বাঘিনী

বাঘিনী

মানুষখেকো বাঘিনীকে মানুষ ভয় করে, ঘৃণা করে। কিন্তু সেই ভয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক ধরনের শ্রদ্ধা–এ-কথাও সত্যি।

মানুষ চিরকালই বীরত্বের পূজারি–তাই নরভুক বাঘিনীর হিংস্র স্বভাবের মধ্যেও সে যখন বীরত্বের সন্ধান পায় তখন নিজের অজান্তে তার মনে শ্রদ্ধার উদয় হয়।

আমি আজ কোনো চতুষ্পদ ব্যাঘ্রীর গল্প বলব না; আমার কাহিনির নায়িকা একটি দ্বিপদ রমণী যার সঙ্গে অনায়াসে বনচারিণী বাঘিনীর তুলনা করা যায়। শৌর্যে, সাহসে ও স্বভাবের ভীষণতায় এই মেয়েটি বাঘিনীর চাইতে কোনো অংশেই কম ছিল না।

আজকের কথা নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আমাদের নায়িকার কাহিনি। তবে এই কাহিনি শুরু করার আগে জুলুদের কথা একটু বলা দরকার। আফ্রিকার অধিবাসী এই জুলুজাতি সাহস ও বীরত্বের জন্য বিখ্যাত। কেবলমাত্র বর্শা ও তরবারি সম্বল করে জুলুরা আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বারংবার। রাইফেল ও মেশিনগানের কল্যাণে শ্বেতাঙ্গরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে বটে, কিন্তু তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে জুলুদের মতো নির্ভীক যোদ্ধা ইউরোপেও নিতান্ত দুর্লভ।

এই জুলুজাতির একটি মেয়েকে নিয়েই আমাদের কাহিনি। জোয়েদি নামক এক জুলু সর্দারের গৃহিণী ছিল নজমবাজী–আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়িকা…

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জুলুজাতির ইতিহাসে আবির্ভূত হলেন এক প্রচণ্ড পুরুষ–রাজা উ-শকা!

একাধিক পুস্তকে তার নামটিকে সংক্ষিপ্ত করে শকা নামে অভিহিত করা হয়েছে, আমরাও তাই বলব।

এই রাজা শকার কোপদৃষ্টিতে পড়ল জোয়েদি সর্দার এবং তার স্ত্রী নজমবাজী। জোয়েদি পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু নজমবাজীকে শকার সৈন্যরা গ্রেপ্তার করে ফেলল।

রাজা শকার তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। যুদ্ধের পর যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন শকা। রণডঙ্কা বাজিয়ে যেদিক দিয়ে ছুটে গেছে তার সেনাবাহিনী, সেইদিকেই ধরিত্রীর বুকে লম্বমান হয়েছে অগণিত মানুষের রক্তাক্ত মৃতদেহ।

এমন একটি মানুষের সম্মুখীন হলে অনেক সাহসী পুরুষের বুকের রক্ত জল হয়ে যায়, কিন্তু নজমবাজীকে যখন বিচারের জন্য শকার সামনে নিয়ে আসা হল তার চালচলনে ভয়ের আভাস ছিল না কিছুমাত্র!

গর্বিত পদক্ষেপে রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল রমণী। তার জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টিতে নেই আতঙ্কের ছায়া–রুদ্ধ আক্রোশ ও ঘৃণায় দপদপ করে জ্বলছে বন্দিনীর দুই চক্ষু

রাজার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল নজমবাজী। জুলুজাতি এবং তাদের রাজা শকাকে উচ্চৈঃস্বরে সে অভিশাপ দিতে লাগল বারংবার।

সমবেত জুলুদের মধ্যে অনেকেই ভীত হল। মারামারি কাটাকাটি করতে জুলুরা ভয় পায় না, কিন্তু ভূত প্রেত মন্ত্রতন্ত্র সম্পর্কে তাদের আতঙ্ক অপরিসীম। নজমবাজী ডাকিনীবিদ্যায় সিদ্ধ, তাই সকলেই তাকে ভয় করত যমের মতো।

কিন্তু রাজা শকা অন্য ধরনের মানুষ আততায়ীর তরবারি এবং ডাকিনীর মন্ত্র তার কাছে সমান উপহাসের বস্তু। শরীরী বা অশরীরী কোনো জীবকেই তিনি পরোয়া করতেন না।

শকা বন্দিনীকে চুপ করতে বললেন। তিক্তস্বরে নজমবাজী বললে, বিচারের রায় আগে দিয়ে দাও রাজা পরে না হয় বিচার কোরো! ফলাফল কী হবে তা তো জানা আছে, মিছামিছি সময় নষ্ট করে লাভ কী?

