নরকের প্রহরী

নরকের প্রহরী

সপাং!

সিন্ধুঘোটকের চামড়ার ভারী চাবুক সশব্দে নামল বিশাল কুকুরটার পিঠে–একগোছা লোম কেটে উড়িয়ে মাংসের মধ্যে চেপে বসল চাবুক, কুকুরটা বসে পড়ল বরফের উপর, তার পেটের মাংসপেশি তখন থর থর করে কাঁপছে!

আবার! আবার! বার বার আছড়ে পড়ল চাবুক। কুকুরটার দুই কান চেপটা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির সঙ্গে, তুষার ভেদ করে তলার শ্যাওলার উপর চেপে বসল পায়ের নখগুলো–আক্রমণের সংকেত?…

সপাং!

আবার পড়ল চাবুক; সঙ্গেসঙ্গে কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল চাবুকধারী রেড ইন্ডিয়ানটির উপর। একটা হিংস্র চাপা গর্জন–পরক্ষণেই ছুরির মতো ধারালো দাঁতগুলো ছিঁড়ে ফেলল নরম মাংসের আবরণ, চাবুকের আস্ফালন হল স্তব্ধ। চাবুকধারী তার হাতের চাবুক ফেলে দুই হাতে গলার ক্ষতস্থান চেপে ধরে বসে পড়ল, বিদীর্ণ কণ্ঠের রক্তধারায় লাল হয়ে গেল হাতের দস্তানা।

আহত রেড ইন্ডিয়ান পেশায় ছিল স্লেজ-গাড়ির চালক। অবাধ্য কুকুরকে যেভাবে পেশাদার, চালকেরা শায়েস্তা করে, সেইভাবেই লোকটি বশ করতে চেয়েছিল বিশাল জন্তুটাকে। কিন্তু কুকুরটা চাবুকের শাসন মানল না, বিদ্রোহ করল এবং তার ফলেই রক্তাক্ত দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

অন্যান্য রেড ইন্ডিয়ানরা আহত মানুষটির সামনে থেকে কুকুরটাকে টেনে সরিয়ে দিল। আর তখনই তার নামকরণ হল মামালুজ। আলাস্কার রেড ইন্ডিয়ানদেব ভাষায় মামালুজ শব্দটির ভাবার্থ হচ্ছে নরকের প্রহরী। রেড ইন্ডিয়ান জাতির কয়েকটি গোষ্ঠীর প্রচলিত বিশ্বাস যে, নরকের দ্বার রক্ষা করে একটি প্রকাণ্ড কুকুর। মামালুজ নামকরণ থেকেই বোঝা যায় কুকুরটা স্থানীয় মানুষের মনে দারুণ আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল। সেখানকার মানুষ নরকের কুকুরকে আবার নরকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অর্থাৎ তারা কুকুরটাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।

কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যে পরিণত হওয়ার আগেই অকুস্থলে উপস্থিত হল এক পেশাদার স্লেজ-চালক, নাম তার লয়েড়. এ. স্মিথ।

ঘটনা যেখানে ঘটেছে, সেই আলাস্কার বিস্তীর্ণ তুষারাবৃত তুন্দ্রা অঞ্চলে কুকুর–টানা স্লেজ-গাড়ি ছাড়া অন্যান্য যানবাহন একেবারেই অচল। সেখানকার প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঘোড়া অথবা খচ্চর খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। যে কুকুরগুলো স্লেজ গাড়ি টানে,তাদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। স্লেজ-বাহক কুকুরগুলো হাস্কি নামে অভিহিত। বিশেষ জাতের ওই কুকুরগুলো অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু, কিন্তু ভীষণ হিংস্র। নেকড়ের মতো ভয়ানক ওই কুকুর দিয়ে গাড়ি চালানোর কাজটা সহজ নয়। দেহে আর মনে যথেষ্ট শক্তি না-থাকলে স্লেজ-গাড়ির চালক হওয়া যায় না। স্থানীয় ভাষায় স্লেজ-চালককে বলা হয় মশার। স্মিথ নামে যে আমেরিকান যুবকটির কথা বলা হচ্ছিল, সেও একজন মশার। ওই অঞ্চলের নানা জায়গায় ডাকবিভাগের চিঠিপত্র, টাকাপয়সা পৌঁছে দেওয়ার ভার নিয়েছিল সে।

রেড ইন্ডিয়ানদের যে-গ্রামে মামালুজ ছিল, সেইখানে হঠাৎ এসে পড়ল স্মিথ তার কুকুর টানা স্লেজ-গাড়ি নিয়ে। সে যাচ্ছিল সল্ট ওয়াটার ল্যান্ড নামে জায়গাটাতে চিঠি বিলি করতে গ্রামটা তার যাওয়ার পথে পড়েছিল। যে-লোকটি মামালুজকে গুলি করে মারতে যাচ্ছিল, সে স্মিথকে জন্তুটা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করল। ওই লোকটির বক্তব্য থেকে স্মিথ জানতে পারল কুকুরটার কাছে আদর-ভালোবাসার মুল্য নেই কিছুমাত্র; ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা আদর করে তার পিঠ চাপড়াতে গেছে, তাদের হাতে-পায়ে মামালুজের দাঁতের দাগ এখনও বর্তমান। স্লেজবাহক কুকুরদের এক দলপতি মামালুজের বরাদ্দ খাদ্যে ভাগ বসাতে গিয়েছিল। ফল হল ভয়াবহ তৎক্ষণাত দলপতিকে হত্যা করেছিল মামালুজ।

বহুদিন শিক্ষা দেওয়ার পর স্লেজবাহক কুকুরদের দলপতি হিসাবে একটি কুকুরকে গড়ে তোলা যায়। টাকার দিক থেকে ধরলেও একটি শিক্ষিত দলপতি কুকুরের দাম বড়ো কম নয়, অতএব দলের নেতা কুকুরটিকে হত্যা করে মামালুজ যে মালিককে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারপর রেড ইন্ডিয়ান স্লেজ-চালকের উপর আক্রমণ চালিয়ে তার গলায় কামড় বসানোর ঘটনাও জানতে পারল স্মিথ। আগন্তুকের কাছে মামালুজ সম্পর্কে যাবতীয় ভীতিপ্রদ তথ্য পরিবেশন করে গ্রামের মানুষটি জানাল কুকুরটা হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাধ্য হয়েছে।

