওয়া যাবে জানিয়েছে, কিন্তু সে ব্যক্তিগতভাবে কখনো অভিযাত্রীদের সঙ্গী হয়নি। খুব সম্ভব সে বুঝেছিল, অভিযাত্রীরা শীঘ্রই তাদের দেশ ছেড়ে বিদায় নেবেন।

সর্দারের সঙ্গে কয়েকজন মাম্বোয়া অনুচর ছিল। তারা সকলেই বিভিন্ন গুহার সন্ধান দিয়ে আত্তিলিওকে সাহায্য করতে চাইল। উৎসাহের আধিক্যে আত্তিলিও সেদিন তেরোটা নূতন গুহা পরিদর্শন করে ফেললেন। একদিনে এতগুলো গুহা অভিযাত্রীদের মধ্যে কেউ ইতিপূর্বে পরিদর্শন করতে পারেননি। চোদ্দো নম্বর গুহাটার মুখে যখন আত্তিলিও পদার্পণ করলেন তখন সন্ধ্যা প্রায় আগত, অস্পষ্ট অন্ধকারের প্রলেপ পড়েছে পৃথিবীর বুকে।

আত্তিলিও চোদ্দো নম্বর গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। সঙ্গীরা গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

গুহার মধ্যে তখন অস্পষ্ট অন্ধকার।

আত্তিলিও চমকে দেখলেন, আবছা আলো-আঁধারের ভিতর থেকে তার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক বিরাট সৰ্পৰ্দানব পাইথন!

এত মোটা আর এত লম্বা সাপ কখনো দেখেননি আত্তিলিও। চকিতে রাইফেল তুলে তিনি গুলি চালালেন। পাইথনের মাথা উড়ে গেল ছিন্নভিন্ন হয়ে, কিন্তু তার মুণ্ডহীন বিরাট শরীরটা মৃত্যুযাতনায় আত্তিলিওর চারপাশে আছড়ে পড়তে লাগল একটা অতিকায় চাবুকের মতো!

আত্তিলিও অনায়াসে ছুটে পালাতে পারতেন, কিন্তু তার বুদ্ধিভ্রংশ হল। সেইখানে দাঁড়িয়েই তিনি বার বার গুলি চালিয়ে সরীসৃপের অন্তিম আস্ফালনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। অজগর-জাতীয় বৃহৎ সরীসৃপের দেহ মৃত্যুর পরেও বেশ কিছুক্ষণ অন্ধ আক্ষেপে কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী পাকিয়ে ছটফট করতে থাকে। এই সাপটাও ছিল বিরাট–তার চামড়া ছাড়িয়ে পরে যখন মাপ নেওয়া হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল পাইথনটার দৈর্ঘ্য হচ্ছে আটত্রিশ ফুট এবং দেহের সবচেয়ে স্থূল জায়গাটার মাপ হচ্ছে তিন ফুট নয় ইঞ্চি!

এত মোটা, এত লম্বা একটা সর্পিল দেহ যদি চাবুকের মতো সজোরে কোনো মানুষের গায়ে আছড়ে পড়ে, তাহলে মানুষটার যে অবস্থা হয়, আত্তিলিও সাহেবেরও সেই অবস্থা হল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে ক্ষণিকের জন্য তিনি অনুভব করলেন একটা মস্ত পাহাড় যেন তার দেহের উপর ভেঙে পড়ছে! পরক্ষণেই তাঁর চৈতন্যকে লুপ্ত করে নামল মূর্ছার অন্ধকার…

.

যষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পথের নিশানা

জ্ঞান ফিরে এলে আত্তিলিও দেখলেন, তিনি তাঁবুর মধ্যে তাঁর নিজস্ব বিছানাতে শুয়ে আছেন এবং তার কপালে কাপড় ভিজিয়ে ঠান্ডা জলের প্রলেপ দিচ্ছে জামানি।

ক্লান্তিজড়িত স্বরে প্রফেসর আর বিলকে ডেকে দিতে বললেন আত্তিলিও। তাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে মহা খুশি জামানি। একগাল হেসে সে জানাল, তারা দুজনেই বাইরে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু মাসাংগার কথা বলা উচিত নয়।

আত্তিলিওর সমস্ত সত্তা আবার ডুবে গেল গভীর নিদ্রার অন্ধকারে…

দ্বিতীয়বার চোখ মেলে আত্তিলিও দেখলেন, তার মাথার কাছে একটা আলো জ্বলছে, বন্ধুরাও কাছেই আছে। প্রফেসর আত্তিলিওকে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, আত্তিলিও যদি কথা বলার চেষ্টা না-করে তবে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে তার আপত্তি নেই। অজ্ঞান হওয়ার কারণটা প্রফেসরের মুখ থেকেই শুনলেন আত্তিলিও–সর্পদানবের দেহের প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ে একটা পাথরে মাথা ঠুকে যাওয়ার ফলেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।

জামানি, মাম্বোয়া-সর্দার এবং দলবল গুহার ভিতর রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন শুনেই বুঝেছিল, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রথমে কেউ সাহস করে ভিতরে প্রবেশ করেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও তিনি যখন বেরিয়ে এলেন না, তখন জামানির অনুরোধে মাম্বোয়া-সর্দার গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে রাজি হয়। গুহার ভিতর অচৈতন্য অবস্থায় আত্তিলিওকে পড়ে থাকতে দেখে তারা তাকে তুলে আনে এবং সবাই মিলে ধরাধরি করে তার দেহটাকে বহন করে নিয়ে আসে। তাবুতে। আত্তিলিও এই পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন, কিন্তু যখন প্রফেসর জানালেন, আটদিন ধরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন, তখন চমকে উঠলেন আত্তিলিও–আটদিন! বলে কী!

চুপ করো!–প্রফেসর চমকে উঠলেন, বিশ্রাম নাও। কথা বলবে না। সব ঠিক আছে। আমি আর বিল তোমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

আত্তিলিও হাতের ওপর ছুঁচ ফোঁটার যন্ত্রটা অনুভব করলেন–ইঞ্জেকশন। আলোটা নিভে গেল। দু-জোড়া পা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল তাবুর বাইরে। দু-চোখের পাতার নিদ্রার স্পর্শ সমগ্র অনুভূতি ও চৈতন্যকে অবলুপ্ত করে নামছে নিবিড় অন্ধকার… আত্তিলিও ঘুমিয়ে পড়লেন…

একমাস পরে নভেম্বরের ২১ তারিখে প্রফেসর রায় দিলেন আত্তিলিও এইবার স্বচ্ছন্দে কাজকর্ম করতে পারেন। বিগত একমাস গত্তি সাহেবকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়নি, দুই বন্ধু তাকে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছিলেন। প্রফেসরের ঘোষণা শুনে মহা উৎসাহে আত্তিলিও অনেকদিন পরে ম্যাপ খুলে বসলেন। ম্যাপটার গায়ে এক জায়গায় খুব বড়ো করে একটা ফুটকির চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। চিহ্নিত স্থান হচ্ছে সেই গুহা, যেখানে একমাস আগে আত্তিলিও অতিকায় পাইথনের দেখা পেয়েছিলেন। চিহ্নটার পাশে কে যেন পেনসিল দিয়ে লিখে রেখেছে : শুক্রবার ১৩ অক্টোবর। শুভদিন। হুররে!