রাজা শান্তস্বরে বললেন, আমি তোমার বিচার করছি বটে, তবে তোমার কথাগুলো আমায় শুনতে হবে। আমি ন্যায়বিচার করতে চাই। তোমার একটি সাধারণ ছোট্ট কথার জন্য হয়তো আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারি।

বিচার শুরু হল। নজমবাজীর বিরুদ্ধে রয়েছে নরহত্যা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। একটি নয়, দুটি নয়–ত্রিশটি মানুষকে নাকি হত্যা করেছে নজমবাজী! শুধু হত্যা করেই সে খুশি হয়নি, নিহত লোকগুলির মুণ্ড নিয়ে সে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার কুটিরের দেয়ালে দেয়ালে!

বন্দিনী অভিযোগ অস্বীকার করল না। দৃপ্তকণ্ঠে সে বললে, হ্যাঁ, আমি ওদের হত্যা করেছি, ওদের মুণ্ডগুলো নিয়ে আমার ঘর সাজিয়েছি।

শকা প্রশ্ন করলেন, কেন? উত্তর এল, ক্ষমতা লাভ করার জন্য। আমি ডাকিনীবিদ্যায় সিদ্ধ হয়েছি। ওই মুণ্ডগুলি আমার দরকার।

শকা গম্ভীর স্বরে বললেন, ভালো, ভালো। কিন্তু ওহে ডাইনি!–বলো দেখি, তোমার ডাকিনীবিদ্যা কি তোমাকে বাঁচাতে পেরেছে?… পারেনি। কারণ তোমার মন্ত্রের চাইতে আমার অস্ত্রের ক্ষমতা অনেক বেশি আর সেইজন্যই আজ তুমি আমার বন্দি। বুঝেছ?

বুঝেছি, বন্দিনীর ওষ্ঠাধরে ফুটল বিদ্রুপের হাসি, কিন্তু মহামান্য ডিশিংওয়ের মুণ্ডুটা তাহলে আমার দেয়ালে ঝুলছে কেন? বলো?

সমবেত জনতা স্তব্ধ নির্বাক। ডিশিংওয়ে রাজার প্রিয় বন্ধু। তাকে হত্যা করেছে নজমবাজী এবং রাজার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথা জানিয়ে বিদ্রূপ করতে সে ভয় পায় না–কী স্পর্ধা!

শকা গম্ভীর স্বরে বললেন, ওই মানুষটির মৃত্যু নিয়ে উপহাস করে তুমি খুব বুদ্ধির পরিচয় দাওনি। ডিশিংওয়ে ছিল ভালো মানুষ সে তোমার স্বামী জোয়েদি ও তোমার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিল, তাই তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হল প্রাণ দিয়ে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। হায়নার মতো নিকৃষ্ট জীবকে যদি কেউ ভালোবাসে, বিশ্বাস করে তবে সেই হায়নার আক্রমণেই হতভাগ্যের মৃত্যু নিশ্চিত; তোমরাও হায়নার চাইতে উন্নত ধরনের জীব নও… ভালো কথা, নজমবাজী–শুনেছি হায়নাগুলি ডাকিনীদের অনুচর, ওরা নাকি ডাকিনীর আদেশ পালন করে ভৃত্যের মতো–কথাটা কি সত্যি?

–নিশ্চয়, সত্যি বই কী!

নজমবাজী ভাবল, ওই উত্তর শুনেই রাজা ঘাবড়ে যাবে।

জুলুরা সাহসী জাতি, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভয় পায় না কিন্তু ভৌতিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা, অশেষ ভীতি!

কিন্তু রাজা শকা অন্য ধরনের মানুষ, স্থির দৃষ্টিতে নজমবাজীর দিকে তাকিয়ে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি তো ডাইনি–তাহলে বনের হায়নারা তোমার অনুচর? তারা তোমার কথা শুনবে?