জন্তুটাকে দেখে স্মিথ আকৃষ্ট হল। এমন বলিষ্ঠ কুকুরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারলে তাকে দিয়ে ভালোভাবেই প্রয়োজনীয় কাজ করানো যাবে।

অবশ্য কুকুরটার স্বভাবচরিত্র সুবিধের নয়, তার সাহচর্য দস্তুরমতো বিপজ্জনক–স্মিথ পাক্কা মশার, বিপদের ভয়ে এমন চমৎকার জানোয়ারটাকে হাতছাড়া করতে সে চাইল না। সুতরাং স্মিথ যখন গ্রাম ছেড়ে গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করল, তখন দেখা গেল তার সঙ্গে চলেছে কুখ্যাত নরকের প্রহরী মামালুজ!

খুনি দুর্নাম থাকা সত্ত্বেও কুকুরটার প্রতি স্মিথের আকৃষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মামালুজ নামে হাস্কি কুকুরটার শরীরে মেদের চিহ্ন ছিল না একটুও। আগাগোড়া শক্ত হাড় আর পেশিবদ্ধ শরীরের ওজন ছিল ১০০ পাউন্ড। বিশেষ করে তার চারটি পা ছিল অসাধারণ শক্তিশালী। যারা কুকুর চেনে, তারা মামালুজের মুখের দিকে একবার চাইলেই বুঝতে পারত জন্তুটা সাধারণ কুকুরের চাইতে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তার চোখে-মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির আভাস অতিশয় স্পষ্ট। এমন একটা জন্তুকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারলে স্লেজ-চালকের মস্ত লাভ তাই মামালুজকে দলের নেতা হিসাবে গড়ে তোলার সংকল্প নিয়েছিল মশার স্মিথ।

যাত্রা শুরু করার পরের দিনই মামালুজ তার হিংস্র স্বভাবের পরিচয় দিল–স্মিথের একটা হাতের উপর পড়ল দন্তাঘাতের চিহ্ন! সপ্তাহটা শেষ হওয়ার আগেই তার নিতম্ব থেকে উরু পর্যন্ত আরও একটা দীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিল মামালুজের ধারালো দাঁত!

স্মিথের বন্ধুরা তার পছন্দকে তারিফ করতে পারল না। তারাও স্লেজ-চালক মশার-বরফে ঢাকা দুর্গম তুন্দ্রার পথে পথে নির্মম তুষার-ঝটিকা ভেদ করে খানাখন্দ পেরিয়ে কুকুরটানা স্লেজ-গাড়ি চালাতে তারা অভ্যস্ত কিন্তু এই নির্ভীক দুর্দান্ত মানুষগুলো মামালুজ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে লাগল। তাদের মতে এই খুনি জন্তুটাকে বিদায় না-দিলে ভবিষ্যতে স্মিথের বিপদ অনিবার্য।

স্মিথ কারো কথায় কর্ণপাত করল না। শীতের মাঝামাঝি সময়ে তার বাঁ-হাতে পুরোবাহুর উপর মামালুজ আবার তার দাঁতের চিহ্ন রাখল এবং দলের একটি কুকুর মারা পড়ল মামালুজের নিষ্ঠুর দন্তাঘাতে। স্মিথ তবুও অবিচল। মামালুজ তখন শকটবাহী কুকুরদের নেতা। তাকে নিয়ে স্মিথ গর্ব করতেও ছাড়ত না।

জন্তুটা ভীষণ বদরাগী, স্মিথ বলত, কিন্তু সে পথ চলতে জানে। আমার চাইতেও ভালোভাবে সে পথের সন্ধান করতে পারে। বরফের তলায় গভীর খাদের মরণফঁদ এড়িয়ে চলার ক্ষমতা জন্তুটার আছে। নেতৃত্ব করার জন্যেই জন্মগ্রহণ করেছে মামালুজ।

কেটে গেল জানুয়ারি মাসের শীতার্ত দিনগুলো; এল ফেব্রুয়ারির অনিশ্চিত আবহাওয়া। সুৎমা নামক দিগন্তবিস্তৃত সমতলভূমি দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে তুষার-ঝটিকার মুখে পড়ল স্মিথ। আশেপাশে সব কিছু তখন তুষারের আবরণে অদৃশ্য। মামালুজের উপরেই পথ চলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করল নিরুপায় স্মিথ। মামালুজ তার প্রভুকে নিরাশ করেনি তার নির্ভুল নেতৃত্ব দুর্গম তুন্দ্রা অঞ্চলের বরফঢাকা মৃত্যুফাঁদ এড়িয়ে দশ মাইল রাস্তা পার হয়ে স্লেজ গাড়িটাকে পৌঁছে দিল অরণ্যের প্রবেশপথে।

কিন্তু তারপরই এল সেই বীভৎস দিন, নরকের প্রহরী যেদিন তার সম্বন্ধে যাবতীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে প্রায় সত্য বলে প্রমাণ করে দিল…

স্যালকিনা হিমবাহের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে উন্মত্ত বাতাস, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো তুষারের আবরণে দৃষ্টির অন্তরালে অদৃশ্য হয়েছে স্যালকিনার সুগভীর মরণফাঁদগুলো, মাংসের মধ্যে যেন কেটে বসতে চাইছে মেরুপ্রদেশের হিমশীতল বায়ু… শকটবাহী কুকুরদের লোমে বরফ জমে গিয়ে ঝুলছে ফিতের মতো, মুখের কালো লোম বরফে সাদা, চোখের উপর বরফ জমে জন্তুগুলোর অবস্থা প্রায় অন্ধের মতো… তাদের মালিক স্মিথের অবস্থাও তার পোষ্যদের চাইতে ভালো নয়।

