অসুর বনাম মহিষাসুর

অসুর বনাম মহিষাসুর

না না, পুরাণে বর্ণিত মহিষাসুরের কাহিনি আজ লিখতে বসিনি, আমি যে জীবটির কথা বলছি সে হচ্ছে আফ্রিকা বনরাজ্যের জীবন্ত বিভীষিকা

নাম তার কেপ-বাফেলো। আফ্রিকার মহিষাসুর!

বন্য মহিষ মাত্রেই হিংস্র ও উগ্র, এমনকী গৃহপালিত মহিষকেও নিতান্ত শান্তশিষ্ট জানোয়ার বলা চলে না। কিন্তু আফ্রিকার কেপ-বাফেলোর মতো এমন ভয়ানক জানোয়ার পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে মহিষগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না।

মহিষ-পরিবারের অন্তর্গত সব জন্তুর প্রধান অস্ত্র শিং এবং খুর। কেপ-বাফেলো ওই দুই মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়, উপরন্তু শিরস্ত্রাণধারী যোদ্ধার মতো তার মাথার উপর থাকে কঠিন হাড়ের স্থূল আবরণ (ইংরেজিতে যাকে বলে Boss of the Horns)।

অস্থিময় এই কঠিন আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখ দন্ত বা রাইফেলের গুপ্ত বুলেট মহিষাসুরের মস্তকে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করতে পারে না।

নিগ্রো শিকারিরা অনেক সময় বর্শা হাতে মহিষকে আক্রমণ করে। অনেকগুলি বর্শার আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাণত্যাগ করার আগে মহিষ তার শিং ও খুরের সদ্ব্যবহার করতে থাকে বিদ্যুৎবেগে অবশেষে এই ধরনের বন্য নাটকের উপসংহারে দেখা যায় নিহত মহিষের আশেপাশে লম্বমান হয়ে পড়ে আছে কয়েকটি হত ও আহত নিগ্রো শিকারির রক্তাক্ত দেহ।

এই ভয়ানক জন্তুকে হত্যা করার একমাত্র উপযুক্ত অস্ত্র হচ্ছে শক্তিশালী রাইফেল। তবে রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টিও সবসময় কেপ-বাফেলোকে জব্দ করতে পারে না–আফ্রিকার অরণ্যে মহিষের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে বহু শ্বেতাঙ্গ শিকারি!

এমন দুর্দান্ত জানোয়ারকে টোনিও নামক নিগ্রো যুবকটি জব্দ করেছিল একখানা বর্শার সাহায্যে!

হ্যাঁ, বন্দুক নয়, রাইফেল নয়, এমনকী মহিষ বা হাতি শিকারের উপযুক্ত দীর্ঘ ফলকবিশিষ্ট বল্লমও তার হাতে ছিল না শুধুমাত্র একটি মাছমারা বর্শার সাহায্যে ক্ষিপ্ত মহিষের আক্রমণ রোধ করেছিল টোনিও নামধারী নিগ্রো যুবক!

কথাটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে–তাই নয় কি?

নিম্নলিখিত কাহিনিটি পড়লেই বোঝা যাবে সত্য ঘটনার চেহারা অনেক সময় গল্পের চেয়ে আশ্চর্য, গল্পের চেয়ে ভয়ংকর…।

সুদান অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ শিকারি–নাম তার রে ক্যাথার্লি। শিকারির ভাগ্য খারাপ, তার নিগ্রো পথপ্রদর্শক হঠাৎ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ল। জিনিসপত্র বহন করার জন্য যে লোকগুলিকে ক্যাথার্লি নিযুক্ত করেছিলেন তারা ছোঁয়াচে অসুখের ভয়ে তল্পিতল্পা ফেলে পালিয়ে গেল।

ক্যাথার্লি বিপদে পড়লেন। শিকারের সরঞ্জামগুলি বহন করার জন্য লোকজন দরকার কিন্তু এই গভীর অরণ্যে তেমন লোক কোথায়? নিরুপায় ক্যাথার্লি শেষ পর্যন্ত মডি জাতীয় নিগ্রোদের সাহায্য নিতে বাধ্য হলেন। মডিরা মৎস্যজীবী অর্থাৎ জেলে, মাছ ধরা তাদের পেশা শিকার-টিকার তারা বোঝে না কিন্তু টাকার মূল্য খুব ভালোভাবেই বুঝতে শিখেছে। টাকার লোভে কয়েকজন মডি জাতীয় ধীবর ক্যাথার্লির মোট বহন করতে রাজি হল।

মডিদের দলের মধ্যে একটি যুবকের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি ছয় ফুটের উপর লম্বা ওই দীর্ঘকায় মানুষটির প্রশস্ত স্কন্ধ ও পেশিবহুল দেহ যেন অফুরন্ত শক্তির আধার!