দৃঢ়স্বরে নজমবাজী বললে, শুনবে। সব কথা শুনবে।

 বাঃ! বাঃ! খুব ভালো কথা, শান্ত স্বরে বললেন শকা, খুব ভালো! খুব ভালো! তাহলে তুমি তোমার কুটিরে ফিরে যাও। নরমুণ্ড সাজিয়ে যেখানে তুমি ক্ষমতার অধিশ্বরী হয়েছ, সেখানেই তুমি নিশ্চিন্তে বাস করো। আমার দেহরক্ষীরা তোমাকে খাদ্য ও পানীয় দিয়ে আসবে। একা একা তোমার খারাপ লাগতে পারে, তাই তোমাকে একটি উপযুক্ত সঙ্গীও দেওয়া হবে। আমার ভৃত্যরা কখনো তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, তবে

-তবে?

–তবে তোমার সঙ্গীর জন্য কোনো আহার্য বা পানীয় দেওয়া হবে না। তার খাদ্যের ব্যবস্থা সে নিজেই করে নেবে।

নজমবাজী অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। রাজা কথা কইছেন খুব শান্তভাবে, কিন্তু সেই শীতল শান্ত স্বরে যেন এক ভয়াবহ ইঙ্গিত!

 নজমবাজী প্রশ্ন করলে, তাহলে, তাহলে আমার শাস্তির কী ব্যবস্থা হল?

মৃদুকণ্ঠে উত্তর এল, যথাসময়ে তুমি জানতে পারবে…

.

নজমবাজীর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল কুটিরের দরজা। হঠাৎ আলো থেকে অন্ধকারের মধ্যে এসে পড়লে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলে তার দৃষ্টিশক্তি নজমবাজীরও সেই অবস্থা হল।

বদ্ধদ্বার কুটিরের অন্ধকার তার চক্ষুকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দিল বটে, কিন্তু নাসিকার ঘ্রাণশক্তি অন্ধকারের কাছে পরাজিত হল না–একটা তীব্র দুর্গন্ধ তার নাকে এসে ধাক্কা মারল! পশুর গায়ের গন্ধ!

নজমবাজী সাহসী মেয়ে। কিন্তু এইবার সে ভয় পেল। যে অজানা জীবটা ঘরের মধ্যে রয়েছে। তার জান্তব চক্ষু নিশ্চয়ই অন্ধকারের মধ্যেও সব কিছু দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু নজমবাজীর দৃষ্টিশক্তি এখনও আঁধারের যবনিকা ভেদ করে তাকে আবিষ্কার করতে পারছে না–ভয়ের কথা বই কী!

পাথরের মূর্তির মতো বদ্ধ দরজায় সে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল… নিশ্চল, নীরব…

 কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল রমণীর দৃষ্টিশক্তি, আর তখনই তার নজরে পড়ল কুটিরের শেষপ্রান্তে প্রায় বিশগজ দূরে মিট মিট করে জ্বলছে একজোড়া অগ্নিময় চক্ষু! তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তনাদ, কী! কী! কী ওটা?

কুটিরের বাইরে ঘন ঘাসের আবরণ সরিয়ে প্রহরীরা জানতে চাইল কী হয়েছে। ভীত ত্রস্তস্বরে নজমবাজী বার বার প্রশ্ন করলে, কী আছে? কী আছে ঘরের মধ্যে? দপ দপ করে ওই যে জ্বলছে আর জ্বলছে–ও দুটো কার চোখ?

প্রহরীরা সবিনয়ে জানিয়ে দিল কুটিরের মধ্যে একমাত্র নজমবাজী ছাড়া অন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা সচেতন নয়।

কথা বলার সময়ে প্রহরীরা কুটিরের দেয়াল থেকে ঘাসের আবরণ সরিয়ে দিয়েছিল। সেই ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো কিছুটা এসে পড়ল অন্ধকার কুটিরের মধ্যে। আবছা আলো-আঁধারিতে এবার নজমবাজীর দৃষ্টিপথে ধরা পড়ল একজোড়া জ্বলন্ত চোখের নীচে একজোড়া বীভৎস চোয়াল!