হিমবাহ স্যালকিনা–

বন্ধুর গিরিখাতে পরিপূর্ণ উত্রাই-এর পথ। সেই পথ বেয়ে স্লেজ গাড়িটাকে চালিয়ে দিয়েছিল স্মিথ। স্লেজের তিন দাঁতওয়ালা গতি-নিরোধক ব্রেকটা চেপে ধরেছিল সে, কিন্তু হিমবাহের বরফ এত মসৃণ আর শক্ত যে, ব্রেকের দাঁত কিছুতেই সেই কঠিন বরফ কেটে ভালোভাবে বসতে পারছিল না। স্লেজগাড়ির রানার (ইস্পাতের সমান্তরাল ফলক, যার উপর ভর করে স্লেজ চলে) দ্রুত গতিতে বরফের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই বরফের রং কোথাও ইবনাইটের মতো মসৃণ কালো, কোথাও-বা সমুদ্রের মতো সবুজ। কখনো কখনো গভীর গিরিখাতের কাছ ঘেঁষে গাড়িটা পার হচ্ছিল। স্মিথের তখন আতঙ্কে শ্বাসরোধের উপক্রম। একটা নড়বড়ে জীর্ণ সাঁকো বাতাসে দুলছিল; অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে কুকুর-বাহিনীর স্লেজ-গাড়ি সেটাকে পার হয়ে গেল। ধীরেসুস্থে পার হতে গেলে সেই সাঁকোটা নির্ঘাত ভেঙে পড়ত হুড়মুড় করে।

দলপতি মামালুজ সম্পর্কে একটা সশ্রদ্ধ মনোভাব গড়ে উঠেছিল স্মিথের মনে, আর ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

পাহাড়ের গায়ে দুটি ফাটলের সন্ধিস্থলে পৌঁছে যাত্রাপথ স্থির করতে একটু দ্বিধায় পড়েছিল মামালুজ, মুহর্তের জন্য সে থমকে গিয়েছিল। ব্লেজার নামে যে-কুকুরটা এতক্ষণ তার গা ঘেঁষে চলছিল, সে হঠাৎ মামালুজের পিছনের পায়ের উপর কামড় বসাল। ব্লেজার ছিল বর্ণসংকর, সাইবেরীয় আর এস্কিমো রক্তের সংমিশ্রণে তার জন্ম, যেমন প্রকাণ্ড শরীর তেমনই প্রচণ্ড শক্তি দলপতির দ্বিধার ভাবটা সে অমার্জনীয় ত্রুটি বলেই মনে করেছিল। কিন্তু ওই কামড়টা যে তারই মৃত্যুর পরোয়ানা বহন করে আনবে, সেটা বোধ হয় তার জানা ছিল না। আর সেই নৃশংস মৃত্যুদণ্ডকে কার্যকরী করা জন্য ওই জায়গাটার চাইতে উপযুক্ত স্থানও বোধ হয় আর পাওয়া যেত না।

কুকুরগুলোর ঝটাপটির মাঝখানে স্মিথ প্রাণপণে ব্রেক চেপে ধরেও বারো ফুট লম্বা মালপত্র-ঠাসা ভারী স্লেজটাকে সামলাতে পারছিল না–ধীরে ধীরে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল পাশের অতলস্পর্শী গিরিখাদের দিকে। তবু মরিয়ার মতো স্লেজটাকে আটকে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল স্মিথ। কুকুরগুলোর লড়াই দেখার সময় বা সুযোগ ছিল না তার, তবে তাদের ভয়ংকর চিৎকার শুনে স্মিথ বুঝতে পারছিল যে, ওখানে চলছে এক মৃত্যুপণ লড়াই। মুহূর্তের মধ্যে নয়টি কুকুরের কণ্ঠে জেগেছে ক্রুদ্ধ গর্জন, শুরু হয়েছে ঝটাপটি আর রক্তাক্ত তাণ্ডব…

স্মিথ প্রাণপণে চিৎকার করে মামালুজকে ডাকল একবার। কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে তার গলার আওয়াজ ডুবে গেল। খুব ধীরে ধীরে স্লেজটা তখন এগিয়ে চলেছে খাতের দিকে। সারমেয় বাহিনীর যোদ্ধাদের সেদিকে দৃষ্টি নেই, তারা তখনও যুদ্ধ করছে আর তাদের সমবেত ওজনে স্লেজের সামনের দিকটা নেমে যাচ্ছে তলার দিকে। স্মিথের চোখের পাতার উপর বরফ জমে গেছে, তারই ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে অনেক কষ্টে অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করছে সে। আর মাত্র ফুটখানেক এগিয়ে গেলেই স্মিথকে স্লেজ ছেড়ে লাফিয়ে পড়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে, গাড়িটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই থাকবে না। এই অবস্থার মধ্যেও সে স্লেজের সঙ্গে বাঁধা কুকুরগুলোর লাগাম কেটে দেওয়া কথা ভাবল–কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল বড়ো দেরি হয়ে গেছে, এখন লাগাম কেটে দিয়েও জন্তুগুলোকে বাঁচানো যাবে না, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্লেজ সমেত এক-শো ফুট নীচে আছড়ে পড়ে শেষ হয়ে যাবে তারা।

স্মিথ আবার চিৎকার করে উঠল। স্লেজটাও যেন দুলে উঠল একবার, তারপর হঠাৎ থেমে গেল। মামালুজ এবার সাইবেরীয় কুকুরটার গলায় কামড় বসিয়েছে। গিরিখাতের গা ঘেঁষে বরফের একটা উঁচু জায়গায় অবিশ্বাস্যভাবে আটকে গিয়ে স্লেজ-গাড়িটা অনিবার্য পতন থেকে বেঁচে গেছে!….

স্মিথ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে কুকুরগুলোকে চালিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এল সে। বর্ণসংকর কুকুরটার প্রাণহীন প্রকাণ্ড দেহটা ততক্ষণে বরফের উপর শক্ত হয়ে গেছে। আরও দুটো কুকুর অতিকষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। স্মিথ তাদের বাঁধন খুলে গাড়ির উপর তুলে নিতে বাধ্য হল। অন্যান্য কুকুরগুলো তখন রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চাটছিল আর দলপতির দাঁত-খিচানো নির্দেশের জবাব দিচ্ছিল একইভাবে দাঁত খিঁচিয়ে!