শিকারির মনে হল মানবের ছদ্মবেশে তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছে এক কৃষ্ণকায় দানব!

দানব বুঝল ক্যাথার্লি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, দন্তবিকাশ করে সে ইংরেজিতে জানিয়ে দিলে তার নাম টোনিও।

ক্যাথার্লি খুশি হলেন–টোনিও কেবল অসাধারণ দেহের অধিকারী নয়, তার মস্তিষ্কও যথেষ্ট উন্নত। মোটবাহকদের দলের মধ্যে টোনিও হচ্ছে একমাত্র লোক যে ইংরেজি ভাষা বুঝতে পারে এবং বলতে পারে।

কিন্তু সবচেয়ে যে বস্তুটি ক্যাথার্লির বিস্মিত দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল সেটি হচ্ছে টোনিওর হাতের বর্শা। সাধারণ বর্শার মতো কাষ্ঠদণ্ডের সঙ্গে ধারালো লোহার ফলা আটকে এই অস্ত্রটি তৈরি করা হয়নি–একটি সরল লৌহদণ্ডকে বর্শার মতো ব্যবহার করেছিল টোনিও।

ওই লোহার ডান্ডার মুখটা ছিল সরু আর ধারালো। গুরুভার অস্ত্রটিকে অতি সহজেই বহু দূরে নিক্ষেপ করতে পারত টোনিও এবং তার নিশানাও ছিল পাকা, সহজে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

এমন একটি মনুষ্য-রত্ন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ক্যাথার্লি, তাঁর প্রধান পথপ্রদর্শকের পদে বহাল হল টোনিও….

কয়েকদিন পরেই ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

টোনিওকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাথার্লি গিয়েছিলেন পাহাড়ের দিকে শিকারের সন্ধানে। তাঁবুতে যে কয়জন মোটবাহক ছিল তারা মাছ ধরবার জন্য যাত্রা করেছিল নদীর দিকে। সন্ধ্যার সময়ে ক্যাথার্লি টোনিওকে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে দেখলেন তাঁবু শূন্য জনপ্রাণীও সেখানে উপস্থিত নেই।

শিকারি প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি। কিন্তু ঘড়িতে যখন নয়টা বাজল তখন তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন। আফ্রিকার জঙ্গলে রাত্রি ন-টা পর্যন্ত কেউ তাঁবুর বাইরে থাকে না–অন্ধকারের অন্তরালে শ্বাপদসংকুল অরণ্য তখন মৃত্যুর বিচরণভূমি…

অবশেষে তাঁবুর কাছে যে অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল তারই আলোতে দেখা গেল লোকগুলি ফিরে আসছে।

আসছে বটে তবে স্বাভাবিকভাবে নয়।

মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে তিনটি লোক। চতুর্থ ব্যক্তিকে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি একটা বিছানার ওপর শুইয়ে তার তিন সঙ্গী ওই শয্যাটিকে বহন করছে।

কাষ্ঠনির্মিত ওই বিছানা তারা নামিয়ে রাখল ক্যাথার্লির সম্মুখে। শয্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠলেন ক্যাথার্লি

হাড়গোড়ভাঙা অবস্থায় যে রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটা কাঠের বিছানার ভিতর পড়ে আছে তার সঙ্গে মনুষ্যদেহের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ক্যাথার্লির মনে হল একটা গুরুভার বস্তুর নীচে মানুষটাকে পিষে ফেলা হয়েছে!