দুই চোখের তীব্র দৃষ্টি সঞ্চালন করলে রমণী–অস্পষ্ট আলোছায়ার মধ্যে দেখা গেল লালা গড়িয়ে পড়তে পড়তে ফঁক হয়ে গেল সেই চোয়াল দুটি ঝক ঝক করে উঠল দুই চোয়ালের ফাঁকে অনেকগুলো তীক্ষ্ণধার দন্ত!

হায়না!

একটা পুরুষ হায়না!

আবার আর্তনাদ করে উঠল নজমবাজী, আবার ছুটে এল প্রহরীরা, সাগ্রহে জানতে চাইল বন্দিনীর ভয়ের কারণটা কী!

আলো, আলো, আরও আলো চেঁচিয়ে উঠল নজমবাজী।

আপনার আদেশ নিশ্চয়ই পালিত হবে, উত্তর এল সসম্ভ্রমে। ছোটো ছোটো জানলাগুলোর উপর ছিল শুষ্ক ঘাসের আবরণ, প্রহরীরা সেগুলো সরিয়ে দিল…

নেমে এল রাতের কালো যবনিকা। নজমবাজীর কুটিরের বাইরে এসে দাঁড়াল আরও কয়েকজন প্রহরী। জানলার ফাঁক দিয়ে বন্দিনিকে আহার্য ও পানীয় সরবরাহ করা হল–প্রচুর মাংসের গ্রিল আর উৎকৃষ্ট বিয়ার জাতীয় সুরা।

পানাহারের রাজকীয় ব্যবস্থা দেখে খুশি হল না বলিনি আসন্ন রাত্রির অন্ধকারের ভয়ে সে বিচলিত। নজমবাজীর ভীতি অমূলক নয়, ঘন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে জন্তুটা তাকে আক্রমণ করতে পারে।

নজমবাজী আগুন চাইল, কিন্তু এইবার তার অনুরোধ রক্ষিত হল না। প্রহরী সবিনয়ে জানাল আগুন দেওয়া সম্ভব নয়–রাজার নিষেধ।

প্রকৃতির কোলে মানুষ হয়েছে বনবালা নজমবাজী, হায়নার স্বভাবচরিত্র তার অজানা নয়। সে জানত হায়না ভীরু জানোয়ার–যতক্ষণ জন্তুটা ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারবে ততক্ষণ সে আক্রমণ করবে না, কিন্তু শূন্য উদরে যখন ক্ষুধার দংশন অসহ্য হয়ে উঠবে তখনই মানুষের মাংসের লোভে ঝাঁপিয়ে পড়বে ক্ষুধার্ত শ্বাপদ

অন্ধকারের মধ্যে নিরস্ত্র অবস্থায় হায়নার হিংস্র আক্রমণ রোধ করা মেয়েটির পক্ষে অসম্ভব।

নজমবাজী বুঝল হায়নাকে নিজের খাদ্য থেকে কিছু কিছু অংশ যদি দেওয়া যায়, তাহলে জন্তুটা তাকে সহজে আক্রমণ করবে না–একটুকরো মাংস নিয়ে সে ছুঁড়ে ফেলল হায়নার দিকে। হায়না একটুও দেরি করলে না। টপ করে মাংসের টুকরোটা চেপে ধরল দুই চোয়ালের ফকে–কঠিন দন্তের সংঘর্ষে শব্দ উঠল খটাস!

শিউরে উঠল নজমবাজী।

আর তৎক্ষণাৎ বাতায়ন পথে ভেসে এল প্রহরীর কণ্ঠস্বর, ওকে খাদ্য দেওয়ার হুকুম নেই। আপনি যদি আদেশ অমান্য করেন তবে আপনাকেও ভবিষ্যতে আর খাবার দেওয়া হবে না।

নজমবাজী বুঝল প্রহরীর কথা না-শুনলে উপবাস অনিবার্য। অনাহারে দুর্বল হয়ে পড়লে আরও বিপদ–সে মাংসের টুকরোগুলিতে মনোনিবেশ করলে। খাওয়ার পর আকণ্ঠ সুরাপান করলে সে। গুরু ভোজনের পর সুরার প্রভাব তার চোখে এনে দিল নিদ্রার আবেশ। কিন্তু নজমবাজী জানত অন্ধকার কুটিরের মধ্যে ক্ষুধার্ত হায়নার সামনে ঘুমিয়ে পড়লে সেই ঘুম আর ভাঙবে না কোনোদিন–