স্মিথ মশারদের উপাস্য সব সাধুসন্তদের নামে শপথ নিয়ে স্থির করল যে, রিলিফ কেবিন-এ পৌঁছেই সে মামালুজকে শেষ করবে। একটা খুনি কুকুরের সৌন্দর্যের মোহে পড়ে নিতান্ত নির্বোধের মতো বিচার-বিবেচনা বিসর্জন দিতে বসেছিল সে।

হিমবাহের পথে এই বিপর্যয় আর কুকুরগুলোর ক্ষয়ক্ষতির জন্য রিলিফ কেবিনে পৌঁছাতে তার বেশ রাত হয়ে গেল। মামালুজ ছাড়া সব কুকুরদের খেতে দিল স্মিথ। মামালুজকে খেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তার দিকে ফিরে একটা কথাও বলল না সে। মামালুজ তার রক্তিম বাদামি চোখে প্রতিবাদ আর অনুযোগের আগুন জ্বালিয়ে বার বার নীরবে দৃষ্টিপাত করছিল স্মিথের দিকে সে বোধ হয় বুঝতে পেরেছে তার বরাতে কী ঘটতে চলেছে…

রিলিফ কেবিনের কাছে তুষার-ঝড় নেই। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদের আলোয় রাতের পৃথিবী প্রায় দিনের মতোই স্পষ্ট। খুনি কুকুরটার চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিথ রাইফেল তুলল। অন্য কোনো কুকুর এই অবস্থায় পড়লে ভয়ে কুঁকড়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, কিন্তু মামালুজ বিন্দুমাত্র ভয়ের ভাব দেখাল না। জ্বলন্ত চোখে স্মিথের দিকে তাকিয়ে সে যেন বলতে চাইছে, হাতে বন্দুক না-থাকলে তোমার বীরত্বের বহর দেখে নিতাম। কুকুরটার বেপরোয়া ভাব দেখে স্মিথের মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছিল, রাইফেলের মাছির দিকে তাকিয়ে লক্ষ স্থির করার চেষ্টা করলেও তার হাত কঁপছিল–

কুকুরটা শান্তভাবে দাঁড়িয়ে চরম আঘাতের জন্য অপেক্ষা করছে, তার আচরণে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই! স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে স্মিথের দিকে!…

স্মিথের মনে হল মামালুজ বলতে চাইছে, আমার যা কর্তব্য বলে মনে হয়েছে, তাই করেছি আমি। আমার স্বভাবটাই এমন। কী করব বল? তার জন্য যদি আমায় শেষ করে দিতে চাও, তবে তাই করো।

স্মিথের আঙুল রাইফেলের ট্রিগারে চেপে বসেছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই ট্রিগার টিপে গুলি ছুঁড়তে সে পারল না। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছিল কুকুর হলেও মামালুজ তার চাইতে অনেক বেশি সাহসী। স্মিথ স্থির করল এবারের গন্তব্যস্থল ফোর্ট এগবার্টে গিয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত কুকুরটার মৃত্যুদণ্ড সে মুলতুবি রাখবে। আপাতত শ্রান্ত দেহকে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, অতএব শয্যার আশ্রয় গ্রহণ করল স্মিথ। বিছানায় শুয়েও সহজে ঘুম এল না, সে ভাবতে লাগল তার বন্ধুরা এবার কী বিদ্রুপের হাসিই-না হাসবে এই ব্যাপারটা নিয়ে!…

হঠাৎ কুকুরদের ভয়ংকর গর্জনের আওয়াজে স্মিথের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে তার মনে হল কোনো জন্তুজানোয়ার হয়তো কুকুরগুলোর কাছে এসে পড়েছে। পরক্ষণেই ভুল ভাঙল একটি লোকের ভারী পায়ের শব্দ আর মামালুজের গম্ভীর গর্জনধ্বনি ভেসে এল তার কানে!

চটপট বিছানা থেকে উঠে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে তার টর্চটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল স্মিথ, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল ঘরের দরজা। খোলা দরজা দিয়ে চাঁদের আলো ঝাঁপিয়ে পড়তেই ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে গেল, আর কুকুরগুলোর চিৎকারের কারণটাও তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল স্মিথ। ফারের টুপি আর ডেনিমের পার্কা পরা খুব লম্বা-চওড়া একটা লোক প্রায় সমস্ত দরজাটা জুড়ে দাঁড়াল এবং স্মিথের বুক লক্ষ করে তুলে ধরল হাতের রাইফেল। তার ঠিক পিছনেই একটা লোক সঙ্গীর কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি মেরে ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল। রাইফেলধারীর মুখে কালো রং-এর ছাঁটা দাড়ি, তার জ্বলন্ত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে স্মিথের বুকের উপর। লোকটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে স্মিথ হঠাৎ পিছন দিকে লাফিয়ে পড়ে নিজের রাইফেলটার জন্য হাত বাড়াল।

তৎক্ষণাৎ সগর্জনে অগ্নিবর্ষণ করল আগন্তুকের রাইফেল। সঙ্গেসঙ্গে কাঁধের বাঁ-দিক থেকে একটা যন্ত্রণার অনুভূতি স্মিথকে প্রায় অসাড় করে দিল। আবার গর্জে উঠল আততায়ীর আগ্নেয়াস্ত্র। দ্বিতীয়বারের আঘাত সহ্য করতে পারল না স্মিথ, অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর…

জ্ঞান ফিরে আসার পর প্রথমেই যে অনুভূতিটা স্মিথকে দংশন করল, তা হচ্ছে নিদারুণ ঠান্ডার অনুভূতি। অসহ্য শীত তাকে কাঁপিয়ে তুলেছে–কেবিনের দরজা খোলা, ঘরের কোণে অগ্নিকুণ্ডটা নিবে গেছে অনেক আগেই। প্রাণপণ চেষ্টা করে সে তার আড়ষ্ট শরীরটা মেঝে থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে কোনোরকমে পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। আহত দেহ প্রতিবাদ জানাল তৎক্ষণাৎ শরীরের বাঁ-দিকে, বিশেষ করে বাঁ-হাতের উপর দিয়ে তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ খেলে গেল। ডান হাতটাও কাঁপছিল, তাই দিয়েই বাঁ-দিকের ক্ষতস্থানটা পরখ করার চেষ্টা করল স্মিথ