মডিদের ভাষা জানতেন না ক্যাথার্লি। টোনিও সঙ্গীদের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনল, তারপর কম্পিতকণ্ঠে ইংরেজি ভাষায় যে-কাহিনিটি সে পরিবেশন করল তা হচ্ছে এই

নদী থেকে মাছ ধরে মোটবাহকেরা ফিরে আসছিল। হঠাৎ একটা কেপ-বাফেলোর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। মহিষটা খুব ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ওই সময়ে যদি তারা চুপচাপ সরে পড়ত তাহলে বোধ হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটত না। মহিষ কাছে এসে লোকগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিল। খুব সম্ভব কাছাকাছি এসে কৌতূহল নিবৃত্ত করে সে আবার প্রস্থান করত–বিনা কারণে সাধারণত কেপ-বাফেলো মানুষকে আক্রমণ করে না। দুর্ভাগ্যবশত মডিদের মধ্যে একজন মহিষটাকে লক্ষ করে বর্শা ছুড়ল। লোকটির নিক্ষিপ্ত অস্ত্র লক্ষ্য ভেদ করল বটে কিন্তু মহিষ একটুও কাবু হল না–মডিদের মাছ-মারা বর্শার খোঁচায় ওই দুর্দান্ত জানোয়ারের কী হবে!

লাঙ্গি নামক যে-যুবকটি বর্শা নিক্ষেপ করেছিল আহত মহিষ তার দিকেই তেড়ে এল।

দলের সবাই ছুটে গাছে উঠে পড়ল, কিন্তু লাঙ্গি পালাতে পারল না ক্ষিপ্ত মহিষ শিং-এর আঘাতে তার পেট চিরে ফেলল। রক্তাক্ত ও বিদীর্ণ উদর নিয়ে ধরাশায়ী হল লাঙ্গি।

মহিষের ক্রোধ তবু শান্ত হল না–সে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দেহের ওপর!

বিপুলবপুমহিষের পায়ের তলায় চূর্ণ হয়ে গেল হতভাগ্যের অস্থিপঞ্জর। অনেকক্ষণ ধরে অভাগার দেহের ওপর চলল মহিষাসুরের তাণ্ডবনৃত্য–অবশেষে ওই দানব অদৃশ্য হল অরণ্যের অন্তরালে…

গাছের ওপর যারা ছিল তারা অনেকক্ষণ নীচে নামতে সাহস করেনি। মহিষের প্রস্থানের পর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে গাছ থেকে নেমে এল তিনটি ভয়ার্ত মানুষ এবং গাছের ডাল কেটে একটা বিছানা তৈরি করে মৃত সঙ্গীর দেহটাকে সেই কাষ্ঠনির্মিত শয্যায় শুইয়ে দিলে। তারপর সেই অপরূপ শবাধার বহন করে তারা তাবুতে ফিরে আসে..

পরদিন সকালে গুলিভরা রাইফেল হাতে ক্যাথার্লি ওই খুনি মহিষটার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। নিহত যুবকের বর্শার আঘাতে আহত হয়েছিল মহিষ–ক্ষতস্থান থেকে নিঃসৃত রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন শ্বেতাঙ্গ শিকারি, তাঁর সঙ্গে চলল টোনিও এবং আরও দুজন মডি যুবক।

রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করতে করতে নদীর ধারে এসে সকলে দেখল একটা মস্ত বাঁশবনের শেষে ঘন পাপিরাস ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে রক্তরেখা–

অর্থাৎ ওই ঘাসঝোপের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেছে মহিষ।

সকলেই বুঝল ওই ঘন ঘাসঝোপের ভিতর পদার্পণ করলে পৈতৃক প্রাণটিকে ওখানেই রেখে আসতে হবে। ক্যাথার্লি সাহসী শিকারি, কিন্তু তিনি শিকার করতে এসেছিলেন, আত্মহত্যা করতে আসেননি–

বাঁশবনের সামনে ঝোপের মুখোমুখি দাঁড়ালেন শিকারি, তাঁর আদেশে টোনিও এবং তার দুই সঙ্গী পাপিরাস ঝোপে আগুন লাগিয়ে দিলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, ঝোপটাকে ঘিরে নেচে উঠল লেলিহান অগ্নিশিখা…।

আচম্বিতে জ্বলন্ত ঝোপ ভেদ করে তিনটি মানুষের সামনে আবির্ভূত হল ক্রুদ্ধ মহিষাসুর!

মহিষ ছুটে এল মানুষগুলির দিকে।

গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল। দুর্ভাগ্যবশত গুলি লাগল মহিষের মাথায়–ইস্পাতের মতো কঠিন অস্থি-আবরণের ওপর ফেটে গেল রাইফেলের টোটা!

দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে এল মহিষ!

