দ্বৈরথ

দ্বৈরথ

বিলি প্যারট ছিল ইংলন্ডের মানুষ। কোনো কাজই তার বেশিদিন ভালো লাগত না, কিন্তু একটি বিষয়ে তার অনুরাগ ছিল অত্যন্ত প্রবল। সেটি হচ্ছে মল্লযুদ্ধ!

দেখতে ছোটোখাটো হলেও বিলি ছিল অসাধারণ শক্তির অধিকারী। তার পরিচিত ইংরেজ ও ভারতীয় সঙ্গীসাথির দল তার নামকরণ করেছিল লৌহমানব।

নামটা যে নিতান্ত মিথ্যার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়নি বর্তমান কাহিনির শেষ অংশেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

পেশায় সে ছিল কামার, কিন্তু বিলি প্যারট করেনি এমন কাজ ছিল না ভূভারতে!

প্রথমে সে নাবিক হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জলপথে ভ্রমণ করল। তারপর হঠাৎ একদিন নাবিকের কাজে ইস্তফা দিয়ে সে চাকুরি গ্রহণ করল কলকাতার টাকশালে। মাইনে হল প্রায় পঞ্চাশ টাকার মতো। আমি যখনকার কথা বলছি ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন হয়নি, তাই ইংলন্ডের মানুষ বিলি প্যারটের পক্ষে ব্রিটিশ-অধিকৃত ভারতে ট্যাকশালের কাজটা জোগাড় করতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিছুদিন পরে এই কাজটাও তার ভালো লাগল না। হেনরি নামক জনৈক ইংরেজ তার যন্ত্রপাতি বহন করার জন্য একটি উপযুক্ত লোকের সন্ধান করছিল–দৈবাৎ তার যোগাযোগ হয়ে গেল বিলির সঙ্গে। মাসিক এক-শো পঞ্চাশ টাকা বেতন এবং ভবিষ্যতে উন্নতিলাভের প্রলোভন দেখাতেই হেনরির কাছে চাকরি করতে সম্মত হল বিলি।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে দুজনেই এসে উপস্থিত হল পূর্ণিয়ার অন্তর্গত তিরহাট নামক স্থানে।

ওই সময় পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের অরণ্যময় অঞ্চলে শিকার করতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিকারি জেমস ইংলিস। বিলির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল অনেক আগেই। মল্লযুদ্ধে তার দক্ষতা ও অসাধারণ দৈহিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তিনি বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। মধ্যে কয়েক বৎসর তাঁর সঙ্গে বিলির দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। হঠাৎ সাহেবগঞ্জ মহকুমার এক ডাকবাংলোতে জেমস সাহেব যাকে দেখে চমকে উঠলেন সেই মানুষটি হল স্বয়ং বিলি প্যারট!

বিলির তখন দারুণ দুরবস্থা। ধারদেনায় তার মাথার চুল পর্যন্ত বিকিয়ে গেছে; খুব সম্ভব হেনরির চাকরিটাও সে ছেড়ে দিয়েছিল। ছোটোখাটো এই মানুষটিকে শিকারি জেমস খুবই ভালোবাসতেন। বিলির দুরবস্থা দেখে তাকে নিয়ে তিনি স্বস্থানে চলে এলেন। ওই সময়ে স্থানীয় পুলিশ-সুপারিনটেন্ডেন্ট ভালুক শিকারের জন্য জেমস সাহেবকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। জেমসের সঙ্গে ওই শিকার-অভিযানে সানন্দে অংশগ্রহণ করল বিলি প্যারট।

জেমস আর বিলি ছাড়া আর যেসব শিকারি পূর্বোক্ত শিকার-অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন, তারা হলেন কলকাতার দুই ব্যারিস্টার, পিলার নামক জেমসের এক বন্ধু এবং স্থানীয় জেলার এক বিচারক। দলের মধ্যে একমাত্র জেমস সাহেবকেই প্রকৃত অর্থে শিকারি বলা চলে, অন্য সকলে ছিলেন শখের শিকারি–নিতান্তই শখ চরিতার্থ করতে তারা শিকারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের নিকটবর্তী একটি অরণ্যে শিকারের আয়োজন করা হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে শিকারিদের জন্য গাছে গাছে মাচা বাঁধা হল, মাচাগুলির পরস্পরের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল প্রায় পঞ্চাশ ফিট। এক একজন শিকারির জন্য নির্দিষ্ট ছিল এক একটি মাচা, কোনো মাচাতেই একাধিক মানুষ স্থান গ্রহণ করেনি। মাচার সারির একপ্রান্তে ছিল বিলি এবং অপর প্রান্তে অবস্থিত শেষ দুটি মাচায় আশ্রয় নিয়েছিলেন যথাক্রমে জেমস ইংলিশ এবং তার বন্ধু পূর্বোক্ত পুলিশ অফিসার।