রমণী প্রাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করতে লাগল…

হঠাৎ তার মনে পড়ল শুধুমাত্র হাড় চিবিয়ে হায়না ক্ষুধানিবৃত্তি করতে পারে। মাংসাশী পশুদের মধ্যে হায়নাই একমাত্র জীব যে মাংসহীন অস্থি থেকে খাদ্যরস সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখে। কুটিরের দেয়াল থেকে নজমবাজী একটু নরমুণ্ড নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। একটু পরেই কুটিরের মধ্যে জাগল এক ভয়াবহ শব্দের তরঙ্গ–কটমট! কটমট! কটমট!

কঠিন শ্বদন্তের নিষ্পেষণে ভেঙে যাচ্ছে অস্থিসার নরমুণ্ড!

ভয়ে ভয়ে জেগে রইল নজমবাজী, একবারও সে চোখ বন্ধ করলে না। হায়না অবশ্য একবারও আক্রমণের চেষ্টা করেনি, শুকনো হাড় চিবিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকল। ভোররাতের দিকে চক চক করে জলপানের আওয়াজ শোনা গেল–কুটিরের একধারে যে কাঠের গামলাতে জল ছিল সেইখানে এসে জন্তুটা তৃষ্ণা নিবারণ করছে…

একটা দিন কাটল। দুপুর এগারোটার সময়ে প্রহরী নিয়ে এল মাংস ও সুরা। নজমবাজী যখন বড়ো বড়ো মাংসের টুকরো চিবিয়ে খেতে শুরু করলে, তখন হায়না হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।

মাংসের গন্ধ তার নাকে গেছে

 মুখ তুলে সে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল সশব্দে!

নজমবাজী কয়েকটা নরমুণ্ড দেয়াল থেকে তুলে নিল। এবার সে মুণ্ডগুলি নিক্ষেপ করতে লাগল জন্তুটাকে লক্ষ করে। বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটির নেশা চড়ে গেল।

সে চিৎকার করে হায়নার দিকে ধেয়ে গেল। জন্তুটা ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করলে। কুটিরের চারপাশে হায়না তাড়িয়ে ছুটতে লাগল নজমবাজী এবং একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমের জন্য প্রস্তুত হল। শুষ্ক করোটিগুলিতে মেয়েটি মাংসের ঝোল মাখিয়ে দিয়েছিল, এমন লোভনীয় খাদ্য ফেলে হায়না নিশ্চয়ই আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়বে না–এই ছিল তার আশা…।

সূর্য অস্ত গেল। প্রহরীরা খাদ্য নিয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল। একটি লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে বসল নজমবাজী। এবার কিন্তু খুব বেশি খাদ্যগ্রহণ করলে না সে, সুরাপান করল খুব অল্প পরিমাণে–তারপর প্রস্তুত হল রাত্রি জাগরণের জন্য।

রাত কাটল। শুষ্ক অস্থিসার নরমুণ্ড ভোজন করলে হায়না। বিনিদ্র চোখে জেগে রইল নজমবাজী। মাঝে মাঝে মেয়েটি চিৎকার করে উঠছিল, কিন্তু হায়না সম্পূর্ণ নীরব–শুধু নিক্ষিপ্ত কঙ্কাল-করোটির ওপর তার দাঁতের বাজনা বেজেছিল কড়মড় শব্দে…

পরের দিনটাও কেটে গেল এবং পার হয়ে গেল আরও একটি রাত। তার পরের দিন সকালবেলা খুব বেশি পরিমাণেই মাংস ভোজন করলে নজমবাজী, তারপর প্রচুর সুরাপান করে নিদ্রাকাতর দেহে লম্ববান হল মাটির ওপর।

সূর্য অস্ত গেল। নজমবাজীর ঘুম ভাঙল না। কুটিরের মধ্যে ঘন হয়ে এল অন্ধকার। নজমবাজী তখনও গভীর নিদ্রায় মগ্ন…

অসহ্য যাতনায় আর্তনাদ করে জেগে উঠল নজমবাজী! এক লাফে শিকারের সামনে থেকে সরে গেল হায়না, তার মুখ থেকে ঝুলছে শ্রীমতী নজমবাজীর একটি পদপল্লবের অর্ধেক অংশ!