রাইফেলের প্রথম গুলিতে বাঁ-কাঁধের হাড় ভেঙে গেছে, জামাকাপড়ের তলায় পশমের অন্তর্বাস রক্তে ভেজা, দারুণ ঠান্ডায় রক্তসিক্ত পশমের টুকরোটাকে বরফ দিয়ে তৈরি বলে মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। দ্বিতীয় গুলিটা বাঁ-হাতের উপরের অংশ ভেদ করে চলে গেছে, তবে হাড় ভাঙেনি।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে চুল্লির আগুনটা আবার জ্বালাতে গিয়ে তিন-তিনবার মেঝের উপর পড়ে গেল স্মিথ। ফলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে সে বাধ্য হল। শারীরিক কষ্টের উপর ছিল মানসিক দুশ্চিন্তা। রাইফেলটা নেই, পিছনে রাখা নীল-সাদা ডোরাকাটা থলেগুলো উধাও! বাইরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে স্মিথ স্লেজ-গাড়িটাকে দেখতে পেল না, অর্থাৎ গাড়িটাকেও নিয়ে গেছে লুঠেরাগুলো!

ডাকগাড়ি লুঠ! ডাকাতরা আসলে কোন জিনিসটা নিতে এসেছিল? বেয়ারভ্যালি মাইনিং কম্পানির ঠিকানায় রেজিস্ট্রি করে পাঠানো সেই পার্সেলটাই কি?

সাধারণ ডাকে পাঠানো চিঠিপত্র লুঠ করে নেওয়ার লোভ কার হবে? এদিকে যে-ডাক আসে, তাতে খনিজ পদার্থ মেশানো মাটি বা পাথরের নমুনা থাকে না। মাথাটা অসম্ভব ঠান্ডা রেখে স্মিথ এসব কথা ভাবছিল আর সেইসঙ্গে লুঠেরাদের ফেলে-যাওয়া পুরানো ধরনের ছোটো বাক্সটার মধ্যে হাত গলিয়ে কিছু খাবার খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল। চুল্লির আঁচে শরীরের হাড়-কাঁপানো শীতের ভাব কিছুটা কেটে যাওয়ার পর স্মিথ তার ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করে ভালোভাবে বেঁধে নিল, তারপর কিছুক্ষণ ভেবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে ফেলল।

লুঠেরাগুলোকে তাড়া করে ধরে ফেলা সম্ভব নয়। স্মিথ নিরস্ত্র, তার উপর একটা হাত তার জখম। ডাকাতগুলো খুব সম্ভব ধরে নিয়েছে সে মরেই গেছে গুলি খেয়ে। কুকুরগুলো সমেত স্লেজ-গাড়িটা পেয়ে যাওয়ায় ডাকাতদের পক্ষে এখনই লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে পলায়ন-পর্ব নিতান্তই সহজ, কিন্তু আহত দেহ নিয়ে স্মিথের পক্ষে পায়ে হেঁটে তাড়াতাড়ি ফোর্ট এগবার্টে পৌঁছে নিজের চিকিৎসায় ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে।

খাবারের একটা ছোটো প্যাকেট বানিয়ে নিয়ে স্মিথ কেবিন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ফোর্ট এগবার্টের রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যাবে বলেই মনস্থ করেছিল সে, কিন্তু বাইরে এসে বরফের উপর পায়ের ছাপগুলো দেখেই তারা চিন্তাধারা বদলে গেল।

পায়ের ছাপগুলো দেখে সে বুঝতে পারল ডাকাতগুলো ফোর্ট এগবার্টের দিকে যায়নি, গেছে। উলটো দিকে অর্থাৎ যেদিক থেকে স্মিথ এসেছিল সেই দিকে। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হল যে, তার কুকুরগুলো মোটেই ঠিকভাবে পথ চলেনি। পদচিহ্ন দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যাত্রা আরম্ভের প্রথমদিকে অন্তত কুকুরদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা বলে কিছু ছিল না।

ফোর্ট এগবার্টের পথ না-ধরে পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে চলল হিমবাহের দিকে। বেশ কয়েক মিনিট ধরে কুকুরের এলোমেলো পায়ের দাগ পর্যবেক্ষণ করে স্মিথ বুঝতে পারল কুকুরগুলোকে ঠিকমতো ক্রমানুসারে সাজিয়ে গাড়িতে জোড়া হয়নি। আর একটু ভালো করে দেখে সে বুঝল মামালুজকে দলের প্রধান হিসাবে সারির প্রথমদিকে বাঁধা হয়নি–অতএব লুঠেরাদের যে বেশ ঝাটে পড়তে হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। স্মিথের সারমেয়বাহিনী সম্পর্কে সঠিক ধারণা না-থাকলে কারো পক্ষে তাদের পর পর ঠিকমতো সাজিয়ে গাড়িতে জোড়া অসম্ভব, আর নেতৃত্বের পদটা বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র মামালুজ নয়।

স্মিথ তার আহত কাঁধকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। ডাকাতদের সঙ্গে দৈবাৎ দেখা হয়ে গেল সে কী করতে পারে? এদিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। ।

হঠাৎ একটু দূরে পাথরের উপর একটা চিহ্ন স্মিথের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এগিয়ে গিয়ে চিহ্নটা ভালো করে পরীক্ষা না-করেই ওখানে কী ঘটেছিল অনুমান করতে পারছিল স্মিথ। বরফের উপর ফুট দুই জায়গা জুড়ে একটা ছোটো গর্তের মতো ছিল, এলোমেলো পায়ের দাগে সেই জায়গাটা বিপর্যস্ত বেশ বোঝা যাচ্ছে ওখানে একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। ধবধবে সাদা বরফের উপর রক্তের চিহ্ন আর গোছ গোছ কুকুরের লোম ছড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে। মানুষের পায়ের দাগও রয়েছে। একটা লোকের কনুইয়ের দাগও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওখানে নিশ্চয়ই লোকটা উলটে পড়ে গিয়েছিল।