একটু পরে বিট আরম্ভ হল। বিটার অর্থাৎ বনতাড়ুয়ার দল বিকট শব্দে চেঁচাতে চেঁচাতে জানোয়ার তাড়াতে শুরু করল। প্রথমেই শিকারিদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল অসংখ্য পাখি–তারপর শেয়াল, খরগোশ প্রভৃতি ছোটো ছোটো অনেক জানোয়ার শিকারিদের চোখের সামনেই ছুটে পালাতে লাগল। ওইসব ছোটোখাটো জন্তুগুলিকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, শিকারিরা চাইছেন বড়ো শিকার। ওই জঙ্গলের ভিতর ছোটো ছোটো গুহার মধ্যে ভালুকের অস্তিত্ব আছে শুনেই শিকারিরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ভালুক যদি না দেখা দেয় তবে ভালুকের পরিবর্তে অন্য বড়ো জানোয়ার মারতেও তাদের আপত্তি ছিল না। শিকারিদের দুধের তৃষ্ণা ঘোল দিয়েই মেটাতে হল–দুটি হরিণ গুলি খেয়ে মারা পড়ল বটে, কিন্তু শিকারিদের সম্মুখে কোনো ভালুকই আত্মপ্রকাশ করতে রাজি হল না।

শিকারিদের নির্দেশ অনুযায়ী এইবার পশ্চিম দিক থেকে বিট আরম্ভ করার জন্য বনতাড়ুয়ার দল জঙ্গলের ভিতর ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পুব দিকের জঙ্গলে তাড়া দিয়ে কোনো ফল হয়নি, কিন্তু এবার ভিন্ন দিক থেকে জঙ্গল পিটিয়ে বিট শুরু করলে হয়তো দু-একটা ভালুকের দেখা মিলতেও পারে।

নিঃশব্দ অরণ্য। বনতাড়ুয়ারা তখনও বিট অর্থাৎ জঙ্গল ঠেঙিয়ে জানোয়ার তাড়াতে শুরু করেনি। শিকারিদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে তীব্র উত্তেজনা।

আতম্বিতে জেমস এবং তার পরবর্তী সঙ্গীর মধ্যস্থলে অবস্থিত একটা ঝোপের ভিতর জাগল এক শব্দের তরঙ্গ–মট মট করে শুকনো গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে কে যেন এগিয়ে আসছে।

শব্দ লক্ষ করে দুই শিকারিই রাইফেল তুলে ধরলেন, কিন্তু যে-জীবটি তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করল তাকে দেখে দুই বন্ধুই হয়ে গেলেন হতভম্ব!

বাঘ নয়, ভালুক নয় তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিলি প্যারট!

একগাল হেসে বিলি জেমস সাহেবকে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, সে অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত এবং যেহেতু তার জলের বোতলে একটুও জল নেই, তাই বাধ্য হয়েই সে এখানে এসেছে তৃষ্ণা নিবারণ করতে–কারণ তাদের কাছে যে জলের বোতল আছে সে-কথা তার অজানা নয়।

জেমসের কাছে জলের বোতল ছিল না, জল ছিল তার বন্ধুর কাছে। কিন্তু শুধু একটু জলের জন্য বিল বিট-এর সময় মাটিতে নেমে এতদূর হেঁটে এসেছে শুনে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। জেমসের বক্তব্য হচ্ছে, কিছুক্ষণ জলপান না-করলে একটা মানুষ মরে যায় না, কিন্তু বিট-এর সময় হঠাৎ ভালুক বেরিয়ে পড়লে যে বিলের জীবন বিপন্ন হতে পারে এ-কথা কি তার জানা নেই?

বিল বলল, সে জলের জন্য এসেছে, জলপান না-করে সে এখান থেকে এক পাও নড়তে রাজি নয়।

জেমস সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন বিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় এসেছে, মাচার ওপর থেকে তার রাইফেলটাও সে সঙ্গে আনার প্রয়োজন মনে করেনি।

জেমসের বন্ধু অন্য গাছ থেকে দুই বন্ধুর কথা কাটাকাটি শুনছিলেন, তাড়াতাড়ি আপদ-বিদায় করার জন্য তিনি মাচা থেকে একটা নীচু ডালে নেমে এসে বিলকে ডেকে তার হাতে জলের বোতলটা সমর্পণ করলেন।

বোতলটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়েই বিলি ঢক ঢক করে জলপান করতে শুরু করল। বিলিকে জলপান করতে দেখে জেমস সাহেবের মনে হল তার গলাটাও অসম্ভব শুকিয়ে এসেছে, একটু জল খেলে মন্দ হয় না। রাইফেল, ছোরা প্রভৃতি মাচার ওপর রেখে তিনি নীচে নেমে এলেন শুকনো গলাটাকে ভিজিয়ে নেবার জন্য।

ততক্ষণে বিলির তৃষ্ণা মিটে গেছে, সে পূর্বোক্ত শিকারির মাচার নীচে দাঁড়িয়ে জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়েছে এবং শিকারিও মাচার উপর শুয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোতলটা হস্তগত করার চেষ্টা করছেন। অকস্মাৎ বাঁ-দিকের একটা মাচার উপর থেকে ভেসে এল বিচারক মহোদয়ের উচ্চ কণ্ঠস্বর–সাবধান! ভালুক! ভালুক!