একজন মডি সভয়ে আর্তনাদ করে উঠল, তারপর পিছন ফিরে পা চালিয়ে দিলে তিরবেগে। অভাগা জানত না যে ধাবমান শিকারের দিকেই সর্বাগ্রে আকৃষ্ট হয় হিংস্র পশু

মহিষ তৎক্ষণাৎ লোকটিকে অনুসরণ করল।

আবার অগ্নদগার করে গর্জে উঠল ক্যাথার্লির রাইফেল উপরি-উপরি দু-বার।

 গুলির আঘাতে মহিষ হাঁটু পেতে বসে পড়ল।

যে-লোকটি ছুটে পালাচ্ছিল সে ততক্ষণে প্রায় বাঁশবনের কাছে এসে পড়েছে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করে সে দেখল মহিষ ভূতলশায়ী, সে থেমে গেল।

সগর্জনে উঠে দাঁড়াল মহিষ, শরীরী ঝটিকার মতো ধেয়ে এল পলাতক শিকারের দিকে। মডি যুবক ছুটতে শুরু করল, বাঁশবনের অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল ধাবমান দ্বিপদ ও চতুস্পদ, শিকার ও শিকারি… ।

রাইফেল বাগিয়ে ক্যাথার্লি ছুটলেন তাদের পিছনে।

একটা বাঁক ঘুরতেই ক্যাথার্লি দেখলেন মহিষ প্রায় লোকটির ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। আবার গুলি চালালেন শিকারি, তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল। পরক্ষণেই মহিষের নিষ্ঠুর শিং দুটো লোকটিকে মাটির ওপর ফেলে দিল–ক্যাথার্লি দেখলেন নিগ্রো যুবকের পৃষ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে আত্মপ্রকাশ করেছে এক ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন!

একবার আর্তনাদ করেই লোকটি মৃত্যুবরণ করল।

মহিষ এইবার ক্যাথার্লির দিকে ফিরল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে শিকারি সভয়ে আবিষ্কার করলেন তার রাইফেলে আর একটিও গুলি নেই! কম্পিতহস্তে তিনি তাড়াতাড়ি নূতন টোটা ভরার চেষ্টা করতে লাগলেন…

ক্যাথার্লির সামনে এসে পড়ল মহিষ।

তখনও তিনি টোটা ভরার চেষ্টা করছেন–এখনই বুঝি একজোড়া ধারালো শিং-এর আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিকারির দেহ…

অকস্মাৎ একটি দীর্ঘাকার মানুষ লাফ দিয়ে ছুটে এল মহিষের দিকে টোনিও!

পিছন দিকে শরীর দুলিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল টোনিও–জীবন্ত বিদ্যুৎরেখার মতো শূন্যে রেখা কেটে ছুটে এল তার হাতের বর্শা এবং মুহূর্তের মধ্যে মহিষের চিবুক ভেদ করে চোয়ালের দুই দিকে ঝুলতে লাগল বর্শার লৌহদণ্ড!

মহিষ ওই আঘাত গ্রাহ্যই করল না, নীচু হয়ে ক্যাথার্লির উদ্দেশে প্রচণ্ডবেগে চালনা করল ভয়ংকর দুই শৃঙ্গ

কিন্তু ব্যর্থ হল তার আক্রমণ।

তার চোয়ালে আবদ্ধ বর্শার দুই প্রান্ত আটকে গেল দু-পাশের বাঁশগাছে।

শিং-এর পরিবর্তে তার মাথাটা ধাক্কা মারল শিকারির দেহে এবং সেই দারুণ ধাক্কায় ছিটকে। মাটির ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন ক্যাথার্লি।

মহিষ তার শিং দুটিকে নামিয়ে আবার শিকারির দেহে আঘাত করার চেষ্টা করল।

তার চেষ্টা সফল হল না। চোয়ালে আবদ্ধ সুদীর্ঘ লৌহখণ্ডের দুই প্রান্ত আবার আটকে গেল ধরাশায়ী শিকারির দুই পাশে অবস্থিত ঘনসন্নিবিষ্ট বাঁশগাছের গায়ে।

বার বার সজোরে ঝাঁকানি দিয়েও ক্রুদ্ধ মহিষ বর্শাটাকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারল না, তার চোয়াল বিদ্ধ করে মুখের দু-পাশে কাঁপতে লাগল টোনিওর বর্শা–এদিকে চার ফুট, ওদিকে চার ফুট!