শুভদিন, না ঘোড়ার ডিম!–আত্তিলিও বলে উঠলেন, আবার হুররে লিখে আনন্দ জানানো হয়েছে! কেন? এত আনন্দ কীসের?

দেখো, দেখো, ভালো করে দেখো। বিল গর্জন করে উঠল।

আত্তিলিও ভালো করে দেখলেন, সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক–কী!

এইবার আত্তিলিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। সুদীর্ঘ বিশ্রাম হৃত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় যে সময়টা তিনি অতিবাহিত করেছেন সেই সময়ে বিল আর প্রফেসর পরিদর্শন করেছেন গুহার পর গুহা। যেসব এলাকা দেখা হয়ে গেছে, সেখানে ফুটকির চিহ্ন। চিহ্নগুলোকে লক্ষ করলে দেখা যায়, কেবল পূর্ব ও দক্ষিণেই ফুটকির ছড়াছড়ি। ফুটকিগুলো সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা জায়গাকে বৃত্তের আকারে ঘিরে ধরেছে। একটু অসমান আর খাপছাড়া হলেও ফুটকিগুলো মোটামুটি একটা সরলরেখার রূপ ধরেই এগিয়েছে এবং বৃত্তের আকারে যে-স্থানটিকে ঘিরে ফেলেছে, সেটা সুগোল না হলেও বৃও বটে। ওই বৃত্তাকার স্থানটির চারপাশেই ফুটকি-চিহ্ন দেখে বোঝা যায় ওই জায়গাটা এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ফুটকিগুলো সোজা এগিয়ে এসে যেখান থেকে ঘুরে অনাবিষ্কৃত অঞ্চলটাকে নির্দিষ্ট করছে, সেই চিহ্নর বেষ্টনী শুরু হয়েছে ঠিক পাইথনের গুহার পর থেকে। অর্থাৎ পাইথনের গুহা অবধি সোজাসুজি এগিয়েছে অভিযাত্রীরা, কিন্তু উক্ত গুহার পরবর্তী স্থানে পদার্পণ করেই তারা বামে ও দক্ষিণে ঘুরে গেছেন। কিন্তু কেন? হ্যাঁ, ঘুরে যাওয়ার কারণটা বেশ স্পষ্ট। চিহ্নিত স্থানের লিখিত তারিখ দেখলেই বোঝা যায় পাইথনের গুহার পর থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা বিল আর প্রফেসরকে বাঁয়ে আর ডাইনে নিয়ে গেছে, সরলরেখা ধরে তাদের এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। ক্রমাগত বাঁয়ে আর ডাইনে ঘুরেছেন তারা, ফলে আবিষ্কৃত স্থানগুলোতে ফুটকির চিহ্ন পড়ে পরিত্যক্ত জায়গাটাকে বৃত্তের আকারে পরিস্ফুট করেছে ম্যাপের ওপর।

স্পষ্টই বোঝা যায়, ওই জায়গাটার উপর প্রফেসর আর বিলের উপস্থিতি পছন্দ করে না মাম্বোয়ারা, তাই তারা প্রফেসর ও বিলকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। আরও শোনা গেল আত্তিলিও যখন বিশ্রাম নিতে বাধ্য হয়ে বিছানায় শুয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন, সেই সময় বিল আর প্রফেসরকে সাহায্য করার জন্য রোজই এসেছে মাম্বোয়া-সর্দার স্বয়ং–দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ওই জায়গাটা থেকে অভিযাত্রীদের দূরে রাখার জন্য তার প্রচেষ্টা দুই বন্ধুই লক্ষ করেছেন। প্রফেসর ও বিলের মনোভাব বুঝতে পারেনি মাম্বোয়া-সর্দার; কারণ, সব বুঝেও কিছু না-বোঝার অভিনয় করেছেন দুই বন্ধু আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে তার ফলেই মানচিত্রের গায়ে ফুটকি-চিহ্ন বেষ্টিত গোল জায়গাটা ধরা পড়েছে।

ম্যাপের উপর ওই গোল চিহ্নবিহীন জায়গাটা দেখতে দেখতে আত্তিলিওর গলা থেকে একটা অস্ফুট অর্থহীন শব্দ বেরিয়ে এল। প্রফেসর হাসলেন, হ্যাঁ, ওইখানেই আছে–কোনো সন্দেহ নেই এ-বিষয়ে।

দারুণ উৎসাহে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। কায়না সম্বন্ধে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, এখন আবার আশায় উদ্দীপনায় তার রক্তে উৎসাহের জোয়ার লাগল। প্রফেসরের ওষুধের চাইতে ম্যাপের চিহ্নগুলো তার স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি উপযোগী হয়েছে সন্দেহ নেই।

পরের দিন সকালে সবাই যখন বেরিয়ে গেল, আত্তিলিও তখন জামানিকে ডেকে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। আত্তিলিও বুঝেছিলেন জামানির সাহায্য ছাড়া তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে তিনি জামানির সামনে প্রলোভনের জাল ফেলতে শুরু করলেন, সেইসঙ্গে জুলু জাতির স্বাভাবিক মর্যাদাবোধ ও অহংকারে সুকৌশলে আঘাত দিয়ে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা চলল… আত্তিলিও কি বোঝেন না, জামানি তার দেশ জুলুল্যান্ডে ফিরে যেতে চায়? এই। হতভাগা মাম্বোয়াদের দেশ আর ভালো লাগে না সে-কথাও তিনি জানেন। তিনি নিজেই কি এই দেশ পছন্দ করছেন? মোটেই না, মোটেই না। তবে কাজ শেষ না-করে তো এই পাথুরে-নরক ছাড়ার উপায় নেই। জামানি যদি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে চায়, তবে তারও উচিত হবে তাকে সাহায্য করা; কারণ কার্যসিদ্ধি হলেই তো তিনি চটপট এখান থেকে সরে পড়তে পারবেন। আর আত্তিলিওর যে অপেরা হ্যাট টুপিটার মধ্যে দারুণ সব জাদুবিদ্যা লুকানো আছে বলে জামানি বিশ্বাস করে, সেই টুপিটা তো জামানিকেই উপহার দিতে চাইছেন তিনি। তবে এমন একটা মূল্যবান উপহারের বিনিময়ে তারও কি মাসাংগাকে সাহায্য করা উচিত নয়?… কায়না-আবিষ্কারের পর আত্তিলিও নিশ্চয়ই তাকে জুলুল্যান্ডে নিয়ে যাবেন, সমস্ত জুলুল্যান্ডের মানুষ অবাক হয়ে দেখবে–হ্যাঁ, একটা পুরুষের মতো পুরুষ বটে জামানি।