দাগটার ওপারে রক্তের ফোঁটাগুলো বেশি ঘন। কনুইতে ভর করে উবু হয়ে আরও ভালো করে দাগগুলো দেখে স্মিথ বুঝতে পারল দুটো কুকুর কামড়াকামড়ির ফলে আহত হয়েছে, আরও দুটো কুকুর পথ চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আগের দিন হিমবাহের পথ ধরে আসার সময়ে যে-দুটো কুকুরের পায়ে চোট লেগেছিল, এই পদচিহ্নগুলো নিশ্চয়ই তাদের।

আর একটা চিহ্ন দেখে স্মিথ সবচেয়ে খুশি হল–স্লেজ-গাড়ির রানার যাওয়ার মসৃণ দাগটার উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে, অর্থাৎ গাড়ির পিছনে যারা হেঁটে আসছিল সেই ডাকাত দুটোর মধ্যে অন্তত একজন জখম হয়েছে।

অনেকক্ষণ পথ চলার পর স্মিথ যখন বিপদসংকুল হিমবাহের শেষ প্রান্ত অতিক্রম করছে, বেলাশেষের স্নান আলো তখন বিদায় নিতে চাইছে পৃথিবীর বুক থেকে। একটু পরেই জ্যোৎস্নার আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। খাবারের প্যাকেট থেকে শুকনো মাংস নিয়ে চিবোতে চিবোতে সামনের দিকে পা ফেলে এগিয়ে চলল স্মিথ…

এ কী! ওটা কি রিলিফ কেবিন?… হ্যাঁ, রিলিফ কেবিনই বটে। ঘরের ভিতরের আলো জানালার পথে স্মিথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু ওখানে আলো জ্বলছে কেন? আরে! স্লেজ-গাড়িটাও যে দেখা যাচ্ছে দরজার কাছে! ডাকাত দুটো তাহলে ওই রিলিফ কেবিনের মধ্যেই রাত কাটাবে নাকি? স্মিথ ঠিক করল চুপি চুপি দরজার কাছে রাখা স্লেজ-গাড়িটার কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখবে তার মধ্যে বন্দুক আছে কি না। সৌভাগ্যের বিষয়, কেবিনটার যে-ঘরে আলো জ্বলছিল, কুকুরদের থাকার ঘরটা তার পিছন দিকে–অতএব কুকুরদের কাছে তার ধরা পড়ার ভয় নেই। কুকুরগুলো মনিবকে দেখে চিৎকার করলে স্মিথ ডাকাতদের চোখেও ধরা পড়ে যাবে, কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই বুঝে সে নির্ভয়ে অগ্রসর হল…

স্লেজ-গাড়িটা খুঁজে স্মিথ হতাশ হল। গাড়ির সব জিনিসই ভিতরে নিয়ে গেছে লোকদুটো। মনে মনে ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে স্মিথ কেবিনের যে-কোণ থেকে কুকুরগুলোকে দেখা যায় না, নিঃশব্দে সেই কোণটায় গিয়ে পৌঁছাল।

স্মিথের বাঁ-হাত অকেজো, ডান হাত দিয়ে খুঁড়িতে তৈরি কেবিনের দেয়ালে একটা জোড় থেকে আলগা কিছু শ্যাওলা নীচের দিকে ঝরিয়ে ফেলে দিল স্মিথ। তৎক্ষণাৎ জোড়ের ফাঁক দিয়ে বাইরে এসে পড়ল সরু এক ফালি আলো। সেই ফাটলে চোখ রেখে ঘরের ভিতরই দেখার চেষ্টা করতে লাগল স্মিথ

 ঘরের এককোণে মরচে-ধরা লোহার চুল্লিতে আগুন জ্বলছে… পিছন দিকের দেয়ালে যাত্রীদের শয়ন করার জন্য যে দুটো বড়ো বড়ো তাক আছে, তার একটার উপর পশমের জামাকাপড় আর ডাকের থলেগুলো গাদা করে রাখা… ছুঁচলো-মুখে দাড়িওয়ালা লোকটা অন্য তাকটাতে বসে। পাশে-রাখা একটা ডাকের থলে থেকে চিঠিপত্র বার করে সেগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে…অন্য লোকটা একটা টেবিলে বসে আছে, সেও চিঠি দেখতে ব্যস্ত…

হঠাৎ দুটো রাইফেলের উপর স্মিথের নজর পড়ল। দুটোর মধ্যে একটা তার নিজের রাইফেল। টেবিল আর তাকের মাঝখানে দেয়ালে হেলান দিয়ে দস্যুদের হাতের খুব কাছাকাছি জায়গায় রাইফেল দুটো রাখা হয়েছে।

স্মিথ সোজা হয়ে দাঁড়াল। ঠান্ডায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার কেঁপে উঠল। এতক্ষণ লোক দুটোকে অনুসরণ করে দ্রুত পথ চলার ফলে তেমন ঠান্ডা লাগেনি, এখন বাইরের হিমশীতল আবহাওয়া স্মিথের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। আবার ফাটলটা দিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে স্মিথ দেখতে পেল টেবিলে-বসা লোকটা ঘুরে বসেছে, তার পরনের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত চিরে গেছে, আর সেই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে লোকটার পায়ের উপর জড়ানো রয়েছে একটা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ।

স্মিথ আর একবার ঘরের চুল্লিটার দিকে চেয়ে দেখল আগুন ভালোভাবেই জ্বলছে। কাছেই ঘন গাছপালায় ঘেরা একটা জায়গার মধ্যে স্মিথ গা-ঢাকা দিল… ।