ক্যাথার্লি তখনও প্রাণের মায়া ছাড়েননি, কম্পিত হস্তে তখনও রাইফেলের টোটা ভরতে চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তার চেষ্টা বুঝি সফল হয় না–

মহিষ হঠাৎ পিছনের দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল, এইবার তার সামনের দুই পা প্রচণ্ড বেগে এসে পড়বে শিকারির বুকের ওপর, সঙ্গেসঙ্গে ভেঙে যাবে শিকারীর বক্ষপঞ্জর

ঠিক সেই মুহূর্তে ছুটে এল টোনিও, তারপর মহিষের মুখের দু-ধারে বিদ্ধ বর্শাদণ্ডের এক প্রান্ত ধরে মারল হাচটা টান!

কী অসীম শক্তি সেই বন্য যুবকের দেহে দারুণ আকর্ষণে ঘুরে গেল মহিষ, আবার ব্যর্থ হল তার আক্রমণ!

ভীষণ আক্রোশে ঘুরে দাঁড়িয়ে নূতন শক্তিকে আক্রমণ করার উপক্রম করল মহিষাসুর, আর সঙ্গেসঙ্গে ক্যাথার্লির রাইফেল সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল।

কর্ণমূল ভেদ করে রাইফেলের গুলি মহিষের মস্তিষ্কে বিদ্ধ হল, পরমুহূর্তেই মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ল সেই ভয়ানক জানোয়ারের প্রাণহীন দেহ।

এতক্ষণ পরে ক্যাথার্লি তার রাইফেলে গুলি ভরতে পেরেছেন!

ক্যাথার্লির মতোই আর একজন সাদা চামড়ার মানুষ স্থানীয় নিগ্রোদের অদ্ভুত সাহসের পরিচয় পেয়ে চমকে গিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলোকের নাম কম্যান্ডার এ গন্ডি। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পূর্বোক্ত সৈনিক কিছুদিন আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। সেই সময় আফ্রিকার অ্যাংকোল জাতীয় নিগ্রো শিকারিদের মহিষ শিকারের কৌশল স্বচক্ষে দেখেছিলেন তিনি। মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর ওপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন কম্যান্ডার গন্ডি–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

তদানীন্তন বেলজিয়ান কঙ্গের যে অঞ্চলে অ্যাংকোলে জাতি বাস করত, সেই জায়গাটা প্রধানত বন্য মহিষের বাসভূমি। বামন মহিষ নয়, অতিকায় মহিষাসুর কেপ-বাফেলোর ভয়াবহ উপস্থিতি অরণ্যকে করে তুলেছে বিপজ্জনক। অ্যাংকোলে নিগ্রোদের ভাষায় পূর্বোক্ত অতিকায় মহিষের নাম জোবি। স্থানীয় মানুষ অর্থাৎ অ্যাংকোলে জাতির নিগ্রোরা খুব লম্বা-চওড়া নয়–বেঁটেখাটো, রোগা ও অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির এই মানুষগুলোকে দেখলে অপরিচিত বিদেশির পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয় যে, প্রয়োজন হলে ওই ছোটোখাটো মানুষগুলো কতখানি দুঃসাহসের পরিচয় দিতে পারে। আফ্রিকার অন্যান্য স্থানে নিগ্রোরা ফাঁদ পেতে অথবা মহিষের চলার পথে গর্ত খুঁড়ে মহিষ-শিকারের চেষ্টা করে, কিন্তু অ্যাংকোলে-শিকারি অমন নিরাপদ পন্থায় শিকারকে ঘায়েল করার পক্ষপাতী নয়। কোন বিস্তৃত যুগে অ্যাংকোলে জাতির পূর্বপুরুষ আবিষ্কার করেছিল মহিষ-চরিত্রের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য–মরা মানুষকে মহিষ আঘাত করে না। তারপর থেকেই যুগযুগান্তর ধরে অ্যাংকোলে শিকারিরা যে পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে থাকে, সেই বিপজ্জনক পদ্ধতির অনুসরণ করার সাহস অন্য কোনো জাতিরই নেই। কম্যান্ডার গণ্ডি একবার অ্যাংকোলে জাতির মহিষ-শিকারের কায়দা দেখেছিলেন। সমস্ত ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর তিনি বলেছিলেন, সাদা কিংবা কালো চামড়ার অন্য কোনো জাতির শিকারি ওইভাবে অপঘাত মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে সাহস করবে না। নিজের সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে কম্যান্ডার সাহেব জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর সেরা লক্ষ্যভেদী শিকারি যদি কাছেই রাইফেল বাগিয়ে বসে থাকে, তাহলেও অ্যাংকোলে জাতির পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করতে তিনি রাজি নন।