জামানি প্রথমে আত্তিলিও কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারেনি, পরে যখন বুঝল, তখন তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তবে জুলু জাতির আদর্শ পুরুষের মতো পুরুষ হলে তো মাম্বোয়াদের কায়নাকে ভয় করা চলে না, তাই বুক ঠুকে শপথ করে জামানি বলল, কায়না অভিযানে সে মাসাংগাকে সাহায্য করবে। মাম্বোয়াদের কথাবার্তা সে শুনতে চেষ্টা করবে এবং কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য শ্রুতিগোচর হলে সেই সংবাদ সে আত্তিলিওকে জানাবে।

আত্তিলিও অবশ্য ভালোভাবেই জানতেন, কোনো গোপন রহস্যের সন্ধান পেলেও জামানি চট করে তাঁকে সংবাদ দেবে না। কিন্তু তার জুলু অনুচরটি তাদের সবাইকে ভালোবাসত, কাজেই নানারকম ছলছুতোয় সে যে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে, সেই ভরসা তিনি রাখতেন। বিশেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, জুলুল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে সে হয়তো কিছুটা দুঃসাহস প্রকাশ করতে পারে। আর একটা ছোটোখাটো বিষয়কেও বোধ হয় জামানি উপেক্ষা করবে না–অপেরা হ্যাট টুপিটার প্রলোভন খুব তুচ্ছ নয় তার কাছে।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ – ভয়াবহ পর্বত

১৯২৮ সালের ২৯ নভেম্বর সকাল বেলা আত্তিলিও ঘোষণা করলেন নিহত পাইথনের গুহাটাকে তিনি আর একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।

পূর্বোক্ত গুহার সামনে এসে বিল ও প্রফেসর দুটো ভিন্ন পথ অনুসরণ করলেন। অজানা পথে হয়তো তারা বিপদে পড়তে পারেন, তাই অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে তার দলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ লোকগুলোকে নিয়ে মাম্বোয়া-সর্দার তাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হল।

আত্তিলিও বর্তমানে পাইথনের গুহার খুব কাছাকাছি থাকতেন, অতএব তাকে সাহায্য করার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি মাম্বোয়া-সর্দার। তবু সাবধানের মার নেই, তাই সর্দারের আদেশে ছয়জন মাম্বোয়া আত্তিলিওর সঙ্গে থেকে গেল। ওই লোকগুলো ছিল দুর্বল ও ব্যক্তিত্বহীন। নিতান্ত নিয়মরক্ষার জন্যই তারা আত্তিলিওর সঙ্গে ছিল। এক নজরে লোকগুলোর চেহারা জরিপ করে আত্তিলিও বুঝে নিলেন নিষিদ্ধ এলাকায় জোর করে প্রবেশ করতে চাইলে এরা তাঁকে বাধা দিতে পারবে না।

হঠাৎ জামানি বলে উঠল, ওই যে মাসাংগা! তুমি একটা বুনো শুয়োর চাইছিলে না? ওই দেখো, একটা শুয়োরের পায়ের ছাপ।

কোনোদিনই শুয়োর মারতে চাননি আত্তিলিও সাহেব, বিশেষ করে সেই মুহূর্তে আফ্রিকার বৃহত্তম বন্য শূকরও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু তিনি জামানির অব্যক্ত ইশারা বুঝতে পারলেন। জমির উপর সত্যি সত্যিই ওয়ার্ট হগ নামক বন্য শূকরের টাটকা পায়ের ছাপ ছিল। পদচিহ্নগুলো এগিয়ে গেছে নিষিদ্ধ এলাকাটার দিকে। মাম্বোয়ারা পায়ের ছাপগুলো দেখেছিল, তারা সন্ত্রস্তভাবে পরস্পরের সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। আত্তিলিও সেদিকে দেখেও দেখলেন না। এমন উৎসাহের সঙ্গে তিনি মাম্বোয়াদের ঠেলতে ঠেলতে শূকরের পায়ের ছাপগুলোর দিকে এগিয়ে চললেন যে, তারা কোনো ছুতো ধরে আপত্তি করারও সময় পেল না। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে তাঁদের চোখে পড়ল একটা পাহাড়। ভীষণ-দর্শন, প্রস্তরবহুল ওই পাহাড়টা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র মাম্বোয়ারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী হল? শিকার কোথায়?–আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন।

ওই যে। অনেক দূরে একটা কম্পিত ঘাসঝোঁপের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল একজন মাম্বোয়া।

এগিয়ে চলো। জামানি হুকুম দিল।

কিন্তু কেউ আর এক পা নড়ল না।

চলে এসো আমার সঙ্গে, ধমকে উঠলেন আত্তিলিও, তোমরা কি পুরুষমানুষ, না আর। কিছু?

পুরুষমানুষরা এবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে সামনে এগিয়ে গেল। আবার থামল। যে-লোকটি আত্তিলিওর দুই নম্বর বাড়তি বন্দুকটা বহন করছিল, সে অস্পষ্ট জড়িতস্বরে কী যেন বলল। বলার সঙ্গেসঙ্গে সে হাতের বন্দুক মাটিতে নামিয়ে রাখল। তৎক্ষণাৎ তার পাশে যে লোকটি দড়ির বান্ডিল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে দড়িটাকে মাটিতে ফেলে দিল। তৃতীয় ব্যক্তি খাদ্য ও বিভিন্ন সরঞ্জামপূর্ণ থলিটাকে ফেলে ভারমুক্ত হল। পরক্ষণেই তারা একসঙ্গে ছুটতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আত্তিলিওর দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হল ছয়টি ধাবমান মনুষ্য-মূর্তি।

আত্তিলিও এইবার পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। পাশে ভয়ার্ত জামানি। অদূরে পাহাড়–পাথরে পাথরে রুক্ষ, শ্রীহীন, অনুর্বর। চারিদিক চুপচাপ শান্ত। কোথাও জীবনের সাড়া নেই, একটি পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। এই নীরবতা অস্বস্তিকর। মানুষের মন এমন জায়গায় আনন্দ পায় না! আফ্রিকার পরিবেশ এখানে প্রস্তরসজ্জায় রুক্ষ, স্তব্ধতায় ভয়ংকর।

জামানি মাম্বোয়াদের ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো মাটি থেকে তুলে নিল। দারুণ আতঙ্কে তার দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হচ্ছিল।

চলে এসো পাহাড়ের উপর,–ধমকে উঠলেন আত্তিলিও, তুমি না জুলু-যোদ্ধা?