একটা পাতা-ঝরা শুকনো বার্চ গাছের ছাল ছুরি দিয়ে ফুটখানেকের মতো কেটে নিয়ে স্মিথ সেটাকে উলটোদিকে গুটিয়ে সোজা করে নিল, তারপর ছালটাকে কেবিনের এককোণে রেখে দিয়ে পা টিপে টিপে কুকুরদের থাকার জায়গাটায় উপস্থিত হল।

গর্জিত কণ্ঠের ঐকতানে কুকুররা স্মিথকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। শঙ্কিত হয়ে গলায় যতদূর সম্ভব মধু ঢেলে স্মিথ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। চেষ্টা প্রায় সফল হল, মামালুজ ছাড়া দলের অন্য কুকুরগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই চুপ করল। মামালুজের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ তবুও স্তব্ধ হল না।

কেবিনের পিছন দিকের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল, বাইরে ছুটে এল এক ঝলক আলো। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে স্মিথ চটপট একটা ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিল।

একটি লোক এগিয়ে এল, কুকুরগুলোর আশেপাশে চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিল, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই তার চোখে পড়ল না। কুকুরদের উদ্দেশে গালাগালি দিতে দিতে লোকটি আবার প্রবেশ করল ঘরের মধ্যে।

স্মিথের শরীরের পেশিগুলো টান টান হয়েছিল–লোকটি ঘরে ঢুকতেই সে ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এল মামালুজের দিকে। এবার তাকে শান্ত করতে বিশেষ অসুবিধা হল না। প্রথমে অবশ্য খুনি কুকুরটা স্মিথের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করেছিল, কিন্তু মিষ্টি কথায় তোয়াজ করে মাথায় দুই-একবার হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর মামালুজ আবার স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়াল। মুখ তুলে একবার যেন লোমশ লেজটাও নেড়ে ফেলল মামালুজ। ব্যস ওই পর্যন্ত আদর-সোহাগ দেখানোর ব্যাপারটা মামালুজের ধাতেই নেই আসলে। তার একজন মনিব আছে, কাজেই তাকে মনিবের কথা শুনে চলতে হয়, এইটুকুর বেশি খাতির করার কথা ভাবতেই পারে না মামালুজ।

মামালুজের গলায় বাঁধা শিকলের অন্য প্রান্ত খুঁটি থেকে খুলে নিয়ে স্মিথ গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল কেবিনের কোণের দিকে। সেখানে তাকে বেঁধে রেখে স্মিথ ওক গাছের ছালটা নিয়ে কেবিনের ছাতে ওঠার উদ্যোগ করল। গাছের গুঁড়ি-বাঁধা দেয়ালের বাইরের দিকে বেরিয়ে-আসা অংশগুলোতে মই-এর ধাপের মতো পা রেখে সে উঠতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাল সামনের দিকে ঝুঁকে-পড়া ছাতটার উপর। আস্তে আস্তে এগিয়ে কেবিনের চুল্লি থেকে ধোঁয়া বার স্মিথের ফস্তিস্বর–কেউ তৈরি হল রির হাত বুলিও লোক টলতেয়ার উপক্রম হওয়ার চিমনির কাছে চলে গেল স্মিথ, তারপর গাছের ছালটা মুড়িয়ে চিমনির মধ্যে ভালো করে ঢুকিয়ে দিয়ে নলের মুখ বন্ধ করে দিল। এবার ছাত থেকে নামার পালা–নিঃশব্দে প্রায় লাফ দিয়েই সে নামল এবং মামালুজকে নিয়ে এসে দাঁড়াল জানালার কাছে…

কিছুক্ষণ পরেই কেবিনের ভিতর থেকে দমফাটা কাশির আওয়াজ ভেসে এসে জানিয়ে দিল স্মিথের ফন্দিটা বিলক্ষণ কাজে লেগেছে। আবার কাশির আওয়াজ, তারপরই শোনা গেল অপরিচিত কণ্ঠস্বর–কেউ একজন জানতে চাইছে চুল্লিটার কী হল!

এইবার আক্রমণের জন্য তৈরি হল স্মিথ। তার শরীরের প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় এখন সজাগ হয়ে উঠেছে, নীচু হয়ে মামালুজের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিল সে…।

আচম্বিতে প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল কেবিনের দরজা। দুটি লোক টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এল ঘরের ভিতর মুখবন্ধ চুল্লিটার ধোঁয়ায় তাদের শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভীষণভাবে কাশতে কাশতে বাইরের খোলা হাওয়ায় তারা শ্বাসপ্রহণের চেষ্টা করতে লাগল।

এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল স্মিথ, তার অক্ষত ডান কাঁধ দিয়ে কেবিনের পলকা জানালায় সজোরে ধাক্কা মারল সে, সঙ্গেসঙ্গে জানালাটা কাঠামো সমেত ভেঙে পড়ে গেল ঘরের মধ্যে। ডান হাত দিয়ে মামালুজকে ভেতরে ঢুকিয়ে স্মিথও ঘরের ভিতর প্রবেশ করল…

লোকদুটো যখন দৌড়ে আবার কেবিনের মধ্যে ফিরে এল, স্মিথ তখন তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, হাতে তার উদ্যত রাইফেল।

ওদের উপর নজর রাখো, মামালুজকে নির্দেশ দিল স্মিথ।

সঙ্গেসঙ্গে হিংস্র আক্রোশে দন্তবিস্তার করে গর্জে উঠল মামালুজ। কুকুরটাকে খুনের তালিম দেওয়া আছে, স্মিথ বলল, তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে লোকদুটোর দিকে, নড়াচড়া করবার চেষ্টা করলেইও তোমাদের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে।

ডাকাত দুটো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

 ডাকের থলে দুটো যে-তাকটায় রয়েছে, ওটার উপর উঠে বসো দুজনে, স্মিথ কঠিন স্বরে বলে উঠল, কোণের দিকে চুপচাপ বসে থাকো।