আহত রমণী চিৎকার করে প্রহরীকে ডাকল। প্রহরী সাড়া দিতেই সে জানাল একটা গাছের ছালের ব্যান্ডেজ, কিছু মাকড়সার জাল আর জোই জাতীয় গাছের পাতা তার এখনই দরকার।

প্রহরী তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে ফিরে এল। নজমবাজী যা যা চেয়েছিল সব কিছুই তাকে দেওয়া হল, উপরন্তু সে পেল একটি ধারালো বর্শা। প্রহরী জানাল তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে মহারাজ শকা বল্লমটা তাকে উপহার দিয়েছেন।

অস্ত্র হাতে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠল মেয়েটি। রক্তাক্ত পা-টিকে সে ভালোভাবে বাঁধল, তারপর প্রহরীর কাছে খাদ্য চাইল। অন্যদিনের মতো আজ সে পরিমিত পানাহার করলে না প্রচুর পরিমাণে মাংস উদরস্থ করে সে বিয়ারের পাত্রে চুমুক দিল। আকণ্ঠ মদ্যপান করে সে সোজা হয়ে বসল, তারপর হুকুম করল কুটিরের বাইরে যেন আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়।

অনুরোধ রক্ষিত হল। কুটিরের পাশ থেকে ঘাসের আবরণ সযত্নে আরও কিছুটা সরিয়ে নিল প্রহরী, ফলে বাইরের জ্বলন্ত আগুনের আলোতে কুটিরের আঁধার মাখা অন্তঃপুরে জাগল অস্পষ্ট আলোর বাতাস…

নজমবাজী আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আচম্বিতে সে অনুভব করলে তার আহত পায়ের ওপর তীক্ষ্ণ দন্তের করাল স্পর্শ। হাতের বল্লম তুলে ধরার আগেই মেয়েটির পায়ের ডিম থেকে এক কামড়ে খানিকটা মাংস তুলে নিয়ে সরে গেল হায়না!

ঘরের মধ্যে তখন বিরাজ করছে নিরেট অন্ধকার। বাইরে আর আগুন জ্বলছে না। নজমবাজী চিৎকার করে প্রহরীদের আগুন জ্বালাতে বললে। আদেশ পালিত হল তৎক্ষণাৎ।

জানলার ফাঁকে ফাঁকে জ্বলন্ত মশালের আলোতে নজমবাজী তার ক্ষতবিক্ষত পা-টিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, তারপর ব্যান্ডেজ বাঁধল খুব নিপুণ হাতে। তখন তার চলার ক্ষমতা আর ছিল না, এক হাতে বর্শা উঁচিয়ে কোনোমতে সে হায়নাটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে। খুব সহজেই উদ্যত বর্শাটাকে এড়িয়ে সরে গেল হায়না। শ্রান্ত অবসন্ন দেহে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে পড়ল নজমবাজী।

তার পায়ের ক্ষত থেকে বেশ কিছু রক্ত ঝরে এক জায়গায় মাটির ওপর জমেছিল। হায়নাটা সেই রক্ত পান করল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নজমবাজীর মুখের ওপর ক্ষুধিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। বর্শার খোঁচা মারার উপায় ছিল না, জন্তুটা ভারি শয়তান, উদ্যত বর্শার নাগালের মধ্যে একবারও পা বাড়াল সে কেবল তার দুই জ্বলন্ত চক্ষুর নির্নিমেষ দৃষ্টি ক্ষুধার্ত আগ্রহে লেহন করতে লাগল রমণীর সর্বাঙ্গ..

অকস্মাৎ অন্ধকার রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কুটিরের মধ্যে জাগল এক ভয়াবহ অট্টহাস্য হা! হা! হা! হা!