মনে হল জামানি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু আত্তিলিও তার গর্বে ঘা দিয়েছেন–একটিও কথা না-বলে সে সোজা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

পাহাড়ের তলায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো পাথর ছিল। পাথরগুলোর ভিতর থেকে একটা সংকীর্ণ গিরিপথের সন্ধান পাওয়া গেল। ওই পথ বেয়ে উপরে উঠে আত্তিলিও দেখলেন, তাঁরা দুজন যেখানে এসে পৌঁছেছেন, সেটা হচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার উপর অবস্থিত একটা প্রশান্ত প্রশস্ত সমতল জায়গা।

সমতল জায়গাটার একপাশে দুটো মস্ত পাথর আত্তিলিওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করল। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

পাথর দুটোর মাঝখানে দেখা গেল একটা গর্ত। গর্তটা প্রায় গোলাকার, চওড়ায় সেটা বারো ফুটেরও বেশি।

কায়না?…

কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু আত্তিলিওর দৃঢ় ধারণা হল, গর্তটাই কায়না। নিজের চোখকে তিনি প্রায় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না–মাসের পর মাস যার জন্য কষ্ট সহ্য করেছেন অভিযাত্রীরা, নিদারুণ বিপদের মুখে প্রাণ বিপন্ন করেছেন বারংবার সেই মৃত্যুগহ্বর আজ আত্তিলিওর পায়ের তলায়।

একবার উঁকি দিয়ে গর্তের ভিতর দৃষ্টিকে চালনা করলেন আত্তিলিও। কিন্তু দেখা গেল না। দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে ধাক্কা মারল। আত্তিলিও সেই গন্ধটা সহ্য করতে পারলেন না, পিছিয়ে এলেন।

গহ্বরের নিবিড় অন্ধকারের ভিতর কিছুই চোখে পড়ছে না। কিন্তু গর্তটা কি খুব গভীর? পাথরটা এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে অনেকগুলো শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করল, কিন্তু একেবারে তলা থেকে পাথরটার পতনজনিত শব্দ শুনতে পেলেন না তিনি। এবার একটা বড়ো পাথর তিনি ছুঁড়ে দিলেন। একটা অস্পষ্ট শব্দ গর্তের তলা থেকে ভেসে এল। আত্তিলিও বুঝলেন পাথরটা নীচে পৌঁছোল।

জামানি, আত্তিলিও বললেন, এইবার তুমি নিশ্চয়ই টুপিটা পাবে।

নিতান্ত কর্তব্যবোধেই জামানি ধন্যবাদ দিল। তার চোখে-মুখে উৎসাহ বা আনন্দের কোনো চিহ্ন আত্তিলিও দেখতে পেলেন না।

জামানির দোষ নেই। স্বয়ং আত্তিলিও সাহেবই কি খুব উৎসাহ বোধ করছিলেন? ওই অন্ধকার গহ্বরের ভিতর কোনো অজ্ঞাত বিভীষিকা লুকিয়ে আছে কি না কে জানে! এটাই যে কায়না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে একটা রহস্যময় গহ্বরের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

সাফল্যের মুখে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন আত্তিলিও। বর্তমানে তার অবস্থাটা হল, যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই মুহূর্তে তার কর্তব্য কী হতে পারে সেটাই তিনি বুঝতে পারছিলেন না। একবার ভাবলেন শূন্যে রাইফেলের আওয়াজ করে প্রফেসর আর বিলকে ডাকলে হয়? তারপর মনে হল, ওরা এখন কোথায় আছে কে জানে! যদি অনেক দূরে থাকে, তাহলে তো গুলির শব্দ শুনতে পেলেও আত্তিলিও যে তাদের ডাকছেন এই কথাটা বুঝতে পারবে কি? গুলি তো কত কারণেই চালানো হয়। তারপর মাম্বোয়া-সর্দার? সেও তো এক সমস্যা। বিল আর প্রফেসরের সঙ্গে মাম্বোয়া-সর্দারও তো তার দলবল নিয়ে আসবে। তারা যে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে বিদেশিদের মৃত্যুগহ্বরের ভিতর ঢুকতে দেবে, এমন তো মনে হয় না!

অবশ্য এত সব ভাবনাচিন্তা না-করে আত্তিলিও তাবুতে ফিরে গিয়ে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন এবং পরের দিন তাদের নিয়ে এখানে চলে আসতে পারতেন অনায়াসে। এই সহজ উপায়টা যে তাঁর মাথায় আসেনি, তা নয়। কিন্তু উপায়টা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি সেটাকে নাকচ করেছেন। কী বলবেন তিনি বন্ধুদের কাছে? মৃত্যুগহ্বর আবিষ্কার করেও তার ভিতর তিনি একা প্রবেশ করতে সাহস পাননি? বন্ধুদের সাহায্য গ্রহণ করা জন্য ফিরে এসেছেন? এমন কথা বলতে পারবে না মহাযুদ্ধের প্রাক্তন সৈনিক কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি।

অতএব আত্তিলিও ঠিক করলেন, ওই গহ্বরের ভিতর ঢুকে আজই তিনি ভিতরটা দেখবেন। দড়িটাকে তিনি হস্তগত করলেন, তারপর গর্তের মুখে অবস্থিত প্রকাণ্ড পাথর দুটোর মধ্যে একটার সঙ্গে দড়িটা বাঁধলেন। দড়ির একপ্রান্ত পাথরের সঙ্গে বাঁধা হল, অপর প্রান্তটা তিনি বাঁধলেন নিজের কোমরের সঙ্গে। যে-থলিটার মধ্যে খাবারদাবার এবং নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছিল, সেটার ভিতর থেকে সব কিছু তিনি বের করে ফেললেন। তারপর সেই থলিটা বুকে ঝুলিয়ে তিনি প্রস্তুত হলেন মৃত্যুগহ্বরের ভিতর অবতরণ করার জন্য। থলিটা অবশ্য একেবারে শূন্যগর্ভ ছিল না, দুটি নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুকে থলির মধ্যে ভরেছিলেন আত্তিলিও টর্চ এবং পিস্তল।