স্মিথের হুকুম তারা তামিল করল সুবোধ বালকের মতো। মামালুজের মুখের কাছ থেকে সরে দেয়ালের দিকে যথাসম্ভব ঘেঁষে থাকার চেষ্টা করছিল তারা। স্মিথ এবার ডান হাত থেকে রাইফেলটাকে বাঁ-হাতে সরিয়ে নিল, সঙ্গেসঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণায় তার বাঁ-কাধটা যেন ছিঁড়ে যেতে লাগল। বাঁ-হাত দিয়ে রাইফেল ছোঁড়ার ক্ষমতা ছিল না তার, নিতান্ত জরুরি একটা কাজ করার জন্যই বাঁ-হাতে রাইফেল ধরেছিল স্মিথ। সেই জরুরি কাজটা হল অন্য রাইফেলটাকে অকেজো করে দেওয়া। দ্বিতীয় রাইফেলটার লম্বা বেল্ট খুলে নিয়ে সেটাকে জানালা গলিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল স্মিথ। এইবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরের ভিতর চারদিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে স্মিথ  আবিষ্কার করল একটা বাটি। বাটিটা শূন্যগর্ভ নয়, বরবটির তরকারিতে পরিপূর্ণ। স্মিথের দারুণ খিদে পেয়েছিল, বাটি থেকে কয়েকটা বরবটি নিয়ে সে মুখে দেওয়ার উদ্যোগ করল।

ডাকাতদের মধ্যে কালো দাড়িওয়ালা লোকটা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিল। স্মিথের বাঁ-হাতটা যে একেবারেই অকেজো হয়ে পড়েছে সে-কথা লোকদুটোকে বুঝতে না-দেওয়ার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু ধাপ্পায় কাজ হল না; কালো দাড়িওয়ালা যে-লোকটা স্মিথকে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল, সে হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে লাফ মেরে তাক থেকে নেমে এল এবং স্মিথের আহত বাঁ-হাতটা ধরে ফেলার চেষ্টা করল, কিন্তু মামালুজকে পেরিয়ে আসা সম্ভব হল না..

দারুণ আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় লোকটার চোখমুখ তখন রক্তহীন, ফ্যাকাশে এবং তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছে আর্তনাদের পর আর্তনাদ

মামালুজের নিষ্ঠুর দাঁতগুলো তার কাঁধ আর বাহুর মাংস কেটে ফালা ফালা করে দিচ্ছে!

 প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে কোনোমতে মুক্ত করে ডাকাতটা যখন তাকের উপর তার সঙ্গীর পাশে উঠে বসল, তখন তার অবস্থা নিতান্তই শোচনীয়। নীচে দাঁড়িয়ে সগর্জনে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল মামালুজ, বোধ হয় সারমেয়-ভাষায় বলতে চাইছিল, আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে না কি স্যাঙাৎ?…

সল্ট ওয়াটার ল্যান্ড থেকে ডাকগাড়িটা ফোর্ট এগবার্টে পৌঁছানোমাত্র চারদিকে দস্তুরমতো সাড়া পড়ে গেল। স্মিথ এবং তার স্নেজগাড়ির দুরবস্থা প্রথমেই যে-লোকটির চোখে পড়েছিল, সে-ই চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে ঘরের বাইরে জড়ো করে দিল।

দৃশ্যটা সত্যি অদ্ভুত—

 মৃতপ্রায় অবস্থায় গাড়ির সামনের দিকের হাতলটা ধরে কোনোরকমে বসে ছিল স্মিথ। গাড়িতে ঠাসা ডাকের থলে, পশমের কম্বল আর শীতবস্ত্রের স্তূপের উপর চেপে বসেছিল স্লেজ-গাড়ির সবকয়টি কুকুর। না সবাই নয়, একটি বাদে গাড়ির পাশ দিয়ে কুচকাওয়াজ করার দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে ধূসরবর্ণের এক কুখ্যাত কুকুর

খুনি মামালুজ!

 কিন্তু তাহলে গাড়ি টানছে কারা?… না, কুকুর না, মানুষেই টানছে গাড়ি। স্লেজ-গাড়ির লাগামগুলো মানুষ দুটোর বাহুর তলা দিয়ে ঘুরিয়ে ঘাড়ের উপর দিকে বাঁধা রয়েছে, তাদের আর এখন দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। লোকদুটোর চোখমুখে নিদারুণ আতঙ্কের আভাস, তারা বার বার তাকাচ্ছিল মামালুজের দিকে। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন।

ফোর্ট এগবার্ট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার একবার লোকদুটোর বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিথকে বললেন, এই লোক দুটো এক সপ্তাহ আগে আমাদের ব্যাঙ্কে হানা দিয়ে হেড টেলারকে গুলি করেছিল, তারপর পাঁচ হাজার ডলার লুঠ করে পালিয়ে গিয়েছিল। তোমার মালপত্রের মধ্যে সেই পাঁচ হাজার ডলার রয়েছে–তাই না?

দারুণ ক্রোধে চিৎকার করে উঠল স্মিথ, ওসব ব্যাপার আমি কিছু জানি না। তোক দুটো আমায় খুন করে ডাকের থলেগুলো লুঠ করার চেষ্টা করেছিল। আমার কুকুরগুলোকে প্রায় খোঁড়া করে দিয়েছিল ওরা। কাজেই আমার মনে হল কুকুরের কর্তব্য ওদেরই করা উচিত, তাই কুকুরগুলোকে গাড়িতে বসিয়ে আমি ওদের দিয়ে গাড়ি টানিয়েছি।

ওই খুনি কুকুরটা তাহলে ওদের রক্ষী হিসাবে ছিল?

হ্যাঁ, তা তো ছিলই। তা ছাড়া শয়তান দুটোকে ধরে ফেলার পর দু-দুবার ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

কথাগুলো বলেই স্মিথ মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। ম্যানেজার তাকে ধরে ফেলে বলে উঠলেন, সাংঘাতিক আঘাত লেগেছে তোমার। চলো, আগে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

ম্যানেজারের হাত ছাড়িয়ে স্মিথ কোনোমতে ঝুঁকে পড়ে তার অক্ষত হাতটা দিয়ে ত্রিভুজের মতো একজোড়া কানে মৃদু টান দিল, তারপর বলল, আগে মামালুজকে শহরের সবচেয়ে ভালো খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আলাস্কার সেরা কুকুর আমার মামালুজ।