ঘটনাটা এইবার বলছি। একটি ছোটোখাটো চেহারার অ্যাংকোলে শিকারি কম্যান্ডার গণ্ডিকে তাদের মহিষ-শিকারের পদ্ধতি দেখাতে রাজি হয়েছিল। অবশ্য লোকটি আগে সাহেবের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল যে, কোনো কারণেই তিনি উক্ত শিকারিকে বাধা দিতে পারবেন না এবং শোচনীয় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা দেখলেও গুলি চালাবেন না। একটা উঁচু গাছের ওপর কম্যান্ডার সাহেব যখন বসলেন, তখনই অ্যাংকোলে-শিকারি তার কর্তব্যে মনোনিবেশ করল।

মুক্ত প্রান্তরের উপর এখানে-ওখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ছোটো ছোটো হলুদ রং-এর ঘাসঝোপ। ওইরকম একটি ঘাসঝোপের ভিতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি। অস্ত্রের মধ্যে তার সঙ্গে ছিল তির-ধনুক আর একটা ছোটো ছুরি।

গাছের উপর থেকে খুব মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে সাহেব আবিষ্কার করলেন, দূর প্রান্তরের সীমানায় যেখানে এক সারি সবুজ ঘাস আত্মপ্রকাশ করেছে, সেইখানে বিচরণ করছে অনেকগুলো কৃষ্ণকায় চতুষ্পদ মূর্তি–মহিষ!

প্রান্তরের বুকে তৃণভোজনে ব্যস্ত মহিষযুথের পিছনে বাঁ-দিকে অবস্থান করছে এক ভীষণদর্শন পুরুষ মহিষ। সাহেব বুঝলেন ওই জন্তুটাই হচ্ছে দলের প্রহরী এবং অ্যাংকোলে-শিকারির লক্ষিত জোবি–ওকেই হত্যা করার চেষ্টা করবে ছোটোখাটো মানুষটি।

গাছের ওপর থেকে সাহেব দেখলেন ঘাসঝোপের ভিতর থেকে হঠাৎ মহিষের খুব কাছেই আবির্ভূত হল একটি মনুষ্যমূর্তি–অ্যাংকোলে-শিকারি!

লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। গাছের ওপর থেকে তার শরীরটা সাহেবের দৃষ্টিগোচর হলেও মাটিতে দাঁড়িয়ে মহিষের পক্ষে লোকটিকে দেখা সম্ভব ছিল না। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে চটপট ধনুক থেকে তির নিক্ষেপ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ধনুকের টংকার-শব্দ সাহেবের কানে এল। সঙ্গেসঙ্গে একটা সংঘাতের আওয়াজ এবং জান্তব কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি–মহিষের স্কন্ধে বিদ্ধ হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে একটা তির।

সর্বনাশ, সাহেব মনে মনে বললেন, এইবার তিরবিদ্ধ মহিষ নিশ্চয়ই হাঁক দিয়ে দলকে সংকেত জানাবে। সেই শব্দ শোনামাত্র মহিষের দলটা ছুটে আসবে অ্যাংকোলে-শিকারির দিকে।

সে-রকম কিছু হল না। আহত মহিষ একটা অস্পষ্ট আওয়াজ করল, বিরক্তভাবে দুই-একবার মাথা নাড়ল, মনে হল একটা বিরক্তিকর মাছিকে সে তাড়াতে চেষ্টা করছে–তারপর চারদিকে সঞ্চালিত করল তীক্ষ্ণদৃষ্টি যেন এক গোপন শত্রুকে সে আবিষ্কার করতে চাইছে!

উদবেগজনক কয়েকটি মুহূর্ত… মহিষযূথ সরে যাচ্ছে দূরে… সঙ্গীদের গতিবিধি লক্ষ করছে তিরবিদ্ধ মহিষ। সে এখনও বুঝতে পারছে না সঙ্গীদের অনুসরণ করা উচিত, না তাদের ফিরেআসার জন্য হাঁক দেওয়া উচিত। মহিষ তার কর্তব্য স্থির করার সময় পেল না, আংকোলে শিকারি নি মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল তির ছুড়ল, তারপর শুয়ে পড়ল মাটিতে। দ্বিতীয় তিরটা ঘাড়ের ওপর বিঁধতেই খেপে গেল মহিষ। লোকটিকে সে দেখতে পায়নি বটে, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে ধনুকের অস্পষ্ট টংকার ধ্বনি–শব্দের দিকনির্ণয় করতেও মহিষের ভুল হল না।