জামানিকে ডেকে আত্তিলিও বললেন, সে যেন কোনো কারণেই স্থানত্যাগ না করে। তারপর তিনি তাকে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে দড়ি ধরে তাকে ধীরে ধীরে গর্তের ভিতর নামাতে হবে। জামানির ওষ্ঠাধর নড়ে উঠল। কিন্তু শব্দ শোনা গেল না। সম্মতিসূচক ইয়েস, মাসাংগা কথাটা তার ঠোঁটের ভিতরেই জমে গেল, উচ্চারিত হল না। দারুণ আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল জামানি, তবু সে নির্দেশ-অনুযায়ী দড়িটা ধরল। সাবধানে আস্তে আস্তে, তাকে দড়ি ছাড়তে বললেন আত্তিলিও। লাটাই থেকে যেভাবে সুতো ছেড়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়, ঠিক সেইভাবেই জামানিকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঘুড়ি ওঠে উপরদিকে, এখানে আত্তিলিও নামছেন নীচের দিকে এবং সুতোর স্থান নিয়েছে জামানির হাতের দড়ি আর লাটায়ের স্থান গ্রহণ করেছে একটা মস্ত পাথর।

খুব সন্তর্পণে আত্তিলিও নামতে শুরু করলেন। গর্তের মুখে পা রাখতে-না-রাখতেই কয়েকটা পাথর তার পায়ের ধাক্কায় গর্তের মধ্যে ছিটকে পড়ল সশব্দে। সেই শব্দে সাড়া দিয়েই যেন অন্ধকার গহ্বরের ভিতর থেকে কী-একটা বস্তু ছুটে এল। আর পরক্ষণেই

পরক্ষণেই আত্তিলিওর মুখের উপর পড়ল এক প্রচণ্ড থাপ্পড়! সঙ্গেসঙ্গে কানের পর্দা ফাটিয়ে এক তীব্র চিৎকার!

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ – মৃত্যু-বিভীষিকা

মুখের উপর সজোরে চপেটাঘাত পড়তেই আত্তিলিও চোখ বন্ধ করে ফেললেন এবং তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলেন দড়িবাঁধা পাথরটাকে।

একটা মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন তিনি, তারপর সম্মুখে দৃষ্টিপাত করে তিনি দেখলেন, আক্রমণকারী জীবটি হচ্ছে মস্ত বড়ো একটা নিশাচর পাখি! অন্ধকারে গহ্বরের ভিতর থেকে উড়ে আসার সময়ে তার মুখের উপর পাখিটার ডানার ঝাঁপটা লেগেছিল। অন্ধকারে অভ্যস্ত নিশাচর দিনের আলোর মধ্যে এসে প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েছিল, গহ্বরের কাছেই একটা শুকনো গাছের ডালপালার মধ্যে চুপ করে বসে ছিল পাখিটা।

এই ঘটনাটা অবশ্য আত্তিলিওর পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল। পাখিটা তাকে ভবিষ্যতের ভয়াবহ সম্ভাবনা সম্পর্কে সাবধান করে দিল–জামানির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে তার অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হতে পারে, এই ঘটনায় তার প্রমাণ পেলেন আত্তিলিও।

জামানির দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, সে দড়ি ছেড়ে মাটির উপর শুয়ে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে পাথরটা না-ধরলে তার দেহটা ছিটকে পড়ত গহ্বরের ভিতর এবং তলদেশে পতিত হয়ে অথবা পাথরের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে তার অবস্থা যে হত নিতান্ত শোচনীয়, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আত্তিলিও ঠিক করলেন, গর্তের ভিতর নামার সময়ে তিনি আর জামানির উপর নির্ভর করে নিজের জীবনকে বিপন্ন করবেন না। জামানিকে ভূমিশয্যা ত্যাগ করতে বললেন তিনি। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে মাথা তুলল জামানি, তারপর বিস্ফারিত দুই চক্ষুর ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চারদিক নিরীক্ষণ করতে লাগল।

ভূ-ভভূত! সহসা আর্তনাদ করে উঠল জামানি, তার ভীত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে পূর্বোক্ত নিশাচর পক্ষীর উপর!

ভূতের নিকুচি করেছে! বলে আত্তিলিও একটা পাথর ছুঁড়ে মারলেন। মস্ত বড়ো পাখিটা ডানা ঝটপট করে শূন্যে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কী? দেখেছ?

আত্তিলিও জামানির মুখের দিকে তাকালেন। জামানি মাথা নেড়ে জানাল, দেখেছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি দেখেই আত্তিলিও বুঝলেন, উড়ন্ত জীবটির পক্ষিত্ব সম্বন্ধে জামানির সন্দেহ দূর হয়নি। খুব সম্ভব সে ভাবছিল, ওটা পাখি না হয়ে একটা ছদ্মবেশী প্রেতাত্মাও হতে পারে!

আত্তিলিও আর জামানির সঙ্গে কথা বললেন না, নেমে পড়লেন গহ্বরের ভিতর। এইবার অবশ্য তিনি দড়িটাকে জামানির হাতে সমর্পণ করেননি; খুব সাবধানে ঝুলতে ঝুলতে তিনি নামতে শুরু করলেন দড়ি ধরে। যে-পাথরটার সঙ্গে আত্তিলিওর দেহসংলগ্ন দড়িটা বাঁধা ছিল, সেই পাথরটা ছিল খুবই গুরভার, অতএব তার দেহের ভারে পাথরটা স্থানচ্যুত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।

আত্তিলিও নামছেন, নামছেন আর নামছেন…উপর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ আলোর আভাসও ক্রমে লুপ্ত হয়ে গেল; তার মাথার উপর, পায়ের নীচে, সামনে পেছনে চতুর্দিকে বিরাজ করছে। এখন সীমাহীন অন্ধকার, অন্ধকার আর অন্ধকার…

গুহার প্রস্তর-প্রাচীর থেকে বেরিয়ে আসা একটা পাথরে আত্তিলিওর পা ঠেকল। পাথরটা খুব ধারালো, কিন্তু সেটার উপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে নির্ভর করা যায়। আত্তিলিও কিছুক্ষণ সেই পাথরটার উপর পা রেখে বিশ্রাম করলেন, তারপর আবার দড়ি ধরে অবতরণ-পর্ব…

কয়েকটা আলগা পাথর আত্তিলিওর দেহের ধাক্কা খেয়ে সশব্দে ছিটকে পড়ল, কয়েকটা নিশাচর পক্ষী ডানা মেলে উড়ে গেল, তাদের ডানার শব্দ ভেসে এল আত্তিলিওর কানে।