জেমস তৎক্ষণাৎ তার মাচা-বাঁধা গাছটার দিকে দৌড় মারলেন। যে শিকারিটি বিলির হাত থেকে জলের বোতল নেবার জন্য মাচার উপর শুয়ে পড়ে হাত বাড়িয়েছিলেন তিনি তড়াক করে উঠে বসে হাত বাড়ালেন রাইফেলের দিকে। বিল জলের বোতল ফেলে দিয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ করেছে!

পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই ঝোপজঙ্গল ভেদ করে সগর্জনে আত্মপ্রকাশ করল একটা মস্ত বড়ো ভল্লুকী।

জন্তুটার পিঠের উপর একটা বাচ্চা প্রাণপণে মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে জেমস আবিষ্কার করলেন, তার হাতের রিভলভারটা তিনি মাচার উপরে ফেলে এসেছেন। চটপট কোমর থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে তিনি ভল্লুকীকে লক্ষ করে গুলি চালালেন।

ভল্লুকী শিকারিদের আক্রমণ করত কি না বলা যায় না, হয়তো সে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু গুলিটা তার চোয়ালে লাগতেই জন্তুটা ভীষণ গর্জন করে বিলির দিকে তেড়ে এল।

যে-শিকারিটি বিলিকে জল দিয়েছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি মাচার উপর শুয়ে পড়ে বিলির উদ্দেশে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কোনোরকমে হাতটা ধরে ফেলতে পারলে বিলি নিশ্চয়ই গাছের উপর উঠে ভালুকের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারত, কিন্তু বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও খর্বকায় বিলের পক্ষে বন্ধুর হাতটাকে হস্তগত করা সম্ভব হল না। ভল্লুকী যখন প্রায় তার দেহের উপর এসে পড়েছে। তখন আর হাত ধরে গাছে ওঠার বৃথা চেষ্টা না-করে বিলি প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল।

বিলির দুর্ভাগ্য, আচমকা একটা শুকনো গাছের ডালে পা আটকে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর এবং পরক্ষণেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহত ভল্লুকী।

জেমসের নিক্ষিপ্ত রিভলভারের গুলি জন্তুটার নীচের চোয়াল ভেঙে দিয়েছিল, তাই তার দংশন করার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু কামড়াতে না-পারলেও ভল্লুকী তার ধারালো নখের সাহায্যে বিলকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল।

অন্য মানুষ হলে নিশ্চয়ই ভল্লুকীর নখে ছিন্নভিন্ন হয়ে ইহলীলা সংবরণ করত, কিন্তু বিলি প্যারট ছিল পাকা কুস্তিগির এবং তার দেহেও ছিল অসাধারণ শক্তি এত সহজে সে পরাজয় স্বীকার করল না।

এমন অদ্ভুত কায়দায় সে পা দিয়ে ভল্লুকীর কোমর জড়িয়ে ধরল যে জন্তুটার পিছনের থাবা দুটো হয়ে গেল অকেজো, ওই দুটো থাবা দিয়ে জন্তুটা তার শত্রুর দেহে আঁচড় বসাতে পারল না।

বাঁ-হাতের কনুইটা সে ঠেলে দিল ভল্লুকীর গলার নীচে এবং তার মুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণ হাত হাতুড়ির মতো পড়তে লাগল শ্বাপদের নাকে, মুখে, পাঁজরে।

ভালুকটা বিলিকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার পিছনের দুই থাবা বিলির কুস্তির প্যাঁচে অকেজো হয়ে পড়েছিল বটে কিন্তু সামনের থাবা দুটোর ধারালো নখগুলি শত্রুর কাঁধের উপর এঁকে দিল অনেকগুলো রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

ভল্লুকী গর্জন করছিল। বিলিও নীরব ছিল না, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় যে-কয়টা গালাগালি তার জানা ছিল সবকটাই সে প্রয়োগ করছিল উচ্চকণ্ঠে!

এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে জেমস হঠাৎ হো হো শব্দে হেসে উঠলেন। হাসির আওয়াজটা বিলির কানে গিয়েছিল, সে ভল্লুকীর সঙ্গে লড়তে লড়তেই জেমসের উদ্দেশে যেসব শব্দ উচ্চারণ করতে লাগল সেগুলো কোনো ভদ্রলোকের পক্ষেই সম্মানজনক নয়।

জেমসের হাসি বন্ধ হয়ে গেল, তিনি অবস্থার গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে গেলেন। ভল্লকীর কবলে যেকোনো মুহূর্তে বিলির প্রাণ যেতে পারে, এই অবস্থায় তাঁর হেসে ওঠা উচিত হয়নি।

বন্দুক হাতে নিয়ে মাচার উপর থেকে মাটিতে নেমে এলেন জেমস। ভল্লুকীর পিঠের উপর যে-বাচ্চাটা ছিল সে অবশ্য অনেক আগেই সরে পড়েছে।

ততক্ষণে শিকারিরা সকলেই যার যার মাচা থেকে নেমে ছুটে এসেছেন, বনতাড়ুয়াদের মধ্যেও অধিকাংশ লোক এসে উপস্থিত হয়েছে অকুস্থলে।

শিকারিদের হাতে বন্দুক তো ছিলই, বনতাড়ুয়ারাও নিতান্ত নিরস্ত্র ছিল না তাদের হাতেও ছিল লাঠিসোঁটা। কিন্তু বিল এবং ভল্লুকী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছিল তাতে বন্দুক তো দূরের কথা, লাঠি পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। কারণ আঘাত ভল্লুকীর গায়ে না-লেগে বিলির গায়েও লাগতে পারে।

সকলে নিরুপায় হয়ে দেখতে লাগলেন, দ্বিপদ ও শ্বাপদ আলিঙ্গনে-আবদ্ধ অবস্থায় গড়াতে গড়াতে এগিয়ে চলেছে যেদিকে, সেখানে হাঁ করে রয়েছে একটা গভীর নালা বা খাত। সমবেত শিকারির দল চিৎকার করে বিলকে এই নূতন বিপদ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার করে দিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হল না। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গড়াতে গড়াতে এসে পড়ল খাতের কিনারে, পরক্ষণেই মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ শ্বাপদ ও দ্বিপদের দেহ দুটি অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকার খাদের মধ্যে!

এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সকলেই প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। একটু পরে সংবিৎ ফিরতেই শিকারিরা খাতের ভিতর নেমে বিলের চূর্ণবিচূর্ণ দেহটাকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট হলেন।

কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। উঁচু-নীচু পাথুরে জমি, ছোটো বড়ো পাথর ও শিকড়বাকড় লতাপাতার প্রায়-দুর্ভেদ্য বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে নামতে গেলে প্রতিমুহূর্তে পা ফসকে পড়ে গিয়ে প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। তবু ওর মধ্যেই জেমস হরিণদের পায়ে-চলা একটা পথ আবিষ্কার করে ফেললেন। অতিকষ্টে প্রাণ হাতে নিয়ে শিকারিরা নীচে নেমে গেলেন এবং অস্পষ্ট অন্ধকার-মাখা জঙ্গলের মধ্যে বিলির খোঁজ করতে লাগলেন।

হ্যাঁ, বিলিকে পাওয়া গিয়েছিল। একটা মস্ত বড়ো পাথরের পাশে ভল্লুকীর মৃতদেহের উপর উপবিষ্ট অবস্থায় যে ক্ষতবিক্ষত মানুষটি শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল, সে হচ্ছে স্বয়ং বিলি প্যারট!

শিকারিরা বিলিকে জীবিত অবস্থায় দেখবেন আশা করেননি, কারণ অত উঁচু থেকে পড়লে কোনো জীবের পক্ষেই বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব।

এই অসম্ভব কী করে সম্ভব হল জানাতে গিয়ে বিলি যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, ভল্লুকীই প্রথমে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে এবং বিলি পড়েছিল তার দেহের ওপর। ভল্লুকীর অস্থিপঞ্জর একেবারে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার শরীরের উপর পড়ার দরুন বিলি তেমন জখম হয়নি।

অবশ্য তার কাঁধের ওপর সুগভীর রক্তরেখায় বিরাজ করছে ভল্লুকীর নখরচিহ্ন এবং পতনজনিত আঘাতের ফলে দেহের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে জানুর কাছে একটা গভীর ক্ষত অনর্গল রক্ত-উদগিরণ করছে বটে, কিন্তু বিলির মতো বলিষ্ঠ মানুষের পক্ষে ওই আঘাতগুলো মারাত্মক নয়।

বিলিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হল শিকারিদের তাঁবুতে। উপযুক্ত চিকিৎসার গুণে বিলি খুব শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করেছিল।

[শ্রাবণ ১৩৭৯]