হায়নার হাসি! কুটিরের মধ্যে নজমবাজীর অঙ্গে অঙ্গে ছুটে গেল আতঙ্কের বিদ্যুৎপ্রবাহ! এমনকী কুটিরের বাইরে মহারাজের নির্ভীক প্রহরীর মাথার চুলও আতঙ্কে খাড়া হয়ে উঠল! জুলু সৈনিক হাতে অস্ত্র থাকলে কারুকে ভয় পায় না, কিন্তু সেই জান্তব অট্টহাস্য তাদের অন্তরেও ভীতির সঞ্চার করলে।

হি! হি! হি! হি! কুটিরের ভিতর থেকে জাগল এবার নারীকণ্ঠে তীব্র হাস্যধ্বনি!

স্নায়ুর ওপর এতখানি চাপ সহ্য করতে পারল না নজমবাজী, সে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ল…

অতর্কিত আক্রমণ করলে হায়না। বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মেয়েটির পায়ে কামড় বসাল।

সজোরে বর্শা চালনা করল নজমবাজী। সাঁৎ করে সরে গিয়ে জন্তুটা আত্মরক্ষা করলে এবং মেয়েটি সাবধান হওয়ার আগেই দুই চোয়ালের বর্জ-দংশনে চেপে ধরলে বর্শাফলক–

পরক্ষণেই এক টান মেরে হায়না অস্ত্র ছিনিয়ে নিল। নজমবাজী বুঝল নিরস্ত্র অবস্থায় আর সে আত্মরক্ষা করতে পারবে না, মৃত্যু তার নিশ্চিত। সে তার আর্তনাদ করলে না, দৃঢ় স্বরে হাঁক দিল, প্রহরী!

উত্তর এল, আদেশ করুন।

–আমি আর একে ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না। শয়তানটা এখনই আমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। রাজাকে জানিয়ো নজমবাজী জীবনে কখনো কাঁদেনি। আজও সে হাসিমুখে মরতে চায়। আমার অন্তিম অনুরোধ এই কুটিরে যেন আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। শত্রুকে যদি পুড়ে মরতে দেখি তাহলে আমিও হাসতে হাসতে মরতে পারব। যাও প্রহরী, তাড়াতাড়ি যাও।

রাজার অনুমতি আনতে একটু দেরি হল। ওই সময়ের মধ্যেই বার বার আক্রমণ চালিয়েছে হায়না। কোনোমতে দুই হাত দিয়ে জন্তুটার আক্রমণ ঠেকিয়েছেনজমবাজী। হায়নার নিষ্ঠুর দাঁত তার শরীরের মারাত্মক স্থানগুলিকে স্পর্শ করতে পারেনি বটে, কিন্তু রাজার আদেশ নিয়ে প্রহরী যখন ফিরে এল তখন হতভাগিনী মেয়েটির দুখানি পায়ের বেশির ভাগ অংশই হায়নার উদরস্থ হয়েছে।

হায়না বুঝেছে তার শিকার দুর্বল হয়ে পড়েছে। হিংস্র দন্ত বিস্তার করে সে আবার আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কুটিরের শুষ্ক আবরণ ভেদ করে উঁকি দিল জ্বলন্ত অগ্নিশিখা!

নজমবাজীর প্রার্থনা পূরণ করেছেন রাজা, প্রহরীরা আগুন লাগিয়েছে কুটিরে…।

দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন, সভয়ে আর্তনাদ করে উঠল হায়না, কুটিরের অভ্যন্তরে জাগল নারীকণ্ঠে তীব্র হাস্যধ্বনি–হি! হি! হি! হি!

কুটিরের ছাতের ওপর, দেয়ালের ওপর সগর্জনে লাফিয়ে উঠল শত শত লেলিহান অগ্নিশিখা–প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ল ছাত। অগ্নিদেবের জ্বলন্ত আলিঙ্গনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল শ্বাপদ ও রমণী…

নজমবাজীকে কেউ প্রশংসা করবে না।

বহু মানুষকে সে হত্যা করেছিল; বাঘিনীর মতো হিংসা-কুটিল তার স্বভাব, বাঘিনীর মতোই সে ভয়ংকরী অপরাধের যোগ্য শাস্তি পেয়েছে সে।

কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় সে দিয়েছিল তার জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মহারাজ শকা–বাঘিনীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি।

ওই সম্মান তার প্রাপ্য।

 বাঘিনীর প্রাপ্য।

[ফাল্গুন ১৩৭৫]