গহ্বরের প্রস্তর-প্রাচীর থেকে বেরিয়ে-আসা পাথরগুলো পা দিয়ে অনুভব করছিলেন আত্তিলিও এবং মাঝে মাঝে ওই পাথরগুলোর উপর পা রেখে তিনি ক্লান্ত বাহু দুটিকে বিশ্রাম দিচ্ছিলেন। পর পর চারটে পাথরের উপর বিশ্রাম নিয়ে পঞ্চম পাথরটির উপর অবতীর্ণ হলেন আত্তিলিও। একহাতে দড়ি আঁকড়ে অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরে তিনি গুহার তলদেশ আবিষ্কার করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গর্তের চারপাশের দেয়াল থেকে ছোটো-বড়ো অসংখ্য পাথর বেরিয়ে এসে দেয়ালটাকে এমন অসমান করে তুলেছে যে, টর্চের আলো সেই প্রস্তরের বেষ্টনী ভেদ করে গুহার তলায় পৌঁছাতে পারল না। আত্তিলিও সবিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন : পঁচাত্তর ফিট দীর্ঘ রজুর দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেছে, উপর থেকে তাঁর কণ্ঠস্বরে সাড়া দিয়ে জামানির উত্তরের রেশ অস্পষ্ট হয়ে দুজনের মধ্যে এক ভয়াবহ দূরত্বের আভাস দিচ্ছে, কিন্তু গহ্বরের তলায় পা দেওয়া তো দূরের কথা, তলদেশ এখনও রয়েছে তার দৃষ্টিসীমার বাইরে! গর্তটা নিশ্চয়ই অতল অসীম নয়, কিন্তু এই ভূতুড়ে গহ্বরের গভীরতা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে? কোথায় কত দূরে গেলে পাওয়া যাবে নীচের মাটি?

হঠাৎ আত্তিলিওর পায়ের তলায় পাথরটা নড়ে উঠল। চমকে উঠে তিনি দড়িটা চেপে ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না–পাথরটা তার দেহের ভারে স্থানচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ল; সঙ্গেসঙ্গে আত্তিলিও সাহেবও ছিটকে পড়লেন সীমাহারা শূন্যতার মাঝে!

তাঁর দেহটা দেয়াল থেকে দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে নীচের দিকে পড়তে লাগল, গুহার পাত্র-সংলগ্ন ধারালো পাথরগুলো ধারালো ছুরির মতোই নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে দংশন করতে লাগল বারংবার, হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আত্তিলিওর দেহটা স্থির হয়ে গেল। পঁচাত্তর ফিট লম্বা দড়ির দৈর্ঘ্য শেষ হয়ে গেছে। রজ্জবদ্ধ অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে লাগলেন আত্তিলিও, তাঁর মনে হল, কোমরে-দড়ি বাঁধা তাকে দু-টুকরো করে ভেঙে ফেলতে চাইছে।

আত্তিলিও সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে একটা আঠার মতো ঘন চটচটে বস্তুর উষ্ণ অস্তিত্ব অনুভব করলেন : রক্ত। ধারালো পাথরগুলো খোঁচা মেরে তাঁর পতনোন্মুখ শরীরটাকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। কিন্তু রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর চাইতে তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে দড়িটা। কোমরের উপর, পাঁজরের দু-পাশে শক্ত দড়ি যেন কেটে কেটে বসছে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় আত্তিলিওর শরীরটা এখনও আস্ত আছে, ভগ্নাংশে পরিণত হয়নি। বুকের সঙ্গে বাঁধা থলির ভিতর থেকে টর্চটা বার করে আত্তিলিও সেটাকে জ্বেলে ফেললেন এবং চারদিকে দৃষ্টি চালনা করে অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। গুহাটা মোটামুটি বৃত্তাকার। তার আনুমানিক ব্যাস প্রায় চল্লিশ ফিট। গুহার ছাদ এবং ভূমির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় শূন্যে দোল খাচ্ছেন আত্তিলিও; পূর্বোক্ত দুটি স্থানের দূরত্ব তার দেহের থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট হবে। গুহার নীচে মাটি প্রায় দেখা যাচ্ছে না, অগণিত নরকঙ্কাল ও অস্থিময় নরমুণ্ডের আবরণে গুহার তলদেশের মৃত্তিকা প্রায় অদৃশ্য। অস্থিপঞ্জরগুলো কোথাও ধবধবে সাদা, কোথাও-বা সময়ের স্পর্শে হলুদ হয়ে এসেছে।

ঝুলতে ঝুলতে আর দুলতে দুলতে আত্তিলিও টর্চের আলোটাকে গুহা-গহ্বরের কিনারাতে ফেললেন।

গুহার দেয়াল যেখানে নেমে এসে গুহাভূমিকে স্পর্শ করেছে, সেইখানেই মেঝের উপর এক জায়গায় আত্তিলিওর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল; হাড়ের স্তূপের মধ্যে কিছু যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।

সচল বস্তুগুলোর স্বরূপ নির্ণয় করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওই জায়গাটা তিনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।

অকস্মাৎ দারুণ আতঙ্কে তার শরীরের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল। স্তূপীকৃত অস্থিপঞ্জর আর কঙ্কাল-করোটির মধ্যে বিচরণ করছে কয়েকটা কেউটে সাপ! আত্তিলিও গুনে দেখলেন, সেখানে অবস্থান করছে সাত-সাতটি বিষধর সরীসৃপ।

টর্চের আলোতে বিরক্ত হয়ে কেউটেগুলো অনধিকার প্রবেশকারীকে সন্ধান করছে। তাদের দীর্ঘ মসৃণ দেহ কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। আবার খুলে খুলে যাচ্ছে।

সাপগুলো বুঝতে পারল, তাদের বিরক্তির কারণটি কোথায় অবস্থান করছে। শত্রুর নাগাল না-পেয়ে হিংস্র আক্রোশে ফণা তুলে তারা দুলতে লাগল একবার পেলে হয়।

অনেকের ধারণা, কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মাটিতেই কেউটে সাপের বাস দেখা যায়। ওই ধারণ ভুল। কেউটে পরিবারের অন্তর্গত অন্তত চারটি বিভিন্ন জাতের সাপ আফ্রিকাতে বাস করে। উপযুক্ত ভয়াবহ তথ্য আত্তিলিও সাহেবের অজ্ঞাত ছিল না; তিনি এ-কথাও জানতেন যে, দেহের যেকোনো স্থানে কেউটের ছোবল পড়লে তাকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকের যাত্রী হতে হবে।