যেদিক থেকে শব্দ এসেছে, সেইদিকেই ছুটল মহিষ… কিন্তু সোজা নয়–বৃত্তের আকারে গোল হয়ে ঘুরে জন্তুটা সঙ্গেসঙ্গে মাথা উঁচুকরে বাতাস থেকে শত্রুর গায়ের গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সাহেব যে গাছটার উপর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই গাছ আরশায়িত নিগ্রো শিকারির মধ্যবর্তী স্থানের মাঝামাঝি এসে মহিষ বোধ হয় মানুষের গায়ের গন্ধ পেল, সে থমকে দাঁড়াল, বার বার বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করল তারপর আবার কয়েক পা এগিয়ে বাতাস শুঁকতে লাগল… অবশেষে মানুষটাকে সে আবিষ্কার করে ফেলল। ঠিক যে জায়গায় নিগ্রো শিকারি, সেই দিকেই ছুটল মহিষ। দিকনির্ণয়ে তার একটুও ভুল হয়নি, পদভরে মাটি কাঁপিয়ে সে ধেয়ে এল উল্কাবেগে।

গাছের উপর থেকে সাহেবের মনে হল, ধরাশায়ী মানুষটার ওপর এসে পড়েছে একজোড়া প্রকাণ্ড শিং, এই বুঝি হতভাগ্য শিকারিকে মাটিতে গেঁথে দেয় একজোড়া জান্তব তরবারি। কিন্তু সেই রক্তাক্ত দৃশ্যে সাহেবের দৃষ্টি পীড়াগ্রস্ত হওয়ার আগেই অকুস্থল থেকে একটি ধুলোর মেঘ লাফিয়ে উঠে তার দৃষ্টিশক্তিকে আচ্ছন্ন করল। একটু পরেই জোর বাতাসের ধাক্কায় সরে গেল ধুলো। সাহেব দেখলেন, অ্যাংকোলে-শিকারি অক্ষত অবস্থায় মাটিতে আর তার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে মহিষ। জন্তুটা অস্থিরভাবে মাটিতে পদাঘাত করছে এবং তার নাসিকা ও কণ্ঠ থেকে উদগীর্ণ হচ্ছে অবরুদ্ধ রোষের ভয়াবহ ধ্বনি।

কম্যান্ডার সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলেন মহিষ পিছন ফিরল। কিন্তু না–অত সহজে রেহাই দিল না যমদূত ক্ষণিকের জন্য লাফিয়ে সরে গিয়েছিল মহিষ, তৎক্ষণাৎ ঘুরে এসে আবার মানুষটাকে পরীক্ষা করতে লাগল সে।

লোকটি একটুও নড়ছে না, তার ধরাশায়ী দেহে কোথাও জীবনের লক্ষণ নেই। তার সর্বাঙ্গে পড়ছে মহিষের তপ্ত নিশ্বাস, কানে আসছে রক্ত-জল-করা গর্জনধ্বনি, খুরের আঘাতে কাঁপছে তার পাশের মাটি–তবু অ্যাংকোলে-শিকারির দেহ নিস্পন্দ, নিশ্চল!

সাহেব অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, নিজের ওপর কতখানি কর্তৃত্ব থাকলে ওই অবস্থায় মড়ার ভান করে পড়ে থাকা যায়!

অনেকক্ষণ পরীক্ষা করার পর মহিষ ফিরে গেল। লোকটি তখনও ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল না। ভালোই করল, কারণ, একটু দূরে গিয়েই আবার ফিরল মহিষ। আগের মতোই শায়িত মনুষ্যদেহের চারপাশে চলল মহিষাসুরের আস্ফালন, পরীক্ষা-নিরীক্ষণ, তারপর আবার ফিরে অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করল জন্তুটা।