আত্মরক্ষার জন্য তিনি যা করলেন, তা পরবর্তীকালে তার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। বাঁ-হাতের টর্চ ঘুরিয়ে তিনি সাপগুলোর উপর আলো ফেললেন এবং ডান হাতের পিস্তল থেকে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলেন। পরপর ছয়বার অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠল পিস্তল, প্রত্যেকটি গুলি অভ্রান্ত লক্ষ্যে ছয়টি সরীসৃপের দেহ বিদ্ধ করল–একটিও গুলি ব্যর্থ হল না।

সাত নম্বর কেউটের দিকে ফাঁকা পিস্তলটা ছুঁড়ে মারলেন আত্তিলিও, সাপটা চট করে গুহার গায়ে একটা ফাটলের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হল।

দড়িটা আত্তিলিওর কোমরে কেটে বসছিল, সেই যন্ত্রণা আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। যা থাকে বরাতে মনে করে শরীরটাকে রজ্জ্বর বন্ধন থেকে মুক্ত করে তিনি লাফিয়ে পড়লেন গুহার মেঝের উপর। সাপগুলো তখনও মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছিল, আত্তিলিও জুতো-পরা পায়ের লাথি চালিয়ে সেগুলোকে নিরাপদ ব্যবধানে পাঠিয়ে দিলেন। তারপরই একটা অস্থিময় নরমুণ্ডের উপর হোঁচট খেয়ে তিনি পড়ে গেলেন!…

কতক্ষণ মূৰ্জিত হয়ে পড়েছিলেন সে-কথা আত্তিলিও নিজেও বলতে পারবেন না। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে আহত ও রক্তাক্ত শরীরের পরিচর্যায় মনোনিবেশ করলেন। উপর থেকে ছিটকে পড়ার সময়ে পাথরের খোঁচা লেগে যেসব জায়গা কেটেকুটে গিয়েছিল, সেই ক্ষতস্থানগুলোর উপর তিনি ব্যান্ডেজ বেঁধে ফেললেন। অবশ্য সেইজন্য তাঁকে পরনের শার্টটা ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল। গহ্বরের গায়ে যে-ফোকরটার ভিতর দিয়ে সাত নম্বর সাপটা অন্তর্ধান করেছিল, সেই ফুটোটার কাছে গিয়ে আত্তিলিও লক্ষ করলেন বাইরের বাতাস পূর্বোক্ত গর্তটার ভিতর দিয়ে সশব্দে গুহার ভিতর প্রবেশ করছে। আত্তিলিও এইবার বুঝলেন, আশি ফিট গভীর এই গহ্বরের ভিতর সাপগুলো কোন পথে এসেছে। স্তূপীকৃত অস্থিপঞ্জরের ভিতর থেকে একটা হাড় নিয়ে তিনি চটপট ওই ফোকরটার মুখ বন্ধ করে দিলেন।

এতক্ষণে আত্তিলিও সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তার দেহে রক্ত চলাচল করছে স্বাভাবিকভাবে। এই ভয়ানক গহ্বরটা যে কায়না, এ-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই তার।

মাম্বোয়া-সর্দারদের আদেশে এই সুগভীর গহ্বরের মধ্যে অপরাধীদের নিক্ষেপ করা হত। অপরাধের গুরুত্ব সবসময় খুব বিবেচ্য নয়, মাম্বোয়া-সর্দার বা মাতব্বরদের অপ্রীতিভাজন হলেই উক্ত ব্যক্তিকে বিসর্জন দেওয়া হত কায়নার গর্ভে। মাম্বোয়ারা এই রীতি পছন্দ করত না, কিন্তু তারা জানত কেউ যদি শ্বেতাঙ্গদের কাছে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধান দেয়, তবে মাম্বোয়া-সর্দারদের আদেশে সেই ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য। সেইজন্যই তারা মুখ খুলত না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু যখন কাছে এগিয়ে এসেছে তখনই তারা মুখ খুলতে চেয়েছে। আত্তিলিওর মনে পড়ল নিগ্রো পুলিশম্যান ও স্থানীয় বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটির কথা। মরার আগে তারা মৃত্যুগহ্বরের রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল, কারণ তারা বুঝেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মাম্বোয়া-সর্দারদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরার করার আগেই মৃত্যুর স্পর্শে তাদের জিহ্বা হয়ে যায় স্তব্ধ। ওইসব ঘটনাগুলো বার বার আত্তিলিওর মনে পড়তে লাগল।

মৃত্যুগহ্বরের ভিতর যেসব মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, তাদের কথা মনে হতেই শিউরে উঠলেন আত্তিলিও। অনাহারে আর তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযাতনা ভোগ করেছে। ওইসব হতভাগ্যের দল, তিল তিল করে শুকিয়ে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে মৃত্যুর দিকে। সেইজন্যই এই গুহার নাম দেওয়া হয়েছে কায়না অর্থাৎ যাতনাদায়ক মৃত্যগহ্বর।

নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য যুগ যুগ ধরে মাম্বোয়া-সর্দাররা এই প্রথা বাঁচিয়ে রেখে জনসাধারণের উপর নিষ্ঠুর সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। মাম্বোয়া জাতির মাতব্বরদের এই নৃশংসতায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই–পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় সর্বদেশে সর্বক্ষেত্রে এই ধরনের একদল লোক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত কায়েমি স্বার্থকে বজায় রাখার জন্য।

আত্তিলিও হঠাৎ চমকে উঠলেন : এসব তিনি কী ভাবছেন? মানুষের দুঃখকষ্টের কথা না-ভেবে তার নিজের কথাই এখন চিন্তা করা উচিত। মাম্বোয়াদের মধ্যে প্রচলিত একটা ভয়ানক প্রবাদবাক্য তাঁর মনে পড়ল–এখানে যে প্রবেশ করে, তার উদ্ধারের আশা নেই!

আত্তিলিওর মনে হল, মূখের মতো অন্য মানুষের দুঃখের কথা ভেবে তিনি মূল্যবান সময়ের অপচয় করছেন। যদি এই গহ্বরের বাইরে তিনি না যেতে পারেন, তবে তার দেহের কঙ্কালটিও একদিন এই গুহার অস্থিস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকবে। আত্তিলিও এইবার মৃত্যুগহ্বরের গর্ভ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

দড়িটা উপরে ঝুলছিল। আত্তিলিও সেটাকে লক্ষ করে লাফ মারলেন। বৃথা চেষ্টা, লাফিয়ে ওই দড়িটাকে করায়ত্ত করা সম্ভব নয়। তিনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেন, প্রতিধ্বনি তাঁকে বিদ্রূপ করল, উপর থেকে জার্মানির কণ্ঠস্বরে কোনো উত্তর এসে পৌঁছাল না তার কাছে।

আত্তিলিও এইবার অন্য উপায় অবলম্বন করলেন। অনেকগুলো পাথর আর নরকঙ্কাল টেনে জড়ো করলেন দড়িটার নীচে, তারপর ওই পাথর আর হাড়ের স্তূপের উপর আরোহণ করে এক সময়ে দড়িটাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হলেন।

কিন্তু এখনও ঝামেলা অনেক–দড়ির শেষ প্রান্তে যে গিট আছে সেটাকে না-খুললে চলবে না। ইতিমধ্যে টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে এসেছে, আলোটা কাঁপতে শুরু করল। আত্তিলিওর সমস্ত শরীর তখন অবসাদে ভেঙে পড়তে চাইছে, কেবল দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি তাকে দু-পায়ের উপর খাড়া করে রেখেছিল! কম্পিত হস্তে দড়ির গিটটা একসময়ে খুলে ফেললেন আত্তিলিও। পিস্তল আর টর্চ ব্যবহারের যোগ্য ছিল না, তাই সে দুটির পরিবর্তে কয়েকটা হাড়ের টুকরো আত্তিলিও তাঁর হাতের থলির মধ্যে ভরে নিলেন। শ্রান্ত দেহে অনেকটা দূরত্ব তাকে দড়ি ধরে অতিক্রম করতে হবে, ওই অবস্থায় হাড়গোড় দিয়ে ওজন বাড়িয়ে নিজেকে ভারগ্রস্ত করলে বিপদের সম্ভাবনা আছে বুঝেও মৃত্যুগহ্বর থেকে কিছু নিয়ে যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেননি আত্তিলিও। জীবনের আশা তিনি ত্যাগ করেছিলেন, তবু যদি জীবিত অবস্থায় কায়নার বাইরে পদার্পণ করতে পারেন, তবে ওই হাড়গুলো বিল আর প্রফেসরের সামনে প্রমাণস্বরূপ দাখিল করতে পারবেন ভেবেই আত্তিলিও বাড়তি ওজনের ঝাট বহন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

হাত আর পায়ের সাহায্যে যেভাবে মানুষ সাধারণত দড়ি বেয়ে উপরে উঠে, সেইভাবে চেষ্টা করলে খুব সম্ভব আত্তিলিও ব্যর্থ হতেন। শ্রান্ত-ক্লান্ত বাহু ও পায়ের মাংসপেশি সুদীর্ঘ রজ্জুপথে বেশিক্ষণ তার দেহভার বহন করতে পারত কি না সন্দেহ। তাই আত্তিলিও একটা কৌশল অবলম্বন করলেন। দড়িটাকে তিনি দক্ষিণ উরুর তলা দিয়ে চালিয়ে দিলেন, তারপর যে-অংশটা তিনি অতিক্রম করছিলেন, দড়ির সেই অংশটুকু ডান দিকের ঊরুর তলা দিয়ে ঘুরিয়ে দক্ষিণ বাহুর ঊর্ধাংশের উপর ফেলে দিচ্ছিলেন। এইভাবে যে দড়ির বেষ্টনী তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ডান পা ঝুলিয়ে রেখে বাঁ-পা দিয়ে গুহার দেয়ালে বেরিয়ে-আসা পাথরের মাঝে মাঝে ধাক্কা মেরে উপরে উঠেছিলেন আত্তিলিও। দোদুল্যমান রঞ্জুর দুটি অংশ পরস্পরের সঙ্গে এবং আত্তিলিওর দুই পায়ের মাঝখানে ঘর্ষিত হয়ে শূন্য পথে ভাসমান দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছিল; ফলে ক্লান্ত শরীরটা অল্প আয়াসেই ঝুলিয়ে রেখে মাঝে মাঝে দম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন তিনি।….

তবু মাঝে মাঝে ক্লান্ত মুঠির বাঁধন খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, মাঝে মাঝেই দড়ির উপর শিথিল হয়ে এসেছে হাতের আঙুলগুলো, কিন্তু কিছুতেই হাত ছাড়েননি আত্তিলিও, শক্ত করে বার বার আঁকড়ে ধরেছেন দড়িটাকে…

গহ্বরের উপরদিকে তিনি যত উঠছিলেন, নিরেট অন্ধকার ততই হালকা হয়ে গহ্বরের বহির্দেশে উজ্জ্বল সূর্যালোকের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল। সেই আলোর আভাসই প্রেরণা দিয়েছে, শিথিল আঙুলের বাঁধন খুলে যেতে আবার দড়িটাকে চেপে ধরেছেন দৃঢ় মুষ্টিতে।

আত্তিলিও উপরে উঠতে লাগলেন অতি কষ্টে, ধীরে ধীরে, অতি সন্তর্পণে…

অবশেষে এক সময় তিনি গহ্বরের মুখে এসে পৌঁছালেন। মাথাটা গর্তের বাইরে ঠেলে দিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলেন : ভগবানকে ধন্যবাদ, জামানি যথাস্থানেই অবস্থান করছে।

আত্তিলিওকে দেখামাত্রই জামানির দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, ওষ্ঠাধর হল বিভক্ত এবং সর্বশরীরে জাগল কম্পিত শিহরন!

সাহায্য করো, আত্তিলিও ভগ্নস্বরে বললেন, তাড়াতাড়ি করো!

জামানি অবরুদ্ধ কণ্ঠে আর্তনাদ করে, মাসাংগা! তোমার নিজের আত্মা!

আত্তিলিওর হাত ধরার চেষ্টা না-করে সে ধপাস করে মাটির উপর পড়ে গেল।

আত্তিলিও পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে গহ্বরের মুখে দড়ি বাঁধা পাথরটা চেপে ধরে পতন থেকে আত্মরক্ষা করলেন। তারপর শেষ শক্তি দিয়ে নিজের পতনোন্মুখ দেহটাকে টেনে আনলেন গহ্বরের বাইরে। শ্রান্ত ও অবসন্ন শরীরে অতি কষ্টে শ্বাস টানতে টানতে আত্তিলিও শুনলেন জামানির আর্তনাদ–মাসাংগা! তুমি মরে গেছ! আমি জানি, তুমি মরে গেছ! মরে তুমি ভূত হয়েছ। তবে কেন থলির মধ্যে তোমার মুণ্ডু আর হাড়গুলো নিয়ে এলে আমার কাছে! মাসাংগা! আমি তোমার বিশ্বস্ত অনুচর, আমার সঙ্গে তোমার এ কী ব্যবহার, মাসাংগা!

আত্তিলিও হাসে নি!

হেসে ওঠার ক্ষমতা তার তখন ছিল না।