সাহেবের সর্বাঙ্গ দিয়ে তখন ঘাম ছুটছে। তিনি এতক্ষণে বুঝেছেন কেন অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনক পদ্ধতিতে মহিষ শিকার করে। তিরের বিষ মহিষের দেহে প্রবেশ করার অনেক পরে তার মৃত্যু হয়। এক-শো ফুটের বেশি দূর থেকে তির ছুঁড়ে মহিষকে কাবু করা সম্ভব নয়–কারণ, দূরত্ব বেশি হলে নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাত করার ক্ষমতা কমে যায়। এক-শো ফুটের মধ্যে গাছে উঠে মহিষকে আঘাত করাও অসম্ভব–তিরের নাগালের মধ্যে আসার আগেই মহিষের দৃষ্টি বৃক্ষে উপবিষ্ট শিকারির দিকে আকৃষ্ট হবে এবং সে সবেগে স্থান ত্যাগ করবে, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। মাটিতে দাঁড়িয়ে কোনো গোপন স্থান থেকে মহিষকে তিরবিদ্ধ করলে শিকারির মৃত্যু অনিবার্য; মহিষের তিনটি ইন্দ্রিয়ই শক্তিশালী চক্ষু-কর্ণ-নাসিকার ত্র্যহস্পর্শ যোগে মহিষ চটপট শিকারির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে তার দিকে ধাবিত হবে এবং তিরের বিষ মহিষের রক্তে সঞ্চারিত হয়ে তার মৃত্যু ঘটানোর আগেই তীক্ষ্ণ শিং আর খুরের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে শিকারির দেহ! ছুটে পালানো সম্ভব নয়, মানুষ আর মহিষের দৌড় প্রতিযোগিতায় মানুষের জয়লাভের কোনো আশাই নেই!

মৃতদেহের প্রতি মহিষের অহিংস মনোভাবের সুযোগ গ্রহণ না-করলে অ্যাংকোলে-শিকারির পক্ষে অন্য কোনো উপায়ে মহিষ-মাংস সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, সেইজন্যই ধনুর্বাণ-সম্বল অ্যাংকোলে জাতি এমন বিপজ্জনকভাবে মহিষ শিকারে প্রবৃত্ত হয়।

আচ্ছা, এইবার কাহিনির পূর্ব সূত্র ধরে দেখা যাক আমাদের পরিচিত অ্যাংকোলে-শিকারির ভাগ্যে কী ঘটল। মহিষ আরও কয়েকবার শিকারির কাছে এসে ফিরে গেল–পাঁচ-পাঁচ বার ওইভাবে ছুটোছুটি করার পর মহিষ যখন আরও একবার ঘুরে আসছে, সেই সময় সাহেব দেখলেন জন্তুটা হঠাৎ হাঁটু পেতে বসে পড়ল–তারপর এক ডিগবাজি খেয়ে সশব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির ওপর, আর উঠল না।

সাহেব বুঝলেন মহিষের মৃত্যু হল, এতক্ষণ পরে কার্যকরী হয়েছে তিরের বিষ!

মহিষের মৃতদেহ থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে শায়িত একটা নিশ্চল মনুষ্যমূর্তি হঠাৎ সচল হয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর দূরবর্তী মহিষফুথের প্রস্থানপথের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সর্বাঙ্গ থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলল এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো টান করে আড়ষ্টভাব কাটিয়ে নিয়ে বাঁ-হাতে আটকানো খাপ থেকে ছুরিটা টেনে নিল। বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর একবার ছুরির ধার পরখ করে নিয়ে অ্যাংকোলে-শিকারি তার পরবর্তী কর্মসূচি অনুসরণ করতে উদ্যত হল।

গাছ থেকে নেমে কম্যান্ডার সাহেব যখন লোকটির কাছে এসে পৌঁছালেন, সে তখন অভ্যস্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে জোবির মৃতদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত। লোকটির ভাবভঙ্গি দেখে সাহেবের মনে হল সে যেন খুব সহজভাবে একটা দোকানে বসে কসাই-এর কর্তব্য করছে তার নির্লিপ্ত আচরণ দেখে কে বলবে একটু আগেই তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিল মূর্তিমান মৃত্যুদূত।

লোকটি মাথা না-তুলেই সাহেবের উপস্থিতি অনুভব করল, নিবিষ্ট চিত্তে মৃত পশুর চামড়াতে ছুরি চালাতে চালাতে সে বলল, একটু পরেই আমার পরিবারের সবাই এখানে এসে পড়বে। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই এই চমৎকার মাংস তারা ঘরে নিয়ে যাবে।

সাহেব বললেন, কিন্তু জোবির বদলে যদি তারা তোমার মরা শরীরটা পড়ে থাকতে দেখত, তাহলে কী হত?

নির্বিকারভাবে শিকারি উত্তর দিল, তাহলে আমার পরিবারের লোকরা ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের টুকরোগুলো নিয়ে গ্রামের পিছনে পুঁতে ফেলত। ওইখানে কোনো খারাপ প্রেতাত্মা যায় না।

[বৈশাখ ১৩৭৬]